Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বেগম মেরী বিশ্বাস || Bimal Mitra » Page 19

বেগম মেরী বিশ্বাস || Bimal Mitra

চেহেতুন আবার বহুদিন পরে সাজানো-গোছানো হচ্ছে। সন্ধেবেলা দরবার বসবে। মুর্শিদাবাদের তাবৎ আমির-ওমরাও আসবে দরবারে। ফিরিঙ্গি কোম্পানির ক্লাইভ সাহেব এসে ওই মসনদে বসবে। জগৎশেঠজি আসবে, ইয়ার লুৎফ খা আসবে, রাজা দুর্লভরাম আসবে, মিরজাফর সাহেব আসবে, মিরন সাহেব আসবে, মেহেদি নেসার, মনসুর আলি মোহর আসবে, মিরদাউদ, রেজা আলি ডিহিদার, মিরকাশিম সাহেব আসবে।

ইনসাফ মিঞা আবার নহবত নিয়ে বসেছে।

ছোটে শাগরেদ বললে–ওস্তাদজি, কোন রাগ বাজাব?

ইনসাফ মিঞার যেন আর নহবত বাজাবার মেজাজ নেই। আর যেন নহবতে ফুঁ দিতে ইচ্ছে করছে না। বললে–কী বাজাব?

ছোটে শাগরেদ বললে–আলিবর্দি সাহেব যেবার মসনদে বসেছিল, সেবার যেটা বাজিয়েছিলে, সেই রাগটা বাজাও

ওদিকে মতিঝিলের পেছন দিকে গঙ্গা যেখানে বেঁকে গেছে সেইখানে ছ’টা বজরা সার সার দাঁড়িয়ে ছিল। মতিঝিলের খিড়কির ফটক দিয়ে বোরখা-পরা এক-একটা মূর্তি বেরিয়ে এল খোলা আকাশের নীচে। তরতর করে বয়ে চলেছে গঙ্গার স্রোত। স্রোতের টানে ছলাত-ছলাত করে জল চলকে উঠছে বজরাগুলোর গায়ে লেগে। এক-একজন বেগম এক-একটা বজরায় গিয়ে উঠল।

পাশে দাঁড়িয়ে ছিল মিরন সাহেবের লোক। আর খানিক দূরে তদারক করছিল মিরন সাহেব নিজে। মনে মনে হিসেব ঠিক রাখছিল।

নানিবেগম!

ঘসেটি বেগম!

আমিনা বেগম।

ময়মানা বেগম।

লুৎফুন্নিসা বেগম!

সকলের শেষে আর এক জোড়া আড়ষ্ট পা দেখা গেল। মিরন ভাল করে লক্ষ করে দেখলেহ্যাঁ, যার ওপর ফিরিঙ্গিবাচ্চা ক্লাইভের এত নেকনজর, সেই মরিয়ম বেগম। সেই মরিয়ম বেগমও জাহাঙ্গিরাবাদে চলে গেল।

মুর্শিদাবাদের সেই দিনটা, সেই তারিখটা, সেই তিথিটা, সে বড় ভয়ংকর। যারা একদিন সূর্যের মুখ দেখলে আইনভঙ্গ হত, যারা চেহেল সুতুনের অন্ধকার ভুলভুলাইয়ার ধাঁধায় নবাবের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে ইচ্ছে করে হারিয়ে যেত, তারাই আবার সেদিন প্রখর সূর্যের আলোর তলায় চিরকালের মতো আইন ভাঙল, চিরকালের মতো উদ্ধব দাসের মতো তুলোট কাগজের পুঁথির পাতায় হারিয়ে গেল৷

তাই মনে হয় উদ্ধব দাস বুঝি সবই দেখেছে। যা নিজের চোখে দেখেনি তাও দেখেছে, যা মেরী বিশ্বাসের কাছ থেকে শুনেছে তাও দেখেছে। তার দেখা আর শোনার ব্যবধান ঘুচিয়ে সে এক মহাকাব্য লিখে গিয়েছে।

সত্যিই হারিয়ে গেল তারা সেই সেদিনকার মুর্শিদাবাদের মানুষগুলো। হারিয়ে গিয়ে বেগম মেরী বিশ্বাসের পাতায় পুঁথি হয়ে রইল। কোথায়ই বা রইল সেই চেহেতুন যেখানে কর্নেল ক্লাইভ মিরজাফরের হাত থেকে এক-একটা করে এগারোটা বেগম নজরানা নিলে। কোথায় রইল সেইমনসুরগঞ্জ, সেই নিমকহারামের দেউড়ি, যেখানে ক্লাইভ সাহেব তার সেপাই বরকন্দাজ নিয়ে সেদিন এসে উঠেছিল।

ক্লাইভ সাহেব বলেছিল–চলল, তোমার বউয়ের সঙ্গে তোমার দেখা করিয়ে দিই পোয়েট!

উদ্ধব দাস বলেছিল–কিন্তু প্রভ, বউ যদি আমার সঙ্গে সেবারের মতো দেখা না করে?

কিন্তু তুমি কী দোষ করেছ বলোত পোয়েট?

উদ্ধব দাস বলেছিল–দোষগুণ তো মনের ভুল প্রভু, আমার কাছে যা গুণ আপনার কাছে তো তা দোষ হতে পারে। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের নাম শুনেছেন প্রভু?

সে কে?

সেও একজন কবি প্রভু, সে লিখেছে–দোষ হইয়া গুণ হইল বিদ্যার বিদ্যায়। তাই তো বলি, দোষও কখনও গুণ হয় প্রভু, আবার গুণও কখনও কখনও দোষ হয়। মানুষের আদালত বড় বিচিত্র স্থান, কোনও নিয়মের ঠিক-ঠিকানা নেই সেখানে।

ক্লাইভ অবাক হয়ে গেল–তুমি এত কথা জানলে কী করে পোয়েট?

হরির কাছে প্রভু, হরিই আমায় সব জানিয়ে দেয়।

হরি? হরি কে? তোমার গড?

আমি যে ভক্ত হরিদাস প্রভু!

তার মানে?

আমি মানুষের মধ্যেই হরিকে দেখি, তাই তো আমার কোটি কোটি হরি প্রভু। আপনার মধ্যেও আমি হরিকে দেখি, আমার বউয়ের মধ্যেও আমি হরিকে দেখি। হরিকে খুঁজতে আমাকে তাই অরণ্যে যেতে হয় না প্রভু। আমার হরি লোকালয়েই থাকে

তা তোমার বউ যে তোমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে তাতে তোমার দুঃখ হয় না? আমার বউ যদি অমনি করে আমাকে তাড়িয়ে দিত তো আমি তো তাকে ডিভোর্স করতাম।

উদ্ধব দাস বললেহরি যদি আমাকে ত্যাগ করে তো আমি কি হরিকে ত্যাগ করতে পারি প্রভু? আমাকে তো লোকালয়ের সবাই ত্যাগ করেছে, কিন্তু আমি কি লোকালয় ত্যাগ করতে পেরেছি? আমি তো এই লোকালয়েই ঘুরে বেড়াই। কখনও আসি মুর্শিদাবাদে, কখনও মোল্লাহাটিতে, কখনও যাই কেষ্টনগরে, আবার কখনও হাতিয়াগড়ে

আচ্ছা, একটা কথা সত্যি বলবে?

সত্য বই মিথ্যা তো বলি না কখনও প্রভু।

তা হলে বলো তো, তোমার বউয়ের নাম কি মরালীবালা দাসী?

হ্যাঁ প্রভু, আপনি সঠিক বলেছেন।

কিন্তু তুমি কি জানো তোমার বউ এখন কোথায়?

না প্রভু, আমার জানবার আগ্রহ নেই।

তুমি কি তোমার বউকে দেখতে চাও?

প্রভু, আমি তো কাউকে ত্যাগ করিনি, বউই আমাকে ত্যাগ করেছে।

তা হলে তোমাকে বলি পোয়েট, তোমার বউ এখানেই আছে!

এই মুর্শিদাবাদে?

হ্যাঁ পোয়েট। আমার নিজের এখন সময় নেই। আমার অনেক ভাবনা মাথার ওপর, আমার নিজের শরীরও খারাপ পোয়েট। লোকে জানে আমি মস্ত বড় বীর, লোকে জানে আমি কোম্পানির কর্নেল, কিন্তু তারা জানে না আমার মতো কাওয়ার্ড আর দুটি নেই, তারা জানে না আমি ঘুমোতে ঘুমোতে ভয় পেয়ে জেগে উঠি–

উদ্ধব দাস বললে–কেন প্রভু, আপনার ভয় কীসের?

সাকসেসের ভয়, পোয়েট। এই অল্প কমাসের মধ্যে তিনটে দেশ জয় করেছি, এ কি সামান্য কথা পোয়েট? ক’জন কর্নেল এ করতে পেরেছে? আজ মিরজাফরসাহেব, মিরনসাহেব, জগৎশেঠজি, সবাই আমাকে এসে ফ্ল্যাটারি করছে, যেন ওদের চেয়ে আমি অনেক বড়। অথচ পোয়েট, আমি নিজে জানি আমি তোমার মতো গরিব, তোমার মতো সাধারণ; ওরা জানে না, যে এতগুলো দেশ জয় করলে, সে আমি নই, আমার ভূত।

বলছে কী প্রভু? ভূত?

হ্যাঁ পোয়েট, সেই ভূতটা মাঝে মাঝে আমার ঘরে ঢোকে, আমি যখন রাত্রে ঘুমোই তখন আমার ঘরে ঢোকে, আমাকে ভয় দেখায়, একটা তাস নিয়ে আমাকে দেখায়, কুইন অব স্পেস, যাকে তোমরা বলো ইস্কাবনের বিবি

ইস্কাবনের বিবি? কেন প্রভু?

হ্যাঁ, তোমার যদি সাকসেস হত পোয়েট তো তোমাকেও সেই ভূতটা ভয় দেখাত, তোমারও অসুখ করত। আমার মতো তোমাকেও ওষুধ খেতে হত

কেন প্রভু?

সে তুমি বুঝবে না পোয়েট! যার সাকসেস হয় তার ঘুম হয় না, তাকে ওষুধ খেতে হয়। তোমার বউ একদিন দেখেছে, একদিন আমাকে ওষুধ খাইয়েছে নিজের হাতে। সেই ওষুধ একটু বেশি মাত্রায় দিয়ে আমাকে সে মেরে ফেলতে পারত, কিন্তু তা সে করেনি। সেই জন্যেই তাকে আমি আমার কাছে রেখেছি, আর সেই জন্যেই আমি তোমাকে আমার কাছে ডেকে পাঠিয়েছি

উদ্ধব দাস চুপ করে বসে সব শুনছিল। বললে–তা আমাকে কী করতে হবে প্রভু?

তুমি আমার সঙ্গে চলো। আমি তোমাকে তোমার বউয়ের কাছে নিয়ে যাব। আজকেই এখানে সব ফয়সালা হয়ে যাক। মুর্শিদাবাদের মসনদেরও ফয়সালা হবে

উদ্ধব দাস বললে–আমার কী ফয়সালা প্রভু করবেন?

তোমার বউয়ের সঙ্গে তোমার মিল করিয়ে দেব।

উদ্ধব দাস হেসে উঠল–আপনি পারবেন?

আমি কী না পেরেছি পোয়েট? আমি যেমন ভাঙতে পারি, তেমনি আবার যে জোড়া লাগাতেও পারি। এইটেই ইতিহাসে লেখা থাকুক। বহুদিন পরে যখন এই মুর্শিদাবাদ নিয়ে ইতিহাস লেখা হবে, তখন অন্তত লোকে জানবে, আমি শুধু ভিলেন ছিলাম না, জানবে আমি একজন মানুষও ছিলাম, আমারও দুঃখ, কষ্ট, ব্যথা, ভয় সবই ছিল–আমিও আর সকলের মতো হেসেছি, কেঁদেছি, ভালবেসেছি, ঘৃণা করেছি, ভয় পেয়েছি, ভয় পেয়েও বুক উঁচু করে আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছি

হঠাৎ দরজায় আওয়াজ হতেই ক্লাইভ চিৎকার করে উঠল–কে?

আমি হুজুর, আমি, হুজুরের শ্রীচরণের দাস, মুনশি নবকৃষ্ণ—

এখন নয় মুনশি, তুমি পরে দেখা কোরো।

উদ্ধব দাস বললে–ও লোকটা কে প্রভু? মাথায় মস্ত বড় টিকি রেখেছে

ক্লাইভ বললেও আর ওই উমিচাঁদ, ওরা সবাই টাকার দাস পোয়েট। ওরা আলাদা জাত, ওদের কাছে টাকাটাই সব, টাকার জন্যে ওরা আমার পেছনে পেছনে ঘোরে। সবসময় ওদের কাছে থাকতে ভাল লাগে না, সেই জন্যেই তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি, তুমি চলো তোমার বউয়ের সঙ্গে তোমার দেখা করিয়ে দিয়ে আসি

বলে ক্লাইভ উঠল। পোয়েটও উঠল সঙ্গে সঙ্গে।

মরালী যেদিন ময়দাপুর থেকে নৌকায় করে বেরিয়েছিল সেদিন স্বপ্নেও ভাবেনি যে, আবার তাকে সেই দুর্দিনের লগে মুর্শিদাবাদেই ফিরে আসতে হবে; স্বপ্নেও ভাবেনি যে, আবার ছোট বউরানির সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, কিংবা নবাব মির্জা মহম্মদের সঙ্গে অমন করে দেখা হয়ে যাবে।

নবাব মির্জা মহম্মদ শুধু একবার চাইলে মরালীর দিকে। কিন্তু মুখ দিয়ে কিছু কথা বেরোল না।

মরালী নবাবকে দেখেই বললে–এ কী আলি জাঁহা, এ কী হল?

লুৎফুন্নিসা বেগম নবাবের পায়ের ওপর মাথা দিয়ে শুয়ে পড়েছিল। বাঁদিটা একটু দূরে বসে আছে, তার কোলে লুৎফা বেগমের মেয়েটা ঘুমোচ্ছে।

মরালীকে দেখেই লুৎফা একটু নড়ে উঠল।

মরালী আবার বললে–এমন করে আপনার সঙ্গে দেখা হবে তা তো ভাবিনি আলি জাঁহা, আর এই অবস্থায়।

মির্জা মহম্মদ সেকথার উত্তর না দিয়ে শুধু বললে–তোমাকেও এরা ধরেছে মরিয়ম বেগমসাহেবা? তুমি কী দোষ করেছিলে?

আমার কথা ছেড়ে দিন আলি জাঁহা, কিন্তু আপনিই বা কী দোষ করেছিলেন?

মির্জা মহম্মদ বললে–আমার কথা বলছ? আমি কী দোষ করিনি তাই বলো আগে!

মরালী বললে–আমি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না আলি জাঁহা, আমি নিজে সাক্ষী আছি, আপনি কারও কোনও ক্ষতি করেননি তো

না মরিয়ম বেগমসাহেবা, আমি অনেক অপরাধ করেছি। সব তো তুমি জানো না।

কিন্তু এমন কী অপরাধ করেছেন যার জন্যে আপনার এই শাস্তি?

মির্জা মহম্মদ বললে–আমি যে সংসারে জন্মিয়েই মহা অপরাধ করেছি বেগমসাহেবা। নবাব যেদিন ফৌজদার হয়েছে সেদিন জন্মিয়েই যে আমি অপরাধ করেছি। নবাব যে মুর্শিদাবাদের মসনদ দিয়েই আমাকে অপরাধী করে গেছে–

কিন্তু এখন কী করবেন আলি জাঁহা?

মির্জা মহম্মদ বললে–তুমি নিজের কথা ভাবো মরিয়ম বেগমসাহেবা। আমি ভেবেছিলাম তোমাকে হাতিয়াগড়ের রাজার কাছে পাঠিয়ে দিয়ে তবে যাব। ভেবেছিলাম তো অনেক কিছুই বেগমসাহেবা। ভেবেছিলাম, ল’সাহেব আজিমাবাদ থেকে ফৌজ নিয়ে এসে আমার সঙ্গে যোগ দেবে, তারপর নতুন করে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখব, কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল আমার বেগমসাহেবা, এখন দেখছ তো আমার এই দুটো হাত বাঁধা ।

মরালী বললে–কিন্তু আপনাকে ওরা চিনতে পারলে কী করে?

সেকথা আর এখন ভেবে কী হবে বলো?

কিন্তু এখন কি আর ছাড়া পাবার আর কোনও উপায় নেই?

মির্জা মহম্মদ বললে–আমার জন্যে তোমাদের সকলের দুর্ভোগ, আমি কেবল সেই কথা ভাবছি বেগমসাহেবা!

শুধু আমি একলা নই আলি জাঁহা, আমার সঙ্গে হাতিয়াগড়ের আসল ছোট বউরানিও ধরা পড়েছে

তার মানে?

মির্জা মহম্মদ যেন চমকে উঠল–তার মানে? তুমি তা হলে হাতিয়াগড়ের আসল ছোট রানিবিবিনও?

না

তা হলে তুমি কে?

আমি তার বদলা! আমি হাতিয়াগড়ের রাজবাড়ির নফরের মেয়ে। তাকে বাঁচাবার জন্যেই আমি তার বদলা হয়ে এসেছিলাম চেহেল্‌-সুতুনে। আমার আসল রূপটা কেউ জানত না চেহেল্‌-সুতুনে। ভেবেছিলাম, তাকে আমি নবাবের ইয়ারবকশিদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতে পেরেছি, কিন্তু আজ দেখলুম তা পারিনি। আজ দেখলুম, আমার বদলা হওয়া মিথ্যে হয়ে গেছে

মির্জা মহম্মদ খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। ইতিহাসের এক মহা-সন্ধিক্ষণে সে যেন মহা সমস্যায় পড়েছে। এতগুলো মানুষ, এত বড় মুলুক, সকলের যেন সর্বনাশ ঘনিয়ে এসেছে তার নিজের সর্বনাশের সঙ্গে সঙ্গে।

একটু পরে বললে–কিন্তু কেন যে আমি মসনদ মসনদ করে এত পাগল হয়েছিলুম কে জানে; তখন কি জানতুম, এই মসনদে এত জ্বালা?

তারপর হঠাৎ মরিয়ম বেগমসাহেবার দিকে চেয়ে বললে–তুমি আমার একটা অনুরোধ রাখবে বেগমসাহেবা? তোমার ওই দুটো হাত দিয়ে আমার এই গলাটা টিপে ধরতে পারবে? এমনভাবে টিপে ধরবে যাতে আমার দম আটকে আসে, যাতে আমি আর নিশ্বাস ফেলতে না পারি?

মরালী বললে–ছি আলি জাঁহা, আপনি না মুর্শিদাবাদের নবাব?

মির্জা মহম্মদ বললে–তুমি আর আমাকে লজ্জা দিয়ো না বেগমসাহেবা, আমি আজ আমার ফৌজদারের কয়েদি, এতেও আমাকে লজ্জা দিতে তোমার লজ্জা হচ্ছে না?

কিন্তু তা হলে আপনার জন্যে কী করতে পারি বলুন আলি জাঁহা?

একদিন তুমি আমাকে একজনের গান শুনিয়েছিলে, মনে আছে? সেই কবি?

কবি? ছড়া লেখে?

মির্জা মহম্মদ বললে–না না, ছড়া লেখে না, সেই যে গান গেয়েছিলেন–মা গো আমার এই ভাবনা, আমি কোথায় ছিলাম কোথায় এলাম, কোথায় যাব নাই ঠিকানা

মরালী বললে–রামপ্রসাদ সেন!

মির্জা মহম্মদ বললে–হা বেগমসাহেবা, সেই তার কথাই আমার বারবার মনে পড়ছে কাল থেকে, ভাবছিলাম তার মসনদ তো কেউ কেড়ে নেয় না, তার মসনদ নিয়ে তো কই এত লড়াই মারামারি হয় না, তার মসনদের জন্যে তো তাকে হাতকড়া বেঁধে কেউ ধরে নিয়ে যায় না তাই তাকে একবার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল, তার গান একবার শুনতে ইচ্ছে করছিল

মরালী বললে–কিন্তু তার আর সময় নেই আলি জাঁহা, এখন অন্য কথা ভাবতে হবে। এখন কী করে আপনাকে ছাড়াতে পারি তাই ভাবছি

আমাকে ছাড়াতে পারবে, বেগমসাহেবা?

মরালী বললে–শুধু আপনাকে নয় আলি জাঁহা, হাতিয়াগড়ের রানিবিবিকেও কী করে মুক্তি দেওয়া যায় তাই ভাবছি

কী করে ছাড়াবে? যদি ছাড়াতে পারো তো আমার এই লুৎফা আর আমার এই ছোট মেয়েটাকেও ছাড়িয়ে দাও তুমি! আমার যা হয় হোক, ওদের জন্যে আমি ভাবছি

মরালী বললে–আমি সকলের কথাই ভাবছি আলি জাঁহা

লুৎফা নবাবের পায়ের কাছে এতক্ষণ চুপ করে শুয়ে ছিল, এবার মুখ তুলে বললে–না আলি জাঁহা, আপনি যেখানে থাকবেন আমি সেখানেই থাকব

মির্জা মহম্মদ রেগে গেল। বললে–তা আমি যদি জাহান্নমে যাই তো তুমিও জাহান্নমে যাবে?

লুৎফা উত্তর দিলে না সেকথার। নবাবের পায়ের ওপর মাথা গুঁজে আবার নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল।

মরালী বললে–তুমি কেঁদো না বহেন, আমি যতক্ষণ আছি, ততক্ষণ কোনও ভয় নেই—

মির্জা মহম্মদ হাসলে। বললে–বেগমসাহেবা, তুমি ওই মিরদাউদকে চেনো না, আর ওই মিরকাশিমকেও চেনো না, তাই ওই কথা বলছ

মরালী বললে–শয়তানকে কী করে বশে আনতে হয় তা আমি জানি আলি জাঁহা, নইলে শয়তান সফিউল্লাকে আমি খুন করতে পারি? আর যদি একটু সময় পেতাম তো ওই উমিচাঁদ আর মেহেদি নেসারকেও খুন করতুম, ওরা খুন হলে আর আজকে আপনার এই দুর্ভোগ হ্রত না

তারপর একটু থেমে বললে–তা হলে আমি এখন আসি আলি জাঁহা, দেখি কী করে হারামজাদাদের খুন করতে পারি।

সত্যিই তুমি ওদের খুন করতে পারবে বেগমসাহেবা? সত্যিই তুমি পারবে? আর যদি তা না পারো তো ওদেরও গিয়ে একটু বুঝিয়ে বলল, জীবনে কখনও আমি কারও পথে আর বাধা হয়ে দাঁড়ার না। যদি পারে আমাকে যেন একফালি জমি দেয়, আমি সেখানেই শেষ জীবনটা শান্তিতে কাটাব, আর কখনও কারও শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাতে আসব না। শুধু একফালি জমি–

মনে আছে, কথা বলতে বলতে সেদিননবার মির্জা মহম্মদের গলাটা বুজে এসেছিল। শুধু তানবাব নয়, রানিবিবির কথাও তো মনে ছিল মরালীর। যদি মুর্শিদাবাদে আসতেই হয় তো সকলের কথা ভেবেই আসতে হবে। একসঙ্গে সকলের ভাল করতেই চেয়েছিল মরালী। বাংলা মূলকের স্বার্থে না হোক, অন্তত চরম সর্বনাশ ঘটবার আগে কয়েকজনকে বাঁচাতে চেয়েছিল সে। সেদিন শুধু মনে হয়েছিল, এমন করে শেষ মুহূর্তে এমন সুযোগ তার হাতে আসবে কে জানত!

মনে মনে একবার বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের দেবতাকে উদ্দেশ করে বলেছিল আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করো ঠাকুর। একদিন সংসারের সব সাধ, সব ঐশ্বর্যের লোভ ছিল আমার। তুমি আমার সেই স্মৰ সাধে ছাই দিয়েছ। চিরকালের মতো তুমি আমার মুখ পুড়িয়ে দিয়েছ ঠাকুর। সবই যখন গেছে ঠাকুর, তখন অন্তত একটা সাধ আমার মেটাও, একটা সাধ মিটিয়ে আমার মেয়েমানুষ-জন্ম সার্থক করো!

ততক্ষণে বুঝি বাইরের আকাশে চাঁদ উঠেছে। বড় নিরিবিলি রাত। এইসব রাতেই বুঝি মানুষের পাপের সাপ ফণা উঁচু করে ফোঁসফোঁস করে। এসব রাত বড় ভয়ংকর। এইসব রাত্রেই অষ্টাদশ শতাব্দীর আমির-ওমরাওরা ষড়যন্ত্রের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে উত্থানের স্বপ্ন দেখত। আঙুরের মদে চুমুক দিয়ে বেহেস্তের বাস্তব ছবি কল্পনা করে নিত। এইসব রায়েই সুন্দরী মেয়েমানুষের দরকার হত। মেয়েমানুষের শরীরের খাঁজে খাঁজে রোমাঞ্চের খোরাক খুঁজত!

মিরদাউদ আর মিরকাশিম। ফৌজদার আর মিরবকশি! বড় ক্ষোভ ছিল দু’জনের বরাবর। অবহেলার ক্ষোভ, অশ্রদ্ধার ক্ষোভ, নেকনজরের ক্ষোভ। কাল সকাল থেকে রাজমহল থেকে বেরিয়েছে। তারপর মুর্শিদাবাদে যাবে। সেখানে নতুন নবব মিরজাফর সাহেবের পায়ে মির্জা মহম্মদকে ইনাম দিয়ে তারিফ পাবে। আর সেই তারিফের স্বপ্নেই সন্ধে থেকে দু’জনে মদ খেতে শুরু করে দিয়েছিল।

সেপাইরা বজরার পেছন দিকে রয়েছে। আর সামনের দিকে দু’জন। মাথার ওপর চাঁদ। ভিজে ভিজে হাওয়া। মদের গরমে নদীর ভিজে হাওয়া শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছিল। মরিয়ম বেগমসাহেবা নবাবের বজরার ভেতরে ঢোকার সময়েই দু’জনে লক্ষ করে দেখেছিল। বড় ভাজা, বড় খুবসুরত মনে হয়েছিল বেগমসাহেবাকে। যাক, ভেতরে যাক, নবাবের হাতে হাতকড়া বেঁধে দেওয়া আছে। বৃড় মুষড়ে পড়েছে নবাব। বড় কান্নাকাটি করছে। মদের নেশায় বড় ভাল লেগেছিল নবাবের আর্জি। হাহা করে হেসে উঠেছিল দু’জনেই। আরে, আমরা কী করব, আমরা তো নবারে নৌকর, যে যখন নবাব হরে আমরা তখন তারই হুকুম তামিল করব।

মিরকাশিম বললে–নবাব, নবাবের কী হবে?

মিরদাউদ বললে–কী আর হবে, ফাঁসি হবে—

ফাঁসি? ফাঁসি হলে কিন্তু খুব তামাশা হবে জনাব।

বলে আবার চুমুক দিলে মদের পেয়ালায়। ফাঁসি হলে কী রকম তামাশা হবে সেইটে যেন নেশার ঘোরে কল্পনা করতে ইচ্ছে হল মিরকাশিম সাহেবের।

হঠাৎ যেন সামনে ভূত দেখলে মিরকাশিম সাহেব। আরে, মরিয়ম সাহেবা যে সামনে এগিয়ে আসছে জনাব! বড়ি খুবসুরত আওরত তো

আইয়ে, আইয়ে বেগমসাহেবা!

মরালী দাঁতে দাঁত চেপে সামনে এগিয়ে আসতে লাগল। হে ঈশ্বর, একদিন অনেক দুঃখে, অনেক আঘাতে এই জগৎজোড়া শ্মশানের মধ্যে আমি পাপের পক্তি-ভোজে বসেছিলাম। সেদিন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আমি অনেক দেখলুম। অনেক ভুগলুম, অনেক সইলুম। হয়তো আরও অনেক দেখতে হবে ভুগতে হবে, সহ্য করতে হবে। কিন্তু আজকের মতো এমন সুযোগ হয়তো আর কখনও আসবে না। আজ তুমি আমার সমস্ত পাপ পবিত্র করে দাও ঠাকুর, আজ তুমি আমার সমস্ত কলঙ্ক নিশ্চিহ্ন করে দাও। আজ আমি তোমার নাম করেই শয়তানদের কাছে নিজেকে আহুতি দিই–

আরে, বড়ি খুবসুরত মাল জনাব!

নেশার ঘোরে ফৌজদার আর মিরবকশিতখন একাকার হয়ে গেছে। মেয়েমানুষের নাম-গন্ধই বুঝি এইরকম৷ সব একাকার করে দেয়।

মরালী শাড়িটাকে আলগা করে দিয়ে শরীর থেকে আঁচলটা খসিয়ে দিলে। বললে–অনেকক্ষণ সরাব খাইনি মেহেরবান, বড় তেষ্টা পেয়েছে–একটু দেবেন বাঁদিকে?

বলে মিরদাউদ সাহেবের গা ঘেঁষে বসল।

মিরকাশিম সাহেব সরে গিয়ে মরালীর কাছে এগিয়ে গেল। বললে–আমার দিকেও একটু নেকনজর দাও বিবিসাহেবা, আমি কী কসুর করলুম!

মরালী দু’জনের দিকেই দুটো হাত বাড়িয়ে দিলে। বললে–তোমার দু’জনে মদের পেয়ালা তুলে দাও জনাব, আমি দু’জনের হাত থেকেই চুমুক দেব

দু’দিক থেকে দু’জনে দুটো পেয়ালা নিয়ে মরালীর ঠোঁটের সামনে এগিয়ে দিয়ে খাওয়াতে চাইলে। কিন্তু দু’জনেরই তখন নেশার ঘোর। হাত কেঁপে ঠোঁটে ঠেকাতেই চলকে পড়ে গেল মরালীর মুখে বুকে সারা শরীরে।

মরালী খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ল।

তোমরা কী যে করো জনাব, মুখ তো আমার একটা, কাকে খুশি করি?

মিরকাশিমের বয়েস কম। সে একেবারে মরালীর গায়ের ওপর এসে বসল। বললে–আমাকে আগে আশরাফজাদি!

মিরদাউদই বা পেছিয়ে যাবে কেন। সেও গায়ে ঢলে পড়ে বললে–আমাকে আগে মেহবুবা

মজা দেখে মরালী হাহা করে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে গায়ের কাপড় খসে যেতে লাগল। মরালী যত আঁচল তুলে গায়ে ঢাকা দিতে চায় তত মিরদাউদ আর মিরকাশিম সাহেব তা টেনে নামিয়ে দেয়।

বড় আরাম হচ্ছে জনাব, বড় আরাম

মিরকাশিম সাহেবের রক্ত তখন মাথায় চড়ে গেছে। বললে–তোমার আরাম আমি আশমানে উঠিয়ে দেব আশরাফজাদি

তা হলে এক কাজ করো জনাব, এখানে আমার বড় লজ্জা করছে। বজরার ভেতরে নবাব রয়েছে, নবাবের জেনানা রয়েছে; ওদের হটিয়ে দাও।

নেশার যেমন মজাও আছে, তেমনি আবার একটা যন্ত্রণাও আছে। নেশার সময় সামনে সুন্দরী মেয়েমানুষ দেখতে পেলে মজার সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রণাটাও একটু যেন কমে যায়। যখন চোখে চাকরির উন্নতি জ্বলজ্বল করছে, তখন ফুর্তির নৌকো বাতাসে পাল তুলে দেয়। তখন মন বলে-কুছ পরোয়া নেই, সিরাজি পিলাও

মিরদাউদ সাহেবেরও তাই হয়েছিল। পেছনে যে সেপাইয়ের দল বন্দুক নিয়ে বজরা তিনটে পাহারা। দিচ্ছে তাদের কথা আর মনে পড়ল না। বজরার ভেতরে যে কয়েদি নবাব রয়েছে, তার বেগম, বাঁদি, লেড়কি রয়েছে, তাদের কথাও আর মনে পড়ল না।

বললে–নবাবকে হটাও—

নিরকাশিম সাহেব নেশার ঘোরে চেঁচিয়ে উঠল–নবাব কো নিকালো–নিকাল দো—

মিরদাউদ বললে–এসো আশরাফুজাদি, সিরাজি পিয়ো–

মরালী সঁতে দাতে চেপে ঠোঁটে মদের পেয়ালাটা ঠেকাল। তার মনে হল যেন একটা আগুনের ডেলা গলা দিয়ে নামতে নামতে একেবারে তলপেটে গিয়ে থামল।

তারপর শুরু হল লড়াই। শয়তানে-মানুষে নখে-াতে সেদিন সেই রাত্রির নিস্তব্ধতার আড়াল ছিঁড়েখুঁড়ে ছত্রখান হয়ে গেল। এতক্ষণ যারা আমিরের মুখোশ পরে আদবকায়দার ওড়নায় মুখ ঢেকে কথা বলছিল, এবার তাদের ভেতরকার আসল রূপ বেরিয়ে পড়ল। নখের আঁচড়ে আর দাঁতের কামড়ে মরালীর শরীরের নরম মাংসগুলো চিরকালের মতো দাগী হয়ে গেল।

মরালী একবার মুখ তুলে বলতে চেষ্টা করলে জনাব, তা হলে আমার নবাবকে তোমরা ছেড়ে দাও–আমাদের রানিবিবিকে ছেড়ে দাও

মিরদাউদ সাহেব তখন জানোয়ারের মতো কামড়ে ধরেছে মরালীকে। কথা বলবার আর উপায় নেই তার।

মরালী মিরকাশিম সাহেবের দিকে চেয়ে বলতে লাগল–তোমরা যে বললে–আমি তোমাদের সঙ্গে শুলে নবাবকে ছেড়ে দেবে, আমার রানিবিবিকে ছেড়ে দেবে?

মিরকাশিম সাহেব তখন লড়াইয়ের জন্য তৈরি করছে নিজেকে। আরও এক টোক মদ খেয়ে বললো– হ্যাঁ হ্যাঁ মেহবুবা, ছেড়ে দেব, কিন্তু তার আগে…

মরালী এবার কাঁদতে লাগল। বললে–কিন্তু কখন ছাড়বে? এখনই যে মুর্শিদাবাদ এসে যাবে আর যে সময় নেই।

চিল্লাও মাত আশরাফজাদি!

মানুষের ঈশ্বর বুঝি মানুষের দুর্যোগের দিনে মাঝে মাঝে এমনি করেই মুখ ফিরিয়ে থাকে। একদিন তাঞ্জামের মধ্যে চড়ে যখন রানিবিবি সেজে চেহেল্‌-সুতুনে এসেছিল মরালী, সেদিনও বুঝি এমন কাতর হয়ে ডাকেনি সেই মানুষের ঈশ্বরকে। সেই অভিমানে, সেই রাগেই বুঝি মুখ ফিরিয়ে রইল মানুষের ঈশ্বর! সেদিন তোমাকে ডাকিনি বলেই কি তুমি আজ এমন বিরূপ হলে ঠাকুর! হে ভয়ংকর, হে প্রলয়ংকর, আমার অন্তঃকরণের সমস্ত জাগ্রত শক্তির উদ্যত চেষ্টায় আমি যে আজ পাপ ধ্বংস করব বলে আত্মবলি দিচ্ছি। একে যদি পাপ বলো তো আমি পাপী, একে যদি কলঙ্ক বলো তো আমি। কলঙ্কিনী। তোমার উদ্যত কৃপাণের আঘাতে তুমি আমাকে টুকরো টুকরো করে দাও ঠাকুর, তবু আজ আমি এতটুকু প্রতিবাদ করব না। শুধু নবাবকে ছেড়ে দাও, আমার রানিবিবিকে ছেড়ে দাও। আমাকে নিয়ে তুমি ওদের মুক্তি দাও। ওদের মুক্তি হলেই যে আমি পরিত্রাণ পাব। ওদের শান্তি হলেই যে আমি মুক্তি পাব।

কই, ওগো আমার কথা রাখলে না তোমরা? আমাকে তোমরা ঠকালে?

দাঁত আর নখ তখন বোধহয় কামনায় উত্তাল উদ্দাম হয়ে উঠেছে। সুখে আর তখন তাদের সুখ নেই, টাকায় আর তখন তাদের আকাঙ্ক্ষা নেই। আলস্যে আর তখন তাদের বিশ্রাম নেই। তখন শুধু ভোগ। চুড়ান্ত ভোগের উপচার নিয়ে ভূরিভোজ তখন তাদের উত্তুঙ্গ হয়ে উঠেছে। ঈশ্বর সে তো ভাওতা, মোল্লাদের তৈরি ধোঁকা বেহেস্ত, সে তত বেবুদ, কোরানের তৈরি ইন্দ্রজাল। মেয়েমানুষই তখন একমাত্র সদাকত, মেয়েমানুষই তখন একমাত্র সচাই, মেয়েমানুষই তখন তাদের একমাত্র হক। আর সব কুছ ঝুটা হ্যায়।

ও-নৌকোর আড়াল থেকে দুর্গা বুঝি তখন হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যেও সব দেখতে পেলে।

বললে–ও ছোট বউরানি, দেখো দেখো, মরুনির কাণ্ডটা একবার দেখো

ছোট বউরানি দুর্গার কথায় রেগে গেল। বললে–কী দেখব আবার

দুর্গা বললে–কী ইল্পতে কাণ্ড দেখো মরুনির, চরিত্তিরটা একেবারে নষ্ট করে ফেলেছে গো–ছি ছি ছি–

কী, করেছে কী?

দুর্গা বললে–আর করবে কী, বলে গেল আমাদের জন্যে বলতে যাচ্ছে, আর ওখানে গিয়ে মদ গিলে কিনা বেলেল্লাগিরি করছে মরদগুলোর সঙ্গে

কই, কোথায়?

দুর্গা বললে–ওই দেখো না–ওই যে পাটাতনের ওপর ন্যাংটো হয়ে রয়েছে–

ছোট বউরানি দেখলে, দুর্গা দেখলো দেখলে আকাশ বাতাস অন্তরীক্ষ, আর দেখলে অতীত বর্তমান ভবিষ্যত, আরও দেখলে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগের সেই সন্ধিক্ষণের ইতিহাস। দেখলে আর ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে নিলে। বজরার উন্মুক্ত পাটাতনের ওপর তখন অসাড় অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে এক প্রাণলক্ষ্মী। বাংলা বিহার উড়িষ্যার সেই প্রাণলক্ষ্মীর হাড়-মাস মজ্জা সব শুষে খেয়ে নিয়েছে তখন মোগল সাম্রাজ্যের কাক-চিল আর শকুনের দল।

চিঁচিঁ করে মরালী তখনও অস্ফুট গলায় শুধু বলতে চেষ্টা করছে–হ্যাগো, তোমরা আমাকে এমন করে ঠকালে…

বজরা তিনটে তখন মুর্শিদাবাদের ঘাটের কাছে এসে পড়েছে

মতিঝিলের ফটকের সামনে আর পাহারা দেবার লোক কেউ নেই তখন। যারা ছিল তারা আগেই পালিয়েছে। এক এক করে সব বেগমসাহেবাদের খিড়কির ঘাটে গিয়ে তুলে দিয়েছে বজরায়। গুণে গুণে তুলেছে সবাইকে। কেউ বাদ না যায়। যারা নবাব মির্জা মহম্মদের আপনজন তাদের কাউকে আর রাখা হবে না মুর্শিদাবাদে। মুর্শিদাবাদের মসনদ মিরজাফর আলি সাহেবের জন্যে নিষ্কন্টক করে রাখতে হবে। মিরন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তার জড় তুলে ফেলেছে।

মেহেদি নেসার পঁড়িয়ে ছিল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার চারদিকে। রেজা আলি সাহেবও দাঁড়িয়ে দেখছে। এক এক করে গুণে গুণে তাদের বজরায় তুলেছে।

নানিবেগম।

ঘসেটি বেগম।

আমিনা বেগম।

ময়মানা বেগম।

লুৎফুন্নিসা বেগম।

হঠাৎ মেহেদি নেসারের খেয়াল হল–আর, নবাবের মেয়েটা কোথায় গেল?

মিরন বললে–থাক থাক, সেটা তো বাচ্চা, তাকে জাহাঙ্গিরাবাদে পাঠিয়ে ফয়দা নেই

তারপর সকলের শেষে আর এক জোড়া আড়ষ্ট পা দেখা গেল।

মিরন ভাল করে লক্ষ করে দেখলে। ফিরিঙ্গিবাচ্চা ক্লাইভের এত নেকনজর যার ওপর, সেইমরিয়ম বেগমসাহেবা! সফিউল্লা সাহেবকে খুন করেছিল। এ মুর্শিদাবাদে থাকলে আবার আগুন জ্বালাবে।

মিরন হুকুম দিলে জলদি কর, জলদি

বজরাগুলো তৈরি হয়েই ছিল। তারা কাছি খুলে দিলে। দাড়ের ঘায়ে জলের স্রোতে ছপাৎ করে শব্দ হল। বদর-বদর

মিরন মাঝিকে ডেকে বলে দিলে ভগবানগোলার দিকে ধীরে ধীরে নাও বেয়ে চলল, আমি পেছনে পেছনে যাচ্ছি

ওদিক থেকে জলুসের ভিড়ের শব্দকানে এল। মিরদাউদ আর মিরকাশিম সাহেবনবাব মির্জা মহম্মদকে ধরে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে আসছে। আর দেরি করা চলবে না। যে-বেগমরা মতিঝিলে পড়ে রইল তাদের সকলকে নজরানা দিতে হবে ক্লাইভ সাহেবকে। তখন তারা ক্লাইভ সাহেবের সম্পত্তি!

ফটকের কাছে আসতেই সোজাসুজি মেজর কিলপ্যাট্রিক সাহেবের সঙ্গে দেখা।

কী সাহেব, কী খবর?

মেজর কিলপ্যাট্রিক ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললে–এরই নাম হিরণ্যনারায়ণ রায়। হাতিয়াগড়ের জমিদার। কর্নেল হুকুম দিয়েছে মরিয়ম বেগমসাহেবাকে এর হাতে তুলে দিতে হবে।

ডিহিদার রেজা আলি একবার চেয়ে দেখলে ছোটমশাইয়ের দিকে। কিন্তু যেন চিনতে পারলে না।

ক্লাইভসাহেবের হুকুম?

ইয়েস!

কিন্তু ক্লাইভসাহেব বললে–তো আমি শুনব না। মিরজাফর সাহেবের হুকুমনামা আছে?

কিলপ্যাট্রিক বললে–মিরজাফরই তোমার কাছে পাঠালে।

মিরন একটু মিইয়ে গেল মিরজাফর আলি সাহেবের নাম শুনে।

কিন্তু সব বেগমদের যে আজকের দরবারে ক্লাইভসাহেবের সামনে হাজির করা হবে। তখন ক্লাইভসাহেব বেগমদের যার হাতে খুশি দান-খয়রাত করতে পারে

কিলপ্যাট্রিক বললে–না, তার আগে মরিয়ম বেগমসাহেবাকে এই জেন্টলম্যানের হাতে তুলে দিতে হবে, কর্নেলের অর্ডার।

অর্ডার! তবে অর্ডারই তামিল করো তুমি! যদি পারো মরিয়ম বেগমসাহেবাকে খুঁজে বার করে নাও। খুঁজে বার করে নিতে পারলে আমার আর আপত্তি নেই।

জলুসটা আরও এগিয়ে আসছে। আরও হাজার হাজার লোক জলুসের পেছন পেছন আসছে। ওদিক থেকে শোরগোল আসছে মানুষের। মুর্শিদাবাদের মানুষের আজ এক স্মরণীয় দিন। মুর্শিদাবাদের হর্তাকর্তা-বিধাতাকে আজ হাতকড়া বাঁধা অবস্থায় রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে আনা হচ্ছে।

মতিঝিলের ভেতরে তখন এক-একটা বেগমসাহেবাকে পরীক্ষা করে দেখছে ছোটমশাই। মিরন সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। ঘরের পর ঘর, বেগমের পর বেগম। চেহেলসূতুনের কতদিনকার পোষা বেগম সব। কেউ কমবয়েসি, কেউ মাঝবয়েসি, কেউ বা যৌন পেরিয়ে বুড়ি হতে চলেছে। তবু চোখে সুর্মা দিয়েছে, হাতের আঙুলের নখে মেহেদি পাতার রং লাগিয়েছে। বাঁকা বাঁকা চাউনি, ওড়নির ফাঁকে ফাঁকে মুচকি হাসি–

এ কে?

এর নাম পেশমন বেগম।

আর এ?

বব্বু বেগম।

আর এ?

গুলসন বেগম।

আর এ?

তক্কি বেগম।

একটার পর একটা বেগমকে মিরন দেখাচ্ছে আর ছোটমশাই বলছে-না, এ তো নয়, এ তো ছোট বউরানি নয়। তার যে অন্য রকম চেহারা। সে যে আরও অনেক সুন্দরী, আরও অনেক ভাল দেখতে। মতিঝিলে যদি না থাকে সে তো কোথায় গেল! কোথায় গেলে তাকে পাওয়া যাবে! ছোট বউরানিকে না পাওয়া গেলে বড় বউরানির কাছে মুখ দেখাবে কী করে!

কিলপ্যাট্রিক সাহেব এতক্ষণ ধরে সব বেগমদের দেখছিল। এত বেগম, এত জেনানা থাকে নবাবের। আর কী সব রূপ! এত বেগম নিয়ে নবাবরা কী করে? কার সঙ্গে কখন রাত কাটায়। বছরে তো নিশো পঁয়ষট্টি রাত, তার মধ্যে ক’জন করাত দেখতে পায় নবাবকে, ক’জন শুতে পায় নবাবের সঙ্গে।

মিরন বললে–আমার অনেক কাজ আছে সাহেব, আমি চলি; জলুস এসে গেছে। আপনাকে সব বেগমদের দেখালাম, আর বেগম নেই–

কিলপ্যাট্রিকের তখনও যেন বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি। বললে–আর ওরা কারা! ওদিকে?

ওরা সব বাঁদি, বেগমদের সঙ্গে বাঁদিদেরও নজরানা দেব।

কিলপ্যাট্রিক বললে–এদের সকলকে নজরানা দেবে? সব কর্নেল পাবে?–ওই বাঁদিরা?

বেগম দিলে বেগমদের বাঁদিদের দিতে হবে না? নইলে বেগমদের তরিবত করবে কে?

তারপর মিরন আর দাঁড়াল না। বললে–এবার আপনারা যা খুশি করুন সাহেব, আমার আর সময় নেই। আমি চলি, জলুস এসে গেছে, আমার এখন অনেক কাজ

ডিহিদার রেজা আলি, মেহেদি নেসার, তারাও মিরন সাহেবের পেছনে পেছনে চলে গেল।

ওদিকে মনসুরগদির মধ্যে তখন বাংলা মুলুকের ভাগ্যলিপি তৈরি হতে চলেছে। শুধু বাংলা মুলুকই বা কেন, সমস্ত হিন্দুস্থানের ভাগ্যলিপি। মুর্শিদাবাদের গঙ্গার ঘাটে যখন বজরাগুলো এসে লাগল তখনও মরালী নির্বাক নিশ্চল।তার খেয়ালই নেই কখন নৌকো এসে ঘাটে ভিড়েছে, কখন হাজার হাজার লোক তাদের নবাবকে দেখতে এসে ভিড় করেছে।

তখনও চিঁ চিঁ করে সে কোনওরকমে বলতে চেষ্টা করছে-হ্যাগো, তোমরা আমাকে ঠকালে?

কিন্তু মাঝিমাল্লা-সেপাইবরকন্দাজ সকলের হট্টগোলে তখন সে-আর্জি কার কানেই বা পৌঁছোবে? ইতিহাসের বইতে তো মরিয়ম বেগমসাহেবার নামই নেই। উদ্ধব দাস এই ‘বেগম মেরী বিশ্বাস’ কাব্য না লিখলে আমিও তো তার নাম জানতে পারতাম না। গাঁয়ের একটা নগণ্য মেয়ে, দিল্লি থেকে নাচতে আসেনি, নেচে গেয়ে চৌষট্টি কলার আকর্ষণ দেখিয়ে কাউকে হাতের মুঠোয় পুরে নবাবের পেয়ারের বেগমসাহেবা হয়নি। মরিয়ম বেগমসাহেবার উৎপত্তি বড় মামুলি। তাই হয়তো রিয়াজ-উস-সালাতিন-এর মুতাক্ষরীনে তার উল্লেখ নেই, গোলাম হোসেনের রোজনামচাতেও তার কোনও হদিশ নেই। তারিখ-ই-বাংলার পুঁথি খুঁজেও মরিয়ম বেগমসাহেবার কোনও নামোল্লেখ পাইনি।

এমনকী জর্জ ফরেস্ট, সি আই ই, যিনি ক্লাইভ সাহেবের অত বড় দু’ভলমের জীবনী লিখে গেছেন, তারও পাতাগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি। তারপর এই সেদিন, ১৯৬৩ সালে ছাপা মাইকেল এডওয়ার্ডস-এর লেখা বই ব্যাটল অব প্ল্যাসি’, তার মধ্যেও মরিয়ম বেগমসাহেবার নাম-গন্ধ খুঁজে পেলুম না। তার কারণ মরালী হারিয়ে গিয়েছিল ইতিহাস থেকে। ইতিহাসে এমন অনেক হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাস আছে। তারা আড়ালে থাকে, আড়ালে থেকে তারা ইতিহাস তৈরি করে, কিন্তু শেষপর্যন্ত তারাই আড়ালে পড়ে যায়, তারাই অদৃশ্য হয়ে যায় চিরকালের মতো।

সেদিন মরিয়ম বেগমসাহেবারও তাই হয়েছিল।

মুর্শিদাবাদের গঙ্গার ঘাটে যখন সবাই নবাবের চরম দুর্দশা দেখতে ব্যস্ত, তখন অন্য বেগম বাদিদের মধ্যে মরালীর ঘোমটা-ঢাকা মুখটা কেউই দেখতে পায়নি। দেখতে চায়ওনি। ময়দপুরের ক্লাইভ সাহেবের কিনে দেওয়া সেই আড়ঙ-ধোয়া তাঁতের শাড়িটা পরে সেও দলের সঙ্গে ঘাটে নেমেছিল। সমস্ত শরীর তার তখন টলছে। ব্যথা হয়ে গেছে কোমরে, গায়ে, মাথায়। নখের আর দাঁতের লজ্জা শাড়ির ভেতরে লুকিয়ে রেখে মাথা নিচু করে হেঁটে হেঁটে চলেছে। শুধু মনে মনে বলেছে, পৃথিবীর সবাই তাকে কেবল প্রবঞ্চনাই করে গেল। কারও কোনও উপকারে লাগল না সে। সামনেই চলেছে নবাব মির্জা মহম্মদ। তার পেছনে লুফুন্নিসা বেগম। তার পেছনে শিরিনা। নবাবের মেয়েকে কোলে নিয়ে চলেছে। তার পেছনে দুর্গা আর ছোট বউরানি, আর তার পেছনে মরালী।

মিরন সাহেব একবার সামনে দেখে, আর একবার পেছনে। আসামিরা না ভাগে।

পেছনে ওটা কে রে?

চারদিকের ভিড় থেকে মানুষেরা কৌতূহলী প্রশ্নগুলো ছুঁড়ে মারে। কেউ চেনে না কাউকে। নবাবকেই তারা চেনে কেবল। আর সব অচেনা। চেহেল্‌-সুতুনের হারেমের ভেতরের মানুষদের চিনবেই বা কী করে! বাইরের কেউ তো কখনও দেখেনি তাদের। তাদের কথা দুরে থাক, আকাশের চন্দ্রসূর্যও কখনও তাদের সাক্ষাত পায়নি। কত বাঁদি কত বেগম চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে থাকে, কে তার খবর রেখেছে।

মিরদাউদ আর মিরকাশিম সাহেব সবার আগে আগে বিজয়ীর মতো বুক ফুলিয়ে এগিয়ে চলেছে। যেন তারাই এ-উৎসবের লক্ষ্য, আর সবাই গৌণ! অথচ কাল রাত্রের কথা কেউ জানে না। তাদের ফৌজ-পোশাকের আড়ালের মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছে না কেউ। তাদের নখে আর তে যে এত ধার আছে তাও কেউ জানতে পারলে না। তবু তারাই আজ চেহেল্‌-সুতুনের দরবারে খেলাত পাবে, ইনাম পাবে।

মরালী একবার থমকে দাঁড়াল।

একটা চেনা গলার আওয়াজ কানে এল যেন। সেই বশির মিঞা। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল তার কথা সেই আর একজন। হয়তো এখনও সে চেহেলসূতুনের অন্ধকারের মধ্যে বোরখা পরে চরম হুকুমের প্রতীক্ষায় মুহূর্ত গুনছে। তুমি আমার জন্য নিজেকে বলি দিতে চেয়েছিলে, কিন্তু তুমি জানতেও পারলে না যে, আমাকে তুমি বাঁচাতে পারলে না। তুমি চেয়েছিলে আমি এই নবাব-মসনদ-আমির, এই বিলা-ঐশ্বর্য-বৈভব সমস্ত কিছু থেকে দূরে পালিয়ে গিয়ে শান্তির সংসার গড়ি স্বামীকে নিয়ে। যাতে আমি নিরাপদে থাকি তাই সমস্ত বিপদের বোঝা তুমি নিজের মাথায় তুলে নিয়েছিলে। কিন্তু তুমি জানতেও পারলে না যে আমি বাঁচিনি। ওদের নখের আর দাঁতের হিংস্রতায় আমি আজ নিঃশেষ হয়ে গেছি।

কোথায় কোন একটা জায়গায় এসে জলুসটা যেন হঠাৎ থামল। মিরন সাহেবের গলা। যেন সবাই উদগ্রীব হয়ে আছে। আসামিরা না পালায়। আমরা পালাব কী করে? তোমরা কি আমাদের আস্ত রেখেছ? মানুষের ধর্মবিশ্বাস-অস্তিত্ব সমস্ত কিছু ধ্বংস করে তবে যে আমাদের পরিত্রাণ দেবে!

যে-ঘরটার মধ্যে মরালীকে ওরা পুরে দিয়েছিল সেটা বড় অন্ধকার ঘর। তার ওপর অন্ধকারের যন্ত্রণা। যন্ত্রণা শুধু অস্তিত্বের নয়, লজ্জার ধিক্কারের আর প্রবঞ্চনার যন্ত্রণা। তখনও যেন মরালীর ভাল করে বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমি যা কখনও করিনি, তোমাদের জন্যে আমি তাই-ই করলুম, লজ্জা-শরম সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে, হেসে হেসে তোমাদের ঠোঁটে মদ তুলে দিলুম, আর তোমরা আমাকে ঠকালে? হ্যাঁগা, ঠকালেই যদি তো এমন করেই ঠকাতে হয়?

পাশাপাশি সার সার ঘর। মিরন সাহেবের নিজের বাড়িতে তুলেছে সবাইকে। তার মধ্যে থেকে কখন যে লুৎফুন্নিসা বেগমসাহেবাকে নিয়ে গিয়ে মতিঝিলে তুলেছিল তা কেউ জানে না। মিরন সাহেবের কাজ অঙ্ক কষা নিখুঁত কাজ। বাঁদিদের রেখে দিয়েছিল, তাদের দিয়ে কোনও ভয় নেই। তারা কোনওদিন ছাড়া পেয়ে মসনদ চেয়ে বসবে না। তারা বাদির দল, যে মসনদে বসবে তার বেগমদের বাঁদিগিরি আবার তারাই করবে।

মিরদাউদ মিরন সাহেবকে পেয়েই বলে দিয়েছিল–খুব হুশিয়ার মিরনসাহেব, নবাবের পালিয়ে যাবার মতলব আছে

মিরন সাহেব বকের মতন ঘাড় বেঁকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল–কেন? নবাব কি কিছু বলছিল?

না, বলেনি, শুধু বলেছিল ছেড়ে দিতে, বলছিল আর কখনও মসনদের জন্যে লড়াই করবে না। বলছিল, যদি ছেড়ে দিই তা হলে জাহাঙ্গিরাবাদে গিয়ে বাকি জিন্দগিটা কাটিয়ে দেবে–

মিরন কথাটা শুনে বলেছিল–আচ্ছা, ঠিক আছে, বাকি জিন্দগিটা কাটাতে দিচ্ছি আমি

নবাবের বিচার হবে তো?

মিরন বললে–আলবত হবে।

কে বিচার করবে?

নবাব মিরজাফর আলি মহবত জঙ করবে। মুর্শিদাবাদের আলমগির করবে। নবাবের বিচার নবাবই করবে। ইনসানের বিচার ইনসান ছাড়া আর কে করবে?

তারপর একটু থেমে বললে–তা হলে সন্ধেবেলার দরবারে আসছেন তো ফৌজদারসাহেব? আসছি। মিরকাশিম সাহেবও আসবে তো?

হ্যাঁ হ্যাঁ হরগিজ আসবে। আমি এখন চলি, লুৎফুন্নিসা বেগমসাহেবাকে আমি মতিঝিলে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছি, কেউ যেন না জানতে পারে। লুৎফুন্নিসা বেগমসাহেবার কাছে কিছু গয়নাটনা ছিল না?

মিরদাউদ সাহেব একটু ঘাবড়ে গেল প্রশ্নটা শুনে। মিরকাশিম সাহেব সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল-না জবাব, কিছু ছিল না

তা হলে শুনেছিলাম যে নবাব অনেক মোহর-গয়না-জহরত সঙ্গে নিয়ে গেছে, সেগুলো সব কোথায় সরাল?

কে জানে কোথায় সরাল!হয়তো ধরা পড়বার ভয়ে গঙ্গার জলে ফেলে দিয়েছে। তাও হতে পারে।

আর এ-ঘরে দু’জন কারা?

মিরদাউদ বললে–ওরা নবাবের বাঁদি।

আর এ-ঘরে?

মিরদাউদ বললে–এ-ঘরে মরিয়ম বেগমসাহেবা।

মরিয়ম বেগমসাহেবা! মিরন সাহেব অবাক হয়ে চেয়ে রইল ফৌজদার সাহেবের দিকে। মরিয়ম সাহেবাকে যে এইমাত্র বজরায় করে জাহাঙ্গিরাবাদে পাঠিয়ে দিয়ে এল নিজে হাতে। মরিয়ম বেগমসাহেবা আবার এখানে আসবে কী করে?

হ্যাঁ জনাব, আমি বলছি মরিয়ম বেগমসাহেবা, আমি আর মিরকাশিমসাহেব দুজনে মিলে যে তার সঙ্গে নৌকোর ওপর মেহফিল করলুম

তার মানে?

মানে ফুর্তি করলুম, সরাব খেলুম। খাসা মাল জনাব। সফিউল্লা সাহেবকে খুন করেছিল, মনে নেই? তাই তার একটু বদলা নিলুম

বদলা নিলুম মানে?

মিরকাশিম সাহেব হেসে উঠল হোহো করে। বললে–আরে জনাব, একটু আয়েশ করলুম দুজনে মিলে; আপনি দেখছি সাটের কথা বোঝেন না! কিন্তু মাল খুব খুবসুরত জনাব, দেমাগ তর হয়ে গেছে কাল, একেবারে তর…

মিরন সাহেব তখন উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। বললে–আরে, একদম গল করেছেন জনাব, বিলকুল গল। মরিয়ম বেগমসাহেবাকে মেহেদি নেসার সাহেব চেহেল্‌-সুতুনে গ্রেফতার করে রেখেছিল, সেখান থেকে আমি তাকে মতিঝিলে নিয়ে গিয়েছিলুম, এখন তো একেবারে জাহাঙ্গিরাবাদে

তাই নাকি জনাব? তোবা! তোবা!

মিরদাউদ আর মিরকাশিম সাহেব ঘেন্নায় তোবা’ তোবা’ করে উঠল। ছি ছি, কাল সারারাত তা হলে দু’জনে মরিয়ম বেগমসাহেবা ভেবে বাঁদির সঙ্গে মেহফিল করেছে। বাঁদির ছোঁয়া মদের পেয়ালায় ঠোঁট ছুঁইয়েছে।

রাত্রের কথাগুলো ভেবে মিরদাউদ আর মিরকাশিম সাহেবের মনটা ঘেন্নায় রিরি করে উঠল। যাক, মনে মনে কান মুললে দুজনেই। এমন বেওকুফি আর কখনও করবে না ফৌজদার সাহেব। রাত্রের অন্ধকারে চেনা যায়নি, তাই অমন ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু বাঁদি হোক আর যাই-ই হোক, মাল খুবসুরত না?

কী বলল মিরকাশিমসাহেব, মাল খুবসুরত না?

বড় খুবসুরত জনাব, বড় আরাম দিয়েছে বাঁদিটা।

কিন্তু মিরন সাহেব তখন সেখান থেকে চলে গেছে। তার অনেক কাজ। বাঁদির সোহাগের কেচ্ছা শুনলে তো আর তার চলবে না। ফিরিঙ্গিবাচ্চার খেয়াল-খুশির একটা ফয়সালাও করতে হবে। তারও নজর পড়েছে মরিয়ম বেগমসাহেবার ওপর। তাকেও একটা বাঁদি দিয়ে বলতে হবে–এর নামই মরিয়ম বেগম।

সেখান থেকে সোজা চলে গেল মিরজাফর সাহেবের মহলে। কাল থেকে অনেক ঝক্তি গেছে মিন সাহেবের মাথার ওপর দিয়ে। কাজকারবার বন্ধ হয়ে রয়েছে শহরের। চেহেসতুনের মালখানার চাবি পর্যন্ত নিজের কাছে নিয়ে রেখেছে ক্লাইভ সাহেব। চাবি আর হাতছাড়া করছে না কিছুতেই

মিরন সাহেব রেগে গিয়েছিল। বলেছিল–তা চাবি তুমি হাতছাড়া করলে কেন?

মিরজাফর সাহেব বললে–চাবি হাতছাড়া করব না তো কী করব?

তা হলে এখন যদি সব টাকাকড়ি নিয়ে নেয়?

তা নিলে আমি কী করব?

আমি যে তাদের অনেক কোশিস করে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রেখে দিয়েছি এতদিন।

মিরজাফর সাহেব রেগে গেল। বললে–তোর বুদ্ধিতে চললেই হয়েছে। তোকে যা বলেছি তুই। তাই বর

আমি তো দরবারের সব ইন্তেজাম করেছি। সব আমির-ওমরাওদের নেমন্তন্নের খত্ পাঠিয়েছি

জগৎশেঠজিকে বলেছিস তো?

বলেছি।

উমিচাঁদকে?

ওকে আর বলতে হয়নি। ও নিজেই তাগিদ দিয়ে দিয়ে আমার কাছ থেকে খত্ আদায় করে নিয়েছে।

আর ফিরিঙ্গি সাহেবদের?

ফিরিঙ্গি সাহেবদের কাউকে বাদ দিইনি। কিলপ্যাট্রিক, ড্রেক, ওয়াটসন, ওয়াট, সেপাইদের ভি কসবার ইন্তেজাম করেছি দরবারে।

মিরজাফর সাহেব তাতেও যেন খুশি হল না। জিজ্ঞেস করলে ওদের খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্ত ঠিক হচ্ছে? কোনও তফলিফ নেই তো?

মিরন বললে–সে তো সব মেহেদি নেসার আর রেজা আলির ওপর ভার দিয়ে দিয়েছি

ও শালারা সব চোর! ওই মেহেদি নেসারটাকে বিশ্বাস করিসনি। ওটা একবার এর দলে, আবার একবার ওর দলে থাকে, টাকা চুরি করতে পারে, নজর রাখবি চারদিকে

মিরন সাহেব চলে আসছিল, হঠাৎ মুখ ফিরিয়েই সামনে দেখে ক্লাইভ সাহেব। সঙ্গে উদ্ধব দাস।

মিরন ফিরিঙ্গিবাচ্চাকে দেখেই কুর্নিশ করলে আদাবরজ সাহেব, কিছু তকলিফ নেই তো হুজুরের?

মিরন দেখলে সাহেবের মুখটা গম্ভীর গম্ভীর। মুর্শিদাবাদে আসার পর থেকে এমন গম্ভীর মুখের ভাব আর কখনও হয়নি সাহেবের।

ক্লাইভ জিজ্ঞেস করলে–মিরজাফর কোথায়? হোয়ার ইজ মিরজাফর আলি?

ওই যে স্যার, ওই যে

থরথর করে কাঁপতে লাগল মিরন সাহেবের কলিজার ভেতরটা। ফিরিঙ্গি সাহেব বেজার হলেই তো সব গোলমাল হয়ে যাবে। মিরন সাহেবের নিজের ভবিষ্যত, মিরজাফর সাহেবের ভবিষ্যত নিয়ে তখন টানাটানি পড়বে।

সাহেবের গলা শুনেই মিরজাফর সাহেব তাকিয়া ছেড়ে উঠে এসেছেন।–কী হুজুর, কী হুকুম।

হঠাৎ যেন সাহেব ফেটে পড়ল। এমন করে রাগতে কখনও কেউ দেখেনি সাহেবকে।

কী হয়েছে বলুন না হুজুর! কী কসুর হয়েছে?

আমি কখন থেকে মরিয়ম বেগমসাহেবার খবর আনতে পাঠিয়েছি, এখনও কোনও ট্রেস নেই কেন? হোয়ার ইজ সি?

মিরজাফর সাহেব কথাটা শুনে লজ্জায় পড়ল। তাজ্জব ব্যাপার। যে-দিকে নিজে দেখবেনা সেই দিকেই গল। সাহেবকে এত খাতির করে ডেকে নিয়ে এসে শেষকালে একটা সামান্য মেয়েমানুষ ভেট দিতে পারছেনা! চেহেসূতুনে এত মেয়েমানুষ থাকতে কিনা আজ মেয়েমানুষের জন্যে সাহেব চটে গেল।

মিরজাফর সাহেব ক্লাইভের সামনেই তেড়ে গালাগালি দিয়ে উঠল, উল্লক, বেল্লিক, বেওকুফ, জাহান্নাম কাকুত্তা। আরও সব উর্দু ফারসি ভাষায় কী গালাগালি দিলে সব বোঝা গেল না। উর্দু ফারসি ভাষায় যে এত রকম চোস্ত গালাগালি আছে, আর বাপ হয়ে যে ছেলেকে এত গালাগালি দেওয়া যায় তাও বুঝি এর আগে কেউ জানত না।

মিরন কিন্তু একটা কথারও জবাব দিলে না। সব গালাগালি মাথা নিচু করে নিঃশব্দে হজম করে নিলে।

তারপর মিরজাফর সাহেব বললে–আপনি নিজের মহলে যান হুজুর, আমি মরিয়ম বেগমসাহেবাকে হুজুরের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি

সেদিন সেই মনসুরগদির মিরজাফরের মহলের খিলেনের তলায় দাঁড়িয়ে আর এক জালিয়াতির শরণ নিল মিরন সাহেব! শুধু মিরন সাহেবনয়, ইতিহাসও বুঝি মাঝে মাঝে এমনই জালিয়াতির আশ্রয় নেয়। যে-মরিয়ম বেগম মুর্শিদাবাদে নেই, যেমরিয়ম বেগমসাহেবাকে বজরায় তুলে দিয়ে জাহাঙ্গিরাবাদের দিকে পাঠিয়ে দিয়েছে, যে-মরিয়ম বেগমসাহেবা তখন বজরায় ছইয়ের তলায় বসে আকাশের দিকে চেয়ে আছে একদৃষ্টে, সেই মরিয়ম সাহেবার নাম করে আর এক জালিয়াতির জাল বোনা হল সেদিন মনসুরগদির বারান্দায় দাঁড়িয়ে।

ক্লাইভ সাহেব আর কিছু কথা বললে–না। উদ্ধব দাস পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে বললে–চলে পোয়েট, চলো—

এ সেই যুগ যখন সারা হিন্দুস্থানে মানুষের বুদ্ধি-বিদ্যে-ক্ষমতার অবক্ষয়ের চিহ্ন পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। দিল্লির বাদশার ক্ষমতা আর নেই, রাজস্থানের রাজপুতদের ঘর ভেঙে গেছে। দক্ষিণের সুবাদাররা স্বয়ম্ভু হয়ে ওঠবার চেষ্টা করছে, মারাঠারা লুঠপাট করে ক্লান্ত, আর পূর্বপ্রান্তের এই জনপদে তখন নখ আর দাঁতের অস্ত্রে শান দেওয়া হচ্ছে সকলের চোখের আড়ালে।

ইতিহাসের সেই সন্ধিক্ষণে একটা মেয়ে হাতিয়াগড়ের মতো অখ্যাত এক জনপদ থেকে বেরিয়েছিল ঘটনাচক্রের অমোঘ বিধানে। তার বিদ্যে ছিল না, বুদ্ধি ছিল না, সহায়-সম্বল কিছুই ছিল না সেদিন। তারপর কেমন করে হিন্দুস্থানের রাষ্ট্রবিপ্লবের সঙ্গে একাত্মভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল তার ভাগ্য। চোখের সামনে ভাগ্য-বিধাতার পরিহাস দেখলে, ধর্ম-অধর্মের কলহ দেখলে। অর্থগৃধুতার চরম বিকাশ দেখলে, লালসার অনির্বাণ জ্বালানল দেখলে, তারপর একদিন সেই আগুনে আত্মাহুতি দিলে। এ সমস্তই মাত্র একটা জীবনের মধ্যে ঘটে গেল। এ বড় অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। আর উদ্ধব দাস তার দেখাকে নিজের দেখায় পরিণত করলে। মরিয়ম বেগমকে অমর করে রেখে গেল।

উদ্ধব দাস লিখে গেছে–একলিযুগ। কিন্তু সত্যযুগের মানুষ ছিল অন্যরকম। তখন মানুষের সাধনা ছিল মুক্তির সাধনা। অধ্যাত্মবাদের মধ্য দিয়ে মুক্তির সাধনাই ছিল তখন প্রধান কাজ। তারপর এল ত্রেতাযুগ। তখন এল ধর্ম। এল ক্ষত্রিয়। দুর্জনের হাত থেকে সত্যনিষ্ঠকে রক্ষার ধর্ম, পাপের হাত থেকে পূণ্যকে। তারপর এল দ্বাপর। দ্বাপরে ন্যায়ের মর্যাদা বাড়ল। সৎপথে অর্থ উপার্জন শুরু হল। এল বৈশ্য। অর্থের সদ্ব্যবহারে মানুষের সমৃদ্ধিসাধন হল। তারপর সকলের শেষে এল কলি। ক্রোধের ঔরসে আর হিংসার গর্ভে জন্ম হল কলির। ধর্ম-অর্থ-মোক্ষ কাম সব ভেসে গেল। এল ম্লেচ্ছ। স্বার্থের সঙ্গে স্বার্থের বিরোধ বাধল, দেশের সঙ্গে বিদেশের, মানুষের সঙ্গে মানুষের। যৌনক্ষমতা দিয়ে বিচার হল মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের। জয় হল দুর্জনের। প্রতিষ্ঠা হল পাপের।

পাণ্ডুলিপিটা পড়তে পড়তে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সামান্য বাউন্ডুলে মানুষ উদ্ধব দাস। কেউই তাকে সেদিন চিনতে পারেনি। হয়তো মরালীও তাকে চিনতে পারেনি। হাতিয়াগড়ের ছোটমশাই, কৃষ্ণনগরের মহারাজাও তাকে চিনতে পারেনি শেষ পর্যন্ত। কিন্তু চিনেছিল বুঝি শেষপর্যন্ত শুধু বিদেশ থেকে আসা একজন বিধর্মী মানুষ!

বারান্দা দিয়ে ফিরে আসতে আসতে উদ্ধব দাস জিজ্ঞেস করেছিল–আপনি আমার জন্যে এত কষ্ট করছেন কেন প্রভু?

ক্লাইভ বলেছিল–তোমাকে তো আমি বলেছি পোয়েট, আমি তোমাকে ভালবাসি

কিন্তু প্রভু, আমি তো আপনাকে ভালবাসিনে!

তা না বাসো, আমার কিছু আসে যায় না। লোকে তো আমার কত নিন্দে করে। কেউ বলে, আমি অত্যাচারী, লোভী। আবার কেউ বলে, মেয়েমানুষের ওপর আমার নাকি দুর্দম লোভ। ফ্রেঞ্চরা আমাকে পেলে খুন করে ফেলে। ডাচরা আমার ওপর হাড়ে হাড়ে চটা, আমি সকলের শত্রু। এই যে নবাবকে আজকে এখানে হাতকড়া দিয়ে ধরে এনে বন্দি করে রেখেছে, তুমি কি ভাবো, মিরজাফর আলি তার। চেয়ে ভাল লোক?

উদ্ধব দাস বললে–আমি ওসব নিয়ে কিছু ভাবিই না প্রভু

তুমি না ভাববা, কিন্তু আমাকে তো ভাবতে হয় পোয়েট! আমি যে কাউকে ক্ষমা করি না। ভালর কাছে আমি ভাল, কিন্তু খারাপের কাছে আমি ডেথ। নবাবকে আজকের দরবারে আমার সামনে হাতকড়া বেঁধে হাজির করবে, আমি তাকে যে শাস্তি দেব তেমন শান্তি কেউ কখনও কাউকে দেয়নি পোয়েট

ভগবান শাস্তি না দিলে আপনি শাস্তি দেবার কে প্রভু?

ক্লাইভ বললে–ঠিক বলেছ পোয়েট, আমি নিজে ভগবানের কাছ থেকে যে শাস্তি পাই তার প্রতিকার করবে কে? জানো পোয়েট, রাত্তিরে আমার ঘুম হয় না

উদ্ধব দাস বললে–আমি কিন্তু খুব পেট ভরে ঘুমোই প্রভু

স্বপ্ন দেখো না?

স্বপ্ন? হ্যাঁ, স্বপ্ন দেখি প্রভু!

স্বপ্ন দেখো? তুমিও স্বপ্ন দেখো?

কেন প্রভু? স্বপ্ন তো সবাই দেখে!

ক্লাইভ এবার উত্তেজিত হয়ে উঠল যেন। বললে–তাসের স্বপ্ন দেখো? হা হ্যাঁ হ্যাঁ, তাস!

কেন, আপনি তাসের স্বপ্ন দেখেন নাকি প্রভু?

ক্লাইভ বললো হ্যাঁ পোয়েট, রাত্রে যখন দুটো চোখ সবে বুজে আসছে, ঠিক তখন একজন আমার ঘরে ঢোকে। ঢুকে আমাকে তাস দেখায়, কুইন অব স্পেড়–ইস্কাবনের বিবি। আমার ঘুম ভেঙে যায়, আমি চিৎকার করে উঠি! একদিন তোমার বউ আমার পাশের ঘরে শুয়ে ছিল। আমার চিৎকারে তার ঘুম ভেঙে গেছে, সে দৌড়ে এসেছে আমার ঘরে, সে কিছু বুঝতে পারলে না। আমি তাকে এক দাগ ওষুধ দিতে বললুম। সে আমায় ওষুধ দিলে তবে আমি আবার ঘুমোলুম!

কিন্তু সে কে প্রভু?

সাকসেস!

সাকসেস মানে কী প্রভু?

সাকসেস মানে এই যশ-খ্যাতি-জয়-ঐশ্বর্যবীর্য-টাকা-চাকরি-উন্নতি, এই সবকিছু মানুষের মূর্তি ধরে রাত্রে আমার কাছে আসে। কেন যে এত লোক থাকতে বারবার আমার কাছেই আসে তা জানি না পোয়েট! আমার মুনশিকে জিজ্ঞেস করেছি, তার কাছে আসে না, তোমার কাছেও আসে না। আমার দলের কাউকে আমি জিজ্ঞেস করিনি, কাউকে আমি কথাটা বলিনি। ইংলন্ডে আমার বাবাকে চিঠি লিখি, আমার বউ পেগিকে চিঠি লিখি। ইন্ডিয়ার সব কথা লিখে জানাই, তোমার কথাও তাদের লিখেছি, কিন্তু একথাটা জানাতে ভয় করে, তা হলে তারা আমাকে দেশে ফিরে যেতে বলবে–

চলতে চলতে নিজের মহলের কাছে এসে গিয়েছিল ক্লাইভ সাহেব। উদ্ধব দাসও পেছন পেছন আসছিল। বিরাট হাবেলি মনসুরগঞ্জ। মতিঝিলের দেখাদেখি তারই অনুকরণে নবাব আলিবর্দি খাঁ মির্জা মহম্মদের জন্যে তৈরি করে দিয়েছিলেন। বারান্দার পর বারান্দা, অলিন্দের পর অলিন্দ, খিলেনের পর খিলেন, চবুতরার পর চবুতরা।

সাহেব বারান্দা পেরিয়ে নিজের মহলের মধ্যে ঢুকল।

সামনে অর্ডার্লি মিলিটারি কায়দায় সেলাম করলে। মহলে ঢুকে প্রথমে বসবার ঘর। মাথার চারদিকে মখমলের চাদোয়া। তার চারপাশ থেকে পাতলা ঝালর ঝুলছে। তার চার কোণে আবার চারটে ঘর। সেই মহলেই আজ সকাল থেকে এত বেলা পর্যন্ত কেটেছে। এই বসবার ঘরে বসেই ক্লাইভ জগৎশেঠজির সঙ্গে কথা বলেছে, উমিচাঁদের সঙ্গে কথা বলেছে, মুনশি নবকৃষ্ণর সঙ্গে কথা বলেছে, মিরজাফর আলির সঙ্গে কথা বলেছে, মিরনের সঙ্গে কথা বলেছে, কিলপ্যাট্রিকের সঙ্গে কথা বলেছে।

কে?

উদ্ধব দাসকে বসবার ঘরে বসিয়ে রেখে ক্লাইভ নিজের শোবার ঘরে ঢুকেছিল। হঠাৎ মনে হল দেয়ালের ঝালরের আড়ালে কে যেন নড়ে উঠল। হাতের পিস্তলটা বাগিয়ে ধরলে সাহেব। স্পাই নয় তো! চারদিকে এত নজর রাখা হয়েছে, তবু কে ভেতরে এসে ঢুকল!

কে তুমি?

ঝালরটা একটু দুলে উঠল।

হু আর ইউ?

আস্তে আস্তে পিস্তলটা সামনে তাগ করে আরও এগিয়ে গেল সাহেব। যে ভেতরে ঢুকেছিল তার যেন গলা শোনা গেল এবার।

ওরা আমাকে ঠকিয়েছে! ওরা আমাকে..

ক্লাইভ ঝালরটা সরিয়ে ভাল করে তাকিয়ে দেখে অবাক হয়ে গেল।

তুমি? তুমি এখানে? আমি তো সব খবর শুনেছি, মাঝিরা আমায় সব খবর দিয়ে গেছে। তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবার জন্যে এতক্ষণ তো আমি ওদের বলেছি, তুমি এখানে কী করে এলে?

মরালী কোনওরকমে বললে—পালিয়ে

কিন্তু কী করে পালিয়ে এলে? কেউ তোমাকে দেখতে পেলে না?

নেয়ামত আমার দরজায় চাবি খুলে দিয়েছে, আমি সকলকে লুকিয়ে তোমার কাছে চলে এসেছি, ওরা দেখতে পেলে আমাকে খুন করে ফেলবে!

আর নবাব?

কী জানি, সেই কথা বলতেই আমি এসেছি তোমার কাছে। আমি জানি এ সময়ে তুমিই একলা নবাবকে বাঁচাতে পারো। শুধু নবাব নয়, নবাবের পাশের ঘরে আমাদের হাতিয়াগড়ের ছোট রানিবিবি আছে, আর তার ঝি আছে, তাদেরও তুমি ছেড়ে দাও দয়া করে, ওদেরও ধরে নিয়ে এসেছে ওরা–

ওদের কেন ধরেছে?

ভেবেছে ওরাও বুঝি নবাবের বেগম। ওদের জন্যে আমি অনেক করেছি, কিন্তু তবু ওদের শয়তানদের হাত থেকে বাঁচাতে পারলাম না। এই দেখো, ওরা আমার কী করেছে

মরালী তার শাড়ির আঁচলটা আলগা করে নিজের শরীরটা দেখালে।

ক্লাইভ জিজ্ঞেস করলে এসব কী? মরালী বললে–ওরা আমাকে আঁচড়ে দিয়েছে, কামড়ে দিয়েছে–এগুলো তোমাকে দেখাতে এসেছি, ওরা মানুষ নয়, জানোয়ার

কে করেছে? কারা?

ওই মিরদাউদ আর মিরকাশিম। সমস্ত শরীরে আমার ব্যথা হয়ে গেছে, আমি আর দাঁড়াতে পারছি না। ওরা আমাকে ঠকিয়েছে, ওরা বলেছিল নবাবকে আর রানিবিবিকে ওরা ছেড়ে দেবে, তাই ওদের হাতে আমি মদ খেয়েছিলুম, ওদের হাতে আমি…

মনে আছে, মরালীর কথা শুনে ক্লাইভের মুখটা লাল হয়ে উঠেছিল খানিকক্ষণের জন্যে। একদিকে মুর্শিদাবাদের নবাব, আর একদিকে মরালী। দু’য়ের মধ্যে পড়ে সেদিন সাহেব কী করবে বুঝে উঠতে পারেনি। রাগে শুধু থরথর করে কেঁপে উঠেছিল।

তারপর বলেছিল–তুমি চাও আমি নবাবকে ছেড়ে দেব? সত্যি তুমি তাই চাও?

শুধু নবাবকে নয়, আমাদের হাতিয়াগড়ের রানিবিবিকেও ছাড়িয়ে দাও। আর মতিঝিলে সেই যে তোমাকে বলেছিলুম আর-একজন মরিয়ম বেগম আছে, তাকেও তুমি ছাড়িয়ে দিয়ে এসো

আর তুমি?

মরালী বলেছিল–আমাকে তুমি আমার বাবার কাছে পাঠিয়ে দিয়ো, হাতিয়াগড়ে। আমি যেখান থেকে এসেছিলুম, সেখানেই আমি ফিরে যাব–

আর তোমার হাজব্যান্ড? তোমার স্বামী?

মরালী বলেছিল–আমার স্বামীর কাছে যাওয়ার মুখ আমি খুইয়েছি

কেন? কী হল তোমার?

মরালী সে-কথার উত্তর দেয়নি তখন। কী উত্তরই বা সে দেবে? আর ক্লাইভেরই বা সে-উত্তর শোনবার মতো সময় কোথায়? তখন সাহেবের মাথায় অনেক কাজের চাপ। উমিচাঁদের সঙ্গে হিসেবনিকেশের একটা ব্যাপার আছে। চেহেল্-সুতুনে দরবার করা আছে, জগৎশেঠের সঙ্গে ফয়সালা করতে হবে। অনেক অনেক কাজ। ইয়ার লুৎফ খাঁ, রাজা দুর্লভরাম আর জগৎশেঠের বাড়ির সামনে স্পাই রাখা আছে! যে-কোনও মোমেন্টে সমস্ত মুর্শিদাবাদ রিভোল্ট করতে পারে।

আচ্ছা ঠিক আছে, আমি তোমার স্বামীকে এখানে আনছি।

আমার স্বামী?

হ্যাঁ, সেই পোয়েট—

বলেই ক্লাইভ বসবার ঘরে চলে আসছিল উদ্ধব দাসের কাছে। কিন্তু মরালী বাধা দিলে। বললে–না, না, তাকে ডেকো না, আমি নষ্ট আমি নষ্ট

তবু ক্লাইভ কথা শুনলে না দেখে মরালী আরও জোরে কেঁদে উঠল–ওগো, তোমার পায়ে পড়ছি, তাকে ডেকো না, আমি নষ্ট, আমি নষ্ট…

ক্লাইভ সেকথায় কান না দিয়ে বাইরের ঘরে আসতেই দেখলে, মেজর কিলপ্যাট্রিক আর সেই হাতিয়াগড়ের রাজা দাঁড়িয়ে আছে।

কর্নেল, মতিঝিলে গিয়েছিলাম। সেখানে মরিয়ম বেগম নেই।

হোয়াট?

ছোটমশাইয়ের মুখটা তখন কাদোকঁদো হয়ে গেছে। বললে–না হুজুর, আমার স্ত্রীকে দেখতে পেলাম না সেখানে!

কোনও বেগম নেই?

কিলপ্যাট্রিক বললে–আছে, যেসব বেগম সেখানে আছে, মিরন সবাইকে ডেকে ডেকে দেখালে। আমি সকলের নাম জিজ্ঞেস করলুম। পেশমন বেগম, গুলসন বেগম, বব্বু বেগম, তক্কি বেগম, আরও সব কত আছে। তা ছাড়া অনেক বাঁদিও আছে, কিন্তু মরিয়ম বেগম বলে কেউ নেই সেখানে

কিন্তু তা কী করে হয়?

ছোটমশাইও বললে–আজ্ঞে হ্যাঁ, আমিও তো তাই ভাবছি, তা কী করে হয়?

উদ্ধব দাস হাঁ করে দাঁড়িয়ে এদের কথা শুনছিল। কিছু বুঝছিল, কিছু বুঝছিল না।

ক্লাইভ হঠাৎ বললে–আচ্ছা দাঁড়াও, আমি এখনই আসছি

বলে ভেতরের ঘরে চলে গেল। মরালী তখনও সেখানে ঠিক সেইরকম করেই দাঁড়িয়ে আছে।

ক্লাইভ গিয়ে বললে–শোনো, মতিঝিলে মরিয়ম বেগম বলে কেউ নেই

কেউ নেই?

অন্য সব বেগম আছে, পেশমন বেগম, গুলসন বেগম, তক্কি বেগম, বব্বু বেগম–সবাই আছে, কিন্তু মরিয়ম বেগম বলে কেউ নেই–

মরালী বললে–কিন্তু নানিবেগমসাহেবা? ঘসেটি বেগমসাহেবা, আমিনা, ময়মানা, লুৎফুন্নিসা, তারা কোথায় গেল?

তা জানি না, আমি আমার মেজরকে পাঠিয়েছিলাম, সে নিজে গিয়ে সকলকে দেখে এসেছে

মরালী বললে–কিন্তু চেহেল্‌-সুতুনে? চেহেলসুতুনটা দেখেছে?

না। চেহেল্‌-সুতুনের মালখানার চাবি আমার কাছে আছে। আমি নিজে সেখানে যাব পরে।

তুমি এখনই কাউকে পাঠাও চেহেলসুতুনে, নইলে সবাইকে ওরা খুন করে ফেলবে। কিংবা কোথাও সরিয়ে ফেলবে। তুমি ওদের চেনো না, ওরা জানোয়ার, ওরা শয়তান, ওরা সব পারে–

ক্লাইভ বললে–তুমি থাকো, আমি আসছি—

বলে বাইরের ঘরে গিয়ে কিলপ্যাট্রিককে বললে–তুমি এখনই চেহেল্‌-সুতুনে যাও। শিগগির, মরিয়ম বেগমকে নিশ্চয়ই চেহেল্‌-সুতুনে রেখেছে ওরা–

কিলপ্যাট্রিকের সঙ্গে ছোটমশাইও চলে গেল।

উদ্ধব দাসের দিকে চেয়ে ক্লাইভ বললে–পোয়েট, এসো, আমার সঙ্গে ভেতরের ঘরে এসো, তোমার সঙ্গে তোমার ওয়াইফের দেখা করিয়ে দেব

মিরনের জীবনেও সে এক ভারী দুর্যোগের দিন গেছে। প্রথমে বুঝতে পারেনি যে ফিরিঙ্গিবাচ্চা ক্লাইভ তার চেয়েও শয়তান। মিরজাফর সাহেবের কাছে ধমক খেয়ে মেজাজটা বিগড়ে গিয়েছিল। কী করবে বুঝতে পারছিল না। মরিয়ম বেগমসাহেবা তো এতক্ষণ ভগবানগোলার দিকে পৌঁছে গেছে। এখন তাকে কী করে ফিরিয়ে আনবে, আর ফিরিয়ে আনবেই বা কেন? কার খেদমত করবে সে? কে ক্লাইভ? কোথাকার ফিরিঙ্গিবাচ্চা, তাকে কীসের এত খাতির। নবাব তো মিরজাফর সাহেব। মিরজাফর সাহেব তো মুর্শিদাবাদের মসনদে বসেই গেছে বলতে গেলে। তা হলে ক্লাইভের কীসের এত হক!

সামনেই মুখোমুখি দেখা মেহেদি নেসারের সঙ্গে। পাশে ডিহিদার রেজা আলি।

বললে–কী খবর জনাব, মুখ এত গভীর কেন?

মিরন বললে–আর ভাইসাহেব, ফিরিঙ্গিবাচ্চা বড় মুশকিলে ফেলেছে, বলে মরিয়ম বেগমসাহেবাকে হুজুরে হাজির করতে! এখন মরিয়ম বেগমসাহেবাকে পাব কোথায়? বানাব? সে তো জাহাঙ্গিরাবাদের পথে।

সত্যই ভাবনার কথা। মেহেদি নেসার সাহেবও মাথা ঘামাতে বসল। এতক্ষণ ধরে ফিরিঙ্গিবাচ্চা আবদার ধরেছে, ও কি সহজে ছাড়বে!

মিরন বললে–এখন কী করা যায় বলো তো ভাইসাহেব, কর্তা খুব নারাজ হয়েছে আমার ওপর, খুব গালাগালি দিলে আমাকে–

ডিহিদার রেজা আলিও কিছু রাস্তা বাতলাতে পারলে না। বললে–বড়ি মুসিবত হল তো

মেহেদি নেসার বললে–সাহেব যখন একবার আবদার ধরেছে, তখন তো আর সহজে রেহাই দেবে না। ও মরিয়ম বেগমকে আদায় করে ছাড়বেই–

ওদিকে মিরদাউদ সাহেব আসছিল। সঙ্গে মিরকাশিম সাহেব। তারাও সব শুনলে। সত্যিই বড় মুসিবত কি বাত! ফিরিঙ্গিবাচ্চা তো একলা নয়, তার সঙ্গে তার আমির-ওমরা এসেছে। সঙ্গে সেপাই-বরকন্দাজ এসেছে।

হঠাৎ মিরদাউদের মাথায় একটা বুদ্ধি এল।

বললে–জনাব, আমার মাথায় একটা মতলব এসেছে

সবাই আশান্বিত হয়ে উঠল–ক্যা মতলব, ক্যা মতলব?

মিরদাউদ বললে–এক কাজ করো জনাব, নফরগঞ্জ থেকে যে আওরতকে ধরে এনেছি, তাকে ফিরিঙ্গিবাচ্চার কাছে হাজির করে দাও,বলল গিয়ে–এরই নাম মরিয়ম বেগমসাহেবা-সাহেব ঠাহর করতে পারবেনা।

বুদ্ধিটা সকলের বড় পছন্দ হল।

মেহেদি নেসার সাহেব বললে–খুব আচ্ছা মতলব!

ডিহিদার রেজা আলিও বললে–বহোত আচ্ছা মতলব

সেদিন সবাই একবাক্যে স্বীকার করলে এমন নিখুঁত মতলব আর হয় না। ক্লাইভ সাহেব নিজের মহলে গিয়ে তখন অপেক্ষা করছে। দেরি করলে আবার সাহেব গোঁসা করবে। আবার মিরজাফর সাহেবের কাছে গিয়ে তাগিদ দেবে। তখন আবার গালাগালি খেতে হবে মিরজাফর সাহেবের কাছ থেকে। আর দেরি করে ফয়দা নেই

কিন্তু মিরন সাহেবের বাড়িতে গিয়ে বজ্রাঘাত হল সকলের মাথায়। বাড়ির পেছন দিকে সার সার। ঘর। সেখানে নেয়ামতকে ভার দিয়ে রেখেছিল মিরন। মতিঝিলের খিদমদগার নেয়ামতই বলতে গেলে তদারক করছিল সকলের। তার কাছেই ছিল ঘরগুলোর চাবি। নেয়ামত ছাড়া যেসব সেপাই ছিল, তারাও তখন সেখানে কেউ নেই। মহলটা খাঁখাঁ করছে। ঘরগুলোর চাবি খোলা।

বাঁদিরা কোথায় গেল?

মিরন ঘরটার ভেতরে উঁকি দিয়ে ভাল করে দেখলে কোথায় গেল বাঁদিরা!

পাশের ঘরেও তাই। ঘরটা খাঁখাঁ করছে। মিরন তাড়াতাড়ি পাশের ঘরটার ভেতরে ঢুকল। নবাব মির্জা মহম্মদও এই ঘরেই ছিল।

ইয়া আল্লাহ

অন্ধকারের মধ্যে হাতকড়া বাঁধা অবস্থায় নবাব তখন চুপ করে বসে আছে। হয়তো পালিয়েই যেত। কিন্তু শেষপর্যন্ত ঠিক সময়ে মিরন এসে পড়াতে পালাতে পারেনি।

সামনে মিরনকে দেখেই মুখ তুলেছে নবাব। চোখে-মুখে কৌতূহল।–কে? কে তোমরা?

মিরন আর কথার উত্তর দিলে না। তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল।

মিরদাউদ জিজ্ঞেস করলেনবাব আছে অন্দরে?

মিরন বললো জনাব, খোদা বাঁচিয়ে দিয়েছে, নেয়ামতকে ভার দিয়ে গিয়েছিলুম, সে বেটা বেইমানি করে পালিয়েছে। এবার বেটাকে আস্ত কোতল করব–

ভাগ্যিস লুৎফুন্নিসা বেগমসাহেবাকে আগে থেকে সরিয়ে ফেলেছিলুম জনাব, নইলে সে-ও ভেগে যেত

মিরনের সত্যিই তখন আর সময় নেই। এখনই ক্লাইভ সাহেবের ডাক পড়তে পারে। ভেতর থেকে বাড়ির ফটকের পাহারাদারকে ডাকলে।

বললে–মহম্মদি বেগ, নেয়ামত কোথায়?

বেগ বললে–নেয়ামত তো আমাকে কিছু বলে যায়নি হুজুর?

ঘরের চাবি তোর কাছে দিয়ে গেছে?

নেহি হুজুর!

তা হলে নতুন একটা তালা-চাবি জোগাড় করে আন।

তারপর সেই তালা-চাবি এল। নতুন করে আবার মির্জা মহম্মদের দরজায় তালা-চাবি পড়ল। যারা ভেঙ্গেছে, তারা ভাগুক, কিন্তু নবাব যেন না পালায়, দেখিস। খুব হুঁশিয়ার। নবাব ভাগলে সব উলটে যাবে। মিরজাফর সাহেবের নবাব হওয়া ঘুচে যাবে।

তারপর আর সেখানে দাঁড়ালু না মিরন। মিরদাউদ, মিরকাশিম, মেহেদি নেসার, রেজা আলি সবাই পড়ে রইল সেখানে। তাড়াতাড়ি মতিঝিলের ঘাট থেকে আর একটা বজরা নিলে। খুব দেরি হয়ে গেছে।

ওদিকে অনেক দূরে ছ’টা বজরা তখন ভগবানগোলার দিকে ভেসে ভেসে চলেছে। সবচেয়ে পেছনের বজরায় একজন বেগম বোরখা পরে আছে। তার জীবনের চারপাশেও তখন বুঝি বোরখার আড়াল নেমেছে। কোনও দিকেই খেয়াল নেই তার। শুধু একমনে অদৃশ্য দেবতার কছে সে প্রার্থনা করে চলেছে, তুমি তাকে সুখী করো ঈশ্বর। সে যেন মুর্শিদাবাদের পাপ আর পঙ্কিলতা থেকে অনেক দূরে চলে যেতে পারে। অনেক দূরে গিয়ে সে যেন শান্তি পায়। যেন সুখ পায়, সংসার পায়, স্বামী পায়, সন্তান পায়।

বজরাগুলো সার সার ভেসে চলেছে জোয়ারের স্রোতে। ভাটার পর জোয়ার এসেছে। আবার ভাটা আসবে, আবার জোয়ার। জোয়ার-ভাটার টানাপোড়েনে বাঁধা আমাদের জীবন। ইতিহাসেরও বুঝি জোয়ার-ভাটা আছে। সেই জোয়ার-ভাটার টানাপোড়েনে রাজ্য ওঠে, রাজ্য পড়ে, মসনদ একবার খালি হয়, আবার ভরে। শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে যায় এমনি করে। জন্ম থেকে যে-জীবন শুরু হয়, মৃত্যুতেই তার পূর্ণচ্ছেদ পড়ে। কিন্তু মানুষের পৃথিবীর বুঝি মৃত্যু নেই। তাই আবার জন্ম হয়, তারপর আবার মৃত্যু আসে। জন্ম-জন্মান্তরের জীবন তাই অশেষ। শেষের দিকেই তার গতি, কিন্তু সে অশেষযাত্রা। সেই অশেষযাত্রার যে পথিক, তার মনে শঙ্কা নেই, তার মনে বিকার নেই, তার মনে অনুতাপ নেই।

সে শুধু বলে চলেছে তুমি তাকে সুখী করো ঈশ্বর। সে যেন মুর্শিদাবাদের পাপ আর পঙ্কিলতা থেকে অনেক দূরে চলে যেতে পারে। অনেক দূরে গিয়ে যেন সে শান্তি পায়। যেন সুখ পায়, সংসার পায়, স্বামী পায়, সন্তান পায়।

আর-একটা বজরা তখন পেছন থেকে আরও জোরে ছুটে চলেছে। আরও জোরে, আরও বেগে সে ছুটছে। মিরন বজরার পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে দূরে দেখবার চেষ্টা করে। আরও জোরে চালাও, আরও জোরে। দেরি হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে, মুর্শিদাবাদের মসনদ হাতছাড়া হয়ে যাবে

আর ওদিকে চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে তখন দরবার বসেছে। ফুল দিয়ে সাজিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে গেছে মিরন সাহেব।

উমিচাঁদ জগৎশেঠজির পাশেই এসে বসেছে। শুধু উমিচাঁদ নয়, সবাই এসেছে। এসেছে মনসুর আলি মেহের মোহরার, এসেছে মেহেদি নেসার, এসেছে মিরদাউদ, মিরকাশিম, ইয়ার লুৎফ খাঁ, দুর্লভরাম, রেজা আলি, নন্দকুমার। ফিরিঙ্গিদের দলে এসেছে ওয়াটসন, ড্রেক, কিলপ্যাট্রিক, ওয়াটস্, মুনশি নবকৃষ্ণ। কে আসেনি?

বিকেলবেলা যখন উমিচাঁদ টাকার জন্যে ছটফট করেছিল, তখন জগৎশেঠজি সান্ত্বনা দিয়েছিলেন–আপনি অত ভাবছেন কেন, আপনার সঙ্গে যখন চুক্তি হয়েছে, তখন তা ফিরিঙ্গিরা মানবেই

উমিচাঁদের তবু ভয় যায়নি। বলেছিল আমার আর কাউকেই বিশ্বাস নেই জগৎশেঠজি—

জগৎশেঠজি বলেছিলেন কিন্তু আপনিই কি নবাবের বিশ্বাস রেখেছেন উমিচাঁদসাহেব?

একথার কোনও উত্তর দেয়নি উমিচাঁদ।

জগৎশেঠজি জিজ্ঞেস করেছিলেন–ক্লাইভসাহেব কোথায়?

চেহেল্‌-সুতুনের মালখানায় গেছে—

তা আপনি সঙ্গে গেলেন না কেন?

আমাকে সঙ্গে নিলে না। সঙ্গে গেল মুনশি নবকৃষ্ণ।

তারপর?

তারপর আর কী! তারপর থেকে তো আমার সঙ্গে দেখাই করছে না সাহেব। আর তারপর তো আপনার সঙ্গে এখানে এলুম। এখানে এসেও তো সাহেব ব্যস্ত

মনসুর আলি কাগজে লেখা নামগুলো একে একে পড়ছে; আর মিরজাফর সাহেব এক-একজনকে নজরানা দিচ্ছে।

গুলসন বেগম!

বশির মিঞা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল একপাশে। মনসুর আলি মেহেরও দাঁড়িয়ে ছিল। মিরজাফর আলি মসনদের ওপর বসে আছে। নিজামত সরকারের আমলা-ওমরাও সবাই হাজির। সারা মুর্শিদাবাদের লোক আজ শহর-গ্রাম-জনপদ ঝেটিয়ে এসে চেহেল্‌-সুতুনের আম-দরবারে হাজির হয়েছে। সবাই ভেতরে ঢুকতে পায়নি, সবাইকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সকাল থেকেই করোরিয়ান, চৌধুরিয়ান, জমিদারানরা হাজির ছিল। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রও সামনে বসে ছিলেন।

গুলশন বেগমের নাম উঠতেই পেছনের খিড়কি দরজা খুলে এসে হাজির হল একজন। সঙ্গে বাঁদি।

মিরজাফর খাঁ বললেন–এসব আপনার হুজুর, আপনি নিন

সমস্ত বন্দোবস্ত আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। হারেমের খোজা সর্দার পিরালিকে আগে থেকেই হুকুম দেওয়া ছিল। মতিঝিল থেকে আনিয়ে নিয়ে এসে গুনে গুনে রেখে দিয়েছিল চেহেল্‌-সুতুনে। সমস্ত বেগমরা সকাল থেকে সাজতে গুজতে শুরু করেছিল। চোখে সুর্মা দিয়েছিল। বুকে বুটিদার কাঁচুলি পরেছিল। নখে মেহেদি রং লাগিয়েছিল। ঘাগরা, চোলি, ওড়নি, কিছুই বাদ যায়নি।

পেশমন বেগম!

আজ আর কারও কোনও অভিযোগ নেই। অবশ্য অভিযোগ ছিলও না কোনওদিন। নবাব-হারেমে অভিযোগ থাকতে নেই কারও। তারপর আর একজন। নহবত-মঞ্জিলে এতক্ষণ মিঞা-কি-মল্লার বাজাচ্ছিল ইনসাফ মিঞা।

ছোটে শাগরেদ প্রাণপণে তবলায় চাটি দিয়ে চলেছে।

তক্কি বেগম!

সত্যিই ভাঁটার পর জোয়ার এসেছে। আবার ভাটা আসবে। তারপর আবার জোয়ার। শতাব্দীর পর শতাব্দী এমনি করেই কেটে যাবে। জন্ম থেকে যে-জীবন শুরু হয়, মৃত্যুতেই তার পূর্ণচ্ছেদ পড়বে। কিন্তু মানুষের পৃথিবীর বুঝি মৃত্যু নেই। তাই আবার জন্ম হয়, আবার মৃত্যু আসে। জন্ম-জন্মান্তরের জীবন। তাই অশেষ। শেষের দিকেই তার গতি, কিন্তু সে অশেষযাত্রা। সেই অশেষযাত্রার যে পথিক তার মনে শঙ্কা নেই, তার মনে বিকার নেই, তার মনে অনুতাপ নেই। সে শুধু বলে চলেছে তুমি তাকে সুখী করো ঈশ্বর। সে যেন মুর্শিদাবাদের পাপ আর পঙ্কিলতা থেকে অনেক দূরে চলে যেতে পারে। অনেক দূরে গিয়ে সে যেন শান্তি পায়। সে যেন সুখ পায়, সংসার পায়, স্বামী পায়, সন্তান পায়।

মরিয়ম বেগম।

হঠাৎ সব ওলোটপালোট হয়ে গেল। মনসুর আলি মেহের সাহেব নাম ধরে ডাকলে। মিরজাফর আলি সাহেব চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগল। কেউ এল না।

এ-ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। এগারোজন বেগম এসে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে গেছে। মিরজাফর সাহেব অস্থির হয়ে পেছন দিকে চাইতে লাগল। মিরন কোথায়? মিরন?

মিরদাউদ সাহেব চাইলে একবার মিরকাশিম সাহেবের দিকে। মেহেদি নেসার সাহেব চাইলে রেজা আলির দিকে। কিন্তু সবাই বোবা।

মরিয়ম বেগম?..

নহবত-মঞ্জিলে ছোটে শাগরেদ হঠাৎ বলে উঠল–চাচা!

ইনসাফ মিঞা তখন মিঞা-কি-মল্লারে নিখাদে গিয়ে সবে ঠেকেছে। সুরটা থামিয়ে চাইলে ছোটে শাগরেদের দিকে।

ছোটে শাগরেদ বললে–চাচা, মরিয়ম বেগমসাহেবার পাত্তা মিলছে না—

মিরজাফর আলির মাথায় যেন তখন বজ্রাঘাত হয়েছে। খোজা সর্দার পিরালির দিকে একবার চাইলে। বরকত আলি, নজর মহম্মদ তারাও কিছু হদিশ দিতে পারলে না।

ক্লাইভ সাহেব চুপ করে বসে ছিল। মিরজাফর আলি কথা দিয়েছিল, আম-দরবারে মরিয়ম বেগমসাহেবাকে হাজির করা হবে। কিন্তু কোথায় কী।নবাব মির্জা মহম্মদের বারোজন বেগমের মধ্যে এগারোজনকে পাওয়া গেল। আর একজনকে পাওয়া গেল না। কোথায় গেল সে?

মরিয়ম বেগম! মরিয়ম বেগম।

মুর্শিদাবাদ থেকে অনেক দূরে মিরনের বজরাটা তখন আরও জোরে ছুটে চলেছে। আরও বেগে। এতক্ষণ ছ’টা বজরা বেগমদের নিয়ে বোধহয় ভগবানগোলার দিকে পৌঁছে গেছে। জোরসে চালাও মাঝি, জোরসে চালাও ।

কিন্তু অশেষযাত্রার পথিক তখন একমনে প্রার্থনা করে চলেছে–তুমি তাকে সুখী করো ঈশ্বর। সে যেন মুর্শিদাবাদের পাপ আর পঙ্কিলতা থেকে অনেক দূরে চলে যেতে পারে। অনেক দূরে গিয়ে সে যেন শান্তি পায়। সে যেন সুখ পায়, সংসার পায়, স্বামী পায়, সন্তান পায়।

চেহেল্-সুতুনের আম-দরবারে মিরজাফর সাহেব তখন শেষবারের মতো ডাকলে–মরিয়ম বেগম!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress