Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বেগম মেরী বিশ্বাস || Bimal Mitra » Page 16

বেগম মেরী বিশ্বাস || Bimal Mitra

আমি জানি, তোমরা সকলে আমার সামনে মুখোশ পরে আছ। আমি মুখে কিছু বলছি না, কিন্তু মিরজাফর আলি সাহেব, তুমি আর আমাকে প্রবঞ্চনা করতে পারবে না। আমাকে তুমি অর্বাচীন ভেবে এতদিন অবজ্ঞা করেছ। আর আমিও তোমাকে যখন-তখন অপমান করে বুঝতে দিয়েছি যে, আমি অর্বাচীন নই। কিন্তু এখন তোমার বুদ্ধির সঙ্গে আমার বিপদের মোকাবিলা হোক!

আচ্ছা মিরজাফর আলি সাহেব, আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, আপনি এখানে আসবার আগে আমার সামনে কোরান ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, আপনি আমার বিরুদ্ধাচরণ করবেন না?

মিরজাফর আলি এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নবাবের সব কথা শুনছিল। এতক্ষণে উত্তর দিলে। বললে–সেকথা তো আমি এখনও বলছি আলি জাঁহা!

আপনি সত্যিই আমার বিরুদ্ধাচরণ করবেন না? আপনি সত্যি বলছেন?

হ্যাঁ, আলি জাঁহা। সত্যি বলছি!

নবাব মির্জা মহম্মদ আর নিজেকে সংবরণ করতে পারলে না। উঠে দাঁড়িয়ে মিরজাফর আলিকে জড়িয়ে ধরলে।

বললে–কিন্তু তা হলে আমার বড় ভয় করে কেন আলিসাহেব!

কীসের ভয় আলি জাঁহা?

কেন মনে হয় আপনি আমার দলে নন, আপনি ওদের দলে আলিসাহেব? মনে হয় আমার কেউই নেই, আমি একলা আর আমার চারপাশে কেবল সব দুশমন! আমি কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না কেন আলিসাহেব? আপনি থাকতে আমি কেন এত অসহায় মনে করছি নিজেকে?

মিরজাফর মির্জার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললে–আপনি স্থির হন আলি জাঁহা।

আপনারা সবাই বিরুদ্ধে গেলে আমি কেমন করে স্থির হয়ে থাকি আলিসাহেব? আমার মাথার ওপরে এত দায়িত্ব নিয়ে আমি কী করে স্থির হতে পারি? আপনারা যখন কাল রাত্রে সবাই চলে গেলেন, তারপর থেকে কি আমি ঘুমিয়েছি? জানেন আলিসাহেব, আমার সোনার কলকেটা পর্যন্ত কে চুরি করে নিয়ে গেছে, তাবুর কাপড়টা কে খানিকটা ছুরি দিয়ে কেটে নিয়ে গেছে। এরা কি মনে করেছে আমি মারা গিয়েছি? আমার মরা পর্যন্তও কি এরা অপেক্ষা করতে চায় না? নিজামত কি নেই? খোদাতালাহও কি মারা গেছে বেহেস্তে? দুনিয়ার ইনসান কি সবাই জানোয়ার হয়ে গেছে?

মিরজাফর সাহেব বললে–আপনি চুপ করুন আলি জাঁহা, আমি তো আছি

কিন্তু কোথায় আছেন আপনি? সকাল থেকে দু’শো-তিনশো সেপাই আমার মারা গেল, আপনারা তো কিছুই করলেন না। ওই দেখুন, আমার মিরমদন এখনও আমার সামনে পড়ে রয়েছে, ও কিছু শুনতে পাচ্ছে না, কিন্তু আপনারা তো কর্নেল ক্লাইভকে মেরে ওর বদলা নিতে পারলেন না?

আপনাকে কিছু ভাবতে হবে না আলি জাঁহা, আমি তো বলছি আমি আছি

মির্জা মহম্মদ বললে–আপনি আছেন তো বলছেন, কিন্তু আমি কেমন করে বিশ্বাস করব যে আপনি আছেন? আপনি কখন কাজ করে দেখাবেন যে আপনি আছেন? আপনার ফৌজরা যে গুলি ছুঁড়েছে তার কি একটাও ফিরিঙ্গিদের ফৌজের ওপর গিয়ে পড়েছে? শুধু আপনি কেন, রাজা দুর্লভরাম, ইয়ার লুৎফ খাঁ তারাই কি একটা ফিরিঙ্গি ফৌজের গায়ে আঁচড় কাটতে পেরেছে? তা হলে আমি কেমন করে বুঝব যে আপনারা আমার পেছনে আছেন? একবার আমি হালসিবাগান থেকে ইজ্জত হারিয়ে পালিয়ে এসেছি, এবারও কি আমি আমার, আপনার, হিন্দুস্থানের সকলের ইজ্জত নিয়ে পালিয়ে যাব বলতে চান? বলুন, আপনার কী মতলব আলিসাহেব, চুপ করে থাকবেন না, কথা বলুন?

হঠাৎ ওদিক থেকে একটা কামানের বিকট শব্দ কানে এল।

ওই দেখুন আলিসাহেব, ওদের কামানের কেমন শব্দ হয়, আমাদের কামানের শব্দ নেই কেন? আমাদের কামানগুলো কি খারাপ? আমাদের কামানগুলো কি ভোঁতা?

মিরজাফর আলি তাড়াতাড়ি বাইরে চলে যাচ্ছিল।

বললে–আমি যাই, দেখে আসি আলি জাঁহা–

না, যাবেন না, আপনি দাঁড়ান আলিসাহেব, আপনার সঙ্গে কথা আছে। আজ আমি সব কথার ফয়সালা করে ফেলতে চাই। আমার মিরমদন বেঁচে থাকলে আজ আমি আপনাকে এমন করে বলতাম না, সে চলে গিয়ে আমাকে খোঁড়া করে দিয়ে গিয়েছে–

মিরজাফর আলি কথার মধ্যেই হঠাৎ বললে–কেন আলি জাঁহা, আপনার মিরমদন নেই বটে, কিন্তু আপনার মোহনলাল তো আছে–

আপনি দেখছি এখনও সেই কথা ভুলতে পারেননি আলিসাহেব! আমি জানি আপনি এখনও এই বিপদের সময়েও আমার ওপর রাগ করে আছেন। কিন্তু সত্যি বলুন তো, আপনার সঙ্গে কি মোহনলালের তুলনা?

মিরজাফর আলি সাহেব চুপ করে রইল।

আপনার কাছে শুধু একটা অনুরোধ, আর একটা দিন আমার যুদ্ধটা চালিয়ে দিন আপনি আলিসাহেব, যেমন করে হোক চালিয়ে দিন, তারপরে আর আমার ভাবনা নেই। জেনারেল ল’ কাল কিংবা পরশুই এসে পড়বে, তখন আর আপনাকে আমি বিরক্ত করব না–বলুন আপনি চালিয়ে যাবেন?

ইয়ারজান পাশেই দাঁড়িয়ে সব শুনছিল।

এতক্ষণে বললে–হ্যাঁ, আলিসাহেব, এমন সময় আপনি আর না’ বলবেন না–আপনি বলুন ‘হ্যাঁ’, আপনার ওপর বাংলা মুলুকের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে

ওদিকে তখন কর্নেল ক্লাইভ চিৎকার করে উঠেছে–কিলপ্যাট্রিক

কিলপ্যাট্রিকের সোলজাররা তখন দেখা গেল পেছন দিকে হটে আসছে। মেজর কিলপ্যাট্রিক তার সৈন্যদের সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে খালের দিকে।

স্টপ, স্টপ দেয়ার

দৌড়োতে দৌড়োতে ক্লাইভ সোজা মেজর কিলপ্যাট্রিকের সামনে গিয়ে হাজির।

কী করছ? ওদের হটাচ্ছ কেন?

মেজর কিলপ্যাট্রিক বললে–ওপাশ থেকে এনিমি এবার ফায়ারিং বন্ধ করেছে, সেই জন্যেই হাইড-আউটের মধ্যে ওদের সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি–

কিন্তু আমি তো চাই এনিমি সামনে এগিয়ে আসুক!

সামনে এগিয়ে এলে আমরা ওদের আর্মির কাছে যে পিষে মারা যাব।

ক্লাইভ রেগে গেল আরও। বললে–কিন্তু আমরা পেছিয়ে এলে যে ওরাও পেছিয়ে যাবে

মেজর কিলপ্যাট্রিক বললে–কিন্তু তাতে ক্ষতি কী? আমাদের আর্মি একটু রেস্ট পাবে।

কিন্তু রেস্ট আগে না ভিক্টরি আগে?

আমার সোলজাররা মারা গেলে কারা ভিক্টরি আনবে?

তুমি তর্ক কোরো না। ডোন্ট আ। লেট দ্য সোলজার্স গো অ্যাহেড, কামান-বন্দুক নিয়ে সবাই এগিয়ে যাক সামনের দিকে, তা হলেই এনিমি-লাইনস এগিয়ে আসবে! আমি তো তাই-ই চাই আমি এ-যুদ্ধ প্রোলং করতে চাই না। জেনারেল ল’ আসবার আগেই আমি ওয়ার খতম করে দিতে চাই–গো অন, ফায়ার, ব্যাটালিয়ান, ফরওয়ার্ড, কুইক, ফায়ার….

হঠাৎ ফিরিঙ্গি আর্মির সেপাইদের মধ্যে যেন বিদ্যুৎপ্রবাহ খেলে গেল। ফরওয়ার্ড, কুইক, ফায়ার। কুড়িজন ইংলিশ আর্মির লোক মারা গেছে, যাক। কিন্তু কোম্পানির জন্যে আমাদের সবকিছু স্যাক্রিফাইস করতে হবে। দরকার হলে মরতে হবে। উই মাস্ট ডু অর ডাই… ফায়ার… ফায়ার…

খবরটা ঘসেটি বেগমের কানেও গেছে। আমিনা বেগমসাহেবার কানেও গেছে। এক-একজন নিজের মহলে বসে ধ্বরটা শুনেছে আর বাঁদিদের ডেকে জিজ্ঞেস করেছে কী হয়েছে রে বাঁদিক্যা হুয়া?

একদিন নবাব আলিবর্দি খাঁ’র আমলে মেয়েরা সব পরামর্শ করত বাপজানের সঙ্গে। কেমন করে মসনদ চালাতে হয় তারই পরাম। দরকার হলে যে তোমার উপকার করবে তাকেও খুন করতে পেছোলে চলবে না। এদুনিয়াটা শুধু সততা দিয়ে চলে না বেটি, চলে ষড়যন্ত্র করে, খুনখারাবি করে আর মোহরের জোরে। আমি তো সোজা সরল পথে মসনদ পাইনি। নবাবি নীতিতে একে অসৎ পথ বলে না। যতক্ষণ মসনদ আমার, ততক্ষণ আমিই নবাব। তুমি যদি তা কেড়ে নিতে পারো তো তখন তুমিই নবাব। এই-ই দুনিয়া। সুতরাং যে-কোনও রকমে মসনদ আঁকড়ে ধরে রাখতে হবে। মসনদে যতক্ষণ তুমি বসে আছ ততক্ষণ সবাই তোমাকে কুর্নিশ করবে। তুমি যেই সরে যাবে, তখন সবাই কুর্নিশ করবে অন্য লোককে। একানুন চিরকালের কানুন, একানুন খোদাতালাহ আল্লাহর কানুন। একানুন বদলায় না, বদলায়নি, বদলাবে না কখনও!

তখন আমিনা বেগম, ঘসেটি বেগম, ময়মানা বেগম সবাই ছোট। সেই ছোট বয়েস থেকেই বাপজানের কাছে শুনে এসেছে এসব কথা। শিখে এসেছে কাকে বলে নবাবি, কাকে বলে ষড়যন্ত্র, কাকে বলে খুনখারাবি!

তারপর একে একে সবাই বড় হয়েছে, সকলের বিয়ে হয়েছে। সবাই দেখেছে মানুষের জীবনের একমাত্র সাধ হওয়া উচিত বাংলা মুলুকের মসনদ পাওয়া। তার জন্যে যদি পরপুরুষের সঙ্গে এক বিছানায় শুতে হয় তাতেও আপত্তি করতে নেই। তাতে তোমার জাত যাবে না, বরং ইজ্জত বাড়বে। ইজ্জত শুধু থাকে টাকায়, থাকে প্রতিষ্ঠায় প্রতিপত্তিতে আর খেতাবে। মেয়েরা বরাবর জেনে এসেছে টাকা থাকলেই তোমার সব রইল। চরিত্র-স্বভাব ওগুলো গ্রামের সাধারণ মানুষদের জন্যে। আমির-ওমরাহ-বেগমের ওসব থাকতে নেই। ওগুলো উন্নতির পথে বাধা কেবল।

সুতরাং ওড়াও ফুর্তি, টাকা কামাও আর কীসে আরও প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ে তার জন্যে ষড়যন্ত্র করো।

কিন্তু মুশকিল শুরু হল মির্জা মহম্মদ নবাবি পাবার সঙ্গে সঙ্গেই।

ষড়যন্ত্রের যেন জাল গড়ে উঠল নিজামতে। প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল আমিরে-আমিরে ওমরাহে-ওমরাহে আর বেগম-বেগমে।

আমিনা বেগমের সঙ্গে ঝগড়া শুরু হল মির্জা মহম্মদের। মির্জা মহম্মদের সঙ্গে ঝগড়া শুরু হল ঘসেটি বেগমের। ঘসেটি বেগমের সঙ্গে ঝগড়া শুরু হল আমিনা বেগমের। কার সঙ্গে কার ঝগড়া বাধল না সেইটেই বলা শক্ত হয়ে দাঁড়াল।

সকলেই ভাবলে কবে মির্জা মহম্মদ মরে। মির্জা মহম্মদ মারা গেলেই যেন মসনদটা তারই ভাগে আসবে!

যে বাঁদিটা খবর এনেছিল সে বকশিশ পেয়ে গেল একটা মোহর।

তুই ঠিক শুনেছিস তো?

হ্যাঁ ছোটি বেগম, আমি ঠিক শুনেছি।

কার কাছে শুনলি?

খোজা সর্দার পিরালি খাঁ-ও বলছিল, বরকত আলিও বলছিল।

নানিবেগমসাহেবা কোথায়?

মতিঝিলে, ওরা দু’জনেই তো নানিবেগমসাহেবাকে ডেকে আনতে গেছে ছোটি বেগম।

ছোটি বেগম আর দেরি করলে না। অনেক দিন ধরে নজরবন্দি হয়ে ছিল চেহেল্‌-সুতুনে। সেই মতিঝিল! কত সাধের মতিঝিল তার। মতিঝিলের এক-একটা পাথরের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল ঘসেটি বেগমের জীবন। জাহাঙ্গিরাবাদে স্বামীকে রেখে মতিঝিলের মধ্যেই তো কাটত তার দিন। আলিবর্দি খাঁ আদর করে বড় মেয়ের নাম দিয়েছিল মেহেরুন্নিসা। তাই থেকে শেষকালে মেহের। রাজা রাজবল্লভও তাকে আদর করে মেহের বলেই ডাকত। হোসেনকুলি খাঁ অনেক রাত্রে লুকিয়ে লুকিয়ে আসত তার শোবার ঘরে। এসে ডাকত–মেহের’। আর শেষ পর্যন্ত ছিল নজরকুলি খাঁ। আঃ, কী খুবসুরতই না চেহারা ছিল নজরকুলির। মার্বেল পাথরের মতো তেলা-তেলা হাত-পা-মুখ-চোখের গড়ন। ছোটি বেগম পাগল হয়ে গিয়েছিল সেই নজরকুলিকে দেখে।

আজ সব কোথায় গেল তারা!

ঘসেটি বেগম বললে–দ্যাখ তো, বাইরের ফটকে পাহারাদার আছে কে?

বাঁদিটা বললে–কেউ নেই ছোটি বেগম, আজ সব বিলকুল বেসামাল হয়ে গেছে চেহেল্‌-সুতুন—

আর নবাব? নবাবের সঙ্গে কেউ আসেনি?

নবাব একলা লড়াই থেকে ওয়াপাস এসেছে ছোটি বেগম। এসেই চেহেল্‌-সুতুনে লুৎফুন্নিসা বেগমসাহেবার মহলে গিয়েছিল, সেখান থেকে আমির-ওমরাহদের তলব দিয়েছে মোলাকাত করবার জন্যে–

কেন?

নবাব আবার ফৌজ বানাবে শুনছি, নয়া ফৌজ। সেই নয়া ফৌজ নিয়ে ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই করবে!

ঘসেটি বেগম সব শুনলে। তারপর বললে–তুই একটা কাজ করতে পারবি রাবেয়া, আমাকে তোর পেশোয়জ দিতে পারবি? তুই আমার সাজ-পোশাক পরে আমার ঘরে বসে থাক, আমি তোর পোশাক পরে একবার চেহেল্-সুতুনের বাইরে যাব

কেন ছোটি বেগম, বাইরে যাবেন কেন?

ঘসেটি বেগম বললে–শিগগির দে, আর বখত নেই, এই-ই আমার সুযোগ। এ-সুযোগ ছাড়লে আর সুযোগ আসবে না জীবনে

কিন্তু, যদি কেউ দেখতে পায় আপনাকে ছোটি বেগম? যদি কেউ ধরে ফেলে?

কে আর ধরবে রে? সবাই তো এই সুযোগই খুঁজছিল। এতদিন পরে যদি সুযোগ এসেছে তো একে আমি ছাড়ব না, দে তোর পোশাকটা দে

রাবেয়া নিজের পোশাকটা খুলে দিলে ছোটি বেগমকে।

বহুদিন আগে একদিন ঘসেটি বেগম মনে মনে একটা ক্ষীণ আশা পোষণ করেছিল যে, একদিন বড় হয়ে তারই ছেলে মুর্শিদাবাদের মসনদে বসবে। ঘসেটি বেগম সেই ছেলের আড়ালে বসে এই বাংলা বিহার-উড়িষ্যা মুলুকের মালকিন হবে। কিন্তু সেছেলে চলে গিয়েছিল। তারপর কোলে টেনে নিয়েছিল। আমিনার ছেলেকে। সে এক্ৰামুদ্দৌলা। সেও একদিন মারা গেল। তার এগারো বছর বয়সেই ঘসেটি বেগমের সব আশা চুরমার করে দিয়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু এবার? এবার কেমন করে আমাকে ঠেকাবে তুমি মির্জা মহম্মদ?

আপনি এখন কোথায় যাবেন ছোটি বেগম?

তোর কোনও ভয় নেই রাবেয়া। আমি ফিরে আসব। মুর্শিদাবাদের মসনদ এই আমিই নেব।

কিন্তু যাবেন কোথায়?

তুই কাউকে বলবি না বল?

না, কাউকে বলব না ছোটি বেগম। আমি শুধু জেনে রাখব

ঘসেটি বেগমের তখন সাজ-পোশাক বদলানো হয়ে গেছে। বললে–যাব নজরকুলি খাঁ’র কাছে–

নজরকুলি খাঁ?

রাবেয়া জানত নজরকুলি খাঁর কথা। একদিন সেই নজরকুলি খাঁই কত টাকা কত মোহর ঠকিয়ে নিয়েছে ছোটি বেগমের কাছ থেকে। যেদিন নবাব মতিঝিলে হামলা করে ঘসেটি বেগমকে বন্দি করে নিয়ে চেহেল্‌-সুতুনে পোরে, সেদিন সেই নজরকুলি খাঁ-ই ঘসেটি বেগমের মোহর-হিরে-জহরত সোনা-চাদি ফৌজের সেপাইদের হাত করবে বলে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল, আর আসেনি। আজ এতদিন পরে সেই নজর কুলি খাঁ’র কাছে যাবে ছোটি বেগম?

তুই একবার বাইরে গিয়ে দেখে আয় তো রাবেয়া, সামনে কেউ আছে কিনা

রাবেয়া মহলটার ফটকে গিয়ে উঁকি মেরে চারদিকে দেখলে। চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে কারা যেন। কথা বলছে। কারা যেন ত্রস্ত পায়ে এদিক থেকে ওদিকে যাচ্ছে। সব ওলোটপালোট, সব বিশৃঙ্খল হয়ে গেছে চারদিকে। ইনসাফ মিঞা নহবত বাজাতে বাজাতে হঠাৎ থামিয়ে দিয়েছে টোড়ি রাগের আলাপ। আবছা আবছা আলো-অন্ধকারের মধ্যে চেহেল্‌-সুতুনের চেহারাটা যেন আমূল বদলে গেছে। ভোরবেলায় চেহেল্‌-সুতুনের কোনও স্পন্দন এমনিতেই থাকে না। এমনিতেই সবাই ঘুম থেকে দেরি করে ওঠে। তারই মধ্যে আজ প্রথম ব্যতিক্রম হয়েছে।

ঘসেটি বেগম নিঃশব্দে পা বাড়াল।

অন্যদিন পাহারাদার মোতায়েন থাকে মহলের ফটকে। কড়া নজর রাখে ঘসেটি বেগমের মহলের ওপর। আজ ফাঁকা রয়েছে সব। কেউ নেই কোথাও। দূরে কোথাও কারও পায়ের শব্দ হল যেন। ঘসেটি বেগম বাদির বোরখা পরেছে, কারও চিনতে পারার কথা নয়। তবু ভয়ে ভয়ে এগোতে হয়। অথচ আবিদি খা’র সময়ে এই চেহেল্‌-সুতুনের মধ্যেই কত প্রতাপ ছিল তার, কত দাপট। নবাবের বড় মেয়ে, কোনওদিন কোনও জিনিস মুখ ফুটে চাইতে হয়নি। না-চাইতে পাওয়াটাই সেই বড় মেয়ের নিয়ম। শুধু যে-একটা জিনিস মন-প্রাণ দিয়ে চেয়েছিল সেইটেই এখনও পাওয়া বাকি রয়েছে। সে এই মসনদ।

কে? কৌন?

আগে হলে এক ধমক দিত চেহেল্-সুতুনের ছোটি বেগম। কিন্তু আজ তার অন্য পরিচয়। আজকের পরিচয় নিয়ে মাথা উঁচু করে কথা বলা বেমানান। আজকে শুধু কুর্নিশ করার পরিচয়, আজকে শুধুহুকুম তামিল করার পরিচয় তার।

যেশব্দটা একবার দূর থেকে আঘাত করেছিল, সে তার সাড়া না পেয়ে আবার আরও জোরে তাগিদ দিলে–কৌন হ্যায়?

একবার মনে হল ধমক দেয় উল্লুকটাকে দুর বেল্লিক

কিন্তু তখনই নিজেকে সামলে নিয়ে জবাব দিলে–ম্যায় রাবেয়া হুঁ —

কৌন রাবেয়া?

ঘসেটি বেগম কি বাঁদি!

আর কোনও বাধা নেই। আর একটা ফটক পেরোতে পারলেই একেবারে বাইরের দুনিয়া। তখন নজরকুলি খাঁ আছে, নিজে আছে, আর আছে মোহর, আর সোনার গয়না। বহু উপহার জীবনে পেয়েছে। বাপজানের কাছ থেকে, রাজা রাজবল্লভের কাছ থেকে, নজরকুলির কাছ থেকে। বেগমের কাছ থেকে তারা নিয়েছে অনেক, কিন্তু তারই মধ্যে কিছু কিছু উপহার হয়েও ফিরে এসেছে। এতদিন গায়ের গয়না হয়ে সেগুলো তার শুধু রূপের বাহার বাড়িয়েছে, জওয়ানির বাহার বাড়িয়েছে। এবার সেগুলো ইজ্জতের বাহার বাড়াক।

তুমি আমাকে ভয় পেয়ে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে নজরকুলি খাঁ। তুমি আমাকে মদত দেবে বলে আমার হিরে-জহরত-মোহর-সোনা-চাদি সবকিছু নিয়ে আর ফিরে আসেনি। কিন্তু তোমার সেই শ্বেতপাথরের মতো হাত-পা বুক-চোখের কথা আমি ভুলতে পারিনি। আমি শুনেছি তুমি জুয়ায় সব টাকা নষ্ট করেছ, কিন্তু তবু আমি তোমাকে ভুলতে পারিনি নজরকুলি৷ তুমি কাশি থেকে ফিরে এসে আবার চকবাজারের খুলিতে এসে উঠেছ। আমার সঙ্গে কতদিন মোলাকাত করবার জন্যে কোশিস করেছ। তখন তোমার সঙ্গে দেখা করবার এক্তিয়ার ছিল না আমার, কিন্তু এবার এক্তিয়ার মিলেছে। এবার তুমি আমাকে মদত দাও নজরকুলি খাঁ। এবার আমার দুশমন খতম হয়েছে। নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা বরবাদ হয়েছে। এই-ই সুযোগ নজরকুলি খাঁ, এই সুযোগ! এবার তুমি আমাকে মদত। দাও

চকবাজারের রাস্তায় তখন বেশ ভিড়। সবাই কি জানতে পেরেছে নবাব লড়াইতে হেরে ফৌজ ছেড়ে পালিয়ে এসেছে? রাস্তার এক পাশ দিয়ে চলতে চলতে কেমন ভয়-ভয় করতে লাগল ঘসেটি বেগমের। সবাই জিজ্ঞেস করছে সবাইকে-ক্যা হুয়া হ্যায় ভাইয়া?

তবে কি কেউ জানে না এখনও?

অল্প অল্প আলো ফুটতে আরম্ভ করেছে পুব দিকের মঞ্জিলের মাথায়। জুম্মা মসজিদের মিনার চারটি ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে আসমানের গায়ে হেলান দিয়ে। ঘসেটি বেগম আরও জোরে পা চালিয়ে দিলে।

কিন্তু জীবনে কখনও পায়ে হেঁটে যে বাইরে বেরোয়নি, তার কি অত জোরে পা চালানো পোষায়!

পেছন থেকে কারা যেন শিস দিয়ে উঠল।

ঘসেটি বেগম আরও ভয় পেয়ে গেছে।

ওরে ইয়ার, চেহেলসতুনের গেম রে, পায়দলে চলেছে!

দুর ইয়ার, বেগম নয় রে, বাদি ও

কোনওরকমে তাদের এড়ানো গেল, কোনওরকমে আর কিছু দূর গেলেই নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। তোমার সব পাত্তা আমাকে আমার বাদি দিয়েছে, নজরকুলি খাঁ। আমি শুনেছি তুমি খুব কষ্টে আছ। তুমি খুব তকলিফে আছ। কিন্তু আমি কী করব বলো? আমাকে যে এতদিন নজরবন্দি করে রেখেছিল ওই শয়তানটা। আমি কেমন করে তোমার সঙ্গে দেখা করব বলো?

আজ আমি স্বাধীন, নজরকুলি খাঁ। আমি আমার যা কিছু আছে সব এনেছি সঙ্গে করে। আমার যে গয়না আছে সঙ্গে, তারই দাম নি লাখ টাকা। এই তিন লাখ টাকা দিয়ে তুমি ফৌজ বানাও নজরকুলি খাঁ। নবাব এখন ফতুর হয়ে গেছে। নবাবের এখন ফৌজ নেই, টাকা নেই, মোহর নেই, আমির নেই। এই সময়েই তুমি চেহেলসূতুনে হামলা করে। তারপর যেমন করে মির্জা মহম্মদ হোসেনকুলি খাঁ-কে খুন করেছে, তেমনি করে তুমি সেই খুনের বদলা নাও নজর কুলি খাঁ

ঘসেটি বেগম বোরখার ভেতরে জেবরের পুঁটলিটা ভাল করে আঁকড়ে ধরল।

কৌন হো তুম?

ঘসেটি বেগম একেবারে সামনাসামনি পড়ে গেছে একজনের। তাড়াতাড়ি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু লোকটা সামনে পথ আটকে দাঁড়াল।

বললে–কোনও ডর নেই, বলো তুমি কে?

ঘসেটি বেগম বললে–আমি ঘসেটি বেগমের বাঁদি—

নাম কী?

রাবেয়া।

বোরখার ভেতর মুখের চেহারা দেখা যায় না। তবু যেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে ভেতরটা দেখবার চেষ্টা করলে লোকটা।

তারপর বললে–কোথায় যাচ্ছ তুমি এখন?

ঘসেটি বেগম কী বলবে বুঝতে পারলে না। অথচ জবাব না দিলেও রেহাই নেই লোকটার হাত থেকে।

বলো, কোথায় যাচ্ছ তুমি এখন?

নজরকুলি খাঁ’র হাবেলিতে!

নজরকুলি খাঁ’র হাবেলি কোথায়? সে তো ঝুপড়ি! সে তোমার কে হয়?

আমার ভাই!

সেখানে এখন যাচ্ছ কেন?

ঘসেটি বেগমের ইচ্ছে হল লোকটার গালে এক চড় কষিয়ে দেয়। কিন্তু ধরা পড়ে যাবার ভয়ে চুপ করে রইল।

বলল, এখন সেখানে যাচ্ছ কেন?

ঘসেটি বেগম বললে–চেহেল্‌-সুতুন থেকে পালিয়ে এসেছি, সেখানে গোলমাল বেধেছে।

লোকটা যেন একটু চুপ করে রইল।

তারপর বললে–নজরকুলি খাঁর বাড়ির রাস্তা তুমি চিনতে পারোনি, রাস্তা ভুল করেছ, তুমি আমার সঙ্গে এসো

ঘসেটি বেগম তখনও নড়ে না দেখে লোকটা ধমক দিয়ে উঠল। বললে–এসো

ঘসেটি বেগম কোনও উপায় না দেখে লোকটার সঙ্গে চলতে লাগল। আশেপাশে সবাই তাদের দিকে চেয়ে দেখছে। ভালই হল, এবার আর কেউ তাকে বিরক্ত করবেনা। লোকটা তাকে ঠিক রাস্তায় পৌঁছে দেবে।

তুমি আগে কখনও নজরকুলি খাঁ’র বাড়িতে গিয়েছিলে?

ঘসেটি বেগম বললে–না

তবে? তুমি তো মহিমাপুরের দিকে যাচ্ছিলে। ওটা তো মতিঝিলের রাস্তা। আর নজরকুলি খাঁ তো থাকে চকবাজারের রাস্তায় এসো আমি তোমাকে ঠিক জায়গায় পৌঁছিয়ে দিচ্ছি

ঘসেটি বেগম আর কোনও কথা না বলে লোকটার সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগল।

কিন্তু নজরকুলি খাঁ’র বাড়ির সামনে অনেক ডাকাডাকি করেও তাকে পাওয়া গেল না। একটা চাকর বাইরে বেরিয়ে এসে বললে–খাঁ সাহেব কাল রাতে বেরিয়েছে, এখনও বাড়ি ফেরেনি!

কখন ফিরবে?

তার কোনও ঠিক নেই বাবুজি! না-ও ফিরতে পারে।

ঘসেটি বেগম কেমন হতাশ হয়ে গেল। এত দূর এসে এত কাণ্ড করেও দেখা হল না। কিন্তু সময়ও যে আর হাতে নেই। যা কিছু করতে হবে সব যে এখনই করতে হবে। আর দেরি করা চলবে না যে! নবাবি ফৌজ ফিরে আসবার আগেই যে সব খতম করে ফেলতে হবে।

এখন কোথায় যাবে? চেহেলসূতুনে ফিরে যাবে?

ঘসেটি বেগম বললে–না–নজরকুলি খাঁ ফিরে এলে আমি আবার তার সঙ্গে দেখা করতে যাব

কিন্তু ততক্ষণ কোথায় থাকবে? আমার খুলিতে চলল

বলে আর সম্মতির অপেক্ষা না করে সোজা সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকানের পেছন দিকে গিয়ে ডাকলে–বাদশা

বাদশা দরজা খুলে অবাক হয়ে গেছে কান্তবাবুকে দেখে। বললে–কান্তবাবুজি, আপনি? সঙ্গে

এ চেহেল্‌-সুতুনের এক বাঁদি, ভাইয়ের কোঠিতে যাচ্ছিল, রাস্তা ভুল হয়ে গেছে তাই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি এখানে থাকবে।

বাদশা সামনে গিয়ে কান্তর ঘরের দরজাটা খুলে দিলে। দিয়ে বাইরে চলে গেল। ঘসেটি বেগম তখন ভেতরে ভেতরে থরথর করে ভয়ে কাঁপছে।

কান্ত চারদিকে চেয়ে দেখলে। কেউ কোথাও নেই।

বললে–এবার বলো তুমি কে?

আমি তো বলেছি আমি রাবেয়া।

কান্ত বললে–সে তো বুঝলাম, এখন সত্যি কথাটা বলো তো

বলে আর দেরি না করে খপ করে বোরখার মুখটা খুলে দিয়েছে। দিতেই দুই হাতে মুখ ঢাকা দিয়েছে ঘসেটি বেগমসাহেবা।

কিন্তু তার আগেই কান্ত স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে মুখখানা!

তুমি তো রাবেয়া নও, বলো তুমি কে?

ঘসেটি বেগম তখন আর্তনাদ করে উঠতে যাচ্ছিল–না-না-না

চেঁচিয়ো না, সব জানাজানি হয়ে যাবে। বলো কে তুমি?

ঘসেটি বেগম তখনও মুখ ঢেকে আছে। বললে–কাউকে বোলো না তুমি, আমি ঘসেটি বেগম।

ঘসেটি বেগম। এতদিন যার নাম শুনে এসেছে।

তারপর আস্তে আস্তে নিজের মাথায় হাত ঠেকিয়ে বললে–কিছু ভাববেন না, আমি কাউকে বলব না। আমি নিজেও চেহেলসুতুন থেকে পালিয়ে এসেছি।

ঘসেটি বেগম হঠাৎ এতক্ষণে মুখটা তুলে সোজা লোকটার মুখের দিকে তাকাল। দেখতে দেখতে কেমন সন্দেহ হল। কললেচেহ্নেতুন থেকে পালিয়ে এসেছ? কে তুমি?

আমার কথাও আপনি কাউকে বলবেন না। আমার নাম মরিয়ম বেগম।

বলে গায়ের জড়ানো উড়ুনিটা খুলে ফেললে। তারপর আবার সেটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বললে–আমাকে এরা এখানে কান্ত বলে সবাই ডাকবে, আপনি যেন কাউকে বলে দেবেন না।

২৪ জুন ১৭৫৭ সালের সে ইতিহাস বাংলা মুলুকের এক চূড়ান্ত সন্ধিক্ষণের ইতিহাস। ইতিহাস বটে, কিন্তু লজ্জার অগৌরবের আর পরাজয়ের ইতিহাস। সেই দিনটার জন্যে সেদিন বাংলার মসনদে কোনও নবাব ছিল না। নবাব থাকলেও সেনবাবের কোনও মর্যাদা ছিল না, সে নবাবের কোনও অস্তিত্ব ছিল না, সে নবাবের কোনও অধিকারও ছিল না। ঠিক সেই দিনই মেহেদি নেসার সাহেব এসে পৌঁছেছিল তার নিজামতি অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। হাতিয়াগড়ের ছোটমশাই হিরণ্যনারায়ণেরও ড়ান্ত অসম্মান ঘটেছিল সেই দিনটিতেই। মরিয়ম বেগমসাহেবা ঠিক সেই দিনই মতিঝিলের কারাকক্ষের ভেতরে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। আর ঘসেটি বেগম সেই দিনই চেহেল সুতুনের হারেম থেকে বাঁদির পোশাক পরে চকবাজারের রাস্তায় পায়ে হেঁটে বেরিয়েছিল।

আর ঠিক সেই দিনই বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব মির্জা মহম্মদ সিরাজউদ্দৌলা হেবাৎ জঙ শা কুলি খান আলমগিরও হঠাৎ একলা একটা উটের পিঠে এসে দাঁড়িয়েছিল চেহেলসূতুনের ফটকে।

এই ফটক দিয়েই মুর্শিদকুলি খাঁ থেকে শুরু করে সুজাউদ্দিন, সরফরাজ খাঁ, আলিবর্দি খাঁ সবাই একদিন ভেতরে ঢুকেছে কিংবা হয়তো বাইরে বেরিয়ে এসেছে, কিন্তু তার আগে আগে চলেছে হাতি, উট, তাঞ্জাম, পালকি, ঘোড়া। নবাবি কেতাদুরস্তে বরাবর নবাবের আগে পিছে ওদের আগমন নির্গমন অপরিহার্য ছিল। কানুনের এতটুকু হেরফের হলে পাহারাদার কি খিদমদগারের কোতল হয়েছে। কিন্তু সেদিন কিছুই হল না।

কৌন হে তুম?

পাহারাদারই বা যাকে তাকে চেহেসূতুনের ভেতরে ঢুকতে দেবে কেন? তুমি কে? তোমার পাঞ্জা আছে কিনা দেখাও, আগে নিজের নামধাম কুলুজি পেশ করো, তবে তো ভাবব ভেতরে যাবার এক্তিয়ার তোমার আছে কিনা

সে বেচারিরও দোষ নেই সত্যি! তখন সারা মুর্শিদাবাদ ঝিম হয়ে ঘুমোচ্ছ নেশার ঘোরে। সারাফত আলির আরকের নেশা। সে-নেশা বড় সাংঘাতিক। একবার সে-নেশা করলে রাজ্য রাজা-বিষয়-ক্ষোভকামনা সবকিছু একাকার হয়ে যায়। ঠিক সেই সময় যেন ছায়ার মতো কে

এল ফটকের সামনে। একটা উটের পিঠের ওপর কে যেন বসে ছিল, সেটাও নজরে পড়েছিল। কিন্তু সে মানুষটা যে কে তা সেই আবছা অন্ধকারে আর ভাল করে দেখতে পায়নি। শুধু অভ্যেসের তাগিদে হাঁক দিয়েছিল

কৌন হো তুম?

আর সঙ্গে সঙ্গে খাড়া মাথাটা গলা থেকে খসে যাবার মতো হয়েছিল তার। মনে হয়েছিল সে যেন যমদূতকে সামনে দেখল।

কিন্তু সামলে নেবার আগেই লম্বা উঁচু উটটা একেবারে সড়সড় করে ভেতরে ঢুকে গেছে। তখন খেয়াল হয়েছে এ তো জাঁহাপনা!

আর দৌড়ে গিয়ে খবরটা দিয়েছে পরের ফটকের চৌকিদারকে। সেও তাজ্জব হয়ে গেছে। তারপর এক কান থেকে আর এক কানে যেতে যেতে নহবত-মঞ্জিলের ইনসাফ মিঞার কানে গিয়েও উঠল। তখন ইনসাফ মি টোড়ির কোমল রেখাবটা নিয়ে কায়দা করতে গিয়ে হয়রান হয়ে যাচ্ছে, এমন সময় ছোটে শাগরেদ বললে–উস্তাদজি,নবাব ফিরে এসেছে

নবাব?

ইনসাফ মিঞা দিনরাত সুর নিয়ে মেতে থাকলে কী হয়, নবাবের খবর তাকেও রাখতে হয়। নবাব কোথায় আছে, কী করছে সব খবর আরসকলের মতো ইনসাফ মিঞাও রাখে। সবাই জানত নবাব লাবাগে ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই করতে গেছে। কিন্তু ফিরে এল কেন? লড়াই ফতেহ হয়ে গেছে?

না চাচা, নবাব একলা ফিরে এসেছে

সঙ্গে ফৌজ নেই?

তাই তো বটে! তখন ইনসাফ মিঞার খেয়াল হল। এমন তো কানুন নয়। নবাব আলিবর্দি খাঁ যখন উড়িষ্যা থেকে পূর্ণিয়া থেকে নানা দিক থেকে লড়াই ফতেহ করে ফিরে আসত তখনকার কথা তো ইনসাফ মিঞার মনে আছে। ছোটে শাগরেদদেরও ইয়াদ আছে। এই নবাবও যখন পূর্ণিয়া থেকে নিজের ভাই শওকত জঙকে হারিয়ে রাজধানীতে ফিরে এসেছিল তখন অন্য রকম। তবে কি টোড়ি রাগ বন্ধ করবে?

জয়জয়ন্তী বাজাব?

না উস্তাদজি, ব্যাপার গড়বড় মালুম হচ্ছে

কীসের গড়বড়? নবাব হেরে পালিয়ে এসেছে

দাঁড়াও উস্তাদজি, আসলি খবর মালুম করে আসছি।

ইনসাফ মিঞা নহত বাজানো বন্ধ করে দিলে। ছোটে শাগরেদ নহবত-মঞ্জিলের পাথরের সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নীচেয় নেমে এল। নীচে নেমে দেখলে চেহেল্‌-সুতুনের ছোট ফটক ফাঁকা। তারপর বড় ফটকে এল। সেখানেও পাহারাদার নেই। এদিক-ওদিক চারদিক দেখতে লাগল। মশালচিরা ঘুমোয় পাশেই, সেখানে গেল। সেখানেও কেউ নেই। বড় তাজ্জব ব্যাপার তো! সবাই কি রাতারাতি নিজামতের চাকরি ছেড়ে দিলে! তারপর বাইরে থেকে হল্লা কানে এল। রাস্তায় যেন ভিড় জমছে মানুষের। কীসের ভিড়? কেন এত ভিড়?

তারপর দেখা হয়ে গেল খোজা সর্দার পিরালি খাঁ’র সঙ্গে। পিরালি খাঁ হন্তদন্ত হয়ে দৌড়োচ্ছে বাইরের ফটকের দিকে।

ছেটে শাগরেদ পেছন পেছন দৌড়ে গেল।কী হয়েছে পিরালি খাঁ সাহেব?নবাব ফিরে এসেছে?

তখন আর পিরালির কথা বলবার সময় নেই। বললো হ্যাঁ

কোথায় যাচ্ছ তুমি খাঁসাহেব?

মতিঝিলে। নানিবেগমসাহেবাকে ডাকতে।

নবাব কি লড়াইতে হেরে ফিরে এসেছে খাঁসাহেব?

কিন্তু সে কথার উত্তর আর দিলে না পিরালি খাঁ। না দিয়ে অন্ধকারের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে গেল। মেই আবছা অন্ধকারের মধ্যেই ছোটে শাগরেদ হতভম্বের মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে আবার নহবত-মঞ্জিলের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল।

নবাব মির্জা মহম্মদ তখন চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে ঢুকেছে। চেনা জায়গা। ছোটবেলা থেকে এই চেহেলসুতুনেই বড় হয়েছে মির্জা মহম্মদ। সবাই সেখানে তখন অসাড় হয়ে ঘুমোচ্ছ। হাতের কাছে হুকুম করবার মতো কেউ নেই। নেয়ামত রয়ে গেছে সেই লক্কাবাগে। নবাবের জীবনের শেষ মর্যাদাটুকু সেই লঙ্কাবাগেই ফেলে রেখে আসতে হয়েছে হঠাৎ।

আর নেয়ামতকে কিছু বলবার সময়ও তখন ছিল না। যে-লোক জীবনে তিনবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল তার সঙ্গে লড়াই করবার আগে তিনবার ভাবা উচিত ছিল। ইয়ারজান বলেছিল–ক্লাইভ তিন-তিনবার নিজের হাতে নিজের জান নিতে গিয়েছিল।

উটটার পিঠ থেকে নবাব নেমে পড়ল। উটটারও কি কম হয়রানি হয়েছে। সেই লঙ্কাবাগ থেকে ছুটতে ছুটতে এসে শুধু একবার দম নিয়েছিল দাউদপুরে।

ভয় ছিল হয়তো ফিরিঙ্গি ফৌজ নবাবের পেছু নেবে।

মরিয়ম বেগমসাহেবা!

সেদিন নবাবের, কেন কে জানে, যেন মনে হয়েছিল সেই বিপদের দিনে এক মরিয়ম বেগম ছাড়া আর তার কেউ নেই। কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ে গেল, মরিয়ম বেগমসাহেবা তো চেহেল্ সুতুনে নেই। ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই করতে যাবার সময়ই কানে এসেছিল কথাটা। কেউ বলেছিল মরিয়ম বেগমসাহেবা পালিয়েছে, কেউ বলেছিল ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে হাত মিলোতে গেছে কলকাতায়। সেদিন বিশ্বাস হয়নি নবাবের।

তবু একটা দরজার সামনে ঘা দিতে দিতে নবাব ডাকতে লাগল-মরিয়ম বেগমসাহেবা! মরিয়ম বেগমসাহেবা!

নজর মহম্মদ নবাবকে সামনে দেখে অবাক হয়ে গেছে।

খোদাবন্দ!

মরিয়ম বেগমসাহেবার মহল কোথায় রে? কোন দিকে?

মরিয়ম বেগমসাহেবা তো মহলে নেই জাঁহাপনা।

নেই? এখনও ফিরে তাসেনি? এত দেরি করছে কেন ফিরতে? কোথায় গেল তোরা খবর রাখিস না কেন?

কিন্তু কথা বলতে বলতে হঠাৎ যেন খেয়াল হল নবাবের। খেয়াল হল যে, আজ আর তার কেউ নেই। এতদিন চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে প্রত্যেকটি বেগম ছিল নবাবের নিজের সম্পত্তি। পুরুষানুক্রমে যে-সম্পত্তি জমা হয়ে হয়ে চেহেল সুতুনের পাথরগুলো পর্যন্ত ভারী হয়ে উঠেছিল, আজ সব ফাঁকা। কেউ নেই তার।

নজর মহম্মদ!

কোনও উত্তর নেই।

আবার ডাকলে নবাব পিরালি খাঁ, বরকত আলি, নজর মহম্মদ

সমস্ত চেহেল-সুতুন যেন সেই চিৎকারে গমগম থমথম করে উঠল। যেন হঠাৎ মুর্শিদাবাদ মসনদের সমস্ত বেহেস্তে যাওয়া নবাবের প্রেতাত্মা একসঙ্গে সাড়া দিয়ে উঠল–খোদাবন্দ!

সাতাশ বছর বয়েসের নবাব চারদিকে চাইতে লাগল হতবাক হয়ে। কে সাড়া দিলে? কে জবাব দিলে? কে? কারা ওরা? কোথায় ওরা?

তারপর মনে পড়ল নানিসাহেবার কথা। দৌড়ে গেল নানিবেগমসাহেবার মহলের দিকে। এ সময়ে নানিবেগমসাহেবা জুম্মা মসজিদে নমাজ পড়তে যায়। তবু নানিবেগমসাহেবার মহলের সামনে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকতে লাগল-নানিবেগমসাহেবা, নানিবেগমসাহেবা..

ঘুঙুরের শব্দ করতে করতে কে যেন সামনে এসে দাঁড়াল। এসে নবাবকে দেখেই ভয়ে চমকে উঠেছে। তারপর কাঁপতে কাঁপতে বললে–নানিবেগমসাহেবা মতিঝিলে গেছে আলি জাঁহা

মতিঝিলে? কেন?

তা মালুম নেই আলি জাঁহা।

সত্যিই নবাবের যেন বিশ্বাস পাকা হল যে, তার কেউ নেই। আমি অত্যাচার করেছি নানিবেগমসাহেবা, আমি পাপ করেছি। মরিয়ম বেগমসাহেবা, তোমাকেও জানিয়ে রাখি, আমি অন্যায় করেছি। এ-খবর তোমাদের কাছেনতুন নয়, কিন্তু আজ নতুন করে আবার তোমাদের জানিয়ে রাখলুম। আমি চলে যাবার পর তোমরা দুনিয়াকে জানিয়ে দিয়ে, আমি লম্পট, জানিয়ে দিয়ে, আমি পাপী, প্রচার করে দিয়ে আমি স্বার্থপর নীচ চরিত্রহীন! কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তোমরা একথাও প্রচার করে দিয়ে যে, আমি অনুতাপ করেছি। আমি বিশ্বাস করেও অনুতাপ করেছি অবিশ্বাস করেও অনুতাপ করেছি। ভালবেসেও অনুতাপ করেছি, ঘৃণা করেও অনুতাপ করেছি। অনুতারে যদি কিছু সুফল থাকে, সেটুকু যেন আমার প্রাপ্য থাকে। তার বেশি কিছু আমি চাই না।

হঠাৎ সামনে যেন কার তাঞ্জাম এসে থামল।

নানিজি!

মির্জা।

মির্জা মহম্মদ দুই হাতে নানিবেগমসাহেবাকে একেবারে জড়িয়ে ধরেছে। নানিবেগমসাহেবার দুই চোখ জলে ভরে এল।

বললে–কী হল রে মির্জা? এমন করছিস কেন?

নানিজি, আমি লড়াইতে হেরে গিয়ে ফিরে এসেছি।

নানিবেগম বললে–তাতে কী হয়েছে মির্জা, তোর নানা অনেকবার এমন করে হেরে গেছে, তুই অভ কাঁপছিস কেন?

মির্জা বললে–আমি যদি সহজে হেরে যেতুম, তা হলে তো আমার দুঃখ থাকত না নানিজি, আমাকে যে আমার মিরবকশিরা হারিয়ে দিলে। আমি যে তাদের বিশ্বাস করেছিলুম খুব। এখন কী হবে নানিজি!

নানিবেগম বললে–কোন মিরবকশি? কোন মিরবকশি তোকে হারালে?-

-মির্জা বললে–মিরজাফর আলি।

কিন্তু কোথায় হারালে? কী করে হারালে?

সব কথা বুঝিয়ে বলবার এখন সময় নেই নানিজি। এরই মধ্যে আমাকে যা-তোক কিছু ব্যবস্থা করতেই হবে। নইলে তোমার চেহেল্‌-সুতুন বাঁচবে না, আমি বাঁচব না, তুমি বাঁচবে না। আমরা কেউ বাঁচব না নানিজি। মুর্শিদাবাদের মসনদ পর্যন্ত চলে যাবে!

কে বললে–মসনদ চলে যাবে?

বলে নানিবেগমসাহেবা নিজেকে মির্জার হাতে থেকে ছাড়িয়ে নিলে। তারপর বললে–পিরালি

গিরালি আর বরকত আলি পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সামনে এসে দাঁড়াল। বললেনহবত-মঞ্জিলে নহবত থামালে কেন ইনসাফ মিঞা?

এতক্ষণে যেন সকলের খেয়াল হল। সত্যিই তো নহবত তো বাজছে না আর!

নবাব লড়াই থেকে ফিরে এলে কি নহবত থেমে যায়? যা, বাজাতে বল গে যা-যা

ছোটে শাগরেদ তখন ইনসাফ মিঞার সামনে বসেনীচের রাস্তার দিকে চেয়ে দেখছে। এ কি তাজ্জব ব্যাপার ঘটছে তার চোখের সামনে। মুর্শিদাবাদে তো এমন ঘটনা ঘটেনি কখনও আগে। সমস্ত কিছু ওলোটপালোট হয়ে যাবে নাকি। একটু আগেই নানিবেগমসাহেবার তাঞ্জাম বেরোল চেহেল্‌-সুতুনের ফটক থেকে, আবার খানিক পরেই চেহেল্‌-সুতুনে ফিরে এল।

কী হবে চাচা?

বুড়ো ইনসাফ মিঞাও হতবাক হয়ে গেছে। এমন করে কখনও তাকে সুরের মুখ চাপা দিতে হয়নি।

হঠাৎ বরকত আলি সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে ওপরে উঠে এসেছে।

কী হল মিঞাসাহেব, নহবত থামল কেন? বাজাও বাজাও

দু’জনেই অবাক হয়ে গেছে বরকত আলিকে দেখে। বরকত আগে কখনও নহবত-মঞ্জিলে এসে এমন করে হুকুম করেনি তাদের।

কী হল বরকত?

নানিবেগমসাহেবা জিজ্ঞেস করছে, নহবত থামল কেন? বাজাতে বলছে।

তা শুনলাম নাকি নবাব লড়াইতে হেরে ফিরে এসেছে?

বরকত আলি রেগে গেল।

দুর মিঞাসাহেব, নবাব কখনও লড়াইতে হারতে পারে? লড়াই চলছে লক্কাবাগে, ফিরিঙ্গি হারামদের সাধ্যি কি নবাবকে হারায় বাজাও, তোমরা বাজাও

বাজাব?

হ্যাঁ, বাজাবেনা তো কি চুপ করে বসে থাকবে? দেখছ না নহবত বন্ধ হয়েছে, রাস্তায় ভিড় জমছে, হল্লা হচ্ছে?

তাই তো বটে। ইনসাফ মিঞা বুড়ো হয়ে গিয়েছিল। হয়তো নতুন জমানার কানুন বুঝতে পারেনি। জমানা বদলে যাচ্ছে। নবাব আলিবর্দি খা’র জমানার কানুন নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার জমানায় চলবে কেন? তাই তো বটে।

বরকত আলি আবার তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেল।

এবার ইনসাফ মিঞা ধরলে–জয়জয়ন্তী

ছোটে শাগরেদ সুরটা শুনেই তবলায় জোরসে চাটি মারলে কেয়াবাত–কেয়াবাত—

এমন যে হবে মরিয়ম বেগমও তা বুঝতে পারেনি। কোথায় ত্রিবেণীর ঘাট, সেখান থেকে মোল্লাহাটি। মোল্লাহাটিতেই যদি পালাতে পারত তা হলে আর ধরা পড়ত না মেহেদি নেসারের হাতে। সেখান থেকে সোজা আবার এই মতিঝিলে।

তারপর?

তারপরের কথা ভাবতে গিয়ে ঘরখানার চারদিকে একবার চেয়ে দেখছিল। এ-ঘরটায় কখনও আগে ঢকেনি মরালী। চারদিক ইট দিয়ে, পাথর দিয়ে শক্ত করে গাঁথা। তখন বুঝতেই পারেনি যে, এখান থেকে আবার বেরোতে পারবে কোনওদিন।

বাইরে সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ মশাইকে দেখে শুধু চিৎকার করে উঠেছিল। বলেছিল নানিবেগমসাহেবাকে একবার খবরটা দিন ঘটকমশাই

কিন্তু তারপর অনেকক্ষণ কেটে গিয়েছিল। কেউ-ই আসে না।

হঠাৎ যখন দরজা খুলল, তখন দেখে অবাক হয়ে গেল। নানিবেগম নয়–কান্ত। আর তার পাশেই দাঁড়িয়ে সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ মশাই।

একী, তুমি?

কান্ত চাপা গলায় বললেমরালী শিগগির করো, আর সময় নেই, কেউ এসে পড়বে, তুমি এখান থেকে পালাও–

পালাব?

মরালীর যেন তখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না।

কী করে দরজা খুললে?

সচ্চরিত্র বলে–আমি খুলেছি মা, আমার কাছে নেয়ামত সব ঘরের চাবি দিয়ে গিয়েছিল।

কান্ত বললে–তুমি আর আপত্তি কোরো না মরালী

কিন্তু মেহেদি নেসার কোথায়? বশির মিঞা কোথায়?

তারা এখন অন্য দিকে চলে গেছে। নানিবেগম এসেছিল এখানে, মেহেদি নেসারও এসেছিল, তোমাকে ছেড়ে দেবার জন্য নানিবেগমসাহেবা মেহেদি নেসারকে হুকুম করেছিল। কিন্তু হঠাৎ নবাব এসে পড়ার খবর পেয়ে দু’জনেই চলে গেছে

নবাব? নবাব কোথা থেকে এল?

হ্যাঁ, শুনছি তো নবাব এসেছে। তাই বাইরের রাস্তায় অত হইচই হল্লা হচ্ছে। এখনই হয়তো নবাব মতিঝিলে এসে পড়বে, তার আগেই তুমি চলে যাও।

আর তুমি? তোমাকে ছেড়ে দিলে কেন ওরা?

আমাকে ছাড়েনি মরালী, আমি টাকা দিয়ে তোমাকে ছাড়াবার জন্য সারাফত আলির দোকানে গিয়েছিলাম, এদিকে রাস্তার হল্লা শুনে বশির মি অন্য ধান্দায় চলে গেছে। বোধহয় নিজামত এবার উলটে যাবে।

তার মানে?

তার মানে আমি জানি না। চারদিকে ব্যাপার দেখে খুব ভয় হচ্ছে। কিন্তু ওসব কথা ভাববার আর সময় নেই এখন। এমন সুযোগ আর আসবে না। শুনছ মহবত-মঞ্জিলে বাজনা থেমে গেছে?

কিন্তু আমি পালাব কী করে? কেউ পাহারাদার নেই এখানে?

পাহারাদাররা আছে, কিন্তু এই সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ মশাইকে ওরা সবাই খুব বিশ্বাস করে। উনি এখন ইব্রাহিম খাঁ। তোমাকে ওঁর হেপাজতে রেখেই ওরা চলে গেছে

কিন্তু ছোটমশাইয়ের খবর কী?

ছোটমশাইও এখানেই আছেন।

তা হলে তাঁকে আগে ছেড়ে দাও

তাঁকেও ছেড়ে দেব, কিন্তু তুমি আগে এসো।

তা হতে পারে না। তিনি এখানে থাকলে আমি ছাড়া পেয়ে কোনও লাভ নেই। আর তা হলে ছোট বউরানির জন্যে আমি কেন এত কিছু করতে গেলুম?

কান্ত সচ্চরিত্র পুরকায়স্থর মুখের দিকে চাইলে।

আপনি ছোটমশাইকে ছাড়তে পারবেন পুরকায়স্থমশাই?

কিছুক্ষণ ভাবতে লাগল পুরকায়স্থ মশাই। এই চাকরি, এই ধর্মান্তর, এই অবমাননা, এই দুর্যোগ, সমস্ত কিছু মাথার ওপর চেপে বসল। থরথর করে কাঁপতে লাগল বুড়ো মানুষটা। সবই তো ছাড়তে। হয়েছে জীবনে। যারা তার আপনজন ছিল, তারাও পর হয়ে গেছে। শেষে যেটা আছে, সেটা তার পেট। সেই পোড়া পেটটা নিয়েই এতদিন এখানে সরাবখানার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। সেটাও যদি খোয়াতে হয়, তা হলে কোথায় মাথা গোঁজবার একটা ছাদ আর দুমুঠো অন্ন সে পাবে?

কিন্তু হঠাৎ যেন সচ্চরিত্র পুরকায়স্থর শরীরে যৌবনের শক্তি ফিরে এল। এত দিনের সব অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্তের কথাটাও মনে এল।

বললে–ঠিক আছে বাবাজি, তাই-ই ঠিক রইল, আমি ছোটমশাইয়ের ঘরের তালাটাও খুলে দিচ্ছি–

তা হলে আপনার কী হবে? আপনাকে যদি…

সচ্চরিত্র বললে–সে যা-হয় হবে বাবাজি! আমি ঈশ্বর ইন্দীবর ঘটকের পুত্র, ঈশ্বর কালীবর ঘটকের পৌত্র,এমনিতেই তো আমার পিতৃপুরুষ আমার হাতে জল পাচ্ছেন না, আমার আর কী ক্ষতি করবে ওরা? আমি যাচ্ছি

বলে সচ্চরিত্র অন্য দিকে চলে গেল।

কান্ত বললে–এবার তো আর তোমার কোনও আপত্তি নেই?

কিন্তু তুমি?

কান্ত বললে–আর তুমি আমার কথা ভেবো না। আমি পুরুষমানুষ, আমি যেমন করে হোক, এখান থেকে পালিয়ে যাবই। এখন যা অবস্থা, তাতে তোমাকে এ-অবস্থায় রেখে আমি কোথাও যেতে পারব না–

কিন্তু আমিই বা কোথায় যাব?

কান্ত বললে–কেন, আজকের জন্যে তুমি তো সারাফত আলির দোকানে গিয়ে থাকতে পারো। সেখানে বাদশা আছে, সে তোমাকে আমার ঘরে থাকতে দেবে। তুমি তো সে-দোকান চেনো, তুমি তো একদিন আমার খোঁজে সেখানে গিয়েছিলে। দোকানের পেছন দিকে গিয়ে বাদশা’ বলে ডাকলেই সে দরজা খুলে দেবে। তারপর যখন অবস্থা শান্ত হয়ে আসবে তখন আমিও এখান থেকে চলে গিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করব। ওই সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ আছে, ও থাকতে কোনও ভয় নেই।

মরালী জিজ্ঞেস করলে কিন্তু কতদিন পরে তুমি আসবে?

বেশিদিন নয়। মেহেদি নেসার সাহেব বাইরে কোথাও চলে গেলেই আমি সেই সুযোগে এখান থেকে পালিয়ে যাব।

কিন্তু এখন চলে গেলে ক্ষতিটা কী? দুজনে একসঙ্গে গেলেই বা কে দেখছে?

না, তা হলে মেহেদি নেসার সাহেব যদি এখনই ফিরে এসে মরিয়ম বেগমসাহেবাকে না দেখতে পায় তো সচ্চরিত্র পুরকায়স্থমশাইকে কোতল করবে। ও বেচারি না থাকলে তোমাকে আজ এমন করে বাঁচাতে পারতাম না, ছোটমশাইকেও ছাড়াতে পারা যেত না।

মরালী বললে–কিন্তু ছোটমশাইকে দেখতে না পেলে যদি পুরকায়স্থমশাইকে হেনস্থা করে?

না, অতটা করবে না, যতটা করবে মরিয়ম বেগমকে না দেখতে পেলে! আমি তো রইলুমই।

কিন্তু আমার যে বড় ভয় করছে। এতে তোমার কোনও ক্ষতি হবে না তো?

কান্ত বললে–কিন্তু আমার তো মনে তৃপ্তি হবে মরালী যে, তুমি নিরাপদে আছ। একবার এখান থেকে বেরিয়ে গেলে আর কখনও যেন মুর্শিদাবাদে এসো না। এ বড় খারাপ জায়গা। আমিও আর কখনও এখানে আসব না। তুমিও এসো না।

তারপর?

ঘসেটি বেগম সমস্ত কাহিনীটা এতক্ষণ শুনছিল। বললে–তারপর কী হল?

মরালী বললে–তারপর তাকে সেই মতিঝিলের ঘরের মধ্যে রেখে আমি তার জামাকাপড় পরে চলে এলাম। আমাকে এখন এখানেই থাকতে হবে যতদিন না ও আসে। রাস্তায় আসতে আসতে খুব ভয় করছিল। ভাবছিলাম কেউ ধরতে পারবে কিনা। কিন্তু কান্ত আমাকে সব বলে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছিল। আমার বুঝতে কোনও কষ্ট হয়নি। দেখলাম সবাই নিজামত নিয়ে ব্যস্ত, সবাই নবাব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। আমি বেটাছেলে বলে আমার দিকে কেউ বিশেষ নজর দিলে না। কিন্তু আপনাকে দেখে আমার কেমন সন্দেহ হল বেগমসাহেবা। আমি এতদিন চেহেল্‌-সুতুনে ছিলাম, আমি হাঁটা-চলা দেখে বুঝতে পারি কে বাঁদি কে বেগম। আপনি আমার চোখকে ঠকাতে পারেননি বেগমসাহেবা।

তা হলে এখন কী করবে?

মরালী বললে–আপনি এখানে থাকুন, আমি দেখে আসছি আপনার নজরকুলি খাঁ বাড়িতে এসেছে কি না–আপনি কারও সঙ্গে কিছু কথা বলবেন না। বোরখা পরে বসে থাকুন। বাদশা আমাকেও চিনতে পারেনি। আপনাকেও চিনতে পারবে না–

বলে আবার বাইরে এল। বুড়ো সারাফত আলি সাহেবের কাশির শব্দ পাওয়া গেল পাশের ঘরে। হয়তো ঘুম থেকে উঠেছে। ও নিশ্চয় সারাফত আলির গলা।

আবার কোথায় চললে কান্তবাবু?

বাদশা উনুনে কাঠ দিয়েছে। আগুন ধরাবে।

আমি এখুনি আসছি বাদশা। বাঁদিটা রইল, ওকে যেন বিরক্ত কোরো না তুমি, দেখো। আমি যাব আর আসব দরজাটা ভেজিয়ে দাও ।

বলে মরালী গায়ের চাদরটা ভাল করে জড়িয়ে নিয়ে চকবাজারের রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। নহবত-মঞ্জিল থেকে হঠাৎ আবার নহবতের সুর বেজে উঠতে সেই দিকেই চলতে লাগল। নহবত আবার বাজতে শুরু করল কেন?

মহিমাপুরের জগৎশেঠজির বাড়ির সামনে সেদিনও ভিখু শেখ পাহারা দিচ্ছিল। হঠাৎ একটা চেনা চেনা মুখ দেখে অবাক হয়ে গেল।

কে? কৌন?

পালকি নেই, তাঞ্জাম নেই, পোশাক-পরিচ্ছদের বাহারও নেই। কিন্তু তবু দেখে মনে হল রেইস আদমি। রেইস আদমিদের ওপর ভিখু শেখের টানটা বেশি!

লোকটা জিজ্ঞেস করলে শেঠজি হাবেলিমে হ্যায়?

জি হাঁ!

তারপর তড়িঘড়ি ভেতরে নিয়ে গেল। দেওয়ানজির সঙ্গে দেখা হল। দেওয়ানজি কিন্তু দেখেই চিনতে পারলে।

অবাক হয়ে বললে–ছোটমশাই আপনি?

ছোটমশাই বললে–আমি এখুনি মতিঝিল থেকে ছাড়া পেয়ে আসছি, শেঠজির সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। কিন্তু আমার স্ত্রীকে ওখানে এখনও আটক করে রেখেছে।

কে?

ওই, যাকে ওরা মরিয়ম বেগম বলে। আমাদের দুজনকেই একসঙ্গে মেহেদি নেসার ধরেছিল, কিন্তু আমি ছাড়া পেয়ে চলে এসেছি। এখন জগৎশেঠজির সঙ্গে দেখা করে এর বিহিত করতে চাই।

দেওয়ানজি বললে–আপনি বসুন, আমি জগৎশেঠজিকে খবর পাঠাচ্ছি। বলে বাইরে চলে গেল।

রণজিৎ রায় মশাই জগৎশেঠজির ডান হাত। নবাবের সঙ্গে যখনই তার বিরোধ বেধেছে তখনই পরামর্শ দিয়েছে রণজিৎ রায়। কলকাতায় যখন প্রথমবার যুদ্ধ বেধেছিল তখনও দেওয়ান রণজিৎ রায় মশাই। গিয়েই সব মিটমাট করে দিয়েছিল।

ছোটমশাই তা জানত। কিন্তু ভেতরের খবর কিছুই জানত না। ভেতরে ভেতরে যে এত কাণ্ড হয়ে গেছে, হাতিয়াগড়ের ডিহিদার রেজা আলি সাহেব যে একদিন আগে মুর্শিদাবাদে এসে সব ফাস করে দিয়েছে তাও জানত না।

জগৎশেঠজি যখন ঘরে এলেন তখনও ছোটমশাই কিছু খবর পায়নি।

ছোটমশাই বললে–আমার সহধর্মিণীকে মেহেদি নেসার ওই মতিঝিলেই আটক করে রেখেছে যে-

-জগৎশেঠজি বললেন–কে বললে–আপনাকে?

আমি নিজের চোখে দেখেছি! সে-সব কথা তো আপনাকে সবই বললুম। মেহেদি নেসার আমাকে আগে ধরেছিল, তারপর মোল্লাহাটির কাছে গিয়ে আমার সহধর্মিণীকেও ধরে। তখন আমার স্ত্রী ওদের নৌকোটা দেখতে পেয়ে ডাঙায় ঝাঁপ দিয়ে পালাতে যাচ্ছিল

আপনার স্ত্রী একলা ছিলেন?

না, সঙ্গে আর একজন কে ছিল। তাকে চিনতে পারিনি।

তারপর?

তারপর সেখান থেকে আমাদের ধরে নিয়ে মতিঝিলে এনে রাখে। কয়েক ঘণ্টা আমি ওখানেই ছিলাম, ভাবলাম মেহেদি নেসারের হাতে যখন পড়েছি তখন আর আমার রেহাই নেই। কিন্তু কে একজন হঠাৎ এসে আমার দরজার চাবি-তালা খুলে দিলে

কে সে?

তা জানি না। মুখময় দাড়ি, খুব বুড়ো একজন মুসলমান খিদমদগার।

নেয়ামত, সেও কি এর মধ্যে ফিরে এল নাকি? কী বললে সে?

ছোটমশাই বললে–কিছু বললে–না। আমার ঘরের ফটকটা খুলে দিয়ে চলে গেল। তাকে আর দেখতে পেলুম না। ভাবলাম আমার সহধর্মিণীকে কোথায় আটকে রেখেছে সেটা একবার দেখে আসি। কিন্তু আর সাহস হল না ওখানে থাকতে। তাই ছাড়া পেয়েই বাইরের রাস্তায় বেরিয়ে পড়লুম। দেখলুম চারদিকে লোকজন গমগম করছে। লোকেরা বলাবলি করছে নবাব নাকি লঙ্কাবাগের যুদ্ধে হেরে চলে এসেছে রাতারাতি। সকলের ভয় হয়ে গেছে, হয়তো নিজামতি চলে যাবে কেউ কেউ বলছে কর্নেল ক্লাইভ নাকি ফৌজ নিয়ে মুর্শিদাবাদের দিকে রওনা দিয়েছে

জগৎশেঠজি চুপ করে শুনছিলেন। কিন্তু উত্তর দিলেন না।

ছোটমশাই জিজ্ঞেস করলে আপনি কিছু শোনেননি?

জগৎশেঠজি বললেন–সবই শুনেছি, শুধু শুনেছি নয়, নবাবের কাছ থেকে ডাকও এসেছে আমার…

ছোটমশাই চমকে উঠল।

তাই নাকি? নবাব আপনাকে ডাকলেন কেন?

আমার কাছে তো সবাই টাকার জন্যেই আসে। আমার সবচেয়ে বড় খাতির আমার টাকার জন্যে। তাই এখন বিপদে পড়ে আমাকেই স্মরণ করতে হয়েছে।

ছোটমশাই বললে–আপনি টাকা দিচ্ছেন নাকি?

সেই কথাই ভাবছিলাম। ভাবছিলাম নবাবের সামনে গিয়ে কী বলব। একবার সকলের সামনে আমার মুখে চড় মেরেছিল নবাব। আমাকে ফাটকের মধ্যে আটকে রেখেছিল, সে কথা আমি ভুলিনি।

এখন নবাবের কী রকম অবস্থা?

জগৎশেঠজি বললেন–তা জানি না, এখন সকলকে ডেকে পাঠাচ্ছেন। রাত চার প্রহরের সময় নাকি হঠাৎ চেহেল্‌-সুতুনে এসে পৌঁছেছেন। কেউ তাকে চিনতে পারেনি শুনছি। কী করেই বা চিনতে পারবে? কী করে কল্পনা করবে যে, নবাব ওই শেষরাত্রের দিকে একলা উটের পিঠে চড়ে চেহেল্‌-সুতুনে ঢুকবেন! সবাই তখন যে-যার জায়গায় মড়ার মতো ঘুমুচ্ছে। নহবত-মঞ্জিলে ইনসাফ মিঞা নহবত বাজাচ্ছিল, সেঁও গোলমাল শুনে বাজনা থামিয়ে দিয়েছিল। নানিবেগমসাহেবাও নাকি শুনছি চেহেলসুতুনে ছিল না

কিন্তু আপনি না-হয় সব খোঁজখবর পান, কিন্তু লোকে এসব খবর কী করে পেলে? আমি যখন গঙ্গার ঘাট থেকে আসছিলাম তখনই শেষরাত্তিরের দিকেই মনে হয়েছিল চকবাজারের রাস্তায় হইহল্লা করছিল

আর একটা কথা

ছোটমশাই বললে–কী?

আপনি জানেন কি না জানি না। এদিকে তো এই গণ্ডগোল, ওদিকে আবার শুনলাম আপনার হাতিয়াগড়ের ডিহিদার রেজা আলিটা হঠাৎ এই হট্টগোলের মধ্যে এসে পৌঁছেছে–

সেকী? তার আবার কী মতলব? সে কি খবর পেয়েছে নাকি নবাবের ব্যাপার?

জগৎশেঠজি বললেন–সে কী করে খবর পাবে? সে নিশ্চয় এসেছিল নিজের কোনও মতলব হাসিল করতে। এসে দেখে এই কাণ্ড!

ছোটমশাই বললে–আমার তো শুনে ভয় করছে জগৎশেঠজি! আমি তো হাতিয়াগড় একলা ছেড়ে এসেছি। সেখানে খাজাঞ্চিবাবুর হাতে সব ভার দিয়ে এখানে এসে ঘুরছি। আমার এত ঘোরাঘুরি দেখছি সব পণ্ডশ্রম হল। আপনিই আমাকে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে পাঠিয়েছিলেন, আপনিই আমাকে ক্লাইভ সাহেবের কাছে পাঠিয়েছিলেন। কোথায় সেই হাতিয়াগড় আর কোথায় সেই কলকাতা, আর কোথায় সেই কেষ্টনগর, আর কোথায়ই বা এই মুর্শিদাবাদ! এবার দেখছি আর বোধহয় কোনও আশা নেই। আপনি ঠিক ভাল রকম জানেন রেজা আলি এসেছে?

জগৎশেঠজি বললেন–শুধু এসেছে নয়, মেহেদি নেসারের সঙ্গে দেখাও করেছে

ছোটমশাই বড় ভাবনায় পড়ল।

বললে–আমি তা হলে এখন কী করব পরামর্শ দিতে পারেন? হাতিয়াগড়ে চলে যাব?

জগৎশেঠজি বললেন–আপনার স্ত্রীকে যখন ওরা মতিঝিলে আটকে রেখেছে দেখে এলেন তখন সেখানে গিয়েই বা কী করবেন? বরং তাকে ছাড়িয়ে নেবার কোনও ব্যবস্থা করা যায় কি না সেই চেষ্টাই দেখুন না

সে কী করে হবে?

জগৎশেঠজি বললেন–দেশে এখন যা অবস্থা তাতে সবকিছু টলমল করছে, এখন তো মুর্শিদাবাদের মসনদই থাকে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। এই অবস্থাতে চেষ্টা করলে হয়তো কিছু সুরাহা হলেও হতে পারে

কী করব তাই বলুন?

জগৎশেঠজি বললেন–বহুদিন আগে আপনার সহধর্মিণী একবার আমার এখানে এসেছিলেন, সে তো আপনি জানেন আমাকে বলে গিয়েছিলেন যে, চকবাজারের খুশবু তেলের দোকানের মালিক সারাফত আলির বাড়িতে একটা লোক থাকে, তার নাম কান্ত, তার কাছে খবর দিলেই আপনার সহধর্মিণীর কাছে তা পৌঁছোবে–

ছোটমশাই বললে–বহুদিন আগে তো একবার গিয়েছিলাম সেখানে, সেদিন ছিল না সে-লোক

এখনই আর একবার যান না, দেখুন না, পান কিনা তাকে। সে হয়তো কিছু খবর দিতে পারে। যদি না পান তো আবার ফিরে আসবেন। ততক্ষণ আমি একবার নবাবের সঙ্গে দেখা করে আসি জরুরি তলব দিয়েছে আমাকে নবাব

ঠিক আছে বলে ছোটমশাই আবার বেরোল। তখন বেশ ফরসা হয়ে গেছে চারদিক। রাস্তায় আরও লোক নেমেছে।

ছোটমশাই চলে যাবার পর জগৎশেঠজির তাঞ্জামও বেরোল। কদিন থেকেই ঘুম হচ্ছিল না জগৎশেঠজির। দেওয়ানজি, খাজাঞ্চি, মোহরার, সবাই ক’দিন ধরে বড় ব্যস্ত। একটা কিছু যুদ্ধ-বিগ্রহ হলেই টাকা দিয়ে নবাবকে মদত দিতে হয়। সেইটেই নিয়ম। লক্কাবাগে ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই করতে যাবার আগে দিতে হয়েছে টাকা। ফৌজের লোকেরা টাকা না নিয়ে লড়াই করতে যাবে না বলে বেঁকে বসেছিল। মিরজাফর আলি খাঁ আড়ালে টাকা দিতে বারণ করেছিল। কিন্তু না দিলে কি আর তখন পার পাওয়া যেত?

শুধু মিরজাফর আলি সাহেব নয়। ইয়ার লুৎফ খাঁ, রাজা দুর্লভরাম, সবাই-ই বলেছিল–আপনি যদি এখন টাকা দেন তো লড়াই থেকে ফিরে এসে আমাদের সকলকে কোতল করবে নবাব

সত্যিই তখন সবাই ভয় দেখিয়েছিল, এতদিনের সব ষড়যন্ত্র সব আয়োজন নষ্ট হবে। তাই নবাব ফৌজ নিয়ে চলে যাবার পর থেকেই উদ্বেগে আর অশান্তিতে দিন কেটেছে। কাল সকালেও খবর এসেছে, নবাবের মন-মেজাজ খারাপ। মেহেদি নেসার সাহেব নবাবের সঙ্গেই সারা রাস্তা গিয়েছিল। তাকেও নাকি নবাব বলেছে–ফিরে এসে সকলকে শায়েস্তা করবে। সেখানে গিয়ে কে যেন নবাবের সোনার কলকেটা চুরি করে নিয়েছিল, সে-খবরও এসেছিল। তারপর বৃষ্টিতে গোলাবারুদ ভিজে গিয়েছিল, তাও কানে এসেছিল। তারপরে সারারাত আর কোনও খবর আসেনি। দেওয়ানজি দফতরে বসে ছিল সারারাত। খবর এলেই যাতে বাড়ির ভেতরে শেঠজির কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। কিন্তু না, আর কোনও খবরই আসেনি।

শুধু ভোররাত্রে খবর এল নবাব রাজধানীতে ফিরে এসেছে। সঙ্গে কেউ ছিল না। একটা উটের পিঠে চড়ে একলা চেহেল সুতুনে ঢোকার সময় কেউ নাকি চিনতেও পারেনি নবাবকে।

তারপরেই খবর এল জগৎশেঠজির ডাক পড়েছে নবাবের আম-দরবারে

আর তারপরেই হাতিয়াগড়ের হিরণ্যনারায়ণ রায় এসে হাজির।

রাস্তায় সত্যিই লোকজনের বড় ভিড়। জগৎশেঠজির তাঞ্জাম মুর্শিদাবাদের মানুষেরা চেনে। সামনে চলেছে জগৎশেঠজির নিশানা লাগানো পাইক। ভিড় হটাতে হটাতে তারা আগে আগে চলেছে। চেহেলসূতুনের আম-দরবারের ফটকে এসে তাঞ্জাম থামতেই জগৎশেঠজি নামল। তারপর খিলেন-দেওয়া ইটের থামের মধ্যে দিয়ে চলতে লাগল দৃরবার-ঘরের দিকে। সব যেন চারদিকে ছন্নছাড়া ভাব। চারদিকে ফিসফিস গুজগুজ শব্দ। মনসুর আলি মেহের, নিজামতের মোহরার জগৎশেঠজিকে দেখেই মাথা নিচু করে কুর্নিশ করলে।

বন্দেগি শেঠজি

নবাব ডেকেছে কেন মোহরার?

মনসুর আলি মেহের সাহেব বললে–শুধু আপনাকে নয় শেঠজি, নবাব আমাদেরও ডেকেছেন, সবাইকে ডেকেছে। মেহেদি নেসার সাহেবকেও ডেকেছেন। মুর্শিদাবাদে যত আমির-ওমরাও আছে সকলকে ডেকেছেন!

কিন্তু কী দরকার নবাবের? লক্কাবাগের লড়াইতে কী হল? মিরজাফর আলি সাহেব কোথায়? তারা কেউ আসেনি?

মনসুর আলি মেহের আরও কাছে সরে এল। মুখের কাছে মুখ নিচু করে বললে–ফিরিঙ্গি ক্লাইভ সাহেব মুর্শিদাবাদের দিকে এগিয়ে আসছে শেঠজি, আর কিছু ভয় নেই আমাদের।

কিন্তু জেনারেল ল’ সাহেবের যে ফৌজ নিয়ে আসবার কথা ছিল?

সে আর আসছেনা শেঠজি! আপনার কাছে টাকা চাইলে আপনি যেন আবার সেবারের মতো টাকা দিয়ে দেবেন না?

জগৎশেঠজি সেকথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন–তুমি ঠিক জানো জেনারেল ল’ সাহেব আসছে না?

হ্যাঁ শেঠজি, বিলকুল ঠিক। কিন্তু আপনাকে বলে রাখছি শেঠজি, আলি জাঁহা আপনাকে ডেকেছে টাকার জন্যে। আপনি যেন এবার আর টাকা দেবেন না সেবারের মতো

কিন্তু টাকা নিয়ে আলি জাঁহা কী করবে?

ফৌজ বানাবে! নতুন ফৌজ নিয়ে ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে ফিন লড়াই করবে।

ফৌজ বানাবে? নতুন ফৌজ?

হ্যাঁ শেঠজি, আমাকে মেহেদি নেসার সাহেব আপনার সঙ্গে দেখা করে বলতে বলেছে সব।

জগৎশেঠজি খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন।

তারপর বললেন মিরজাফর আলি সাহেব এখন কোথায়?

দাউদপুরে। দাউদপুরে ক্লাইভসাহেব মিরজাফর আলি সাহেবকে ডেকে পাঠিয়েছে। সেখানে মিরজাফর আলি সাহেব আছে, তার ছেলে মিরনসাহেব আছে, মির্জা ওমর বেগ আছে, আর স্ক্র্যাফর্টন সাহেব আছে। ক্লাইভসাহেব মিরজাফর আলি সাহেবকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সুবাদার বলে স্বীকার করে নিয়েছে ।

জগৎশেঠজি চমকে উঠলেন।

বললেন–তাই নাকি? তারপর

তারপর মিরজাফর আলি সাহেব আর মিরনসাহেব রওয়ানা দিয়েছে দাউদপুর থেকে। মুর্শিদাবাদের দিকে আসছে খবর এসে গেছে। তাদের পথ আটকাবার জন্যেই আলি জাঁহা ফৌজ বানাতে চাইছেন রাতারাতি

হঠাৎ নেয়ামত দৌড়োত দৌড়াতে আসছিল, জগৎশেঠজিকে দেখে কুর্নিশ করে বললে–নবাব শেঠজিকে এত্তেলা দিয়েছেন, আপনাকে ডাকতেই আমি যাচ্ছিলাম

চলো

জগৎশেঠজি আর দাঁড়ালেন না। আগে আগে চলতে লাগলেন। আমরবার ঘরে তখন অনেক আমির-ওমরাহর ভিড়। দূরে নবাব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সকলের সঙ্গে কথা বলছেন। জগৎশেঠজির মনে হল নবাবের যেন অন্য রকম চেহারা হয়ে গিয়েছে। যেন ভেঙে পড়েছে, নুয়ে পড়েছে চেহারাটা এই দু’দিনের মধ্যেই। যেন নবাবের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। যেন নবাব বলছে–আমার মসনদ আজ আর আমার নয়, এ তোমাদের সকলের মসনদ। আমি যদি এ-মসনদ হারাই তো তোমরাও এ হারাবে। তোমরাও আমার মতো নিঃস্ব হয়ে যাবে। তোমাদের জন্যেই আমিনবাবি পেয়েছিলাম, আমার নবাবি চলে গেলে তোমরাও তোমাদের অধিকার হারাবে। আমিই কি শুধু তোমাদের ছিলাম? তোমরাও তো আমারই ছিলে। তোমাদের ওপর একদিন যে অন্যায় করেছিলাম, তা আজ হাজার গুণ হয়ে আমার ওপরেই ফিরে এসেছে। তেমনই আমার ওপরেও যদি তোমরা কোনও অন্যায় করো, সে অন্যায় হাজার গুণ হয়ে আবার তোমাদের ওপরেও ফিরে আসবে। অন্যায় দিয়ে অন্যায়ের প্রতিকার যদি হত তা হলে কি আজকে আমাকে লক্কাবাগ ছেড়ে চলে আসতে হয়? চলে এসে তোমাদের কাছে মার্জনা ভিক্ষে চাইতে হয়?

নবাব কথাগুলো বলছে আর সমস্ত দরবার-ঘরটা গমগম করে উঠছে।

দূর থেকে জগৎশেঠজি সব শুনছিলেন। নবাবের সামনে অনেক ভিড়। মুর্শিদাবাদের কেউ আর আসতে বাকি নেই। এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে মেহেদি নেসার আর একপাশে হাতিয়াগড়ের ডিহিদার রেজা আলি। তার পাশে ইরাজ খাঁ, তার পাশে গোলাম হোসেন, তার পাশে..

আমি তাই আজ তোমাদের সকলকে আমার সামনে ডেকে পাঠিয়েছি। বিপদ যে সামনে এগিয়ে আসছে তা তোমরা বুঝতে পারছ। আর বিপদের দিনে যে আপন-পর ভাবলে চলে না তাও তোমরা জানো। এ-বিপদ যেমন আলিবর্দি খাঁ’র আমলে এসেছিল সে-বিপদ নয়। এরা পশ্চিম থেকে এসে দেশ লুঠপাট করে আবার নিজের দেশে ফিরে যাবে না। এরা মসনদ নিয়ে নেবে। হিন্দুস্থান নিয়ে নেবে। এরা দিল্লির বাদশার মসনদ কেড়ে নিয়ে তামাম হিন্দুস্থানে কায়েম হয়ে বসবে। আমি এই দুই হাত জোড় করে তোমাদের বলছি, তোমরা আমাকে ফৌজ দাও, টাকা দাও, সোনা দাও, তোমাদের যা কিছু আছে সব দিয়ে আমার মুর্শিদাবাদের মসনদ বাঁচাও। আমাকে বাঁচালে তোমরাও বাঁচবে, আমার মসনদ থাকলে তোমাদের মুর্শিদাবাদও থাকবে। আমি আল্লার নামে শপথ করে বলছি, মসনদ যদি এবার বাঁচে তো এ তোমাদের কাউকে দিয়ে আমি চলে যাব। দুরে কোথাও চলে গিয়ে আল্লার নাম করব-বলো তোমরা আমায় মদত দেবে? বলল তোমরা আমার পাশে থাকবে?

নবাব তখনও জগৎশেঠজিকে দেখতে পায়নি, তখনও একমনে কথা বলে চলেছে

হঠাৎ চেহেল্‌-সুতুনের ভিতর থেকে যেন কী-এক চিৎকার গোলমাল কানে এল।

নবাব অন্যমনস্ক হয়ে গেল কে? কার গোলমাল? কীসের আওয়াজ?

শুধু নবাব নয়, মেহেদি নেসারও যেন কান পেতে রইল সেইদিকে। ডিহিদার রেজা আলিও অন্যমনস্ক হয়ে গেল। আম-দরবারে যত আমির-ওমরাও ছিল সবাই-ই যেন একটু চঞ্চল হয়ে উঠল। এমন তো হয় না? তবে কি চকবাজারের রাস্তার লোকজন সবাই চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে ঢুকে পড়েছে?

জগৎশেঠজিও কেমন অবাক হয়ে গেলেন।

পাশে তখনও দাঁড়িয়ে আছে মনসুর আলি মেহের সাহেব। জিজ্ঞেস করলেন–ও কীসের আওয়াজ?

মোহরার সাহেবও বুঝতে পারছিল না। কান পেতে রইল। চেহেল্‌-সুতুনের হারেম থেকে এমন শব্দ তো কখনও আসে না।

জগৎশেঠজির কী যেন সন্দেহ হল।

জিজ্ঞেস করলেন–ফিরিঙ্গিরা এসে পড়ল নাকি?

কথাটা মনে লাগল মোহরার সাহেবের। বললে–দাঁড়ান, দেখে আসি—

বলে মনসুর আলি মেহের সাহেব কোথায় চলে গেল।

নবাব বোধহয় আবার কথা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু আওয়াজটা আরও বাড়ল যেন। এবার মেয়েলি গলার শব্দ স্পষ্ট শোনা গেল। চেহেলসুতুনের হারেমে এত বড় বেআদপি তো কখনও আগে আর ঘটেনি? তবে?

ইরাজ খা আর থাকতে পারলে না। বলে উঠল–নেয়ামত কোথায়? নেয়ামত?

নেয়ামত নেই। নেয়ামত তার আগেই হারেমের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। সেখানে তখন গোলমাল চলেছে চারদিকে।

পিরালি খাঁ দৌড়োচ্ছিল ভুলভুলাইয়ার দিকে। নেয়ামত ডাকলে খসাহেব, কী হল? গোলমাল কীসের?

কিন্তু খাঁ সাহেবের কানে বোধহয় সেশব্দ গেল না। কিন্তু নেয়ামতও ছাড়লে । পেছনে আসছিল নজর মহম্মদ।

কী রে নজর? নানিবেগমসাহেবা অত চেঁচাচ্ছে কেন?

নজর মহম্মদ চলতে চলতেই বললে–চোর ধরা পড়েছে চেহেলসূতুনে!

চেহেলসতুনের হারেমের ভেতর চোর? কথাটা যেন বিশ্বাস হল না নেয়ামতের।

বললে–কে চুরি করেছে?

আমিনা বেগমসাহেবা।

আমিনা বেগমসাহেবা? নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার মা? কী চুরি করতে গেল?

তবু নজর মহম্মদ সবটা খুলেও বললে–না। সোজা চলে গেল ভেতরের দিকে। আজ চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে যেন সব অরাজক অবস্থা। নেয়ামতকে দেখে চেহেল্‌-সুতুনের বেগমরা আর আড়ালে চলে গেল না। সেই তক্কি বেগম আলুথালু অবস্থাতেই একেবারে সামনে এসে হাজির হয়েছে।

জিজ্ঞেস করলে নেয়ামত, কী চুরি হয়েছে রে?

সেকথার উত্তর না দিয়ে নেয়ামত ভেতরের দিকে ছুটে গেল। সেখানে সব বেগমসাহেবারা এসে জুটেছে। জোরে জোরে কথা বলছে। বব্বু বেগম, গুলসন বেগম, পেশমন বেগম। সবাই।

হঠাৎ নবাবের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। আম-দরবার ছেড়ে নবাব হারেমের ভেতরে এসে ঢুকেছে।

পিরালি খাঁ?

সেই দাউদপুর থেকে সমস্ত রাস্তাটা উটের পিঠে দৌড়োতে দৌড়োতে এসে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল নবাব। তারপর ঘুম নেই, বিশ্রাম নেই। আম-দরবারে আমির-ওমরাদের ডেকে তোয়াজ তদবির খোশামদ করতে হয়েছে। ওদিকে মুর্শিদাবাদের মসনদ যখন বিপন্ন তখন হারেমের ভেতরে এ কী গোলমাল!

খোদাবন্দ।

পিরালি খাঁ খোজা সর্দার কুর্নিশ করে সামনে এসে দাঁড়াল।

এত গোলমাল কীসের?

হারেমের ভেতরে চোর ধরা পড়েছে।

কে চুরি করেছে? কী চুরি করেছে?

পিরালি খাঁ বললে–জি খোদাবন্দ, মালখানার হিরে, জহরত, মুক্তো, আসরফি

কে, কে?

আমিনা বেগমসাহেবা!

নবাবের মাথার ওপর যেন বাজ ভেঙে পড়ল। মা! মাথা থেকে পা পর্যন্ত যেন টলতে লাগল।

নানিবেগমসাহেবা খবর পেয়েই দৌড়ে কাছে এসেছে। বললে–শুনেছিস মির্জা, মেহের পালিয়েছে

ঘসেটি বেগম?

অনেক খুঁজলাম, কোথাও পাওয়া গেল না তাকে। সমস্ত হারেম খুঁজেছে পিরালি সর্দার–

নবাব মির্জা মহম্মদ মুখে কিছু বললে–না। নানিবেগমসাহেবার দিকে শুধু চেয়ে রইল। বললে–আর একটা কথা তো বললে–না নানিজি? আমার মার কথা তো বললে–না। মালখানা থেকে কী কী চুরি করেছে মা?

নানিবেগমসাহেবা বললে–ওকথা থাক, তুই মাথা ঠান্ডা কর, আয়, আমার সঙ্গে আয়

মির্জা বললে–না, নানিজি, আম-দরবারে আমি সকলকে বসিয়ে রেখে এসেছি, তারা সবাই অপেক্ষা করছে, আমি আসি। জানি কিছু হবে না। যার মা নিজের ছেলের জিনিস চুরি করে, যার মাসি শত্রু, তার কোনও আশা নেই। তবু একবার শেষ চেষ্টা করে দেখি। জগৎশেঠজি অনেক ডাকাডাকির পর শেষপর্যন্ত এসেছে

বলে আর দাঁড়াল না সেখানে। আবার ফিরে গেল আম-দরবারে।

বুড়ো সারাফত আলির তখনই সন্দেহ হয়েছিল। ভোরবেলা যখন চকবাজারের রাস্তায় প্রথম হল্লা শুরু হয় তখন নেশার ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে ছিল। তারপর যত বেলা বাড়তে লাগল ততই বাড়তে লাগল গোলমাল। একবার যেন আশা হল। হাজি আহম্মদের বংশটা তবে কি বরবাদ হল নাকি।

বাদশা।

বাদশা কাছে আসতেই মিঞাসাহেব বললে–এ কীসের গোলমাল রে?

হুজুর, নবাব লড়াই থেকে ফিরে এসেছে

অ্যাঁ?

আনন্দে খুশিতে যেন ডগমগ করে উঠল। নবাব হেরে গেছে? আল্লাহ্ তার আর্জি শুনেছে?

ওপাশে দোকানের সামনে কে একজন এসে দাঁড়াল। সারাফত আলি লোকটার দিকে চেয়ে দেখলে। শরিফ খানদানি আদমি বলে মনে হল যেন। আরক কিনতে এসেছে নাকি?

কী চাই? আগরবাতি? তাম্বাকু? খুশবু তেল?

ছোটমশাইয়ের এখানে আসতে একটু সংকোচই হয়েছিল। প্রথমত তাঞ্জাম নেই, হাতি নেই, হেঁটে আসা। তারপর সেই মহিমাপুর থেকে চকবাজার পর্যন্ত সমস্ত রাস্তাটায় কেবল মানুষের ভিড়। কত রকম লোক কত রকম কথা বলছে। কেউ বলছে নবাব লড়াইতে হেরে ফিরে এসেছে, কেউ বলছে নবাব বন্দুকের চোট খেয়েছে। কেউ আবার বলছে নবাব মারা গেছে। কেউ কারও কথা বিশ্বাস করছে না। কেউ বলছে ফিরিঙ্গিফৌজ এখনই মুর্শিদাবাদে এসে পড়ল বলে।

না, ধূপ চাই না।

তা হলে খুশবু তেল? ভরি দু’মোহর

ছোটমশাই বললে–না, এখানে কান্তবাবু বলে কেউ থাকে? কান্ত সরকার? আমি তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

বাদশা বললে–না বাবুজি, কান্তবাবু এখনই এসেছিল, একটু আগেই বেরিয়ে গেছে। আপনি কোত্থেকে আসছেন? আপনার নাম কী?

ছোটমশাই কী বলবে বুঝতে পারলে না। তারপর বললে–আমার নাম বললে–চিনতে পারবে না। কন আসবে কান্তবাবু?

আপনি একটু বসবেন?

বুড়ো সারাফাত আলির ভাল লাগল না কথাটা। বললে–কেন বসবে? কাহে বৈঠেগা? তুমি কে? তুম কৌন হে? কাহাসে আয়া হো? বাবুজি তুমহারা কৌন লগতা হ্যায়?

এতগুলো কথা বুড়োটার মুখ থেকে শুনতে হবে ভাবতে পারেনি ছোটমশাই। অথচ রাগারাগি করাও যায় না। মুখ বুজে সহ্য করাই ভাল।

বললে–আমার সঙ্গে তার নিজের একটা দরকার ছিল।

সারাফত আলি তখন বাদশাকে বলছে–যাকে-তাকে দোকানে বসতে বলছিস কেন? তোর দোকান? এ আমার দোকান, আমি এর মালিক, আমি যাকে এখানে বসতে দেব সে এখানে বসবে। আপনি এখন যান, এখানে কারও সঙ্গে দেখা হবে না।

ভেতর থেকে সমস্ত কথাগুলো শুনছিল ঘসেটি বেগম। একবার মনে হল নজরকুলি খাঁ নাকি? নজরকুলি খাঁ খবর পেয়েছে নাকি যে তার মেহেরুন্নিসা এখানে এসে উঠেছে?

একবার মনে হল চিৎকার করে বলে-নজর, এই যে আমি এখানে

কিন্তু আবার মনে হল, সে কী করেই বা জানবে যে তার মেহের এখানে এসে উঠেছে।

যে-লোকটা এতক্ষণ কথা বলছিল সে বোধহয় এখন চলে গেছে। আর কারও কথা শোনা গেল না। কিন্তু এমন করে এখানে চুপ করে বসে বসে সময় নষ্ট করেই বা কী হবে?

দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলে, সেই বাদশা রান্না করবার জোগাড় করছে। দরজার কাছে এসে ডাকলে বাদশা

বাদশা ডাক শুনে কাছে এল।

তোমার নাম বাদশা তো? ও কে এসেছিল বলতে পারো? এতক্ষণ কার গলা শুনছিলাম?

নাম জানি না বাঁদিজি, ও শায়েদ এমনি রাস্তার লোক, ওকে ডাকব?

ঘসেটি বেগম বললে–না, ডাকতে হবে না, তুমি গিয়ে ওকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারো? জিজ্ঞেস করে এসো গিয়ে ওর নাম কী।

বাদশা বললে–যাচ্ছি বাঁদিজি, আমি এখনই জিজ্ঞেস করে আসছি

ছোটমশাই তখনও বেশি দূরে যায়নি। রাস্তায় তখনও ভিড় হচ্ছে। সবার মুখেই আতঙ্কের ছায়া। সবাই কৌতূহলী হয়ে উঠেছে নিজামতের ভবিষ্যতের ভাবনায়।

ছোটমশাই কোনদিকে যাবে বুঝতে পারলে না। যখন চারদিকে গোলমাল, এই সময়ে মতিঝিলে গিয়ে দেখা করলে ক্ষতি কী? এখন কি আর পাহারাদার কেউ আছে সেখানে?নবাব তো লক্কাবাগ থেকে পালিয়ে এসেছে একলা। এখন তো ফৌজের সেপাই-সার্ভি সবাই সেখানে। এখন যদি কেউ চেহেল্‌-সুতুন থেকে। পালিয়ে বাইরে চলে আসে কে দেখতে পাবে? এই সময়টাই তো ভয়ের। এই সময়েই তো বেগমরা বাঁদিরা নবাবের সম্পত্তি লুটপাট করে নিয়ে পালায়। কতবার এইরকম হয়েছে আগে। এক-একজন নবাব মসনদ ছেড়েছে আর সেই সুযোগে কত চুরি কত রাহাজানি হয়ে গেছে নবাবের হারেমে।

মতিঝিলে যাবে নাকি একবার?

কিন্তু সেই দাড়িওয়ালা বুড়ো খিদমদগারটা! বুড়োটা কিছু কথা বলেনি। কোনও কথার জবাব দেয়নি, শুধু দরজাটা খুলে দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। কেন যে সে ছোটমশাইকে ছাড়িয়ে দিয়েছিল তারও কোনও উত্তর দেয়নি। ছোটমশাইকে মতিঝিল থেকে ছাড়িয়ে দিয়ে তার কী লাভ? কে তাকে পায়ে ধরেছিল ছোটমশাইকে ছেড়ে দিতে!

ছোটমশাই তবু জিজ্ঞেস করেছিল তাকে–মরিয়ম বেগমসাহেবা কোথায়, কোন ঘরে?

বুড়োটা জবাব দেয়নি।

তার সঙ্গে একবার আমার দেখা করিয়ে দিতে পারো তুমি?

তবু বুড়োটা কিছু বলেনি।

তারপর আর কোনও উপায় না দেখে ছোটমশাই একেবারে সোজা জগৎশেঠজির বাড়ির দিকে চলে গিয়েছিল।

কিন্তু এখন কোথায় যাওয়া যায়? জগৎশেঠজি তো নবাবের আমদরবারে গেছে। সেখানে নবাব হয়তো আবার শেষ চেষ্টা করে দেখবে। আবার ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই করে সব অপমানের প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করবে। কিন্তু তারই মধ্যে যদি বউকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসা যায়। দরকার হলে ঘুষ দেবে। জগৎশেঠজির কাছ থেকে নয়তো ধার করে টাকা নেবে।

মতিঝিলের কাছাকাছি এসে দাঁড়াল ছোটমশাই।

ফটকে অন্য দিনের মতো কোনও পাহারাদার নেই। নহবত-মঞ্জিলে নহবত থেমে গিয়েছিল, কিন্তু আবার বাজতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু তোকজন নেই কেন?

একবার মনে হল এই সুযোগে ঢুকে পড়বে নাকি ভেতরে? কিন্তু যদি ধরা পড়ে যায় তখন? তখন তো জবাবদিহি দেবার আর কেউ থাকবে না। ভেতরে মতিঝিলটার দিকে চেয়ে দেখলে। ঝিল পেরিয়ে বিরাট প্রাসাদ। এই বাড়ি তৈরি হবার সময় থেকেই দেখে আসছে ছোটমশাই।

বাবুজি।

চমকে উঠেছে ছোটমশাই। পেছন ফিরে দেখলে কে একজন তাকে ডাকছে। অচেনা মুখ।

তুমি কে?

লোকটি বললে–আমি বাদশা হুজুর। বাঁদিজি আমাকে পাঠিয়েছে

বাঁদিজি? কোন বাঁদিজি? কোথাকার বাঁদিজি?

লোকটা যেন খুলে বলতে চাইছে না সব। কিংবা বলতে ভয় পাচ্ছে।

শেষকালে বললে–আপনি আমাকে চিনতে পারছেন তো?

ছোটমশাই বললে–না

আমি সেই সারাফত আলি সাহেবের খুশবু তেলের দোকানের নোকর বাবুজি। আপনি একটু আগে সেখানে কান্তবাবুকে খুঁজতে গিয়েছিলেন। আমি সেখান থেকেই আসছি

ছোটমশাই বললে–তা কান্তবাবু কি ফিরে এসেছে?

না, লেকন বাঁদিজি আছে।

কে বাঁদিজি?

কান্তবাবুর সঙ্গে এক বাঁদিজি এসেছিল, চেহেল সুতুনের বাঁদিজি, সেই বাঁদিজি আপনার নাম জিজ্ঞেস করতে পাঠিয়েছে।

ছোটমশাই অবাক হয়ে গেল।

বললে–কিন্তু চেহেল্‌-সুতুনের বাঁদিজি তোমাদের দোকানে এল কেন?

তা জানি না বাবুজি। কান্তবাবু বলেছে চেহেল সুতুনের বাঁদিজি, তাই বলছি। আমি তার মুখ ভি দেখিনি, বোরখায় ঢাকা আছে–

ছোটমশাইয়ের মনটায় কেমন দোলা লাগল। বোরখা পরে আছে। চেহেল সুতুনের বাঁদিজি! এমন তো হয় না। এমন তো হবার কথা নয়। নিশ্চয় কোনও রহস্য আছে এর পেছনে। তবে কি কান্তবাবু তার স্ত্রীকে মতিঝিল থেকে বোরখা পরিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে এসে লুকিয়ে রেখেছে ওখানে?

এ বাঁদিজি কি তোমাদের দোকানে আগে কখনও এসেছে?

না হুজুর, বাঁদিজিরা দোকানে আসবে কেন? চেহেল্‌-সুতুনের খোজারা আসে মাল গন্ত করতে!

তুমি জানো কিছু বাঁদিজি কেন এসেছে?

না হুজুর, তা মালুম নেই, বাঁদিজি আজ সকালেই কান্তবাবুর সঙ্গে এসেছে। আপনাকে জিজ্ঞেস করতে বলেছে আপনার নাম কী

তোমার বাঁদিজি কি আমাকে চেনে? আমাকে দেখেছে?

তাও মালুম নেই হুজুর।

ছোটমশাই কী যেন ভাবলে। হয়তো চেহেল্‌-সুতুনের বাঁদিকে জিজ্ঞেস করলে মরিয়ম বেগমের সম্বন্ধে কিছু জানা যাবে। চেহেল্-সুতুনের বাঁদি যখন, তখন নিশ্চয়ই মরিয়ম বেগমকে চেনে।

তুমি বাঁদিজির কাছে আমাকে একবার নিয়ে যেতে পারবে?

বাদশা বললে–হুকুম না পেলে কী করে নিয়ে যাব হুজুর? বেগর অনুমতিতে আমি কী করে আপনার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেব? আপনার কী দরকার বলুন?

কী দরকার, সেটা বাঁদিজিকে বলব, তোমাকে বলা যায় না!

তা হলে আমি বাঁদিজিকে গুছিয়ে বলব।

ছোটমশাই বললে–তার চেয়ে এক কাজ করো, আমি তোমার সঙ্গে দোকান পর্যন্ত যাই, তুমি ভেতর থেকে বাঁদিজিকে জিজ্ঞেস করে আমাকে এসে ডেকে নিয়ে যেয়ো

বাদশা বললে–তা চলুন, তবে বেশি গোলমাল করবেন না হুজুর, সারাফত আলি সাহেব বড় গোসা করবে, বড় বদরাগী মানুষ

চলো

বলে ছোটমশাই আবার চকবাজারের দিকে চলতে লাগল বাদশার সঙ্গে সঙ্গে। আগের দিন সারারাত ঘুম হয়নি, সমস্ত দিনটাও বিশ্রাম হয়নি। তার ওপর মানসিক যন্ত্রণারও শেষ নেই। তারপর আজ ভোর থেকেই ঝঞ্ঝাট চলেছে। মুর্শিদাবাদের ভিত পর্যন্ত নড়ে গেছে যেন। হাতিয়াগড়ের মতো মুর্শিদাবাদেরও যেন সর্বনাশ ঘনিয়ে এসেছে।

হঠাৎ রাস্তার লোকগুলো যেন একটু বেশি চঞ্চল হয়ে উঠল। ফিরিঙ্গি ফৌজ আসছে। ফিরিঙ্গি ফৌজ আসছে। হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার।

যে যেদিকে পারছে দৌড়োত লাগল।

বাদশা থমকে দাঁড়াল। হোমশাইও খানিক থমকে দাঁড়াল। ফিরিঙ্গি ফৌজ আসছে। তা হলে তো ক্লাইভ সাহেবও আসছে।

সেই ১৭৫৭ সালের ২৪ জুন সমস্ত বাংলা মুলুক যেন আশায় আনন্দে উৎসাহে আত্মহারা হয়ে উঠল। আসছে, আসছে, ফিরিঙ্গি ফৌজ আসছে। ফিরিঙ্গি ফৌজ আসছে।

বাদশাও দৌড়োতে লাগল সকলের দেখাদেখি। ছোটমশাইও বাদশার পেছন পেছন জোর কদমে পা বাড়িয়ে দিলে। ক্লাইভ সাহেব আসছে। আর কিছু ভয় নেই আর কিছু দুঃখ নেই। এবার আর সুন্দরী মেয়ে-বউদের লুকিয়ে রাখতে হবে না। টাকা কড়ি-গয়না-মোহর আর মাটিতে পুঁতে রাখতে হবে না।

বাদশা পেছন ফিরে চিৎকার করে ডাকলে জলদি আসুন হুজুর, জলদি

ছোটমশাই তখন ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে পড়েছে। তবু কোনওরকমে শরীরটাকে টেনে নিয়ে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলতে লাগল।

সারাফত আলি সাহেব সকালবেলার দিকে একটু তাজা থাকে। আগের রাত্রের নেশা তখন সবটাই কেটে যায়। সকালবেলার দিকে খুশবু তেলের দোকানে তেমন খদ্দের আসে না। কিন্তু তাতে কিছু ক্ষতি হয় না সারাফত আলি সাহেবের। খদ্দের না থাকাই ভাল। আর নেশার জিনিসের কারবার আলি সাহেবের, নেশার জিনিস সকালবেলা কে কিনবে? তখন মালের হিসেব রাখবার সময়। লাভ-লোকসানের কথা বড় একটা ভাবে না সারাফত আলি সাহেব। লাভ-লোকসানের কথাই যদি ভাববে তত দিল্লি ছেড়ে এখানে এই বাংলা মুলুকে–এই মুর্শিদাবাদে দোকান করতে আসবে কেন সে?

কিন্তু বয়েসও তো হচ্ছে! যত বয়েস হচ্ছে ততই কুঁজো হয়ে পড়ছে। মনে হয় আর বোধহয় কিছু দেখে যেতে পারবে না। এই চেহেল্-সুতুন, এই নিজামতের বরবাদি এ-জিন্দগিতে বোধহয় আর দেখা হল না।

সকালবেলাই একটা বেত্তমিজ এসে মেজাজটা বিগড়ে দিয়ে গিয়েছিল। সারাফত আলি সাহেব ভেবেছিল সকালবেলাই বুঝি খুশবু তেলের খদ্দের এসেছে। কিন্তু না, খদ্দের নয়, কান্তবাবুকে খুঁজতে এসেছে

হিসেব করতে করতে হঠাৎ মনে হল চকবাজারের রাস্তায় গোলমালটা যেন আবার বেড়ে উঠল।

ক্যা হুয়া?

রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলে তোকজন দৌড়োচ্ছ আর বলছে–ফিরিঙ্গি ফৌজ আসছে–ফিরিঙ্গি ফৌজ আসছে

ফিরিঙ্গি ফৌজ আতা হ্যায়!

বুড়ো লাফিয়ে উঠল। লাফিয়ে উঠতে গিয়ে হিসেবের খাতাটা কোল থেকে ছিটকে পড়ল মাটিতে। তা পড়ুক।

বাদশা, বাদশা

বাদশার সাড়াশব্দ নেই। এক ডাকে বেল্লিকটা জবাব দেবেনা কখনও। সোজা ভেতরের দিকে গিয়ে ডাকলে-বাদশা, বাদশা, এ বাদশা

কোথাও নেই বাদশা। কোথায় গেল বেত্তমিজটা! লোকগুলো কী বলছে সেইটে জানতে হবে। ফিরিঙ্গি ফৌজ কি সত্যিই আতা হ্যায়? কখন আসবে? কখন এসে নিজামতে চড়াও হবে, জানা দরকার।

হঠাৎ বুড়োর মনে হল কাবাবুর ঘরের ভেতরে কে যেন বসে আছে। মানুষের মতো মালুম হচ্ছে।

কৌন? কৌন ইহা? কৌন তুম? কান্তবাবু?

কিছু জবাব নেই কারও। সারাফত আলি সাহেব আস্তে আস্তে ঘরের দরজাটা হাট করে খুলে ভেতরে ঢুকল।

ঘসেটি বেগম তখন ভয়ে কাঁপছে।

কৌন তুম? তুম কৌন হো?

তবু জবাব নেই। সারাফত আলি সাহেব একেবারে মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ল।

বলে–কৌন তুম?

সেই ছোট ঘুপচি ঘরের মধ্যে ঘসেটি বেগম তখন ঘামছে। বোরখার ভেতরে তার হাতের পুঁটলিটা বারবার হাত থেকে খসে যাবার জোগাড় হচ্ছিল।

সারাফত আলি সাহেবের দৃষ্টি ক্ষীণ হতে পারে, কিন্তু নেশার ঘোর তখন কেটে গেছে।

বললে–জবাব দেও, কৌন তুম? ইহা ক্যায়সে আয়ি

তবু জবাব দিতে ঘসেটি বেগমের ভয় হল। যদি জানাজানি হয়ে যায় শহরে যে ঘসেটি বেগম এই খুশবু তেলের দোকানে লুকিয়ে আছে, তা হলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। নজরকুলি খাঁ যদি এর মধ্যে এসে পড়ে, তা হলেই সে যেন বেঁচে যায়। কিন্তু এত দেরিই বা করছে কেন সে এখানে আসতে! তবে কি মরিয়ম কোনও খবর দেয়নি তাকে? না, নজরকুলি এখনও বাড়ি ফেরেনি। রাত্রে কোথায় যায় সে? যদি কোথাও গিয়েই থাকে তো এত দেরি করে কেন বাড়ি ফেরে?

সারাফত আলি আর দেরি সহ্য করতে পারলে না।

জীবনে অনেক প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধ স্পৃহা বুকের মধ্যে পুষে রেখে রেখে বুড়ো হয়ে গেছে। সে। অনেক আরক অনেক তামাক অনেক আগরবাতি হজম করে ফেলেছে মিছিমিছি। পাঠান দেশ থেকে পায়ে হেঁটে হেঁটে বাংলা মুলুকে এসেছে শুধু কি এই আরক আর তামাকের আর ধূপের কারবার করবার জন্যে? এতদিন যে রাগ পুষে রেখেছে বুকের মধ্যে সে কি শুধু নিজের মনে মনে পুড়ে ছাই হবার জন্যে?

জবাব দেও–দেও জবাব!

আর দেরি করলে না সারাফত আলি। এক টানে ঘসেটি বেগমের বোরখাটায় টান দিলে, আর ঘসেটির মুখখানা স্পষ্ট বেরিয়ে পড়ল সারাফত আলির ঝাপসা দৃষ্টির সামনে।

মুখখানা দেখে চিনতে পারলে না বুড়ো৷ একেবারে মুখখানার কাছে নিজের গোঁফ-দাড়িওয়ালা মুখখানা নিচু করে নামিয়ে নিয়ে এল।

বললে–কৌন হ্যায় তুম?

আমি বাঁদি হুজুর, চেহেল্‌-সুতুনের বাঁদি!

চেহেলসূতুনের বাঁদি তো এখানে কেন? ইহা কেঁও?

ঘসেটি বেগম ভয়ে ভয়ে বললে–হুজুর, চেহেল্‌-সুতুনে ইনকিলাব শুরু হয়েছে

ইনকিলাব?

হ্যাঁ হুজুর, ইনকিলাব শুরু হয়েছে। লুঠপাট-খুনজখম চলছে, আমি ঘসেটি বেগমসাহেবার বাঁদি রাবেয়া। মেরা নাম রাবেয়া খাতুন, তাই পালিয়ে এসেছি

ঘসেটি বেগম?

ঘসেটি বেগমের নামটা শুনেই সারাফত আলির পাঠানি রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠল। কী করবে বুঝতে পারলে না হঠাৎ। তার পরে একটু সংবিৎ ফিরতেই ঘসেটি বেগমের চুলের মুঠি ধরলে। বললে–চল, আমার সঙ্গে চল। ইনকিলাবের সময় তুই কেন বাঁচবি? তোকেও মরতে হবে। চল আমার সঙ্গে ঘসেটি বেগমের সঙ্গে তোরও কবর দেব–

ঘসেটি বেগমের বাঁদি যে কী অপরাধ করেছে, তার কোনও প্রমাণ নেই। তোক বাঁদি, কিন্তু এই বাঁদিরাই তো বেগমসাহেবাদের খেদমত করে। এই বাঁদিরাই হাজি আহম্মদের ছেলের বউদের তদ্বির-তদারক-খোশামোদ করে। সেই বউরাই তো মুর্শিদাবাদের নবাবকে পয়দা করেছে। হাতের কাছে বেগমদের না পেয়ে যেন বাদিদের ওপর অত্যাচার করেই সারাফত আলি তার নিজের অপমানের প্রতিশোধ নিতে চাইছে।

ডাকলে–বাদশা-বাদশা

ডেকেই কিন্তু মনে পড়ল, বাদশা বাড়িতে নেই। কোথাও গেছে। তা হলে নিজেকেই যেতে হয়।

হঠাৎ ঘসেটি বেগমের চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে তাকে বাইরে নিয়ে এল সারাফত আলি। বেশ দিন হয়ে গেছে তখন। রাস্তায় লোকজন জমে গেছে। চেহেল্‌-সুতুনের বোরখা-পরা মেয়েমানুষকে রাস্তায় হিড়হিড় করে টানাটানি করতে দেখে ভিড় জমে গেল চারপাশে।

কেয়া হুয়া আলিসাহেব?

সারাফত আলি বুড়ো মানুষ। আগেকার মতো শরীরে তাকত নেই। কিন্তু রাগ আছে। রাগের তেজও আছে। চিৎকার করে উঠল–চল, উল্লুকা-পাঠঠা।

চারপাশের মানুষ আবার জিজ্ঞেস করলে–কী হয়েছে আলিসাহেব?

আরে জনাব, এ-হারামজাদি বাঁদি চেহেলসুতুনের বেগমসাহেবাদের খেদমত করেছে, বেগমসাহেবাদের হুকুম তামিল করেছে, বেগমসাহেবাদের তদ্বির-তদারক-খোশামোদ করেছে এবাদি হারামজাদি আছে–

লোকগুলো হো হো করে হেসে উঠল। বেগমসাহেবাদের খেদমত করেছে, খোশামোদ করেছে তা কী হয়েছে? বেগমসাহেবাদের খেদমত করা কি গুনাহ?

আলবাত গুনাহ! হাজারবার গুনাহ! বেগমসাহেবরা তো হাজি আহম্মদের বংশের নবাবের মা, নবাবের মাসি, নবাবের আওরত!

লোকগুলো আরও জোরে হেসে উঠল। নবাব নিয়ে এত জোরে হাসি-ঠাট্টা-তামাসা করবার সাহস কালকেও ছিল না কারও। অথচ এক রাত্রের মধ্যে কী আমূল পরিবক্স হয়ে গেল। শুধু নবাব নয়, নবাবের মা, নবাবের বেগম নিয়েও হাসি-ঠাট্টা-তামাসা। এ যেন কাল কেউ কল্পনাও করতে পারত না।

থুঃ থুঃ থুঃ–সেই প্রকাশ্য দিনের আলোয় সারাফত আলি সাহেব হঠাৎ এক কাণ্ড করে বসল। আর কিছু করতে পেরে ঘসেটি বেগমের মাথার ওপর থুঃ থুঃ করে থুতু ফেলতে লাগল। যেন ঘসেটি বেগমের মাথার ওপর থুতু ফেললেই হাজি আহম্মদের বংশের ওপর চূড়ান্ত প্রতিশোধ নেওয়া যাবে।

সারাফত আলি সাহেবের কাণ্ড দেখে চকবাজারের রাস্তার মানুষ যেন এক বিনা-পয়সার মজা পেয়েছে। তারা হেসে গড়িয়ে পড়ল। সারাফত আলি সাহেবের দেখাদেখি তারাও থুতু ফেলতে লাগল ঘসেটি বেগমের মাথার ওপর।

সারাফত আলি সাহেবের আনন্দ আর ধরে না। বললে–ফেকো থুক, থুক ফেকো

অর্থাৎ–আরও থুতু ফেলল। আরও প্রতিশোধ নাও। আমার বিবির ওপর হাজি আহম্মদ যে অত্যাচার করেছে, তোমরা সকলে মিলে দল বেঁধে তার প্রতিশোধ নাও। এই নিজামত, এই নবাব, এই মুঘল-শক্তির মাথার ওপর তোমরা থুতু ফেলল। আবার পাঠান রাজত্ব আসুক, ফিরিঙ্গি রাজত্ব আসুক, আবার মারাঠি রাজত্ব আসুক। আমি সব সহ্য করব মুখ বুজে। কিন্তু হাজি আহম্মদের বংশকে মুর্শিদাবাদের মসনদে বসতে দেব না। আমি অনেক আরক খাইয়েছি ওই বেগবাদিদের, অনেক আসরফি খরচ করেছি এদের মারতে। এতদিন এদের কাউকে হাতের কাছে পাইনি, আজ পেয়েছি। আজকে একেই, এই বাঁদিকেই খতম করি

থুঃ থুঃ থুঃ—

হঠাৎ ঘসেটি বেগম কাকে দেখে চিৎকার করে উঠল–নজর-নজর–আমার নজর

নজরকুলি খাঁ রাজনীতিও বোঝে না, রানিনীতিও বোঝে না। একটা নীতিই শুধু সে বোঝে, সে হল নারীনীতি। জীবনে কোনও সুখকেই সে সুখ বলে মনে করে না, একমাত্র নারীসুখ ছাড়া। আল্লাহ তাকে মেয়েমানুষ-ভোলানো রূপ দিয়েছিল। সেইটেই ছিল তার মূলধন। সেই মূলধন ভাঙিয়েই সে একদিন সুখের সিংহাসনে বাদশা হয়ে বসেছিল। এই ঘসেটি বেগমসাহেবাই একদিন তার রূপ-যৌবন দেখে তাকে মতিঝিলের বিছানায় পাশে নিয়ে শুয়েছিল। কিন্তু যেদিন নবাব মির্জা মহম্মদ মতিঝিলে হামলা। করে ঘসেটি বেগমকে পাকড়াও করে নিয়ে আসতে গিয়েছিল, সেদিন থেকেইনজরকুলি খাঁর জীবনের সব সুখ চলে গিয়েছে। ঘসেটি বেগমের দেওয়া সোনাদি-মোহর নিয়ে চলে গিয়েছিল কাশী। কিন্তু জুয়াতে আর ভাঙে সব হারিয়ে আবার মুর্শিদাবাদে ফিরে এসেছিল। সেই মোহর নেই, সেই রূপ নেই, সেই আগেকার যৌবন নেই তখন। কিন্তু যৌবনের নেশা তখনও যায়নি। সেই রাত হলেই। মেহেরউন্নিসার কথা মনে পড়ত আর চকবাজারে বস্তির মধ্যে গিয়ে বাজারের ভাড়া করা মেহেরউন্নিসাদের সঙ্গে শুয়ে পুরনো আস্বাদ বাজিয়ে নিত।

সেদিনও নজরকুলি বস্তিতে রাত কাটিয়ে ফিরছিল অন্য দিনের মতো। কিন্তু রাস্তার মধ্যে গোলমাল, হল্লা আর ভিড় দেখে থমকে দাঁড়াল। কে? সারাফত আলি সাহেবকার মাথায় থুতু ফেলছে অমন করে! ভেতরে কে?

উঁকি মেরে দেখতে গিয়েই মেহেরউন্নিসার গলার আওয়াজ এল নজর–নজর–মেরা নজর–

এতক্ষণে সারাফত আলি সাহেব নজর দিয়ে দেখলে নজরকুলির দিকে।

মেহের, মেহের, মেরা মেহের

মেহেরউন্নিসার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল নজরকুলি খাঁ। কিন্তু বুড়ো সারাফত আলি সাহেব। তার চুলের মুঠিটা ধরে ফেলেছে।

দুশমন, বেত্তমিজ কাহিকা

কিন্তু নজরকুলিই বা কম যায় কীসে। একদিন তার স্বাস্থ্য ছিল, একদিন শ্বেতপাথরের মতন চকচকে ছিল তার পেশিগুলো। তখন মুর্শিদাবাদের মেয়েরা তার দিকে লোভাতুর দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে থাকত। তারপর জুয়া, রাত-জাগা আর অত্যাচারের ফলে সে চেহারার বাহার আর নেই। কিন্তু তবু যা আছে, তাতে তখনও বুড়ো সারাফত আলিকে কাবু করা যায়।

নজরকুলি খাঁ-ও সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠেছে তবে রে বুড়ো মিঞা

আর তারপর সেই সকালবেলা চকবাজারের রাস্তার ওপরেই দু’জনের মল্লযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। এতদিন শুধু দূর থেকেই সারাফত আলি সাহেব মনে মনে পুড়েছে, এতদিন শুধু দূর থেকেই সারাফত আলি অভিশাপ দিয়েছে নিজামতকে। আর আজ যেন লড়াই করবার মতো একটা লোক পেল প্রথম। বুড়ো হাড়ে যতটা শক্তি ছিল, সব দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল নজর কুলির ওপর ।

আর চারপাশে যারা মজা দেখছিল, তারা তখন তামাসা পেয়ে লাফিয়ে উঠেছে লে ঝটাপট–লে ঝটাপট-লে

যখন নজরকুলি খাঁ আর সারাফত আলি জড়াজড়ি করে রাস্তার ওপর গড়াগড়ি খাচ্ছে, আর লোকগুলো সবাই সেই দিকে দেখতে ব্যস্ত, তখন ঘসেটি বেগম এক ফাঁকে লুকিয়ে পড়ল। তারপর ভিড়ের মধ্যে দিয়ে একেবারে বাইরে বেরিয়ে এল সকলের চোখের আড়ালে। আর তারপর যেদিকে পারলে ছুটে চলতে লাগল।

দু’-একজন বুঝি দেখতে পেয়েছিল।

ওরে, বাঁদিজি ভাগ রহি হ্যায়

ছুট ছুট–পাকড়ো, পাকড়ো

কিছু লোক বাঁদির পেছন পেছন ছুটতে লাগল। কিন্তু ঘসেটি বেগমসাহেবার তখন চরম বিপদ। তিরের মতো ছুটতে ছুটতে চলেছে সে। আর কোনও দিকে তার যাবার নিশানা নেই–সামনেই চেহেলসূতুনের ফটক ভোলা পড়ে রয়েছে। পাহারাদার নেই। তার ভেতরেই সোঁ সোঁ করে ঢুকে পড়ল।

ইনসাফ মিঞা তখন জয়জয়ন্তীর কোমল নিখাদে সবে নেমেছে। সেই নিখাদটা নিয়ে সে কায়দা করে আবার গান্ধারে যাবে, হঠাৎ ছোটে শাগরেদ বললে–উস্তাদজি উ কৌন ভাগ আতি হ্যায়?

ওপর থেকে নীচের সব দেখা যায়। নিচু হয়ে দেখলে।

কিন্তু ইনসাফ মিঞা বাধা পেয়ে খেপে গেছে। একেই মেজাজ বিগড়ে আছেনবাবের ব্যাপার নিয়ে। টোড়ি থেকে জয়জয়ন্তী বাজাতে হয়েছে, তার ওপর ছোটে শাগরেদের এই বখেড়া। বাজনা থামিয়ে একটা ধমক দিয়ে উঠল–চোপরাও বেল্লিক

রসের বাধা পড়লে গুণীর মুখ দিয়ে তো গালাগালি বেরোবেই।

কিন্তু ওদিকে তখন সারাফত আলি সাহেবের খুশবু তেলের দোকানের সামনে ভিড় আরও বেড়ে গেছে। দুটো ষাঁড়ে লড়াই লাগলেও চকবাজারের রাস্তাতে এমনি মানুষের ভিড় জমে। আর এ তো মোগলে-পাঠানে লড়াই। বুড়ো আর জোয়ানে। বুড়ো সারাফত আলির মেহেদি রং-লাগানো দাড়িটা। ধরে নজরকুলি তখন প্রাণপণে টানছে। আর সারাফত আলিও জোরে জাপটে ধরে আছে নজরকুলি খাঁ-কে–

যত জড়াজড়ি চলেছে, তত ভিড় বাড়ছে মানুষের।

বাদশা ছোটমশাইয়ের সঙ্গে আসছিল। দূর থেকে তার নজরে পড়েছে। ফিরিঙ্গি ফৌজের কথাটা কানে আসতেই যে-যেদিকে পারে দৌড়োচ্ছিল। বাদশাও দৌড়োচ্ছিল খুশবু তেলের দোকান লক্ষ্য করে।

ছোটমশাই সেই বয়েসে বাদশার সঙ্গে দৌড়িয়ে পারবে কেন?

বাদশা একবার পেছন ফিরে ডাকলে–জলদি আইয়ে বাবুজি–জলদি

ছোটমশাই বললে–একটু আস্তে, একটু আস্তে চলো

ফিরিঙ্গি ফৌজ আসছে, তুরন্ত চলে আসুন—

কিন্তু অত তাড়াহুড়ো সহ্য হবে কেন ছোটমশাইয়ের। একদিন হলেও নাহয় সহ্য হত, কিন্তু এ যে ক’ মাস ধরেই এইরকম চলছে। তবু যদি লোকটার সঙ্গে গেলে একটা কিছু হদিস পাওয়া যায়, তাই প্রাণ বার করে বাদশার সঙ্গে সঙ্গে আসছিল।

হঠাৎ বাদশা দোকানের কাছাকাছি এসে অত মানুষের ভিড় দেখে অবাক হয়ে গেছে। এই একটু আগেই যখন সে দোকান থেকে চলে গিয়েছিল বাবুজিকে ডাকতে, তখনও তো এত হল্লা ছিল না। কী হল আবার? ফিরিঙ্গি ফৌজ আসবার খবর পেয়ে সবাই বুড়ো সারাফত আলির দোকানের সামনে এসে জুটেছে নাকি?

ছোটমশাইও দেখেছে। এত ভিড় হল কেন? তবে কি মরিয়ম বেগমসাহেবা ধরা পড়ল?

ও বাদশা, ওখানে তোমাদের দোকানের সামনে অত হল্লা কেন?

বাদশা সেকথার উত্তর না দিয়ে একেবারে জটলার পেছনে এসে দাঁড়াল। তারপর ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখবার চেষ্টা করলে

কেয়া হুয়্যা ভাইয়া? ইহা কেয়া হোতা হ্যায়?

কিন্তু কে আর তখন বাদশার কথার উত্তর দেবে। তারা সবাই হুমড়ি খেয়ে তামাসা দেখছে। মজাটার কিছু অংশও যেন ফসকে না যায়।

কিন্তু বাদশা ভাল করে কিছু দেখতে পাবার আগেই ফয়সালা হয়ে গেছে। চরম ফয়সালা। সারাফত আলি নজরকুলি খাঁর ধাক্কা খেয়ে তখন সেই যে মাটিতে মুখ গুঁজে পড়ল আর উঠতে পারলে না। শুধু শেষ নিশ্বাস ফেলবার আগে একবার বলতে চেষ্টা করলে ইয়া আল্লা–

কিন্তু বোধহয় তখন তার অন্তিম অবস্থা। সেই শব্দটুকু উচ্চারণ করবার শক্তিটুকুও তার নেই। সেই যে বুড়ো মুখ গুঁজড়ে পড়ে রইল আর উঠল না।

নজরকুলি তখন বিজয়ীর মতন তার গায়ের ওপর দু’চারটে লাথি মারলে। তাতেও সাড়া নেই সারাফত আলির। সারাফত আলি যেন তখন নিজের আরক খেয়ে অজ্ঞান-অচৈতন্য হয়ে সেখানে আচ্ছন্ন হয়ে আছে।

বাদশা এতক্ষণে বুঝতে পারলে। কোনওরকমে ভিড় ঠেলে যখন ভেতরে যেতে পারলে, ততক্ষণে সব শেষ সব খতম–

নজরকুলি খাঁ এদিক-ওদিক চাইতে লাগল। মেহের? মেহের কোথায় গেল?

কে একজন বদ ছোকরা বুঝি রসিকতা করে বললে–পঞ্জি ভাগ গয়ি–

আর ছোটমশাই! ছোটমশাই যখন দেখলে বুড়ো সারাফত আলি, খুশবু তেলের দোকানের মালিক, খুন হয়ে গেছে, তখন ভয়ে আঁতকে উঠল।ঝগড়াটা কাকে নিয়ে? মরিয়ম বেগমসাহেবাকে নিয়ে নাকি?

সামনের একজনকে ছোটমশাই জিজ্ঞেস করলে মেয়েটা কে?

জনাব, সে চেহেলসূতুনের এক বাঁদি

কোথায় গেল সে?

জনাব, সে ভাগ গয়ি।

ভাগ গয়ি মানে? কোথায় ভাগ গয়ি? কোন দিকে?

ওই দিকে। ওই চেহেল সুতুনের দিকে। ছুটতে ছুটতে আবার চেহেল্-সুতুনের ভেতরেই ঢুকে পড়েছে।

যেন বাজ ভেঙে পড়ল ছোটমশাইয়ের মাথায়। মতিঝিল থেকে বেরিয়ে আর কোনও উপায় না দেখে ছোটবউ হয়তো কান্তবাবুর সঙ্গে এখানেই এসেছিল। ভেবেছিল এখানে এসে তারপর কোনওরকমে খবরটা পাঠাবে হাতিয়াগড়ে। তা আর হল না। তার আগেই খুশবু তেলের দোকানের মালিক টের পেয়ে গেছে। তারপর মারামারি হাতাহাতি খুননাখুনি শুরু হয়ে গেছে। সেই ফাঁকে আর কোনও উপায় না পেয়ে আবার চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে গিয়ে ঢুকেছে

তাড়াতাড়ি সেখান থেকে বেরোল ছোটমশাই!

আর দেরি করা চলে না। খবরটা গিয়ে দিতে হবে জগৎশেঠজিকে। আবার মহিমাপুরের দিকে চলতে লাগল ছোটমশাই—

মরালী খুশবু তেলের দোকান থেকে বেরিয়ে নজরকুলি খাঁ’র বাড়ির দিকেই যাচ্ছিল। কিন্তু নহবতমঞ্জিলে আবার বাজনার শব্দ শুনে কেমন যেন সন্দেহ হল। আবার নহবত বেজে উঠল কেন? নবাব কি তবে লড়াইতে জিতেছে। নবাবের ফৌজ লড়াই জিতে ফিরে আসবার খবর পৌঁছে গেছে?

সারা মুর্শিদাবাদ যেন পাগল হয়ে উঠেছে ভোরবেলা থেকে।

একজন বুড়োমন লোক দেখে মরালী জিজ্ঞেস করলে কী হয়েছে শহরে? আপনি জানেন কিছু?

লোকটা মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখলে ভাল করে। তারপর নিঃসন্দেহ হয়ে বললে–জনাব কোন মুলুকের লোক?

মরালী আড়ষ্ট হয়ে গেল কথাটা শুনে। সন্দেহ করছে নাকি?

জনাব কি নয়া এসেছেন মুর্শিদাবাদে?

মরালী আর দাঁড়াল না সেখানে। একবার পেছন ফিরে দেখে নিলে লোকটা তাকে দেখছে কিনা। তারপর আবার সামনের দিকে চলতে লাগল। চড়া রোদ উঠেছে আকাশে।

কিন্তু খবরটা তখন মুখে মুখে ফিরছে।

কী বললেন জনাব?

হাঁ জি, নবাব খতম, নিজামত ভি খতম

তার মানে?

তারপর সব খবরটা বেরিয়ে এল। নবাব লড়াইতে হেরে গেছে। যা শুনেছিল, সব তা হলে সত্যি। ফিরিঙ্গি ফৌজ মুর্শিদাবাদে আসছে। তা হলে কী হবে? সেই ক্লাইভ সাহেব এসে নবাব হবে মুর্শিদাবাদের? এই মুর্শিদাবাদের মসনদে বসবে?

সঙ্গে সঙ্গে আবার ফিরল। সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকানের দিকে আবার চলতে লাগল। ফিরিঙ্গি ফৌজ আসবার আগেই যা-কিছু বন্দোবস্ত সব শেষ করে ফেলতে হবে। ঘসেটি বেগমসাহেবাও হয়তো সেই ঘুপচি ঘরের ভেতরে বসে বসে ভাবছে! নজরকুলি খাঁ-কে ডেকে দেবার কথা ছিল, তার জন্যে অপেক্ষা করছে।

কিন্তু কাছাকাছি আসতেই নজরে পড়ল খুশবু তেলের দোকানের সামনে অনেক মানুষের ভিড়। ওখানে কী হচ্ছে। তবে কি জানাজানি হয়ে গেছে যে, ঘসেটি বেগমসাহেবা বাদির পোশাক পরে ওখানে লুকিয়ে আছে?

কী ভেবে মরালী সেখানেই খানিক দাঁড়িয়ে পড়ল। ওখানে আর যাওয়া চলে না। তা হলে কোথায় যাবে?

আবার চলতে লাগল উলটো দিকে। উলটো দিকের পথও তো মহিমাপুরে যাবার পথ। জগৎশেঠজির বাড়ির পথ। জগৎশেঠজির কাছে যাবে? জগৎশেঠজিকে গিয়ে সব বলবে? এখন সত্যি কথাটা বলতে আর দোষ কী? এখন তো জানাজানি হলে আর কিছু ভয় নেই। এখন যদি জগৎশেঠজিকে গিয়ে একবার ছোটমশাইকে খবর দিতে বলে, তা কি আর তিনি দেবেন না?

জগৎশেঠজিকে গিয়ে স্পষ্টই বলে দেবে আমি আসল মরিয়ম বেগম নই, আসল মরিয়ম বেগম মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের বাড়িতে আছে–আপনি হাতিয়াগড়ের ছোটমশাইকে একবার খবরটা পাঠান–

আর তা ছাড়া এখন যদি মেহেদি নেসার সাহেব জানতেও পারে যে, রানিবিবি সেজে শোভারাম বিশ্বাসের মেয়ে চেহেল্‌-সুতুনে এসেছিল, তাতেও কোনও ক্ষতি নেই। এখন তো সব ফিরিঙ্গি রাজত্ব হয়ে যাচ্ছে। এখন তো নবাব হবে ক্লাইভ সাহেব!

মুখটা ফেরাতেই হঠাৎ দেখলে সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ মশাই—

একী, আপনি?

হ্যাঁ মা, আমি

কোথায় যাচ্ছেন?

সচ্চরিত্র বললে–আমি মা চলে যাচ্ছি মতিঝিল ছেড়ে, শুনলাম নাকি ফিরিঙ্গি ফৌজ মুর্শিদাবাদে আসছে?

তা আর সবাই কোথায়?

কেউ নেই মা, সবাই চাকরি ছেড়ে পালিয়েছে। আমিই বা আর থাকি কেন? একবার মোছলমান হয়েছি, এবার হয়তো আবার খিরিস্টান হতে বলবে–

বলে ইব্রাহিম খাঁ হাউহাউ করে কেঁদে উঠল।

আর কান্ত? সে কোথায় রইল?

সচ্চরিত্র বললে–আমি বাবাজিকে অনেক করে বললাম আমার সঙ্গে আসতে। কিন্তু এল না

কেন?

বাবাজি বললে–না, মেহেদি নেসার যদি জানতে পারে মরিয়ম বেগমসাহেবা পালিয়ে গেছে তো মরালীর ওপর অত্যাচার করবে। তার চেয়ে আমি এখানেই থাকি।

মরালী বললে–তা এখন তো আর কেউ নেই সেখানে, তবু কেন রইল?

ও মা, শুধু তোমার জন্যে। শুধু তোমার বিপদের কথা ভেবেই বাবাজি একলা পড়ে রইল। আমি কত করে পালিয়ে যেতে বললাম, তবু শুনলে না। তোমার কথা ভেবে ভেবেই বাবাজি অস্থির। কেবল বলছে, মরালীর যেন কোনও ক্ষতি না হয়, আমার যা হয় হোক–একেবারে আস্ত পাগল।

মরালী বললে–চলুন, আপনিও আমার সঙ্গে চলুন, আমি নিজে গিয়ে তাকে বার করে আনছি।

সচ্চরিত্র বললে–তাই চলো মা, তাই চলল। আমার কথা তো বাবাজি শুনবে না, এখন তোমার কথা যদি শোনে–

মরালী তাড়াতাড়ি মতিঝিলের দিকে চলতে লাগল। পেছন পেছন সচ্চরিত্র পুরকায়স্থও চলল।

মতিঝিলের সামনে-পিছনে তখন মানুষের মিছিল, কিন্তু ভেতরটা ফাঁকা, আগে অন্যদিন যেখানে খিদমদগারদের জটলা চলত, চবুতরার আশেপাশে যেখানে নবাব-বেগমদের তাঞ্জাম-পালকি-হাতি-ঘোড়ার জটলা হত, সেখানেও কেউ নেই।

মরালীর মনটা তখনও পড়ে ছিল সেই সারাফত আলির দোকানে। মাত্র কিছুক্ষণের জন্য ছিল সেখানে। কিন্তু তারই মধ্যে দেখে এসেছিল কোথায় কোন ঘরে কেমন করে কান্ত থাকে। অন্ধকার ঘুপচি ঘরখানা। বাইরের আলো বাতাস ঢোকে না সেখানে। তবু ওইখানেই দিনের পর দিন কাটিয়েছে।

আচ্ছা, ঘটকমশাই, ওখানে অত ভিড় ছিল কেন বলুন তো?

কোথায় মা?

ওই যে সারাফত আলি সাহেবের খুশবু তেলের দোকানের সামনে?

সচ্চরিত্র বললে–কী করে বলব মা, আজকে তো সব জায়গাতেই ভিড়। সবাই-ই তো মুর্শিদাবাদ ছেড়ে পালাচ্ছে। ফিরিঙ্গি ফৌজের ভয়ে কেউ আর এখানে থাকতে চাইছেনা।

ফিরিঙ্গিরা এসে অত্যাচার করবে নাকি?

না, তার জন্যে নয় মা। সবাই কাজকর্ম বন্ধ করে দিয়েছে যে। ভিস্তিরা আজ সকাল থেকে জল দেয়নি, যে-হাতিগুলো আছে পিলখানায় তারা খেতে পর্যন্ত পায়নি কাল থেকে। মুর্শিদাবাদের ঘাটে মদের জালার চালান এসেছে। কিন্তু আনতে যেতে পারিনি

কেন, আনতে যেতে পারেননি কেন?

মতিঝিলের সরাবখানা কার ওপর ছেড়ে দিয়ে যাব? দেখছনা মা, সকালবেলা নহবতমঞ্জিল থেকে বাজনা শুরু হয়েছিল, তারপর হঠাৎ বলা-নেই কওয়া-নেই থেমে গেল। এমন কখনও আগে হয়েছে? এমন কখনও আগে হতে শুনেছ?

আশেপাশের লোকগুলো যে-সব আলোচনা করছে তাও কানে এল। কেউ বলছে ফিরিঙ্গি ফৌজ আসছে, কেউ বলছেনবাব জগৎশেঠজিকে ডেকে পাঠিয়েছে আবার ফৌজ তৈরি করবার জন্যে! ফৌজ। তৈরি করে কি নবাব আবার নতুন করে লড়াই করতে যাবে?

জগৎশেঠজির তাঞ্জাম আসছিল মতিঝিলের সামনে দিয়ে। মরালী আর সচ্চরিত্র সরে দাঁড়াল।

ঘটকমশাই বললে–শুনেছ মা, নবাব নাকি জগৎশেঠজিকে ডেকে পাঠিয়েছিল টাকার জন্যে।

আপনাকে কে বললে? কার কাছ থেকে শুনলেন?

নেয়ামত। ওই তো আমার মালিক। নবাব লক্কাবাগ থেকে একলা ফিরে আসার পর নেয়ামতও সেখান থেকে একটা ঘোড়া নিয়ে নবাবের পেছন পেছন চলে এসেছে। সে যে একটু আগে মতিঝিলে এসেছিল–

কী বললে–সে?

সে-ই তো আমাকে চলে যেতে বললে। বললে–ফিরিঙ্গি ফৌজ নবাবের পেছনে পেছনে মুর্শিদাবাদে এসে পৌঁছোচ্ছে। বললে–মুর্শিদাবাদ ছেড়ে পালিয়ে যেতে। এখন এই বুড়ো বয়েসে কোথায় যাই বলো তো মা? আমার আছে কে যে তার কাছে যাব? তাই তো সেই কথা ভাবতে ভাবতেই যাচ্ছিলুম, এমন সময় তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল

ততক্ষণে মতিঝিলের ভেতরে এসে গিয়েছিল দুজনে।

ফাঁকা মতিঝিল, ফাঁকা চবুতরা, ফাঁকা দালান! সমস্ত হাবেলিটা যেন খাঁ খাঁ করছে।

মরালীই আগে আগে উঠতে লাগল সিঁড়ি দিয়ে।

ওপরের অলিন্দ পেরিয়ে একেবারে শেষ ঘরখানার সামনে গিয়ে দেখলে দরজা বন্ধ।

সচ্চরিত্র বললে–দরজা খোলাই আছে মা, ধাক্কা দাও, দরজা খুলে যাবে

কিন্তু দরজাটা খুলতেই অবাক হয়ে গেল মরালী! কোথায়? কান্ত কোথায়?

সচ্চরিত্র পুরকায়স্থ মশাইও অবাক হয়ে গেছে, কোথায় গেল? কান্তবাবাজি কোথায় গেল?

সচ্চরিত্র বললে–এই তো আমি এখনই দেখে গেলাম বাবাজিকে। এই তো আমার সঙ্গে কথা হল

কী কথা হল?

আমি বাবাজিকে বললাম–বাবাজি, এখন কেউ নেই, আমি পালিয়ে যাচ্ছি, তুমিও যেদিক পানে দু’চোখ যায় পালিয়ে চলো। তা আমার কথা শুনলে না। বললে–আপনি একলা চলে যান ঘটকমশাই, আমি যাব না। আমি চলে গেলে মরালীকে ওরা ধরে ফেলবে। তা তবু কত করে বললাম, কিছুতেই শুনলে না। তখন দরজার চাবিটা খুলে দিয়ে আমি বাবাজিকে রেখে চলে গেলাম

মরালী জিজ্ঞেস করলে আপনি এখান থেকে চলে যাবার পর আর কেউ এসেছিল?

সচ্চরিত্র বললে–কে আর আসতে যাবে মা এখানে। কারও তো এদিকে নজর দেবার সময় নেই। এখন যে সবাই চেহেল সূতুনের দিকে নজর দিচ্ছে। সেখানে যে যা পারে হাতাচ্ছে। শুনলাম নাকি ঘসেটি বেগমসাহেবা, যাঁকে নবাব নজরবন্দি করে রেখেছিলেন, তিনি এই ফাঁকে গয়নাগাটি নিয়ে পালিয়েছেন।

মরালী চমকে উঠল। জিজ্ঞেস করলে–ঘসেটি বেগমসাহেবার কথা আপনাকে কে বললে?

কে আবার বলবে মা। সকলের মুখে মুখে তো ওই এক কথা! আরও শুনছি নবাবের মা আমিনা বেগমসাহেবাকে নাকি নবাব নিজে হাতেনাতে ধরে ফেলেছে

কেন?

তিনি নাকি চেহেল্-সুতুনের মালখানা থেকে সোনা-জহরত গয়নাগাটি সরাচ্ছিলেন। তাকে নাকি কোতল করা হয়ে গেছে।

আপনি ঠিক শুনেছেন?

সচ্চরিত্র বললে–তা কী করে বলব মা। লোকের মুখে যা যা শুনলাম তাই তোমাকে বলছি। ওইসব শুনেই তো প্রাণটা ভয়ে কাঁপতে লাগল। অবাক কাণ্ড মা, একদিন জাত গিয়েছিল বলে নিজেই ইছামতীতে ডুবে মরতে গিয়েছিলাম, এখন আবার সেই পোড়া প্রাণটার জন্যে পালিয়ে বাঁচবার চেষ্টা করছি

তা হলে এখন কী করব? কী করা যায় বলুন তো?

সচ্চরিত্র বললে–আমিও তো তাই ভাবছি মা, কান্তবাবাজিকে আমি পইপই করে পালিয়ে যেতে বললাম, তখন গেল না। এখন কী যে হল কে জানে!

মরালী বললে–শেষপর্যন্ত আপনি চলে যাবার পর হয়তো চলেই গেছে–

না, তা তো যাবার মতো ছেলে নয় আমার বাবাজি।

মরালী জিজ্ঞেস করলে কী করে বুঝলেন?

সচ্চরিত্র বললে–আমাকে যে বাবাজি সব বলেছে মা। তোমার সঙ্গে বিয়ে হয়নি বলে বাবাজির মনে বড় কষ্ট ছিল যে। আমি বলতাম বাবাজিকে, সবকিছুর জন্যে আমিই দায়ী বাবাজি, তোমাদেরও বিয়েটা হল না, আমারও সর্বনাশ হয়ে গেল।

তারপর একটু থেমে সচ্চরিত্র বলতে লাগল–আর একটা কী কথা জানো মা, বাবাজি আমাকে বরাবর বলত–আমিই মরালীর জাত খেয়েছি পুরকায়স্থমশাই, আমিই চেহেল্‌-সুতুনে মরালীকে এনে পুরেছি

মরালী বললে–কিন্তু যা হয়ে গেছে তা নিয়ে কেন ভাবত ও?

সচ্চরিত্র বললে–সেই কথা কে বলে বাবাজিকে! বাবাজি কেবল সেই কথা ভেবে ভেবে মনমরা হয়ে থাকত। আমি কতবার বলতাম–তোমার কী ভাবনা বাবাজি, তোমার বয়েস আছে, তুমি আর একটা বিয়ে করে নিয়ে আবার ঘরসংসার করো গে, কিন্তু কার কথা কে শোনে।

চলুন ঘটকমশাই, এখানে দাঁড়িয়ে কোনও লাভ নেই।

সচ্চরিত্র বললে–কিন্তু তুমি কোথায় যাবে মা এখন?

আপনি? আপনি কোথায় যাবেন?

আমার কথা ছেড়ে দাও মা, আমি আবার একটা মানুষ! আমার প্রাণটার ভারী তো দাম। তুমি কোথায় যাবে বলো?

মরালী বললে–আমার কথা আপনাকে আর ভাবতে হবে না ঘটকমশাই, আপনি আপনার কথা ভাবুন

সচ্চরিত্র বললে–তা কি কখনও হয় মা? তোমাকে এ-সময়ে কি একলা ছেড়ে দিতে পারি? মুসলমান হয়ে গিয়েছি বলে কি আমি মানুষ নই মা? আমারও তো হিন্দু মেয়ে আছে–

তা হলে আপনি কোথায় যাবেন?

সচ্চরিত্র বললে–তুমি যেখানে যাবে না, আমি সেখানেই যাব

মরালী বললে–আমার তো কোনও যাবার জায়গাও নেই ঘটকমশাই, আমি হাতিয়াগড় থেকে এসেছিলুম, চেহেসতুনে ঢুকে আপনার মতোই একদিন জাত খুইয়েছিলুম, এখন আবার সেই চেহেলসুতুনও যে গেল। আমি এখন কোথায় যাই?

সচ্চরিত্র বললে–আমার কথা যদি শোনো মা, এখন তোমার এই মুর্শিদাবাদে থাকা উচিত নয়, শুনেছি ফিরিঙ্গি ফৌজ আসছে। এ সময়ে তারা এসে যদি নবাবের নিজামত কেড়ে নেয় তো মহামারী কাণ্ড হবে মা-তার চেয়ে মা তুমি হাতিয়াগড়ে চললা, আমি তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি

কিন্তু ওদের কী হবে ঘটকমশাই? ওই ছোট বউরানির? আমি হাতিয়াগড়ে গেলে যদি কারও নজরে পড়ে যাই?

সচ্চরিত্র বললে–তোমার বাপের কাছে তুমি থাকবে, কে তোমায় দেখবে? আর এদিকে নিজামতের তো এই অবস্থা, নবাবি থাকে কি না তাই দেখো আগে–

তা হলে তাই-ই চলুন

সচ্চরিত্র বললে–তা হলে আমার সঙ্গে এসো, সোজা মুর্শিদাবাদের ঘাটে গিয়ে নৌকো ধরব। জলপথে যাওয়াই ভাল, ওখানে মাঝিটাঝিদের সঙ্গেও আমার ভাব আছে, আমি সরাবখানার ভাঁড়ারি বলে–চলো–

মরালী সচ্চরিত্র পুরকায়স্থর সঙ্গে মতিঝিলের বাইরে এল। তখন রাস্তায় আরও ভিড়। মুর্শিদাবাদের মানুষ তখন দিশেহারা হয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে।

লক্কাবাগের প্রান্তরে তখন বাংলা মুলুকের ভাগ্যনির্ণয় শেষ হয়ে গেছে। তখনও রক্তের দাগ লেগে আছে জল-কাদার মাটিতে। যে-আমগাছগুলো কত বছর ধরে কত পাখিকে আশ্রয় দিয়েছে, কত ফল ফলিয়েছে, কত বর্ষা শীত বসন্তের নীরব সাক্ষী হয়ে মানুষের উত্থান-পতনের ইতিহাস লক্ষ করেছে তারাও সেদিন রেহাই পায়নি। কোনওটার গায়ে বুলেটের গর্ত, কোনওটার ডালপালা আগুনে পুড়ে গেছে, কোনওটা দিশি কামারের তৈরি কামানের ঘায়ে উপড়ে গেছে।

ময়দাপুরের ছাউনিতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন একমনে ক্লাইভ হাতে কাগজ কলম নিয়ে ভাবছিল। সেই লঙ্কাবাগের কথাগুলোই বারবার মনে পড়ছিল তার।

সব জিনিসের যেমন একটা শেষ আছে, দুর্ভানারও যে একটা শেষ থাকবে তাতে আর আশ্চর্য হবার কী আছে? ময়দপুরের আকাশটার দিকে চেয়ে দেখতে দেখতে রবার্ট ক্লাইভ কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল।

খবরটা প্রথম দেয় মেজর কিলপ্যাট্রিক।

স্যার, নবাব পালিয়ে গেছে! তখন মাথার ওপর আকাশটা ভেঙে পড়লেও বোধহয় অমন করে চমকে উঠত না সেন্ট ফোর্ট ডেভিডের কম্যান্ডার।

বললে–হোয়াট?

চমকে উঠেছিল কিলপ্যাট্রিক। ক্লাইভকে এত উত্তেজিত হতে দেখেনি কখনও আগে। তখন চারদিকে সোলজারদের চিৎকার আর কাতরানি। খালের জল লাল হয়ে গেছে নিরীহ সেপাইদের রক্তে। চারদিকের গাছের ডাল থেকে ধোঁয়া উঠছে। সেই আগুন, হত্যা আর মৃত্যুর মধ্যে হঠাৎ জীবনের সংবাদ এলে চমকে ওঠারই তো কথা।

আর ইউ শিয়োর? তুমি ঠিক শুনেছ?

আশ্চর্য! আশ্চর্যই বটে! এই ময়দাপুরের ছাউনিতে সবাই যখন প্রাণভরে ঘুমোচ্ছে তখন সেই কথাগুলো ভাবতে ভাল লাগে বই কী। ক্লাইভ আবার গিয়ে উঠল সেই বাড়িটার ছাদে। নবাবের সেই শিকার করবার বাড়িটার ছাদে। সত্যিই নবাবের ছাউনিটা দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। সেখানে যেন অনেক হট্টগোল। এলোপাতাড়িভাবে নবাবের জেনারেলরা গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াচ্ছে।

কিলপ্যাট্রিক পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। বললে–মিরজাফর তার কথা রেখেছে কর্নেল

কিন্তু ওদিক থেকে ফরাসি জেনারেল সিনফ্রে তখনও পুরো দমে লড়াই করে চলেছে। তাদের এক-একটা গোলা এসে সামনের সেপাইদের সামনে ফেটে পড়ছে।

ক্লাইভ বললে–কুইক কিলপ্যাট্রিক এবার আমাদের আমি নিয়ে ওদের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে-চলো

কিলপ্যাট্রিক মেজর হলে কী হবে, আসলে ছেলেমানুষ। শুধু ছেলেমানুষই নয়, সংসারী মানুষ। সংসারী মানুষরা লাভ-লোকসান খতিয়ে বিচার-বিবেচনা করে কাজ করে। কিন্তু অত বিচার-বিবেচনা করতে গেলে কি যুদ্ধ করা চলে? তুমি যদি অত বিচার-বিবেচনা করে চলো তো সংসারী মানুষ হিসেবে তোমার উন্নতি হবে। কিন্তু জীবনটা তো সংসার নয় মেজর। তোমরা সুখী হবে, তোমরা হয়তো চাকরিতেও উন্নতি করবে। আজ মেজর আছ, কাল হয়তো কর্নেলও হবে। কিন্তু এম্পায়ার? এম্পায়ার তৈরি করতে হলে সেই আমাকেই দরকার হবে যে!

কাল তোমরা সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিলে। আমি যখন নবাবের আর্মিকে অ্যাটাক করবার জন্যে তোমাদের অর্ডার দিলুম, তোমরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলে কিলপ্যাট্রিক। আমাদের আর্মি ছোট, আমাদের সেপাই কম, আমাদের গুলি-গোলাবারুদ কম। তোমরা ভেবেছিলে আমরা ওদের আর্মির চাপে পিষে গুঁড়িয়ে যাব। কিন্তু এখন?

আজ এই ময়দাপুরে এসে সবাই তোমরা ঘুমোচ্ছ। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই কেন বলতে পারো?

না, আমাদের এ-প্ৰশ্নর জবাব দেবার দরকার নেই। এর জবাব দেবে হিস্ট্রি। হিস্ট্রিই একদিন উত্তর দেবে আমি কাল ভাল করেছিলাম না খারাপ করেছিলাম। আর তা ছাড়া এ তো যুদ্ধ নয় মেজর। ইন্ডিয়ানরা যদি যুদ্ধই করত তো কোথায় থাকতে তুমি, কোথায় থাকত কোম্পানি, আর কোথায় থাকতাম আমি। এতক্ষণ আমার ডেডবডি ভাসত লাগের খালে।

কে?

ক্লাইভের মনে হল কে যেন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কে তুমি? হু আর ইউ?

বাইরে অর্ডার্লিটা পর্যন্ত এমন অঘোরে ঘুমোচ্ছ যে ঘরে কে ঢুকল তা টের পায়নি।

সেন্ট ফোর্ট ডেভিড জয় করার পরও একবার এমনি হয়েছিল। যখন মনটা একলা থাকে, তখনই কে যেন এসে সামনে দাঁড়ায়।

কে তুমি? হু আর ইউ?

বেশ লম্বা-চওড়া ম্যানলি চেহারা। দেখে মনে হয় ইউপিয়ান। কেন এমন হয়? কেন এরা আসে? কেন এসে বারবার তাকে বিরক্ত করে?

আমাকে চিনতে পারছ না কম্যান্ডার? আমি আগে অনেকবার এসেছি যে তোমার কাছে?

ক্লাইভ কোমরের পিস্তলটায় হাত দিলে।

ওখানে হাত দিয়ো না কম্যান্ডার। ওতে আমার কিছুই হবে না। আমি মরি না।

কিন্তু হু আর ইউ? কেন তুমি আমার কাছে আসো বারবার?

লোকটা বললে–আমি সাকসেস!

সাকসেস?

হ্যাঁ, যে-লোক ভাগ্যের সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়, আমি তাদের সঙ্গেই দেখা করি। দেখা করে সাবধান করে দিই। সাবধান করে দেওয়াই যে আমার জ কর্নেল। তুমি এবার বড় হয়েছ। তুমি ম্যাড্রাসের সেন্ট ফোর্ট ডেভিড জয় করেছ, চন্দননগরের ফোর্ট জয় করেছ, এবার বেঙ্গলও নিয়ে নিলে।

ক্লাইভ হুংকার দিয়ে উঠল–কী বলতে এসেছ, বলে শিগগির, আমার সময় নেই–

লোকটা হেসে উঠল–মানুষ যখন সাকসেসফুল হয়, তখন তার সময় থাকেই না কর্নেল। তবু সময় করে নিতে হয়। সেই কথাটা বলতেই আমি এসেছি। একদিন তোমার কিছু ছিল না। একদিন তোমার টাকা ছিল না, বন্ধু ছিল না, সংস্থান ছিল না। সেদিনের কথা কি তোমার মনে পড়ে?

কিন্তু মনে পড়ে লাভ কী? সে কথা কেন মনে করতে যাব এখন?

আমি যে সেই কথা মনে পড়িয়ে দিতে এসেছি কর্নেল। মনে পড়া যে ভাল।

কেন মনে পড়া ভাল? আমি নিজের ক্ষমতায় ভাগ্যের মাথায় উঠেছি। কেন আমি সে কথা মনে রাখব? কেন মনে রেখে মন খারাপ করব?

লোকটা বললে–আমি জানি, তুমি ওই কথাই বলবে। কিন্তু এটা চিনতে পারো?

রবার্ট ক্লাইভ দেখেই চিৎকার করে উঠলো—না না না

আর সেই চিৎকার শুনে অর্ডালিটা দৌড়ে ঘরে এসেছে–হুজুর

ওদিক থেকে কিলপ্যাট্রিক, আয়ার কুট সবাই ঘুম ভেঙে দৌড়ে এসেছে।

হোয়াটস আপ কর্নেল? কী হয়েছে? কী হয়েছে কর্নেল?

ক্লাইভ লজ্জায় পড়ে গেল। এমন করে ভয় পাওয়া উচিত হয়নি ক্লাইভের। পলাশির ব্যাটল জয় করে ভীরুর মতো চেঁচিয়ে উঠেছে সে। ও লোকটা কেন আসে? কেন ওটা দেখায় তাকে? ওটা তো শুধু একটা তাস!

আবার সবাই যে-যার ঘরে ফিরে গেছে। আগের দিন যুদ্ধ করে সবাই ক্লান্ত হয়ে আছে। মিছিমিছি আবার সকলের ঘুমের ব্যাঘাত হল। আবার লিখতে চেষ্টা করলে ক্লাইভ। ডেসপ্যাঁচটা লিখতে বসেও নানারকম বাধা আসে।

জোর করে কলম চালিয়ে যেতে লাগল–প্লাসির ব্যাট-এ আমরা জিতেছি। নবাব পালিয়ে গেছে মুর্শিদাবাদে। আমি আর্মি নিয়ে তার পেছন পেছন চলেছি। আমাদের পক্ষে মারা গেছে সাতজন হোয়াইট ইংরেজ, আর ষোলোজন সেপাই। আর ইজিয়োরড হয়েছে তেরোজন গোরা আর ছত্রিশজন সেপাই। নবাবের জেনারেল মিরজাফর আলি আমার সঙ্গে দাউদপুরে দেখা করেছিল। পাছে সে আমাকে সন্দেহ করে তাই আমি তাকে আলিঙ্গন করে পাশে বসিয়েছি। বলেছি–তোমাকেই আমি মুর্শিদাবাদের নবাব করব জেনারেল। আমার কথা শুনে মিরজাফর আলি খুব খুশি। আমি তাকে মুর্শিদাবাদে গিয়ে নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার কী মতলব তা জানিয়ে আমাকে খবর দিতে বলেছি। আমি এখন আমি নিয়ে ময়দাপুরে ক্যাম্প করে আছি। মিরজাফরের লেটার এলে তবে আমি বেঙ্গলের ক্যাপিটেলে নিজে যাব।

চিঠিটা খামের মধ্যে পুরে মুখটা বন্ধ করে দিলে। সকাল হলেই চিঠিটা পাঠিয়ে দিতে হবে হোমে। আর একটা চিঠি পেগিকে লিখলে হত। কিন্তু সেপরে দিলেও চলবে।

তারপর ক্লাইভ বিছানার ওপর গা এলিয়ে দিলে। আলোটা জ্বলুক। ওটা জ্বললে তবু মনে হয় যেন সে বেঁচে আছে। অন্ধকার হলে যেন বড় ভয় করে ক্লাইভের।

কিন্তু কোথা দিয়ে যে কখন তন্দ্রা এসেছিল তার খেয়ালই নেই। হঠাৎ চোখ চাইতেই নজরে পড়ল। বাইরের সেই অন্ধকার আকাশটা কখন আলোয় আলো হয়ে গেছে।

অর্ডার্লি।

অর্ডার্লি দৌড়োতে দৌড়োতে ঘরে এসেছে। হরিচরণটা নেই। সেটা সেই বেঙ্গলি লেডিজদের নিয়ে চলে গেছে। তার জায়গায় এই নতুন অর্ডার্লিটা এসেছে।

হুজুর, কলকাতা থেকে মুনশি এসেছে।

মুনশি? নিয়ে এসো ভেতরে।

কলকাতার কেল্লা থেকে সারা পথ নৌকোয় এসে ঠিক সময়েই মুনশি দাউদপুরে এসেছিল। সেখানে এসে শুনেছিল সাহেব মনিব ময়দাপুরের দিকে গেছে। রাত্রেই এসে পৌঁছেছিল এখানে। কিন্তু রাত্রে আর কাউকে বিরক্ত করেনি। ছাউনির বাইরেই চাদর মুড়ি দিয়ে পড়ে ছিল।

সাহেবের ঘরের ভেতরে ঢুকে সাহেবের পায়ের ধুলো নিয়ে টিপ করে একটা প্রণাম করলে। তারপর পায়ের ধুলোটা মাথার টিকিতে ছোঁয়ালে!

ক্লাইভ বললে–কী মুনশি, কী খবর?

নবকৃষ্ণ মুনশি বললে–হুজুর, আজ পনেরো দিন আমি মা-সিংহবাহিনীর পুজো করেছি। কাল হঠাৎ মায়ের মাথা থেকে পুজোর ফুল পড়ল

ফুল পড়ল মানে?

হুজুর, আমার মানত ছিল কিনা। মাথার ফুল পড়লে তবে বুঝব যে হুজুর লড়াইতে জিতেছেন। আমার মা-সিংহবাহিনী জাগ্রত মা কিনা।

ক্লাইভ হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেল। রাত্রের স্বপ্নের কথাটা মনে পড়ল। মুনশিকে স্বপ্নের কথাটা বলবে নাকি!

বললে–আচ্ছা, মুনশি তুমি স্বপ্ন দেখো?

আজ্ঞে, স্বপ্ন? রোজ দেখি!

কী স্বপ্ন দেখো?

নবকৃষ্ণ বললে–আজ্ঞে, স্বপ্ন দেখি যেন হুজুর রাজরাজ্যেশ্বর হয়েছেন, আর আমি পদতলে বসে হুজুরের সেবা করছি

না না, ও স্বপ্ন নয়। অন্য কোনও স্বপ্ন দেখো না?

না হুজুর, রোজ ওই একই রকম স্বপ্ন দেখি!

ক্লাইভ বারবার দ্বিধা করতে লাগল। তারপর বলে ফেললে–আচ্ছা, রাত্রে কোনওদিন স্বপ্নে তোমার ঘরে কেউ ঢোকে না?

রাত্রে কেন কেউ ঘরে ঢুকবে হুজুর। আমি তো ঘরের দরজা বন্ধ করে শুই।

ক্লাইভ বললে–কিন্তু স্বপ্নে দরজা বন্ধ থাকলেও কেউ ঘরে ঢুকতে পারে তো?

তা তো পারে।

তা সেইরকমভাবে ঢুকে তোমাকে কেউ কিছু দেখায় না?

কী দেখাবে হুজুর?

ধরো তাস!

তাস?

মুনশি নবকৃষ্ণ অবাক হয়ে গেল। সাহেবের কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?

হ্যাঁ হ্যাঁ, তাস। শুধু একটা তাস। কুইন অব স্পেডস। ইস্কাবনের বিবি!

নবকৃষ্ণ আরও অবাক হয়ে গেল সাহেবের কথা শুনে।

যাক গে, ওসব তুমি বুঝবে না মুনশি! সত্যিই তো। ধ্বই কি সব বোঝে! ওই সাকসেস। কেন যে সাকসেস বারবার মানুষের মূর্তি ধরে ক্লাইভের সামনে এসে ওই তাস দেখায়! কে জানে, হয়তো সাকসেস মানেই ইস্কাবনের বিবি। সাকসেস মানেই কুইন অব স্পেড়। সাকসেস মানেই কি তবে মায়া। সাকসেস হওয়া কি তবে ভাল নয়! সাকসেস মানেই কি তার ডেথ! সাকসেস মানেই কি তবে মৃত্যু।

ম্যাড্রাসে ওই লোকটা বলেছিল–তুমি বড় হতে চেয়ো না ক্লাইভ। বড় হওয়া মানেই সাকসেসফুল হওয়া। সাকসেসফুল হওয়া মানেই যন্ত্রণা পাওয়া। তুমি সাধারণ হতে চেষ্টা করো, স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করো, সহজ হতে চেষ্টা করো। তবেই শান্তি পাবে

হঠাৎ বাইরে বিগল বেজে উঠল।

কেউ এল নাকি মুনশি?–অর্ডার্লি!

অর্ডার্লি ঘরে এসে স্যালিউট করলে।

হুজুর, মিরজাফর আলি সাহেব তাঁর ছেলে মিরন আলিকে হুজুরের সঙ্গে দেখা করতে পাঠিয়েছেন।

ক্লাইভ বললে–ভেতরে নিয়ে এসো

মিরন ভেতরে এসে কুনিশ করে দাঁড়াল।

কী খবর মিরন আলি?

হুজুর, নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা মুর্শিদাবাদ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। আমার বাপজান মিরজাফর আলি সাহেব সেই খবর দিতে পাঠিয়েছেন আপনার কাছে।

নবাব! নবাব পালিয়েছে? কোথায়?

তা জানি না। চর গেছে চারদিকে তালাস করতে।

ক্লাইভ উঠল। কোথায় গেল তার ক্লান্তি, কোথায় গেল তার স্বপ্ন। অর্ডার্লিকে ডেকে বললে–মেজর কিলপ্যাট্রিক সাহেবকে সেলাম দেও–

অর্ডার্লি কুর্নিশ করে বাইরে হুকুম তামিল করতে চলে গেল।

ডিহিদার রেজা আলি এমন সময় মুর্শিদাবাদে এসেছিল, যখন তার না এলেও চলত। কিন্তু না এলে বোধহয় আর উদ্ধব দাসের বেগম মেরী বিশ্বাস’ কাব্য লেখাও হত না।

মতিঝিল থেকে যখন সবাই চলে গেছে, একটা খিদমদগারও নেই, ইব্রাহিম খাঁ-ও চলে গেছে চাবির গোছ রেখে, তখন কান্ত ঘরের মধ্যে একলা চুপ করে বসে ছিল।

না, সে কিছুতেই এখান থেকে যাবে না। তার জন্যে যদি মরালী নিঃশব্দে মুক্তি পায় তো পাক। মরালীর জন্যে সব শাস্তি সে মাথা পেতে নেবে। নিয়ে তার সব অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করবে! কেন সে পালাবে? প্রাণের ভয়ে? নিজের প্রাণটাই তার কাছে বড় হল?

বহুদিন আগের একটা কথা হঠাৎ মনে পড়ল। চকবাজারের রাস্তায় একদিন সেই গনতকারটা তার হাত দেখে বলেছিল–যার সঙ্গে আপনার বিয়ে হবার কথা ছিল, তার সঙ্গে আবার বিয়ে হবে বাবুজি।

আরও একটা কথা বলেছিল সে। বলেছিল–জল থেকে একটু সাবধান থাকবেন বাবুজি, জলেই আপনার ভয়

তা হোক, নিজের জন্যে আর তার ভয় নেই। ভয় মরালীর জন্যে! মরালী সুখী হোক, মরালী বিপদমুক্ত হোক। তা হলেই সে হাসিমুখে মৃত্যু বরণ করবে। সে জলই হোক আর আগুনই হোক!

হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ হল। কান্ত তাড়াতাড়ি বোরখায় মুখ ঢেকে ফেললে।

দরজা খুলতেই কান্ত দেখতে পেলে, ভেতরে ঢুকছে মেহেদি নেসার সাহেব, ডিহিদার রেজা আলি আর বশির মিঞা।

বোরখার আড়াল থেকে তিনজনকে দেখে কান্তর বুকটা প্রথমে আঁতকে উঠেছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই মনে হল কীসের ভয় তার! সে তো মরতেই এসেছে। মৃত্যুর ভয় থাকলে সে তো আগেই পালিয়ে যেত মতিঝিল থেকে। সে ত মরালীর জন্যেই মরছে। মরালী যদি বাঁচে, মরালী যদি রক্ষে পায়, তা হলে তো তার মরেও সুখ!

মেহেদি নেসার সাহেব বোধহয় খুব ব্যস্ত ছিল। কিন্তু ডিহিদার রেজা আলি সাহেবই তাকে জোর করে ধরে এনেছে।

মেহেদি নেসার বললে–ওই মরিয়ম বেগমসাহেবা?

বশির মিঞা বললে–হ্যাঁ, খোদাবন্দ তো নিজেই মরিয়ম বেগমসাহেবাকে এখানে রেখে দিয়ে গিয়েছিলেন।

ডিহিদার রেজা আলি বললে–লেকন জনাব, হাতিয়াগড়ের আসলি রানিবিবি এ নয়—

কেন?

ডিহিদার বললে–হাতিয়াগড়ের রাজাসাহেব বাত-খেলাপি করেছে নিজামতের সঙ্গে। আসলি রানিবিবি বলে নকলি রানিবিবি চালিয়ে দিয়েছে।

মেহেদি নেসার বললে–সুবুত কোথায়? প্রমাণ তো চাই, শুধু বললে–তো চলবে না।

ডিহিদার বললে–সুবুত আমার কাছে আছে জনাব। দফতরেমনসুর আলি মেহের সাহেবের কাছে সে সুবুত রেখে দিয়েছি। আমি জনাবকে দেখাতে পারি। আসলি বলে ঝুটা চালিয়ে দিয়েছে রাজাসাহেব।

বশির মিঞা বললে–খোদাবন্দ হুকুম দেন তো এই একে পুছতে পারি।

দুর বেত্তমিজ, ওকে জিজ্ঞেস করলে তো ও ঝুট বলবে।

ডিহিদার বললে–তা হলে জনাব, ওকে চেহেল্‌-সুতুনে বন্ধ করে রেখে দিন।

কেন? এখানে মতিঝিলে কীসের ক্ষতি?

ডিহিদার রেজা আলি বললে–না জনাব, মতিঝিলে এখন কোনও খিদমদগার নেই, ফটকের পাহারাদার ভি নেই, সবাই ভেগে গেছে। যদি এখান থেকে ভেগে যায়?

মেহেদি নেসার বললে–বোত আচ্ছা, মরিয়ম বিবিকে চেহেসূতুনের পিরালি খাঁ কি নজর মহম্মদের হাতে জিম্মা দিয়ে আয়–তারপর আমার হাত খালি হলে আমি দেখব। জনাব এখন খিঁচড়ে আছে, জগৎশেঠজি ভি খিঁচড়ে আছে, আমার এখন অনেক কাজ

বলে পেছন ফিরল। ডিহিদার বশির মিঞাকে ইঙ্গিত করতেই সে মরিয়ম বেগমের দিকে চেয়ে বললে–আইয়ে বেগমসাহেবা, মেরা সাথ আইয়ে

কান্ত ভাল করে নিজেকে বোরখার আড়ালে ঢেকে নিয়ে উঠল। তারপর তিনজনের পেছন পেছন চলতে লাগল।

চবুতরায় নেমে একটা পালকি দাঁড়িয়ে ছিল। তাতেই উঠতে বললে। কান্ত পালকির ভেতর উঠে বসতেই পালকির পাল্লা দুটো বশির মিঞা বন্ধ করে দিয়েছে। তারপর আর কিছু দেখা যায় না। পালকিটা দুলতে দুলতে চলতে লাগল।

তারপর একটা সময়ে নহবতের সুরটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। বোঝা গেল চেহেল-সূতুনের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে তাকে। আস্তে আস্তে বাইরের লোকজনের হল্লা-চিৎকার কমে এল।

কোথায় কোন জায়গায় তাকে রাখবে কে জানে। জানাজানি হয়ে গেলে তাকে বন্দি করে রাখতে পারে, কোতল করেও ফেলতে পারে!

পালকির ভেতরে বসে বসেই কান্ত বোরখার মধ্যে ঘেমে নেয়ে উঠল। তবু তুমি কিছু ভেবো না মরালী। আমার জন্যে তুমি কিছু ভেবো না। আমি যেখানে যেমন ভাবেই থাকি, তোমার মঙ্গল কামনা করব। আমি মনে অন্তত এই ভেবে শান্তি পাব যে, তুমি সুখী হয়েছ। যদি পারো, তুমি এই মুর্শিদাবাদ থেকে চলে যেয়ো। আর যদি সেই উদ্ধব দাসকে খুঁজে পাও তো তাকে নিয়েই সংসার করে সুখী হবার চেষ্টা কোরো।

হঠাৎ পালকিটা যেন একটু দুলে উঠল।

কোথায় এল সে? নহবতটা যেন ঠিক মাথার ওপরেই বাজছে। তবে বোধহয় চেহেসূতুনের ভেতরে ঢুকল এতক্ষণে পালকিটা।

বশির মিঞার গলা শোনা গেল।

নজর মহম্মদ।

ওদিক থেকে নজর মহম্মদের জবাব এল।

কেয়া বাত?

মতিঝিল থেকে মরিয়ম বেগমসাহেবাকে এনেছি পালকি করে, মেহেদি নেসার সাহেবের হুকুম। একে তালা বন্ধ করে এর মহলে রেখে দিবি।

কেন, কী কসুর করেছে মরিয়ম বেগমসাহেবা?

বশির বুঝি রেগে গেল। বললে–সে খবরে তোর কাম কী? মেহেদি নেসার সাহেব হুকুম দিয়েছে, তুই বিলকুল তামিল করবি-যা

নজর মহম্মদের মেজাজটা বোধহয় তখন চড়া ছিল। বললে–লেক বেগমসাহেবা ভেগে গেলে আমার কিছু কসুর নেই!

কেন, ভাগবে কেন? ঘরে তালা বন্ধ করে রাখলে ভাগবে কী করে?

আরে জনাব, চেহেল্‌-সুতুনের ভেতরে ইনকিলাব শুরু হয়ে গেছে। ঘসেটি বেগমসাহেবা ভি ভেঙ্গে গিয়েছিল।

কে বললে? বশির মিঞা শুধু একলাই চমকায়নি, বোরখার ভেতরে কান্তও চমকে গিয়েছিল খবরটা শুনে।

বশির মিঞা বললে–তারপর? তারপর কী হল?

হুজুর, নবাব তো চেহেল্‌-সুতুনে এসেছে। খাস-দরবারে জলুস হচ্ছে। সবাই চুরি ভি করছে!

বশির মিঞা বোধহয় আরও অবাক হয়ে গেল। চুরি? কে চুরি করছে? কী চুরি করছে?

হুজুর, আমিনা বেগমসাহেবা বমাল গ্রেফতার হো গিয়া!

বশির মিঞা বললে–সেকী রে? বলছিস কী তুই নজর?

হাঁ জি, আমিনা বেগমসাহেবা মালখানার সিন্দুক খুলে জেবর-এর সবকিছু চুরি করছিল, অচানক ধরা পড়ে গেছে। ইনকিলাব শুরু হয়ে গেছে চেহেলসূতুনে, সেই জন্যেই তো বলছিলাম।

তা বাব কোথায়? নবাব কিছু বললে না?

নজর মহম্মদ বললে–নবাব তো খাসদরবার থেকে বেরিয়ে এখন বেগমমহলে এসেছে, নানিবেগমসাহেবার মহলে ঢুকেছে

বশির মিঞারও বোধহয় তখন আর সময় ছিল না। বললে–আমি চললুম, তুই মরিয়ম বেগমসাহেবকে সামলে রাখিস, যেন খোয়া যায় না

বশির চলে গেল। পালকিটা তারপর আরও এগিয়ে গিয়ে থামল এক জায়গায়। সেখানে পালকিটা থামতেই দুটো দরজা খুলে গেল।

নজর মহম্মদ বললে–আইয়ে বেগমসাহেবা

কান্ত বোরখাটা ঢেকে নিয়ে নজর মহম্মদের পেছন পেছন একটা ঘরে গিয়ে পৌঁছোল। সেই মরালীর ঘরখানা। এই ঘরটাতেই কতদিন লুকিয়ে লুকিয়ে এসেছে সে। এই নজর মহম্মদই কতদিন তাকে ঘুষ পেয়ে এখানে নিয়ে এসে তুলেছে। তারপর অনেক রাত পর্যন্ত মরালীর সঙ্গে কাটিয়ে দেবার পর আবার। সুড়ঙ্গের পথে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে।

নজর ঘরের ভেতরে পৌঁছে দিয়েই বাইরে চলে গেল। যাবার আগে বললে–আপনার যদি কিছু জরুরত থাকে তো হুকুম করবেন আমাকে, আমি তামিল করব। কিছু দরকার আছে?

কান্ত বললে–না

নজর মহম্মদ বললে–বাইরে থেকে আমি তালা-চাবি বন্ধ করে যাচ্ছি—

বলে বাইরের দরজায় চাবি বন্ধ করে চলে গেল।

কান্ত বোরখাটা খুলে আয়নার সামনে নিজের চেহারাটা দেখলে। ঠিক যেমন করে মরালী মরিয়ম বেগম সাজত তেমনি করেই সাজিয়ে দিয়েছে তাকে। যদি কেউ দেখতেও পায় হঠাৎ চট করে চিনতে পারবে না।

কান্ত খাটের ওপর গিয়ে শুয়ে পড়ল। খানিকক্ষণের জন্যে সে নিশ্চিন্ত। খানিকক্ষণের জন্যে অন্তত কেউ তাকে আর বিরক্ত করবেনা। আর কোনওরকমে যদি দুটো দিন এমনি করে এখানে কাটিয়ে দিতে পারে তো ততক্ষণে মরালী মুর্শিদাবাদ ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে যেতে পারবে। অনেক দূর। এমন জায়গায় চলে যাবে যেখানে নবাব সিরাজ-উ-দৌলা নেই, মেহেদি নেসার নেই। সফিউল্লা, ইয়ারজান, কেউ নেই। জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, নন্দকুমার কেউ নেই যেখানে, সেখানে গিয়েই মরালী তার সংসার পাতবে। সুখে শান্তিতে দিন কাটাবে সে। আর কেউ তাকে বিরক্ত করবে না তার রূপের জন্যে, তার যৌবনের জন্যে, তার বয়েসের জন্যে। তার অসহায়তার সুযোগ নিয়ে যেখানে কেউ তাকে অত্যাচার করবেনা।

তুমি চলে যাও মরালী। যত তাড়াতাড়ি পারো চলে যাও। আমার কথা ভেবো না। আমি তোমার জন্যে সব কষ্ট হাসিমুখে সহ্য করব। আমার কোনও কষ্ট হবে না। আমাকে যদি এরা কোতল করে তবু আমি এই ভাবতে ভাবতে বিদায় নেব যে তুমি সুখে আছ, তুমি শান্তিতে আছ।

হঠাৎ কান্তর মনে হল চেহেল্‌-সুতুনের মধ্যেও যেন গোলমাল শুরু হয়েছে। অনেক মানুষের গলার আওয়াজ কানে এল। অনেক বেগম, অনেক খোঁজার গলা। কিন্তু কারও গলাই চিনতে পারল না।

তবুকান্ত সেই দিকে কান পেতে রইল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress