Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বেগম মেরী বিশ্বাস || Bimal Mitra » Page 14

বেগম মেরী বিশ্বাস || Bimal Mitra

তারপর রাত গভীর হল। গঙ্গার ধার দিয়ে একটা বজরা ছুটে চলছিল। ভোররাত্রে মুর্শিদাবাদ থেকে বজরাটা ছেড়েছে। তারপর সারা সকাল, সারা দুপুর, সারা সন্ধেটা কেটেছে। তারপর কখন রাত হয়েছে, রাত গম্ভীর হয়েছে তার খেয়াল ছিল না কারও।

কান্ত বললে–তোমার ঘুম পাচ্ছে, তুমি ঘুমোও, আমি উঠি

মরালী বললেতুমি কোথায় শোবে?

কান্ত বললে–বাইরে–

মরালী বললে–কালকের মতো যদি আবার বৃষ্টি আসে? ওই দেখো না, বাইরে খুব কালো মেঘ করেছে।

কিন্তু এখানে তুমি শুলে আমি কী করে সোব–

মরালী হাসল–কেন, এখানে আমার পাশে শুতে তোমার ভয় করে নাকি?

কান্ত বললে–ভয় করবে না? আমি তো আমি, তোমাকে কে না ভয় করে? জগৎশেঠজি থেকে আরম্ভ করে উমিচাঁদ, নন্দকুমার, মিরজাফর, মনসুর আলি, মেহেদি নেসার, এমনকী ক্লাইভসাহেব পর্যন্ত তোমাকে ভয় করে! সত্যি বলল তো এসব তুমি কোথায় শিখলে এত?

কী সব?

এই, কী করে লোকের সঙ্গে মিশতে হয়, লোকের সঙ্গে কথা বলতে হয়, কী করে সকলকে হাতের মুঠোয় আনতে হয়!

মরালী আবার হেসে উঠল। বললে–ওমা, কী যে বলো তুমি, কাকে আবার হাতের মুঠোয় আনলুম?

কান্ত বললে–কেন, জানো না?

মরালী বললে–খুলে বলো না, কাকে? নজর মহম্মদকে?নানিবেগমকে?

কান্ত বললে–কাকে হাতের মুঠোয় আনননি বলতে পারো? নবাবকে তুমি হাতের মুঠোয় আনননি? জগৎশেঠজিকে আনননি? সত্যিই তুমি জাদু জানো, না মরালী?

মরালী বললে–আর তোমার নিজের কথাটা যে বাদ দিলে?

আমি? আমার কথা ছেড়ে দাও, আমি আবার একটা মানুষ। আমাকে হাতের মুঠোয় আনা আবার কি একটা বাহাদুরি?

মরালী বললে–সত্যিই, তুমি কেন আমার জন্যে নিজের জীবনটা নষ্ট করছ বলো তো?

নষ্ট কোথায় করছি মরালী? এই যে তোমার কাছে থাকতে পারছি, তোমার কুম তামিল করতে পারছি, এটা কি আমার কম লাভ মনে করো? এক-একবার মনে হয়, তোমার জন্যে আরও কিছু করতে পারলে যেন ধন্য হয়ে যেতাম

মরালী সেই পুরনো প্রশ্নটাই আবার করে বসল।

বললে–কিন্তু আমি তোমার কে যে, আমার জন্যে তুমি এত করো?

কান্ত বললে–সে তুমি বুঝবে না। তুমি যদি পুরুষমানুষ হতে তো বুঝতে!

কেন, মেয়েমানুষ হলে বুঝি বুঝতে নেই?

কান্ত বললে–কিন্তু তুমি তো সেরকম মেয়েমানুষ নও! তুমি যে আলাদা

আমি আলাদা?

আলাদা নও? আলাদা না হলে আমার সঙ্গে তুমি এমন ব্যবহার করো? এই যে তুমি আমাকে একসঙ্গে ঘরের ভেতর বসিয়ে কথা বলতে দিচ্ছ, এ অন্য কেউ হলে করতে দিত? অন্য কেউ হলে নিজের স্বামীকে ছেড়ে চেহেলসূতুনে এসে নবাবের সঙ্গে রাত কাটাতে পারত?

কেন, আমার মতো তো অন্য অনেক মেয়ে এসে চেহেল্‌-সুতুনে রয়েছে!

কিন্তু তারা কি তোমার মতো? তারা তো সবাই সারাফত আলির আরক খায়, তারা নবাবকে খুশি করে টাকা-মোহর-গয়না আদায় করতে চায়। তুমি কি তাই করো?

তারপর হঠাৎ থেমে গিয়ে কান্ত আবার বললে–তুমি একটু শুয়ে পড়ো মরালী, নইলে কাল তোমার আবার শরীর খারাপ হয়ে যাবে। আমি উঠি

মরালী বললে–কেন, এখানেই শোও না।

না মরালী, আমাকে আর লোভ দেখিয়ো না। আমার মনের জোর নেই তোমার মতো, কখন কী করে ফেলব, তখন আর আফশোসের শেষ থাকবে না!

মরালী বললে–অত যদি আফশোসের ভয় তো মুর্শিদাবাদ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেলেই পারো। অন্য কোনও চাকরি নিয়ে বিয়ে করে ঘরসংসার করতে পারো

তা যদি পারতুম!

বলে আর দাঁড়াল না। ছই থেকে বাইরে বেরোতেই হঠাৎ আকাশ ভেঙে ঝমঝম করে বৃষ্টি এল। কান্ত সেই মেঘ-ভাঙা কালো অন্ধকার আকাশের দিকে চেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। কী করবে বুঝতে পারলে না।

মরালী বিছানার ওপর হেলান দিয়েছিল।

বললে–দেখলে তো? আমি বললুম বৃষ্টি আসবে। দরজা বন্ধ করে দাও, জলের ছাট আসছে—

দরজা বন্ধ করে কান্ত আবার ভেতরে চলে এল।

বাইরে তখন ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি নয় তো যেন বাজনা। বাজনা কি শুধু উৎসবেরই প্রতীক! জীবন-মৃত্যু আনন্দ-বিরহ সবকিছুই যেন সংগীত হয়ে নিজেকে প্রকাশ করে। কান্নাও তো একরকম সংগীত। কিন্তু সেই ঝমঝম বৃষ্টি-পড়া নিরিবিলি রাত্রে কান্নাই বা আসবে কেন কান্তর চোখে।

মরালী কান্তর মুখের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেল।

বললে–কী হল তোমার? কাঁদছ?

কান্ত বললে–না

তা হলে? দেখি, কাছে এসো

কান্ত কাছে গেল না। বললে–না, থাক–

মরালীই শেষপর্যন্ত উঠে কাছে এল। দু’হাত দিয়ে কান্তর দুটো কাধ ধরল। তারপর চিবুকটা ধরে মুখটা উঁচু করে তুলল।

বললে–সত্যিই কাঁদছ নাকি, না বৃষ্টির ফোঁটা পড়ল-?

তারপর হাত ধরে মরালী কান্তকে নিজের কাছে এনে বসাল। বললে–তুমি দেখছি মেয়েমানুষেরও বেহদ্দ! কোথায় আমি কাঁদব, তা নয় তো তুমিই কাঁদতে শুরু করলে! কেন, কী হয়েছে তোমার বলো তো! কী হয়েছে তোমার?

নৌকোটো তখন ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যে তিরের মতো গঙ্গার বুকের ওপর দিয়ে ভেসে চলেছে। আর নৌকোর ভেতরে দু’জন মানুষের বুকের মধ্যে তখন বাইরের অশান্ত প্রকৃতির মতোই অশান্ত তীব্র যন্ত্রণা নিঃশব্দ আর্তনাদ করে চলেছে।

অনেকক্ষণ পরে মরালী বললে–কী যে তুমি ছেলেমানুষি করো! নিজের কষ্টটাই যেন তোমার কাছে বড় হল, আর আমার বুঝি কিছু কষ্ট হতে নেই? আমার বুঝি পাথরের বুক, আমার বুঝি কিছু বোঝবার ক্ষমতা নেই?

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কান্ত বললে–কিন্তু কেন তুমি এমন করে নিজের সর্বনাশ করছ মরালী?

বা রে–মরালী হেসে উঠল বা রে, আমি আমার সর্বনাশ করেছি না তুমি আমার সর্বনাশ করেছ?

কান্ত বললে–সেই তবু তুমি আমাকেই দোষ দেবে? আমি তো তোমাকে অনেকবার বলেছি চলে যেতে! কতবার চেহেল সুতুন থেকে পালিয়ে যেতে বলেছি। তুমি রাজি হয়েছ? তুমি আমার কোনও কথা কখনও শুনেছ?

কিন্তু যখন তুমি আমাকে চেহেল্‌-সুতুনে নিয়ে এসেছিলে তখন তোমার মনে ছিল না?

কিন্তু তখন কি আমি জানতুম যে, আমি তোমাকেই চেহেল্‌-সুতুনে নিয়ে চলেছি!

মরালী বললে–বেশ, তা না হয় জানতে না, কিন্তু এটা জানতে তো যে, একজন মেয়েমানুষকে নিয়ে যাচ্ছ নবাবের চেহেসূতুনে? সে না-ই বা হলাম আমি, কিন্তু সেও তো একজন মেয়েমানুষ? তারও তো সংসার আছে। তখন একবার ভাবলে না যে, তুমি আর একজনের সুখের সংসার ভেঙে দিচ্ছ?

কান্ত কিছু বলবার আগেই মরালী আবার বলতে লাগল অথচ দেখো, যার কপালে সুখ নেই, কোনও সুখই তাকে সুখী করতে পারে না। নইলে আমার বিয়ের রাতের আগের দিন সকালে ওই ছোট বউরানির শোবার ঘরে গিয়ে দেখেছি, সে কী ঐশ্বর্য! শোবার খাট বিছানা। মাথার কাছে ফুলের তোড়া, কেমন সাজানো ঘর। ছোটমশাইয়ের ভালবাসা পেয়ে পেয়ে ছোট বউরানির তখন ঠ্যাকারের সীমা নেই–অথচ কোথায় গেল সেসব, কোথায় গেল সেই ঠ্যাকার! আজ আমাকেই আবার সেই ছোট বউরানি চিঠি লিখেছে–কপাল এমনই জিনিস

কান্ত বললে–ছোট বউরানির যা হয় হোক, কিন্তু আমি ভাবছি আমার কথা

তোমার কথা? তোমার কথা আবার কী?

আমার জন্যেই তো তোমার এই হাল হল?

মরালী বললে–সে কথা ভেবে আর কী করবে, এও আমার কপালে ছিল মনে করে নাও

কিন্তু ভাবলেই কষ্ট হয় যে! কোথায় ছিলুম বেভারিজ সাহেবের সোরার গদিতে, কোথায় কেমন করে আবার চলে এলুম নবাব-নিজামতে। এই ক’বছরে কত কী হয়ে গেল। যেখানে আমি কাজ করতুম, সেই গদিবাড়িতে গিয়ে দেখেছি, কত বদলে গেছে, গঙ্গার ধারে ধারে কত ঘাট হয়েছে, কত বাজার হয়েছে। কলকাতায়; সবকিছু বদলে গেছে, তুমিও বদলে গেছ; আমিই শুধু সেই একই রকম রয়ে গেলুম!

মরালী বললে–বা রে, আমি কোথায় বদলালুম?

বদলাওনি তুমি? আগে কি তুমি এইরকম ছিলে?

ওমা, আগে কী রকম ছিলুম?

এখন তুমি কত সুন্দর হয়েছ, তা জানো?

মরালী হেসে বললে–ওমা, আগে বুঝি খারাপ দেখতে ছিলুম?

না, খারাপ দেখতে থাকবে কেন? সচ্চরিত্র পুরকায়স্থমশাই যখন বিয়ের সম্বন্ধ করতে এসেছিল, তখন আমাকে বলেছিল তোমার চেহারার কথা।

কী বলেছিল?

সে না-ই বা শুনলে। কিন্তু পরে যখন তোমাকে দেখলুম তখন মনে হয়েছিল সে যেমন বলেছিল তার চেয়ে তুমি অনেক সুন্দরী। তারপর যত তোমাকে দেখছি ততই যেন তুমি দিন দিন আরও সুন্দরী হচ্ছ

মরালী হো হো করে হেসে উঠল

বললে–এই বৃষ্টির রাত্তিরে নৌকোর ছইয়ের মধ্যে একলা আমার সামনে কি ও কথা বলতে আছে?

কান্ত বললে–কেন, কেউ তো শুনতে পাচ্ছে না–

শুনতে পেলে বুঝি দোষের হত?

কান্ত বললে–দোষের হত না? এইসব কথা কি সকলের সামনে বলা যায়? অন্য লোকে শুনলে তারা তো অন্য মানে করত?

কী মানে? মনে করত তুমি আমায় ভালবাসো?

হঠাৎ নৌকোটা দুলে উঠল। কান্ত আর একটু হলেই ঝাঁকুনি লেগে মরালীর গায়ের ওপর ঢলে পড়ছিল। তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে উঠে বসে বললে–ঝড় উঠল বোধহয়, ঢেউ উঠেছে গঙ্গায়–

মরালী বললে–তা হোক না, তুমি চমকে উঠলে কেন?

কান্ত বললে–দাঁড়াও, বাইরে গিয়ে দেখে আসি কী হল

মরালী বললে–কেন, ঝড় উঠলে ভয় কী?

কান্ত বললে–আমার জন্যে ভয় নয়, ভয় তোমার জন্যে

আমার জন্যে? আমার জন্যে কীসের ভয় তোমার এত? তুমি কি মনে করেছ আমি সাঁতার জানি না?

কান্ত বললে–সাঁতার তো আমিও জানি। ছোটবেলায় একলা গঙ্গা সাঁতরে পার হয়ে কলকাতায় উঠে বেঁচেছিলম। সেজন্য বলছি না–

মরালী বললেও, এবার বুঝতে পেরেছি

কী?

ওই যে তোমাক চকবাজারে কে এক গণতকার তোমার হাত দেখে বলেছিল তুমি জলে ডুবে মারা যাবে, সেইজন্যে!

কান্ত বললে–না না, সত্যি বলছি সে জন্যে নয়! গণতকারের কথা কি আমি বিশ্বাস করি ভেবেছ? সে তো আরও অনেক কথাই বলেছিল, সব কি ফলেছে না ফলছে?

কী বলেছিল? আমার সঙ্গে তোমার আবার বিয়ে হবার কথা?

কান্ত হাসল-বাঃ, তোমার তো দেখছি সব মনে আছে!

মরালী বললে–তা তুমি কি ভাবো আমার মন বলে কিছু নেই?

কান্ত আর থাকতে পারলে না। একেবারে মরালীর কাছাকাছি সরে এল। বললে–আচ্ছা, সত্যিই বলল না, গণতকার ওকথা বললে–কেন?

ওমা মরালী সরে বসল–তুমি আবার কাছে সরে আসছ কেন? একটু মিষ্টি কথা বললেই একেবারে গলে যাও দেখছি তোমরা। ঠিক নবাব যেমন, তুমিও তেমনই

কান্ত বললে–নবাবের কথা এখন থাক, তুমি আমার কথা বলে মরালী! সত্যিই কি তুমি আমার কথা ভাবো? সত্যিই কি তুমি আমার দুঃখটা বোঝো? যা হয়ে গেছে তার কি আর কোনও পার নেই?

মরালী বললে–না, তোমাকে নিয়ে দেখছি আর পারা গেল না, ভাল মুশকিল তো করেছি তোমাকে সঙ্গে এনে

না, সত্যি বলছি, বলল না? তুমি কি আমার কথা ভাবো?

মরালী বললে–অমন করে পীড়াপীড়ি কোরো না, ওকথা জিজ্ঞেস করতে নেই

কান্ত বললে–কিন্তু তা হলে আমি কী করব বলো? আমি কী নিয়ে বেঁচে থাকব, বলো?

বলেছি তো আমার কথা ভুলে যেতে! বলেছি তো একটা বিয়েথা করে ঘরসংসার করতে।

কান্ত বললে–তা যদি সম্ভব হত তো বিয়ে করতুম না মনে করো?

কিন্তু কেন সম্ভব নয়, তা বলবে তো?

সেও তোমায় খুলে বলতে হবে? তুমি কিছু বোঝো না? তা হলে কেন তুমি আমাকে চেহেলসতুনে ডেকে পাঠিয়েছিলে? কেন তুমি আমার সঙ্গে হেসে কথা বলেছিলে? কেন তুমি আমাকে বিশ্বাস করেছিলে? কেন তুমি আমাকে আশ্বাস দিয়েছিলে?

ছিঃ

মরালী হঠাৎ নিজের হাত দিয়ে কান্তর মুখটা চাপা দিয়ে দিলো বললে–ছিঃ, তোমার মুখে দেখছি কিছুই আটকায় না–

আর সঙ্গে সঙ্গে ঠিক সেই সময়েই কি নৌকোটা অমন করে দুলে উঠতে হয়? দুলে উঠতেই মরালী আর টাল সামলাতে পারলে না, একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সামনের দিকে। আর কাও তখন কথা বলতে বলতে এত এগিয়ে আসছিল যে মরালীর ভয় লেগে গিয়েছিল। কাস্তর মুখে হাত চাপা না দিয়ে। আর কোনও উপায় ছিল না মরালীর পক্ষে।

বাইরে থেকে তখন মাঝিটা হঠাৎ চিৎকার করে উঠেছে–হুশিয়ার-তুফান উঠেছে নদীতে

হ্যাঁ, সত্যি, সেদিন তুফানই উঠেছিল সেই নৌকোর ভেতরের নিস্তব্ধ নিরিবিলিতে। কান্তর জীবনের তুফান, মরালীর জীবনেরও তুফান। কিন্তু সেকথা এখন থাক।

সিলেক্ট কমিটির মিটিং থেকেই ক্লাইভ সাহেব সোজা চলে গিয়েছিল উমিচাঁদ সাহেবের বাড়িতে। যে ষড়যন্ত্র একদিন শুরু হয়েছিল মহতাপচাঁদ জগৎশেঠের হাবেলিতে, সেই ষড়যন্ত্রই গড়িয়ে গড়িয়ে এসে পৌঁছেছিল কলকাতার সিলেক্ট কমিটির মিটিংয়ে। এমন মিটিং আগেও হয়েছে। সমস্তই ঠিক ঠিক বন্দোবস্ত হয়ে গিয়েছিল। কাকে কত দিতে হবে, বখরা ভাগাভাগির কথাবার্তা সবই পাকা হয়ে। গিয়েছিল। এতদিন পরে যখন সোলজার আর্মি আর্মস-অ্যামিউনিশন পাঠানো হয়ে গিয়েছে, তখন, আবার নতুন করে কীসের কনট্র্যাক্ট?

ক্লাইভ সাহেব বললে–উমিচাঁদসাহেব আমাদের মুখের কথায় বিশ্বাস করতে চায় না

কেন? আমরা ফরেনার বলে কি ভদ্রলোক নই? আমাদের কথার কোনও দাম নেই?

ক্লাইভ বললে–এখন আর সেকথা বলে লাভ নেই। উমিচাঁদ বিজনেসম্যান, মুখের কথা বিশ্বাস করতে চাইছে না। তা ছাড়া…

ওয়াটসন বললে–তা ছাড়া?

তা ছাড়া আমি সব দিক ভেবে আর উমিচাঁদকে চটাতে চাইলুম না। ওয়ারের সময় সকলের সঙ্গে ফ্রেন্ডলি রিলেশন রাখাই ভাল। কারণ এখন যদি নবাবকে গিয়ে মিরজাফরের কথা বলে দেয় তো সর্বনাশ। মিরজাফরসাহেবই তো আমাদের একমাত্র অ্যাসেট, সে-ই তো আমাদের একমাত্র মূলধন! উমিচাঁদের কথায় যদি নবাব মিরজাফরকে অ্যারেস্ট করে নেয়, তখন?

সেদিন সন্ধে থেকেই আকাশে মেঘ করে ছিল। সিলেক্ট কমিটির মিটিংয়ের সময় সেই বৃষ্টি ঝমঝম করে শুরু হয়ে গেল।

তারপর রাত আরও অনেক গম্ভীর হল।

প্রত্যেকটা আইটেম পড়ে পড়ে শোনানো হল সকলকে। ক্লাইভের নিজের হাতের তৈরি। ভাগ বখরার বিশদ হিসেব। কে কত পাবে, কার ভাগে কত পড়বে। ইন্ডিয়ার নবাবের সিন্দুক যখন হাতের মুঠোয় আসবে, তখন তার ভেতর থেকে বেরোবে পাঁচ পুরুষের জমানো ট্রেজার, সঞ্চিত সম্পত্তি। মুর্শিদকুলি খাঁ থেকে শুরু করে আলিবর্দি খাঁ পর্যন্ত সবাই মানুষের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে। উপায় করা টাকায় ভাগ বসিয়ে বসিয়ে সিন্দুক ভারী করে তুলেছে। এ সেই টাকা। আর শুধু টাকাই নয়, হিরে মুক্তো পান্না চুনি তাও আছে। সে যে কত আছে তার হিসেব লেখা নেই তারিখ-ই বাংলার পাতায়। সেই সমস্ত টাকার হিসেব বড় কম হিসেব নয়।

দু’খানা কাগজ। একখানা সাদা কাগজ, আর একখানা লাল।

দু’খানা কাগজ কেন?

ক্লাইভ বললে–একটা জাল, আর একটা আসল

আসল কাগজটাতে সকলের নাম আছে। শুধু উমিচাঁদের নাম নেই। জাল লাল কাগজটাতে সকলের নামের সঙ্গে মিরজাফরের নাম আছে।

ক্লাইভ বললে–স্কাউজ্বেলটাকে এই জাল দলিলটা দেখাব, এই জাল দলিলেই তার সই থাকবে খানিকক্ষণের জন্য বিবেকে বাধল বোধহয় সকলের। আমরা কি তা হলে লায়ার? আমরা কি তবে। সবাই মিথ্যেবাদী? কিন্তু তা কেন? ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্বার্থ দেখতে এসেছি আমরা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্বার্থ আমাদের স্বার্থ। দেয়ার ইজ নাথিং রং ইন ওয়ার অ্যান্ড লাভ। যুদ্ধ করতে বসে ন্যায়-অন্যায় ভাবলে চলে নাকি।

প্রথমেই সই করলে ক্লাইভ। রবার্ট ক্লাইভ। বড় বড় অক্ষরে নিজের নাম লিখে ড্রেকের দিকে এগিয়ে দিলে। কলমটা বাগিয়ে ধরে ড্রেক সাহেব সই করে দিলে তার নীচেয়। তারপর ওয়াট, তারপর কিলপ্যাট্রিক, তারপর বিচার। পাশে মিরজাফরের সই আগে থেকেই ছিল।

এবার তুমি সই করো?

ওয়াটসন এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। বললে–না।

কেন, সই করবে না কেন?

জাল দলিলে আমি সই করব না! ওটা পাপ!

ক্লাইভের চোখ দুটো গোল হয়ে উঠল রাগে, অপমানে, ক্ষোভে, লজ্জায়, ঘৃণায় আর অহংকারে। ক্লাইভ বরাবরই বড় অহংকারী। বরাবর মানুষের তাচ্ছিল্য পেয়ে পেয়ে বড় স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছিল ক্লাইভ। ওয়াটসন কি তবে নিজেকে সকলের চেয়ে বড় মনে করে, সুপিরিয়ার মনে করে! জাল দলিলে সই করে উমিচাঁদকে ঠকাতে যাচ্ছে বলে ক্লাইভ তার চেয়ে ছোট হয়ে গেল? তুমি কি মনে করো আমি জানি না কাকে বলে ন্যায়, কাকে বলে অন্যায়? ইন্ডিয়াতে এসে নবাবের থ্রোন কেড়ে নেওয়া অন্যায় নয়? এখানে এসে ইন্ডিয়ার মেয়ের সঙ্গে রাত্রে এক বিছানায় শোয়া অন্যায় নয়?

যখন কথা বলতে আরম্ভ করে ক্লাইভ, তখন আর তার জ্ঞান থাকে না। যখন আর্মি নিয়ে আমরা জীবনমরণের যুদ্ধ করতে যাচ্ছি, যখন জানি না কাল বেঁচে থাকব কি মারা যাব, তখন ভালমন্দর বিচার করে কে? সে আর যে-ই হোক, রবার্ট ক্লাইভ নয়। রবার্ট ক্লাইভ জীবনে কাউকে পরোয়া করে চলতে শেখেনি। সে বাপকে পরোয়া করেনি, মাকে পরোয়া করেনি, পৃথিবীকে পরোয়া করেনি। নিজের জীবনকে পর্যন্ত পরোয়া করেনি সে। তুমি তাকে আজ ন্যায়-অন্যায় শেখাতে এসেছ? তুমি কি মনে করো আমি এতদূর পর্যন্ত এগিয়ে এসে এখন থেমে যাব, পেছিয়ে যাব? নো, নেভার।

ওয়াটসন তখনও বেঁকে আছে। বললে–না, আমি সিগনেচার দেব না—

তা হলে দরকার নেই তোমার সইয়ের। তা হলে তোমার হয়ে অন্য লোক সই করবে। জাল সই।

কে সই করবে?

সে যে-ই হোক, তোমার একলার জন্যে আমি এতদুর এগিয়ে পেছিয়ে আসব না। জীবনে হেরে যাওয়া কাকে বলে আমি জানি না, আজও আমি হার মানব না–

তবু শুনি কে সই করবে?

ল্যাসিংটন! ল্যাসিংটনকে দিয়ে আমি সই করিয়ে নেব!

আর শেষপর্যন্ত সত্যিই তাই হল। সিলেক্ট কমিটির মেম্বাররা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন। যেমন করে হোক কাজ উদ্ধার হলেই হল। আমরা লড়াইতে জিততে চাই। আমরা ধর্মপ্রচার করতে আসিনি, আমরা এসেছি ইন্ডিয়ার সিংহাসন দখল করতে, আমাদের আবার অত সততা সত্যবাদিতার কী দরকার?

বৃষ্টি তখন আরও বেড়েছে। সেই রাত্রেই ক্লাইভ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল।

উমিচাঁদের তখনও ঘুম আসছে না। হাঁ করে বাইরের দিকে কান পেতে আছে। একবার মনে হয় যেন কার ঘোড়র পায়ের আওয়াজ হল। আবার মনে হয়, না–কেউ নয়।

ক্লাইভ যখন এসে পৌঁছোল তখন মাথা থেকে পা পর্যন্ত ভিজে গেছে। সমস্ত গা দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছে।

বড় হাসি বেরোল উমিচাঁদের মুখ দিয়ে।

বললে–আমি ভাবছিলাম সাহেব, তুমি বোধহয় আর এলে না—

ক্লাইভ বললে–সেকী? আমি কথা দিয়েছিলাম তোমাকে

না, খুব জোরে বৃষ্টি এল কিনা। তোমার সমস্ত শরীর ভিজে গেছে–একটু ড্রিঙ্ক করবে?

ক্লাইভ নিজের জামার পকেটের ভেতর থেকে লাল কাগজে লেখা দলিলটা বার করলে।

লাল কাগজ কেন?

আর কোনও কাগজ ছিল না দফতরে। সিলেক্ট কমিটির মেম্বাররাও প্রায় সবাই চলে যাচ্ছিল। লাস্ট মোমেন্টে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। আর একটু দেরি হলে আর কাউকেই পেতাম না।

উমিচাঁদের সামনে কাগজটা বার করে ভাজ খুলে চিত করে রাখলে।

সবাই সই করেছে দেখছি।

ক্লাইভ বললে–হ্যাঁ, ভাল করে দেখে নাও, সকলের সই রয়েছে। এই দেখো সকলের মাথায় আমার সই, তারপর ড্রেকের, তারপর ওয়াট, তারপর এইটে মেজর কিলপ্যাট্রিক, এরপর বিচার। আর এই সকলের শেষে ওয়াটসন

আরও খুশি হল উমিচাঁদ। মুখটা হাসিতে ভরে উঠল। কুড়ি লাখ টাকা! কোনও পরিশ্রম নয়, কোনও মাথা ঘামাননা নয়, কোনও মূলধন খাটানো নয়। শুধু একটু কূট বুদ্ধি৷ সেই কূট বুদ্ধির চালের সঙ্গে কুড়ি লাখ টাকা এসে গেল।

এবারে সই করো!

উমিচাঁদ সাহেব মাথার ওপর দেয়ালে টাঙানো গুরু নানকের ছবিটার উদ্দেশে নমস্কার করে নীচেয় সই করে দিলে।

ঠিক আছে?

ক্লাইভ বললো, হ্যাঁ ঠিক আছে

তারপর কাগজটা নিয়ে পকেটে রাখতে রাখতে বললে–তা হলে আমি আসি?

একটু ড্রিঙ্ক করবে না?

ক্লাইভ বললে–এখন আর ড্রিঙ্ক করবার সময় নেই। ওদিক থেকে মিরজাফর সাহেবের চিঠি পেয়েছি। লিখেছে, নবাব তাকে আর্মি দিয়ে কলকাতার দিকে পাঠিয়েছে। এদিকে, আমাদের আমিও কাল বিকেলবেলা চলে গিয়েছে–এতক্ষণ বোধহয় তারা কালনায় পৌঁছে গিয়েছে

তারপর আর দাঁড়াল না ক্লাইভ। এবার আর দাঁড়ানো চলেও না। কত বছর আগে থেকে ক্লাইভ যেন এই দিনটারই প্রতীক্ষা করছিল। মিরজাফর আসবে! মিরজাফর আসবে! মিরজাফর নিশ্চয়ই আসবে!

পেছন থেকে উমিচাঁদ একবার ডাকলে বৃষ্টি থামলে তারপর যেয়ো সাহেব—

কিন্তু সাহেব তখন খোলা আকাশের ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যেই ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে

উমিচাঁদ দরজাটা বন্ধ করে দিলে। অনেক দিন পরে আজ আবার ভাল করে ঘুম হবে! কুড়ি লাখ। কুড়ি লাখ টাকা। উমিচাঁদ সাহেব কোটি কোটি টাকার মালিক। কিন্তু তার সঙ্গে আরও কুড়ি লাখ টাকা যোগ হয়ে গেল। কোম্পানির এক কোটি টাকা। ফিরিঙ্গিদের পঞ্চাশ লাখ টাকা। আর তার বেলাতেই যত আপত্তি। তিরিশ লাখ থেকে কমিয়ে কুড়ি লাখ হল। তা হোক, কুড়ি লাখই বা কে দেয়?

উমিচাঁদ গুরু নানকের ছবির নীচেয় দাঁড়িয়ে আর একবার প্রণাম করলে। চোখ বুজে অনেকক্ষণ ধরে প্রণাম করলে। কিন্তু সেদিন চোখ খোলা থাকলে উমিচাঁদ দেখতে পেত, গুরু নানক ভক্তের ভক্তিতে নিঃশব্দে শুধু হেসে উঠলেন একবার।

আর কুড়ি লাখ টাকাতে সেদিন ইন্ডিয়া দুশো বছরের মতো বিক্রি হয়ে গেল।

পেরিন সাহেবের বাগানের ভেতরে দুর্গা, ছোট বউরানি দু’জনেই চুপ করে বসে আছে। বৃষ্টি পড়ছিল বাইরে। এই এখানেই কতদিন দুজনে বাস করে গেছে। প্রায় ঘরবাড়ি হয়ে গিয়েছিল তাদের। এইখানেই হরিচরণ তাদের দেখাশোনা করত। এই এখান থেকেই সাহেবের ওপর রাগ করে তারা চলে গিয়েছিল। কিন্তু কী যে কপালে ছিল। কোথা থেকে কী হয়ে গেল। গোরা সেপাইরা এসে তাদের নৌকোর ভেতর ঢুকে সব ওলোটপালোট করে দিয়ে গেল।

দুর্গা বলেছিল–তা তুমি কেন তোমার নাম বলতে গেলে ছোট বউরানি?

ছোট বউরানি বললে–আমি আবার কখন আমার নাম বলতে গেলাম–ওরাই তো বললে–আমি মরিয়ম বেগম–

সন্ধে থেকে খাওয়াদাওয়া হয়নি।

দুর্গা বললে–সে মুখপুড়িরই বা আক্কেলখানা কেমন, একখানা চিঠি পাঠালাম, তার জবাব পর্যন্ত পাঠাবার ব্যবস্থা করলে না। নবাবের হারেমে ঢুকে সাপের পাঁচ-পা দেখেছে খুঁড়ি!

তা সে চিঠি পেলে কিনা তারই তো ঠিক নেই! তুমি কার হাতে দিলে চিঠি, সে কি আর তার হাতে পৌঁছেছে! যার-তার চিঠি কি আর হারেমের ভেতরে পৌঁছোয় রে!

সন্ধে থেকে একজন কেবল খাওয়াবার জন্যে পীড়াপীড়ি করছিল। তখন খাবে না বলে তেজ দেখিয়েছিল। এখন খিদের চোটে পেট চোঁচো করছে। আর সাড়াশব্দ নেই কোথাও। বাইরে থেকে দরজায় শিকল তুলে দিয়ে চলে গেছে। সেই মুখপোড়া সাহেবই বা গেল কোথায়?

তারপর সেই যে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে, তার আর থামবার নাম নেই।

হঠাৎ বাইরে যেন কার দরজার কড়া নাড়বার শব্দ হল। ছোট বউরানি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দুর্গার গা ঘেঁষে বসল। কিন্তু দুর্গার সাহস আছে খুব।

বললে–কে?

এক-এক সময় এমন হয়। যখন মাথার ওপর বিপদ ঘনিয়ে আসে, পার পাবার আর কোনও রাস্তা থাকে না তখন। এক-এক সময় মনে হয়, কে যেন ডাকলে, কে যেন এল বাঁচাতে। বিশেষ করে সেই সেদিনকার জুন মাসের ঝড়বৃষ্টির রাত্রে।

শেষকালে বোধহয় ছোট বউরানির আর ধৈর্য থাকল না। বললে–তোর জন্যেই তো এইরকম হল, তুই যদি এখান থেকে না বেরোতিস তো এমন হয়?

দুর্গার আর কথা বলবার মুখ নেই তখন। শুধু বললে–আমি তো তোমার ভালর জন্যেই। গিয়েছিলাম ছোট বউরানি। কিন্তু কপালে গেরো থাকলে আমি কী করব?

তা তুই এত মন্তর জানিস আর একটা কিছু বিহিত করতে পারছিসনে? বাণ মারতে পারিসনে হারামজাদাদের? আমরা কী করেছি ওদের যে, আমাদের এমন করে হেনস্থা করবে?

কিন্তু কতক্ষণ ধরে আর এমনি করে ঝগড়া করা চলে? ঝগড়া করতে করতে ছোট বউরানিও কেমন একসময়ে নেতিয়ে পড়ে। বিছানাটার ওপর উপুড় হয়ে মুখ গুঁজে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে। তারপর দুর্গার কোনও কথাই আর শুনতে চায় না। বলে–বেরো তুই, বেরো এখান থেকে, তোর কোনও কথা শুনতে চাইনে, তুই বেরো এখান থেকে যা চলে যা

দুর্গার যেন সত্যিই পরাজয় হয়ে গিয়েছে। বহুদিন আগে দুর্গা একদিন বিধবা হয়েছিল। সে তখন ছোট। এখন তার বিয়ের কথাও মনে নেই, তার স্বামীর কথাও মনে নেই। শুধু এইটুকু মনে আছে, বর এসেছিল, উলুর শব্দ হয়েছিল চারদিক থেকে। ওই পর্যন্তই। তারপর যখন থেকে জ্ঞান এসেছে, তখন থেকে বড় বউরানির সঙ্গেই আছে। প্রথমে বড় বউরানির বাপের বাড়িতে। এমন কিছু বড় সংসার নয় সে বাড়ি। কিন্তু যেদিন বড় বউরানির বিয়ে হল হাতিয়াগড়ের ছোটমশাইয়ের সঙ্গে, সেইদিন থেকেই তার কপালটা খুলে গেল। হাতিয়াগড়ে আসার পর থেকেই দুর্গার ক্ষমতা বেড়েছিল, প্রতিপত্তি বেড়েছিল, তেজও বেড়েছিল। লোকের বিপদ আপদে মন্তর পড়ে, টোটকা ওষুধবিষুধ দিয়ে হাতিয়াগড়ের মেয়েমহলে বেশ নামডাক করে ফেলেছিল। কবে একদিন ছোটবেলায় দু-একটা তুকতাক শিখেছিল এক বুড়ির কাছে, তাই ভাঙিয়েই চলছিল। বুড়ি বলে দিয়েছিল–লোকের ভাল করবি, লোকের ভাল দেখবি, তা হলে তোরও ভাল হবে

তাই এতদিন দুর্গা ভালই করে এসেছে সকলের। কিন্তু যেদিন থেকে মরিমুখপুড়িকে লুকিয়ে রেখে দিয়েছিল হাতিয়াগড়ের রাজবাড়িতে, যে-দিন থেকে মরালীকে মুর্শিদাবাদের চেহেল্‌-সুতুনে পাঠিয়ে দিয়েছে, সেইদিন থেকেই আর তুকতাক কিছুই ফলছে না। কোনও মন্তরতন্তরই আর কাজ করছে না। দুর্গা যেন তাই কেমন অসহায় হয়ে গিয়েছে আজকাল।

ছোট বউরানি যখন রেগে যায়, তখন বলে–তোর কথা আমি আর শুনছিনে, তোর কথা শুনেই আমার এই কাল হল

দুর্গার চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। বলে–তুমি তোমার কথাটাই ভাবছ ছোট বউরানি, আর আমার বুঝি কিছু কষ্ট হচ্ছে না?

ছোট বউরানি বলে–তা তোর সেই মরটন্তর কোথায় গেল? তুই বাণ মারতে পারছিস না। হারামজাদাদের?

দুর্গা বলে বাণ আর খাটবে না ছোট বউরানি, আমার মন্তর আর খাটবে না—

কেন, খাটবে না কেন? কী হল মন্তরের?

দুর্গা বললে–আমি বাণ মেরেছিলুম ছোট বউরানি, কিন্তু খাটল না। আমার দাইবুড়ি, যে আমাকে

মন্তরটন্তর শিখিয়েছিল, সে বলেছিল, কারও যেন ক্ষেতি করিসনে দুগ্যা, এ-মন্তর তা হলে আর ফলবেনা

তা কার ক্ষেতি করেছিস তুই?

ওমা, কী বলছ ছোট বউরানি, ক্ষেতি করিনি! মরি-মুখপুড়ির ক্ষেতি করিনি? তাকে মোছলমানের হারেমে পাঠিয়েছি, সে কি তার কম ক্ষেতি ভেবেছ ছোট বউরানি? আমাদের কি ভাল হবে বলতে চাও তাতে? তুমি আজ এইটুকুতেই ছটফট করছ, আমাকে গালাগাল দিচ্ছ, আমাকে দুর দুর করছ, কিন্তু তার কথা তো ভাবছ না? সেই মুখপুড়ির কষ্টটার কথা তো ভাবছ না তুমি একবারও ছোট বউরানি?

ছোট বউরানি রেগে গেল। বললে–তার কথা ভাবতে যাব কেন শুনি? মুেখপুড়ি কি আমাদের কথা ভাবছে? এই যে তাকে তুই চিঠি দিলি, সে-চিঠির কি কোনও জবাব দিলে সে মুখপুড়ি?

দুর্গা বলে–ছি, তাকে তুমি অত গালাগাল দিয়ো না ছোট বউরানি, সে বেচারা হয়তো এখন চেহেল্‌-সুতুনে বসে কাঁদছে

এমনি করেই সমস্ত রাতটা কেটে গেল। প্রথমে বৃষ্টিটা একটু আস্তে আস্তে পড়ছিল। তারপর জোরে জোরে নামল। তারপর আরও জোরে। এতদিন গরমে মাটি ফুটিফাটা হয়ে ছিল। এইই প্রথম বৃষ্টি। বৃষ্টির তোড়ে যেন সব ঠান্ডা হয়ে এল আবার। ঠান্ডা হয়ে গেল ঘরটা। হোট বউরানি সেই অবস্থাতেই কখন ঘুমিয়ে পড়ল একবার। দুর্গা পাশে বসে ছিল। আস্তে আস্তে আর একখানা শাড়ি নিয়ে হোট বউরানির গায়ের ওপর চাপা দিলে। বড় মশা হয়েছে।

তারপর সব ঠান্ডা। বাগানের গাছে বুঝি কয়েকটা বাদুড় উড়ছিল। তাদের পাখা ঝাপটানির শব্দ কানে এল। দুর্গা আর বসে থাকতে পারলে না। ছোট বউরানির পায়ের কাছে গুটি মেরে শুয়ে পড়ল। আর কখন ঘুমিয়ে পড়েছে সেইভাবে, তার খেয়ালও ছিল না।

যখন ঘুম ভাঙল, তখন অল্প অল্প ভোর। বাইরে অন্ধকার বটে, কিন্তু ভাল করে তাকালে বোঝা যায়, কেমন যেন নীল-নীল আবহাওয়া। একটু নীলচে হয়ে এসেছে অন্ধকারটা, একটু পাতলা-পাতলা অন্ধকার। তখনও ছোট বউরানি ঘুমোচ্ছে। দুর্গা একবার সেই দিকে চেয়ে দেখলে। ছোট বউরানির ঠোঁট দুটো যেন একটু নড়ছে। বোধহয় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্নের মধ্যে ছোটমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলছে।

আস্তে আস্তে দরজাটা খুললে দুর্গা। দরজাটা খুলে বাইরের দিকে উঁকি মেরে দেখল। কোনও কিছু দেখা যায় না। এ-দরজাটা কি বন্ধ করতে ভুলে গেছে বেটারা! সামনের উঠোনের দিকে একেবারে শেকল দিয়ে গেছে। এ-দিকটা আর দেখেনি। হরিচরণ বহুদিন ছিল তাদের সঙ্গে। হরিচরণ জানত সব। এ-বেটা নতুন। জানে না যে, এ-দিকটাতেও একটা দরজা আছে।

দরজাটা খোলবার সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গার দিক থেকে হুহু করে হাওয়া এসে ঢুকল ঘরের মধ্যে। বৃষ্টি তখন থেমে গেছে। কেমন সোঁদা সেঁদা গন্ধ। হাতিয়াগড়ে প্রথম বৃষ্টি নামলে মাটি থেকে এইরকম গন্ধ বেরোত।

দুর্গা আবার বাইরের দিকে চেয়ে দেখলে। এখন যদি এখান থেকে ছোট বউরানিকে নিয়ে পালিয়ে। যায় তো কে দেখতে পাবে? কিন্তু এখান থেকে পালিয়ে যাবে কোথায়? কেমন করে যাবে? রাস্তায় দু’জন । মেয়েমানুষ দেখলেই তো লোকে সন্দেহ করবে? কার মনে কী আছে, কে বলতে পারে? দিনকাল খারাপ। চারদিকে সেপাই-সান্ত্রি ঘোরাফেরা করছে। যদি আবার ধরে নিয়ে এসে গারদে পুরে দেয়।

হঠাৎ ঘুমের ঘোরে ছোট বউরানি যেন একবার একটা শব্দ করে উঠল!

দুর্গা তাড়াতাড়ি ছোট বউরানির কাছে এসে ডাকলে কী হল ছোট বউরানি, কী হল? স্বপ্ন। দেখছিলে নাকি?

ছোট বউরানি হয়তো স্বপ্নই দেখছিল। দুর্গার কথায় শুধু পাশ ফিরে শুয়ে আবার ঘুমোতে লাগল। সমস্ত নিস্তব্ধ। বৃষ্টি থেমে যাবার পর চারদিকে ঝিঁঝিপোকার শব্দটা আরও জোরে কানে আসছে। তার সঙ্গে আছে ব্যাঙের ডাক। হয়তো আবার বৃষ্টি আসবে। দুর্গা কী করবে, বুঝতে পারলে না।

বউঠান।

হঠাৎ একটা চাপা গলার আওয়াজ পেয়েই দুর্গা চমকে উঠেছে। পেছন ফিরে চাইতেই অবাক হয়ে গেল। দরজার বাইরে একটা বেটাছেলের মূর্তি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দুর্গা চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল। কিন্তু বেটাছেলেটার চোখের চাউনি দেখে থমকে দাঁড়াল।

আমাকে চিনতে পারবেন না আপনারা। আমি মরালীর কাছ থেকে এসেছি।

মরালী! নামটা শুনে একটু ভরসা হল দুর্গার। বললে–তুমি কে?

চুপি চুপি এসেছি আমি, আপনাদের বাঁচাবার জন্যে। বউঠানকে ডেকে তুলুন, এখান থেকে আপনাদের নিয়ে যাব

বেটাছেলেটার জামাকাপড় সমস্ত তখন জলে ভিজে জবজব করছে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত টপটপ করে জল পড়ছে। একটু থেমে বললে–সন্ধে থেকে এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছি, ভরসা পাচ্ছিলাম না ভেতরে আসতে

দুর্গা তখনও ভাল করে অবস্থাটা বুঝতে পারেনি। বলে কী লোকটা! আবার কোনও বিপদের মধ্যে পড়বে নাকি?

আমাদের খবর পেলেন কী করে?

কেন, আপনারা যে মরিয়ম বেগমের নামে চিঠি দিয়েছিলেন।

তা হলে মুখপুড়ি সে-চিঠি পেয়েছে?

সেই চিঠি পেয়েই তো আমাকে পাঠিয়ে দিলে এখানে।

তা সে মুখপুড়ি তোমার কে? তুমি কেন এলে? তুমি তার কে?

লোকটা বললে–কেউ না

কেউ না! শেষকালে তোমার কথায় বিশ্বাস করে যাই, আবার তখন কোন চুলোয় কার হাতে গিয়ে পড়ি আর কী!

লোকটা বললে–আমাকে আপনারা বিশ্বাস করতে পারেন, আমি আপনাদের কোনও ক্ষতি করব না–

কিন্তু তবু যেন দুর্গার বিশ্বাস হল না।

কী করে নিয়ে যাবে আমাদের? নৌকো আছে?

হ্যাঁ, সঙ্গে নৌকো রয়েছে গঙ্গায়

কোথায় নিয়ে যাবে?

যেখানে বলবেন। যদি হাতিয়াগড়ে যেতে চান, সেখানেও নিয়ে যেতে পারি, যদি কেষ্টনগরে যেতে চান, তাও নিয়ে যেতে পারি।

কী করবে দুর্গা কিছু বুঝতে পারলে না। তারপর বললে–একটু পঁড়াও, ছোট বউরানিকে ডাকি, ছোট বউরানি কী বলে দেখি

ছোট বউরানি তখনও ঘুমোচ্ছিল। এত যে কথা চলছে, তাতেও ঘুম ভাঙেনি ছোট বউরানির। অঘোরে ঘুমোচ্ছে একেবারে। দুর্গা গিয়ে ছোট বউরানির গা ঠেলে জাগাতে চেষ্টা করলে ও ছোট বউরানি, ছোট বউরানিওঠো, ওঠো, দেখো, সেই মুখপুড়ি লোক পাঠিয়েছে আমাদের নিয়ে যেতে ও ছোট বউরানি

ঠেলতে গিয়ে নিজেই যেন ঠেলা খেলে দুর্গা।

ও দুগ্যা, ওঠ ওঠ–

আর সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে গেছে দুর্গার। দুর্গা চোখ দুটো খুলে দেখলে, ছোট বউরানি। ছোট বউরানি দুর্গাকে ঠেলা দিচ্ছে। বলছে-কী রে, কী ঘুম তোর, দেখেছিস কত বেলা হয়ে গেছে!

ধড়মড় করে উঠে বসল দুর্গা। একেবারে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছিল দুজনে।

চারদিকে চেয়ে দেখলে বেশ ফরসা হয়ে গেছে বাগানের বাইরেটা। অল্প অল্প রোদ এসে গেছে ঘরের ভেতর। কোথায় সেই লোকটা, কোথায় কে, কারও দেখা নেই! যেমনভাবে ছোট বউরানি আর সে এই ঘরের মধ্যে ছিল, তেমনই সব রয়েছে। কেউই তো আসেনি মরালীর কাছ থেকে? কেউই তো তাদের পালিয়ে যাবার সাহায্য করবার জন্যে নৌকো নিয়ে হাজির হয়নি! ছোট বউরানি বললে–তুই বেশ নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিস তো আর আমার এদিকে ঘুম নেই–

দুর্গা বললে–সেকী, তুমি ঘুমোচ্ছ দেখেই তো আমি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লাম

আমি আবার কখন ঘুমোলাম রে? তুই বলছিস কী?

দুর্গা বললে–সত্যি বউরানি, আমি কি মিথ্যে কথা বলছি? তুমি ঘুমিয়েছ, আমি দেখেছি

তা ঘুমিয়েছি বেশ করেছি। কিন্তু আর যে থাকতে পারছিনে। একটা কিছু ব্যবস্থা কর তুই!

দুর্গা বললে–খাবার দিতে বলব এদের? খাবে তুমি এদের হাতে?

ছোট বউরানি বললে–তা খাব না কি উপোস করে মরব?

তা হলে ওদের ডাকি?

ছোট বউরানি বললে–ডাক

দুর্গা কিছু বুঝতে পারলে না। কী করবে, কাকে ডাকবে, কোথায় যাবে, তাও বুঝতে পারলে না। আশেপাশে কেউ কোথাও নেই। জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। দেখলে দূরে যেন কে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। গোরা নয়, বাঙালি।

হাত দিয়ে তাকে ডাকলে।

বললে–ওগো, কে তুমি? একবার এদিকে শোনো তো বাছা

লোকটা যেন ভয় পেয়ে চারদিকে চেয়ে দেখলে। লোকটা কে তার ঠিক নেই। কেমন যেন ভয়ে ভয়ে তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।

ফিরিঙ্গি সেপাইরা তখন পাটুলিতে পৌঁছেছে। নবদ্বীপ থেকে ছ’ক্রোশ দূরে পাটুলি। সেখান থেকে কাটোয়া। কাটোয়ার উত্তরে অজয় নদের ওপারে সাঁকাইতে মস্ত বড় একটা কেল্লা। আগে থেকে সব ব্যবস্থা হয়েছিল। ইংরেজরা গোলাগুলি ছুড়লেই কেল্লার সৈন্যসামন্তরা পালিয়ে যাবে।

কিন্তু মেজর সাহেবকে এত সহজে কেল্লা দখল করতে হয়নি।

একবার মনে হল, কেল্লার ভেতর থেকে নবাবের সৈন্যরা গোলা ছোড়বার ব্যবস্থা করছে। সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজ সেপাই ঝাঁপিয়ে পড়ল। আর দেখা গেল, কেল্লার চালে তারা নিজেরাই আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। তারপর দেখা গেল, সৈন্যসামন্তরা পেছনের দরজা দিয়ে পালাচ্ছে।

ক্লাইভ আর দেরি করলে না। সদলবলে ভেতরে ঢুকে পড়ে দেখলে, কেল্লার ভেতরের সবকিছু তারা ফেলে গেছে। জামাকাপড়, বালিশ-বিছানা আর চাল। এত চাল। হিসেব করে দেখলে, যত চাল আছে, তাতে দশ হাজার লোক এক বছর ধরে খেয়েও ফুরিয়ে উঠতে পারবে না।

ক্লাইভ সেখানেই থামতে বললে–সকলকে। প্রথমে মাঠে তাঁবু পড়েছিল। ঝমঝম করে বৃষ্টি আসতে সবাই কাটোয়ার বাড়িগুলো দখল করে রাত কাটাল।

পরদিন ভোরবেলা। তখনও ভাল করে ফরসা হয়নি। মিরজাফর সাহেবের চিঠি এসে পড়ল। তাতে মিরজাফরসাহেব লিখেছে–নবার মনকরায় এসে পৌঁছেছেন, ওইখানেই গড়খাত করে যুদ্ধের জন্যে অপেক্ষা করবেন। আপনারা ঘুরে এসে যেন হঠাৎ হামলা করেন

সঙ্গে সঙ্গে ক্লাইভ চিঠির উত্তরে লিখলেন–আমি সৈন্যসামন্ত নিয়ে পলাশি পর্যন্ত এগিয়ে যাচ্ছি, এরপর মিরজাফর সাহেব যদি দাদপুরে এসেও আমাদের সঙ্গে যোগ না দেন তো আমি সরাসরি নবাবের সঙ্গে সন্ধি করব–

চিঠিটা পাঠিয়ে দিয়ে ক্লাইভ চুপ করে খানিকক্ষণ বসে রইলেন। হঠাৎ ল্যাসিংটন সামনে এসে দাঁড়াল। অবাক হয়ে গেছে ক্লাইভ ল্যাসিংটনকে দেখে। পেরিন সাহেবের ছাউনি ছেড়ে হঠাৎ এসেছে কেন? জিজ্ঞেস করলে কী হল, মরিয়ম বেগমদের কোথায় রেখে এলে? কার কাছে?

ল্যাসিংটন তখনও হাঁফাচ্ছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গোড়া থেকেই সে আছে বেঙ্গলে। একদিন অনেক কষ্ট করেছে। যখন কোম্পানির ফৌজ কলকাতা থেকে পালিয়ে ফলতায় গিয়ে নোঙর করেছিল, তখন অনেকদিন আধপেটা খেয়ে নবাবের বিরুদ্ধে যুঝেছে। ফ্লেচারের সঙ্গেই এসেছিল সে ইন্ডিয়ায়। কিন্তু তারপর কত লোক এল-গেল তবু এখনও তার প্রমোশন হয়নি।

একবার কর্নেল ক্লাইভকে নিজের দুঃখের কথা বলেছিল ল্যাসিংটন।

সব শুনে ক্লাইভ বলেছিল–তুমি আমার সঙ্গে থাকো, আমি তোমাকে হেলপ করব—

ইংলন্ডের মায়ে-তাড়ানো বাপে-খেদানো ছেলে সবাই। যার কোথাও কেউ নেই তখন তারাই ইন্ডিয়ায় এসেছিল ভাগ্য ফেরাতে। কিন্তু এখানে এসেও যাদের ভাগ্য ফেরেনি, ল্যাসিংটন তাদেরই একজন। দরকার হলে স্পাইয়ের কাজও করতে হত, মেসেঞ্জারের কাজও করতে হত। কোম্পানির জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবকিছুই করতে হত ল্যাসিংটনকে।

সেবার হঠাৎ মাসের পয়লা তারিখে ক্লাইভ ল্যাসিংটনের হাতে দুটো টাকা দিয়ে বলে–এটা নাও–

ল্যাসিংটন টাকা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। টাকা! কীসের টাকা?

এটা তোমাকে আমি নিজের পকেট থেকে দিলাম। ইউ টেক ইট। কোম্পানি যতদিন তোমার কিছু না করে ততদিন আমি মাসে মাসে এই টাকা দিয়ে যাব

ল্যাসিংটনের চোখে সেদিন কর্নেলের ব্যবহারে জল এসেছিল। টাকাটা নিতে গিয়েও সেদিন তার হাতটা পেছিয়ে এসেছিল।

নাও, নাও, আমি বলছি তুমি টাকাটা নাও। আমিও একদিন তোমার মতোই কোম্পানির কাছে মাইনে বাড়াবার দরবার করেছি, কেউ আমার কথায় কান দেয়নি। শেষকালে সকলের সঙ্গে ঝগড়া করে মারামারি করে আমি নিজের পাওনা আদায় করেছি

সেই থেকে বরাবর ল্যাসিংটন ক্লাইভের কাছ থেকে প্রত্যেক মাসের পয়লা তারিখে দুটো করে টাকা পেয়ে এসেছে। আর ক্লাইভ যখন যা বলেছে তখন তা-ই করেছে। কর্নেলের জন্য ল্যাসিংটন সবকিছুই করতে পারত।

ক্লাইভ বোঝাত–দেখো, আমাদের কোম্পানিও যা, এই ইন্ডিয়ার নবাব বাদশাও তাই। ঠিক নবাব-নিজামতেরও তোমার মতো হাজার হাজার ল্যাসিংটন আছে। আমি এতদিন ধরে তাদেরই খুঁজছি, যদি আজ নবাবকে লড়াইতে হারাতে পারি তো সেই সব ল্যাসিংটনদের সাহায্য নিয়ে হারাব নিজামতে তারা তাদের ন্যায্য পাওনা পায় না বলেই আজ তারা আমাদের সাহায্য করছে।

ল্যাসিংটন চুপ করে শুনত শুধু কর্নেলের কথাগুলো।

ক্লাইভ আরও বলত–শুধু উমিচাঁদ, শুধু মিরজাফর, শুধু জগৎশেঠদের দলে টানলেই যুদ্ধ জেতা যায় না। তাদের পেছনে ল্যাসিংটনরাও থাকা চাই তোমার মতো লোকের সাহায্য নিয়েই আমি ফোট সেন্ট ডেভিড জয় করেছিলুম। তোমরাই আসলে লাইক দিয়েছ, আর সমস্ত ক্রেডিট পেয়েছি আমি। আমি কর্নেল হয়েছি, আর তোমাদের মাইনে সেই এখনও ছটাকা রয়ে গিয়েছে। এই-ই হয়, সংসারের এই-ই নিয়ম। আগেও এই হয়েছে, এখনও হচ্ছে, পরেও এই-ই হবে। তবু দুঃখ কোরো না। যদি এই যুদ্ধে জিতি তো আমি তোমার জন্যে নিশ্চয় কিছু করব

ল্যাসিংটন হাসিমুখে শুধু কর্নেলের কথাগুলো শুনে গিয়েছিল, কিছু উত্তর দেয়নি।

তারপর যখন কর্নেল মিরজাফরের দলিলে অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের সই জাল করতে বললে–তখন একবার একটু দ্বিধা করেছিল।

বলেছিল–সই করব?

হ্যাঁ করো

কিন্তু জাল সই করলে অন্যায় হবে না?

কর্নেল ক্লাইভ আর কিছু বলেনি তখন। অপেক্ষা করবার মতো সময়ও তখন তার আর নেই। শুধু চোখ দুটো দেখে ল্যাসিংটন বুঝেছিল, কর্নেল রেগে গেছে খুব। তাড়াতাড়ি কর্নেল সাহেবের কাছ থেকে কাগজখানা নিয়ে বিনা দ্বিধায় ওয়াটসনের নামটা সই করে দিয়েছিল সেদিন।

কর্নেল ক্লাইভ জিজ্ঞেস করেছিল–সই করে দিলে যে?

ল্যাসিংটন বলেছিল–আপনি রাগ করছেন, তাই

ক্লাইভ বলেছিল–রাগ করার কথা নয়। তুমি একদিন তোমার মাইনে বাড়ছে না বলে দুঃখ করেছিলে। কিন্তু কেন মাইনে বাড়ছেনা আজ তো বুঝতে পারলে? আজ তো বুঝতে পারলে ছটাকা মাইনেতে রাইটার-ক্লার্ক হয়ে ঢুকে কেমন করে আমি কর্নেল হলুম? একটা কথা তোমাকে বলে রাখি ল্যাসিংটন, ভবিষ্যৎ জীবনে তোমার কাজে লাগবে-ন্যায় কাকে বলে তা আমি জানি, অন্যায় কাকে বলে তাও আমি জানি। কিন্তু অন্যায়ের সঙ্গে যখন লড়াই করতে হবে, তখন ন্যায়-অন্যায়ের বাছবিচার যে করে তার অন্তত মিলিটারি লাইনে আসা উচিত নয়। এইটে মনে রাখলে একদিন তুমিও আমার। মতো কর্নেল হয়ে উঠবে

কথাটা অনেকবার ভেবেছে ল্যাসিংটন। লন্ডনের সাবাবের একটা ছেলে ক্লাইভের মতন একদিন পালিয়ে এসেছিল ইন্ডিয়ায়। প্রথমে উদ্দেশ্য ছিল অ্যাডভেঞ্চার। তারপর এল আমবিশন। কিন্তু সকলের সব অ্যামবিশন কি পূর্ণ হয়?

আশ্চর্য! ছ’টাকা মাইনের সেই ল্যাসিংটন ক্লাইডের কাছে দীক্ষা পেয়ে হয়তো একদিন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে কর্নেলই হয়ে উঠত। কিন্তু লক্কাবাগের যুদ্ধের সময় নবাবের ফৌজের হাতে আচমকা গুলি খেয়ে যে সে একদিন প্রমোশনের আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু কোম্পানি নয়, কোম্পানির মালিকদেরও ছেড়ে যাবে তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।

সেদিন ল্যাসিংটন জানতে পারেনি, কেউই জানতে পারেনি। কিন্তু ক্লাইভ সেদিন কেঁদেছিল। তা সে তো পরের কথা। তার আগে আরও অন্য ঘটনা আছে।

ল্যাসিংটন প্রথমটায় বুঝতে পারেনি। প্রথম দিন পেরিন সাহেবের বাগানে যখন ভেতরের ঘরে নবাবের এক বেগমসাহেবাকে রাখা হয়েছিল তখন নিজের দায়িত্ব সম্বন্ধে ল্যাসিংটন সচেন ছিল। ক্লাইভ সাহেবের হুকুম ছিল–যেন মরিয়ম বেগমসাহেবা ঘর থেকে বেরোতে না পারে। কড়া নজর রাখবে।

সেদিন ভেতর থেকে বাঁদিটা জানালা দিয়ে ডাকলে ওগো, শোনো বাছা, তোমরা কি আমাদের মেরে ফেলতে চাও নাকি? আমাদের খিদে পায় না?

ল্যাসিংটন কিছুই বুঝতে পারেনি তার কথা।

দুর্গা আবার বলেছিল তোমাদের সায়েব কোথায়? তোমাদের সায়েবকে ডেকে আনো আমার কাছে, তার মুখে আমি খ্যাংরা মারব যত বলছি আমরা মরিয়ম বেগম নই, তবু আমাদের কথা তোমরা শুনবে না গা?

ল্যাসিংটন মনে মনে শুধু বলেছিল–খুব হয়েছে, বেশ হয়েছে। তখন খাবার জন্যে অত সাধাসাধি, তখন খেলে না। আর এখন খেতে চাইলে কী হবে? যে-দিন তোমাদের নবাব আমাদের কলকাতার ফোর্ট পুড়িয়ে দিয়েছিল সেদিন তোমাদের খেয়াল ছিল না। মরিয়ম বেগমসাহেবার বাঁদিটা আরও যেন কী সব চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছিল। ল্যাসিংটন সে-সব কথায় আর কান দেয়নি। এবার এমন এক জায়গায় চলে গিয়েছিল, যেখানে গেলে কারও চেঁচামেচি আর কানে যায় না। তারপর আর কী হয়েছে মনে নেই। কোম্পানির ফৌজ ফোর্ট ঝেটিয়ে চলে গেছে কর্নেলের সঙ্গে। কেউ কোথাও নেই। শুধু ল্যাসিংটন আর মরিয়ম বেগম আর বাঁদিটা।

রাত্রে অনেক বৃষ্টি হয়েছিল। জুন মাসের প্রথম বৃষ্টি। ঠান্ডার দেশের লোক, ইন্ডিয়ার গরমের পর প্রথম বৃষ্টি পেয়ে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল নাক ডাকিয়ে। তারপর কোথায় লড়াই, কোথায় প্রমোশন, কোথায় ডিউটি, আর কোথায় মরিয়ম বেগম! ঘুমের সময়ে আর অন্য কিছু কি মনে থাকে। বাগানের পেছনের দিকে আউটহাউসে কর্নেলের সিভিল স্টাফ থাকত। কুক, সুইপার, হরকরা, এইসব। তারাও তখন অঘোর-অচৈতন্য অবস্থায় রয়েছে। কেমন যেন মনে হয়েছিল কী একটা শব্দ হল। ঝনঝনাত। তারপর সব চুপ। বোধহয় বাদুড়ের কিচকিচ, কিংবা আউটহাউসের কেউ দরজার হুড়কো খুলল। কিংবা হয়তো কিছুই নয়, মনের ভুল। মনের ভুলে কানের ভুলে ভুল শব্দ শুনছে। তারপর আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

তারপর যখন ভোরবেলা ঘুম ভেঙেছে তখন উঠে একবার ওদিকে গিয়েছিল।

প্রথমে মনে হয়েছিল বুঝি সবাই ঘুমোচ্ছে। কিন্তু কাছে যেতেই দেখলে জানালা-দরজা খোলা রয়েছে। এ কেমন হল! দরজায় তালা-চাবি দেওয়া ছিল, কোথায় গেল? তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেল। কেউ নেই। তারপরে পাশের ঘরে ঢুকল। সেখানেও কেউ নেই। তারপরে উঠোন, কেউ কোথাও নেই। কোথায় গেল মরিয়ম বেগম? কোথায় গেল মরিয়ম বেগমের সেই বাঁদিটা? ল্যাসিংটনের মাথা থেকে পা পর্যন্ত থরথর করে কেঁপে উঠল। এখন কী হবে।

তারপর যখন খুঁজে খুঁজে কোথাও পাওয়া গেল না, তখন দৌড়ে আউটহাউসের দিকে গেল। বাবুর্চি, খানসামা, কুক, সুইপার অনেকেই চলে গেছে আর্মির সঙ্গে। দু-একজন রয়েছে শুধু। তাদেরই ডাকলে। তারা প্রাণভরে ঘুমোচ্ছিল। অনেক দিন পরে একটু ছুটি পেয়েছে। একটু হালকা হয়েছে।

ডাকাডাকিতে তারা উঠে পড়ল।

বললে–না হুজুর, আমরা তো কিছু জানি না

তা হলে মরিয়ম বেগম আর তার বাদি উড়ে গেল? ঘরে তালা বন্ধ ছিল, সে তালা কে ভাঙলে? কোথায় গেল তারা? কখন গেল?

সমস্ত বাগানটা নিস্তব্ধ। সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল ল্যাসিংটনের চিৎকারে। কর্নেল সাহেবের কড়া হুকুম ছিল নজর রাখবার জন্যে। নিশ্চয় স্টাফের মধ্যে কেউ ঠকিয়েছে তাকে। নইলে কেমন করে তারা পালাবে? হঠাৎ পালালেই হল?

আমি এক্ষুনি যাচ্ছি কর্নেল ক্লাইভের কাছে, সকলের এগেনস্টে আমি রিপোর্ট করব। আই শ্যাল স্যাক ইউ অল–

কিন্তু সকলের চাকরি খতম করে দিলেই তো আর মরিয়ম বেগমসাহেবাকে পাওয়া যাবেনা। কোনও সমস্যার সমাধানও হবে না। একটা কিছু করতে হবে। ল্যাসিংটন সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয়ে নিলে। কর্নেল সাহেবকে খবরটা অন্তত তাড়াতাড়ি দেওয়া উচিত।

তারপর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সব ব্যবস্থা করে একেবারে সোজা হাটা-পথে রওনা হয়ে গেল।

কর্নেল ক্লাইভের তখন মাথা ভারী হয়ে গেছে ভাবনায়। সেবারে ছিল কলকাতায় যুদ্ধ। কলকাতায় যুদ্ধ হলে অনেক লোকসান হবার ভয় থাকে। কিন্তু এবারকার যুদ্ধ কলকাতার বাইরে। কিন্তু বাইরেরই হোক আর ভেতরেরই হোক, যুদ্ধটা হল যুদ্ধ। যুদ্ধ মানেই জীবন, যুদ্ধ মানেই মৃত্যু। জীবন-মৃত্যু নিয়ে সারাজীবন তো যুদ্ধই করে এসেছে কর্নেল ক্লাইভ। এবার না হয় আর একবার। ঝড় আসে আসুক, বৃষ্টি আসে আসুক। মৃত্যু এলেই বা ক্ষতি কী? একদিন তো মৃত্যুই চেয়েছিল ক্লাইভ। মৃত্যুর জন্যে তৈরি হয়েই তো এই চাকরিতে ঢুকেছে। ছ’টাকা মাইনের রাইটার থেকে আজ এত উঁচুতে উঠেছে। খবর এসেছিল নবাব মনকরা থেকে আর্মি নিয়ে আরও এগিয়ে আসছে। দাদপুর ছাড়িয়ে একেবারে সামনাসামনি এসে গেছে।

ল্যাসিংটনের কথাটা শুনে প্রথমে চমকে উঠেছিল।

কী বললে?

ল্যাসিংটন বললে–দেখলাম তালাটা ভাঙা, আমি আউটহাউসের সবাইকে ডেকেছিলাম, তারাও কেউ কিছু জানে না

কিন্তু তা হলে মরিয়ম বেগম গেল কোথায়? কে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে? আমাদের স্টাফের কেউ ব্রাইব নেয়নি তো? আমি কিন্তু ফিরে গিয়ে সবাইকে স্যাক করব। যদি এরপর মরিয়ম বেগমকে না পাওয়া যায় তো তোমাকেও স্যাক করব ল্যাসিংটন। আই শ্যাল স্পেয়ার নো বডি।

ক্লাইভের এ-চেহারা কখনও আগে দেখেনি ল্যাসিংটন। ওয়ার-ফিল্ডের ক্লাইভ যেন আলাদা মানুষ। কথা বলতে বলতে চোখ দুটো এক জায়গায় স্থির থাকে না। কথা বলছে ল্যাসিংটনের সঙ্গে কিন্তু চোখ রয়েছে অনেক দিকে। ওদিকে হাজার হাজার ক্যাভালরি, তার ওপাশে ইনফ্যানট্রি। লক্কাবাগ পর্যন্ত ল্যাসিংটনকে টেনে নিয়ে এসেছে। সেখানে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে গেছে ক্লাইভের আর্মি।

হঠাৎ খবর এসে গেল, নবাব এসে পৌঁছেছে। ক্লাইভ যেন এক মুহূর্তের জন্যে অন্যমনস্ক হয়ে গেল। চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে গেল সব। তখন আর কিছুই মনে নেই। ল্যাসিংটনের দিকে চেয়ে বললে–তুমি? তুমি এখানে কেন? কে তোমাকে আসতে বলেছে? হু টোলড ইউ টু কাম?

ল্যাসিংটন বুঝল ক্লাইভ সাহেবের তখন আর মাথার ঠিক নেই।

ও, বুঝতে পেরেছি, মরিয়ম বেগমের খবর নিয়ে এসেছ তুমি? কিন্তু কেমন করে পালাল সে? কে তাকে পালাতে হেলপ করলে?

রাত একটার সময় এই লক্কাবাগের এক লাখ আমবাগানের মধ্যে এসে পৌঁছেছিল ক্লাইভ। চারদিকে তখন শুধু জোনাকিপোকার ঝক। বর্ষাকালের রাত। পায়ের তলায় কাদা। কাদায় কাদায় প্যাঁচপেচে হয়ে গেছে জায়গাটা। একেবারে ফাঁকা জায়গা।

ক্লাইভ চিৎকার করে উঠল–ব্যাটালিয়ন, হল্ট।

সঙ্গে সঙ্গে থেমে গিয়েছিল আর্মি। কিন্তু সকলের কাছে গিয়ে গিয়ে ক্লাইভ দেখতে লাগল। কারও কোনও অসুবিধে হয়েছে কিনা। আর ইউ টায়ার্ড? আর ইউ হাংরি? তোমরা কি ক্লান্ত? তোমাদের কি ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু আজ তোমাদের ক্লান্ত হলেও তো চলবে না, আজ তোমাদের ঘুম পেলেও তো চলবে না। আমরা আজ একশো আট্টান্ন বছর ধরে ঘুমোইনি। সেই ১৫৯৯ সালে আমাদের কোম্পানির পত্তন হয়েছিল ইংলন্ডে, আর আজ ১৭৫৭ সাল। এই একশো আটান্ন বছর ধরে আমরা জেগে আছি। আমরা এই দিনটার জন্যে অপেক্ষা করে আছি। আর শুধু কি আমরা? আমাদের আগেও কত লোক এসেছে এখানে। তারাও ঘুমোয়নি, তারাও খায়নি, তারাও টায়ার্ড হয়নি।

ল্যাসিংটন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনছিল।

হঠাৎ ক্লাইভ বললে–এসো, আমার সঙ্গে এসো

একটা উঁচু জায়গায় এসে দাঁড়াল ক্লাইভ। লক্কাবাগের চারদিকে উঁচু মাটির বাঁধ, পাশে শুধু একটা সরু খাল।

ক্লাইভ দূরের দিকে চেয়ে বললে–ওই দেখো

ল্যাসিংটনও দেখলে। ভোর তখন হয়েছে কি হয়নি। সার সার হাতি দাঁড়িয়ে আছে সামনে। তাদের পিঠের ওপর লাল পোশাক। তার পাশে ক্যাভালরি। সেপাইদের হাতের খাপ-খোলা শোর্ড আর হাজার হাজার নবাবি নিশান উড়ছে তাদের সকলের মাথার ওপর। অত বড় আর্মি, অত সোলজার, অত এলিফ্যান্ট, অত হর্স! ল্যাসিংটনের বুকটা দুরদুর করে উঠল। নবাবের আর্মির কাছে আমাদের আর্মি কতটুকু। এই তো আমাদের আটটা কামান শুধু, আর সোলজারই বা ক’জন।

ক্লাইভ তখনও সেইদিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।

হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই ও-দিক থেকে একটা বিকট শব্দ কানে এল। আর সঙ্গে সঙ্গে কী ঘটল বোঝা গেল না, ল্যাসিংটন ছিটকে পড়ল নীচেয়।

ক্লাইভ প্রাণপণে চিৎকার করে উঠেছে–ব্যাটালিয়ন, ফায়ার

কেমন করে যে সেদিন কী হল তা আজও মনে আছে মরালীর। সারাফত আলির খুশবু তেলের দোকান থেকে বেরিয়ে ছোটমশাই কী করবে বুঝতে পারেনি। সেই রাত্রেই মুর্শিদাবাদের চকবাজারের রাস্তা যেন অন্যদিনের চেয়ে বেশি থমথমে হয়ে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি জগৎশেঠজির বাড়িতে যেতেই জগৎশেঠজি বললেন–কী হল, কিছু টের পেলেন?

ছোটমশাই বললে–না, ওনামে ওখানে কেউ থাকে না, ওরা বললে। এখন কী করব আপনি বলুন!

জগৎশেঠজি অনেকক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন–তা হলে আমি যে-খবর শুনেছি সেইটেই ঠিক! হয়তো আপনার সহধর্মিণী ক্লাইভের হাতেই ধরা পড়েছে–

তা হলে আমি কি কলকাতায় যাব, আপনি বলছেন? ক্লাইভসাহেব আমাকে খুব ভাল করে চেনেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে গিয়ে আমি একবার তার সঙ্গে আমার সব কথা বলে এসেছি

জগৎশেঠজি বললেন–তা হলে তো ভালই হয়েছে। আপনি গেলেই সাহেব আপনার হাতেই আপনার সহধর্মিণীকে দিয়ে দেবেন। এ ভালই হয়েছে–আপনি এখনই চলে যান

এই রাত্রেই?

জগৎশেঠজি বললেন–হ্যাঁ, এই রাত্রেই। নইলে হয়তো আপনার দেরি হয়ে যাবে। আমি শুনলাম নবাব কাল সকালেই ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাচ্ছে–

আবার?

জগৎশেঠজি বললেন–হ্যাঁ আবার। নইলে ক্লাইভসাহেবই মুর্শিদাবাদে হামলা করতে আসত। এবার আর কলকাতায় যুদ্ধটা করতে দিতে চায় না ফিরিঙ্গিরা। সেবারে বড় লোকসান হয়েছিল ওদের

তা সেই কথার ওপর নির্ভর করে ছোটমশাই নৌকো চালিয়ে চলে এসেছিল কলকাতায়। নিশুতি রাত। ছোটমশাইয়ের মাঝিমাল্লাদেরও হয়েছে জ্বালা। এতদিন ধরে তারা বজরা চালাচ্ছে। পুরুষানুক্রমে হাতিয়াগড়ের এই মাঝিমাল্লার বংশধরেরা এই কাজই করে আসছে। কিন্তু এই কমাস ধরে যে ঝামেলা চলছে তার যেন আর শেষ নেই। একবার হাতিয়াগড়, একবার মুর্শিদাবাদ, একবার কৃষ্ণনগর, আর একবার কলকাতা। এই-ই করতে হচ্ছে কয়েকমাস ধরে। পরের দিন মাঝরাত্রে এসে ছোটমশাইয়ের নৌকো পৌঁছোল ত্রিবেণীর ঘাটে।

এই ঘাট দিয়েই একটু আগে দলে দলে কোম্পানির ফৌজ গেছে। তখনও মানুষের পায়ের চাপে ঘাটের পথ কাদায়কাদায় নোংরা হয়ে আছে।

ছোটমশাইয়ের নৌকোটা ঘাটে লাগতেই ছোটমশাই বললে–এখানেই রাখ বিন্দাবন, একটু ফরসা হোক তখন নামব

ঘাটের আর-একদিকে আর-একটা বজরার ভেতর তখন ফিসফিস করে যেন কাদের কথা হচ্ছে।

ওরা আবার কারা এল?

ছোট বউরানি আর দুর্গা তখন একপাশে চুপ করে শুয়ে ছিল। একদিন দুজনেরই ঘুম নেই খাওয়া নেই শান্তি নেই। এতদিন পরে যেন একটু নিশ্চিন্ত আশ্রয় পেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু মরালী তখনও জেগে। দাড়ের শব্দ পেয়ে সে চমকে উঠেছিল। বললে–ওরা আবার কারা এল?

কান্ত বললে–অত জোরে কথা বোলো না তুমি, শুনতে পাবে ওরা—

মরালী বললে–তার চেয়ে বজরা ছেড়ে দিতে বলো—

কান্ত বললে–মনে হচ্ছে ব্যাপারীদের নৌকো-আমি দেখে আসছি

বলে কান্ত বাইরের দিকে মুখ বাড়িয়ে দেখলে।

বাইরে এসে অন্ধকারে ভাল দেখা যাবে না জেনেও কান্ত ভাল করে দেখবার চেষ্টা করলে। সময় খারাপ। এ-সময়ে সকলেরই সন্দেহ হয়। ভাগ্যিস পেরিন সাহেবের বাগান ছেড়ে ফিরিঙ্গিরা যুদ্ধ করতে গেছে, নইলে ছোট বউরানিকে কি আর বের করে নিয়ে আসা যেত।

একবার ইচ্ছে হল মাঝিদের সঙ্গে ভাব করে জেনে নেয় বজরার ভেতরে কে আছে, কিংবা কার বজরা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আবার ভয় হল। ব্যাপারটা যদি জানাজানি হয়ে যায়। যদি ক্লাইভ সাহেবের কানে কেউ খবরটা দিয়ে দেয়।

ভেতরে ঢুকতেই মরালী বললে–কী হল? কে?

কান্ত বললে–জিজ্ঞেস করতে ভয় করতে লাগল। ভেবেছিলাম ব্যাপারীদের নৌকো, তা নয়, এ একটা বজরা

কার বজরা?

তা জিজ্ঞেস করিনি।

মরালী একবার চেয়ে দেখলে কোণের দিকে দুর্গা আর ছোট বউরানি দু’জনেই ঘুমোচ্ছ।

কান্ত জিজ্ঞেস করলে–এখন ওদের নিয়ে কোথায় যাবে বলো তো? ওদের জন্যে দেখছি শেষকালে তুমি না ধরা পড়ে যাও–

কেন? আমাকে কে ধরবে?

কান্ত বললে–বাঃ, চেহেল্‌-সুতুনে যদি তোমার খোঁজ পড়ে? যদি নানিবেগমসাহেবা জানতে পারে তুমি পালিয়ে গেছ, যদি নবাবের কানে কেউ তুলে দেয় খবরটা? তখন?

মরালী হেসে বললে–আমার জন্যে আমি ভাবি না। আমাকে এখন খুন করে মেরে ফেললেও আমার কিছু বলবার নেই। ছোট বউরানির জন্যেই তো আমি এত কাণ্ড করতে গিয়েছিলুম। ছোট বউরানির জন্যেই তো আমি চেহেসতুনে এসেছিলুম ।

কান্ত বললে–তা তো জানি, কিন্তু তুমিই কি ফ্যালনা? তোমার নিজের সুখদুঃখ বলতে কিছু নেই? তুমি তোমার নিজের দিকটা একবারও ভাববে না?

মরালীবললে–ওসব কথা অনেক শুনেছি, আর শুনতে ভাল লাগে না। এখন ওদের নিয়ে কোথায় যাব তাই ভাবছি। এমন অঘোরে ঘুমোচ্ছ দু’জনে..

কান্ত বললে–ওদের ডাকো না, ওদের জিজ্ঞেস করো না, কোথায় ওরা যেতে চায়!

সত্যিই তখন ঘুমিয়ে পড়েছিল দুজনে। দুর্গার মতো দজ্জাল মেয়েমানুষও কদিনের মধ্যে কাবু হয়ে পড়েছিল। মরালী যদি আর একদিন দেরি করত তা হলে হয়তো গলায় দড়ি দিয়ে মরতে হত তাদের। বড় ভয় পেয়ে গিয়েছিল হোট বউরানি। প্রথম যখন দুর্গা কান্তকে দেখলে তখন ভয়ে আঁতকে উঠতে যাচ্ছিল। কিন্তু কান্ত বলেছিল–চুপ করো, চেঁচিয়ো না, আমি মরালীর কাছ থেকে আসছি

দুর্গা বলেছিল–কোথায় সে মুখপুড়ি?

তোমরা রাগ কোরো না, চেঁচিয়ো না, চেঁচালে জানাজানি হয়ে যাবে। তোমাদের চিঠি মরালী পেয়েছে, পেয়ে নিজে তোমাদের নিতে এসেছে, এই গঙ্গার ঘাটে বজরাতে রয়েছে–

তা ডাকো তাকে। সে আসছে না কেন?

কান্ত বলেছিল–মরালী এলে ধরা পড়তে পারে। মরালীই আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে।

তুমি কে?

কান্ত বললে–আমি কান্ত!

দুর্গা বললে–কান্ত বললেই হল? কান্ত কী? মরির সঙ্গে তোমার কীসের সম্পর্ক? সে তোমাকে পাঠিয়েছে কেন? তুমি কিনবাব-নিজামতে চাকরি করো? তোমাদের কাউকে আমার বিশ্বাস নেই। এই বেটা সাহেব, যে আমাদের আটকে রেখেছে এখানে, ভেবেছিলাম সে-মানুষটা বুঝি ভাল। এখন দেখছি সে-মানুষটাও হারামজাদা! আমরা বাপু যাকে-তাকে আর বিশ্বেস করছিনে। তুমি মুখপুড়িকে গিয়ে ডেকে নিয়ে এসো, সে এসে না ডাকলে আমরা যাচ্ছিনে

শেষপর্যন্ত সেই অন্ধকার রাত্রে মরালীকেই আসতে হয়েছিল। মরালীকে দুর্গা প্রথমটা যানয় তাই বলে গালাগালি দিতে আরম্ভ করেছিল–মুখপুড়ি, মড়াপুভুনি, তোর নরকেও ঠাই হবে না। তোকে মুর্দোফরাসেও ছোঁবে না হারামজাদি! যার খাস তারই সর্বনাশ করিস তুই, তোর এত বড় আস্পর্ধা?

সামনে পেয়ে দুর্গা হয়তো আরও অনেক গালাগালি দিয়ে মনের ঝাল মেটাত, কিন্তু তার আগেই মরালী একেবারে দুর্গার পা দুটো জড়িয়ে ধরেছে দোহাই তোমার দুগ্যাদি, এখন গালাগালি দেবার সময় নয়, পরে যত ইচ্ছে গালাগালি দিয়ো-।

বেরো, বেরো এখান থেকে, বেরো–আমাকে ছুঁসনে

বলে দুর্গা পা দিয়ে লাথি মেরে মরালীকে দূরে সরিয়ে দিলে। মরালী গিয়ে পড়ল ঘরের কোণের দিকে।

চেঁচামেচিতে ছোট বউরানির ঘুম ভেঙে গিয়েছে। ঘুম ভেঙে উঠেই কাণ্ড দেখে অবাক।

বললেও কে দুগ্যা? আমাদের মরালী?

বলে মরালীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু দুর্গাই বাধা দিলে। বললে–ছুঁয়ো না, ছোট বউরানি, মুখপুড়িকে ছুঁয়ো না, ও গোরু খেয়েছে, মোছলমান হয়েছে

পাশে দাঁড়িয়ে কান্তর কানে সব কথাগুলো যাচ্ছিল। তার ভীষণ রাগ হল। যাদের জন্যে মরালী এত করলে তারাই কিনা এমন করে তার হেনস্থা করছে!

কিন্তু ছোট বউরানি ততক্ষণে ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছে। ছোট বউরানি বললে–তুই সর–তুই কেন ওকে বকছিস অত?

তারপর মরালীর কাছে গিয়ে বললে–আমাদের চিঠি পেয়েছিলি তুই?

মরালী তাড়াতাড়ি ঢিপ করে একটা প্রণাম করে বললে–আমি তোমাদের নিতেই তো এইছি ছোট বউরানি। সত্যি বলছি, তুমি বিশ্বাস করো, আমি গোরু খাইনি

দুর্গা বললে–গোরু খেলে তুই-ইনরকে যাবি, আমাদের কী!

ছোট বউরানি সে কথায় কান না দিয়ে বললে–আমাদের এক্ষুনি নিয়ে চলো ভাই, তুমি না এলে আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরতুম–

কিন্তু তখন আর কথা কাটাকাটির সময় নেই। ওদিকে মনে হল কাদের যেন পায়ের শব্দ হল। যদি কেউ এসে পড়ে তো সকলেরই সর্বনাশ। দরজার তালা ভাঙার সময়েই যে কেউ টের পায়নি সেই-ই যথেষ্ট। তারপর আর দেরি করলেই হয়তো কারও ঘুম ভেঙে যাবে। যে যেমন অবস্থায় ছিল তেমনি

অবস্থায়ই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নৌকোয় উঠল।

নৌকোয় উঠেও যেন ভয় যাচ্ছিল না ছোট বউরানির। ভেতরে বিছানার ব্যবস্থা ছিল, খাবারদাবার ছিল। সব বন্দোবস্তই করে এসেছিল মরালী।

কিন্তু ছোট বউরানি খেতে চাইলে না। বললে–না রে, আমাকে খেতে বলিসনে। তুই যে আমাকে মনে রেখেছিস, মনে রেখে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে এলি এই-ই আমার যথেষ্ট।

দুর্গাও মুখে কুটোটি পর্যন্ত দিলে না।

মরালী বললে–তুমি খাও ছোট বউরানি, ও খাবার আমি নিজে ছুঁইনি—

দুর্গা বললে–না বাছা, তুমি নিজে জাত দিয়েছ, আমাদের আর জাত নিয়ো না–এখনও দু’বেলা কাঁচাকাপড়ে সন্ধে আহ্নিক করি

কিন্তু জল? জলটুকুও খাবে না?

আমাদের এই গঙ্গার জলই যথেষ্ট বলে গঙ্গা থেকে আঁজলা ভরতি করে জল নিয়ে টোক টোক করে খেলে।

দুর্গা বললে–এ ক’দিন দিনে রাতে এক ফোঁটা ঘুমোতে পর্যন্ত পারিনি, একটু ঘুমোব—

বলে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল।

মরালী বললে–তোমরা কোথায় যাবে তাই আগে বলো দুগ্যাদি, তোমাদের আমি পৌঁছে দিই—

তা তুই কোথায় যাবি এখন?

যেদিকে তুমি বলবে সেই দিকেই তোমাদের নিয়ে যাব।

কিন্তু তুই নিজে? তুই নবাবের হারেমে ফিরে যাবি?

মরালী বললে–আমার কথা ছেড়ে দাও দুগ্যাদি! একদিন তোমাদের জন্যেই আমি নবাবের হারেমে গিয়েছিলাম, তোমাদের জন্যেই নিজের জাত খুইয়েছিলাম। আজকে যদি তোমাদের আবার কোথাও নিরাপদ জায়গায় পৌঁছিয়ে দিতে পারি তো আমার কাজ ফুরিয়ে যাবে, তারপরে আমি বাঁচি আর মরি তা নিয়ে ভাবনা করব না

তারপর হঠাৎ যেন একটা কথা মনে পড়ে গেল মরালীর।

বললে–আমার বাবা কেমন আছে দুগ্যাদি–? বাবা কি আমাকে একেবারে ভুলে গেছে?

দুর্গারও যেন এতক্ষণে মনে পড়ল। বললে–তবু যা হোক তোর বাপের কথা মনে আছে দেখছি

মনে থাকবে না দুগ্যাদি? বাবার কথা কি ভুলতে পারি? জাত দিয়েছি বলে কি বাপের কথাও ভুলে যাব? মেয়ে হয়ে কি বাপের কথা কেউ ভুলতে পারে?

তারপর বাবার কথার সঙ্গে যেন চোখের সামনে সব ভেসে উঠল। বললে–সেই ছাতিমতলার ঢিবিটা এখনও আছে দুগ্যাদি? আহা, সেই বাবুদের বাড়ির দেউড়ির সেই আতাগাছটা? আর আমার নয়ানপিসি? তার খবর কী দুগ্যাদি? নন্দরানিদিদি এখন কী করছে? আমার সেই বিয়ের বাসরে যার বরের মরার খবর এসেছিল? নন্দরানিদির মায়ের কান্নার কথা আমার এখনও মনে আছে, জানো দুগ্যাদি! আমি কিচ্ছু ভুলতে পারি না। তোমরা ভাববা আমি খুব আরামে আছি। কিন্তু কী আরামে যে আছি তা যদি তুমি দেখতে পেতে?

একমনে মরালী তার কথা বলে যেতে লাগল। হঠাৎ এক নিমেষের মধ্যে যেন আবার সে সেই হাতিয়াগড়ে গিয়ে পৌঁছেছে।

কথা শুনতে শুনতে দুর্গা বললে–অত কাছে সরে আসিসনে বাছা, ছুঁয়ে দিবি শেষকালে।

মরালী বললে–কিন্তু দুগ্যাদি, এতদিন তো তুমি ক্লাইভ সাহেবের ছোঁয়া খেয়েছ?

কে বললে–সাহেবের ছোঁয়া খেয়েছি? আমাদের রান্না তো সব হরিচরণ করত। তাকে তো মেরে ফেলেছে ওরা। সে থাকলে কি আর তোকে চিঠি লিখতুম? কী গো ছোট বউরানি, তুমি বলো না হরিচরণ থাকলে কি অমন করে মরি-কে চিঠি লিখতুম?

ছোট বউরানি বললে–তুই থাম তো দুগ্যা, বকবক করিসনি, আমার ঘুম পাচ্ছে, আমি ঘুমোই

মরালী বললে–তুমি ঘুমোও দুগ্যাদি, আমি আর তোমাকে বিরক্ত করব না। তুমি সেই আমার বিয়ের দিন যে উপকার করেছ তা আমি জীবনে ভুলব না

দুর্গার মনে পড়ে গেল। বললে–হ্যাঁরে, সে ভাতার তোর আর খোঁজ করেনি?

মরালী বললে–খোঁজ করেছিল দুগ্যাদি, পালকি করে মুর্শিদাবাদ যাবার সময় একটা সরাইয়ের সামনে তার গান শুনেছিলাম। খুবই খেদের গান আমি রব না ভব-ভবনে

তা তুই কী বললি?

আমি আর কী বলব দুগ্যাদি! তখন যদি কথা বললে–ধরা পড়ে যাই, তাই আর কিছু বলিনি।

বলিসনি, বেশ করেছিস-ও একটা বাউন্ডুলে মানুষ, তুই ওর সঙ্গে ঘর করতে পারবি কেন? তা হারে, নবাবের হারেমের ভেতরটা কেমন রে? খুব কষ্ট? না খুব আরাম? শুনছি নাকি বেগমরা সব গোলাপজল দিয়ে চান করে, সোনার থালায় ভাত খায়? বাঁদিরা খাইয়ে দেয়, কাপড় পরিয়ে দেয়, ঘুম পাড়িয়ে দেয় গান গেয়ে গেয়ে? সত্যি?

মরালী বললে–না দুগ্যাদি, সব মিথ্যে কথা, সবাই কাঁদে, কাঁদে আর কষ্ট ভোলবার জন্যে আরক খায়

আরক খায়? আরক কী রে? সে খেলে কী হয়?

মরালী বললে–সে একরকম বিষ দুগ্যাদি।

বিষ?

হ্যাঁ দুগ্যাদি, সেঁকো বিষ। সেই বিষ বাজার থেকে কিনে এনে নবাবের বেগমরা সব খায়।

কেন, বিষ কিনে খায় কেন? মরতে?

মরালী বললে–না দুগ্যাদি, সে বিষ খেলে মানুষ সব ভুলে যায়। দুঃখু ভুলে যায়, সুখ ভুলে যায়, আত্মীয়-স্বজন বাপ-মা সকলের কথা ভুলে যায়। সে খেলে মনে হয় যেন কোনও কষ্ট নেই আমার। গায়ে লোহা পুড়িয়ে ছ্যাকা দিলেও ব্যথা লাগে না, আর সারা অঙ্গ যখন জ্বলে যায় তখন সেই আরকের নেশায় বেগমরা খিলখিল করে হাসে!

ওমা, বলছিস কী তুই? তুই তাই খেতিস?

মরালী বললে–তা খেলেও যদি ছোট বউরানির কিছু উপকার হত তত তা-ও খেতাম দুগ্যাদি বিশ্বাস করো দুগ্যাদি, আমি তোমাদের জন্যে সব করতে পারতুম! কিন্তু তার দরকার হয়নি। তোমাদের যে আমি শেষপর্যন্ত ডাকাতের হাত থেকে বাঁচাতে পেরেছি তাই-ই আমার যথেষ্ট

দুর্গা বললে–এ কমাস যে কী কষ্টে আছি তা তোকে কী বলব মরি

তা এখন তো তুমি মুক্তি পেলে দুগ্যাদি, এখন আর তোমার ভয় নেই!

দুর্গা বললে–ছোটমশাইয়ের পায়ের কাছে যেদিন এই ছোট বউরানিকে তুলে দিতে পারব সেইদিন বুঝব আমার মুক্তি হয়েছে। তার আগে নয়। কী কুক্ষণেই যে কার মুখ দেখে বেরিয়েছিলাম হাতিয়াগড় থেকে!

মরালী বললে–তা হাতিয়াগড় থেকে তোমরা বেরোতে গেলে কেন দুগ্যাদি? আমিই তো ছোট বউরানি সেজে চেহেল্‌-সুতুনে গিয়ে উঠেছিলাম। ছোট বউরানিকে তুমি আড়াল করে রাখতে পারোনি? যাতে কেউ জানতে না পারে?

দুর্গা বললে–সব কপাল রে মরি, সবই কপাল!

তা যা বলেছ দুগ্যাদি! আমি চেহেল্‌-সুতুনে গিয়ে ভেবেছিলাম ছোট বউরানির বুঝি খুব উপকার করলাম! কিন্তু এমন করে যে তোমাদের ভুগতে হবে তা কি জানতাম।

তারপর বাইরের দিকে চেয়ে ডাকলে–কান্ত!

কান্ত বাইরে গিয়েছিল, ভেতরে এল। মরালী বললে–মাঝিদের বলে দাও ত্রিবেণীর ঘাটে যেন বজরা বাঁধে

কান্ত বাইরে চলে গেল।

দুর্গা জিজ্ঞেস করলেও কে রে মরি? ছেলেটা কে? তোর চাকর বুঝি?

হ্যাঁ দুগ্যাদি, আমার চাকরই বটে!

চাকরই বটে মানে? তা হলে তোর চাকর নয় সত্যি সত্যি? তখন থেকে তো দেখছি তোর কথায় উঠছে বসছে, আমাদের হরিচরণও ঠিক অমনি ছিল–

মরালী বললে–নিজের বলতে তো আমার কেউ নেই দুগ্যাদি। তবু ওর মতো নিজের লোক আমার আর কেউ নেই আমার জন্যে ও প্রাণও দিতে পারে–

তা বেশ পেয়েছিস তো চাকরটাকে। কত করে মাইনে দিতে হয়?

মরালী বললে–সবাই কি মাইনে চায় দুগ্যাদি, না মাইনে নেয়! মাইনে না পেলেও ও কাজ করবে, ও এমন মানুষ। আর তা ছাড়া আমি খুশি হলেই ওর সব পাওয়া হয়–

দুর্গা বললে–তোর হেঁয়ালি কথা আমি বুঝতে পারছিনে বাপু, পষ্ট করে বল

মরালী বললে–তোমার বুঝেও দরকার নেই দুগ্যাদি, ও তুমি বুঝতেও পারবে না–তুমি বরং ঘুমোও, ক’দিন ধরে তোমার ঘুম হয়নি–আমি তোমায় ডেকে দেব’খন–

বলে দুর্গার বিছানাটা পেতে দিলে মরালী। অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। দুর্গা ছোট বউরানির পায়ের কাছে শুয়ে পড়ল। বাইরে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। মরালী বাইরে চোখ মেলে তাকাল। ছইয়ের বাইরে কান্ত তখন কঁকা আকাশের দিকে চেয়ে চুপ করে বসে ছিল।

মরালী ডাকলে–কান্ত, শোনো

কান্ত ছায়ার মতো কাছে এল। মরালী বললে–কী ভাবছ?

কান্ত বললে–কই, কিছু ভাবছি না তো!

ভাবছ, কেন আমি তোমায় ডেকে নিয়ে এলাম, কোথায় এদের নিয়ে যাচ্ছি। ভাবছ যদি তোমাকে নিয়ে এলুম তো তোমার সঙ্গে কথা বলছি না কেন! এইসব ভাবছ তো?

কান্ত বললে–না, আমি ওসব কিছুই ভাবছি না-

মরালী সেকথায় কান না দিয়ে বললে–যাদের জন্যে আমি নিজের সব সুখে জলাঞ্জলি দিয়েছি এরা তারা, তা তো তুমি জানো?

কান্ত বললে–জানি

এদের তো উদ্ধার করা হল। এখন এদের হাতিয়াগড়ে পৌঁছে দিয়ে তুমি আমাকে যেখানে খুশি নিয়ে যেতে চাও, চলো।

কান্ত বললে–বলছ কী তুমি?

মরালী বললে–হ্যাঁ, ঠিকই বলছি, একদিন তুমিই আমাকে চেহে সুতুন থেকে পালিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলে। সেদিন এই ছোট বউরানির মুখ চেয়েই যেতে পারিনি। আজ আর আমার কারও ওপর কোনও দায়দায়িত্ব নেই, আজ আমি স্বাধীন।

কান্ত তখনও কথাটা বুঝতে পারেনি।

মরালী বলেছিল–হা করে দেখছ কী? আমি যা বলছি তাই করো—

কান্ত তখনও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। বললে–তুমি আমার সঙ্গে পালিয়ে যাবে?

কেন, পালাতে দোষ কী? এতদিন ওদের কথা ভেবেই আমি চেহেল্‌-সুতুন ছেড়ে যেতে চাইনি। এবার তো আর সে বাধা নেই!

কান্ত বললে–তা হলে নবাব? তুমি যে নবাবকে অত ভালবাসতে?

মরালী হাসল। বললে–নবাবের কি ভালবাসার লোকের অভাব আছে? নবাবকে ভালবাসতে লোকের অভাব হয় না।

কিন্তু তুমিই যে এতদিন পরে নবাবকে ঘুম পাড়ালে মরালী! তুমিই যে নবাবকে কোরান পড়তে শেখালে।নবাব যে তোমাকে না পেলে পাগল হয়ে যাবে!

মরালী আবার হেসে উঠল।

বললে–তুমি তা হলে নবাবকে ছাই চিনেছ! যেদিন নবাব মুর্শিদাবাদের মসনদ ছাড়তে পারবে সেইদিনইনবাব মানুষ হয়ে উঠবে। তার আগে নয়। তুমি তো জানো না, নবাবদের কাছে আগে মসনদ, তারপরে বেগম। বেগমরা তো নবাবের সম্পত্তি! নবাব কখনও বেগমদের ভালবাসতে পারে? না বেগমরাই কখনও ভালবাসতে পারে নবাবকে।

কান্ত সব শুনে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বললে–তা হলে?

তা হলে যা বললুম তাই করো।

কান্ত বললে–তুমি কি পাগল হয়েছ? তোমাকে নিয়ে আমি কোথায় পালাব? যদি কেউ জানতে পারে তো তখন কী বিপদ হবে বলো তো।

মরালী বললে–তুমি তোমার পিদের কথাটাই ভাবছ আর আমার কথাটা একবারও ভাবছ না? এর পর পালিয়ে না গিয়ে কি আমার উপায় আছে মনে করো? আমি কোথায় যাব? আমি কি আমার বাবার কাছে গিয়ে এর পরও মুখ দেখাতে পারব? এর পর কে আমাকে আশ্রয় দেবে বলতে পারো?

কেন, তুমি ছোট বউরানির সঙ্গে ছোটমশাইয়ের বাড়িতেই থাকবে।

তবেই হয়েছে। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গিয়েছিলাম, তাতেই বলে পা সরিয়ে নিলে, এরপর বাড়িতে থাকতে দেবে, খেতে দেবে।

কিন্তু তুমি তো ওদের জন্যে অনেক করলে মরালী! কারও জন্যে কেউ যা করে না তুমি তাই-ই করেছ, তবু বলছ তোমাকে থাকতে দেবে না ওদের বাড়িতে?

মরালী বললে–ওকথা থাক–এখন কী করবে বলো? এবার যখন বেরিয়েছিলুম তোমাকে নিয়ে তখনই ভেবে ঠিক করে নিয়েছিলাম যে, আর চেহেল্‌-সুতুনে ফিরব না।

ওদের হাতিয়াগড়ে পৌঁছিয়ে দিলে যদি আবার কোনও বিপদ হয়, তখন?

আবার কী বিপদ হবে?

যদি মেহেদি নেসারসাহেব আবার জানতে পারে যে, তুমি হাতিয়াগড়ের আসল ছোট বউরানি নও, তখন? যদি জানতে পারে যে, ছোট বউরানি হাতিয়াগড়ের বাড়িতেই আছে, তখন?

মরালীও কথাটা ভাবলে খানিকক্ষণ। তারপর বললে–তা হলে কোথায় ওদের নিয়ে যাই বলো তো? কোথায় নিয়ে গিয়ে ওদের লুকিয়ে রাখি?

কান্তও ভাবছিল। বললে–মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে ছোটমশাইয়ের তো খুব জানাশোনা আছে শুনেছি, তাদের কাছে সেই কেস্টনগরেই না-হয় রেখে আসি

হঠাৎ বজরাটা থেমে গেল। বাইরে থেকে মাঝি বললে–ত্রিবেণীর ঘাটে এসে গেছি হুজুর

কান্ত বললে–এই ত্রিবেণীর ঘাটেই বজরা বাঁধো

তারপর মরালীর দিকে চেয়ে বললে–ওদের জিজ্ঞেস করো ওরা কেষ্টগরে যাবে কিনা

মরালী বললে–আহা, ওরা ঘুমোচ্ছে ঘুমোক, জাগলে তখন জিজ্ঞেস করব–তার আগে বলল আমি কোথায় যাব?

কান্ত বললে–দাসমশাই? দাসমশাইয়ের কাছে যেতে তোমার আপত্তি কীসের?

ঠিক এই সময়েই আর একটা নৌকো এসে ঘাটে লাগবার শব্দ হল।

মরালী বললে–কারা এল ঘাটে?

কান্ত দেখে এসে ভেতরে ঢুকে বললে–না, ব্যাপারীদের নৌকো নয়, মনে হল কোনও জমিদারটমিদার হবেন; অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম, কেউ নামল না। বোধহয় ভেতরে ঘুমোচ্ছে

তা যদি চিনে ফেলে আমাদের? মাঝিদের জিজ্ঞেস করলে না কেন, ভেতরে কে আছে?

কান্ত বললেন, তাতে হয়তো আরও সন্দেহ হবে! ভাববে আমরাই বা অত খোঁজ নিচ্ছি কেন। তার চেয়ে চলো এখান থেকে চলে যাই

হঠাৎ বাইরে থেকে মাঝিটা ডাকলে–হুজুর

কান্ত বেরিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে কী?

এই দেখুন হুজুর, ওই বজরার মাঝি একবার আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে

কী, বলো?

লোকটা বিনীত হয়ে নমস্কার করে বললে–আজ্ঞে, আপনারা বলতে পারেন, ফিরিঙ্গি ক্লাইভ সাহেব কলকাতায় আছে কি না।

কান্ত বললে–ক্লাইভসাহেব কলকাতায় আছে কি না তা আমরা বলব কী করে? আমরা ক্লাইভসাহেবের দফতরে চাকরি করি?

আজ্ঞে তা নয়, রাস্তায় একজন বললে–কিনা সাহেব ফৌজ-সেপাই নিয়ে কলকাতা ছেড়ে কাটোয়ার দিকে গেছে। তাই বাবুমশাই আপনাকে জিজ্ঞেস করতে বললেন! আপনারা কিছু জানেন কিনা তাই জানতে চাইছেন

না বাপু, আমরা ওসব কিছু জানি না।

বৃন্দাবন আর একবার নমস্কার করে আবার নিজের বজরায় গিয়ে উঠল। ছোটমশাই তখন বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে ছিল।

বৃন্দাবন আসতেই ছোটমশাই জিজ্ঞেস করলে–কী রে বৃন্দাবন, কী বললে–ওরা?

বৃন্দাবন বললে–না হুজুর, ওয়ারা কিছু জানেন না

ছোটমশাই আবার জিজ্ঞেস করলে–ক্লাইভসাহেব এ রাস্তা দিয়ে ফৌজ নিয়ে যায়নি?

আজ্ঞে, ওঁয়ারা কিছুই জানেন না!

ছোটমশাই ভাবলে, তা হবে হয়তো, ঘোটলোক, কোনও খবরই রাখে না। কিংবা হয়তো বিদেশি লোক, সবে এইমাত্র ঘাটে এসে লেগেছে। মাথাটা তুলে ছোট ঘুলঘুলিটা দিয়ে বাইরের আকাশের দিকে চেয়ে রাতটা আন্দাজ করবার চেষ্টা করলে ছোটমশাই। পুবদিকটায় একটু যেন লালচে আভা দিয়েছে। আর খানিক পরেই ভোর হবে। তারপর মাথাটা আবার বালিশের ওপর রেখে বললে–ঠিক আছে, তুই এখন একটু ঘুমিয়ে নে, আমি তোকে ডাকব’খন—

আর সত্যিই তখন কেউ-ই জানতে পারলে না যে, পুবদিকের আকাশটা অন্য দিনের চেয়ে যেন একটু বেশি লালই হয়ে উঠেছে। জানতে পারলে না যে অষ্টাদশ শতাব্দীর অন্ধকার কেটে গিয়ে ভোর হতে বেশি দেরি নেই

লক্কাবাগের ছাউনির ভেতরে নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা তখন পরদার ফাঁক দিয়ে একবার বাইরের দিকে চাইলে। সত্যিই আকাশটা যেন অন্য দিনের ভোরের চেয়ে একটু বেশি লাল। কিংবা হয়তো কুয়াশার জালে আটকে গেছে সূর্যের আলোটা। তাই অত লাল দেখাচ্ছে।

ভোররাত পর্যন্ত মেহেদি নেসার নবাবের সঙ্গে ছিল। তারপর নবাবের ঘুম পাচ্ছে দেখে বেরিয়ে এল। ওদিকটা চুপচাপ। লাল লাল টুপি মাথায় ফিরিঙ্গিদের দূর থেকে দেখা যায় ছোট ছোট পিঁপড়ের সারির মতো।

মেহেদি নেসার সাহেব একটা তুড়ি মারলে নিজের মনেই! টাকা নিয়েই যত গোলমাল। মির্জা মহম্মদ প্রথমে যখন ভয় পেয়েছিল তখন মেহেদি নেসার সাহেবই সাহস দিয়েছে তাকে।

মির্জা বলেছিল–এত টাকা এখন কোথায় পাব?

ফৌজি সেপাইরা সবাই একজোটে বেঁকে বসেছিল মুর্শিদাবাদে। অনেক দিন মাইনে পায়নি তারা!

মেহেদি নেসার বলেছিল–শালাদের সব গুলি করে মারব, শালারা হারামজাদা

মির্জা থামিয়ে দিয়ে বলেছিল–না থাক, এখন বিপদ আমার, এ সময় ওরাও যদি বেঁকে বসে তো কাদের ভরসায় লড়াই করতে যাব

ইয়ারজান সাহেবও সেই কথায় সায় দিলে। মিরমদন, মোহনলাল, মিরজাফর সাহেবও সেই কথায় সায় দিলে।

মিরজাফর সাহেব বললে–টাকা সব মিটিয়ে দিলেই হয়—

মির্জা মহম্মদ বললে–বিশ্বাস করুন, টাকা নেই আমার। অত টাকা দিতে গেলে সব খালি হয়ে যাবে

আশ্চর্য, সেই টাকা সমস্ত শোধ করার পর তবে সেপাইরা রাজি হয়েছে লড়াইতে আসতে। দুর্লভরাম, ইয়ার লুৎফ খাঁ সবাই এসেছে। এই লক্কাবাগের তিন দিক ঘিরে সাজিয়েছে মিরবকশি সাহেব।

পঁয়ত্রিশ হাজার পায়দল ফৌজ, পনেরো হাজার ঘোড়সওয়ার, আর চল্লিশটা কামান। আর ওদিকে দাঁড়িয়ে আছে ফরাসিরা। তাদের রাগ তখনও মেটেনি। তারা কথা দিয়েছে, ইংরেজদের তারা গুঁড়িয়ে পিষে মেরে ফেলবে তবে ঠান্ডা হবে। ইউনিয়ন জ্যাকের ওপরই তাদের বেশি রাগ, যে-ইউনিয়ন জ্যাক তাদের চন্দননগরের কেল্লার ওপর উড়ছে।

মেহেদি নেসার সাহেব আর একবার তুড়ি দিলে নিজের মনেই।

তুড়ি দিতেই হঠাৎ যেন শিউরে উঠেছে।–কে?

বশির মিঞা কখন ছায়ার মতন পেছনে এসেছিল জানতে দেয়নি।

আমি বশির মিঞা, খোদাবন্দ!

বশির মিঞা তো কী! কী দরকার তোর? দেখছিস এখন লড়াই শুরু হয়ে যাবে, এখন কিছু বলবার সময় নেই, তুই যা–ভাগ

খোদাবন্দ, মরিয়ম বেগমসাহেবার তালাস করতে হুকুম দিয়েছিলেন, সেই তালাস পেয়েছি।

মরিয়ম বেগমসাহেবা! মেহেদি নেসার সাহেবের এত আনন্দের মধ্যেও হঠাৎ একটা পরাজয়ের কাটা খচ করে বুকে বিধে গেল। মুর্শিদাবাদ থেকেই মেহেদি নেসার সাহেবের টনক নড়েছে। চেহেল্‌-সুতুন থেকে নিঃশব্দে মরিয়ম বেগমের পালিয়ে যাওয়াটা যেন মেহেদি নেসার সাহেবের নিজের অপমান। ওটাকে জব্দ করতে না পারলে কীসের নবাবের পেয়ারের ইয়ার! সেই লস্করপুরের তালুকদার। কাশিম আলির যে অবস্থা করেছিল, মরিয়ম বেগমেরও সেই অবস্থা না করতে পারলে যেন আর কলজেটা ঠান্ডা হচ্ছে না। চেহেল্‌-সুতুনের খোজা সর্দার পিরালি খাঁ, নজর মহম্মদ, কেউই মরিয়ম বেগমসাহেবার হদিস দিতে পারেনি। আর তখন মির্জা লড়াই করতে বেরোচ্ছে, টাকার জন্যে হিমসিম খাচ্ছে, সে সময় অত ভাববার সময়ও ছিল না। শুধু মোহরার মনসুর আলি মেহের সাহেবকে খবরটা দিয়েই এই লক্কাবাগে চলে এসেছিল নবাবের ফৌজের সঙ্গে।

তারপর এই হঠাৎ আবার মরিয়ম বেগমসাহেবার খবর পাওয়া গেল।

বশির মিঞার দিকে চেয়ে বললে–কোথায় মরিয়ম বেগমসাহেবা?

খোদাবন্দ, ত্রিবেণীর ঘাটে!

ত্রিবেণীর ঘাটে!

জি হাঁ! আমি কলকাতায় গিয়েছিলুম, সেখান থেকে টুড়তে ছুঁড়তে শেষকালে ত্রিবেণীর ঘাটে এসে পাত্তা পেলুম!

কিন্তু কথাটা শেষ হবার আগেই একটা বিকট শব্দে কানে তালা লেগে যাবার অবস্থা হল। ফরাসিরা আচমকা একটা কামানের গোলা ছুঁড়েছে। গোলাটা গিয়ে পড়ল একেবারে ফিরিঙ্গিদের ছাউনির ওপর। আর ঠিক তার সঙ্গে সঙ্গে যেন ক’জন লোকের চিৎকার কানে এল!

ইয়া আল্লা!

মেহেদি নেসার খুশির চোটে আর একবার তুড়ি মারলে। তারপর বশির মিঞার দিকে চেয়ে বললে–চল, আমি ত্রিবেণীর ঘাটে যাব-চল শালা, চল

তারপর ফিরিঙ্গিদের কামানগুলো ফেটে চৌচির হয়ে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ হতে লাগল–দুম দুম দুম

মেহেদি নেসার একবার মিরজাফর সাহেবের ফৌজের দিকে চেয়ে দেখলো কোথায়? মিরবকশি সাহেবের মতিগতি তো বোঝা যাচ্ছে না কিছু। তবে কি সব বানচাল হয়ে যাবে? সব বন্দোবস্তই তো ঠিক হয়ে আছে। হঠাৎ নবাবের ফৌজের ডান দিক থেকে দুম দুম করে আবার শব্দ হল।

মেহেদি নেসার নিচু হয়ে সরে এল পাশের দিকে। বললে–সরে আয় উল্লুক, মরে যাবি

বশির মিঞাও সরে এল প্রাণের দায়ে। সূর্যটা ততক্ষণে অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে। মেহেদি নেসার সাহেব তখনও লড়াইটা দেখবার লোভ ছাড়তে পারছে না। যা-কিছু একটা ফয়সালা যেন এবার হয়ে গেলেই হয়। নবাবের ফৌজের কামান থেকে গোলাগুলো যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সবগুলোই আমগাছের ডালে গিয়ে লাগছে। সারা রাস্তা নবাবের সঙ্গে এসেছে মেহেদি নেসার সাহেব। এ-আসা মেহেদি নেসারের প্রথম নয়। মির্জা যতবার যেখানে গেছে, সেখানেই সঙ্গে গেছে। লড়াইতে গেলে ফুর্তিটা জমে ভাল। লড়াই তো করবে মিরবকশির ফৌজ। মরতে হলে মরবে সেপাইরা। এদিক-ওদিক থেকে গুলিগোলা ছোঁড়া হবে, সেই সময়ে দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখতে ভাল লাগে। তারপর আছে ফুর্তি, হররা, মহফিল। আগে আগে মির্জার ফুর্তির ওপর লোভ ছিল। নিজেও ফুর্তি করত, সকলকে ফুর্তি করতে বলত। ক’মাস ধরে যেন অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। মতিঝিলের আম-দরবারে যখন গেছে, সেখানকার খিদমদগার বলেছে, সদর দরওয়াজা বন্ধ। ভেতরে গিয়ে যে মির্জার সঙ্গে একটু কথা বলবে, তার ফুরসত মেলেনি। সবসময়েই নাকি মরিয়ম বেগম ভেতরে থাকে। যে-সময় মরিয়ম বেগমসাহেবা কাছে থাকে না, সে-সময় মির্জা মৌলবির কাছে কোরান পড়ে।

প্রথমে অবাকই হয়ে গিয়েছিল মেহেদি নেসার। তারপর হয়েছিল বিরক্ত। এ তত বড় মজা হল। কোথা থেকে মেহেদি নেসারই নিয়ে এসেছিল এই মরিয়ম বেগমকে! হাতিয়াগড়ের রানিসাহেবা। তখন ভেবেছিল মেয়েমানুষ দিয়ে ভুলিয়ে রাখবে নবাব মির্জা মহম্মদকে। এখন সেই মরিয়ম বেগমই আবার নবাবকে হাত করে ফেললে!

রাগটা তখন থেকেই ছিল মেহেদি নেসারের।

মনসুর আলি মেহের মোহরারকে তখন থেকেই হুকুম দিয়ে রেখেছিল, যেমন করে তোক ওই বেগমটাকে সরাতে হবে। সরাতে হবে মানে খতম করতে হবে।

মনসুর আলি মেহের সাহেব আবার যথারীতি হুকুম দিয়ে দিয়েছিল বশির মিঞাকে।

বশির মিঞা সেই সময় থেকে পেছনে লেগে আছে। বলেছিল–আমি ওকে খতম করে দেব ফুপাসাহেব!

মনসুর আলি সাহেব সাবধান করে দিয়েছিল–দূর বেল্লিক, খতম করবি না তুই, খতম করতে হলে মেহেদি নেসার সাহেব নিজেই করবে! তুই যেন বেল্লিকের মতো কাম করিসনি!

কিন্তু খতম করা কি অত সোজা! বড় চালাক মেয়ে মরিয়ম বেগমসাহেবা। তাঞ্জাম তাক করে কতদিন চকবাজারের রাস্তায় ওত পেতে থেকেছে। ভেবেছে, যখন অনেক রাত্রে বেগমসাহেবা মতিঝিল থেকে তাঞ্জাম করে ফেরে, তখন গুম করে ফেলবে। খোজা নজর মহম্মদকে কতদিন পান খাইয়েছে, পিরালি খাঁ-কেও কতদিন তোয়াজ করবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। রাতকে-রাত কাবার হয়ে গেছে চকবাজারের রাস্তার অলিগলিতে, তবু ধরতে পারেনি বেগমসাহেবাকে। কত বকুনি গালাগালি খেয়েছে মনসুর আলি মেহের মোহরার সাহেবের কাছ থেকে। আর বশির মিঞা শুধু নিজের নসিবকে গালাগালি দিয়েছে। নিজের ওপরেই তার রাগ হয়েছে।

একদিন প্রায় সবই ঠিক বন্দোবস্ত করে ফেলেছিল। গলির মোড়ে মোড়ে লোক বসিয়ে দিয়েছিল। বেগমসাহেবা আসবে আর তার পালকিকে বেপাত্তা করে দেবে। কিন্তু রাত যত বাড়তে লাগল, ততই উদ্বেগ বাড়তে লাগল। বেগমসাহেবার পালকির পাত্তা নেই। একবার মতিঝিল আর একবার চকবাজার করেছে। শেষকালে মতিঝিলে গিয়ে দেখেছে পালকি নেই। তখন এখানে-ওখানে খুঁজতে খুঁজতে একেবারে জগৎশেঠজির হাবেলিতে গিয়ে হাজির।

জগৎশেঠজির হাবেলির সামনে তখন বেগমসাহেবার পালকি মজুদ।

কিন্তু ওই হারামির বাচ্চা ভিখু শেখ! পাঠানের বাচ্চাটা বশির মিঞার সঙ্গে জানোয়ারের মতো ব্যবহার করে!

তারপর যখন ভোর হয়-হয়, তখন বেগমসাহেবার পালকি চলতে লাগল আবার।

পেছনে পেছনে বশির মিঞাও চলল।

কিন্তু সে-পালকি চেহেল্‌-সুতুনের দিকে না গিয়ে একেবারে সোজা চলতে লাগল গঙ্গার ঘাটের দিকে।

বশির মিঞা ভাবলে বেগমসাহেবা বুঝি বজরা করে কোথাও চলল।

পালকি-বেহারারা যখন পালকি নিয়ে চলেছে, বশির গিয়ে জিজ্ঞেস করলে–পালকিতে কে যায়?

বেহারারা বললে–কেউ যায় না

বেগমসাহেবা কোথায় গেল?

বজরায় করে চলে গেলেন।

কোথায় গেল?

তা জানি না হুজুর!

তারপর সেই রাত্রেই বশির মিঞা দলবল নিয়ে আবার একটা বজরা জোগাড় করে গঙ্গা পাড়ি দিলে। আগের বজরাটা যত জোরে যায়, পেছনের বজরাটাও তত জোরে চলে। শেষে যখন সামনের বজরার পাত্তা পাওয়া গেল, তখন মুর্শিদাবাদ থেকে অনেক ক্রোশ দূরে চলে এসেছে।

কিন্তু কোথায় কী! সব ভোঁ ভোঁ!

বশির জিজ্ঞেস করলে–বেগমসাহেবা কোথায়?

মাঝি বললে–বেগমসাহেবা? কোন বেগমসাহেবা? কার কথা বলছেন হুজুর?

কেন, মরিয়ম বেগমসাহেবা? এই বজরাতেই তো ছিল। কোথায় গেল? কোথায় লুকোল?

মাঝি বললে–কোথায় আবার লুকোবে হুজুর, এ তো খালি বজরা, এবজরাতে সারাফত আলি সাহেবের সওদা এসেছিল হুগলি থেকে, মাল খালাস করে আবার হুগলি ফিরে যাচ্ছি

সেবারে খুব বোকা বানিয়েছিল বেগমসাহেবা। ঝুটমুট হয়রানি আর ঝামেলা পোয়াতে হয়েছিল বশির মিঞাকে। কিন্তু কোথায় যে বেগমসাহেবা গিয়েছিল, তারও ঠিকানা পাওয়া যায়নি! না ছিল পালকিতে, না ছিল বজরাতে।

মনসুর আলি মেহের সাহেব খুব ধমক দিয়েছিল–তা হলে যাবে কোথায়? পালকিতে থাকবে না, বজরাতেও না, তা হলে কোথায় যাবে? আসমানে উড়ে পালিয়ে গেল বলতে চাস?

আর শুধু একবারই নয়। আগেও অনেকবার এমনই হয়েছে। সেই সফিউল্লা সাহেবের খুন হওয়ার পর থেকেই রেগে আছে মেহেদি নেসার সাহেব। মওকা খুঁজছিল শুধু। একবার যদি ধরে ফেলতে পারা যায় তো আর রক্ষে থাকবে না।

তারপর থেকেই বশির মিঞা আতিপাতি করে খুঁজছিল বেগমসাহেবাকে। হঠাৎ কানে এল মরিয়ম বেগমসাহেবা ধরা পড়েছে কলকাতায়। ওয়াটস্ সাহেব আর উমিচাঁদ সাহেব বেগমসাহেবাকে ধরে ক্লাইভ সাহেবের জিম্মায় পেরিন সাহেবের বাগানে রেখে দিয়েছে। খবরটা বশির মিঞার কানে আসতে একটু দেরি হয়েছিল। কবে গেল, কখন গেল, কিছুই টের পাওয়া যায়নি। সঙ্গে নাকি আবার একটা বাঁদিও আছে। বাঁদি কোত্থেকে এল কে জানে! চেহেল্‌-সুতুনের খোজারা পর্যন্ত কেউ জানল না, কেমন করে গেল সেখানে! অথচ গেল কেন? কী মতলব আছে তার?

মনসুর আলি সাহেব বলেছিল–নিশ্চয়ই আমাদের সব খবর ফাঁস করে দেবে

কোন খবর?

মেহেদি নেসারের মতো লোকও ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এই মিরজাফর-উমিচাঁদ-জগৎশেঠজি সকলের সব খবর জানিয়ে দেবে নাকি? সে-সব খবর জানবে কী করে মরিয়ম বেগম?

আজ্ঞে, মিরজাফর সাহেবের দলিলটা যখন জগৎশেঠজির বাড়িতে পড়া হচ্ছিল, তখন যে মরিয়ম বেগমসাহেবা পাশের ঘর থেকে সব শুনতে পেয়েছে।

তা নবাবকে না জানিয়ে ক্লাইভসাহেবকে জানাতে যাবে কেন?

মনসুর আলি সাহেব বলেছিল–নবাবকে জানাবার সে ফুরসত পায়নি জনাব। আমার চর বশির মিঞা যে রাস্তা আগলে দাঁড়িয়ে ছিল। তাই মতিঝিলের ভেতরে না গিয়ে বেগমসাহেবা একেবারে সোজা কলকাতায় চলে গিয়েছে। ক্লাইভসাহেব যদি জানতে পারে নবাবের কানে সব পৌঁছেছে, তা হলে আর লড়াই করতে আসবে না

ব্যাপারটা তখন খুব ভাবিয়ে তুলেছিল মেহেদি নেসারকে। কিন্তু তারপরেই খবর এল ক্লাইভ সাহেব ফৌজ নিয়ে মুর্শিদাবাদের দিকে আসছে। যেমন যেমন কথা ছিল তেমনই তেমনই কাজ হচ্ছে বোঝ গেল। কিন্তু তবু ভয়টা গেল না।

নবাবের দলবলের সঙ্গে যখন মেহেদি নেসার সাহেব মুর্শিদাবাদ থেকে বেরোল তখনও মনে ভয় ছিল, হয়তো সব গোলমাল হয়ে যাবে। হয়তো নবাব মরিয়ম বেগমসাহেবার খবরটা জানতে পারবে।

মেহেদি নেসার জিজ্ঞেস করেছিল মির্জাকে–এবার তয়ফাওয়ালিরা সঙ্গে যাবে না?

লড়াইতে যাবার সময় নবাবের দলের সঙ্গে বেগমরা যায়, তয়ফাওয়ালিরাও যায়। পূর্ণিয়ায় শওকত জঙ-এর সঙ্গে লড়াই করতে যাবার সময় তারা ছিল।

মির্জা বলেছিল-না–

মেহেদি নেসার সাহেব আবার জিজ্ঞেস করেছিল–তা বেগমসাহেবাদের কাউকে সঙ্গে নিয়ে চললেন না কেন আলি জাঁহা?

মির্জার মুখখানা খুব গম্ভীর ছিল। বললে–না, কাউকেই সঙ্গে নেব না এবার ইয়ার। আর কোন বেগমকেই বা সঙ্গে নেব। কাউকেই যে সঙ্গে নিতে ভাল লাগছে না–

কিন্তু বেগমসাহেবারা সঙ্গে থাকলে মেজাজটা ভাল থাকত আলি জাঁহা।

কেউ তো আমাকে ভালবাসে না মেহেদি নেসার! সবাইকে যাচাই করে দেখেছি, তারা কেবল আমার খোশামোদ করে, তারা কেবল আমার তারিফ চায়, আমার বাহবা চায়। আমাকে কিন্তু তারা কিছুই দিতে চায় না। আমাকে দেবার মতো তাদের কিছুই নেই

মেহেদি নেসার বলেছিল–কিন্তু মরিয়ম বেগমসাহেবা?

তাকে আমি কিছু বলতে চাই না ইয়ার, সে বড় ভাল মেয়ে। তাকে তুমি জোর করে তার স্বামীর কাছ থেকে নিয়ে এসেছ। সে ওদের মতো নয়।

কিন্তু সে তো আলি জাঁহাকে ভালবাসে!

মির্জা বলেছিল–সে ভালবাসলেও আমি তো তার ভালবাসা নিতে পারি না ইয়ার। সে আমাকে রামপ্রসাদের গান শুনিয়েছে, সে আমাকে কোরান পড়তে শিখিয়েছে। তার জন্যে আমি আজ ঘুমাতে পারছি–তা জানো? তাকে আমি কেমন করে কষ্ট দিই!

কষ্ট?

কষ্ট নয়? যুদ্ধে যাওয়া কি সুখ? তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি ইয়ার। আমার ঘুম আসত না বলে সেও আমার সঙ্গে মাসের পর মাস রাত জেগেছে। আমার কীসে ভাল হবে, দিনরাত সেই কথাই কেবল ভেবেছে

আর কোনও বেগমরা তা ভাবে না ভেবেছেন?

মির্জা মহম্মদ কথাটা শুনে ম্লান হাসি হেসেছিল শুধু। বলেছিল আমার নিজের মা-ই কি আমার ভালর কথা কখনও ভেবেছে?

তারপর হঠাৎ থেমে গিয়ে বলেছিল–থাক গে ওসব কথা ইয়ার, ওসব কথা ভাবলে এখন চলবে না আমার। আমাকে এখন অন্য কথা ভাবতে হবে …আচ্ছা তোমার কী মনে হয় ইয়ার, মিরজাফরসাহেব আমার কোনও ক্ষতি করবে না, তুমি কী বলে?

কেন, ওরকম কথা বলছেন কেন আলি জাঁহা?

অনেক রকম কথা কানে আসে কিনা…

কী কথা?

অনেকে বলছে মিরজাফরসাহেব নাকি ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, আমাকে তাড়িয়ে দিয়ে নাকি নিজে নবাব হবার চেষ্টা করছে…।

কী বলছেন আলি জাঁহা? মিরজাফরসাহেব কখনও এমন কাজ করতে পারে? মিরজাফরসাহেবকে আপনি চেনেন না?

কিন্তু জগৎশেঠজি কেন আমার সঙ্গে ওভাবে কথা বলে আজকাল? আমি কি কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি? অবশ্য বলতে পারো আমি যখন হুকুম দিয়েছিলাম যে মিরজাফরসাহেব দরবারে এলে খাজা হাদিকে সেলাম করতে হবে, এতে বোধহয় অপমান মনে করেছে–

মেহেদি নেসার বলেছিল–না না, তাতে কী! আপনাকে নবাবি করতে হলে সকলকে খুশি করা তো চলে না!

সত্যি ইয়ার, তুমি আমার কথাটা ঠিক বুঝেছ। ক’টা লোককে আমি খুশি করতে পারব? আগে অবশ্য ভেবেছিলাম, নবাব হলে আমার যত জানাশোনা বন্ধুবান্ধব তাদের সকলকে বড় বড় চাকরিতে বসিয়ে দেব। কিন্তু তা কি পেরেছি? তুমিই বলো না, পেরেছি? এই যে তুমি, তুমি আমাকে এত ভালবাসো, তোমারও মাইনে তো আমি বাড়িয়ে দিতে পারিনি

মেহেদি নেসার বললে–আমার কথা ছেড়ে দিন আলি জাঁহা, আমি আপনার মুহব্বত পেয়েছি তাই-ই যথেষ্ট, আমি টাকা চাই না

সে তুমি ভাল লোক বলে তাই বলছ। কিন্তু আমার তো ইচ্ছে করে তোমাদের খুশি করতে কিন্তু কোথায় পাব টাকা? নবাব আলিবর্দি খাঁ কি একটা টাকা রেখে গেছে? বর্গিদের সঙ্গে লড়াই করতে করতে সব টাকা ফুরিয়ে গিয়েছিল তার। আমি তখন বুঝিনি, তাই তার সঙ্গে কত ঝগড়া করেছি। কিন্তু নিজে নবাব হয়ে এখন সব বুঝতে পারছি। এখন বুঝতে পারছি নবাবের নিন্দে করা সোজা, নবাবের মসনদ কেড়ে নেওয়াও সোজা, কিন্তু নবাব যে হয়, সে-ই বুঝতে পারে নবাবি চালানো কত শক্ত!

তারপর একটু থেমে মির্জা মহম্মদ বলেছিল–আমি বলছি না যে আমার দোষ-ত্রুটি কিছু নেই। বলছি না যে আমি একেবারে নিষ্পাপ, কিন্তু নবাব হবার পর তো আমি কারও কোনও ক্ষতি করিনি! যা কিছু করেছি সব তো এই মসনদের জন্যেই! শওকত জঙকে খুন করেছি, কিন্তু নিজামত চালাতে গেলে সে তো করতেই হবে। ঘসেটি বেগমকে বন্দি করেছি, কিন্তু সেটুকুও যদি না করি তো এ-মসনদ থাকবে? যারা আমার ক্ষতি করতে চাইবে তাদের আমি শায়েস্তা করব না?

নিশ্চয় আলি জাঁহা, নিশ্চয় শায়েস্তা করবেন।

যাক গে, এত কথা বলবার সময় নেই এখন, ফিরিঙ্গিদের শায়েস্তা করে ফিরে এসে তখন এর সব ফয়সালা করব ইয়ার। আমি নানিবেগমকেও বলে রেখেছি, ফিরিঙ্গিদের আগে জব্দ করতে দাও, তখন আমি তোমাদের সকলকে ডেকে যার যা বলবার আছে সব শুনব! ঘসেটি বেগম গেছে, শওকত জঙ গেছে, এবার ফিরিঙ্গিদের খতম করে নিজের ঘরের লড়াই মেটাব। শুধু ভয় হচ্ছে মিরজাফরসাহেবকে নিয়ে

না আলি জাঁহা, মিরজাফরসাহেবকে আপনি মিছিমিছি ভয় করছেন! উনি তো আপনার সামনে কোরান ছুঁয়ে কথা দিয়েছেন!

মির্জা মহম্মদ বলেছিল–তা জানি ইয়ার, কিন্তু কোরান বড় না টাকা বড়?

রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে হাতির হাওদার মধ্যে বসে এইসব কথা হয়েছিল। পেছনে সামনে নবাবের ফৌজ। সার বেঁধে চলেছে সবাই! এক-একটা গ্রাম পার হয়েই ফাঁকা মাঠ। কয়েক ক্রোশ মাঠ পেরিয়ে আবার হয়তো একটা গ্রাম পড়ে। মেহেদি নেসারের মনে আছে, কথাগুলো বলতে বলতে মির্জা মহম্মদের চোখ দুটো এক-একবার বুজে আসছিল। এই এতগুলো সেপাই, এই হাজার হাজার গ্রাম, এই সারা বাংলা বিহার আর উড়িষ্যার নবাবের বন্ধু মেহেদি নেসার সাহেব। মেহেদি নেসারেরও ক্ষমতার শেষ নেই। তবু কেবল মনে হয়েছিল, আজ বিপদে পড়েই মির্জা নরম সুরে কথা বলছে। আবার যখন ফিরিঙ্গিদের লড়াই ফতে করে ফিরবে তখন এই মির্জাই আবার সকলকে একধার থেকে অপমান করবে। এই নবাবদের চিনতে বাকি নেই মেহেদি নেসারের।

মেহেদি নেসার বললে–আপনি মিছিমিছি সন্দেহ করছেন আলি জাঁহা, কোরানের কাছে কি টাকা বড় হতে পারে কখনও?

আরে ইয়ার, পারে। মহারাজ নন্দকুমার, মিরজাফর আলি, রাজা দুর্লভরাম, জগৎশেঠজি–এদের সকলের কাছে আল্লার চেয়ে টাকা বড়। শুধু উমিচাঁদ লোকটা ভাল। ও গুরুনানককে বড় ভক্তি করে

উমিচাঁদসাহেব ভাল?

হ্যাঁ, তোমরা যতই ওর নামে নিন্দে করো ইয়ার, আমি বলি সাচ্চা লোক।

কী করে বুঝলেন আলি জাঁহা?

কেন? উমিচাঁদ কি খারাপ লোক? তোমার কী মনে হয়?

মেহেদি নেসার বললে–আমি আপনার সঙ্গে একমত আলি জাঁহা। যদি খাঁটি লোক কেউ থাকে তো সে উমিচাঁদসাহেব।

মির্জা বলতে লাগল–তুমি ঠিক ধরেছ ইয়ার। মরিয়ম বেগমসাহেবা উমিচাঁদসাহেবের নামে আমাকে অনেকবার বলেছে, আমি বিশ্বাস করিনি। আমি ভাবছি মুর্শিদাবাদে ফিরে এসে দিল্লির বাদশার দফতর থেকে উমিচাঁদের নামে সনদ এনে দেব

হ্যাঁ আলি জাঁহা, খুব ভাল কাজ হবে–

আর দেখো, আমি মিরজাফরকে তাড়িয়ে দেব, একেবারে বাংলা মুলুক থেকে বার করে দেব। ওটা আসল হারামি। আর কী করব জানো? আমি সব ভেবে ঠিক করে রেখে দিয়েছি। মরিয়ম বেগমসাহেবাকেও আমি বলেছি। মুর্শিদাবাদ ছেড়ে আমি কলকাতায় গিয়ে রাজধানী বসাব, এখানে ফিরিঙ্গিদের কেল্লাটা ঠিকঠাক মেরামত করে নিয়ে আমার হারেম তৈরি করব

আহা, কত স্বপ্ন ছিল মির্জার! নিজের মনেই সব ভবিষ্যতের নকশা এঁকে নিয়েছিল। আগে তাড়াবে মিরজাফর আলিকে, তারপর রাজা দুর্লভরামকে, তারপর ইয়ার লুৎফ খাঁ-কে। আর জগৎশেঠ? জগৎশেঠজির সম্বন্ধেও একটা বন্দোবস্ত করে রেখেছিল মির্জা।

বলেছিল–তুমি যেন কাউকে বোলো না ইয়ার

না না, আমি কেন বলতে যাব আলি জাঁহা? আমি আপনার নিমকহারামি কখনও করতে পারি?

সে আমি জানি। তবু সাবধান করে দিচ্ছি। সাবধানের মার নেই। জগৎশেঠজির টাকা আমি ফৌজ দিয়ে লুঠ করাব। যদি দিল্লির বাদশা কিছু বলে তো আমি বাদশাকেও সে টাকার ভাগ দেব, তখন বাদশার মুখ বন্ধ হয়ে যাবে কিন্তু একথা যেন কেউ টের না পায়, খুৰ হুঁশিয়ার

ফরাসিদের কামানের গোলাটা যখন গিয়ে ফিরিঙ্গিদের ছাউনির ওপর পড়ল, তখন নবাবের ওই কথাগুলো মনে পড়তে লাগল।

বশির মিঞার কথায় যেন হঠাৎ চমক ভাঙল। বশির বললে–চলুন জনাব, একটু জলদি করুন, নইলে মরিয়ম বেগমসাহেবার বজরা ছেড়ে দেবে

মেহেদি নেসার সাহেব রেগে গেল।

বললে–দাঁড়া বেল্লিক বেটা, লড়াইটা দেখি ঠিক-ঠিক হচ্ছে কি না–

সত্যিই সব মতলবই তো আগে থেকে ঠিক হয়েই ছিল। তারপর নবাবে কামানের গোলাগুলো যখন আমগাছের ডালে এসে পড়ল তখন মেহেদি নেসার সাহেব আবার তুড়ি দিয়ে উঠল। শাবাশ মিঞাসায়েব, শাবাশ!

কোথায় কোথাকার কোন মিঞাসাহেব, কোন মিঞাসায়েবকে যে শাবাশ দিয়ে উঠল মেহেদি নেসার সাহেব তা বুঝতে পারলে না বশির মিঞা। ফিরিঙ্গিদের দিকটা আমগাছের আড়াল পড়েছে। আর নবাবের ফৌজের দিকটা একটু ফাঁকা ফাঁকা।

বশির মিঞার ভয় লেগে গেল। হঠাৎ জিজ্ঞেস করে ফেললে ফিরিঙ্গি সাহেবরা জিততে পারবে জনাব?

তুই থাম বেটা বেল্লিক, তুই লড়াইয়ের কী জানিস?

বহুদিন বোধহয় জায়গাটায় মানুষজন পা দেয়নি। বিরাট বিরাট আম গাছ। সেপাইদের কামানের পেতলগুলো কচি রোদ লেগে ঝকঝক করতে লাগল। মেহেদি নেসার চলে যেতে যেতেও পেছন ফিরে ফিরে দেখতে লাগল। নবাব তখনও ছাউনির ভেতর ঘুমোচ্ছে। তুমি ঘুমোও নবাব মির্জা মহম্মদ সিরাজ-উ-দ্দৌলা আলমগির। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই তুমি স্বপ্ন দেখো ভবিষ্যতের। জেগে উঠে তুমি মিরজাফর আলি সাহেবকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা থেকে তাড়িয়ে দিয়ো। রাজা দুর্লভরাম, ইয়ার লুফৎ খাঁ সাহেব, তাদেরও কোতল কোরো। তুমি মহতাপ জগৎশেঠজির টাকাও ফৌজ দিয়ে লুঠ করে দিল্লির বাদশার সঙ্গে সেটাকা ভাগাভাগি করে নিয়ো। আজ যদি তোমার ঘুম ভাঙে তো জেগে উঠে যা তোমার খুশি তাই কোরো আলি জাঁহা। আর তারপর যখন মিরজাফর আলি সাহেব নবাব হবে, তখন আমাকে আর ইয়ার বলে ডাকতেও সাহস হবে না তোমার। তখন আমি মিরজাফর সাহেবের সনদ পেয়ে দেওয়ান-খালসাশরিফা মহম্মদ মেহেদি নেসার খাঁ সাহেব হয়ে গেছি। আমার সঙ্গে মোলাকাত করতে হলে তোমাকে তিনবার কুর্নিশ ঠুকতে হবে।

কী বললি?

বশির মিঞা বললে–কই, আমি তো কিছু বলিনি মেহেরবান

তুই কিছু বলিসনি? তা হলে কে যেন কী বললে–মনে হল!

কিছুই কেউ বলেনি। কিন্তু তবু মেহেদি নেসারের সন্দেহ হল কেউ যেন কিছু বললে। হাজার-হাজার সেপাইয়ের প্রাণ নিয়ে টানাটানি। পঁয়ত্রিশ হাজার পায়দল-ফৌজ একদিকে তলোয়ার উচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পনেরো হাজার ঘোড়সওয়ার আর চল্লিশটা কামানের ধোঁয়ার ভিড়ে এমন সকলেরই হয়। নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলারও হয়, মিরজাফর আলি সাহেবেরও হয়। যারা এই অদৃশ্য ইঙ্গিত উপেক্ষা করে, তারাই শুধু অবাক হয়ে যায়, তারাই শুধু ভাবে–কে যেন ডাকলে? কে যেন কী বললে–মনে হল?

তখনও পূর্বদিকের সূর্যটা লাল হয়ে রয়েছে। মেহেদি নেসার সাহেব আবার আকাশের দিকে চাইলে। তারপর বললে–চল, বেশি সময় নেই, যাব আর আসব ।

বশির মিঞা আগে আগে চলছিল। মেহেদি নেসারও চলতে লাগল। বেশি দূর নয়। নবাবের ছাউনিটা পেছনে ফেলে রেখে একটু এগিয়ে গেলেই দাদপুর। দাদপুরেই নৌকো তৈরি রেখেছিল বশির মিঞা। সেই নৌকোতে উঠে বশির মিঞা জোর তাগিদ দিলে–একটু জলদি বেয়ে চলো ভাই, বড় জরুরি কাম–

মেহেদি নেসারের চোখে তখনও আকাশের লাল সূর্যটা ভাসছে।

দূর থেকে বশির মিঞা আঙুল দিয়ে দেখালে ওই, ওই যে—

ওরই ভেতরে মরিয়ম বেগমসাহেবা আছে?

আজ্ঞে হ্যাঁ, জনাব। আমি তো পেরিন সাহেবের বাগানে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়েই শুনলাম, মরিয়ম বেগমসাহেবাকে ওরা ধরে রেখে দিয়েছিল ঘরে তালাচাবি বন্ধ করে। কিন্তু সেই তালা ভেঙে বেগমসাহেবা নাকি মাঝরাত্তিরে পালিয়ে গেছে।

তারপর?

তারপর ছুঁড়তে ছুঁড়তে কঁহা কঁহা গেলাম। ত্রিবেণীর ঘাটে দেখলাম ওই বজরাটা রয়েছে। তারপর ভাল করে নজর করে দেখি, আমাদের কান্তবাবু বাইরে বসে আছে। অন্ধকারে আমাকে ঠাহর করে দেখতে পায়নি। আমি…

কান্তবাবু কে?

জনাব, যাকে আমি নিজামতের দফতরে নোকরি করে দিয়েছিলাম। সেই হারামির বাচ্চা! সে তো এখন মরিয়ম বেগমসাহেবার খপ্পরে। মরিয়ম বেগমসাহেবা তাকে নবাবের জলুসখানায় কাম করে দিয়েছে। এখন তো আর চরের কাম করে না।

তা গরহাজির বলে তার নোকরি খতম হয় না কেন?

জনাব, মরিয়ম বেগমসাহেবার পেয়ারের আদমির নোকরি কে খাবে? কার এত কলিজার পাটা?

এই কথা?

মেহেদি নেসার যেন কান্তর চরম সর্বনাশ করবার আগে একবার দম নিয়ে নিলে। তারপর বললে–নবাব লড়াই থেকে ফিরে গেলে ওকে বরখাস্ত করে দিতে হবে।

জনাব, মরিয়ম বেগমসাহেবার লোক বলে এতদিন ওকে কিছু বলতে পারিনি।

এবার আর ওকে ছাড়ব না। কই, বাইরে কারা বসে আছে যেন মালুম হচ্ছে?

আজ্ঞে, ও-বজরার মাঝিমাল্লা। কান্তবাবু এখন ভেতরে মরিয়ম বেগমসাহেবার সঙ্গে মেহফিল করছে।

বলতে বলতে নৌকোটা একেবারে বজরার গায়ে এসে ভিড়ল। ভিড়তেই বশির মিঞা লাফিয়ে বজরার ওপর উঠেছে কান্ত, এই কান্ত

মেহেদি নেসার সাহেবও একেবারে পেছন পেছন এসেছে।

বশির মিঞা বললে–একটু হুশিয়ার থাকবেন জনাব, বেগমসাহেবার পেট কাপড়ে ছোরা থাকে—

দুত্তোর ছোরার নিকুচি করেছে বলে মেহেদি নেসার আরও এগিয়ে গেছে।

মাঝিমাল্লারা প্রথমে হাঁ হাঁ করে উঠেছিল। তারপর নবাবি-নিজামতের কোনও আমির-ওমরাহ ভেবে পেছিয়ে এল।

বশির ভেতরে উঁকি মেরে দেখলে কেউ নেই কোথাও। মাঝিদের জিজ্ঞেস করলে–বেগমসাহেবা কোথায় লুকোল? আর সেই কান্তবাবু তোদের কোথায় গেল?

বৃন্দাবন অবাক।

আজ্ঞে, বেগমসাহেবা তো কেউ নেই কর্তা। কান্তবাবু বলেও কেউ নেই। এ তো ছোটমশাইয়ের বজরা।

ছোটমশাই? ছোটমশাই কে? কোথাকার ছোটমশাই?

আজ্ঞে কর্তা, হাতিয়াগড়ের জমিদার ছোটমশাই–কেমন যেন শুকিয়ে গেল বশির মিঞার মুখটা। মেহেদি নেসার সাহেবকে এত দূর টেনে এনে এমন বোকা বনতে হবে বুঝতে পারেনি।

তা ছোটমশাই কোথায় গেল?

আজ্ঞে, ডাঙায় নেমেছেন। আমাদের বজরা বাঁধতে বলে নিজে ডাঙায় নেমে চলে গেছেন। আসতে দেরি হবে তার।

বশির মিঞা কী করবে বুঝতে পারলে না। তারপর বললে–তোমরা কোথা থেকে আসছ?

বৃন্দাবন বললে–আজ্ঞে, হাতিয়াগড় থেকে বেরিয়ে মুর্শিদাবাদ গিয়েছিলেন ছোটমশাই, সেখান থেকে এখানে এইচি

মেহেদি নেসার সাহেব এতক্ষণে কথা বললে–জিজ্ঞেস করলে–ছোটমশাই কে?

বশির মিঞা বললে–জনাব, ছোটমশাই হল হাতিয়াগড়ের জমিদার সাহেব। ডিহিদার রেজা। আলির এলাকায়। এই ছোটমশাইয়ের রানিসাহেবাই হল আমাদের মরিয়ম বেগমসাহেবা!

কথাটা পরিষ্কার হয়ে গেল মেহেদি নেসারের কাছে। বললে–আচ্ছা, আমরা এখানে বসি, তোমাদের ছোটমশাই আসুক। ছোটমশাই বোধহয় বিবির খবর পেয়েই এখানে এসেছে। ওকে পাকড়ালেই মরিয়ম বেগমকে পাকড়ানো যাবে।

তাই বসা ভাল জনাব। যাবে কোথায় ছোটমশাই? বজরাতে তো আসতেই হবে!

মেহেদি নেসার বললে–তা তুই তো এখানেই দেখেছিলি মরিয়ম বেগমসাহেবাকে?

আজ্ঞে হ্যাঁ জনাব। আল্লার কিরে বলছি আমি, এই বজরায় কান্তবাবুকে দেখেছি আর মরিয়ম বেগমসাহেবাকে দেখেছি আমি ঝুট বলে জনাবকে মিছিমিছি তকলিফ দেব কেন?

মেহেদি নেসার বললে–ঠিক আছে, তুই ঝুট বলেছিস কি সাচ্চা বলেছিস, এখনই পরখ হয়ে যাবে, ওই ছোটমশাই হাজির হলেই পরখ হয়ে যাবে

বলে ছোটমশাইয়ের ঘরে ঢুকে তার বিছানায় বসে পড়ল। জানালার ফাঁক দিয়ে দেখলে সূর্যটা এবার যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মেহেদি নেসার সাহেবের একবার মনে পড়ল লক্কাবাগের কথা। গুলি মারো লক্কাবাগের বুকে। মিছিমিছি ভেবে ফয়দা নেই। মিরজাফর সাহেব নিজেই আছে। ভেবে কী হবে? লক্কাবাগের পরের কথা ভাবাই ভাল। দেওয়ান-খালসা-শরিফা হয়ে তখন মরিয়ম বেগমসাহেবার ইজ্জত কেমন করে নেবে, সেই কথা ভাবাই ভাল।

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সেদিন সন্ধেবেলাই বিষ্ণুমঙ্গলের আসর বন্ধ করে দিয়েছিলেন। খবরটা কানে গিয়েছিল সকলেরই। তখন থেকেই মনটা বিগড়ে গিয়েছিল। তবু গোপালবাবু ছাড়েনি। একটার পর একটা কেচ্ছা শুনিয়েছে।

কৃষ্ণচন্দ্র বলেছিলেন–আর থাক গোপালবাবু, আজকে আর ভাল লাগছে না–এবার ঘুমোতে যাই–

গোপালবাবু বলেছিল–মহারাজের না-হয় দুটো পাখা, কিন্তু আমাদের যে একটা পাখা, আমাদের কি এত সকালে ঘুমোতে যাওয়া পোষায়?

পাখা মানে?

আজ্ঞে, পাখা মানে পক্ষ!

এতক্ষণে হাসি বেরোল মহারাজের মুখ দিয়ে। বললেন দ্বিতীয় পক্ষের মজাটাই বুঝেছ গোপালবাবু, জ্বালাটা তো আর বুঝলে না বুঝেছে মুর্শিদাবাদের নবাব, তার আবার হাজারটা পাখা। আর বুঝেছে হাতিয়াগড়ের ছোটমশাই। দুটো পাখার মধ্যে তার আবার একটা পাখা অকেজো

কথা হতে হতে হঠাৎ কালীকৃষ্ণ সিংহ মশাই ঘরে ঢুকলেন।

কী খবর সিংহীমশাই, লক্কাবাগের খবর কিছু পেলে?

আজ্ঞে না, অন্য একটা খবর আছে—

কী খবর?

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। দেওয়ানজির মুখ দেখেই বুঝেছিলেন, একটা কিছু গুরুতর খবর আছে। তাড়াতাড়ি বাইরে এসে দাঁড়ালেন।

কালীকৃষ্ণ সিংহ মশাই মুখ নিচু করে বললে–হাতিয়াগড়ের দ্বিতীয় পক্ষের সহধর্মিণী এসেছেন–সেকী?

একেবারে চমকে উঠেছেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। বললেন–কোথায়? কোথায় এসেছেন? কার সঙ্গে এসেছেন?

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের অনেক দিন থেকে সন্দেহ হচ্ছিল। মুর্শিদাবাদ থেকে যেসব খবর পাচ্ছিলেন তিনি, তাতে তারও কেমন ভয় লেগে গিয়েছিল। নবাবের সঙ্গে ফিরিঙ্গিদের ঝগড়া দিন দিন যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে একটা বিপর্যয় ঘটবে তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু তা যে এত তাড়াতাড়ি ঘটবে তা বুঝতে পারেননি। নবাবের ফৌজের মধ্যেও তার লোক ছিল। তিনি নিজের জমিদারি থেকে তাকে মাইনে দিতেন। সেই শশীর কাছ থেকেও খবর আসত ফৌজের লোকেরা টাকা না পেলে লড়াইতে যাবে না বলে দিয়েছে। এক-একটা খবর আসত আর মহারাজ দেওয়ানমশাইকে ডাকতেন। যখন সবাই আসর ছেড়ে চলে যেত তখন চুপি চুপি দু’জনে পরামর্শ করতেন।

এমন করে মরিয়ম বেগমের চেহেল-সূতুন ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার খবরটাও কানে এসেছিল।

একজন সামান্য মেয়ে সবাইকে কী রকম নাস্তানাবুদ করে দিচ্ছে তা ভেবেও অবাক হয়ে যেতেন।

একদিন ছোটমশাইকে বলেছিলেন সেকথা। বলেছিলেন–আপনার সহধর্মিণীর বাহাদুরি আছে ছোটমশাই। কোন বংশের মেয়ে তিনি?

ছোটমশাই বলেছিল–বংশ খুব বড়, কিন্তু বংশ দেখে তো বিয়ে হয়নি আমার মহারাজ। বড়গিন্নি নিজে পছন্দ করে আমার সঙ্গে সম্বন্ধ করেছিলেন। বড়গিন্নি রূপ দেখে এঁকে ঘরে এনেছিলেন। তবে বুদ্ধিমতী খুব

বুদ্ধিমতী সে তো বুঝতেই পারছি–তা না হলে বেগম তো আরও আছে নবাবের, কিন্তু এমন করে আগে কারও হাতের মুঠোর মধ্যে তো যায়নি নবাব

ছোটমশাই বলেছিল–কী জানি মহারাজ, আমি কিন্তু কিছু বুঝতে পারছি না। আমার সহধর্মিণী নবাবকে কেমন করে হাতের মুঠোর মধ্যে আনবে? বড় ধীরস্থির স্বভাব যে!

মহারাজ কথাটা শুনে হেসেছিলেন।

বলেছিলেন স্ত্রী-চরিত্র বড় রহস্যময় ছোটমশাই। আমারও তো দুটি স্ত্রী। আমি এদিকে এত বুঝি কিন্তু স্ত্রীদের আজও বুঝতে পারলাম না। অথচ এত বছর একসঙ্গে সংসার করছি

ছোটমশাই বলেছিল তা হবে, আমি অতশত নিয়ে মাথা ঘামাইনি মহারাজ। যতদিন বাবামশাই ছিলেন ততদিন তো কিছু নিয়েই মাথা ঘামাইনি। এখন তবু খাজনা-আবওয়াব নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়, নইলে বাকি খাজনার দায়ে কোনদিন জমিদারি নিয়ে টান পড়বে। সাংসারিক জীবনে এতদিন আমার কোনও অশান্তিই ছিল না। তবে একটা জিনিস নজরে পড়েছে, আমার গৃহিণীর রূপ ছিল অপূর্ব

মহারাজ বলেছিলেন–তা স্ত্রীর রূপ থাকবে তা তো স্বামীর অপরাধ নয়—

কিন্তু ওই রূপই যে কাল হল মহারাজ!

মহারাজ বলেছিলেন–নিয়ম যে তাই! অর্থ থাকলে চোরের উপদ্রব হবেই। আপনার রূপসি স্ত্রী হবে, আর অন্যলোকে নজর দেবে না, তা কি কখনও সম্ভব ছোটমশাই? নজর যদি কেউ না দেয় তো বুঝতে হবে আপনার স্ত্রী রূপসিই নন। সেটাই কি আপনাদের মনঃপূত হবে?

এসব আলোচনা অনেকদিন আগেকার। তারপর হঠাৎ একদিন মুর্শিদাবাদ থেকে খবর এল মরিয়ম বেগমকে ক্লাইভ সাহেব আটক করেছে। আগে একদিন এই মরিয়ম বেগম ক্লাইভ সাহেবের দফতরে ঢুকে জরুরি চিঠি চুরি করেছিল, এবার তার শাস্তি দেবে হয়তো।

খবরটা পাওয়ার পর ছোটমশাইকে খবরটা দেবেন ভেবেছিলেন। সরখেল মশাইকে একবার পাঠিয়েও ছিলেন হাতিয়াগড়ে। কিন্তু সরখেল একদিন ফিরে এল খালি হাতে।

দেওয়ানমশাই জিজ্ঞেস করেছিল চিঠিটা কী করলি রে সরখেল?

সরখেল বলেছিল–চিঠি ফেরত নিয়ে এসেছি। ছোটমশাই তো সেই হাতিয়াগড়ে, চিঠি কার হাতে দেব?

তা ঠিক করেছিস।

বলে চিঠিটা ফেরত নিয়ে নিয়েছিল দেওয়ানমশাই। নিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেছিল। এসব চিঠি রেখে দেওয়াও নিরাপদ নয়।

তারপর আর কোনও খবরাখবর নেই। মরিয়ম বেগম কোথায় রইল, কী হল তার, তারও কিছু হদিস নেই তখন। হঠাৎ একদিন খবর এল নবাব ফৌজ নিয়ে রওনা দিয়েছে মনকরার দিকে। তখন আর অন্য কোনও দিকে মন দেওয়ার মতো মনের অবস্থাও নেই। শুধু নবাবের যুদ্ধে যাওয়া তো নয়, সমস্ত বাংলাদেশটাই যুদ্ধে যাবে তার সঙ্গে। আর সমস্ত বাংলাদেশের প্রজারাই যে চেয়ে আছে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের দিকে। লড়াইটা সেবার বেধেছিল কলকাতাতে। সেখানে লড়াই বাধলে কারও কোনও ক্ষতি বৃদ্ধি নেই। কিন্তু কলকাতা ছাড়া আর সব জায়গাতেই তো মহারাজের অনুগৃহীত প্রজারা আছে। কেউ বা প্রজা, কেউ বা বৃত্তিভোগী পণ্ডিত। পাঠশালার খড়ের চালে যদি গুলি লেগে আগুন ধরে যায় তো মহারাজকেই তো তার গুণোগার দিতে হবে। নবদ্বীপেই যদি যুদ্ধ বাধে তো যা-কিছু লোকসান-ক্ষতি হবে তার খরচ দিতে হবে তো মহারাজকেই। নবাবও দেবে না, ফিরিঙ্গিরাও দেবে না।

আগের দিন খবর পেয়েছিলেন মহারাজ যে, নবাবের ফৌজ মনকরার দিকে গিয়ে মাঠের মধ্যে ছাউনি ফেলবে! মনে এমনিতেই একটা দুশ্চিন্তা ছিল। কিন্তু অনেক রাত্রে দেওয়ানমশাইয়ের কাছে মরিয়ম বেগমের খবরটা পেয়ে আর এক দুশ্চিন্তায় পড়লেন। নবাব যদি জানতে পারে যে, তার বেগমকে তিনি লুকিয়ে রেখেছেন নিজের বাড়িতে, তা হলে?

কিন্তু তখন কি আর অত ভাববার সময় আছে?

বললেন তাড়াতাড়ি আপনি নিজে পালকি নিয়ে ঘাটে যান, সঙ্গে অন্দরের দু’চার জন ঝিউড়িদের সঙ্গে নিয়ে যাবেন। কেউ যেন জানতে না পারে। জানলে মহা মুশকিল হবে

তাদের কোথায় তুলব?

কোথায় আবার তুলবেন? অন্দরমহলে।

না, তা বলছি না। মুসলমান তো, ওঁদের জন্যে আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে। বাবুর্চি খানসামা… বলতে গিয়েও সংকোচ করতে লাগল দেওয়ানমশাই। কিন্তু মহারাজ বললেন–তা করতে হয় করতে হবে। কিন্তু তা বলে তো ওঁদের ফিরিয়ে দিতে পারি না। আমার এখানে যখন এসেছেন তখন ওঁদের আশ্রয় দিতেই হবে। আর আমার এখানে যে ওঁরা আছেন তাও যেন নবাবের কি ফিরিঙ্গিদের কানে না ওঠে। আর কালকেই সরখেলকে পাঠাতে হবে হাতিয়াগড়ে। চিঠি লিখে ওর হাত দিয়ে পাঠাবেন। চিঠিতে কিছু লেখার দরকার নেই। শুধু লিখবেন তিনি যেমন অবস্থায়ই থাকুন যেন চিঠি পাওয়ামাত্র রওনা দেন–

দেওয়ানমশাই চলে গেল।

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র আর দাঁড়ালেন না। ভেতরের দিকে চলতে লাগলেন। আজ একটু সকাল সকালই আসর ছেড়ে উঠেছেন। অন্ধকার রাত। তবুবর্ষার রাতে অল্প রাতেই বেশি অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। সারা। জীবনই মহারাজ এই অন্ধকারের সঙ্গে সংগ্রাম করে আসছেন। ভেবেছিলেন সব দায়িত্বটা পরের ঘাড়ের ওপর দিয়েই যাক। প্রত্যক্ষভাবে যেন আর তাকে জড়িয়ে পড়তে না হয়। নবাবের ভালবাসাও যেমন বিপজ্জনক, নবাবের রাগও তাই। জগৎশেঠজি, উমিচাঁদ, মেহেদি নেসার সবাই তাকে তাদের দলে থাকতে বলেছিল। হাতিয়াগড়ের ছোটমশাইও বারবার অনুরোধ করেছিল। কিন্তু এবার? ফিরিঙ্গিদের হারিয়ে দিয়ে নবাব যখন আবার মুর্শিদাবাদে ফিরে গিয়ে শুনবে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র বেগমসাহেবাকে তার নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে, তখন কী ভাববে?

ছোট গৃহিণী সামনে এসে অবাক হয়ে গেছে।

একী, তুমি? তুমি এই সন্ধেবেলা অন্দরমহলে? এত তাড়াতাড়ি তোমাদের আসর ভাঙল আজ?

মহারাজ গম্ভীরভাবে বললেন–আজ ঘুম পেয়ে গেল।

সেকী? আমি যে পাশার ছক নিয়ে যাচ্ছি বড়দির কাছে, খেলতে ডাকছিল বড়দি।

মহারাজ বললেন–তা যাও-না। তুমি পাশা খেললে আমার ঘুমের ব্যাঘাত হবে না।

কী হল বলো তো? এমন তো হয় না! তোমার নিশ্চয় কিছু হয়েছে। তোমার হাত দেখে কেউ গুণে কিছু বলেছে নাকি? যাকে-তাকে এমন হাত দেখাও কেন? তোমার গণতকাররা যা বলে তা তো ফলে না–

মহারাজ বললেন–গণতকারের কথা ফলে না কে বললে? আমি যে কুলীনকন্যাকে বিয়ে করব একথা তো বিদ্যানিধিমশাই আগেই বলে দিয়েছিলেন

হাসি বেরোল গৃহিণীর মুখ দিয়ে। বললেন–কিন্তু কুলীনকন্যা যে কিশোরকুলীনকে বিয়ে করবে একথা তো আমার হাত দেখে কেউই আগে বলতে পারেনি

দেখো

মহারাজ যেন কেমন অন্যমনস্ক ছিলেন। বললেন–দেখো, মোগলের রাজত্বে বাস করি, জাত নিয়ে এত বড়াই ভাল নয়। হাতিয়াগড়ের ছোটরানির কথা শুনেছ তো?

গৃহিণী বললেন কিন্তু আমি হাতিয়াগড়ের রানি নই, নবদ্বীপের মহারানি, আমার সঙ্গে তুমি হাতিয়াগড়ের ছোটরানির তুলনা করলে?

তুলনা করিনি, কিন্তু ভবিতব্যের কথা কেউ কিছু বলতে পারে না। তাঁকে শেষপর্যন্ত মোগলের চেহেল্‌-সুতুনে গিয়ে গোরুর মাংস খেতে হয়েছে–তা তো জানো?

তাঁর কথা ছেড়ে দাও—

মহারাজ বললেন–তাঁর কথা ছেড়ে দিতে পারবনা। আর আমি ছাড়লেও তিনি ছাড়বেন না। তিনি এখানে এসেছেন, এই রাজবাড়িতে!

তার মানে? তুমি বলছ কী?

মহারাজ বললেন–হ্যাঁ, মরিয়ম বেগমসাহেবা এখন এই রাজবাড়িতেই এসে উঠছেন–

গৃহিণী বললেন–ওমা, তুমি সেই মোছলমান মাগিকে এখানে এনে তুলবে নাকি? তুমি কি জাত-জম্ম কিছু রাখবে না আমাদের? আমি যাচ্ছি বড়দিকে গিয়ে…

না না, শোনো শোনো

মহারাজ থামিয়ে দিলেন গৃহিণীকে। বললেন–কিছু বোলো না কাউকে, তোমাকে বলাই দেখছি ভুল হয়েছে, তোমরা মেয়েমানুষ, পেটে তোমাদের কিছু কথা থাকে না। বোঝে না কেন, এসব কথা কাউকে বলতে নেই। মরিয়ম বেগমসাহেবাও আসছেন, আর ওদিকে হাতিয়াগড়ের ছোটমশাইকেও আসতে চিঠি লিখছি–

তা ওই মোছলমান বউকে নিয়ে আবার ছোটমশাই ঘর করবে নাকি?

মহারাজ দেখলেন মহা বিপদ। বললেন–শোনো, কাছে এসো, আর যাই করো, এ নিয়ে বাড়াবাড়ি কোরো না। দিনকাল এখন ভাল নয়। যদি কেউ কথাটা নবাবের কানে তুলে দেয় তখন তোমার অবস্থাও খারাপ হবে। তখন তোমার নামও হয়তো নশিরন বেগম হয়ে যাবে।

ইঃ, তার আগে আমি বিষ খেয়ে মরব না?

মহারাজ বললেন–থাক, অত বড়াই কোরো না। ছাতার আড়ালে আছ তাই বুঝতে পারছ না কত কায়দা করে রাজত্ব চালাতে হচ্ছে আমাকে। সত্যিই দিনকাল খুব খারাপ। এখন যে-কোনও দিন। যে-কোনও জমিদারের ওই হাতিয়াগড়ের অবস্থা হতে পারে–তুমি কাউকে বোলো না এসব কথা। তখন তোমারও বিপদ আমারও বিপদ

ওদিকে গঙ্গার ঘাটে বজরা থেকে তখন দুটো ঘোমটা দেওয়া মূর্তি অন্ধকারের আড়ালে চুপি চুপি নেমে এল। মহারাজের চারজন দাসী তৈরিই ছিল সেখানে পালকি নিয়ে। সোজা গিয়ে তারা পালকির মধ্যে উঠল।

পালকিটা চলতেই কালীকৃষ্ণ সিংহ মশাই এগিয়ে এলেন। বললেন–তা হলে আসি আমি।

কান্তও নমস্কার করলে। বললে–আসুন, দেখবেন দেওয়ানমশাই, যেন এখবর কেউ টের না পায়। ছোটমশাইকে ডেকে এনে যেন তাঁর হাতেই ওঁদের তুলে দেওয়া হয়–

তারপর আবার বজরায় এসে উঠল কান্ত। মাঝিরা তৈরিই ছিল। কান্ত বললে–চলো, বজরা ছেড়ে দাও–

বজরার নোঙর তুলতেই সেটা তরতর করে এগিয়ে চলল—

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress