বৃক্ষকাহিনী
গ্রামের নাম পলাশডাঙ্গা।গালভরা নাম হলে হবে কি!সেখানকার মানুষজনের দুর্দশা আর ভোগান্তি এমন জীবন্ত চালচিত্র নিরীক্ষণ করলে মাথায় হাত দিয়ে বসে ভাবতে বাধ্য হতে হবে,যে এমন ছিরিছাঁদহীন আধা জঙ্গল আধা গ্রামের এমন নাম নিয়ে এখানকার দিন আনি দিন খাই মানুষজন কি দুবেলা ধুয়ে জল খায়!এই গ্রামের প্রতিকূল জীবনযাত্রার রোজনামচায় অন্তর্ভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি,সেটি হল এখানকার রাস্তা।
পায়ে চলার রাস্তায় খানাখন্দ ভর্তি,তায় বর্ষা এলেই কয়েকমাস যা অবস্হা হয় মানুষজন ঘর থেকে বাইরে বেরোবার সময় হলেই তাদের রীতিমতো কান্না আসার মতো অবস্হা হয়।এতদিন ধরে পঞ্চায়েতের কাছে রীতিমতো ধর্ণা দিয়ে অবশেষে সবুরে মেওয়া ফলেছে।জঙ্গল সাফ করতে হবে।যথাসময়ে অনেক লোক ঠিক করা হল কুড়ুল নিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করার জন্য।কাজ শুরু হয়ে গেল নির্দিষ্ট দিনে।তার দুদিন বাদেই ঘটল সেই ঘটনা।একজন কুড়ুলধারী একটি বটগাছে সবেমাত্র কোপ বসাতে যাবে,এমন সময় তার ছয় সাত হাত দূরত্বের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটি বটগাছের একটি শাখা হঠাৎ অক্টোপাসের শুঁড়ের মতো আকৃতি ধারণ করে রাক্ষুসে গতিতে ওই কুড়ুলধারীর মাথা এমনভাবে পেঁচিয়ে ধরল যে তার শ্বাসরোধ হওয়ার উপক্রম হল।জিভ বেরিয়ে এল।প্রাণ একেবারে যায় যায় এইভাবে মিনিট পাঁচেক একেবারে জাপটে ধরে থাকার পর অবশেষে তার গলা ছেড়ে শাখাটি কেটে দেওয়া ইলাস্টিকের ফিতরের মতো দ্রুতগতিতে সুড়ুৎ করে নিজের জায়গায় ফিরে পূর্বের আকৃতি ও আকার ধারণ করে একেবারে নিরীহ পথবৃক্ষের রূপ ধারণ করল।ছাড়া পেয়ে কুড়ুলধারী মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়া পথিকের মতো মাথায় হাত দিয়ে,ঘাসের ওপর দুই ঠ্যাং মেলে শুয়ে ফ্যালফ্যাল করে আকাশের দিকে তাকিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।এমন সময় আরেকজন সাফাইকর্মী পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে এইভাবে আবিষ্কার করল।কিছু একটা বিপদ আঁচ করল সে।তার মুখে চোখে জলের ছিটা দিয়ে তার হুঁশ ফেরাল ধীরে ধীরে উঠে বসল সে।আস্তে আস্তে বাকি সাফাই কর্মীরা সবাই জড়ো হল সেখানে।আস্তে আস্তে জ্ঞান ফিরল ভুক্তভোগী সাফাইকর্মীর।চোখ মেলতে লাগল ধীরে ধীরে।এবার সবাই ওর মুখের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল।দেখল এক কুঁজো ভয় গিলে ওর চোখদুটো যেন রক্তজবার মত হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে কুঁকড়ে যাওয়া গলায় মিহি স্বর ফুটল।ওর মুখ থেকে যে অতিপ্রাকৃতিক ঘটনার বয়ান মিলল ,তাতে সকলেই ধরা নিল অতিরিক্ত মাদকসেবনে ওর মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। সকলে মিলে তাকে যারপরনাই তিরস্কার করে টরে অতঃপর প্রত্যেকে যে যার কাজে মন দিল।ঘটনাটা এখানেই চাপা পড়ে গেল।
এই ঘটনার দুদিন পরে ফের আরেকজন কুড়ুলধারীকে জঙ্গলের ওই একই জায়গায় জ্ঞান হারিয়ে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে থাকা অবস্হায় আবিষ্কার করল তার সঙ্গীসাথীরা।পূর্বের ভুক্তভোগী তখন আত্মপক্ষ সমর্থনের তীব্র রোষানল জারি রেখে সব সঙ্গীসাথীদের সাথে একত্রিত হয়ে সহকর্মীর জ্ঞান ফেরানোর উদ্দেশ্যে তার চোখেমুখে জল ছিটাতে লাগল।অতঃপর জ্ঞান ফিরল নতুন ভুক্তভোগীর।সেও তার বিস্ময়ে বিস্ফারিত লাল চোখদুটি মেলার পর ওই একই বয়ান দিল।
এবার ব্যাপারটা হাল্কা ছলে নেওয়ার আর কোনো উপায় রইল না।ব্যাপারটা সকলের মধ্যেই একটা চাপা ত্রাসের সৃষ্টি করল।
কুড়ুলধারীদের মধ্যে একজন বলল,ব্যাপারটা সম্বন্ধে একটু জানা দরকার। ঠিক কোন গাছের থেকে এসব হচ্ছে সেইটা জানতে হবে।তাই না?
—তুই ঠিক বলেছিস।ব্যাপারটা একদম সুবিধার ঠেকছে না।ভাই তুই বল তো কোন গাছটার থেকে এসব হল?
দ্বিতীয় ভুক্তভোগী তখন কাঁপা কাঁপা গলায় অঙ্গুলী নির্দেশ করল একটি বটবৃক্ষের দিকে।সবাই ভীত সন্ত্রস্ত পায়ে ধীরগতিতে বটবৃক্ষটির দিকে অল্প এগোল।এবার প্রথম ভুক্তভোগী চেঁচিয়ে উঠল।
“আরে,ওই তো পেয়েছি আমার গামছাখানা।আরে এই গাছটা কি করে এমন করবে!এই গাছটায় যখন কাল আমি কুড়ুল মারতে যাব তখন উল্টোদিক হতে আরেকটা গাছ এসে এমনটা করছিল।এইবার আমার মনে পড়েছে বলে সে ছয় হাত দূরের বটবৃক্ষের দিকে অঙ্গুলীনির্দেশ করল।তখন দ্বিতীয় ভুক্তভোগী বিদ্রোহ করে উঠল।মোটেই না।আমি বাজি রেখে বলতে পারি এই গাছটাই আমায় ডালপালা নিয়ে গিলতে এসেছিল।প্রথম ভুক্তভোগী তখন বলল,তুই তোর চোখের মাথা খেয়েছিস।আমার গামছা এই গাছের নীচে পাওয়া গেল।আমি তো সেদিন এখানেই জ্ঞান হারালুম।আমি এই গাছের নীচেই ছিলুম আর ওদিক থেকে ওই বটগাছটা আমায় গিলতে এল যার নীচে তুই শুয়েছিলি।
ব্যাস্…আর পায় কে!
এখন গাছ নিয়ে দুজনের মধ্যে তুমুল ঝগড়া বেঁধে গেল।বেগতিক দেখে একজন চেঁচিয়ে উঠল।
—তোরা থামবি?গাধার মতো ঝগড়া করে কোনো লাভ নেই।চল ব্যাপারটা মালিককে গিয়ে জানাই।
সবাই তাতে সহমত হল।তারা সবাই দল বেঁধে পঞ্চায়েত প্রধানকে ব্যাপারটা জানাল।ব্যাপারটা তখন মুচমুচে খাস্তার মতো গোটা গ্রামে ছড়িয়ে গেল সেদিন দুপুরে পঞ্চায়েত প্রধান দলবল নিয়ে দেখতে এলেন ব্যাপারখানা কি!
পুরো ব্যাপারটা শুনে নিয়ে একটু থম মেরে মুখটা গম্ভীর করে কিছু অনুধাবন করার চেষ্টা করতে থাকলেন।এমন সময় যে শহুরে বাবুটি এই জঙ্গলে ছাওয়া গ্রামটিতে পাকা রাস্তা করার দায়িত্বে ছিলেন,তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন, “একটা প্রশ্ন জাগছে আমার মনে।এই ভরা জঙ্গলে এত লতাপাতা আর গাছগাছালির ভীড়ে দুটো বটগাছ এখানে কি করছে!এই গোটা চত্বর জুড়ে আমি তো অন্তত কতগুলো বুনো গাছপালা ছাড়া আর কিছুই দেখলাম না।এইটাও একটা ভাববার বিষয় নয় কি?
পঞ্চায়েত প্রধান বললেন,”ব্যাপারটা আপনি ঠিকই লক্ষ্য করেছেন। সত্যিই তো!এখানে কতগুলো জংলা বনবাদাড়ের ভীড়ে দুটো বটগাছ কি করছে!আর সারা গ্রামের মধ্যে এরকম বটগাছ আছে বলে তো আমার মনে পড়ছে না।”
—ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভুত। রাস্তা তৈরি করতে গেলে তো সব গাছই কাটতে হবে,তোমরা আর দেরী কোরো না…এক্ষুনি কাজে লেগে পড়ো…
বলে কুড়ুলধারীদের দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করলেন।
কুড়ুলধারী শ্রমিকেরা একসাথে বলে উঠল।”দেখুন বাবুরা…জঙ্গলের সব গাছ আমরা কাটতে রাজী।কিন্তু ওই দুটো বটগাছে আমরা হাত লাগাতে পারব না।আমাদের মাপ কইরেন”।
অগত্যা কি আর করা…।ঠিক হল,জঙ্গলের সব গাছ কেটে পরিষ্কার করা হলে তারপর ওই দুটো বটগাছ অন্যখান থেকে লোক আনিয়ে বা কোনো একটা ব্যবস্হা করে কাটানো হবে এই মর্মে সিদ্ধান্ত হল।
কুড়ুলধারীদের মধ্যে একজন বলল,ব্যাপারটা সম্বন্ধে একটু জানা দরকার। ঠিক কোন গাছের থেকে এসব হচ্ছে সেইটা জানতে হবে।তাই না?
—তুই ঠিক বলেছিস।ব্যাপারটা একদম সুবিধার ঠেকছে না।ভাই তুই বল তো কোন গাছটার থেকে এসব হল?
দ্বিতীয় ভুক্তভোগী তখন কাঁপা কাঁপা গলায় অঙ্গুলী নির্দেশ করল একটি বটবৃক্ষের দিকে।সবাই ভীত সন্ত্রস্ত পায়ে ধীরগতিতে বটবৃক্ষটির দিকে অল্প এগোল।এবার প্রথম ভুক্তভোগী চেঁচিয়ে উঠল।
“আরে,ওই তো পেয়েছি আমার গামছাখানা।আরে এই গাছটা কি করে এমন করবে!এই গাছটায় যখন কাল আমি কুড়ুল মারতে যাব তখন উল্টোদিক হতে আরেকটা গাছ এসে এমনটা করছিল।এইবার আমার মনে পড়েছে বলে সে ছয় হাত দূরের বটবৃক্ষের দিকে অঙ্গুলীনির্দেশ করল।তখন দ্বিতীয় ভুক্তভোগী বিদ্রোহ করে উঠল।মোটেই না।আমি বাজি রেখে বলতে পারি এই গাছটাই আমায় ডালপালা নিয়ে গিলতে এসেছিল।প্রথম ভুক্তভোগী তখন বলল,তুই তোর চোখের মাথা খেয়েছিস।আমার গামছা এই গাছের নীচে পাওয়া গেল।আমি তো সেদিন এখানেই জ্ঞান হারালুম।আমি এই গাছের নীচেই ছিলুম আর ওদিক থেকে ওই বটগাছটা আমায় গিলতে এল যার নীচে তুই শুয়েছিলি।
ব্যাস্…আর পায় কে!
এখন গাছ নিয়ে দুজনের মধ্যে তুমুল ঝগড়া বেঁধে গেল।বেগতিক দেখে একজন চেঁচিয়ে উঠল।
—তোরা থামবি?গাধার মতো ঝগড়া করে কোনো লাভ নেই।চল ব্যাপারটা মালিককে গিয়ে জানাই।
সবাই তাতে সহমত হল।তারা সবাই দল বেঁধে পঞ্চায়েত প্রধানকে ব্যাপারটা জানাল।ব্যাপারটা তখন মুচমুচে খাস্তার মতো গোটা গ্রামে ছড়িয়ে গেল সেদিন দুপুরে পঞ্চায়েত প্রধান দলবল নিয়ে দেখতে এলেন ব্যাপারখানা কি!
পুরো ব্যাপারটা শুনে নিয়ে একটু থম মেরে মুখটা গম্ভীর করে কিছু অনুধাবন করার চেষ্টা করতে থাকলেন।এমন সময় যে শহুরে বাবুটি এই জঙ্গলে ছাওয়া গ্রামটিতে পাকা রাস্তা করার দায়িত্বে ছিলেন,তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন, “একটা প্রশ্ন জাগছে আমার মনে।এই ভরা জঙ্গলে এত লতাপাতা আর গাছগাছালির ভীড়ে দুটো বটগাছ এখানে কি করছে!এই গোটা চত্বর জুড়ে আমি তো অন্তত কতগুলো বুনো গাছপালা ছাড়া আর কিছুই দেখলাম না।এইটাও একটা ভাববার বিষয় নয় কি?
পঞ্চায়েত প্রধান বললেন,”ব্যাপারটা আপনি ঠিকই লক্ষ্য করেছেন। সত্যিই তো!এখানে কতগুলো জংলা বনবাদাড়ের ভীড়ে দুটো বটগাছ কি করছে!আর সারা গ্রামের মধ্যে এরকম বটগাছ আছে বলে তো আমার মনে পড়ছে না।”
—ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভুত। রাস্তা তৈরি করতে গেলে তো সব গাছই কাটতে হবে,তোমরা আর দেরী কোরো না…এক্ষুনি কাজে লেগে পড়ো…
বলে কুড়ুলধারীদের দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করলেন।
কুড়ুলধারী শ্রমিকেরা একসাথে বলে উঠল।”দেখুন বাবুরা…জঙ্গলের সব গাছ আমরা কাটতে রাজী।কিন্তু ওই দুটো বটগাছে আমরা হাত লাগাতে পারব না।আমাদের মাপ কইরেন”।
অগত্যা কি আর করা…।ঠিক হল,জঙ্গলের সব গাছ কেটে পরিষ্কার করা হলে তারপর ওই দুটো বটগাছ অন্যখান থেকে লোক আনিয়ে বা কোনো একটা ব্যবস্হা করে কাটানো হবে এই মর্মে সিদ্ধান্ত হল।
কেটে গেল কয়েকদিন।গ্রামের সমস্ত আগাছা আর জঙ্গল কাটা পড়ল।বিস্তীর্ণ উন্মুক্ত খোলা প্রান্তরের মাঝ বরাবর মাথা উচু করে মুখোমুখি দন্ডায়মান হয়ে রয়ে গেল শুধুমাত্র ছ’হাত দূরত্ব বিশিষ্ট দুটি বটগাছ।
এদিন পঞ্চায়েত প্রধান নিজে অন্যত্র থেকে ডেকে আনা আগাছা কাটার লোক নিয়ে আসলেন এবং নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কাজের তদারকি করতে শুরু করলেন।লোকেরা এসে কুড়ুল হাতে নিয়ে কাজে লেগে গেল।নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল,”আজব ব্যাপার মাইরি…সব জঙ্গল নিজেরা কেটে সাফ করে আমাদের নিয়ে এল এই দুটো গোদা গাছ কাটতে!”
—“বাবুদের খেয়াল…আমাদের আর কি!জঙ্গল সাফ করার পয়সা পাচ্ছি যখন,তখন কথা বাড়িয়ে আর কাজ নেই,জলদি লেগে পড়…”
একজন কুড়ুলধারী কোমরে গামছা কষে টাইট করে বেঁধে নিয়ে যেই একটি বটগাছে কুড়ুল বসাতে যাবে,তখনই আবার ঘটল সেই অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা।ছ’হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বটগাছটির একটি শুঁড়ের ন্যায়ে তীব্রবেগে ধাবিত হল কুড়ুলধারীর গ্রীবা লক্ষ্য করে।মূহুর্তের মধ্যে তা বজ্রমুষ্ঠির ন্যায়ে সাঁড়াশির মতো মর্মান্তিক হয়ে চেপে বসল কুড়ুলধারীর কন্ঠনালীয় এবং এত তীব্র জোরে চেপে ধরল যে কুড়ুলধারীর কন্ঠনালী এবং এত তীব্রজোরে চেপে ধরল যে তার জিহ্বা উন্মুক্ত হয়ে পড়ল। তার বোবা দুচোখ জুড়ে একটাই আকুতি যেন ধ্বনিত হতে লাগল…”ছেড়ে দে বাপ…কেঁদে বাঁচি…”
ব্যাপার দেখে অন্য সব কুড়ুলধারীদের মধ্যে ত্রাহী ত্রাহী রব উঠল।কয়েক মূহুর্ত এইভাবে চেপে ধরে রাখার পর হঠাৎ শাখাটি কেটে দেওয়া ইলাস্টিকের মতো সুড়ুৎ করে পিছিয়ে গিয়ে আপন স্হানে আগের রূপে পর্যবসিত হল।এইরকম একটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটার মূহুর্তের মধ্যেই চতুর্দিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল।ঘটনাস্থলে সেইদিন দুজন সংজ্ঞাহীন মানুষকে ঘিরে গ্রামবাসীরা জড়ো হল এবং ক্রমাগত জলের ছিটা দিয়ে তাদের জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টায় সক্রিয় হল।দুজনের একজন হল সেই ভুক্তভোগী কুড়ুলধারী আর অপরজন হলেন পঞ্চায়েত প্রধান। অনেক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর প্রথমে পঞ্চায়েত প্রধান এবং অতঃপর ভুক্তভোগী কুড়ুলধারী ধীরে ধীরে চোখ মেলল।
আকস্মিকতার ঘোর একটু কাটার পর জনতার ভীড়এর মাঝে কয়েকজন বলে উঠল,ওই রাক্ষুসে গাছটা গ্রামে থাকাটা মোটেই নিরাপদ নয়।ওটাকে এক্ষুনি কেটে ফেলা উচিত।
বিষয়টাতে সকলেই একমত হল।কিন্তু মুশকিল হল,বেড়ালের গলায় ঘন্টাটা বাঁধার জন্য কাউকেই আর পাওয়া যাচ্ছে না।সবাই এক কথায় পিছিয়ে যাচ্ছে।শেষকালে ভালোরকম টাকা পয়সার প্রলোভন দিয়ে রাজী করানোর চেষ্টা আরম্ভ হল।কুড়ুলধারীদের একজনের সেই সময় ঋণের বোঝায় একেবারে গলাডুবি হয়ে গেছে।বাকিটুকু কোনোমতে চলছে প্রতিদিনের মজুরির পয়সায়।এখন এরা যে টাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে সেটা হাতে পেলে সে ঋণের বোঝাটা বেশ খানিকটা নামিয়ে দম ফেলতে পারবে।সে মনে মনে ভাবল,প্রত্যেক দিন একটু একটু করে মরার থেকে একদিনে মরে যাওয়াই ঢের ভালো।সে কুড়ুল হাতে এগিয়ে এসে বলল,গাছটা সে-ই কাটবে।
গ্রামশুদ্ধ লোকের একত্রিত নিঃশ্বাস তখন এমনভাবে পড়ল যে চমকে গিয়ে সেখানে বসা কাকগুলো সব উড়ে গেল।তারপর সবাই বলে উঠল,”তবে আর দেরী কেন বাপু…!এক্ষুনি নিকেষ করো গাছটাকে…প্রাণে বাঁচুক সব”
সে কুড়ুল নিয়ে বটগাছটির দিকে কম্পমান বুক নিয়ে এগিয়ে গেল সেই গাছটির দিকে,যে গাছটি এক্ষুনি তার সহকর্মীর গলা ভয়ংকরভাবে পেঁচিয়ে ধরেছিল।সে আর আগুপিছু কিছু না ভেবে,যা থাকে কপালে…বলে কুড়ুল নিয়ে তার গোড়ার দিক লক্ষ্য করে কোপ বসাতে যাবে,এমন সময় যে ঘটনাটি ঘটল,তা বিস্ময়ের পারদকে তার গন্তব্য সম্পূর্ণ করে দিল।উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য বটগাছটির একটি শাখা অক্টোপাসের মতো শুঁড়ের আকৃতি ধারণ করে তীব্রগতিতে ধাবমান হয়ে প্রায় উড়ে এসে চেপে ধরল তার গলা।এবারে সবাই একেবারে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল।কয়েক মূহুর্ত মর্মান্তিকভাবে তার গলা চেপে ধরে আবার পূর্বের মতোই ছেড়ে দিয়ে শাখাটি চলে গেল তার নিজ স্হানে।ব্যাপার বুঝতে আর কারোর দ্বিমত রইল না।দুটি বটগাছের মধ্যে এমন কোনো গহিন যোগসূত্র রয়েছে যার জন্য একজনকে কেউ কোনোভাবে আঘাত করতে উদ্যত হলেই পাশের বটগাছটি ফুঁসে উঠে সেটি আটকে দিচ্ছে।
সূর্য অস্ত গেল।সেদিনকার মতো সব কাজ পন্ড হল।তল্পিতল্পা গুটিয়ে সবাই একে একে ফিরে গেল আপন বাসায়।সারা গ্রাম জুড়ে ছেয়ে গেল এক আতঙ্কের কুয়াশা।
গ্রামের বাচ্চা যুবক,নবীন প্রবীণ সবার মধ্যে এখন একটাই কথা,একটাই চর্চা।এই সময়ে গ্রামের এক তেমাথা বৃদ্ধ হুঁকো টানতে টানতে তার সঙ্গীসাথীদের বলল,”আমি বোধহয় এই ব্যাপারটা সম্বন্ধে কিছু জানি কিন্তু নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি না কারণ ঘটনাটা ঘটে আমারও দুই পুরুষ আগে।আমার তখন জন্ম হয়নি।কাজেই সত্যমিথ্যা যাচাই না করে কেউ যদি আমায় অবিশ্বাস করে সে আমি বরদাস্ত করব না।তোমরা যদি ঘটনাটি জানতে চাও তো আগে ওই দুই বটগাছের তলা খুঁড়তে আরম্ভ করো।কি পেলে এসে আমায় বলো,তারপর আমি সব বলব।
এই তেমাথা বৃদ্ধের বয়স একশো ছুঁই ছুঁই।গ্রামের সবথেকে প্রবীন মানুষ।তাই গ্রামের সব মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা করে,প্রয়োজনে পরামর্শও নেয়।তাই তিনি যখন বলছেন, তার কথা কেউ অগ্রাহ্য করল না।গ্রামের মানুষরাই কুড়ুল নিয়ে ওই দুই বটগাছের তলার মাটি খুঁড়তে লেগে গেল।অনেকটা খুঁড়ে ফেলার পর আস্তে আস্তে দুটি বটগাছের তলায় একটু একটু করে উন্মুক্ত হতে থাকল একটি করে কবরস্হান।এবার গ্রামের সবাই বিস্ফারিত চোখে একরাশ বিস্ময় ঢেলে এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল নীরবতা ভাঙলেন তেমাথা বৃদ্ধ।
“যা বলেছিলুম মিলে গেছে তো!এবার তোমাদের এর গোড়ার কথাটা বলি।মোটামুটি দুশো বছর আগের কথা।সে সময় হিন্দু আর মুসলমান মানুষের মধ্যে মারামারি-কোন্দল-?খুনোখুনি একেবারে নাওয়া খাওয়ার মতোই নিত্য ঘটনা ছিল।সেই সময়েএক হিন্দু চাষার মেয়ের প্রেমে পড়ে এক মুসলমান ব্যবসায়ী ঘরের ছেলে।ভিনজাতে প্রেম বলে সেই খবর আগুনের মতো সারা গ্রামে ছড়িয়ে গেল।ভালোবাসার পিয়াসী দুটি পাখি রাতারাতি সমাজের চোখে বনে গেল দাগী আসামী।তাদের দুজনকে বিচারাধীন হিসাবে বন্দী করা হয়েছিল।সালিশিসভায় তাদের নিয়ে যাওয়ার পথে কিভাবে যে তারা কড়া প্রহরা উপেক্ষা করে দুজনে দুজনের হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিল তা অনুধাবন করা দুঃসাধ্য।কিন্তু এই লৌহকঠিন অন্ধ সমাজের নিকষ অন্ধকারে না মরে একটু বাঁচার স্বপ্ন নিয়ে তারা ঠিকই একে অপরের হাত ধরে পালাতে সক্ষম হয়েছিল কিন্তু শেষরক্ষা হল না।গাঁয়ের শেষ প্রান্তে তারা খোদ মোড়লের হতেই ধরা পড়ে যায়।
এই ভয়ংকর “গর্হিত” অপরাধে তাদের শাস্তি জোটে একটাই।মৃত্যুদন্ড দুজনকে লটকানো হয় ফাঁসির দড়িতে।শোনা যায়,তখন পরস্পর পরস্পরের কাছে আকাশ কাঁপিয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ হচ্ছে,”এ জন্মে একসাথে বাঁচা হল না…কিন্তু মরণের পর আর কোনো শক্তি আমাদের আলাদা করতে পারবে না।আজ আমরা পরস্পরের মৃত্যুতে নীরব।মরণের পরে আমাদের অনন্ত মিলনের পর আর কোনো আঘাত…কোনো বিরহ আমরা সইব না…সইব না…সইব না…।
এই তীব্র দ্রোহের ধ্বনিকেই চেপে ঠেসে ধরে ফাঁসির দড়ি পরানো হয়েছিল গলায়।ফাঁসির পর ছেলেটির দেহ কবর দেওয়ার সিদ্ধান্ত হল।কিন্তু হিন্দু চাষা মেয়ের বাপ মা জাত খোয়ানোর ভয়ে মুসলমান ছেলের সংস্পর্শে আসা মেয়ের দেহ আর নিতে পারল না।বাকি হিন্দু মানুষজনও ছুঁতে চাইল না মেয়েটির দেহ।সবাই বলল,”অচ্ছুত মেয়েমানুষের দেহ ছুঁয়ে কি নরকে যাব!যার যেমন পাপ সে তেমন শাস্তিই পেয়েছে।
শেষমেষ ছেলেটির কবরের পাশেই মেয়েটির দেহ বেওয়ারিশ লাশের মতো পড়ে থাকল।কিছুদিন যাওয়ার পর গ্রামবাসী একটু একটু করে উপলব্ধি করতে সক্ষম হল যে কত বড় অবিচারের শিকার হল ওই নিষ্পাপ দুটি ছেলেমেয়ে।গ্রামের মানুষের মনে অনুশোচনা জেগে উঠল।অতঃপর গ্রামবাসীরা মেয়েটির চিল শকুনের খাওয়া পচাগলা লাশটিকে উপর থেকে মাটিচাপা দিয়ে তার আত্মার শান্তি কামনা করল।দুজনের মৃতদেহ পাশাপাশি থাকায় ওই দুটি স্হানে গ্রামবাসীরা চাঁদা তুলে গড়ে তুলল দুটি সমাধিক্ষেত্র। এক্ষেত্রে আর হিন্দু কি মুসলমান…চিতা না কবর এই শ্রেণীবিন্যাসে না গিয়ে তাদের দুজনের একটি স্মৃতিচিহ্ন তৈরি করল।এই দুই বটগাছের উৎপত্তি যে ওই কবরস্থানের উপরেই এ নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
সকলের মনের মধ্যে এক বিস্ময় যেন বিদ্যুতের তরঙ্গ বইয়ে দিয়ে চলে গেল।তাদের বুঝতে আর বাকি রইল না,যে মৃত্যুকালে তাদের অঙ্গীকারের কি তীব্র পরিস্ফুটনই তারা স্বচক্ষে অবলোকন করেছে।
সন্ধ্যা নামল।গায়ের বাতাসের সাথে ফের সখ্যতা স্হাপন করল গাঢ় অন্ধকার।গ্রামবাসী তেমাথা বৃদ্ধের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যে যার ঘরের পথ ধরল।ফেরার পথে একটি হাড় হিম করা দৃশ্য দেখে তারা কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল।বিস্ময়ে হাঁ হয়ে তারা দেখতে থাকল,উন্মুক্ত প্রান্তরে পূর্ণিমার মায়াবী জ্যোৎস্নার মায়ায় স্নাত হয়ে মিশমিশে কালো দুই বৃক্ষমূর্তি তাদের আপন শাখা দিয়ে একে অপরকে তীব্র আদরে জড়িয়ে ধরে অনির্বাচনীয় উন্মাদনার সাগরে যেন এক মাতাল জোয়ার তুলে অনন্ত প্রণয়ের উৎসবে আত্মগহন করেছে। সকলের শিড়দাড়া দিয়ে যেন একটা হিমশীতল ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল…।