Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

পুঁটি দাদাকে মুহূর্তের বিশ্রাম দেয় না। পূজার সময় হইতে পৌষের শেষ পর্যন্ত ক্রমাগত নগরের পর নগর, তীর্থের পর তীর্থে টানিয়া লইয়া ফিরিতেছিল। তার অল্প বয়স, সুস্থ সবল দেহ, অসীম কৌতূহল, তাহার সহিত সমানে পা ফেলিয়া চলা নীলাম্বরের সাধ্যাতীত—সে শ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছে। অথচ কোথাও বসিয়া একটুখানি জিরাইয়া লইবার ইচ্ছা না হইয়া কেন যে সমস্ত দেহটা তাহার ঘরের পানে চাহিয়া অহর্নিশ পালাই পালাই করিতেছে, ভারাক্রান্ত মন দেশে ফিরিবার জন্য দিবানিশি কাঁদিয়া কাঁদিয়া নালিশ জানাইতেছে, ইহাও সে বুঝিতে পারিতেছে না। কি আছে দেশে? কেন এমন স্বাস্থ্যকর স্থানে মন বসে না? ছোটবৌ মাঝে মাঝে পুঁটিকে চিঠি দেয়, তাহাতেও এমন কোনও কথা থাকে না, তথাপি সেই বন-জঙ্গলের অবিশ্রাম টানে তাহার শীর্ণদেহ কঙ্কালসার হইয়া উঠিতে লাগিল। পুঁটি চায়—দাদা সব ভুলিয়া আবার তেমনি হয়। তেমনিই সুস্থ সদানন্দ, তেমনই মুখে মুখে গান, তেমনই কারণে অকারণে উচ্চহাসির অফুরন্ত ভাণ্ডার। কিন্তু দাদা তাহার সমস্ত চেষ্টা নিষ্ফল করিতে বসিয়াছে। আগে সে এমন করিয়া ভাবিয়া দেখে নাই। হতাশ হয় নাই, মনে করিত, আর দুদিন যাক। কিন্তু দুদিন করিয়া চার-পাঁচ মাস কাটিয়া গেল, কৈ কিছুই ত হইল না। বাড়ি ছাড়িয়া আসিবার দিনে মোহিনীর কথায় ব্যবহারে বিরাজের উপর তাহার একটা করুণার ভাব আসিয়াছিল, তাহার কথাগুলো বিশ্বাসও করিয়াছিল। দাদা ভাল হইয়া গেলে ছেলেবেলার কথা মনে করিয়া সে হয়ত মনে মনে তাহাকে সম্পূর্ণ ক্ষমা করিতেও পারিত। বস্তুতঃ ক্ষমা করিবার জন্য, সেই বৌদিদিকে একটুখানি মাধুর্যের সহিত স্মরণ করিবার জন্য এক সময় নিজেও ব্যাকুল হইয়াছিল, কিন্তু সে সুযোগ তাহার মিলিতেছে কৈ? দাদা ভাল হইতেছে কৈ? একে ত সংসারের এমন কোনও দুঃখ, কোন হেতু সে কল্পনা করিতেও পারে না যাহাতে এই মানুষটিকে এত দুঃখে ফেলিয়া রাখিয়া কেহ সরিয়া দাঁড়াইতে পারে। বৌদি ভাল হউক, মন্দ হউক, পুঁটি আর ভ্রূক্ষেপ করে না, কিন্তু ত্যাগ করিয়া যাইবার অমার্জনীয় অপরাধে যে স্ত্রী অপরাধিনী, তাহার প্রতি বিদ্বেষেরও তাহার যেন অন্ত রহিল না। সেই হতভাগিনীকে প্রত্যহ স্মরণ করিয়া তাহার বিচ্ছেদ এমন করিয়া মনে মনে লালন করিয়া, যে মানুষ নিজেকে ক্ষয় করিয়া আনিতেছে, তাহারও প্রতি তাহার চিত্ত প্রসন্ন হইল না।

একদিন সকালে সে মুখ ভার করিরা আসিয়া বলিল, দাদা, বাড়ি যাই চল। নীলাম্বর কিছু বিস্মিত হইয়াই বোনের মুখের পানে চাহিল, কারণ মাঘ মাসটা প্রয়াগে কাটাইয়া যাইবার কথা ছিল। পুঁটি দাদার মনের ভাব বুঝিয়া বলিল, একটা দিনও আর থাকতে চাইনে, কালই যাব।

তাহার রুষ্টভাব অবলোকন করিয়া নীলাম্বর একটুখানি বিষন্নভাবে হাসিয়া বলিল, কেন রে পুঁটি?

পুঁটি এতক্ষণ জোর করিয়া চোখের জল চাপিয়া রাখিয়াছিল, এবার কাঁদিয়া ফেলিল। অশ্রু-বিকৃতকন্ঠে বলিতে লাগিল, কি হবে থেকে? তোমার ভাল লাগচে না, তুমি যাই যাই করে প্রতিদিন শুকিয়ে উঠচ, না, আমি কিছুতেই একদিনও থাকব না।

নীলাম্বর সস্নেহে তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া কাছে বসাইয়া বলিল, ফিরে গেলেই কি ভাল হয়ে যাব রে? এ দেহ সারবে বলে আর আমার ভরসা হয় না পুঁটি—তাই চল বোন, যা হবার ঘরে গিয়েই হোক।
দাদার কথা শুনিয়া পুঁটি অধিকতর কাঁদিয়া উঠিয়া বলিল, কেন তুমি সদাসর্বদা তাকে এমন করে ভাববে? শুধু ভেবেই ত এমন হয়ে যাচ্চ।

কে বললে আমি তাকে সর্বদা ভাবি?

পুঁটি তেমনই ভাবে জবাব দিল, কে আবার বলবে, আমি নিজেই জানি।

তুই তাকে ভাবিস নে?

পুঁটি চোখ মুছিয়া উদ্ধতভাবে বলিল, না, ভাবিনে। তাকে ভাবলে পাপ হয়।

নীলাম্বর চমকিত হইল—কি হয়?

পাপ হয়। তার নাম মুখে আনলে মুখ অশুচি হয়, মনে আনলে স্নান করতে হয়,—বলিয়াই সে সবিস্ময়ে চাহিয়া দেখিল, দাদার স্নেহকোমল দৃষ্টি একনিমেষে পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে। নীলাম্বর বোনের মুখের দিকে চাহিয়া কঠিনস্বরে বলিল, পুঁটি!

ডাক শুনিয়া সে ভীত ও অত্যন্ত কুন্ঠিত হইয়া পড়িল। সে দাদার বড় আদরের বোন, ছেলেবেলাতেও সহস্র অপরাধে কখনও এমন চোখ দেখে নাই, এমন গলা শুনে নাই। এখন বড়বয়সে বকুনি খাইয়া তাহার ক্ষোভে ও অভিমানে মাথা হেঁট হইয়া গেল।

নীলাম্বর আর কিছু না বলিয়া উঠিয়া গেলে, সে চোখে আঁচল দিয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিতে লাগিল। দুপুরবেলা দাদার আহারের সময় কাছে গেল না, অপরাহ্নে দাসীর হাতে খাবার পাঠাইয়া দিয়া আড়ালে দাঁড়াইয়া রহিল।

নীলাম্বর ডাকিল না, কথাটি বলিল না।

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। নীলাম্বর আহ্নিক শেষ করিয়া সেই আসনে চুপ করিয়া বসিয়া আছে, পুঁটি নিঃশব্দে ঘরে ঢুকিয়া পিছনে আসিয়া হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া দাদার পিঠের উপর মুখ রাখিল। এটা তাহার নালিশ করার ধরন। ছেলেবেলায় অপরাধ করিয়া বৌদির তাড়া খাইয়া এমনই করিয়া সে অভিযোগ করিত। নীলাম্বরের সহসা তাহা মনে পড়িয়া দুই চোখ সজল হইয়া উঠিল, মাথায় হাত দিয়া কোমলস্বরে বলিল, কি রে?

পুঁটি পিঠ ছাড়িয়া দিয়া কোলের উপর উপুড় হইয়া মুখ গুঁজিয়া কাঁদিতে লাগিল। নীলাম্বর তাহার মাথায় উপর একটা হাত রাখিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। বহুক্ষণ পরে পুঁটি কান্নার সুরে বলিল, আর বলব না দাদা!

নীলাম্বর হাত দিয়া তাহার চুলগুলি নাড়িতে নাড়িতে বলিল, না, আর ব’ল না।

পুঁটি চুপ করিয়া পড়িয়া রহিল। নীলাম্বর তাহার মনের কথা বুঝিয়া মৃদুস্বরে কহিল, সে তোর গুরুজন। শুধু সম্পর্কে নয় পুঁটি, তোকে মায়ের মত মানুষ ক’রে তোর মায়ের মতই হয়েচে। অপরে যা ইচ্ছে বলুক, কিন্তু তোর মুখের ও-কথায় গভীর অপরাধ হয়। পুঁটি চোখ মুছিতে মুছিতে বলিল, কেন সে আমাদের এমন করে ফেলে রেখে গেল!

কেন যে গেল পুঁটি, সে শুধু আমি জানি, আর যিনি সর্বযামী তিনি জানেন। সে নিজেও জানত না—তখন সে পাগল হয়েছিল, তার এতটুকু জ্ঞান থাকলে সে আত্মহত্যাই করত, এ কাজ করত না।

পুঁটি আর একবার চোখ মুছিয়া ভাঙ্গা গলায় বলিল, কিন্তু—এখন, তবে কেন আসে না দাদা?

কেন আসে না? আসবার জো নেই বলেই আসে না দিদি, বলিয়া সে নিজেকে জোর করিয়া সংবরণ করিয়া লইয়া ক্ষণকাল পরেই বলিল, যে অবস্থায় আমাকে ফেলে রেখে গেছে, তার এতটুকু ফেরবার পথ থাকলে সে ফিরে আসত—একটা দিনও কোথাও থাকত না। এ কথা কি তুই নিজেই বুঝিস নে পুঁটি?

পুঁটি মুখ ঢাকিয়া রাখিয়াই ঘাড় নাড়িয়া বলিল, বুঝি দাদা।
নীলাম্বর উদ্দীপ্ত হইয়া বলিল, তাই বল্‌ বোন; সে আসতে চায়, পায় না। সে যে কি শাস্তি পুঁটি, তা তোরা দেখতে পাসনে বটে, কিন্তু চোখ বুঝলে আমি তা দেখি! সেই দেখাই আমাকে নিত্য ক্ষয় করে আনচে রে, আর কিছুই নয়।

পুঁটি কাঁদিয়া ফেলিল।

নীলাম্বর হাত দিয়া নিজের চোখ মুছিয়া লইয়া বলিল, সে তার দুটো সাধের কথা আমাকে যখন-তখন বলত। এক সাধ, শেষ সময়ে আমার কোলে যেন মাথা রাখতে পায়; আর সাধ, সীতা-সাবিত্রীর মত হয়ে মরণের পরে যেন তাদের কাছেই যায়। হতভাগীর সব সাধই ঘুচেচে।

পুঁটি চুপ করিয়া শুনিতে লাগিল।

নীলাম্বর রুদ্ধকন্ঠ পরিষ্কার করিয়া লইয়া বলিল, তোরা সবাই তার অপরাধ দিস্‌, বারণ করতে পারিনে বলে আমিও চুপ করে থাকি, কিন্তু ভগবানকে ফাঁকি দিই কি করে বল্‌ দেখি? তিনি ত দেখচেন, কার ভুল, কার অপরাধের বোঝা মাথায় নিয়ে সে ডুবে গেল। তুই বল্‌, আমি কোন্‌ মুখে তার দোষ দিই, আমি তাকে আশীর্বাদ না করে কি করে থাকি? না বোন, সংসারের চোখে সে যত কলঙ্কিনীই হোক, তার বিরুদ্ধে আমার কোন ক্ষোভ, কোন নালিশ নেই। নিজের দোষে এ জন্মে তাকে পেয়েও হারালুম, ভগবান করুন, যেন পরজন্মেও তাকে পাই। সে আর বলিতে পারিল না, এইখানে তাহার গলা একেবারে ধরিয়া গেল।

পুঁটি তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিয়া আঁচল দিয়া দাদার চোখ মুছাইয়া দিতে গিয়া নিজেও কাঁদিয়া ফেলিল,সহসা তাহার মনে হইল, দাদা যেন কোথায় সরিয়া যাইতেছে। কাঁদিয়া বলিল, যেখানে ইচ্ছে চল দাদা, কিন্তু, আমি তোমাকে একটি দিনও কোথাও একলা ছেড়ে দেব না।

নীলাম্বর মুখ তুলিয়া একটুখানি হাসিল।

বিরাজ জগন্নাথের পথে ফিরিয়া আসিতেছিল। এই পথ ধরিয়া যখন সে অনুদ্দিষ্ট মৃত্যুশয্যার অনুসন্ধানে গিয়াছিল, সেই যাওয়ায় আর এই আসায় কি প্রভেদ! এখন সে বাড়ি যাইতেছে। তাহার দুর্বল দেহ পথে যতই সকাতরে বিশ্রাম-ভিক্ষা চাহিতে লাগিল, সে ততই ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত হইয়া উঠিতে লাগিল। কোন কারণে কোথাও বিলম্ব করিতে সে সম্মত নয়। তাহার কাশি যক্ষ্মায় পরিণত হইয়াছে, ইহা সে টের পাইয়াছিল, তাই আশঙ্কার অবধি ছিল না, পাছে যাওয়া না ঘটে। ছেলেবেলা হইতে একটা বিশ্বাস তাহার বড় দৃঢ় ছিল, দেহ নিষ্পাপ না হইলে কেহ স্বামীর পায়ে মরিতে পায় না। সে এই উপায়ে মরণের পূর্বে একবার নিজের দেহটাকে যাচাই করিয়া লইতে চায়—তাহার প্রায়শ্চিত্ত সম্পূর্ণ হইয়াছে কি না। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইতে পারিলে সে নির্ভয়ে, মহানন্দে জীবনের পরপারে দাঁড়াইয়া তাঁর জন্য অপেক্ষা করিয়া বসিয়া থাকিবে। কিন্তু দামোদরের এধারে আসিয়া তাহার হাত-পা ফুলিয়া উঠিল, মুখ দিয়া অধিক পরিমাণে রক্ত পড়িতে লাগিল—আর কিছুতেই পা চলিল না। সে হতাশ হইয়া একটা গাছতলায় ফিরিয়া আসিয়া ভয়ে কাঁদিতে লাগিল। এ কি ভয়ানক অপরাধ যে, এত করিয়াও তাহার শেষ আশা মিটিল না! তাহার এ-জন্ম গেল, পরজন্মেও আশা নাই, তবে সে আর কি করিবে! আশা নাই, তবুও সে গাছতলায় পড়িয়া সারাদিন হাতজোড় করিয়া স্বামীর পায়ে মিনতি জানাইতে লাগিল।

পরদিন তারকেশ্বরের কাছাকাছি কোথায় হাটবার ছিল। প্রভাত হইতে সেই পথে গরুর গাড়ি চলিতে লাগিল। সে সাহসে ভর করিয়া এক বৃদ্ধ গাড়োয়ানকে আবেদন করিল। বুড়ো মানুষ তাহার কান্না দেখিয়া, সম্মত হইয়া তাহাকে গাড়ি করিয়া তারকেশ্বরে পৌঁছাইয়া দিয়া গেল। বিরাজ স্থির করিল, এই মন্দিরের আশেপাশে কোথাও সে পড়িয়া থাকিবে। এখানে কত লোক আসে যায়, যদি কোন উপায়ে একবার ছোটবৌর কাছে সংবাদ পাঠাইতে পারে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress