Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বিদ্যমান “Arsinocosis” ও অসহায় আক্রান্তজন || Purabi Dutta

বিদ্যমান “Arsinocosis” ও অসহায় আক্রান্তজন || Purabi Dutta

বিদ্যমান “Arsinocosis” ও অসহায় আক্রান্তজন

কিছুদিন আগে এই ফেসবুকেই “বিষপর্ব” শিরোনামে, কিছু “রাসায়নিক বিষ”, বিষয় নিয়ে নানা পর্বে আলোচনা করেছিলাম। তার মধ্যে ছিল এক অন্যতম রাসায়নিক বিষ , প্রাচীন কাল থেকেই যা চলে আসছে তার ব্যবহার বহু দেশে— গ্রীক, ইংল্যান্ড, চীন , ভারত সর্বত্র ….. বিভিন্ন নামে। এ বিষ প্রয়োগে বিদূরিত করা হতো নিমেষে— ইঁদুর, সাপ, মানুষ. …. সোজা বাংলায় যার নাম ছিল , “সেঁকোবিষ” সর্বস্তরের সকলের হাতে উঠে আসবার জন্য খোলা বাজারে অনায়াসে পাওয়া যেতো। অতি নিরীহ স্বাদ, গন্ধ, বর্ণহীন এক সাদা পাউডার যা তৈরি হতো আকর থেকে কারখানায় অথবা পৃথকীকরণ না করেই অবিকল পৃথিবীর উৎস অংশ বিশেষে । “বিষে বিষক্ষয়”, এই মর্মে এ বিষের হিসাবী সংযত ব্যবহারও ছিল নানা ঔষধেও। তখনও ত জানা ছিল না , কি পরিণতি আসবে ভবিষ্যতে!!!

ছোটবেলার রূপকথার দেশে একটু যাই, তখন থেকেই ত সেঁকোবিষের কথা জানতাম কিন্তু জানতাম না তখন রসায়ন বিষয় নিয়েই থাকব সারাজীবন আর এক সখ্যতা হবে দীর্ঘদিন ধরে, ঐ সেঁকোবিষের সাথে—- সর্বক্ষণ…..

সেদিন গ্রীষ্ম- বর্ষা সন্ধিক্ষণে পূব আকাশে সোনার থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ উঠল, পুকুরে স্নান সেরে আনন্দে দুয়োরানি বেলফুলের মালা গেঁথে খোঁপায় জড়িয়ে লাল পাড় শাড়ী পরে রাঙা পায়ে আলতা মাখতে বসলেন— অনেক দিন পর রাজা আসবেন যে তার কুঁড়েঘরে (রাজবাড়ির এক কোনেতে )। হঠাত্ দরজায় পড়ল টোকা, চমকে উঠলেন রানী,সে কি ! এত তাড়াতাড়ি ! দরজা খুলে দেখেন , না, রাজা নন, সুয়োরানির কুঁজি দাসী — হাসি মুখে এগিয়ে দেয় শ্বেত পাথরের থালা– তাতে বড়ো বড়ো আনন্দ নাড়ু, সুয়োরানি পাঠিয়েছেন । আঃ দুয়োরানির মনে আজ কি সুখ, কি সুখ– সুয়োরানি তাকে পাঠিয়েছেন! খুসীমনে খেলেন আনন্দ নাড়ু—- তারপর ? রানী লুটিয়ে পড়লেন মেঝেতে— বুক জ্বালা , পেটব্যথা, বমি, চোখে অন্ধকার —- না, আর হলো না রাজার সাথে তার মিলন আর কোনদিন। ওদিকে খিলখিল করে হাসছেন নিজ মহলে সুয়োরানি , আনন্দ নাড়ুতে যে অনেক খানি সেঁকোবিষ মিশিয়ে ছিলেন । শুধু কি রূপকথা ? রাজবাড়ী , খামারবাড়ি, গৃহস্থবাড়ি , সর্বত্র গুমখুন বা অবাঞ্ছিত লোক অপসারণে দক্ষ ছিল সেকালে, এই সেঁকোবিষ । কি এই সেঁকোবিষ? সাদা এক পাউডার গন্ধ স্বাদ বিহীন। সোজা কথায় “আর্সেনিক” আসলে আর্সেনিক বললেও তা ধাতু আর্সেনিক নয় , অক্সিজেনের সাথে যোগ পদার্থ আর্সেনিক ট্রাই অক্সাইড বা সোডিয়াম আরসিনেট লবন। যা আমরা অবলীলায় ল্যাবে নাড়াচাড়া করতাম।

ল্যাবরেটরিতে আর্সেনিক সালফাইড আমার খুব পছন্দের ছিল , কারণ তার অসাধারণ উজ্জ্বল সোনালি ও কমলা রঙ। আগে রঙ হিসাবে ব্যবহার হতো, বহু পুরনো ফ্রেসকোতে এই সোনালি রঙ বৈচিত্র্যপূর্ণ ছবি আকর্ষণ করার এক কারণ। রোমান অ্যামপায়ার ছাড়াও বিশেষ চিন দেশে, তাদের ড্র্যাগনের গায়ে যে সোনালি হলুদ রঙ চাইই। না, এখন সে হলুদ রঙ আর আর্সেনিক সালফাইড নয়, অন্য উপাদানের ভিন্ন রঙ। “অরপিমেন্ট” মাটির তলে এক আর্সেনিক এর এক আকর যা কিনা আসলে এক বিশেষ “আর্সেনিক সালফাইড “, উজ্জ্বল সোনালি ও কমলা রঙের । রঙ হিসাবে ব্যবহার হতো আগে । চিন দেশের এক রাজকুমার মারা গিয়েছিলেন এক অজানা রোগে পরে জানা যায় তার শোবার ঘরে ফ্রেসকোতে ছিল ঐ আর্সেনিক সালফাইড যা থেকে হয়েছিল দূরারোগ্য এক অসুখ। আর্সেনিক এর অনেক ব্যবহার ছিল ঔষধেও, অনেকটা বিষে বিষক্ষয়, যা বলেছি প্রথমেই।

আর্সেনিক নামটিও এসেছে “আর্সেনিকন” থেকে গ্রীক ভাষায় যার মানে বলবান। ব্যবহার হতো , ইঁদুর, সাপ,কীটনাশক হিসাবে, ঔষধে, রঙ হিসাবে, বাজি ও রঙমশালে আর … (অবশ্যই মানুষ লোপাট করতেও)। এখন ত এর ব্যবহার সব চূড়ান্তভাবে বন্ধ। বন্ধ হয়েছে আর্সেনিক কারখানায় আর্সেনিক সামগ্রী তৈরির। আর্সেনিক কারখানায় বহু শ্রমিক কর্মী আক্রান্ত হতো অজানা এক রোগে আর ঢলে পড়ত মৃত্যুতে। সে অসুখ অনেক পরে আবিষ্কৃত হয় — নাম দেওয়া হয়— “আর্সেনিকসিস”, আর্সেনিক ঘটিত বলে। তবে আর্সেনিক এই কথাটি এখন সকলেই জানেন—- জলদূষণের এক বিভীষিকায় । কারণ পর্যাপ্ত পরিমানে কোন কোন দেশস্থানের জলে মিশে আছে এই পদার্থ। WHO নির্ধারিত জলে তার সহনমাত্রা ছিল প্রথম ০.০১ মিলিগ্রাম প্রতি লিটারে কিন্তু এখন সহনশীলতা বাড়িয়ে করা হয়েছে ০.০৫। তবুও দেখা যায় আতঙ্কিত অবস্থা বহু স্থানে বিশেষ পশ্চিম বঙ্গে, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, মেক্সিকো, ল্যাটিন আমেরিকা । ক্রমাগত এ জলপানে ধীরে ধীরে শরীর কাহিল— ক্ষুধামান্দ, পেট খারাপ,বমিভাব, হাত পায়ের কালো দাগ ঘা (black foot) ইত্যাদি দুর্বল শরীর শেষে কবলিত হয় কর্কট রোগে।

এ আর্সেনিক জলে নিশ্চুপ এক শয়তান —- না আছে রঙ, না আছে গন্ধ, না আনে কোন স্বাদের তারতম্য, কিন্তু নীরব খুনির ভূমিকা পালনে তৎপর। শরীরে ঢুকলে স্থায়ী আস্তানায় গেড়ে বসে। লুকিয়ে জলের মাঝে থাকে, রাসায়নিক পরীক্ষা ছাড়া তার উপস্থিতি বুঝবার উপায় নেই। তাহলে এখন উপায়? কেন স্থানে স্থানে সে জলে হাজির। না, সে নিজে ইচ্ছে করে কিন্তু আসে নি ! এসেছে মানুষের ডাকে , প্রগতির হাওয়ায়, কৃষি কার্যের তৎপরতায় । তার বাস ছিল পৃথিবীর অভ্যন্তরে বিশেষ বিশেষ জায়গায় ( ঐ যা উল্লেখ করলাম) , কিন্তু অনেক কারণের মধ্যে প্রধান হলো।

সেচকর্মের অসংখ্য গভীর নলকূপ, টেনে আনল সেই বিষের থলি , একটু একটু করে পৃথিবীর একদম উপর তলায় । এর আগে আর্সেনিক এর আকর, “realgar” বা “orpiment ” থেকে আর্সেনিক এর পদার্থ তৈরি হতো মাত্র। চূড়ান্ত ভাবে ধরা পড়ল বিংশ শতাব্দীর অষ্টম দশকের দোরগোড়াতে, গ্রামে গঞ্জে দেখা গিয়েছে এক অদ্ভুত অজানা রোগ । সে রোগ আর্সেনিক ঘটিত, অত্যন্ত স্থায়ী যৌগ পদার্থ, ঘাঁটি রয়েছে জলে। নানা সমস্যা ও লক্ষ্মণ নিয়ে অজানা রোগ আতঙ্ক ছড়িয়েছিল প্রথম বিংশ শতাব্দীর সত্তর-আশির দশকে, অবশেষে ধরা পড়ল।

“কলকাতা স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন ” সংস্থায়। (ডারমোটলজিষ্ট ডক্টর কে. সি. সাহা ,তৎপরতায় আরও অনেকের।) আক্রান্তরা সকলেই কিন্তু ষোল বছরের ঊর্ধে!!! কোন শিশু বা কমবয়সীরা নয়। কেন? কারণ আর্সেনিক যুক্ত জল পান ধীরে ধীরে ছোবল মারে ,সময় নেয় কম করেও বারো বছর। নিবন্ধ বড্ড বড়ো হয়ে যাচ্ছে, অনেক কথা, আর দু-চার কথা বলে শেষ করব। আমরা ছোটবেলায় কালী পূজোতে অনেক বাজির সাথে ছিল লাল রঙের “চটপটী” বা “মোমছাল” যা মেঝেতে ঘসলে ফটফট আওয়াজ হতো। ওটা লাল আর্সেনিক,আর্সেনিকের আর এক alltropy । সব পরে বন্ধ । আর্সেনিক আক্রান্ত রোগের চিকিত্সা আছে ঔষধ (DMSA)সংক্ষেপে, অনেক ঔষধের মধ্যে এক। তবে সমস্যা হলো চিকিত্সাতে রোগীর দেহ থেকে আর্সেনিক বেড়িয়ে যায় মূত্রের মাধ্যমে ঠিকই, কিন্তু যাবে কোথায়? পৃথিবীর উপরিভাগে ত, মিশবে মাটিতে, তারপর — ঘুরেফিরে সে আবার পানীয় জলে মিশবে, আবার আমরা সে জল পান করব।

আর্সেনিক ত ভেঙ্গে অন্য কিছু হবে না!! সে যে অজৈব এক ধাতু সন্ধিক্ষণে স্থির। আর কে রেখে আসবে ফেরৎ , ঐ বিষের থলি, আর্সেনিককে আবার ঐ অতল গভীরে মাটির অভ্যন্তরে ? বা কে একাই গ্রহণ করে শিবের মতো নীলকণ্ঠ হয়ে উঠবেন? না, কোন উপায় নেই । আর দুঃখের বিষয় অপুষ্টিগত দরিদ্র মানুষেরাই আক্রান্ত হন স্বাভাবিকভাবে। রাসায়নিকভাবে আর্সেনিক মুক্ত করে জল পান করে মানুষেরা সাময়িকভাবে রক্ষাও পাবে, কিন্তু পরিত্যক্ত আর্সেনিক কে ফেলবে, আর কোথায়? পৃথিবীরপৃষ্ঠের মাটিতেই ত, সে বিষ আবার জলে মিশে আমাদের পানীয় জলেই হানা দেবে, তাহলে? উত্তর জানা নেই । এ হলো আমাদের সভ্যতার আর এক অভিশাপ। এখন প্রশ্ন হলো, পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, ল্যাটিন আমেরিকা ইত্যাদি দেশের জলে যখন এমন ওতপ্রোতভাবে আর্সেনিক মিশে আছে, তাহলে ত বারোবছরের ঊর্ধে সে দেশের সকলেরই ত “আর্সেনিকসিস” হওয়া উচিত। এর জবাব সবচেয়ে সোজা যা হলো প্রতিরোধ ক্ষমতা, সুস্বাস্থ্য ও সতর্কতা।

জল থেকে আর্সেনিক বিতাড়িতও করা যায় নানা পদ্ধতিতে। যদিও সে আর্সেনিক আবার ভূপৃষ্ঠেই পতিত হবে। মুষ্টিমেয় কয়েকজনের কথাও নয়, তৃতীয়বিশ্বে সংখ্যাগুরু দরিদ্রজনেদের কজন জানেন এ খবর। কতজন যে আছেন malnutrition এ ,অপুষ্টিগত অনাহারে যা পান তাই যখন খেতে হয়, সেখানে এ জ্ঞানের কথার কি তাৎপর্য আছে? আমার জেনে কি তাদের অসুখ নিরাময় হবে?

আশ্চর্য হতেও হয়, আর্সেনিকসিস অসুখ জানা হলেই কি , আর কোন ইতিকর্তব্য-পালন নেই। সব জানা হলেই পরে বুঝি সে অসুখ আর থাকে না!!! সে অসুখ কি আর নেই? গ্রামে শহরে অজস্র অপুষ্টিগত শরীরে এ ব্যাধির কবলে কতো লোকের প্রাণনাশ হচ্ছে কে তার খবর রাখে।

বর্তমানে কলেরা টাইফয়েড কি হয় না, হয়, প্রতিকার আছে, যাদের সঙ্গতি আছে, আর যাদের নেই, তারা সব অসুখের কবলে পড়লে যেমন থাকেন। ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, করোনা…. সবাই সোচ্চার …. তবে— সেই অসহায়, (খেতে না পাওয়ায়) অনাহারি , অপুষ্টিগত শরীরে আর্সেনিকসিস থেকে কর্কট রোগ আক্রান্ত মানুষগুলোর কিন্তু শেষ পরিণতিও ঐ একই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *