ত্রিশূলটা সন্তুর হাতে
ত্রিশূলটা সন্তুর হাতে দিয়ে কাকাবাবু টর্চ নিয়ে এগোচ্ছেন সামনে-সামনে। তাঁর পেছনে সন্তু। তারপর জোজো। বিরজু সিং জোজোর চুলের মুঠি ধরে আছে এক হাতে, অন্য হাতে রিভলভারটা রেডি রেখেছে।
সিঁড়িটা শুধু যে সরু তাই নয়, মাঝে-মাঝে দু-একটা ধাপ একেবারে ভাঙা। কাকাবাবু একটা ক্রাচ বাড়িয়ে আগে দেখে নিচ্ছেন পরের ধাপটা আছে কি না, তারপর পা ফেলছেন। সন্তু পেছন থেকে ধরে আছে কাকাবাবুর কোমর, যাতে তিনি হঠাৎ পা পিছলে পড়ে না যান।
সন্তু নিজেই আগে-আগে যেতে চেয়েছিল, কাকাবাবু রাজি হননি। তিনি কয়েকবার জোরে নিশ্বাস টেনে বললেন, একটা বিচ্ছিরি গন্ধ পাচ্ছি। কিসের গন্ধ বলতে পারিস?
সন্তু বলল, বুঝতে পারছি না। কিছু একটা পচা গন্ধ মনে হচ্ছে।
প্রায় তিরিশটা সিঁড়ি নামবার পর টর্চের আলোয় চক চক করে উঠল কালো জল।
কাকাবাবু বললেন, এই রে, এখানে জল দেখছি। কতটা গভীর কে জানে?
সন্তু জিজ্ঞেস করল, আমিনেমে দেখব?
কাকাবাবু বললেন, না, আগেই তোর নামবার দরকার নেই। আমি দেখে নিচ্ছি।
সিঁড়ির ওপর বসে তিনি একটা ক্রাচ বাড়িয়ে দিলেন সামনে। সেটা বেশি ড়ুবল না। মাটিতে ঠকঠক শব্দ হল।
কাকাবাবু বললেন, না, এখানে জল বেশি নেই। সামনে আর সিঁড়িও নেই, শক্ত মাটি। এখন চিন্তার কিছু নেই।
সেই জলের মধ্যে এগোতে-এগোতে এক জায়গায় হাঁটু পর্যন্ত ড়ুবে গেল। তারপর আবার জল কমে গেল। খানিকটা জায়গা একেবারে শুকনো।
কাকাবাবু বললেন, এই রাস্তাটা উঁচু-নিচু। যেখানটা ঢালু, সেখানে জল জমে আছে।
জোজো বলল, এত নীচে জল এল কী করে?
কাকাবাবু বললেন, সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না এখনও।
সন্তু বলল, মাটির তলা থেকে জল উঠতে পারে। এরকম একটা গভীর কুয়ো খুঁড়লে কি জল বেরোত না?
কাকাবাবু বললেন, এসব পাথুরে দেশে অনেক গভীর করে কুয়ো খুঁড়তে হয়। তা ছাড়া যেখানে মাটির তলা থেকে জল ওঠে, সেখানে কি রাজারা গুপ্ত ঘর বানাত? কী জানি, দেখা যাক।
জোজো বলল, এই লোকটা আমার চুল খামচে ধরে আছে কেন?
কাকাবাবু বললেন, সত্যিই তো। ওর চুল চেপে ধরার কী দরকার?
টর্চের আলোটা ঘুরিয়ে তিনি বিরজু সিংকে বললেন, এই, তুমি ওকে ছেড়ে দাও না! আমরা তো আর পালাচ্ছি না এখান থেকে!
বিরজু সিং গম্ভীরভাবে বলল, নেহি! নেহি ছোড়ে গা!
কাকাবাবু বললেন, এ তো আচ্ছা গোঁয়ার দেখছি!
জোজো সন্তুর কোমরে একটা খোঁচা মেরে কী যেন ইঙ্গিত করল। তারপর সে কাকুতিমিনতি করে বলল, ও সিংজি! একবার একটু ছাড়ো। আমার খুব মাথা চুলকোচ্ছে। একবার চুলকে নিই?
বিরজু সিং হাতের মুঠিটা আলগা করল।
জোজো পকেট থেকে হাত বার করে মাথা চুলকোবার জন্য ওপর দিকে হাত তুলেই শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো ছুঁড়ে দিল বিরজু সিং-এর চোখে।
বিরজু সিং মর গয়া, মর গয়া বলে আর্তনাদ করে উঠল। সেই অবস্থাতেই এক হাতে চোখ চাপা দিয়ে অন্য হাতে গুলি চালাতে গেল, সন্তু তার ত্রিশূলটা দিয়ে খুব জোর মারল সেই হাতে।
হাত থেকে রিভলভারটা খসে পড়ে গেলেও বিরজু সিং অন্ধের মতন লাফিয়ে জোজোকে জাপটে গলা টিপে ধরল। এবার সন্তু আর এক ঘা ত্রিশূল কষাল তার মাথায়।
বিরজু সিং আঃ বলে ঢলে পড়ে গেল।
কাকাবাবু বললেন, কী করলি রে, মেরে ফেললি নাকি লোকটাকে?
সন্তু বলল, না। ত্রিশূলের পাশ দিয়ে মেরেছি। গেঁথে দিইনি। অজ্ঞান হয়ে গেছে। জোজো, তুই কী করলি রে, লোকটাকে?
জোজো বলল, সেই শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো। সকালবেলা পকেটে নিয়েছিলাম মনে নেই? কাজে লেগে গেল!
সন্তু বলল, তুই যে এবার সত্যিই দারুণ কাণ্ড করে ফেললি রে, জোজো! আমি আগে বুঝতেই পারিনি।
জোজো ঠোঁট উলটে বলল, এ আর এমনকী? এরকম কত গুণ্ডাকে আমি আগে ঘায়েল করেছি? একবার ইজিপ্টে…
কাকাবাবু বললেন, এবার থেকে জোজোর সব কথাই বিশ্বাস করতে হবে। লোকটাকে যখন অজ্ঞান করেই ফেলেছিস, তা হলে ওর হাত-পা বেঁধে ফ্যাল। নইলে কখন আবার পেছন থেকে এসে ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বে!
জোজো বলল, দড়ি কোথায় পাওয়া যাবে?
কাকাবাবু বললেন, দড়ি পাওয়া যাবে না। তোদের জামা দুটো খুলে তাই দিয়ে বেঁধে দে। হাত দুটো পেছনে নিয়ে গিয়ে বাঁধলে আর খুলতে পারবে না। এখানে দেখছি সামনে একটা দেওয়াল। আর পথ নেই।
টর্চের আলোয় পরীক্ষা করে তিনি সেই দেওয়ালের গায়ে একটা চৌকো গর্ত দেখতে পেলেন। তার মধ্যে ঢুকে গেল ত্রিশূলটা। কাকাবাবু ত্রিশূলটা ডাইনে বাঁয়ে ঘোরাতেই দেওয়ালটাও ঘুরতে লাগল একটু একটু করে, সেই সঙ্গে সুড়ঙ্গের ওপর দিকে বিরাট জোরে শব্দ হতে লাগল। ওপর থেকে যে একটু-একটু আলো আসছিল, তা মুছে গেল।
কাকাবাবু বললেন, আশ্চর্য ব্যাপার। আগেকার দিনের লোকদেরও কতখানি ইঞ্জিনিয়ারিং জ্ঞান ছিল দ্যাখ। এই দেওয়ালটা সরে যেতেই ওপরের সুড়ঙ্গের মুখটা বন্ধ হয়ে গেল।
ওপরের আওয়াজটা এত জোর যে বুক কেঁপে উঠেছিল সন্তু আর জোজোর!
বিরজু সিং-এর রিভলভারটা হাতে তুলে নিয়ে কাকাবাবু বললেন, এটা তো মনে হচ্ছে আমারই। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছি। মোহন সিং আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল। সন্তু, তুই যেমন ব্রিজু সিং-এর মাথা ফাটালি, সেইরকম জগ্গু বলে একটা লোক আজ দুপুরে আমার মাথা ফাটিয়েছে। এখনও মাথাটা টনটন করছে
দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে কাকাবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ও এতক্ষণে মুক্তি পাওয়া গেল। আজ সারাদিন বড় জ্বালিয়েছে ওরা। এবার আর ওপরের শিবলিঙ্গটা ওরা সরাতে পারবে না। ওটা ভাঙতেও পারবে না। কোনও কুলি-মজুরও শিবলিঙ্গ ভাঙতে রাজি হবে না। এখন হিরেটা খুঁজে পাই। বা না পাই, তাতে কিছু আসে যায় না, কী বল?
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, একখানা হিরের জন্য এরা এত কাণ্ড করছে কেন? এই হিরেটা কী-এমন দামি?
কাকাবাবু বললেন, ও, তোরা তো সব ব্যাপারটা জানিস না। আমি সংক্ষেপে বলে দিচ্ছি। বিজয়নগর আর বাহমনি রাজ্যের কথা তো ইতিহাসে কিছুটা পড়েছিস। এই দুই রাজ্যে দারুণ শত্রুতা ছিল। প্রায় দুশো-আড়াইশো বছর ধরে ওদের মধ্যে লড়াই হয়েছে। কখনও বিজয়নগর জিতেছে, কখনও বাহমনি জিতেছে। তারপর হল কী এক সময় বাহমনি রাজ্য ভেঙে পাঁচ টুকরো হয়ে গেল। স্বাভাবিকভাবেই টুকরো-টুকরো হয়ে ওরা দুর্বল হয়ে পড়ল, আর বিজয়নগর হয়ে উঠল খুব শক্তিশালী! বিজয়নগরের রাজা তখন সদাশিব, তিনি ছিলেন অপদার্থ, আসল ক্ষমতা ছিল রাজারই এক আত্মীয়, রাম রায়ের হাতে। এই রাম রায় ছিলেন দারুণ বীরপুরুষ, তিনি অনেকগুলো যুদ্ধ জয় করে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সীমানা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ওদিকে বাহমনির সুলতানরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে মরছে।
জোজো জিজ্ঞেস করল, তা হলে বিজয়নগর ধ্বংস হল কেন?
কাকাবাবু বললেন, হল কী, কয়েকটা যুদ্ধ জয় করার পর ওই রাম রায়ের দারুণ অহঙ্কার হয়ে গেল। তিনি ভাবলেন, বিজয়নগরের সৈন্যদের আর কেউ হারাতে পারবে না। তিনি সুলতানদের খুব অপমান করতে লাগলেন। তখন। মরিয়া হয়ে সেই পাঁচজন সুলতান আবার জোট বাঁধল, তারা একসঙ্গে লড়াই করবে ঠিক করল। তাদের নেতা হলেন আলি আদিল শাহ। সেই পাঁচটি রাজ্যের ফৌজ একসঙ্গে আক্রমণ করতে এল বিজয়নগর রাজ্য। সেখানকার রাজা তো কোনও খবরই রাখতেন না। রাম রায় অহঙ্কার নিয়ে মত্ত ছিলেন। তিনি ভাবতেন, বাহমনির সুলতানরা এই রাজ্য আক্রমণ করতে সাহসই পাবে না। একদিন দুপুরে তিনি খেতে বসেছেন, এইসময় খবর পেলেন, শত্রুপক্ষ তাঁদের রাজ্যের অনেকখানি ভেতরে ঢুকে পড়েছে। খাওয়া ছেড়ে তক্ষুণি উঠে রাম রায় গেলেন যুদ্ধ করতে। তখন তাঁর বয়েস নব্বই-একানব্বই হবে! তবু সাহস ছিল খুব। বুড়ো প্রোফেসর ভগবতীপ্রসাদ শর্মা এই জন্যই রাম রায়ের পার্ট করতে চেয়েছিলেন, তাঁর বয়েসের সঙ্গে মানিয়ে যেত। যাই হোক, রাম রায় তো যুদ্ধ করতে গেলেন, সৈন্যদের বললেন, আলি আদিল আর অন্যান্য সুলতানদের প্রাণে মারবে না। জ্যান্ত ধরে আনবে, আমি তাঁদের খাঁচায় পুরে পুষব। কিন্তু ঘটনা ঘটল ঠিক উলটো। রাম রায় যুদ্ধে যেতে-না-যেতেই শত্রুপক্ষের একটা হাতি পাগলা হয়ে গিয়ে ঢুকে পড়ল এদিকে। সেই পাগলা হাতির তাণ্ডবে কাছাকাছির সৈন্যরা ভয়ে দৌড়তে লাগল। রাম রায় একটা চতুদোলা চেপে ছিলেন, সেটা থেকে তিনি পড়ে গেলেন। অমনি শত্রুপক্ষের কিছু সৈন্য তাঁকে দেখতে পেয়ে ধরে নিয়ে গেল সুলতানের কাছে। সুলতান একটুও দেরি না করে রাম রায়ের মুণ্ডুটা কেটে ফেলে একটা লম্বা বশীর ফলকে গেঁথে উঁচু করে দেখাতে লাগলেন বিজয়নগরের সৈন্যদের। রাম রায়ের কাটা মুণ্ডু দেখেই বিজয়নগরের সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। বিজয়নগরের সৈন্যবাহিনী ছিল বিশাল, ঠিকঠাক লড়াই হলে তারা জিততেও পারত, কিন্তু একজন ভাল সেনাপতির অভাবে তারা গো-হারান হেরে গেল, যে যেদিকে পারল পালাল। যুদ্ধে জয়ী হবার পর আলি আদিল ঠিক করলেন, বিজয়নগরের রাজধানীটাকেই একেবারে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবেন, যাতে এরাজ্য আর কোনওদিন উঠে দাঁড়াতে না পারে। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই বিজয়নগর একেবারে ধ্বংস হয়ে গেল।
সন্তু বলল, পুরো শহরটাকেই ধ্বংস করে দিল?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট, মন্দির-টন্দির সব। হাজার-হাজার লোককে মেরে ফ্যালে। দুটো-একটা মন্দির শুধু টিকে গেছে, আর রাজপ্রাসাদের খানিকটা অংশ। মোটকথা বিজয়নগর চিরকালের মতন ধ্বংস হয়ে গেল, তারপর আর এখানে মানুষ থাকেনি, চারশো বছর ধরে এইরকম ধ্বংসস্তৃপ হয়েই পড়ে আছে।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, তা হলে সেই হিরেটা?
কাকাবাবু বললেন, আঁা, এবার হিরের কথাটা বলছি। তখন ইওরোপিয়ান বণিকরা এদেশে আসতে শুরু করেছে। বিজয়নগরের জাঁকজমক দেখে তারা অবাক হয়ে যেত। ধন-দৌলত, মণি-মাণিক্যের শেষ ছিল না। কেউ-কেউ বলেছে, বিজয়নগর রোমের চেয়েও বড় শহর ছিল। পর্তুগিজ, ইতালিয়ান পর্যটকরা বিজয়নগরের কথা লিখে গেছেন। এখানে তখন অনেক হিরে পাওয়া যেত। গোলকুণ্ডার হিরের খনিও ছিল বিজয়নগর রাজ্যের মধ্যেই। তার মধ্যে কয়েকজন পর্যটক একটা হিরের কথা লিখেছে। যেটা প্রায় অবিশ্বাস্য। সেই হিরেটা নাকি একটা মুরগির ডিমের সমান! পৃথিবীতে এতবড় হিরে আজও কেউ দ্যাখেনি। সেই হিরেটা গেল কোথায়?
সন্তু বলল, সুলতানের সৈন্যরা যখন বিজয়নগর ধ্বংস করে তখন নিশ্চয়ই লুটপাটও করেছিল। তারা সেই হিরেটা পায়নি!
কাকাবাবু বললেন, লুটপাট তো করবেই। গোরুর গাড়ি ভর্তি করে সোনাদানা আর হিরে-জহরত নিয়ে গেছে। রাম রায় মারা যাবার পর রাজা সদাশিবও তাড়াতাড়িতে যা পেরেছেন সোনাদানা নিয়ে পালিয়েছিলেন। কিন্তু মুরগির ডিমের মতন হিরেটা তাঁর কাছে ছিল না। অনেকে বলে যে, বিজয়ী বীর হিসেবে আলি আদিল শাহ সেই হিরেটা পেয়েছিলেন। কিন্তু সেটাও বোধহয় সত্যি না। তারপর সেটা গেল কার কাছে? অতবড় হিরেটা তো হারিয়ে যেতে পারে না? মোগল সম্রাট শাজাহানের কাছে যে কোহিনুর ছিল, সেটা নানান হাত ঘুরে শেষ পর্যন্ত পঞ্জাব কেশরী রণজিৎ সিং-এর নাবালক ছেলের কাছ থেকে ইংরেজরা নিয়ে নেয়। সেটা এখনও ইংল্যান্ডের রানির সম্পত্তি। আর কোহিনূরের চেয়েও বড় একটা হিরে সম্পর্কে সারা পৃথিবীর মানুষের কৌতূহল তো থাকবেই?
জোজো বলল, হিরেটা তা হলে এখানেই আছে?
কাকাবাবু বললেন, বহু লোক এখানে এসে বিজয়নগরের বিখ্যাত হিরেটা খোঁজাখুঁজি করেছে। আমিও একবার এসে খুঁজে গেছি। কেউ কোনও সন্ধান পাইনি। কিন্তু হিরে তো কখনও ভাঙে না, বা নষ্ট হয় না, তা হলে সেটা অদৃশ্য হয়ে যাবে কী করে! অনেকের ধারণা হয়েছে, সেটা নিশ্চয়ই কোনও রাজা-বাদশার হাত থেকে নদীতে বা সমুদ্রে পড়ে গেছে। এ ছাড়া আর কোনও ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু প্রোফেসর ভগবতীপ্রসাদ শর্মা ওই হিরেটার সন্ধানে বহু বছর ধরে লেগেছিলেন, তাঁর দৃঢ় ধারণা ছিল, হিরেটা এখানেই আছে। হঠাৎ কিছুদিন আগে তিনি একটা পুঁথির খোঁজ পান। সেই পুঁথিতে লেখা আছে যে, রাম রায় সেই হিরেটা বিঠলস্বামীর মন্দিরে দান করেছিলেন। অত দামি জিনিস বাইরে রাখা হত না। এই মন্দিরেরই কাছাকাছি কোনও গুপ্ত জায়গায় সাবধানে রাখা থাকত।
সন্তু বলল, পুঁথি মানে কী জানিস তো জোজো? পুরনো আমলের হাতে-লেখা বই। পুঁথির মালার পুঁথি নয়।
জোজো বলল, জানি, জানি। এ তো সবাই জানে!
সন্তু বলল, সুলতানরা এই মন্দিরটা কেন ভাঙল না? এখানে কেন লুটপাট করেনি? আপনি কী কী যেন বাজনার কথা বললেন তখন!
কাকাবাবু বললেন, সেটাও একটা গল্পের মতন। সুলতানদের বাহিনী যখন বিজয়নগর ধ্বংস করার জন্য কামান দাগতে এগোচ্ছে, তখন কামানের আওয়াজ এক-একবার থামতেই তারা সুন্দর টুংটাং, ঝুনঝুন শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। ঠিক যেন কোনও মিষ্টি বাজনার মতন। তারা তো দারুণ অবাক। এইরকম সাঙ্ঘাতিক যুদ্ধের মধ্যেও কে বাজনা বাজাবে? আরও একটু এগিয়ে এসে দেখল, এই মন্দিরের বারান্দায় পাকা চুল-দাড়ি আর ধপধপে সাদা কাপড় পরা একজন পুরোহিত একা দাঁড়িয়ে আছে, আর এই মন্দিরের থাম থেকে আপনি-আপনি বাজনার শব্দ হচ্ছে। তখন সৈন্যরা ভাবল, এটা কোনও অলৌকিক ব্যাপার। তারা ভয়ে আর এই মন্দিরের কাছ ঘেঁষল না। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, এই মন্দিরের থামগুলো বিশেষ কায়দায় তৈরি। কিছু দিয়ে আস্তে টোকা মারলেই সুন্দর গানের সুরের মতন শব্দ হয়। সেদিন কামানের প্রচণ্ড গর্জনে যে ভাইব্রেশান হচ্ছিল, তাতেই মন্দিরের থাম থেকে আপনি-আপনি সুর বেরোচ্ছিল। সেই সুর শুনে সৈন্যরা ভয় পেয়ে পালাল বলেই মন্দিরটা বেঁচে গেল। এখনও এই মন্দিরের থামে টোকা দিলে সেই সুর শোনা যায়। রঞ্জনকেও ওই বাজনা শোনাব বলেছিলাম। ও হ্যাঁ, রঞ্জনেরা কোথায় গেল? রঞ্জন-রিঙ্কুকে দেখিসনি?
সন্তু বলল, না। জোজো আর আমি আগেই অজ্ঞান হয়ে গেলুম ওই শরবত খেয়ে!
জোজো বলল, রঞ্জনদা দেড়-গেলাস খেয়েছিল। হয়তো রঞ্জনদার এখনও জ্ঞান ফেরেনি।
সন্তু বলল, আমাদের চেয়ে রঞ্জনদার চেহারা অনেক বড়। তাড়াতাড়ি হজম করে ফেলতে পারে। কিন্তু আমাদের দুজনকে যেখানে ওরা ফেলে এসেছিল, সেখানে রঞ্জনদা-রিঙ্কুদি বোধহয় ছিল না।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তোদের কোথায় ফেলে দিয়ে এসেছিল?
জোজো বলল, অনেক দূরে একটা পাহাড়ের ওপর জঙ্গলের মধ্যে। আমাদের মেরে ফেলতে চেয়েছিল। যেভাবে আমরা ফিরে এসেছি, তা আপনি শুনলে…
কাকাবাবু বললেন, আচ্ছা, সে-ঘটনা পরে শুনব। রঞ্জন-রিঙ্কুর জন্য চিন্তা হচ্ছে খুব। কিন্তু এখন কিছু উপায়ও তো নেই। এখান থেকে বেরিয়ে ওদের খোঁজ করতে হবে।
জোজো বলল, এখান থেকে আমরা কী করে বেরোব? ওপরে উঠলেই তো ওরা ধরবে!
কাকাবাবু বললেন, না, ওপরে আর ওঠা যাবে না। সাধারণত এই ধরনের সুড়ঙ্গের দুটো মুখ থাকার কথা। শেষ পর্যন্ত গিয়ে তো দেখা যাক। চল, অনেকক্ষণ বিশ্রাম আর গল্প হয়েছে।
জোজো জিজ্ঞেস করল, এই বিরজু সিং এখানে পড়ে থাকবে?
সন্তু বলল, তা না তো কি ওকে টেনে-টেনে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাব নাকি!
জোজো বলল, আমি ওর চুল ধরে নিয়ে যেতে পারি। ও আমার চুলের মুঠি ধরে অনেক ঝাঁকিয়েছে।
কাকাবাবু বললেন, ও এখানেই থাক। পরে ওকে ছেড়ে দেবার একটা কিছু ব্যবস্থা করা যাবে।
খানিকটা এগোতেই সামনে আবার খানিকটা জল দেখা গেল। তার মানে এইখানটা ঢালু। ওরা জলে পা দিতেই একটু দূরে, কী যেন খলবল করে উঠল জলের মধ্যে। তিনজনেই চমকে পিছিয়ে গেল খানিকটা।
জোজো ভয় পেয়ে বলল, সাপ! মাটির তলায় সাপ থাকে?
কাকাবাবু টর্চের আলো ফেলে ভাল করে দেখতে লাগলেন। আর একবার খলবল করে শব্দ হতেই তিনি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, সাপ নয়, মাছ!
সন্তু বললেন, মাটির তলায় সাপ যদিও বা থাকতে পারে, মাছ আসবে কী করে?
কাকাবাবু বললেন, যাত্রাপথে মাছ দেখা শুভলক্ষণ।
সন্তু বলল, এতক্ষণে আর-একটা জিনিস বুঝতে পারলুম। আমরা যে পচা। গন্ধটা পাচ্ছিলুম, সেটা আসলে মাছ পচা গন্ধ। এই জলে মাছ থাকলে তা তো খাবার কেউ নেই। একসময় কিছু-কিছু মাছ মরে পচেও যায় নিশ্চয়ই!
কাকাবাবু বললেন, এটা ঠিকই বলেছিস। মাছ পচা গন্ধই বটে!
জোজো হঠাৎ ভয় পেয়ে কাকাবাবুকে চেপে ধরল, কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, কাকাবাবু, ওটা কী? ওখানে কে বসে আছে?
দৃশ্যটা দেখে ভয় পাবারই কথা। জলটা যেখানে শেষ হয়েছে, ঠিক তার পাশেই দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসানো আছে একটি মানুষের কঙ্কাল। শুধু হাড়গুলোই দেখা যাচ্ছে টর্চের আলোয়, কিন্তু তার বসে থাকার ভঙ্গিটার জন্যই মনে হচ্ছে যেন জীবন্ত। যেন কঙ্কালটা মাথা নিচু করে কিছু একটা চিন্তা করছে, এক্ষুনি মুখ তুলে চাইবে!
কাকাবাবু বললেন, হয়তো চারশো বছর আগে লোকটা ওই গুপ্ত সুড়ঙ্গের প্রহরী ছিল। কোনও একদিন সুড়ঙ্গের মুখটা বন্ধ হয়ে গেছে, আর খোলেনি, ওর চিকারও কেউ শুনতে পায়নি।
সন্তু বলল, কিন্তু বসে-বসে কি কেউ মরে? মরার সময় তো শুয়েই পড়ে সবাই।
কাকাবাবু বললেন, শুয়ে-শুয়ে মরার পরও অনেক সময় মৃতদেহটা আস্তে-আস্তে উঠে বসে। এরকম আমি নিজের চোখে দেখেছি।
জোজো বলল, ওইটার পাশ দিয়ে আমাদের যেতে হবে? সন্তু বলল, ভয়ের কী আছে? কঙ্কাল মানে তো ভূত নয়। এই দ্যাখ, আমি যাচ্ছি।
সন্তু আগে-আগে চলে গেল, জোজো কাকাবাবুকে ধরে রইল। কঙ্কালটার পাশ দিয়ে যাবার সময় সে চোখ বুজে ফেলল।
বেশ জোরে-জোরেই সে বলল, হে ভগবান, এখান থেকে কী করে বেরোব?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, এ-লোকটা প্রহরীই ছিল, ওর পাশে একটা মরচে-ধরা তলোয়ার পড়ে আছে। এখানে প্রহরী বসিয়ে রাখত, তার মানে কাছাকাছি রত্ন ভাণ্ডার থাকার কথা!
জোজো বলল, আমাদের অবস্থাও বোধহয় ওই লোকটার মতনই হবে। সুড়ঙ্গের ওপরটা যদি আর না খোলে!
কাকাবাবু বললেন, অত ঘাবড়ানি রে জোজো, তাতে কোনও লাভ হবে। আগে শেষ পর্যন্ত দেখে নি।
একটু পরেই আবার একটা ঢালু জায়গা, সেখানেও জল জমে আছে। সন্তু ছপছপ করে আগে এগিয়ে গেল। জোজো এখনও কাকাবাবুর হাত ছাড়েনি। একটু অসাবধান হতেই কাকাবাবুর হাত থেকে টর্চটা জলে পড়ে গেল। কাকাবাবু হাত ড়ুবিয়ে টর্চটা খুঁজতে লাগলেন, তাঁর হাতের ওপর দিয়ে দু-একটা মাছ চলে গেল।
সুড়ঙ্গটা অন্ধকার হয়ে গেছে, তারই মধ্যে সামনে একটা হুড়মুড় শব্দ হল। তারপরই সন্তু চেঁচিয়ে উঠলেন, কাকাবাবু! আমায় ধরেছে!
কোনওরকমে টর্চটা তুলে সেদিকে আলো ফেলতেই কাকাবাবু দেখতে পেলেন দুটো জ্বলজ্বলে চোখ। নীল আগুনের টুকরোর মতন।
চোখ দুটো দেখেই কাকাবাবু চিনতে পেরেছেন। কিন্তু এই প্রথম ঘাবড়ে গেলেন তিনি। টর্চের আলো তাঁর হাতে কেঁপে যাচ্ছে। দরদর করে ঘাম বেরোতে লাগল শরীর দিয়ে।
জোজো বলল, ওরে বাবা, ফোঁসফোঁস শব্দ হচ্ছে!
কাকাবাবু বললেন, জোজো, ভয় পাসনি, তুই টর্চটা ধর। ওই চোখ দুটোর ওপর থেকে আলো সরাবি না। সন্তু, নড়াচড়া করিস না। এতবড় সাপের বিষ থাকে না। তুই শুধু নিজের চোখ দুটো ঢেকে থাক। চোখে যেন না কামড়ায়। গুলি করতে পারছি না। তোর গায়ে লাগবে।
কাকাবাবু পিছিয়ে গিয়ে সেই কঙ্কালটার পাশ থেকে মরচে-পড়া তলোয়ারটা তুলে নিয়ে এলেন। ফিরে এসে সন্তুর খুব কাছে এগিয়ে গেলেন। সন্তু আঃ-আঃ করে কাতরাচ্ছে। জোজোর হাতেও টর্চটা কাঁপছে।
কাকাবাবু তলোয়ারের ডগাটা দিয়ে সাপটাকে চেপে একটা খোঁচা মারবার চেষ্টা করলেন। সঙ্গে-সঙ্গে রেগে খুব জোরে ফোঁস করে সাপটা অনেকটা মুখ বাড়িয়ে কামড়াতে এল কাকাবাবুকে। কাকাবাবু বিদ্যুৎবেগে সাপটার গলায় একটা কোপ বসালেন। মরচে পড়া তলোয়ারে সাপটার গলা মোটেই কাটল না, কিন্তু কাকাবাবু তলোয়ার দিয়ে সাপটার মাথা ঠেসে ধরলেন জলের মধ্যে।
সন্তু চেঁচিয়ে উঠল, কাকাবাবু, ও আমার পাটা গুঁড়িয়ে দিচ্ছে।
কাকাবাবু বললেন, লেজের দিকটা চেপে ধরে খোলবার চেষ্টা কর।
প্রাণপণ শক্তিতে ডান হাতের তলোয়ার দিয়ে জলের মধ্যে সাপটার গলা চেপে রেখে কাকাবাবু বাঁ হাত দিয়ে রিভলভারটা বার করলেন। তারপর খুব সাবধানে টিপ করে জলের মধ্যেই গুলি চালালেন দুবার।
তারপর দারুণ পরিশ্রান্তভাবে কাকাবাবু বললেন, সন্তু-জাজো, সাবধান। এরকম সাপ সাধারণত একজোড়া থাকে। আর-একটা আছে বোধহয়। তোরা খুঁজে দ্যাখ। আমি বসে একটু রেস্ট নিই।
সাপটা ময়াল জাতের। সন্তুর পা পড়ে গিয়েছিল ওর গায়ে, সঙ্গে-সঙ্গে ও সন্তুর ডান পায়ে সাতটা পাক দিয়েছিল। আর একটুক্ষণ বেঁচে থাকলেই সাপটা সন্তুর পায়ের হাড় মুড়মুড়িয়ে ভেঙে দিত।
একটু সুস্থ হবার পর জোজোর কাছ থেকে টর্চটা নিয়ে সন্তু সুড়ঙ্গের সামনের দিকটা দুদিকের দেওয়ালের গা ভাল করে দেখতে লাগল। দ্বিতীয় সাপটার কোনও চিহ্ন নেই।
কাকাবাবু আস্তে-আস্তে বললেন, এখানের মাছগুলো ওই সাপের খাদ্য।
সন্তু সে-কথা শুনতে পেল না। সুড়ঙ্গের একদিকের দেওয়ালে কুলুঙ্গির মতন একটা জায়গায় কাটা। সেখানে আলো ফেলতেই কী-যেন ঝকঝক করে উঠছে। সে বারবার সেখানে আলো ফেলছে। ওখানেই কি দ্বিতীয় সাপটা আছে, তার চোখ ঝকঝক করছে?
কাকাবাবুও সেই আলোর ঝিলিক দেখতে পেলেন একবার। সঙ্গে-সঙ্গে প্রায় লাফ দিয়ে উঠে এসে তিনি চিৎকার করে বললেন, বিজয়নগরের হিরে?
কুলুঙ্গিতে ভেতরের দৃশ্যটা অদ্ভুত!
সামনেটা কড়সার জাল দিয়ে প্রায় ঢাকা। সেই জাল ছিড়তেই দেখা গেল, সেখানেও বসানো রয়েছে একটা বাচ্চা ছেলের কঙ্কাল। মাত্র তিন-চার বছরের শিশুর কঙ্কাল বলে মনে হয়। সেই কঙ্কালটার সামনে অনেকরকম লাল-সবুজ-নীল পাথরের টুকরো ছড়ানো। কঙ্কালটার ঠিক কোলের কাছে রয়েছে, অবিকল মুরগির ডিমের মতনই একটা পাথর, আলো পড়লেই তা থেকে চোখ ধাঁধানো দীপ্তি বেরিয়ে আসছে।
কাকাবাবু খুব সাবধানে সেই পাথরটা বার করে এনে বললেন, তা হলে সত্যি আছে। বিজয়নগরের হিরে। প্রোফেসর শর্মা এখানে থাকলে কত খুশি হতেন। এটা আবিষ্কারের কৃতিত্ব আমরা প্রোফেসর শর্মাকেই দেব, কী বলিস, সন্তু?
সন্তু বলল, আমি একবার হাতে নিয়ে দেখব?
জোজো আর সন্তু দুজনেই হিরেটাকে ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখল। হাতে নিলে খুব একটা সাঙ্ঘাতিক কিছু বলে মনে হয় না। এর যে এত দাম বোঝাও শক্ত।
কাকাবাবু বললেন, অনেক কালের ধুলো জমেছে। পালিশ করাতে হবে। নতুন করে কাটাতেও হবে। ঠিক মতন কাটার ওপরেই হিরের সৌন্দর্য ঠিকমতন খোলে। অন্য পাথরগুলোও খুব দামি হবে নিশ্চয়ই, ওগুলোও পকেটে ভরে নে। এবার শিগগির বেরিয়ে পড়তে হবে।
জোজো রঙিন পাথরগুলো পকেটে ভরতে ভরতে বলল, কোনদিক দিয়ে বেরোব?
কাকাবাবু বললেন, সাপটাকে দেখে একটা জিনিস বোঝা গেল। মাছ। দেখেও আমার সেই কথাই মনে হয়েছিল আগে। এখানে বাইরে থেকে জল ঢুকে পড়ে। খুব সম্ভবত কাছাকাছি একটা নদী আছে। জলের সঙ্গে মাছও আসে, তারপর ঢালু জায়গাতে আটকে যায়। সেই মাছ খেতে সাপ আসে। সুতরাং নদীর দিকে একটা বেরোবার রাস্তা আছেই।
এরপর আরও দুজায়গায় ঢালু জলাশয় পড়ল। প্রত্যেকটাতেই দ্বিতীয় সাপটা আছে কি না ভাল করে দেখে নিয়ে তারপর ওরা নামল। এদিকের মাছগুলো ছোট-ঘোট মৌরলা মাছের মতন, জলও অনেক পরিষ্কার। পাথরের দেওয়াল পড়ল আর একটা। সেটা খুলতে হল ত্রিশূল দিয়ে।
সুড়ঙ্গটা একটা বাঁক নিতেই দেখা গেল একটা লোহার দরজা। কিন্তু তার একটা দিক কিছুটা ভাঙা। সেখান দিয়ে এখনও জল ঢুকছে একটু-একটু।
কাকাবাবু বলেছিলেন না, এইসব সুড়ঙ্গে রাজারা সবসময় একটা বেরোবার রাস্তা রাখত। বহুকালের পুরনো দরজা, জল লেগে মরচে পড়ে খানিকটা ভেঙে গেছে।
দরজাটায় ভেতরের দিকে হুড়কো লাগানো। সেটা ধরে খানিকক্ষণ টানাটানি করতে খুলে গেল। দরজাটা ফাঁক করতেই দেখা গেল একটু নীচে একটা নদী।
বাইরে এসে বড়বড় নিশ্বাস নিয়ে কাকাবাবু বললেন, আঃ, কী আরাম! ভেতরে যেন দম আটকে আসছিল শেষ দিকে।
সন্তু বলল, ভোর হয়ে আসছে। একটু-একটু আলো ফুটেছে।
জোজো বলল, সত্যি বেঁচে গেলুম! আঁ? এই সন্তু!
বাইরের জায়গাটা উঁচু ঢিবির মত। চতুর্দিকে ঝোপঝাড় হয়ে আছে। সেইজন্যই লোহার দরজাটা দেখা যায় না। অবশ্য ভেতরেও সুড়ঙ্গের মাঝখানে নিরেট পাথরের দেওয়াল আছে। ত্রিশুলের চাবি ছাড়া যা খোলা যায় না। সেই পাথরের দেওয়ালের তলা দিয়ে জলের সঙ্গে সাপ বা মাছ যেতে পারে। মানুষের গলে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
কাকাবাবু বললেন, আমাদের চেষ্টা করতে হবে নদীটা পার হয়ে যেতে। তারপর হসপেটে গিয়ে বাঙ্গালোরে ফোন করে সব জানাব। হসপেট থানা থেকে পুলিশ এনে ধরতে হবে মোহন সিং-এর দলটাকে।
সন্তু বলল, কাকাবাবু, ওই দেখুন, খানিকটা দূরে একটা গোল নৌকো দেখা যাচ্ছে। ওটা বোধহয় খেয়াঘাট। ওখান দিয়ে নদী পার হওয়া যাবে।
কাকাবাবু বললেন, চল তা হলে, ওইদিকেই যাই। এখন বিশ্রাম নিলে চলবে না। নদীটা পার হওয়া আগে দরকার।
পুব আকাশে লাল রঙের সূর্য উঠছে। আশ্চর্য ব্যাপার, ভোরের সূর্যের রং টুকটুকে লাল হলেও ভোরের আলোর রং নীলচে। শোনা যাচ্ছে পাখির কিচিরমিচির।
কাকাবাবু এক জায়গায় থমকে গিয়ে বললেন, দিনের আলোয় একবার হিরেটা দেখি। এটা তো গভর্নমেন্টকে দিয়ে দিতেই হবে, তার আগে একবার ভাল করে দেখে নি।
কাকাবাবু সূর্যের দিকে মুখ করে দুহাত ঘুরিয়ে হিরেটা দেখছেন আচমকা টিবির ওপর থেকে একটা লোক লাফিয়ে পড়ল তাঁর সামনে। লোকটার হাতে একটা রাইফেল! তারপরই নেমে এল একটি মেয়ে। কস্তুরী আর জগগু!
কস্তুরী বলল, রায়চৌধুরীবাবু, আপনি খুব ধোঁকাবাজ তাই না? আমাকে ফাঁকি দেবেন! আপনি কস্তুরীকে চেনেননি ভাল করে। দুঘন্টা ধরে বসে আছি এখানে। আপনাদের জন্য। দিন, আমায় হিরেটা দিন?
কাকাবাবু জগগুর দিকে তাকালেন। জগগুর মুখখানা বুলডগের মতন, চোখদুটো স্থির। রাইফেলের ট্রিগারে তার হাত। কস্তুরীর হুকুম পেলেই সে যে গুলি চালাবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
কস্তুরী বলল, দিন, দিন, হিরেটা দিন।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী করে এখানে এলে? কী করে বুঝলে যে…
কস্তুরী বলল, অত কথা বলার সময় নেই। আমি তিন গুনব, তার মধ্যে হিরেটা দিন আমার হাতে, নইলে এই জগ্গু…এক, দুই…
কাকাবাবু হিরেটা কস্তুরীর হাতে তুলে দিলেন।
কস্তুরী হিরেটাতে চুমু খেতে-খেতে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, পেয়েছি-পেয়েছি, শেষ পর্যন্ত পেয়েছি, সব কষ্ট সার্থক। বুঝলেন, বাঙালিবাবু, আমি বিঠলস্বামীর মন্দিরের পুরুতকে জেরা করে জেনেছি, এদিকে নদী আছে কি না। পুরুত এই সুড়ঙ্গের কথাও তার বাবার মুখে শুনেছে, কিন্তু কোনওদিন খুলতে দ্যাখেনি। আমি ঠিক বুঝতে পেরে চলে এসেছি নদীর ধারে। সুড়ঙ্গের একটা মুখ এদিকে থাকবেই।
কাকাবাবু বললেন, তোমার বুদ্ধি আছে, তা স্বীকার করতেই হবে।
কস্তুরী বলল, হিরে পেয়ে গেছি, এবার আমিও আমার কথা রাখব। আপনাদের প্রাণে মারব না। তবে আপনারা আর আমাকে ফলো করবার চেষ্টা করবেন না। আমি নদী পেরিয়ে হসপেট স্টেশনে চলে যাব। তারপর সোজা বোম্বাই। চল, জগ্গু!
জগ্গু কর্কশ গলায় বলল, ঠারো! ত্রিশূল লেও, পিস্তল লেও!
কস্তুরী বলল, ঠিক, ঠিক তো। জগ্গুর সব মনে থাকে। ত্রিশূল আর রিভলভার দিয়ে দিলেই আর কোনও ঝঞ্ঝাট থাকবে না! দিন!
জগঞ্জ রাইফেলের নলটা নিচু করতেই সন্তু ত্রিশূলটা দিয়ে দিল কস্তুরীর হাতে। কাকাবাবুও পকেট থেকে বার করে রিভলভারটা দিতে বাধ্য হলেন।
সঙ্গে-সঙ্গে পিছন ফিরে কস্তুরী দৌড় মারল। জগগু যেতে লাগল আস্তে-আস্তে, চারদিক দেখেশুনে।
ওরা একটু দূরে চলে যাবার পর কাকাবাবু বললেন, এবার ওই জগগু যদি কস্তুরীকে মেরে হিরেটা নিয়ে নেয়, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। হিরে অতি সাঙ্ঘাতিক জিনিস। একটা হিরের জন্য কত মানুষ খুন হয়। তার ঠিক নেই।
সন্তু বলল, তা বলে ওই লোকটা হিরেটা নিয়ে নেবে।
জোজো বলল, ইশ, যদি আর খানিকটা শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো থাকত, তা হলে ওই জগ্গু ব্যাটাকে..।
কাকাবাবু বললেন, হসপেট থেকে বম্বে যেতে গেলে ট্রেনে কিংবা গাড়িতে ছাড়া যেতে পারবে না। তারমধ্যেই থানায় পৌঁছে ওদের ধরার ব্যবস্থা করতে হবে।
গোল নৌকোটার কাছে গিয়ে আগে কস্তুরী তাতে উঠে বসে বৈঠা হাতে নিল। এরপর জগগু উঠে রাইফেলটা উঁচিয়ে এদিকে চেয়ে রইল।
নৌকোটা ছাড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কোথা থেকে যেন একটা বিরাট পাথরের চইি এসে পড়ল নৌকোটার ঠিক পাশ ঘেঁষে জলের মধ্যে। অমনি জগঞ্জ এদিকে গুলি চালাল একবার।
কাকাবাবু বললেন, শুয়ে পড়, শুয়ে পড়। আমরা কিছু করিনি, তবুও আমাদের মারতে চাইছে। আমরা এতদূর থেকে অতবড় পাথর ছুঁড়ব কী করে?
জোজো শুয়ে পড়ে ফিসফিস করে বলল, কে পাথর ছুঁড়ল? মোহন সিং?
ঢিবির ওপর থেকে আবার একটা পেল্লায় পাথর এসে পড়ল গোল নৌকোর ওপরে। আর-একটা জগগুর মাথায়। এর মধ্যে নৌকোটাও উলটে গেছে, কস্তুরী আর জগ্গু পড়ে গেছে জলে।
কাকাবাবু বললেন, কী ব্যাপার হল কিছু বুঝতে পারছি না। কেউ কোনও শব্দ করিস না। চুপচাপ শুয়ে থাক। দেখা যাক, এরপর কে আসে।
এবার শোনা গেল একটা উঁচু গলায় গান! একজন কেউ গাইছে, হোয়েং গেল! হোয়েং গেল!
খানিকদূরে টিবির ওপর থেকে গড়িয়ে নেমে এল রঞ্জন আর রিঙ্কু! কস্তুরী সাঁতার জানে না। সে জলে হাবুড়ুবু খাচ্ছে। রিঙ্কু জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে টেনে তুলল তাকে।
রঞ্জন বলল, ও ব্যাটাকে তুলো না, ও একটু নাকানিচোবানি খাক।
সন্তু রঞ্জনদা বলে চিৎকার করে ছুটে গেল ওদের দিকে!
কাকাবাবু হেসে বললেন, রঞ্জনটা একটা খেলা দেখাল বটে। আমি তো শেষ মুহূর্তে আশাই ছেড়ে দিয়েছিলুম।, চল, জোজো।
কস্তুরী মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে হাপুস নয়নে কাঁদছে আর বলছে, আমার হিরে! জলে ড়ুবে গেল! আমার হিরে! কী সর্বনাশ হল। কেন আমাকে জল
থেকে তুললে! সব গেল। সব গেল!
জোজো হতাশভাবে বলল, কাকাবাবু, হিরেটা জলে ড়ুবে গেল! এত কাণ্ডের পরও হিরেটা রাখা গেল না!
কাকাবাবু হাঁটতে-হাঁটতে বললেন, এই নদীতে বেশি জল নেই। জেলে এনে জাল ফেলে দেখতে হবে। পাওয়া যাবে মনে হয়! পেতেই হবে!
রঞ্জন রিঙ্কুকে জিজ্ঞেস করল, এ-মেয়েটা এত কাঁদছে কেন? মোটে একখানা হিরে গেছে, তাতে কী হয়েছে?
সন্তু বলল, ও রঞ্জনদা! তুমি তো হিরেটার কথা কিছুই জানো না। এটা বিজয়নগরের হিরে, ওয়ার্লড ফেমাস, এটার জন্য আমরা কত কষ্ট করেছি…
রঞ্জন সন্তুর কাঁধ চাপড়ে বলল, আরে, রাখ তো হিরের কথা। হিরে মানে তো কয়লা! একটুকরো কয়লাও যা, একটা হিরেও তা।
তারপর সে কাকাবাবুকে দেখে আনন্দে দুহাত তুলে বিশাল শরীর নিয়ে নেচে-নেচে গাইতে লাগল। হোয়েং গেল! সবং কিছুং ঠিকঠাকং হয়েং গেল! কাকাবাবু, কেমং আছেন?
কাকাবাবু মুচকি হেসে বললেন, আর একটু কাজ বাকি আছে। চলল, আগে ওপারে যাওয়া যাক। আমি আর কস্তুরী আগে খেয়া নৌকোয় যাব। তোমরা জগ্গুর ওপরে নজর রাখো, ওকে ওপারে নিয়ে যাবার দরকার নেই।
কাকাবাবু এগিয়ে গিয়ে কস্তুরীর হাত ধরলেন। কস্তুরী জোর করে হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে বলল, আমি এখন যাব না!
কাকাবাবু তার চোখের দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললেন, এখন আমি যা বলব, তাই-ই তোমাকে শুনতে হবে। চলো, দেরি করো না!
গোল নৌকোটায় উঠে কাকাবাবু বসে পড়লেন। তাঁর চোখের ইঙ্গিত পেয়ে রঞ্জন আর সন্তু কস্তুরীকে প্রায় চ্যাংদোলা করে তুলে দিল।
মাঝ নদীতে এসে কাকাবাবু বললেন, কস্তুরী, এত কষ্ট করে উদ্ধার করার পরও হিরেটা হারিয়ে গেল? ছি ছি ছি, কী দুঃখের কথা!
কস্তুরী বলল, নৌকোটা উল্টে গেল যে হঠাৎ! হিরেটা জলে পড়ে গেল। এর চেয়ে আমার ড়ুবে মরা ভাল ছিল! কত টাকা খরচ করেছি! কত কষ্ট করেছি, সব গেল?
কাকাবাবু বললেন, নদীতে পড়লেও আবার ভোলা যেতে পারে। অত নিরাশ হচ্ছ কেন? এই জায়গাতেই তো পড়েছিল, তাই না?
কস্তুরী খানিকটা ঝুঁকে পড়ে বলল, প্রায় এই জায়গায়। নদীতে স্রোত আছে। বোধহয় দূরে সরে গেছে।
কাকাবাবু বললেন, একবার ড়ুব দিয়ে দ্যাখো তো, পাওয়া যায় কি না!
কস্তুরী আঁৎকে উঠে বলল, আমি ড়ুব দেব? আমি সাঁতার জানি না।
কাকাবাবু বললেন, তাতে কী হয়েছে? একবার ড়ুব দাও, তারপর তোমাকে আমি ঠিক তুলব।
কস্তুরী দু হাত ছড়িয়ে বলল, না, না, না, আমি পারব না। আমি পারব।
কাকাবাবু বজ্র কঠিন হাতে কস্তুরীর কাঁধ চেপে ধরে বললেন, তোমাকে ড়ুব দিতেই হবে। কিংবা, হিরেটা যদি তুমি লুকিয়ে রেখে থাকে, তা হলে ভালয় ভালয় আমাকে দিয়ে দাও! ওটা সরকারের সম্পত্তি।
কস্তুরী বলল, আমি লুকিয়ে রাখিনি! মিঃ রায়চৌধুরী, বিলিভ মী! জলে পড়ে গেছে।
কাকাবাবু বললেন, তা হলে তোমাকে ড়ুব দিতেই হবে। ঠিক একটা পুতুলের মতন কাকাবাবু তাকে উঁচুতে তুলে জলে ফেলে দিলেন।
পাড়ে রঞ্জন, রিঙ্কু, জোজো আর সন্তু অবাক হয়ে এদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রঞ্জন রিভলভারটা ঠেকিয়ে রেখেছে জগ্গুর পিঠে।
কস্তুরী জলে ড়ুবতে ড়ুবতে কোনওরকমে একবার মাথা তুলতেই কাকাবাবু তার একটা হাত ধরে বললেন, পেলে না? আবার ড়ুব দেবে? না, তোমার। কাছেই আছে, এখনও বলো!
দারুণ আতঙ্কে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে কস্তুরী কোনওরকমে বলল, আমার কাছে নেই, আমার কাছে নেই! আমি শপথ করছি।
কাকাবাবু বললেন, তা হলে আবার ড়ুব দাও।
কাকাবাবু কস্তুরীর মাথাটা জলের মধ্যে ঠেসে ধরে রইলেন। প্রায় মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল কস্তুরী।
তারপর কাকাবাবু আর একবার তাকে তুলতেই সে, কোনওক্রমে দম আটকানো গলায় বলল, বাঁচান! আছে?
কাকাবাবু এবার এক ঝটকায় কস্তুরীকে তুলে আনলেন নৌকোর ওপরে। হাসতে হাসতে বললেন, কোনও মেয়ে অত দামি একটা হিরে চট করে জলে ফেলে দেবে, এ আমি বিশ্বাস করতে পারি? কোথায় লুকিয়েছ, বার করো!
কস্তুরী হাঁপাতে হাঁপাতে দম নিতে লাগল। জ্বলন্ত চোখে চেয়ে রইল কাকাবাবুর দিকে। কাকাবাবু হাসলেন। কস্তুরী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। তারপর জামার ভেতর থেকে বার করে আনল সেই মুর্গীর ডিমের সমান হিরেটা।
কাকাবাবু সেটা উঁচু করে তুলে সন্তুদের দেখিয়ে বললেন, এই দ্যাখ, পাওয়া গেছে!
রঞ্জন আবার দু হাত তুলে নাচতে নাচতে গেয়ে উঠল, হোয়েং গেল! পাওয়াং গেল! সত্যি সত্যি বিজয়নগরের হিরে পাওয়া গেল। হোয়েং গেল! খেল খতম্!…