রিঙ্কুকে আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে
রিঙ্কুকে আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে সেই মাটির নীচের ঘরটায়। সেখানে অবশ্য এখন মোম জ্বলছে। সেই মোমের পাশে চুপটি করে বসে আছে জানকী। তার অবশ্য মুখ আর হাত-পায়ের বাঁধন এখন খোলা।
জানকীকে দেখে রিঙ্কুর একটু লজ্জা করল। সে মুখটা ফিরিয়ে রইল অন্যদিকে।
জানকী শান্ত গলায় বলল, এসো বহিন! আমি তোমার ওপর রাগ করিনি। আমি তো আগে জানতাম না যে, তোমাদের এরা জোর করে ধরে রেখেছে। আমাকে বলেছিল, তুমি একটু পাগল। তাই তোমাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করাই ছিল আমার কাজ। তোমাকে এরা কেন ধরে রেখেছে?
রিঙ্কু মুখ না ফিরিয়ে বলল, আমি কী কররে জানব?
জানকী বলল, আর-একজন খোড়াবাবুকেও নাকি এরা হাত-পা বেঁধে রেখে। দিয়েছে।
এবারে রিঙ্কু মুখ ফিরিয়ে ব্যস্তভাবে বলল, কোথায়? কোথায়?
জানকী বলল, সেটা ঠিক জানি না। ওপরের সেপাইটা বলল। তোমাকে দিয়ে জোর করে ফিল্মের পার্ট করাতে চাইছে কেন তাও তো বুঝি না! আমি কত ফিল্মের মেকআপের কাজ করেছি, এরকম কখনও দেখিনি!
রিঙ্কু জিজ্ঞেস করল, আমাদের সঙ্গে আরও যারা ছিল, একজন দাড়িওয়ালা, বেশ লম্বা-চওড়া চেহারা, সে কোথায় আছে জানো? আরও দুটি অল্প বয়েসী ছেলে?
জানকী বলল, তাদের কথা তো কিছু শুনিনি। তুমি পালাতে পারলে না? ধরা পড়লে কী করে?
রাগে-দুঃখে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে রিঙ্কু বলল, গেটের কাছের। পুলিশগুলোই তো আমাকে ধরিয়ে দিল। পুলিশের কাছে সাহায্য চাইলুম, কস্তুরী এসে পড়ল সেই সময়ে!
জানকী বলল, ওই কস্তুরী দেবী বড় হিংসুটি! অন্য কোনও সুন্দরী মেয়েকে ও সহ্য করতে পারে না। তোমাকে খুব কষ্ট দেবে। এখন তো শুনছি, সুজাতাকুমারীর পার্টের যে-জায়গাটা ডামি দিয়ে করাবার কথা, সেই জায়গাটা তোমাকে দিয়ে করাবে।
রিঙ্কু বলল, ডামি মানে?
জানকী বলল, সিনেমায় ডামি কাকে বলে জানো না? মনে করো, ফাইটিং সিন। হিরো একজনের সঙ্গে ঘুমোঘুসি করছে। সেখানে কিন্তু সত্যিকারের। হিরো লড়ে না। হিরোর মতন পোশাক পরে আর-একজন খুব ঘুসি চালায়, ক্যামেরার কায়দায় তাকেই হিরো মনে হয়। তাকেই বলে ডামি। সেইরকম হিরোইন যখন ঘোড়া ছুটিয়ে যায় কিংবা জলে ঝাঁপ দেয়, সত্যিকারের। হিরোইনরা তো ওসব পারে না। অন্য একজন করে দেয়।
আমাকে দিয়ে কী করাতে চায় ওরা?
আমি তো স্টোরিটা সব জানি না। একটু পরেই তোমাকে এসে ওরা বলবে। তুমি শাড়িটা বদলে নাও।
আমার হাত যে বাঁধা! এই অবস্থায় শাড়ি বদলাব কী করে? আমার হাত খুলে দাও।
ওরে বাবা, আমি খুলে দিতে পারব না। আমাকে মেরে ফেলবে। তুমি তখন আমার মুখ বেঁধে পালিয়ে গেলে, সেইজন্য ওরা এসে আমায় কী করেছে জানো? এই দ্যাখো, আমার মাথার চুল কেটে দিয়েছে!
আমার এইরকম হাত বাঁধাই থাকবে? তাই তো বলেছে। আচ্ছা, আমি তোমায় শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছি। রিঙ্কু দেওয়ালের দিকে সরে গিয়ে বলল, খবদার! আমি মোটেই আমার শাড়ির বদলে এই শাড়ি পরব না।
জানকী বলল, এই রে! তা হলে আমি কী করি! ঠিক আছে! শাড়ি এখন নাই-বা বদলালে। তোমাকে মেকআপটা করে দিই? চোখে কাজল দিতে হবে। গালে লাল রং মাখতে হবে।
রিঙ্কু বলল, আমি ওসব কিছু মাখব না। কিছুতেই মাখব না!
জানকী কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলল, তুমি কোনও কথাই শুনবে না? আমি তো তোমার ওপর জোর করতে পারব না!
রিঙ্কু বলল, তুমি যখন এদের দলে নও, তা হলে তুমি বরং একটা কাজ করো। তুমি বাইরে গেলে তো তোমাকে আটকাবে না। তুমি গিয়ে দেখে এসো, সেই যে খোঁড়া ভদ্রলোককে ওরা হাত-পা বেঁধে রেখেছিল, তিনি ছাড়া পেয়েছেন কি না। আর-একজন লোককে খুঁজবে, ওই বললুম, সারা মুখে দাড়ি, লম্বা-চওড়া, মাথার চুল বাবরি মতন, তাকে বলবে যে, আমাকে এখানে আটকে রেখেছে। আমার নাম রিঙ্কু!
জানকী বলল, এই অন্ধকারের মধ্যে আমি তাদের কোথায় খুঁজে পাব?
একটুখানি ঘুরে দ্যাখো। বুঝতে পারছ না, আমাদের কতখানি বিপদ। ওরা যদি কাকাবাবুকে মেরে ফ্যালে, উনি কতবড় একজন নামকরা লোক, তুমি জানো?
আমি বাইরে বেরিয়ে ঘোরাঘুরি করলে ওরা সন্দেহ করবে।
একটু সাবধানে ঘুরবে। রঞ্জনকে একটা খবর দিতেই হবে। ও হ্যাঁ, ওই দাড়িওয়ালা লোকটির নাম রঞ্জন। জানকী, প্লিজ যাও!
আমার ভয় করছে, বহিন।
মানুষ বিপদে পড়লে তুমি এইটুকু সাহায্য করবে না?
যদি আমি ধরা পড়ে যাই?
তুমি কেন ধরা পড়বে, তোমাকে তো ওরা আটকে রাখেনি। তুমি কাজ করতে এসেছ। যাও, লক্ষ্মীটি, আমাদের বিপদ কেটে গেলে তোমাকে আমি এক জোড়া সোনার দুল উপহার দেব।
জানকী থুতনিতে আঙুল দিয়ে চিন্তা করতে লাগল।
রিঙ্কু তাকে তাড়া দিয়ে বলল, যাও, আর দেরি করো না।
জানকী বলল, ঠিক আছে, যাচ্ছি! তুমি… তুমি ততক্ষণ অজ্ঞান হবার ভান করে শুয়ে থাকো। আমায় যদি কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে, আমি বলব, তুমি অজ্ঞান হয়ে গেছ বলে আমি ওষুধ আনতে যাচ্ছি। ওরা দেখতে এলে তুমি অজ্ঞান সেজে থাকতে পারবে তো?
রিঙ্কু মাথা নেড়ে বলল, তা পারব না কেন? অজ্ঞান সাজা আবার শক্ত নাকি?
জানকী বলল, তা হলে তুমি চোখ বুজে শুয়ে পড়ো! রিঙ্কু মোমবাতিটার দিকে তাকাল, সে মনে-মনে ঠিক করে ফেলেছে, জানকী চলে গেলেই সে মোমবাতির শিখায় তার দড়ির বাঁধনটা পুড়িয়ে ফেলবে। তারপর যা হয় দেখা যাবে।
জানকী সিঁড়ির দিকে এগোতেই শপাং করে একটা চাবুকের ঘা পড়ল তার মুখে। জানকী ভয়ে একেবারে হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠল।
সিঁড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে এল মোহন সিং। জানকীর দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, আমি সব শুনেছি। তুই আবার একে সাহায্য করছিলি? এবার তোকে বাঁধব।
জানকী হাত জোড় করে বলল, সাহেব, আমার কোনও দোষ নেই। আমার কোনও দোষ নেই। আমি ওকে মিথ্যে কথা বলে আপনাদেরই খবর দিতে যাচ্ছিলাম। ও শাড়িটা বদলাতে চাইছে না। ওই মিলের শাড়ি পরে ও কী করে হিস্টোরিক্যাল বইতে পার্ট করবে?
মোহন সিং বলল, ওতেই হবে! মেয়েটা যদি যেতে না চায়, জোর করে ওকে তুলে নিয়ে যাব। তুই মাথার দিকটা ধর, আমি পা দুটো চেপে ধরছি।
রিঙ্কু সঙ্গে-সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমাকে নিয়ে যেতে হবে না। আমি নিজেই যাচ্ছি।
মোহন সিং রিঙ্কুর হাতের দড়িটা ধরে টেনে বলল, চল!
মাঠের মধ্য দিয়ে রিঙ্কুকে টানতে-টানতে এনে দাঁড় করানো হল বিলস্বামী মন্দিরের পেছন দিকটায়। সেখানে এখন বড় বড় আলো জ্বেলে একটা ক্যামেরা সাজানো হয়েছে। দশ বারোজন লোক ঘোড়ায় চেপে বসে আছে। আগেকার দিনের সৈন্যদের মতন সাজপোশাক করে। নকল শর্মাজির ছবি তোলা হচ্ছে সেইসব অশ্বারোহী সৈন্যদের সঙ্গে।
রিঙ্কুকে একজন লোকের সামনে বসিয়ে দিয়ে মোহন সিং বলল, দেখিস একে! আমি আসছি!
ছোট ভাঙা মন্দিরটার মধ্যে সেই শিবলিঙ্গটিকে অনেক ঠেলাঠেলি করেও আর এক চুলও নড়ানো যায়নি। সুড়ঙ্গের মধ্যে যে কী হচ্ছে তা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। চারজন বন্দুকধারী গার্ডকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে তার চারপাশে।
বিঠলস্বামী মন্দিরের বৃদ্ধ পুরোহিতকে ঘুম থেকে তুলে এনে কস্তুরী বারবার। জিজ্ঞেস করে চলেছে, এই শিবলিঙ্গটাকে সে কখনও সরতে দেখেছে কি না। বৃদ্ধটি বারবার মাথা নেড়ে বলে যাচ্ছে, সে জীবনে কখনও দ্যাখেনি।
মোহন সিং এসে কস্তুরীকে বলল, এখানে তো পাহারা রইলই। চলো, ততক্ষণ আমরা শুটিং সেরে আসি?
কস্তুরী বলল, তুমি আগে তোমারটুকু করে নাও। আমি পরে যাব। ওই মেয়েটার মুখখানা ভাল করে মাটির সঙ্গে ঘষে দিও!
মোহন সিং বলল, রায়চৌধুরী কোথায় পালাবে? আমি তাকে কিছুতেই ছাড়ব না!
তারপর সে শিবলিঙ্গের নীচের বেদীটার চৌকো গর্তে মুখ দিয়ে বলল, রায়চৌধুরী, ভাল চাও তো বেরিয়ে এসো। তোমাদের দলের মেয়েটার গা থেকে আমি ছাল ছাড়িয়ে নিচ্ছি।
মোহন সিং-এর কথা সুড়ঙ্গের মধ্যে পৌঁছল কি না কে জানে। ভেতর থেকে কোনও উত্তর এল না।
কস্তুরী বলল, আমি অনেক চেষ্টা করেছি। কোনও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।
মোহন সিং দপদপিয়ে বেরিয়ে গেল সেই মন্দির থেকে। শুটিং-এর জায়গায় গিয়ে বলল, আরম্ভ করো।
খুব রোগা লিকলিকে চেহারার একজন লোককে মনে হল পরিচালক। সে বলল, আমি সিনটা আগে বুঝিয়ে দিচ্ছি। ঘোড়ায় চড়া সৈন্যরা প্রথমে দুজন দুজন করে ছুটে যাবে ক্যামেরার সামনে দিয়ে। বেশি দূরে যাবে না কিন্তু, একটুখানি গিয়েই পেছন দিক দিয়ে ঘুরে এসে ঠিক আবার আগের মতন ক্যামেরার সামনে দিয়ে যাবে। তাতে মনে হবে, পরপর অনেক ঘোড়া ছুটছে। এইরকম ঠিক চারবার ঘুরে যাবে। শেষবার আর থামবে না। অনেক দূরে মিলিয়ে যাবে। সেটা আমি লং শট নেব। ঠিক বুঝেছ?
ঘোড়ায় চড়া সৈন্যদের মধ্যে একজন বলল, হ্যাঁ, সার, ঠিক আছে?
পরিচালক বলল, ঠিক গুনে-গুনে চারবার ঘুরে যাবে। তারপর দূরে। মিলিয়ে যাবে, মনে থাকে যেন। এরপর মোহন সিং-এর সিন। আপনি এই বন্দিনী মেয়েটিকে আপনার ঘোড়ার ওপর আড়াআড়িভাবে শুইয়ে নিয়ে যাবেন!
মোহন সিং বলল, ঘোড়ার পিঠে নিয়ে যাব না। ওকে আমি মাটি দিয়ে তঁাচড়াতে-হাচড়াতে নিয়ে যাব।
পরিচালক একটু হকচকিয়ে গিয়ে বলল, সে কী, স্ক্রিপ্ট বদলে গেছে? আগে তো ঘোড়ার পিঠে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল।
মোহন সিং বলল, হ্যাঁ, বদলে গেছে।
পরিচালক বলল, সে কী, বদলে গেল, আর আমি জানলাম না?
মোহন সিং বলল, যা বলছি, তাই শোনো!
পরিচালক তবু বলল, ঘোড়ার পিঠে শুইয়ে নিয়ে গেলে পরের সিনটার সঙ্গে… মানে, পরে এই মেয়েটির সঙ্গেই তো আপনার বিয়ে হবে, তাকে মাটি দিয়ে হেঁচড়ে-হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া কি ঠিক হবে?
মোহন সিং বলল, হ্যাঁ, এটাই ঠিক হবে। আমি বলছি, এইটাই হবে!
পরিচালক বলল, তবে তো হবে নিশ্চয়ই। আমি টেক করছি। লাইট, লাইট ঠিক করো।
রিঙ্কু চেঁচিয়ে বলল, আমি এই পার্ট করব না!
মোহন সিং বলল, এই মেয়েটার মাথার গোলমাল আছে। এর কোনও কথায় কান দেবার দরকার নেই।
অশ্বারোহীদের একজন ফিসফিসিয়ে আর একজনকে বলল, এ মেয়েটা কে? এ তো সুজাতাকুমারী নয়?
পাশের অশ্বারোহী বলল, তাই তো মনে হচ্ছে। এ সুজাতাকুমারী হতেই পারে না!
প্রথম অশ্বারোহীটি হাসতে-হাসতে বলল, সুজাতাকুমারীর পেট খারাপ হয়েছে শুনেছি। এরা কোথা থেকে একটা পাগলিকে ধরে এনেছে!
পাশের অশ্বারোহীটি হাসতে-হাসতে বলল, ঠিক বলেছ। পাগল, একদম পাগল।
পরিচালক হেঁকে বলল, সব চুপ! টেকিং! স্টার্ট সাউন্ড! ক্যামেরা…
অন্যদিক থেকে দুজন বুলল, রানিং।
অশ্বারোহী সৈন্যরা দৌড়ে গেল ক্যামেরার সামনে দিয়ে। মোট বারোটা ঘোড়া, কিন্তু তারা ঘুরে-ঘুরে আসতে লাগল বলে সত্যি মনে হল অনেক অশ্বারোহী যাচ্ছে। ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে সব সৈন্যদের মুখ একইরকম দেখায়।
চারবারের পর তারা মিলিয়ে গেল অন্ধকারের মধ্যে ঘোড়ার খুরের কপাকপকপকপ শব্দ শোনা গেল খানিকক্ষণ।
পরিচালক বলল, গুড! ভেরি গুড! এবার মোহন সিং-এর সিন। আপনি তৈরি হয়ে নিন!
মোহন সিং-এর জন্য এবার আর-একটা ঘোড়া আনা হল। হাতে একটা তলোয়ার নিয়ে মোহন সিং অন্য একজনের কাঁধে ভর দিয়ে সেই ঘোড়ায় চাপল। তারপর বলল, মুকুট? আমার মাথার মুকুটটা কোথায়?
একজন এসে একখানা প্রায় আসলের মতন দেখতে রাজমুকুট পরিয়ে দিল তার মাথায়।
এবার সে বলল, ওই মেয়েটার হাতের দড়িটার একটা দিক আমাকে দে! রিঙ্কু জোর করে দড়িটা টেনে রেখে বলল, আমি যাব না। আমি যাব না!
মোহন সিং হাসতে-হাসতে বলল, ভোলো, এইখান থেকে তোলো!
মোহন সিং ঘোড়াটার পেটে একটা লাথি মারতেই ঘোড়াটা এগিয়ে গেল কয়েক কদম। দড়ির হ্যাচকা টানে রিঙ্কু হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মাটিতে। এবার তার কান্না এসে গেল।
সে বলল, আমাকে ছেড়ে দাও!
হা-হা শব্দে আকাশ ফাটানো অট্টহাসি দিয়ে উঠল মোহন সিং।
একবার চেঁচিয়েই থেমে গেল রিঙ্কু। সে বুঝতে পারল, কাঁদলে কিংবা কাকুতি-মিনতি করলে এরা কেউ শুনবে না। সবাই ভাববে, এটাই অভিনয়।
পরিচালক বলল, ফাইন। তবে, আর-একবার করতে হবে। দড়িটা আরও লম্বা হলে ভাল হয়।
মোহন সিং বলল, ঠিক বলেছ। যতক্ষণ না ভাল হয়, ততবার আমি ওকে মাটিতে ছ্যাঁচড়াব। ওর হাতে একটা লম্বা দড়ি বেঁধে দাও!
রিঙ্কু মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। বাধা দিয়ে আর কোনও লাভ নেই বলে সে চুপ করে রইল। একজন একটা মোটা লম্বা দড়ি বেঁধে দিল তার দুহাতে।
মোহন সিং বলল, মেয়েটাকে আবার দাঁড় করিয়ে দাও। আমি আবার। হ্যাচকা টান মারলে ও পড়ে যাবে, সেইখান থেকে ছবি তুলবে। তারপর ওকে অনেকখানি টেনে নিয়ে যাব।
পরিচালক বলল, খা, ঠিক আছে। তবে, প্রথমটায় আপনি আস্তে-আস্তে টানবেন। তারপর জোরে।
রিঙ্কুকে একটা পুতুলের মতন দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। দড়ির টানে আবার সে পড়ে গেল। তলোয়ারটা উঁচিয়ে হাসতে-হাসতে ঘোড়া ছোটাতে লাগল মোহন সিং।
হঠাৎ উলটো দিকের অন্ধকার থেকে ছুটে এল আর-একটা ঘোড়া। একজন বিশাল চেহারার অশ্বারোহী তলোয়ার তুলে হা-রে-রে-রে বলে চিৎকার করতে করতে এসে প্রথমে মোহন সিং-এর তলোয়ারে এক ঘা মারল। মোহন সিং-এর হাত থেকে তলোয়ারটা ছিটকে গেল, ঝোঁক সামলাতে না পেরে সেও পড়ে গেল ঘোড়া থেকে।
সেই অশ্বারোহী তারপর এক কোপে কেটে দিল রিঙ্কুর হাতের দড়ি।
তারপর রাশ টেনে ছুটন্ত ঘোড়াটাকে থামাতেই ঘোড়াটা চি-হি-হি-হি করে ডেকে দাঁড়িয়ে পড়ল দু পা তুলে। ঘোড়াটার মুখ ঘুরিয়ে এনে অশ্বারোহী ঝুঁকে পড়ে হাত বাড়াল। দড়িটা কাটবার পর রিঙ্কু উঠে দাঁড়াতেই সেই অশ্বারোহী এক হাতে বিন্ধুকে তুলে নিল নিজের ঘোড়ায়। তারপর ঘোড়াটা প্রায় ক্যামেরার ওপর দিয়েই লাফিয়ে চলে গেল। অশ্বারোহী আবার চিৎকার করে উঠল, হা-রে-রে-রে!
সব ব্যাপারটা ঘটে গেল প্রায় চোখের নিমেষে। অন্য সবাই ভ্যাবাচ্যাকা। খেয়ে গেল। অনেকেই ভাবল, সেই ব্যাপারটাও বোধহয় সিনেমার গল্পের মধ্যে আছে।
মোহন সিং উঠে দাঁড়িয়ে হাত-পা ছুঁড়ে বলতে লাগল, পাকড়ো! পাকড়ো! উসকো পাকড়ো! ডাকু?
অশ্বারোহীটি মন্দিরের এলাকা পেরিয়ে মাঠের মধ্যে এসে পড়েছে। এবার সে ফুর্তিতে বলে উঠল, পৃথ্বীরাজ-সংযুক্তা। পৃথ্বীরাজ-সংযুক্তা! কেমন দিলুম, অ্যাঁ? ঠিক নিক অফ দা টাইমে এসে পড়েছি! কী গো, রিঙ্কু, খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলে, তাই না?
রিঙ্কু বলল, রঞ্জন! তুমি কোথায় ছিলে?
রঞ্জন বলল, তোমার কাছেই ছিলুম, চিনতে পারোনি তো? সৈন্য সেজে ছিলুম, ক্যামেরার সামনে শুটিং করলুম ঘোড়া ছুটিয়ে।
রিঙ্কু বলল, সৈন্য সাজলে কী করে?
রঞ্জন বলল, খুব সোজা! আমাকে শরবত খাইয়ে অজ্ঞান করে দিয়ে কোথায় যেন ফেলে দেবার জন্য নিয়ে যাচ্ছিল। এত বড় লাশ তো আর বয়ে নিয়ে যেতে পারে না। তাই ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল এক ব্যাটা। কিন্তু আমাকে তো চেনে না। দেড় গেলাস শরবত খেয়ে টক্ করে অজ্ঞান হয়ে গেলেও জ্ঞান ফিরে এসেছে তাড়াতাড়ি। ভেজাল, ভেজাল, আজকাল বিষেও ভেজাল! জ্ঞান ফেরার পরেই আমি সেই ব্যাটাকে কাবু করে হাত-পা বেঁধে ফেললুম। তারপর তার সঙ্গে আমার পোশাক বদলাবদলি করে ফিরে এলুম এখানে। সৈন্যদের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে ছিলুম।
রিঙ্কু বলল, উঃ, রঞ্জন, যদি আর একটু দেরি করতে, তা হলে আমি বোধহয় মরেই যেতুম!
রঞ্জন বলল, কেন, পাথরে নাক ঘষে গেছে বুঝি? মুখখানা নষ্ট হয়ে যায়নি তো? তোমার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আমি একবার পাগল, একেবারে পাগল বলে হাসলুম, তখন আমার গলা শুনেও চিনতে পারোনি?
বিষ্ণু বলল, খেয়াল করিনি। তখন মনের অবস্থা এমন ছিল…
রঞ্জন বলল, ভয় পেয়ে কাঁদছিলে!
রিঙ্কু বলল, মোটেই আমি কাঁদিনি! রঞ্জন, রঞ্জন, পিছনে আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, ওরা তাড়া করে আসছে।
রঞ্জন বলল, শক্ত করে ধরে থাকো, পাগলি! এবারে ঘোড়াটাকে পক্ষিরাজের মতন উড়িয়ে নিয়ে যাব।
রিঙ্কু বলল, সাবধান, সাবধান! সামনে একটা পাঁচিল, এদিকে যাওয়া যাবে না!
রঞ্জন বলল, অন্ধকারে যে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
রঞ্জন ঘোড়াটাকে বাঁ দিকে ঘুরিয়ে নিতেই কোনাকুনি এসে কয়েকজন অশ্বারোহী তাকে প্রায় ধরে ফেলল।
রঞ্জন বলল, কুছ পরোয়া নেই। ডরো মত্ রিঙ্কু?
তার পাশে একজন অশ্বারোহী আসতেই রঞ্জন তার তলোয়ার তুলল। অন্য অশ্বারোহীটির হাত থেকে দু-তিনবার আঘাতেই খসে গেল তলোয়ার।
রঞ্জন বলল, আরে ব্যাটা, তোরা তো সিনেমার জন্য সৈন্য সেজেছিস। তোরা আমার সঙ্গে লড়তে পারবি? আমি পয়সা খরচ করে ফেনসিং শিখেছি।
দ্বিতীয় সৈন্যটির তলোয়ারে আঘাত করতে করতে রঞ্জন বলল, ইশ, এই লড়াইটার কেউ ছবি তুলছে না? তা হলে একটা রিয়েল ফাইটিং-এর ছবি হত। আমার ভাগ্যটাই খারাপ!
দ্বিতীয় অশ্বারোহীটিও হেরে গিয়ে পালিয়ে গেল।
তারপর এগিয়ে এল মোহন সিং।
রঞ্জন বলল, এই তো, এবার রিয়েল ভিলেইন এসেছে! এবার তোমাকে পেয়েছি চাঁদু! দ মোহন সিং, আজ তোমারই একদিন, কি আমারই একদিন!
মোহন সিং বলল, কোথায় পালাবি তুই? এই দ্যাখ, তোকে খতম করছি!
মোহন সিং ঘোড়ার রাশ ছেড়ে দিয়ে দু হাতে তলোয়ারটা ধরে প্রচণ্ড জোরে একটা কোপ মারতে গেল রঞ্জনের পিঠে। রঞ্জন সামান্য একটু সরে গিয়ে সেই কোপটা এড়িয়ে গেল। হাসতে-হাসতে বলল, এ ব্যাটা কি জানে না। শুধু গণ্ডারের মতন গায়ের জোর দেখাতে এসেছে। দু হাতে কেউ সোর্ড ধরে! এটা কি গদা পেয়েছিস?
মোহন সিং দ্বিতীয়বার তলোয়ার তোলার আগেই রঞ্জন তার কবজিতে একটা আঘাত করল। যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠে মোহন সিং পড়ে গেল তার ঘোড়া থেকে।
রঞ্জন বলল, এবার এ ব্যাটার গলাটা কেটে ফেলি, কী বলল রিঙ্কু?
রিঙ্কু বলল, ছিঃ! তুমি মানুষ খুন করবে নাকি! মানুষকে কখনও মারতে নেই।
রঞ্জন বলল, এই তো মুশকিল, আমাদের বড় দয়ার শরীর। এ ব্যাটা সত্যি-সত্যি মানুষ কি না, সে বিষয়ে তুমি কি শিওর? রিঙ্কু বলল, তা হোক, তবু তুমি ওকে মেরো না! রঞ্জন বলল, একেবারে মেরে ফেলব না। তবে কিছু শাস্তি দেবই। তোমাকে মাটিতে ঘষটেছে, ওকে আমি ঘোড়া দিয়ে মাড়িয়ে দেব!
মোহন সিং ডান হাতের রক্তমাখা কবজিটা বাঁ হাতে চেপে ধরে কোনওক্রমে উঠে দাঁড়িয়েছে। রঞ্জন হুড়মুড় করে ঘোড়াটা চালিয়ে দিল তার গায়ের ওপর দিয়ে।
ঘোড়াটাকে আবার ফিরিয়ে বলল, একবারে হয়নি, আরও দু-তিনবার দিতে হবে।
রিঙ্কু বলল, না, রঞ্জন, আর থাক। হঠাৎ দুটো বন্দুক গর্জে উঠল দূর থেকে।
রঞ্জন বলল, রিঙ্কু, মাথা নিচু করো, মাথা নিচু করে প্রায় শুয়ে পড়ো! গুলি ছুঁড়ছে?
মোহন সিংকে ছেড়ে সে ঘোড়াটা ছোটাল অন্যদিকে। বিড়বিড় করে বলল, কাওয়ার্ডস! আনফেয়ার মিনস নিচ্ছে! আমার কাছে বন্দুক-পিস্তল কিছু নেই, তবু ওরা গুলি ছুঁড়ছে কেন? সামনাসামনি লড়ে যাবার হিম্মত নেই!
মাঝে-মাঝেই এক-একটা ভাঙা দেওয়াল এসে পড়ছে বলে ঘোড়ার মুখ ফেরাতে হচ্ছে বারবার। একটা দিক অনেকটা ফাঁকা পেয়ে রঞ্জন ঘোড়া ছুটিয়ে দিল প্রচণ্ড জোরে। গুলির আওয়াজ আর শোনা গেল না।
রিঙ্কু বলল, আস্তে, এবার একটু আস্তে। আর আমি ধরে থাকতে পারছি! পড়ে যাব!
রঞ্জন বলল, ঘোড়া এখন পক্ষিরাজ! আর কে ধরবে আমাদের।
বলতে-বলতেই ঘোড়াটা একটা উঁচু জায়গা থেকে লাফ দিল সামনে। সবাই মিলে একসঙ্গে ঝপাং করে গিয়ে পড়ল জলে। সেখানে একটা নদী।
রঞ্জন বলল, যাক, ভালই হল। আজ সারাদিন স্নান করা হয়নি, মনে। আছে? তুমিও অনেক ধুলোবালি খেয়েছ। এবার নদীতে ভাল করে স্নান করা যাবে?