সাহেবরা বলে লাঞ্চ, কেরানিরা বলে টিফিন
সাহেবরা বলে লাঞ্চ, কেরানিরা বলে টিফিন। সে যাই হোক, ঠিক দুপুরবেলা একটু আলগা সময় পাওয়া যায়। এই সময়টা বসে বসে শশা, ছোলাসেদ্ধ আর টোস্ট খাওয়া ছাড়া আর কোনও কাজ থাকে না লীনার। তার সিট ছেড়ে যাওয়ার উপায় নেই। সাহেবের সেক্রেটারি হওয়ার অনেক ঝামেলা। বেশিক্ষণ দুরে, আউট অফ ইয়ারশট থাকার নিয়ম নেই, সব সময়েই একটা কঁটাওয়ালা চেয়ারে বসে থাকার মতো।
লীনা ঘড়ি দেখে টিফিন-টাইম শুরু হয়েছে বুঝতে পেরে সবে তার স্টেনলেস স্টিলের টিফিন-বাক্সটা খুলেছে, এমন সময় ইন্টারকম বাজল।
সাহেবের গলা, একটু আসুন তো।
লীনা উঠে সুইং-ডোর খুলে ঢুকল। সাহেবের ঘরটা বিশাল বড়। দেয়াল থেকে দেয়াল অবধি মেজে জোড়া নরম মেজেন্টা রঙের কার্পেট। ইংরিজি এল অক্ষরের ছাদে মস্ত একটা টেবিল। ওপাশে গাঢ় সবুজ রঙের বড় রিভলভিং চেয়ার।
কিন্তু সাহেব অর্থাৎ ববি রায় অর্থাৎ কোম্পানির একনম্বর ইলেকট্রনিক ম্যাজিসিয়ান এবং দুনম্বর টপ বস চেয়ারে বসা অবস্থায় নেই। রোগা, কালো, মোটামুটি ছোটখাটো চেহাবার অস্থিরচিত্ত লোকটি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে চেয়ে আছেন। বাইরে বিশেষ কিছু দেখার নেই। এয়ার কন্ডিশনের জন্য কাচে আঁটা জানালা। ওপাশে একটা সরু রাস্তার পরিসর, তারপর আবার বাড়ি। বাড়ি আর বাড়িতে চারদিক কণ্টকিত এই মিডলটন স্ট্রিটে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে থাকার মানেই হয় না।
ইয়েস স্যার।
ববি রায় ফিরে তাকালেন। সকাল থেকে এই অবধি বার চারেক দেখা হয়েছে। চারবারের কোনওবারই মুখে মেঘ ছিল না। এখন আছে। ববি রায় হচ্ছেন সেই মানুষ, যাঁকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে নিয়েছে তার কাজ, তার কম্পিউটার ও অন্যান্য অত্যাশ্চর্য যন্ত্রপাতি, তিনি এতই খ্যাতিমান যে তাকে একবার লন্ডন থেকে একরকম কিডন্যাপ করে ইজরায়েলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ববি রায়ের যেতে হয় আমেরিকা থেকে শুরু করে চিন-জাপান অবধি। কখনও শিখতে, কখনও শেখাতে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ববি রায় নিশ্চয়ই কোম্পানির কাছ থেকে বছরে কয়েক লক্ষ টাকা বেতন বাবদ পান, আরও কয়েক লক্ষ টাকা কোম্পানি হাসিমুখে বহন করে টুর বাবদ। ববি রায় বোধহয় আজও ভেবে ঠিক করতে পারেননি যে, এত টাকা দিয়ে তিনি প্রকৃতই কী করবেন। কোম্পানি তাঁকে লবণ হ্রদে বিশাল বাড়ি করে দিয়েছে, চব্বিশ ঘণ্টার জন্য গাড়ি এবং দিন-রাতের জন্য দু’জন শফার, কলকাতার সর্বোত্তম নার্সিং হোমে পুরো পরিবারের কোম্পানির খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থা, টেলিফোন বা ইলেকট্রিকের বিল, গাড়ি সারানোর খরচ কিছুই ববি রায়ের পকেট থেকে যায় না। কোম্পানি তাকে শুধু দেয় আর দেয়। কোম্পানি বোকা নয়। ববি রায়ও কোম্পানিকে তেমন কিছু দেন যা কোটি কোটি টাকার দরজা খুলে দিচ্ছে, উন্মােচিত করছে নতুন নতুন দিগন্ত।
দ্বিতীয়বার লীনাকে বলতে হল, স্যার, কিছু বলছিলেন?
বসুন।–গলাটা গম্ভীর।
লীনা অবাক হল। তাকে কখনও ববি রায় বসতে বলেননি।
লোকটার জন্ম ফরাসি দেশে, ভারতীয় দূতাবাসের অফিসার বাবার সূত্রে। জীবনের প্রথম বিশটা বছর কেটেছে বিদেশে। সুতরাং লোকটা যে ভাল বাংলা জানবে না এটা বলাই বাহুল্য। ববি রায় কদাচিৎ মাতৃভাষা বলেন। এবং বলেন অনেকটা সাহেবদের বাংলা বলার মতোই।
বস হিসেবে লোকটা ভাল না মন্দ তা আজও বুঝতে পারেনি লীনা। মাত্র তিন মাস আগে সে এই অতি বৃহৎ মাল্টি-ন্যাশনালে বরাতের জোরে চাকরিটা পেয়ে গেছে। তবে তিন মাসে সে এটা লক্ষ করেছে যে, ববি রায়ের তাকে খুব কমই প্রয়োজন হয়। ববি বছরে বার দশেক বিদেশে যান। ববি রায় ডিকটেশন দেওয়া পছন্দ করেন না। নিজের কাজ ছাড়া বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে লোকটি নিতান্তই অজ্ঞ। মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সেই বিপুল পড়াশুনোর চাপে লোকটির ইলুপ্তি ঘটতে চলেছে। প্রবল রকম অন্যমনস্ক। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যেটা চোখে পড়ে, তা হল লোকটার এক অবিরল অস্থিরতা। লীনা দেখেছে, লোকটা কথা বলতে বলতে চেয়ার ছেড়ে বার বার উঠে পড়েন, টেবিলের উপর রাখা ছাইদানি, পেনসিল বক্স, এটা ওটা বার বার এধার ওধার করেন, বার বার চুলে। হাত বোলান, নিজের কান টানেন, নাকের ডগাটা মুঠো করে চেপে ধরেন। এত দায়িত্বশীল এবং উচ্চ পদে আসীন কোনও মানুষের পক্ষে এই অস্থিরতা একটু বেমানান।
এখন ববি রায়কে আরও একটু অস্থির দেখাচ্ছিল। লীনাকে বসতে বলে তিনি চেয়ারের পিছনে অনেকটা পরিসর জুড়ে চঞ্চল এবং দ্রুত পায়ে কিছুক্ষণ পায়চারি করলেন। তারপর হঠাৎ দাঁড়িয়ে দু’হাতের মুঠোয় মাথার চুলগুলো চেপে ধরলেন। সিলিং-এর দিকে চোখ।
লীনার মনে হল, এই চঞ্চলমতি লোকটি এইভাবেই চুল টেনে টেনে নিজের মাথায় প্রায় টাক ফেলে দিয়েছেন।
হঠাৎ ববি রায় লীনার দিকে তাকিয়ে অতিশয় বিরক্তির গলায় প্রশ্ন করলেন, হোয়াই গার্লস?
লীনা একেবারে ভোম্বল হয়ে চেয়ে রইল। লোকটা বলে কী রে?
এবার লীনার ফোঁস করার মতো অবস্থা হল। লোকটা বোধহয় তাকে এবং মহিলা সমাজকে অপমান করতে চায়। সে মেরুদণ্ড সোজা করে এবং মুখটা যথেষ্ট ওপরে তুলে বলল, আই ফাইন্ড মেন মোর ডিসগাস্টিং মিস্টার রয়। প্লিজ ওয়াচ হোয়াট ইউ সে।
ববি রায় তেমনি শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইলেন। লীনার কথাটা বুঝতে পেরেছেন বলেই মনে হল না। কিন্তু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এবং অস্বচ্ছন্দ বাংলা বললেন, আপনার মেয়ে হওয়ার কী দরকার ছিল? আঁ! হোয়াই আই অলওয়েজ গেট এ গার্ল অ্যাজ সেক্রেটারি?
এরকম প্রশ্ন যে কেউ করতে পারে লীনা খুব দুরূহ কল্পনাতেও তা আন্দাজ করতে পারে না। এত অবাক হল সে যে জুতসই দূরের কথা, কোনও জবাবই দিতে পারল না।
ববি রায় আচমকা লীনার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং পিছন ফিরে সোজা জানালা বরাবর হেঁটে যেতে যেতে বললেন, ইট গিভস মি ক্রিপস হোয়েনএভার দেয়ার ইজ এ গার্ল ড়ুয়িং মেনস জব।
লীনা এবার যথেষ্ট উত্তপ্ত হল এবং সপাটে বলল, ইউ আর এ মেল-শৌভিনিস্ট। ইউ আর এ-এ…
ববি রায়কের জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। নিজের প্রস্তরমূর্তির মতো। মিনিটখানেক শব্দহীন।
লীনা উঠতে যাচ্ছিল। লোকটাকে তার এত খারাপ লাগছে!
প্রস্তরমূর্তির থেকে আচমকাই লোকটা ফের স্প্রিং দেওয়া পুতুলের মতো ঘুরে দাঁড়ালেন। কী যেন বিড় বিড় করে বকছেন, শোনা যাচ্ছে না। পৃথিবীর মহিলাদের উদ্দেশে কটুকাটব্য নয় লে? হয়তো খুবই অশ্লীল সব শব্দ! লীনা কণ্টকিত হল রাগে ক্ষোভে এবং অপমানে।
এখন কি তারও উচিত পৃথিবীর অকৃতজ্ঞ পুরুষজাতির উদ্দেশে বিড়বিড় করে কটুকাটব্য করা? কী করবে লীনা? এই অপমানের একটা পালটি নেওয়া যে একান্তই দরকার।
ববি আবার অতি দ্রুত পায়ে পায়চারি করলেন কিছুক্ষণ। তারপর টেবিলটার কোণের দিকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। টক করে একটা সুইচ টিপলেন। টেবিলের ওই অংশটায় একটা ভিডিয়ো ইউনিট লুকোনো আছে, লীনা জানে। কমপিউটারের সঙ্গে যুক্ত এই ইউনিটটা বিস্তর তথ্যে ভরা আছে। কিন্তু ববি কী চাইছেন তা লীনা বুঝতে পারছে না।
ম্প্রিং-এ ভর দিয়ে খুদে ইউনিটটা ড়ুবুরির মতো উঠে এল ওপরে।
ববি অতি দ্রুত অভ্যস্ত আঙুলে চাবি টিপলেন। পরদায় ঝিক করে ফুটে উঠল একটা ফটো। নীচে নাম, লীনা ভট্টাচার্য। আবার চাবি টিপলেন ববি। পরদায় হরেক নম্বর আর অক্ষর ফুটে উঠতে লাগল যার মাথামুন্ডু লীনা কিছুই জানে না। সম্ভবত কোড।
ববি ভ্রু কুঁচকে খুব বিরক্তির চোখে স্ক্রিনের দিকে চেয়ে ছিলেন। কী দেখলেন উনিই জানেন। তবে মুখখানা দেখে মনে হল, যা দেখলেন তাতে মোটেই খুশি হলেন না।
অপমানের বোধ লীনার প্রবল। কারও বায়োডাটা বা ভাইট্যাল স্ট্যাটিসটিকস তার সামনেই চেক করা কতদূর অভদ্রতা এই লোকটা তাও জানে না। কিংবা ইচ্ছে করেই তাকে অপমান করতে চাইছে লোকটা!
ববি রায় সুইচ টিপে ভিডিয়ো বন্ধ করে দিলেন এবং সেটা আবার ড়ুবে গেল টেবিলের তলায়। ববি রায় মাথা নেড়ে বললেন, দেখা যাচ্ছে একমাত্র মোটরগাড়ি চালাতে জানা ছাড়া আপনি আর তেমন কিছুই জানেন না।
এই নতুন দিক থেকে আক্রমণের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না লীনা। আজ লোকটার হল কী? মাথা-টাথা গন্ডগোল হয়ে যায়নি তো! এইসব উইজার্ডরা পাগলামির সীমানাতেই বাস করে।
প্রতিভাবানদের মধ্যে অনেক সময়েই পাগলামির লক্ষণ ভীষণ প্রকট।
কিন্তু কথা হল, লোকটার এত বড় বড় কাজ থাকতে হঠাৎ লীনাকে নিয়ে মাথা ঘামানোর কী দরকার পড়ল?
লীনা দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে স্থির করল। প্রতি-আক্রমণ করার জন্য নিতান্তই প্রয়োজন নিজেকে সংহত, একমুখী ও গনগনে করে তোলা। লীনা একটু চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, মিস্টার বস,
কিন্তু ববি তার কথা শোনার জন্য মোটেই আগ্রহী নন। তিনি উদভ্রান্তের মতো ফের জানালা কাছে চলে গেলেন। হাতটা ওখান থেকেই তুলে লীনাকে চুপ থাকবার ইঙ্গিত করলেন। তারপর পুরো এক মিনিট নীরবতা পালন করে রে দাঁড়ালেন।
মিসেস ভট্টাচারিয়া, গাড়ি চালানোর রেকর্ডও আপনার খুব খারাপ। গত এক বছরে তিনটে পেনাল্টি। ভোর ব্যাড। আপনার দাদা একজন এক্স-কনভিক্ট। ইউ লাভ পোয়েট্রি অ্যান্ড মিউজিক। দ্যাটস অফুল। হরিবল। ইউ হ্যাভ ইমোশন্যাল ইনভলভমেন্ট উইথ এ ভ্যাগাবন্ড।
পর পর বজ্রাঘাত হলেও বোধহয় এর চেয়ে বেশি স্তম্ভিত হত না লীনা। তার সমস্ত শরীরটা যেন কাঠের মতো শক্ত হয়ে গেল অপমানে। এমনকী সে মুখ পর্যন্ত খুলতে পারছে না। মনে হচ্ছে, লক জ।
ববি চড়াই পাখির মতো চঞ্চল পায়ে ফের জানালার কাছে চলে গেলেন।
লীনা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, যথেষ্ট হয়েছে। আর নয়।
দাঁতে দাঁত পিষতে পিষতে সে বলল, ইউ আর এ স্কাউন্ড্রেল মিস্টার রয়। এ ডাউনরাইট স্কাউন্ড্রেল। আই অ্যাম লিভিং।
ববি রায় কথাটা শুনতে পেলেন বলে মনেই হল না। কোনও বৈলক্ষণ নেই। প্রস্তরমূর্তির মতো আবার নীরবতা।
লীনার শরীর এত কাঁপছিল যে, দরজা অবধি যেতে পারবে কি না সেটাই সন্দেহ হচ্ছে।
ভারী দরজাটা খুলে লীনা প্রায় টলে পড়ে গেল নিজের চেয়ারে বসে খানিকক্ষণ দম নিল। শরীর জ্বলছে, বুক জ্বলছে, মাথা জ্বলছে। কিছুক্ষণ সে কিছু ভাবতে পারল না। টাইপরাইটারে একটা রিপোর্ট অর্ধেক টাইপ করা ছিল। সেটা টেনে ছিঁড়ে দলা পাকিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল লীনা। নতুন দুটো কাগজ কার্বন দিয়ে লোড করল। ইস্তফাপত্র।
কী-লোর্ডে আঙুল তুলতে গিয়েও থমকে গেল লীনা। কী বলছিল লোকটা? গাড়ি চালানোতে তিনবার পেনাল্টি? দাদা এক্স-কনভিক্ট? কবিতা ও গানের প্রতি আসক্তি? একজন ভ্যাগাবন্ডের সঙ্গে
প্রেম?
আশ্চর্য! আশ্চর্য! এসব খবর একে কে দিয়েছে। পুলিশও তো এত কিছুর খোঁজ নেয় না কোনও সরকারি কর্মচারীর! এ লোকটা জানল কী করে?
তডিৎস্পৃষ্টের মতো উঠে দাঁড়াল লীনা। কী করবে? গিয়ে লোকটার কলার চেপে ধরবে? কী করে জানলেন আপনি এত কথা? আর কেনই বা?
ইন্টারকমটা পি করে বেজে উঠল। লীনা ঘৃণার সঙ্গে তাকাল টেলিফোনটার দিকে। ববি রায় আর কী চায়? আরও অপমানের কিছু বাকি আছে নাকি?
লীনা একবার ভাবল ফোনটা ধরবে না। তারপর ধরল। অত্যন্ত খর গলায় সে বলল, ডোন্ট ডিস্টার্ব মি। আই অ্যাম লিভিং।
ববি রায় কিছু বললেন না প্রথমে। নীরবতা। গিমিক?
লীনা টেলিফোন রেখে দিতে যাচ্ছিল। হঠাৎ ববি রায়ের গলা শোনা গেল, একবার ভিতরে আসুন।
না। যথেষ্ট হয়েছে।
খুব ক্লান্ত গলায় ববি বললেন, গার্লস আর সেম এভরিহোয়ার। নেভার সিরিয়াস। অলওয়েজ ইমোশন্যাল।
আপনি মেয়েদের কিছুই জানেন না।
হতে পারে। কিন্তু কথাটা জরুরি। খুব জরুরি।
আমি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি।
প্লিজ।
লীনা ঝাং করে ফোনটা রেখে দিল। একবার ভাবল, যাবে না। তারপর মনে হল, শেষবারের মতো দেখেই যায় ব্যাপারটা।
ববি রায়ের ঘরে ঢুকে লীনা দেখল, প্রশান্ত মুখে লোকটা চেয়ারে বসে আছে। মুখে অবশ্য হাসি নেই। কিন্তু অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে না।
লোকটা কিছু বলার আগেই লীনা বলল, আপনার কম্পিউটারে আমার সম্পর্কে কয়েকটা ভুল ইনফরমেশন ফিফড করা আছে। প্রয়োজন মনে করলে শুধরে নেবেন। প্রথম কথা, আমি মিসেস নই, মিস। আমার দাদা এক্সকনভিক্ট নন, পোলিটিক্যাল প্রিজনার ছিলেন। আর ভ্যাগাবন্ড
ববি রায় হাত তুলে ইঙ্গিতে থামিয়ে দিলেন লীনাকে। তারপর বললেন, ইররেলেভেন্ট।
আমি জানতাম না যে, আপনারা আমার পিছনে স্পাইং করেছেন। জানলে কখনও এই কোম্পানিতে জয়েন করতাম না।
ববি রায় অত্যন্ত উদাসীন চোখে চেয়ে ছিলেন লীনার দিকে। বোঝা যাচ্ছিল, লীনার কথা তিনি আদৌ শুনছেন না।
আচমকা লীনার কথার মাঝখানে ববি রায় বলে উঠলেন, ইট ইজ অ্যাবসোলিউটলি এ ম্যানস জব।
তার মানে?
ববি রায় নির্বিকারভাবে সামনের দিকে চেয়ে বললেন, কিন্তু আর তো সম্ভব নয়। সময় এত কম! আপনি একটা কাজ করবেন মিস্টার রয়?
উঃ?
আপনি ইমিডিয়েটলি কোনও সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে দেখা করুন। ইউ আর নট উইদিন ইয়োরসেলফ।
ববি রায় লীনার দিকে খুব তাচ্ছিলোর সঙ্গে চেয়ে বললেন, না, অত সময় নেই। টাইম ইজ দি মেইন ফ্যাক্টর। দে উইল স্ট্রাইক এনি মোমেন্ট নাউ। নো ওয়ে। নাথিং ড়ুয়িং।
ইউ হ্যাভ গন আউট অফ ইয়োর রকার।
ববি রায় মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে লীনার কথাটা উড়িয়ে দিলেন। তারপর আকস্মিকভাবে বললেন, মিসেস ভট্টাচারিয়া—
লীনার প্রতিবাদে চিৎকার করতে ইচ্ছে করল। তবু সে কণ্ঠ সংযত রেখে বলল, মিসেস নয়, মিস।
মে বি, মিস ভট্টাচারিয়া, আপনি কি বিশ্বাসযোগ্য?
লীনা ডান হাতে কপালটা চেপে ধরে বলল, ওঃ, ইউ আর হরিবল। প্র
শ্নটা খুবই গুরুতর। আপনি কি সত্যিই বিশ্বাসযোগ্য?
লীনা বাঙ্গ করে বলল, আপনার কম্পিউটার কী বলে?
কম্পিউটার বলছে, ইট ইজ অ্যাবসোলিউটলি এ ম্যানস জব।
হোয়াট জব?
আপনি মোটরবাইক চালাতে জানেন?
না।
ক্যান ইউ রান ফাস্ট?
জানি না।
আপনি কি সাহসী?
আপনার কম্পিউটারকে এসব জিজ্ঞেস করুন।
কম্পিউটারের ওপর রাগ করে লাভ নেই। কাজটা জরুরি। আপনি পারবেন?
লীনার রাগটা পড়ে আসছিল। হঠাৎ তার মনে হল, ববি রায় তাকে সত্যিই কিছু বলতে চাইছেন। কাজটা হয়তো-বা জরুরিও।
লীনা ববি রায়ের দিকে চেয়ে বলল, আপনি সংকেতে কথা বললে আমার পক্ষে তা বোঝা সম্ভব নয়।
ববি রায় কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে লীনার দিকে চেয়ে থেকে বললেন, এখানে নয়। উই মে মিট সামহোয়ার আউটসাইড দিস অফিস।
তার মানে?
ববি রায় টেবিলে কনুইয়ের ভর দিয়ে ঝুঁকে বসে বললেন, ওরা এ ঘরে দুটো বাগ’ বসিয়ে রেখেছিল।
বাঘ?
বাঘ! আরে না। বাগ মানে স্পাইং মাইক্রোফোন। ইলেকট্রনিক।
ওঃ।
আমি দুটো রিমুভ করেছি। কিন্তু আরও দু’-একটা থাকতে পারে। এখানে কথা হবে না।
লীনা ভয়ে বলল, কারা বসিয়েছিল?
জানি না। তবে দে নো দেয়ার জব।
আমাকে কী করতে হবে তা হলে?
একটা জায়গা ঠিক করুন। আজ বিকেল পাঁচটার পর–
না। আমার থিয়েটারের টিকিট কাটা আছে।
ববি থমকে গেলেন। তারপর হঠাৎ গম্ভীর মানুষটার মুখে এক আশ্চর্য হাসি ফুটল। ববিকে কখনও কোনও দিন হাসতে দেখেনি লীনা। সে অবাক হয়ে দেখল, লোকটার হাসি চমৎকার। নিষ্পাপ, সরল।
পরমুহূর্তেই হাসিটা সরিয়ে নিলেন ববি। খুব শান্ত গলায় বললেন, যাবেন। আফটার দি ফিউনারেল।
তার মানে?
আজকের থিয়েটারটা আপনাকে স্কিপ করতে অনুরোধ করছি। যে-কোনও সময়েই ওরা আমাকে খুন করবে। সেটা কোনও ব্যাপার নয়। আমি অনেকদিন ধরেই এসব বিপদ নিয়ে বেঁচে আছি। কিন্তু দেয়ার ইজ সামথিং ইউ হ্যাভ টু ড়ু ইমিডিয়েটলি আফটার মাই ডেথ।
লীনা এত ভয় খেয়ে গেল যে চোখের পাতা ফেলতে পারল না। লোকটা কি সত্যিই পাগল?
ববি জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় আমাদের দেখা হতে পারে বলুন তো! না, দাঁড়ান। এ ঘরে কথা বলাই ভাল। আপনি একটা কাজ করুন। আমাকে আপনার চেনা জানা কারও ফোন নম্বর একটা কাগজে লিখে দিন, আর আপনি সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করুন। এখন আড়াইটে বাজে। আমি আপনাকে সাড়ে তিনটে নাগাদ ফোন করব।
ব্যাপারটা একটু ড্রামাটিক হয়ে যাচ্ছে না তো?
হচ্ছে। রিয়াল লাইফ ড্রামা। কিন্তু সময় নষ্ট করবেন না। যান।
লীলা উঠল। হঠাৎ ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, আমার রেজিগনেশন লেটারটা–?
ববি রায় আবার হাসলেন। বললেন, আই অ্যাম রাইটিং মাই ডেথ সেনটেন্স।
লীনা বেরিয়ে এল। ব্যাগ গুছিয়ে নিল। তারপর টেলিফোন নম্বরটা একটা চিরকুটে লিখে যখন ববির ঘরে ঢুকল তখন ববি টেবিলে মাথা রেখে চুপ করে বসে আছেন।
মিস্টার রায়।
ববি মাথা তুললেন না। শুধু হাতটা বাড়ালেন। ভুতুড়ে ভঙ্গি।
লীনা চিরকুটটা হাতে দিতেই হাতটা মুঠো হয়ে গেল।
লীনা করিডোরে বেরিয়ে এল। দু’ধারে বড় অফিসারদের চেম্বার। লাল কার্পেটে মোড়া করিডোর ফাঁকা। দু’-একজন বেয়ারাকে এধার-ওধার করতে দেখা যাচ্ছে। পিতলের টবে বাহারি গাছ।
কেমন গা শিরশির করল লীনার। লিফটে নেমে সে একটা ট্যাক্সি নিল। তারপর সোজা হাজির হল তার বাড়িতে। টেলিফোনের কাছাকাছি চেয়ার টেনে অপেক্ষা করতে লাগল।
ফোনটা এল ঘণ্টাখানেক পর।
মিসেস ভট্টাচারিয়া—
মিসেস নয়, মিস।
কোথায় মিট করব বলুন তো!
রাস্তায়। গড়িয়াহাট রোড আর মেফেয়ার রোডের জংশনে। আমি দাঁড়িয়ে থাকব।
গুড। ভেরি গুড। পাঁচটায় তা হলে?
হ্যাঁ।
লীনার মনে পড়ল, ববি যখন হাত বাড়িয়ে চিরকুটটা নিয়েছিলেন তখন হাতটা একটু কাঁপছিল।