বিংশ শতাব্দীর সত্তর-আশির অশান্ত দশক
১)
সেই সময় কতকগুলি কথা চালু হয়েছিলো, “লোডশেডিং” আর তার গরীব -ধনী বৈমাত্রেয় ভ্রাতাগণ– “ইনভার্টার” , “এমাজেন্সী লাইট”, আর ” পাওয়ার কাট”। আবার কবর খুঁড়ে আনা “লম্ফ”, হ্যারিকেন” “মোমবাতি” “টর্চ” “দেশলাই” , “তাল পাতার পাখা” ইত্যাদি, সব আমাদের ছিল দিন রাতের সাথী। অসহ্য গরম, গলগলে স্বেদবিন্দুর স্রোতে ভাসছি, ধূম করে পাখা বন্ধ, রাত হলে ত আবার ঘুরঘুট্টি চতুর্দিক অন্ধকার, —চীৎকার একসঙ্গে দুটি শব্দ– “জ্যোতি গেলো”। আবার যখন হঠাৎ কম পক্ষে দু’ঘন্টার পর সব আলো ঝলমল– শোনা যেতো ” জ্যোতি এলো” পাড়ার ছেলে ছোকরার দল, অলিতে গলিতে যুব শক্তির ক্ষয়। আংশিক বা বহু এলাকা ভিত্তিক, “পাওয়ার কাট” যখন তখন, রাতের বেলা আলোর জন্য বোঝা যেতো , কখনো আমাদের নেই, অদূরে ওদের আছে, একটু অসূয়া । আবার আমাদের আছে ওদের নেই, আত্মপ্রসাদের ছোওয়া। ও, কারোরই নেই, যাক্। মনে যেন অলক্ষে একটু শান্তি। মাঝরাতে, মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে যেতো, অসহ্য ঘেমো গরম, কেমন অন্ধকার, নিস্তব্ধ থুম ধরা ভাব— ওঃ, লোড শেডিং.. কি আর করা, “তালপাতার হাতপাখা” আর “বিনিদ্র রাত” হলো দুই সখী, সাথে আবার উপরি পাওনা— মশাদের কানের কাছে মৃদু মিষ্টি সুরের ঘরানা।
কিছু করার নেই, কিন্তু তারপর ? শেষরাতে বা সকালে পাওয়ার , কি খুসীতেই না মন ভরে উঠতো। যাক্ এসেছে ত !!! কলকাতার লোকেরা সবসময়ই ইতিবাচক ভূমিকায় আগ্রহী। আশ্বাস পাই মুখে মুখে, এই সাঁওতালডি ইউনিট চালু হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আশাবাদী মন । লোডশেডিং শুরু হলেই, কেক প্রস্তুতির আয়োজন যোগাড় সরঞ্জাম চলত, যাতে কারেন্ট এলেই “ওভেন” চালাতে পারি। বুদ্ধিটা আমায় কলেজের এক কলিগ দিয়েছিলেন।
২)
জীবনে অনাবৃষ্টি কাকে বলে টের পাই নি কোনদিন, কিন্ত অতিবৃষ্টি , অকাল বৃষ্টি জীবনভর পেয়ে আসছি। বর্ষাকালে সে কি অবস্থা– আমি দক্ষিণ কলকাতার যে এলাকাতে থাকতাম, বৃষ্টিকালে আমাদের বাড়ি একটি ছোট্ট দ্বীপে পরিণত হতো। বেড়োবার সব রাস্তা ও গলিমুখ তখন ছোট বড় নদী— হাটু জল, বা আরো বেশি, বা খুব অগভীর বা ছোট এক পুকুর— পায়ের জুতো জবজব অন্তত। বাসস্ট্যান্ড যেতে হলে, খেয়া পারাপার করতে , টানা রিকশা ভরসা একমাত্র। তাদের তখন মরশুম, যা চাইত তাই দিতে হতো জল না ছোওয়া থেকে উদ্ধার পেতে।
শুনতে পেতাম নিকাষী নালা উদ্ধারের কাজ হয় না, ভরাট হয়ে আছে বা পাম্প অকেজো, ঠিক সময়ে ঠিক কিছু না করা হলে এমন ত হবেই। এসব গজগজানির লোকেরা কলকাতার , বড্ড সহনশীল ও রসিক বরাবর— সেজন্যই চটপট নানা বিকল্প ব্যবস্থার বন্দোবস্ত নিজেরা আমরা সবসময়ই তৈরি করে নিতাম।
‘৭৮ এ হলো সারা পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতাতে বন্যা, অতিবৃষ্টিতে অবশ্যই, আর ডিভিসি জল ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলো । [‘৬৮ উত্তর বাংলার জলপাইগুড়ির বাঁধভাঙা বন্যার ভয়াবহতার গল্প শুনেছি, কিন্ত তখন ত আর আমি সেখানে ছিলাম না।”] কলকাতার আমাদের বাড়িটি যথেষ্ট উচু জমিতে থাকা সত্ত্বেও একতলার মেঝেতে জল উঠে এলো। অনেক জায়গায় কলকাতাতেই নৌকো চলাচল, সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা।
আমাদের আরও করুণ অবস্থা, কারণ সে সময় আমরা দিন কুড়ির জন্য দক্ষিণ ভারত ভ্রমণে যাবার প্ল্যান , সেজন্য বাক্স প্যাটরা বেঁধে প্রস্তুত, বেড়োব, কিন্ত সে কি বিপদ – বৃষ্টিও ত হচ্ছিলই.. কি বিপত্তি রে বাবা ! যাবার আগের দিন থেকেই জল জমতে জমতে কলকাতা, হাওড়া স্টেশন সব ভাসমান। বন্ধ ট্রেন , বন্ধ যানবাহন । মালপত্র ঘরের মাঝখানে , আমরা কিংকর্ব্যবিমূঢ় ! দোতলার জানলা দিয়ে দেখছি নীচে নদী বয়ে চলেছে। সারা কলকাতা — “ভেনিস” কি মনখারাপ , কি মনখারাপ!!! তারপর টিকিট ফেরতের ঝামেলা, টাকা উদ্ধার , পরের বছর “টুর” – তবে না মন সুন্দর ।
৩)
গৃহস্থের বাজার বাজেটে মহা সংকট, সাঁ করে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দর, মাছ, মাংস, সব্জি ফলামূল সব হঠাৎই আকাশচুম্বি। কি আর করা, বাঁধা আয়ের লোকেদের খরচ সংক্ষেপ মানে রুটিন ব্যবহার সঙ্কুচিত করাই সুগম পথ। ঘরে ঘরে এক সমস্যা, তখন কর্পোরেট অফিসার ছাড়া কজনের আর চার অংকের বেতন ছিল। আর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ত একই অবস্থা। দাম বেড়েছে, তাতে একটু ব্যয় সংক্ষেপ, ক্ষতি কি? দুটির বদলে এক পিস মাছ খাও। নয়ত সপ্তাহে একদিন নিরামিষ, সস্তার মাছ “ট্যালাপিয়া ” বাজারে ত পাওয়া যায়। মাংস কম খাও, শাক সব্জি কম খাও, ফল কম খাও , শরীর ভাল থাকবে। “Cut your coat, according to your cloth”
৪)
নকশাল আন্দোলন তখন তুঙ্গে, কোন বাড়িতে কুড়ি বাইশ বছরের ছেলে থাকলেই বিপদের সম্ভাবনা, ধড়্ পাকড়, গুলি প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে— কোন্ পক্ষ? জানতে কে চাইবে সবার মুখে যে কুলুপ। একরাতে (এগারোটা হবে) আমার স্নেহভাজন এক কাজিন ভাই আশ্রয় দিতে অনুরোধ করে একটা রাতের জন্য দুটি ছেলেকে।
আমার স্বামীর ত কোন কিছুতেই তোয়াক্কা ছিল না, হলে হয়, না হলে না হয় গোছের— কিন্ত যত ঝক্কি আমার, বাড়িতে বৃদ্ধ শ্বশুর শাশুড়ি, কচি দুটি ছেলে মেয়ে, আছে কুড়ি একুশ বছরের ভাগ্নে , সর্বোপরি আমার সরকারি চাকুরি। সারারাত বিনিদ্র অবস্থা, খুব ভোরবেলা আমি তাদের সতর্কতার সাথে চলে যেতে বললাম, পাড়া নিশ্চিন্ত করতে এক দম্পতিকে আমার কর্তা এগিয়ে বড়ো রাস্তার কাছে পৌছে দিলেন। একটা চিরুনি, একটা শাড়ি– পুরোন আর আর …… এই আমার দান !!! যাবার আগে আহত ক্লান্ত ছেলেটির সাথে এক ঝলক দৃষ্টি বিনিয়োগ—- কি ছিল সেই বেদনার্ত চোখের ভাষা যা আজও ভুলতে পারি নি। কাদের জন্য তারা উঠতি জীবনের সব সখ আল্হাদ ভুলে , মায়ের কোল ছেড়ে পথে ঘাটে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে—- কাদের সুখের জন্য, কোন্ রঙ্গীন ভারত গড়বে বলে !!! জানা নেই ? না আছে জানা, রাজনীতি ছুতে না চাওয়া…. “…….ভারত আবার জগত সভার শ্রেষ্ঠ আসন লবে….” ছোট থেকে শুনে গেয়ে, আশা মরে না, স্বপ্ন কি সত্যিই রঙ্গীন হয় না সাদাকালো ? হয়ত দুটোই। স্বপ্ন টুকু আছে বলেই না জীবন এতো সুন্দর।