বাপ মানি খোকন
এটা ওই শিশুর আপন সৃষ্টি। সবাই ওর গোনা দেখে হাসত।গণনা পদ্ধতি দেখে মজা পেত।প্রতিদিন ভোরে হাতের তালুতে তিনটি লজেন্স
তার চাই। হাতে নিয়ে খুশিমনে সে গুণতে থাকে
আর রবীন্দ্রনাথও তা দেখে আনন্দ পেয়ে সবাইকে ডেকে বলতেন শিশু বয়সে এতো নির্লোভ আমি
দেখিনি। একরাশ আশঙ্কায় বহু প্রশ্ন নিয়ে সেদিন
শান্ত সেই ছটফটে শিশুটি। বাইশে শ্রাবণ দুপুরবেলা সব জাগতিক বন্ধন ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ অমৃতলোকে।ঘরে ভিড় উপছে পড়ছে।ভিড়ের ভিতরই একটু ফাঁক করে
পথ করে নিয়ে বিদ্যুতের মত এসে দাঁড়িয়ে ছিল
সে।তাঁর রবিদাদুকে সেদিন সাদা চাদরে আবক্ষ ঢাকা দেখে সে স্তব্ধ।একটিও কথা ছিল না তার মুখে।সেদিন সে আর বাপ মানি খোকন এই অদ্ভুত অঙ্কের তিন লজেন্স চায়নি।সে দেখেছিল অপারেশনের আগে তার হাতে লজেন্স না দেখে
ক্ষুব্ধ হয়েছিল রবিদাদু। আজ দাদু শান্ত হয়ে শুয়ে।তারপর যখন ফুলে ঢাকা গুরুদেবের দেহ
নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নীচে তখন সে চিৎকার করে
কেঁদে উঠেছিল।হাজার লোকের ভিড়ের মাঝে
বলেছিল, __ দাদুকে কোথায় ওরা নিয়ে যাচ্ছে?
অমন করে নিয়ে যাচ্ছে কেন?দাদুর যে কষ্ট হবে।
হ্যাঁ কষ্ট তার হয়েছিল।শেষ ইচ্ছা তাঁর পূরণ হয়নি।
তিনি শান্তিনিকেতনের শান্তছায়ায় থেকে যেতে
চেয়েছিলেন। কিন্তু তা না হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের
মুখে ধ্বনিত ‘জয় বিশ্বকবি কি জয়’, ‘জয় রবীন্দ্রনাথের জয়’, ‘বন্দেমাতরম’ নানা শ্লোগানের
হৈচৈতে তাঁকে এগিয়ে যেতে হয়েছিল মহাপ্রস্থানের
পথে।ছোট্ট শিশু বুঝে গেল তাকে আর ‘যুবরাজ’
বলে ডেকে দাদু আর লজেন্স দেবে না। সেইদিন
থেকে সে আর কোনদিন লজেন্স কারো থেকে
নেয়নি। কিন্তু কে এই শিশু যুবরাজ?সেই ছোট্ট ছেলে যাকে পাশে নিয়ে বিশ্বকবি কিছু কথা বলছেন ছবিটি গুগল সার্চ করলেই চলে আসে।
আর শিশুটি নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়
সত্যজিত হিসাবে ‘গ্রেট উইথ এনাদার গ্রেট নামে’।
কিন্তু বাস্তব বলে, যুবরাজ হল তাঁর প্রিয়তম
অভিজিৎ চন্দ।রবীন্দ্রনাথের সচিব অনিল চন্দ
ও রাণী চন্দের একমাত্র পুত্র।অভিজিতের জন্ম
কলকাতায়।প্রথমবার যখন সে শান্তিনিকেতনে আসে,তাকে স্নেহভরে কোলে তুলে আদর করে
বলেছিলেন নাম রইল অভিজিৎ। তখন শান্তিনিকেতনে অভিজিৎ একমাত্র শিশু। তখনও
সে চলতে শেখেনি মায়ের কোলে চড়ে বাইরে এসে
সে আগে রবীন্দ্রনাথের মুখ দেখত। ভোরে উঠে
তাঁর কাছে আসা অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। সে এলেই দাদু লেখার টেবিলের উপরে রাখা কাঁচের বয়াম খুলে তার সামনে ধরতেন।সে হাত ডুবিয়ে
একমুঠো লজেন্স তুলে নিত।তারপর হাতের তালুতে তা মেলে ধরে গুণত।আর দাদু মুগ্ধ ভরে
তা দেখত।শিশুর প্রতি ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ।
বাপ মানি খোকন বলে তিনটি লজেন্স রেখে সে
বাকি লজেন্স বয়ামে ফেলে দিত।এই তিনটির
বেশি সে কোনদিন বেশি লজেন্স নিত না।এইভাবে অভিজিতের দিন শুরু হত।প্রতিদিন ভোরের এই প্রাপ্তি থেকে তাকে বঞ্চিত করল বাইশে শ্রাবণ। সেই দিন থেকে বন্ধ হয়ে গেল তার
নিজের সৃষ্টি গণনা পদ্ধতি বাপ মানি খোকন। নির্লোভ যুবরাজের রবি সেদিন অস্তাচলে।আর
তার লজেন্স খাওয়ার ইচ্ছাটুকুও তলিয়ে গেল
অতলে।