বানপ্রস্থ
লাইমুকরা থেকে বাসে চেপে এসে বসন্তবাবু পুলিশ বাজার আর জি এস রোডের মোড়ে নামলেন। জি এস রোডের বড়ো দোকান থেকে উল কিনে নিয়ে যাবেন। শ্রীমতী উলের লাছি দিয়েছেন। রঙে রঙে মিলিয়ে আনতে হবে। জামাইয়ের জন্য সোয়েটার বুনবেন। মেয়ের বিয়ের
পর প্রথম সোয়েটার বুনে দেবেন তিনি গুণমণি মডার্ন জামাইকে।
বাস থেকে নামতেই বাঁ-হাঁটুটা কটকট করে উঠল। বাসটা চলে যেতেই শিলং ক্লাবের পেছনে ওয়ার্ড লেকের আশেপাশের পাইন গাছগুলোর মধ্যে একটা বেহিসেবি উদাত্ত হলুদ চাঁদকে উদ্ভাসিত দেখতে পেলেন।
বসন্তবাবু বললেন, মনে মনে আদিখ্যেতা।
পূর্ণিমা-অমাবস্যার জোয়ে বাতের ব্যথাটা বড়ো বাড়ে। পূর্ণিমার চাঁদকে চাবকাতে পারলে খুশি হতেন বসন্তবাবু।
সিনেমা হলটার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে বসন্তবাবু মনে করার চেষ্টা করতে লাগলেন শ্রীমতী তাঁকে কখনো কোনো সোয়েটার বুনে দিয়েছিলেন কি না। তেইশ বছর বিয়ে হয়েছে। তেইশ। বছরের স্মৃতিকে দু-হাত দিয়ে হাতড়ালেন, থাবড়ালেন, তারপর মনে পড়ল, দিয়েছিলেন একবার। প্রথম এবং শেষ। কালো উলের। শ্ৰীমতীর বাপের বাড়ির লোকেদের মাপ প্রমাণ ছিল বলে কয়েকঘর বেশিই নিয়ে বুনেছিলেন সোয়েটারটা শ্ৰীমতী। ফলে, দু-বেলা-পাতলা বসন্তবাবুর সেটা ভোগে বিশেষ লাগেনি। একবার খুব শীতে আগরতলায় বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিকে গিয়ে গায়ে দিয়েছিলেন। এক চা-বাগানের লালমুখো সাহেব তাঁর ওই কিম্ভুতকিমাকার সোয়েটারে তাঁকে কালো ভাল্লুক ভুল করে একটু হলে গুলিই করে দিয়েছিলেন কিন্তু বসন্তবাবু ভালোভাবেই জানেন যে, জামাইয়ের বেলা তা হবে না। বিশেষ যত্ন নিয়ে জামাইয়ের বক্ষ ও মধ্যপ্রদেশের মাপ নিয়েই বানাবেন শ্রীমতী। আজকাল অল্পবয়সি মেয়েদের বয়ফ্রেন্ড আর বর্ষীয়সী মহিলাদের। জামাইদের সমান স্ট্যাটাস।
ইডিপাস কমপ্লেক্স এবং ইলেকট্রী কমপ্লেক্স ইত্যাদির কথা তাঁর জানা আছে কিন্তু বসন্তবাবুর দৃঢ় বিশ্বাস যে, শাশুড়ি আর জামাইয়ের মধ্যে ইত্যাদির কথা এরকম কোনো গূঢ় গোপন হাশ হাশ ব্যাপার থাকে, ফলে জামাই সম্বন্ধে এই রসাধিক্য, ঔৎসুক্য এবং স্নেহ ভালোবাসার যাবতীয় আধিক্য বসন্তবাবুর ভালো লাগে না। শ্ৰীমতীর বয়স যেন দিন দিন কমছে।
পুলিশবাজার আর জি এস রোডের মোড়ে তাঁর সুপুরের মতো বহু ভ্যাগাবন্ড, বাপের হোটেলে খাওয়া ছেলেছোকরারা ভিড় করে থাকে সন্ধ্যের সময়ে। মেয়ে দেখে, সিগারেট ফোঁকে লম্বা লম্বা টানে, মাইয়াগুলানও ত্যামনি। লাজ নাই, লজ্জা নাই, সহবত নাই, ক্যামন কইরা হাঁটে, ক্যামন। কইরা কথা কয়, ঠারে ঠারে চায়। চাহন যায় না।
আসলে বসন্তবাবুর মেজাজ আজ দুপুর থেকেই খারাপ। আজ ছুটি নিয়েছিলেন লক্ষ্মীপুজোর। মেঘালয় গভর্নমেন্ট এসব ছুটি মঞ্জুর করেন না। ছেলে মুকু, দর্জি দোকান থেকে ফিরে সেই প্রচণ্ড চেঁচামেচি করে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে তুলেছিল। শীতের মুখে মুখেই বসন্তবাবুর ওয়ান অফ দ্য বেস্ট উলেন কোট ছেলেকে দিয়ে বলেছিলেন অলটার করে নিতে। ছেলে দর্জি দোকান। থেকে ফিরে এসে বলল, তোমার এই কোট অলটার করে পরার চেয়ে স্টাফড টোম্যাটো হওয়া অনেক সুখের কথা। থ্যাঙ্ক স্ট্যি। আমার গরম জামা লাগবে না। যা আছে তাই দিয়েই চালাব। এই কোট পরলে লাবান আর রিলবঙের কুকুরগুলো আমাকে ধাওয়া করে আমার পেছন খুবলে নেবে। যার নেই, যার বাবা অ্যাফোর্ড করতে পারে না, সে পরবে না। সো-হোয়াট?
হঠাৎ পাশের দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন বসন্তবাবু। গুয়া পান খাবেন একটা। শ্রীমতী, তাঁর মাইয়া মালতী আর পোলা মলয় ওরফে মুকু সব য্যান এক্কেরে সাহেব হইয়া গ্যাছে গিয়া। বাসায় আর পান খাওন চলে না। ভদ্দর লোকে নাকি অ্যাহনে পান খায় না। যারা খায়, তারা। সকলেই ছোটোলোক। যারা খাইত, তারাও রাতারাতি ছাইড়া দিয়া ভদ্রলোকোগো দলে নাম লিখাইছে। পোলাডার কী অডাসিটি! ফাদার বইলা কোনো রেসপেকটইনাই। আরে তগো লইগ্যা কী-ই না করলাম! আর তগোই নাই কোনো কনসিডারেশন? হঃ!
গুয়ায় একটা করে কামড় দেন, আর পানে একটু করে চুন লাগান খাসিয়াদের মতো।
গা-টা আস্তে আস্তে গরম হয়ে ওঠে। কানের লতিটা গরম হয়ে ওঠে। পান খেতে খেতে উলের দোকানের দিকে চলেন বসন্তবাবু।
হঠাৎ রাজেন সেনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়।
কোথায় চলেছেন?
এই-ই তো! এটটু উলের দোকানে।
চলুন উল কিনে নিয়ে তারপর আমার সঙ্গে আমার বাড়ি।
না না, এহন থাউক।
বসন্তবাবুর হঠাৎ শ্ৰীমতীর রাগে দেদীপ্যমান মুখখানি মনে পড়ে যায়। তাঁর ফতোয়া সন্ধ্যা আটটার মধ্যে ডিনার খেতে হবে-সাহেবরা তা-ই খায়–পাঞ্জাবিরা খায়–সিন্ধিরা-মাড়োয়ারিরা–যারাই জীবনে উন্নতি করেছে তারাই সকাল সকাল ডিনার খায়।
অতএব উন্নতি না করলেও জীবনের লাস্ট ইনিংসে এসে তাঁকেও খেতে হবে।
ওয়াক থুঃ থুঃ।
বলেন, নানা, আইজ থাউক। আরেকদিন হইব খনে। আছেন তো কিছুদিন।
হ্যাঁ, তা আছি সাতদিনের মতো। তা হলে চলে আসবেন যে কোনো দিন সন্ধ্যের পর।
আসুম অনে–স্যরি, আসব।
রাজেন সেন এখন কলকাতায় বড়ো চাকরি করে। ওঁদের বাড়ি ছিল গোয়ালপাড়ায়। অরিজিন্যালি সিলেটে। এই রাজেনবাবুর মতো লক্ষ লক্ষ লোক যে কেন নিজেদের ভাষায় কথা বলেন না তা ভেবে অবাক হন বসন্তবাবু। কাউকে আইসেন বা আসেন বলে বললে আপ্যায়নটা যতটা আন্তরিক হয়, হতে পারে, তা কখনো আসুন আসুন বললে হতে পারে? অথচ তবু লুঙি-ধুতির মতো, গুয়া পানের মতো, বিনা প্রতিবাদে মুখের ভাষাটাও এঁরা সকলে ত্যাগ করেছেন। দ্যাশি ভাষায় কথা বললে লোকে বাঙাল ভাববে। যেন বাঙাল ভাষায় যারা কথা কয় তারা মনুষ্যেতর জীব!
আসলে মানুষগুলানের অরিজিন্যালিটিই নষ্ট হইয়া গ্যাছে গিয়া।
গুয়া খেয়ে গা গরম হয়ে ওঠে। উৎসাহ উদ্দীপনা বোধ করেন তিনি। তাঁদের দেশেও সুপুরি, মাটির নীচে, মাটির কলসিতে পোঁতা রেখে মজানো হত। যখন সেই কলসি উঠত–উসস রে! কী বদ গন্ধ! সেই সবই এখন তামাদি হয়ে গেছে-সেই সব শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ, সেইসব রূপ-রূপগুণের সংজ্ঞা–সব কিছুই পালটে গেছে।
উলের দোকানটায় ঢুকলেন। এই দোকানটা সিন্ধুপ্রদেশের একজনের। পার্টিশনের আগে পূর্ব ভারতে সিন্ধিদের কেউ চিনত না, পাঞ্জাবিদেরও নয়। কিন্তু এখন মেঘালয়, অরুণাচল, মণিপুর, ত্রিপুরা এবং আসামে পশ্চিম ভারতীয় ব্যবসায়ীরা ভালো ব্যবসা করছে। শ্রীমতী, মুকু ও মালতী তো এই দোকানের জামাকাপড় ছাড়া পরেনই না, বা পরে না। বলে, বাঙালি দোকানগুলোয় সব বেটপ জামাকাপড় রাখে। বাঙালিরা ব্যবসা জানে না।
অনেক রঙা উলের লাছিনাড়তে চাড়তে অত আলোর মধ্যে বসন্তবাবুর মাথাটা কেমন রঙের প্রাচুর্যে ঘুরে গেল।
নাকে নদীর জলের গন্ধ পেলেন বসন্তবাবু-বহু যুগের ওপার হতে বন্দরের আওয়াজ এল কানে হীরালাল সার দোকানে যেন দাঁড়িয়ে আছেন তিনি–কত রকমের উল–তাঁর মা তাঁকে উল কিনতে পাঠিয়েছেন–একপাশে উল, অন্য পাশে আর সব। বাজার থেকে পাটালি গুড় আর। তামাকের গন্ধ আসছে। ইলিশ মাছের নৌকো ভিড় করছে ঘাটে। বড়ো বড়ো ইলিশ। নাকে গন্ধ এখনও আছে। টাকায় আটটা।
আট টাকা!
বড্ড দাম!
জিনিসটাভি দেখুন দাদা। জিনিসটাভি ফার্স্ট ক্লাস আছে।
তা আছে।
তবে?
বড্ড দাম।
এক দাম–আমরা দর-দাম করি না।
স্বাধীনদের বাড়ি ছিল হরিসভার পুকুর পাড়ে। কদম গাছ দুটো? আহা! বর্ষাকালে কেমন কদম ফুল ঝরে পড়ত। স্বাধীনদের বাড়ির সিঁড়ির দু-দিকে হাতির শুঁড় তোলা ছিল। শুড়ের মধ্যে পাথরের বল। একটা লটকা গাছ-বাড়িতে ঢুকতেই।
মালতীর ছেলে মেয়ে যদি হয়–এখন হওয়ার চান্স নেই–জামাই মেয়ে এখন নাকি পাঁচ বছর হানিমুনিংকরবে–মালতী তার মাকে বলেছে–কিন্তু যদি হয়, তখন অবাক চোখে শুধোবে বসন্তবাবুকে, লটকা গাছ কী গাছ দাদু।
বসন্তবাবু যে ওদের দেখাবেন, চেনাবেন যে এইটেই লটকা গাছ তেমন কোনো সম্ভাবনাও নেই। দেশে লটকা গাছ নেই। য্যাগো দ্যাশে ছিল তাগো দ্যাশ অ্যাহনে বাংলা দ্যাশ। বাংলা-ভাষী বাংলা।
হরিসভার পুকুরে ভাসানের দিন। গাঁটিয়া ফোঁটাত পুজো কমিটির লোকেরা মাঠের পাশের মিউনিসিপ্যালিটির রাস্তায়। পরদিন মাঠময় বারুদের গন্ধ—উচ্ছ্বসি হাউইয়ের স্তব্ধপক্ষ মুখ থুবড়ানো স্বপ্ন–কালো, পোড়া ঘাস, তারই উপর একরাশ নরম কমলা সাদা রাতে-ঝরা শিশিরভেজা শিউলি ফুল।
ভুল, ভুল, সব ফুল।
সবুজ মাঠের মধ্যে থেকে ফুলমণি গাই ডাকত হাম্বা-আ-আ-আ করে। অত মিষ্টি করে পৃথিবীর আর কোনো গোরু কখনো ডাকেনি, ডাকবে না। অমন ফড়িং উড়বে না, বৃষ্টির পর বৃষ্টিকে ধাওয়া করে। বাঁশবনে অমন করে জোনাকি জ্বলে না, জ্বলবে না কখনো কোনো দেশে–যে দেশ। বসন্তবাবুর মস্তিষ্কে সুরেলা কিন্তু বড়ো করুণ জলতরঙ্গেই কেবলমাত্র বেঁচে আছে–থাকবে আরও কিছুদিন। তারপর খুলি ফাটবে ফট। বসন্তবাবুর চিতা জ্বলবে। স্মৃতিগুলি ফুটে যাবে ঘিলুর সঙ্গে–দাউ দাউ করবে আগুন।
আগুনই থাকে শেষ পর্যন্ত। মানুষই একদিন আবিষ্কার করেছিল আগুনকে। আগুনের মধ্যেই মানুষের সমাপ্তি। পাবক। মানুষ দাহ্য। বসন্তবাবু দাহ্য। স্মৃতি, বোধ, সবই দাহ্য।
উঃ এত দাম! আগুন। আগুনই থাকে। জামাইও তো একদিন চিতায় জ্বলবে। কিছুদিন পরে। বসন্তবাবু শিগগিরি। তিনি পথিকৃৎ। ঘাটের মড়া। টাইম আপ। ফসিল। কিন্তু জামাইও জ্বলবে।
আজ-ইয়া-কাল। হিন্দি সিনেমা। তবে আর মিছে আগুন দামের উল কেন?
আরে ওঃ শাম্মা! আমজাদ খান। শোলে। প্রতিবেশীর রেকর্ড ওরে ওঃ শাম্মা। বড়ি নটখট। ই দুশমনী বড়ি ম্যাহেঙ্গা পড়েগাঠাকুর!
শোলে মানে কী? স্ফুলিঙ্গ? মুকু বলেছিল। আগুন।
আপনার দেশ কোথায়?
বসন্তবাবু শুধোলেন দোকানদারকে।
হিঁয়া।
না, না, অরিজিন্যাল দেশ?
ওঃ আমরা রিফিউজি। সিন্ধের লোক।
উদবাস্ত। জিন্না আমাদের ছিলেন।
নেতাজি আমাদের। বসন্তবাবু পানের ঢোক গিলে বললেন।
নেতাজি কে? গান্ধী আর জিন্না আর নেহরু। পার্টিশান। পার্টিশান, জিন্না আর নেহরু।
গোবর খড়ের গন্ধ, গোয়ালঘরে সাপ আর ফুলমণি গোরু।
বসন্তবাবু বললেন, ও তা হলে আপনারাও উদবাস্তু। দ্যান দ্যান উল দ্যান। উলগুনান ভাললাই? কী কন?
দোকানি হাসলেন। একগাল। বললেন, ভালোই।
উল কিনে বসন্তবাবু ভাবলেন একটু কিছু খাবেন কোনো রেস্তোরাঁতে। ডায়াবেটিস বলে খাওয়া দাওয়ার বড়ো কষ্ট। শ্রীমতী কিছুমাত্র খেতে দেন না। লাভ কী? বসন্তবাবু জীবদ্দশাতেই যা দিয়েছেন, গত হলেই তাই-ই দেবেন। পলিসিগুলোর প্রিমিয়াম ঠিক ঠিক দিয়ে এসেছেন গত পঁচিশ বছর।
প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটির টাকাও শ্রীমতীর ইচ্ছানুযায়ীই খরচ হবে। না বেশি না কম। তবে এত খাতির কেন? বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা কেন? আগুন ছাড়া আর কোনো প্রকৃত বন্ধু তাঁর নেই।
উল কেনা হল। কিনতে হল। শ্রীমতীর আদেশ।
এবার একটু কিছু খেলে হয়। রসমালাই? হোক। এই পাহাড়ি গোরুগুলোর দুধে গাধার দুধের গন্ধ। দ্যাশের গোরুর বাঁটের রং ছিল শিউলি ফুলের বোঁটার মতো। পাথরের বাটিতে জমানো লাল সরের পায়েস। রসমালাই এখানের? হউক। আর কী করণের আছে?
সিঁড়ি দিয়ে উঠলেন রেস্তোরাঁতে। বললেন, এক প্লেট রসমালাই নিয়া আসো, আর বেশি চিনি দিয়া চা।
এখানে চাইনিজও পাওয়া যায়। কী যে খায় ছ্যামরাগুলান। খাওয়া-দাওয়া সব পালটে গেল। জামাকাপড়, নৈতিকতা, শুভ-অশুভ বোধের মতো।
পাটশাক আর কাঁঠালের বিচির তরকারি? আহা! লোত লোত। জিভ দিয়া জল আসে। থানকুনি পাতা, পেঁপে কাঁচকলার শুক্তানি। ভেটকি মাছের কাঁটাচচ্চড়ি। মৌরলা মাছ ভাজা–কুটুর-পুটুর। ভাপা ইলিশ। কাঁচালঙ্কা, কালো জিরা দিয়ে তেল-কই। আহা! চিতল মাছের পেটি-ধনেপাতা আর কাঁচালঙ্কা দিয়া আর গাদার মুঠা-মুঠ মুঠ, য্যান মাংস! কচি পাঁঠার ঝোল। সরপুঁটি, সরষে বাটা দিয়া।
নাঃ, মুখটা জলে ভরে এল বসন্তবাবুর। আজকাল বাড়িতে চাওমিয়েন, চপসুই, পর্ক-চপ, হ্যাম, ব্যাকন হেইসবেরই চলন। ব্যাং শুয়ার না-খাইলে আইজকাল আর মডার্ন হওন যায় না। আর। নিজে যখন প্রথম প্রথম কাউঠার মাংস আনতেন হাতে কইর্যা-কী চিৎকার আর চেঁচামেচি। শ্রীমতী বলতেন, ঐতিহাসিক প্রস্তর যুগের লোক তিনি। আহা কাউঠ্যার চর্বি! কত্বদিন খান না। আর নিজেরা জামাই-পোলা লইয়া পা ছড়াইয়া ব্যাঙের ঠ্যাং শুয়ার খাইতাছ, তার বেলা? না, ব্যাং চালান যায়–সায়েবরা খায়। খাউক গ্যা, খাইয়া নিপাত যাও।
সারাটা দ্যাশ আজ বড়ো সায়েব-ভক্ত হইয়া গ্যাছে। সায়েবদের গু-ও ভালো। তাইলে আর চরকা কাইট্যা জেলে গিয়া সত্যাগ্রহ কইর্যা পড়াশুনায় ইস্তফা দিয়া তাগো তাড়াইলা ক্যান। সত্যই সেলুকস! কী বিচিত্র এই দ্যাশ!
খেয়ে দেয়ে মুখ মুছে ভুরুক-ভুরুক করে চায়ে চুমুক লাগালেন বসন্তবাবু। বাড়িতে জিভ পুড়াইয়া নিঃশব্দে চিনি ছাড়া স্যাকারিন গোলা চা গিল্যা খাইতে হয়। শব্দ করণ অসভ্যতা। সায়েবরা শব্দ কইর্যা খায় না। বোঝলানি!
বাইরে এসে ভাবলেন, একটুখানি হেঁটে যান। এক পক্কর চা খাইয়া এক চক্কর হন্টন মারেন। লেকের চাইর-পাশের রাস্তা ধইর্যা–গবর্নরের বাসার আশ-পাশ। রাস্তাটা নির্জন।
সন্ধ্যের পর ফুটবল খেলে যখন বাঁশবনের রাস্তা দিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরতেন তখনকার কথা মনে পড়ে।
এদিকটায় বড়ো বড়ো গাছ। ভারী-ভারী ছায়াগুলান হুমড়ি খাইয়া পড়ছে। আলো। তাগো সরাইতে পারে না। বড়ো ভালো লাগে।
শঙ্কামারির শ্মশানের রাস্তায় হরিধবনি তুইল্যাশব লইয়া যাইত কারা যান। বলো হরি, হরি বোল। মুসলমান ছাওয়ালগুলান রংপুর শহরে দুধ বিক্রি কইর্যা শূন্য মাটির কলস বাজাইয়া কী মিষ্টি সুরের গান গাইতে গাইতে খোঁয়াড়ের পথ ধইর্যা তাগো বাসার পথে ফিরত।
আঃ! কী নির্জন পথ। ঠান্ডা। বড়ো আরাম। সংসার নাই, অফিস নাই, ছাওয়াল-মাইয়া-জামাই কেউই নাই।
বসন্তবাবুর বড্ড ঘুম পেয়ে যায়। চিরদিনের মতো ঘুমোতে ইচ্ছে করে এই শান্তির মধ্যে।
সেই ঘুমের মধ্যে যদি সহস্র স্বার্থপর মুখ ঝুঁকে পড়ে তার ঘুমন্ত চোখকে জাগতে বলে-যদি কেউ জিগগায়, কী করেন?
বসন্তবাবু উত্তরে শুধু অস্ফুটে বলবেন, কিছুই করি না।
কিছু করি না, কিছু করতেও চাই না . একটু ঘুমোতে চাই। ফুলমণির ডাকের মধ্যে, বসন্তবউরির
চমকে-ওঠা ঘুমপাড়ানি সুরের মধ্যে, বাঁশবনে হাওয়ার শব্দের মধ্যে, হাওয়ায় ওড়া সজনেফুলের মধ্যে, চোতরা পাতার কটুগন্ধে ভারি মন্থর পরিবেশের পরিচ্ছন্নতায় একটু ঘুমোতে চান বসন্তবাবু।
হঠাৎ চোখ মেলে দেখেন পাইনের জঙ্গল ঘন হয়ে এসেছে।
জঙ্গল গভীর, গভীরতর, ছায়াচ্ছন্ন। উপরে হারামজাদি হলুদ চাঁদ। পায়ে বাত। বসন্তবাবু জঙ্গলের দিকে দৌড়ে যেতে চান–পালিয়ে যেতে চান, হারিয়ে যেতে চান সংসার থেকে জরাজীর্ণ ভবিষ্যহীন গাৰ্হস্থ্যর এই ন্যক্কারজনক নোংরামি ও হল্লাগুল্লা থেকে।
বসন্তবাবু খোঁড়াতে খোঁড়াতে জঙ্গলের দিকে এগোন।