বাচ্চু কেন ফিরে এল
সুস্মিতার স্বামী অলকেশ যখন স্কুটার অ্যাকসিডেন্টে মারা গেল, তখন সুস্মিতার বয়স চল্লিশও পার হয়নি। আর বাচ্চু একটা নেহাত বালক। অলকেশ পাঁচ মাসের কাছাকাছি সময় কোমায় পড়ে রইল জীবন্মত হয়ে। ডাক্তাররা বললেন ক্লিনিক্যাল ডেথ হয়নি। নাড়ি জানান দিচ্ছে, শারীরিক ক্রিয়াকর্ম হয়ে যাচ্ছে, শুধু জ্ঞান নেই। তাঁরা খুব সম্ভব জানতেন, এই জ্ঞান আর ফিরবে না। কিন্তু সুস্মিতা বা তার কোনো আত্মীয়স্বজনকেই কথাটা বলা ভালো মনে করেননি। পাঁচ মাস ধরে সুতরাং তিনটে প্রক্রিয়া চলল। প্রথম—সুস্মিতার প্রতিদিন নতুন আশা নিয়ে মিলিটারি হাসপাতালে প্রবেশ করা, আজ নিশ্চয়ই সে অলকেশের চৈতন্যলাভের কোনো-না-কোনো লক্ষণ দেখবে। দ্বিতীয়-আত্মীয়স্বজনদের প্রতিদিন অলকেশের একটু একটু করে শীর্ণ-হয়ে-যাওয়া ছোটো-হতে-থাকা অচৈতন্য শরীরটার দিকে। তাকাতে তাকাতে তার মৃত্যু-কামনা করা। কারণ এই শরীরে যদি কোনোদিন সাড় ফিরে আসেও, এ যে কোনোদিন আর স্বাভাবিক হতে পারবে না, দুর্বহ এক বোঝ হয়ে থাকবে—এ কথা তাঁরা বুঝতে পারছিলেন এবং মৃত্যুশোক উত্তীর্ণ হয়ে ধীরে ধীরে যুক্তিপূর্ণ মনোভঙ্গিতে পৌঁছোচ্ছিলেন, সুস্মিতার পক্ষে যেটা সম্ভব ছিল না। এবং তৃতীয়–বাছুর হঠাৎ বড়ো হয়ে যাওয়া।
এই তৃতীয়টাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সবচেয়ে অস্বাভাবিক। বাচ্চু প্রতিদিন হাসপাতালে বাবার শয্যার পাশে বসে নির্নিমেষে তার বাবার মুখের দিকে চেয়ে থাকত। ডাক্তাররা কী বলতেন, তার মা কী বলছে, কাকা-মামা-মাসি-পিসিরা কে কী বলছে, কীভাবে প্রতিক্রিয়া করছে সে কিছুই দেখত না। খালি নির্নিমেষে বাবার মুখ দেখত। মাঝে মাঝে বাবার মুখ-হাত-পা খিচিয়ে উঠছে, চোখের ভেতর তারা নড়ছে। অন্য কারও কথা, কারও আশ্বাস বা হতাশার কোনো মূল্যই তার কাছে আর নেই। সে নিজে নিজে বুঝতে চাইছে তার এই বাবা, যে মাত্র কদিন আগে কমাস আগেও অদ্ভুত জীবন্ত ছিল, ছোটো মাসি-মেসোর জন্য দই আনতে গিয়ে যে বাবা লরির ধাক্কায় নর্দমায় পড়ে গিয়ে লোকবাহিত হয়ে ঘরে ফিরল কর্দমাক্ত এবং রক্তাক্ত হয়ে, সেই বাবার কথা-না-বলা, না-হাসা এই নিগ্রুপ-পড়ে-থাকার মধ্যে কী রহস্য আছে। তার মনোযোগের সারাৎসার দিয়ে সম্পূর্ণভাবে বুঝে নিতে চাইছে।
অবশেষে বাবার হৃৎস্পন্দন থেমে গেলে তাঁর মুখাগ্নি করে বাচ্চু বাড়ি ফিরেই কাছা গলায় পড়তে বসল। তার বার্ষিক পরীক্ষা সামনে। সে আর সময় নষ্ট করতে পারে না। পাশের ঘরে যখন তার মাকে ঘিরে অন্যান্য মহিলারা কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন, সে হঠাৎই একবার উঠে গেল। দরজাটা খুলে বলল, এত শব্দ করলে আমি পড়ব কী করে? তার গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যাতে উপস্থিত সবাই চুপ করে গেল। তার আচরণ সবার কাছেই খুব অস্বাভাবিক ঠেকল। সুস্মিতা পাঁচ মাস ধরে নিজের অজান্তেই স্বামীর মৃত্যুর জন্য হয়তো প্রস্তুত হয়ে ছিল, তাই তার নতুন করে ভাবনা হল আকস্মিক আঘাতে বাছুর কিছু হয়নি তো? সে উঠে গিয়ে বাচ্চু যে ঘরে পড়ছিল, সেই ঘরে পাতা তক্তাপোশের ওপর গিয়ে বসল, বাচ্চু বলল, দরজাটা বন্ধ করে দাও মা। শোও। ঘুমিয়ে পড়ো।
বাচ্চু সে বছর বার্ষিক পরীক্ষায় প্রতিটি বিষয় অদ্ভুত নম্বর পেয়ে ফার্স্ট হল। সে যখন পড়ে, এমন নিবিষ্ট হয়ে পড়ে যে ডাকলে শুনতে পায় না।
অলকেশের মৃত্যুর প্রথম ধাক্কাটা কেটে যাবার পর, তার আত্মীয়রা অর্থাৎ জ্যাঠাকাকারা ক্রমে ক্রমে সুস্মিতার ওপর তাদের দাবি বাড়াতে লাগলেন। এরকম কথা শোনা যেতে লাগল, অলকেশ চিরকাল বাইরে বাইরে থেকেছে, বাড়ির জন্য কিছু করেনি, সুতরাং বাড়ির ওপর তার স্ত্রী-পুত্রের দায় বর্তায় না। বরং তাদের ভরণ-পোষণের জন্য খরচের টাকাটা তো বটেই, আরও কিছু সুস্মিতা দিক। নানা ছলছুতোয়, সুস্মিতা ও বাচ্চুকে দোতলায় যে ঘরে তারা কলকাতায় এলে থাকতে অভ্যস্ত ছিল, সেখান থেকে একতলার স্যাঁতসেঁতে ঘরে নির্বাসিত করা হল। এবং তার টাকাকড়ির হিসেব চাওয়া হতে লাগল। এই নিয়ে অশান্তি ও অপমান যেদিন চরমে পৌছোলো, হঠাৎ দেখা গেল বাচ্চু তার সাইকেলের ক্যারিয়ারে তার চেয়ে বেশ বড়ো একটি বন্ধুকে নিয়ে আসছে। সে উঠোনের মধ্যে দাঁড়িয়ে বিনা ভূমিকায় বলল, মা, তুমি রেডি হয়ে নাও। বাড়ি ঠিক করে এসেছি। মালপত্র নেবার জন্যে টেম্পো আসছে। এই খোকনদা সব ব্যবস্থা করবে, তুমি শুধু জামাকাপড়, বইপত্র গুছিয়ে নাও।
সুস্মিতার দেওর বিস্ময়ের প্রথম ধা কাটা কাটিয়ে উঠে চ্যাচামেচি করে বলল, মনে রেখো এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে আর কোনোদিন ঢুকতে পারবে না— বাড়ির অংশ দাবি করতে এলে দেখিয়ে দেব মজা।
সুস্মিতা ইতস্তত করছিল। এতটুকু একটা ছেলের কথায় নিশ্চিন্ত না হোক নিশ্চিত আশ্রয় ছেড়ে যাওয়া! বাচ্চু তখন এগিয়ে এসে কঠিন হাতে তার হাত ধরল। বলল—কই, রেডি।
হও! সুস্মিতার মনে হল বাচ্চু তার হাত মুচড়ে দেবে তার কথা না শুনলে। বাছুর তখন ঠিক চোদ্দো বছর বয়স।
তারা যেখানে এসে উঠল, সেটা মফসসল। বাছুর এক বন্ধুর মামারবাড়ির একতলা। নতুন বাড়ি। সবকিছুই আলাদা। সদর দরজা পর্যন্ত। বাচ্চু বলল, আমরা দিল্লিতে, বরোদায়, কানসভালে ঠিক যেভাবে ছিলাম সেইভাবে বাড়িটাকে সাজাও মা। সে শুধু বলেই ক্ষান্ত হল না। নিজেও হাত লাগাল। বন্ধুবান্ধবের দল নিয়ে কদিনের মধ্যেই বাড়িটাকে ছিমছাম করে ফেলল। যেখানে ছবি থাকবার ছবি রইল, যেখানে ফুলদান গাছদান থাকবার ফুলদান গাছদান বসাল, টেবিলের ওপর ফোটোফ্রেমে বাবা-মা-বাছুর ছবি শোভা পেতে লাগল।
রাতে হা ক্লান্ত হয়ে শুতে যাবার আগে বাচ্চু বলল, মা, তোমার টাকাপয়সা কোথায় কী আছে, কত আছে, কীভাবে আছে একটু বোঝাও তো!
যতক্ষণ না বুঝল সে কিছুতেই ছাড়ল না। তারপর হিসেব করতে বসল। করে দেখিয়ে দিল বাড়িভাড়া দিয়ে, সংসারখরচ করে, তার পড়াশোনার জন্য ব্যয় হয়েও তাদের ঠিক কত থাকবে। সমস্ত করে-টরে সে মাকে বলল, গোয়াবাগানের একতলার খাটালের-গন্ধ-আসা মশা-অলা ঘরটার চেয়ে এখানেই তো আমরা ভালো থাকব। তা ছাড়া গালাগাল, খারাপ কথা, গোলমাল এসবের কোনোটাই আমার ভালো লাগে না।
সুস্মিতারা চলে আসায় গোয়াবাগানের বাড়িতে এবং পাড়ায় একটা প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। জনমত সুস্মিতাদের পক্ষে। মা বেঁচে থাকতে বিধবা বউটাকে, নাতিটাকে বাড়ি ছাড়া করল গা, এমন ইতর চামারও তো দেখিনি! ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই প্রতিক্রিয়ার ধাক্কাতেই হোক, অনুশোচনাতেই হোক ধীরে ধীরে সুস্মিতার শ্বশুরবাড়ির কেউ-কেউ তার নতুন বাড়িতে আসতে লাগল, পুজো এবং জন্মদিনে বিশেষ করে বাচ্চুর জন্য উপহারাদি নিয়ে। সুস্মিতা বেশ পুলকিত। হাজার হলেও নিজের দেওর, জা, ননদ, শাশুড়ি। হয়তো মনে মনে শ্বশুরবাড়ির ন্যায্য ভাগ। পাওয়ার আশাও তার মনে জেগে থাকবে। সে সুগন্ধি চা, জলখাবার ইত্যাদি তৈরি করে তাঁদের আপ্যায়িত করে। এভাবে পুজো গেল, জন্মদিন এল। তাঁরা আবার এসেছেন। হাতে বাচ্চুর জন্য শার্টপ্যান্টের প্যাকেট। বাচ্চু সেদিন বাড়ি ছিল। সে ঢুকে গত পুজোর দেওয়া জামাকাপড়গুলো টেবিলের ওপর রাখল, শান্তভাবে বলল, যেগুলো এনেছ সেগুলো এবং এগুলো নিয়ে যেয়ো। চা-টা খাও, তারপর এগুলো নিয়ে চলে যেও। আর এসো না। আমার অসুবিধে হয়। তার বয়স পনেরো পূর্ণ হয়েছে। তার ঠাকুমা, জ্যাঠা ও জেঠিমা দেখলেন তাঁদের সামনে যেন ছোটো অলকেশ দাঁড়িয়ে রয়েছে। অবিকল!
অপমানের চেয়ে বেশি যেন আতঙ্ক নিয়ে ওঁরা চলে গেলেন। অলকেশই কি ছেলের মধ্যে দিয়ে এসে তাঁদের ভৎসনা করে গেল? সুস্মিতা বাচ্চুকে বকতে ভয় পায়। বাচ্চু যেন তার চেয়ে বয়সে অনেক বড়ো। সে কিন্তু-কিন্তু করে বলল, বাচ্চু, তোর চেয়ে আমি তো কম ভুগিনি, আমিও জানি কে কী রকম, তবুও আপনজন, নিজে থেকে যখন আসছে আসুক না। ক্ষতি তো কিছু নেই!
বাচ্চু সংক্ষেপে বলল, আপনজন চিনতে শেখো।
আস্তে আস্তে বাচ্চুর যেমন নিজস্ব বন্ধুর বৃত্ত গড়ে উঠেছিল, সুস্মিতারও তেমনি অনেক নতুন বন্ধু হল। প্রতিবেশিনী, বাছুর বন্ধুদের মায়েরা। সুস্মিতা ভুলে যেতে থাকল তার নিঃসঙ্গতা, আত্মীয়ের অভাব। তার অনেক গুণ। সে ভালো গাইতে পারে, অভিনয় করতে পারে, রান্নাবান্নায় সে দ্রৌপদীবিশেষ। তাকে ঘিরে আপনা আপনিই একটা সাংস্কৃতিক ক্লাব গড়ে উঠল। সুস্মিতা গান গাইছে, গান শেখাচ্ছে, রান্নার বই লিখছে। সরস্বতীপুজো উপলক্ষ্যে ফাংশন করাচ্ছে। একে একে তিনটে কুকুর হয়েছে। সুস্মিতার ভাবনা-চিন্তা করবারই বা অবসর কই? সর্বক্ষণ সুস্মিতা। সুস্মিতাদি! সুস্মিতা মাসি।
বাচ্চু হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করল, সাংঘাতিক ভালো ভালো মার্কস পেয়ে। সে যাদবপুরে ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাচ্ছে। কিন্তু থাকে শ্রীরামপুরে, যেতে হবে যাদবপুর। হস্টেলেও আপাতত সিট পাওয়া যাচ্ছে না। কী হবে?
এই সময়ে সুস্মিতার এক জাঠতুতো বোন, তার ছেলেবেলার সখী, বলল, আমি থাকতে ভাবছিস কেন? হস্টেলে সিট পেলেও বাচ্চর সেখানে থাকার প্রশ্ন উঠছে না। আমি থাকি ম্যান্ডেভিল গার্ডনস-এ। সেখান থেকে যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কতদূর? আমি থাকতে আমার বোনের ছেলে যাবে হস্টেলে?
বাচ্চুকে অগত্যা রাজি হতে হল। তার মাসিরা বিশাল ধনী। তাদের প্রাসাদোপম বাড়ি। মাসি মেসো, বিশেষ করে মেসো, বেশিরভাগই ব্যাবসা উপলক্ষ্যে লন্ডনে থাকেন। মাসির দুই ছেলে-মেয়ে বিরাট বাড়িতে একা। দুজনেই লেখাপড়ায় যথেষ্ট ভালো। বাচ্চুর আলাদা ঘর, সঙ্গে ডব্ল সি। মাইক্রোওয়েভ আভেনে ঘন্টাখানেকের মধ্যে রান্না হয়ে যায়। সকালে, বিকেলে, দুপুরে, রাতে মাসির লোজন বিশেষভাবে দেখাশোনা করে বাচ্চুকে। সকালে যে জামাকাপড় ছেড়ে সে কলেজে যায়, ফিরে সে সেগুলো খুঁজে পায় না। বেশি খুঁজতে থাকলে মাসির লোক এসে বলে, কাচা, আয়রন করা সব ক্যাবিনেটে সাজানো আছে। মাসি বলে, যা ছাড়বি সঙ্গে সঙ্গে ওয়াশিং মেশিনে চলে যাবে। ভাবিস কেন? তিনটে ওয়াশিং মেশিন কাজ করছে। ছাড়া জিনিস ভদ্রলোক পরে আর?
সকালে ব্রেকফাস্ট এনে দেয় বেয়ারা। এত ব্রেকফাস্ট যে দুপুরে খাওয়ার জন্যে পেটে জায়গা থাকে না। এ বাড়িতে কেউ সেভাবে লাঞ্চ বোধহয় খায়ও না। শেষ দুপুরের দিকে খিদে পায়, তখন বাচ্চু কলেজ-ক্যানটিনে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতে মারতে কিছু খেয়ে নেয়।
সন্ধেবেলায় তাড়াতাড়ি খাওয়া। টেবিলে এসে বসে বাচ্চু। মাসির মেয়ে তনিকা, সে বাচ্চুর সমবয়সি, এসে একটা দুটো জিনিস হাতে তুলে নেয়, কামড় দিতে দিতে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে থাকে। বাচ্চু ডাক দিয়ে বলে, তনি, বসে খাও না। গল্প করব। তার এখন আড্ডার মেজাজ। এই সময়েই তার মায়ের সঙ্গে গল্প জমত।
সময় কোথায়? তনিকা হেসে চলে যায়। তার নিজের ঘরে ক্যাসেট চালিয়ে এসেছে। কিংবা ভিডিয়ো। সে ঘরে ঢুকে প্রথমে পর্দাটা টেনে দেয়। তারপর দরজাটা বন্ধই করে দেয়।
ছেলেটি বাছুর থেকে ছোটো। সে খেতে খেতে বই পড়ে। বাচ্চু জিজ্ঞেস করে, কী পড়ছ?
মলাট উলটে দেখায় রোহণ, কাফকা। প্রস্ত।
বাচ্চু এসব লেখকের নামও শোনেনি। কিন্তু সে খুব কৌতূহলী, সাহিত্য বিষয়েও। সে বলল, আমাকে পড়তে দিও। আলোচনা করব।
কী দরকার। ফিরে হেসে রোহণ বলে।
বেশিরভাগ দিনই সন্ধেবেলায় রোহণ বেরিয়ে যায় গাড়িতে। তনিকা ট্রামে বাসে। কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞেস করলে হাসে-উত্তর দেয় না। বাচ্চুর জন্যও সকালে-বিকালে গাড়ি প্রস্তুত থাকে। মাসি বলে, খবর্দার, তনির মতো ট্রামে বাসে যাস না বাচ্চু! কত জার্ম, কত নোংরা, তনিটা
পাগলি! মাসি নিজেও সন্ধেবেলায় বাড়ি থাকে না। কিন্তু বাচ্চুর সন্ধেবেলাটাই বাড়ি থাকার সময়।
মাস তিনেকের মাথায় বাচ্চু ফিরে গেল। মাসি প্রথমটা বুঝতেই পারেনি। দু দিন তিনদিন পর ড্রাইভার বলল, বাচ্চুবাবু তো গাড়িতে কলেজ যায় না। গাড়ি তো গ্যারেজে তুলে দিই। বেয়ারা তখন বলল, বাচ্চুবাবু তো ব্রেকফাস্ট খায় না, ট্রে নিয়ে ফিরে আসি। মাসি তখন ঘরে ঢুকে দেখল নিভাঁজ শয্যা পড়ে আছে, ওয়ার্ডরোবের কপাট খুলে দেখল বাচ্চুর টি শার্ট, জিনস এসব ঝুলছে না, টেবিলের ওপর বাচ্চুর বইখাতা নেই। মাসি মেয়েকে জিজ্ঞেস করল, তনি, বাচ্চু কোথায় গেল?
বাঞ্ছ? হাউ ডু আই নো?
মাসি ছেলেকে জিজ্ঞেস করল, রোহণ বাচ্চু কোথায়?
বাচ্চুদাই জানে। আমি কারো পার্সন্যাল ব্যাপারে থাকিনে মা।
গাড়ি নিয়ে মাসি সোজা শ্রীরামপুরে চলে গেল। ভীষণ উল্কণ্ঠিত। পরের ছেলে। সুস্মিতা দরজা খুলে দিয়েই জড়োসড়ো হয়ে গেল।
কীরে সুস্মিতা, বাচ্চু এসেছে নাকি?
হ্যাঁ রে। এই তো তিনদিন আগে, বিষ্ণুত্বর। কলেজ থেকে চলে এল সোজা। তোকে বলে আসেনি, না?
সে কথার উত্তর না দিয়ে মাসি বল, এল কেন? মায়ের জন্যে হঠাৎ মন কেমন করে উঠল, না কী?
সুস্মিতা হেসে ফেলল, বলল, হবে হয়তো। তোকে বলে আসেনি, বোধহয় তুই আটকাবি বলে। কী পাজি দ্যাখ! তা ছাড়া তোকে পায়ও নি বোধহয় হাতের কাছে।
এসব কথা হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর মতো করে উড়িয়ে দিয়ে মাসি বলল, সুস্মিতা, ওর কীসের অসুবিধে? কোনো অনাদর করেছি। দ্যাখ, আমি নিজের হাতে না করলেও ওর সবকিছুরু ওপর নজর রেখেছি…
আরে দূর! তুই তো নজর রেখেছিসই। কমাসেই চেহারা পালটে দিয়েছিস।
তবে? ওর অভিমানটা কীসের? ও ফিরে এল কেন?
অভিমান-টান নয়। ও বড়ো খেয়ালি। কিছু মনে করিস না। নে, এখন চা খা। তো! বাবা-মরা ছেলে, মাফ করে দিস ভাই।
তা যেন হল। কিন্তু ও ফিরে এল কেন?
জানি না, বলছি না খেয়ালি!
বাছুর মাসি কোনোমতে চায়ে দুটো চুমুক দিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে গেল। তার ভেতরটা আসলে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে আছে। তার এমন আতিথ্য, এমন শৃঙ্খলা, হাতে-মুখে এমন সেবা, বাজারের শ্রেষ্ঠ খাবারদাবার। এর আগেও দু তিনটি ছেলেমেয়ে যে তার বাড়িতে থেকে মানুষ হয়নি, তা নয়। কেউ তো এভাবে ফিরে যায়নি! বাচ্ছ কেন ফিরে এল? কোনো কিছুকে খুব গুরুত্ব দেবার অভ্যেস মাসির নেই। কিন্তু এ প্রশ্নটা তাকে ভাবাচ্ছে। বাচ্চু কেন…।
সুস্মিতা বোনকে বলতে বাধ্য হল, সে জানে না। কিন্তু আসলে সে জানে। অর্থাৎ জানে না, বোঝেনি সঠিক। কিন্তু বাচ্চু তাকে বলেছে সে কেন ফিরে এসেছে।
শীতের কুয়াশা-ভরা রাত আটটা নাগাদ তার বড়ো কালো ব্যাগটা নিয়ে বাচ্চু ফিরে এল। কমাসেই তার স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে। চোখমুখ জ্বলজ্বল করছে। দরজা খুলে সুস্মিতা অবাক। আহ্লাদে আটখানা। তারপরই খেয়াল হল, শনি-রবি তো নয়! বিষুবার! তা ছাড়া এই ব্যাগ নিয়েও সে আসে না। বাড়িতে তার একপ্রস্ত জামাকাপড় থাকে। অসুবিধে হয় না। সে বলল, কী রে, আজ এখন চলে এলি?—কাল কলেজ নেই?
কেন থাকবে না?
যাবি না?
কেন যাব না?
তা হলে আজ এলি?
আমি চলে এলাম, ব্যাগটা টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বাচ্চু বলল।
চলে এলাম মানে?
চলে এলাম মানে চলে এলাম। আর যাব না।
সে কী? কী হল? কী অসুবিধে…
কিছু না।
কেউ কিছু বলেছে?
না তো!
তা হলে? বাচ্চু, এক এক বাড়ির লাইফ-স্টাইল একেক রকম। তুই… মানে। তোর কত অসুবিধে হবে বল তো? এখানে থেকে কলেজ করতে হলে?
বাচ্চু চুপচাপ নিজের ব্যাগের জিনিসপত্র যথাস্থানে রাখতে লাগল মন দিয়ে। তার মা তখনও দরজার কাছে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে।
গোছগাছ শেষ করে নিয়ে বাচ্চু হঠাৎ ফিরে দাঁড়াল। সে এগিয়ে এসে মায়ের কাঁধ দুটো ধরল। এখন সে মায়ের থেকে পুরো এক হাত লম্বা। মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে সে বলল, বলব। কিন্তু তুমি কী বুঝবে?
বুঝি না বুঝি, বাচ্চু, তুই বল অন্তত। আমাকে তো কৈফিয়ত দিতে হবে!
কৈফিয়ত? আমার কথা থেকে বোধহয় তুমি কোনও কৈফিয়ত তৈরি করতে পারবে না!
তবু বল।
মা, একটা মানুষ বেঁচে আছে, অথচ বেঁচে নেই, এমন অবস্থা দেখেছ? মনে পড়ে?
সুস্মিতা শিউরে উঠল। তার চোখে এখন আর জল আসে না। শুধু একটু শুষ্ক দুঃখ আর ভয় বিকীর্ণ হতে থাকে। সেদিকে নিবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে বাচ্চু বলল, এই ভয়ঙ্কর কোমা দেখে আমি জীবন শুরু করেছি মা। একটা মানুষ হাত-মুখ খিচোচ্ছে, তোমার দিকে চেয়ে আছে অথচ সে জানে না সে কী করছে। কোমা যখন একটা দুর্ঘটনার ফল হয় তখন কারও কিছু করার থাকে না। ব্যাপারটা সইতেই হয়। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই যখন মানুষ কোমার ভেতরে ঢুকে যেতে থাকে, খাচ্ছে-দাচ্ছে, মলমূত্র ত্যাগ করছে, অথচ অচৈতন্য, হাত-পা খিচোচ্ছে ওই গোয়াবাগানের মতো, কিংবা সাড়া দিতে পারছে না ঠিকঠাক, ধরো ম্যান্ডেভিলের
মতো, ক্লিনিক্যালি অ্যালাইভ, বাট ডেড… ডেড ফর অল প্র্যাকটিক্যাল পার্পাসেস… তখন আমি সেই ভয়াবহ কোমা সইতে পারি না। এর জন্য যদি পৃথিবীর দূরতম বিন্দু থেকেও আমাকে কলেজ যাতায়াত করতে হয়, আমি রাজি আছি।
বাচ্চু তাই ফিরে এসেছে।