Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বাঙ্গালীর বীরত্ব || Panchkari Dey » Page 5

বাঙ্গালীর বীরত্ব || Panchkari Dey

রাত্রি ঝাঁ ঝাঁ করিতেছে। পৃথিবী নিস্তব্ধ। রাত্রিঞ্চর ব্যতীত প্রাণীমাত্রেই নিশ্চল, নিদ্রিত। এ প্রকার প্রগাঢ় নিশীথ সময়ে কে ওই রমণী একাকিনী ঐ দ্বিতল গৃহের বাতায়নে বসিয়া আছেন? কেন ও নীলোৎপল বিনিন্দিত নয়নযুগল অসংখ্য নক্ষত্রখচিত নীলাকাশে অর্পিত হইয়াছে? যুবতী কি কাহারও আগমন প্রতীক্ষা করিতেছেন? না, কোন অসহ্য মনোবেদনায় একাল পৰ্য্যন্ত সুখশয্যা হইতে বঞ্চিত হইয়াছেন? গৃহমধ্যে একটি প্রদীপ জ্বলিতেছে এবং একখানি পর্য্যঙ্কোপরি একটি বিধবা নিদ্রিতা রহিয়াছেন। গৃহের নীচে দিয়া একটা শৃগাল খ্যাঁক খ্যাঁক্ করিয়া ছুটিয়া গেল, পরক্ষণেই কতকগুলো কুকুর কঠোর চীৎকার করিয়া উঠিল। বিধবার নিদ্রা ভাঙ্গিল, তিনি জানালার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “ঠাকুর-ঝি, শোবে না? রাত্রি অনেক হয়েছে যে।”

বাতায়নস্থিতা রমণী দেওয়ান গোবিন্দরামের সহধর্মিণী, নাম বিনো। বিনোদিনী ক্ষীণস্বরে উত্তর করিলেন, ‘হাঁ—যাই।”

বিধবা পাশমোড়া দিয়া বলিলেন, “সারা রাত জাগলে অসুখ হবে যে।”

বিনোদিনী। হাঁ—যাই।

বিধবা। আর দেরি করছ কেন? ঠাকুর-জামাই এলে এতক্ষণ আসতেন। আজ আর তিনি আসবেন না। তুমি শোবে এস।

বিনো। হাঁ, যাই।

বিধবা। সে কি, তুমি কাঁদছ নাকি?

বিনোদিনীর হৃদয়ে বড়ই যন্ত্রণা হইতেছিল। নানা দুশ্চিন্তা তাঁহার চিত্তপটে কতই অমঙ্গলের ছবি চিত্রিত করিতেছিল। বহুদিনের পর তাঁহার স্বামী আসিবেন। তিনি এতক্ষণ তাঁহার আগমন প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। বিধবার কথা শুনিয়া আর মনের আবেগ সংবরণ করিতে পারিলেন না, কাঁদিয়া ফেলিলেন।

বিধবা শয্যা পরিত্যাগ করিয়া বিনোদিনীর হস্ত ধরিয়া পর্য্যঙ্কে আনিয়া বসাইলেন এবং আপনি ও তাঁহার পার্শ্বে বসিলেন। সম্মুখস্থ দীপালোকে তাঁহাদের উভয়ের অনিন্দ্যবদন যার-পর-নাই মনোহর বোধ হইতে লাগিল। তাঁহারা উভয়েই যুবতী, উভয়েই সুন্দরী। পার্শ্বাপার্শ্বি উপবিষ্টা হইলে বোধ হইল যেন, একশাখায় একটি অর্দ্ধমুকুলিত ও আর একটি পূর্ণবিকশিত গোলাপ ফুল বিরাজিত রহিয়াছে। কি অপূর্ব্ব রূপলাবণ্য, কি অপূর্ব্ব শোভা! জগতে যত প্রকার সৌন্দর্য্য আছে, বোধ হয়, রমণী-সৌন্দর্য্যের নিকট সকলই পরাস্ত।

বিধবা নিজ বসনাঞ্চলে বিনোদিনীর মুখ মুছাইয়া দিয়া বলিলেন, “ছি ভাই! তুমি কাঁদছ কেন? ঠাকুর-জামাই এলেন না বলে কাঁদছ? তুমি বড় নির্ব্বোধ মেয়ে। কেঁদে তাঁর অকল্যাণ কর কেন? নৌকা-ডিঙ্গির পথ, জোয়ার ভাঁটার সুবিধা-অসুবিধা আছে; বোধ হয়, নৌকা এসে পৌঁছায়নি, তাই তিনি এলেন না। তা আজ না আসেন, কাল সকালে আসবেন। সেজন্য এত ভাবনা কি, কান্না কেন?”

বিনো। বৌ, আমার বড় মন কেমন করছে। আমার মনে কেবলই কু গাইছে। তিনি ভাল আছেন ত? (পুনর্ব্বার নয়ন যুগল জলে ভাসিয়া গেল।)

বিধবা। বালাই, ভাল থাকবেন না ত কি; এমন অমঙ্গুলে কথা মুখে আনতে আছে। ঠাকুর-ঝি, কে যেন সদর দরজায় ঘা দিচ্ছে না? তাই ত, দরজা ভেঙ্গে ফেল্লে যে।

বিনো। বাবা ত বাহিরে শুয়ে আছেন, তিনি কি এতই ঘুমিয়ে পড়েছেন?

বিধবা। রাত্রি কি কম হয়েছে। আহা! বুড়ো মানুষ, বসে থেকে থেকে হয় ত ঘুমিয়ে পড়েছেন। তা এক কৰ্ম্ম কর, প্রদীপটা নিয়ে আমার সঙ্গে এস, আমিই গিয়ে দরজা খুলে দিচ্ছি।

বিনোদিনীর মুখকমল প্রফুল্ল হইল। বিনোদিনী প্রফুল্ল অন্তরে বাম হস্তে প্রদীপ লইয়া আগে গিয়া ঘরের দ্বার খুলিলেন। বহির্দ্বারে শব্দের বিরাম নাই। বিধবা বিনোদিনীর পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন ও হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “তাই ত ঠাকুর-জামাইয়ের আর দেরি সচ্ছে না যে— দরজাটা ভেঙ্গে ফেলবে নাকি?”

তাঁহারা যেমন বহির্বাটীতে পদার্পণ করিলেন, অমনি বহির্দ্বারের একখানি কবাট সশব্দে ভাঙ্গিয়া পড়িয়া গেল; এবং যমদূতের ন্যায় বিকটাকার দুইজন পুরুষ বাটীর ভিতরে প্রবেশ করিল। তাহাদের সর্ব্বশরীর তৈল-কালীতে অভিষিক্ত, উভয়েরই হস্তে এক-একটি জ্বলন্ত মশাল ও এক- একগাছি সুদীর্ঘ যষ্টি; বামাদ্বয় অকস্মাৎ এই ভয়ঙ্কর মূর্ত্তিদ্বয় দেখিয়া ভয়ে চীৎকার করিয়া উঠিলেন। বিনোদিনীর হস্তস্থিত প্রদীপটি স্খলিত হইল। তাঁহারা দুইজনে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়িয়া গিয়া পূর্ব্বোক্ত দ্বিতল গৃহে প্রবেশ করিলেন।

বিনোদিনী স্বভাবতঃ কোমল প্রকৃতি, একে রাত্রি জাগরণে ও উৎকণ্ঠায় তাঁহার দেহ ও মন জৰ্জ্জরিত হইয়াছিল, তাহাতে আবার এরূপ ঘটনায় তিনি ভয়ে ও নৈরাশ্যে বিহ্বলা হইয়া পড়িলেন- —আর দাঁড়াইতে পারিলেন না—একেবারে জ্ঞানশূন্যা হইয়া ধরাশায়িনী হইলেন। বিধবাও হতবুদ্ধি হইয়া, ঘরের দ্বার রুদ্ধ করিয়া, গবাক্ষদ্বার দিয়া, বহির্বাটীর দিকে চাহিয়া কাষ্ঠবৎ দাঁড়াইয়া রহিলেন।

যে দুই বিকটমূৰ্ত্তি বাটীমধ্যে প্রবেশ করিল, তাহাদের এক জন দস্যু-প্রধান রত্নাপাখী ও অপর ব্যক্তি তাহার অনুচর। রত্নাপাখী বাটীমধ্যে প্রবেশ করিয়া ভয়ঙ্কর হুঙ্কার ছাড়িল ও ঝোড়োকে ঘাটি আগলাইতে বলিয়া সেই রমণীদ্বয়ের অনুসরণ করিল; কিন্তু উপরে যাইয়া দেখিল, তাঁহারা ভিতর হইতে দ্বার রুদ্ধ করিয়াছেন। তখন সে বাহির হইতে দ্বারের শিকল বন্ধ করিয়া পুনরায় বহির্বাটীতে আসিল। চণ্ডীমণ্ডপে একখানি খাটিয়ার উপরে দেওয়ানের শ্বশুর বৃদ্ধ হলধর ঘোষ নিদ্রা যাইতেছিলেন। ঠিক নিদ্রা নহে, রত্নাপাখীর বিকট চীৎকারের পূর্ব্বেই তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ হইয়াছিল, কিন্তু ডাকাইত পড়িয়াছে, দেখিয়া তিনি জড়বৎ পড়িয়া রহিলেন।

রত্নাপাখী মশালহস্তে বৃদ্ধের সম্মুখীন হইয়া বলিল, “ওরে বুড়ো, ঔ, তোর সেই জামাইয়ের চাকর বেটা কোথা?“

বৃদ্ধ। অ্যা—জামাই—

রত্না। তোর জামাইকে যমের বাড়ী পাঠিয়েছি, এখন তার চাকর আর বাক্স কোথা, বল্।

বৃ। অ্যা—বাক্স—তা আমি ত—কিছুই জা-নি না—বাবা—

র। তবে রে বেটা পাজি, জানিনে? (প্রহার করিতে করিতে) বল্ বলছি, কোথা আছে বল্। বৃ। দোহাই বাবা, আমি কিছুই জানি না, ভগবান জানেন আমি কিছুই জানি না। বাবা, এই চাবি দিচ্ছি—আমার যা কিছু আছে, তোমরা নাও, আমাকে প্রাণে মেরো না।

র। (চাবি লইয়া) আরে বেটা, তোর কি আছে, তা নেব, সে বাক্সটা কোথা বল্।

বৃ। বাবা, তোমার পায়ে পড়ি, আমায় আর মেরো না। বাক্স-মাক্স আমি কিছুই জানি না, বাবা। “বলবি নি,” বলিয়া রত্নাপাখী পদাঘাত করিয়া বৃদ্ধকে দূরে নিক্ষেপ করিল। বৃদ্ধ আর্তনাদ করিতে লাগিল; কিন্তু রত্নাপাখী তাহাতে কর্ণপাত না করিয়া পুনরপি একখানি বৃহৎ কাষ্ঠের দ্বারা তাহার হাত-পা ছেঁচিতে লাগিল। যখন দেখিল, তাহাতেও তাহার মনোরথ পূর্ণ হইল না, তখন সেই অসমর্থ, অসহায় বৃদ্ধকে টানিয়া লইয়া একটা গো-গৃহের ভিতরে প্রক্ষেপ করিল, বৃদ্ধ মৃতপ্রায় পড়িয়া রহিল। গোয়ালের গাভীটি সেই ভয়ঙ্কর মূর্তি, সেই জ্বলন্ত মশাল ও অরুন্তুদ ব্যাপার দেখিয়া লাফাইয়া উঠিল এবং বলপূর্ব্বক দড়ী ছিঁড়িয়া হাম্বারব করিতে করিতে পলাইয়া গেল।

রত্নাপাখী বাহির হইতে কবাট রুদ্ধ করিয়া সেই জ্বলন্ত মশাল দ্বারা ঘরের চালে আগুন লাগাইয়া দিল। চালের খড় ক্রমে জ্বলিয়া উঠিল। রত্নাপাখী পুনরায় অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া লুটপাট আরম্ভ করিল। বিধবা বাতায়ন হইতে বৃদ্ধ শ্বশুরের নিদারুণ নিপীড়ন ও যন্ত্রণা দেখিয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন, তাঁহার ক্রন্দনে বিনোদিনীর চেতনা হইল। তিনি উঠিয়া বসিলেন, কিন্তু উন্মাদিনীর ন্যায় কেবল একদিক পানে ফ্যাল্ ফ্যাল্ করিয়া চাহিয়া রহিলেন।

রত্নাপাখী নীচের ঘরে যাহা কিছু বহুমূল্য দ্রব্যাদি পাইল, সংগ্রহ করিয়া একখানি বস্ত্র দ্বারা আপনার কটিদেশে বন্ধন করিয়া উক্ত দ্বিতল গৃহের দ্বারে পদাঘাত করিতে লাগিল। বারংবার পদাঘাতে অর্গল ভাঙ্গিয়া গেল।

তখন রত্নাপাখী গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়াই বিনোদিনীর কণ্ঠহার ছিঁড়িয়া লইল,; লইয়া বলিল, “যদি বাঁচিতে চাস্ ত বাক্স বাহির করিয়া দে।”

কিন্তু কোন উত্তর না পাইয়া স্ত্রীলোক দুটিকে প্রহার করিতে করিতে বহির্বাটীতে লইয়া আসিয়া বলিল, “দেখ্ ঝোড়ো, সে চাকর ব্যাটা আর সেই বাক্সটা কোথা, যদি না বলে, তা হলে এ বেটীদেরও পুড়িয়ে মার্।।”

এই কথা বলিয়া রত্না ভয়ঙ্কর হুঙ্কার করতঃ চপলাক্রীড়াবৎ- যষ্টি সঞ্চালন করিতে করিতে ইতস্ততঃ বিচরণ করিতে লাগিল। গো-গৃহের চাল তখন ধূ ধূ করিয়া জ্বলিয়া উঠিয়াছে; এবং সেই গৃহমধ্যে হতভাগ্য বৃদ্ধ প্রাণভয়ে আর্তনাদ করিতেছে। কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য! কি লোমহর্ষণ ব্যাপার!

বিনোদিনী পুনর্ব্বার মোহপ্রাপ্ত হইলেন। কিন্তু ধন্য বিধবার সহিষ্ণুতা, ধন্য তাঁহার সাহস! তিনি এ অবস্থাতেও বিনোদিনীর মস্তক ক্রোড়ে লইয়া বসিলেন, এবং তাঁহাকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। বিনোদিনীর গাত্রে অবশিষ্ট যাহা কিছু অলঙ্কার ছিল, ঝোড়ো তাহা খুলিয়া লইল, শেষে কর্ণাভরণ শীঘ্র খুলিতে না পারিয়া বলপূর্বক ছিঁড়িয়া লইল। তাঁহার কপোল বহিয়া রুধির প্রবাহিত হইতে লাগিল। বিধবা কাঁদিতে কাঁদিতে নিজ বসনাঞ্চলে সেই রক্তধারা মুছাইয়া দিতে লাগিলেন।

এমন সময়ে “হায় কি করিলি পিশাচ,” বলিয়া কে চীৎকার করিয়া উঠিল? কাহার হৃদয়ের অন্তস্তল হইতে এ কাতর বাণী বিনির্গত হইল? বিধবা সেই স্বরে ক্ষণেকের জন্য ফিরিয়া চাহিলেন; চাহিয়া দেখিলেন, সেই মুহূর্ত্তে দস্যুর স্কন্ধ হইতে মস্তক দ্বিধা হইয়া গেল। বিধবা চীৎকার করিয়া উঠিলেন, এ কাহার কার্য্য? এ বিপদ কালে কে আসিয়া সহায়তা করিল? বিধবা আবার দেখিলেন, রক্তাক্ত অসিহস্তে উন্মত্তের ন্যায় একব্যক্তি আসিয়া বিনোদিনীকে হৃদয়ে তুলিয়া লইয়া অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন। সেই ব্যক্তি দেওয়ান গোবিন্দরাম।

পরক্ষণেই ভীম সর্দ্দার আসিয়া উপস্থিত হইল। রত্নাপাখী আপনাকে সহায়হীন দেখিয়া পলায়ন করিল। তখন ভীম সর্দ্দার আর্তনাদ শুনিয়া, প্রজ্জ্বলিত গো-গৃহে প্রবেশ করিয়া নিমেষের মধ্যে বৃদ্ধ হলধর ঘোষের উদ্ধার সাধন করিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *