বৈশালীর মন্ত্রভবনে একটি কক্ষে
বৈশালীর মন্ত্রভবনে একটি কক্ষে তিনজন কুলপতি বেদীর উপর বসিয়া আছেন, তাঁহাদেরও বয়স আরও বাড়িয়াছে। তাঁহাদের সম্মুখে পৃথক আসনে শিবামিশ্র হেঁটমুখে বসিয়া আছেন। প্রধান কুলপতি সহানুভূতিপূর্ণ স্বরে বলিতেছেন
আপনার এত দীর্ঘ সাধনা, এত দীর্ঘ প্রতীক্ষা—সবই ব্যর্থ হল। আবার শিশুনাগ বংশেরই একজন মগধের সিংহাসনে বসেছে।
ক্ষণেক স্তব্ধ থাকিয়া শিবামিশ্র মুখ তুলিলেন।
হাঁ, মগধের প্রজাপুঞ্জ আবার শিশুনাগ বংশের একজনকে সিংহাসনে বসিয়েছে। কিন্তু আমার সাধনা এখনও ব্যর্থ হয়নি। এখনও আমার হাতে একটি অস্ত্র আছে একটি অমোঘ অস্ত্র আছে। ভেবেছিলাম এ অস্ত্র ব্যবহার করতে হবে না—কিন্তু আর উপায় নেই।
দ্বিতীয় কুলপতি প্রশ্ন করিলেন—কী অস্ত্র—কোন্ অস্ত্রের কথা বলছেন?
শিবামিশ্র বলিলেন—মহামান্য কুলপতিগণ, এতদিন আমি আপনাদের কাছে কোনও সাহায্য চাইনি, মনে করেছিলাম আমি একাই শিশুনাগ বংশ নির্মূল করতে পারব। কিন্তু এখন আপনাদের কাছে আমার একটি প্রার্থনা।
প্রধান কুলপতি বলিলেন—কি প্রার্থনা বলুন। আমরা তো সর্বদাই সর্বভাবে আপনাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত।
শিবামিশ্র বলিলেন—ধন্য। (ক্ষণেক চিন্তা করিয়া) মগধের সঙ্গে লিচ্ছবির ভিতরে ভিতরে শত্রুতা থাকলেও প্রকাশ্যে মৈত্রীভাবই আছে—
কুলপতিগণ সকলেই মৃদু হাস্য করিলেন।
তৃতীয় কুলপতি বলিলেন—তা আছে।
শিবামিশ্র বলিলেন—কিন্তু দীর্ঘকাল লিচ্ছবির কোনও রাষ্ট্রপ্রতিনিধি মগধের রাজসভায় উপস্থিত নেই।
প্রধান কুলপতি কহিলেন—না। মগধও আমাদের সভায় প্রতিনিধি পাঠায়নি, আমরাও পাঠাইনি।
মগধে এখন নূতন রাজা, সুতরাং প্রতিনিধি পাঠালেও দোষের হবে না। আপনারা প্রতিনিধি পাঠান, শুধু আমার প্রার্থনা, আমি যাকে নির্বাচন করব তাকেই প্রতিনিধি পাঠাবেন।
কুলপতিগণ পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করিয়া সম্মতিসূচক শিরঃসঞ্চালন করিলেন—
আপত্তি কি? এতেই যদি আপনার কার্যসিদ্ধি হয়—
শিবামিশ্র উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং দুই হাত তুলিয়া আশীর্বাদ করিলেন—
আপনারা ধন্য।
শিবামিশ্রের বাটি-সংলগ্ন ক্রীড়াভূমি। পুরুষবেশা উল্কা একজন বয়স্ক অসি-শিক্ষকের সহিত অসিক্রীড়া করিতেছে। দুজনের হাতে ঋজু অসি, দেহে লৌহজালিক। অসির সহিত অসির সংঘাতে ঝন্ ঝন্ শব্দ উঠিতেছে, অসিফলকে আলো ঝলকিয়া উঠিতেছে। উল্কার অধরেও মাঝে মাঝে হাসির ঝলক খেলিয়া যাইতেছে।
অসি-ক্রীড়া চলিতেছে এমন সময় শিবামিশ্র ক্রীড়াভূমির প্রান্তে আসিয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহার বক্ষ বাহুবদ্ধ, চোখে একাগ্র কঠোর দৃষ্টি। তিনি নীরবে অসিক্রীড়া দেখিতে লাগিলেন।
অবশেষে উল্কা শিক্ষককে অসিযুদ্ধে পরাস্ত করিয়া ভূতলশায়ী করিল, তারপর উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া গুরুর পদধূলি গ্রহণ করিল। গুরু ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিলেন। নতজানু উল্কার মস্তকে হস্তার্পণ করিয়া বলিলেন—
বিজয়িনি! তোমাকে আর আমার কিছু শেখাবার নেই।
শিবামিশ্র উল্কার পিছনে আসিয়া দাঁড়াইলেন—
শিষ্যবিদ্যা গরীয়সী।
উল্কা উঠিয়া দাঁড়াইয়া শিবামিশ্রের দিকে ফিরিয়া হাসিল, শিবামিশ্র কিন্তু হাসিলেন না, গম্ভীরভাবে উল্কাকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন—
উল্কা, তোমার শিক্ষা শেষ হয়েছে যাও, স্নান কর গিয়ে। স্নান করে আমার ঘরে যেও–তোমাকে কিছু বলবার আছে।
উল্কা ঈষৎ বিচলিত হইল, কিন্তু কোনও প্রশ্ন না করিয়া প্রস্থান করিল।
যে আজ্ঞা পিতা।
একটি প্রসাধন কক্ষ। উল্কা স্নান সারিয়া বেশ পরিবর্তন করিয়াছে, সিক্ত কেশ পৃষ্ঠে লম্বিত। সে একটি ধাতু-নির্মিত দর্পণ বাঁ হাতে ধরিয়া সযত্নে ভ্রূ মধ্যে সিন্দুরের টিপ পরিল।
শিবামিশ্র নিজ কক্ষে বসিয়া আছেন; তাঁহার মুখ বিষণ্ণ গম্ভীর।
উল্কা আসিয়া দ্বারের নিকট দাঁড়াইল। শিবামিশ্রকে আত্মস্থ দেখিয়া সে সঙ্কুচিতভাবে বেদীর পাশে আসিয়া বসিল। শিবামিশ্র চিন্তা-জড়িমা হইতে জাগিয়া উল্কার পানে স্নেহবিধুর চক্ষে চাহিয়া রহিলেন, অঙ্গুলি দিয়া তাহার চিবুক তুলিয়া ধরিয়া ঈষৎ কম্পিত স্বরে বলিলেন
কন্যা—আমার কন্যা
উল্কা শঙ্কা-বিস্ফারিত চক্ষে বলিল—কি হয়েছে পিতা?
শিবামিশ্র আত্মসংবরণ করিলেন।
মা, আজ যেকথা তোমাকে বলতে যাচ্ছি তা উচ্চারণ করতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। তবু বলতে হবে। তোমার জীবনের কাহিনী আজ তোমাকে শোনাব।
আমার জীবনের কাহিনী।
হাঁ। বড় ভয়ঙ্কর সে কাহিনী। তুমি সহ্য করতে পারবে?
উল্কা ক্ষণেক নিজের মনের অজ্ঞাত আশঙ্কার সহিত যুদ্ধ করিল, তারপর দৃঢ়স্বরে বলিল
বলুন পিতা, আমি সহ্য করতে পারব।
শিবামিশ্র কুণ্ঠিত নীরবতার পর বলিলেন
উল্কা, তুমি আমার কন্যা নও।
উল্কা বুদ্ধিভ্রষ্টের মত চাহিয়া রহিল, তাহার অধরোষ্ঠ বিভক্ত হইয়া গেল। শেষে সে স্খলিতকণ্ঠে বলিল—
কন্যা নই—আপনার কন্যা নই। তবে আমি কে?
তুমি যখন একদিনের শিশু তখন আমি তোমাকে পাটলিপুত্রের মহাশ্মশান থেকে তুলে এনেছিলাম।
পাটলিপুত্রের মহাশ্মশান! (রুদ্ধশ্বাসে) পিতা, সব কথা আমাকে বলুন, কিছু গোপন করবেন না।
দুইজনেই গভীরভাবে অভিভূত। তারপর শিবামিশ্র নিজের মন দৃঢ় করিয়া বলিলেন—
বলছি শোনো। উল্কা, কন্যা আমার, যা বলছি সংযতভাবে শোনো, ধৈর্য হারিও না
না পিতা, আমি ধৈর্য হারাব না-আপনি বলুন।
অতঃপর শিবামিশ্র উল্কার জীবন কাহিনী বলিলেন। উল্কা সারা দেহ ঋজু ও কঠিন করিয়া শুনিল; তাহার চোখের দীপ্তি অস্বাভাবিক।
শিবামিশ্র অবশেষে বলিলেন—বৎসে, এই তোমার জীবনের ইতিহাস। তুমি বিষকন্যা।
উল্কা মোহাচ্ছন্ন স্বরে বলিল—বিষকন্যা
হাঁ। বিষকন্যা যে পুরুষের সংসর্গে আসবে তার মৃত্যু হবে। তাই তোমার বিবাহ দিইনি।
উল্কা নতদৃষ্টিতে কিয়ৎকাল বসিয়া থাকিবার পর চক্ষু তুলিল—
পিতা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। এই ইতিহাস আমাকে বলবার কি প্রয়োজন ছিল?
শিবামিশ্র কহিলেন—যতদিন প্রয়োজন হয়নি বলিনি। আজ প্রয়োজন হয়েছে—উল্কা, প্রতিহিংসা সাধনের জন্য আমি বেঁচে আছি। চণ্ড আর মগধের সিংহাসনে নেই বটে, কিন্তু শিশুনাগ বংশ এখনও সদর্পে রাজত্ব করছে। এর প্রতিবিধান এখন এক তুমিই করতে পার।
উল্কা চমকিয়া বলিল—আমি। আমি কি করতে পারি?
শিবামিশ্র স্থির নেত্রে উল্কার পানে চাহিলেন—
তুমি বিষকন্যা। শিশুনাগ বংশের উচ্ছেদ তুমিই করতে পার।
উল্কা তাঁহার কথার ইঙ্গিত বুঝিল। ক্ষণকাল নতমুখে থাকিয়া মুখ তুলিল—কি করতে হবে বলে দিন।
যা বলব—পারবে।
পারব।
শিবামিশ্র তখন বলিলেন—শোনো—শিশুনাগ বংশের সেনজিৎ এখন মগধের সিংহাসনে। প্রজারা তাকে ভালবাসে, তার বিরুদ্ধে মাৎস্যন্যায় করবে না। আমরা স্থির করেছি তোমাকে লিচ্ছবি রাজ্যের প্রতিনিধি করে পাটলিপুত্রে পাঠাব। তুমি রাজসভায় আসন পাবে, সর্বদা সেনজিতের সঙ্গে তোমার দেখা-সাক্ষাৎ হবে।…সেনজিৎ বয়সে তরুণ, তার ওপর শিশুনাগ বংশের রক্ত তার শরীরে আছে বুঝতে পারছ?
উল্কা দৃঢ়স্বরে বলিল-বুঝেছি পিতা। আর কিছু করতে হবে?
শিবামিশ্র ক্ষণেক চিন্তা করিয়া বলিলেন—শুনেছি প্রজারা চণ্ডকে হত্যা করেনি। সে যদি বেঁচে থাকে, তোমার মা মোরিকার ঋণ এখনও শোধ হয়নি।
উল্কা উঠিয়া দাঁড়াইল—সে ঋণ আমি শোধ করব।
শিবামিশ্রও উঠিয়া দাঁড়াইলেন; উল্কা তাহার নিকটে আসিয়া তাহার হাত ধরিল। বলিল—
পিতা, আপনার ইচ্ছা পূর্ণ হবে। যে দুর্গ্রহের অভিসম্পাত নিয়ে আমি জন্মেছি, আমার মায়ের নিষ্ঠুর হত্যার প্রতিশোধ নিয়ে তা সার্থক হবে। আপনি আমাকে কন্যার মত পালন করেছেন, সে ঋণও এই অভিশপ্ত দেহ দিয়ে পরিশোধ করব।
শিবামিশ্র উল্কার দুই স্কন্ধের উপর হাত রাখিলেন। তাঁহার কণ্ঠস্বর কাঁপিয়া গেল
উল্কা! প্রাণাধিকা কন্যা আমার! আশীর্বাদ করি বিজয়িনী হয়ে আবার আমার কোলে ফিরে এস–
উল্কা নতজানু হইয়া তাঁহার জানু জড়াইয়া ধরিল।
দিবা দ্বিপ্রহর। পাটলিপুত্র নগরের উপকণ্ঠে মৃগয়া কাননকে চক্রাকারে বেষ্টন করিয়া নির্জন পথ গিয়াছে।
মধ্যবয়স্ক কৃষকশ্রেণীর একটি লোক এই পথ দিয়া আসিতেছে। তাহার মাথায় বৃহৎ ঝাঁকা, ঝাঁকার মধ্যে কয়েকটি কলার কাঁদি রহিয়াছে; মনে হয় লোকটি কদলী লইয়া পাটলিপুত্র নগরে বিক্রয় করিতে যাইতেছে।
একটি বৃক্ষতলে আসিয়া লোকটি ঝাঁকা নামাইয়া বসিল, গামছা দিয়া নিজেকে বীজন করিতে লাগিল; তারপর এক কাঁদি সুপক্ক কলা বাহির করিয়া নিশ্চিন্তমনে খাইতে লাগিল।
বাঁকের মুখে অনেকগুলি অশ্বের ক্ষুরধ্বনি শোনা গেল। লোকটি গলা বাড়াইয়া দেখিল। একদল অশ্বারোহী আসিতেছে।
অশ্বারোহীদের অগ্রে উল্কা। তাহার পাশে একটু পিছনে উল্কার প্রিয়সখী বাসবী। তাহাদের পশ্চাতে আরও তিনটি তরুণী। সকলেরই পুরুষবেশ। তাহাদের পিছনে চারজন পুরুষ রক্ষী।
কদলী-ভক্ষণ নিরত লোকটির পাশ দিয়া যাইবার সময় উল্কা অশ্ব স্থগিত করিল।
পথিক, পাটলিপুত্রের পুরদ্বার আর কতদূর বলতে পারো?
পথিক কদলীচর্বণে বিরতি দিয়া বলিল—তা পারি বৈকি ঠাকরুন। —এই রাজপথ দিয়ে যদি যেতে চাও, চার ক্রোশ পথ। ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছ, পৌঁছুতে দুতিন দণ্ড লাগবে।
উল্কা জিজ্ঞাসা করিল—রাজপথ ছাড়াও অন্য পথ আছে নাকি?
পথিক বলিল—আছে বৈকি ঠাকরুন, এই বনের ভিতর দিয়েও যাওয়া যায়। তবে ওটা রাজার মৃগয়া কানন, সাধারণ লোকের ওর ভিতর দিয়ে যাওয়া বারণ।
উল্কা ভ্রূভঙ্গি করিয়া বলিল-বারণ। তবে আমি বনের ভিতর দিয়েই যাব, দেখি কে বারণ করে। (অন্য সকলকে) তোমরা রাজপথ দিয়ে যাও।
বাসবী উদ্বিগ্নভাবে বলিল—ও প্রিয় সখী, তুমি বনের ভিতর দিয়ে একলা যাবে? যদি হারিয়ে যাও?
উল্কা হাসিয়া বলিল—ভয় নেই, আমি হারাব না। দেখিস, তোদের আগে পৌঁছুব।
উল্কা ছাড়া আর সকলে পথ দিয়া ঘোড়া ছুটাইয়া চলিয়া গেল, তারপর উল্কা মৃগয়া কাননে প্রবেশ করিল। পথিক কলা খাইতে খাইতে দেখিল। অর্ধস্ফুটস্বরে বলিল—
হুঁ। দেবীর দেখছি এবার ঘোটকে আগমন!
মৃগয়া কাননের ভিতর দিয়া উল্কা চারিদিকে দেখিতে দেখিতে চলিয়াছে। কোথাও হরিণের দল, কোথাও সরোবরে মরাল সারস ক্রীড়া করিতেছে। কোথাও ময়ুর নাচিতেছে।
একটি ঝিলের পাশ দিয়া যাইতে যাইতে উল্কা অশ্ব হইতে অবতরণ করিল, ঝিলের কিনারায় নতজানু হইয়া অঞ্জলি ভরিয়া জল পান করিল।
জলপানান্তে পিছু ফিরিয়া উল্কা দেখিল, ভীষণাকৃতি একটা লোক তাহার অশ্বের বলগা ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছে। লোকটা মৃগয়া কাননের রক্ষী কুম্ভ। সে রূঢ়কণ্ঠে বলিল—
কে রে তুই। তোর কি প্রাণের ভয় নেই?—আরে এ কি—এ যে নারী!!
উল্কা অধর কুঞ্চিত করিল।
হাঁ নারী! তুমি কে?
কুম্ভের উগ্রভাব তিরোহিত হইল। সে বলিল—আমি এই বনের রক্ষী। সুন্দরি, তুমি এই পথহীন বনে একলা এসেছ বুঝেছি—অভিসারে এসেছ। (চোখ টিপিয়া) তোমার নাগর কই?
উল্কা উত্তর দিল না, বিরক্তিপূর্ণ চক্ষে চাহিয়া রহিল। কুম্ভ লুব্ধভাবে তাহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল
তা নাগরিকা, নাই বা এল তোমার নাগর, অভিমান করে চলে যেও না।—এস, কাছেই আমার গুল্ম, চল তোমাকে সেখানে নিয়ে যাই (উল্কা ঘৃণাভরে তাহাকে পাশ কাটাইবার চেষ্টা করিল)—ও কি, চললে যে! আমিও তো পুরুষ, আমার পানে একবার চেয়েই দেখ না
কুম্ভ উল্কার হাত ধরিবার চেষ্টা করিল।
উল্কা তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলিল—আমাকে ছুঁও না—অনার্য!
কুম্ভের মুখ আরও কালো হইয়া উঠিল—অনার্য! বটে! তবে দেখি আজ অনার্যের হাত থেকে কে তোমাকে রক্ষা করে।
কুম্ভ বাম বাহু দ্বারা উল্কার কটিবন্ধন বেষ্টন করিয়া আকর্ষণ করিল এবং লালসাপুর্ণ মুখ উল্কার মুখের কাছে আনিল।
বর্বর! জানিস না—আমি বিষকন্যা! আমাকে ছুঁলে মরতে হয়। বিদ্যুদ্বেগে কটি হইতে ছুরিকা বাহির করিয়া উল্কা কুম্ভের পঞ্জরে বিদ্ধ করিয়া দিল। কুম্ভ কিছুক্ষণ অবাক হইয়া রহিল। তারপর গলার মধ্যে শব্দ করিয়া মাটিতে পড়িয়া গেল!
উল্কা অগ্নিপুর্ণ চক্ষে কুম্ভকে দেখিতে দেখিতে ছুরিকা আবার নিজ কটিতে রাখিল, তারপর এক লক্ষে অশ্বপৃষ্ঠে উঠিল।
দিবা প্রায় তৃতীয় প্রহর। পাটলিপুত্রের উত্তুঙ্গ নগরদ্বার। পথে জন-চলাচল নাই; তোরণদ্বারের দুই পাশে দুইজন করিয়া প্রতীহার প্রাচীরগাত্রে ঠেস দিয়া ঝিমাইতেছে, তাহাদের হাতে বল্লম।
একটি ফুটি কাঁকুড়-বোঝাই গরুর গাড়ি বাহির হইতে ভিতর দিকে চলিয়া গেল। তারপর দ্রুত অশ্বক্ষুরধ্বনি শুনিয়া প্রতীহার চতুষ্টয় খাড়া হইয়া দাঁড়াইল।
উল্কা ও তাহার দল আসিতেছে। প্রতীহারগণ ইতিমধ্যে দৃঢ়ভাবে বল্লম ধরিয়া পথ আগলাইয়া সমব্যবধানে দাঁড়াইয়াছে। উল্কা তাহাদের সম্মুখে আসিয়া রাশ টানিয়া অশ্বকে দাঁড় করাইল। তাহার সঙ্গী ও সঙ্গিনীরা কিছুদুর পশ্চাতে দাঁড়াইল।
প্রতীহারদের মধ্যে যে ব্যক্তি প্রধান তাহার গালপাট্টা ও গোঁফ বড় বড়। সে বলিলকে
কে যায়
উল্কা গর্বিতস্বরে কহিল—লিচ্ছবি রাজ্যের প্রতিনিধি।
প্রতিনিধি মহাশয় কোথায়?
উল্কা বলিল—আমি লিচ্ছবির প্রতিনিধি—পথ ছাড়ো।
প্রধান প্রতীহার গোলাকার চক্ষু পাশের প্রতীহারের দিকে ফিরাইল, পাশের প্রতীহার চক্ষু গোল করিয়া তৃতীয় প্রতীহারের দিকে ফিরাইল, তৃতীয় প্রতীহার চতুর্থ প্রতীহারকে উক্তরূপে নিরীক্ষণ করিল। উল্কা অধীরভাবে অধর দংশন করিল। তখন প্রধান প্রতীহার গলা খাঁকারি দিয়া বলিল—
লিচ্ছবি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি মহাশয়া, নগরে প্রবেশ করুন।
নগরের অভ্যন্তর। তোরণদ্বার হইতে কিয়দ্দূরে পথের পাশে একটি জলাধার, প্রস্তর-নির্মিত গো-মুখ হইতে জল নিঃসৃত হইয়া জলাধারে সঞ্চিত হইতেছে। কয়েকটি মৃত্তিকার পান-পাত্র ইতস্তত পড়িয়া আছে।
সহসা অনতিদূর হইতে শুষ্ক কর্কশ কণ্ঠস্বর আসিল—
জল! জল! জল দাও—
উষ্কার দল মন্থর গতিতে এইদিকেই আসিতেছে। তাহারা জলাধারের পাশ দিয়া যাইবার সময় আবার সেই কর্কশ কণ্ঠস্বর শোনা গেল—
জল! জল! জল দাও।
উল্কা ঘোড়া থামাইল, বাসবীও আসিল। উল্কা আর সকলকে আগে বাড়িতে ইঙ্গিত করিল। তাহারা চলিয়া গেল। উল্কা ও বাসবী অশ্ব হইতে অবতরণ করিল।
রাজপথ হইতে অদূরে একটি কণ্টকগুল্মের আড়ালে প্রস্তর-নির্মিত একটি বেদী : বেদীটি সমচতুষ্কোণ, দৈর্ঘ্যে প্রস্থে দশ হাত। ভূতপূর্ব মগধেশ্বর চণ্ড এই বেদীর উপর পড়িয়া আছেন। তাহার হস্ত-পদ শৃঙ্খলাবদ্ধ, মাথায় রুক্ষ জটিল কেশ, চোখে তীব্র হিংস্র দৃষ্টি।
জল! জল! জল!
উল্কা ও বাসবী আসিয়া বেদীর পাশে দাঁড়াইল। উল্কার মুখে কোনও বিকার নাই, কিন্তু বাসবী ভয় পাইয়াছে। সে শঙ্কিতস্বরে বলিল—এ কে, প্রিয়সখি?
উল্কা চণ্ডকে দেখিতে দেখিতে বলিল—বোধহয় কোনও অপরাধী।
তাহাদের কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইয়া চণ্ড মাথা তুলিলেন; দন্ত নিষ্ক্রান্ত করিয়া ভীষণ স্বরে বলিলেন
জল দাও—জল!
উল্কা অবিচলিত ভাবে চণ্ডের পানে চাহিয়া বলিল—বাসবী, জলাধার থেকে জল নিয়ে আয়—
বাসবী যে পথে আসিয়াছিল সেই পথে চলিয়া গেল।
উল্কা আরও কিছুক্ষণ চণ্ডকে অবিচলিত মুখে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল—কোন্ অপরাধে তোমার এই দণ্ড হয়েছে?
চণ্ড উত্তর দিলেন না, কণ্ঠের মধ্যে ক্রুর ব্যাঘ্রের মত শব্দ করিলেন। বাসবী মৃৎপাত্রে জল লইয়া ফিরিয়া আসিল কিন্তু চণ্ডের নিকটে যাইতে ইতস্তত করিতে লাগিল। উল্কা তখন মৃৎপাত্র লইয়া চণ্ডের হাতে দিল। চণ্ড দুই হাতে পাত্র ধরিয়া জল পান করিলেন এবং শূন্য পাত্র দূরে নিক্ষেপ করিলেন।
উল্কা প্রশ্ন করিল—কে তোমার এমন অবস্থা করেছে? শিশুনাগ বংশের রাজা?
চণ্ড বিষাক্ত চক্ষে উল্কার পানে চাহিলেন—পথের কুকুর সব—দূর হয়ে যা—দুর হয়ে যা
বাসবী ভীতভাবে বলিল—এস প্রিয়সখি, আমরা চলে যাই
উল্কা চণ্ডকে জিজ্ঞাসা করিল—তুমি কে?
আমি কে! তুই জানিস না? হা হা
আমি পাটলিপুত্রে নতুন এসেছি।
চণ্ড উগ্রস্বরে বলিল—যা–দুর হ—দূর হয়ে যা। একদিন তোদের পায়ের তলায় পিষেছি—আবার যেদিন শিকল ছিড়ব—যা, এখন দুর হ।
উল্কা সহসা প্রজ্বলিত চক্ষে চাহিয়া বলিল—তোমার নাম কি?
চণ্ড গর্জন করিলেন—আমার নাম জানিস না! মিথ্যাবাদিনী। আমার নাম কে না জানে! আমি চণ্ড—মহারাজ চণ্ড! তোর প্রভু—তোর দণ্ডমুণ্ডের অধীশ্বর। আমি মগধের ন্যায্য অধিপতি—মহারাজ চণ্ড।
উল্কার সারা দেহ যেন বিদ্যুৎশিখার মত জ্বলিয়া উঠিল। সে এক পা আগে বাড়িল, অমনি বাসবী পিছন হইতে তাহার হাত ধরিয়া আকর্ষণ করিল।
প্রিয়সখি, চল আমরা যাই। এখানে কেউ নেই—আমার ভয় করছে।
উল্কা বাসবীর দিকে ফিরিয়া মুখে ক্ষীণ হাসি টানিয়া আনিল। বলিল—বাসবী, তুই যা। তোরা সকলে ঐ পিপ্পলি গাছের তলায় অপেক্ষা কর, আমি এখনি যাচ্ছি।
বাসবী একটু দ্বিধা করিল; উল্কা তাহাকে লঘুহস্তে ঠেলিয়া দিল; তারপর চণ্ডের দিকে ফিরিল। বাসবী চলিয়া গেল।
উল্কা গভীর বিরাগ ভরে বলিল—তুমিই ভূতপূর্ব রাজা চণ্ড!
চণ্ড বলিলেন—ভূতপূর্ব নয়, আমিই রাজা। আমি থাকতে মগধে অন্য রাজা নেই।
উল্কা বলিল—তোমার প্রজারা তাহলে তোমাকে হত্যা করেনি!
চণ্ড দম্ভভরে বলিলেন—আমাকে হত্যা করবে এত সাহস কার আছে? যেদিন শিকল ছিডব—
চণ্ড শিকল ছিড়িবার চেষ্টায় দুই বাহু আস্ফালন করিতে লাগিলেন, শিকল কিন্তু ছিড়িল না।
উল্কা কুঞ্চিত চক্ষে চাহিয়া বলিল—মহারাজ চণ্ড, মোরিকা নামে রাজপুরীর এক দাসীকে মনে পড়ে?
মোরিকা। কে মোরিকা।
মনে করে দেখুন, আপনার অবরোধে মোরিকা নামে দাসী ছিল—মোরিকার এক বিষকন্যা জন্মেছিল—আপনি সেই বিষকন্যার পিতা। মনে পড়ে?
চণ্ডের ক্রুর চক্ষু সহসা উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিল—
মনে পড়েছে। সেই বিষকন্যাকে শ্মশানের বালুতে পুঁতেছিলাম-হাঃ হাঃ হাঃ—মন্ত্রী শিবমিশ্রকেও শৃগালে ছিঁড়ে খেয়েছিল—
উল্কার কণ্ঠে গাঢ় শীৎকার ফুটিয়া উঠিল—
সে বিষকন্যা মরেনি, শিবমিশ্রকেও শৃগালে ছিঁড়ে খায়নি। মহারাজ চণ্ড, ভাল করে চেয়ে দেখুন নিজের কন্যাকে চিনতে পারছেন না? (চণ্ড বিস্ফারিত চক্ষে চাহিয়া রহিলেন) আমি সেই বিষকন্যা!—মহারাজ, শিশুনাগ বংশের চিরন্তন নিয়তি মনে আছে কি? এ বংশের রক্ত যার শরীরে আছে সে-ই পিতৃহন্তা হবে। তাই বহু দুর থেকে বংশের প্রথা পালন করতে এসেছি।
উল্কা কটি হইতে ছুরিকা বাহির করিল। কিন্তু উত্তেজনার ঝোঁকে সে চণ্ডের কাছে আসিয়া পড়িয়াছিল, চণ্ড শৃঙ্খলিত হস্তে তাহার মণিবন্ধ ধরিয়া ফেলিলেন। উল্কা হাত ছাড়াইবার চেষ্টা করিল কিন্তু পারিল না, চণ্ডের বজ্রমুষ্টির চাপে ছুরি তাহার হাত হইতে পড়িয়া গেল। নিঃশব্দে দুজনের মধ্যে টানাটানি চলিতে লাগিল।
এই স্থান হইতে কিয়দূরে নাগবন্ধুকে দেখা গেল। মুহূর্ত মধ্যে ব্যাপার বুঝিতে পারিয়া নাগবন্ধু ছুটিয়া আসিল।
ইতিমধ্যে চণ্ড দুই হাতে উল্কার কণ্ঠ চাপিয়া ধরিয়াছেন, উল্কার মুখ নীলবর্ণ ধারণ করিয়াছে। নাগবন্ধু ছুটিয়া আসিয়া উল্কার স্খলিত ছুরি তুলিয়া লইল এবং একটি আঘাতে উহা চণ্ডের কণ্ঠে প্রবিষ্ট করাইয়া দিল।
চণ্ডের হাত শিথিল হইয়া গেল, তিনি চিৎ হইয়া বেদীর উপর পড়িয়া গেলেন। উল্কা উঠিয়া দাঁড়াইয়া কটিলগ্ন হস্তে দেখিতে লাগিল।
চণ্ডের প্রকাণ্ড দেহ মৃত্যু-যন্ত্রণায় ধড়ফড় করিতে লাগিল। দুইবার তিনি কথা বলিবার চেষ্টা করিলেন কিন্তু বাক্যস্ফুর্তি হইল না, মুখ দিয়া গাঢ় রক্ত নির্গলিত হইয়া পড়িল। তারপর চণ্ডের দেহ স্থির হইল।
ঊর্ধ্বে বায়সের কর্কশ স্বর শোনা গেল। উল্কা এবং নাগবন্ধু চোখ তুলিয়া দেখিল অদূরে একটি বৃক্ষের শুষ্ক শাখায় বসিয়া কাক ডাকিতেছে।