Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

চার দিন বাদে মুখে দুশ্চিন্তা

চার দিন বাদে মুখে দুশ্চিন্তা এবং শরীরে ক্লান্তি নিয়ে এয়ার ইণ্ডিয়ার জাম্বো জেট থেকে এক বিকেলে নিউ ইয়র্কের জে এফ কে বিমানবন্দরে নামলেন বাবুরাম এবং বনিকে কোলে নিয়ে প্রতিভা।

প্রতিভাকে রেখে-ঢেকে সবই প্রায় বলেছেন বাবুরাম। শুধু বনির প্রসঙ্গটা চাপা দিয়ে বনির জবানিতে যা জেনেছেন সেটা চাপিয়েছেন চি চেং তথা পানচোর ঘাড়ে। প্রতিভা পুরোপুরি বিশ্বাস করেননি। তবে বনির ভালর জন্য সবকিছু করতেই তিনি রাজি। তাই তাঁদের পক্ষে বিপজ্জনক আমেরিকাতেও ফিরে আসতে সম্মত হয়েছেন।

চি চেং-কে সঙ্গেই এনেছেন বাবুরাম। মস্ত বড় সুটকেসে জামা কাপড়ের সঙ্গেই তাকে ভরে লাগেজে দিয়েছিলেন। মালপত্র যখন এক্স-রে করা হচ্ছিল তখন বাবুরামের ভয় ছিল, পানচো ধরা পড়ে যাবে। কিন্তু অবাক কাণ্ড, পানচোর ছবি এক্স-রে মেশিনে ধরা পড়েনি।

প্রতিভা বললেন, “শোনো, নিজেদের বাড়ি থাকতে হোটেলে ওঠাটা আমার পছন্দ নয়।”

বাবুরাম সবিস্ময়ে বললেন, “নিজেদের বাড়িতে উঠব! সর্বনাশ। শয়তানরা যে ওত পেতে থাকবে সেখানে!”

প্রতিভা শান্ত গলায় বললেন, “আমার তো ভয় করছে না। আমাদের সঙ্গে পানচো আছে।”

“পানচো!” বলে বাবুরাম একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, “ঠিক আছে। চলো, বাড়িতেই যাই। বাড়ি যেতে ইচ্ছেও করছে আমার।”

ট্যাক্সি নিয়ে তাঁরা জার্সি সিটির বাড়িতে এলেন। তারপর ঘরদোর পরিষ্কার করা, বাজার করা, রান্না খাওয়া ইত্যাদিতে সময় চলে গেল। রাত্রিবেলা পানচোকে বেসমেন্টে নিয়ে গেলেন বাবুরাম। সঙ্গে বনি এবং প্রতিভাও বেসমেন্টে বাবুরামের নিজস্ব অত্যাধুনিক ব্যক্তিগত

কমপিউটার আছে। কমপিউটারের মাধ্যমে বনির সঙ্গে বাবুরামের কথা হতে লাগল।

“বনি, আমরা ফের আমেরিকায় এসেছি।”

“বুঝতে পারছি।”

“তোমার কেমন লাগছে?”

“ভাল।”

“বনি, মাদার কমপিউটারকে টের পাচ্ছ?”

“পৃথিবীর যেখানেই যাই না কেন, মাদার কমপিউটার আমাকে নিয়ন্ত্রণ করবেই।”

“তুমি কি মাদার কমপিউটারকে পছন্দ করো?”

“কিছুটা করি। কিন্তু মাঝে-মাঝে…”

“মাঝে-মাঝে কী বনি?”

“মাঝে-মাঝে কী একটা গণ্ডগোল হয়ে যায়।”

“যদি মাদার-কমপিউটার ধ্বংস হয়ে যায় তা হলে কি তুমি দুঃখ পাবে?”

“দুঃখ! না, ওসব আমার হয় না। তবে হয়তো আমিও ধ্বংস হয়ে যাব।”

“না, বনি, তুমি ধ্বংস হলে আমি কিছু করব না। একটা কথা বলব তোমাকে?”

“বলো।”

“মাদার কমপিউটারের চেহারাটা দেখতে চাই।”

“সঙ্গে-সঙ্গে পরদায় গ্র্যাণ্ড পিয়ানোর মতো চেহারার একটা রেখাচিত্র ফুটে উঠল। তারপর দেখা গেল পরিষ্কার একটা রঙিন ফোটো।”

“বাবুরাম কমপিউটারের একজন বিশেষজ্ঞ। অনেকক্ষণ ধরে তিনি ছবিটা দেখলেন। তারপর বললেন, “বনি, আমি এর ট্রাইডেম চেহারা দেখতে চাই। পারবে দেখাতে?”

সঙ্গে-সঙ্গে ছবি ঘুরে চতুর্দিক থেকে কমপিউটারকে দেখাতে লাগল।

“তুমি এর ভিতরকার সার্কিটগুলোর প্ল্যান জানো?”

“সঙ্গে-সঙ্গে কমপিউটারের অভ্যন্তরে জটিল সব যন্ত্রপাতি ফুটে উঠল পরদায়। ডক্টর লিভিংস্টোন নিশ্চয়ই এত বোকা নন যে, তাঁর এই মূল্যবান কমপিউটারের সব তথ্য তাঁর দাসদের জানিয়ে রাখবেন। এটা যে সম্ভব হচ্ছে পানচো তথা চি চেং-এর জন্যই তা বুঝতে বাবুরামের লহমাও লাগল না।

“বনি, আমি কমপিউটারটার সব রকম প্রিন্ট-আউট চাই।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই স্লট দিয়ে অন্তত পনেরোখানা প্রিন্ট-আউট বেরিয়ে এল।

বাবুরাম সারা রাত জেগে সেগুলো খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলেন।

সকালবেলায় তিনি হাসপাতালে টেলিফোন করে ডক্টর ওয়াং-এর অবস্থা জানতে চাইলেন।

হাসপাতাল বলল, অবস্থা ভাল নয়। তাঁকে ইনটেনসিভ কেয়ারে রাখা হয়েছে।

বাবুরাম ফোন রেখে দিলেন। তারপর অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলেন। কী করবেন, কোন প্ল্যানমাফিক এগোবেন তা বুঝতে পারছেন না।

ব্রেকফাস্ট খেয়ে তিনি গাড়ি নিয়ে সোজা গিয়ে হাজির হলেন ভবঘুরেদের আস্তানায়। তাঁকে দেখে সবাই বেরিয়ে এসে ঘিরে ধরল। বাবুরাম তাদের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলেন, ওদের দুজন ওয়াংকে বাঁচাতে গিয়ে খুন হওয়ায় ওরা ভীষণ ক্ষুব্ধ। তবে রাগটা ওয়াং-এর ওপর নয়, খুনেদের ওপর।

ফ্রেড বলল, “আমাদের কাছে অস্ত্র নেই। থাকলে এত দিনে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতাম।”

বাবুরাম ওদের শান্ত হতে খানিকটা সময় দিলেন। তারপর সকালের কথা থেকে যা বুঝতে পারলেন তা হল, তিনি আর প্রতিভা বনিকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার কয়েকদিন পরেই ওয়াং এদের কাছে আসেন এবং আমেরিকায় নতুন ধরনের যান্ত্রিক দাস তৈরি করার ষড়যন্ত্রটি ওদের বুঝিয়ে বলেন। পোর্টল্যাণ্ডের ডক্টর লিভিংস্টোনের ক্লিনিকটিই যে এই ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রস্থল তাও জানান। পুলিশ বা সরকার যে আইনের পথে এদের কিছু করতে পারবে না তাতেও সন্দেহ ছিল না। কিন্তু বুদ্ধিমান ওয়াং যে সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন সেটিই ছিল বোকার মতো। তিনি তাঁর তিনজন সঙ্গী এবং ভবঘুরেদের জনা-পাঁচেককে নিয়ে একটা দল গড়েন এবং সেই দল নিয়ে পোর্টল্যান্ডে গিয়ে লিভিংস্টোনের ক্লিনিকটি ঝটিতি দখল করার চেষ্টা করেন। উত্তেজনার মাথায় এ-কাজ করতে গিয়ে তাঁরা সহস্র প্রহরীদের পাল্লায় পড়ে যান। কয়েকজন পালাতে পারলেও যা। ঘটবার তা ঘটে গেছে।

“ফ্রেড, মাইক, তোমরা এখন কী করতে চাও?” বাবুরাম জিজ্ঞেস করলেন।

“কী করব তা বুঝতে পারছি না। লিভিংস্টোন পুলিশের কাছে নালিশ করেছে। পুলিশ তো আর জানে না যে, লিভিংস্টোন কী কাণ্ড করছে। প্রমাণ করাও সহজ নয়। ফলে পুলিশ তাকে প্রোটেকশন দিচ্ছে। ইচ্ছে থাকলেও ওই ক্লিনিকে আর হামলা করা সম্ভব নয়। লিভিংস্টোন ধূর্ত লোক।”

বাবুরাম বাড়ি ফিরে এলেন। তিনি কোনও পথই খুঁজে পাচ্ছেন

দুপুরবেলা আবার কমপিউটারের প্রিন্ট আউট নিয়ে বসলেন। কিন্তু কোনও উপায় তাঁর মাথায় এল না।

প্রতিভা বললেন, “অত ভেবো না। খেয়ে নাও। তারপর বিশ্রাম করো। মাথা ঠাণ্ডা না হলে বুদ্ধি খেলবে কী করে?”

ভরদুপুরে যখন পাড়া সুনসান তখন হঠাৎ ডোরবেল শুনে প্রতিভা উঠলেন। জেট ল্যাগ-এর ক্লান্তি ছিল। সতর্ক হওয়ার কথা খেয়াল

করেই গিয়ে দরজাটা খুললেন। আর সঙ্গে-সঙ্গে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। তাঁর সামনে পাঁচজন সশস্ত্র লোক দাঁড়িয়ে।

প্রতিভাকে রূঢ় একটা ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে তারা ঘরে ঢুকল। তারপর ঠেলে তুলল বাবুরামকে বনিকে নির্দয় হাতে বিছানা থেকে তুলে একটা চাঁদরে পুঁটুলির মতো বেঁধে ঝুলিয়ে নিল। প্রতিভার কান্নাকাটি চিৎকারে কর্ণপাতও করল না। পিস্তল বুকে ঠেকিয়ে বলল, “চলো, তোমাদেরও যেতে হবে।”

বাবরামের ইচ্ছে করছিল নিজের গালে চড় কষাতে। এ বাড়িতে ওঠা যে কত বড় ভুল হয়েছে। এখন আর কিছুই করার নেই। তীরে এসে তরী ডুবল।

বাবুরাম শুধু চেষ্টা করলেন, পানচোকে সঙ্গে নিতে। কিন্তু দেখলেন সেটা জায়গায় নেই।

কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে তাঁদের একটা প্রকাণ্ড গাড়ির ভিতরে তুলে গাড়ি ছেড়ে দিল গুণ্ডারা। বাবুরাম আর প্রতিভা নির্বাক হয়ে বসে রইলেন।

যখন তাঁরা পোর্টল্যাণ্ডে ঢুকলেন তখনও রোদ রয়েছে। চারদিকে আলো। শুধু প্রতিভা আর বাবুরামই চোখে অন্ধকার দেখছেন।

একটা নির্জন শহরতলির বনভূমি পেরিয়ে অনেকটা যাওয়ার পর এক বিশাল চত্বর জুড়ে চমৎকার একখানা ক্লিনিকের বাড়িঘর নজরে পড়ল। ভিতরে অজস্র বাগান, ফোয়ারা, ডিয়ার পার্ক, খেলার মাঠ। কয়েক মাইল নিয়ে ক্লিনিক।

গাড়ি একটা টিলার গায়ে চওড়া সুড়ঙ্গের ভিতরে ঢুকে গেল। সুড়ঙ্গটি আলোয়-আলোয় ছয়লাপ। যেখানে এসে গাড়ি থামল সেটি একটি ভূগর্ভের বাড়ি। এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর এত আলোর ব্যবস্থা যে, বিশ্বাসই হতে চায় না এখানে এক নারকীয় পরিকল্পনার ষড়যন্ত্র আঁটা হচ্ছে।

লোকগুলো খুবই চটপটে। তাদের গাড়ি থেকে নামিয়ে প্রায় ছাগল তাড়ানোর মতো ডিয়ে একটা ঘরে এনে ঢুকিয়ে দিল। বনিকে পুঁটলি করে কোথায় নিয়ে গেল কে জানে। প্রতিভা দৌডে গিয়ে দরজা টানাটানি করলেন, কিন্তু দরজা লক হয়ে গেছে।

বাবুরাম চারদিকে চেয়ে দেখলেন, এ-ঘরটি একটি জানালাহীন গর্ভগৃহ। যদিও শীতাতপনিয়ন্ত্রিত এবং আলো ঝলমল, তবু অনেকটা বন্দীনিবাসের মতোই মনে হচ্ছে।

প্রতিভা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “কী হবে এবার?”

বাবুরাম মাথা নেড়ে বললেন, “সব শেষ।”

প্রতিভা ব্যাকুল কণ্ঠে বললেন, “বনিকে ওরা কি মেরে ফেলবে?”

“সেটাই সম্ভব প্রতিভা।”

“আর আমরা?”

“সান্ত্বনা এই যে, বনির পর আমাদেরও বাঁচিয়ে রাখবে না।”

প্রতিভা কাঁদতে লাগলেন। বাবুরাম চোখ ঢেকে বসে রইলেন। কিছু করার নেই।

কতক্ষণ এভাবে কাটল কে জানে, হঠাৎ কোনও গুপ্ত মাইক্রোফোন থেকে কেউ বলল, মিস্টার এবং মিসেস গাঙ্গুলি, কষ্ট দেওয়ার জন্য দুঃখিত, তবে আপনারা আমাদের মহা মূল্যবান গবেষণার তাৎপর্য না বুঝে বোকার মতো এমন অনেক কাজ করেছেন, যা সভ্যতার পক্ষে ক্ষতিকারক। বনিকে মারবার কোনও ইচ্ছে আমাদের ছিল না। কিন্তু আপনারা বোধ হয় জেনে গেছেন যে, তার মগজের মাইক্রোচিপ ঠিকমতো সেট হয়নি। কোথায় গণ্ডগোল হল তা দেখার জন্য তার মগজ আমাদের তন্ন-তন্ন করে দেখতে হবে। কিন্তু তার মৃত্যু ভবিষ্যতে বৃহত্তর গবেষণায় প্রচুর সাহায্য করবে। বনির মৃত্যু মহান। আপনারা যদি অপারেশনটি দেখতে চান তা হলে দরজা খুলে বেরিয়ে বাঁ দিকে এগোলেই লিফট পাবেন। লিফট আপনাদের একটা অবজারভেশন গ্যালারিতে নিয়ে আসবে। সেখান থেকে সবই দেখতে পাবেন।

বাবুরাম চেঁচিয়ে বললেন, “আমাদের এখানে ধরে রেখেছেন কেন?”

“আপনারা বিপজ্জনক। দুঃখিত, আপনাদের রেহাই দেওয়ার কোনও উপায় নেই।”

প্রতিভা বাবুরামের হাত চেপে ধরে বললেন, “চলো, আমার ছেলেকে শেষবারের মতো দেখে আসি। আর তো ইহলোকে দেখা হবে না।”

বাবুরাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “চলো৷”

এবার দরজা টানতেই খুলে গেল। করিডোর পেরিয়ে বাবুরাম আর প্রতিভা টলতে-টলতে লিফটে এসে উঠলেন। নিঃশব্দে লিফট তাদের নিয়ে এসে একটা ঘরে হাজির করল। অর্ধচন্দ্রের মতো সুন্দর ঘর। বাঁকা দেওয়ালটা পুরোপুরি স্বচ্ছ কাঁচে তৈরি। সেখানে বসবার জন্য আরামদায়ক সোফাসেট রয়েছে।

কাঁচের ভিতর দিয়ে মাত্র আট দশ ফট নীচে দেখা যাচ্ছে বিরাট একটা অপারেশন থিয়েটার। সেখানে হাজারো ছোটবড় যন্ত্রপাতি। কয়েকজন সাদা পোশাক পরা মুখ-ঢাকা মানুষ ব্যস্তসমস্ত হয়ে ঘোরাফেরা করছে। মাঝখানে অপারেশন টেবিলের ওপর বনি শুয়ে আছে।

প্রতিভা কাঁচের গায়ে কিল মারতে মারতে পাগলের মতো চেঁচাতে লাগলেন, “বনি! বনি! বনি! বনি!”

সেই চিৎকার অবশ্য পুরু প্লেক্সি গ্লাস ভেদ করে ও-পাশে যাবে না। তবে একটা গম্ভীর গলা মাইক্রোফোনে বলে উঠল, “চেঁচিয়ে লাভ নেই। চিন্তা করবেন না, বনির ব্যথা-বেদনার কোনও বোধ নেই। ওর মাথার খুলি খুব সূক্ষ্ম যন্ত্র দিয়ে চিরে ফেলা হবে। এই দেখুন, লেসার যন্ত্র নিয়ে ডক্টর লিভিংস্টোন নিজেই কাজটা করছেন।”

প্রতিভা তবু পাগলের মতো চেঁচাতে লাগলেন, “বনি! বনি! বনি!”

কণ্ঠস্বর বলে উঠল, “ওই দেখুন, বনির চোখের রং কেমন পালটে সবুজ হয়ে গেল। আবার গাঢ় লাল। এই লক্ষণটাই বিপজ্জনক। তার মানে হল, বনির মগজের মাইক্রোচিপ যথাযথ কাজ করছে না। আমাদের কমপিউটার তরঙ্গ ঠিকমতো ধরতে পারছে না। ওকে যদি আদেশ দেওয়া হয়, তুমি তোমার বাবাকে খুন করো, ও হয়তো তা না করে বাবার গালে একটা চুমু খাবে। সেইজন্যই আমাদের দেখতে হবে, কোথায় আমাদের ত্রুটি থেকে যাচ্ছে, কোথায় ভুল হচ্ছে। বিজ্ঞান চিরকালই এভাবে সত্যে পৌঁছেছে। বনি একটা সামান্য শিশু মাত্র…”

প্রতিভা কোনও কথাই শুনলেন না, পাগলের মতো চেঁচাতে লাগলেন, “বনি! বনি! বনি!”

বাবুরাম প্রতিভাকে কিছুই বললেন না। চুপ করে বসে রইলেন। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত।

ওদিকে বনির চোখের মণি ক্রমশ রক্তাভা ধারণ করল। এত লাল যে, দূর থেকেও প্রতিভা ওর চোখের দুটি আলো ঝলমল করছে। দেখতে পেলেন।

লিভিংস্টোন নামক লোকটি ঝুঁকে পড়লেন বনির ওপর, হাতে একটি যন্ত্র।

হঠাৎ আলো নিবে গেল। চারদিকে এক পাথরের মতো নিরেট অন্ধকার।

প্রতিভা একটানা চিৎকার করে যাচ্ছিলেন, “বনি! বনি! বনি!”

সেই জমাট অন্ধকারে হঠাৎ পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে কার বেশ উত্তেজিত গলা শোনা গেল, “এটা কী হচ্ছে, ইমার্জেন্সি লাইট জ্বলছে না কেন?”

কে যেন জবাব দিল, “টর্চ অবধি জ্বলছে না। তাজ্জব ব্যাপার।” আর-একজন বলে উঠল, “আমার লাইটারও জ্বলল না তো!”

সেই জমাট অন্ধকারে শুধু বনির দু’খানা রক্তচক্ষু দেখা যাচ্ছিল। আর কিছু নয়।

“বনি! আমার বনি! আমার বনি!” প্রতিভা কাঁচের গায়ে নিজের মাথা ঠুকছেন।

বাবুরাম নিঃশব্দে উঠলেন। আন্দাজে বাঁ দিকে দরজা লক্ষ করে এগিয়ে গেলেন। লিফট। উঠে দাঁড়াতেই লিফটটা নিঃশব্দে খানিকটা নেমে দাঁড়াল।

বাবরাম সোজা হেঁটে গিয়ে একটা দরজায় ধাক্কা খেলেন। হাতড়ে দরজার নব পেয়ে একটানে খুলে ফেললেন দরজা। ঘরটা একটা লাল আলোয় ভরে আছে। আবছা আলো। কিন্তু তাতে অপারেশন থিয়েটারটা চিনতে তাঁর দেরি হল না।

বনির টেবিলের ধারে কয়েকজন সাদা পোশাক-পরা মানুষ একটু অপ্রস্তুত অবস্থায় দাঁড়িয়ে উত্তেজিত গলায় আলোচনা করছে।

বাবুরাম সামান্য চেষ্টাতেই অপারেশনের যন্ত্রপাতি রাখার ট্রেটা দেখতে পেলেন। একটা সার্জিকাল ছোরা তুলে নিলেন হাতে। বনির চোখের আলো তাঁকে পথ দেখাচ্ছে।

নিঃশব্দে তিনি এগিয়ে গেলেন। ডক্টর লিভিংস্টোনকে চিনতে কষ্ট নেই। তাঁর হাতে এখনও লেসার গান। বাবুরাম তাঁর পিছনে গিয়ে সামান্য একটু দ্বিধা করলেন। আবার খুন!

কে যেন তাঁকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে সতর্ক করতে চেষ্টা করল ডক্টর লিভিংস্টোনকে। লিভিংস্টোন ঘুরে তাঁর মুখোমুখি হতে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময়ে বাবুরাম ছোরাটা তুললেন।

কিন্তু শেষ অবধি ছোরাটা বসাতে পারতেন কি না তা নিয়ে বাবুরামের সন্দেহ আছে। শত অনিষ্টকারী শত্রু হলেও বাবুরাম কোনও মানুষকে এরকমভাবে মেরে ফেলতে হয়তো পারতেন না। ছোরাটা তুলেছিলেন বাবুরাম, তুলেই রইলেন। মারতে পারলেন না।

লিভিংস্টোন চট করে লেসার গান ফেলে পকেট থেকে চোখের পলকে একটা পিস্তল বের করলেন।

বাবুরাম বোকার মতো চেয়ে দেখলেন পিস্তলের নল সোজা তাঁর বুকের দিকে তাক করা।

ঠিক এই সময়ে একটা বিস্ফোরণের শব্দ হল খুব কাছেই কোথাও। একটা আলোর ঝলকানি।

লিভিংস্টোন চমকে উঠে চেঁচালেন, “মাদার কমপিউটার! মাদার-কমপিউটার! সর্বনাশ! কে মাদার কমপিউটারের নাগাল পেল?”

বনির চোখের আলো নিবে গেল।

অন্ধকারে কে কারা যেন দৌড়াদৌড়ি করে হুড়মুড় করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

আর রোমাঞ্চিত বিস্ময়ে ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বাবুরাম হঠাৎ

শুনতে পেলেন, একটি শিশুর কান্না। প্রচণ্ড কাঁদছে।

“বনি! বনি!” চেঁচিয়ে উঠলেন বাবুরাম। হাতড়ে-হাতড়ে টেবিলটার কাছে যেতেই তাঁর হাতে ঠেকল বনির হাত আর পা। বনি কাঁদতে কাঁদতে হাত-পা ছুঁড়ছে।

.

পর দিন কাগজে এবং টেলিভিশনে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে একটি খবর প্রচারিত হল। ডক্টর লিভিংস্টোনের ক্লিনিকে বিস্ফোরণজনিত অগ্নিকাণ্ডে যাঁদের মৃত্যু হয়েছে তাঁদের মধ্যে লিভিংস্টোনও আছেন। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে লিভিংস্টোনের ক্লিনিকে কিছু অবৈধ যন্ত্রপাতি এবং কনস্ট্রাকশন ছিল। সরকার থেকে এ-বিষয়ে আরও তদন্ত চালানো হবে…..

সকালবেলায় বাবুরাম খুব মন দিয়ে কাগজ পড়লেন এবং টিভির খবর শুনলেন।

শোওয়ার ঘরে খাটের ওপর বনি হাত-পা ছুঁড়ে প্রবল বিক্রমে খেলা করছে। মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছেন প্রতিভা। বুকের ভার নেমে গেছে। তাঁর ক্লান্ত মুখে মায়ের গর্বের হাসি।

পনেরো দিন পরে ডক্টর ওয়াং হাসপাতাল থেকে টেলিফোন করলেন, “গাঙ্গুলি, অভিনন্দন।”

“অভিনন্দন আমার প্রাপ্য নয় ডক্টর ওয়াং। প্রাপ্য চি চেং-এর। কিন্তু…”

ওয়াং দুঃখিতভাবে বললেন, “কী আর করা যাবে। চি চেং ওই সাঙ্ঘাতিক আগুন থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। তার কারণ সে নিজে ওই মাদার কমপিউটারে ঢুকে পড়েছিল। বেরোবার সময় পায়নি। তবে ভাববেন না, চি চেং-এর মতো অদ্ভুত-অদ্ভুত যন্ত্র আমি আবার বের করব। দুনিয়ার সবাইকে তাক লাগিয়ে দেব। বিদায়। কালই জাপান যাচ্ছি।”

দিনটা বড় ভাল। বাবুরাম আর প্রতিভা প্যারামবুলেটরে বনিকে বসিয়ে বেড়াতে বেরোলেন। এমন আনন্দের দিন বড় একটা আসেনি।

Pages: 1 2 3 4 5 6
Pages ( 6 of 6 ): « পূর্ববর্তী1 ... 45 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *