ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি – ৬ষ্ঠ পর্ব
রাজেনবাবুকে এ বেলা দেখে তবু অনেকটা ভাল লাগল। কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতে বললেন, ‘দুপুরের দিকটা বেশ ভাল বোধ করছিলাম। যত সন্ধে হয়ে আসছে ততই যেন কেমন অসোয়াস্তি লাগছে।’
ফেলুদা তিনকড়িবাবুর দেওয়া প্যাকেটটা রাজনবাবুকে দিল। সেটা খুলে তার থেকে একটা চমৎকার বুদ্ধের মাথা বের হল। সেটা দেখে রাজনবাবুর চোখ ছলছল করে এল। ধরা গলায় বললেন, ‘খাশা জিনিস, খাশা জিনিস!’
ফেলুদা বলল, ‘পুলিশ থেকে লোক এসেছিল?’
‘আর বলো না। এসে বত্রিশ রকম জেরা করলে। কদ্দুর কী হদিশ পাবে জানি না, তবে আজ থেকে বাড়িটা ওয়াচ করার জন্য লোক থাকবে, সেই যা নিশ্চিন্তি। সত্যি বলতে কী, তোমরা হয়তো না এলেও চলল।’
ফেলুদা বলল, ‘স্যানাটোরিয়ামে বড্ড গোলমাল। এখানে হয়তো চুপচাপ আপনার কেসটা নিয়ে একটু ভাবতে পারব।’
রাজেনবাবু হেসে বললেন, ‘আর তা ছাড়া আমার চাকরটা খুব ভাল রান্না করে। আজ মুরগির মাংস রাঁধতে বলেছি। স্যানাটোরিয়ামে অমনটি খেতে পাবে না।’
রাজেনবাবু আমাদের ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন।
ফেলুদা সটান খাটের উপর শুয়ে পড়ে একটা সিগারেট ধরিয়া কড়িকাঠের দিকে তাগ করে পর পর পাঁচটা ধোঁয়ার রিং ছাড়ল।
তার পর আধবোজা চোখে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘ফণী মিত্তির কাল সত্যিই রুগি দেখতে গিয়েছিলেন। কার্ট রোডে একজন ধনী পাঞ্জাবি ব্যবসায়ির বাড়ি। আমি খোঁজ নিয়েছি। সাড়ে এগারোটা থেকে সাড়ে বারোটা অবধি ওখানে ছিলেন।’
‘তা হলে ফণী মিত্তির অপরাধী নন?’
ফেলুদা আমার কথার জবাব না দিয়ে বলল, ‘প্রবীর মজুমদার ষোলো বছর ইংলণ্ডে থেকে বাংলা প্রায় ভুলেই গেছেন।’
‘তা হলে ওই চিঠি ওর পক্ষে লেখা সম্ভব নয়?’
‘আর ওর টাকার কোনও অভাবই নেই। তা ছাড়া দার্জিলিং-এ এসেও লেবং-এ ঘোড়দৌড়ের বাজিতে উনি অনেক টাকা করেছেন।’
আমি দম আটকে বসে রইলাম। ফেলুদার আরো কিছু বলার আছে সেটা বুঝতে পারছিলাম।
আধখাওয়া সিগারেটটা ক্যারমের ঘুঁটি মারার মতো করে প্রায় দশ হাত দূরের জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়ে ফেলুদা বলল, ‘আজ চা বাগানের গিলমোর সাহেব দার্জিলিং-এ এসেছে। প্লান্টারস ক্লাবে গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। লামার প্রাসাদের আসল ঘণ্টা একটাই আছে, আর সেটা গিলমারের কাছে। রাজনবাবুরটা নকল। অবনী ঘোষাল সেটা জানে।’
‘তা হলে রাজেনবাবুর ঘণ্টা তেমন মূল্যবান নয়?’
‘না।…আর অবনী ঘোষাল কাল রাত্রে একটা পার্টিতে প্রবীর মজুমদারের সঙ্গে রাত ন’টা থেকে ভোর তিনটে অবধি মাতলামি করেছে।’
‘ও। আর মুখোশ পরা লোকটা এসেছিল বারোটার কিছু পরেই।’
‘হ্যাঁ।’
আমার বুকের ভেতরটা কেমন খালি খালি লাগছিল। বললাম, ‘তা হলে?’
ফেলুদা কিছু না বলে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে খাট থেকে উঠে পড়ল। ওর ভুরু দুটো যে এতটা কুঁচকোতে পারে, তা আমার জানাই ছিল না।
কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে কী যেন ভেবে ফেলুদা বৈঠকখানার দিকে চলে গেল। যাবার সময় বলল, ‘একটু একা থাকতে চাই। ডিস্টার্ব করিস না।’
কী আর করি। এবার ওর জায়গায় আমি বিছানায় শুলাম।
সন্ধে হয়ে আসছে। ঘরের বাতিটা আর জ্বালতে ইচ্ছে করল না। খোলা জানলা দিয়ে অবজারভেটরি হিলের দিকটায় অন্যান্য বাড়ির আলো দেখতে পাচ্ছিলাম। বিকেলে ম্যাল থেকে একটা গোলমালের শব্দ পাওয়া যায়। এখন সেটা মিলিয়ে আসছে। একটা ঘোড়ার খুরের আওয়াজ পেলাম। দূর থেকে কাছ এসে আবার মিলিয়ে গেল।
সময় চলে যাচ্ছে। জানালা দিয়ে শহরের আলো কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসছে। বোধহয় কুয়াশা হচ্ছে। ঘরের ভিতরটা এখন আরও অন্ধকার। একটা ঘুম-ঘুম ভাব আসছে মনে হল।
চোখের পাতা দুটো কাছাকাছি এসে গেছে, এমন সময় মনে হল, কে যেন ঘরে ঢুকছে।
মনে হতেই এমন ভয় হল যে, যে দিক থেকে লোকটা আসছে, সে দিকে না তাকিয়ে আমি জোর করে নিশ্বাস বন্ধ করে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
কিন্তু লোকটা যে আমার দিকেই আসছে আর আমার সামনেই এসে দাঁড়াল যে!
জানালার বাইরে শহরের দৃশ্যটা ঢেকে দিয়ে একটা অন্ধকার কী যেন এসে আমার সামনে দাঁড়িয়েছে।
তার পর সেই অন্ধকার জিনিসটা নিচু হয়ে আমার দিকে এগিয়ে এল। এইবার তার মুখটা আমার মুখের সামনে, আর সেই মুখে একটা–মুখোশ!
আমি যেই চিৎকার করতে যাব অমনি অন্ধকার শরীরটার একটা হাত উঠে গিয়ে মুখোশটা খুলতেই দেখি–ফেলুদা!
‘কী রে–ঘুমিয়ে পড়েছিলি নাই?’
‘ওঃ–ফেলুদা–তুমি?’
‘তা আমি না তো কে? তুই কি ভেবেছিলি…?’
ফেলুদা ব্যাপারটা বুঝে একটা অট্টহাসি করতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গম্ভীর হয়ে গেল। তার পর খাটের পাশটায় বসে বলল, ‘রাজেনবাবুর মুখোশগুলো সব কটা পরে দেখছিলাম। তুই এইটে একবার পর তো।’
ফেলুদা আমাকে মুখোশটা পরিয়ে দিল।
‘অস্বাভাবিক কিছু লাগছে কি?’
‘কই না তো। আমার পক্ষে একটু বড়, এই যা।’
‘আর কিচ্ছু না?’ ভাল করে ভেবে দেখ তো।’
‘একটু…একটু যেন…গন্ধ।’
‘কীসের গন্ধ?’
‘চুরুট।’
ফেলুদা মুখোশটা খুলে নিয়ে বলল, ‘এগজ্যাক্টলি।’
আমার বুকের ভিতরটা আবার টিপ টিপ করছিল। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, তি-তিনকড়িবাবু?’
ফেলুদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘সুযোগের দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি ছিল এঁরই। বাংলা উপন্যাস, খবরের কাগজ, ব্লেড, আঠা কোনওটারই অভাব নেই। আর তুই লক্ষ করেছিলি নিশ্চয়ই–স্টেশনে আজ যেন একটু খোঁড়াচ্ছিলেন। সেটা বোধহয় কাল জানালার বাহিরে লাফিয়ে পড়ার দরুন। কিন্তু আসল যেটা রহস্য, সেটা হল–কারণটা কী? রাজেনবাবুকে তো মনে হয় রীতিমতো সমীহ করতেন ভদ্রলোক। তা হলে কী কারণে, কী উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি এই চিঠি লিখেছিলেন? এটার উত্তর বোধ হয় আর জানা যাবে না…কোনও দিনও না।’