Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

জানলাটা বন্ধ

জানলাটা বন্ধ করলো স্বপ্নেন্দু। তার মানে, সে একা নয়। আরও কিছু মানুষের চেহারায় এই পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু কজন মানুষের? এই ঘরে বসে থাকলে কিছুই জানা যাবে না। চাকরটা থাকলে তাকে ডেকে দেখা যেত।

স্বপ্নেন্দু আর পারল না। পায়জামায় দুটো পা গলিয়ে দড়িটা বাঁধতে গিয়ে দেখল সেটা কোমরে থাকছে না। অনেক কায়দার পর মোটামুটি ভদ্রস্থ হলো। গেঞ্জিটা এখন ঢলঢল করছে। তার ওপর পাঞ্জাবিটাকে মনে হচ্ছে হ্যাঙারে ঝোলানো হয়েছে। অভ্যাসে চুলে হাত বোলাতে গিয়ে হোঁচট খেল সে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা দেখে হঠাৎ হাসি পেয়ে গেল।

তুমি, স্বপ্নেন্দু, তোমার আসল চেহারা হলো এই। অবিকল কাকতাড়ুয়া। এতকাল মাংস চামড়ার দৌলতে খুব ফুটুনি করেছ। আসল বস্তুটিকে চাপা দিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়িয়েছ। তোমার মুখের গড়নে কিঞ্চিত গরিলাদের ছায়া আছে। তোমার পূর্বপুরুষ যে বনমানুষ ছিল এ থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়।

জুতোগুলোর দিকে তাকল সে। ওগুলো এখন পায়ে সম্পূর্ণ বেমানান। ঢলঢল করবে, হাঁটা যাবে না। বরং হাওয়াইটা চেষ্টা করা যেতে পারে। পায়ে ঢুকিয়ে দেখা গেল সেটা বেশ বড়ো তবে হাঁটা যাচ্ছে। অভ্যেসবশে ঘড়ি পরতে গিয়ে জব্দ হলো। স্টেনলেসের ব্যান্ডটা হাত গলে বেরিয়ে আসছে। ওটাকে ছোট করা দরকার। প্রায় ছত্রিশ ঘণ্টা হয়ে গেল কিন্তু দম ফুরোয়নি ঘড়িটার। এটাকে নিয়ে আর কী হবে।

আয়নার দিকে তাকিয়ে মনটা খুঁতখুঁত করছিল। ন্যাড়া মাথাটা ভীষণ কটকটে লাগছে। চট করে একটা চাদর বের করে একটা পাক বুকে জড়িয়ে মাথাটা ঢেকে নিলো স্বপ্নেন্দু। তারপর সন্তর্পণে দরজা খুলল।

বাতাসটা এখনও গরম। তবে সহনীয় হয়ে এসেছে। কয়েক পা হাঁটতেই সে চমকে উঠল। ডানদিকের মোড়ে একটা চায়ের দোকান ছিল। দোকানটা অবিকল রয়েছে। কিন্তু সেখানে বসে আছে গোটা পাঁচেক কঙ্কাল। কঙ্কালগুলোর সাইজ বিভিন্ন রকমের। কেউ খুব মোটা কেউ রোগা, কেউ বেঁটে, কেউ লম্বা। চায়ের দোকানের মালিক অবনীদাকে সে চিনতো। ওদের মধ্যে অবনীদা কোনটে? অবনীদা বেঁটেখাটো গোল মাথার ভারি ভালো মানুষ ছিলেন। স্বপ্নেন্দু বেশ কিছুক্ষণ লক্ষ করার পর একটি কঙ্কাল শনাক্ত করল। টেবিলের ওপর মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। স্বপ্নেন্দু আরও লক্ষ্য করল পাঁচজনের মধ্যে দুজন সম্পূর্ণ নগ্ন। প্রচণ্ড কুৎসিত দেখাচ্ছে তাদের। অবনীদার পরনে একটা ধুতি জড়ানো। ওপরে সেই শার্টটা। খাকি রঙের, দুদিকে পকেট।

এদের দেখে মন কিছুটা শান্ত হলো। তার মানে সে একা নয়। এপাড়ার অনেকেরই এক অবস্থা। স্বপ্নেন্দু ধীরে এগিয়ে যেতে হঠাৎ একজনের নজর পড়ল। চেঁচিয়ে উঠল, আরে, আস্ত মানুষ।

আস্ত মানুষ। বাকি চারজন এক সঙ্গে উচ্চারণ করল।

স্বপ্নেন্দু কাছাকাছি যেতেই অবনীদা টেবিল থেকে নেমে এদিকে তাকালেন। স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞাসা করলো, অবনীদা।

আরে এ আমাকে চেনে দেখছি।

চিনবো না কেন? আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না?

গলার স্বরটা চেনা চেনা লাগছে। কে ভাই আপনি?

আমি স্বপ্নেন্দু।

স্বপ্ন? অবনীদা এবার চিনতে পারলেন, ওঃ তুমি। কী হল বল তো, এ কী হলো? আমরা কী করে বেঁচে আছি? এই অবস্থায় তো প্রেতেরা বেঁচে থাকে, আমরা কি সবাই প্রেত হয়ে গেলাম? অবনীদা আর্তনাদ করলেন।

সবাই? স্বপ্নেন্দুর মাথাটা সামান্য এগিয়ে গেলো।

সবাই। এমন কি আমার তিন বছরের বাচ্চাটা পর্যন্ত। তার চেহারা দেখলে শিউরে উঠতে হয়। অত হেলদি বাচ্চাটা একটা কঙ্কাল হয়ে ঘুরছে।

পাড়াটা এত ফাঁকা লাগছে কেন? কেউ মারাটারা গেল নাকি?

ফাঁকা? কাল সারারাত আজ সারাদিন তো লোকে পাগলের মতো ছোটাছুটি কান্নাকাটি করেছে। এখন যে যার বাড়িতে ঢুকেছে কারণ যদি সন্ধে হতেই আবার কালকের সেই গরম লাভার মতো কিছু কলকাতার ওপর বয়ে যায়। একবার তো মাংসমজ্জা শুষে নিয়ে গিয়েছে, এখন তো হাড়গুলো ছাড়া আমাদের আর কিছু নেই।

অন্য লোকগুলো কেউ কথা বলছিল না। এবার একজন বলল, আজ সন্ধে সাতটায় রেডিও খুলবেন। মুখ্যমন্ত্রী রেডিও থেকে এই বিষয়ে ভাষণ দেবেন।

মুখ্যমন্ত্রী? মুখ্যমন্ত্রী বেঁচে আছেন?

বাঃ বেঁচে থাকবে না কেন? আমরা কেউ মারা যাই নি।

কিন্তু কী করে জানতে পারলেন যে উনি ভাষণ দেবেন?

তুমি কি এইমাত্র বের হলে? অবনীদা জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ।

বিকেলে পুলিশের জিপ মাইকে করে বলে গেল।

পুলিশ?

হ্যাঁ। তারা য়ুনিফর্ম-পরে এসেছিল বটে কিন্তু শরীরের হাল আমাদের মতোই। দেখি মুখ্যমন্ত্রী কী বলেন।

আপনার এখানে রেডিও আছে?

হ্যাঁ চালালে এখন কোনো শব্দ হচ্ছে না। হয়তো স্টেশন খোলেনি। কিন্তু আগে ঢাকা দিল্লি গৌহাটি ধরতে পারতাম। এখন কিছুই আসছে না।

ব্যাটারি ঠিক আছে তো?

হ্যাঁ, সেটা দেখে নিয়েছি। তুমি দাঁড়িয়ে কেন, বসো।

ওরা জায়গা করে দিলে স্বপ্নেন্দু বেঞ্চিতে বসল। সন্ধে হয়ে গেছে। কিন্তু চারধার অন্ধকারে ঢেকে যায়নি। রাস্তার আলোগুলো জ্বলছিল। স্বপ্নেন্দু বুঝল কাল রাত থেকেই জ্বলছে। আজ সকালে নেভাতে হয়নি। সে আড়চোখে লোকগুলোর দিকে তাকাল। প্রত্যেকের বুকের খাঁচায় কালচে হৃৎপিণ্ড দেখা যাচ্ছে। একজন অন্যমনস্ক হয়ে সেখানে হাত দিতে গিয়ে বাধা পেল। অর্থাৎ সেই অদৃশ্য গোলকে প্রত্যেকেরই হৃৎপিণ্ড আবদ্ধ। এক একজনের মাথার করোটিও এক একরকম। কোনোটা বেশি লম্বা, কোনটা সামনের দিকে ছুঁচলো। মুখের হাড়ের গঠনে বনমানুষের স্পষ্ট ছাপ, অবনীদার মুখে বেশ গরিলা গরিলা ভাব আছে। তবে প্রত্যেকের করোটি বেশ মোটা।

স্বপ্নেন্দু দেখল চায়ের উনুনে আঁচ পড়েনি। জিনিসপত্র চারপাশে অবহেলায় ছড়ানো। সে জিজ্ঞাসা করল, অবনীদা, আপনার দোকানের ছেলেটা আসেনি?

এসেছিল। মাথা নাড়াল, অবনীদা, আর ওকে দিয়ে আমার কি হবে। ওই উনুন ধরিয়ে আর কী হবে। চা খাওয়ার মানুষ কোথায়? আমি একেবারে শেষ হয়ে গেলাম ভাই। ধনেপ্রাণে শেষ।

এক ব্যক্তি বলল, মানুষ কাজ করে পেটের জন্যে। সেই প্রয়োজন না থাকলে কী হবে কাজ করে। এ দায় থেকে বাঁচা গেল।

যা বলেছেন। আজ সারাদিন কিছুই খাই নি। অথচ দেখুন, আমার একটুও খিদে পাচ্ছে না। অথচ আমার পেটে আলসার ছিল। ডাক্তার বলেছিলেন নিয়ম করে খেতে। একদম যেন খালি পেটে না থাকি। তা পেটই যখন নেই।

এই সময় তৃতীয়জন হেসে উঠল। সামান্য শব্দ হলো। স্বপ্নেন্দু অবাক হয়ে লোকটাকে দেখল সম্পূর্ণ উলঙ্গ। এই অবস্থায় কোনো মানুষ হাসতে পারে। আমাদের সব গিয়েছে কিন্তু প্রাণ এবং কঙ্কালটা আছে। তাই কীভাবে হাসি আসে? তারপরেই ওর খেয়াল হলো, কালকের পর এই প্রথম সে হাসি শুনল। হাসির যদি অপব্যবহারও হয়ে থাকে তাহলেও হাসি ইজ হাসি। তবু লোকটার দিকে তাকিয়ে তার অস্বস্তি হচ্ছিল। সে শান্ত স্বরে বলল, আপনার একটা পোশাক পরা উচিত ছিল।

উচিত ছিল? লোকটা আবার খুক খুক করে হাসলো, কেন উচিত ছিল?

পোশাক পরা কেন উচিত ছিল তাই জিজ্ঞাসা করছেন?

আগে করতাম না। এখন করছি। এখন আমার কোনো গোপন অঙ্গ নেই যে তাকে ঢেকে রাখব। এখন শীতকাল নয় যে হাড় কনকন করবে ঢেকে না রাখলে। গরমের সময় খোলাখুলি থাকলে আরাম হবে। হাওয়া এপাশ থেকে ওপাশ বইলে হাড় জুড়োবে। আপনি বললেই আমাকে শুনতে হবে? খুক খুকিয়ে হাসলো লোকটা।

অবনীদা বললো, অরবিন্দ, তুমি যা বললে তা খুব মিথ্যে নয়। তবে কিনা চোখেরও তো একটা ব্যাপার আছে। দেখতে বড় খারাপ লাগে।

সে আলাদা কথা। উনি উচিত বলছেন। উচিত বলার কী? মুখ্যমন্ত্রী নাকি?

স্বপ্নেন্দু বলল, মুখ্যমন্ত্রী বললে শুনতেন?

এই দ্যখো আমরা এখানে কী জন্যে বসে আছি? মুখ্যমন্ত্রী সাতটার সময় রেডিওতে কিছু বললেন বলেই তো। আমরা তো তাঁর কথা শুনব।

স্বপ্নেন্দু আর কথা বাড়াল না। এক একটা লোক থাকে ঝগড়াটে টাইপের। যে কোনো ছুতো পেলে তাদের জিভ লকলকিয়ে ওঠে। এতবড় একটা পরিবর্তন হয়ে গেল তবু লোকটার স্বভাব পালটাল না।

স্বপ্নেন্দু আবার লোকগুলোর দিকে তাকাল। সম্পূর্ণ ভৌতিক দৃশ্য। একদিন আগে হলে তবু লোকটায় এই রকম চেহারার সঙ্গে বসে আছে ভাবলে বুক শুকিয়ে যেত। এই সময় অবনীদা রেডিওটাকে খুলে দিলেন। সেই কু শব্দ শুরু হয়েছে। এখন চুপচাপ চারধার। গরম বাতাসটা থেমে গেছে। রেডিওয় স্টেশন শুরু হওয়ার সিগন্যালটা বন্ধ হয়ে পুরুষকণ্ঠ শোনা গেলো, আকাশবাণী কলকাতা। বিশেষ ঘোষণা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গতকাল থেকে আকাশবাণীর নিয়মিত অধিবেশন বন্ধ রাখতে হয়েছিল বলে আমরা দুঃখিত। এখন সমস্ত কলকাতাবাসীর কাছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিশেষ বক্তব্য রাখবেন। কয়েক সেকেন্ড নীরবতার পর মুখ্যমন্ত্রীর পরিচিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, বন্ধুগণ। আমরা অভূতপূর্ব একটি পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে বাধ্য হয়েছি। পৃথিবীর ইতিহাসে কখনও এমন ঘটনার কথা এর আগে শোনা যায়নি। গতকাল রাত সাড়ে দশটার সময় হঠাৎ দূর মহাকাশের একটি নক্ষত্র স্থানচ্যুত হয়। তারই আকর্ষণে পৃথিবীর একাংশে প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। আমাদের দুর্ভাগ্যের কিংবা সৌভাগ্যের বিষয় সেই একাংশটি হলো কলকাতা শহর। হঠাৎ বাতাস উত্তপ্ত হয়। এবং পরমাণু বিস্ফোরণের প্রতিক্রিয়া অথবা আগ্নেয়গিরি থেকে উদ্ভূত লাভার মতো একটি হাওয়া কলকাতার ওপর বয়ে যাওয়ায় মানুষের শরীর থেকে রক্ত মাংস ধমনী অদৃশ্য হয়ে যায়। শুধু মানুষ নয়, কলকাতার যত পশু-পাখি ছিল তাদেরও এই হাওয়া শিকার করে। মানুষ এবং সুগঠিত প্রাণীরাই শেষ পর্যন্ত জীবিত থাকতে পেরেছেন। সেই সময় চালু থাকা কিছু ক্যামেরায় অদৃশ্য লাভার রঙ ছিলো কালো।

মাত্র আধঘণ্টা ওই লাভাস্রোতের স্থায়িত্ব কিন্তু তার মধ্যেই আমাদের পরিচিত মানবীয় চেহারা লুপ্ত হয়। কলকাতার চৌহদ্দিতে যত গাছপালা, ফুলের বাগান এবং ঘাস ছিল সব ছাই হয়ে যায়। এই মুহূর্তে আমরা বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন। আমি আমাদের বিজ্ঞানীদের বলেছি তারা যেন অবিলম্বে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমি তাদের এও বলেছি প্রাকৃতিক পরিবর্তনের হেতু আমাদের শারীরিক পরিবর্তন হয়েছে। কোনো অবস্থায় আবার আগের চেহারায় আমার ফিরে যেতে পারি কি না।

বন্ধুগণ! আমি জানি এই পরিবর্তন মেনা নেওয়া খুব কঠিন, এতদিন আমরা যে শরীর দেখে অভ্যস্ত হয়েছি তার ব্যতিক্রম অবশ্যই পীড়া দেবে। কিন্তু জনসাধারণকে অনুরোধ করছি এই যে পরিবর্তন ঘটে গেল তা আপাতত অনেকগুলো সমস্যা থেকে মুক্তি দেবে। প্রথমত, খাদ্যবস্তুর অভাব আমরা অনুভব করব না। পৃথিবীতে আমরা জন্মগ্রহণ করি এবং জীবিত থাকি কিছু কাজ করবার জন্যে। যা দেশের উপকারে লাগে এবং মনের শান্তি হয় কিন্তু এতদিন আমরা শরীর টিকিয়ে রাখতে অনেক বাজে সময় ব্যয় করতাম। খাদ্য উৎপাদন এবং অর্থ নষ্ট হত। এখন আমাদের আর এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। এ মুহূর্তে আমাদের হাতে পর্যাপ্ত বিদ্যুত এবং আধুনিক জীবনের যাবতীয় প্রয়োজনীয় বস্তু মজুত আছে। আমি কলকাতাবাসীর কাছে আন্তরিক আবেদন করছি তাঁরা যেন অবিলম্বে স্বাভাবিক কাজকর্মে যোগ দেন। যে যা করছিলেন এতকাল আগামিকাল থেকেই সেই সব কাজ শুরু করেন। শারীরিক পরিবর্তনের কারণে যারা কর্মচ্যুত হবেন সরকার তাদের সমস্ত দায়িত্ব নেবে। আমরা স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হয়েছি, আপনারা সাহায্য করুন। কাল থেকে যে যার কাজে যোগ দিন।

বন্ধুগণ, প্রথমেই আমি বলেছি কলকাতা দুর্ভাগ্য কিংবা সৌভাগ্যের অধিকারী। কেন সৌভাগ্য তা ব্যাখ্যা করা দরকার। এতকাল এই যুক্তরাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এবং সামাজিক পরিবেশে আমরা অনেক কাজ ইচ্ছে থাকলেও করতে পারিনি। আমরা একটা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু পরিস্থিতি আমাদের অনেক দূরে থাকতে বাধ্য করেছিল। গত রাত্রে আমরা সেই সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছি। এই শারীরিক পরিবর্তন আমাদের কী কী সুবিধে এনে দেবে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না গিয়েও প্রধান কয়েকটি কথা জানাচ্ছি। এখন থেকে মানুষের সঙ্গে মানুষের কোনো শারীরিক পার্থক্য থাকবে না। কালার প্রবলেম বা গায়ের চামড়ার পার্থক্যপ্রসূত যে ব্যবধান তা দূর হবে। কলকাতার মানুষের চেহারা এক হয়ে যাওয়ায় কোনো সাম্প্রদায়িক সংঘাত হবে না। খাদ্যদ্রব্যের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। তাছাড়া অর্থনীতির নানান পরিবর্তন আসতে বাধ্য।

বন্ধুগণ! কেউ কেউ আমার কাছে আর একটি বিষয়ে আশংকার কথা ব্যক্ত করেছেন। শারীরিক পরিবর্তনের কারণে মানুষের প্রজনন ক্ষমতা লুপ্ত হওয়ায় আমাদের বংশধররা পৃথিবীতে আসবে না। এর ফলে কলকাতাবাসীরা একদিন লুপ্ত হবে। কিন্তু আমি বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা আমাকে জানিয়েছেন বিপ্লব আমাদের যা দিতে পারত না এই লাভাস্রোত তা আমাদের দিয়েছে। আমরা এখন অমৃতের সন্তান। মৃত্যুর কালো হাত আর আমাদের স্পর্শ করবে না। আমরা অমর। যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন আমরা বেঁচে থাকব। এই মহান সম্মানের অধিকারী হওয়া যে সত্যি সৌভাগ্যের সেকথা বলাই বাহুল্য। তবু আমি বিজ্ঞানীদের অনুরোধ করেছি তারা গবেষণা করুন। এমন একটা আবিষ্কার করুন, কলকাতাবাসীরা প্রজনন ক্ষমতার অধিকারী হয়। আপনারা স্মরণ করুন, একদিন আগেও আমরা জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্যে প্রচার চালিয়ে এসেছি। ওই লাল ত্রিকোণ চিহ্নের কোনো প্রয়োজন আর আমাদের নেই। অতএব আমরা আবার জনসাধারণকে অনুরোধ করছি অবিলম্বে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনুন। নমস্কার।

এরপরেই ঘোষকের স্বর শোনা গেল, এতক্ষণ কলকাতাবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দিলেন পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। গ্রামাফোন রেকর্ডে রবীন্দ্রসুর বাজানো হচ্ছে। স্বপ্নেন্দু উঠে দাঁড়াল। রেডিওতে তখন বাজানো হচ্ছে, হে নূতন, দেখা দিক আর বার।

অবনীদা করোটি ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, চললে?

অরবিন্দ নামক লোকটা বলল, তুমি তো দেখছি সত্যি ভালো মানুষ। আরে তোমার উনুন ধরানোর কী দরকার? খাওয়া দাওয়ার চিন্তা নেই। পায়ের ওপর পা তুলে দিনরাত গপ্পো করব। এই উনুনটা ভেঙে ফেলো। এখানে আরো আড্ডা মারার জায়গা করো। তোমার তো খাটুনি বেঁচে গেল।

দিনরাত গপ্পো করব? আমার তো সময় কাটবে না।

স্বপ্নেন্দু বেরিয়ে এল। মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণের প্রতিক্রিয়া কি না কে জানে তবে এখন রাস্তায় নরকঙ্কাল দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ কাঁদছে। কিন্তু বাকিরা খুব ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকাচ্ছে। এইসব কঙ্কালেরা পোশাক পরেছে এলোমেলোভাবে। বিছানার চাদর কোমরে জড়িয়ে নিয়েছে কেউ। স্বপ্নেন্দু লক্ষ্য করলে কোনো মহিলা কঙ্কাল নেই রাস্তায়। একটি শিশু কঙ্কালকে বুকের কাছে নিয়ে কুঁজো হয়ে যাওয়া একটি কঙ্কাল ফুটপাতে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ছে। স্বপ্নেন্দুকে দেখে লোকটা জিজ্ঞাসা করলো, আমি কি রক্ত মাংসের মানুষ?

স্বরে বোঝা গেল লোকটা বৃদ্ধ। উত্তর না দিয়ে স্বপ্নেন্দু মাথা থেকে চাদরের আড়ালটা সরিয়ে দিতে বৃদ্ধ মাথা নাড়াল, ওঃ। একই অবস্থা। সব মানুষের একই হাল। এ যে নরক হয়ে গেল।

নরক বলছেন কেন? মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ শোনেননি?

শুনেছি। কিন্তু তাতে কি মন মানে? দুদিন আগে আমার বউ মারা গেছে। কি সৌভাগ্যবতী ছিল সে। রক্ত মাংসের শরীর নিয়ে ড্যাং ড্যাং করে চিতায় চড়ে গেল। বুড়োর স্বরে কান্না মিশল।

কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বললেন আমরাই একমাত্র সৌভাগ্যবান।

সৌভাগ্য? কি জানি!

আজকে আপনার শরীরের কী পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন?

বৃদ্ধ এবার হাসলেন, তা হয়েছে বইকি। প্রস্রাব করতে খুব কষ্ট হত। সেটা দূর হয়েছে। হাঁটতে গেলে পায়ের শিরায় টান ধরত, এখন হচ্ছে না।

তাহলে বলুন, আপনি অনেক ভালো আছেন।

আমার কথা ছেড়ে দাও! এই বাচ্চাটা। মোটে একবছর বয়স। এখনও ভালো করে হাঁটতে পারে না। এর কী হবে? এ কি কখনো বড়ো হবে?

স্বপ্নেন্দু বললো, আমি জানি না।

আর হাঁটতে তার ভাল লাগছিল না। শরীর যদিও হালকা তবু হয়তো অনভ্যাসে ক্লান্তি লাগছিল। স্বপ্নেন্দু বাড়িতে ফিরে এল। পায়ের তলাটা বেশ টনটন করছে। তার মানে এতকাল চামড়া এবং মাংস যে আড়াল রেখেছিল তা না থাকায় ব্যথা হয়েছে।

ঘরে ঢুকে পাঞ্জাবিটা খুলতেই মন খারাপ হয়ে গেলে আবার। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো সে। এই কাঠামোটা তার? অথচ এতকাল এর অস্তিত্ব সম্পর্কে সে সজাগই ছিলো না। স্বপ্নেন্দুর খেয়াল হলো তার হাড়ের গায়ে মাঝে মাঝে কালচে পোড়া চামড়া লেগে আছে। এগুলো পরিষ্কার করে ফেললে ভালো হয়। বাথরুমে ঢুকলো সে। কল খুলতে অবাক হলো সে। জল নেই। এক ফোঁটা জল বের হলো না। এই বাড়ির ছাদে একটা ট্যাঙ্ক আছে। সারা দিনরাত জলের আজ পর্যন্ত কোনো অভাব হয় নি। তারপরেই মেরুদণ্ডের হাড় কেঁপে উঠলো, কলকাতা শহরের সমস্ত জল গতকালের প্রতিক্রিয়ায় উধাও হয়ে যায় নি তো! জল ছাড়া কী চলছে? মুখ্যমন্ত্রী একবারও এ বিষয়ে কিছু বললেন না। জল হলো জীবন, কলকাতায় যদি জল না থাকে। নিজেকে গালাগাল দিল সে। এখনও উল্টোপাল্টা ভেবে যাচ্ছে। কলকাতার মানুষের আর জলের প্রয়োজন নেই। এখন যে শরীর নিয়ে তাদের বেঁচে থাকতে হবে জল তার কোনো কাজেই লাগবে না। তোয়ালে দিয়ে শরীরটাকে পরিষ্কার করলো সে। ক্রমশ হাড়গুলোর চেহারা পাল্টে যেতে লাগলো। বেশ তকতকে দেখাচ্ছিলো সেগুলো। আয়নার সামনে এসে দাঁড়াতেই নিজের শরীরটাকে একটু পছন্দসই বলে মনে হলো। আর তখনই সুজিতের কথা মনে পড়ল।

সুজিত গতকাল ফোন করে বলেছিল আজকে সন্ধ্যায় যেন সে যায়। এই চেহারা নিয়ে যাওয়া যায়? তাছাড়া সুজিত, সুজিতের কি অবস্থা? ও তো নামকরা চিত্রাভিনেতা। পাশের ঘরে টেলিফোন। খুব সন্তর্পণে ডায়াল করলো স্বপ্নেন্দু। এটা এখন কাজ করছে কিনা কে জানে। কিন্তু ডায়াল টোন ছিলো যখন, স্বপ্নেন্দু শুনলো ওপাশে রিং হচ্ছে। তারপরেই সুজিতের নার্ভাস স্বর কানে এলো, হ্যালো।

সুজিত? আমি স্বপ্নেন্দু।

ওঃ!

তুমি কেমন আছ?

আমি? আমি শেষ হয়ে গেছি। কমপ্লিট ব্রোক। আয়নার সামনে দাঁড়াতে পারছি না। কি ভয়ঙ্কর! আমি এখন কী করব? ঘরের দেওয়াল জুড়ে আমার যে সুন্দর ছবি সেদিকে তাকালে বুক জ্বলে যাচ্ছে। কেউ আর আমার দিকে ফিল্ম অ্যাক্টর বলে তাকাবে? জানলা দিয়ে দেখলাম রাস্তার মানুষজন আমারই মতো দেখতে। এমনকি আমার চাকরটার সঙ্গেও কোনো পার্থক্য নেই।

মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন বিপ্লবও এতটা আনত না।

রেখে দাও বিপ্লব। এখন আর টালিগঞ্জে কাজ হবে ভেবেছ। আমি আজ সারাদিন আমাদের লাইনের সবাইকে কন্ট্রাক্ট করার চেষ্টা করেছি। তুমি জানো মিস মিত্র আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন!

মিত্র মিত্র?

ওঃ তুমি সিনেমা দ্যাখো না নাকি? বাংলার শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নায়িকা। কিন্তু গলায় দড়ি দেওয়া সত্ত্বেও ওঁর মৃত্যু হয়নি। শুধু ঘাড়ের হাড় ভেঙে যাওয়ায় মাথাটা হেলে রয়েছে! এ কি হল স্বপ্নেন্দু?

জানি না। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন মেনে নিতে।

তোমাদের আর কী। এসব এখন বলতে বাধা নেই। দেহপট সনে নট সকলই হারায়। উঃ, ভগবান, কি যে করি!

তোমার ওখানে আজ আমার

সেসব ক্যানসেল্ড। ইয়ার্কি হচ্ছে? আমার ফ্রিজে গাদাগাদা খাবার। কালকে তিনটে রয়্যাল স্যালুট এনেছিলাম। সবচেয়ে দামী হুইস্কি। সব চোখের সামনে অথচ আমি খেতে পারছি না। ওপাশে সজোরে রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দ পেল স্বপ্নেন্দু।

এই প্রথম তার হাসি পেল। মিস মিত্র আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেও পারেননি! মিস মিত্র সত্যিই সুন্দরী আর তখনই ওর মনে হেনা সেনের মুখ ভেসে উঠল। আজ সারাদিন নিজেকে নিয়ে এমন ব্যস্ত ছিল যে হেনার কথা মনেই পড়ে নি। হেনা কেমন আছে? সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল স্বপ্নেন্দু। সেই লোভনীয় শরীর আর তার চলনের ভঙ্গিটা চোখের সামনে দেখতে পেল। না হতে পারে না। হয়তো হেনার ওদিকে অদৃশ্য লাভার স্রোত বয়ে যায়নি। হেনার তীক্ষ্ণ অথচ দিঘির মতো ভারী বুক এবং নিতম্ব, চোখের কারুকাজ স্বপ্নেন্দুর মাথায় কিলবিল করতে লাগল আর তারপরেই একটা ভয় হৃৎপিণ্ডটাকে আঘাত করল। যদি হেনা সেন আক্রান্ত না হয়, যদি তার শরীর এখনও আগের মতো মাদকতা জড়ানো থাকে তাহলে? স্বপ্নেন্দু ঝিম হয়ে বসে রইল। না, তা হতে পারে না। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন কলকাতার ওপর দিয়ে সেই অদৃশ্য লাভা স্রোত বয়ে গিয়েছে। হেনা সেন কোনোভাবেই বেঁচে যেতে পারে না। ঠিক হলো না কথাটা, হেনা সেনের আগের শরীরটা অটুট থাকতে পারে না। যদি হেনা সেন আগের মতো থাকে তাহলে সে কখনও তার সামনে দাঁড়াতে পারবে না। রক্তমাংসের ওই সুন্দরী কখনই একটি জীবন্ত কঙ্কালকে চোখে চেয়ে দেখতে পারবে না। ঘৃণা এবং ভয়ে মুখ ফিরিয়ে নেবে। স্বপ্নেন্দু স্পষ্ট অনুভব করল তার হৃৎপিণ্ড কাঁপছে। হেনা সেনের জন্যে অদ্ভুত একটা আকর্ষণ বোধ করছিল সে। ঈশ্বর নিশ্চয়ই এতটা কঠিন হবেন না। ওই অদৃশ্য লাভাস্রোত নিশ্চয়ই হেনার বাড়ির ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। এখন এই রাত্রে কিছু জানবার উপায় নেই। ওর বাড়িতে টেলিফোন আছে কি না তা জানে না স্বপ্নেন্দু। কাছাকাছি হলে না হয় হেঁটে যাওয়া যেত।

ভীষণ কাহিল লাগছিল। আলোটা নেভাতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল সে। তার হৃৎপিণ্ড আবার কাঁপছে। শরীর স্থির। তারপর পায়ে পায়ে সে এগিয়ে গেল টেবিলের কাছে। কাচের বাটিটা টকটকে লাল হয়ে গেছে। উল্টো করে বসানো বাটিটার মধ্যে সেই লাল গোলাপটাকে এখন আরও জীবন্ত দেখাচ্ছে। আরো টাটকা। এমনকী ওর নিটোল নরম পাপড়ির গায়ে সেই জলের ফোঁটাও চকচক করছে। লোভীর মতো ফুলের দিকে তাকিয়ে রইল স্বপ্নেন্দু। কি উদ্ধত ভঙ্গি রক্ত গোলাপটার। হাত বাড়াল সে। কিন্তু তারপরেই কথাটা খেয়াল হলো। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন কলকাতার কোনো গাছ কিংবা বাগান যদি বেঁচে না থাকে, মাঠের ঘাসগুলো যদি শুকিয়ে ছাই হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে এই লাল গোলাপটা এখনও অমন গর্বিত ভঙ্গিতে বেঁচে আছে কী করে? স্বপ্নেন্দুর মনে হলো হয়তো সমস্ত কলকাতায় এই একটি মাত্র জীবিত ফুল। যদি ওটা কোনো ফুলদানি কিংবা টেবিলে খোলা থাকত তাহলে আজ সকালে ছাই হয়ে যেত। কিন্তু কাচের পাত্রে নিচ্ছিদ্র আড়াল ফুলটাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এবার প্রচণ্ড লোভীর মতো মাথাটাকে কাচের বাটির গায়ে নিয়ে গেল সে। পাপড়ির শরীরের কোষগুলোকে যেন অনুভব করতে পারবে সে। এই কলকাতার কোথাও এই মুহূর্তে আর কোনো উদ্ভিদ নেই শুধু এই ফুলটি ছাড়া। কিন্তু কতদিন এ এই রকম থাকবে? আস্তে আস্তে তো শুকিয়ে মরে যাবেই। স্বপ্নেন্দুর মাথা নাড়ল। না, কাল রাত্রের ওই ভয়ঙ্কর ঘটনার পরও যখন এ বেঁচে আছে তখন নিশ্চয়ই অনেককাল অটুট থাকবে। ওই কাচের বাটিটাকে সরালে চলবে না। কোনো অবস্থায় ওই বাটিতে হাত দেবে না সে। তাহলে ফুলটা বেঁচে থাকবে। ওকে যেভাবেই হোক বাঁচিয়ে রাখতে। হবে। স্বপ্নেন্দু কাচের বাটিটার দিকে তাকালো। খুব জোর হাওয়া বইলে কি ওটা উল্টে যাবে? ঠিক ভরসা হয় না। সে চারপাশে তাকিয়ে দেখল। তারপর আরও একটা কাচের বড় জার এনে সেটাকে উল্টে বাটিটাকে চাপা দিল সন্তর্পণে যাতে দুটোয় ছোঁয়াছুঁয়ি না হয়ে যায়। তারপরে সে ফিরে এলো বিছানায়। দুটো কাচের আড়ালে থাকলেও ফুলের লালরঙটা বোঝা যাচ্ছে। স্বপ্নেন্দুর সেই রূপকথার গল্পটা মনে পড়লো। গভীর সমুদ্রের নিচে একটা ঝিনুকের বুকে কারোও প্রাণ লুকোনো ছিল। মনে হল ওই দুই কাচের পাত্রের আড়ালে জীবন্ত ফুলটা তার প্রাণ কারণ ওটার দিকে তাকালেই হৃৎপিণ্ডটা অদ্ভুত শান্ত হয়ে যায়। কোনো চিন্তা মাথায় আসে না, শুধু একটা ভালো লাগায় বিভোর হতে হয়।

কাল সারাটা রাত ঘুম আসেনি। চেষ্টা করেছে স্বপ্নেন্দু, বিছানায় নিথর হয়ে পড়ে থেকেছে। তবু ঘুমুতে পারেনি। তার চোখের পাতা কিংবা অক্ষিগোলক নেই। শোওয়া অবস্থায় সবসময়ে ঘরের ছাদটায় দৃষ্টি আটকে থেকেছে। এই দৃষ্টি বন্ধ করার কোনো কায়দা তার জানা নেই। শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছে পরিবর্তিত অবস্থায় তাদের ঘুম আসবে না। ঘুম প্রয়োজন শরীরের। ঘুমন্ত অবস্থায় হৃৎপিণ্ড কাজ করে যায়। তাই শরীর যদি না থাকে তাহলে ঘুমের কী দরকার। অতএব খাবার জল ইত্যাদির মতো ঘুমও তার জীবন থেকে চলে গেল।

মাঝরাত্রে খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। সে সারাজীবন ঘুমাতে পারবে না এটা চিন্তা করতেই অস্বস্তিটা বেড়ে যাচ্ছিল। অন্যমনস্ক স্বপ্নেন্দু পাশ ফিরে তাকাতেই সেই গোলাপের রঙটা দেখতে পেল। আর অমনি তার চিন্তা স্থির হয়ে মিলিয়ে গেল। সে লক্ষ্য করেছে বেশি উত্তেজিত হলে হৃৎপিণ্ড কাঁপে। ফুলটার দিকে তাকালে সেই কাঁপুনি থেমে যায়। সুন্দর শান্তিতে রাতটা কেটে গেল, ঘুম নেই, কিন্তু ফুলটার দিকে তাকিয়ে থেকে তার একটুও কষ্ট হচ্ছিল না সকালে।

আজও ছুটি। তার কিছুই করবার নেই। রেডিওটা খুলতেই বাজনা শুনতে পেল সে। আর মাঝে মাঝেই সরকারের পক্ষ থেকে কলকাতাবাসীদের কাছে আবেদন জানানো হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালু করার জন্যে। খবর শুনল সে। আজ সকালে ট্রামবাস আগের মতো চলতে শুরু করেছে। কলকাতার মানুষ দলে দলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছেন। মনে হচ্ছে তারা ওই ঘটনার প্রাথমিক আঘাত খুব দ্রুত কাটিয়ে উঠেছেন। আজ ছুটির দিন। মুখ্যমন্ত্রী আবেদন করেছেন কাল থেকে সবাই যেন নিয়মিত অফিস-কাছারিতে যোগ দেন।

দুপুরে বাড়ি থেকে বের হলো স্বপ্নেন্দু। সেই পাজামা পাঞ্জাবি এবং চাদর জড়িয়ে। আজ রাস্তায় অনেক লোক। স্বপ্নেন্দুর ভালো লাগল প্রত্যেকেই যে যার মতো পোশাক পরেছে। ট্রাম স্টপেজের কাছে আসতেই সে একটা স্বর শুনতে পেল, এই যে দাদা, খুব শীত নাকি?

সে মুখ ফিরিয়ে তাকাতে দেখতে পেলো চারটি মাঝারি সাইজের কঙ্কাল একটা রকে বসে আছে। প্রত্যেকের পরনে চাপা প্যান্ট এবং রঙিন জামা। করোটির দিকে তাকালে বোঝা যায়। ওদের বয়স খুব বেশি নয়। সে দেখছে বুঝে একজন বলল, অত লজ্জা কেন? আপনার মাথা কি আলাদা? খুলে ফেলুন খুলে ফেলুন। পাঁচজনে দেখুক।

আর একজন পিনিক কাটল, যেন লজ্জাবতী বউ!

স্বপ্নেন্দুর চোয়াল শক্ত হল। এরা যে রকবাজ তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না! সামনে বস্তির কিছু ছেলে এখানে এসে বসে আড্ডা মারে, খিস্তি করে, প্রয়োজনে বোমাটোমাও ছোড়ে। এই দলটা তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এখন সে কিছুই করতে পারে না। এই শরীরে নিয়ে মারামারি করার কথা চিন্তা করাও যায় না। কিন্তু এত কাণ্ডের পরও ওরা ওদের স্বভাব ত্যাগ করতে পারেনি সেটাই আশ্চর্যের কথা। এই জেনারেশনের ছেলেগুলো কি কোনো কিছুতেই রিঅ্যাক্ট করে না? তার মনে হলো, ওরা আগের মতোই আছে, হয়তো ভালোই আছে।

ধর্মতলার ট্রাম আসছিল। স্বপ্নেন্দু লক্ষ্য করল ড্রাইভারের শরীরে ওভারকোট, মাথায় মাফলার জড়ানো! কিন্তু লোকটা যে কঙ্কাল তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। লোকটা নিশ্চয়ই তারই মতো। নইলে এই গরমে ওসব জড়িয়ে বের হয়। ট্রামটা থামতে, উঠে পড়ল স্বপ্নেন্দু। বিভিন্ন সাইজের কঙ্কালে সিটগুলো ভরে আছে। কিছু দাঁড়িয়ে। বোঝা যাচ্ছে ছুটির দিন সবাই কলকাতার নতুন চেহারা দেখতে বেরিয়েছে। এবং তখনই তার চোখে পড়ল লেডিস সিটে দুজন মহিলা বসে আছেন। মহিলা, তার কারণ ওঁদের পরনে শাড়ি ব্লাউজ। আঁচল ঘোমটার মতো মাথায় জড়ানো। স্বপ্নেন্দুর হৃৎপিণ্ড থরথরিয়ে উঠল। মুখের দিকে তাকালে কেমন ছ্যাঁক করে ওঠে। সে আরও একটু সরে এল। লেডিস সিটে কিছু জায়গা খালি আছে। যারা দাঁড়িয়ে তারা ইচ্ছে করেই বসে নি। সে দুই মহিলার মুখের দিকে তাকাল। গোলগাল ছোট্ট করোটি। নাক এবং গালের হনুতে স্পষ্ট পার্থক্য আছে পুরুষদের সঙ্গে। হাতের হাড় সরু সরু। দেখলেই বোঝা যায় খুব পলকা শরীর। পাশে দাঁড়ানো একজন বলল, বসতে চান বসে পড়ুন। লেডিস উঠলেই হয়ে যাবে।

একজন মহিলা সেকথা শুনে মুখ তুলেই ফিরিয়ে নিলেন! এর নাকের ডগাটা বসা, কপাল উঁচু। কোনো মেয়ের চেহারা এত বীভৎস হতে পারে? মনে হতেই হেসে ফেলল স্বপ্নেন্দু। রাস্তায় বের হলেই বোঝা যাচ্ছে পুরুষরাও কতখানি কুৎসিত দেখতে। এতকাল মাংস চামড়া এবং রঙ প্রত্যেকের খামতি আড়াল করে রাখত। আজ কলকাতার কোনো দোকানপাট খোলেনি। ধর্মতলাটা ছুটির দিনে যেমন তার থেকেও বেশি খাঁ-খাঁ। যেন হরতাল হয়ে গেছে। শুধু কাতারে কাতারে মানুষ উৎসুক হয়ে বেরিয়ে পড়েছে। বাস চলছে গোটা কয়েক। কিন্তু প্রাইভেট গাড়ি চোখে পড়ল বেশ কিছু। যারা চালাচ্ছে তাদের ভঙ্গি ঠিক আগের মতোনই। ট্যাক্সি একটাও বের হয় নি রাস্তায়।

গড়ের মাঠের অবস্থা খারাপ হয়েছিল পাতাল রেলের কল্যাণে। এখন তো তাকানোই যায় না। সব ঘাস উধাও হয়ে ন্যাড়া হয়ে গেছে চারধার। গাছগুলো পর্যন্ত পোড়া কয়লা। ইডেন গার্ডেন একটা পোড়া বাগানের চেহারা নিয়েছে। আরও কয়েক পা হাঁটার পর চমকে উঠল স্বপ্নেন্দু। গঙ্গায় এক ফোঁটা জল নেই। চাপ চাপ শক্ত কাদার ওপর মৃত জলচর প্রাণীর হাড় ছড়িয়ে আছে। নদীর কঙ্কালটাকে বীভৎস দেখাচ্ছিল। লঞ্চ এবং জাহাজগুলো নদীর কাদায় আটকে রয়েছে। জল নেই, কথাটা মনে পড়ল। মুখ্যমন্ত্রী বলছেন বহির্জগতের সঙ্গে কলকাতা বিচ্ছিন্ন। তাহলে এই গঙ্গার শেষ যেখানে সেখানে কী আছে? স্বপ্নেন্দুর মাথায় ঢুকছিল না নিশ্চয়ই গোটা সমুদ্রটা উধাও হয়ে যায় নি। অবশ্য কলকাতার বাইরে।

সারাদিন স্বপ্নেন্দু ঘুরে বেড়াল। মানুষের আচরণ এখন প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তবে রাস্তাঘাটে বিভিন্ন সাইজের কঙ্কালের অকারণ ভিড়। তালতলায় এসে ওর মন্টুদার কথা মনে পড়ল। প্রচণ্ড আড্ডার লোক। বিয়ে থা করেও ঠিক সংসারি হয় নি। বউদি সংসার চালিয়ে এসেছেন, মন্টুদা টাকা দিয়ে খালাস। স্বপ্নেন্দু ট্রাম থেকে নেমে পড়ল। মন্টুদার বাবার এ অঞ্চলে বড়লোক বলে খ্যাতি ছিল। গোটা তিনেক বাড়ি আছে। সেগুলোর ভাড়াটেরা আদ্যিকালের ভাড়ায় বহাল তবিয়তে রয়েছে। এই নিয়ে কোর্ট-কাছারি চলছে। এইটেই মন্টুদার একমাত্র অশান্তির কারণ।

গলির মুখে একগাদা কঙ্কাল ভিড় করেছে। স্বপ্নেন্দু দরজার কড়া নাড়ল। প্রথমে কোনো সাড়াশব্দ নেই। তারপর একটা স্বর শোনা গেল, কে?

আমি স্বপ্নেন্দু। দরজা খোলো।

তবু সময় লাগল। যে খুললো তার দিকে তাকিয়ে স্বপ্নেন্দু ঠাহর করতে পারলো না পরিচয়। সে জিজ্ঞাসা করলো, মন্টুদা আছে?

বসার ঘরে ঢুকে ইজিচেয়ারটার দিকে তাকাতে স্বপ্নেন্দু চমকে উঠলো। মন্টুদার শরীর ছিল ছফুট লম্বা। গায়ের রঙ টকটকে লাল। শরীরে এক ফোঁটা মেদ নেই। আর পঞ্চাশ বছর বয়সেও মাথা ভরতি চুল দেখে ঈর্ষা হতো ওদের। অনেক বিখ্যাত পরিচালক মন্টুদাকে ফিল্মে নামাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেকথা শুনলেই হো হো করে হাসত মন্টুদা, বায়োস্কোপ? ও স্কোপ আর নাই বা নিলাম। এই বেশ আছি। খাচ্ছি দাচ্ছি বগল বাজাচ্ছি। কী বলিস?

সেই মন্টুদা ইজিচেয়ারে লম্বা হয়ে পড়ে আছে। পরনে পাঞ্জাবি আর সিল্কের লুঙ্গি। করোটির সাইজটা লম্বাটে। কি বীভৎস সাদা দেখাচ্ছে ওটা। এই সময় মন্টুদা কথা বললো, ভেবড়ে গিয়েছিলি মনে হচ্ছে। বসে পড়।

মন্টুদা। স্বপ্নেন্দু সন্তর্পণে চেয়ারটায় বসলো।

তুই যদি নাম না বলতিস তাহলে চিনতাম না।

কেন?

আমি এখন কাউকে চিনতেই পারছি না। তুই ভাবতে পারিস, আমার বউ আর বড়মেয়েকে গুলিয়ে ফেলেছি দুবার। একবারে এক সাইজের প্রোডাকশন। বহুৎ ঝামেলা হয়ে যাচ্ছে। মন্টুদা সোজা হয়ে বলল।

তোমার কোনো রিঅ্যাকশন হয়নি?

রিঅ্যাকশন! নিশ্চয়ই! এর চেয়ে আরাম আর কিছুতে কল্পনা করা যায়। চাকরি করতে হবে না এ জীবনে। বেশ পায়ের ওপর পা তুলে বই পড়ব। পৃথিবীর কত বই। তুই সিরিয়াসলি পড়লেও এক হাজারের এক ভাগও একটা জীবনে পড়ে শেষ করতে পারবি না। কিন্তু এখন? মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন আমরা অমর। ডাল ভাতের ঝামেলা নেই। পৃথিবীর সব বই শেষ করব এখন।

আরামদায়ক একটা শব্দ উচ্চারণ করল মন্টুদা।

কিন্তু বহির্বিশ্বের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই।

বয়ে গেল। এই কলকাতায় বই-এর অভাব?

হঠাৎ বই নিয়ে পড়লে?

কিছু একটা নিয়ে থাকতে হবে যে রে! নিজেকে খুব অশিক্ষিত মনে হয়। এবার শোধ তুলব। তোর বউদির ঘ্যানর ঘ্যানর করার দিন খতম।

কেন?

সংসারে কোনো কাজ করো না। বাজার করো না রেশন করো না। এইসব টিকটিকানি আর শুনতে হবে না। তারও জ্বালা জুড়োলো আমিও বেঁচে গেলাম। মন্টুদা বললো, শুধু সিগারেটের অভাব ফিল করছি।

সেকি? এত জিনিস থাকতে সিগারেটের?

অভ্যেস ভাই অভ্যেস। সেই পনেরো বছর বয়সে শুরু করেছিলাম। যাক, তোর খবর কি বল। অনেকদিন বাদে এলি।

মাইরি মন্টুদা, তোমার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে কিছুই হয়নি। যেন আগের অবস্থায় আছ। তোমার প্রতিক্রিয়া হয়নি।

উপনিষদ পড়েছিস?

না।

ওই তো জ্ঞান হবে কোত্থেকে? মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ শুনেছিস?

হ্যাঁ।

তাও শিক্ষা হলো না। তিনি বলেছেন সব কিছু স্বাভাবিক মনে মেনে নিতে তাহলে আর কোনো কষ্ট থাকবে না। আরে একটা বিপ্লব করতে কত পরিশ্রম, কত সংগ্রাম কত রক্তক্ষয়। অথচ দ্যাখ, আমাদের কিছুই লাগল না অথচ বিপ্লব হয়ে গেল, মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন।

মুখ্যমন্ত্রীর এত বাধ্য হলে কবে থেকে?

কারণ, বিরোধী নেতাদের বাণী এখনও কানে আসেনি। সমস্ত খবরের কাগজ এখন বন্ধ। আরে জীবনটাকে এবার চুটিয়ে উপভোগ কর। পড়বি, গান শুনবি গান গাইবি। আমরা তো এখন দেবতাদের মতেন। রোগ যন্ত্রণার বালাই নেই।

মন্টুদার কথা শেষ হওয়া মাত্র একটি বালক দরজায় এসে দাঁড়াল। তার পরনের হাফপ্যান্ট দড়ি দিয়ে কোনোরকমে কোমরে বাঁধা।

মন্টুদা জিজ্ঞাসা করলেন, কি সমাচার বৎস?

বাবা আমি খেলতে যাব?

আমার অনুমতি কিবা প্রয়োজন?

মা নিষেধ করছে। বলছে মাঠের ঘাস ছাই হয়ে গেছে, ওখানে যেতে হবে না।

চমৎকার। মাকে ডেকে দাও।

ছেলেটি চলে গেল। মন্টুদা বললেন, খোকা কি লাকি বল তো। সারা জীবন খেলে কাটাবে। ওর শৈশব কোনোদিন কাটবে না। আমরা বলতাম মানুষের শৈশব হলো তার জীবনের গোল্ডেন ডেজ। ও চিরকাল সেই গোল্ডেন ডেজে থাকবে। এর চেয়ে সুখবর আর কি আছে।

এই সময় কেউ দরজার বাইরে দাঁড়াল। তার শাড়ির একাংশ দেখা যাচ্ছিল। মন্টুদা ডাকলেন, হায় তুমি ওখানে কেন প্রিয়ে! ভেতরে এসো। এখানে স্বপ্নেন্দু বসে আছে। তোমার দেবর। ওকে দেখে এত লজ্জা। কেন?

বউদি যেন আরও সঙ্কুচিত হলেন। তার নিচু গলা শোনা গেলো, কি বলছ?

কি আশ্চর্য! তোমার এ ঘরে ঢুকতে এত লজ্জা কেন?

না, আমি যেতে পারব না।

মাথা নাড়লো মন্টুদা। তারপর বললো, খোকাকে মাঠে পাঠাও। ও খেলুক।

ওখানে শুধু ছাই।

ছাই মাখুক। মহাদেব ছাই মাখতেন।

যা ইচ্ছে করো।

তোমার মনটা আগের মতো আছে। আরে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলো। তোমার কত কাজকর্ম কমে গেছে, তা দেখছ না!

বউদি অন্যরকম গলায় বললেন, আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে।

চেষ্টা করলেও পারবে না। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন আমরা অমর। কথাটা বলে হো হো করে হেসে উঠলো মন্টুদা। স্বপেন্দু বুঝলো বউদি অসন্তুষ্ট হয়ে চলে গেছে দরজার আড়াল থেকে।

হঠাৎ মন্টুদা বললো, দাবা খেলবি?

দাবা?

চমৎকার সময় কাটানোর খেলা। তুই তো জানিস।

এখন ভালো লাগছে না।

ও। মন্টুদা আবার ইজিচেয়ারে শুয়ে পড়লো, তুই এখনও শক্ কাটিয়ে উঠতে পারিসনি। চেষ্টা কর। জলের মতো হয়ে যা, যখন যেমন পাত্র তখন তেমন আকার।

স্বপ্নেন্দু উঠলো, আজ চলি মন্টুদা।

চলে আসিস। মন খারাপ হলেই চলে আসিস, আমি ভালো করে দেব।

স্বপ্নেন্দু হেসে ফেললো, তুমি সত্যি নমস্য ব্যক্তি। সন্ধে হয়ে এসেছিলো। রাস্তায় নেমে চমকে উঠল স্বপ্নেন্দু। মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে একটা নগ্ন কঙ্কাল চেঁচাচ্ছে, বেরিয়ে আয় শালা, এক বাপের বাচ্চা হলে সামনে আয়। তার ডান হাতে একটা গোলমতো বস্তু দেখা যাচ্ছে। সেটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আস্ফালন করছে লোকটা। স্বপ্নেন্দু এগিয়ে যাচ্ছিল। পাশ থেকে একজন বলে উঠলো, যাবেন না দাদা, ওর হাতে পেটো আছে।

পেটো?

পুরনো ঝগড়া। আজ বদলা নিতে এসেছে।

স্বপ্নেন্দু হতভম্ব হয়ে গেল। যাদের মন্টুদার বাড়িতে যাওয়ার সময় এখানে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল তারা আশেপাশে আড়াল খুঁজে সেঁধিয়েছে। পুরনো অভ্যেসে এরা প্রাণভয়ে ভীত। কিন্তু যে লোকটা পেটো ছুঁড়তে এসেছে? স্বপ্নেন্দু লোকটার দিকে তাকাল। সমানে তড়পে যাচ্ছে লোকটা অকথ্য ভাষায়, এই যে এতো বড়ো একটা পরিবর্তন হয়ে গেল কলকাতায়, মানুষ বিপর্যস্ত, তার কোনো প্রতিক্রয়া কি ওর মধ্যে হয়নি? এখন পুরোনো আক্রোশ টিকে থাকতে পারে? স্বপ্নেন্দুর মাথায় ঢুকছিল না। এ বোধ হয় শুধু কলকাতাতেই সম্ভব হতে পারে।

স্বপ্নেন্দু এগিয়ে গেল। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন এখন কলকাতাবাসী অমর। তিনি মিথ্যে কথা বলবেন। তাই ওই লোকটা যতই শাসাক তার কিছু করতে পারবে না।

গলির ভেতর থেকে কেউ বেরিয়ে আসছে দেখে লোকটা চিৎকার থামিয়ে মুখ ঘোরাল। ওর হাত ক্রমশ ওপরে উঠে যাচ্ছে। স্বপ্নেন্দু চেঁচাল, আমি স্বপ্নেন্দু, তুমি যাকে খুঁজছো সে নই। হাত নামাও।

বুঝব কী করে? সব শালাকে যে একরকম দেখতে হয়ে গেছে।

ততক্ষণ লোকটার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে সে। না, লোক নয়। হাড়ের গঠন এবং শারীরিক চাঞ্চল্য প্রমাণ করছে এ তরুণ। স্বপ্নেন্দু বলল,

তুমি খামোখা মাথা গরম করছ। তার গলার স্বর কি আমার মতো?

একটু চিন্তা করল ছেলেটা, তারপর বলল, এক মনে হচ্ছে না।

তাহলে হাত নামাও। তুমি একটা বুদ্ধু, এখন পেটো ছুড়ে কাউকে মারলেও তার কিছু হবে। রক্ত মাংস নেই তো পেটো কী করবে?

সে আমি জানি।

জানো মানে?

গলার স্বর নামিয়ে আনল ছেলেটি, ফালতু ভয় দেখাচ্ছি। দেখুন না, শালারা কেমন ছাগলের মতো লুকিয়েছে। দেখে যে কি আরাম লাগছে, কি বলব!

স্বপ্নেন্দু আর দাঁড়াল না। ট্রাম রাস্তায় এসে সে হতভম্ব হয়ে গেল। না, কোনো গাড়ি ঘোড়ার চিহ্ন নেই। সন্ধে হয়ে গেছে। রাস্তায় আলোগুলো এদিকে জ্বলছে না। কেমন যেন গা ছমছমে ভাব। তাকে যেতে হবে অনেক দূর। আগে হলে কেয়ার করত না। কিন্তু এখন এতটা পথ হেঁটে যাওয়া অসম্ভব। এমনিতে তার পায়ের হাড় কনকন করছে। সন্ধে হচ্ছে বলে লোকজন রাস্তা থেকে কমে যাচ্ছে। স্বপ্নেন্দু ভেবে পাচ্ছিল না সে কি করবে। একটু একটু করে হেঁটে সে ওয়েলিংটনের মোড়ে চলে এল। জায়গাটা শ্মশানের মতো ফাঁকা। কলকাতা শহরে দাঁড়িয়ে এমন অসহায় সে আর কখনও হয়নি। এই সময় একটা শিস শুনতে পেল সে। কেউ যেন মনের আনন্দে শিস দিয়ে যাচ্ছে। মেরা জুতা হ্যায় জাপানি। চারপাশে চোখ বোলাতে সে ফুটপাথের ধার ঘেঁষে ভিখিরিটাকে দেখতে পেল। দুটো ছেঁড়া চট গায়ে চাপিয়ে রাজার মতো হেলান দিয়ে বসে বসে শিস্ দিচ্ছে। তার ঊধ্বাঙ্গে কোনো বস্ত্র নেই। হঠাৎ তাকালে আনন্দমঠের মম্বন্তর গ্রামের ছবিটি মনে পড়ে যায়। চোখাচোখি হতে লোকটা খুকখুক করে হাসল, এই যে বাবু, দুটো পয়সা হবে!

স্বপ্নেন্দু অবাক হল। ভিখিরিটা এখনও পয়সা চাইছে! কিন্তু হাসল কেন? সে কোনো কথা বলার আগেই ভিখিরিটা চেঁচিয়ে উঠলো, লাথি মারি টাকার মুখে। আর আমাকে কারো কাছে পয়সা চাইতে হবে না। কি আনন্দ! আর শালা মানুষের গালাগালি শুনব না। মেরা জুতা হ্যায়। জাপানি। এই যে দাদা, দুটো পয়সা হবে। নিজের গলাটাকেই বিকৃত করে শোনাল লোকটা।

ঠিক তখন একটা প্রাইভেট গাড়িকে আসতে দেখল স্বপ্নেন্দু। ফিয়াট। গাড়িটা যাচ্ছে তার গন্তব্যস্থলের দিকে। স্বপ্নেন্দু। হাত তুলল। সেটা পর্যাপ্ত নয় ভেবে রাস্তায় মাঝখানে নেমে গিয়ে ইশারা করতে লাগল থামাবার জন্যে। ড্রাইভার যেন খানিকটা ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে থামাল গাড়িটা। স্বপ্নেন্দু ছুটে গেলো জানলায়,

কোথায় যাচ্ছেন আপনি?

শ্যামবাজার।

আমিও যাব। কোনো কিছু পাচ্ছি না। যদি—

উঠে বসুন।

গাড়িতে উঠে স্বপ্নেন্দু বললো, ধন্যবাদ।

কোনো দরকার নেই। আগে আমি কাউকে লিফ্ট দিতাম না। এখন তো কোনো ভয় নেই এই যে হৃৎপিণ্ড দেখছেন ওটা এমন একটা প্রটেকশনে আছে আণবিক বোমা মারলেও ভাঙবে না। ডু য়ু নো, এটা কী?

না।

আমাদের পাপ। সারাজীবন আমি যে পাপ করেছি এটা তাই দিয়ে তৈরি।

হেসে ফেলল স্বপ্নেন্দু, তাহলে একটি এক বছরে শিশুর বেলায় কী বলবেন?

সে তার বাপ মায়ের কাছ থেকে রক্তের সূত্রে ওটা পেয়েছে।

স্বপ্নে দেখলো গাড়ির কাচে রেডক্রশ চিহ্ন রয়েছে। সে জিজ্ঞাসা করল, আপনি ডাক্তার?

আই ওয়াজ। আমার একটা মরণাপন্ন পেশেন্ট ছিলো নার্সিংহোমে। আজ গিয়ে দেখি সে নাকি হেঁটে বাড়ি চলে গেছে। নার্সিংহোমের সবাই বেকার। সুতরাং আমিও। আমি এখন কী করব? মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন আমাদের মৃত্যু নেই। শরীর নেই যখন তখন অসুখ বিসুখ করবে না কারো। আমি বেকার হয়ে গেলাম। মুখ্যমন্ত্রী বললেন যারা খাদ্য ব্যবসায় আছে তাদের দেখবেন। বাট হোয়াট অ্যাবাউট আস? তাছাড়া কেমন যেন অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। সারাদিন রোগী দেখে। বেড়াচ্ছি, চেম্বারে পেশেন্ট গিজ গিজ করছে। সবসময় টেনশন। সারা জীবনে তো কম আর্ন করিনি। সেগুলো নিয়ে আমি কি করব এখন? ডাক্তার স্বপ্নেন্দুর দিকে তাকালেন, আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু লিভ। জানেন, আমার কাছে কিছু সায়েনায়েড ছিল। এক ফোঁটা জিভে লাগলে চোখ বন্ধ হয়ে যাবে। মুঠোয় করে মুখে ঢালোম, হৃদপিণ্ডে মাখালাম। নো রেসপন্স। হাতুড়ি দিয়ে ভাঙবার চেষ্টা করলাম বুকের বাক্সটা। একটুও টসকাল না।

ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললেন ডাক্তার।

স্বপ্নেন্দু নিচু গলায় বলল, মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন এই পরিবর্তিত অবস্থাকে সহজ মনে মেনে নিতে। অ্যাকচুয়ালি, আপনি আপনার সঞ্চিত টাকা এখন মানুষের উপকারে খরচ করতে পারেন। খাওয়া পরা অথবা অসুখ বিসুখ ছাড়াও তো মানুষের অনেক প্রয়োজন আছে। যেগুলো এতকাল আমরা পারতাম না।

বাধা দিলেন ডাক্তার, আপনি কমুনিস্ট?

না। মোটেই না।

তাহলে রাবিশ কথাবার্তা বলবেন না। আমি সারাজীবন এত কষ্ট করে যা উপার্জন করেছি তা পাঁচজনের জন্যে বিলিয়ে দেব? তার চেয়ে নিজের হাতে পুড়িয়ে ফেললে বেশি আরাম লাগবে।

স্বপ্নেন্দু কথা বলল না। গাড়ি ততক্ষণ কলেজ স্ট্রিট ছাড়িয়ে গেছে। পথঘাট নির্জন। এবার ডাক্তারের গলায় হাহাকার শোনা গেলো, আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ আনন্দটাকে চিরকালের জন্য হারালাম।

কী সেটা।

ডাক্তারের করোটিটা দুললো, ইঞ্জেকশন। যখন আমি কারো শরীরের কাছে সিরিঞ্জ নিয়ে যেতাম অদ্ভুত প্লেজার হতো। দিনে অন্তত গোটা পাঁচেক ইঞ্জেকশন না দিলে আমার রাত্রে ঘুম আসতো না।

সেকি?

আমি অ্যাদ্দিন কাউকে বলি নি। এখন অবশ্য বাধা নেই। কাউকে বলিনি ঠিক নয়, আমার এক মনস্তাত্ত্বিক বন্ধুকে বলেছিলাম। সে জিজ্ঞাসা করেছিল, আমি কি ইমপোটেন্ট? স্বীকার করিনি তখন। এখন কলকাতার মানুষ আর সেসবের কথা ভাববে না। তাই বলছি, হি ওয়াজ রাইট।

স্বপ্নেন্দু নড়ে চড়ে বসল। লোকটা পাগল নাকি? দু মিনিটের আলাপে যে সব কথা বলছে তা কোনো সুস্থ মানুষ বলে? হয় পাগল, নয় স্বপ্নেন্দু মাথা নাড়ল, এসব পরিবর্তিত পরিস্থিতির ফল। এখন মানুষের কিছুই হারাবার ভয়ডর নেই। অতএব নিজের গোপন তথ্য খুলে বললেও ক্ষতি নেই।

শ্যামবাজার কোথায়?

স্বপ্নেন্দু রাস্তাটার নাম বলল। ডাক্তার বললেন, অয়েল ইন্ডিকেটারের দিকে তাকিয়ে দেখুন। ওটা শূন্যে আটকে আছে। অথচ গাড়িটা সুন্দর চলছে। জল নেই এক ফোঁটা তবু ইঞ্জিন বন্ধ হচ্ছে না। আগে শুনলে পাগল বলতাম। তাই না?

সেকি পেট্রোল নেই তবু গাড়ি চলছে।

দেখছেন তো।

হয়তো আপনার ইন্ডিকেটারটা ঠিক কাজ করছে না।

নো। ওটা ঠিক আছে।

তাহলে?

এটাও বোধহয় পরিবর্তিত পরিস্থিতির রেজাল্ট। আরে মশাই, গাড়িতে যে এক ফোঁটা জল নেই সেটা বিশ্বাস করেন তো। ওই দেখুন হেদোর কি অবস্থা!

স্বপ্নেন্দু হতভম্ব হয়ে গেল। এখন থেকে গাড়ির জন্য আর পেট্রোলের দরকার হবে না? কি আশ্চর্য! স্বপ্নেন্দুর মোড়ে এসে গাড়িটা থামালেন। ধন্যবাদ জানিয়ে নেমে যাচ্ছিল সে। ডাক্তার বললেন, শুনুন মশাই, আপনার নাম জানি না। কোনোদিন দেখা হবে কি না তারও ঠিক নেই। তবে আমাকে পাগল ভাবার কোনো কারণ নেই। যে যে কারণে আগে পাগল ভাবা হতো, এখন সেইসব কারণগুলো বাতিল হয়ে গিয়েছে। বরং আপনার যদি কোনো পাপ টাপ থাকে তাহলে বলাবলি করতে শুরু করুন, দেখবেন বেশ হালকা লাগবে।

গাড়িটা চোখের সামনে থেকে চলে গেলেও স্বপ্নেন্দু দাঁড়িয়েছিল। অদ্ভুত লোক তো! তার পরেই খেয়াল হলো, তার নিজের কোনো পাপ আছে কি না। স্বপ্নেন্দু অনেক চিন্তা করেও তেমন কোনো পাপের কথা মনে করতে পারল না। ছেলেবেলায় একবার একটা বেড়ালকে ঢিল ছুঁড়ে খোঁড়া করে দিয়েছিলো। খুব চুরি করত বেড়ালটা। সে এমন পাপ, আদৌ পাপ কি না বলা মুশকিল, কিন্তু ও কথা কাউকে বলা যাবে না।

ঘরে ঢুকে বিছানায় চিৎপাত হতে গিয়েই স্বপেন্দুর মনে পড়ল। টেবিলের দিকে তাকাতেই কাচের আড়ালে সেই লাল গোলাপটাকে দেখতে পেল সে। গোলাপটাকে আরও টাটকা আরও বেশি লাল দেখাচ্ছে। সে দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে স্বপ্নেন্দুর মন শান্ত হয়ে গেল।

পরের দিন রেডিও খুলে স্বপ্নেন্দু বুঝল কলকাতার অবস্থা বেশ স্বাভাবিক। চমৎকার গানবাজনা হচ্ছে। খবরে বলা হলো, প্রচুর ট্রাম বাস চলছে সকাল থেকে। গত দুদিনে কলকাতায় খুনজখম দূরের কথা সামান্য ছিনতাই-এর ঘটনা পর্যন্ত ঘটেনি। তবে ধুতি এবং লুঙ্গির চাহিদা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। নাগরিকদের কাছে আবেদন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী, অবিলম্বে যে যার কাজে যোগ দিন। আজ স্বপ্নেন্দু চাদরটাকে বাতিল করল। কারণ ওতে মনের জড়তা ধরা পড়ে। যা হয়েছে তা ওর একার ক্ষেত্রে নয় যখন, তখন প্রকাশ্যে মেনে নেওয়াই ভাল। ঘর থেকে বের হবার আগে সে আবার ফুলটার দিকে তাকাল। চমৎকার তাজা। কলকাতা শহরে একমাত্র তার কাছেই ফুল আছে, খাঁটি ফুল। ওটাকে ছোঁওয়া যাবে না, টেবিল থেকে নড়ানো যাবে না। অথচ এই ঘরে ফুলটা একা পড়ে থাকবে সেটাও ভালো লাগছিল না। স্বপ্নেন্দু একটা চাদর দিয়ে বড় জারটাকে ঢেকে দিল।

আজ ট্রামে বাসে খুব ভিড়। ট্রামে বাসে যত লোক ধরত এখন তার ডবল ধরবে।

কথাটা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। একজন বলল, মুখ্যমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন। বিপ্লব এলেও ট্রান্সপোর্ট প্রব্লেম সলভ করতে পারত না।

প্রথম জন স্বপ্নেন্দু দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাদের বাথরুমটাকে কী করবেন ভাবছেন?

বাথরুম? স্বপ্নেন্দু হতভম্ব।

দুর মশাই। এখন তো আর বাথরুমের প্রয়োজন নেই। খামোকা কিছু ঘর খালি পড়ে থাকবে বাড়িতে বাড়িতে। আমি ভাবছি ওটা ভাড়া দিয়ে দোব। আমাদের বাথরুমটা বেশ বড়।

দ্বিতীয়জন বলল, ভাড়ার টাকা দিয়ে কী করবেন দাদু?

কেন? শখের জিনিস কিনব। এই ধরো কালার টিভি।

টি ভি? স্টেশন তো চালু হয়নি।

হয়নি, কিন্তু হবে।

ওঃ টিভির মেয়েগুলোকে কী রকম দেখাবে ভাবুন তো! আমার বড় মেয়েটি দেখতে ভালো নয় বলে অ্যানাউন্সারের চাকরি পায় নি। এখন আবার অ্যাপ্লাই করতে বলি, কি বলেন?

স্বপ্নেন্দু দেখল কলকাতার মানুষ বেশ সহজেই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। হয়তো মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধে কাজ হয়েছে। তার বেশ ভালো লাগছিল। লিফটের সামনে বিরাট লাইন। কিন্তু আজ অনেক বেশি লোক করছে বলে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে লাইনটা। স্বপ্নে দেখল লাইনে তিনটে শাড়ি আছে। তার মানে মেয়েরাও অফিসে এসেছে। তার হৃৎপিণ্ড কাঁপতে লাগল, হেনা সেন আছে নাকি লাইনে? কী করে হেনাকে চিনবে সে? আজ সকালে রেডিওতে বলেছিল, প্রত্যেক নাগরিক আইডেন্টিটি কার্ড সঙ্গে নিয়ে অফিসে যাবেন। কিন্তু সে কার্ড তো ব্যাগের ভেতরে থাকবে।

স্বপ্নেন্দু ছটফট করছিল। লিফটে উঠে সে শাড়ির দিকে তাকাল। সেদিন হেনা সেন যে শাড়ি পরেছিল সেটার সঙ্গে এই তিনটির রঙ মিলছে না। হেনা যদি তাকে দ্যাখে তাহলে নিশ্চয়ই হাসবে। সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল হলো, তার চেহারাও তো হেনার চেনার কথা নয়।

নিজের ফ্লোরে এসে স্বপ্নেন্দু অবাক হলো। দেওয়ালে পোস্টার পড়েছে কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতা চলবে না। ঘুষখোর অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। নিজের ঘরে যাওয়ার সময় সে। দেখলো অফিসে বিরাট জটলা হচ্ছে। বেশ উত্তেজনা। ঘরে ঢুকে সে দেখল তার চেয়ারে কেউ বসে আছে। তাকে দেখে লোকটা উঠে দাঁড়াতে স্বপ্নেন্দু চিনতে পারল। লোকটা নির্জীব গলায় জিজ্ঞাসা করল,

আপনি কি সাহেব?

এক গ্লাস জল দাও হরিমাধব। বলতে বলতে খেয়াল হলো আর জলের দরকার নেই, জল পাওয়াও যাবে না। হরিমাধব ততক্ষণে তিন হাত দূরে ছিটকে গেছে, মাপ করুন স্যার। আমি ভাবিনি আপনি আসবেন।

ভাবনি?

না স্যার। বিশ্বাস করুন এর আগে আমি কখনও ওই চেয়ারে বসিনি। আজ বড় ইচ্ছে হলো শরীরটা যখন পাল্টে গেল, নিজেকে ভূতের মতো দেখাচ্ছে তখন ভাবলাম চেয়ারটায় বসে দেখি কেমন লাগে।

ঠিক আছে। স্বপ্নেন্দু চেয়ারটায় বসলো। অনেক কষ্টে প্যান্টটাকে কোমরে শক্ত করে বেঁধেছে। কিন্তু কেবলই মনে হয় এই বুঝি পড়ে গেল।

হরিমাধব এগিয়ে এলো, স্যার, অফিসের সবাই খুব ক্ষেপে গেছে।

কোন?

ওই ট্রান্সফার হবে। আজ কেউ কাজ করবে না বলেছে।

এখনও ওইসব ওদের মাথায় আছে নাকি?

হ্যাঁ স্যার। আপনি সাবধানে থাকবেন। হরিমাধব দরজার দিকে তাকাল, আর হ্যাঁ, ম্যাডাম আপনাকে ফোন করেছিলেন দুবার। সঙ্গে সঙ্গে মিসেস বক্সীর শরীরটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। মরলেও বোধহয় স্বভাব পাল্টাবে না। তার পরেই ওর হাসি পেল। আর এখন তো হাসি পেতেই তা খুকখুক করে বেরিয়ে পড়ে। কঙ্কালশরীর বোধহয় নিঃশব্দে হাসতে পারে না। স্বপ্নেন্দু টেলিফোনটার দিকে তাকাল। অপারেটর এসেছে তাহলে।

সে আবার হরিমাধবকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার কেমন লাগছে হরিমাধব? ভালো না স্যার। এই ভূতের চেহারা নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালেই শিউরে উঠি। আমার পরিবারকে আবার ঠিক শাঁকচুন্নির মতো দেখায়। নরক, নরকে এসে গেছি। স্যার, শাস্ত্রে লেখা ছিল কলিযুগের পর নাকি এইরকম সাক্ষাৎ নরকবাস ঘটবে। ফুঁপিয়ে উঠল হরিমাধব। স্বপ্নেন্দু তাকালো হরিমাধবের বুকের দিকে। অদৃশ্য গোলকের গর্তে থাকা হৃৎপিণ্ডটা থরথরিয়ে কাঁপছে। তার মানে লোকটার কান্না জেনুইন। মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেল স্বপ্নেন্দুর। এখন কেউ ভান করলে তার বুকের দিকে তাকালেই ধরা পড়ে যাবে। বাঃ ফার্স্ট ক্লাশ।

এই সময় টেলিফোনটা বেজে উঠলো। হ্যাল, বলতেই মিসেস বক্সীর গলা ভেসে এল, কখন এসেছেন? কেউ বলেনি আমি ডেকেছি?

বলেছে। স্বপ্নেন্দু নিস্পৃহ স্বরে বলল।

বলেছে? তবু আপনি আমার সঙ্গে দেখা করছেন না?

যাচ্ছি। আমি একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। রিসিভার নামিয়ে রেখে স্বপ্নেন্দু হরিমাধবকে জিজ্ঞাসা করল, আজ অফিসে সবাই এসেছে? হরিমাধবের করোটিটা নড়ল, না স্যার, অনেকেই আসেনি। পেটের ধান্ধা যখন আর করতে হবে না তখন মিছিমিছি কেন আসতে যাবে?

স্বপ্নেন্দুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। সবাই আসেনি? তার মানে হেনা সেনও না আসতে পারে। প্রশ্নটা করতে গিয়েও পারল না, কেমন সংকোচ বোধ হলো। হরিমাধব আবার এই নিয়ে গপ্পো করবে। যা করতে হবে তাতে অফিসিয়াল ব্যাপার যোগ না করলে হরিমাধবরা অন্যভাবে দ্যাখে।

ঘর থেকে বেরিয়ে আসামাত্র করিডোরে চিৎকার শুনতে পেলো সে। দশবারো জন কংকাল বিভিন্ন পোশাকে দাঁড়িয়ে হাত তুলে স্লোগান দিচ্ছে। সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ করে দেবার হুমকি দিচ্ছে। ওরা। স্বপ্নেন্দুকে দেখেও দেখল না যেন। বোধহয় চিনতে পারেনি। স্বপ্নেন্দু সুড়ুৎ করে মিসেস বক্সীর দরজার কাছে চলে এল। সেখানে একটা কঙ্কাল উর্দি পরে দাঁড়িয়ে আছে।

কাকে চাই? লোকটা জিজ্ঞাসা করল।

এই প্রথম মিসেস বক্সীর ঘরে ঢুকতে বাধা পেল স্বপ্নেন্দু। বিরক্ত স্বরে সে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি কে?

আমি ওর বেয়ারা। ম্যাডাম কাউকে ঘরে ঢুকতে দেবেন না।

কি আশ্চর্য! তুমি আমাকে চিনতে পারছ না? আমি স্বপ্নেন্দু!

সঙ্গে সঙ্গে লোকটা কপালে হাত ঠেকাল ক্ষমা করবেন স্যার। আমার একবার সেরকম মনে হয়েছিল কিন্তু সব মুখগুলো দেখতে যে একরকম। যান স্যার, ম্যাডাম আপনাকে যেতে বলেছেন।

এরকম পাহারা তো আগে দাওনি।

ওই যে, অফিসের লোকরা চেঁচাচ্ছে তাই ম্যাডাম বললেন।

স্বপ্নেন্দু দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। বিশাল ঘরে কেউ নেই। টেবিলের ওপাশে ঘুরন্ত চেয়ারটা ফাঁকা। স্বপ্নেন্দু একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বলল। ঘরের কোণায়, একটা পর্দা ঘেরা জায়গা আছে। সেখানে ইজিচেয়ারে শুয়ে মিসেস বক্সী বিশ্রাম করেন। কিন্তু লাগোয়া বাথরুমের দরজাটা খোলা। ঘরে যিনি ঢুকলেন তাকে দেখে চমকে উঠল স্বপ্নেন্দু। অসম্ভব বেঁটে এবং রোগা একটা কঙ্কালের গায়ে আলখাল্লা টাইপের ম্যাক্সি জড়ানো। করোটির ওপরে বড় রুমাল বাঁধা। ঘরে ঢুকেই ম্যাডাম স্থির হলেন, কে?

আই ম্যাডাম, স্বপ্নেন্দু।

আমি সি। গুড়গুড় করে উনি চলে এলেন নিজের চেয়ারে। তারপর শরীরটা সিধে রেখে বললেন, আমি ভাবছি প্রত্যেকের বুকের ওপরে একটা নেমপ্লেট রাখতে বলব। নইলে চিনতে অসুবিধে হচ্ছে।

এত দেরি হল কেন?

অফিসে আসব না ভেবেছিলাম।

সে কি? কেন? এখন তো শরীর খারাপের অজুহাত টিকবে না।

না। চাকরি করব না ভাবছি।

হোয়াট ডু য়ু মিন? আপনি শোনেননি চিফমিনিস্টার কি বলেছেন? প্রত্যেক নাগরিক এতকাল যা যা করেছেন এখনও তাই করতে হবে। অন্তত সরকারি বেসরকারি চাকরিতে যারা ছিলেন তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে সেই চাকরি করতে হবে। একটা স্পেশ্যাল পুলিশ ফোর্স এই ব্যাপারটা দেখবে। খুক খুক করে হাসলেন মিসেস বক্সী, চাকরি করব না বললেই মিটে গেল?

সে কি? পুলিশরাও এখনও অ্যাকটিভ আছে নাকি?

মোর অ্যাকটিভ। আপনি ভাবছেন গুলি করেও যখন কিছু হবে না তখন যা ইচ্ছে করবেন? এর মধ্যে বিজ্ঞানীরা এমন একটা অস্ত্র বের করেছেন যার রিঅ্যাকশনে হৃৎপিণ্ড আধঘন্টা অসাড় হয়ে যাবে। সেই সময় আপনি নড়তে চড়তেও পারবেন না। আপনাকে অ্যারেস্ট করে টিউব রেলে ফেলে রাখা হবে।

টিউব রেলে?

ইয়েস, টিউব রেল তো ইনকমপ্লিট। তাছাড়া এখন আর টিউবের কোনো প্রয়োজনও হবে। ট্রান্সপোর্ট প্রবেলম সলজ্ঞ। তাই টিউবটাকে অন্ধকূপ হিসেবে ব্যবহার করা হবে। পানিশমেন্ট সেল।

তারপরে অন্য স্বরে মিসেস বক্সী বললেন, ওসব চিন্তা ছাড়ন। ইউ আর ইয়ং হ্যান্ডসাম। কত ব্রাইট প্রসপেক্ট সামনে পড়ে আছে। আজকের অ্যাটেন্ডেন্স অবশ্য সেভেন্টি। নট ব্যাড।

স্বপ্নেন্দু ঠিক ঠাওর করতে পারছিল না মিসেস বক্সী দেখাচ্ছে কি না। তবু সে জিজ্ঞাসা করলো, ডেকেছিলেন কেন?

মিসেস বক্সী বললেন, স্লোগান শুনেছেন? মানুষের অভ্যেস কোথায় যাবে? এই চেঞ্জড শরীরেও ওরা চেঁচাচ্ছে। এটা বন্ধ করতে হবে।

বলুন কী করব?

আঃ, সেটা আপনি ঠিক করুন।

ওই ট্রান্সফার অর্ডারটা বাতিল করে দিন।

সে কী?

ঠিকই বলছি। এখন আর পার্টিরা ঘুষ দিতে আসবে না। কারণ মানুষের অনেক প্রয়োজন আর ঠিক আগের মতো নেই। তাছাড়া ঘুষ নিয়ে ওরা কি করবে? টাকারও মূল্য কমে গেছে!

ইউ আর রাইট। আমি অনেকবার ভেবেছি। সত্যি কথা। এখন আর ঘুষ দেবে কে? আর ঘুষ নিয়ে কিই বা করবে। কিন্তু এটা প্রেস্টিজের ব্যাপার। চট করে আমরা এই সিদ্ধান্ত ওদের জানাব না। মিসেস বক্সী চেয়ার ছাড়লেন। মহিলার চেহারা এখন আমূল পাল্টে গেছে। সেই থপথপে মাংসের তালটা চলে যাওয়ায় বেশ ছিমছাম দেখাচ্ছে। কিন্তু ম্যাক্সিটা নিশ্চয়ই ওঁর নয়। মিসেস বক্সী হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালেন, আমাকে খুব কুৎসিত দেখাচ্ছে?

না না। বিউটিফুল।

ওঃ বাটারিং করবেন না। ওটা আমি একদম পছন্দ করি না। আমি তো প্রথমে এমন শকড ছিলাম যে বিছানা থেকে উঠতেই পারি নি। নাউ আই ফিল ইটস বেটার। অ্যাট লিস্ট উই আর সেফ ফ্রম ইওর হাঙ্গরি আইস। তার পরেই হেসে ফেললেন মিসেস বক্সী, রাগ করবেন না। আমি আপনাকে মিন করি নি। ইউ আর গুড। আসুন না আজকে সন্ধেবেলায় আমার বাড়িতে। আমার মেয়ে খুশি হবে।

আপনার মেয়ে? স্বপ্নেন্দু এতটা তরল হতে ম্যাডামকে কখনও দ্যাখে নি।

হ্যাঁ। এবার লরেটো থেকে পাশ করেছে। ম্যাক্সিটা তো ওরই।

ও, ঠিক আছে যাওয়া যাবে। স্বপ্নেন্দু উঠে দাঁড়ল।

কিন্তু বিনা শর্তে নয়।

মানে?

ওদের ক্ষমা চাইতে হবে বিক্ষোভ করার জন্যে। তারপর আমরা ট্রান্সফার অর্ডারটা ক্যানসেল করব। ও কে?

যাঃ বাবা। কোন্ কথা থেকে কোথায় চলে এলেন মহিলা। স্বপ্নেন্দু করোটি নেড়ে বেরিয়ে এল বাইরে।

দুপুরে খবর পাওয়া গেল ওদের গেট মিটিং-এ একদম লোক হয়নি। নেতারা অনেক অনুরোধ করা সত্ত্বেও কর্মচারীরা নাকি সেখানে উপস্থিত হয়নি। তারা বলছে এখন যেহেতু অফিসে আসা বাধ্যতামূলক তাই আসতে হয়। ট্রান্সফার নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কোনো লাভ নেই।

নেতারা নাকি খুব ভেঙে পড়েছে কর্মচারীদের এই ব্যবহারে। টিফিনের পর নেতারা এল তার ঘরে। স্বপ্নেন্দু ওদের বসতে বলল,

বলুন, কী চাই আপনাদের।

ওটা, করবেন না।

কর্মচারীরা তাই চাইছেন?

এখন তো অনেকেই সরে যাচ্ছে। কিন্তু এটা আমাদের প্রেস্টিজের প্রশ্ন।

মিসেস বক্সীর সঙ্গে কথা বলুন।

না। উনি খুব একরোখা। তাছাড়া আমরা আপনাকে মধ্যস্থতা করতে বলছি।

মেনে নিন। অফিস অর্ডার বলে কথা।

মেনে নিলে আমাদের আন্দোলনের মেরুদণ্ড ভেঙে যাবে।

আপনারা আর কি নিয়ে আন্দোলন করবেন?

চাকরি যখন করছি তখন সমস্যা তো আসবেই। তাছাড়া এখন থেকে আর আটান্ন বছর বয়সে রিটায়ারমেন্ট নেই। অতএব সমস্যা থাকবেই।

রিটায়ারমেন্ট নেই?

না স্যার।

এক মিনিট ভাবল স্বপ্নেন্দু। এই চাকরি চিরকাল করে যেতে হবে? কোনো প্রমোশন নেই? তারপর লোকগুলোর মুখের দিকে তাকাল সে। করোটি দেখে মনের প্রতিক্রিয়া বোঝা যায় না। আর এরা শার্ট পরে আছে বলে মনের প্রতিক্রিয়া ওদের হৃৎপিণ্ডে দেখা যাচ্ছে না। হরিমাধবের শার্টের বোতাম একটাও নেই। তাই ওরটা বুঝতে অনেক সুবিধে।

হঠাৎ হেনা সেনের কথা মনে পড়ল। সে জিজ্ঞাসা করল, শুক্রবার যে মহিলা তর্ক করছিলেন। তিনি কোথায়? তিনি কি এখন আপনাদের সঙ্গে আছেন?

নেতারা মুখ চাওয়াচায়ি করল। শেষ পর্যন্ত একজন বলল, উনি আসেননি আজ।

ও। স্বপ্নেন্দুর মন খারাপ হয়ে গেলেও সে মুখে বলল, ভদ্রমহিলা বিচক্ষণ কথাবার্তা বলেছিলেন। অলরাইট। আপনারা যান, আমি দেখছি কী করা যায়। বুঝতেই পারছেন এসব আমার হাতে নেই।

আমরা জানি স্যার। আপনি মধ্যস্থতা করুন। ততক্ষণ আমরা একটু আধটু আন্দোলন চালাব।

আন্দোলন চালাবেন মানে?

না চালালে ইমেজ নষ্ট হয়ে যাবে।

নেতারা চলে গেলে স্বপ্নেন্দু উঠে দাঁড়াল। যাক প্রব্লেম সলভড। তবে এ কথা এখনই মিসেস বক্সীকে বলা চলবে না। ওঁকেও দুদিন ঝুলিয়ে রাখলে অন্য কাজ নিয়ে টিকটিক করবেন না। শালা, প্রমোশনই যখন কোনোকালে হবে না তখন কাজ দেখিয়ে লাভ কী? টেলিফোনটা শব্দ করতেই বিরক্ত হল স্বপ্নেন্দু। মিসেস বক্সী নির্ঘাৎ। দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আবার ফিরে এলো সে। সে যে বেরিয়ে যাচ্ছে একথা বলে দেওয়া ভালো।

আমি মুখার্জি বলছি।

যাঃ শালা। থার্ড অ্যাসেসমেন্ট অফিসার মুখার্জির ফাইলটা তো মিসেস বক্সীর কাছে আটকে আছে। সে জবাব দিলো, বলুন।

শোনো। তোমাকে শুক্রবারে যে রিকোয়েস্ট করেছিলাম সেটা করতে হবে না। ম্যাডামের অ্যাভালের কোনো দরকার নেই।

কেন?

দিগম্বর হয়ে বসে আছি এখন। আমি আর ইন্টারেস্টেড নই।

টেলিফোন নামিয়ে হেসে ফেলল স্বপ্নেন্দু। বিপ্লবও এতটা কার্যকরী হতো না। মুখ্যমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন। জাঁদরেল ঘুষখোর অফিসার আর ঘুষের জন্যে অনুরোধ করছে না। চমৎকার।

মিসেস বক্সীকে জানাল না স্বপ্নেন্দু। হরিমাধবকে বলে গেল কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবে শরীর খারাপ বলে, তাড়াতাড়ি চলে গেছেন। হরিমাধবের বিস্ময় বাড়ল, স্যার, আপনার শরীর খারাপ?

তৎক্ষণাৎ খেয়াল হলো। শরীর কোথায় যে খারাপ হবে? এই অজুহাতটা চিরকালের মতো বাতিল হয়ে গেল। স্বপ্নেন্দু গম্ভীর গলায় বলল, ঠিক আছে। কেউ খুঁজলে বলে দিও জরুরি কাজে বেরিয়েছি।

এখন দুপুর শেষ হয়নি। রোদের তাপ বড্ড বেশি। কিন্তু ঘাম হচ্ছে না বা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা না থাকায় তেমন কষ্ট হচ্ছে না। বাস থেকে নেমে স্বপ্নেন্দু হেসে ফেলল। কন্ডাকটার চুপচাপ বসে আছে। কোনো যাত্রীকেই টিকিট কাটতে হচ্ছে না। এটা কদ্দিন চলবে কে জানে।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress