প্রদর্শনী উদ্বোধন
প্রদর্শনী উদ্বোধন করতে এলেন লেডি রাণু মুখার্জি।
এত দিন তাকে শুধু ছবিতেই দেখেছি। অসাধারণ রূপসী ছিলেন, এখন প্রচুর বয়স হয়ে গেলেও সেই রূপের আভা যায়নি। একা একা আর চলা-ফেরা করতে পারেন না, সব সময় তার সঙ্গে এক জন সেবিকা থাকে, তবু নাকি তিনি আজও প্রত্যেকটি ছবির প্রদর্শনীতে আসেন। শিল্পের প্রতি এই ভালবাসা তাঁর বর্ণময় জীবনকে একটা আলাদা মর্যাদা দিয়েছে।
শিল্প জগতের এই প্রবাদ-প্রতিমাকে অমি মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলাম দূর থেকে।
সিরাজুল সাহেব এই প্রদর্শনীর শিল্পীদের সঙ্গে লেডি রাণুর আলাপ করিয়ে দিতে লাগলেন।
অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের তিনখানা ঘর জুড়ে চলছে এই প্রদর্শনী। মোট সতেরো জন শিল্পী, সকলেই যে বয়সে নবীন তা নয়। কেউ কেউ এসেছে বারাসত, বনগাঁ, ঝাড়গ্রাম, দুর্গাপুর থেকে। তবে কলকাতার ছেলে-মেয়েদের সংখ্যাই খুব বেশি। সতেরো জনের মধ্যে এক জন শুধু অসুস্থ বলে আসতে পারেনি।
অন্য শিল্পীদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল ফুলমণিকে। আজও পায়ে সেইরবারের চটি, নীল পাড় সাদা শাড়ি, বিশেষত্বের এই যে, আজ তার মাথার চুল ভালভাবে আঁচড়ানো, তাতে একগুচ্ছ সাদা ফুল গোঁজা।
ছোটপাহাড়ি থেকে এনে ফুলমণিকে আর কোথায় তুলব, চন্দনদার কথা মতো নিয়ে গিয়েছিলাম নীপাবউদির কাছে। নীপাবউদি বেশ আগ্রহ করেই ফুলমণিকে স্থান দিয়েছে। আজকাল সব মহিলার মধ্যেই একটু একটু উইমেন্স লিব-এর ছোঁয়া আছে, তাই এক জন নারী হয়ে অন্য একটি নারীকে সাহায্য করতে নীপাবউদির কোনও কার্পণ্য নেই।
মুশকিল হয়েছিল লালুদাকে নিয়ে। এই সবর্ঘটে কাঁঠালি কলাটি যথারীতি সে-বাড়িতে উপস্থিত। ফুলমণি সম্পর্কে নীপাবউদির উৎসাহ দেখে লালুদার উৎসাহ চতুর্গুণ বেড়ে গেল। ফুলমণি দুখানা মাত্র নীল-পাড় শাড়ি ছাড়া আর কিছুই আনেনি শুনে লালুদা লাফিয়ে উঠে বলল, সে কী, অত বড় আর্ট একজিবিশানে যাবে, লেডি রাণু আসবেন, সাজিয়ে-গুছিয়ে পাঠানো দরকার। তাহলে ওর জন্য এক জোড়া বেনারসি কিনে আনি?
নীপাবউদি বলল, বেনারসি? কেন, ও কি বিয়ে করতে যাচ্ছে নাকি?
লালুদা বলল, তাহলে সিল্ক টাঙ্গাইল।
নীপা বউদি বলল, আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে নাকি! ও অত সেজেগুজে যাবে কেন? ওর যা স্বাভাবিক পোশাক, তা পরেই যাবে। তাতেই ওর আত্মসম্মান বাড়বে।
তাহলে এক সেট রুপোর গয়না কিনে আনা যাক। ওরা রুপোর গয়না খুব পরে আমি দেখেছি।
কোনও দরকার নেই। বেশি সাজগোজ করে ও যাবে কেন?
আহা, বুঝছ না নীপা। লোকের চোখে পড়া দরকার, বুঝলে না, আজকাল পাবলিসিটির যুগ।
ছবি ভাল লাগলেই লোকে ওকে চিনবে।
তাহলে অন্তত কয়েকটা ভাল সাবান।
নীপাবউদির ধমক খেয়ে লালুদা শেষ পর্যন্ত নিরস্ত হল বটে, কিন্তু কোনও অছিলাতেই টাকা খরচ করার সুযোগ না পেয়ে মর্মাহত হল খুব।
নীপাবউদি যে ফুলমণির পোশাক নিয়ে কোনও বাড়াবাড়ি করেনি, তাতে আমিও খুশি হয়েছি। এক সাঁওতাল গ্রামের মেয়ে কেন কলকাতার মেয়েদের মতো সাজতে যাবে। ওর নিজের পোশাকই তো ওর অহঙ্কার। ও যেমন, ঠিক তেমনই ওকে মানাবে।
এখন যে ফুলমণি অন্য শিল্পীদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে ওকে একটুও বেমানান লাগছেনা। পোশাকনয়, আসল তো মুখ। নিরক্ষর, গ্রাম্য মেয়ে হলেও ফুলমণি বোকা নয়। শিল্পীসুলভ একটা প্রত্যয়ের ছাপ আছে ওর মুখে। এখানকার অন্য ছবিগুলো দেখে ও নিশ্চয়ই বুঝেছে যে, ও নিজেও অন্যদের চেয়ে কম কিছু নয়।
সতেরো জনের মধ্যে ফুলমণি ছাড়াও আরও পাঁচটি মেয়ে আছে, তারাও কেউ উগ্র সাজগোজ করেনি। সহজ-অনাড়ম্বর পোশাক। ফ্যাশানেবল মহিলারা সচরাচর ভাল শিল্পী হয় না।
সিরাজুল তারিক অন্য শিল্পীদের সঙ্গে লেডি রাণুর পরিচয় করিয়ে দিতে দিতে ফুলমণির কাছে এসে বললেন, এই মেয়েটি, জানেন, কোথাও শেখেনি, একটা রিমোট গ্রামে থাকে, কিন্তু অসাধারণ ছবি এঁকেছে।
লেডি রাণু বললেন, তাই নাকি? তাহলে তো ওর ছবিই আগে দেখতে হয়।
প্রত্যেকেরই চারখানা করে ছবি টাঙানো হয়েছে। ফুলমণির ছবিগুলোর কাছে গিয়ে দেখতে দেখতে লেডি রাণু বলতে লাগলেন, বাঃ বেশ তো। সত্যি ভাল।
তারপর ফুলমণিকে জিজ্ঞেস করলেন, অনেক রকম লাইন দেখছি, তুমি কতগুলো তুলি ব্যবহার করো?
সিরাজুল সাহেব বললেন, ও তো তুলি দিয়ে আঁকেনা।
ফুলমণি তার একটা হাত তুলে পাঞ্জাটা মেলে ধরল।
সিরাজুল সাহেব বললেন, ও শুধু আঙুলের ডগা আর নখ দিয়ে আঁকে। আমি নিজে দেখেছি আঁকতে। ফ্যানটাস্টিক!
লেডি রাণু খুবই অবাক হলেন। আরও অনেক প্রশংসা করে চলে গেলেন অন্য ছবির দিকে।
লোক কম হয়নি। প্রেস, চিত্র সমালোচক, ফটোগ্রাফার, শিল্পীদের আত্মীয়-স্বজন এবং কিছু দর্শক। নীপাবউদিরা আজ আসতে পারেনি, কাল আসবে বলেছে।
ফুলমণির ছবিগুলোর কাছে কিছু দর্শক দেখলেই আমি তাদের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াই, তাদের মন্তব্য শোনার চেষ্টা করি। সবাই যে একবাক্যে প্রশংসা করছে তা নয়। কেউ কেউ শুধু চোখ বুলিয়ে চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ খুঁটিয়ে দেখছে। কেউ বলছে, বাঃ, মন্দ নয়।
দুজন নামকরা সমালোচক সিরাজুল সাহেবের কাছে যেচে প্রশংসা করে গেলেন। আলাপ করলেন ফুলমণির সঙ্গে। ফুলমণি একটা-দুটো প্রশ্নের উত্তরও দিল। ওঁদের মধ্যে এক জন শুধু প্রশংসাই করে গেলেন, আর এক জন রঙের ব্যবহার নিয়ে কয়েকটি পরামর্শ দিলেন ফুলমণিকে। দুজনের ব্যবহারই বেশ আন্তরিক। চন্দনদা সমালোচকদের সম্পর্কে বড় কঠিন মন্তব্য করেছিল। এই তো এঁরা নিজে থেকেই এসেছেন। এখানে মদের ফোয়ারা নেই, খাওয়া-দাওয়ার এলাহি ব্যবস্থা নেই, শুধু চা আর দুটো করে সিঙাড়া।
কিছু কিছু খ্যাতিমান শিল্পীরা আসছেন, কয়েকজনকে চেনা যায়। এরা তরুণদের কাজ সম্পর্কে কৌতূহলী, এক-এক জনকে ঘিরে ছোটখাটো দল হয়ে যাচ্ছে। বিখ্যাত ব্যক্তিদের সদলবলে চলাই রীতি। আমি লক্ষ্য করলাম, এরা প্রায় সকলেই ছবিগুলোর দিকে ওপর ওপর চোখ বুলোলেন শুধু, তারপর ভক্তদের সঙ্গে গল্প করতে লাগলেন। এদের পাকা চোখ, এক ঝলক দেখেই বুঝে নেন। কোনও কোনও তরুণ শিল্পী তার গুরুস্থানীয়কে জোর করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিজের ছবিগুলোর কাছে। এক-এক জন শিল্পী এতই ভদ্র এবং উদার যে, সবাইকে বিলিয়ে যাচ্ছেন প্রশংসা।
সিরাজুল তারিক সাহেব চলে গেলেন একটু আগে।
আমার ওপর নির্দেশ দিয়ে গেছেন, ফুলমণিকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত থেকে যেতে। আটটার সময় বন্ধ হবে। থাকতে আমার খারাপ লাগবে না। এতগুলি শিল্পীর এত রকমের ছবি, এত দিনের নিষ্ঠা, ভাবনা, রঙের পরীক্ষা, সব মিলিয়ে পরিবেশটা একেবারে অন্যরকম। যেন একটা চমৎকার উদ্যান।
কোনও বিখ্যাত শিল্পীকে ফুলমণি তার নিজের ছবির কাছে নিয়ে যাবে, সে-প্রশ্নই ওঠে না। সে দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে। আমিও কারুকে অনুরোধ করতে পারছি না, কেউ যদি হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, আপনার এত উৎসাহ কেন মশাই? ওই মেয়েটা আপনার কে হয়?
আমি দূর থেকে অন্যদের প্রতিক্রিয়া দেখছি। কেউ কেউ ফুলমণির ছবির সামনে থামছে, কেউ থামছে না। তবে একটা ব্যাপার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, এ-পর্যন্ত এক জনও কেউ বলেনি যে, এ আদিবাসী মেয়েটির আঁকা ছবি নিম্নমানের, এই প্রদর্শনীর উপযুক্ত নয়। ফুলমণির ছবি দয়া করে রাখা হয়নি, কিংবা চন্দনদা, সিরাজুল সাহেবের হুজুগে পক্ষপাতিত্ব নয়। অন্য শিল্পীদের সমান যোগ্যতা তার আছে।
আমাদের দেশে প্রদর্শনীর মাঝখানে ছবি কেউ কিনতে চাইলে ‘সোল্ড’ লিখে দেওয়া হয় না, শুধু একটা লাল টিপ দেওয়া হয়। ফুলমণির ছবি কেউ কেনে কিনা সে সম্পর্কে আমার দারুণ কৌতূহল। সিরাজুল সাহেব অবশ্য বলেছিলেন, আমাদের দেশে সাধারণ বাঙালি দর্শকরা তো ছবি কেনে না, তাদের ভরসা নেই। ছবি কেনে গোয়েঙ্কা, ডালমিয়া, বিড়লা, রুশি, মোদিরা। তারা নতুনদের প্রদর্শনীতে চট করে আসে না, তাদের প্রতিনিধিদের ধরে আনতে হবে।
তবে এরই মধ্যে একটিমাত্র ছবিতে লাল টিপ পড়েছে। কৌশিক শূর নামে একজনের আধাবিমূর্ত ছবি। কৌশিক শূরের বয়স বড় জোর সাতাশ, মুখভর্তি দাড়ি, চোখ দুটি স্বপ্নময়।
সাড়ে সাতটার সময় এলেন বিশ্বদেব রায়চৌধুরী, এঁর খ্যাতি ভারতজোড়া। দীর্ঘকায়, সুপুরুষ, সদা হাস্যময়মুখ। তার কোনও এক ভাবশিষ্যের ছবি আছে এখানে, খুব সম্ভবত সেই জন্যই তিনি এসেছেন।
ঘুরতে ঘুরতে তিনি ফুলমণির দিকে তাকিয়ে থমকে গেলেন।
অ্যাকাদেমি অফ ফাইন আর্টসের প্রদর্শনীতে মাথায় ফুল গোঁজা একটি সাঁওতাল মেয়েকে তো আর প্রতি দিন দেখা যায় না। কোনও চাষি, জেলে, মজুর, তাঁতি কোনও দিন এখানে আসেনা। এসব ছবি তাদের জন্য নয়। শিল্প-সাহিত্য গোটা ব্যাপারটা থেকেই আমাদের দেশের শতকরা আশি জন বাদ।
বিশ্বদেব রায়চৌধুরীর বিস্ময় স্বাভাবিক।
কয়েক জন তরুণ শিল্পী ফুলমণিকে ওঁর কাছে নিয়ে গেল। আমি দূর থেকে দেখলাম, উনি ফুলমণির সঙ্গে আগ্রহ নিয়ে দু’চারটে কথা বললেন, ফুলমণির ছবিও দেখলেন।
তারপর তিনি অন্য দিকে মন দিতে আমি ফুলমণিকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ওঁকে চিনতে পেরেছ? বিরাট শিল্পী। উনি কী বললেন তোমাকে?
ফুলমণি সরু করে হেসে, দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল, উনার ভাল লাগে নাই।
কথাটা আমার বিশ্বাস হল না। বিশ্বদেব রায়চৌধুরীর যেধরনের মানুষ, খারাপ লাগলেও তো সেকথা মুখে বলবেন না। তিনি এখন এত উঁচুতে উঠে গেছেন যে কারুকেই আর ছোট করার দরকার হয় না ওঁর।
পাশ থেকে আর একটি মেয়ে বলল, না না, উনি ছবিগুলোকে খারাপ বলেননি। প্রশংসাই করেছেন। শুধু বললেন, যে কাগজে আঁকা হয়েছে, তাতে রঙ বেশি দিন থাকবে না। ভাল কাগজে কিংবা ক্যানভাস ব্যবহার করা উচিত।
আমি ভাবলাম, ভাল কাগজ কিংবা ক্যানভাস কেনার পয়সা ও পাবে কোথায়? সিরাজুল সাহেব ঝোঁকের মাথায় বলেছিলেন, ফুলমণির ছবির প্রত্যেকটির দাম পাঁচ হাজার টাকা। এখানে ছবির মেটেরিয়াল অনুযায়ী দাম ধরা হয়েছে। ফুলমণির একটা ছবির দাম সাতশো, অন্যগুলো একহাজার, দেড় হাজার, দু’হাজার। বিক্রি হয় কি না সেইটাই পরীক্ষা। ধরা যাক সব কটাই বিক্রি হয়ে গেল। তারপর ফুলমণি কী করবে? ওই ক’টা টাকায় ওর কত দিন চলবে? ওর শ্বশুর বেশ কিছু নিয়ে নেবে, পাড়া-প্রতিবেশীরাও ভাগ বসাবে। বড় ভোজ হবে। ফুলমণি কি আবার ইট বওয়ার কাজে ফিরে যাবে?
অন্য আর পাঁচ জন শিল্পীর মতো ফুলমণি শুধু ছবি আঁকার সাধনা করে যাবে, এর কি কোনও উপায় নেই?
চন্দনদার সঙ্গে এবিষয়ে আলোচনা করতে হবে।
সিগারেট টানার জন্য বাইরে এলাম, ফুলমণিও এল আমার সঙ্গে। অ্যাকাডেমির সামনের প্রাঙ্গণে সবসময়েই ভিড় থাকে, এখন অনেকটা ফাঁকা হয়ে গেছে। বিদ্যুতের চমক বৃষ্টির খবর দিল। অনেকগুলো ফুলের গন্ধ আসহে এক সঙ্গে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ফুলমণি, কেমন লাগছে এখানে?
ফুলমণি হাসল। কথা তো বলেই না প্রায়, ওই হাসিটুকুও যথেষ্ট।
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, যদি কিছু ব্যবস্থা করা যায়, তুমি কলকাতায় থেকে যেতে পারবে? এখানে ইচ্ছে মতো ছবি আঁকবে।
আমার চোখের দিকে স্থির ভাবে তাকিয়ে ফুলমণি বলল, কী জানি!
আর কিছু বলার আগেই ভেতরে একটা গোলমাল শুনতে পেলাম। কে যেন রেগেমেগে চিৎকার করছে।
আর্ট একজিবিশানে সবাই মৃদু স্বরে কথা বলে। এখানে চিৎকার অস্বাভাবিক। ছুটে গেলাম হলের মধ্যে।
এখন দর্শক আর নেই বলতে গেলে সবাই প্রায় শিল্পী বা তাদের বন্ধুবান্ধব। বিশ্বদেব রায়চৌধুরী দূরের এক কোণে ছবি দেখছেন, আর ফুলমণির ছবির সামনে এক জন মজবুত, দীর্ঘকায়, ইগল-নাসা পুরুষ, অনিন্দ্য দাস! হাতের বেতেরছড়ি।
ছড়িটা তুলে বললেন, কোথায় চন্দন ঘোষাল কোথায়? ডাক সেই শালাকে। আদিবাসী মেয়ের আঁকা ছবি? কোন কালচার? এথনিক? আমার সঙ্গে ফেরেববাজি। চন্দন ঘোষালকে আমি চিনি না? আমার সঙ্গে স্কুলে পড়ত। ছবি আঁকার খুব শখ ছিল। ছবির হ্রস্বি-দীর্ঘি জ্ঞান নেই, তবু আঁকবে। এই সব এঁকেছে, নিজের নামে ছবি ঝোলাবার মুরোদ নেই, এখন সাঁওতাল মেয়ের নামে চালাচ্ছে!
আমাকে দেখতে পেয়ে গলা চড়িয়ে অনিন্দ্য দাস জিজ্ঞেস করলেন, অ্যাই যে, এই ছেলে ই-দিকে আয়। চন্দন কোথায়?
আমি বললাম, তিনি আসেননি।
পালিয়ে থাকছে! সাহস নেই। ওর কি এত পয়সার খাঁকতি হয়েছে যে ছবির বাজারে ঢুকতে চায়? আদিবাসী আর্ট, শালা। মধুবনী পেইন্টিং এখন বালিগঞ্জে তৈরি হয়, আমি জানি না? কালিঘাটের পটের ভেজাল, আর্ট কলেজের ছাত্ররা এঁকে সাপ্লাই দিচ্ছে! চন্দন আসেনি কেন? তোরা যে বলছিলি… কোথায় সেই মাগিটা কোথায়? মাগিটাকে শো কর, দেখি সে কেমন আঁকে।
আমার মাথায় রাগ চড়ে গেল। অনিন্দ্য দাস যত বড় শিল্পীই হোক না কেন, আমি তার ধমক খেতে যাব কোন দুঃখে?
আমি বললাম, আপনাকে আমি প্রমাণ দিতে যাব কেন? আপনার ইচ্ছে না হয় বিশ্বাস করবেন না! হাতের ছড়িটা আমার কাঁধে ঠেকিয়ে অনিন্দ্য দাস বললেন, আলবাত প্রমাণ দিতে হবে। আর্টের বাজারে জোচ্চুরি আমরা সহ্য করবনা। ফলস নামে ছবি বেচা, আমাদের সকলের বদনাম হবে।
বিশ্বদেব রায়চৌধুরী কাছে এগিয়ে এসে সস্নেহ ভর্ৎসনার সঙ্গে বললেন, কী হল অনিন্দ্য, এত রাগারাগি করছ কেন?
অনিন্দ্য দাস বললেন, আপনি চুপ করুন তো। আপনি কিছু জানেন না, কী সব নখরাবাজি চলছে চারদিকে। আমি মাগিটাকে দেখতে চাই, সে কেমন ছবি আঁকে। এটা কিছু অন্যায় বলিনি।
কথা বলতে বলতে অনিন্দ্য দাস একটুখানি দুলে যেতেই বোঝা গেল, তিনি বেশ খানিকটা মদ্যপান করে এসেছেন। তার মাথায় কোনও যুক্তিবোধ কাজ করছেনা।
বিশ্বদেব রায়চৌধুরী বুঝলেন এখানে আর কথা বলতে গেলে তার মান থাকবে না। তিনি আস্তে আস্তে সরে পড়লেন।
অন্য এক জন কেউ বলল, মেয়েটি তো এখানেই ছিল। বোধহয় বাইরে গেছে।
কোথায়, কোথায়, বলতে বলতে অনিন্দ্য দাস দরজার দিকে এগোলেন। আমাকেও সঙ্গে যেতে হল।
ফুলমণি জলের ফোয়ারাটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি পড়ছে দু’এক ফোঁটা। ফুলমণিকে দেখে হা-হা শব্দে অট্টহাসি দিয়ে উঠলেন অনিন্দ্য দাস।
তারপর বললেন, এই মেয়ে! একে তো রেল লাইনের ধার থেকে ধরে এনেছে। একটা সাঁওতাল মেয়েকে এনে দাঁড় করালেই হল। ও ওর বাপের জন্মে তুলি ধরতে শিখেছে? আমি বাজি ফেলতে পারি।
ফুলমণির কাছে গিয়ে তিনি আবার বললেন, এই মেয়ে, তুই ছবি আঁকতে পারিস? সত্যি করে বল!
ফুলমণি কোনও উত্তর দিল না, ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
ফস করে পকেট থেকে একটা তুলি বার করে অনিন্দ্য দাস বললেন, এটা ধর তো! ছবি এঁকে দেখাতে হবে না, শুধু তুলিটা কেমন ভাবে ধরিস, সেটা দেখব।
আমি বললাম, ও তুলি দিয়ে আঁকে না।
তবে কি ইয়ের ইয়ে দিয়ে আঁকে।
ও শুধু আঙ্গুল দিয়ে আঁকে।
আবার একখানা জোর হাসি দিলেন অনিন্দ্য দাস। আমাকে একটা খোঁচা মেরে বললেন, আঙুল দিয়ে…একি বাবা কপালে ফোঁটা কাটা? তোর কপালে মেয়েটা ফোঁটা দিয়েছে নাকি রে?
ফুলমণির একটা হাত চেপে ধরে তিনি বললেন, দেখি দেখি, আঙুলগুলো দেখি! এ যে সব ঢ্যাঁড়োশ।
ফুলমণি জোর করে হাতটা ছাড়িয়ে নিল।
অনিন্দ্য দাস বললেন, ইঃ, তেজ আছে! ক’পয়সা পেয়েছিস? ফুলমণির গালে এক আঙুলের ঠোনা মেরে বললেন, মুখটা ফেরা তো। হুঁ প্রোফাইলটা ইন্টারেস্টিং।
হঠাৎ আমার মনে হল, আমি একটা সাঁওতাল ছেলে। ঝাড়খণ্ডের সমর্থক। আমার গ্রামের একটি মেয়েকে অপমান করছে কলকাতার এক বাবু। আমার রক্ত গরম হয়ে গেল।
আমি ঝাঁপিয়ে পড়ে অনিন্দ্য দাসের কলার চেপে ধরে বললাম, ছেড়ে দিন ওকে। অসভ্য কোথাকার।
অনিন্দ্য দাস আমাকে মারার জন্য ছড়ি তুললেন।
আর কয়েক জন মাঝখানে এসে পড়ে ঠেলে সরিয়ে দিল দু’জনকে।
কেউ একজন আমাকে টানতে টানতে নিয়ে এল ভেতরে। জোর করে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল। রাগে তখনও আমি হাঁপাচ্ছি। অনিন্দ্য দাসের কয়েকটা দাঁত ভেঙে দেওয়া উচিত ছিল।
যে-ছেলেটি আমাকে টেনে এনেছে, সে বলল, চুপ করে একটু বসুন। অনিন্দ্য দাস লোক খারাপ নন। যখন তখন মাথা গরম করেন। কিন্তু গ্রেট সোল। আপনার সঙ্গে যদি ভাব হয় একবার, দেখবেন আপনার জন্য সর্বস্ব দিয়ে দেবেন।
আমি বললাম, আমার দরকার নেই ভাব করার। যে ও-রকম মুখ খারাপ করে।
ওনার মুখটাই ও-রকম, মনটা পরিষ্কার।
ফুলমণিকে ও যদি আবার কিছু বলে?
না, ফুলমণি বাথরুমে গেছে।
পাশ থেকে আর এক জন বলল, অনিন্দ্যদা চলে গেলেন। কী বলতে বলতে গেলেন জানো, এখানকার সবকটা ছবি বোগাস! সব ফলস।
ওই দু’জন খুব হাসতে লাগল।
একজন বলল, কাল দেখবি অনিন্দ্যদা এসে খুব প্রশংসা করবে। আজ পেটে একটু বেশি পড়েছে। কর্তৃপক্ষ-স্থানীয় এক জন ভদ্রলোক আমার সামনে এসে বললেন, আপনারা এখানে মারামারি শুরু করেছিলেন? ছি ছি ছি। এখানে কোনও দিন ও-সব হয় না।
আমি আহতভাবে বললাম, আপনি শুধু আমাকে বলছেন? আমি কি শুরু করেছি! অনিন্দ্যবাবু যা-তা বলতে শুরু করলেন।
অনিন্দ্যবাবু এক জন নামকরা আর্টিস্ট। তার মুখে মুখে আপনি কথা বলতে গেলেন কেন? আপনি কে?
আমি ছবি আঁকতে পারি না বটে, কিন্তু আমি এক জন ভদ্রলোক।
সিরাজুল সাহেবকে বলব।
যা খুশি বলবেন। আমি চলে যাচ্ছি, আর আসব না।
আটটা বেজে গেছে। বন্ধ করার সময়ও হয়ে গেছে। চলে এলাম বাইরে। ফুলমণি এখনও বাথরুম থেকে ফেরেনি। এতক্ষণ পর্যন্ত এই পরিবেশটা সম্পর্কে যে ভাললাগা ছিল, এক জন লোক এসে তা নষ্ট করে দিল। এখানে চন্দনদার উপস্থিত থাকা উচিত ছিল। অন্তত প্রথম দিনটা। কিন্তু চন্দনদা নিজে সব ব্যবস্থা করে দিলেও সামনে আসতে চাইছে না। নীপাবউদিকে বোঝাতে চায় যে, ফুলমণি সম্পর্কে যাবতীয় উৎসাহ শুধু আমার।
একে একে সবাই বেরিয়ে যাচ্ছে। ফুলমণি এতক্ষণ কী করছে বাথরুমে? সে-দিকে খানিকটা এগিয়ে গেলাম, কিন্তু মেয়েদের বাথরুমের মধ্যে ঢুকে তো দেখা যায় না।
বিদ্যুৎ চমকের সঙ্গে সঙ্গে মাঝে মাঝে গজরাচ্ছে আকাশ।
আসল বৃষ্টি শুরু হয়নি, ঝোড়ো বাতাসের সঙ্গে বড় বড় ফোঁটা এসে গায়ে লাগছে। এই রকম সময়ে বেড়াতে মজা লাগে। ফুলমণি যদি চায়, এক্ষুনি বাড়ি না ফিরে ময়দানে খানিকক্ষণ ঘোরা যেতে পারে। কলকাতার ময়দানের একটা দারুণ রূপ আছে, সেটা দেখলে ওর ভাল লাগবে আশা করি। চৌরঙ্গির এক দিকে আলোকোজ্জ্বল বড় বড় বাড়ি, আর এক দিকে অন্ধকার।
আরও একটা সিগারেট শেষ হয়ে গেল, ফুলমণি তবু আসছে না কেন? এবারে বোধহয় গেট-ফেট বন্ধ করে দেবে। না, পেছন দিকের হলের নাটক এখনও ভাঙেনি। বাথরুমের মধ্যে গিয়ে ফুলমণি অসুস্থ হয়ে পড়ল নাকি?
একটি যুবতী খটখটে জুতোর শব্দ তুলে বেরিয়ে আসছে বাথরুম থেকে। চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে তার সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কিছু মনে করবেন না। বাথরুমে কি আর কেউ আছে? আমার একজন আত্মীয় ঢুকেছিলেন।
মেয়েটি সপ্রতিভ ভাবে বলল, না, আর কাউকে দেখলাম না তো।
তারপর সে নিজেই আর একবার উঁকি দিয়ে এসে বলল, না, কেউ নেই। আমি বললাম, কেউ নেই? তাহলে…তাহলে আমি একবার নিজে দেখে আসতে পারি?
মেয়েটি বলল, হ্যাঁ, যান না। আমি দাঁড়াচ্ছি।
কপালে আমার এত ছিল, মেয়েদের বাথরুম পরিদর্শন করতে হবে। তা-ও কিনা ফাঁকা। মেয়েদের বাথরুমের দেওয়ালে কিছু লেখা থাকে কিনা, সে-বিষয়ে আমার কৌতূহল ছিল যথেষ্ট, কিন্তু এখন সেসব দেখার সময় নয়।
নিঃসন্দেহে বলা যায় ভেতরে কেউ নেই।
যুবতীটি অপেক্ষা করছে, বলল, পেলেন না?
আমি দুদিকে মাথা নাড়লাম।
কী-রকম দেখতে বলুন তো?
নীল-পাড় সাদা শাড়ি পরা, মাথায় ফুল গোঁজা, রোগা, আপনারই বয়সীহবে বোধহয়।
না, সেরকম কারুকে দেখিনি। দেখুন বোধহয় বাইরে অপেক্ষা করছেন।
যুবতীটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি প্রায় দৌড়ে চলে এলাম গেটের বাইরে। সেখানে কেউ নেই। রাস্তার ওপারে নিশ্চয়ই যাবেনা।
ফিরে এসে অ্যাকাডেমির ঘরগুলো খুঁজলাম তন্নতন্ন করে।
যদি ভুল করে থিয়েটার হলের মধ্যে ঢুকে পড়ে, তাই অপেক্ষা করলাম নাটক শেষ হওয়া পর্যন্ত। পৌনে ন’টায় হুড় হুড় করে বেরিয়ে এল বহু নারী-পুরুষ, গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আমি পরীক্ষা করলাম প্রত্যেকটা মুখ। সবাই বেরিয়ে গেলে মঞ্চ এবং গ্রিনরুম দেখতেও বাকি রাখলাম না।
ফুলমণি কোথাও নেই।
আমার বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে। এ কী হল? আমাকে কিছু না বলে কোথায় যাবে ফুলমণি? অনিন্দ্য দাসের বিশ্রী ব্যবহারে রাগ করে সে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে? তাহলেই তো সর্বনাশ! ফুলমণি কলকাতার কিছুই চেনে না। এত গাড়ি-ঘোড়ার রাস্তা কী করে পার হতে হয় জানে না।
সামনের রাস্তার এ-দিক থেকে ও-দিক, ময়দানের খানিকটা অংশে খোঁজাখুঁজি করেও কোনও লাভ হলো না।
তাহলে কি নীপাবউদির বাড়িতে ফিরে গেছে? ঠিকানাও তো জানে না। আসবার সময় ট্যাক্সিতে এসেছি, সেই সব রাস্তা মনে রেখেছে? গ্রামের লোক শহরে এলে দিশেহারা হয়ে যায়, সমস্ত রাস্তাই তাদের এক রকম মনে হয়। তবে যদি ফুলমণির স্মৃতিশক্তি অসাধারণ হয়, বলা তো যায় না।
এ ছাড়া আর তো কিছু করবারও নেই। একটা ট্যাক্সি পেয়েই বললাম, খুব জলদি, সুইন-হো স্ট্রিট। ঠিক তখনই আকাশ ফাটিয়ে বৃষ্টি নামল। চড়চড়াৎ শব্দে বিদ্যুৎ চিরে গেল কলকাতার এ-প্রান্ত থেকেও-প্রান্ত।
নীপাবউদিআর লালুদা টিভিতে সিনেমা দেখছে।
বুকের ধড়ফড়ানি অতি কষ্টে সামলে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ফুলমণি কী করছে? কখন ফিরল?
নীপাবউদি বলল, ফুলমণি! সে একা ফিরবে কী করে? তোমার সঙ্গে আসেনি?
আমি ধপাস করে বসে পড়লাম সোফায়! হাতের তালু ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। পায়ে জোর নেই।
সব শুনে লালুদা চক্ষু গোল গোল করে বলল, কেস সিরিয়াস। মেয়েটা যদি সত্যি সত্যি হারিয়ে যায়, আদিবাসী মেয়ে, আমাদের নামে অ্যাবডাকশান চার্জ আনতে পারে। ওহে নিলাম্বুজ, এটা কী করলে?
আমি কী করব বলুন। ও বাথরুমে গেল, তখনও কি আমি ওর পেছন পেছন যাব?
তা-ও যাওয়া উচিত ছিল।
নীপাবউদি বলল, তুমি হুট করে চলে এলে? ওখানেই আছে নিশ্চয়ই। যাবে কোথায়।
আমি সব জায়গায় দেখেছি। কেউ নেই। এখন আর লোকজনই নেই বলতে গেলে।
হয়তো কোনও গাছটাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে।
মুমু পাশের ঘরে পড়তে বসেছিল। উঠে এসে সব শুনছে। সে-ও বলল, নীলকাকা, তুমি ওকে হারিয়ে ফেললে? এখন কী হবে?
সবাই আমার নামে দোষ দিচ্ছে। আমি যেন চুরির দায়ে ধরা পড়েছি।
লালুদা বলল, এক্ষুনি তো একটা ব্যবস্থা করতে হয়। চলো বেরোই। থানায় একটা ডায়েরি করতে হবে। নীলমণিকে যদি অ্যারেস্ট করে, তার জন্য জামিনের ব্যবস্থা করতে হবে।
নীপাবউদি চমকে উঠে বলল, কেন, নীলুকে অ্যারেস্ট কবে কেন?
মুমু এক গাল হেসে বলল, বেশ হবে! নীলকাকাকে জেলে ভরে রাখলে খুব মজা হবে। আমরা দেখতে যাব।
রাত হয়ে গেছে, তাই মুমুর বায়না সত্ত্বেও তাকে সঙ্গে নেওয়া হল না, কাল তার স্কুল আছে। লালুদার সঙ্গে নীপাবউদি আর আমি বেরিয়ে পড়লাম। বৃষ্টি হঠাৎ থেমে গেছে।
একটা গাড়ি থাকলে কত সুবিধে। নীপাবউদির কথায় থানায় না গিয়ে আমরা আগে গেলাম অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের কাছে।
সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল, ভিকটোরিয়া মেমোরিয়াল, রেড রোড, রেস কোর্স এই সব চক্কর দিয়ে প্রায় পুরো ময়দানটাই ঘুরে দেখা হল। ফুচকা, আলুকাবলির দোকানগুলোও উঠে গেছে, দু’একটা থেমে থাকা গাড়িতে রয়েছে কয়েক জোড়া দুঃসাহসী প্রেমিক-প্রেমিকা, কিছু গোপন মদ্যপায়ী ও কিছু পুলিশ ছাড়া আর কেউ নেই।
লালুদা বলল, মেট্রো রেলের কাজের জন্য অনেক আদিবাসী ওয়ার্কার আনিয়েছে। তারা ময়দানের মধ্যে এক জায়গায় ঝুপড়ি বেঁধে আছে। আমার মনে হয়, মেয়েটা সেখানে চলে গেছে। হয়তো কোনও দেশোয়ালির সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে।
নীপাবউদি বলল, সেখানে আমরা যাব কী করে?
লালুদা বলল, দেখোই না!
সত্যি, লালুদা অসাধ্য সাধন করতে পারে।
টাটা সেন্টারের কাছাকাছি উলটো দিকে গাড়িটা থামাল লালুদা। এখানে মেট্রোরেলের অনেকগুলো গুদাম ঘর, শেড আছে। মাঝখান দিয়ে একটা সরু পথ, অন্ধকার। লালুদার গাড়িতে টর্চও থাকে, লোডশেডিংয়ের সময়ের জন্য। নীপাবউদিকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে লালুদা শুধু আমাকে নিয়ে ভেতরে যেতে চাইল, নীপাবউদি রাজি হল না। এত রাতে নীপাবউদির পক্ষে একা গাড়িতে বসে থাকা বিপজ্জনক।
ভেতরে ঢুকে দেখা গেল, এক জায়গায় রয়েছে অনেকগুলো বুড়ি। কলকাতার একেবারে বুকের ওপর একটা আদিবাসী গ্রাম। একজন গার্ড প্রথমে আমাদের বাধা দিয়েছিল, লালুদা তার হাতে একটা কুড়ি টাকার নোট গুঁজে দিতে সেই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল আমাদের।
কিছু লোক এক জায়গায় গোল হয়ে বসে আছে, মাঝখানে জ্বলছে একটা হ্যাজাক। সেখানে হাত ধরাধরি করে নাচছে দুটি মেয়ে। অন্যরাহাততালি দিচ্ছে। তাদের পাশে পাশে দিশি মদের বোতল।
প্রথমে আমার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল। যে-দু’জন নাচছে, তাদের মধ্যে একজন ফুলমণি নয়? সেই রকম নীলপাড় শাড়ি, মাথায় ফুল গোঁজা।
ফুলমণি যদি আমাকে কিছু না বলে চলে এসে এখানে এসে নাচত, তাহলে আমি তাকে কোনও দিন ক্ষমা করতে পারতাম না। না, এ দুটি মেয়ের এক জনও ফুলমণি নয়।
আমাদের দেখে নাচ থেমে গেল। ওরা মনে করল, আমরা পুলিশ। ওরা যদিও বে-আইনি কিছু করছেনা, মদটা ওদের খাদ্যের মধ্যে পড়ে, আর নিজেরাই নাচ-গানে মেতে আছে। তবু বিনা কারণেও পুলিশের ঝামেলা করতে তো বাধা নেই।
ওদের সব বুঝিয়ে বলা হল। ছোটপাহাড়ি থেকে কেউ এসেছে? ফুলমণি নামে কোনও মেয়েকে চেনে?
এরা এসেছে বীরভূম থেকে। ছোটপাহাড়ি কোথায় তা এরা জানে না। এখানে ফুলমণি নামে কেউ নেই।
লালুদা অদম্য। গাড়িতে ফিরে এসে বলল, আমার মাথায় আর একটা আইডিয়া এসেছে। কী বলো তো?
লালুদার মাথার আইডিয়া আন্দাজ করার মতো প্রতিভা আমার নেই।
লালুদা বলল, কলকাতায় অনেক মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে। রাইট? সেখানে অনেক মিস্তিরি-মজুর কাজকরে, রাইট? মেয়েরা মাথায় করে ইট বয়ে নিয়ে যায়? সেরকম কোনও বাড়িতে মজুরনিদের কাজ করতে দেখে ফুলমণির দেশের কথা মনে পড়ে গেছে। ফুলমণি অমনি তাদের কাছে ছুটে গেছে। কী যেতে পারে না। তুমি কী বলল, নীলধ্বজ?
নীলধ্বজনামে কোনও ব্যক্তি নিশ্চয়ই এ বিষয়ে কিছু মতামত দিতে পারত, কিন্তু আমার মাথাটা একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। কিছুই ভাবতে পারছি না।
লালুদা বলল, লেটস গো।
চৌরঙ্গির ওপরেই তৈরি হচ্ছে একটা এগারতলা বাড়ি। গাড়ি চলে এল সেখানে। চার জন গার্ড মালপত্র পাহারা দিচ্ছে, কোনও মিস্তিরি-মজুররাত্তিরে দেখানে থাকেনা।
এরপর থিয়েটার রোড।
এখানে যে বাড়িটা তৈরি হচ্ছে তার কন্ট্রাক্টর লালুদার চেনা।
দারোয়ানরা বসে বসে রুটি পাকাচ্ছে, লালুদা তাদের ঘরে উঁকি মেরে জিজ্ঞেস করল, সুখেন্দুবাবু হ্যায়?
পাগল না হলে সুখেন্দুবাবু নামক কন্ট্রাক্টরের এত রাতে এখানে থাকার কথা নয়। কিন্তু ওইনামটা বলে দারোয়ানদের কাছে নিজের দর বাড়িয়ে নিল লালুদা। তারপর আসল কথাটা পাড়ল।
দারোয়ানদের মধ্যে একজন বেশ রসিক। সে জানাল যে, ফুলমণি নামে কেউ নেই। আজ নতুন কোনও মেয়ে আসেনি। তবে, চারটি মুসলমান কামিন এখানে থাকে, তাদের কারুকে লাগবে?
নীপাবউদি বিরক্ত হয়ে বলল, দুর, এ-ভাবে খোঁজা যায় নাকি? এটা পাগলামি হচ্ছে।
লালুদা বলল, তবে তো থানায় যেতেই হয়, হাসপাতালগুলোতেও খোঁজ নিতে হবে। যাওয়া হল ওয়াটগঞ্জ থানায়। ময়দান অঞ্চল ওই থানার এক্তিয়ারে।
এখানে নীপাবউদি গাড়িতেই বসে রইল। লালুদা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে আমাকে বলল, কথাবার্তা যা বলার আমি বলব, বুঝলে নীলরতন। তুমি চুপ করে থাকবে। নইলে তোমাকে যদি ফস করে অ্যারেস্ট করে ফেলে। অবশ্য অ্যারেস্ট করলেও তোমাকে ছাড়াবার ক্ষমতা আমার আছে।
দারোগাবাবু পাতলা কাগজে তামাকভরে সিগারেট বানাচ্ছেন। লালুদা দরজার কাছ থেকেই সাড়ম্বরে বলল, নমস্কার। কী খবর, ভাল?
দারোগা প্রতিনমস্কার না দিয়ে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার?
টেবিলের ওপর হাত দিয়ে ঝুঁকে লালুদা বলল, একটি আদিবাসী মেয়ে, বুঝলেন, ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়েস হবে, সন্ধে থেকে হারিয়ে গেছে।
দারোগা ভুরু নাচিয়ে বলল, হারিয়ে গেছে, না পালিয়ে গেছে? কোথায় মাইফেল বসেছিল?
মাইফেল মানে? ও, না না, সেসব কিছুনা। ফুলমণিকে পাওয়া যাচ্ছে না।
ফুলমণি নামে আদিবাসী মেয়ে? কোনও আদিবাসী মেয়ে কক্ষনও হারায় না। সেরকম কোনও রেকর্ড নেই আজ অবধি।
হ্যাঁ, হারিয়েছে। ফ্যাক্ট। ডায়েরি লিখুন।
মার্ডার-ফার্ডারক রে আসেননি তো? রাত সাড়ে এগারোটায় হঠাৎ একটা আদিবাসী মেয়ে সম্পর্কে এত দরদ?
না না, সে ছবি আঁকে।
ছবি আঁকে! ও-ও-ও-ও। ছবি আঁকলে আর মার্ডার করা যায় না?
আপনি আমার কথা সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না।
আপনার কথা কিছু বুঝতেই পারছি না মশাই।
জয়েন্ট পুলিশ কমিশনার আমার বন্ধু! আমার ফার্স্ট ফ্রেন্ড!
সেকথা আগে বলেননি কেন? জয়েন্ট সিপিকিংবা সি পি কিংবা কোনও আই জি যদি আপনার বন্ধু হয় তাহলে আপনি মার্ডার-ফার্ডার যা খুশি করতে পারেন। সে-সব বুঝবে লালবাজার। এখানে কেন?
আই ইনসিস্ট!
আপনি সরুন না মশাই। ওই ছেলেটিকে বসতে দিন।
দারোগা আমার দিকে ভুরুর ইঙ্গিত করে বলল, কী হয়েছে বলো তো ভাই! ঠিক দু’লাইনে বলবে, বেশি সময় নষ্ট করবে না।
আমি মুখস্থ কবিতার ভঙ্গিতে বললাম, ছোটপাহাড়ি থেকে একটি সাঁওতাল মেয়েকে নিয়ে আসা হয়েছিল, সে ভাল ছবি আঁকে। আজ তার ছবির প্রদর্শনী ছিল অ্যাকাডেমিতে। সন্ধের পর থেকে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার পরনে…।
ব্যাস, ব্যাস, দুলাইন হয়ে গেছে। মেয়েটার ছবি কোথায়?
ওর ছবি তো অ্যাকাডেমিতে টাঙানো হয়েছে।
ওই ছবির কথা বলছিনা। ফটোগ্রাফ। মেয়েটির ফটোগ্রাফ।
তা তো তোলা হয়নি।
কেন হয়নি?
লালুদা বাধা দিয়ে বলল, সেকি আমাদের আত্মীয় যে তার ছবি তুলে রাখব?
দারোগা লালুদাকে ধমক দিয়ে বলল, আত্মীয় যদি না হয়, তাহলে সে হারিয়ে গেছে বলে আপনার এত মাথাব্যথা কেন?
তারপর দারোগা আমাকে বলল, চিন্তার কিছু নেই। বাড়ি যান। সে নিশ্চয়ই নিজের দেশে ফিরে গেছে। কলকাতা শহরের মতো একটা জঘন্য জায়গা তার ভাল লাগবে কেন? আমারই ভাল লাগে না। চান তো ডায়েরি লিখে নিচ্ছি। কোনও দরকার নেই যদিও।
থানা থেকে বেরিয়ে এসে লালুদা বলল, ও ব্যাটারা খুঁজবে না। পলিটিক্যাল লিডার ছাড়া আর কারুর কথা শোনেই না! লালবাজারে গিয়ে প্রেশার দিতে হবে!
বৃষ্টি থেমে গেলেও আকাশ এখন থমথমে, চমক দিচ্ছে বিদ্যুৎ। সিনেমার নাইট শো ভেঙেছে, তাই রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বেড়ে গেল হঠাৎ। দোতলা বাস ভর্তি মানুষ! সন্ধে থেকে কিছু খাইনি। খিদের কথা এতক্ষণ মনেও পড়েনি। এখন গরুর গাড়ির চাকার মতো ঘর্ঘর শব্দে জেগে উঠল খিদে।
লালুদা বলল, কলকাতা শহরে এত গাড়ি-ঘোড়া, ট্রাম-বাস, তার মধ্যে গ্রামের একটা অবলা মেয়ে…একটা বনের হরিণীকে এনে যদি কলকাতার জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে কী অবস্থা হবে বল তো!
আমি থ। এত রাত্রে আচমকা কবিত্বশক্তি জেগে উঠলো লালুদার। ফুলমণি..বনের হরিণী।
.
০৮.
পরদিন সকাল এগারোটার মধ্যেও কোনও খবর পাওয়া গেল না। হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নেওয়া হয়েছে, এমনকী এক পুলিশ বন্ধুকে ধরে মর্গেও ঘুরে এসেছে লালুদা। ফুলমণি যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে।
সিরাজুল সাহেবের বাড়িতে যাওয়া হল।
অনিন্দ্য দাসের সঙ্গে আমার ঝগড়ার ঘটনাটা এর মধ্যেই তার কানে এসেছে। দু’জন তরুণ শিল্পী বসে আছে তার ঘরে। আমার কাছে সব বিবরণ শুনে তার মুখে দুঃখের ছায়া পড়ল, কিন্তু কোনও মন্তব্য করলেন না।
একটু পরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে। কেন ওকে নিয়ে এলাম ওর গ্রাম থেকে। ওখানেই বেশ ছিল। শহরে কত খারাপ লোক আছে।
এক জন শিল্পী বলল, শুনেছি কিছু লোক কলকাতা থেকে মেয়ে ধরে ধরে বম্বেতে বিক্রি করে দিয়ে আসে। আরব দেশগুলোতে অনেক মেয়ে চালান হয়।
সিরাজুল সাহেব বললেন, ওর কাছে কি টাকা-পয়সা কিছু ছিল? এমন কি হতে পারে যে, আমাদের শিল্পীবন্ধুটির কথাবার্তায় ও অপমানিত বোধ করেছে তাই তক্ষুনি হাওড়ায় গিয়ে ট্রেনে চেপে তাতে ছোটপাহাড়িতে ফিরে গেছে?
ফুলমণিকে আমি একশো টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু ও কি নিজে নিজে হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে?
সিরাজুল সাহেব বললেন, রাস্তার লোককে জিজ্ঞেস করে করে হাওড়া পৌঁছে যাওয়া খুবই সম্ভব। ফুলমণি কথা কম বলে বটে, কিন্তু বোকা তো সে নয়। বোকা মানুষেরা শিল্পী হতে পারে না।
এক জন শিল্পী বলল, যাই বলুন স্যার, আঙুল দিয়ে ছবি আঁকাটা ঠিক প্রপার আর্ট ফর্মনয়। ওকে তুলি ধরতে শেখাতে হবে।
সিরাজুল সাহেব বললেন, ওসব কথা এখন থাক। আগে মেয়েটির নিরাপত্তা…আচ্ছা, ছোটপাহাড়িতে টেলিফোন করে জানা যায় না?
আমি বললাম, ওখানে এখনও টেলিফোন যায়নি। আমি ভাবছি, আজই আমি একবার চলে যাব।
সিরাজুল সাহেব বললেন, কাল আমার একটা খুব জরুরি মিটিং আছে বটে। তবু আমি আপনার সঙ্গে যেতে পারি। থাক কাজ। হ্যাঁ, চলুন আমি যাব।
এক জন শিল্পী বলল, সে কী স্যার? আজ বিকেলে আপনার…।
সিরাজুল সাহেব বললেন, তাতে কী হয়েছে। তোমরা ম্যানেজ করবে। আমি যাব, কটায় ট্রেন আছে নীলুবাবু?
তরুণ শিল্পীটি বলল, আজ সিরাজুল সাহেবের জন্মদিন। সন্ধেবেলা একটা অনুষ্ঠান আছে, অনেকে আসবে এ-বাড়িতে।
সিরাজুল সাহেব তবু কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তাঁকে বাধা দিয়ে আমি বললাম, আপনার যাওয়ার কী দরকার? আমি গিয়ে খবর নিয়ে আসছি। ফুলমণিকে ওখানে পাওয়া গেলে আপনাকে জানাব, আমি ফিরেই দেখা করব।
অন্য শিল্পীটি বলল, সব দোষ অনিন্দ্য দাসের। উনি যা খুশি করবেন। কিন্তু ওর মুখের ওপর কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না।
সিরাজুল সাহেব মিনতির সুরে বললেন, আমার বাড়িতে ও-সব কথা আলোচনা কোরো না, প্লিজ।
অর্থাৎ সিরাজুল সাহেব নিজে তো নিন্দে করবেনই না, অন্য কারুর মুখে নিন্দে শুনতেও চান না।
এত কাণ্ডের মধ্যেও আমার এই একটি পরম লাভ হল, সিরাজুল সাহেবের সঙ্গে পরিচয় হল।
বড় মাপের মানুষ না হলে কি বড় শিল্পী হওয়া যায়? এই প্রশ্নটা অনেক দিন ধরে আমার মাথায় ঘুরছিল।
দরজা পর্যন্ত আমাকে পৌঁছে দিতে এসে সিরাজুল সাহেব মৃদু গলায় বললেন, আপনি একলা একলা যাবেন, যদি আপনার কিছু রাহাখরচ…।
আমি বললাম, আমি তো ওখানে চাকরি করি। আমাকে তো এমনিই যেতে হত। চন্দনদাকে খবরটা জানানো দরকার।
সিরাজুল সাহেব বললেন, তাড়াতাড়ি ঘুরে আসুন। ভাল খবর নিয়ে আসুন। উনি আমার হাত ধরলেন।
আমি বললাম, দোয়া করবেন।
এখানকার খবরাখবরের ভার রইল লালুদার ওপর। লালুদা বলল, কোনও চিন্তা কোরো না। ফুলমণির খোঁজ পেলেই আমি তোমাকে কুরিয়ার সার্ভিসে জানিয়ে দেব। এমনকী নিজেও চলে যেতে পারি।
নীপাবউদি বলল, নীলু, তুমি তোমার চন্দনদাকে বিশেষ ব্যস্ত হতে বারণ করো। ফুলমণি যদি ছোটপাহাড়িতে না গিয়ে থাকে, এখানে তার সন্ধান পাওয়া যাবেই। মেয়েটা তো আর উধাও হয়ে যেতে পারে না।
লালুদা বলল, নানা, চন্দনের এখন কলকাতায় আসার দরকার নেই। সে কত কাজে ব্যস্ত। আমরা এদিকটা ঠিক ম্যানেজ করে নেব। সন্ধেবেলা অ্যাকাডেমিতে আর্ট একজিবিশনেও আমি বসে থাকব।
যে-যার তালে আছে। চন্দনদা কলকাতায় না থাকলে লালুদার পক্ষে এ-বাড়িতে আড্ডা জমানোর বেশি সুবিধে হয়।
হাওড়ার বাসে চাপবার সময় আমার মনে হল, অনিন্দ্য দাশের বাড়ি দমদম। উনি বিয়ে-টিয়ে করেননি। একা থাকেন। ছোটপাহাড়ি যাবার আগে ওঁর নাকে একটা ঘুষি মেরে যাওয়া উচিত নয় কি? যতনষ্টের গোড়া!
কিন্তু দমদম একেবারে উলটো দিকে। সেখান থেকে ঘুরে হাওড়ায় যেতে হলে আর ছোটপাহাড়ির ট্রেন পাবনা। সেই জন্যই অনিন্দদাস আমার হাতের ঘুঁষি থেকে বেঁচে গেলেন। কিংবা আমি ওর লাঠির আঘাত থেকে বেঁচে গেলাম বোধহয়।
হাওড়া স্টেশনে শান্তনু চৌধুরীর সঙ্গে দেখা। উনি ললিতকলা অ্যাকাডেমির কোনও মিটিঙে যোগ দিতে মাদ্রাজ যাচ্ছেন। চন্দনদার পেছনে এক তল্পিবাহক হিসেবে উনি আমাকে একবার মাত্র দেখেছেন, আমাকে ওঁর চেনার কথা নয়। তবু উনি চিনতে পারলেন। ট্রেনটা এখনও আসেনি, আমরা অপেক্ষা করছি, উনি হাতছানি দিয়ে আমাকে ডাকলেন কাছে।
ছাই রঙের স্যুট ও টাই পরা, নিখুঁত লোশাক। মসৃণ মুখ। পাট করা চুল। উচ্চ-মধ্যবিত্তের পরিচয় ওঁর সর্ব অঙ্গে লেখা, কেউ আর্টিস্ট হিসেবে ভুল করবে না। অথচ ভাল ছবি আঁকেন।
শান্তনু চৌধুরী খানিকটা ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে বললেন, শুনুন, সে-দিন আপনার নামটা জিজ্ঞেস করা হয়নি। আপনি চন্দনের ভাই, তাইনা?
কথা না বাড়িয়ে আমি মাথা নেড়ে দিলাম।
শান্তনু চৌধুরী বললেন, অনিন্দ্য নাকি এক কাণ্ড করেছে? আপনাকে আর ওই মেয়েটিকে নিয়ে…ঠিক কী হয়েছিল বলুন তো?
মানুষের চরিত্রে যতগুলো খারাপ দিক থাকে, তার মধ্যে সব চেয়ে নিকৃষ্ট হল অসাক্ষাতে কোনও বন্ধুর নিন্দে উপভোগ করা। শান্তনু চৌধুরীকে সবাই অনিন্দ্য দাসের খুব বন্ধু বলে জানে।
এ ব্যাপারটাতে আমি প্রশ্রয় দেব কেন? আমি উলটে বললাম, আপনি কী শুনেছেন?
শান্তনু চৌধুরী এক ঝলক হেসে বললেন, অনিন্দ্য নাকি ওই সাঁওতাল মেয়েটার কাপড় ধরে টেনেছে সবার সামনে?
এবার বোঝা গেল যে, শান্তনু চৌধুরী নিখুঁত ভদ্রতার প্রতিমূর্তি হলেও ওঁর ঝোঁক আদিরসের দিকে।
মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন।
শান্তনু চৌধুরী বললেন, আর একবার কী হয়েছিল জানেন? একটা পার্টিতে অনিন্দ্য এমন বেসামাল হয়ে গেল, ক্যালকাটা ক্লাবের মেম্বার মিস্টার নানপুরিয়ার বউকে, সে-মেয়েটি একবার মিস ইন্ডিয়া হয়েছিল, সবার সামনে অনিন্দ্য তাকে বলল, তোমার ওই ইয়ে দুটো, বুঝলেন না। ইয়ে, ওই দুটো কি ফলস? লজ্জায় আমরা মুখ তুলতে পারি না। তারপর থেকে মিসেস নানপুরিয়ার দিকে তাকালেই আমরা ওঁর ইয়ে দুটোর দিকে, ফলস আসল।
ট্রেন ঢুকতেই একটা শোরগোল পড়ে গেল।
শান্তনু চৌধুরী এ. সি ফার্স্ট ক্লাসে যাবেন, তাকে আর দেখা গেল না।
আমার শরীর-মন কেমন যেন অসাড় হয়ে গেছে, ট্রেন চলতে শুরু করার পরেই আমি ঘুমে ঢুলতে লাগলাম।
এই দুরপাল্লার ট্রেনটা বালুঘাই স্টেশনে একমিনিটের জন্য থামে। কেন অত ছোট স্টেশনে থামে তা কে জানে! আমার পক্ষে সুবিধেজনক।
একটাই মুশকিল, রেলস্টেশন থেকে ছোটপাহাড়ি যেতে বাস ছাড়া উপায় নেই। রাত আটটায় শেষ বাস ছেড়ে যায়। এই ট্রেনটা লেট করলেই চিত্তির!
ঠিক লেট হল দেড় ঘণ্টা।
আজকাল যেহেতু ছোটপাহাড়িতে নানা রকম কনস্ট্রাকশন চলছে, তাই মালপত্র নিয়ে অনেক ট্রাক যায়। ট্রাকগুলোর দিন-রাত্রি জ্ঞান নেই। চন্দনদা প্রথম দিনই আমাকে বলে দিয়েছিল, যদি কোনও দিন বালুঘাই স্টেশনে পৌঁছে বাস মিস্ করিস, তাহলে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে হাত দেখাবি, কোনও না কোনও ট্রাক তোকে পৌঁছে দেবে।
এত ছোট স্টেশনে দশ-পনের জনের বেশি যাত্রী ওঠানামা করেনা।
অনেক আগেই আমার ঘুম ভেঙে গেছে, তবু ঘুম ঘুম চোখে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে স্টেশনের বাইরে এসে আমি বড় রাস্তার দিকে এগোতে যাচ্ছি, এমন সময় কে যেন ডাকল, মি. নীললোহিত!
দৈববাণী নাকি? কিন্তু ঠাকুরদেবতারা কি আমাকে মিস্টার বলবে? কে জানে, আজকাল হয়তো ঠাকুরদেবতারা খুব হিন্দি ফিল্ম দেখে।
প্রায় যেন মাটি খুঁড়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন মহিম সরকার। আমার হাত ধরে বললেন, আরে মশাই, আপনাকে ডাকছি, শুনতে পাচ্ছেন না? চলুন, আমার জিপ আছে। ওই যে ডান দিকে।
আমি বললাম, আপনি এখানে কেন?
আসলে আমার মাথা থেকে ঘুম কাটেনি। মহিম সরকারকে দেখে তো আমার খুশি হবারই কথা।
উনি ওঁর কোনও আত্মীয়কে ট্রেনে তুলে দিতে এসেছেন। বেশ সহজে আমি লিফট পেয়ে গেলাম। তবু যেন আমার মনে হচ্ছে, হাইওয়েতে গিয়ে আমাকে হাত দেখিয়ে কোনও ট্রাক থামাতে হবে।
আমাকে টেনে তুলে মহিম সরকার ড্রাইভারের পাশের সিটে বসিয়ে দিলেন। জিপ চালাচ্ছেন উনি নিজে।
গাড়ি স্টার্ট দেবার পর মহিম সরকার জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কী খবর বলুন। কলকাতায় সব ঠিকঠাক হল?
আমি বললাম, হ্যাঁ, খবর খুব ভাল, খুব ভাল। যে-জন্য গিয়েছিলাম, অত্যন্ত সাকসেসফুল। ছোটপাহাড়ির খবর কী?
ছোটপাহাড়ির খবর ঠিকইআছে। আপনার ওখানকার তেতলায় কনস্ট্রাকশন অনেকটা হয়ে গেছে। মি. নীললোহিত, ছাদ ঢালাইয়ের সময় কিন্তু আপনাকে উপস্থিত থাকতে হবে। জানেন তো, ঢালাই একবার থেমে গেলে কত ক্ষতি হয়?
থাকব। নিশ্চয়ই থাকব।
ফুলমণি আবার কাজ করবে?
ফুলমণি?
আপনি এত চমকে যাচ্ছেন কেন? ফুলমণি, যে ভাল ছবি আঁকে। সে ফিরেছে নিশ্চয়ই? তাকে তো আপনি সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন কলকাতায়।
হ্যাঁ, কিন্তু সে কি একলা ফিরতে পারে না?
তা তো আমি জানি না। কিন্তু নীললোহিত, আমি যত দূর জানি, সে ফেরেনি। সবাই জানে, আপনি তাকে কলকাতায় নিয়ে গেছেন। আপনিও আর ফিরবেন না, সে-ও ফিরবেনা।
আরে মোলো যা! আমার ফেরার সঙ্গে তার কী সম্পর্ক? ফুলমণি আমার কে?
হঠাৎ যেন একটা ঝাঁকুনি খেয়ে আমি সজাগ হলাম। এ-সব আমি কী বলছি? লালুদা আর নীপাবউদি পই পই করে বলে দিয়েছিল, ফুলমণির হারিয়ে যাবার খবরটা যেন চন্দনদার আগে অন্য কারুকে জানানোনা হয়। ঘুমের ঘোরে আমার গুলিয়ে গেছে সবকিছু।
মহিমবাবু আমার দিকে ত্যারছা চোখে তাকিয়ে আছেন।
কথা ঘোরাবার জন্য আমি বললাম, আমাকে মিস্টার মিস্টার বলেন কেন মহিমবাবু? আমি ক্লাস খ্রি স্টাফ, আপনার মতো তো অফিসার নই। আপনার থেকে আমি বয়সেও অনেক ছোট। আমাকে শুধুমাম ধরে ডাকবেন।
ও একথাটা প্রথম দিন বললেই পারতেন। আমি ভেবেছিলাম বড় সাহেবের ভাই।
সিগারেট খাবেন? এখানে বৃষ্টি হয়নি? কাল কলকাতায় কী তুমুল বৃষ্টি।
ফুলমণিকে কোথায় রেখে এলেন?
এ যে ভবী ভোলবার নয়। ঘুরেফিরে আবার সেই ফুলমণির কথা। কেন যে মহিমবাবুর জিপে উঠলাম।
ও তো কলকাতাতেই রয়ে গেছে। ওর একজিবিশান যত দিন চলবে…ওর ছবির খুব নাম হয়েছে, বুঝলেন।
তবে কেন জিজ্ঞেস করলেন ফুলমণি ফিরেছে কিনা?
ওটা এমনিই আপনার সঙ্গে ঠাট্টা করছিলাম।
হুঁ!
আমি বুঝব কী করে মহিমবাবু এর মধ্যে তার শালা কিংবা ভাইপোর চাকরি মনে মনে পাকা করে ফেলেছেন। বাকি রাস্তা তিনি আমার সঙ্গে কোনও কথা বললেন না। আমি গল্প জমাবার চেষ্টা করলেও হুঁ-হাঁ করে সারলেন।
জঙ্গলটা পেরিয়ে ছোটপাহাড়িতে পৌঁছে বাজারের কাছটায় এসে মহিমবাবু বললেন, একটা মুশকিল হয়েছে, আমার জিপে ডিজেল খুব কম, আপনার গেস্ট হাউসে পৌঁছোতে গেলে…আমার গাড়ি সম্পূর্ণ উলটো দিকে…যদি ডিজেল একেবারে ফুরিয়ে যায়? আপনি এইটুকু হেঁটে যেতে পারবেন?
লোকটা মহা কিপ্যুস তো। দেড় ঘণ্টা জিপ চালিয়ে এল, আর দশ মিনিট চালালেই ডিজেল ফুরিয়ে যাবে? আসলে আমাকে অবজ্ঞা দেখাতে চায়।
তবু ওঁকে খাতির করে বললাম, না না, আমার বাড়ি বাঁ-দিকে, আপনি এখান থেকে ঘুরে চলে যান। আমি এইটুকু রাস্তা সচ্ছন্দে হেঁটে যেতে পারব। মালপত্র কিছু নেই, আপনি যে এতটা পৌঁছে দিলেন, তাতেই কত উপকার হল। ট্রাক ধরে এলে পয়সা লাগত!
গাড়ি থেকে নেমে বললাম, আচ্ছা। কাল দেখা হবে।
মহিমবাবু বললেন, নিশ্চয়ই!
ছোট্ট বাজার, অনেক আগেই আলো টালো নিবিয়ে সব ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেছে। বাজারের পেছনে একটা নতুন কুলি বস্তি, ক্ষীণ গান-বাজনার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে সেখানে।
আমার রাস্তা ডান দিকে, সম্পূর্ণ অন্ধকার।
এ-রকম অন্ধকার, এ-রকম নিস্তব্ধতা কলকাতায় দেখা যায় না। গাড়ি-টাড়ি তো দূরের কথা, একটাও মানুষ নেই পথে। দু’পাশে এখনও প্রচুর ফাঁকা মাঠ, দূরে দূরে বাড়ি, সে-সব বাড়ির লোকেরা ঘুমিয়ে পড়ে নটা-সাড়ে ন’টার মধ্যে। টিভি নেই তো, ভদ্রলোকেরা জেগে থাকবে কী করে?
গেস্ট হাউসে নয়, আগে যেতে হবে চন্দনদার বাড়িতে।
চন্দনদা কোনও কোনও দিন দেড়টা-দুটো পর্যন্ত জেগে পড়াশুনো করে, আবার কখনও ঘুমিয়ে পড়ে রাত দশটার মধ্যে। কোনও ঠিক নেই। আজ ঘুমিয়ে পড়লেও জাগাতেই হবে। ফুলমণির দায়িত্বটা আমি এবার চন্দনদার ওপর দিয়ে দিতে চাই, আমি আর পারছি না।
কাছেই পাহাড় ও জঙ্গল আছে বটে কিন্তু নির্জন রাস্তায় হঠাৎ হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের ভয় নেই। তবে সাপ বেরোয় প্রায়ই। বিশেষত বৃষ্টির দিনে। সাপ তাড়াবার শ্রেষ্ঠ উপায় মাটিতে জোরে জোরে শব্দ করা। আমি চটি দিয়ে ধপাস ধপাস করে এগোতে লাগলাম।
নিজের পায়ের আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শুনতে পাওয়ার কথা নয়। হঠাৎ যেন আরও কয়েকটা পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল।
পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, অন্ধকারের মধ্যেই চলন্ত অন্ধকার হয়ে গোটা কয়েক লোক ছুটে আসছে। ওরা কারা কে জানে, আমি সরে দাঁড়ালাম এক পাশে।
লোকগুলো কিন্তু আমারই কাছে এসে থেমে গেল এবং ঘিরে ফেলল। মিস্তিরি-কুলি শ্রেণির মানুষ, কয়েক জনের হাতে লাঠি।
একজন জিজ্ঞেস করল, এ বাবু, ফুলমণি কোথায়?
লোকগুলোকে ঠিক চিনতে পারছি না। ও-রকম রুক্ষ স্বরের প্রশ্ন আমার পছন্দ হল না। ফুলমণি, সে-কৈফিয়ৎ যদি দিতে হয় তার শ্বশুরকে দেব, এরা কারা?
জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কে?
সেই লোকটি আবার জিজ্ঞেস করল, ফুলমণি কোথায়?
সে কলকাতায় আছে।
তাকে আনলি না কেন?
তার কাজ এখনও শেষ হয়নি।
তুই নিয়ে গেছিস, তুই আনবিনা?
সে এখন…।
আমার কথাটা শেষ করতে দিল না, একজন আমার মাথার চুল ধরে হ্যাঁচকা টান দিল। আর এক জন পিঠে মারল লাঠির বাড়ি।
আমি লাফিয়ে সরে যাবার চেষ্টা করে বললাম, আরে দাঁড়াও দাঁড়াও, আমার কোনও দোষ নেই, ফুলমণি–।
ওরা আমাকে কোনও কথা বলতে দিতে চায় না। সবাই চালাল কিল-চড়-ঘুষি। এবার পালানো ছাড়া উপায় নেই। দৌড় মারবার চেষ্টা করতেই এক জন আমার পায়ে খুব জোরে একটা লাঠির ঘা কষাল। আমি হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম, পাথুরে রাস্তায় কপালটা ঠুকে গেল, ছেঁচে গেল নাক।
এবার একজন আমার মাথা ঘেঁষে কাঁধে যে জিনিসটা দিয়ে মারল, সেটা লাঠি না লোহার রড? যাই-ই হোক, তাতে কিছু আসে যায় না, মোট কথা আমার মাথা ফেটে রক্ত বেরুচ্ছে বুঝতে পারছি।
আরও মারছে আর কত মারবে!
সেই অবস্থায় আমার মনে পড়ল, ভাগ্যিস সিরাজুল তারিক সাহেব আমার সঙ্গে আসেননি। যদি তাকেও এরা…।
আমি গড়াবার চেষ্টা করেও পারছিলাম না। আর কিছু চিন্তাও করতে পারছি না কেন? চোখের মধ্যে যেন অনবরত বিদ্যুতের ঝিলিক দিচ্ছে। আমি কি অজ্ঞান হচ্ছি, না মরে যাচ্ছি? মৃত্যুর সময় বুঝি চোখে এরকম ঝিলিক খেলে? এরা আমাকে শেষ পর্যন্ত মেরে ফেলল? ছি ছি ছি ছি।
একেবারে শেষ মুহূর্তে আমি টের পেলাম বৃষ্টি নেমেছে। আমার শেষ চিন্তাটা এই যে, ছোটপাহাড়িতে আমার চাকরি এই শেষ। এক মাসের মাইনেটাও পেলাম না? এরা আমাকে পুরো একটা মাসও চাকরি করতে দিল না। আজ মাসের উনতিরিশ তারিখ। মায়ের হাতে তুলে দিতে পারলাম না একটা টাকাও। আমি একটা অপদার্থ।