Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ফাগুয়ারা ভিলা || Buddhadeb Guha

ফাগুয়ারা ভিলা || Buddhadeb Guha

০১.

নেপালি দারোয়ান মস্ত বড় লালরঙা গেটটা ভিতর থেকে খুলে দিতেই ফাগুয়ারা ভিলা’র হাতার বাইরের লাল মাটির পথে পড়েই ভটকাই আমাকে বলেছিল, দেখলি, যা বলেছিলাম কলকাতাতে, ঠিক তাই-ই হল।

তিতির বলেছিল, আমাদের উপরে যেন অভিশাপ লেগেছে।

সত্যি!

আমি বলেছিলাম।

গাড়ি না এলে-গেলে বড় গেটটা সচরাচর খোলে না দারোয়ান। বড় গেটের পাশেই ছোট একটা গেট আছে মানুষের এবং বিশেষ করে সাধারণ মানুষদের যাওয়া-আসার জন্যে। তবু আমরা যে ভি. আই. পি. তা দারোয়ান আমাদের প্রতি তার মালিকদের ব্যবহারেই বুঝে নিয়েছে। দারোয়ান একজন নয়, দুজন, সম্ভবত বারো ঘণ্টা করে ডিউটি করে।

গেটের ভিতরের দিকে প্রায় ফিট দশেক কাউ ক্যাচার। গেট দৈবাৎ খোলা থাকলে যাতে গবাদি পশু ভিতরে ঢুকে না আসতে পারে, সেজন্যে।

এখন ঋজুদা আমাদের সঙ্গে আসেনি। বলেছে, তোরা হেঁটে আয়। চোখ কান খোলা রেখে হাটবি। তেমন কিছু দেখলে আমাকে ফিরে এসে বলবি।

‘তেমন কিছু’ মানে?

ভটকাই বোকার মতো প্রশ্ন করেছিল।

ঋজুদা এমনিতে বিরক্তই ছিল, কারণ নিরবিচ্ছিন্ন ছুটিটা দরকার ছিল ঋজুদারই সবচেয়ে বেশি। তা ভণ্ডুল হয়ে যাওয়াতে মেজাজ খিঁচড়েই ছিল ঋজুদার। তার উপরে ভটকাই-এর এরকম বোকা বোকা প্রশ্ন।

ঋজুদা বলল, ‘অ্যালবিনো’র রহস্য উদঘাটনের সময়ে তুই না-হয় ছিলি না সঙ্গে কিন্তু ‘কাঙ্গপোকপি’ ও ‘স্যেশেলস’-এ তো ছিলি! গোয়েন্দাগিরি কিছু তো করেছিস!

ভটকাই লজ্জিত হয়ে বলল, সরি, সরি।

এখনও সন্ধে হতে প্রায় দেড় ঘণ্টা বাকি। তবু জঙ্গলের অভ্যাসবশে আমরা যে যার টর্চ নিয়েই বেরিয়েছি।

আমার পয়েন্ট টু টু পিস্তলটাও আছে কোমরে বাঁধা উইন্ড-চিটারের তলায়। আর কারও কাছে কিছু নেই। আমাদের তো শুধু বেড়াতেই আসার কথা ছিল এখানে। ঋজুদার কোল্ট পিস্তলটা অবশ্য আছে ঋজুদার কাছে। সেটা আর আমারটা ছাড়া এবারে আর কোনও আগ্নেয়াস্ত্রই আনা হয়নি।

পথটা একটু এগিয়েই হঠাৎ বাঁদিকে ইউ-টার্ন নিয়েছে, একটা বহু প্রাচীন শিমূল গাছকে সাক্ষী রেখে। শিমূলটার গুঁড়িতে পাঁচটি ভাগ। একেক ভাগের আড়ালে জনাদশেক মানুষ স্বচ্ছন্দে লুকিয়ে থাকতে পারে। সেই শিমূলের মগডালে এক জোড়া লাল-গলা দুষ্প্রাপ্য শকুনের বাসা। শেষ বিকেলে তারা গলা লম্বা করে গলাতে রোদ পোয়াচ্ছে। পথের দুপাশে বড় শাল এবং শাল-চারার বনের ভিতরে ভিতরে হরজাই জঙ্গল। শিশু, গামহারা, বিজা, হরীতকী, আমলকী, খয়ের এবং আরও নানা গাছ। বিদায়ী সূর্যের আলো পড়াতে শীতের পাটকিলে ধুলোমলিন গাঢ় সবুজ জঙ্গল গায়ে এক মেরুনরঙা কাশ্মীরি মলিদা জড়িয়ে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। দুপাশ থেকে ছাতারেরা ডাকাডাকি করছে এমনভাবে যেন তাদের বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। তিতিরও ডাকছে টিউ টিউ করে। বনমোরগ ডেকে উঠল একবার।

ভাল শীত আছে। রাতে ঠান্ডা আরও বাড়বে বলে মনে হয়।

ইটখোরি নদীটা এঁকে-বেঁকে ঘুরে ঘুরে চলে গেছে ফাগুয়ারা ভিলাকে পাক দিয়ে। ভারি শান্ত সমাহিত চাল এ নদীর। কোনও তাড়াহুড়ো নেই, ক্ল্যাসিক উপন্যাসের চাল-এর মতো।

কিছু দুরেই পিতিজ-এর জঙ্গল। একসময়ে কাতরাস-এর কয়লা খাদানের শৌখিন মালিক বদি রায়ের একটি বাড়ি ছিল পিতিজ-এ। ঋজুদার সঙ্গে আলাপ ছিল বদিবাবুর। কলিয়ারি জাতীয়করণের পরে কাতরাস ছেড়ে এসে হাজারিবাগে বাড়ি করেছিলেন উনি। তিনি তো মারা গেছেনই বছর ছ-সাতেক হল। তাঁর দুই ছেলেও মারা গেছে কিছুদিন আগে।

আমরা দুদিকের জঙ্গল দেখতে দেখতে চলেছি, এমন সময়ে দেখা গেল কাঁধে বন্দুক ঝুলিয়ে একজন মৌলবি, বড় তালিবানি দাড়ি গালে, মাথাতে কালো রঙা ফেজ টুপি, লাল সবুজ চেক চেক লুঙ্গি পরে সাইকেল চালিয়ে আসছেন এদিকেই। তার সাইকেলের হ্যাঁন্ডেলের সঙ্গে লতা দিয়ে বাঁধা মাথা নিচু পা উপুড় করা দুটি বড়কা মোরগ ঝুলানো। জ্যান্ত নয়। উনি শিকার করেছেন বলে মনে হল!

ভটকাই গলা নামিয়ে বলল, লোকাল লোক। এর কাছ থেকে আমরা অনেক খবরাখবর পেতে পারি।

ঠিক।

আমি বললাম।

বলেই, বললাম, সালাম ওয়ালেকুম।

মৌলবি সাহেব ডান হাতটা হ্যাঁন্ডেল থেকে তুলে সেলাম জানিয়ে বললেন, ওয়ালেকুম আস্সালাম।

তারপরেই কাছে এসে সাইকেল থেকে নেমে পড়ে বললেন, আপ হি লোগ ফাগুয়ারা ভিলামে ঠারে হুঁয়ে হেঁ?

জি হাঁ।

আমি বললাম।

ঋজু বোস কওন হ্যায়?

ভটকাই বলল, উনোনে ত ফাগুয়ারা ভিলামেই হ্যায়। মগর আপ কি কৈসে মালুম?

ভিলাকি কেয়ারটেকারনে বাতায়া মুঝে। ইয়ে মোরগা তো উনহিকি দিয়া হুয়া বন্দুক ঔর টোটাসে মারা হ্যায় আপ হি লোগোঁকি লিয়ে।

বহত বহত্ সুক্রিয়া আপকি।

আমি বললাম।

ভটকাই বলল, লাগতা হ্যায়, বহতই আচ্ছা বন্দুক হ্যায়। ক্যা বন্দুক হ্যায় ঈ?

দেখিয়ে না। বন্দুক হ্যায় ব্যঙ্গ বন্দুকই হ্যায়। ম্যায় জানতে হ্যায় থোরি ক্যা বন্দুক? বলেই, কাধ থেকে বন্দুকটা খুলে দিলেন মৌলবি সাহেব। ব্যারেলে গুলি নেই সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে বন্দুকটা ভটকাই ভাল করে নেড়ে-চেড়ে দেখে ফেরত দিল মৌলবি সাহেবকে।

কী দেখলে?

তিতির বলল।

বুঝলাম না।

আমি দেখি। বলে, তিতির বন্দুকটা ভাল করে নেড়ে-চেড়ে দেখে বলল, বাবাঃ।

বললাম, কী ব্যাপার?

তিতির চোখ নাচিয়ে বলল, স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসসন।

তাই?

ভটকাই বলল, খুব দামি বুঝি?

ইয়েস।

স্মিথ এন্ড ওয়েসসন।

ভটকাই বলল।

বন্দুকটা ফেরত নিয়ে কাঁধে লটকাতে লটকাতে উনি বললেন, কী দুঃখের কথা বলুন তো। নিজের বাড়ির বারান্দাতে বসে কেউ আততায়ীর গুলিতে মারা যান। মেজকুমার মানুষও ভারী ভাল ছিলেন। নিঃসন্তান। তবে হ্যাঁ, পোষ্য নিয়েছেন তার একমাত্র শালির ছেলেকে। সে পুণেতে কী যেন পড়ে। গত বছরে বড়দিনের সময় এসেছিল। ছেলেটা একেবারে ভেঙে পড়েছে। কুড়ি বাইশ বছরের ছেলে।

কোথায় পড়ছে পুণেতে? কী পড়ছে?

তা জানি না।

তারপর বললেন, মেজকুমার বহত পড়ে লিখে আদমি থে। রায়পুরেই থাকতেন অধিকাংশ সময়। ওখানের কলেজেই পড়াতেন। বহতই সিম্পল আদমি থে। না জামাকাপড়ের চালিয়াতি ছিল না অন্য কোনও শখ। তিনি অজাতশত্রু মানুষ ছিলেন। তাকে যে কেউ গুলি মারতে পারে এ তো এই অঞ্চলের কারও মাথাতেই আসছে না।

নাম কী তার?

কার?

মেজকুমারের পোষ্যপুত্রের?

বিজিতনারায়ণ। কেন? তার সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি আপনাদের?

না। বললাম আমি। (ভাবলাম, সদ্য পরিচিত মানুষের সঙ্গে খুনের তদন্ত করতে এসে বেশি কথা বলা ভাল নয়।)। আমরা তো মাত্র গতরাতেই এসে পৌঁছেছি। আপনিই তো বললেন তিনি ভেঙে পড়েছেন।

আপনাদের ছোটকুমার ছাড়া মালিকদের কারও সঙ্গেই দেখা হয়নি এখনও। ভটকাই বলল।

আমি বললাম, বড়কুমার কন্দর্পনারায়ণ এখানে আসেন না?

আসেন আসেন। পুজোর সময়ে আসেন প্রতি বছর আর দেওয়ালির পরে ফিরে যান। এই জায়গাটা তার খুবই প্রিয়। তবে তিনি লাগাতার থাকতে পারেন না। আসেন যান। তার সময় কোথায়? কত বড় ব্যবসা তার সারা দেশজোড়া। চা বাগান, ফাউন্ড্রি, আমদানি-রপ্তানি, কফির বাগিচা দক্ষিণের কুনুরে।

ভটকাই বলল, তাই?

তাই তো।

বলেই, মৌলবি সাহেব বললেন, আমি এগোই। বন্দুক গুলি মোরগা সব তো আমাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। রান্না হলে তবে না আপনারা খাবেন।

খাওয়ার এখন কী! সবে তো বিকেল।

গুলি কেন? গুলি তো খরচই হয়ে গেছে।

তিতির বলল।

মৌলবি সাহেব হেসে বললেন, আমার নাম এ অঞ্চলে ‘মোরগার যম। একটিই দুনম্বর ছররা দিয়ে দুটি মোরগ মেরেছি। আরেকটি গুলি বেঁচে গেছে।

সাব্বাস মৌলবি সাহেব।

আমি বললাম।

ডান হাতটা মাথায় ঠেকিয়ে, অভিনন্দন গ্রহণ করে মৌলবি সাহেব সাইকেলে উঠলেন।

আসলে আমরা সকলেই জানি যে, ঋজুদা কন্দর্পবাবুর অনুরোধেই এখানে বেড়াতে আসতে রাজি হয়েছিল কদিনের জন্যে। কন্দর্পবাবু আগে কিছু জানাননি, কিন্তু আমরা ট্রেনে ওঠার সময়ে নিজে স্টেশনে এসে একটা চিঠি দিয়েছিলেন ঋজুদার হাতে। ঋজুদাকে বলেছিলেন, এই চিঠিটা পড়বেন ঋজুবাবু। আমাকে ফিরাবেন না। আপনি ছাড়া আর কেউই আমাকে এ বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবেন না। ফিস-এর জন্যে আপনি ভাববেন না। আপনার ক্ষতি আমি পুষিয়ে দেব। ব্ল্যাঙ্ক চেক দেব আপনাকে।

ট্রেন ছাড়ার পরেই ঋজুদা চিঠিটা পড়ে কন্দর্পবাবুর উপরে মনে মনে খুবই বিরক্ত হয়েছিল। বলেছিল, ব্যবসাদার লোকদের এই দোষ। যেন তেন প্রকারেণ নিজের নিজের স্বার্থ পূরণ করতে পারলেই হল। প্রয়োজনে তারা পায়ে পড়ে যাবে তারপর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাজ হয়ে গেলে চিনতেই পারবে না। তবে কন্দর্প শুক্ল মানুষটা খারাপ নয়। কিন্তু এ কী জবরদস্তি! জোর করে কেস গছানো।

চিঠিতে কী আছে?

তিতির বলেছিল।

ভটকাই বলেছিল, আমাদের খাওয়া-দাওয়া ঘুম আর রিল্যাক্স করা হবে না তাহলে। স্বর্গে গিয়েও কেঁকিতে পাড় দিতে হবে।

ঋজুদা বলল, হয়তো নয়। তবে রথ দেখা কলা বেচা করতে হবে আর কী!

আমরা একটা ফোর বার্থ এ. সি. কম্পার্টমেন্টে ছিলাম, তাই প্রাইভেসির অভাব ছিল না। আমাদের ঔৎসকু নিবৃত্তির জন্যে চিঠিটা তিতিরের দিকে এগিয়ে দিয়ে ঋজুদা বলল, জোরে জোরে পড়। তুই সবচেয়ে ভাল পড়িস। অন্যরাও শুনবে।

তারপরই আমার দিকে ফিরে বলল, মোবাইলে এই নাম্বারটা লাগা তো রুদ্র, বলেই, নিজের মোবাইলে-এর সুইচ টিপে নাম্বারটা বের করে মোবাইলটাই দিয়ে দিল আমার হাতে। বোতাম টিপতেই ফোন বাজতে লাগল। ভাগ্যিস অফ করা নেই।

ওদিক থেকে হ্যালো’ শুনেই ঋজুদাকে দিয়ে দিলাম।

ঋজুদা বলল, আপনি কোথায়?

ঘরকি নজদিকমে। কম্যান্ড হসপিটালকি সামনেমে–আলিপুর।

দেখুন কন্দর্পবাবু, এভাবে মার্ডার কেস সালটানো যায় না। পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট, ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের রিপোর্ট এসব দরকার। পুলিশ কি কারও বিরুদ্ধে চার্জ ফ্রেম করেছে? কোন থানায় পড়বে আপনাদের ফাগুয়ারা ভিলা’? তা ছাড়া, আপনাদের, পরিবারসুদ্ধ সকলের একই সঙ্গে আসতে হবে একবার এখানে। আমার পক্ষে তো সব জায়গাতে গিয়ে ইনটারোগেট করা সম্ভব হবে না। কবে সকলে এখানে আসতে পারবেন জানাবেন। না আসতে পারলে, আমি ফিরে যাব।

আরও কীসব কথা বলে ঋজুদা মোবাইলটা অফফ করে দিল।

ভটকাই বলল, তোমার নাম্বারটা দিয়ে দিলে না?

তিতির বলল, বোকাটা। ঋজুদার নাম্বারটা তো কন্দর্পবাবুর মোবাইলে উঠেই গেছে।

তা ছাড়া, আমার সব নাম্বার ওঁর কাছে আছে।

ঋজুদা বলল।

ভটকাই কিছু বলল না।

ঋজুদা বলেছিল। পুলিশ চার্জ দেয়নি। কারওকে সন্দেহই করতে পারছে না। তারপরে বলল, ছোট জায়গার থানা–যে খুন করেছে সে কি আর খুন করার আগে থানাদারকে হাত করে রাখেনি! মোটা টাকার খাম ধরিয়ে রেখেছে। হয়তো তার উপরওয়ালাকেও খাইয়ে রেখেছে। সত্যি! দেশটা যে কী হয়ে গেল চোখের সামনে অথচ…।

আমাদের কি কিছুই করার নেই?

তিতির বলল।

নিশ্চয়ই আছে। প্রতিবাদ করতে হবে সব জায়গাতে। বাসে, ট্রামে, ট্রেনে, পথে-ঘাটে অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদ করতে হবে। আমার পায়ে কেউ মাড়িয়ে না যাওয়া পর্যন্ত চুপ করে থাকলে চলবে না। কারণ চুপ করে থাকলে আগামীকাল আমার পা-ও ওরা মাড়িয়ে যাবে। প্রতিবাদী না হলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

তিতির বলেছিল, সেই বঙ্কিমচন্দ্র লিখে গিয়েছিলেন না? ‘আইন! সে তো তামাশা মাত্র। বড়লোকরাই পয়সা খরচ করিয়া সে তামাশা দেখিতে পারে। এদেশে যার পয়সার জোর নেই তার কিছুই নেই।

ভটকাই বলেছিল, আর যার আছে তার সব আছে।

কন্দর্পবাবুরা বুঝি খুবই বড়লোক?

হ্যাঁ। কিন্তু যাদের অনেক থাকে তাদেরই আরও অনেক দরকার।

তাই তাদের পরিবারেরই কেউ হয়তো খুনটা করেছে। কে জানে! ব্যাপারটা বুঝতে পারছিস?

বুঝছি।

ঋজুদা বলেছিল, মার্ডার কেস-এর তদন্ত করতে হলে আগেই মোটিভটা কী তা জানার চেষ্টা করা দরকার। এই খুন করে কার লাভ বেশি সেটাই জানার চেষ্টা করতে হবে। তবে অনেক সময় অর্থ ছাড়াও অন্য মোটিভ থাকে। ঈর্ষা, প্রতিহিংসা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি।

আধ মাইলটাক এসেছি আমরা ফাগুয়ারা ভিলা থেকে। তিতির বলল ভটকাইকে, চলো, আরও একটু এগিয়ে গিয়ে আমরা পথ দিয়ে না ফিরে নদীর বুকের বালি মাড়িয়ে ফিরি। অ্যাডভেঞ্চারও হবে আর নদীর দিক থেকে ফাগুয়ারা ভিলাটা কেমন দেখায় তাও দেখা যাবে। এই জঙ্গলে কী কী জানোয়ার আছে। তারও একটা ধারণা হবে বালির উপরে তাদের পায়ের দাগ দেখে।

বাঃ! গুড আইডিয়া।

বলল, ভটকাই।

তারপর বলল, আচ্ছা, শিকার তো সারা দেশেই বে-আইনি এখন। তাওঁ ওই মৌলবি মারল কী করে মোরগ দুটো।

আমি বললাম, এ তো শুক্লদেরই প্রাইভেট শুটিং প্রিসার্ভ। এই এলাকার মধ্যে তাদের আইনই মান্য। দেশের আইনের কোনও এক্তিয়ার নেই।

তিতির বলল, ভালুক আবার খামচা খামচি করবে না তো? নদীর বুক ধরে হাঁটলে। আমরা তো নিরস্ত্র।

বললাম, আমার কাঁখে খোকা আছে।

ওই খোকা দিয়ে ভালুক পিঠ চুলকোবে।

ভারতীয় ভালুক হচ্ছে ইংলিশ ওয়েদারের চেয়েও বেশি আনপ্রেডিকটেবল। সে কী করে, কখন করে, তা আদৌ বলা যায় না। চলো, আরও পনেরো মিনিট হেঁটে আমরা নদীতে নামব।

ভটকাই বলল।

তিতির বলল, ওক্কে।

.

০২.

ফাগুয়ারা ভিলার কিচেনে একজন গ্র্যাজুয়েট কিচেন ম্যানেজার আছেন। মি. শর্মা। সাসারাম-এ বাড়ি। সকালের ব্রেকফাস্ট খাওয়ার সময়েই আমাদের মিস্টার ভটকাই তাঁর সঙ্গে দোস্তি করে নিয়েছে। মি. শর্মা গ্র্যাজুয়েট কারণ ফাগুয়ারা ভিলাতে নাকি কলকাতা থেকে সাহেবসুবো অতিথিরাও আসেন। তাঁদের সঙ্গে ইংরেজিও বলতে হয়। মি. শর্মা ইংরেজিটা ভালই বলতে পারেন। বলতে বলতেই উন্নতি হয়েছে বোধহয়। আমাদের সঙ্গেও বলেছিলেন, ঋজুদার ধমক খেয়ে হিন্দিতেই বলছেন।

সাহেবি রান্নার প্রয়োজন হলে গোয়ানিজ কুক ম্যাথুজ রান্না করেন। দিশি ও নিরামিষ-এর জন্যে আছেন পাঁড়েজি। মুসলমানি রান্না ম্যাথুজই শিখে নিয়েছে সব। বেঁধে দেয়। চাইনিজও রাঁধে।


আমরা তিনজন আমার ঘরে কম্বলের তলাতে আরামে বসে গল্প করছিলাম। ফায়ার প্লেস-এ আগুন জ্বেলে দিয়েছে। প্রথমে একটু ধুয়ো হয়েছিল। এখন নেই। ঠান্ডাটা জব্বর পড়েছে। ঋজুদা বলেছে, একটু পরেই আসছে আমার ঘরে আলোচনা আছে।

ভটকাই বলল, আজ রাতে সষুকা সাগ, মাক্কিকা রোটি, আঁওলার আচার আর ঝুমরি তিলাইয়া থেকে আনা কালাকাঁদ।

আর মৌলবি সাহেবের মুরগি?

তিতির বলল।

আমিই মানা করে দিলাম। কাল লাঞ্চে চিকেন বিরিয়ানি, রাইতা আর সালাদ করতে বলেছি। আর রাবড়ি।

রাবড়ি?

তিতির বলল।

ইয়েস রাবড়ি। আমি আনাবার বন্দোবস্ত করেছি। তোর নাম করে বলেছি যে মেমসাহেবের ভীষণ কনস্টিপেশন। রাবড়ি রোজ চাই-ই। সঙ্গে আমরাও খাব।

এত অসভ্য না।

তিতির বলল।

এমন সময়ে ঋজুদা হাতে একটা scroll মতো নিয়ে ঢুকল। গোল করে পাকানো কাগজটা। কোনও দলিলের মতো দেখতে।

ঋজুদা আমাদের সকলের উৎসুক চোখে চেয়ে বলল, এটা কেয়ারটেকার মিশিরজির কাছ থেকে জোগাড় করেছি। জিনিসটা অরিজিনাল। কাল ব্রেকফাস্টের পর ভটকাই এটা ঝুমরি তিলাইয়া অথবা কোডারমাতে নিয়ে গিয়ে চার কপি জেরক্স করে আনবি। আমাদের প্রত্যেকের কাছেই একটি করে কপি থাকা দরকার-ফর রেডি রেফারেন্স।

এটা, মানে, এই জিনিসটা কী?

আমি বললাম।

জনমপত্রী। তবে ঠিক জনমপত্রী নয়–এটিকে বলা উচিত বংশলতিকা। আমি মাত্র দুপুরুষের এনেছি। বলেই, কার্পেটের মধ্যিখানে পাতা মস্ত সেন্টার টেবিলটার উপরে সেটাকে মেলে ধরে বলল, তোরা সবাই এগিয়ে আয়।

এইরকম পরিবারে রোজি নামটা কেমন বেমানান, না?

আমি বললাম।

ঋজুদা কিছু না বলে আমার চোখে তাকাল একটুক্ষণ। মনে হল, আই মেড আ পয়েন্ট।

ভটকাই বলল, কেন অমিতাভ, ধর্মেন্দ্র, হেমা, নাম হলে মেয়েদের, স্ত্রীর নাম রোজি হতে দোষ কী?

মনে হয় পঞ্চান্ন মতো।

ওঁর সবচেয়ে ছোট ভাইয়ের বয়স?

দ্যাখ না, নামের পাশেই লেখা আছে।

ওঃ। পঁয়ত্রিশ।

তার মানে তো বড়র সঙ্গে ছোটর কুড়ি বছরের তফাত।

আর সেজর?

মেজ ভীষ্মনারায়ণ–ডিসিজড। মেট আ ভায়োলেন্ট ডেথ। পঞ্চাশ বছর আগে।

হুঁ।

ঋজুদা বলল।

তারপরে বলল, কন্দর্পনারায়ণবাবুর সঙ্গে কথা হল অনেকক্ষণ ধরে। ওঁদের পরিবারের সকলকে একসঙ্গে এখানে পাওয়া যাবে না। কেউ আলাদা আসবেন সামনের উইকএন্ডেকারও কাছে আমায় যেতে হবে।

মানে, পর্বতের যেতে হবে মহম্মদের কাছে।

তিতির বলল।

সেইরকমই। কিন্তু কন্দর্পনারায়ণবাবুদের পারিবারিক রহস্য উদঘাটনের জন্যে তো আমি এখানে মৌরসিপাট্টা গেড়ে থাকতে পারব না। আমাকে এবং তোদেরও সবাইকে ফিরে যেতে হবে কলকাতাতে যার যার কাজে।

তারপর বলল, তোরা এখানে খাদা, বেড়িয়ে বেড়া, রিল্যাক্স কর। আমি একটু কলকাতা যাব কালই।

সে কী! কেন?

কী? কেন? এসব জিজ্ঞেস করবিনা। কলকাতাতে পৌঁছে কাল রাতেই রায়পুর রওয়ানা হয়ে যাব। ভীষ্মনারায়ণবাবু সম্বন্ধে একটু খোঁজখবর করতে হবে।

তারপর? ফিরবে কবে?

কাজ শেষ করে রায়পুর থেকে গাড়িতে চলে যাব নাগপুর। নাগপুর থেকে খুব ভোরে কলকাতার ফ্লাইট আছে। যাতেই ফিরি, ট্রেনে কিংবা প্লেনে, কলকাতা ফিরে সেদিনই ভেস্টিবুল ধরে কোডারমাতে নামব এসে–হোপফুলি যদি নাগপুর থেকে ফ্লাইটটা সময়মতো ছাড়ে কুয়াশার জন্যে প্রায় রোজই ডিলেড হয় ফ্লাইট বছরের এই সময়ে।

তারপরে বলল, কলকাতাতে সময়ে পৌঁছলে তোর মোবাইলে ফোন করে দেব রুদ্র। তোরা গাড়ি নিয়ে আসিস কোডারমা স্টেশনে। তবে ড্রাইভার রেখে যাবি। নিজেরাই চালিয়ে আসিস। কে কার চর কে জানে। এখানের সকলকে বলবি। কাজে আমাকে কলকাতা যেতে হয়েছে।

তারপর বলল, তোরা এখানে এনজয় কর। তাই করতেই তো আসা। বিপদের তো কিছু দেখছি না আমি। তবুও সবসময়ে চোখ কান খোলা রাখবি। আমার অ্যাসেসমেন্ট ভুলও হতে পারে। আমি তো আর ভগবান নই।

.

০৩.

হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে দুটি শাখা আছে। দায়ভাগা আর মিতাক্ষরা। উত্তর ভারতের অধিকাংশই মিতাক্ষরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মিতাক্ষরা আইনে পুত্রসন্তান জন্ম নেবার সঙ্গে সঙ্গেই পৈতৃক সম্পত্তিতে তার অধিকার জন্মে যায়। আর দায়ভাগাতে তেমনটি হয় না। যেমন বাঙালিদের। বাঙালি বাবারা ছেলেদের যেমন ত্যাজ্যপুত্র করতে পারেন এবং অনেক সময়ে করেন, তা মিতাক্ষরাতে হয়। তবে ওই অধিকার জন্মায় শুধুমাত্র বাবা যে পৈতৃক সম্পত্তি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন তারই উপরে।বাবার স্বোপার্জিত সম্পত্তিতে ছেলের কোনও অধিকার জন্মায় না। বাবা দিয়ে গেলে অন্য কথা, না দিয়ে গেলে, কিছুই করণীয় নেই। বাবা রামকৃষ্ণ মিশনে বা অন্য কোনও ভাল সেবা প্রতিষ্ঠানে তার নিজস্ব রোজগার দানও করে দিয়ে যেতে পারেন।

ঋজুদা এই অবধি বলে থামল।

তিতির বলল, তাহলে ভীষ্মনারায়ণের পৈতৃক সম্পত্তিতে বিজিতনারায়ণের এমনিতেই হক ছিল। তাহলে, ছেলে সে যতই চালিয়াত ও খরচে হোক, বাবার বিরুদ্ধে তার অনুযোগ থাকার তো কথা নয়।

ঋজুদা কাল বিকেলেই ফিরেছে কলকাতা থেকে। আমরা বিকেলে হাঁটতে ‘বেরিয়েছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে ওইসব আলোচনা হচ্ছিল।

ঋজুদা বলল, অনুযোগ থাকতে পারে। বাবার অবর্তমানে সে এ সম্পত্তি পাবেই কিন্তু বাবা কতদিন বাঁচবেন তা তো জানা নেই। বাবা তো নব্বই বছরও বাঁচতে পারেন। ততদিনে পালিত পুত্র বিজিতনারায়ণের বয়স হয়তো হয়ে যাবে সত্তরের কাছাকাছি। অতদিন অপেক্ষা করার ধৈর্য তার হয়তো ছিল না। তোদের প্রজন্মের কারওরই অপেক্ষা করার ধৈর্য নেই। রমাপদ চৌধুরীর একটা উপন্যাস ছিল না? ‘এখনই’–যাকে বলে right now’–তোরা সকলেই right now-তে বিশ্বাসী। তা ছাড়া ভীষ্মনারায়ণ অধ্যয়নশীল মানুষ ছিলেন। বই আর কলম ছাড়া তাঁর অন্য কোনও খরচ ছিল না নেশাও ছিল না। খদ্দরের ধুতি পাঞ্জাবি পরতেন, নিরামিষ খেতেন, রায়পুরের বিদগ্ধ মহলে তার বিশেষ সম্মান ও প্রতিপত্তি ছিল। চিন ও জাপান সম্বন্ধে তিনি বিশেষ পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। অনেকবার গেছেনও ওই দুদেশে। জাপানি ও চিনা পণ্ডিতেরা তার পাণ্ডিত্যকে সম্মান করতেন। তার। কয়েকটি বই ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে পঠিত হয়। পলিটিকাল সায়ন্স-এর সেইসব বই থেকেও তার প্রচুর আয় ছিল–হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট হিসেবে মাইনেও কম পেতেন না। তিনি যে বিজিতনারায়ণকে যথেষ্ট টাকা দিতেন না এমনও নয়–যদিও তাঁর জীবনযাত্রা এবং বিজিতনারায়ণের জীবনযাত্রাতে বিস্তরই তফাত ছিল। তার কাছে যা যথেষ্ট’ তা হয়তো বিজিতের কাছে যথেষ্ট ছিল না।

কী পড়ে বিজিতনারায়ণ পুণেতে?

ম্যাসকম।

ভটকাই বলল, মানে?

আমি বললাম, মাস কম্যুনিকেশান।

ও পড়ে কী হয়?

অ্যাডভার্টিজমেন্ট লাইনে যাওয়া যায়–টিভিতে, রেডিওতে, ভাল চাকরি পাওয়া যায়। নিজেও কোম্পানি করতে পারে। আজকাল স্পেশালাইজেশনের যুগ।

অ।

ভটকাই বলল।

ঋজুদা বলল, খোঁজ নিয়ে জানলাম যে, বিজিতনারায়ণ ব্রান্ডেড জামাকাপড় ছাড়া পরে না। স্কচ হুইস্কি ছাড়া খায় না।

ব্রান্ডেড মানে?

ভটকাই আবার বলল।

ওকে বুঝিয়ে দে রুদ্র।

ব্রান্ডেড মানে নামকরা ব্রান্ডের জামাকাপড়। যেমন নাইকে, ওয়েস্টসাইড, উইকএন্ডার আরও কত কী। একটা ঢোলা হাফ-প্যান্টের দাম হাজার টাকা যেমন ঢোলা হাফ-প্যান্ট আগেকার দিনের কনস্টেবলরা পরত–খাকি কাপড়ের।

আমি বললাম, লজ্জা তো কত সস্তাতেই নিবারণ করা যায় কিন্তু এখন লজ্জাস্থান গোপন করার চেয়ে তো বিভিন্নভাবে প্রকাশ করাটাই সপ্রতিভতার উৎকর্ষ বলে মনে হয়। প্রয়োজন নয়, এখন কায়দাটাই আসল।

যা বলেছ।

তিতির বলল।

তারপর বলল, আর সেই কায়দার জন্যে গুণাগার কী পরিমাণ গুনতে হয়! পশ্চিমি বড়লোকদের দেশে ওরা করে বা পরে, ঠিক আছে। ওদের রোজগার আমাদের চেয়ে কত বেশি! যে দেশে সব মানুষে দুবেলা খেতে পায় না, একজোড়া ধুতি-জামা পরতে পায় না সারাবছর, সেই দেশে এইসব চালিয়াতির কী মানে হয় আমার মাথাতে আসে না।

আমি বললাম, বলেছ ঠিকই। এইসব চালিয়াতিতে যারা শামিল হয় এদেশে তারা জনগণের কত জন? শতকরা এক ভাগও কি হবে?

তাও হবে না। মানে, এক ভাগও হবে না তারা। অথচ মিডিয়াগুলো এদের জন্যেই সবকিছু করে সাধারণ মানুষের জন্যে কিছুমাত্রও নয়। লজ্জাকর!

ঋজুদা বলল। ওসব গ্লোবালাইজেশনের কুফল। গ্লোবালাইজেশনের সুফল যে একেবারেই নেই তা বলব না। তবে যা দেখছি, তাতে মনে হয়, কুফলই বেশি। কিন্তু এ প্রসঙ্গ থাক। আমরা বিজিতনারায়ণের প্রসঙ্গ থেকে অনেকই সরে এলাম।

হ্যাঁ। আমি বললাম।

তারপর বললাম, আমাদের বিবেচনার বিষয় ছিল, চটজলদি বড়লোক হবার জন্যে বিজিতনারায়ণ কি তার পালক বাবাকে খুন করতে পারে?

সেইটাই হচ্ছে প্রশ্ন।

ভটকাই বলল, ভীষ্মনারায়ণকে খুন করে আর কার লাভ হতে পারত?

সেটাও প্রশ্ন। ভেরি পার্টিনেন্ট প্রশ্ন।

তিতির বলল, যে খুনি সে কি নিজে হাতে খুন করেছে না কারওকে দিয়ে খুন করিয়েছে সেটাও একটা প্রশ্ন।

এ দিকটা নিয়ে আমি ভেবেছি।

ঋজুদা বলল। তারপরে বলল, এই পরিবারে শুধুমাত্র কন্দর্পর ভাই শার্দুল ছাড়া আর কেউ বন্দুক রাইফেল চালাতেই জানে না। সে তো আমরা বুঝেই গেছি। নইলে মৌলবিকে দিয়ে মোরগা মারতে পাঠায় মিশিরজি গুলি বন্দুক দিয়ে!

সে তো মৌলবি তোদের বলেছিল। আসলে কে পাঠায় তার খোঁজ করেছিস কি?

ঋজুদা বলল।

আমরা মাথা চুলকে বললাম, না তো।

মোরগ খেয়ে তো হজম করে দিলি। আর এই খবরটাই নিলি না। মৌলবি যা বলল তাই বিশ্বাস করে ফেললি। যুক্তি দিয়ে বিচার না করে কোনও কিছুকে বিশ্বাস করাটাই গোয়েন্দার ধর্ম নয়।

ঋজুদা বিরক্ত গলাতে বলল।

তারপরে বলল, আজই খোঁজটা নে। এই ফাগুয়ারা ভিলাতে গুলিবন্দুক কার জিম্মাতে থাকে? কী কী রাইফেল বন্দুক আছে এখানে? কার্তুজ বা অ্যামুনিশানই বা কী আছে? কে সেই অ্যামুনিশান ইস্যু করে?

তিতির বলল, ভীষ্মনারায়ণকে যেদিন খুন করা হয় সেদিন শার্দুলনারায়ণ কি এখানে ছিলেন?

হ্যাঁ। ঋজুদা বলল, খোঁজ নিয়েছি। ছিলেন। কিন্তু এও জেনেছি যে শার্দুলনারায়ণ এবং তাঁর স্ত্রী দিয়া ভীষ্মনারায়ণের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ ছিলেন এই পরিবারে। দিয়া গোয়ালিয়রে একটি কলেজের লেকচারার হিন্দি পড়ায়। হিন্দিতে কবিতা লেখে। বলতে গেলে, ভীষ্মনারায়ণই ছিলেন দিয়ার মেন্টর, আদর্শ, ফিলসফার।

সে জন্যেই হয়তো শার্লের রাগ থাকতে পারত ভীষ্মনারায়ণের উপরে।

ঋজুদা বলল, নট আনলাইকলি। কিন্তু মনে হয় না। আমি ভাল করে খোঁজ নিয়েছি শার্দুল পুরো পরিবারে তার দেবতুল্য দাদা ভীষ্মনারায়ণকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসত ও শ্রদ্ধা করত। দিয়া ভীষ্মনারায়ণের কন্যাসমা–তার সঙ্গে স্ত্রী-হারা হলেও ভীষ্মনারায়ণের অন্য কোনও সম্পর্কর কথা অভাবনীয়। রাজরাজেন্দর শুক্ল পরিবারের সকলের এবং পরিবারের বাইরেও যত লোকের সঙ্গে আমি রায়পুরে কথা বলেছি সকলেই এক বাক্যে এ কথা বলেছেন।

তুমি একদিনেই এত তথ্য জোগাড় করলে কী করে! আর তা রায়পুরেই বা পেলে কী করে?

আমি অবাক গলাতে বললাম।

রায়পুরেই তো বাবু রাজরাজেন্দর শুক্লর পৈতৃক নিবাস ছিল। সেখানেই তো ব্যবসা করে তিনি এত টাকা রোজগার করেন। এত অল্প সময়ে কী করে এত জানলাম সেই প্রশ্নের উত্তরে বলতে পারি যে আমার যোগাযোগ ছিল রায়পুরে। এবং গড ইজ কাইন্ড টু মি–একট্রিমলি কাইন্ড ইনডিড।

তিতির বলল, কী রকম?

বিদ্যাচরণ শুক্লর নাম শুনেছিস তো? ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার সময়ে যাঁর নাম শ্রদ্ধা হয়তো অশ্রদ্ধার সঙ্গেও ঘরে ঘরে উচ্চারিত হত! এই বিদ্যাচরণ শুক্লর ছেলের সঙ্গে কার বিয়ে হয়েছে জানিস?

কার?

আমাদের বাংলার মহিষাদলের রাজপরিবারের মেয়ের। শক্তিপ্ৰসাদ গর্গকে মনে নেই, রাইফেল ক্লাবে আসতেন? সেই শক্তিদারই দাদার মেয়ের সঙ্গে।

বাঙালির মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন বিদ্যাচরণজির ছেলে?

কেন?

তিতির বলল।

কেন করবেন না। অপরূপ সুন্দরী, প্রায় মাখন দিয়ে তৈরি বাঙালি রাজার মেয়ের সৌন্দর্য মধ্যপ্রদেশের রাজসদৃশ ক্ষমতাবানের অপছন্দ হবার তো কিছু ছিল না।

ও। তাই বলো।

তিতির বলল।

রায়পুরে নেমেই সটান আমি ওদের বাড়ি গিয়ে উঠি। ওরাও তো শুক্লই যদিও রাজরাজেন্দ্রর শুক্লর সঙ্গে কোনও আত্মীয়তা ছিল না ওঁদের। ওখানেই সারাদিন থেকে চৰ্য্য চোষ্য লেহ্য পেয় করে খেয়ে ওদেরই গাড়ি করে রাতে বেরিয়ে একেবারে সোজা নাগপুর এয়ারপোর্ট গিয়ে পৌঁছলাম। ভোর ভোর। শীতের দিন, তখনও অন্ধকার ছিল।

সত্যি! তোমার ব্যাপারই আলাদা।

ভটকাই বলল।

তিতির বলল, মরুভূমি বা সমুদ্রর মধ্যেও হয়তো তোমার এরকমই কানেকশানস বেরিয়ে যাবে।

আমি কে? সবই উপরওয়ালার দয়া।

আজকাল দেখি ঋজুদা প্রায়ই উপরওয়ালার কথা বলে। আর চলে-যাওয়া বন-জঙ্গলের বন্ধুদের কথা, গোপাল সেন, সুব্রত চ্যাটার্জি, নাজিম সাহেব, এই সব। বুড়ো হচ্ছে বোধহয়।

ভাবলাম আমি।

তিতির বলল, ফরেনসিক রিপোর্ট কী বলছে? কলকাতাতে খোঁজ নিয়েছ। নিশ্চয়ই ভটচার্যি সাহেবের কাছে।

ফাস্ট হ্যান্ড রিপোর্ট নয়। জানতে হবে বিনোদ ঠাকরের কাছ থেকে। রাঁচি থেকে। এখন ঝাড়খণ্ডর রাজধানী তো রাঁচি। ভটচার্যি সাহেব বিকেলে রাঁচির সঙ্গে কথা বলে জানাল, কোনও লাইট-বোর রাইফেল দিয়ে মারা হয়েছে ভীষ্মনারায়ণ শুক্লকে। এগজাক্ট বোরটা পরে জানা যাবে। তবে পুরো খবরের জন্যে আমি রাঁচির বড় উকিল বীরু রায়কে ফোন করেছি। বীরুদার দাদা রাঁচি হাইকোর্টের জজও ছিলেন। বীরু খবর নিয়ে এলে মোবাইলে জানাবে। চমৎকার মানুষ বীরু। আমার বন্ধু।

তারপর ঋজুদা বলল, দোতলার বারান্দাতে ভীষ্মনারায়ণ বিকেলে রোদে ইজিচেয়ারে বসে বই পড়ছিলেন। পাদুটি ছিল গদি বসানো মোড়ার ওপরে। ডানদিকে ছিল একটা তেপায়া। তাতে চায়ের পট, পেয়ালা-পিরিচ-দুধের পট, চামচ। কিছুক্ষণ আগেই চা খেয়েছিলেন। টি-কোজিতে মোড়া চায়ের পটও ছিল। তাতে চা গরম ছিল। হয়তো আরেক কাপ নেবেন!

গুলিটা কোথায় লেগেছিল? বুকে?

না। একেবারে কপালে। দু-চোখের মাঝে। প্রথম গুলিটা। তারও পর আরও দুটি গুলি করে আততায়ী। একটি বুকের বাঁদিকে, অন্যটি গলাতে। যে মেরেছে তার হাত আর্মির স্নাইপারদের মতো ভাল। তা ছাড়া, বাড়ির কেউই গুলির আওয়াজ পায়নি। দেওয়ালির আগের দিন। জঙ্গলের মধ্যের গাঁয়ের ছেলেরা ধানি পটকা ও আছাড়ি পটকাও ফাটাচ্ছিল মাঝেমধ্যে। আওয়াজ হয়ে থাকলেও দূরাগত সে আওয়াজকে পটকার আওয়াজ বলেই ধরে নিয়েছে সকলে। গুলিগুলো কাছ থেকে আদৌ করা হয়নি। দোতলার খোলা বারান্দা যথেষ্ট উঁচু। সেখানে বসে থাকা মানুষকে মারতে হলে যথেষ্ট উঁচু থেকেই মারতে হবে এবং সেরকমই মারা হয়েছে এবং গুলির শব্দ যখন বাড়ির লোকেরা তেমন পাননি কাছ থেকে তখন ধরেই নিতে হবে যে গুলিটা বেশ দূর থেকেই করা হয়েছে। এখন ঠিক কোথা থেকে যে করা হয়েছে তা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। মাটিতে দাঁড়িয়ে মস্ত চওড়া দোতলার বারান্দার পেছন দিকে বসে-থাকা ভীষ্মনারায়ণকে মারা অসম্ভবই ছিল।

ভটকাই হঠাৎ বিজ্ঞর মতো বলল, কিন্তু মোটিভ। খুনের মোটিভ কী এবং কে খুন করেছে সেটা তো বের করতে হবে।

নিশ্চয়ই!

ঋজুদা হেসে ফেলে বলল, ঠিক সেই কম্মো করতেই তো কন্দর্প আমাদের অনুরোধ করেছেন। তা ছাড়া, শুধু খুনি নিজেই নয়, সে যদি অন্য কারও নির্দেশে খুন করে থাকে তবে সে কার নির্দেশে খুন করেছে, সেটাও খুঁজে বের করতে হবে। মানে abetment-এর চার্জ কাদের উপরে আসতে পারে সেটাও দেখতে হবে।

তা ঠিক।

আমি বললাম।

তিতির হঠাৎ বলল, ভাল কথা মনে পড়ে গেল। তিনদিন হয়ে গেল, আমরা যে নদীর বালিতে অদ্ভুত একটা জানোয়ারের পায়ের দাগ দেখলাম এবং হাতির পুরীষের মতো পুরীষ জায়গাতে জায়গাতে, তা তো ঋজুদাকে রিপোর্ট করলে না ভটকাই।

ভটকাই অপরাধীর মুখে বলল, সময় পেলাম কই? তোরা সবসময়েই এত কিচিরমিচির করছিস, যেন পাখি নয়তো বাঁদর, দুটো সিরিয়াস কথা বলতে পারি, একটু কনসেনট্রেট করতে পারি তার সুযোগ কোথায় পাচ্ছি।

আমি বললাম, নে। ঢের হয়েছে। এবারে বল।

কী বলবে?

ঋজুদা উৎসুক হয়ে বলল।

ভটকাই বলল, সেদিন ফাগুয়ারা ভিলাতে বিকেলে জঙ্গল থেকে হেঁটে ফেরার সময়ে পথ দিয়ে না ফিরে আমরা নদীর বুক ধরে ফিরেছিলাম। যাতে এ বনে কী জন্তু-জানোয়ার আছে তার একটা হদিশ পাওয়া যায়। দিনমানে না হলেও রাতের বেলা তো তারা ওই নদীর বুক ধরে যাওয়া-আসা করেই।

শুধু নদীর বুক ধরে কেন সামনের বড় কাঁচা রাস্তা দিয়েও যাওয়া-আসা করে। সন্ধের পরে এ বাড়ির ত্রিসীমানাতেও তো কোনও মানুষজন আসে না। পুরো এলাকাটাই তখন বন্যপ্রাণীদের দখলে চলে যায়।

তারপর বলল, বল কী দেখলি?

বালিতে শম্বরের পায়ের দাগ দেখলাম, কোটরা হরিণ, চিতল হরিণ, শজারু বলেই বলল, শজারুকে হিন্দিতে কী যেন বলে?

তিতির বলল, সাহিল।

হ্যাঁ সাহিল। তারপর সাপের যাওয়ার দাগ, নানা পাখির পায়ের দাগ। কিন্তু একটা জন্তুর পায়ের দাগ দেখলাম তেমন দাগ আজ অবধি কোনও জঙ্গলেই দেখিনি।

কোনও জঙ্গলে মানে?

মানে, ভারতের বা আফ্রিকার।

ঋজুদা চিন্তিত ভটকাইকে দেখে হেসে ফেলল।

ভটকাই তাড়াতাড়িতে বলল, মনে কোরো না আমি একাই দেখিনি। তিতির এবং রুদ্র তোমার দুই ভাস্টলি এক্সপিরিয়েন্সড ওয়ার্ল্ড-ট্র্যাভেলড সাগরেদরাও দেখেনি।

ঋজুদা এতক্ষণে হয়তো ভাবছিল আমরা, ভটকাই ওর সঙ্গে মজা করছি। বলল, সত্যি নাকি রে?

সত্যি!

আমি আর তিতির সমস্বরে বললাম।

দাগটা কীরকম। পাগ-মার্ক না হুফ-মার্ক?

হুফ মার্ক। তিতির বলল। হুফ মার্ক যে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই।

গ্রামের গোরু-মোষের পায়ের দাগ দেখে থাকবি নিশ্চয়ই।

তাহলে কি আমরা চিনতে পারতাম না?

নয় বলছিস?

তারপর একটু ভেবে বলল, তাহলে সম্ভবত নীলগাই-এর পায়ের দাগ দেখেছিস।

আমি বললাম, নীলগাইয়ের পায়ের দাগও আমাদের চেনা।

হুমম-ম-ম।

ঋজুদা বলল। তারপর বলল, দাঁড়া এক ফিল পাইপ খেয়ে নিই। বুদ্ধি ঘুলিয়ে দিলি তোরা।

তারপরই বলল, হাতির পুরীষ না কীসের কথা বললি তোরা। কিন্তু হাতি তো এ অঞ্চলে নেই।

একটাও নেই?

না, একটাও নেই। তবে কয়েকবছর বাদে বাদে পানুয়ানা ব্লাড় থেকে কোনও হাতি দলছুট হয়ে রোগ’ হয়ে চলে আসে। তারা রে-রে-রে করে রীতিমতো জানান দিয়েই আসে। বাড়ি-ঘর গাই-বয়েল ভেঙে, আছড়ে মেরে তাণ্ডব নৃত্য করতে করতে যায়। এ অঞ্চলে হাতি এসেছে অথচ স্থানীয় মানুষ খোঁজ রাখে না এমনটি হতেই পারে না।

তাহলে কীসের পুরীষ?

তাই তো ভাবছি।

তারপরেই বলল, আচ্ছা, কাল সকালে এক কাপ করে চা খেয়েই বেরিয়ে পড়ব তোদের সঙ্গে। ব্যাপারটা ইনভেস্টিগেট করতে হচ্ছে। সময় তো আর বেশি নেই। আমায় পনেরো তারিখে ব্যাঙ্গালোরে যেতেই হবে। এই রহস্যের উন্মোচন পনেরো তারিখের মধ্যেই করতে হবে যে করে হোক।

আর যদি না করা যায়?

তাহলে হবে না। মানে আমাদের দ্বারা হবে না। অন্য কেউ করবেন হয়তো পরে। সংসারে সব অঘটনের রহস্য উদঘাটনই যে আমাদেরই করতে হবে তারই বা কী মানে আছে? তা ছাড়া আমাদের চেয়ে বিদ্বান বুদ্ধিমান মানুষ তো কম নেই এই ভারতভূমে। আমরাই কি একমাত্র তালেবর?

সেটা ঠিক। কিন্তু কখনও তো তুমি হারোনি।

একবার না-হয় হার স্বীকার করেই দেখা যাক। Failures are the pillars of success. বুঝেছ ভটকাইচন্দ্র।

তারপরই বলল, এবারের খাদ্য পানীয় সম্বন্ধে ভটকাই-এর একেবারেই ইন্টারেস্ট দেখা যাচ্ছে না। কী ব্যাপার বল তো রুদ্র। ওর শরীরটরির খারাপ নাকি?

করে মরি তোমাদেরই জন্যে আর তোমরাই আমাকে লাফিং স্টক করো। তাই এবারে ইচ্ছা করেই ওদিকে যাচ্ছি না। ওদিকে না গেলেও মিশিরজি, কিচেন ম্যানেজার মি. শর্মা এবং অন্যেরা মিলে বন্দোবস্তের কোনও ত্রুটি রাখেননি। তবে তারাই আমাকে একটু কনসাল্ট করেছিলেন লাঞ্চ-এর পরে। কী করে লোকে বুঝে যায় কে জানে!

ভালই তো, আমরা তো তোমাকে চিনলাম না। যারা চিনলে ভাল তারাই তো চিনেছেন। তিতির বলল।

তাই? ভটকাই বলল উজ্জ্বল মুখে।

ঋজুদা হাসি হাসি মুখে ভটকাইয়ের দিকে চেয়ে বলল, রাতে কী হচ্ছে?

যা ঠান্ডা পড়েছে, রাতের মেনুটাই আসল।

এখনই কী ঠান্ডা! পরে ঠান্ডা বাড়বে।

তিতির বলল, তুমি জানলে কী করে।

ছেলেবেলা থেকে সেই জেঠুমনির সঙ্গে যখন বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতাম তখন থেকেই জেনে আসছি। জানুয়ারি মাসের ২৩ থেকে ৩১ পূর্ব ভারতের বনে পাহাড়ে বৃষ্টি হবেই আর তার সঙ্গে নামবে কনকনে ঠান্ডা। বৃষ্টি মানে, মুষলধারের বৃষ্টি নয়। তা হলেও সামান্যক্ষণের জন্যে হবে। তারপরই একটা উথাল-পাথাল হাওয়া বইতে থাকবে ফুল পাতা আর বনগন্ধ উড়িয়ে নিয়ে আর সঙ্গে ফিসফিসে বৃষ্টি। ঠান্ডা পড়বে তখন, যাকে বলে ঠান্ডা।

তারপরই বলল, সে যাই হোক, ভটকাই কী বলে শোনা যাক আজকের রাতের মেনুর কথা।

ভটকাই গলাটা খাঁকরে নিয়ে বলল, মুলিংগাটানি স্যুপ। তবে তিতির ভালবাসে না বলে তিতিরের জন্যে চিকেন ব্ৰথ।

তারপর?

তারপর ছাতুর লিট্টি, বেগুনভাত্তা সঙ্গে কঁচালঙ্কা, কঁচা পেঁয়াজ, টোমাটো কুচি। সঙ্গে ময়ুরের কাবাব

কীসের কাবাব?

চমকে উঠে ঋজুদা বলল।

ময়ুরের।

তুই জেলে যাবি এবং আমাদেরও পাঠাবি?

ভারতবর্ষ এক বিচিত্র দেশ ঋজুদা। এই এককালীন রাজ-এস্টেটের মধ্যে মানুষ মারলেও যেমন জেল হয় না, ময়ূর মারলেও হয় না। ‘ইয়ে সব হামারা রাজ হ্যায়। মহান ভারতের ভিতরে এখনও এরকম অনেক ইন্ডিপেন্ডেট স্টেট বেঁচে আছে। কয়লা রাষ্ট্রায়ত্ত হলে কী হয়, খোঁজ নিয়ে দেখো এখনও অনেক জায়গাতে বে-আইনি খাদান চালু আছে, বিশেষ করে ওপেন কাস্ট মাইন। বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান, জগজন মানিবে বিস্ময়।

ঋজুদা ভটকাইয়ের রসিকতাতে মোটেই গলল না। বলল, ময়ূর মারল কে?

তারপরই আমার দিকে ফিরে বলল, তুই তোর পিস্তল ওকে দিয়েছিলি? আমি সজোরে মাথা নাড়িয়ে বললাম, মাথা খারাপ।

তবে?

তবে আমি কী করে জানব?

ভটকাই বলল, সবই খাবার টেবিল-এ বসে মিশিরজি আর শর্মাজির কাছে শুনো। বিনা কারণে আমাকে দুষছ কেন? তবে হ্যাঁ। যখন ময়ূরের মাংসর কথা শর্মাজি বললেন দুপুরে, আমি মানা করিনি কারণ ঋজুদা তার টাগরার সঙ্গে জিভ লাগিয়ে কতবার বলেছে, আহা! বেস্ট হোয়াইট মিট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড। তখন আমার জিভে জল এসেছে বারবার। তা ছাড়া অন্যায়টা তো আমি করছি না। ওঁরা কারওকে দিয়ে করাচ্ছেন হয়তো। হয়তো সেই মৌলবিই হবেন। তা সে সব ওদের ব্যাপার।

তারপর বলল, যাই হোক ঋজুদা, কথা দিচ্ছি, এই ফার্স্ট আর এই লাস্ট। এর পরে এ জীবনে এই অন্যায় কর্ম আর করব না। নিজে মারার কথা তো ওঠেই না অন্যে মারলেও তাকে জেলে দেব। মাংস ফেলে দেব।

ঋজুদার মুড অফ হয়ে গেছিল। বারবারই মাথা নাড়ছিল আর বলছিল, ন্যাশনাল বার্ড! কী অন্যায়।

তারপরে বলল, আরে আমরা কি আজ খেয়েছি? তখন তো ন্যাশনাল বার্ড ছিল না। আমি তখন হাফ-প্যান্ট পরতাম। রুদ্র আর তিতিরও তো খায়নি। কই? ওদের তো তোর মতো লোভও হয়নি খাবার!

ভটকাই মুখ নিচু করে কাধ শ্রাগ করে বলল, ওরা ভাল, আমি খারাপ।

তিতির ওই সিরিয়াস পরিবেশের মধ্যেও হঠাৎ খুক করে হেসে উঠল। এবং হাসি সাংঘাতিক ছোঁয়াচে। তিতির হাসতেই আমরাও হেসে ফেললাম, মায় ঋজুদা পর্যন্ত।

.

০৪.

আমরা ফাগুয়ারা ভিলাতে ফিরে যেতেই আমাদের কাছে বিদায় নিয়ে শাধূলনারায়ণ সিং চলে গেলেন। গাড়িতে ঝুমরি তিলাইয়ার উলটোদিকে ডোমচাঁচে গিয়ে ক্রিশ্চান মাইকা ইন্ডাস্ট্রিজ-এর গেস্ট হাউসে রাতটা কাটাবেন। তারপর ভোর রাতের গাড়ি ধরে কলকাতা চলে যাবেন। তারপর রাতের বম্বে মেল ধরে রায়পুর। তাঁর স্ত্রী দিয়াদেবীর এক বান্ধবীর অসুস্থতার খবর শুনে উনি অনেক আগেই চলে গিয়েছিলেন। তাঁর মন এমনিতেই ভারী খারাপ। ভীষ্মনারায়ণের তিনি খুবই কাছের মানুষ ছিলেন।

শার্দুলনারায়ণ বললেন, ঋজুদার হাত ধরে, আপনাকে কী আর বলব। আমার দেবতুল্য দাদার হত্যাকারীকে যদি খুঁজে বের করতে পারেন তবে আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। ফিস-এর জন্যে আপনি চিন্তা করবেন না।

বলেই বললেন, আমি বরং আপনাকে একটা ব্ল্যাঙ্ক চেক দিয়ে যাচ্ছি।

ঋজুদা হাত ধরে বললেন, ওসব কোনও ব্যাপারই নয়। কন্দর্পনারায়ণকে আমি বহুদিন হল জানি। আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে। এই দুঃখবহ ঘটনার সূত্রে আপনাদের সকলের সঙ্গেও চেনা হল। তারপরই বলল, প্রয়োজনে আপনার কাছে যেতে হতে পারে। হয়তো না-জানিয়েই রায়পুরে গিয়ে উপস্থিত হব। দিয়াদেবীর সঙ্গে একবার দেখা করতে পারলে আমার কাজের খুব সুবিধা হত।

শার্দুলনারায়ণ যেন কেমন মিইয়ে গেলেন এই কথাতে। বললেন, আমার স্ত্রী যদিও অধ্যাপিকা কিন্তু একেবারেই মিশুকে নন। কারও সঙ্গেই দেখা করতে চান না। যদি তেমন প্রয়োজন ঘটে তবেই আসবেন। ওঁর ব্যবহারে যেন ওঁকে ভুল বুঝবেন না। তবে আগে জানিয়ে আসবেন। উনি তো গোয়ালিয়রে থাকেন। ওঁকে আসতে বলতে হবে।

ঋজুদা বলল, আপনার অত অ্যাপলজেটিক হবার কোনও দরকার নেই। সমস্ত রকম মানুষের সঙ্গেই মেশা আমার কাজ। আমি একটুও ভুল বুঝব না ওঁকে। এবং নিতান্ত প্রয়োজন না পড়লে ওঁকে বিরক্তও করব না। আমিও গোয়ালিয়রে যেতে পারি ওঁর রায়পুরে আসার অসুবিধে থাকলে।

রাতে খেতে বসে ঋজুদা ইচ্ছে করে কেয়ারটেকার মিশিরজি এবং কিচেন ম্যানেজার শর্মাকে আপারহ্যান্ড দিল। ওরাই বক্তা আর আমরা শ্রোতা। মালিকদের মধ্যে মাত্র একজন ছিলেন। তিনিও আজ চলে গেলেন তাই এখন ওঁরাই মালিক। মুখে একবারে খই ফুটছে।

সব মানুষই কথা বলতে ভালবাসেন শুধু ইন্ধন জোগানো চাই। দুজনের মধ্যে কে বেশি জানেন তা নিয়ে যেন প্রতিযোগিতা চলছে। ঋজুদা তো বটেই আমরাও ওঁদের পেট থেকে এই শুক্ল পরিবারের সব ভাই এবং তাদের পরিবার সম্বন্ধে যত কথা জানা যায় সব জেনে নিচ্ছিলাম।

সবচেয়ে আগে ময়ূর-রহস্য উন্মোচন করা হল। যা ভেবেছিলাম তাই। মৌলবি সাহেবকেই ভার দেওয়া হয়েছিল তবে ময়ূর পথ পাশের ঝোপে-ঝাড়ে তো তত দেখা যায় না তাই মৌলবি সাহেব তার ভাতিজা মুনতাজারকে দিয়ে মারিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন। মুনতাজারও ভাল শিকারি। মৌলবি সাহেবের ভাতিজা হলেও ওর নাকি অন্য নানা ধান্দা আছে। বোঝা গেল, তাকে মিশিরজি বা শর্মাজি বিশেষ পছন্দ করেন না।

মিশিরজি বলেছিলেন, ছেলেটা নাকি খুব উদ্ধতও। মৌলবিকেও মানে না। এখানে সব সময়ে থাকেও না। হাজারিবাগ, কোডারমা, গেয়া, চাতরা, নওয়াদা, গিরিডি এই সব অঞ্চলেই ঘুরে বেড়ায়। মুম্বাইও যায় মাঝে মাঝে। নানারকম খতরনাক লোকজনের সঙ্গে ওর মেলামেশা। কোনও মালিকই ওকে পছন্দ করে না, তবে বড়বাবু কন্দর্পনারায়ণ ওকে ছোটবেলা থেকে জানেন এবং নিজের কোনও সন্তান না থাকাতে মুনতাজারকে ছেলেবেলাতে অনেক চকলেট খাইয়েছেন, খেলনা দিয়েছেন, সাইকেল এবং এয়ার-গান কিনে দিয়েছেন। পুরনো স্নেহের কিছুটা এখনও রয়ে গেছে। বড়বাবু ওকে টাকা-পয়সাও দেন বলে ওঁদের ধারণা। অন্য মালিকেরা চান না যে মুনতাজার এ প্রাসাদে আসুক। ছোট রানিমা, মানে, দিয়াদেবী তো ওকে একেবারেই পছন্দ করেন না। দিয়াদেবী অত্যন্তই সুন্দরী। অনেকটা কারিশমা কাপুরের মতো।

শর্মা সাহেব যোগ করলেন। তাঁকে নাকি কী একটা খারাপ কথা বলেছিল কখনও মুনতাজার। সেই থেকে বড়বাবুই বারণ করে দিয়েছেন মুনতাজারকে ফাগুয়ারা ভিলাতে আসতে, যতক্ষণ ছোট রানি এখানে থাকেন। কন্দর্পনারায়ণের স্ত্রীর নাম রোজি কেন? তিতির শুধোল।

ভটকাই-এর ওই pertinent question-এর উত্তরে যা শোনা গেল তা সত্যিই অবাক হওয়ারই মতো। এখানকার নিরামিষাশী, ব্যবসা-অন্তপ্রাণ, দেব-দেবীতে মনপ্রাণ নিবেদিত কন্দর্পনারায়ণ নাকি যৌবনে অন্যরকম ছিলেন। এ নিয়ে রাজা রাজরাজেন্দ্রর নারায়ণের সঙ্গে তাঁর মতান্তর লেগেই থাকত। রোজি আসলে মুম্বাই-এর মেয়ে। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। মুম্বাই-এর একটা নামী নাইট ক্লাব-এর ক্রুনার ছিলেন তিনি। গান গাইতেন। পপ গান। বিটলসদের গান। কন্দর্পনারায়ণও তখন রেগুলার বার ক্রলার। এবং নানা নাইট ক্লাব-এ তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। ওই বিয়েতে রাজাসাহেব এবং রানিসাহেবার একটুও মত ছিল না। কিন্তু কন্দর্পনারায়ণ অটল। শেষে রাজাসাহেব এই শর্তে বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন যে রোজি বহুজি কোনওদিনও এ পরিবারের কোনও প্রাসাদে বা মেহাল-এ ঢুকতে বা থাকতে পারবেন না। তার সন্তান হলে তারা এই পরিবারের সব সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে। কলকাতাতে রাজাসাহেব আলাদা বাড়ি কিনে দিয়েছিলেন রোজি বহুজির জন্যে, এবং বম্বের জুহুতে সমুদ্রতটের উপরে একটা ফ্ল্যাটও কিনে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে কন্দর্পনারায়ণ বড় ভাই হিসেবে অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলেও তার স্ত্রীর সঙ্গে পরিবারের কারওরই কোনও সম্পর্ক ছিল না। আজও নেই। রোজি বহুজির কোনও খবরও মানে এর বেশি খবর ওঁদের কারওরই জানা। নেই।

রাজা রাজরাজেন্দর শুক্লর কোন ছেলে তার সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন?

তিতির জিজ্ঞেস করল।

মিশিরজির বয়স প্রায় সত্তর মতো। এ বাড়িতে জিম্মাতে আছেন আজ চল্লিশ বছরেরও বেশি। বললেন, মেজছেলে ভীষ্মনারায়ণ। কত দেখে-টেখে বিয়ে দিলেন অনসূয়াদেবীর সঙ্গে রূপে গুণে সরস্বতী-লক্ষ্মীও বটেন–তার বাবার একমাত্র মেয়ে ছিলেন–মুম্বাই-এর নামী জহুরি ছিলেন ওঁর বাবা। কিন্তু বিয়ের এক বছরের মধ্যেই তিনি চলে গেলেন। তাতে যেন মেজকুমারের প্রতি রাজা ও রানিমার স্নেহ আরও উথলে উঠল। আর হবেই বা না কেন? অধ্যাপক হিসেবে তার খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। অন্য ছেলেরা ব্যবসা করে বড়লোক হয়েছিল বটে অনেক কিন্তু মান তো অত পাননি। স্বদেশে পূজ্যতে রাজা বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে। অমন মানুষকে কেউ মারতে পারেন এ কথা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়।

রোজি মেমসাহেব, থুড়ি, রানি এখন কোথায় থাকেন? কলকাতা? না মুম্বাই?

ভটকাই জিজ্ঞেস করল।

জানি না।

ওঁর খবর কে রাখেন?

কেউই রাখে না। যতদূর জানি বড় রাজকুমারও রাখেন না। তবে টাকা পাঠিয়ে যান অনবরত। বড় রাজকুমারের মনে শান্তি নেই। ডিভোর্স করতে চেয়েছিলেন কিন্তু রোজি মেমসাহেব ডিভোর্স দেবেন না। দেবেনই বা কেন? সাহেব চোখ বুজলে সবই তো তার।

উনি মুম্বাইতেই থাকেন শুনছি। তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে মুনতাজার।

মুনতাজার?

আমরা সকলেই চমকে উঠলাম।

ওঁরা অবাক না হয়ে বললেন, পোয্য নেননি বটে কিন্তু ছেলেবেলা থেকে বড় রাজকুমার পুত্রজ্ঞানেই তো দেখেছেন মুনতাজারকে। তা ছাড়া, রোজি মেমসাহেবও ওকে পছন্দ করেন।

মেমসাহেবের বয়স এখন কত?

বেশি নয়। বড় রাজকুমারের চেয়ে প্রায় বিশ বছরের ছোট তো। বিয়ের সময়ে তো শুনেছি সতেরো বছর বয়স ছিল। এখন হবে চল্লিশ-টল্লিশ।

অ।

ভটকাই এমন মুরুব্বিয়ানার সঙ্গে ‘অ’ টা উচ্চারণ করল যে আমরা সকলেই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম।

তিতির বলল, তা মুনতাজারের চাচা মোরগা-যম মৌলবি সাহেব তো সাইকেলে করেই ঘোরাফেরা করেন। মুনতাজারের বাহন কী? না কি পায়ে হেঁটেই এত সব জায়গা চষে বেড়ায়।

না, তা কেন? তার একটা ঝিং-চ্যাক মোটর সাইকেল আছে এখানে চড়বার জন্যে। যা কিছু দুষ্কর্ম মোটর সাইকেলে চড়েই করে। তারপর বম্বে সিনেমার স্টাইলে উধাও হয়ে যায়। মোটর সাইকেলই বা কেন এয়ারোপ্লেন ছাড়া চালাতে জানে না এমন কোনও যানই নেই। কানাঘুষোতে শুনেছি, ওর চড়ার জন্যে কলকাতা ও মুম্বাইতে বড় রাজকুমার জিপ এবং গাড়িও রেখেছেন। তবে সেসব নিয়ে এখানে কখনও আসে না। এখানে থাকেই বা কতটুকু সময়! ডুমুরের ফুল সে। থাকে না বলে আমরাও নিশ্চিন্ত থাকি। তাকে আমরা সকলেই ভয় পাই। সে করতে পারে না এমন কোনও কাজ নেই।

কী রকম?

এই তো গত বছর মেজকুমার ভীষ্মনারায়ণের এক বন্ধু আর স্ত্রী তাদের প্রিয় সাদা একটা পমেনারিয়ান কুকুর নিয়ে এখানে বেড়াতে এসেছিলেন মেজ রাজকুমারের সঙ্গে। বিকেলে কুকুরটিকে নিয়ে ওঁরা তিনজনে বেড়াতে বেরিয়েছেন, মুনতাজার আসছিল নদীর দিক থেকে মোটর সাইকেলে চড়ে। কুকুরটিকে পছন্দ হওয়াতে সে কোলে তুলে নিয়ে বাইক হাঁকিয়ে চলে গেল। আমরা সকলে লজ্জাতে মরি। মেহমান বলে কথা! মেজকুমারও মৌলবিকে দিয়ে মুনতাজারকে ডেকে পাঠালেন। প্রথমে আসেনি। বলেছিল, আমি শুক্ল পরিবারের বান্দা নই। তারপরে কী মনে করে এসেছিল–এসে মেজকুমারকে বলেছিল আপনার দোস্তকে জিজ্ঞেস করুন কত দিয়ে কিনেছেন কুকুরটাকে। দাম আমি দিয়ে দেব।

স্তম্ভিত মেজকুমার বলেছিলেন ভালবাসার কী দাম হয়? কুকুরটার দামের চেয়ে ভালবাসার দাম যে অনেক বেশি।

মুনতাজার বলেছিল এ দুনিয়াতে সব ভালবাসারই দাম হয়। পয়সা দিলে পাওয়া যায় না এমন কিছুই নেই এখানে। আমি তো কুকুরের মালকিনকেও তুলে নিয়ে যেতে পারতাম। তাকেও তো আমার পছন্দ হয়েছিল। ভারী নমকিন। কিন্তু তা তো নিইনি।

মেজকুমার বন্ধুর সামনে মুখ নিচু করে আমাকে বললেন, মিশিরজি, ও লোকটা যেন আর কোনও দিন এই ফাগুয়ার ভিলার হাতার মধ্যে না ঢোকে, বলে দেবেন।

মিশিরজি বললেন।

তারপর?

তারপর আর কী? আমি কিছু বলার আগেই মুনতাজার বলল, আমি আসতে চাইলে আমাকে আটকায় এমন কে আছে? দয়া করে আমি আসি না, এই যা। আপনাদের ছোট বহু দিয়ারানিকেও আমার খুব পছন্দ। সে এলে, তাকে একটু দেখবার জন্যেই আসি। কিন্তু সে এত নিষ্ঠুর যে এলেও দেখা দিতে চায় না।

মেজকুমার বললেন, মিশিরজি, বন্দুকটা কোথায়? বন্দুকটা আনুন। আমি এখুনি এর বদতমিজি শেষ করব। তারপর সারাজীবন জেল খাটতে হয় কি ফাঁসি যেতে হয় তাই যাব।

মুনতাজার মেজকুমারের পায়ের কাছে থুথু ফেলে বলেছিল, বন্দুক থাকলেই কি হয় নাকি? চালাতে জানতে হয়।

বলেই, সে চলে গেছিল।

ভটকাই বলল, এত বড় কথা। ভাগ্যিস আমাদের সঙ্গে তার দেখা হয়নি। হয়ে গেলে কুরুক্ষেত্র বাঁধত।

তিতির বলল, ময়ূর মারে, এ তো অ্যান্টিন্যাশনাল। ছিঃ!

মি.শর্মা বললেন, জুগনু নামের একটা রাখাল তার ঘরে না-ফেরা গোরু খুঁজতে খুঁজতে এক রাতের বেলা জঙ্গলে ঢুকেছিল। মুনতাজার তার জিভটা কেটে দেয়। জুগনু বোবা হয়ে গেছে।

মিশিরজি গভীর উম্মার সঙ্গে বললেন।

আর তারপরও সেই মানুষ মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়ায়, আপনাদের সঙ্গে ধমকে কথা বলে, আপনাদের বাড়িতে সে আসে!

না, বাড়িতে সেই কুকুরের ঘটনার পরে আর আসেনি। আর তার সঙ্গে দেখাই হয় না, তার কথা কী হবে।

আপনাদের গাঁয়ের মানুষগুলো মানুষ নয়।

ভটকাই ভীষণ রেগে মুঠি পাকিয়ে বলল।

হয়তো তাই।

মিশিরজি বললেন।

তারপর বললেন, গাঁয়ের মানুষেরা গরিব, খুবই গরিব, কোনওরকমে দিন। গুজরান করে বেঁচে থাকে।

ঋজুদা এতক্ষণে বলল, ওরা তো আপনাদেরই প্রজা ছিল এত বছর। জমিদারি বিলোপের পরে না-হয় জমিদারি গেল এই দেশে। কিন্তু ওদের গোলামি তো শেষ হয়নি। আপনারা ওদের মানুষের মর্যাদা দিলে খাওয়া-পরার সুবন্দোবস্ত করলে ওরা মানুষের মতো বাঁচত, মানুষ হত, এইভাবে অসম্মানের মধ্যে নিজেদের ধর্মের চরম অপমান সহ্য করেও খাওয়া-পরার জন্যে, নিছকই নিশ্বাস নেবার জন্যে বাঁচত না, এমন মনুষ্যেতর জীবন বইত না।

শর্মাজি বললেন, আমরা তো কর্মচারী, আমরা কী করব।

কর্মচারী যেমন, তাঁদের মনিবও তেমনই জোটে।

ভটকাই ফুট কেটে বলল।

তিতির বলল, ভটকাই এঁদের বলে দে কাল থেকে আমরা ডাল-ভাত আর একটা সবজি খাব দুপুরে আর রাতে স্রেফ খিচুড়ি। এসব শুনে খাওয়া-দাওয়ার স্পৃহা চলে গেছে।

তারপরই স্বগতোক্তি করল, একটা লাফাঙ্গা, সে তালিবানিই হোক আর যাই হোক, পুরো বস্তি, পুরো রাজবাড়িকে এমনভাবে টেররাইজ করে রাখবে এ সহ্য করা যায় না।

তারপরই খাওয়ার টেবিল ছেড়ে আমরা উঠে এলাম।

থানা কী করে? এখানে কি থানাটাই নেই?

আমি জিজ্ঞেস করলাম ঋজুদাকে।

থানাই যদি কিছু করত তবে কি মুনতাজারের অত বাড় বাড়ত?

ঋজুদা বলল।

মিশিরজি এবং শর্মাজি দুজনেই কিচেনের ভিতরে গেছিলেন। ওরাও বোধহয় এখন পস্তাচ্ছেন আমাদের এত কিছু বলে ফেলে।

ঋজুদা গলা নামিয়ে বলল, আমরা এখানে দাঙ্গা-মারামারি করতে আসিনি। যাদের যা যোগ্যতা তারা সেরকমই জীবন পায়। ক্লীব, ভীরু, নিজস্বার্থপরায়ণ মানুষদের এমন কুকুর, বেড়ালের মতোই বাঁচতে হবে। এরা নিজেদের হাতে-পায়ে বল সঞ্চার না করলে বাইরে থেকে এসে আমরা এদের বলীয়ান করতে পারব না।

ভটকাই বলল, তাহলে আমরা কী করব?

এখান থেকে আমরাও চলে যাব। কন্দর্পনারায়ণ তো আমাকে এ আপদের কথা ঘুণাক্ষরেও বলেননি অথচ দেখা যাচ্ছে এই ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন তারই হাতে তৈরি, তার পুত্রসম। এ তো মহা গোলমেলে ব্যাপার দেখছি।

খাওয়া-দাওয়ার পর রাতে ঋজুদার ঘরে গিয়ে আমরা একটু নিরিবিলিতে পরামর্শ করলাম। ঋজুদা বলল, কাল বিকেলেই আমরা এখান থেকে চলে যাব। আমার এমনিতেই ফিরতে হত। এখানে না হচ্ছে বিশ্রাম–মানে নিরবচ্ছিন্ন বিশ্রাম–না হচ্ছে গোয়েন্দাগিরি। তা ছাড়া কন্দর্পনারায়ণের এই ব্যাপারটা আমার ঘাড়ে চাপানোর রকমটা গোড়া থেকেই আমার পছন্দ হয়নি।

চলে যাব?

হতাশ গলাতে ভটকাই বলল।

চলে যাব, তবে কাল সকালে তোদের সঙ্গে নদীতে যাব। কী সব রহস্যময় পদচিহ্ন এবং পুরীষ দেখেছিস তোরা বললি তা একটু আমার দেখা দরকার।

কেসটা ছেড়ে দেবে ঋজুদা? তাহলে ভীষ্মনারায়ণের মৃত্যুর তদন্ত হবে না আর মুনতাজার না কে সে হনুমানটা এখানে এমন করেই তাণ্ডব করে যাবে?

সেসব কন্দর্পনারায়ণের পরিবারের ব্যাপার। সব দায়িত্ব কি আমার নাকি? না আমাদের?

কিন্তু কেসটা মাঝপথে ছেড়ে দিলে কী হবে?

কী হবে? গোয়েন্দার কি অভাব আছে কি? কন্দর্পনারায়ণের পয়সা আছে। পয়সা ফেললে গোয়েন্দার অভাব কী?

না, তা নয়, আমতা আমতা করে তিতির বলল।

ঋজুদা বলল, ভীষ্মনারায়ণের হত্যা রহস্য উদঘাটন করি আর নাই করি ওই আউট-ল মুনতাজারকে একটু ঢিট করতে আসব একবার শিগগির। তবে এখানে উঠব না।

কোথায় উঠবে?

পিতিজ বনবাংলোতে। একেবারে নদীর উপর ছোট্ট কিন্তু সুন্দর বনবাংলো আছে। দুটি বেডরুম, মাঝে ড্রয়িং কাম ডাইনিং। বারান্দাটা চওড়া এবং ভারী সুন্দর। কাজমি সাহেব এখন হাজারিবাগের ডি. এফ. ও.। কলকাতাতে ফিরেই ফোনে ওঁকে বলে দেব রিজার্ভেশনের জন্যে।

কোন কাজমি? যিনি পালামৌতে ছিলেন? সাউথ কোয়েলে?

আমি বললাম।

যাঁর জিপ ল্যান্ডমাইনে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল জঙ্গি ছেলেরা? ড্রাইভার মারা গেছিল?

তিতির বলল।

হ্যাঁ। সেই কাজমি সাহেবই।

তারপর বলল, কাটা দিয়ে কাটা তুলব আমি। এই ছেলেদের দিয়েই আমি ওই মুনতাজারকে শায়েস্তা করব।

গুপ্তচরদের সঙ্গে এদের যোগ নেই তো?

ভটকাই উদ্বিগ্ন গলাতে বলল।

না। ওরা দেশদ্রোহিতা করবে না। ছেলেগুলো ভাল।

তুমি জানলে কী করে!

তিতির বলল।

আমার সঙ্গে ওদের একটা দলের দেখা হয়েছিল।

কোথায়? আমাদের তো বলোনি।

আমি বললাম।

পালামৌর কেঁড় বাংলোতে। বছর পাঁচেক আগে একা ছিলাম কেঁড় বাংলোতে। একটা জরুরি লেখা লিখতে গেছিলাম। বিদ্যুৎ ছিল না। সারাদিন, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত লিখতাম তারপর সন্ধের পরে চান করে বারান্দাতে বসে থাকতাম থামের গায়ে পা তুলে দিয়ে। সূর্য ডুবত, চাঁদ উঠত আর এম সি সি-র ছেলেরা হাততালি দিয়ে দিয়ে দারুণ ছন্দোবদ্ধ এবং মহড়া-দেওয়া সমবেত সংগীত গাইত জঙ্গলের মধ্যে বসে। একদিন ওদের কাছে গিয়ে পৌঁছলাম একা।

তোমাকে কিছু করল না?

আমি বললাম।

না তো। আমাকে বসতে দিল বাঁশের খোঁটার মোড়াতে। বোঝা গেল যে, রুদ্র রায়ের কল্যাণে ওরা আমাকে চেনে। আমার সম্বন্ধে নানা লেখা ওরা পড়েছে। তা ছাড়া কোজাগর’ও পড়েছে ওরা। কোজাগর’-এ নকশাল ছেলেদের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থন চাপা তো ছিল না।

তারপর বলল, তখনই ওরা বলেছিল, যে কোনও প্রয়োজনে ওদের সঙ্গে যেন যোগাযোগ করি আমি। একটা পাসওয়ার্ডও দিয়েছিল। যে কোনও গাঁয়ের পান বিড়ি বা চায়ের দোকানে সেই পাসওয়ার্ড বললেই ওরা আলাদা করে ডেকে নিয়ে আমার কথা শুনবে তারপর রাঁদেভু পয়েন্ট ঠিক করে নিয়ে দেখা করবে।

পাসওয়ার্ড কী?

ভটকাই বলল।

তোকে বলব কেন? তুই একটা নিরেট হচ্ছিস দিনে দিনে-বুদ্ধি-সুদ্ধি সব ব্যাকগিয়ারে দিয়ে রেখে মহানন্দে আছিস।

ভটকাই লজ্জা পেল।

আমি বললাম, তা ছাড়া, পাঁচ বছরের পুরনো পাসওয়ার্ড এখন বাতিলও হয়ে গেছে নিশ্চয়ই।

.

০৫.

খুব ভোরে এক কাপ চা খেয়েই আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম। দারুণ ঠান্ডা। যদিও তেইশে জানুয়ারি ধারে কাছে নেই। নদীর জল থেকে ফ্রিজের দরজা খুললে যেমন ঠান্ডা ধোঁয়া বেরোয় তেমনই ধোঁয়া বেরোচ্ছে, যদিও জল খুবই কম গভীর।

নদীর বালির দিকে তাকাতে তাকাতে আমরা হেঁটে যাচ্ছি। যার চোখে যে জানোয়রের পদচিহ্ন পড়ছে, কথা না বলে অন্যদের তা আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে সে।

একটা মস্ত ভালুকের পায়ের দাগ দেখা গেল। যা আগের দিন দেখা যায়নি। তার আধ মাইলটাক যাবার পরে সেই কিম্ভুত জানোয়ারের পায়ের দাগও দেখা গেল। বেশ টাটকা দাগ। হয় রাতে গেছে, নয় কিছুক্ষণ আগে।

ঋজুদাকে তিতির আঙুল দিয়ে দেখাল দাগটা। ঋজুদা মনোযোগ সহকারে দেখল। তারপর সেই দাগ অনুসরণ করে এগিয়ে চলল। দাগটা গিয়ে নদীর উলটোদিকে একটা মস্ত বড় পিপ্পল গাছের নীচে থেমেছে। সেখানে জানোয়ারটা ঘুরেছে-ফিরেছে, অনেকক্ষণ ছিল হয়তো ওই একই জায়গাতে। এবং সেখানেই, যাকে আমরা হাতির পুরীষ বলে ভেবেছিলাম, তেমন পুরীষও পড়ে আছে। বেশ টাটকাই।

ঋজুদা সেই গাছতলাতে ঘুরে-ফিরে আমাকে বলল, জুতোজোড়া খুলে ফ্যাল তো!

এই ঠান্ডায় খালি-পা হব? কী করব?

জুতো খুলে এই গাছটাতে ওঠ। যা বলছি, তাই কর। উপরে উঠে দ্যাখ তো ফাগুয়ারা ভিলার পেছনের দোতলার খোলা বারান্দাটা দেখা যায় কি না! যদি দেখা যায়, তবে ভীষ্ম নারায়ণ যে জায়গাতে চেয়ারে বসে বই পড়ছিলেন বলে আমাদের বলা হয়েছে বারান্দার সেই জায়গাটা দেখা যায় কি না?

ঋজুদার কথামতো জুতো খুলে ফেললাম আমি। মোজাজোড়াও খুললাম। খালি পায়ে গাছে চড়তে সুবিধা হবে। তারপর আস্তে আস্তে পিপ্পলগাছটার ওপরে উঠতে লাগলাম। প্রায় পঁচিশ ফিট উঠেছি এমন সময়ে আমার চোখ পড়ল একটা মাচা। তার উপরে গাঢ় সবুজ-রঙা একটা শতরঞ্জি পাতা। দুটো শুকনো কমলালেবু রাখা আছে শতরঞ্জির উপরে আর কিছু শুকনো মেওয়া।

অবাক হয়ে সাবধানে আমি মাচার উপরে উঠে বসলাম। তারপর সামনে তাকিয়ে দেখি, মাচার সামনেটার ডালপালা কিছুটা পরিষ্কার করে হাঁটা। মাচাতে বসে ফাগুয়ারা ভিলার পেছনের বারান্দাটা দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। As a crow flies–হয়তো একশো গজও হবে না। মনে হল। আসলে, বারান্দাটা সেখান থেকে শ’ দুয়েক গজ দূরে হবে।

আমি উত্তেজনাতে হাঁফাচ্ছিলাম। নীচে কেউ কোনও কথা বলছিল না। আমাকে নীচ থেকে দেখাও যাচ্ছিল না।

মাচার উপরে ওই পিপ্পলগাছেরই ডাল কেটে বানানো একটা tripod দেখলাম। যেটার উপরে রাইফেলের ব্যারেল রেখে নির্ভুল নিশানা নিয়ে রাইফেল ছোঁড়া যায়। তার মানে, এইখানে বসেই ভীষ্মনারায়ণকে পরপর তিনটি গুলি ছুঁড়ে, খুন করেছে আততায়ী। মাচার ডানদিকে একটা ফোকর ছিল দুটি ডালের মাঝে। সেখানে কী একটা চকচকে জিনিস চোখে পড়ল। তুলে দেখি, রাইফেলের একটি খালি কার্তুজ। সেটিকে পকেটে চালান করে দিলাম। তারপরে তাড়াতাড়ি নেমে এলাম গাছ থেকে। আমার বুক ধুকপুক করছিল। যদি সেই আততায়ী ফিরে আসে এক্ষুনি–তখন কী হবে? আমরা তো প্রায় নিরস্ত্রই।

কোমর থেকে পিস্তলটা খুলে হাতে নিলাম মাটিতে নেমেই।

ঋজুদা যেন জানেই আমি কী দেখেছি উপরে এমন ভাবে বলল, কী দেখলি?

তুমি যা ভেবেছিলে।

তাই?

বলেই ঋজুদা একটু ভাবিত মুখে উপরে তাকাল। বললাম, মক্কেল ফিরে আসবে আবার। একজোড়া কমলালেবু, মুঠিভর শুকনো মেওয়া, এসব রাখা আছে। মাচার উপরে শতরঞ্জিতে।

তার মানে, আরও কারওকে মারবে।

তিতির বলল।

তুই কী করে বুঝলি?

ঋজুদা বলল।

তাই তো মনে হচ্ছে। এটা আমাদের ধোঁকা দেওয়ার জন্যেও করা হয়ে থাকতে পারে। দেখাবার জন্যে যে সে মাচাতে বসে জানোয়ার শিকার করতেই এসেছিল। কমলালেবু আর মেওয়াটা সেটা প্রমাণ করার জন্যেই রাখা ছিল। ভীষ্মনারায়ণ তো আর দু-একদিন আগে খুন হননি!

ঋজুদা বলল।

তিতির বলল, ঠিক।

তারপর বলল, চল এবার চটপট কেটে পড়ি এখান থেকে। জুতোজোড়া পরে নে রুদ্র। যেই আসুক, সে গাছের নীচে বালির উপরে আমাদের এত জনের জুতোর ছাপ অবশ্যই দেখতে পাবে। এবং আমরা যে তার হাইড-আউট ইনসপেক্ট করতেই এসেছিলাম তাও বুঝতে পারবে।

তিতির বলল, হু।

তারপর, ফিসফিস করে বলল, লেটস ক্লিয়ার দ্য এরিয়া।

আমরা যেদিক দিয়ে এসেছিলাম তার উলটোদিকে এবং নদীর অন্য পাড় দিয়ে। ফেরার পথ ধরলাম সিংগল ফরমেশানে।

তিতির বলল, সব তো বোঝা গেল কিন্তু ওই জানোয়ারটা কী?

কোন জানোয়ারটা?

ঋজুদা বলল।

ওই যে! মিস্টার কিম্ভত, যার পুরীষ দেখলাম, পায়ের দাগ।

ভটকাই বলল।

ঋজুদা হেসে ফেলল। বলল, ইয়েতি।

তিতির রেগে গিয়ে বলল, বলো না ঋজুকাকা?

আমরাও একটু অবাক হলাম।

ঋজুদা বলল, ঘোড়া, যার নাম অশ্ব। তবে রেসের ঘোড়া নয়, বড় ঘোড়া নয়। টাটু ঘোড়া। প্রায় অশ্বেতরের কাছাকাছি। বিভিন্ন প্রদেশের গাঁয়ের হাটে দেখিসনি? দিশি ঘোড়া। কত দেখেছিস আর তার পায়ের দাগ চিনতে পারলি না?

আমরা কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলাম জংলি জানোয়ারের পায়ের দাগের মধ্যে ও দাগ দেখে।

তার মানে, যে আগন্তুক এই পিপ্পলগাছে বসে ভীষ্মনারায়ণ সিংকে গুলি মারে সে তো ঘোড়া করেই যাতায়াত করে।

ভটকাই বলল।

বুদ্ধি খুলেছে তাহলে।

তিতির বলল।

ঋজুদা বলল, তাই তো করবে। হেঁটে গেলে সময় নষ্ট হয় আবার জিপ বা মোটর সাইকেলে এলে আওয়াজ শোনা যায় এই নির্জন জায়গাতে দূর থেকে। তা ছাড়া, জিপ বা মোটর সাইকেল সব জায়গাতে যায় না কিন্তু ঘোড়া স্বচ্ছন্দেই যায়। খুনির বুদ্ধি আছে।

ভটকাই বলল, বোঝাই যখন গেছে তখন আর দেরি কেন? চলো মুনতাজারকে অ্যারেস্ট করে থানাতে দিয়ে আসি।

কেন? মুনতাজার কেন? সাক্ষী প্রমাণ কিছু আছে? এখানে ঘোড়সওয়ার কারা আছে তা বের করতে হবে। থানাতে নিয়ে যাওয়া অত সহজ নয়। তা ছাড়া কোন থানা?

বললাম, চৌপারন?

তিতির বলল, হান্টারগঞ্জ?

ভটকাই বলল, ঘাংড়ি?

ঋজুদা বলল, না, কোনওটাই নয়। এমনকি চাতরাও নয়। থানা বলতে হাজারিবাগ। একেবারে কোতেয়ালি বড় রাস্তাতেওচওকের কাছে।

বলেই বলল, কিন্তু থানায় গেলে কিছুই হবে না। তিতির ঠিক বলেছে। সাক্ষ্য প্রমাণ কী আছে আমাদের? শুধুই surmise! তা ছাড়া মুনতাজারই যে গুলি করেছে তারই বা কী প্রমাণ আছে আমাদের কাছে?

আমরা যখন এই সব কথা বলতে বলতে এগোচ্ছি হঠাৎ চমকে উঠে দেখি, উলটোদিক থেকে তিনি আসছেন। তাঁর আগমন তো নয়, যেন আবির্ভাব।

সঙ্গে সঙ্গে আমরা যে যেদিকে পারি উল্কার টুকরোর মতো ছিটকে গেলাম। তিনি এলেন এবং চলেও গেলেন। আমরা যে যার প্রাণ নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বিরাট এক মদ্দা ভালুক। কুচকুচে কালো, বুকে সাদা ‘V’ চিহ্ন–যেন V for vic tory৷ রাইফেল বন্দুক কিছুই নেই সঙ্গে পিস্তল দিয়ে একে কবজা করা যেত না। তা ছাড়া, কবজা করবই বা কেন?

কেষ্টর এমন কেলে-কিস্টি মিষ্টি জীব। ঝগড়া তো আমাদের তার সঙ্গে নয়। তার রাজত্বে আমরাই বরং অবাচ্ছিত আগন্তুক। ঝগড়া সে করতেই পারত আমাদের সঙ্গে। কিন্তু করে তো নি।

নমঃ ভালুক নমঃ, ভালুক নমঃ, ভালুক নমঃ করতে করতে আমরা ফাগুয়ারা ভিলার দিকে ফিরে চললাম।

ভটকাই বলল, কোনও অ্যাডভেঞ্চারই হল না অথচ কীরকম খিদে পেয়ে গেছে, দেখেছিস?

আমি বললাম, হুঁ।

ঋজুদা বলল, মিশিরজি এবং শর্মাজিকে বলে দিস ভাল করে, ওঁদের মালিকেরা কেউই যেন কিছুদিন দোতলার খোলা বারান্দাটা ব্যবহার না করেন। রোদ পোয়াতে কি গল্প করতে হয়, তো সামনের বারান্দা এবং দেড়তলার ঢাকা বারান্দাই যেন ব্যবহার করেন। তবে ফার্নিচারের অ্যারেঞ্জমেন্ট যেমন আছে। তেমনই থাকবে যাতে মনে হয় এখুনি কেউ এসে বসবেন ও বারান্দাতে। ফার্নিচার কিছুমাত্র নড়বে না জায়গা থেকে। তারপরই বলল, আমরা পিপ্পলগাছে কী দেখেছি দেখেছি তা বলার দরকার নেই কারওকেই। না বলার কোনও কারণও নেই যদিও, তবু। ভটকাই বলল, বুঝেছি। কী বুঝেছে তা ভটকাই-ই জানে। আমি কিছুই বুঝলাম না। ঋজুদার মাথাতে কখন যে কী আসে তা ঋজুদা নিজেও কি বোঝে? ভটকাই বুঝবে কোত্থেকে।

ফাগুয়ারা ভিলা থেকে কোডারমা স্টেশনে আসার সময়ে ওদের ড্রাইভারের সামনে কোনও আলোচনাই করা হবে না যে একথা ঋজুদা বলেই দিয়েছিল। কে কার চর তা কে জানে!

ট্রেনে উঠে ঋজুদা বলল, পুরো ব্যাপারটা জট পাকিয়ে গেল।

তিতির বলল, কেন? মুনতাজারই তো মেরেছে মনে হচ্ছে ভীষ্মনারায়ণ সিংকে।

অত সহজেই বুঝলি। মুনতাজারই যে মেরেছে অন্য কেউ মারেনি সে সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হলি কী করে। দ্বিতীয়ত, ওর উদ্দেশ্য কী? জঙ্গুলে জায়গা। ও মারতে চাইলে তো পথে-ঘাটে যেখানে হয় মারতে পারত। অত কষ্ট করে পিপ্পলগাছে শিকারিদের মতো মাচা বেঁধে ঘোড়ায় চড়ে এসে মারার হরক করতে যাবে কেন?

ভীষ্মনারায়ণ তো ইনট্রোভার্ট। উনি তো বাড়ি থেকে বেরোতেনই না, শুধুই পড়াশুনো করতেন। ওঁকে বাইরে পেলে তো মারবে!

ভটকাই বলল।

সেটা ঠিক। কিন্তু তাও যদি না হয়, তবে মাচাটা এখনও বাঁধা রয়েছে কেন? শতরঞ্জি বিছানো, কমলালেবু, মেওয়া, কেন? অন্য আর কাকে মারতে চায় সেই আততায়ী?

হয়তো ছোট রাজকুমার বা দিয়ারানিকে।

তারা তো এখানে নেই, আবার কবে আসবেন তারও ঠিক নেই।

এখানে তার আসার কথা আছে কি শিগগিরি? জিজ্ঞেস করেছিলি মিশিরজিকে।

ঋজুদা বলল, আমাকে।

হ্যাঁ। জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি বা ওঁরা আসছেন না তবে কন্দর্পনারায়ণের আসার কথা পরশু। উনি তো জানেন আমরা এখনও আছি ফাগুয়ারা ভিলাতেই।

তা উনি যা খুশি ভাবতে পারেন। লেট হিম ফাইন্ড ফর হিমসেলফ। আমি হাত ধুয়ে ফেলব। গাজোয়ারি করে কেস চাপানো ঘাড়ে! অত্যন্তই বিরক্ত হয়েছি। কন্দর্পনারায়ণের উপরে। লোকটা নিজেকে ভাবেটা কী? সেই অ্যালবিনো’ রহস্যর মুলিমালোয়ার রাজবাড়ির বিষেনদেও সিংদের মাধ্যমে আলাপ হয়েছিল আর তারপর থেকে একটু একটু করে ঘাড়ে চড়েছে। একেবারে নাছোড়বান্দা। অমন গায়েপড়া, জোর করে সম্পর্ক করা মানুষদের আমি একেবারেই পছন্দ করি না। সত্যিই আমি বিরক্ত।

আমরা চুপ করে রইলাম।

কোডারমা থেকে যদি আমরা উলটোদিকে যেতাম তবে পরপর অনেকগুলো টানেল পড়ত পথে। টানেলের মধ্যে দিয়ে যখন ট্রেনটা যেত তখন কিছুক্ষণের জন্যে অন্ধকার হয়ে যেত রেলের কামরা দিনমানেও। তা তো নয়। আমরা যাচ্ছি ধানবাদের দিকে। এর আগে হাজারিবাগ রোড স্টেশনে, মানে, সারিয়া পেরিয়ে এলাম।

ঋজুদা বলল, মনে হচ্ছে, এই প্রথম হার হবে আমাদের। এ রহস্যর সমাধান আমাদের দ্বারা হবে না।

ভটকাই বলল, বললেই হল। তুমি মাঝপথে কেস ছেড়ে দিলে আমাদের বে-ইজ্জত হয়ে যাবে। আমরা হারিনি কখনও, হারব না। হারতে ভাল লাগে না।

তবে আর কী? যাকে খুশি তাকে আসামি বলে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বিবেকের কাছে ছুটি নিয়ে নে, পুলিশেরা যা করে।

তিতির রবীন্দ্রনাথের শ্যামা থেকে একটি কলি গেয়ে উঠল: চোর চাই। চোর চাই। যে করেই হোক। চুরি হয়ে গেছে রাজকোষে।

আমি হেসে ফেললাম। বললাম, যা বলেছিস।

তারপরেই ঋজুদাকে বললাম, তোমার বর্তমান মানসিক অবস্থাতে একটু আশার আলো দেখাতে পারি।

কীরকম?

অন্যমনস্ক ঋজুদা বলল।

আমি পকেট থেকে মাচার পাশের ফোকরের মধ্যে পাওয়া রাইফেলের কার্তুজের খালি খোলটা ঋজুদাকে দিলাম বের করে।

ঋজুদার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

বলল, কোথায় পেলি।

বললাম। তারপর বললাম, একটা রাইফেল থেকে ইজেক্টেড হয়ে ফোকরের। মধ্যে গিয়ে পড়েছিল। একটা ফাঁকা খোলের হিসেব মিলছিল না বলেই বোধহয় খুনি মাচাতে আবার এসেছিল ওটারই খোঁজে। অথচ খুঁজে পায়নি।

ঋজুদা খোলটাকে নেড়ে-চেড়ে বলল, কী বোর-এর রাইফেলের এম্পটি কাট্রিজ হতে পারে এটা? রুদ্র?

আমি তো আগেই নেড়েচেড়ে দেখেছিলাম।

বললাম, থার্টি ও সিক্স? বুঝতে পারছি না।

উঃ হুঃ।

ঋজুদা বলল।

তারপর বলল, আমার মনে হয়, থ্রি ফিফটিন-এর। ইন্ডিয়ান অর্ডন্যান্স কোম্পানি যে রাইফেল তৈরি করে–এবং গুলিও।

এখন বের করতে হবে মুনতাজারের কাছে থ্রি ফিফটিন রাইফেল ছিল কি?

তিতির বলল।

ঋজুদা বলল, ফাগুয়ারা ভিলাতে তো স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসসন-এর দোনলা বন্দুক আছে তোরা বললি। আর কী কী ওয়েপন আছে জানতে হবে। বলেই, মোবাইল ফোনটা অন করে বোতাম টিপল। কাকে করছ?

কন্দর্পনারায়ণকে।

ও।

লাইন লাগলে ঋজুদা বলল, হ্যাঁ। একটা ইনফরমেশানের জন্যে ফোন করলাম।

-হ্যাঁ। অফ করে রেখেছিলাম। ফোন একটা বিরক্তিকর জিনিস।

হ্যাঁ। আমরা বেরিয়ে পড়েছি। কে বলল? মিশিরজি?

–হ্যাঁ। এ কেস আমার দ্বারা মীমাংসা হবে না। এসবের জন্যে মানসিক প্রস্তুতি, চিন্তাভাবনা লাগে। হুট করে বললেই তো হত্যা রহস্যর জট খোলা যায় না।

–হ্যাঁ। যা বলছিলাম। ফাগুয়ারা ভিলাতে কী কী ওয়েপনস আছে? সেগুলো ব্যবহার করে কে বা কারা? কীসের জন্যে?

এবং তারপর ঋজুদা বেশ কিছুক্ষণ শুনল কন্দর্পনারায়ণবাবুর কথা। ওপাশ থেকে উনি কী বলেছিলেন তা তো আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম না।

আপনি তাহলে পরশু আসছেন এখানে। আমি ভেবেছিলাম আমরা ফিরে যাচ্ছি শুনে আপনি আর আসবেন না।

তারপরই মোবাইলটা অফ করে দিল ঋজুদা।

আমরা চুপ করে তিনজনই ঋজুদার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম।

ঋজুদা বলল, একটি ডাবল ব্যারেল বন্দুক, তোরা যেটা দেখেছিলি, একটা পয়েন্ট টু-টু, চেকোশ্লোভাকিয়ান রাইফেল আর একটি ফোর সেভেন্টি ডাবল ব্যারেল জেফরি রাইফেলবাঘ বা হাতির মোকাবিলার জন্যে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে থ্রি ফিফটিন নেই ফাগুয়ারা ভিলাতে।

ভটকাই বলল।

তিতির বলল, ফাগুয়ারা ভিলাতে খুনির রাইফেল থাকবেই বা কেন? মানে, থাকতে হবেই কেন?

ঋজুদা তিতিরের মুখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। মুখে কিছুই বলল না।

তারপর বলল, ফাগুয়ারা ভিলার ফোন নাম্বার তাদের কারও কাছে আছে?

আমার কাছে আছে। মিস্টার শর্মা কলকাতাতে আসবেন শিগগিরি। তাকে একটু খাতির করতে হবে। আমাদের এত খাতির যত্ন করলেন।

ভটকাই বলল।

ঋজুদা ভটকাইকে থামিয়ে বলল, লাইনটা লাগা। মিশিরজির সঙ্গে কথা বলব।

মিস্টার শর্মাই ফোনটা ধরলেন। ধরে ভটকাই-এর প্রশ্ন শুনে বললেন, মিশিরজি নেই। নেই, মানে পুজো করছেন।

ঋজুদা হাতঘড়ির দিকে চাইল একবার।

হাত দিয়ে ফোনটা আড়াল করে বললাম, আর কিছু বলব?

না ছেড়ে দে।

ঋজুদা বলল।

তারপর আমাকে বলল, ট্রেন থেকে নামবার আগে আবার ফোন করবি রুদ্র। মিশিরজিকে পেলে জিজ্ঞেস করবি ওঁর পুজো হয়ে গেছে? উনি কখন পুজো করেন সেই সময়টা জেনে নিবি। উনি এখন সত্যিই পুজো করছেন কী না আমাদের জানা দরকার।

কেন জানি না, এই শর্মা লোকটাকে আমার পছন্দ হয়নি।

তিতির বলল।

ঋজুদা বলল, তুই তো শর্মাকে বিয়ে করছিস না। পছন্দ হবার দরকারই বা কী?

আমরা হেসে উঠলাম। তিতির অপ্রতিভ হল।

ভটকাই বলল, মি. শর্মা চমৎকার মানুষ। অনেক বিষয়ে পড়াশুনো আছে।

কিচেন ম্যানেজার হলে কী হবে। ওয়াইডলি ট্রাভেলডও। আগামী মে মাসেই তো বাইরে যাচ্ছেন।

ঋজুদা একটু অবাক হয়ে বলল, শর্মা? বাইরে? কী করতে?

বেড়াতে।

তাই? বাঃ।

মিশিরজিকে মনে করে ফোনটা করিস রুদ্র। উনি থাকলে আমাকে দিবি।

তারপরে বলল, এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে যাওয়া যাক।

যা বলেছ।

তিতির বলল।

গল্পে গল্পে এক সময়ে হাওড়াতে পৌঁছানো গেল। দশ মিনিটের মধ্যে ট্রেন ঢুকে যাবে প্ল্যাটফর্মে। হঠাৎ ফোন করার কথা মনে পড়ল। লাইনটা লাগাতেই মিশিরজিই ধরলেন। আমি ঋজুদাকে দিয়ে দিলাম ফোনটা।

ঋজুদা বলল, পুজো হয়ে গেল?

–ও। তাই।

বন্দুক রাইফেলের গুলি কলকাতার কোন দোকান থেকে কেনেন? আমার ভারী অসুবিধে হচ্ছে। ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনের মেম্বারশিপের কোটাতে তুলতাম–একটা গোলমালে ঝামেলা হচ্ছে।

কী বললেন? ইস্ট ইন্ডিয়া আর্মস কোম্পানি? ১ নং চৌরঙ্গি? হ্যাঁ। হ্যাঁ। এ. বি. বাবু। চিনি তো। ওঁর সঙ্গে কি আজকের আলাপ?

–ও। কন্দর্পনারায়ণবাবুর লোকই গুলি তুলে পাঠিয়ে দেয়? ঠিক আছে।

–আপনাদের খুব জ্বালিয়ে এলাম।

–হ্যাঁ। হ্যাঁ। আসব আবার কখনও। নমস্তে নমস্তে…

ঋজুদা বলল, রুদ্র তুই সকালেই ইস্ট ইন্ডিয়া আর্মস-এ যাবি। এ. বি. বাবু একটু দেরি করে আসেন আজকাল। উনি না থাকলে ওঁর ছেলে চাদুর সঙ্গে দেখা করে বলবি যে আমার কাছ থেকে আসছিস–এই নে একটা কার্ড রাখ।

আমাকে তো চেনেন ওঁরা।

ও। তাই?

কী বলব?

জিজ্ঞেস করবি, কন্দর্পবাবুর লোক বছরে শটগান এবং দুটি রাইফেলের জন্যে কত গুলি তোলে? ভাল করে রেকর্ড দেখে আসবি? লাইসেন্স কার নামে আছে বন্দুক রাইফেলগুলোর? কন্দর্পনারায়ণের কি অন্য ওয়েপনও আছে? যদি থাকে, তাহলে সেগুলি কী কী?

নকশাল আন্দোলনের সময় থেকে এবং অন্য কারণেও অনেকেই বন্দুক রাইফেল বন্দুকের দোকানেই রেখে দেন, প্রয়োজনের সময়ে তুলে নেন প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে আবার দোকানে জিম্মা দিয়ে দেন। সমস্ত ইনফরমেশন কারেক্টলি টুকে আনবি। সন্ধেবেলাতে আমার বাড়িতে আসবি। ভুনি খিচুড়ি করতে বলব গদাধরকে। বহুদিন আমার ওখানে জমায়েত হয়নি। ছাতুর লিট্টি খেয়ে পেটের অবস্থা একেবারে শোচনীয়। ভটকাই কি আসবি?

নেমন্তন্ন না করলে যাই কী করে।

বাবা। খুব যে পায়াভারী হয়েছে দেখছি। আগে তো খিচুড়ির গন্ধ পেলেই দৌড়ে যেতিস।

আমি বললাম।

আগের ভটকাই তো আর নেই আমি। থিঙ্গস হ্যাভ চেঞ্জড।

আই সি।

ঋজুদা বলল, তিতিরও আসিস কিন্তু। কাল সন্ধেবেলা। ভুলে যাস না।

আসব।

তিতির বলল।

.

০৬.

পরদিন সন্ধেবেলা আমি যখন গিয়ে পৌঁছলাম তখনও আর কেউ আসেনি। আমি ছোট মামাবাড়িতে গেছিলাম যোধপুর পার্কেনইলে ভটকাই-এর সঙ্গেই আসতাম।

বল, কী খবর?

খবর আছে। শটগানের গুলি বছরে দু বাক্স তোলেন।

কী কী লটস?

দুনম্বর চার নম্বরই বেশি আর গোটা পাঁচেক এল.জি., এস.এস.জি।

আর রাইফেলের গুলি?

সেটাই একটু অবাক করল। পয়েন্ট টু-টুর গুলি এক হাজার তুলেছেন দেখলাম।

অত গুলি। একার লাইসেন্সে?

অন্য কারও লাইসেন্সেও তুলতে পারেন। জানি না, সেটা লিগালাইজ করে নিয়েছেন বিশ্বাসবাবুরা নিশ্চয়ই। কিন্তু অত গুলি কেন?

পয়েন্ট টু-টু দিয়েই হয়তো মুরগি তিতির বটের প্যাট্রিজ খরগোস ইত্যাদি মারা হয়। তিতির মুরগি মারতে তো অত গুলি লাগতেই পারে না।

আমি বললাম, টার্গেট প্র্যাকটিসের জন্যেও ব্যবহার করা যেতে পারে।

পারে। কিন্তু সেই মার্কসম্যানটি কে? কন্দর্পনারায়ণ নিশ্চয়ই নন।

ঋজুদা বলল।

তা কি বলা যায়? কন্দর্পনারায়ণ হয়তো রাইফেল শুটিং কম্পিটিশনে নাম দেন।

আর ফোর সেভেন্টির গুলি?

ও রাইফেলের গুলি তিন বছর আগে দশ রাউন্ড নেওয়া হয়েছিল।

ও রাইফেল ব্যবহারই হয় না। বাঘ বা হাতি তো রোজ এসে ফাগুয়ারা ভিলার গেটে মাথা ঠোকে না গুলি খাওয়ার জন্যে।

আর কিছু?

হ্যাঁ। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং খবর হচ্ছে যে থ্রি ফিফটিন রাইফেলের গুলিও তোলা হয়েছে।

রাইফেল কার নামে?

জনাব মুনতাজার আলি সাহেবের।

এই সব গুলি কে তুলেছে দোকান থেকে? লাইসেন্স প্রডিউস করে?

অধিকাংশ সময়েই মুনতাজার। মিস্টার শর্মা একবার তুলেছিলেন, এবং কন্দর্পনারায়ণ নিজেও একবার। গত পাঁচ বছরের হিসেব দেখে বলছি।

হুম্ ম্।

বলল, পাইপটা ভরতে ভরতে।

শেষবারে গুলি কে তুলেছে?

মি, শর্মা।

কবে?

মাস দুয়েক আগে।

থ্রি ফিফটিন এর গুলিও?

না। থ্রি ফিফটিন-এর গুলি তুলেছে একমাত্র মুনতাজারই। তাও গত বছরে।

কত গুলি তুলেছিল?

কুড়িটা।

হ্যাঁ। থ্রি ফিফটিনটা মুনতাজারেরই নামে আছে?

হ্যাঁ। এ. বি. বাবু বলেছেন, দুবছর আগে কন্দর্পনারায়ণ রাইফেলটা ওদের দোকান থেকেই কিনে প্রেজেন্ট করেছেন মুনতাজারকে। লাইসেন্সও হোম ডিপার্টমেন্টে বলে পাইয়ে দিয়েছেন।

আমার আর কিছু বলার নেই।

আমি বললাম।

হ্যাঁ। আমারও নেই। এখন ভাববার সময়। ভাব। সকলে মিলে ভাব।

তুমি কি কোনও ক্ল পেলে? ক্লু পাইনি।

এখনও surmiseএর স্টেজেই আছে। Acid test-এ ট্যাঁকে কি না দেখতে পাইনি।

তারপরই বলল, এই ব্যাপারটা শেষ না করে ফেললে অন্য কোনও কাজে মন লাগাতে পারছি না। চল, রুদ্র, আমরা কালই Scorpion গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। কন্দর্পনারায়ণও পরশু গিয়ে পৌঁছচ্ছেন। জিজ্ঞাসাবাদের সুবিধাও হবে।

কাল তিতির আর রুদ্র কি যেতে পারবে? ওদের দুজনেরই তো কি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়র বিয়ে আছে বলছিল না।

না যেতে পারলে যাবে না। আমরা তো আর পিকনিক করতে যাচ্ছি না যে না গেলে কিছু মিস করব। ওখানে দু-তিনদিন থাকব তারপর তো ফিরেই আসব। এখানে না ফিরে তো রহস্যর জট পুরো খোলা যাবে না। অনেক loose ends tie up করতে হবে।

হু। আমি বললাম।

কাল কখন বেরোবে?

এখন পথ যা ভাল হয়ে গেছে। দু নম্বর হাওড়া ব্রিজ পেরিয়ে হাইওয়ে ধরে বেরিয়ে যাব।

ব্রেকফাস্ট করে বেরোব পথে কোথাও দুপুরের খাওয়া খেয়ে নেব। রাতে পিতিজ-এর বনবাংলোতে খিচুড়ি।

বলেই বলল, ভাল কথা, হাজারিবাগে কাজমি সাহেবকে ধর তো। বলে দি। এবারে একদিন ওঁর বাড়ি বিরিয়ানি খেতে যেতেই হবে হাজারিবাগ শহরে। তা ছাড়া নাজিম সাহেবের ছেলেরাও আছে। বানাদাগ-এর পথের কবরখানাতে নাজিম সাহেবের কবরে মোমবাতিও দিতে হবে।

তারপর বলল, দোস্তরা কেউই নেই। হাজারিবাগে যেতেই ইচ্ছে করে না আর।

কাজমি সাহেবের সঙ্গে ঋজুদার কথাও শেষ হল আর তিতির ও ভটকাইও প্রায় একই সঙ্গে হাজির হল।

বাবাঃ। কী টাইমিং।

আমি বললাম।

হাতঘড়িতে সাড়ে সাতটাতে তর্জনী দিয়ে দেখিয়ে ভটকাই বলল, ঘড়ি মিলিয়ে নিতে পারিস।

তাই তো দেখছি।

ঋজুদা বলল, উন্নতি হচ্ছে আস্তে আস্তে।

ওরা বসতে বসতে আমি বললাম, মুনতাজার-এর থ্রি ফিফটিন রাইফেল আছে।

আছে?

বলেই, ভটকাই লাফিয়ে উঠল। বলল, আমি বলেছিলাম না!

তিতির বলল, তাতে কিছুই প্রমাণিত হয় না। মুনতাজারই মাচাতে বসে ভীষ্মনারায়ণকে গুলি করেছিল কিনা সে সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে হবে। আর যদি করেও থাকে, কী কারণে? হোয়াট ওজ দ্য মোটিভ বাহাইন্ড?

কারেক্ট!

ঋজুদা বলল।

রুদ্র, বন্দুকের দোকানে কী কী তথ্য পেলি ওদের জানা। তারপর ভাব। সকলে মিলে ভাব।

ভটকাই বলল, পণ্ডিচেরির অরোভিল এর কমুনিটি থিংকিং-এর মতো?

ঋজুদা ভটকাই-এর প্রগলভতার জবাব দিল না।

ইতিমধ্যে গদাধরদা এসে বলল, এই যে সোনারা সব এসে গেছ। ভুনি খিচুড়ি তো করিতিচিই কিন্তু তোমাদের খপর যেটি দেবার তা হতিচি বাংলাদেশ থিকি বদরুল মিঞা মস্ত এট্টা ইলিশ পাইট্যেচে প্লেনে কইরে। পাঁচশো টাকা নাকি কেজি। আমাদের টাকায়। ফোনে আমাকে বইলতেছিল। তোমরা সবাই না এসি পড়লে এ মাছ নে আমি কী বিপদেই না পইড়তাম বলো দিকি।

দূর! এক কেজি ইলিশ মাছে স্বাদই হয় না।

ভটকাই বলল, তাচ্ছিল্যের সঙ্গে।

এক কেজি!

গদাধরদা আহত হয়ে বলল, আরে, না, না। প্রায় আড়াই পৌনে-তিন কেজি মাছটা।

আমরা হই হই করে উঠলাম।

তিতির বলল, গত দু বছরে কলকাতার কোনও বাজারেই বড় ইলিশ পাইনি। বাবা তো ইলিশ গত প্রাণ। একটা ঘটনার মতো ঘটনা ঘটালে বটে গদাধরদা তুমি।

আমরা তো খিচুড়ির সঙ্গে ভাজাই খাব। গদাধরদা, বাকি মাছ তুমি তিন ভাগ করে গাদা-পেটি আলাদা করে যাবার সময়ে ওদের দিয়ে দিয়ে। বাড়িতে রান্না করে খাবে যার যেমন রুচি।

ঋজুদা বলল।

এ কী! এ কী! তুমি কী খাবে?

আমরা সমস্বরে বললাম।

ঋজুদা মিথ্যে কথা বলল, ইলিশ মাছ আমার ভাল লাগে না।

ভটকাই তিতিরের দিকে চেয়ে বলল, এইজন্যেই বলে খেয়ে যায়, নিয়ে যায় আরও যায় চেয়ে, কে যায়, কে যায়? বাঙালির মেয়ে।

ঋজুদা আমাদের নতুন প্ল্যানটার কথা বলল ওদের। কাল ব্রেকফাস্টের পরে মাহিন্দ্রর টার্বো ইঞ্জিন-এর Scorpion গাড়ি নিয়ে আমরা ইটখোরি পিতিজ যাচ্ছি। তবে থাকব পিতিজ বনবাংলোতে, ফাগুয়ারা ভিলাতে নয়।

ওরা দুজনে শুনেই প্রায় কেঁদে ফেলল।

তিতির বলল, ঋজুকাকা এ কী চককান্ত।

এবং যথারীতি ভটকাই আমাকে সন্দেহ করল।

বললাম, এই সিদ্ধান্ত ঋজুদা হঠাৎই নিয়েছে। বন্দুকের দোকান থেকে যা তথ্য পাওয়া গেছে তারই ভিত্তিতে যাওয়াটা দরকার।

দু-তিনদিন থেকেই হয়তো ফিরে আসব আমরা। খুব প্রয়োজনে দিন পাঁচ সাত থাকতেও হতে পারে।

ঋজুদা বলল।

তিতির আর ভটকাই আমাকে বলল, বন্দুকের দোকানে কী খবর পেলি বল।

ওই তো। মুনতাজারকে কন্দর্পনারায়ণ থ্রি ফিফটিন রাইফেল কিনে দিয়েছেন। ইন্ডিয়ান অর্ডন্যান্স ফ্যাকট্রির। ফাগুয়ারা ভিলা-তে কেউ রাইফেল প্র্যাকটিস করছে পয়েন্ট টু-টু রাইফেল দিয়ে। তার মানে, সেখানে কোনও মার্কসম্যান আছেন যিনি হয়তো আইপিং করতে পারেন।

বলেই, ঋজুদার মুখের দিকে চেয়ে বললাম, তাই তো?

ঋজুদা বলল, হুঁ।

ভটকাই বলল, তুই একটা মারাত্মক ভুল করছিস। ভীষ্মনারায়ণকে যে গুলি করেছিল সে থ্রি-ফিফটিন দিয়ে গুলি করেছিল, পয়েন্ট টু-টু দিয়ে নয়। গাছের কোটরে তুই-ই তো থ্রি ফিফটিন রাইফেলের এম্পটি সেল পেয়েছিলি কুড়িয়ে। ভুলে গেলি? তারপরেও অন্য রাইফেলের কথা আসে কী করে।

সেটা ঠিক।

আমি বললাম।

তিতির বলল, ওই অঞ্চলে টাট্ট ঘোড়া কার আছে খোঁজ লাগাও গিয়ে। ঘোড়াটাও একটা ফ্যাকটর।

ঋজুদা বলল, হুঁ।

এই যে। খাবার লাইগ্যে দিচি। খেতি খেতি কথা বলবে একন।

আমরা খাওয়ার ঘরে গিয়ে সবাই চেয়ার টেনে বসলাম একে একে।

ফাগুয়ারা ভিলাতে তো বেশি লোক থাকে না। দুজন নেপালি দারোয়ান তারাও অবশ্য রাইফেল বন্দুক চালাতে জানতে পারে। পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট বলতে প্রায় বৃদ্ধ মিশিরজি আর ভটকাই-এর নতুন বন্ধু মি. শর্মা। বাড়ির অন্য কাজের লোকেরা কেউ বন্দুক রাইফেল চালায় এটা ভাবাটা বাড়াবাড়ি।

সবই ভাবতে হবে। ঋজুদা বলল। তারপর বলল, যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো তাই, মিলিলে মিলিতে পারে অমূল্য রতন।

তিতির বলল, হ্যাঁ।

ভটকাইকে খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। ঋজুদা বলল, ইলিশের কাটা জিভে বা মাড়িতে ফুটে যাবে। হড়বড় করিস না, টেক ইয়োর ওন টাইম।

ভটকাই লজ্জা পেয়ে খাওয়ার স্পিড কমাল।

ঋজুদা বলল, তুই তৈরি হয়ে থাকিস রুদ্র। তোকে আমি পৌনে নটা নাগাদ তুলে নেব। পরেই বলল, তার চেয়ে তুই এখানেই চলে আয় বরং আটটার মধ্যে একটা ট্যাক্সি নিয়ে। গাড়ি তো তখন পাবি না। এখানেই ব্রেকফাস্ট সেরে এদিক দিয়ে বেরিয়ে যাব। কম ঘোরা হবে। বিশপ লেফ্রয় রোড থেকে আর বিদ্যাসাগর সেতু কতটুকু পথ।

ঠিক আছে।

তবে তোর রাইফেলটা সঙ্গে নিস।

কোনটা?

বিষেণদেওবাবু যেটা তোকে উপহার দিয়েছিলেন। আর দশ রাউন্ড গুলি। আমার এখানে এসে আমার থ্রি ফিফটিন রাইফেলটা, দশ রাউন্ড গুলি এবং : দূরবিনটা নিবি। তোরটাও নিয়ে আসিস। আমার আলমারি থেকে নাইট ভিশান-এর দূরবিনটাও নিয়ে নিস। এখন কৃষ্ণপক্ষ। রাতে ঘুটঘুটি অন্ধকার হবে। প্রয়োজন হতে পারে।

বললাম, ঠিক আছে।

ঋজুদা ওদের দুজনকে উদ্দেশ করেই বলল, তোরা তাহলে কোনও ক্রমেই যেতে পারছিস না।

না ঋজুদা। ইমপসিবল। এমন কাছের মানুষের বিয়ে যে না থাকলেই নয়।

ফুঃ। বিয়ে করার আর সময় পেল না সব।

ভটকাই-এর রাগে আমরা হেসে ফেললাম। বেচ্চারি বর বউ!

ওক্কে। কী আর করা যাবে।

যাওয়াটা পেছানো যেত না, না? কোনওমতেই?

ভটকাই আবার বলল।

না। টাইম ইজ দ্য এসেন্স। সময় অনেকই নষ্ট হয়েছে আর নষ্ট করার সময় নেই।

ঋজুদা বলল।

.

শীতের দিনে গাড়িতে করে দূরে কোথাও যেতে আলাদা আনন্দ। তবে এখন এয়ারকন্ডিশনাড গাড়ি হয়ে গিয়ে শীত-গ্রীষ্ম বোঝার উপায় তো নেই। শীতে গরম গাড়ি আর গরমে ঠান্ডা। এই কৃত্রিম ব্যাপারটা ভাল লাগে না আমার। কিন্তু এও ঠিক যে পথের ধুলো ধোঁয়া আওয়াজ সবেরই হাত থেকেই তো বাঁচা যায়। তবে একটা গাড়ি করেছে বটে মাহিন্দ্র অ্যান্ড মাহিন্দ্র। Scorpion! পৃথিবীর যে কোনও এই শ্রেণীর গাড়িকে টেক্কা দিতে পারে। গাড়ি তো নয়, যেন রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। বনে-জঙ্গলে-পাহাড়-পর্বতে এ গাড়ির জবাব নেই–সকলকে বাঁ পায়ে দশ গোল দিয়ে দেবে।

ঋজুদা বলল, আমরা হাজারিবাগ হয়ে যাব, কারণ, থানাতে আর ফরেস্ট অফিসে একবার করে হয়ে যেতে হবে। কিছু সময় বেশি লাগবে তাতে।

তারপর বলল, তুই-ই চালা, আমি বাঁদিকের কাঁচ নামিয়ে দিয়ে একটু পাইপ খাই। সারা পৃথিবীতে স্মোকিং-এর বিরুদ্ধে যে ধরনের প্রচার চলেছে তাতে বিদেশ তো বটেই এ দেশেই আর কদিন এই আনন্দ থাকবে বলা যায় না।

ক্যানসার তো সত্যিই হচ্ছে।

ছাড় তো! গড়িয়াহাটের বা চৌরঙ্গির মোড়ে দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলে যা ক্ষতি হয় তা দশ বছর স্মোক করার ক্ষতির সমপরিমাণ। আগে পথ-ঘাট-মাঠ সব দূষণমুক্ত করো তারপরে মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতাতে হাত দাও। পটলামামার আশি বছর বয়স–এখনও দিনে পাঁচ প্যাকেট সিগারেট খাচ্ছেন আর দু চামচ চিনি দিয়ে পনেরো কাপ চা। কই তার তত কিছুই হয়নি। না ডায়াবেটিস, না ক্যানসার হার্ট-প্রবলেম। মনের আনন্দটাও তো একটা ব্যাপার না কি? যার হবার তার হবে। অমন পুতু পুতু করে বাঁচার কোনও মানে হয় না। দুস-স-স।

না খাওয়াই ভাল। তুমি অসুস্থ হলে আমাদের কী হবে? অনেকদিন খেলে তো।

আমি বললাম।

আমার কিছু হলে তোমাদের কিছুই হবে না। তোমরা সব আরও তালেবর হবে। আমাকে বিছানাতে ফেলে রেখে নিজেরা অ্যাডভেঞ্চার আর গোয়েন্দাগিরি করবে। যে যতদিন দৌড়াচ্ছে ঠিক আছে। থেমে গেলেই সব সঙ্গীরা তোমাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবে। তারাও নিরুপায়। মানুষের ধর্মই হচ্ছে সামনে চলা। পিছন দিকে তাকানো মানেই ফুরিয়ে যাওয়ার আগের স্টেজ। আইদার দ্যু রান ওর ড্রপ আউট। নিজে অন্যদের বোঝা হওয়াটা কখনওই উচিত নয়। আমি অসুস্থ হলে এই সুন্দর পৃথিবীতে বাইরে না বেরিয়ে তোরা আমার বিছানাতে বসে আমাকে প্রবোধ দিবি, আমার সেবা করবি, এত বড় দুর্দৈব ঈশ্বর যেন কখনওই না ঘটান। এই প্রার্থনা করি।

তুমি ঈশ্বর মানো? ঋজুদা?

খুব মানিরে! দুশো ভাগ মানি। ঈশ্বরের দয়া ছিল বলেই তো আজ জীবনে কিছু পেয়েছি। পরিচয়, নাম, যশ, তোদের মতো চেলা-চামুণ্ডা।

চামুণ্ডিও আছে।

তা ঠিক। তার দয়া না থাকলে কিছুই হয় না। পুরুষকার দরকার, খুবই দরকার। কিন্তু শুধুই পুরুষকারে কিছুই পাওয়া যায় না।

তারপর বলল, এসব কথা তোর বয়সে বুঝবি না। অতি-সপ্রতিভ নিরীশ্বরবাদীদের জীবনভর অনেকই শিখতে হয়। যদি শেখার মতো মন তাদের থাকে। এসব বোধ চট করে ভিতরে আসে না। যদি তোর আধার ভাল না হয় তবে ঈশ্বরবোধ যে কী জিনিস তা তুই সারাজীবনেও বুঝতেই পারবি না। সকলের সব কিছু হয় না। যাদের হল, তারা ভাগ্যবান, যাদের হল না তারা অভাগা। বিজ্ঞানের সঙ্গেও ঈশ্বরের কোনও বিরোধ নেই, যাদের দৃষ্টি স্বচ্ছ নয় তারাই ভাবেন যে বিরোধ আছে।

তারপর বলল, তোর সিনহা সাহেবকে মনে আছে?

কোন সিনহা সাহেব?

ছত্রিশগড়ের গর্ভনর। আমরা না তার অতিথি হয়েই ছত্রিশগড়ে গিয়েছিলাম গত বছর। ইন্দ্রাবতী প্রপাতে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন মোটরকেড নিয়ে। মনে নেই?

মনে আবার নেই। আমাদের সঙ্গে নাগপুরের প্রদীপ গাঙ্গুলি কাকু, রায়পুরের প্রদীপ মৈত্ৰ কাকুরা সব ছিলেন।

হ্যাঁ। সিনহা সাহেব তো আগে বিহারের আই. জি. পুলিশ ছিলেন। এখনও তার খুব সম্মান বিহার এবং ঝাড়খণ্ডে। ওঁকেই কাল রাতে ফোন করেছিলাম ঝাড়খণ্ডের ডি. জি. পি-কে বলে দিতে। ডি. জি. পি. হাজারিবাগের এস. পি.-কে বলে রাখবেন যাতে আমাদের যা সাহায্য লাগে তা পাওয়া যায় নির্বিঘ্নে।

তুমি কি রহস্যর সমাধান করে ফেলেছ? ঋজুদা।

পাইপের পোড়া টোব্যাকো বাইরে খুঁচিয়ে ফেলতে ফেলতে ঋজুদা বলল, অলমোস্ট। তবে আমি তো আর খুনি বা খুনির মদতকারীদের অ্যারেস্ট করতে পারব না। পুলিশকে সব ব্লু দেব। ভীষ্মনারায়ণের সব ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদেরও দেব। তারপর পুলিশ সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড় করে চার্জ ফ্রেম করবে। এ ব্যাপারে আত্মীয়রা যতটুকু পারেন সাহায্য করবেন পুলিশকে। সেই জন্যেই ইচ্ছা আছে হাজারিবাগ থেকে টুটিলাওয়া সীমারিয়া বাঘড়া মোড় হয়ে চান্দোয়া হয়ে রাঁচি চলে যাব। সেখানে ডি. জি. পি.-র সঙ্গে দেখা করে ও বীরুর সঙ্গে আড্ডা মেরে পরদিন ভোরে বেরিয়ে বিকেলে কলকাতাতে এসে পৌঁছব।

কোথায় উঠবে রাঁচিতে? বি. এন. আর.-এ?

এখন এস. ই. আর.। কিন্তু সে হোটেল আগের মতো আর নেই। আমরা উঠব অশোকাতে। আই. টি. ডি. সি-র হোটেল। হাইকোর্টের কাছেই। নিরিবিলি। এবং ভাল।

.

০৭.

হাজারিবাগের পুলিশ সাহেবের বাড়ি ক্যানারি হিল রোড আর সার্কিট হাউসের রাস্তার মোড়ে।

ঋজুদা বলল, পুরনো বাড়িটার অনেক রদবদল হয়েছে। পঞ্চাশ বছরেরও আগে আমার বন্ধু সুব্রত চ্যাটার্জির বাবা এই বাড়িতে থাকতেন। হাজারিবাগের এস. পি. ছিলেন। তখন হাজারিবাগ মস্ত জেলা ছিল–গিরিডি, কোডারমা, চাতরা সবই হাজারিবাগের মধ্যে ছিল।

আমরা যেতেই পুলিশ সাহেব মি. রাওয়াল বেরিয়ে এলেন। লন-এ সামিয়ানার মতো তাঁবু খাটানো।

আমাদের ছেলেবেলাতেও এসবই দেখেছি। বুঝলি।

ঋজুদা বলল।

উনি চা-বিস্কিট খাইয়ে বলেছিলেন, কোতোয়ালিতে যখন দরকার পড়বে তখনই আসবেন। এখন সময় নষ্ট করে যাওয়ার দরকার নেই। আমার মোবাইলেই ফোন করবেন। যদি সুইচ-অফ করা থাকে তবে বড় দারোগার মোবাইল নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি। তাকে করবেন। তাঁকে সব বলা আছে। কোনও অসুবিধে হবে না।

ঋজুদা বলল, একটা উপকার করতে হবে। এখন ডি. এফ. ও. কাজমি সাহেবের কাছে আমি গেলেই উনি আটকে দেবেন। বিরিয়ানি না খাইয়েই ছাড়বেন না। আপনি বাঁচান। ওঁকে খবর দিয়ে দিতে হবে যে আমি এসে গেছি–পিতিজ বাংলোতে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাব। ওঁর সঙ্গে কাল কথা বলব মোবাইলে।

ঠিক আছে। বলে দেব। বাই অল মিনস। বললেন, রাওয়াল সাহেব।

আমরা ওঁর বাংলো ছেড়ে পিতিজ-এর দিকে এগোলাম।

.

গরম জলে চান করে জামাকাপড় বদলে বাইরের বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে আছি। মুগের ডালের খিচুড়ি ফিনফিনে করে কাটা আলু আর মুরগি ভাজা হচ্ছে বাবুর্চিখানাতে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে ভটকাইটা থাকলে আমরা সকলেই নিশ্চিন্ত থাকি। ওকে মিস করছি। আমি গরম কফির কাপ নিয়ে বসে হাত গরম করছি আর ঋজুদার হাতে কনিয়াকের গ্লাস। ভি. এস. ও. পি.। তবে ব্রান্ডি গ্লাস-টাস এখানে নেই। চা কফির গ্লাসেই ঢেলে নিয়েছে ঋজুদা।

আগে ঋজুদা এসব খেত না। গত বছর দু-তিন হল দেখছি একটু খায়। বলে বুঝলি রুদ্র, বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। ঠেকনার দরকার হয়।

আমি জানি, এসব বাজে কথা। বুড়ো কখনওই হবে না ঋজুদা। ইচ্ছে হচ্ছে খাচ্ছে, তার আবার এত বাহানা কেন? যখন ইচ্ছে হবে না, খাবে না।

ভাল ঠান্ডা বাইরে। তা ছাড়া, নদীর একেবারে উপরেই বাংলোটা। ঠান্ডাটা বেশি লাগে সে জন্যে। বাইরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার রাত। আকাশ ভর্তি তারা। বারান্দার লণ্ঠনটা ভিতরে পাঠিয়ে দিয়েছে ঋজুদা। নদীর এপার থেকে একটি নাইটজার ডাকছে আর ওপার থেকে সাড়া দিচ্ছে তার দোসর। নদীর বুকের উপর দিয়ে একজোড়া ডিড উ্য ডু ইট পাখি চমকে চমকে ডাকতে ডাকতে বাঁ থেকে ডাইনে উড়ে যাচ্ছে কিছু দূর গিয়ে আবার ফিরে আসছে। অন্ধকারে তাদের ঝুলন্ত পা দুটিকে দেখা যাচ্ছে না কিন্তু তাদের ডাকে নদীর জলও যেন চমকে উঠে চলকে যাচ্ছে।

ঋজুদা বলল, রান্না হলে তাড়াতাড়ি খেয়ে কম্বলের তলায় যাব। বুঝলি। কাল সকাল সকাল বেরোব। ফাগুয়ারা ভিলার আশেপাশে একটু ঘোরাঘুরি করে ব্রেকফাস্ট-এর সময়ে ফাগুয়ারা ভিলাতে ঢুকে কন্দর্পনারায়ণকে চমকে দেব। তারপর জমিয়ে ব্রেকফাস্ট করব।

তারপর বলল, খাওয়ার কথা উঠলেই ভটকাইয়ের কথা মনে আসে।

কী ব্রেকফাস্ট করবে?

গরম গরম পরোটা, আলুর চোকা, আওলার আচার, বেগুন ভাজা-ঘি চপ চপ। আর রাবড়ি। ইচ্ছে আছে। দেখা যাক কপালে কী জোটে!

.

ঘুম ভাঙল এক জোড়া র‍্যাকেট-টেইলড় ড্রঙ্গোর ধাতব আওয়াজে। ভারী। ঝগড়া করে পাখিগুলো।

মুখ হাত ধুয়ে দু কাপ করে গরম চা খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। চা-এর ব্যাপারে ঋজুদা আর তিতির খুবই খুঁতখুঁতে। ঋজুদা যেখানেই যায় নিজের দার্জিলিং অরেঞ্জ পিকো চা সঙ্গে নিয়ে যেতে ভোলে না। তিতিরও ওই চায়ের ভক্ত। আমি আর ভটকাইও ওঁদের সঙ্গগুণেই কন্যোসার হয়ে গেছি।

গাড়িটা করেই বেরোলাম। আমাদের রাইফেল এবং অন্যান্য সরঞ্জাম সব গাড়িতেই তুলে নিলাম। আমাদের উপরে হয়তো এক বা একাধিক মানুষে লক্ষ রাখবেন। থানা থেকেই যে আমাদের আসার খবরটা রিবাউন্ড করে আমরা এখানে পৌঁছবার আগেই এসে পৌঁছয়নি তাও বলা যায় না। আজকাল ডি. জি. পি., আই. জি., এস. পি. কারওকে জানাটাই যথেষ্ট নয়। শুধু পুলিশই নয়, সব সরকারি দপ্তরেই ঘুন ধরে গেছে। তাই গাড়ির মধ্যেই সব কিছু রইল। দুজনের পিস্তল আছে কোমরে। সব সময়ের সঙ্গী।

গত রাতে ঋজুদা চৌকিদারের সঙ্গে অনেক গল্প করছিল। নেহাত গল্প করার জন্যেই নয়, খবর জোগাড় করার জন্যেও। স্থানীয় প্রত্যেকটি মানুষের কাছ থেকেই নানা খবর পাওয়া যেতে পারে। সেগুলোকে ঝাড়াই বাছাই করে নিতে হয়। চৌকিদারের চেলা রান্না করছিল আর চৌকিদার আমাদের কম্পানি দিচ্ছিল। ঋজুদার প্রশ্নর উত্তরে সে বলল, এখানে, মানে এই অঞ্চলে দুটি টাটু ঘোড়া আছে। একটা মুনতাজার আলির অন্যটা ফাগুয়ারা ভিলার।

ফাগুয়ারা ভিলাতে টাট্টু ঘোড়া আছে? কোথায় থাকে?

অবাক হয়ে বললাম আমি।

ভিলার পেছন দিকে আস্তাবল আছে। আগে বড় বড় দুটো উইলার ঘোড়া ছিল। রাজাবাবুর আমলে।

‘উইলার’ মানে ‘ওয়েলার’ বুঝলাম। নামী ইংলিশ ঘোড়া।

চৌকিদার বলল, হাজারিবাগের মস্ত বড়লোক টুটু ইমাম তাদের নিয়ে নিলেন। টুটু ইমাম সাহেবের অনেক রেসের ঘোড়া ছিল এক সময়ে। ফাগুয়ারা ভিলাতে এখন ঘোড়া নেই ওই টাটুটা আছে। ফাগুয়ারা ভিলাতে মেহমানদের বাচ্চাটাচ্চারা এলে চড়ানো হয় তাদের। ভিলার কেউ চড়ে কিনা বলতে পারব না।

মুনতাজার চড়ে?

হ্যাঁ। সেই তো এখানকার মাস্তান। সে কীসে না চড়ে! মোটর সাইকেল আছে, সাইকেল আছে, ঘোড়াভি আছে। তবে সে নিজের টাটুতে চড়ে, ফাগুয়ারা ভিলার টাট্ট নয়।

ছেলেটা কেমন?

খতরনাক। আরও বেশি বাড় বেড়েছে বড় রাজকুমারের জন্যে। খুব আহ্লাদ দেন তিনি। আজ নয়, বচপন থেকে। নিজের তো ছেলেমেয়ে নেই। যত পেয়ার দুলহার সব এই অপোগণ্ডর উপরে।

চৌকিদারের নাম, রজব আলি। সে গলা নামিয়ে বলল, মুনতাজারের কথা আর বেশি আলোচনা না করাই ভাল। ওর চর আছে চতুর্দিকে। কিছুদিন হল ও এমন এমন সব মানুষের সঙ্গে মিশছে যে ওকে ভয় করি আমরা।

তারা কারা?

স্থানীয় লোক নয়। আনজান জায়গা থেকে আসে। জিপে করে, মোটর সাইকেলে করে। মুনতাজারকে আমরা তাই এড়িয়ে চলি। বম্বে সিনেমার ভিলেইনের মতো ও যা-খুশি তাই করে। এর মেয়ে ওর বউ উঠিয়ে নিয়ে যায়, এর মোরগা তার বকরি।

এখানে হিন্দি সিনেমা তোমরা কোথায় দেখো?

পাঞ্চায়েতে কালার টিভি আছে। সেখানেই দেখি। মাসে মাসে হাজারিবাগ শহরে গেলে শহরের হলেভি দেখে আসি।

হুঁ।

ঋজুদা স্বগতোক্তি করল, এই টিভি আর বলিউড-এর সিনেমাই ভারতবর্ষের যা কিছু শাশ্বত ও ভালত্ব ছিল, যা কিছু ভারতীয়ত্ব তার প্রায় সবইনষ্ট করে দিল। খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, রাহাজানি এত বেড়ে গেছে চারদিকে এই জন্যে। তা ছাড়া লোভ? লোভ ঢুকে গেছে অরণ্যে পর্বতে। মানুষ, কোনও মানুষই আর অল্পে সন্তুষ্ট নয়। সকলেরই সব চাই। এই সব’-এ তার সত্যিই প্রয়োজন আছে কি নেই, এসব কেউ ভাবে না।

তারপরে বলল, বার্ট্রান্ড রাসেলের একটা কথা আজকাল প্রায়ই মনে পড়ে, বুঝলি।

কী কথা?

উই ডু নট স্ট্রাগল ফর এগজিস্টেন্স, উই স্ট্রাগল টু আউটশাইন আওয়ার নেবার্স৷’ এই কথার সত্য শহরের বাসিন্দাদের দেখে রোজই মনে হয়। এই সব জঙ্গলে-গ্রামে ওই দৌড় অতখানি তীব্র হয়ে ওঠেনি এখনও। তবে ভবিষ্যতে হয়তো হবে। হয়তো কেন, অবশ্যই হবে। এখন এদের চোখও লোভে চকচক করে।

ঋজুদা বলল, চল আগেই যাই ফাগুয়ারা ভিলাতে। তারপরে ওখানের খবর-টবর জেনে চারধারে ঘুরে নেওয়া যাবে। নদীর পারের সেই পিপ্পলগাছের হাইড-আউটে তো এই ভারী গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে না। হেঁটেই যেতে হবে।

যাবে কি না একবার পরখ করে দেখাই যাক। Scorpion-এর এঞ্জিন যা ক্ষমতাসম্পন্ন তা জাহান্নমে গিয়ে জন্নত-এও ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারবে আমাদের।

তাহলে চল। তাই যাওয়া যাবে।

ফাগুয়ারা ভিলার গেটে গিয়ে হর্ন বাজাতে একটু পরে নেপালি দারোয়ান ছোট গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আগন্তুকদের পরিচয় জানতে এসেই আমাদের চিনে ফেলে স্যালুট করল।

ঋজুদা বলল, কন্দর্পনারায়ণবাবু হ্যায় ক্যা?

দারোয়ান জবাব দিতে দিতে উনি নিজেই চলে এলেন গেটের কাছে। জগিং স্যুট পরে জগিং শু পরে হাঁটছিলেন ভিলার হাতার মধ্যে। আমাদের দেখে ওঁর মুখ কালো হয়ে গেল মনে হল।

বললেন, কী ব্যাপার? সারা রাত গাড়ি চালিয়ে আসছেন না কি কলকাতা থেকে?

মনে করুন তাই। ঢুকতে দেবেন তো? খিদে পেয়েছে খুব। নাস্তা করব।

ততক্ষণে কন্দর্পনারায়ণ নিজেকে সামলে নিয়েছেন। বললেন, বাহাদুর গেট খোলো। বলেই আমাদের পাইলট করে নিয়ে চললেন। ভিলার সামনে যেখানে ভোরের রোদ এসে লুটিয়ে পড়েছে সেখানে সাদারঙা বেতের চেয়ার ও গোল টেবিল পাতা হয়ে গেছে এরই মধ্যে। কন্দর্পনারায়ণ একজন খিতমদগারকে বললেন, চায়ে লাও, আর নাস্তা বানানে বোলো পাঁড়েজিকো।

গাড়ি পার্ক করে আমরা এসে চেয়ারে বসলাম। উনিও বসলেন। তারপর বললেন, এই গেলেন আবার না বলেকয়ে ফিরে এলেন, ব্যাপারটা কী? অ্যাই কওন হ্যায়? গাড়িসে সব সামান উতারো।

ঋজুদা বলল, না না, আমরা নাস্তা করেই চলে যাব। থাকব না। হাজারিবাগ শহর হয়ে রাঁচি যাব বাঘড়া মোড় হয়ে।

কেন? রামগড় হয়ে না কেন?

যা ট্রাফিক থাকে ওই রাস্তাতে। ঘোরা পথ হলেও সময় কম লাগবে।

কন্দর্পনারায়ণ এবারে যেন একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। বললেন, বাত ক্যেয়া হ্যায় ঋজুবাবু? মার্ডারার কি পতা মিলা কি?

কাছাকাছি এসেছি কন্দর্পবাবু। আপনি এত করে অনুরোধ করলেন, আর এত গোয়েন্দা থাকতে করলেন আমাকেই! আমাকেই যে কেন করলেন তা নিয়েও ভেবেছি।

ভেবে কী বের করলেন?

এখনও পারিনি।

বলেই বলল, মি. শর্মাকে একবার ডাকবেন? আর মুনতাজার কি আছে এখন বস্তিতে? থাকলে, তাকেও একটু জিজ্ঞাসাবাদ করতাম।

মুনতাজার ছিল কিন্তু গতকালই বম্বে মেইল ভায়া ইলাহাবাদ ধরে মুম্বাই চলে গেছে।

কোন স্টেশান থেকে ধরল ট্রেন?

কেন? কোডারমা।

তারপরে বললেন, আপনার সন্দেহ আছে নাকি?

না। আমার ইনফরমেশান, ও গয়া থেকে ট্রেন ধরেছে।

তাই? সে কি? কে আপনাকে বলল?

গোয়েন্দারা কি ইনফরমারের আইডেনটিটিটা ডিসক্লোজ করে? কে বলেছে, তা বলব না।

তাজ্জব কি বাত।

অবাক হয়ে বললেন কন্দর্পনারায়ণ। তারপর বললেন, মি. শর্মার সঙ্গে কী কাজ পড়ল?

তিনি এলেই জানবেন। আপনার আড়ালে বলার মতো কোনও কথা নেই।

কন্দর্পনারায়ণ ভিতরে খবর পাঠালেন মি. শর্মাকে ডাকতে।

ঋজুদা বলল, ভদ্রলোক কি খুব ওয়েল-অফ? কিন্তু এতই যদি ভাল অবস্থা হবে তাহলে এই জঙ্গলে কিচেন ম্যানেজারি করছেন কেন?

ভাল অবস্থা নয় তবে জঙ্গল খুব ভালবাসে। কে কী করে, কেন করে তা কি এত স্বল্প পরিচয়ে জানা যায় ঋজুবাবু।

ভাল অবস্থা না হলে বিদেশে কেউ বেড়াতে যেতে পারেন?

ও। আপনি তাও জানেন দেখছি।

ওঁর টিকিট কি আপনিই কেটে দিয়েছেন?

ওই! ইকনমি ক্লাস-এর টিকিট। স্টেটসে আমার এক বন্ধুর কাছে উঠবে তারপর সে-ই একটু ঘুরিয়ে দেবে এদিক-ওদিক। গ্ৰেহাউন্ড-এ করেও যেতে পারে। তা ছাড়া বিজনেস অ্যাসোসিয়েটসও তো আছে কিছু আমার।

তা তো থাকবেই।

ধুতির ওপরে সবুজ-রঙা খদ্দরের পাঞ্জাবি আর তার উপরে হলুদ-রঙা একটি আলোয়ান গায়ে দিয়ে পায়ে বাথরুম স্লিপার গলিয়ে মি. শর্মা এলেন। ওঁর স্যুট পরা চেহারাটাতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম আমরা। তাই এই পোশাকে দেখে একটু অবাক হলাম।

শর্মাসাহেব বললেন, নমস্তেজি!

ঋজুদা বলল, নমস্তে নমস্তে। আসুন বসুন।

উনি বসতে চাইছিলেন না কিন্তু কন্দর্পনারায়ণের চোখের ইঙ্গিতে বসলেন।

ঋজুদা বললেন, রিসেন্ট কার্ড আছে আপনার কাছে?

কীসের কার্ড?

চমকে উঠে বললেন, মি. শর্মা।

শর্মাসাহেব যেমন অবাক হলেন প্রশ্নটা শুনে আমরা সকলেও কম অবাক হলাম না।

ঋজুদা বলল, টার্গেট কার্ড।

শর্মাসাহেব অবাক হয়ে বললেন, আপনি জানলেন কী করে।

আমাদের অনেক কিছু জানতে হয়।

তারপর বলল, এই জঙ্গল ছাড়াও, গুমিয়ার ইন্ডিয়ান এক্সপ্লোসিভস কোম্পানির শুটিং রেঞ্জেও কি প্র্যাকটিস করেন?

প্র্যাকটিস আর কী? ওঁদের ইয়ারলি চ্যাম্পিয়ানশিপের আগে একটু হাতটা ঠিক করে নিই। ওই।

তারপরে বললেন, গুমিয়ার রাইফেল ক্লাবের কথা জানলেন কী করে আপনি?

ওই ক্লাবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমিও উপস্থিত ছিলাম। ওই রেঞ্জে পিস্তলও ছুঁড়েছি বহুবার যদিও প্রতিযোগিতাতে অংশগ্রহণ করিনি। আপনাদের ফাউন্ডার প্রেসিডেন্ট সুব্রত চ্যাটার্জি ছিলেন না?

তা বলতে পারব না। তখন আমি মুম্বাইতে কেটারিং পড়তে গিয়েছিলাম।

ও৷ তাহলে দেখান না শেষ কার্ড দুএকটা।

শর্মাসাহেব উঠে গেলেন মুখ গোঁজ করে।

কন্দর্পনারায়ণ বললেন, তাজ্জব কি বাত।

ঋজুদা বলল, তাজ্জবের কী আছে? রাইফেলে মি. শর্মার হাত যে ভাল কি আপনি জানেন না? না জানলে, প্র্যাকটিসের জন্যে অত কাট্রিজ আপনি প্রতি বছর কলকাতার দোকান থেকে ওঠাতেন?

অন্য গুলির সঙ্গে ওঠাতাম। আমি অত জানব কী করে। শিকারও করি না শিকারের মাংসও খাই না। এরা যেমন যেমন চায় তেমন তেমন পাঠিয়েছি। তা ছাড়া পয়েন্ট টু-টু রাইফেলের গুলির দাম তো সবচেয়ে সস্তাও।

তা ঠিক।

শর্মাসাহেব দুটি কার্ড নিয়ে এলেন। ঋজুদা হাতে নিয়েই একটু উপরে তুলে বলল, চমৎকার। তারপর আমাকে দিয়ে বলল, দ্যাখ।

দেখলাম, বুলস আই-এর টাকার মতো কালো জায়গাটা একেবারে ফুটো হয়ে গেছে।

ঋজুদা বলল, আপনার তো ন্যাশনালে যাওয়া উচিত। এত ভাল পাঞ্চ করেছেন কার্ড। তাও স্পোর্টিং রাইফেল দিয়ে, ম্যাচ রাইফেল দিয়ে নয়।

না। ম্যাচ রাইফেল কোথায় পাব।

চমৎকার। কনগ্রাচুলেশানস মি. শর্মা।

তারপরই বলল, কন্দর্পনারায়ণের দিকে ফিরে, আমরা একটু রোদে পিকনিক করব। আপনাদের এখানে শতরঞ্জি হবে একটা? রাতেই ফেরত দিয়ে যাব। অথবা বিকেলেই। নিজেরা না আসতে পারলে পাঠিয়ে দেব কাউকে দিয়ে।

কন্দর্পনারায়ণ বললেন, শতরঞ্জি কি হবে? কী শর্মা হবে কি?

শর্মাজি বললেন, একটিই আছে।

আনতে বলুন তাহলে।

জি হ্যাঁ।

শর্মা সাহেব চলে গেলে ঋজুদা বলল, কার্ড কখনও পাঞ্চ করেছিস?

না তো! আমি বললাম।

এই দ্যাখ, মধ্যের এটাকে বলে বুলস আই। তা তো জানিসই বোধহয়, লেম্যানরাও জানে। তারপরে যে সার্কেলটা, সেটার নাম ‘ইনার। তারও পরে যে বৃত্ত সেটার নাম ম্যাগপাই’ আর সবচেয়ে বাইরে যে বৃত্ত তার নাম আউটার। বুলস আই-তেই যে শর্মা সাহেবের গুলিগুলো লেগেছিল শুধু তাই-ইনয়, কোনও কোনও গুলি একটার ঘাড়ে আরেকটা পড়েছে, মানে, ফুটো দিয়ে গলে গেছে।

আমি দেখে সত্যিই অবাক হয়ে গেলাম।

এই জঙ্গলে বসে কিচেন ম্যানেজারি করে রাইফেলের হাত এইরকম রাখা মস্ত বাহাদুরি বলতে হবে।

তিত্বর বটের বগারি মারেন হয়তো সালভর, যখন যা পাওয়া যায়–এমনি করেই হাত ঠিক রেখেছেন।

বললাম, গুমিয়ার সুব্রত চ্যাটার্জি মানে তোমার বন্ধু? সেই গোপালদা-সুব্রতদা-নাজিম সাহেব?

ইয়েস। সুব্রত ও গোপাল দুজনেই চলে গেছে। নাজিম সাহেব তো কবেই গেছেন।

শর্মাসাহেব ফিরে এলেন একজন খিতমদগারের হাতে শতরঞ্জি দিয়ে। দেখলাম সবুজ-রঙা একটি শতরঞ্জি, সেই পিপ্পলগাছের উপরের মাচার উপরে যেটা ছিল। ঋজুদার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হল।

ঋজুদা বলল, বাঃ ফারস্ট ক্লাস। এখান থেকে যাওয়ার সময়ে গাড়িতে তুলে নিস রুদ্র।

কন্দর্পনারায়ণের মুখ ক্রমশ গম্ভীর হয়ে উঠেছিল।

উনি শর্মাসাহেবকে বললেন, আপনি গিয়ে নাস্তা লাগানোর বন্দোবস্ত করুন তাড়াতাড়ি। উনি চাইছিলেন না যে শর্মাসাহেব আর বেশিক্ষণ আমাদের সামনে থাকুন।

ঋজুদা কন্দর্পনারায়ণকে বললেন, রহস্যটা সমাধান প্রায় করেই ফেলেছি। আপনার মেজভাই ভীষ্মনারায়ণকে আততায়ী রাইফেল দিয়ে গুলি করে মেরেছে। কিন্তু যে রাইফেল দিয়ে মেরেছে সেটা পয়েন্ট থ্রি ফিফটিন–ইন্ডিয়ান অর্ডন্যান্স এর।

আমি অবাক হয়ে ঋজুদার মুখে চেয়ে রইলাম।

তারপরই বলল, আপনার কি কারওকে সন্দেহ হয়?

চমকে উঠে কন্দর্পনারায়ণ বললেন, আমার?

তারপরই সামলে নিয়ে বললেন থ্রি ফিফটিন রাইফেল দিয়ে কেউ গুলি করে থাকলে একজনকেই সন্দেহ হতে পারে।

কে সে?

মুনতাজার আলি। তাকে আমি থ্রি ফিফটিন রাইফেল কিনে দিই একটা। সেই রাইফেল দিয়ে সে যে আমার ভায়েরই রক্তপাত ঘটাবে তা জানব কী করে। আপনি রাইফেলের বোরের কথা না বললে তো আমি বুঝতেই পারতাম না। বড় বিচিত্র এ সংসার। মুনতাজারকে এ বাড়ির কেউই দেখতে পারে না। আমিই শিশুকাল থেকে প্রশ্রয় দিয়ে এই দৈত্য বানিয়েছি। নানারকম মাস্তানির জন্যে মানুষে আমাকে দোষ দেয় এখন যদি তাকে পুলিশ অ্যারেস্ট করে ভীষ্মনারায়ণের মার্ডারের চার্জে, লোকে এবং আমার পরিবারের মানুষেরাই বা কী ভাববে?

কী আর ভাববে। ভাববে আপনিই তাকে ভীষ্মনারায়ণকে মারতে প্ররোচিত করেছেন।

ভাববে কি না বলুন!

মুখে উনি এ কথা বললেন বটে ওঁকে একটুক্ষণ আগের তুলনাতে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। হাঁক ছাড়লেন হঠাৎ জোরে, আরে নাস্তাকা ক্যা হুয়ারে। আরে-রে রামখিলাওন।

ভিতর থেকে পড়েজি চিৎকার করে বলল, বন গ্যয়া হুজৌর। ঔর স্রিফ পাঁচ মিনট।

পড়েজির নামই কি রামখিলাওন পড়ে? বোঝা গেল না ঠিক। তবে গলার স্বরটা অবশ্য তেমনই মনে হল।

ভাল করে নাস্তা করার পরে কন্দর্পনারায়ণের কাছে বিদায় দিয়ে আমরা বেরোলাম। ঋজুদা বলল, শতরঞ্জিটা নিয়ে চল। আমি শতরঞ্জিটাকে Scorpion এর পেছনে তুলে নিলাম।

কন্দর্পনারায়ণ বললেন, কলকাতাতে কবে দেখা করব আপনার সঙ্গে?

আপনি কবে ফিরবেন? যেদিন ফিরবেন সেদিনই বিকেলে ফোন করবেন একটা। কবে ফিরবেন?

কথা তো আছে পরশু।

ঠিক আছে। আপনার সময়মতো আসুন। ততদিনে বোধহয় ফ্যায়সালা একটা হবে। মুনতাজারের বিরুদ্ধে কেসটা তৈরি করতে মানে চার্জ ফ্রেম করতে আপনার অনেক সাহায্যর দরকার হবে।

ঠিক আছে।

ফাগুয়ারা ভিলার বাইরে বেরিয়ে আমি বললাম, সেই পিপ্পলগাছের কাছে যাব কি?

আমিই চালাচ্ছিলাম গাড়ি।

না তার দরকার নেই। শতরঞ্জিটাতেই আমাদের কাজ চলে যাবে। পুলিশের স্নিফার ডগকে শতরঞ্জির গন্ধ ভাল করে শুকিয়ে দিলে তারাই শর্মাকে ধরবে ফাগুয়ারা ভিলাতে তাদের নিয়ে এলে। বাকিটা ফরেনসিক এক্সপার্টরা করবেন।

এবারে কোন দিকে যাব?

পিতিজ বাংলোতে। একবার চেক করে নে কিছু ফেলে গেলাম কিনা। তোয়ালে দুটো টগর গাছের উপরে মেলে দেওয়া আছে সে দুটোকে তুলে নিতে হবে।

তারপর?

তারপর কোতোয়ালিতে গিয়ে শতরঞ্জিটা জিম্মা দিতে হবে এবং এস. পি-র সঙ্গে কথা বলতে হবে।

তারপর?

তারপর টুটিলাওয়া সীমারিয়া বাঘড়া মোড় হয়ে চান্দোয়া টোরি হয়ে কুরু হয়ে বিজুপাড়া হয়ে রাঁচি। কোতোয়ালি থেকে বেরিয়ে বীরুকে একটা ফোন করতে হবে।

আমি পিতিজ বাংলোতে গিয়ে তোয়ালে দুটো গাড়ির পেছনে তুলে নিলাম। শুকিয়ে গেছিল ততক্ষণে। চৌকিদার ও তার চেলাকে বকশিস দিয়ে গাড়িতে উঠলাম।

ঋজুদা বলল, দুজনকেই দিয়েছিস তো?

হ্যাঁ।

বড় পাত্তি।

হ্যাঁ।

কোন বড় পাত্তি?

পাঁচের।

ঠিক হ্যাঁ।

এই বকশিসের ব্যাপারে ঋজুদার মতো উদার-হস্ত খুব কম মানুষকেই জানি। ঋজুদা বলে, গরিব দেশ আমাদের-স্যোশালিস্ট হবার এমন সহজ পথ আর নেই। Always from the Haves to the Have nots! আমাদের দেশের সাধারণ মানুষেরা এত ভাল যে, সোনা দিয়ে এদের ওজন করলেও তুল্যমূল্য হয় না।

চৌকিদারদের সেলাম আর থামে না। এ জীবনে এক রাত থাকা বাবু অন্য কেউ পাঁচশো টাকার পদ্মফুলের রঙের নোট আর কখনও দিয়েছেন বা দেবেন এমন আশা ওরা কখনওই করেনি।

গাড়িটা হাজারিবাগমুখো করে বললাম, ঋজুদা এবার summing-up করো। আর প্রতীক্ষা সহ্য হয় না। আমিই তোমার সবচেয়ে পুরনো সাগরেদ–তাই সিনিয়রিটি বিচার করলেও আমাকেই সবচেয়ে আগে কনফিডেন্সে নেওয়া উচিত।

ঋজুদা বলল, দাঁড়া! পাইপটা ভাল করে ধরিয়ে নি।

তা ধরাও কিন্তু জানালা খুলো না। বড় ঠান্ডা হাওয়াটা।

তুই প্যাসিভ স্মোকিং করবি?

তা না হয় একটু করলামই। তোমার গোল্ডব্লক টোব্যাকোর গন্ধটা আমার ভারী ভাল লাগে।

পাইপটা ধরিয়ে ভাল করে এক টান লাগিয়ে ঋজুদা বলল, কী জানতে চাস বল?

মাচাতে থ্রি-ফিফটিন রাইফেলের গুলি পাওয়া যাওয়া সত্ত্বেও শর্মাসাহেবই পয়েন্ট টু-টু দিয়ে ভীষ্মনারায়ণকে মেরেছেন এমন তুমি ভাবলে কেন?

কন্দর্পনারায়ণের চাল ওটা। উনি এক ঢিলে দুই পাখি মারার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু করতে গিয়ে ওভার কনফিডেন্ট হয়ে গেছিলেন যে জন্যে এই বিভ্রাট। উনি নিশ্চয়ই মুনতাজারের কাছ থেকে থ্রি ফিফটিন-এর এম্পটি কাট্রিজ চেয়ে নিয়েছিলেন একটি বা একাধিক। শর্মাও চাইতে পারে কন্দর্পনারায়ণের নির্দেশে।

কী বলে চাইলেন?

–সে কত কিছু বলে চাওয়া যায়। বাচ্চারা খেলবে বা তাবিজ বা মাদুলি বানাবেন। তা ছাড়া, যিনি রাইফেলটাই প্রেজেন্ট করেছেন এবং গুলিও সাপ্লাই করেন তিনি চাইলে না দেওয়ার কী আছে?

কিন্তু আমিই ভেবে দেখলাম অত দূর থেকে থ্রি ফিফটিন রাইফেল দিয়ে অমন স্নাইপিং করা প্রায় অসম্ভব। তা ছাড়া টেলিফোটো লেন্স তো ছিল না।

ছিল না যে তা তুমি জানলে কী করে?

বলতে পারিস, আন্দাজেই কিছু হ্যাঁজার্ডাস গেসস তো করতে হয়ই। পরে অবশ্য ভটচার্যি সাহেব পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এবং ফরেনসিক টেস্টের রিপোর্ট-এ পয়েন্ট টু-টু রাইফেলের ব্যাপারটা কনফার্ম করলেন। বুলেট দেখেই ওরা জানতে পেরেছিলেন।

বলেই বলল, কন্দর্প, এই ডাইভার্সনটা মানে, ফোকরে শর্মাকে দিয়ে থ্রি ফিফটিনের এম্পটি শেল নিয়ে রাখাটা মারাত্মক চাল চেলেছিল। যে কোনও গোয়েন্দা এই গাড্ডায় পড়লে আর উঠতে পারত না। তুই যেমন পড়েছিলি! ভটকাইও। তিতির কিন্তু পড়েনি। মেয়েটা প্রচণ্ড ইন্টেলিজেন্ট যে এ কথা তোকে স্বীকার করতেই হবে।

সে কথা কি কখনও অস্বীকার করেছি? সব দিক দিয়েই ও আমাদের মধ্যে বেস্ট।

আমার বন্ধু জনসন সাহেব একটা কথা বলতেন।

কী কথা?

একটা কম্যুনিটি যখন ডুবে যেতে বসে তখন দেখা যায় মেয়েরা সব দিকে ভাল হয়ে উঠে আসছে আর ছেলেরা তলিয়ে যাচ্ছে। আমাদের বাঙালি সমাজেও এখন তেমনই ঘটছে। আজকে বাঙালি মেয়েরা ছেলেদের দশ গোল দিয়ে যাচ্ছে জীবনের সমস্ত পরীক্ষাতে।

আমি চুপ করে রইলাম। মিনমিন করে বললাম, তা ঠিক।

শুধু ঠিকই নয়, বল, বিলকুল ঠিক।

বিলকুল ঠিক।

তারপর বললাম, কিন্তু কন্দর্পনারায়ণ তো জানতেনই যে থ্রি ফিফটিন রাইফেলের গুলি পেলে মুনতাজারকেই ফাসাবে পুলিশ।

জানতেনই তো। শুধু তাই-ই নয়, পুলিশ তো ওই কর্মটাই করত যদি না তুই এম্পটি শেলটা পকেটস্থ করতিস। কোতোয়ালিতে মোটা মোটা খামও দিয়ে রেখেছিল কন্দর্প ঘটনা ঘটার আগেই, সে বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। সে ভেবেছিল, আমার কানেকশানস সে তার অ্যাডভান্টেজেই লাগাবে কিন্তু তা যে তার বিপক্ষে চলে যাবে তা সে দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। আমরা কলকাতা থেকে ট্রেনে চড়বার দুদিন আগেই মার্ডারটা হয়েছিল এবং ফাগুয়ারা ভিলাতে এসে পুলিশ সুপারফিশ্যাল এনকোয়ারি করে চলেও গিয়েছিল। কিন্তু মেজভাই-এর মৃত্যুতে বড়র নির্বিকার থাকাটা ভাল দেখায় না বলেই কন্দর্পনারায়ণ লোক দেখানোর জন্যে গোয়েন্দা লাগানোর কথা ভেবেছিল।

শার্দুলনারায়ণকে জেরা করে জেরবার করেছিল নিশ্চয়ই। বেচারা মিশিরজিকেও রেয়াত করেনি।

কে?

পুলিশ।

তা তো হবেই। জেরবার তো চিরদিন নিরপরাধীরাই হয়।

মুনতাজারকে ফাঁসিয়ে লাভ কী হত কন্দর্পনারায়ণ-এর।

আমি বললাম।

মুনতাজার দৈত্যকে আর বোতলে ফেরাতে পারছিল না কন্দর্পনারায়ণ। মুনতাজার এবং রোজি মিলে কন্দর্পনারায়ণকে রীতিমতো নিংড়ে নিচ্ছিল। কন্দর্পনারায়ণ কলকাতাতে একটা ছোট ফ্ল্যাট কিনে সেখানে টিভি সিরিয়ালের এক নায়িকাকে রেখেছে বছর দুই হল। মুনতাজার তা জানতে পেরে নিয়মিত ব্ল্যাকমেইল করছিল কন্দর্পনারায়ণকে। এমনকী সেই মেয়েটিকেও টেররাইজ করছিল।

তুমি জানলে কী করে।

এসব তথ্য রায়পুরে কন্দর্পনারায়ণের পরিবারের নানা মানুষ ও পরিচিতদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা। তথ্যে ভুল নেই কোনও।

এই না তুমি বললে, মেয়েরা উঠে আসছে আর ছেলেরা তলিয়ে যাচ্ছে। টিভি সিরিয়ালের মেয়েটির বেলাতে কী হল?

ঠিকই বলেছি। যারাই উঠে আসে তারাই জানে উঠে আসার কত রকম হ্যাঁপা। একটি মেয়েকে দেখে তুই বিচার করতে পারিস না। একসেপশান প্রভস দ্য রুল। এক-এক পেশার এক এক রকম। দোষ দেওয়া উচিত নয়।

তারপর।

তাই শর্মাকে দিয়ে ভীষ্মনারায়ণকে মারিয়ে সেই হত্যার দায় মুনতাজারের উপরে চাপিয়ে দিয়ে কন্দর্পনারায়ণ এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিল। এবং সেই চেষ্টাতে প্রায় সফল হয়েও এসেছিল।

কিন্তু কন্দর্পকে পুলিশ ছোঁবে কী করে? তার তো এই হত্যাতে কোনও ইনভলভমেন্ট নেই।

নেই কী রে! অ্যাবেটমেন্টের দায়ে পড়বে না। শর্মাকে স্পেইনে বেরিয়ে আসার খরচ সে দেবে কেন? যৌথ মালিকানার পারিবারিক অবসর বিনোদনের ফাগুয়ারা ভিলা-র কিচেন ম্যানেজার তার এত প্রিয় হবে কেন?

স্টেটস নয়?

না স্টেটস নয়, স্পেইন।

আচ্ছা, মি. শর্মা কেন এমন কাজ করতে গেলেন?

অলিম্পিক দেখতে যাবে বলে–তাও ওর যাতে ইন্টারেস্ট–তাই দেখতে।

দেখতেই যাচ্ছে শুধু, রাইফেল, পিস্তল ও স্কিট আর ট্রাপ গান-শুটিং। এবারে অলিম্পিক কোথায় হচ্ছে?

স্পেইনের বার্সিলোনাতে। বার্সিলোনাতে সে যাচ্ছে, তার টিকিটও কাটা হয়ে গেছে। স্টেটসে যাচ্ছে এ খবর ভুল। মিথ্যে করে বানানো। রাইফেল শুটিং শর্মার নেশা। নেশার জন্যে মানুষ কত অন্যায় কাজই না করে। অলিম্পিক দেখার সুযোগ ছাড়াও থোক ক্যাশ টাকাও নিশ্চয়ই পেয়েছে অথবা পাবে। শর্মা ব্যাচেলর। এই তার নেশা। নেশা তো নয়, নাশা।

শর্মা যে অলিম্পিক দেখতে যাচ্ছে তা জানলে কী করে তুমি!

ট্রাভেল এজেন্টের সঙ্গে ক্রস ভেরিফাই করিয়েছি কলকাতার সি. বি. আই.-কে দিয়ে। ফোন করেছিলাম ইস্টার্ন জোনের ডিরেক্টরকে। কন্দর্পনারায়ণ কয়েকটা মস্ত ট্যাকটিকাল ভুল করেছিল। তার মধ্যে একটি তার নিজের কোম্পানির ট্রাভেল এজেন্টকে দিয়ে মি. শর্মার ট্রাভেল অ্যারেঞ্জমেন্ট করানো। টিকিট, প্যাসেজ মানি, ক্যাশও দেওয়া হয়েছে। হোটেলের রিজার্ভেশানও করেছে তারই এজেন্ট। তারপর ফেরার পথে ব্যাংককও হয়ে আসবে শর্মা তিনদিনের জন্যে। এসব ভেরিফাই করে তারপরই আজ শর্মার সামনে এসেছি। তা ছাড়া সীতা ট্রাভেল এজেন্সির মিসেস হানসা প্যাটেলের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলাম। তার স্বামী নিরঞ্জনকে আমি বহুদিন হল চিনি।

বাবাঃ। এত তুমি করলে কখন?

মোবাইল ফোনের যুগে শুভ কর্ম বা অপকর্ম কিছু করতেই সময় লাগে না। যেমন কন্দর্পনারায়ণ যদি মোবাইলে তার চেলাদের বা মুনতাজারকেও বলে দেয় যে আমাদের হাজারিবাগের পথেই ওয়েলেইড করতে–মোটর সাইকেলে করে দুটো ছোঁড়া অটোমেটিক রাইফেল দিয়ে পথেই আমাদের মেরে রেখে যেতে পারে।

তা অবশ্য ঠিক। এখন এ. কে. ফর্টিসেভেন নেই কার কাছে! আমরা তো আগ্নেয়গিরির ওপর বসে আছি।

আমার গাড়ির কাচ অবশ্য বুলেট প্রুফ। মর্টার ছাড়া রাইফেলে সুবিধা কিছু করতে পারবে না।

সত্যি! এই ইনফরমেশন টেকনোলজির রমরমাতে ভাল যেমন হয়েছে খারাপও কম হয়নি। কী বলে?

আমি বললাম, ঋজুদাকে।

খারাপটাই বেশি হয়েছে ও হবে। যত দিন যাবে, ততই বোঝা যাবে।

এবারে বলল, ভীষ্মনারায়ণকে খুন করবার পেছনে কন্দর্পনারায়ণের মোটিভ কী?

আমি বললাম ঋজুদাকে। এটা আমার মাথাতেই আসছে না।

এক কথাতে বলব?

বলো।

ঈর্ষা।

বলো কি? গুণী মানী ছোটভায়ের উপরে দাদার ঈর্ষা এরকম চেহারাও নিতে পারে।

দেখলিই তো যে নিয়েছে। এত টাকার মালিক হয়েও মেজভাইয়ের পৃথিবীব্যাপী যশ ও সম্মান, আত্মীয়স্বজনের কাছে সমাদর, টিভি এবং নানা মিডিয়াতে লাগাতার এক্সপোজার এসবে পাগলা কুকুরের মতো ক্ষিপ্ত অবস্থা হয়েছিল কন্দর্পনারায়ণের। সংসারে আজকাল টাকা থাকলেই মান পাওয়া যায়। কিন্তু সেই মানের একটা সীমা আছে–একটা বিশেষ উচ্চতা পর্যন্ত পৌঁছানো যায় টাকা নিয়ে। কিন্তু তারপর টাকার কোনও দামই থাকে না।

ভীষ্মনারায়ণ কিন্তু এসব ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন। দাদাকে বিশেষ শ্রদ্ধা-ভক্তিও করতেন, দাদা বলেই, তার দোষগুণ বিচার না করেই পায়ে হাত দিয়ে হোলি ও দিওয়ালিতে প্রণাম করতেন। তিনি যে বিশেষ মানী মানুষ এ সম্বন্ধে তিনি সচেতন ছিলেন না আদৌ এবং এ কারণে তার আত্মীয়স্বজন চেনাপরিচিতিরা তাকে আরও শ্রদ্ধা করতেন। আর এসবই অসহ্য লাগত কন্দর্পনারায়ণের। তিনি বড়ভাই হওয়া সত্ত্বেও আত্মীয়রা, এমনকি নিজের অন্য ভায়েরাও ভীষ্মনারায়ণের কাছেই উপদেশ আদেশের জন্যে আসতেন।

আমি বললাম, ভাবা যায় না। ঈর্ষা মানুষকে এত নীচে নামাতে পারে?

পারে বইকী। ঈর্ষা তো ছয় রিপুর এক রিপু।

তাই?

নয়? মাৎসর্য। মাৎসর্য তো ঈর্ষারই এক নাম। মাৎসর্য হচ্ছে পরগুণদ্বেষ।

মাইকেলের ভাষায় ‘বিষদশন’।

আচ্ছা ঋজুদা, তুমি যে এই অ্যাডভেঞ্চার বা গোয়েন্দাগিরি করো এবং আমাদেরও তোমার সাগরেদ করো এতে কি তুমি আনন্দ পাও?

কেন? তোরা পাস না?

আমরা পাই, কিন্তু মনে হয়, মানে না বুঝে পাই। মানে, তাৎপর্য না বুঝে।

ঋজুদা হেসে ফেলল আমার কথা শুনে।

তারপর বলল, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এই যে আমাদের সামান্য প্রচেষ্টা–এর দামও তো বড় কম নয়। জোসেফ ম্যাটসিনির সেই কথা আছে না? যখন তুমি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করবে, তখনই তুমি কর্তব্যভ্রষ্ট হবে। উপনিষদের ঋষি বলেছেন, মমুরসি মন্যং ময়ি ধেহি।

তারপর বলল, অত দূরে যাবার দরকার কী আমাদের, হাতের কাছে রবীন্দ্রনাথ থাকতে?

..ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা,
হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা
তোমার আদেশে। যেন রসনায় মম
সত্যবাক্য ঝলি উঠে খরখড়্গসম
তোমার ইঙ্গিতে। যেন রাখি তব মান
তোমার বিচারাসনে লয়ে নিজ স্থান।
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে।
তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে। —‘নৈবেদ্য’-র কবিতা।

তারপর বলল, রবীন্দ্রনাথ পড় ভাল করে রুদ্র তোরা রবীন্দ্রনাথ পড়।

অনেকেই যে আজকাল বলছে শুনি, রবীন্দ্রনাথ ফালতু, রবীন্দ্রসংগীত অশ্রাব্য।

বলছে বুঝি? তা বলুক। এরা সব ‘আবহমানের ভাঁড় এসেছে গাধার পিঠে চড়ে। জীবনানন্দের লাইন মনে পড়ে গেল।

তারপরে একটু চুপ করে থেকে বলল, বুঝলি রুদ্র, জ্ঞানের সীমা চিরদিনই ছিল কিন্তু অজ্ঞতার সীমা কোনওদিনই ছিল না। রবীন্দ্রনাথের ছায়ায় থাক, জীবনে তরে যাবি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress