ফরাসি প্রেমিক (Farasi Premik) : 07
নীলা তখন ঘোরে, মালাবারে, আর ঘরে বিকশিত ধবল দস্তরাজি—সহাস্য সুশান্ত, স্নাত সুগন্ধিত, আয়েশি ভর্তার মতো হস্তদ্বয় প্রসারিত করে শোভনাঙ্গী স্বৈরিণীর পিনোন্নত পয়োধরে। সুখদ সম্মোহে সম্ভোগে সম্মত নীলা, মহাসুখসম্প্রপ্তি সমাপনে সুশান্ত শ্ৰান্তপ্রশান্ত।
মেঘ সরে যেতে দুধেল পূর্ণিমায় নক্ষত্র বিভ্রম কাটে, নেকড়ের জ্বলন্ত চোখ ঝলসে দেয় তার সর্বাঙ্গ।
থিরথির কাঁপে শীতে, পায়ের কাছের কাঁথাটি গায়ের ওপর টানতে গেলেই ওটি কেড়ে নেয় এক হিংস্র থাবা, যেন হাত থেকে আঙুল কেড়ে নিচ্ছে কোনও আততায়ী, আর্তনাদ করে ওঠে নীলা।
তোমার গায়ে জ্বর। কাঁথায় ঢেকো না। চোখের সামনে মূর্তিমান সুনীল।
ধীরে বালিশে মাথা রেখে ক্ষীণ কণ্ঠে বলে নীলা, আপনি এখানে কী করছেন?
সুনীল দম টেনে হাসে, অদ্ভুত শোনায় সে হাসি।
আশঙ্কায় কুকুরকুণ্ডুলি হয়ে নীলা শোনে, কিষানের খবর রাখো? ও তো ডিভোর্সের ব্যাপারে উকিলের সঙ্গে কথা বলেছে।
কুণ্ডুলির চতুষ্পার্শ্বে আরও মুঠো মুঠো শব্দ ছুঁড়ে দেয় সুনীল, চৈতালির সঙ্গে সম্পর্কটা তার ভাল যাচ্ছে না। ওর মেজাজ আজকাল বেশ খিটখিটে হয়ে উঠছে। রাতে এক বিছানায় শোয়া হয় বটে, স্পর্শ করে না পরস্পরকে। এভাবে কোনও পুরুষমানুষের যে চলে না, তা চৈতালির বোঝা উচিত। অনেকক্ষণ থেমে সরু গলায় বলে, ওকে আসলে বিয়ে করাই উচিত হয়নি আমার। খুব অন্য প্রকৃতির মেয়ে। এ বাড়ির জন্য কাগজপত্র দেওয়াতে চৈতালি খুব রাগ করেছে। তোমার জন্য চাকরির খোঁজ করতেও বাধা দিচ্ছে। বলে, বউ বাচ্চা সংসার ফেলে এত নীলা নীলা করো কেন, কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর আছেই। উফ…
সুনীলের উফ শেষ না হতেই দরজায় শব্দ। তড়িঘড়ি জামা চড়িয়ে, কুণ্ডলির ওপর কাঁথা ছুঁড়ে সুনীল দরজা উদোম করে, বেনোয়া।
কুণ্ডলির ওপর কোমল একটি হাতের স্পর্শ। ওদিকে আসি বলে স্বচ্ছন্দে চলে গেছে সুনীল। টেবিলের ওপর রেখে গেছে কলকাতা থেকে নিখিলের পাঠানো চিঠি।
বেনোয়ার হাতে রঙিন কাগজে মোড়া উপহার, আর লাল একটি গোলাপ।
সুদূর থেকে ভেসে আসা কণ্ঠ নীলার, ওই লোকটি আমাকে ধর্ষণ করেছে।
নীলাকে, নীলার সমস্ত উত্তাপ বুকে জড়িয়ে হু হু করে কাঁদে বেনোয়া।
আঙুলে বেনোয়ার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে নীলা বলে, জানি না, হয়তো আমিই চেয়েছিলাম। মাথার ঠিক ছিল না।
আমার ওপর রাগ করে, আমি জানি।
কষ্টে ভরা আবেগ নিয়ে বেনোয়া বলে, এই আমি তোমার পাশে আছি, আমি ছাড়া আর কেউ তোমাকে ছুঁতে পারবে না। আমি তোমাকে সব দেব, সব।
সত্যি দেবে? আলুথালু বেশ, উড়োখুড়ো চুল, যেন ধুলোর ঝড়ে পড়া মেয়ে নীলা, কাতর স্বরে উদ্ধার ভিক্ষে চাইছে।
বেনোয়া কথা দেয়, নীলাকে ছেড়ে আর সে কোথাও যাবে না। নীলাকে নিরাপত্তা দেবে সে।
রঙিন কাগজ আর ফিতে খুলে নিলে বের হয় বোদেলেয়ারের সবগুলো কবিতার বই। নীলার তপ্ত শুষ্ক ওষ্ঠ সিক্ত হয় প্রেমার্দ্র চুম্বনে। আরও সিক্ত হতে চায় নীলা, প্লাবনে ভাসতে চায়। বেনোয়া বলে, আগে সেরে ওঠো, তারপর।
বেনোয়ার হাতটি নিয়ে নীলা তার কপালে রাখে, ইচ্ছে এভাবে কপালে হাত রেখে বেনোয়া বলুক, জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গা। জ্বর হলে মলিনা যেরকম ক্ষণে ক্ষণে হাত রাখতেন কপালে, আর বলতেন ইস জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গা, নীলার ইচ্ছে করে বেনোয়া বলুক অমন উদ্বিগ্ন স্বরে, জলপট্টি দিক কপালে মলিনা যেমন দিতেন, গলায় তোয়ালে পেঁচিয়ে মাথাটি বিছানার কিনারে এনে বদনিতে জল ঢালতেন মাথায়, জল গড়িয়ে নীচের বালতিতে পড়ত। নীলার ইচ্ছে করে বালিশের কাছে থোকা থোকা আঙুর এনে বেনোয়া রাখুক অনির্বাণ যেমন রাখতেন, দুর্বল হাতে একটি একটি করে সে আঙুর মুখে দেবে। মলিনা যেমন শিংমাছের পাতলা ঝোলের সঙ্গে জাউভাত করে এনে মুখে লোক তুলে দিতেন, তেমন দিক বেনোয়া।
কপাল থেকে হাতটি সরিয়ে বেনোয়া বলে, তুমি কি অসুস্থ বোধ করছ?
নীলা বলে, সে ঠিক আছে।
ইচ্ছেগুলো চেপে রেখে জিজ্ঞেস করে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে আমার গা তাই না?
ও তা তো জানি না। তুমি কি দেখতে চাচ্ছ তোমার জ্বর কত? ঠিক আছে আমি তোমাকে জ্বর মাপার যন্ত্র এনে দিচ্ছি।
জ্বর মাপার যন্ত্রটি স্নানঘরে রাখা ওষুধের বাক্স থেকে এনে নীলার দিকে বাড়াতেই নীলা হাঁ করে মুখ, সেই হাঁয়ের দিকে হাঁ হয়ে তাকিয়ে যন্ত্রটি বেনোয়া হাতে দেয় নীলার। হাতে দিয়ে তোমার সেবায় জীবন সঁপিনু ভঙ্গির একটি হাসি হাসে। ওই হাসি দেখে যন্ত্রটি মুখের ভেতর ঢুকিয়ে মুখ থেকে প্রায় বেরিয়ে আসা ইচ্ছের লাগাম টেনে রাখে।
সে রাতেই বেরিয়ে দুটো ভরা সুটকেস নিয়ে বাড়ি ফেরে বেনোয়া। নীলাকে ছাড়া তার জীবন অর্থহীন, এ সে বুঝে গেছে, তাই এ সিদ্ধান্ত।
আর ওদিকের সম্পর্কটা?
সে ধীরে ধীরে চুকিয়ে ফেলব।
কত ধীরে, তা জানার তার ইচ্ছে করে না। বেনোয়ার এই সব ছেড়ে ছুড়ে তার কাছে চলে আসায় গভীর জ্বরের চেয়ে আরও বেশি কেঁপেছে নীলা, কেঁপেছে সুখে। সে এখন স্পষ্ট জানে বেনোয়া তাকে ভালবাসে। বেনোয়ার কাছে নীলার আর চাওয়ার কিছু নেই। তার বুকের সুগন্ধ নিতে নিতে নীলা পরম নিশ্চিন্তে চোখ বোজে। বাড়িটির পেছনে অঢেল টাকা খরচা করা তার সার্থক হয়েছে, মনে তার স্বপ্ন ছিলই এ বাড়িতে বেনোয়াকে নিয়ে একটি সংসার পাতার। স্বপ্ন এখন নীলার হাতের মুঠোয় রক্ত মাংসসহ জীবন্ত। অনিশ্চিত জীবনের বোঝা কাঁধে বয়ে বেড়াবার দিন ফুরিয়েছে তার, আজ থেকে জীবন আমূল বদলে গেল। বেনোয়ার হাত ধরে রাজনন্দিনীর মতো সে এখন পথ চলবে, কোনওদিন আর কোনও বর্ণবাদী টুঁ শব্দ করার সাহস পাবে না। সরকারের বিদেশি তাড়ানো মন্ত্রণালয় নীলার জন্য ফরাসি যুবকের আত্মত্যাগ দেখে ধারালো দাঁত নখ গুটিয়ে নেবে। কিষানের কুচুটেপনা নীলাকে স্পর্শ করতে পারবে না, সুনীলের করুণাকে আঁস্তাকুড়ে ছুঁড়ে দেবে সে। তার বেনোয়া আছে। বেনোয়া তার একার, আর কারও নয়, সে কোনও রক্ষিতা নয় কারও। বেনোয়া তার জ্বর কপালে হাত না রাখুক, না দিক জলপট্টি, না দিক মাথায় জল, না কিনে আনুক আঙুর, তবু বেনোয়া তাকে ভালবাসে, পাশ্চাত্যের ভালবাসা এমনই, হাতে জ্বর মাপের যন্ত্র দেওয়াই কি কম দেওয়া নাকি!
বেনোয়া নিজে রান্না করে, রান্না বলতে কাসুলের একটি টিন উপুড় করে ঢেলে দেওয়া কড়াইয়ে, গরম হলে ঢেলে দেওয়া থালায়, কাঁটা ছুরি আর মুখ মোছার রুমাল থালার পাশে রাখা, ওয়াইন ঢেলে দেওয়া গেলাসে, আর লম্বা বাগেত ফালি ফালি করে কেটে রাখা। টেবিলে সাজিয়ে নীলাকে ডাকে বেনোয়া, মোমের শিখার ওপারে নীলা দেখে বেনোয়ার হাসি মুখ। সিমের বিচির সঙ্গে ভেড়ার মাংস সেদ্ধ, ভেড়ার গায়ের গন্ধ মাংসে, নীলার খেতে রুচি হয় না। বেনোয়া পা নাচিয়ে বেশ স্বাদ হয়েছে তাই না বলে চিবোয়। নীলা একটি দুটি সিমের বিচি কাঁটায় তুলে মুখে দিয়ে হ্যাঁ বেশ স্বাদ বলে। বলে, কারণ সংসারী বেনোয়াকে হতাশ করতে নীলার আশঙ্কা হয়।
বেনোয়া জিজ্ঞেস করে, আমার ছোটবেলা কী করে কেটেছে, শুনবে?
ছোটবেলার গল্প করে সে। মন দিয়ে শোনে নীলা, ছ বছর বয়সে রেলে করে ইতালি গিয়েছিল বাবা মার সঙ্গে, রোমের রাস্তায় দেখেছিল জনতার ঢেউ, কীসের উৎসব ছিল, মনে করতে পারে না, উৎসবের একটি ছেলে থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বেনোয়ার হাত ধরে টেনেছিল, এসো, বাজিফোটানো হবে। বেনোয়া যায়নি, পরে তার বারবার মনে হয়েছে গেলেও পারত। সেই বাজির উৎসব দুর থেকে দেখেছে সে, আর বুক ফেটে গেছে আফসোসে।
পরের রাতেও ছোটবেলার গল্প বলতে গিয়ে ওই একই গল্প বলে বেনোয়া।
বেনোয়ার সঙ্গে নীলার সত্যিকার সংসার শুরু গেছে। সংসারে এক গল্প বারবার শুনলে এমন কিছু ক্ষতি নেই, নীলার একরকম আনন্দই হয় বেনোয়ার শৈশব কৈশোরের খুঁটিনাটি জানতে, কবে কোন ইস্কুলের মাস্টার তাকে বাহবা দিয়েছে, কবে কোন বন্ধুর নাকে ঘুষি লাগিয়ে অরলেওঁর গির্জায় পুরোহিতের কাছে গোপনে নিজের দোষ স্বীকার করে এসেছে সে। তার ছোটবোন ভালেরি লেখাপড়ায় বেনোয়ার মতো ভাল ছিল না, তাই বরাবরই সে হিংসে করে এসেছে তাকে, ছোটবেলায় বেনোয়ার ইস্কুলের বইখাতা প্রায়ই কুটি কুটি করে ছিঁড়ে মাটির তলে পুঁতে রাখত। ভালেরি এখনও তাকে হিংসে করে, নিজে সে শখের ওকালতি করে, ও করেই নাকি বেনোয়ার চেয়ে বেশি কামায়। বিয়ে করেছে, বাচ্চা হয়েছে, দাবি করে বাচ্চাটির স্বভাব চরিত্র নাকি জ্যাকলিনের চেয়ে ভাল।
রাতে বিছানায় শুতে আসে বেনোয়া উলঙ্গ হয়ে।
তোমার এভাবে জামা কাপড় গায়ে ঘুম আসে! বেনোয়া নীলার জামা কাপড় পরে শোয়ার দিকে ভ্রু কুঞ্চিত করে।
ঘুম আসে। বরং উলঙ্গ হয়ে ঘুমোনোর অভ্যেস আমার কোনওকালেই নেই।
নীলার সহসা মনে হয় নীলার উলঙ্গ শরীরে বুঁদ হতে চাইছে বেনোয়া, তাই এই ইঙ্গিত, কিন্তু পাশে ঘন হয়ে শুয়ে নীলাকে সেন্তেক্সোপেরির ছোট্ট রাজকুমারের গল্প শোনায় বেনোয়া অর্ধেক রাত অব্দি, বেনোয়ার শীতল শরীরে শীতল শিশ্ন ঝুলে থাকে। পরের রাতেও শুতে এসে শেয়াল আর বাঘের গল্প বলে। গল্প শেষ হলে বিছানা ছেড়ে জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে।
কী হল কী! নীলা জিজ্ঞেস করে।
বেনোয়া বলে, না কিছু না।
কিছু তো নিশ্চয়ই।
জানালা থেকে চোখ না ফিরিয়ে বেনোয়া বলে, জ্যাকলিন নিশ্চয়ই আমাকে খুব মনে করছে।
কাল তুমি ও বাড়িতে গিয়ে জ্যাকলিনকে দেখে আসতে তো পারো!
জানালা থেকে ফিরে এসে নীলাকে চুমু খেয়ে, চোখে চিকচিক আনন্দ, বলে, সত্যি বলছ?
নিশ্চয়ই, তোমার ইচ্ছে করলে তুমি যাবে না কেন?
তাই তো, বেনোয়াও বলে, যাবে না কেন? জ্যাকলিনের শরীরে তারই রক্ত বইছে, জীবনে তার যা কিছু ঘটুক না কেন, সন্তানের প্রতি পিতার যে কর্তব্য তা সে নিশ্চয়ই করে যাবে।
জ্বর রাতের বেলা ভীষণ বেড়ে ওঠে নীলার, সারারাত কঁকায়। সকালের দিকে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লে বেনোয়াকে কাছের ফার্মেসি থেকে কিছু এমক্সিসিলিন কিনে আনতে বলে। না হবে না, ডাক্তার না লিখে দিলে ফার্মেসি থেকে এ ওষুধ কেনা যাবে না। বেনোয়া আপিসে চলে গেলে, নীলা রান্নাঘরে ঢুকে দেখে ধুয়ে মুছে সব ঝা তকতকে করে রেখেছে বেনোয়া। পুরো দিন তার যায় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে, বেনোয়ার ফিরতে আর ক’ঘণ্টা ক’মিনিট ক’সেকেন্ড বাকি আছে, তা হিসেব করতে করতে।
ওই অপেক্ষার সময়েই দানিয়েলের ফোন আসে।
জ্বর শরীরেও নীলা উচ্ছ্বাস আটকে রাখতে পারে না। বেনোয়ার সঙ্গে তার সংসারের নতুন খবর দেয়। সে যে রক্ষিতা নয়, এ কথাটি বার বার বলে।
চলে এসো দানিয়েল, দেখে যাও কীরকম সুখে আছি আমি।
দানিয়েল আগ্রহ দেখায় না নীলার সুখের সংসার দেখার।
অন্তত জ্বর দেখতে আসো। মনে হচ্ছে টাইফয়েড।
টাইফয়েড এদেশে হয় না। অন্য কোনও জ্বর সম্ভবত। জ্বরের মধ্যে এসে কী করব, জ্বর সারুক তোমার। তারপর আড্ডা দিতে যাব।
নীলার চেতন ফেরে, এদেশ ভারত নয়, কারও অসুখ দেখতে কেউ কারও বাড়ি যায় না। সুস্থ হও, উচ্ছল হও, প্রচুর জীবনশক্তিতে টইটম্বুর হবে যখন, তখন কিছু পান করে আসব। আর যদি অসুখ বিসুখ হয়ে মরো, কালো জামা পরে তোমার সৎকার উৎসবে গিয়ে তোমার উদ্দেশে পান করব আর নাচব। ব্যাস।
দুচার কথার পর আগামী সপ্তাহে মিউচুয়ালিতে নারীবাদীদের একটি অনুষ্ঠানে নীলা যদি যেতে চায়, যেতে পারে ধরনের একটি আমন্ত্রণ জানায় দানিয়েল।
ফোনে কথা শেষ করে সুনীলের রেখে যাওয়া খামটি খোলে নীলা। খুলে প্রথম সে অনির্বাণের চিঠিটি পড়ে, কিষানের মুখে যাহা শুনিলাম, তাহাতে আমার মানসিক অবস্থা কী প্রকার হইতে পারে, তাহা নিশ্চয়ই অনুমান করিতে পারো। বিদেশের মাটিতে যাহা ইচ্ছা তাহা করিবার সুযোগ হয়তো তুমি পাইতেছ, কিন্তু একদিন নিশ্চয় তোমার বোধোদয় হইবে, তখন সময় থাকিবে না আর শুধরাইবার। এ যাবৎ অনেক ভারতীয় আক্ষেপ করিয়াছেন কেন তাহারা বিদেশের কুকুর ধরিয়াছিল স্বদেশের ঠাকুর ফেলিয়া। সুতরাং সময় থাকিতে সঠিক পথ বাছিয়া নাও। কিষানের সহিত যদি মীমাংসা না করো, তবে অতি শীঘ্রই দেশে ফিরিয়া আসো। এখনও সময় আছে নিজের ভুল ত্রুটি সংশোধন করিয়া, সমাজের দশটা লোকে যেন আর অধিক মন্দ না বলিতে পারে, দেশে আসিয়া সেই মতো জীবন যাপন করো।
নিখিলের চিঠির বক্তব্যও প্রায় একই। একটিই পার্থক্য, চিঠিটি চলিত ভাষায় লেখা।
রাত সাতটায় বেনোয়া ফোন করে জানায়, আপিস থেকে সোজা সে রু দ্য রেনে গেছে। পাসকাল আর জ্যাকলিনকে নিয়ে রেস্তোরাঁয় খেতে যাবে, খেয়ে ওদের পৌঁছে দিয়ে, জ্যাকলিনকে গল্প বলে ঘুম পাড়িয়ে তবে বাড়ি ফিরবে।
বেনোয়া রাত্তিরে সুখী মুখ নিয়ে বাড়ি ফেরে। সঙ্গে সুখী একটি কুকুরের বাচ্চা, কলকাতার রাস্তায় নেড়িকুকুরের পড়ে থাকা বাচ্চার মতো। ও বাড়িতে দুটো কুকুর, যেটি তার খুব ন্যাওটা, সেটিকে নিয়ে এসেছে। কুকুরটি নীলাকে দেখে ঘেউ ঘেউ করে বিছানায় লাফিয়ে ওঠে। একে বিছানা থেকে নামাও, নোংরা করে ফেলছে বলে তাড়াতে হাত তুলতেই করো কী করো কী বলে বেনোয়া ছুটে এল। ওয়ান্ডাকে বুকে নিয়ে বিছানায় গড়িয়ে ওয়ান্ডার একটি হাত বাড়িয়ে নীলার দিকে বলল, আমার প্রেমিকার সঙ্গে হাত মেলাও ওয়ান্ডা। নীলা সংসারের তিন নম্বর সদস্যকে স্বাগতম জানাল।
ওয়ান্ডা বাচ্চা নয়, রীতিমতো প্রাপ্তবয়স্ক। আকারে ছোট, ছোট জাত বলে, এর চেয়ে বড় এ জাতের কুকুর হয় না। এই ছোট জাত কুকুরের মূল্য বড় জাতের কুকুরের চেয়েও বেশি। ওয়ান্ডা কী খেতে ভালবাসে, ঘুম থেকে কখন ওঠে, উঠে তার কী কী করা চাই, কখন তার হাওয়া খেতে যাওয়া চাই, কখন খাওয়া খেতে ইত্যাদি বিস্তারিত বর্ণনা করে বেনোয়া প্রতি রাতের মতো জামা কাপড় খুলে বিছানায় আসে। নীলাকে চুমু খায় আর বলে, জ্যাকলিন তো আমাকে ছাড়তেই চাচ্ছিল না, ওকে বলেছি তোমার কথা। ও তোমাকে দেখতে চাইছে।
বেনোয়া এরপর নীলাকে আরও একটি চুমু খেয়ে হেসে বলল, আর একটা কী কথা বলেছে জানো?
কী কথা?
বলেছে ও একটা ভাই চায়।
বেনোয়ার চোখে উথলে ওঠা আবেগ, কী দেবে না জ্যাকলিনকে একটা ভাই?
নীলার একটি হাত নিজের উত্থিত শিশ্নের ওপর রেখে বলে, চলো আজই ভালবেসে রোপণ করি স্বপ্ন।
নীলা প্রায় জিজ্ঞেস করতে নেয়, কার স্বপ্ন? তোমার? আমার? নাকি জ্যাকলিনের? কিন্তু করে না, আশঙ্কায়, যদি সে বলে বসে, তোমার মন এত ছোট, ছ বছর বয়সের একটা শিশুর সঙ্গে হিংসে করছ, ছি!
উত্থিত শিশ্নের আগাগোড়া স্পর্শ করেও শরীরে তার বান ডাকে না। স্তনবৃন্ত প্রেমিকের আঙুলের, ঠোঁটের, জিভের স্পর্শেও চোখ মেলে না। বেনোয়া বলে, তোমার অসুখ সারুক, তারপর না হয়।
বেনোয়াকে অনিশ্চিত অপেক্ষার মধ্যে ফেলতে নীলার আশঙ্কা হয়, যদি নীলার শরীরই একমাত্র আকর্ষণ বেনোয়ার কাছে, তবে এ শরীর সে ভোগ করুক, করেও তাকে ভালবাসুক। নীলা তার শরীর মেলে দেয় বেনোয়ার তৃপ্তির জন্য। বেনোয়া সে শরীরে রোপণ করে জ্যাকলিনের স্বপ্নের বীজ। রোপন করার সময় অবশ্য দুবার বিছানায় লাফিয়ে উঠেছে ওয়ান্ডা, লেজ নাড়তে নাড়তে ন্যাংটো মনিবের চাষ দেখেছে।
লজ্জার মুখ লুকিয়ে নীলার বুকে বেনোয়া বলে, দুঃখিত, তাড়াতাড়ি এসে গেলাম!
না, ঠিক আছে।
তুমি রাগ করোনি?
কেন?
তুমি যে পাওনি!
একদিন না হয় না পেলাম। নীলা মধুর হেসে বলে।
নীলা শীর্ষসুখে পৌঁছয়নি বলে অপরাধী মুখ করে অনেক রাত অব্দি বসে রইল বেনোয়া আর বারবারই ব্যাখ্যা দিতে লাগল, খুব ধকল গেছে আপিসে, মোটে বিশ্রাম নেওয়া হয়নি, সে কারণেই সম্ভবত, অথবা অনেক দিন বাদে বলে।
বেনোয়ার শেষোক্ত ধারণাটি নীলাকে স্বস্তি দেয়, অন্তত সে ভাবতে পারছে, জ্যাকলিনকে ঘুম পাড়িয়ে পাসকালের সঙ্গে সে সঙ্গম সেরে আসেনি। কেবল স্বস্তি নয় চমকিত হয় দেখে যে, পুরুষ নিজের তৃপ্তির চেয়ে সঙ্গিনীর যৌনতৃপ্তির ব্যাপারে সচেতন। অন্তত ভারতবর্ষে এমন সচেতনতার খবর সে শোনেনি। নীলার প্রেমিকপ্রবর সেই সুশান্তর সঙ্গে প্রথম মিলন হওয়ার পর একবারও সে জিজ্ঞেস করেনি সারা শরীরে আমি যেমন অদ্ভুত এক আনন্দ পেয়েছি, তুমিও পেয়েছ তা। ভারতবর্ষের বেশির ভাগ মানুষ, নীলার বিশ্বাস, মনে করে ব্যাপারটি পুরুষের, পুরুষের তৃপ্তির পর যে জিনিসটি মিলবে মেয়েদের, সে হল সন্তান। মাতৃত্বই যেহেতু নারীর জীবন সার্থক করে, পুরুষের অনুকম্পায় নারী তার জীবন সার্থক করার সুযোগ পায়, এ নিয়ে নারী যেমন কৃতজ্ঞ থাকে পুরুষের প্রতি, পুরুষেরও গৌরব করার সুযোগ হয়।
জ্বরে তিনদিন ভোগার পর বেনোয়া তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার নীলাকে পরীক্ষা করে ওষুধ লিখে দেয়, সে ওষুধ কিনে বাড়ি পৌঁছে নীলা দেখে শিশির গায়ে গাছ পাতা আঁকা। অবাক হলে বেনোয়া বুঝিয়ে বলে, এ সব গাছগাছালির ওষুধ, আজকাল কেমিকেল কেউ খায় না, বোকা ছাড়া। কৃত্রিমভাবে ফলানো জিনিস খেয়ে লোকের অসুখ করছে। গাছগাছালির ডাক্তারের কাছেই এখন সচেতন মানুষের ভিড়। ঝিমঝিম করে নীলার মাথা, জ্বরের কারণে নয়, গাছগাছালির কারণে। এ সব ওষুধ সে খেতে দেখেছে কলকাতার অশিক্ষিত অজ্ঞান লোকদের, যারা প্রতারকের খপ্পরে হামেশা পড়ছে, হামেশা নিঃস্বান্ত হচ্ছে, রোগে শোকে নিঃশব্দে মরে যাচ্ছে। দেখেছে তাদের, যারা চোখে ঠুলি এঁটে, কুসংস্কারের কালো চাদরে ঢেকে রেখেছে আপাদমস্তক। প্রাচ্যদেশে যুক্তি আর বিজ্ঞানের পক্ষে দাঁড়ানো নীলা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে দেখে পাশ্চাত্যের সভ্য শিক্ষিত উচ্চ সমাজের মুখ অন্ধকারের দিকে অযুক্তির দিকে ফেরানো। চোখে হেথা নয়, হোথা নয়, অন্য কোথার আকুলতা। গাছের শেকড় আর বাকল বেটে রস বানানো ওষুধের শিশি বেনোয়াকে লুকিয়ে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। পাশের বাড়ির ছাদের ওপর শিশি দুটো ভেঙে শত টুকরো হয়ে প্যারিসের শত ফোয়ারার মতো ছলকে ওঠে।
নীলার জ্বর এমনিতেই সাত দিন পর সেরে যায়।
জ্বর সারার পর নীলা নতুন উদ্যমে নতুন সংসারে মন ঢেলে দেয়। অর্ধেক দিন ধরে সপ্তব্যঞ্জন রেঁধে, স্নান করে সেজেগুজে বেনোয়ার অপেক্ষায় ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে চোখের মণি আর মন আটকে যায় যখন, বেনোয়া জানায়, পাসকাল আজ রাতে তাকে নেমন্তন্ন করেছে, আজ তার বাড়ি ফিরতে রাত হবে, নীলা যেন খেয়ে নেয়।
কিন্তু আমি যে এত কিছু রান্না করলাম তোমার জন্য।
আগে বলবে তো। কিন্তু পাসকালকে তো কথা দিয়ে ফেলেছি, যেতে হবে আমার।
নীলার মেনে নিতে হয়, যত হোক পাসকাল তার স্ত্রী। বেনোয়ার ওপর পাসকালের দাবি নীলার চেয়ে বেশি।
নীলা একা একা এ ঘর ও ঘর করে। কম্পিউটারের টেবিলটি বেনোয়া নিজের জন্য সাজিয়ে নিয়েছে, দু এক ফাইল কাগজপত্র, আর টেবিলের ওপর দুটো ফ্রেমে বাঁধানো ছবি, একটি পাসকালের, আরেকটি জ্যাকলিনের। পাসকালের ছবিটি হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নীলা। কোনও কোণ থেকে পাসকালকে তার অসুন্দরী ঠেকে না, ঘাড় অব্দি লাল চুল, পাতলা গোলাপি ঠোঁট, টিকোলো নাক, বসা গালের, সবুজাভ চোখের সুন্দরী পাসকালকে না ভালবাসার কোনও কারণ, নীলার মনে হয়, বেনোয়ার থাকতে পারে না।
সারাদিন চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করেছে ওয়ান্ডা। তার মনিব অনেক রাতে ফিরে ওয়ান্ডাকে কোলে তুলে ওরে সোনারে, ওরে পুতুলরে বলে আদর করে কুকুর ছোঁয়া গন্ধ হাতে নীলার গায়ে হাত বুলোতে থাকে।
নীলা ঘুমোয়নি, কিন্তু ভঙ্গি ঘুমেরই করে।
ঘুমিয়ে গেছ। তা হলে ঘুমোও, বিরক্ত করব না।
হঠাৎ শব্দ শুনে ঘুম ভেঙেছে ধরনে উঠে নীলা বলে, ও তুমি! এই মাত্র ফিরলে?
অনেকক্ষণ ফিরেছি। তুমি ঘুমিয়েছ বলে জাগাইনি।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে হাই তোলে, অনেক দেরি করে ফিরলে, অপেক্ষা আর কতক্ষণ করা যায়…
বেনোয়ার তাজা কণ্ঠ, নানারকম বিল এসে রয়েছে বাড়িতে, সব মেটাতে হল।
নীলা ঘুমের স্বরে বলে, থেকে গেলেই পারতে।
বেনোয়া জুতো খুলতে খুলতে বলে, ভেবেছিলাম থেকে যেতে। কিন্তু পাসকালই বলল, যাও নীলা অপেক্ষা করছে।
এ মুহূর্তে নীলার সম্ভবত পাসকালের কাছে কৃতজ্ঞ হতে হয়।
ও তোমাকে অন্য এক মেয়ের কাছে যেচে পাঠায়, এ কেমন? নীলার ঘুম কেটে যাওয়া স্বর। ও কি তোমাকে ভালবাসে না কি বাসে না?
নিশ্চয় বাসে।
তবে এই যে আমার সঙ্গে থাকছ, ও রাগ করে না? আমি তো পারতাম না বলতে যাও তোমার অন্য প্রেমিকার কাছে যাও। ও কী করে পারে?
ও খুব ভাল মেয়ে নীলা। বেনোয়া জোর দিয়ে আরও বলে, ওর মতো ভাল মেয়ে আমি পৃথিবীতে দুটি দেখিনি।
তা হলে এত ভাল মেয়েকে ছেড়ে এলে কেন?
তুমি তো জানো কেন? তোমার জন্য। জানো না?
তোমার নিজের জন্য কী ইচ্ছে করে, শুনি, কার সঙ্গে থাকতে, কোন বাড়িতে?
আমার নিজের জন্য যা ইচ্ছে করে, তা আমি করছি।
বিছানায় নয়, চেয়ারে বসে বলে বেনোয়া। নীলার চোখের দিকে চোখ ফেলে। আবছা অন্ধকারে বসা সে, আর নীলার ওপর আলো, বিছানার পাশের ছোট টেবিলের ছোট আলো!
আমার মনে হচ্ছে তুমি এখনও নিশ্চিত হওনি, তুমি কী চাও। নীলা বলে।
আমি তোমাকে আগেই জানিয়েছি আমি কী চাই। বলেছি, তোমাকে ছাড়া আমার জীবন চলবে না। বেনোয়া নরম স্বরে বলে।
আমাকে ছাড়া তোমার জীবন কী হবে, শুনি? তুমি কি খাবে না, দাবে না, ঘুমোবে না, চাকরি করবে না? জীবনের কী চলবে না তোমার?
আমি হয়তো সব করব কিন্তু সে আমি এই আমি হব না। জীবিত থেকেও মৃত। নীলা তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না? তুমি জানো না তোমাকে কতটুকু ভালবাসি। তুমি জানো না, কতটুকু ভালবাসা থাকলে একটি সুখের সংসার ছেড়ে আসা যায়। আমার আর পাসকালের মধ্যে কোনওদিন এতটুকু কথা কাটাকাটি হয়নি। তোমার ঘটনা আমি সব ওকে খুলে বলেছি। ও মেনে নিয়েছে। আমি কোনও কিছু লুকোই না ওর কাছে। ও আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু নীলা। ও আমাকে ভীষণ ভালবাসে, ভালবাসে বলেই আমি যা করতে পছন্দ করছি, তাতে ও বাধা দেয় না। ভালবাসার মানুষের জন্য ত্যাগ আর দেখেছ কোথাও এমন? পাসকালই পারে। ওকে আমি ভাল যেমন বাসি, শ্রদ্ধাও করি। তোমার জন্য আমি আমার সবচেয়ে ভালবাসার মানুষদের, আমার পাসকালকে, আমার জ্যাকলিনকে ছেড়ে দিয়েছি, এতেও তুমি খুশি হও না?
নীলা একটি বই মুখের সামনে তুলে ধরে। বেনোয়া কঠিন স্বরে বলে, বইটি সরাও, আমি তোমার চোখ দেখতে পাচ্ছি না।
চোখ দেখার দরকার কী তোমার।
আমি তোমার সঙ্গে কথা বলছি। আমার কথার উত্তর দাও, তুমি কি খুশি হওনি যে আমি তোমার কাছে আমার স্ত্রী কন্যা ছেড়ে চলে এসেছি? বলো।
নীলা বইটি মুখের সামনে ধরে রেখেই বলে, কেন বলো যে ছেড়ে এসেছি। তুমি তো ছেড়ে আসোনি। সে এখনও তোমার স্ত্রী। তোমাদের প্রতিদিন ফোনে কথা হচ্ছে। প্রায়ই ওর কাছে যাচ্ছ। ছেড়ে আসা বলো কেন? এর নাম ছেড়ে আসা নয়। তোমাদের ভালবাসার আংটি এখনও তোমার আঙুলে, তোমার টেবিলে ওর ছবি, লোকে যেখানে আদরের বউয়ের ছবি রাখে।
বেনোয়া চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। নীলার সামনে বসে, বইটি বাঁ হাতে সরিয়ে বলে, তুমি কী চাও বলো তো! তুমি চাও আমি ও বাড়িতে চলে যাই?
তোমার যদি ইচ্ছে হয়, নিশ্চয়ই যাবে। আমি বাধা দেব কেন? আমি তোমাকে এ বাড়িতে আসতে বলিনি। তুমি নিজে এসেছ। ও বাড়িতে যখন ছিলে, তোমার আমার সম্পর্ক কিছু খারাপ ছিল না। পার্থক্যটা কী?
বেনোয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আজ যদি অন্য কোনও লোক হত আমার জায়গায়, বলত আপিসে কাজের চাপ ছিল, অথবা মিটিং ছিল, অথবা আপিসের কাজে রাতের খাবার ছিল, তাই দেরি হয়েছে। আমি সত্য কথা বলি, কিছু লুকোই না তোমার কাছে। আমার সততার এই মূল্য দিচ্ছ তুমি, নীলা? তোমার মন এত ছোট কেন, আমি বুঝি না।
নীলা ধীরে শান্ত কণ্ঠে বলে, আমার মন ছোট নয় তো। মন বড়। বড় বলেই আমি বলছি তুমি পাসকালের সঙ্গে থাকো গিয়ে। ওর সঙ্গে সুখের সংসার করো, যেমন করছিলে। তুমি ওকে ছেড়ে আসোনি। তুমি ওকে ছাড়তে পারবে না, তার সবচেয়ে বড় কারণ কী জানো, ওকে তুমি ভালবাস।
বেনোয়া তার হাঁটুর ওপর দু কনুইয়ের ভর রেখে দু হাতে মাথা চেপে ধরে।
বেনোয়ার পিঠের ওপর একটি হাত রেখে নীলা বলে, আমি জানি তুমি সত্য কথা বলছ। কিন্তু ওর কথা ভেবেই আমি বলছি। আজ যদি তুমি আমার স্বামী হতে, আর তুমি যদি আমাকে ছেড়ে অন্য মেয়ের সঙ্গে থাকতে, আমার কী রকম কষ্ট হত, সে আমি অনুমান করতে পারি। পাসকালকে আর কষ্ট দিয়ো না। নিজেকেও আর কষ্ট দিয়ো না। তোমাকে হারিয়ে আমার খানিকটা কষ্ট হবে তা ঠিক। এ নিয়ে ভেবো না, কষ্ট পেয়ে আমার অভ্যেস আছে। কষ্ট পেয়ে আমার মারও অভ্যেস ছিল।
বেনোয়া উঠে ঘরের উজ্জ্বল বাতি জ্বেলে দেয়। নীলার বুকে ধক করে শব্দ হয়। এই বুঝি বেনোয়া গুছোতে শুরু করছে তার সুটকেস। এই বুঝি নীলাকে একা করে দিয়ে জন্মের মতো চলে যাবে তার একটি মাত্র আশ্রয়। আলো জ্বেলে বেনোয়া বিছানায় মুখোমুখি বসে নীলার, বলে, সত্য করে একটা কথা বলো। নীলা, তুমি কি মন থেকে বলছ কথাগুলো? তুমি কি সত্যি চাও আমি চলে যাই?
নীলা উত্তর দেয় না।
বেনোয়ার মুখে হাসি ফোটে, আমি জানি, তুমি মন থেকে ও সব বলছ না। তুমি বলতে পারো না। তুমি আমাকে ভালবাসো, তুমি আমাকে হারাতে চাও না।
নীলার কণ্ঠের কাছে এক থোকা কষ্ট এসে বসে। দাঁতে ঠোঁট চেপে ঢোক গিলে সে কষ্টের গতিকে নিম্নমুখী করে।
বেনোয়া নীলাকে বুকে জড়িয়ে দুলতে থাকে ডানে বামে। বলতে যাকে জ তেম জ তেম জ তেম।
নীলা জানে একা থাকা কাকে বলে। বেনোয়া চলে গেলে এই বাড়িটিতে নিজের ছায়া দেখে নিজে চমকে উঠবে। কেউ তাকে এভাবে আলিঙ্গন করবে না, কেউ বলবে না, জ তেম। প্রেমিক তাকে সঁপে দিচ্ছে জীবন, আর সে হেলা করে দূরে সরাবে, এত স্পর্ধা সে কোথায় পাবে। এত শক্তি!
বেনোয়া বলে, যেদিন তোমার বই ছুড়ে চলে গেলাম, ভেবেছিলাম, তোমার আমার সম্পর্ক এই শেষ। পাসকালের কাছে ক্ষমাও চেয়েছিলাম, কিন্তু যখনই কল্পনা করেছি, তুমিহীন আমার জীবন, আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, তুমি আমার প্রাণবায়ু নীলা। আমি তখনই বুঝেছি। তখনই বুঝেছি ঈশ্বর আমাদের তৈরি করেছেন পরস্পরের জন্য। আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করছিল, ছুরি নিয়েওছিলাম হাতে। পাসকাল আমাকে তখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল।
কীসের ডাক্তার?
সাইকিয়াট্রিস্ট।
নীলা চমকায়। ওই সাধারণ বাগবিতণ্ডার কারণে মানসিক রোগের ডাক্তারের কাছে যেতে হয়েছে বেনোয়াকে! বেনোয়ার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে আলগোছে সরিয়ে বেনোয়ার আবেগে নিমীলিত চোখে তাকিয়ে সে প্রশ্ন করে, তারপর তোমাকে ওই ডাক্তার বলল বোদেলেয়ারের বই আর একটি গোলাপ নিয়ে এখানে আসতে?
বেনোয়ার ঠোঁটে তেঁতো হাসি, তুমি কি ভেবেছ আমার ইচ্ছে করেনি তোমার কাছে আসতে? ডাক্তার বলেছে বলে এসেছি?
নীলার ভয় হয়, সুস্থ হোক কি অসুস্থ হোক, মানসিক রোগের ডাক্তারের কাছে যাওয়া ফরাসিদের যেহেতু নাপিতের কাছে চুল কাটতে যাওয়ার মতো নৈমিত্তিক, হয়তো ডাক্তার একদিন বলে বসবে, যাও পাসকালের সঙ্গে মন দিয়ে সংসার করো গিয়ে। বেনোয়া তাই করবে।
কী ব্যাপার, তুমি মনে করছ আমার মাথার অসুখ আছে? বেনোয়া জিজ্ঞেস করে।
নীলা হেসে উত্তর দেয়, না। মোটেই না। আমার মনে হয় আমার মাথার অসুখ আছে। আমার শিগরি ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
কেন, তোমার আবার কী হয়েছে।
আমারও মাঝে মাঝে কেমন শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। বলে নীলা।
ঘুমের নীলাকে একটু একটু করে জাগায় বেনোয়া, কানের কাছে ফিসফিস করে, আমার সঙ্গে যাবে এক জায়গায়?
কোথায়?
যাবে কি না আগে বলোই না।
এই রাত্তিরে?
হ্যাঁ। তুমি বললে আমি এক্ষুনি তোমাকে নিয়ে যাব।
যাব। বলল এবার, কোথায়।
সাত আকাশে।
বেনোয়া নীলাকে সাত আকাশে নেয়। পালকের মতো ওড়ে সে সাত আকাশে। বেনোয়া তাকে যত সুখ দেয়, পৃথিবীর আর কেউ কোনওদিন দেবে বা দিতে পারবে বলে নীলার মনে হয় না।
বেনোয়ার হারেমেই নিজের অদুষ্ট কল্পনা করে নেয় নীলা।
সপ্তম আকাশ জুড়ে ভ্রমণও শেষ হয়, রাতও ফুরোয়। নীলার ক্লান্ত শরীর যেই না ঘুমের অতলে ডুবেছে, বেনোয়ার রেডিয়োর খবর তাকে পারে ওঠায়। রেডিয়ো এলার্ম বেনোয়ার। ওয়ান্ডা ছুটে এসে নীলার গায়ের ওপর বসলে লাফিয়ে নেমে যায় সে। কুকুরটির গায়ের বোটকা গন্ধ আর কানের কাছের রেডিয়োর চিৎকার, নীলার ঘুম সপ্তম নয়, চৌদ্দতম আকাশে উড়িয়ে নেয়। উঠে সে বেনোয়ার জন্য কফি বানিয়ে রুটি জেলি মাখন যা আছে বের করে টেবিলে রাখে। কফিতে দু চুমুক শুধু। খাওয়ার সময় নেই।
এত তাড়া কীসের?
মেট্রো ধরতে হবে।
মেট্রো কেন? গাড়ি কোথায়?
ও তোমাকে বলিনি। গাড়ি তো কাল পাসকালকে দিয়ে এসেছি। ও ব্যবহার করবে এ গাড়ি। বেনোয়ার সহজ স্বাভাবিক কণ্ঠ।
তা হলে তুমি কী ব্যবহার করবে? নিজের জন্য চায়ের জল চাপিয়ে নীলা বলে।
আপাতত মেট্রো আর বাসেই চলাফেরা করতে হবে।
আপাতত। তারপর?
আসলে কী জানো নীলা, মেট্রো আর বাসে চলাফেরা করতেই আমার ভাল লাগে। গাড়ি নিয়ে প্যারিসে কী রকম অসুবিধে দেখেছ তো। পার্কিং পাওয়ার জন্য সারা শহর ঘুরতে হয়। একটু এদিক ওদিক হল তো জরিমানা।
নীলা মাথা নাড়ে। সে বুঝেছে গাড়ির অসুবিধের কথা। চুক চুক কোরে দুঃখ করে বলে, তা হলে পাসকালেরও বিষম ভুগতে হবে গাড়ি নিয়ে।
ওর দরকার বেশি আমার চেয়ে। জ্যাকলিনকে ইস্কুলে দিয়ে আসা নিয়ে আসা।
ও।
শুনে খুশি হলে না মনে হয়? বেনোয়া তির্যক দৃষ্টিতে তাকায়।
তুমি খবর জানালে আমি শুনলাম। এটুকুই। খুশি হওয়ার না খুশি হওয়ার কোনও ব্যপার ঘটেনি।
নীল জিনসের ওপর একটি টিশার্ট পরে নেয় বেনোয়া। পায়ে ছালওঠা মোটা জুতো। টাই সে পরে না আদৌ, শার্ট কদাচিৎ। নীলার কেনা শার্টগুলো বলেছে বাইরে কোথাও ভাল জায়গায় বেড়াতে গেলে পরবে, টাইগুলো আলমারিতে অব্যবহৃত পড়ে আছে। অডি কোলনও। নীলার পছন্দ করা সুগন্ধী সে ছোঁয়নি, নিজের এরামিস মাখে গায়ে। এরামিস তার পছন্দ, কারণ এ নাম তিন মাসকেটিয়েরের একজনের।
গায়ে সুগন্ধ ছড়িয়ে নীলার সামনে দাঁড়ায় বেনোয়া, বলে, শোনো, মন দিয়ে শোনো, আগেই বলেছি আমি, পাসকালকে ছেড়ে এসেছি সত্য, কিন্তু ওর খরচপত্র সব আমাকে বহন করতে হবে। জ্যাকলিনকে ও সময় দিতে পারছিল না চাকরির কারণে, আমিই ওকে বলেছি স্টারবুর্গের চাকরিটি ছেড়ে দিতে। দিয়েছে। ও বাড়ির খরচ সবই আমাকে দিতে হবে। পাসকাল এবং জ্যাকলিনের দায়িত্ব সম্পূর্ণ আমার। বুঝলে?
নীলা বুঝল। নীলা আগেই বুঝেছিল।
তার ইচ্ছে করে বলতে, আমিও তো চাকরি করি না, আমার দায়িত্ব কে নেবে?
কিন্তু আবারও মুখের লাগাম টেনে রাখে।
বেনোয়া চলে গেলে লাইব্রেরিঘরে জে এম কোয়াতেজির ডিসগ্রেস বইটি নীলা হাতে নেয়। বইয়ের নামটি তাকে আকর্ষণ করে, আগে এই লেখকের কোনও বই সে পড়েনি। পড়তে গিয়ে চোখ বারবার চলে যায় পাসকালের ছবিতে। দৃষ্টি দমন করে বইয়ের প্রতিটি শব্দে চোখ ফেলে সে অর্ধেক বই শেষ করে, হঠাৎ খেয়াল হয়, বইয়ে তার মোটেও মন নেই, মন পাসকালে। ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বড় বড় শ্বাস নেয় নীলা। কেবল বেনোয়ার সঙ্গে সংসার করছে না সে, করছে বেনোয়ার পুরো পরিবারের সঙ্গে। বড্ড ভিড়ের সংসার।
নীলার ওই শ্বাস বন্ধ হওয়া সময়ে বেনোয়া ফোন করে, ওয়ান্ডাকে খাবার দিয়েছ?
না।
কেন?
মনে ছিল না।
মন যে কোথায় আজকাল থাকে তোমার…যেভাবে বলে দিয়েছি, ঠিক সেভাবে সেভাবে দাও। ছোট্ট একটা কুকুর আর….
আর কী, নীলা বলে, তাকেও হিংসে করছি?
না সে কথা বলছি না, ভাবছি ওর কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই।
নীলা ফোন রেখে ওয়ান্ডার তিন বাটিতে তিন রকম খাবার দিল, জলের বাটিতে জল বদলে দিল।
দিয়ে বারান্দায় এসে বড় বড় শ্বাস নিল আবার।
খানিক পর বেনোয়া আবার জিজ্ঞেস করে, দিয়েছ ওয়ান্ডাকে খেতে?
না দিইনি। নীলা ঠাণ্ডা গলায় বলে।
কেন? ওদিকে উত্তেজিত
দিইনি কারণ ওয়ান্ডার খাবারগুলো আমি খেয়ে ফেলেছি। নীলার শান্ত স্বাভাবিক গলা।
এ সব কী বলছ তুমি?
ঠিক বলছি। আমি গরিব দেশের মেয়ে, কুকুর বেড়ালকে এত ভাল ভাল খাবার খাওয়ানোর অভ্যেস নেই। এত ভাল খাবার মানুষের জোটে না। তাই লোভে খেয়ে ফেলেছি।
খটাস।
টেলিফোনের খটাসের সঙ্গে একটি কাচভাঙা শব্দ এসে মেশে। কাচ ভাঙাটি কোন ঘর থেকে, সেটি খুঁজতে গিয়ে দেখে টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ছে ওয়ান্ডা, আর মেঝেয় পড়ে টুকরো হয়ে আছে পাসকালের ছবির ফ্রেম। ছবিটি মেঝে থেকে তোলে না, ঠিক যেভাবে ছিল সেভাবে রেখেই বেরিয়ে যায় সে। বেরোতে গিয়েই দেখে পাশের এপার্টমেন্ট থেকে পুলিশ একটি মৃতদেহ বের করছে। মাদাম সুজান দুগের মৃতদেহ। বয়স পঞ্চাশ হবে সুজান দুগের। নীলার সঙ্গে দেখা হত প্রায়ই সিঁড়িতে, করিডোরে। প্রথামত বজুঁ নীলাও বলেছে, সুজানও। সম্পৰ্কটুকু বজুঁতেই ছিল, একদিন সুজান কেবল যেচে কথা বলেছিলেন। জিজ্ঞেস করেছিলেন, অনেক রাত অব্দি তিনি গান শোনেন, গানের শব্দ নীলার কোনওরকম অসুবিধে ঘটায় কি না। নীলা না বলেছে, গানের কোনও শব্দই সে পায়নি কখনও বলেছে। সুজান দুগে বলেছিলেন, আসলে একা থাকলে গান শুনে সময় পার করা ছাড়া আর উপায় থাকে না। পুলিশের কাছে জিজ্ঞেস করে নীলা জানে, সুজান দুগে এ ঘরে মরে পড়ে আছেন বেশ কদিন হল, কনসিয়েজ করিডোর পরিষ্কার করতে এসে বিশ্রী গন্ধ পায়, সুজানের ঘর থেকে বেরোচ্ছে, দরজা ধাক্কিয়ে কারও কোনও সাড়া শব্দ না পেয়ে পুলিশে জানিয়েছে, পুলিশ এসে দরজা ভেঙে আবিষ্কার করেছে সুজানের ফুলে ওঠা মরা দেহ।
সুজানের ফুলে ওঠা পচে ওঠা মুখটি দেখে নীলার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সে চোখ নাক কান বুজে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দেয়ালে হেলান দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে যায়, প্রায় দৌড়ে জর্জ ব্রাসাঁ পার্কে, সরোবরের কিনারে, ঘাসের ওপর শুয়ে আকাশের দিকে মুখ করে, শুয়ে থাকে। তার ভয় হয়, সুজানের মতো সেও একদিন একা ঘরে মরে পড়ে থাকবে।
ঘণ্টাদুয়েক পর জর্জ ব্রাসাঁ থেকে বেরিয়ে শহরে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ায়। বিকেলে বাড়ি ফেরে, একটি নতুন ফ্রেম হাতে। পাসকালের ছবিটি ওতে লাগিয়ে ভাঙা কাচ সরিয়ে নিয়ে হাঁসের মাংস রান্না করে, বেনোয়া হাঁস খেতে ভালবাসে।
বিকেলে আপিস থেকে ফিরে বেনোয়া বলে, আজ তার মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে ফোনে। বেনোয়া বলেছে সে নীলাকে নিয়ে যাবে তাঁকে দেখতে। পারলে আজই।
যেন কনে দেখাতে নিচ্ছে বেনোয়া, নীলার সেরকম বোধ হয়। নীলা সাজলও সেরকম, চুল বাঁধল, মুখ সাজল, উঁচু জুতো পরল, পশ্চিমে যা মানায়, লম্বা কালো জামা পরে, গায়ে সুগন্ধী ছড়িয়ে বেনোয়ার হাত ধরে বেরোল।
গার দ্য অস্তারলিজ থেকে অরলেওঁ। পথে এক ঘণ্টা বেনোয়া একাই কথা বলে, বলে নীলার সঙ্গে সম্পর্কটি যদি দুদিনের সম্পর্ক মনে করত, তা হলে তাকে নিয়ে সে তার বাবা মার কাছে যেত না। তারপর আগেও যা বলেছে, তাই নতুন করে বলে, বেনোয়া তার সংসারে অসুখী ছিল না, বরং অতি সুখের সংসার ছিল তার, অত সুখ দেখে তার বন্ধুরা প্রায়ই বলেছে, এমন আদর্শ জুটি তারা এ সমাজে আর দেখেনি। পাসকাল তার অবাধ্য হয়নি কোনওদিন, লক্ষ্মী বউয়ের মতো সে স্বামীর সেবা করে গেছে। স্বামীকে সুখী করার জন্য সে এমন কিছু নেই যে করেনি। সুতরাং এ ভাবার কোনও কারণ নেই, যে বেনোয়া বউয়ের যন্ত্রণায় তিক্ত বিরক্ত হয়ে অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছে। বেনোয়ার গল্প অন্য লোকদের মতো নয়, ভিন্ন। বেনোয়ার জীবনে হঠাৎ বিদ্যুৎচমকের মতো নীলার উপস্থিতি সব কিছু অন্যরকম করে দিয়েছে। এ ঘটেছে বলে বেনোয়া এত পাষণ্ড নয় যে পাসকালকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করবে। পাসকালের যে কোনও প্রয়োজনে সে পাশে দাঁড়াবে। আপিস থেকে বেনোয়ার মাসের বেতন সোজা চলে যাবে পাসকালের অ্যাকাউন্টে, অল্প কিছু সে নিজের হাতখরচের জন্য রাখবে শুধু। এই ত্যাগটি নীলার জন্যই করছে সে। আর সামনের শনি রোববার রু দে রেনের বাড়িতে তার কাটাতে হবে, কারণ পাসকাল বলেছে, জ্যাকলিনও। বুঝলে?
বুঝতে চেষ্টা করছি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীলা। ফুসফুস ভরে শ্বাসের বাতাস সে সংগ্রহ করেছে। কিছু খরচ করলে ক্ষতি নেই।
ইশটিশনে বেনোয়ার বাবা দাঁড়িয়েছিলেন গাড়ি নিয়ে। দুজনকে তুলে সোজা বাড়ি। বাড়িতে বেনোয়ার মা স্বাগতম জানালেন বেনোয়া আর তার প্রেমিকাকে, গালে গাল লাগিয়ে চকাস চকাস চুমু। বেনোয়ার মাকে নীলা শাশুড়ি জ্ঞান করে মা বলে ডাকতে যাচ্ছিল, শুধরে মাদাম দুপঁ বলে। মাদাম করিন দুপঁ ছোটখাটো ভারী শরীরের হাসিখুশি মধ্যবয়সি, কারখানার শ্রমিক ছিলেন, অবসর নিয়েছেন। আর মসিয়ে দুপঁ নীলাকে পাশে বসিয়ে নিজের জন্মের কাহিনী বলে নেন প্রথম, তিনি হচ্ছেন মাঝ চল্লিশ দশকের বেবি বুম-এর একজন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে সৈন্যরা ঘরে ফিরে বউদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যা ঘটিয়েছিল ইয়োরাপে, তিনি তার ফল। পনেরো বছর বয়সে করিনের মতো তিনিও কারখানার কাজে ঢুকেছিলেন, পরে ভাল লাগে না বলে চলে গেলেন মারসেইয়ে, ওখানে জাহাজে কাজ করলেন দু বছর, তারপর ট্যাক্সি চালালেন কিছুদিন, সে কাজ ছেড়ে আঙুর চাষ করলেন আলসাসে, তাও একসময় ভাল লাগেনি, ছেড়ে পুলিশ হলেন, কোমরে মাঝে মাঝে ব্যথা হয় বলে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। বেশ আছেন এখন, খান দান, ঘুমোন, কম্পিউটারে তাস খেলেন, দামি পাইপে তামাক টানেন, আর একটি পর্স গাড়ি কেনার স্বপ্ন দেখেন। চারটে গেলাসে পতো ঢেলে দিয়ে জুতোর একটি বাক্স আনলেন, বাক্সের ভেতর রাজ্যির ছবি। কোনটি ঠাকুরদা, কোনটি ঠাকুরদার বাবা, ঠাকুরদার ঠাকুরদা ইত্যাদি তো দেখালেনই, কয়েকশো আত্মীয়র ছবিও দেখালেন, আর শেষে বেনোয়ার ন্যাংটোকালের কিছু ছবি। আত্মীয় যারা বেঁচে আছে, তাদের সঙ্গে হঠাৎ কোনও বিয়ে বা সৎকারউৎসবে দেখা হয়, এরপর যে যার জীবনে চলে যায়। বেনোয়াই এ বাড়িতে এসেছে আড়াই বছর পর। বেনোয়া বাড়ি থেকে বেরিয়েছে তেরো বছর বয়সে। লেখাপড়া করেছে এক ক্যাথলিক ইস্কুলে। তারপর বাকেলেরিয়া পাশ করেছে। সরকারই খরচ চালিয়েছে লেখাপড়ার। বাবা মার সঙ্গে যা যোগাযোগ হত, বেশির ভাগই চিঠিতে। পাসকালের সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার পর ওকে নিয়ে এ বাড়িতে এসেছে, বেনোয়ার বাবা মা পাসকালকে খুবই পছন্দ করেন, জ্যাকলিন জন্ম নেওয়ার পর আবার এসেছে, আর এবার নীলাকে নিয়ে। প্যারিস থেকে মাত্র এক ঘণ্টার পথ, অথচ বেনোয়ার বাবা মাকে দেখতে আসা হয় না, ছুটিছাটায়ও আসা হয় না। জীবন যার যার তার তার। কারও ইচ্ছে নেই অতীত নিয়ে পড়ে থাকার। মসিয়ে এবং মাদাম দুপঁর আলাদা জীবন আছে, ছেলেমেয়েকে বারোত্তীর্ণ করে দিয়েছেন, দায়িত্ব পালন শেষ। সন্তান যদি শারীরিক বা মানসিক ভাবে বিকলাঙ্গ না হয়, তবেই বিরক্ত কম করবে। কোনও সুখবর যদি থাকে, দূর থেকে একবার ফোনে বা চিঠিতে জানিয়ে দিলেই ওঁরা সন্তুষ্ট। বেনোয়ার নতুন প্রেমও মসিয়ে এবং মাদাম দুপঁর জন্য সুখবর। বেনোয়া নিজে সুখবরটি বয়ে এনেছে। নীলা দেখতে সুন্দরী কি পেঁচি, নীলার আচার ব্যবহার বানরের মতো নাকি মানুষের মতে, এ তাঁরা বিচার করছেন না। নীলা যে রকমই হোক, তাঁদের পুত্রধন একে নিয়ে সুখী, সেটিই বড় কথা। বেনোয়া যদি এক শাকচুন্নি এনে বলত, এর প্রেমে আমি পড়েছি, একে নিয়ে আমি আনন্দে আছি, মসিয়ে দুপঁ শাকচুন্নির গেলাসে পর্তো ঢেলে দিতেন, এবং জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা শেষে জুতোর বাক্সও আনতেন সামনে। অন্যের পছন্দের ওপর নাক এরা বাঙালির মতো গলায় না। বাঙালি তার ভোঁতা নাক আদিকাল থেকে গলাচ্ছে, যদি নাক গলালে নাকের কিছু ক্ষয় হত, নাক বলতে বাঙালির সম্ভবত আর কিছু অবশিষ্ট থাকত না। পাঁচ থেকে সাত বছর বয়স অব্দি বেনোয়া যে কীর্তিকাণ্ড করেছে সোৎসাহে তার বর্ণনা করে যান বেনোয়ার বাবা মা। গল্পে গল্পে যা হয়, অরলেওঁ থেকে শেষ রেলগাড়িটি চলে যায় প্যারিসের দিকে, সুতরাং সে রাত থেকে যেতে হয়। বেনোয়া ছোটবেলায় যে ঘরটিতে থাকত, সে ঘরে ছোট বিছানা, ছোট টেবিল, ছোট আলমারিতে ছোট ছোট কাপড় চোপড় এখনও সাজানো, সেই ঘরের বিছানায় নীলাকে নিয়ে বাকি রাত স্মৃতি ও সঙ্গমে পার করে বেনোয়া। শীৎকারের তীব্র শব্দ, নীলা অনুমান করে, বাকি মানুষদুটোর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। বেনোয়া পরোয়া করে না।
ভোরবেলা অরলেওঁ ছেড়ে জন দার্কের স্মৃতি ছড়ানো শহর ছেড়ে, প্রাণোচ্ছল দুপঁ দম্পতি ছেড়ে প্যারিসের পথে নীলা রেলের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে পরিচ্ছন্ন গ্রামগুলোর দিকে। দিগন্ত বিস্তৃত খেত, হঠাৎ হঠাৎ খেতের কিনারে খামারবাড়ি, হৃষ্টপুষ্ট গাভীদের হৃষ্টপুষ্ট দুধের ওলান। কৃষকেরা মাঝে মধ্যে গাড়ি করে সাঁ সাঁ ছুটে যাচ্ছে, হাতে বিয়ারের কৌটো, আনন্দে উৎসবে মেতে আছে। কেউ গোরু চরায় না খেতে, মেশিন বীজ ছড়ায়, মেশিন ফসল কেটে নেয়, মেশিন জড়ো করে। শহর কলকাতা থেকে বেরোলেই নীলা দেখে শীর্ণ গোরু নিয়ে শীর্ণ কৃষকেরা লাঙলে জমি চাষ করে, হাতে ফসলের চারা বোনে, হাতে ফসল কাটে। সারা বছর হাড়ভাঙা খাটুনির পর দুবেলা পেট পুরে খাবার মতো খাবার জোটে না। আর এদেশে কৃষকদের সরকার কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দেয় ফসল না ফলানোর জন্য, দুধ না উৎপাদন করার জন্য, ভেড়া বা শূকর না বাড়ানোর জন্য। এত ফসল, এত দুধ, এত মাংসে বাজার উপচে পড়ে। এ দেশে উৎপাদন ঘটালে যে খরচা হয় তার চেয়ে অনেক কম খরচায় অন্য দেশ থেকে খাদ্যদ্রব্য আমদানি করা যায়। কৃষক গোঁফ পাকাতে পাকাতে হয়তো হাঁক দিল, আমার যে জমি আছে, ওতে ফসল ফলালে বছরে দশ লক্ষ টাকা আয় হবে, সরকার বলবে তোমাকে আমি কুড়ি লক্ষ টাকা দেব বছর বছর, ফসল ফলিয়ো না।
নীলা হঠাৎ হেসে ওঠে।
কী ব্যাপার হাসছ কেন?
মাঝে মাঝে আমার খুব হাসি পায় বেনোয়া। মানুষের অবস্থার কী পার্থক্য দক্ষিণে আর উত্তরে। কোথাও সম্পদের আধিক্য, কোথাও অভাব। কেউ ধোঁকে, কেউ আনন্দ করে। পুরো ব্যাপারটা কেমন কৌতুক বলে মনে হয়।
নীলা আবার অন্যমন।
বেনোয়া নীলার ধ্যানে টোকা দিয়ে বলে, কী ভাবছ এত।
না তেমন কিছু না।
তেমন কিছু না মানে। আমাকে বলো।
বলার মতো কিছু না।
বলার মতো না হলেও বলো।
বেনোয়ার কণ্ঠে দাবি, প্রেমিকের দাবি। প্রেমিকা অন্যমনে কিছু ভাবলেও তা শোনার বা জানার দাবি সে করতেই পারে, কারণ নীলা বেনোয়াকে জীবন সঁপে দিয়েছে। জীবন সঁপে দিলে শরীর যেমন দেওয়া হয়, মনও দিতে হয়, রেলের কামরায় বসে ভাবা টুকরো টুকরো উদাসীন ভাবনাগুলোও।
জঁ পল সার্ত্রের কথা ভাবছি। নীলা বলে।
আমাদের জঁ পল সার্ত্রের কথা?
হ্যাঁ তোমাদের জঁ পল সার্ত্রের কথা।
বেনোয়া জোরে হেসে ওঠে, আমি ভাবলাম তুমি বুঝি তোমাদের দরিদ্র কৃষকের কথা ভাবছ।
নীলা অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলে, সার্ত্র বলেছেন জীবনের কোনও অর্থ নেই, কিন্তু একে অর্থময় করে তুলতে হবে। কী করে অর্থময় করতে হয় বলো তো? কোনও দরিদ্র দেশে দরিদ্র পরিবারে দরিদ্র ছেলে বা মেয়ের জন্ম হল, লেখাপড়া করার সুযোগ জোটেনি, অনাহারে অভাবে অসুখে কষ্ট পাচ্ছে, চব্বিশ ঘণ্টা তার পরিশ্রম করতে হয় এক থালা ভাত জোটাতে, তার হয়তো বিরাট প্রতিভা ছিল বড় একজন বিজ্ঞানী হবার, বা বড় একজন লেখক হবার, বা বড় একজন দার্শনিক হবার। কিন্তু প্রতিভাকে সে কাজে লাগাবে কী করে, বলো? জীবনকে অর্থময় করার তার সুযোগ কোথায়? পেটে যার খাবার নেই, গায়ে যার কাপড় নেই, মাথা গোঁজার যার ঠাঁই নেই, তার কাছে জীবন মানে কি কেবলই যন্ত্রণা নয়?
নীলা মলিনার কথা ভাবে, মলিনার কি কোনও সাধ্য ছিল তাঁর নিজের জীবনকে কোনও অর্থ দেবার? স্বামীর সংসারে বন্দি ছিলেন মলিনা, অদৃশ্য শেকল ছিল মলিনার শরীরে মনে, সামাজিক শেকল, সেই শেকল ছেঁড়ার নিয়ম তাঁর জানা ছিল না। এরকম লক্ষ লক্ষ মলিনা ধুঁকে মরছে সংসারে, জানে না কী করে বাঁধন ছিঁড়তে হয়।
বেনোয়া আবারও হেসে ওঠে, বলে, কী সব আবোল তাবোল বকছ? সবাই তো আর একরকম করে জীবনের অর্থ তৈরি করে না। আমার জীবনের অর্থ হচ্ছে জ্যাকলিন। আমার বাবা মা ধনী ঘরের সন্তান ছিলেন না, তাঁরাও প্রচুর সংগ্রাম করেছেন। সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, আমি তাঁদের জীবনকে পূর্ণতা দিয়েছি, অর্থ দিয়েছি। আর তা ছাড়া পরকালে কৃতকর্মের ফল তো ভোগ করতেই হবে। জীবন অর্থহীন হবে কেন?
নীলা জোরে হেসে ওঠে।
কী হাসছ যে?
নীলা হাসতে হাসতেই বলে, তুমি পরকালে বিশ্বাস কর?
নিশ্চয়ই। তুমি কর না?
না।
কেন তোমাদের ধর্মে তো স্বর্গ নরক আছে! বেনোয়া বলে।
বহুকাল আগে এক বাঙালি লেখক লিখে গেছেন স্বর্গ নরক নিয়ে, কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বলে তা বহুদূর, মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর। নীলা হাসতে হাসতে বলে।
বেনোয়া সোজা হয়ে বসে, গম্ভীর কণ্ঠ তার, তুমি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস কর না।
নীলা স্পষ্ট স্বরে বলে, না।
আশ্চর্য। বেনোয়া গা ছেড়ে দেয় আরাম চেয়ারে।
ভারতবর্ষের খ্যাতিই হচ্ছে এর অধ্যাত্মবাদ। ভারতে আদিকাল থেকে এরই চর্চা হয়েছে, এখনও এরই চর্চা হচ্ছে, এ সে ইস্কুলের বইয়েই পড়েছে জানাল।
নীলা বলে, প্রাচীন ভারতের চার্বাক দার্শনিকের কথা তোমার ইস্কুলের বইয়ে লেখেনি? তখনকার জনপ্রিয় দর্শনের নাম ছিল লোকায়ত। লোকায়িতরা আত্মা মানত না, ঈশ্বর মানত না, স্বর্গ নয়, নরক নয়। বহুকাল ধরে ভারতবর্ষ ইংরেজদের শাসনে থেকেছে। ইংরেজরা আমাদের বোঝাতে চেয়েছে যে আমরা ভারতবাসীরা, নেহাত খাটো ধরনের মানুষ। সভ্যতার শিক্ষায় জ্ঞানে বুদ্ধিতে কোনওদিক থেকেই ওদের সমান নই, তাই আমাদের পক্ষে দাসত্বটাই স্বাভাবিক। অবশ্যই এ সব মিথ্যে। ভারতবাসীকে ঠকাবার জন্যই এ সব বলা হচ্ছে। এ কারণেই, ভারতবর্ষে যখন স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরু হল, কিছু কিছু জাতীয়তাবাদী পণ্ডিত দেশের অতীত গৌরবটাকে খুব বড় করে দেখাবার চেষ্টা করলেন। ভারতবর্ষের ইতিহাস খুঁড়ে প্রমাণ দেখাতে লাগলেন কত মহান, কত উচ্চ আমাদের সভ্যতা। পশ্চিমের বিজ্ঞানবাদ বা বস্তুবাদের বিপরীত ভাববাদ দেখিয়ে বলতে লাগলেন, অতীতে মুনি ঋষিরা বলে গেছেন সংসারটা হচ্ছে অনিত্য, মায়া, মিথ্যা। সংসারের কিছু স্থূল সুখভোগকেই পুরুষার্থ মনে করা নেহাত স্থূলবুদ্ধির লক্ষণ। এ সব হচ্ছে আত্মমর্যাদার কারণে আর একেই পশ্চিমিরা ভেবে নিয়েছে, ভারতের সত্যিকার পরিচয়।
এটুকু বলে নীলার আশঙ্কা হয় এই বুঝি বেনোয়া এখন প্রশ্ন করবে, এতই যদি বস্তুবাদের কদর ভারতবর্ষে, কই, দেশ তো এখনও দরিদ্রই রয়ে গেছে। অর্থনীতির অবস্থা এমন করুণ কেন? মানুষ কেন দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে? নীলা সম্ভাব্য প্রশ্নটির একটি উত্তর দাঁড় করায়, কারণ দুশো বছরের ইংরেজ শাসন অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে। প্রশ্ন, ইংরেজ তো গেছে, পঞ্চাশ বছরের বেশি হয়ে গেল। উত্তর, পঞ্চাশ বছর খুব কম সময় দেশকে গড়ার জন্য। বেনোয়া যুক্তি দেখাতে পারে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর জার্মানিতেও কিছু ছিল না, পঞ্চাশ বছরে ইয়োরোপের সবচেয়ে ধনী দেশ জার্মানি। নীলা তখন আমেরিকার মার্শাল প্ল্যানের কারণটি দেখাবে।
ধ্যুত। মাথা ঝিমঝিম করে নীলার। মাথায় বেনোয়ার ভয় ঘাপটি মেরে আছে। সব কেমন এলোমেলো লাগছে। মনে হচ্ছে কোথাও যেন কিছু ভুল থেকে যাচ্ছে। মলিনার রোগে ভোগা মলিন শরীরের মতো দেশটি তার পড়ে আছে একা, শুশ্রূষা করার কেউ নেই, নীলা মনে মনে পাখি হয়ে উড়ে যায় দেশটিতে, মনে মনে সে বৃষ্টি হয়ে ঝরে দেশটির খরায় পোড়া শরীরে। নীলার মনে হতে থাকে শেকলে সেও বাঁধা, যদি সে পারত সকল বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে মাথা নত করতে তার দেশটির সামনে। এই নিষ্ঠুর বিদেশ সে কেন অযথা পড়ে আছে, সে জানে না। এই দেশটিকে যত সে দেখছে, তত তার অচেনা মনে হচ্ছে, এই দেশ তাকে কী দেবে, নিরাপত্তা? কীসের নিরাপত্তা? সুখের, নাকি বেঁচে থাকার! নীলার মাঝে মাঝে মনে হয় বেঁচে থেকে কী লাভ। সুখী হয়েই বা কী লাভ।
নীলার হাতদুটিতে আঙুল বুলিয়ে দিতে দিতে বেনোয়া বলে, তা হলে তুমি কি বলতে চাও তুমি বিশ্বাস করো না যে ঈশ্বর আমাদের গড়েছেন পরস্পরের জন্য?
নীলা জানালা থেকে চোখ না ফিরিয়ে বলে, না।