Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ফরাসি প্রেমিক || Taslima Nasrin » Page 5

ফরাসি প্রেমিক || Taslima Nasrin

সারাদিন ঘোরে কাটে নীলার। সন্ধেয় দানিয়েলের বাড়িতে নীলাকে পৌঁছে দিয়ে বেনোয়া বলে যায়, কাল সন্ধে সাতটা। মোপারনাস, ক্লসারি দ্য লিলা। ঠিক তো?

ঠিক।

দানিয়েল ঘরেই ছিল, দরজা খুলে নীলাকে দেখে অবাক, তুমি প্যারিসে? কবে এলে?

আজ।

নীলা ঘরে ঢুকে দেখে ঘর সেই আগের মতোই, তবে ঘরে অন্য এক মেয়ে।

ও নাতালি, আমার প্রেমিকা।

নাতালি পাতলা জামা গায়ে বিছানায় শুয়েছিল। উঠে বসল। প্রথম পরিচয়ের বেলায় যা করে, হাতে হাত ধরে ঝাঁকানো, তা চলে নীলা আর নাতালিতে, আর দানিয়েলের সঙ্গে নীলার গালে গাল লাগিয়ে চুমু।

নাতালি প্রভান্সের মেয়ে, প্যারিসে নতুন এসেছে, এখন, হ্যাঁ এখানেই থাকবে। নাতালি মিষ্টি হাসে। ছোট করে কাটা বাদামি চুল মাথায়, বাদামি চোখ। বাদামি চোখদুটোও হাসে। নীলা কে, তার পরিচয় দিতে হয় না নাতালিকে, সে জানে, দানিয়েলই নীলার গল্প করেছে ওর কাছে।

আমি তো জানি তুমি আর ফিরবে না, প্যারিসে। দানিয়েল বলে।

নীলা চেয়ার টেনে বসে, ভেবেছিলাম ফিরব না, কিন্তু ফিরতে হল।

কোথায় উঠেছ?

নীলা এর উত্তর তক্ষুনি দিতে পারে না। দানিয়েলের বাড়িতে উঠেছে বলেই সে জানে। কিন্তু প্রশ্ন তার জিভকে ভারী করে রাখে।

দানিয়েল সিগারেটে লম্বা একটি টান দিয়ে বলে, প্রথমেই বলে নিই, এ ঘরে কিন্তু এখন নাতালি আর আমি থাকছি, তোমাকে অন্য কোথাও থাকতে হবে।

সিগারেটটি দানিয়েল নাতালিকে দেয় ফুঁকতে।

তা যাবে কোথায় জানো?

নীলা জানে না, দানিয়েলের এখানে আশ্রয় না মিললে সে যাবে কোথায়।

পকেটে রাখা বেনোয়ার ঠিকানা ফোন নম্বর লেখা কাগজটি সে স্পর্শ করে, যেন সে বেনোয়ার শরীর স্পর্শ করছে। শরীরে তার অদ্ভুত এক শিহরন জাগে। বেনোয়ার তীব্র শীৎকার এখনও তার কানে লেগে আছে, এখনও শরীর ভিজে আছে বেনোয়ার বেনো জলে। এখনও নীলা ঘোরে।

নাতালি সিগারেটটি আবার দানিয়েলকে দেয় ফুঁকতে।

টানবে মারিহুয়ানা?

নীলা কোনওদিন মারিহুয়ানার স্বাদ নেয়নি। স্বাদ নিতে গিয়ে, এক টানেই মাথা ঝিমঝিম করে নীলার।

ঘরে ছড়িয়ে আছে নাতালির জুতো জামা। বেড়েছে বই। টেবিলে একটির জায়গায় দুটো কম্পিউটার।

আমার ছবিগুলো? ইজেল? নীলা জিজ্ঞেস করে।

দানিয়েল মারিহুয়ানায় টান দিয়ে হাসে। হাসতে হাসতে বলে, ঘরে জায়গা নেই। ফেলে দিতে হয়েছে।

দানিয়েল মজা করছে, নীলা ভাবে।

সত্যি করে বলো, কোথায় রেখেছ ইজেল, আমি ছবি আঁকা শুরু করব আবার। নীলার দিকে একটি স্বপ্নশিশু হামাগুড়ি দিতে দিতে এগোয়।

দানিয়েল আবারও বলে, ফেলে দিয়েছি।

নীলার সংকোচ হয় ইজেল আর ছবি বিষয়ে আর কোনও প্রশ্ন করতে। দানিয়েল ওগুলো ফেলে দিয়েছে, এর অর্থ ওগুলো বিরক্তিকর ঠেকেছে তার কাছে, তাই যদি হয়, ওগুলোর প্রসঙ্গও বিরক্তিকর নিশ্চয়ই।

বদল করে সে প্রসঙ্গ, তোমার ওই মনিকের সঙ্গে কলকাতায় দেখা করেছিলাম।

তাই নাকি? মনিক চমৎকার মানুষ, তাই না? দানিয়েলের উচ্ছ্বাস উপচে পড়ে।

মনিক কলকাতা অন্ত প্রাণ। কলকাতা সম্পর্কে এত বিস্তর জ্ঞান তাঁর, এমন জ্ঞান কোনও কলকাতা বিশেষজ্ঞরও নেই। জঁ রাসিন কলকাতা বিষয়ে কী জানে, তার চেয়ে অনেক বেশি জানেন মনিক। এত ধুলো, এত ভিড়, এত নোংরা কলকাতা, তারপরও ওই কলকাতাকে ভালবেসে তিনি থেকে গেছেন ওখানে। গরিবদের দুহাতে সাহায্য করেন। এমন বড় হৃদয়ের মানুষ, সহসা দেখা যায় না। বাঙালি জাতিকে এত ভাল আর কেউ বাসেনি।

নীলা দানিয়েলকে থামিয়ে বলে, আমার মনে হয় না।

কী মনে হয় না?

মনে হয় না মনিক খুব বড় হৃদয়ের মানুষ। মনে হয় না তিনি কলকাতার মানুষদের সত্যিকার শ্রদ্ধা করেন। নীলা তার মনে না হওয়ার কথাকটি বলে শুধু, কেন তার মনে হয়, তা বলতে যাবার আগেই দানিয়েল বারুদের মতো জ্বলে ওঠে, চেঁচিয়ে চিলেকোঠা চৌচির করে,

তুমি এক আশ্চর্য চরিত্র নীলা। মোটেও তুমি লোককে বাহবা দিতে চাও না। মনিকের মতো মেয়ের প্রশংসা তুমি করতে চাও না। আমি তোমার জন্য কম করেছি? তোমার জন্য আমি কলকাতা পর্যন্ত গেছি, গেছি তোমার পাশে থাকার জন্য, তোমাকে সাহস আর শক্তি জোগাতে। তোমার জন্য ভেবেছি, তোমার জন্য করেছি, আর বিনিময়ে তুমি কী করেছ? জঘন্য ব্যবহার করেছ, যাচ্ছেতাই রকম অবহেলা করেছ, অপমান করেছ। এই প্যারিসে তোমার কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না, আমি তোমাকে আশ্রয় দিয়েছিলাম, আমি দিয়েছিলাম আমি। অথচ প্রথম দিনই তুমি আমার সঙ্গে মিথ্যে কথা বলেছ। বলেছ, নাচতে জানো না, অথচ তুমি নাচতে জানো। নিকলের বাড়িতে তোমাকে নেমন্তন্ন খেতে নিয়েছি, তুমি ইচ্ছে করেই ভাল কোনও ড্রেস পরোনি, পরে গেছ জিনস। এত তোমাকে খাতির করল নিকল, ওকে তুমি যাওয়ার আগে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত বলোনি। ক্যাথারিনের বাড়িতে হঠাৎ গিয়ে হাজির হয়েছিলে, এমন অদ্ভুত আচরণ এ দেশে কেউ করে না, ক্যাথারিন না হয়ে অন্য কেউ হলে পুলিশ ডাকত, ও তোমাকে সাহায্য কম করেছে? তুমি জানতেই না কারখানার কাছে কোথায় রেস্তোরাঁ, ও তোমাকে চিনিয়েছে, পোস্টাপিস কোথায় তাও তো তুমি জানতে না, ও দেখিয়ে দিয়েছে। অথচ ওর সঙ্গে তুমি অনেকদিন হেসে কথা বলোনি। তুমি ভাবো, অন্যরা তোমার জন্য করবে, করাটা অন্যের দায়িত্ব আর তুমি রানির মতো বসে সব উপভোগ করবে আর যারা করবে তাদের দিকে তুমি অবজ্ঞা ছুড়বে, এভাবেই জীবন চলবে তোমার, ভেবেছ? দেখলাম তো কী বুর্জোয়া পরিবারের মেয়ে তুমি। খামোখা তো স্বভাব নষ্ট হয়নি। যা চাও, পেয়ে যাও হাতের কাছে, কোনও কিছু পেতে তোমার পরিশ্রম করতে হয় না। তোমার এই স্বভাব বদলাও নীলা, নাহলে ভুগে মরবে। কেউ তোমার দাস বা দাসী হবার জন্য বসে নেই। ইয়োরোপের ধনীরাও এত প্রাচুর্যের মধ্যে থাকে না, ভারতের মতো গরিব দেশে যেমন তুমি ছিলে। আর এখন এখানে এসেছ শ্রমিকের জীবন যাপন করতে? দারিদ্র্য পোহাতে? ধনীর আবার শখের শেষ নেই। তুমি ওই ইজেল চাইছ আর ছবি, ফেলে দিয়েছি। তুমি ছবি না, ছাই আঁকতে জানো! কিছু হয় না ওসব। ওগুলো ফেলে দেওয়ার মতো জিনিস, তাই দিয়েছি। আর বেশি কথা না। আমাদের নেমন্তন্ন আছে। বেরোতে হবে। তোমাকে আর সময় দিতে পারছি না নীলা। যথেষ্ট বিরক্ত করেছ আমাকে, আর নয়।

নীলা দ্রুত বেরিয়ে যায় ভারী সুটকেসদুটো নিয়ে। একটি একটি করে সুটকেস ওপর থেকে নীচে নামায়, এখানে রামকিরণ নেই যে সুটকেস নামাবে, এখানে সিঁড়ির কাছে গাড়ি অপেক্ষা করছে না যে সে উঠে বসবে, চালককে গন্তব্য বলে দেবে। এখানে তার কোনও গাড়ি নেই, চালক নেই, এবং সবচেয়ে বড় যেটি নেই তার, সে হল গন্তব্য। নীচে নেমে, রাস্তায়, নীলার ইচ্ছে করে কাছের ফোন বুথ থেকে ফোন করে বেনোয়াকে।

কী বলবে! আমাকে তোমার বাড়িতে আশ্রয় দাও! লজ্জার কী আছে আর তার! সব লজ্জা কি আজ সারাদিন বেনোয়ার বেনোজলে ভেসে যায়নি!

নীলা প্রথম কিছুক্ষণ ইতস্তত করেও ফোন করে বেনোয়ার নম্বরে, বেনোয়া ফোন ধরেও।

কী করছ?

তোমাকে ভাবছি। হা হা।

সত্যি?

সত্যি সত্যি সত্যি।

আমিও ভাবছি তোমাকে।

বান্ধবী নিশ্চয় তোমাকে পেয়ে খুব খুশি?

নীলা থামে এখানে। বান্ধবী যে তাকে পেয়ে খুব খুশি হয়নি, এ কথা নীলার জিভে গড়াগড়ি খায়। জিভ থেকে খসে পড়লেই নীলা বেনোয়ার কাছে প্রমাণ করবে সে এ শহরে অবাঞ্ছিত এক মানুষ। নীলার ভয় হয়, আবার না বেনোয়ার কাছেও সে অবাঞ্ছিত হয়। যে কুকুরটিকে একজন লাথি দেয়, নীলা দেখেছে তাকে সবাই লাথি দেয়, তার ভয় হয়। জিভের গড়াগড়ি খাওয়া কথাগুলো ভেতরে ফিরিয়ে নিয়ে বলে সে, হ্যাঁ খুশি।

আমার কথা বলেছ ওকে?

বলেছি।

কী বলল?

বলল, তা ওর বাড়িতে গিয়ে থাকো না কেন? বলে নীলা অপেক্ষা করে, অপেক্ষা করে বেনোয়া বলবে, তা চলে আসছ না কেন আমার কাছে। আমার ক্ষুধিত তৃষিত তাপিত চিত, বঁধু হে, ফিরে এসো, আমার করুণ কোমল, এসো, ওগো, সজলজলদস্নিগ্ধকান্ত সুন্দর, ফিরে এসো, আমার নিতিসুখ, ফিরে এসো, আমার চিরবাঞ্চিত, এসো! আমার চিতসঞ্চিত, এসো! ওহে চঞ্চল, হে চিরন্তন, ভুজবন্ধনে ফিরে এসো! আমার বক্ষে ফিরিয়া এসো, আমার চক্ষে ফিরিয়া এসো, আমার শয়নে স্বপনে বসনে ভূষণে নিখিল ভুবনে এসো।

বেনোয়া হাসে, হেসে বলে, কাল কিন্তু ক্লজারি দ্য লিলা, একশো একাত্তর বুলেভার্ড মোপারনাস, মনে আছে তো?

নীলার নিশ্চয়ই মনে আছে। তার স্মরণশক্তি এখনও ধসে পড়েনি, তবে রেস্তোরাঁর খাবারের চেয়ে এই মুহূর্তে নীলার কাছে একটি চার দেয়ালের ঘর আর মাথার ওপর ছাদ সবচেয়ে বেশি প্রার্থনীয়।

জিজ্ঞেস করে সে, ওখানে যাব, খাব। তারপর?

তারপর আমার বাড়িতে কফি খেতে আসবে।

তারপর?

অনুমান করো।

অনুমান করতে পারছি না। আর জানো তো কফি খাই না আমি।

তাহলে আমাকে খাবে।

আমার এত খিদে নেই।

আছে।

কী করে জানো?

আমি জানি।

খুব অভিজ্ঞ বুঝি তুমি?

খুব না হলেও কিছুটা তো। বোঝোনি?

বেনোয়া হাসে একা একাই। নীলা চুপ হয়ে শোনে। শোনে, তোমার বান্ধবীকে বলে রেখো, কাল তোমার ফিরতে রাত হবে। ভেবো না, আমি পৌঁছে দিয়ে আসব।

হাতে অনেক টাকা থাকলে সে কোনও হোটেলে উঠত। কারও বাড়িতে ধরনা দেওয়ার, কাউকে বিরক্ত করার লজ্জা থেকে নিজে সে মুক্ত হত। কিন্তু এই মুহূর্তে সহায় হতে পারে এক কিষান আর সুনীল। অনির্বাণের সঙ্গে কিষানের যে কথা হয়েছে, তাতে সে জানায়নি যে নীলার পাট সে চুকিয়েছে। একটি ট্যাক্সি ডেকে প্রথম রু দ্য ফুবোই বলে নীলা, পরে মাঝপথে মত পালটে বলে, রু দ্য রিভলি।

চৈতালি ছিল বাড়িতে। নীলাকে দেখে চমকে ওঠে, তুমি কোত্থেকে?

নীলা টের পায়, কোথাও তাকে কেউ আশা করছে না। দানিয়েলও ঠিক এই সুরে এ কথা জিজ্ঞেস করেছে। কলকাতার মেয়ে কলকাতায় থাকবে এই ভেবে নিয়েছিল সবাই। প্যারিস নীলার জন্য নয়, অথবা নীলা প্যারিসের জন্য নয়, এরকম একটি সরল অঙ্ক কষা হয়ে গেছে চৈতালিরও। অনাহুত অবাঞ্ছিত চৈতালিকে পাশ কেটে সে ভেতরে ঢোকে।

কী ঘটনা, বলো। চৈতালি তার চমকানো চোখ নিয়ে জানতে চায়।

কিছু ঘটনা নয়। কলকাতা থেকে এলাম। থাকার জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছি। শেষ অব্দি এখানে…

এই তো একটু আগে কিষান ফোন করল। বলল ও সকালে বিমানবন্দরে গিয়েছিল, কথা তো ছিলই এমন!

নীলা বলে, আমার সঙ্গে কথা হয়নি।

বলল, তুমি নাকি এক ফরাসি ছেলের হাত ধরে চলে গেলে, ওর দিকে ফিরেও তাকাওনি!

নীলার মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে। জল চেয়ে খায়।

কী হয়েছে কী তোমার?

কিছু হয়নি তো!

নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে।

সোফায় গা ছেড়ে দেয় নীলা। সুটকেস পড়ে থাকে দরজার কাছে। চৈতালি বলে না সুটকেস ভেতরের ঘরে নিয়ে যেতে, বড় ধকলের কথাও বলে না, স্নান সেরে আসার কথাও না, কিছু খাবার কথাও না। অথচ এই চৈতালিই গতবার নীলা প্যারিস এলে আপন দিদির মতো স্নেহ ঢেলেছিল, গায়ের কোট খুলে ঢেকে দিয়েছিল নীলার গা, স্নান করতে পাঠিয়েছিল, খেতে দিয়েছিল। মানুষ কত তাড়াতাড়ি বদলে যায়! নীলা ভাবে।

মুখ চুন করে কিছুক্ষণ বসে থেকে চৈতালি সুনীলকে ফোন করে। কথা বলা শেষ করে নীলার সামনে আবারও মুখ চুন করে বসে।

কী বলল সুনীলদা?

শোনো নীলা! সুনীলের সঙ্গে কিষানের সম্পর্কটাই নষ্ট হয়ে গেছে তোমার কারণে। এখন কিষান যদি জানে যে তুমি আমাদের বাড়িতে উঠেছ, সুনীলের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগবে। ব্যাপারটা ভাল দেখায় না। স্বামীর কল্যাণকামনায় যে স্ত্রী সকাল সন্ধ্যা ঠাকুরকে ডাকে, সে স্ত্রীর জন্য এ অস্বাভাবিক নয় যে স্বামীর অমঙ্গল আশঙ্কায় সে বিষাদকাতর হবে, আর তার কাতরতা যতদূর ছড়ানো যায়, ছড়াবে।

নীলা বলে, আমি কলকাতা থেকে কিষানের বাড়ি যাবার জন্য আসিনি।

তবে কী?

না, এখানে থাকার জন্যও আসিনি। আমি একটি বাড়ি ভাড়া নেব শিগরি। কলকাতা থেকে আমার টাকা এসে না পৌঁছোনো পর্যন্ত এখানে থাকব। আমাকে অন্য কোথাও যেতে বোলো না।

চৈতালি আবার ফোন করতে ওঠে সুনীলকে। চৈতালির বিষাদ নীলাকেও কুরে খাচ্ছে, সে দ্রুত সুটকেসদুটো তুলে নিয়ে বেরিয়ে যায়। ফিরে যাওয়ার জন্য পেছনে চৈতালির কোনও ডাক সে শোনে না। রাস্তায় নামলে একেবারে গা ঘেঁষে গাড়ি থামাল সুনীল।

কোথায় যাচ্ছে নীলা? সে জানে না সে কোথায় যাচ্ছে। কিষানের বাড়ি যেতে চাইলে, সুনীল প্রস্তাব দেয়, সে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারে। কিষানের বাড়িতে নীলা যাচ্ছে না। তবে কি সেই বান্ধবীর বাড়িতে যাচ্ছে? যেতে চাইলে সুনীল ওখানেও পৌঁছে দেবে। না, সে বাড়িতেও নীলা যাচ্ছে না। তবে সে যাচ্ছেটা কোথায়? সে কোথাও কারও বাড়িতে যাচ্ছে না, যে কোনও রাস্তাই তার ঠিকানা, এর চেয়ে নিরাপদ আপাতত তার সামনে কিছু নেই, রাস্তা থেকে তাকে অন্তত কেউ তাড়িয়ে দেবে না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নীলাকে সুনীল টেনে ওপরে তোলে। তারপর ধীরে সুস্থে, মাথা ঠাণ্ডা করে যে প্রশ্নের উত্তর সুনীল নীলাকে দিতে বলে, তা হল কিষানের বাড়িতে সে কেন যেতে চাইছে না।

কিষানের বাড়িতে তার যেতে ইচ্ছে করছে না। ঠাণ্ডা মাথা উত্তর।

ইচ্ছের বাইরে মেয়েদের অনেক কিছু করতে হয় নীলা! চৈতালি কঠিন স্বরে বলে।

চৈতালির মতে ইচ্ছের বাইরে নীলাকে কিষানের বাড়ি গিয়ে নিজের সংসার গুছিয়ে নেওয়া উচিত। সুনীলের মতে নীলার উচিত কলকাতা ফিরে যাওয়া।

কিন্তু নীলা কিষানের সঙ্গে সংসার করবে না, কলকাতায়ও ফিরবে না। ওই নোংরা সমাজে সে আর ফিরতে চায় না। বালিগঞ্জের বাড়িতে ফিরে গেলে অনির্বাণের মুখে চুনকালি পড়বে, ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে যদি সে শহরে কোথাও একা থাকতে চায়, লোকে ছি ছি করবে। চাকরি বাকরি করে সে একা থাকার ব্যবস্থা নিশ্চয় করতে পারে, কিন্তু সে জীবন এক দুর্বিসহ জীবন, এ সে জানে। স্বামী ছেড়ে এসেছে যে মেয়ে, সে মেয়ে নষ্ট, সে মেয়ে পচা, সে মেয়ে পতিতা, তার ওপর বিনা দ্বিধায় ঝাঁপিয়ে পড়বে যত কামুক পুরুষ।

আবার বিয়ে করার প্রসঙ্গ ওঠে।

একবার বিয়ে হওয়া মেয়েকে বিয়ে করতে কে আসবে? কেউ না। যদি কেউ আসে, সে হবে সত্তর বছরের বুড়ো, নয়তো চরিত্রহীন, নয়তো পাগল, নয়তো…

চৈতালি মাঝখানে আসল প্রশ্নটি করে, বিমানবন্দরে কার হাত ধরে যাচ্ছিলে, কে সে?

নীলার গলা শুকিয়ে আসে। জল চেয়ে নয়, এবার নিয়ে খায়। ঢোক গিলে বলে, এক বন্ধু।

ফরাসি বন্ধু তোমার সঙ্গে কলকাতা থেকে ফিরেছে? নাকি তোমাকে তুলে আনতে গিয়েছিল?

ওই বিমানে পরিচয়।

বিমানে পরিচয় ছেলে তোমার বন্ধু হয়ে গেল? এত শিগরি?

সুনীল হেসে ওঠে, এ হাসিতে সুখের ছিটেফোঁটা নেই। চৈতালি এবং সুনীল দুজনেরই ধারণা নীলার বোধবুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে।

বন্ধু হওয়া এত সোজা জিনিস নয় নীলা, বারো বছর একসঙ্গে চলাফেরা করেও দেখা যায়, বন্ধুত্বই হল না।

নীলা বোধবুদ্ধি প্রমাণ করতে যুক্তি দেখায়, আবার একদিনেও হয় তো। হয় না?

সুনীল হাসে। এ হাসি সম্মতির হাসি নয়।

ওসব বাদ দাও, সময়ে বুঝতে পারবে, জীবন কোথাও সহজ নয়। কলকাতায় নয়, প্যারিসেও নয়। খানিক থেমে দু পা ছড়িয়ে সামনে, দু হাত ছড়িয়ে সোফার কাঁধে, বলে কিষানলালের যে মানসিক অবস্থা, যে কোনও সময় সে তোমাকে ডিভোর্স দিতে পারে, তখন তো তোমার কলকাতা না ফিরে উপায় নেই।

টুম্পাকে ঘুম পাড়াতে যাবার জন্য ওঠে চৈতালি, শোবার ঘরের দিকে যেতে যেতে বলে, তা হবে কেন, ওর ওই ফরাসি বন্ধু ওকে বিয়ে করলেই তো সব ঝামেলা ফুরোয়।

সুনীলের কাছে সরে এসে নীলা খুব বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মেয়ের মতো কিছু টাকা ধার চায়, যা সে শোধ দিয়ে দেবে, কলকাতা যাবার সময় যে টাকা ধার করেছিল, তাও দেবে, খুব শিগরি, কুড়ি লক্ষ টাকাটা প্যারিস পৌঁছে গেলেই। বেশি নয়, তার পাঁচ হাজার ফ্রাঁ হলেই চলবে। তবে এক্ষুনি লাগছে না, কদিন পরে হলেও চলবে। সুনীল বুঝে পায় না এতগুলো ফ্রাঁ দিয়ে নীলা করবে কী, এ বাড়িতে আছো। বাড়ি ভাড়া নেই, খাওয়ার খরচা নেই। আপাতত তো এখানেই থাকছ। আপাতত নীলা এখানেই থাকছে তা ঠিক। কিন্তু নীলার দরকার আছে টাকার। কিছু পরিকল্পনা আছে তার। খামোকা টাকা চায়নি। আর এও নীলা জানিয়ে দেয়, প্যারিসে ভিখিরি হয়ে থাকতে সে আসেনি। যদি সুনীলের কোনওরকম সন্দেহ হয়, সে নিখিলের কাছে ফোন করে জেনে নিতে পারে কুড়ি লক্ষ টাকা নীলার আছে কি নেই।

চৈতালির পুজোর ঘরে নীলার জন্য বিছানা পেতে দেওয়া হয়। দুর্গা, সরস্বতী, কালী, লক্ষ্মীকে ঘাড়ের পেছনে রেখে নীলাকে শুতে হয়। সারারাত সে এপাশ ওপাশ করে শুয়ে। সকাল হবে, সকাল পার হয়ে দুপুর, দুপুর গেলে বিকেল, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বিকেল যাবে, তারপর সেই আনন্দসাগরে ঝাঁপ দেওয়া, বেনোয়ার বেনো জলে ভেসে যাওয়া। নীলা ঘড়ির কাঁটার দিকে চেয়ে থাকে। কাঁটা এত ধীরে চলতে সে আর দেখেনি। তার তর সয় না।

সারা বিকেল সে বাথটাবে শুয়ে কাটাল। শরীরের আনাচ কানাচে যত ধুলো ময়লা দূর করে ভাল যত পোশাক আছে প্রতিটি পরে আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার দেখে যেটির তুলনা নেই সেটিই শেষ অব্দি নির্বাচন করে, পরে, চোখের ভুরুতে, পাতায়, কিনারে, গালে, ঠোঁটে রং লাগিয়ে, পয়জন-এর সবুজ শিশি উপুড় করে সারা গায়ে ঢেলে নীলা যখন তৈরি, তখন বাজে সাড়ে পাঁচটা। বাকিটা সময় অপেক্ষা, না নড়ে না চড়ে কেবল দুর্গামূর্তির মতো বসে থেকে অপেক্ষা। শুয়ে গড়ালে পোশাকের ইস্ত্রি ভেঙে যাবে, চুলের ঢেউ যাবে নষ্ট হয়ে, কিছু খেলে বা পান করলে, ঠোঁটের রং যাবে উঠে, নীলা তাই কিছুই করল না। কেবল বুকের শব্দ শুনল আর স্থির চোখে দেখল ঘড়ির কাঁটার দ্রুত পার হওয়া।

ক্লজারি দ্য লিলায় ভারতীয় রূপসী নেমে এলে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা ফরাসি সুদর্শন বিস্ফারিত চোখে সে রূপ দেখে প্রায় উড়ে এসে রূপসিকে বুকে গাঢ় আলিঙ্গনে পিষে গভীর চুমু খেল। চোখে চোখে নয়, কথা হল জিভে জিভে। অমৃতের মতো পান করল একে অপরের প্রেমার্দ্র জিভজল।

ফরাসি চুমুর এমন গা বিবশ করে দেওয়া স্বাদ পেয়ে রূপসি শরীর কাঁপে।

তুমি আমাকে পাগল করে দেবে নীলা। বেনোয়া বলে।

এত যত্নে রাখা ঠোঁটের রং উবে গিয়ে গাঢ় বাদামি রঙের ঠোঁট বেরিয়ে আসে নীলার, সেটি ঢাকতে ঠোঁট বিযুক্ত করে নীলা নাকে পাউডার লাগাতে যায়। ফিরে আসে রক্তাভ ঠোঁট নিয়ে, নিশ্চিন্ত।

বেনোয়ার মুখোমুখি বসে নীলা বলে, এত লোকের সামনে তুমি এই করলে?

কী করলাম?

জানো না বুঝি কী করলে, নীলার ঠোঁটে কামড়, ঠোঁটে হাসি, চোখে শরম।

অন্যায় কিছু করেছি? বেনোয়া ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল, নীল তারায় নীলা নিজের মুখটি দেখে।

চুমু খেলে যে!

বেনোয়া হো হো হেসে বলল, তোমার আপত্তি ছিল কি!

নীলা মেনু টেনে নিয়ে মুখ ঢাকল। মেনু সরিয়ে চোখে চোখ, আপত্তি ছিল?

হেসে নামিয়ে নিল চোখ, চিবুক, চিবুকের কালো তিল।

এই, আমার চুমু আমি খেয়েছি, এতে অন্য লোকের কী!

রাস্তায়, পার্কে, মেট্রোয় ছেলেমেয়েদের অহর্নিশি চুমু খেতে দেখে নীলা, দেখতে দেখতে চুমু ব্যাপারটি তার কাছে অনেকটা মেপেল গাছের পাতা অথবা গাছে ঝুলে থাকা আপেল দেখার মতো। কিন্তু চুমু নিজের ঠোঁটে এসে পড়লে সেটি যেন অন্য কিছু, সেটি আর দেখা নয়, অনুভব করা কেবল। শরীরের প্রতি কোষে অনুভব করা। আর সেটি অন্যরকম নিশ্চয়ই, সে চুমু যদি সোনালি চুলের নীল চোখের কোনও সুঠাম সুদর্শন যুবকের হয়, সে চুমু যদি ফরাসি চুমু হয়।

কী খাবে বলো! ফোয়া গ্রা?

এ আবার কী জিনিস?

হাঁসের কলিজা, হাঁসকে খুব করে খাইয়ে তারপব কলিজা বের করে নিয়ে এ জিনিস তৈরি করা হয়।

বর্ণনায় নীলার রুচি চলে যায়।

তাহলে সালাদ নেবে? মোৎজারেলা আর টমাটো?

পনির তো! পছন্দ করি না।

খাবে কী তা হলে?

মাছ টাছ নেই? আমি আবার মাছের দেশের মেয়ে।

সামুদ্রিক মাছ আছে, নিতে পারো!

ধুত, সমুদ্রের মাছে স্বাদ নেই, পুকুরের মাছ নেই?

মেনু দেখতে দেখতে বেনোয়া মাথা নাড়ে, নেই।

এনত্রোকোত নেবে? ও এ তো তুমি খাবে না।

কেন খাব না? আগে একদিন খেয়েছি।

গোরু তো তোমাদের দেবতা।

নীলা হাসি সামলে বলল, ওই এনত্রোকোতই নেব।

তুমি ধর্ম মানো না?

আমার ধর্ম আমার কাছে।

বেনোয়া চোখ নাচিয়ে বলে, তোমার ধর্মে তা হলে গোরু খাওয়া আছে।

নীলা গম্ভীর মুখ করে বলে যায়, হিন্দু ধর্মে গোরু খাওয়া নিষেধ কে বলেছে? বৈদিক যুগে গোরু খাওয়া হত। তারপর ব্রাহ্মণরা নিজেদের উঁচু জাতকে আলাদা করতে কিছু নিষেধের আয়োজন করল, ব্রাহ্মণ গোরু খাবে না। এরপর ব্রাহ্মণের নীচে যে জাত, সে জাতও গোরু খাওয়া বন্ধ করল, তার নীচের জাতের সঙ্গে নিজেদের আলাদা করার জন্য। এভাবেই যে যত জাতে উঠতে চায়, গোরু না খাওয়া এক ধরনের রীতি করে তুলল।

এখানে কিন্তু জাতে উঠতে গেলে গোরু খেতে হয়। বেনোয়া বলে।

নীলা কপট বিস্ময় কণ্ঠে বলে, এখানেও জাত আছে? ফরাসি বিপ্লব তা হলে কি জাত ফাত দূর করতে পারেনি? ধনী এলাকা গরিব এলাকা একাকার করতে পারেনি?

বিপ্লব বিষয়ে বেনোয়ার আগ্রহ নেই। সে আগ্রহ প্রকাশ করে বরদো ওয়াইনে, পুরো বোতল বরদো দিতে অনুরোধ করে।

খেতে খেতে নীলা বলল, সে বান্ধবীর বাড়িতে থাকছে না, থাকছে রু দ্য রিভলিতে।

বেশ ধনী এলাকা তো রু দ্য রিভলি। কোনও ফরাসির বাড়ি?

না। বলে নীলা থামে, অপেক্ষা করে বেনোয়া তাকে জিজ্ঞেস করবে যদি ফরাসির নয়, তবে কার। বেনোয়ার এতে, নীলা দেখে, কোনও আগ্রহ নেই। অতঃপর নিজেই বলে, বাঙালির। শুনে বেনোয়ার চোখ হঠাৎ মাছের চোখের মতো গোল।

কেন বাঙালিরা বুঝি ধনী এলাকায় থাকতে পারে না?

না সে কথা বলছি না।

বেনোয়া তবে কোন কথা বলছে, তা অবশ্য বলে না।

লাল বরদোর গেলাস উঠিয়ে বেনোয়া সঁতে বলল, নীলাও সঁতে।

ক্লসারি দ্য লিলায় যাঁদের আড্ডাখানা ছিল, পান করতে করতে যাঁরা রাতকে সকাল করতেন, সেই অগুনতি লেখক শিল্পীদের নাম, থালার তলায় কাগজে লেখা। বোদেলেয়ার থেকে শুরু করে এজরা পাউন্ড, এফ স্কট ফিৎজেরাল্ড, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, জর্জ অরওয়েল, স্যামুয়েল বেকেট! কাগজটিতে চোখ বুলিয়ে নীলা উচ্ছ্বসিত। আচ্ছা, এটা কি সেই রেস্তোরাঁ, যেখানে লেনিন আসতেন, ট্রটস্কি আসতেন!

আমার মনে হয় না। বেনোয়া আশপাশ তাকিয়ে বলে।

খানিক ভেবে নীলা বলে, আমার মন বলছে এটা সেই রেস্তোরাঁ যেখানের তেরাসে বসে হেমিংওয়ে তাঁর সান অলসো রাইজেস লিখেছিলেন, মাত্র ছ সপ্তাহে। কাছেই তো ছিলেন, পিকাসোও আসতেন তাঁর কবিবন্ধু এপোলেনিয়েরকে নিয়ে।

পিকাসো! বেনোয়ার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

হ্যাঁ পিকাসো, কিন্তু হেমিংওয়ের ব্যাপারটা আমি বুঝি না। প্রচণ্ড দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেছেন এই প্যারিসে, যখন চুয়াত্তর কার্দিনাল লেমোয়াঁয় থাকতেন। ঠাণ্ডা ঘরে, ঘরে কোনও গরম জল ছিল না। ঘর গরম করার জন্য জ্বালানি কাঠ কেনার টাকা ছিল না। কোনও তয়লেত ছিল না বাড়িতে। একটি বালতি ব্যবহার করতেন, ব্যাস। আর ঠিক ঠিকই ক্যাফে বারে রেস্তোরাঁয় যেতেন, প্লাস শাঁ মিশেলে ক্যাফে দেসামেচ্যুওর-এ বসে ক্যাফে ও লে পান করতেন। এমনকী ঘোড়দৌড়ের বাজিও খেলতেন। কী করে? একটু খটকা লাগে তাই না?

নীলা তাকায় বেনোয়ার দিকে। রামস্টেক চিবোতে চিবোতে সে বড় বড় চোখে নীলাকে দেখছে। নীলার চোখের সামনে গেলাসের টুং টাং শব্দ, চোখের সামনে পাঁড় মাতালের হুল্লোড়, আর তাজা তাজা শব্দাবলি, গদ্য পদ্য। শতাব্দীর শুরুতে আমেরিকায় মদ নিষিদ্ধ হওয়ার পর মদারু লেখকেরা রাগ করে আমেরিকা ছেড়ে প্যারিসে এসে মদ্যাশ্রয় নিয়ে এই রেস্তোরাঁয় রাতভর চেঁচাতেন, শব্দের ফুলকি ওঠাতেন, দৃশ্যটি নীলার সামনে স্থির হয়ে থাকে, তার চোখের তারাও স্থির হয়। ঢকঢক করে বেনোয়ার বরদো গেলার শব্দে সংবিৎ ফেরে, হেমিংওয়ের ব্যাপারটা দেখো, তার টাকা সবসময় ফুরিয়ে যায় খাবার কিনতে যাবার সময়। অবশ্য বই কেনার সময়ও। যত বই পড়েছেন, বইয়ের দোকান থেকে ধার করে। খালিপেটে পল সেজানের ছবি দেখে চমৎকার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার পরামর্শও দিয়েছেন। আমি একদিন সালভাদর দালি মিউজিয়ামে খিদেপেটে ঢুকেছিলাম, মাথা চরকির মতো ঘুরছিল। কাছে কোনও গাছ পেলে ওর ডালে আমি দালির ঘড়ির মতো ঝুলে পড়তাম, আমাকে বেরিয়ে আসতে হল, মোমার্তের ওসব পর্যটক ভোলানো রেস্তোরাঁয় আগে খেতে হল। খেয়ে তারপর দালি দেখলাম। খিদেপেটে সেজান দেখলেও ওই হবে আমার।

ওয়াইন ফুরোলে, বেনোয়া আবার ঢেলে দেয় দুটো গেলাসেই, এক চুমুকে অর্ধেক শেষ করে, নীলা বলে, তবে যাই বলো বেনোয়া, হেমিংওয়ে একটি খুব ভাল কথা বলেছেন, প্যারিসে থাকা কখনও বৃথা যায় না। যা কিছুই তুমি প্যারিসকে দাও, প্যারিস তোমাকে তার বিনিময় দেয়। অবশ্য এসব পুরনো সময়ের কথা। প্যারিস পুরনো আমলে এমনই ছিল, এবং হেমিংওয়েরা খুব গরিব ছিলেন এবং খুব সুখী ছিলেন। আজকাল অন্যরকম, আজকাল হাতে কাঁড়ি কাঁড়ি ফ্রাঁ না হলে তুমি দ্বারে দ্বারে ঘোরো, আশ্রয় চাও, ভিক্ষে চাও, তুমি ভোগো, তুমি মরো।

নীলার চোখদুটো কি ভিজে উঠছে! ভিজে উঠছেই তো। ভিজে উঠছে।

না ভিজে উঠছে না, এনত্রোকোতে সে গোলমরিচটা বেশি ঢেলেছে ভুল করে, তাই। বেনোয়া পরিমাণ মতো নুন আর গোলমরিচ নিয়েছে, ওর চোখ খরার মাটির মতো, শুকনো। ওর চোখ, কান কিছুই জ্বালা করছে না, রং বদলে লাল হচ্ছে না, নাকের অগ্রভাগ সামান্য লালচে যদিও, অত্যধিক বরদো পানের কারণে।

হঠাৎ বান্ধবীর বাড়ি থেকে চলে গেলে কেন নীলা? বেনোয়া জিজ্ঞেস করে।

নীলা উত্তর দেয় না, দানিয়েলের বাড়ি থেকে চলে এসে, নীলার মনে হয়, একরকম ভালই হয়েছে। নাতালির সঙ্গে দানিয়েলের সম্পর্ক হওয়াতে তার মুক্তি হয়েছে প্রতি রাতের ওই লকলকে জিভের কবল থেকে। চোখের সামনে জিভটি ঝুলতে থাকে, সে জিভ ঠেলে সরিয়ে নীলা জিজ্ঞেস করে, ভাল না বেসে কারও সঙ্গে যৌন সম্পর্কে যেতে পারো তুমি?

বেনোয়া বলে, নির্ভর করে।

কীসের ওপর?

পরিবেশ, আর…

আর কী?

আবেগ ইত্যাদি ইত্যাদি। বেনোয়ার অস্পষ্ট উত্তর শুনে, নীলা তার না-লালচে নাকটি তুলে স্পষ্ট করে বলে, আমি পারি না।

ভালবাসার উতল হাওয়া নীলাকে কলকণ্ঠ করে, ভালবাসা কখন যে আচমকা আমাকে এমন গ্রাস করে নিল। হঠাৎই, চোখের পলকে। যখন হাঁটি, চলি, কারও সঙ্গে কথা বলি, একা বসে থাকি, যখন ঘুমোই, যখন জেগে উঠি, আমি স্পষ্ট টের পাই যে কাউকে আমি ভালবাসি।

তুমি যে তোমার এনত্রোকোত খেলে না!

চেষ্টা করেছি খেতে, কিন্তু এক নম্বর, মশলা ছাড়া রান্না মাংস খেয়ে অভ্যেস নেই, দু নম্বর, গোরুর মাংস খেয়ে অভ্যেস নেই।

আর তিন নম্বর, বেনোয়া বলে, দেবতা খেয়ে অভ্যেস নেই। হা হা।

নীলা হাসে।

আইসক্রিমে দেবতা নেই, সেটা নিশ্চয়ই পারো।

আইসক্রিম খেতে খেতে নীলা তার ইচ্ছের কথা বলে, যে সে একটি বাড়ি ভাড়া নেবে, ভাল একটা চাকরি নেবে। স্বনির্ভর হওয়ার স্বপ্ন তার বহুদিনের।

কোথায় ভাড়া নেবে?

সে এখনও ঠিক করিনি। বাড়ি ভাড়া নিতেও তো শুনেছি মহা ঝামেলা। ধনী লোককে জিম্মাদার হতে হয়।

বেনোয়া বলে, আমার বাড়ির কাছাকাছি ভাড়া নিয়ো, তা হলে বেশ হবে।

বেনোয়া হাত বাড়িয়ে দেয় নীলার হাতের দিকে। সে হাতে, সে জানে, হাত রাখতে হবে। হাত রাখলে, নীলার সরু আঙুলগুলো আঙুলে বুলোতে থাকে বেনোয়া।

কী চমৎকার করে এরা ভালবাসতে জানে, নীলা ভাবে।

রেস্তোরাঁর লোক লাদিসিয়োঁ দিয়ে যায় বেনোয়ার সামনে। নীলা সেটি ছোঁ মেরে তুলে নেয়।

বেনোয়া হাঁ হাঁ করে ওঠে, করছ কী করছ কী এ তো আমি দেব, আমি তোমাকে নেমন্তন্ন করেছি।

তাতে কী!

সাড়ে আটশো ফ্রাঁ টেবিলে রেখে বলে, গরিব দেশ থেকে এসেছি বলে কি ভিখিরি নাকি!

বেনোয়া বাধা না দিয়ে বলে, ঠিক আছে এর পর আমি খাওয়াব তোমাকে।

লাদিসিয়োঁ বেনোয়ার সামনে দিয়েছে লোকটি, নিশ্চয়ই ভেবেছিল, নীলার দাম মেটাবার যোগ্যতা নেই। একে কালো, তার ওপর মেয়ে! নীলার এক ধরনের গৌরব হয় খাবারের দাম মিটিয়ে।

গৌরবের মূল্য আছে বটে, এটি ঘাড়ে থাকলে বেনোয়ার তৃষ্ণার্ত গোলাপি ঠোঁটে নীলা খুব সহজে ঠোঁট রাখতে পারে।

রেস্তোরাঁ থেকে উঠে কফি খেতে রেনোয়ার রু দ্য রেনের বাড়িতে যেতে হয়; যথারীতি। আবারও সেই কফি খাব না, চা খাব ব্যাপার।

আর চা যদি না দিতে পারি? অন্য কিছু যদি দিই! চায়ের তৃষ্ণা মিটবে তো। দেখো তো মেটে কি না!

বেনোয়া উঠে গানের যন্ত্রটি চালিয়ে দিয়ে, গেলাসে লাল ওয়াইন ভরে চুমুক দিতে দিতে গানের তালে তালে পা বাড়ায় নীলার দিকে! হোয়েন ইউ ওয়ান্ট ইট, হোয়েন ইউ নিড ইট, ইউ উউল অলওয়েজ হ্যাভ দ্য বেস্ট অব মি, আই কান্ট হেল্প ইট, বিলিভ মি…

নীলাকে বিছানায় শুইয়ে জামা পান্তলুন টেনে খুলে ছুড়ে দেয় মেঝেয়, যেন একগাদা বাড়তি জিনিস নীলা গায়ে জড়িয়েছিল। এরপর দীর্ঘ গভীর চুমু ঠোঁটে, ঠোঁটের লাল চুষে খেতে থাকে, যেন কেবল ঠোঁটেই নয়, ঠোঁটের ওই লালেও আছে মধু, ঠোঁট থেকে ঠোঁট না সরিয়ে দুহাতে খুলে ফেলে নিজের পরনের যা কিছু, ওগুলোও বাড়তি। নীলা শরমে চোখে বোজে, চাদর টেনে দেয় নিজের শরীরে। সেটিও টেনে সরিয়ে নেয় বেনোয়া। এবার নীলার হাত আড়াআড়ি বুকের ওপর রাখা। হাতদুটোও সরিয়ে বেনোয়া মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে নীলার শরীরে। থরথর কণ্ঠ কাঁপে, কী সুন্দর তুমি নীলা!

নীলা পাশ ফিরে নিজেকে লুকোতে গিয়ে বলে, কী আছে আমার, যে সুন্দর।

তোমার রং। বেনোয়ার কণ্ঠে আবেগ উথলে ওঠে।

রং? এ তো সাদা নয়। নীলা বলে।

সাদা নয় বলেই তো সুন্দর।

মিঠুর মুখটি হঠাৎ মনে পড়ে নীলার। আহা মিঠু, একবার যদি দেখতে পেতিস, এই শ্যামল রঙের কারণে আমাকে ভালবাসছে একজন। আহা মিঠু, তোর জীবনেও হয়তো এমন কেউ আসতে পারত, অপেক্ষা করলি না কেন। আহ মিঠু, জীবনের আশ্চর্য সুন্দর এই রূপটি না দেখেই চলে গেলি, আহা মিঠু….

কী অপূর্ব রং তোমার গায়ের। কী মসৃণ ত্বক। কী চমৎকার রং তোমার চুলের। কী গভীর কালো। কী সুন্দর তোমার স্তন। কারও এমন সুন্দর স্তন আমি দেখিনি। যেন দুটো কচি বাতাবি লেবু। আমাকে পাগল করে দেবে তুমি। বলতে বলতে নীলার বুকের ওপর ফোঁটা ফোঁটা ওয়াইন ঢেলে সেই ওয়াইন জিভে শুষে নেয়।

এতে ওয়াইনের স্বাদ গেছে বেড়ে। সত্যি? সত্যি।

ঠিক?

ঠিক।

এরপর বাকি ওয়াইন নীলার বুকে পেটে তলপেটে ঢেলে পান করে বেনোয়া, আর নীলা বেনোয়ার সোনালি চুলের ভেতর ডুবিয়ে দেয় আঙুল, চুল থেকে বেনোয়ার কামানো গালে, কামানো গাল থেকে লালচে নাকের ডগা, ও থেকে ঠোঁট, ঠোঁট বেয়ে চিবুক, চিবুক থেকে আঙুল উঠে যায় নাক বেয়ে কপালে, কপাল থেকে আঙুলের আদর চোখের ভুরুতে, বোজা চোখের পাতায়…ব্রায়ান এডামসের সঙ্গে বেনোয়া তখন গাইছে—আই মে নট অলওয়েজ নো হোয়াটস রাইট, বাট আই নো আই ওয়ান্ট ইউ হেয়ার টুনাইট, গনা মেক দিজ মোমেন্ট লাস্ট ফর অল ইয়োর লাইফ, ওহ ইয়া দিজ ইজ লাভ, এন ইট রিয়েলি মিন সো মাচ, আই ক্যান টেল ফ্রম এভরি টাচ…।

স্তনজোড়ায় প্রথম পালকের মতো স্পর্শ আঙুলের। এরপর পাখির ঠোঁটের মতো নাক এসে চুমু খায় দুটোয়, এরপর বেনোয়া জিভের জলে ভিজিয়ে দেয় দুটো, ঘুমিয়ে থাকা কালো স্তনবৃন্তদুটো অল্প অল্প জাগতে থাকে, সেই জাগতে থাকা পলক না ফেলে দেখে, ঠোঁট নেমে আসে জেগে ওঠা বৃন্তে, আলতো করে চুমু খায়, যেন স্তনবৃন্তের চোখের পাতায় চুমু খেল, এই চুমুতে বৃন্ত যখন পুরো জেগে চোখ খোলে, শেষ অমৃতের পাত্র থেকে তলানি নিঃশেষ করার মতো বেপরোয়া বেনোয়া ও দুটো লেহন করে বলতে বলতে যে এ তার চেরি ফল। বেনোয়াকে বেনোয়া মনে হয় না তার, যেন এপোলো, এপোলো তার আফ্রোদিতিকে ভালবাসছে, গভীর করে ভালবাসছে।

নীলার বুক থেকে পেটে চুমু খেতে খেতে বেনোয়া নীচে নামতে থাকে, লাজুক যৌনাঙ্গে। দু ঊরু শক্ত করে যুক্ত করে রাখা, দুটোকে দুহাতে বিযুক্ত করতে করতে বেনোয়া বলে, তোমার স্বাদ নিতে দাও নীলা, তোমার স্বাদ নিতে দাও।

না।

কেন?

কী বিচ্ছিরি ব্যাপার।

তোমার কোমল কালো লোমগুলো কী অপূর্ব। তারও নীচে আমি জানি, অমৃত আছে। আমাকে পান করতে দাও।

ধীরে ধীরে দু ঊরু বিযুক্ত করে বেনোয়া। নীলাকে চোখ ঢাকতে হয় লজ্জায়।

যৌনাঙ্গের ঠোঁটজোড়া জিভের জলে ভিজিয়ে দিয়ে বেনোয়া আরও গভীরে আরও জল উপচে পড়া নদীর দিকে যায়, মোমের মৃদু আলোয় বেনোয়াকে ডুবুরির মতো দেখতে লাগে। সবটুকু জল সে শুষে নিতে থাকে অন্ধ উন্মাদের মতো, যেন অমৃতসাগর সে খুঁজে পেয়েছে, পুরো অমৃত পান না করলে তার মৃত্যু হবে, এমনই তৃষ্ণার্ত তার শরীর।

বেনোয়া ফিসফিস করে বলে, চোখ খোলো নীলা। দেখো আমাকে। স্পর্শ করো। চুমু খাও।

নীলা চোখ খুলে আঁতকে ওঠে, প্রকাণ্ড এক শিশ্ন নীলার চোখের সামনে দপদপ করছে, যেন শিশ্ন নয়, বনাগ্নির লেলিহান শিখা। ভয়ে লজ্জায় সে চোখ বোজে। পুরুষঅঙ্গ, জীবনে দুটোই তাকে ছুঁয়েছে, সুশান্তরটির দিকে লজ্জায় সে তাকায়নি, কিষানেরটির দিকে হঠাৎ চোখ পড়েছিল, কড়ে আঙুলের মতো অথবা নেংটিইঁদুরের লেজের মতো দেখতে। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে কিষানের শিশ্ন উইয়ের ঢিবি যদি হয়, বেনোয়ার অঙ্গ হিমালয়। হিমালয়কে শেষ অব্দি স্পর্শ করে নীলা, মুঠো করে ধরেও নখের নাগাল পায় না, হাত থরথর কাঁপে তার। বেনোয়া নীলার ঠোঁটের কাছে লেলিহান শিখাটিকে, বিশাল দৈত্যটিকে আনে, চুমু পেতে।

এমন মড়ার মতো শুয়ে থাকো কেন? কালও চোখ বুজে মড়া হয়ে ছিলে, চোখ খোলো, দেখো, অনুভব করো, আনন্দ করো। হাতে নাও, মুখে নাও, গালে নাও, বুকে নাও, আমাকে জাগাও, আমাকে বাজাও। এ তো আমার একার নয়, এ আনন্দ আমাদের দুজনের।

চিত হয়ে মড়ার মতো শুয়ে থাকাই নীলার অভোস। এ খেলার নিয়মই, সে জানে, এমন। মেয়ে শুয়ে থাকবে চোখ বুজে, আর পুরুষ সেই মৃতপ্রায় শরীরের ওপর চড়ে বসে সুখ নেবে। নিয়ে নেমে যাবে। মেয়ে যদি কিছু পায় তো পেল, না পেলে না পেল।

বেনোয়া নীলার শরীরের ওপর নিজের শরীর ফেলে না, দু হাতে ভর রেখে শরীরকে তুলে রাখে শরীরের ওপর, কেবল সেই দৈত্যটি তার অথৈ জলের কাছে গোড়ালি ভেজাতে থাকে। নীলা ছটফট করে, তীব্র এক তৃষ্ণা তাকে কামড়াতে থাকে, জল ফুসে উঠলে দৈত্যটি তীরের বালুতে দৌড়ে চলে যায়। জল ফুসতে থাকে, ওকে পেতে। ও যাবে না। একী খেলা, মুখের কাছে টোপ ঝুলিয়ে রেখেছ, খেতে দাও। নীলা চোখ খুলে দেখে বেনোয়া হাসছে। দুহাতে বেনোয়ার পিঠ আঁকড়ে নিজের দিকে টানে সে।

কী চাও, বলো। বেনোয়া ফিসফিস করে। আবছা আলো এসে পড়েছে অদ্ভুত সুন্দর মুখে। এত গভীর নিকটে এমন সুদর্শন নীলা কখনও দেখেনি আগে। নীলার সারা গা ভালবাসায় কাঁপে।

বলো কী চাও।

লাজে রক্তিম হয় নীলা, সে বলে না সে কী চায়। ডানে কাত করে মাথা, বেনোয়াও ডানে ফেরে, নীলা বামে ঘোরায়, বেনোয়াও বামে।

কী, দেরি সইছে না বুঝি?

দেরি সইছে না তার কিন্তু মুখে এ কথা বলতে সে জানে না, শেখেনি, অভ্যেস নেই। ব্রীড়ার চাদর তাকে আমুল ঢেকে রাখে।

বেনোয়া মিষ্টি মিষ্টি হাসে। দুষ্টু দুষ্টু হাসে। হাসতে হাসতে নীলার ছাতি ফেটে যাওয়া তৃষ্ণা দেখে।

হঠাৎ কোনও কিছু জানান না দিয়ে সেই হিমালয় পাড় বিদীর্ণ করে নীলার থইথই জলে ঢুকে যায়, সবটুকু জল এক অতিকায় তিমির মতো শুষে নেয়। আর্তনাদ করে ওঠে নীলা, ধনুকের মতো বেঁকে ওঠে মসৃণ শ্যামল শরীর।

আর বেনোয়া, সেই এপোলো, সেই ঝড়ের দেবতা, ভেঙে তছনছ করে সব, বলতে বলতে তুমি তো কুমারী মেয়ে, কেউ তোমাকে স্পর্শ করেনি এর আগে, কেবল আমি, কেবল আমি! নীলার পা দুটো বুকের ওপর তুলে ঝড় তোলে, পা দুটোয় চুমু খেতে খেতে, তেড়ে আসে উদ্দাম উত্তাল সর্বনাশের মতো। ঝড়ের গতি দ্রুত বাড়তে থাকে, ভেতরে বাইরে ঝড়ের দেবতা হাসছে। সারা শরীরে তার উথাল পাথাল সুখ, বিদ্যুৎ চমকের তীব্র সুখ।

চিত হয়ে শোয়া নীলাকে ঝটিতে বেনোয়া নিজের কোলের ওপর বসিয়ে দেয়, আর নিজে শ্রান্ত দু হাত দু পাশে ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে।

ঘোড়ার পিঠে চড়েছ কখনও?

না, চড়েনি, ঘোড়া দৌড়োনোর অভ্যেস তার নেই, নিশ্চল বসে থাকে সে।

বেনোয়া তাকে দুহাতে ওপরে তোলে, নীচে নামায়। অশ্বচালনা শেখায়। দুর্বার গতিতে তাকে ছুটতে বলে। কানে কানে মন্ত্র দেয় তুখোড় অশ্বারোহী হবার। টেনে আনে নিজের কাছে, দু স্তন মুঠো করে ধরে, আর সেই চেরিফলের নেশায় মাতাল হতে থাকে।

বিছানার একপাশ থেকে একের গভীরে ঢুকে থাকা আরেক, গড়িয়ে অন্য পাশে যায়। সেই পাশ থেকে দৃঢ় আলিঙ্গনে বেঁধে পরস্পরকে আরেক পাশে। গড়াতে গড়াতে দুটো শরীর এবার মেঝেয়।

আবার ফিসফিস করে বেনোয়া, নাচতে জানো?

নীলা নাচতে জানে না। নাচ সে শেখেনি কোনওদিন।

নাচো, ঘুরে ঘুরে নাচো, আমার দিকে পেছন ফিরে নাচো।

শরীরটিকে ঘুরিয়ে দিয়ে নাচায় বেনোয়া। এমন নাচ নীলা নাচেনি কখনও, পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নীলাকে নাচের তালিম দেয়। এরপর সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে দিয়ে শুইয়ে দেয় উপুড় করে, সুঠাম সুদর্শন শরীরে ঢেকে দেয় সুশ্রী সুতনু।

ঝড় বইছে পেছনের আঙিনায়। আবার তছনছ।

নীলা চিৎকার করে বিদ্যুৎ চমকে।

সেই ঝড়ো হাওয়া এতটুকু না থেমে, নীলার কটিদেশ তুলে আনে ওপরে। নিতম্বজোড় বেনোয়ার হাতের মুঠোয়। হাঁটু ভেঙে বসে নীলার সমুদ্রে উত্তাল ঢেউ আনে আবার। আবার গোড়ালি ভেজাল তো, আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই ঢেউএ, পুরো গা ভিজিয়ে স্নান করে।

নীলা হাঁপাতে থাকে।

মেঝে থেকে তুলে নীলাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বেনোয়া জল নিয়ে আসে, গেলাসে অর্ধেক খেয়ে বাকিটা নীলাকে দেয় খেতে। জল খেতে খেতে আড়চোখে দেখে সে, লাল জিভ বের করে দৈত্যটি তখনও ফুঁসছে। বেনোয়া পাঁজাকোলা করে নীলাকে সোফায় এনে নিজের কোলে বসায়। সারা শরীরে চুমু খেতে খেতে তাকে চঞ্চল করতে করতে বলে, এত সুন্দর নিতম্বকে স্থবির করে রাখো কেন, দোলাও, দোলাও আমার জগৎখানা দোলাও।

দোলাতে সে জানে না। দোলাতে বেনোয়াকেই হয়। ঝড়ের বেগ যখন বাড়ে, নীলাকে কোলের ওপর তুলেই বেনোয়া দাঁড়ায়। শরীরটিকে শূন্যে তুলে, দেয়ালে সেঁটে ঝড় বইরে দেয় ভেতর ঘরে, আবার। নীলার শীৎকারে চিৎকারে ঘর দোলে। বেনোয়া দোলে। দুলতে দুলতেই, নীলাকে, যেন ছোট্ট শিশু, বাঁ কাতে শুইয়ে দেয় বিছানায়। পেছন থেকে জাপটে রাখে ক্লান্ত শিশুকে, শিশুর বুকের কচি বাতাবিলেবু দুটোকে, তার ওপরের দুটে চেরিফলকে। তারপর নতুন উদ্যমে বেনোয়া, সেই ঝড়, সেই তুফান, সেই তছনছ করে দেওয়া উন্মত্ত উত্তাল উত্তেজনা, প্রবল গতিতে ঢোকে নীলার শান্ত স্নিগ্ধ মন্দিরে, ভেঙে চুরে সর্বনাশ করে ঘেমে নেয়ে বিদ্যুৎচমক আনে, সেই চমক নীলা থেকে বেনোয়ায় সংক্রামিত হয়, বেনোয়া থেকে নীলায়। বেনোয়ার সাদা বেনো জলে নীলার দুকুল ভেসে যায়, নীলার ভুবন ভেসে যায়।

ঘাম ঝরছে বেনোয়ার চুলের গোড়া থেকে, বুক পিঠ থেকে। তখনও সুখে কাঁপতে থাকা নীলার শরীরখানি জড়িয়ে রাখে বেনোয়া, বুকে।

মোমবাতি অনেকক্ষণ নিবে গেছে। ব্রায়ান অ্যাডামস অনেকক্ষণ থেমে গেছে। ঘড়ির কাঁটা এক এক করে তিন ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। মধ্যরাতও পার হয়েছে।

বেনোয়ার বুকের সুগন্ধ নিতে নিতে নীলা তখন খানিক ঘুমে, খানিক না ঘুমে। আঁধার আঁধার ঘরটিতে বেনোয়াকে সেই রাজপুতুরের মতো লাগে, নীলা যে হঠাৎ হঠাৎ ভাবত একটি রাজপুত্তুর এসে তাকে ঘোড়ায় তুলে নিয়ে যাবে তার প্রাসাদে। এই তো সেই প্রাসাদ এই সেই রাজপুত্তুর। নীলার সারা শরীরে অদ্ভুত এক প্রশান্তি, সারা হৃদয়ে সুখ। এর চের বেশি সুখ, নীলার বিশ্বাস, আর কেউ পেতে পারে না। ভালবাসা এত তীব্র করে এর আগে কখনও সে অনুভব করেনি। নীলা থরথর কণ্ঠে বলে তোমাকে খুব, খুব ভালবাসি বেনোয়া। বলে না, এক দেখাতেই প্রেম। এমনই হল আমাদের।

বেনোয়া চোখ খোলে, আলতো চুমু খেয়ে নীলার ঠোঁটে বলে, তোমাকে খুব ভাল লাগে আমার, খুব খুব ভাল লাগে।

নীলা বলে, আমাকে ভালবাসো না?

এখনও না।

চকিতে উঠে বসে নীলা।

কী বললে, আমাকে তুমি ভালবাসো না?

না। শান্ত স্বর বেনোয়ার।

তুমি আমাকে ভালবাসো না, তা হলে কী করে তুমি পারলে এমন নিষ্ঠ প্রেমিকের মতো এত সব করতে! যাকে ভালবাসো না, তাকে দেখে তোমার শরীর কী করে জাগে?

বেনোয়া বলে, ভাল লাগে তোমাকে, ভাল লাগলে শরীর জাগবে না কেন?

আমার নিজের ওপর ঘেন্না হচ্ছে আমার, ছি!

কী বলছ এসব? বেনোয়া উঠে বসে।

ভেবেছ, এ গরিব দেশ থেকে এসেছে, খেতে পায় না পরতে পায় না, একে দুকথা বলে পটিয়ে বিছানায় নিয়ে যাওয়া খুব সহজ!

ভাঁজ জমতে থাকে বেনোয়ার কপালে, চোখে। নীলা তার জামা কাপড় যত দ্রুত সম্ভব পরে নেয়।

তুমি কি বোকা নাকি? এত শিগরি কি ভালবাসা হয়? হয়তো একদিন বাসব। বেনোয়া বলে।

হয়তো বাসবে না।

তুমি কি যাচ্ছ নাকি!

হ্যাঁ যাচ্ছি।

অনেক রাত হয়েছে নীলা। থেকে যাও এখানে।

থেকে যাব? কেন, ভয় পাও না? পাসকাল, যাকে তুমি ভালবাসো, হঠাৎ এসে পড়তে পারে।

উলঙ্গ বেনোয়া তার তৃপ্ত ঘুমন্ত শিশ্নখানা নিয়ে হতভম্ব বসে থাকে, নীলা বেরিয়ে যায়।

অপমান নীলার পেছন পেছন যায়, অপমান নীলার সামনে সামনে হাঁটে, অপমান নীলার ডানে বাঁয়ে। নীলাকে দেয়ালে সেঁটে অপমান নীলার ভেতর বাহির তছনছ করতে থাকে। নীলা স্পষ্ট বুঝতে পারছে, যা ঘটিয়েছে বেনোয়া, ও কোনও সুখের কোনও ব্যাপার ছিল না, সে ভোগ করেছে নীলার শরীর, যেমন করে যে কোনও কামুক ধর্ষক ভোগ করে কোনও অসহায় বেকুব মেয়েকে। ছি! নীলা ছি! তুই মর। তুই মিঠুর মতো গলায় ফাঁস লাগিয়ে মরে যা।

এ কলকাতা নয়, প্যারিস। প্যারিস সারারাত জেগে থাকে। হাত ওঠালেই ট্যাক্সি। হাত বাড়ালেই প্রেমিক।

মরুনি ভেরনেস

নীলা বাড়ি ফিরলে, সুনীল ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, কোথায় ছিলে এতক্ষণ?

এক বন্ধুর বাড়ি।

বেনোয়া নামে এক লোক দুবার ফোন করেছে। তুমি ফিরলে ফোন করতে বলেছে, বলে সুনীল চলে যায় শোবার ঘরের দিকে।

নীলাও যায় তার শোবার ঘরে। বাতি নিবিয়ে যখন শুতে যাবে, টেলিফোনের শব্দ, টুম্পার মা মা বলে কেঁদে ওঠার শব্দ, আর সুনীলের শব্দ, নীলা ফোন ধরো।

ফোনে বেনোয়া।

এত রাতে ফোন করেছ কেন? লোক ঘুমোচ্ছে তো।

তোমার সঙ্গে আমার কথা বলা জরুরি।

এখন, এই রাতে?

হ্যাঁ।

না। আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমোব।

কাল দেখা করবে?

না।

নীলা ফোন রেখে দিল।

ফোন রেখে শোবার ঘরের দিকে যেতে আবার ফোন। নীলা এবার ফোনের তার খুলে রেখে শুতে যায়।

সাতসকালে উঠে নীলা বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে, জানে সে বাড়ি থাকা মানে একশো প্রশ্নের সামনে পড়া, কে এই বেনোয়া, কেন সে গভীর রাতে ফোন করে ঘুম ভাঙাচ্ছে অন্যের, তার সঙ্গে যা কথা আছে, নীলা কেন বাইরেই সেরে আসেনা সব। ইত্যাদি ইত্যাদি। বেরিয়ে, নীলা এলোমেলো ঘুরে বেড়ায়, মানুষের ভিড় চারদিকে, মেয়েরা লোম কাটা মসৃণ পা দেখিয়ে হাঁটছে, পেট পিঠ খোলা এমন জামা গায়ে, হাঁটছে আর ওদের স্তন দুলছে, নিতম্ব দুলছে। সারা শীত সালাদপাতা চিবিয়ে চকচকে শরীর বানিয়েছে, যত মেদ ছিল, ঝরিয়েছে, ঝরিয়ে এই গরমে শরীর প্রদর্শন করছে রাস্তাঘাটে বাগানে…। গরমকাল এখন, সুখের কাল এদের। অসহ্য গরমে নীলা ঘামে, ছায়া ধরে হাঁটে, আর অন্যরা হাঁটে রোদে। কুলকুল করে ঘামছে ওরা, তবু রোদ চাই। সাদা ত্বক রোদে পুড়ে লাল হয়ে ওঠে, তবু রোদ চাই। গরমকালে, সূর্য যখন থোকা থোকা আগুন ঢালতে শুরু করে, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে সব। সিনেমা থিয়েটারে ভিড় নেই। চার দেয়াল আর মাথার ওপর ছাদ এ জিনিস শীতকালের, গরমকালের নয়। ক্যাফে রেস্তোরাঁর ভেতরে কেউ বসে না, সব তেরাসে, বাইরে চেয়ার পেতে। বাইরে বসেই রোদ তাপাতে তাপাতে আড্ডা দিচ্ছে, পান করছে, খাচ্ছে। মধ্যাহ্নের গা ঝলসানো রোদে, নীলা দেখে, জারদা তুয়েরিতে একশো ছেলে মেয়ে প্রায় উলঙ্গ শুয়ে আছে। নিজে সে গরম দেশের মেয়ে হয়ে এত গরম সইতে পারে না, কিন্তু শীতের দেশের মানুষ গোগ্রাসে রোদ খাচ্ছে, যেন রোদের চেয়ে সুস্বাদু খাদ্য আর জগতে নেই। হাজার মানুষের ভিড়ে নীলাই একা, বাকিরা জোড়ায় জোড়ায়। চুমুতে শৃঙ্গারে ব্যস্ত জোড়া। তুয়েরি থেকে হেঁটে জারদা দ্য লুক্সেমবার্গেও একই দৃশ্য। ঘাসের ওপর তোয়ালে বিছিয়ে কচ্ছপের মতো শুয়ে শত শত সাদা রোদ তাপাচ্ছে, প্রতিটি লোমকূপে রোদ ঢোকাচ্ছে। গাছের ছায়ায় নীলা ছাড়া আর কেউ নেই বসা। বাগান রঙিন হয়ে আছে ফুলে, এই বাগানের রূপ বদলে যায় প্রতি ঋতুতে, গরমকালে এ সবচেয়ে বেশি রূপবতী হয়ে ওঠে, তখন ভিড় বাড়ে বাগানটিতে, রূপোন্মত্তদের ভিড়।

গরমে প্যারিস কানায় কানায় ভরে ওঠে পর্যটকে। আমেরিকান বুড়ো বুড়ি লম্বা ঢিলে শর্টস পরে, প্যারিস গাইড আর ম্যাপ হাতে নিয়ে শহরের আনাচ কানাচ ঘুরে বেড়ায়। পর্যটকের ভিড়ে অতিষ্ঠ হয়ে প্যারিসবাসী গরমের শেষ মাসে লম্বা ছুটি নিয়ে শহর ছেড়ে দূরে চলে যায়, দক্ষিণের দিকে, আরও গরমের দিকে, ইতালি বা স্পেন বা গ্রিসের দিকে। সমুদ্রতীরের বালুতে কচ্ছপের মতো পুরো গরমকাল শুয়ে থেকে রোদে গা পুড়িয়ে তামাটে করে তবে দেশে ফেরে, নিজের শহরে ফেরে, এই নিয়ম। যে যত কালচে, যত তামাটে, যত বাদামি করতে পারে রং, তত তার অহংকার। নীলার কোনও অহংকার হয় না তার কালচে রং নিয়ে। সে জানে, এই রংটিকে বেনোয়া ভাল লাগে বলেছিল কেবলই শরীর পেতে। যৌনাঙ্গ কালো হোক সাদা হোক, আনন্দ যেহেতু একই দেয়, আপত্তি করেনি বেনোয়া।

লুক্সেমবার্গ বাগান থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে উইলিয়াম এন্ড স্মিথ থেকে কিছু বই কিনে পাসাজ ব্রাদিতে ঢোকে, ভারতীয় খাবার খেতে। যাদের প্রেমিকের কপাল নেই, তাদের বই ছাড়াও গতি নেই, বাগানে ক্যাফেতে বাসে রেলে একা নিজের একাকিত্ব লুকোতেই বইয়ের আশ্রয়। পাসাজ ব্রাদির রেস্তোরাঁয় খেতে খেতে বইয়ে মন দেবে এই তার ইচ্ছে। সারাদিনে যে জিনিসটি সে এই প্রথম দেখে, একা একটি মেয়ে। মেয়েটির গায়ের রং ঘোর কালো, কিন্তু নাক ভোঁতা নয়, চুল কোঁকড়া নয়, আফ্রিকার মেয়ে সে নিশ্চয় নয়। রেস্তোরাঁয় আর কোনও খদ্দের নেই, কেবল মেয়েটিই। মেয়েটির পাশের টেবিলে বসে নীলা ভাবে, এ মেয়ে ভারতীয় না হয়ে যায় না। কিন্তু কোনও ভারতীয় ভাষায় রেস্তেরাঁর কারও সঙ্গে কথা বলার কোনওরকম চেষ্টা না করে মেয়েটি যখন বিশুদ্ধ ফরাসিতে রেস্তোরাঁর লোকের কাছে জল চায়, খাবার চায়, খাবারে ঝাল কম চায়, নীলা বই থেকে চোখ তুলে মেয়েটির আপাদমস্তক নতুন করে লক্ষ করে। দুজনের চোখাচোখি হয় বেশ কবার।

চোখাচোখি হলে এক ধরনের দায়িত্ব নীলা অনুভব করে, দুএকটি বাক্য বিনিময় করা। জিজ্ঞেস করে, আপনার মাতৃভাষা কী?

ফরাসি? মেয়েটি উত্তর দেয়।

নীলা প্রস্তুত ছিল শুনতে তামিল বা মালায়ালাম।

আপনি কি ভারতীয় নন?

মেয়েটি না বলল।

তা হলে কোন দেশি?

ফরাসি।

নীলার কৌতূহল বাড়ে।

কোথায় জন্ম আপনার?

ভারতে।

নীলা হাসে। বিদেশিরা এ দেশের নাগরিকত্ব পেয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের বলতে থাকে ফরাসি, নিজের দেশের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে। নীলা উমবার্তো একোর বই থেকে আঙুল সরিয়ে জিজ্ঞেস করে, ভারতের কোথায়?

সম্ভবত কলকাতায়।

কলকাতায়?

নীলার চোখে মুখে খুশি উপচে ওঠে, বাংলায় বলে, তা কতদিন এখানে আছেন?

মেয়েটি হেসে বলল, আমি ভারতীয় ভাষা জানি না।

আপনি কলকাতার মেয়ে, বাংলা জানেন না? আবারও বাংলায় বলে নীলা।

মেয়েটি ভাবলেশহীন তাকায়।

কম ঝালের খাবার এসে গেলে, মেয়েটি খাওয়ায় মন দেয়। নীলা ঠিক বুঝে পায় না মেয়েটির সঙ্গে সে কথা চালিয়ে যাবে না কি নিজের চরকায় তেল দেবে। চরকা বলতে যদিও কিছু নেই তার, ভবঘুরেদের কোনও চরকা থাকে না। মেয়েটির মায়াকাড়া মুখ, ডাগর চোখ দেখে নীলার বিশ্বাস জন্মে, এ মেয়ে তাকে ইচ্ছে করে এড়িয়ে যাচ্ছে না। আগ বাড়িয়ে বলে, আমি কলকাতার মেয়ে।

মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দেয়, আমি মরুনি ভেরনেস

। নীলার খাবারও এসে যায়। সাদা ভাত আর মুরগির ঝোল। সেও খাওয়ায় মন দেয়, কিন্তু টের পায় তার কৌতূহল কমেনি। কৌতূহলের কারণ নীলা কলকাতার মেয়ে জেনেও মরুনি কেন কোনও রকম উৎসাহ দেখাচ্ছে না কথা বলার।

খাওয়া শেষ করে মরুনি একটি সিগারেট ধরায়। কালো একটি টিশার্ট পরা, হাঁটুপকেটঅলা প্যান্ট, পায়ে সাদা কেডস, পিঠের ব্যাকপ্যাক পায়ের কাছে রাখা। উদাস তাকিয়ে আছে পাসাজে।

নীলা বলে, আপনি বোধহয় অনেক আগে এ দেশে এসেছেন তাই না? আপনার বাবা মা এখানেই থাকেন।

মরুনি হ্যাঁ বলে।

কিছু মনে করছেন না তো, জিজ্ঞেস করছি যে আপনাকে এত কথা।

না মোটেই না, মরুনি হাসে। মিষ্টি মুখে মিষ্টি হাসি।

কফি খেতে খেতে মরুনি এবার নিজে থেকে বলে, আসলে আমি ভাল ইংরেজি জানি না। কথা বলতে তাই সংকোচ হচ্ছে।

কে বলল জানেন না, বেশ ভাল তো বলছেন।

মরুনির সংকোচ দূর করতে নীলা ব্যস্ত হয়ে পড়ে, এর চেয়ে খারাপ ইংরেজি সে শুনেছে, মরুনির ব্যাকরণে কোনও রকম ভুল এখনও সে পায়নি, আর আজকাল ব্যাকরণ ঠিক করে কেউই ইংরেজি বলে না, ইত্যাদি।

আপনি কি এখানেই লেখাপড়া করেছেন? নীলা প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ এখানেই।

কবে এসেছেন প্যারিসে?

সাতাশ বছর আগে।

এরপর মরুনি ভেরনেস ভাঙা ইংরেজিতে বলে যায়, কলকাতার মাদার তেরেসা আশ্রমে ছিল সে, যখন দু মাস বয়স, এক ফরাসি দম্পতি ওকে দত্তক নিয়ে আসে। সেই থেকে, সেই দু মাস বয়স থেকে সে প্যারিসে। আপাদমস্তক প্যারিসিয়ান। আশ্রমের লোকেরা ফুটপাতের ময়লা ফেলার ডাস্টবিন থেকে মরুনির যখন এক মাস বয়স, কুড়িয়ে এনেছিল। মরুনি নামটি ওই আশ্রম থেকেই দেওয়া।

নীলা গালে হাত দিয়ে মরুনির গল্প শোনে।

তারপর?

তারপর আর কিছু না।

তুমি জানো না তোমার বাবা মা কে ছিল?

নাহ।

মরুনি আরেক কাপ কফি নেয়। নীলাও আরেক কাপ চা।

এরপর আর যাওনি, কলকাতায়?

নাহ।

যেতে ইচ্ছে করে?

আর যে কোনও শহরের মতো কলকাতাও একটি শহর তার কাছে। এ শহরের জন্য তার আলাদা করে কোনও ভালবাসা নেই যে তার যেতে ইচ্ছে করবে।

তোমার কখনও কোনও কষ্ট হয় মরুনি? নিজের শহরে নিজের দেশেই তোমার থাকা হল না বলে?

নাহ। কেন হবে? বরং মনে হয়, যা হয়েছে বেশ ভাল, না হলে আমি ওই ডাস্টবিনেই তো মরে থাকতাম।

মরুনি ভুল বলেনি, কিন্তু নীলার বুকের ভেতর মিহি একটি কষ্ট পালকের মতো উড়ে এসে ঢুকে যায়।

কে ফেলেছিল তাকে ডাস্টবিনে, সে জানে না। তার জানার কথা নয়। তার এও জানার কথা নয়, তার কলকাতায় জন্ম বা কিছু। বড় হয়ে তার ফরাসি বাবা মার কাছে শুনেছে সে সব। আশ্রমের কাগজপত্রে শুধু তার নাম লেখা ছিল, জন্মস্থান বা জন্মতারিখের জায়গায় প্রশ্নবোধক চিহ্ন শুধু, বাবা ও মায়ের নামের পাশেও বড় প্রশ্নবোধক।

নীলা বলে, যদি তোমার মা ফেলে দিয়ে থাকে তোমাকে ডাস্টবিনে, কেন ফেলেছে জানো?

মরুনি মাথা নাড়ে, তার কোনও রকম ধারণাই নেই।

নীলা বলে, ফেলেছে তুমি কালো ছিলে বলে। কালো মেয়েদের কেউ বিয়ে করে না। অথবা তোমার মায়ের বিয়ে হয়নি বলে, বিয়ে না হয়ে বাচ্চা জন্ম দেওয়া ভীষণ রকম অপরাধ, তোমার মার আর সমাজে জায়গা হত না বলে। অথবা তুমি মেয়ে ছিলে বলে, সমাজে মেয়ের জন্ম কেউ চায় না, মেয়ে হল খরচার জিনিস, বিয়ে দিতে পণ লাগে, সম্ভবত তোমার বাবা মা গরিব ছিলেন, হয়তো মেয়েও ছিল বেশ কটা, তাই।

মরুনি হাসে।

ভেবে তোমার রাগ হয় না?

মরুনি হেসে বলে, না।

মরুনির নির্লিপ্তি নীলাকে বিস্মিত করে।

তুমি ভারতীয় খাবার বুঝি পছন্দ করো?

হ্যাঁ, খুব করি।

আমার যদি আজ একটা বাড়ি থাকত এই প্যারিসে, আমি তোমার জন্য বাঙালি খাবার রাঁধতে পারতাম। ভারতীয় রেস্তোরাঁয় কিন্তু আসল ভারতীয় খাবার পাওয়া যায় না। আমার কাছে কলকাতার অনেক ছবি আছে, তোমাকে দেখাব। একটু একটু বাংলা শব্দ যদি শিখতে চাও শেখাব।

নীলার উচ্ছ্বাস দেখে মরুনি হাসে। নীলার মনে হয় না কলকাতার ছবি দেখার অথবা বাংলা শেখার কোনও রকম ঝোঁক মরুনির আছে।

মরুনি উচ্ছল প্রাণবান মেয়ে। দুঃখের একফোঁটা চিহ্ন কোথাও নেই। এমনকী নীলা তাকে বলার পরও কী কারণে তার মা নিজের হাতে নিজের মেয়েকে ডাস্টবিনে ফেলেছিলেন, তা শুনেও এক ফোঁটা দুঃখ এসে তাকে স্পর্শ করছে না।

ভারতীয় কাউকে চেনো এ শহরে?

না।

পরিচিত হতে চাওনি কোনওদিন?

মরুনি কাঁধ ঝাঁকায়। পরিচিত হতে চাওয়া বা না চাওয়ার প্রশ্নটি সে নিজেকে করেনি কোনওদিন।

নীলা অনুমান করে, একজন ভারতীয়র সঙ্গে আর একজন পর্তুগিজের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার মধ্যে মরুনি কোনও পার্থক্য দেখে না।

নীলা ভাবে, মরুনিকে যদি তার মা বা বাবা বা অন্য কেউ রাতের অন্ধকারে ভয়ংকর নিষ্ঠুরের মতো ডাস্টবিনে ফেলে না দিত, যদি সে কলকাতায় বড় হত, বাংলায় কথা বলত, শাড়ি পরত। বয়স সাতাশ ওর, কালো বলে ওর বিয়ে হত না, ওকে সম্ভবত গলায় ফাঁস লাগিয়ে মিতুর মতো মরতে হত।

তৃতীয় দফা চা কফি শেষ হবার পর এক সাদা ফরাসি ছেলে, মরুনিরই বয়সি, রেস্তোরাঁয় ঢুকে মরুনিকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে, ডান হাতে ওকে জড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। যাবার আগে নীলাকে তার ফোন নম্বর দিয়ে গেছে মরুনি, নীলার আপাতত নম্বরটি নিয়েছে। কেবল বেঁচে আছে যে তা নয়, নীলা ভাবে, মরুনি সুখে আছে। ফরাসি ছেলেটি, নীলা অনুমান করে, চুমু খেয়ে খেয়ে দিন পার করবে। মরুনিও আর সব ফরাসির মতো রোদের তলে কচ্ছপের মতো শুয়ে থেকে কালো রং আরও কালো করবে, ও রোদ থেকে গা বাঁচাতে শেখেনি, গায়ে রূপটান মেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে রং সামান্য ফরসা করা শেখেনি। সাদা ফরাসি যুবকটি মরুনিকে নিশ্চয়ই শতবার বলেছে, কী চমৎকার রং তোমার মরুনি।

নীলা বাড়ি ফিরে শ্রুতিযন্ত্রে বারোটা কণ্ঠস্বরের এগারোটিই পেল বেনোয়ার। নীলা একবার ফোন করো। আমি তোমার কথা খুব ভাবছি। বাড়িতে এসো, আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।

চৈতালি আর সুনীল দুজনের কেউই কাজ থেকে ফেরেনি। নীলা বেনোয়াকে মুছে ফেলে শ্রুতিযন্ত্র থেকে।

সন্ধেয় বাড়ি ফিরে দুজনের কেউই কে এই বেনোয়া, কী সম্পর্ক নীলার সঙ্গে এসব প্রসঙ্গ একেবারে ওঠায় না। টুম্পামণি খেলা করতে থাকে ঘরময়, আর পুজোতে দেশে যাবে নাকি প্যারিসেই থাকবে এ নিয়ে সুনীল চৈতালিতে আলোচনা শুরু হয়। প্যারিসে পুজোকমিটিতে দলাদলি শুরু হয়ে গেছে, দেশে যাওয়াই ভাল, চৈতালির মত। আর সুনীলের মত, গত পুজোয় দেশে যাওয়া হয়েছিল, এবার বরং ইয়োরোপের কোথাও যাওয়া হোক। কোথায়? সুনীলের এক কাকা থাকেন লন্ডনে, ওখানে। আর লন্ডনে পুজোও তো ঘটা করে হয়, কলকাতার চেয়ে কোনও অংশে কম নয়।

তুমি কী বলল নীলা?

সুনীল নীলার মতামত জানতে চায়।

নীলা ঠোঁট উলটে বলে, সম্পূর্ণ আপনাদের ব্যাপার। তবে আমাকে যদি বলা হত লন্ডন যাবে না কলকাতা? আমি লন্ডন বেছে নিতাম।

চৈতালি বলল, আত্মীয়স্বজন কলকাতা থাকে, বছরে মাত্র একবার দেখা করার সুযোগ হয়, এ সুযোগ নষ্ট করার মানে হয় না। লন্ডন যেতে হলে, ইয়োরোস্টারে চড়ে বসলে তিন ঘণ্টায় চলে যাওয়া যায়। শুক্রবার গিয়ে দুদিন ছুটি কাটিয়ে আসা যায়, যে কোনও সপ্তাহে।

ঠিক আছে তা হলে বাক্স ভরে বাজার করো। আত্মীয়স্বজনের তো আর শেষ নেই।

বুঝলে নীলা, সবাই আশা করে থাকে। কারও যে অভাব আছে তা নয়। হাতে ছোটখাটো কোনও বিদেশি জিনিস পেলেই খুশি হয়। আত্মীয়স্বজনে বন্ধুবান্ধবে শহর ভর্তি। সবার জন্য তো নেওয়া সম্ভব হয় না। টুম্পার কাপড়চোপড়ই তো এক বাক্স যায়। কারও কারও শুকনো মুখ দেখতে হয়, এ কারণে কি কলকাতা যাওয়া বন্ধ করে দেব।

ঘণ্টা দুই চলে যায়, তখনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না ছুটিতে কোথায় যাওয়া হবে।

নীলা সে রাতে ঘুমোতে যাবার আগে, অভাবিত একটি ফোন পায়, মরুনির। প্যারিসে বা প্যারিসের বাইরে নীলার যদি কোথাও যেতে ইচ্ছে করে, কিছু দেখতে ইচ্ছে করে, ঘুরে বেড়াতে চায়, তবে সময় আছে তার, সে দিতে পারে, কারণ আগামী দুটো দিন তার কোনও ব্যস্ততা নেই। নীলা সোল্লাসে রাজি হয়, তার জিভার্নি যাওয়ার শখ, ক্লদ মনের বাগান দেখতে। কখন দুজনের দেখা হবে, কোথায়, মরুনি বলে দেয়। অনেক রাত অব্দি শুয়ে শুয়ে মরুনির কথা ভাবে নীলা। মরুনি তার সঙ্গে যোগাযোগ না করলেও পারত, কেউ তাকে মাথার দিব্যি দেয়নি, রেস্তোরাঁয় এক দুপুরের পরিচয়ের পর কেউ কাউকে এমন বন্ধু করে নেয়, নীলা অন্তত শোনেনি, কলকাতায় ঘটতে পারে এমন ঘটনা, প্যারিসে নয়। মরুনির স্বভাবে কলকাতার কিছু নেই, তা হলে কী কারণে মরুনির এই উদারতা নীলার প্রতি! তার মনে হয়, মরুনি স্বীকার না করলেও এক ধরনের আত্মীয়তা সে অনুভব করছে নীলার সঙ্গে। তার এও মনে হয়, যে মা মরুনিকে জন্ম দিয়েছিল, তার কথা মরুনি ভাবে হঠাৎ হঠাৎ, কেমন সে দেখতে, কী তার নাম।

কলকাতার কোথাও নিশ্চয়ই এখনও বেঁচে আছে মরুনির নিজের মা, নিজের নিষ্ঠুরতার জন্য নিজেকে কি কখনও সে ক্ষমা করতে পারে? সে কি কখনও রাতে রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে না! একই সঙ্গে মানুষগুলো কী ভয়ানক নিষ্ঠুর হয়, আবার কোমল কাদার মতো নরম হয়। কোন চরিত্রটি মানুষের সত্যিকার চরিত্র নীলার কখনও জানা হয় না।

মরুনি পরদিন নীলাকে তার মার্সেডিজে করে জিভার্নি নিয়ে যায়। যখন একশো আশি কিলোমিটার বেগে মরুনি বড় রাস্তায় গাড়ি চালাতে থাকে, মোবাইল বার বার বেজে ওঠে, ডান হাতে মোবাইল, বাঁ হাতে স্টিয়ারিং, পাশে বসে নীলা প্রকৃতি দেখার চেয়ে মরুনিকেই দেখে বেশি। ক্লদ মনের বাড়ির বাগানে ছোট্ট সরোবরটির কাছে দাঁড়িয়ে তিরতির জলের ওপর পদ্মপাতার ভেসে থাকা দেখতে দেখতে সে মরুনিকে ভাবে। মরুনি এখানে ধনী বাবা মার আদরে বড় হওয়া মেয়ে। সরবনে দর্শন পড়েছে, নিজে হয়তো বড় একজন দার্শনিক হবে একদিন। কলকাতায় থাকলে, হয়তো তার অ আ ক খ পড়ারই সুযোগ হত না, হয়তো একবেলা খাবার জুটত না, অনাহারে অর্ধাহারে, অসুখে অভাবে তাকে হয়তো অল্প বয়সে মরে যেতে হত, অথবা সোনাগাছির বেশ্যা হতে হত। বেশ্যা হয়েও সম্ভবত সে খদ্দের বেশি পেত না, কারণ রং তার কালো।

জিভার্নিতে ঘণ্টা দুই কাটিয়ে মরুনি নীলাকে নিয়ে রুয়োতে যায়, রুয়োর সেই বিখ্যাত গির্জাটি দেখায়, ক্লদ মনে সকাল বিকেল, সন্ধ্যার আলো পড়া যে গির্জার ছবি এঁকেছেন। জনদাকর্কে পুড়িয়ে মারার জায়গাটিও দেখায়, অন্য এক গির্জার পিছনে। গির্জা দেখায় বটে, কিন্তু বলে, ধর্মে সে বিশ্বাস করে না। নীলা ভাবে মরুনি যদি কলকাতায় বড় হত, সে নিশ্চয় ধর্ম মানত, শিবপুজো করত, কালীঘাটে যেত, গঙ্গার নোংরা জলে স্নান করত।

শিল্পসাহিত্যে নীলার আগ্রহ আছে জেনে পরদিন মরুনি তাকে নিয়ে প্যারিসের বাইরে কুড়ি কিলোমিটার দূরে উভের সুর ওয়াসিতে যায়। ওয়াসি নদীর পারে উভের নামের ছোট্ট শহর। ছোট্ট এই শহরটিতে তখনকার নামী সব শিল্পী, দবিনি, কামিল, পিসারো থাকতেন। পল সেজানও থাকা শুরু করেছিলেন আর ডাক্তার গসেত নামের এক শিল্পবোদ্ধার আমন্ত্রণে ভ্যান গগও। জীবনের শেষ কটা দিন এখানেই কাটিয়েছেন তিনি, রাভোস ইন নামের এক ক্যাফের দোতলায় একটি ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন ভ্যান গগ। যে ঘরটিতে বসে সত্তর দিনে সাতাত্তরটির মতো ছবি এঁকেছিলেন। সব ছবিই ঘরে বসে আঁকা নয়, তখন প্রকৃতির নেশা তাঁর খুব। উভেরের গির্জার পাশে দাঁড়িয়ে নীলা রোদ পড়া গির্জাটির রং দেখে নীলাভ, ভ্যান গগের ছবির মতো। ফসল উঠে যাওয়া ভুট্টাখেতের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নীলা দেখে হলুদে ছেয়ে আছে খেত, কাক উড়ছে মাথার ওপর। হেঁটে ভুট্টাখেতের পাশে কবরখানায় ঢুকে সবুজ লতাগুল্মে ঢাকা ভ্যান গগের বাঁধানো কবরটির কিনারে বসে নীলা, মরুনি বসে ভ্যান গগের ভাই থিওর কিনারে। বসে নীলা বলে, কারও কি সব স্বপ্ন সাধ পূরণ হয় এক জীবনে?

হয় না। হলে বেঁচে থাকার আকর্ষণ নষ্ট হয়ে যায়, মরুনির ধারণা।

জীবন খুব ছোট, মানুষের আয়ু অন্তত দুশো বছর হওয়া উচিত। নীলা বলে। মরুনির তা মনে হয় না, তার মনে হয় না মানুষের এত দীর্ঘ বছর বাঁচার কোনও প্রয়োজন আছে।

হঠাৎ একটি উদ্ভট প্রশ্ন জাগে নীলার মনে, জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা মরুনি, যদি দেখো দুজন মেয়ে জলে পড়ে মারা যাচ্ছে, আমি আর আরেক জন ফরাসি মেয়ে, তুমি একজনকে বাঁচাতে পারো, সে সুযোগ তোমার আছে, কাকে বাঁচাবে?

মরুনি বলে, তোমাকে।

কেন?

কারণ তোমাকে আমি চিনি।

ধরো ফরাসি মেয়েটিকেও চেনো। ওর সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে।

মরুনি হেসে বলে, সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হবে।

ধরো আমার চেয়ে বেশি চেনো ওকে। ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব আছে তোমার!

তা হলে ওকে। মরুনি উত্তর দেয়।

ধরো কাউকেই চেনো না। কাউকেই কখনও দেখোনি আগে।

তবে যার বয়স কম, তাকে।

বয়স সমান।

মরুনি উত্তর না দিয়ে হেসে ওঠে। নীলা লক্ষ করে মরুনি বলছে না, ভারতীয় মেয়েটিকে বাঁচাবে সে।

ভুট্টাখেত থেকে লু হাওয়া এসে ওড়াতে থাকে মরুনির একমাথা ঘন কালো চুল। সেদিকে তাকিয়ে লতাগুল্মের ওপর নিজের শরীরটি বিছিয়ে দিয়ে, আকাশের দিকে মুখ করে নীলা গাইতে শুরু করে, ধীরে ধীরে ধীরে বও ওগো উতল হাওয়া।

মরুনি তন্ময় হয়ে শোনে গানটি।

নীলা জিজ্ঞেস করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম মরুনি শুনেছে কি না। শোনেনি সে।

সে কে?

মরুনি বাঙালি মেয়ে, পশ্চিমি সব শিল্পীসাহিত্যের খবর তার নখদর্পণে, অথচ রবীন্দ্রনাথের নাম শোনেনি। ত্বরিতে উঠে নীলা বলে, চলো তোমাকে একটি জায়গায় নিয়ে যাব।

উভের ছেড়ে প্যারিসে এসে এভেনিউ দেতালির দিকে যেতে বলে মরুনিকে। ওখানে একটি ছোট্ট রাস্তায় থেমে মরুনির হাত চেপে ধরে উত্তেজনায়, নীলা বলে দেখো, এ রাস্তার নাম, রু টেগোর, টেগোর—যাঁর গান আমি গাইছিলাম। রাস্তা থেকে নেমে গেলেই স্প্যানিশ শিল্পী মিরোর নামে একটি বাগান, অপর পাশের রাস্তা রুশ শিল্পী মার্ক শাগালের নামে।

মরুনি জিজ্ঞেস করে, টেগোরও কি শাগাল বা মিরোর মতো শিল্পী ছিলেন?

নীলা বলে, ওঁর নাম টেগোর নয়, শুদ্ধ উচ্চারণ হচ্ছে ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ইংরেজরা তাঁর নামের উচ্চারণ করতে পারত না বলে টেগোর বলত।

মরুনি নীলার হাতখানা ছাড়িয়ে নিয়ে মিরার বাগানে হাঁটে, পাশে হাঁটতে হাঁটতে নীলা বলে যায় রবীন্দ্রনাথ ছবি আঁকতেন বটে, তবে তাঁর ছবির চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান তাঁর গান, কবিতা, তাঁর ছোটগল্প। বাঙালির কাছে, তিনি অনেকটা ঈশ্বরের মতো। আজও বাঙালির ঘরে ঘরে রবীন্দ্রসংগীত বাজে, কত নতুন নতুন সংগীতের উদ্ভব হয়, ঝরেও যায় কদিন পর, কেবল রবীন্দ্রসংগীত থেকে যায়। কোনও গীতিকার বা সুরকারের সাধ্য নেই রবীন্দ্রনাথের মতো শিল্পীকে ডিঙিয়ে যাওয়া। তাঁর সংগীত হাজার বছরেও এতটুকু মলিন হবে না।

মরুনি বলে, তুমি কি মিরোর কাজ দেখেছ?

বারসেলোনায় মিরোর শিল্পকর্ম দেখে মরুনি কীরকম মুগ্ধ হয়েছিল, সে কথা পাড়ে। বারসেলোনায় যদি কখনও যায় নীলা, তবে মিরোর কাজ যেন অবশ্যই দেখে আর কিছুতেই যেন গাউদির স্থাপত্য, বিশেষ করে গির্জাটি দেখতে ভুলে না যায়, বলে।

আমি তোমাকে রবীন্দ্রনাথের একটি বই দেব ফরাসি ভাষায়, পড়ে দেখো। আরও পড়তে চাইবে। নীলা বলে।

মরুনি গাড়ির দিকে যেতে যেতে বলে, সে নিৎসের ওপর একটি বক্তৃতা লিখছে, লেখাটি নিয়ে ইদানীং ভীষণ ব্যস্ত সে। রবীন্দ্রনাথের কিছু পড়ার এখন সময় নেই মোটে। সময় হলে সে নীলাকে জানাবে।

নীলার বুকের মধ্যটা হঠাৎ হু হু করে ওঠে, অকারণে।

জ তেম জ তেম জে তেম

নীলা ব্যাঙ্কে খোঁজ নিয়েছে, টাকা এখনও আসেনি।

নিজে সে কলকাতার ব্যাঙ্কে ফোন করে টাকার খোঁজ নিয়েছে। ওরা সাফ বলে দিয়েছে। টাকা পাঠানো হয়ে গেছে।

একটা অসহ্য অস্থিরতার মধ্যে নীলা দিন কাটাচ্ছে।

শ্রুতিযন্ত্র থেকে বেনোয়ার প্রতিদিনকার আকুল কণ্ঠ মুছে ফেলছে।

সুনীলকে বেশ কবার তাড়া দিয়েছে, ভাড়া নেওয়ার জন্য একটা বাড়ি খুঁজতে।

সুনীল খুঁজি খুঁজি করেও খুঁজছে না।

কিন্তু যে সকালে সুনীল বেরিয়ে যাবার আগে নীলা আবার আবদার করল বাড়ি খোঁজার, চৈতালি পাশেই ছিল, বলল সুনীলের এত সময় কী করে হবে!

সুনীল হবে বলল। সামনের সপ্তাহেই হবে।

চৈতালি বলল, ভাড়া নেওয়া কি মুখের কথা। জিম্মাদার হবে কে!

নীলার আবদার, সেও সুনীলকে হতে হবে।

চৈতালি ঝাঁজালো গলায় বলে, সুনীল জিম্মাদার হলে, কী হতে আবার কী হয়। ফরাসি কেউ হলে ভাল। তোমার তো ফরাসি বন্ধু আছেই।

না, আমার কেউ নেই। নীলা বলে।

এত বড় ঝুঁকি কী করে নেবে সে? আগের ঝাঁজালো সুরেই বলে চৈতালি।

ঝুঁকির প্রশ্ন আসছে কেন? বাড়িভাড়া দিতে কি আমি বাকি রাখব? টাকা পৌঁছলে সুনীলদা দেখেই না হয় দেবেন! যদি বিশ্বাস না হয়।

সুনীল চোখ টেপে নীলার দিকে। নীলাও টেপে। পাক্কা।

সেদিন দুপুর পার হয়, আর নীলা গরমে হাঁসফাঁস করে ঘরের ভেতর। কোনও পাখার বংশ নেই চালাবে। ঘরের বাইরে গনগনে আগুনের চুল্লি জ্বলছে। জানালায় তাকিয়ে কিছুক্ষণ সে বাইরের উৎসবের ঢেউ দেখে। সারাবছর রোদ না পাওয়া লোকগুলো অর্ধউন্মাদ হয়ে গেছে, রোদ যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ এর প্রতিটি কণা ওদের ভোগ করা চাই। নীলার এই সমস্যা নেই, সে জন্ম থেকে রোদে ভুগে আসছে, রোদ তাকে টানে না।

সারাদিনই ঘরে থেকে সুকুমারী ভট্টাচার্যের লেখা নিয়তিবাদ : উদ্ভব ও বিকাশ বইটি শেষ করেছে। শেষ করে চা খেতে খেতে আধশোয়া হয়ে জয় গোস্বামীর কবিতা পড়তে শুরু করে, জোরে। কবিতা সে সশব্দেই পড়ে, নিজেকে শুনিয়ে। এও অভ্যেস তার। কবিতা তার কাছে পড়ার যেমন জিনিস, শোনারও।

নীলর সামনে যখন গরম চা, জয়ের কবিতা, আর মনে অমল আনন্দ, সুনীল ঢোকে বাড়িতে। একেবারে নীলার শোবার ঘরে। দুর্গার ঘরে, কালীর ঘরে, সরস্বতীর ঘরে।

কী ব্যাপার! এই অসময়ে বাড়ি ফিরলেন! নীলা বলে।

বিছানায় গা এলিয়ে একটি বালিশ টেনে নিয়ে বুকে, সুনীল বলে, আর বোলো না, কিছু ভাল লাগছিল না। কাজ কাজ আর কাজ।

নীলার হাত থেকে কবিতার বইটি নিয়ে চোখের সামনে মেলে সুনীল বলে, তুমি কবিতা পড়ছ! কতদিন আমার কবিতা পড়া হয় না! সেই দিনগুলি কোথায় যে গেল! সেই আমার সোনা রঙের দিনগুলি…

দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না। গানটি গুন গুন করে গাইতে থাকে নীলা।

সুনীল উঠে বসে, বাহ। বাহ, তুমি যে এত ভাল গান করো, তা তো জানতাম না!

নীলা ভুরু নাচায়, মোটেও না, এককালে ভাল গাইতাম। এখন না গাইতে গাইতে গলা আর নেই।

সুনীল আবার হেলে পড়ে, কবিতার বইটি নীলার দিকে ঠেলে দিয়ে বলে, একটা কবিতা শোনাও তো। জয় গোস্বামী চমৎকার কবিতা লেখে শুনেছি।

নীলা বইয়ের পাতা ওলটায় পড়ার মতো কবিতা পেতে, ডান হাতে। বাম হাতটি রাখা ছিল কোলে, সেটি তুলে নেয় সুনীল। হাতের রেখায় তাকিয়ে বলে, দেখি তো তোমার কটা বিয়ের কথা লেখা আছে।

বিয়ে? আরও? একটি করেই যন্ত্রণা পোহাচ্ছি কত। সুরে বলে নীলা।

আলগোছে হাতটি সুনীলের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে, কবিতায় মন দেয়।

নিঃশ্বাস নিতে দেব না,
তোমাকে নিঃশ্বাস নিতে দেব না।
একবার যদি পাই, পুনরায়
আরবার যদি পাই,
পাঁজরে পাঁজর গুঁড়ো করে দেব–ছাই!

গুড়গুড় করে মনে করে মুচিরাম
জয় রাম বলে জয়রাম বলে
নিইনি কখনও তার নাম মুখে
ভবিষ্যতেও নেব না–
কিন্তু লিখব একবার যদি হাতে পাই একা ছাতে পাই
কিছুতেই ছেড়ে দেব না।

সুনীল মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে নীলার দিকে। সুনীল আধশোয়া, নীলাও।

একা একা চা খাচ্ছ! আমার জন্য এক কাপ হবে কি! সুনীল ঠোঁট ফুলিয়ে বলল।

যেন এ বাড়ির অতিথি নীলা নয়, যেন সুনীল। নীলা চা করে আনল, সুনীলের জন্য তো বটেই, নিজের জন্যও আরেক কাপ। এবার আর বিছানায় নয়, চেয়ারে বসে, সুনীলের নাগালের বাইরে, বসে, বলল, বাড়ি কবে ঠিক হবে বলুন!

এত তাড়া কীসের?

তাড়া নেই! তবে এভাবে অন্যের বাড়ি আর কদিন থাকা যায়!

কেন, তোমার কি অসুবিধে হচ্ছে?

আমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। ঘর দখল করে রেখে আমিই বরং আপনাদের অসুবিধে করছি।

আমাদের এত পর ভাবো কেন শুনি?

নীলা জানে, সুনীল ছাড়া এ শহরে আপন তার কেউ নেই। ওকে পর ভাবলে এ বাড়িতে সে নিজের বাড়ির মতো করে থাকতে পারত না।

কোনও একটা চাকরি পেয়ে গেলে স্বস্তি পেতাম। নীলা বলে।

হয়ে যাবে, হয়ে যাবে। নারায়ণকে বলেছি, ও ব্যাটা বেশ কাজের লোক। চাকরি খুঁজছে। তবে ভাষাটা ভাল জানলে ভাল চাকরি পেতে।

আমার ভালর দরকার নেই। যেমন তেমন হলেই হয়।

নীলা হঠাৎ গরম চায়ে চুমুক দিয়ে উহু মাগো বলে কুঞ্চিত করে ঠোঁট, গাল, কপাল চোখ। ছলকে পড়ে চা, কোলের ওপর জয়ের বই, আর বইয়ের ওপর কাপ, আঙুল সরিয়ে নিয়ে কাপের হাতল থেকে তাকায় সুনীলের চোখে। সুনীলের চোখ হাসছে।

কী জিভ পুড়ল তো!

সুনীলের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নীলা মেঝেয় রাখে চোখ, দাবার ছকের মতো মেঝে, সাদা কালো, কালো সাদা। এ পারে হাতি ঘোড়া রাজা মন্ত্রী কিছু নেই, কেবল এক নিরস্ত্র সৈন্য, ওপার থেকে ঘোড়া এল আড়াই ঘর হেঁটে, দেখি পুড়েছে কতটা, জিভ বের করো তো…

সুনীলের লম্বা লাল জিভ নীলার পুড়ে যাওয়া জিভের দিকে যেই এগোয়, নীলা জিভ ঢুকিয়ে নেয় ভেতরে। চেয়ার পেছনে হেলিয়ে সুনীলের জিভের নাগাল থেকে নিজেকে বাঁচায়।

কী হচ্ছে কী! সুনীলকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নীলা উঠে দাঁড়ায়।

দাঁড়িয়ে ওঠা নীলাকে বিছানায় এক ঝটকায় টেনে আনে সুনীল। নীলার হাত থেকে ছিটকে পড়ে চায়ের কাপ, জয়ের বই। নীলার শরীর চেপে রাখে নিজের শক্ত শরীরে, এক হাতে তল থেকে নীলার পাজামার ফিতে খুলে নীচে নামিয়ে, নিজের প্যান্টও হাঁটু অব্দি নামিয়ে নীলার ভেতর ঠেসে ধরে নিজেকে। বাকহীন শক্তিহীন পড়ে থেকে কুৎসিত এই দৃশ্য দেখে নীলা। সারা বাড়িতে আর কোনও শব্দ নেই, কেবল সুনীলের গোঙানো, ও নীলা ও নীলা।

সুনীল কয়েক মুহূর্ত পর নেতিয়ে পড়ে নীলার শরীরের ওপর।

নীলা সুনীলকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য স্পর্শ মাত্র করে না। এক দৃষ্টে সাদা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে।

সুনীল নিজেকে দ্রুত গুছিয়ে দেখে চোখ থেকে জল গড়িয়ে বালিশ ভিজছে নীলার।

কী ব্যাপার কাঁদছ তুমি?

সুনীল আঙুলে চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে, কাঁদছ কেন?

ওই সাদা দেয়ালে তাকিয়ে থেকেই সে ভাঙা গলায় বলে, আমি কাঁদছি না। আমি কাঁদি না। আমার মা আমাকে একা রেখে চলে গেছেন, আমি কাঁদিনি। কোনও কষ্টই আমার কাছে কষ্ট মনে হয় না। জীবন এরকমই সম্ভবত…এরকমই কুৎসিত। আমার কেবল মনে হল, আমার দাদা নিখিল এইমাত্র আমাকে ধর্ষণ করল।

আমি তোমার দাদার বন্ধু, আপন দাদা তো নই।

আমরা তো দাদার বন্ধুদের দাদাই ভাবতে শিখি সেই ছোটবেলা থেকে।

সেই দাদার বন্ধুদের সঙ্গে তো আবার বিয়েও হয়, হয় না?

হয়, কিন্তু আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়নি। কিষানের সঙ্গে মেলে না বলে ওকে ছেড়ে এসেছি, ওকে কখনও আমার আপন বলে মনে হয়নি, এ শহরে আপনিই ছিলেন আমার আপন। এসব অসম্মান সওয়ার চেয়ে আমার সম্ভবত ওর বাড়ি ফিরে যাওয়াই ভাল। শরীর ভোগ করবে করুক, যত হোক স্বামী সে, দাদা তো নয়।

সুনীল ভারী গলায় বলে, আমি তো জানতাম তোমার সায় ছিল। জয়ের ওই কবিতা পড়তে পড়তে তুমি আমার দিকে কেমন চোখে তাকাচ্ছিলে, তাকাচ্ছিলে না? বলো!

সুনীল বেরিয়ে যেতেই নীলা স্নানঘরে গেল। অনেকক্ষণ ধরে স্নান করল, আস্ত সাবান ফুরোল ঘষে, শরীর তো নয়, যেন শেয়াল শকুনের ভাগাড় এটি। নীলা থুতু ছুড়ে দেয় নিজের শরীরে। সাবান ঘসে ঘসে লোভ, ঘেন্না, কফ, থুতু বীর্য, রক্ত যা আছে শরীরের অলিগলিতে, সরায়। নিজেকে বারবার সে বলে, না কোনও ঘটনা ঘটেনি, সে এমনিতে সাবান ফুরোচ্ছে, এ তার নিজের কুৎসিত মনের কল্পনা। সুনীল অসময়ে বাড়ি ফেরেনি, তার বিছানায় শোয়নি, তাকে স্পর্শ করেনি, যদি কেউ করেও থাকে, সে অন্য লোক, অথবা নীলা ঘুমিয়েছিল দুপুরে, এ তার নিতান্তই স্বপ্নের মধ্যে ঘটেছে। স্বপ্নদোষ। অথবা প্রতিবেশী কোনও লোক, কোনও দুষ্ট কালোলোক বাড়ি লুঠ করতে এসে নীলাকে একা পেয়ে ধর্ষণ করেছে, অথবা ধর্ষণ করেনি, নীলাই চেয়েছে ধর্ষিতা হতে। সুনীল সন্ধেয় ফিরবে, প্রতিদিনকার মতো। প্রতিদিনকার মতো সন্ধের পর সুনীল চৈতালি আর নীলাকে নিয়ে গল্পের আসর বসাবে, মাছ ভাত খাবে, আর নীলার মনে হতে থাকবে, কেবল এ শহরে নয়, এ জগতে সুনীলই তার সবচেয়ে কাছের আত্মীয়।

স্নানঘর থেকে বেরিয়ে নীলা ফোন করে বেনোয়াকে।

বেনোয়ার ব্যাকুল কণ্ঠস্বর শোনে, এক্ষুনি সে নীলার সঙ্গে দেখা করতে চায়। কোথায় দেখা হবে? কোথায় দেখা করলে তোমার জন্য সুবিধে?

সুবিধে? শব্দটির নীলা অর্থ জানে না।

সাড়ে পাঁচটায় মোপারনাসের সিলেক্টে বেনোয়ার সঙ্গে দেখা হয় নীলার। বেনোয়া চা বলে নীলার জন্য, নিজের জন্য কফি। তেরাসে রাস্তার দিকে মুখ করে পাশাপাশি বসে দুজন।

নীলার কালো একটি টিশার্ট গায়ে, আর সাদা প্যান্ট। চুল বাঁধেনি, মুখে রং লাগায়নি, ঠোঁট গাঢ় বাদামি। এ রং ঢাকতে নাকে পাউডার লাগানোর ছুতোয় সে আজ যাচ্ছে না কোথাও। উদাস চোখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থেকে মাঝে মাঝে চায়ে চুমুক দেয়।

কী করেছ আজ সারাদিন?

শুয়ে শুয়ে বই পড়েছি।

বাইরে বেরোওনি?

না।

ফোন ধরোনি, সারাদিন ফোন করলাম।

তার খুলে রেখেছিলাম।

আমার সঙ্গে যেন কথা বলতে না হয়! তাই না! তো কী মনে করে মনে করলে আমাকে?

জানি না।

নীলা, আমার দিকে তাকাও।

তাকায় সে বেনোয়ার গভীর নীল চোখদুটোয়।

এ চোখে কিছু দেখো না?

না।

তুমি কি অন্ধ?

না।

নীলার হাত বেনোয়া তার উষ্ণ হাতে নিয়ে হাতের পিঠে চুমু খায়।

একটি কথা রাখবে?

কী কথা?

রাস্তায় কী দেখছ? আমাকে দেখো।

নীলা আবার তাকায় বেনোয়ার চোখে।

তোমার মন খারাপ?

না।

কী হয়েছে বলো!

কিছু হয়নি।

সেদিন ওই অত রাতে তুমি ওভাবে চলে গেলে, সারারাত আমি ঘুমোত পারিনি।

নীলা নির্বিকার। বেনোয়ার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে আবার তার চোখ রাস্তায়, রাস্তার ওপারে লা কুপলে লোকের ভিড়। প্রতিটি ক্যাফে রেস্তোরাঁ ভিড়ে উপচে পড়ছে। চা কফি না ফুরোতেই ক্যাফের লোক কাপ উঠিয়ে নিয়ে যায়।

নীলার হাত ধরে বেনোয়া হাঁটতে থাকে ফুটপাত ধরে। নীলার ভাল লাগে বিকেলের এই ফুরফুরে হাওয়ায় এভাবে হাঁটতে। এভাবে পাশাপাশি। নীলার ইচ্ছে করে বেনোয়া এভাবেই তার হাত ধরে থাকুক, না ছাড়ুক। রু দ্য রেনে শাঁ প্লাসিদের মোড়ে পাঁচতলা বাড়ির চারতলায় বেনোয়ার এপার্তোমো। ঘরে ঢুকে নীলাকে বসিয়ে, না চুমু না কিছু, বেনোয়া রান্নাঘরে ঢোকে। নীলা নিশ্চিত গেলাসে লাল ওয়াইন নিয়ে ঢুকবে বেনোয়া, উলঙ্গ করে সে ওয়াইন ঢালবে তার শরীরে, পান করবে। সে যেমনই হোক, সুনীল দ্বারা ধর্ষিতা হওয়ার চেয়ে এ ঢের ভাল। ইচ্ছের বাইরে বেনোয়া নীলার সঙ্গে কোনও যৌনসম্পর্কে যায়নি।

নীলাকে চমকে দিয়ে বেনোয়া দু কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢোকে।

চা তো তোমার ঘরে নেই জানতাম।

আর্ল গ্রে কিনে রেখেছি, তোমার জন্য। এতে চলবে? শান্ত সুন্দর স্বর বেনোয়ার।

নীলা হাসে, চলবে।

বেনোয়া উঠে আসে নীলার পায়ের কাছে। নীলার কোলের ওপর মাথা রাখে।

কোলের মাথাটিকে সে ঠিক বুঝে পায় না কী করবে।

কিছুই করে না সে। চা পান করতে থাকে। গরম চায়ে চুমুক দিয়ে আবার জিভ পোড়ায় সে। হঠাৎ অসচেতনে উহ মাগো শব্দ বেরিয়ে আসে, বুক কেঁপে ওঠে তার, এই বুঝি বেনোয়া এখন পোড়া জিভ দেখার ছলে লম্বা লাল জিভ নিয়ে এগোবে।

বেনোয়া মাথা তোলে, কী হয়েছে?

কিছু না।

জিভ পুড়েছে কি না জিজ্ঞেস করে না। নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে নীলার চা খাওয়ার দিকে, বলে, জ তেম।

চায়ের কাপটি কেঁপে ওঠে, ওটিকে দুহাতে ধরে, জিজ্ঞেস করে, কী বললে?

জ তেম। তোমাকে ভালবাসি।

অদ্ভুত শান্ত স্বর বেনোয়ার। আগের সেই অস্থিরতা নেই বেনোয়ার মধ্যে। নীলাকে হাতের কাছে পেয়ে শরীরী আনন্দে মেতে ওঠার সেই মাতলামো নেই। এ কদিনে সে অনেক বেশি পরিণত, অনেক ধীর স্থির। কাঁপা চায়ের কাপটি টেবিলে রাখতে নীলা ওঠে, আসলে চমক সামলাতেই ওঠে সে। উঠে জানালার কাছে যায়, রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রাস্তার মানুষ দেখে কিছুক্ষণ, আবার ফিরে আসে। বেনোয়া থেকে দূরে বসে। চায়ের কাপটি আবার হাতে নেয়, যেন সে যেমন চা খাচ্ছিল, তেমনই খাচ্ছে, মাঝখানে জ তেম বলে কোনও শব্দ সে শোনেনি।

নীলার ভয় হতে থাকে, সুনীল যা করে গেছে তার শরীরে আজ, জেনে, বেনোয়া এই জ তেম আর বলবে না। চোখ বুজে দাঁতে দাঁত চেপে মুঠো শক্ত করে অন্তস্থ করে সে তার একাকিত্ব, অসহায়ত্ব, তার গোপন সব যন্ত্রণা। বেনোয়ার ভালবাসা তার সবচেয়ে বড় অহংকার। বেনোয়াকে সে নিজের কোনও গ্লানির গল্প শোনাবে না। নীলা সব হারিয়েছে, হারাতে হারাতে হারিয়েছে হারাবার সব বেদনাকে। বেনোয়াকে সে হারাতে চায় না। এক বেনোয়ার ভালবাসাই যদি তাকে বাকি জীবন বাঁচিয়ে রাখে। নীলা প্রাণপণ বাঁচতে চায়। এই নিষ্ঠুর কুৎসিত পৃথিবীতে নীলা সুন্দরের হাত ধরে হেঁটে যাবে তার এতকাল লালন করা স্বপ্নের দিকে।

পা পা করে এগিয়ে এসে সে বেনোয়ার পেছনে হাঁটু গেড়ে বসে। একটি হাত রাখে বেনোয়ার কাঁধে, সেই হাতটির ওপর বেনোয়া আলতো করে নিজের একটি হাত রাখে।

দুটো হাতের স্পর্শ শুধু, বেনোয়ার ওই আলতো করে রাখা হাতটি থেকে সুখ নেমে আসে নীলার হাতে, হাত থেকে ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত শরীরে।

সত্যি ভালবাসো?

বেনোয়া ঘুরে তাকায়। স্বপ্নালু দুটো চোখ তার। গভীর নীল।

নীলাকে নিজের কোলের ওপর বসিয়ে জড়িয়ে ধরে গভীর করে চুমু খেয়ে বলে, জ তেম, জ তেম।

এখন সে বেশ জানে ফরাসিরা ভালবাসি শব্দটি সহজে বলে না। ভালবাসলেই কেবল উচ্চারণ করে শব্দটি। দূরের এক ছাদে দাঁড়ানো কোনও মেয়েকে দেখেই এক পলকে যেমন বাঙালি ছেলেরা ভালবেসে ফেলে, ভালবেসে রাত জেগে একশো পদ্য লিখে ফেলে, চেনা নেই জানা নেই, বোঝা নেই, ভালবেসে জীবন দিয়ে দেয়, এরকম এখানে নয়। এদের ভালবাসা সত্যিকার ভালবাসা। আর এ সত্যিকার ভালবাসা নীলার জন্ম সার্থক করে। অর্থহীন জীবনকে অর্থময় করে।

বেনোয়ার কোল থেকে উঠে গিয়ে বিছানায় শোয় নীলা। ভালবাসা তাকে পালকের মতো নরম করে তুলছে, জানালা দিয়ে তার উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে, শহরের প্রতিটি লোককে তার বলতে ইচ্ছে করছে, সে আর একা নয়, তাকে আর লোকে ভোগ করার জন্য ভোগ করছে না, কেউ তাকে ভালবাসে, কেউ তার প্রেমে সত্যিকার পড়েছে। বেনোয়া নীলার পাশে শুয়ে বলে, তুমি ফরাসি ভাষা শিখতে চাইছিলে না? জানো এ ভাষা কী করে শিখতে হয়?

কী করে?

শিখতে হয় প্রেমিকের কাছ থেকে, বালিশ থেকে বালিশে, শুয়ে।

নীলাকে বুকে জড়িয়ে নীলার চুলের সুগন্ধ নিতে নিতে বেনোয়া বলে, তুমি কি আমাকে ভালবাসো?

বাসি। নীলা বলে।

তবে বলো, জ তেম।

জ তেম।

এল, এমব্রোসো মো।

এমব্রোসো মো।

বলো, লা ভি এ বেল।

লা ভি এ বেল।

সা সে লা ভি।

সা সে লা ভি।

বেনোয়া চুমু খায় নীলাকে আবার।

বেনোয়া শান্তিপুরি চপ্পল খুলে নীলার পায়ে চুমু খায়, পায়ের প্রতিটি আঙুলে, সুশান্তর কথা ভাবে নীলা, সুশান্তও তো তাকে ভালবাসে বলে বলত, কিন্তু কখনও তো এভাবে বেনোয়ার মতো আদর করেনি। বেনোয়ার ভেতরে এক শিল্পী বাস করে, বেনোয়াই পুরো জগতের আর সব পুরুষ থেকে আলাদা না কি সব ফরাসি পুরুষই এমন চমৎকার করে ভালবাসে তাদের প্রেমিকাদের। নীলা বোঝে না, না বোঝা চোখে থই থই করে প্রেম।

আমি তোমার বয়সে বড় জানো তো। আমাদের দেশে বয়সে বড়দের দিদি বলে ডাকে। বোনকে যেমন দিদি বলে। নীলা বলে।

তুমি যদি চাও তোমাকেও দিদি বলব।

ও কাজটি কোরো না। তা হলে তোমাকে আমি চুমুই খেতে পারব না।

বেনোয়া আবার চুমু খায় নীলার ঠোঁটে জিভে। চুমু খেয়ে মুখটি উঠিয়ে বলে, দিদি।

আবার চুমু খেয়ে আবার দিদি বলে।

বয়সে বড় তুমি? তাতে কী হয়েছে?

আমাদের সমাজে প্রেম করো বা বিয়ে করো, ছেলেদের হতে হবে বড়, মেয়েদের বয়সে ছোট।

এ তো তোমাদের সমাজ নয়। এ আমাদের। ভাল যে এ আমাদের, নয়তো তোমাকে আমার পাওয়া হত না। বেনোয়া হেসে বলে।

এই যে কচি কচি ফুটফুটে মেয়েগুলো সারা শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তোমার ইচ্ছে করে না কাউকে জ তেম বলতে?

ঠোঁট ওলটায় সে, না।

তুমি তো বলেছ, বাদামি রং নাকি পছন্দ, রোদে পুড়ে ওরাও তো এই রং পাচ্ছে, তবে?

বেনোয়া অনেকক্ষণ হেসে বলল, ও রং তো ওদের কদিন পর চলে যাবে, কৃত্রিম রং। ছো!

বেনোয়া আবার চুমু খায়, নীলাকে জড়িয়ে।

তুমি বয়সে বড় তো। এ ভাল, তোমার কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।

আমার চেয়ে তুমি অনেক বেশি জানো।

কী জানি তোমার থেকে বেশি?

নীলা বেনোয়ার নাক নাড়ে দু আঙুলে, তুমি জানো তুমি কী জানো।

না জানি না, বলো।

বলব না।

বলবে না?

না।

কেন?

ইচ্ছে।

আমারও একটি ইচ্ছে আছে।

কী, শুনি।

এ শোনার জিনিস নয়।

তবে কীসের জিনিস।

অনুভবের।

নীলা চোখ বোজে।

চোখ বুজে সে অপেক্ষা করে বেনোয়ার স্পর্শের, বেনোয়ার বেনো জলের, প্রলংকরী ঝড়ের।

অনেকক্ষণ কোনও স্পর্শ নেই। চোখ খুলে নীলা দেখে বেনোয়া তার পাশেও নেই, হাসছে মেঝেয় শুয়ে, নীলার নাগাল থেকে দূরে।

কিছু অনুভব করেছ?

দুষ্টুমি হচ্ছে, না? নীলা বিছানা থেকে নেমে বেনোয়ার পাশে বুকের ওপর মাথা রেখে শোয়।

বেনোয়া এক হাতে নীলাকে জড়িয়ে রাখে। সাদা বুকে বাদামি আঙুল বুলোতে বুলোতে চুমু খায়, বুক থেকে নীলার ঠোঁট বেনোয়ার গলায়, চিবুকে, ঠোঁটে।

দু বাহুতে নীলাকে শক্ত করে বেঁধে বেনোয়া বলে, জ তেম, জ তেম, জ তেম।

এখানেই জগৎ থেমে যাক। শ্বাস বন্ধ করে রাখে সে। তৃষ্ণার জন্য এক ফোঁটা তার প্রয়োজন ছিল, বেনোয়া উজাড় করে গোটা সমুদ্র তাকে ঢেলে দিচ্ছে, এত তার প্রাপ্য ছিল না, নীলা তাড়া খাওয়া, আত্মীয়হীন বন্ধুহীন, আশ্রয়হীন একটি অসহায় প্রাণী, মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়া, কুঁকড়ে যাওয়া, কুঁচকে যাওয়া, তলিয়ে যাওয়া।

আবেগে সে চোখ বোজে। সেই বোজা চোখের ওপর বেনোয়ার ঠোঁটের স্পর্শ। বেনোয়ার ভালবাসা নীলা সমস্ত শরীরে অনুভব করে। সমস্ত হৃদয়ে। যত গভীরে যায় বেনোয়া, যত অতলে, নীলা টের পায়, এ নিছক সঙ্গম নয়, শরীর শরীর খেলা নয়, এ গভীর গহন ভালবাসা। এ শরীরকে শুদ্ধ করে, স্নিগ্ধ করে, শীতল করে। এ হৃদয়কে প্রফুল্ল করে, প্রশস্ত করে, প্রোজ্জ্বল করে।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে দুজন রাতে, ঘড়িতে রাত, অথচ আকাশ জুড়ে আলো। এ প্রকৃতির ক্ষতিপূরণ, শীতকালে আলো কেড়ে নেয় বলে গ্রীষ্মে এসে তার পূরণ করে দেয়। শাঁজ এলিজের ঘাসের ওপর ঘন হয়ে বসে থাকে, হৃদয়ে আনন্দধারা বইতে থাকে নীলার। একটি সাদা ঘাসফুল তুলে, ঘাসফুলের নাম মার্গারিত, পাপড়িগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে বেনোয়া বলতে থাকে, জ তেম, ওঁ প, বকু, প্যাশনোমো, আলা ফলি, পা দু তু। তোমাকে ভালবাসি, অল্প, বেশি, অত্যধিক, পাগলের মতো, একটুও না। শেষ পাপড়িটি যেটিতে এসে থামবে, সেটিই ধরে নিতে হবে মনের কথা। এই পাপড়ি ছেঁড়া খেলায় বেনোয়ার শেষ পাপড়িতে হয় আলা ফলি, নীলার হয় পা দু তু। বেনোয়া বলে, দেখলে তো আমি তোমাকে পাগলের মতো ভালবাসি, তুমি আমাকে একটুও না।

তাই মনে হয় তোমার? নীলা হেসে বলে।

নীলাকে চুমু খায় প্রথম, পরে বলে, না। আমি জানি তুমি আমাকে খুব ভালবাসো।

আর তুমি কি সত্যিই আলা ফলি?

আমি সত্যিই আলা ফলি।

ক্যাফেতে বসে রাতের খাবার খেতে খেতে মানুষের ঢল দেখে নীলা, আলোয় ভাসছে মানুষ, উচ্ছল উজ্জ্বল প্রাণবন্ত মানুষ। শাঁজ এলিজে সারারাত জেগে থাকে, হাজার মানুষের ভিড় সারারাত। ক্যাফের ভেতর সেজেগুজে ষাট সত্তর বছর বয়সের মহিলারা বসে আছে। দেখে নীলা বলে, বুড়োবুড়ি কারওরই ঘুম নেই!

ওই ধনী বুড়িগুলো বসে আছে জিগোলো পেতে। বেনোয়া নীলার কানে কানে বলে।

জিগোলো পেতে মানে? গলা চেপে নীলা।

যুবকেরা আসবে, যে যাকে পছন্দ করবে, তার সঙ্গে সেঁটে যাবে এরা।

বলছ কী?

দেখোই না।

নীলা ঘন ঘন পেছন ফেরে।

ঘটনা সত্যিই ঘটে। বয়সে বড় মহিলারা বয়সে ছোটর হাত ধরে মহা সুখে বেরিয়ে যায়, যেন মা বেরোচ্ছে ছেলের হাত ধরে।

এখন কী হবে?

মহিলা তার বাড়িতে নেবে ছেলেটিকে। তারপর আনন্দ করবে। ছেলেটিকে উপহার টুপহার কিনে দেবে, খাওয়াবে। একসঙ্গে নাচবে। শোবে। ছেলেটি টাকা পয়সা চাইলে টাকা পয়সা দেবে।

নীলা জিভে কামড় দেয়। ও মা কী কাণ্ড।

শাঁজ এলিজের এক মাথা থেকে আরেক মাথা অব্দি, অর্ক দ্য ট্রয়ম্ফ থেকে কনকর্ডের ঘুরন্ত চাকা অব্দি যায়, আবার ঘুরে আসে, পরস্পরের কোমর জড়িয়ে, যেন স্বর্গের উদ্যানে হাঁটছে, দুজন হাঁটে। কখনও আবার আইসক্রিম খেতে বা কফি চা, কোনও ক্যাফের তেরাসে বসে, আবার হাঁটে। টুকরো টুকরো হালকা কথা তুলোর মতো হাওয়ায় ওড়াতে থাকে দুজন, কার কোন রং পছন্দ, নীলার নীল, বেনোয়ার হালকা সবুজ, কার কী খেতে পছন্দ, রুইমাছ ভাত, ক্যানার আর আলু, কোন শহর কার সবচেয়ে পছন্দ, নীলার প্যারিস, বেনোয়ার রোম, রোম কি গেছে কখনও সে, যায়নি। বৃষ্টি ভাল লাগে? নীলার লাগে, বেনোয়ার লাগে না। আকাশ? মেঘলা আকাশ, নীলাকাশ। ছোটবেলার দুঃখের স্মৃতি? ইস্কুলের পরীক্ষায় খারাপ করার পর অনির্বাণ পিটিয়ে তাকে আধমরা করেছিলেন। মাদাম দুপঁ বলেছিলেন চকোলেট এত খেয়ো না, খেলে দাঁত নষ্ট হয়ে যায়। সুখের স্মৃতি? পরীক্ষায় ভাল করলে সে একটি লাল ফ্রক উপহার পেয়েছিল। বেনোয়ার সুখের স্মৃতি যখন সে বারো বছর বয়সে বন্ধুদের সঙ্গে অস্ট্রিয়ার স্কি করতে গিয়েছিল।

ফুটপাত ধরে হাতে হাত ধরে হাঁটছে সব বয়সের ছেলেমেয়ে, কেবল ছেলে মেয়েও নয়, মেয়ে মেয়ে, ছেলে ছেলেও। চুমু খাচ্ছে, ঝরনায় স্নান করছে। গান গাইছে। প্রাণ খুলে হাসছে। কারও ইচ্ছে হল ঢুকে যাচ্ছে সিনেমায়। হাতে হাতে বিয়ারের কৌটো। বেনোয়া যখন ঢোকে ভারজিন নামের এক দোকানে, রাত তখন তিনটে। কড়া আলোয় ভেসে যায় নীলা, ভারজিনে চড়া স্বরে গান বাজছে, বেনোয়া জ্যাক ব্রেলের একটি সি ডি কিনে নীলাকে দিয়ে বলে, এই সিডির একটি গান শুনবে, ভাববে যে আমি গাইছি এটি।

কোনটা?

ন মে কিত পা।

ন মে কিত পা, আমাকে ছেড়ো না। বেনোয়াকে নীলা ছাড়বে কেন! বাঁচতে গেলে যে হাওয়া দরকার হয় শ্বাস নেবার, নীলার জন্য বেনোয়া সে হাওয়া। বেনোয়া ছাড়া, নীলা কল্পনা করে, তার জীবন ধুলোর মতো, ধুলোয় পড়ে থাকা এক টুকরো দুর্গন্ধ মল।

নীলা যখন ক্লান্ত, যখন ঘুমে চোখ ঢুলে আসছে, বেনোয়া জিজ্ঞেস করে, বাড়ি যাবে তো!

যাব। মনে মনে বলে, বাড়ি গিয়ে তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোব। নির্ভয়ে, নিশ্চিন্তে ঘুমোব।

নীলা ভেবেছিল, প্রাস দ্য লা কনকর্ড থেকে সেইন পার হয়ে বুলোভার্ড শাঁ জার্মা ধরে রু দ্য রেনে যাচ্ছে বেনোয়া। কিন্তু অনেকটা দূর চলে এলেও নীলা দেখে সেইন পড়ছে না সামনে, কনকর্ড থেকে সোজা সে রু দ্য রিভলির রাস্তায়। ডানে জারদা দ্য কুয়েরি, ডানে ল্যুভর।

নীলা জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাচ্ছ?

তোমাকে পৌঁছে দিতে।

ও।

ওরা তোমাকে খুব ভালবাসে, তাই না?

নীলার বলতে ইচ্ছে করে, ওরা আমাকে একটুও ভালবাসে না। বলতে ইচ্ছে করে আমাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে যাও, চরম লাঞ্ছনা থেকে রক্ষা করো আমাকে, আমাকে বাঁচাও। নীলা বলতে চায়, কিন্তু কে যেন তার কণ্ঠনালী শক্ত করে চেপে রাখে, কণ্ঠে কোনও স্বর ওঠে না।

নিশ্চয়ই খুব ভালবাসে, না হলে এতদিন ধরে কি ওরা রাখছে নীলাকে। এ যুক্তির কথা বটে।

ওদের ঘুম নষ্ট হবে না তুমি ঢুকলে?

না, আমার কাছে চাবি আছে। নীলা বলে।

তাহলে পা টিপে টিপে ঢুকে যেয়ো আমার বেড়ালসোনা।

নীলাকে নামিয়ে চুমু খেয়ে, বেশ কবার জ তেম বলে, মনে করিয়ে দিয়ে কবে কোথায় আবার দেখা হচ্ছে, বেনোয়া চলে যায়।

বড় দরজায় তিন শূন্য এ পাঁচ নয় দুই টিপলে বন্ধ দরজা খুলে যায় ভেতর থেকে, দোতলা অব্দি উঠে আর উঠতে ইচ্ছে করে না নীলার। ইচ্ছে করে না ও বিছানায় গিয়ে আবার শুতে। দোতলার সিঁড়ির কাছে শুয়ে পড়ে সে, শুয়ে শুয়ে বাকি রাত পার করে ভেবে, বেনোয়া কেন তাকে বলেনি চলো আমার বাড়ি চলো। এমন তো নয় যে বেনোয়ার বউ, পাসকাল, অদৃশ্য প্রেতের মতো ঘুরে বেড়ায় ও বাড়িতে! শরীরের ও মনের ক্লান্তি নীলার আপাদমস্তক আবৃত করে রাখে। শেষ রাতে কিছু পায়ের শব্দে সে ধড়ফড়িয়ে ওঠে, এই বুঝি কেউ ধর্ষণ করতে আসছে তাকে। ভয়ে সে কুঁকড়ে যেতে থাকে। সারারাত হল্লা করে ভোরবেলা বাড়ি ফিরতে সে আগেও দেখেছে ফরাসিদের। তাকে দেখে কেউ কোনও প্রশ্ন করে না, কেন সে এখানে শুয়ে আছে, কোথায় তার বাড়ি, ইত্যাদি। এ কারণেই প্যারিসে তার এক ধরনের স্বস্তি হয়, কারও ব্যক্তিগত জীবনে কেউ নাক গলায় না। কারও ইচ্ছেতে বাধা দেওয়া কারও স্বভাব নয়। নীলার ইচ্ছে করছে এখানে শুয়ে থাকতে, যেখানে শুয়ে আছে, শুয়ে থাকার অধিকার তার একশো ভাগ আছে, যতক্ষণ না অন্যকে সে বিরক্ত করছে।

ভোরের রাস্তায় শীতল স্নিগ্ধ হাওয়ায় নীলা একা একা হাঁটে। পৃথিবীর সব দেশে, ভোরই বুঝি সবচেয়ে সুন্দর সময়। এ সময় প্রত্যেককে দেখতে বড় শিশুর মুখের মতো নির্মল দেখায়। ক্যাফেতে চা খেয়ে সকাল দশটা পার করে নীলা। প্যারিসে এ তার ভাল লাগে, সাতসকালে সব ক্যাফে খুলে যায়, ভোরবেলা আপিসে যাবার পথে লোকেরা সার সার দাঁড়িয়ে ক্যাফেতে কফি খেয়ে দিন শুরু করে। নীলার দিন শুরু করার কিছু নেই। কোনও আপিস নেই তার, কোথাও যাবার নেই, দিনের কোনও শুরু নেই, শেষ নেই। দিন আসে দিন যায়, নীলা নীলাই থেকে যায় কেবল বেনোয়াই যা তরঙ্গ তোলার তোলে তার নিস্তরঙ্গ নীরস জীবনে। তার মলিনাহীন জীবনে। বেনোয়ার সঙ্গে দেখা হলে তার দিন শুরু হয়, বিচ্ছিন্ন হলে শেষ হয় সে দিন। বাকি যে সময় পড়ে থাকে, তা কেবল অন্ধকার। বিচ্ছিরি অন্ধকার। যে অন্ধকারে শেয়াল শকুন ওত পেতে থাকে অন্যের সর্বনাশ করার আশায়। যে অন্ধকারে চুপচাপ মরে যায় মানুষ।

দশটার পর নিশ্চিত হয়ে বাড়িতে কেউ নেই, ঢুকে নীলা তার নিজের সুটকেস গুছিয়ে নেয়। টেলিফোন বই দেখে খোঁজ করে হোটেলের। যেদিকে যে হোটেলেই ফোন করে, সব কমপ্লেত, নয়তো চড়া দাম। খুঁজে পেতে রু দ্য লা কভোঁসিওঁতে কোনও এক স্টুডিয়ো হোটেলে একটি ঘর পায় ফাঁকা, তিনশো ফ্রাঁ ভাড়া, ক্রেডিট কার্ডের ওপর ভরসা করে ওটিতেই যাবে ঠিক করে ট্যাক্সি ডাকে। ট্যাক্সি তিন মিনিটের মধ্যে দাঁড়াবে নীচে, বলে। জয় গোস্বামীর বইটি পড়ে ছিল মেঝেয়, সেটি কুড়িয়ে সুটকেস নিয়ে দরজার কাছে যেই পৌঁছয় সে ফোন বাজে। বেনোয়া ভেবে নীলা দৌড়ে ফোন ধরে, বেনোয়া নয়, ওপাশে দানিয়েল।

কেমন আছো ভাল আছি জাতীয় কথাবার্তার পর দানিয়েল বলে, তোমার একটি চিঠি এসেছে, মনে হচ্ছে জরুরি, ব্যাঙ্কের চিঠি।

চিঠিটি আমার দরকার, নীলা রীতিমতো উত্তেজিত।

তোমার স্বামীর বাড়িতে ফোন করেছিলাম, কেউ ধরেনি, তারপর রিভলিতে তোমার বন্ধুর বাড়িতে খবর দেব বলে করলাম। বললে, তোমার ওই বন্ধুর ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে পারি চিঠিটি।

না। আমার কোনও বন্ধু নেই। এ লোক আমার দাদার বন্ধু ছিল জানতাম, আসলে বন্ধু নয়, শত্রু। এ বাড়ি থেকে আমি এখন চলে যাচ্ছি।

দানিয়েল ঠাণ্ডা গলায় বলে, চিঠিটি তবে আমি ব্যাঙ্কের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিচ্ছি।

খুলে পড়বে? কী লেখা? নীলা কাঁপে, আবেগে, রাগে।

দানিয়েল খোলে। টাকা এসেছে ভারত থেকে। তোমার একাউন্টে এখন দু লক্ষ নব্বই হাজার সাতশো আশি ফ্রাঁ।

নীলা জানত যে এ টাকা আসবে, কিন্তু টাকা এসে সত্যিকার পৌঁছোনোর পর মনে হচ্ছে তার, এ টাকা হঠাৎ চমকে দেওয়া টাকা, লটারিতে জিতে পাওয়ার টাকা।

দানিয়েল তুমি আমাকে বাঁচালে। নীলার কণ্ঠে উত্তাপ, উত্তেজনা।

দানিয়েলের নিরুত্তাপ স্বর, তুমি তো মরছিলে না যে আমি বাঁচিয়েছি! তুমি বেশ ভাল বেঁচে আছ, অনেকের চেয়ে ভাল।

এরপর দানিয়েল নিজের কথা খানিক বলে, সে করের ঝামেলায় পড়েছে। ইদানীং অর্ধেক টাকাই বেরিয়ে যাচ্ছে কর দিতে গিয়ে, দিন দিন সাধারণ মানুষের জন্য সরকারি সাহায্যগুলো কমে যাচ্ছে এ দেশে। কারণ সরকার ব্যস্ত গরিব দেশগুলোয় দান খয়রাত করতে। এ নাকি ধনী দেশেরই স্বার্থে, স্বার্থে না ছাই, দানিয়েল বলে, ধনী দেশের গরিবদের করের টাকা যায় গরিব দেশের ধনীদের হাতে। গরিব গরিবই থাকে।

খাবার টেবিলের ওপর চাবি রাখে নীলা, যেভাবে কিষানের বাড়িতে সে চাবি রেখেছিল। সেভাবেই পা বাড়ায় বাইরে, যেভাবে নতুন আরেকটি জীবনের দিকে আগেও পা বাড়িয়েছিল। সে জীবন অনিশ্চিত জেনে আগেও সে দ্বিধা করেনি, এখনও না।

আমি আকাশের নীলে, বাতাসের পাখায়,
সরোবরের জলে, ঘাসের শরীরে, ঘাসফুলে
তোমার নাম লিখি স্বাধীনতা।
-জেক্রি ত নম লিবার্তে।

স্টুডিয়ো হোটেলের ঘরে লম্বা একটি ঘুম দিয়ে পরদিন সকালে ওঠে নীলা। খিদেয় চোঁ চোঁ করছে পেট। হাতে তার কার্তে ব্লু, ব্যাঙ্কে টাকার অভাব নেই, সে বেরিয়ে পড়ে কোনও ভাল রেস্তোরাঁয় খেতে। কভোঁসিওঁ এলাকায় আগে সে কখনও আসেনি। ঘুরে ফিরে এলাকাটি তার মন্দ লাগে না, ক্যাফে রেস্তোরাঁ সিনেমা মেট্রো বাসস্টপ সারি বুলনজেরি সব হাতের কাছে। বৃহস্পতিবার। কভোঁসিওঁর দুপাশের ফুটপাতে বাজার বসেছে খাট পালঙ্ক, কাপড়চোপড়, বই, ভিডিও, মাছ মাংস, ফুল ফল সবজি, তিনশো রকম পনির, মদ সবই বিক্রি হচ্ছে। আস্ত আস্ত ভাজা মুরগি আর খরগোশ চেঁচিয়ে বিক্রি করছে একটি মেয়ে। গরম লোহার শিকে মুরগি আর খরগোশ ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরছে। নীলা একটি খরগোশ কেনে। বাজারি উৎসবে সে ভিড় কেটে কেটে হেঁটে দু বোতল ওয়াইন কেনে। কিছু কমলালেবু, কামেবেয়ার পনির আর একটি সেদিনের পারতিকুলিয়ে, বাড়িভাড়ার বিজ্ঞাপনের কাগজ। ও নিয়ে হোটেলে ফিরে ফোন করে বেনোয়াকে।

বেনোয়া ফোন করেছিল সুনীলের বাড়িতে বেশ কবার। নীলা নেই, কোথায় কেউ জানে। না জানিয়ে নীলার এমন হঠাৎ হাওয়া হয়ে যাওয়া বেনোয়ার ভাল লাগে না।

কোথায় তুমি রহস্যময়ী?

তুমি খরগোশ খেতে পছন্দ করো, বলেছিলে না?

তা করি। তুমি কি খরগোশ হয়ে গেছ? বলো, তা হলে নুন আর গোলমরিচের গুঁড়ো নিয়ে এসে যাই তোমার কাছে।

এসে যাও।

হোটেলের ঠিকানা দেয় সে বেনোয়াকে।

বেনোয়া না আসা তক নীলা পারতিকুলিয়ের বাড়ি ভাড়া যেগুলো পাঁচ থেকে সাত হাজারের মধ্যে, দেখে বাড়িঅলাদের ফোন করে। দুপুরের আগেই বেশির ভাগ বাড়ি ভাড়া হয়ে গেছে। বাকি কয়েকটি, যা এখনও ভাড়া হয়নি, কথা বলে সময় ঠিক করে নেয় কখন সে দেখতে যাবে।

বেনোয়া হোটেলের ঘরে ঢুকে ধপাস করে বসে চেয়ারে। নীলা কেন হোটেলে উঠেছে, এ তার কিছুতে মাথায় ঢুকছে না।

ও বাড়িতে কোনও অসুবিধে ছিল?

ছিল না। এমনি।

চমক কাটলে বেনোয়া জল খায়, নীলার হোটেলে ওঠার কারণ অনুমান করে বলে, অবশ্য নিজের স্বাধীনমতো থাকা যায় একা থাকলে।

হ্যাঁ। তোমার যেমন আছে। নীলা বলে।

খরগোশ ওয়াইন পনির পড়ে থাকে টেবিলে। বেনোয়া তৃষ্ণার্ত, সে ওয়াইন পান করে তার তৃষ্ণা মেটাবে না। চুমু খেয়ে মেটাবে। বেনোয়া ক্ষুধার্ত, তবে মৃত খরগোশে তার রুচি নেই, খাবে জ্যান্ত খরগোশ। দীর্ঘ দীর্ঘ সময় নিয়ে সে তার মধ্যাহ্নভোজন সারে।

বিকেলে ঝরনার জলে লুটোপুটি করে স্নান করে বেরোয় দুজন। এভিন্যু এমিল জোলায় একটি বাড়ি দেখতে যায়, ভাড়া আট হাজার। নীলার বেশ পছন্দ হয় বাড়িটি।

নেব নাকি? জিজ্ঞেস করে বেনোয়াকে।

বেনোয়া কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, তোমার ইচ্ছে।

ঠিক বলেছে সে, নীলা বাড়ি নেবে, নীলার ইচ্ছেতেই হতে হবে, এতে বেনোয়ার কিছু যায় আসে না, কিছু বলার নেই তার।

নীলার ইচ্ছে হলেই যে সব হবে তা নয়। বাড়িঅলা নাকচ করে দেয়, কারণ নীলা কোনও চাকরি করে না।

ব্যাঙ্কে টাকা আছে। বাড়িঅলা বলে, তাতে কী?

নাকচ।

রু দ্য ভজিরায় আরেকটি বাড়ি দেখে পছন্দ হওয়ার পর কবে নতুন বাড়িতে উঠবে তা জানতে চাইলে, নীলার মাসিক আয়ের কথা জিজ্ঞেস না করে বাড়িঅলা জিজ্ঞেস করে, জিম্মাদার হওয়ার লোক আছে কি না।

নীলা করুণ চোখে তাকায় বেনোয়ার দিকে।

বেনোয়ার নির্লিপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে নীলা মাথা নাড়ে, নেই।

নাকচ।

বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে বেনোয়া বলে, গ্যারান্টি না পেলে বাড়ি ভাড়া পাবে না প্যারিসে।

এমন কী আমি লাখপতি হলেও না?

না।

কোটিপতি হলেও না?

না।

কী করতে পারি তবে?

নীলা আশা করে বেনোয়া বলবে, জিম্মি সে হবে। বলে না বেনোয়া। নীলার কেবল আশায় বসতি।

তোমার তো চেনা আছে ভারতীয়, ওদের বলো।

না, ওদের কাছে চাইতে ইচ্ছে করে না।

রিভলিতে তোমার বন্ধুকে বলো।

সে আমার বন্ধু নয়।

তার বাড়িতে এতদিন ছিলে, সে বন্ধু নয়। এ কেমন কথা!

নীলার জিভে এসে যায়, তুমি জিম্মি হও বেনোয়া। তুমি তো আলকাটেলে ভাল বেতনের চাকরি করো।

বলে না, কারণ আশঙ্কা হয় তার, বেনোয়া বুঝি ভাবছে, এ মেয়ে আজ এখানে, কাল সেখানে করে বেড়াচ্ছে, কখন আবার বাড়ি ভাড়া না দিয়ে পালাবে, তখন বিপদ হবে আমার।

যদি এরকম কোনও দুর্ভাবনা উঁকি দেয় বেনোয়ার মনে, দূর করতে নীলা বলে, যে, তার মা তাকে প্রচুর টাকা দিয়ে গেছে। তিন বছর কোনও চাকরি বাকরি ছাড়াই সে প্যারিসে বেশ স্বচ্ছন্দে চলতে পারবে। বেনোয়া শোনে। কেবল শোনেই।

নীলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আমার মা চাননি আমি বিদেশে থাকি। কলকাতায় থাকলে বাড়ি ভাড়া পেতে কোনও অসুবিধে হত না। ওখানে এরকম জিম্মির প্রশ্ন ওঠে না। ভাড়াটের টাকা থাকলে কোনও বাড়িঅলা না করে না।

বেনোয়া বলে যায় প্যারিসে এ নিয়ম অনেকদিনের। বাড়িঅলারা কেন এ নিয়ম করেছে, তাও সে বলে।

বাড়িভাড়া নেওয়ার এবং দেওয়ার একশো নিয়ম গড়গড় করে বলে যায়। রু দ্য রেনের বাড়িটি সে কিনেছে, না কিনলে তারও ভাড়া নেওয়ার সমস্যা হত, বলে।

বেনোয়াকে স্বস্তি দেয় নীলা কোনওরকম প্রশ্নে না যেয়ে। বেনোয়াও কিছু জিজ্ঞেস করে না নীলা কী করে বাড়ি ভাড়ার ব্যবস্থা করবে।

পিগালের রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে সন্ধের আলো ঝলমল রাস্তায় হেঁটে হেঁটে বারবার বলে সে জ তেম।

রাস্তার দুপাশে লাল নীল রঙের বাতি জ্বলছে নিবছে, যৌনখেলনার দোকানগুলোয় কৃত্রিম শিশ্ন, কৃত্রিম নারীযোনি দেদার বিক্রি হচ্ছে। সঙ্গম প্রদর্শনী চলছে ছবির নয়, পুতুলের নয়, মঞ্চে রক্তমাংসের নারীপুরুষের।

একা এই রাস্তায়, নীলা জানে, তার পক্ষে সম্ভব হত না হাঁটা। ভয় এবং লজ্জা তার পা সম্পূর্ণ অচল করে দিত। বেনোয়া আছে বলে সে নির্ভাবনায় পিগালের রাস্তায় হাঁটে। ভয় লজ্জা পেছনে নিশ্চল পড়ে থাকে।

চলো মুলা রুজে যাই। নীলা বলে।

ওরে বাপ। ওখানে খরচা করার টাকা নেই আমার।

আমার আছে, চলো। তুলুজ লট্রেস কী নাচ দেখতেন দেখে আসি।

সেই নাচ কি আর আছে!

সেই নাচ নেই জেনেও নীলা-ঢোকে ভেতরে। জেনেই ঢোকে যে মূলা রুজ পর্যটক ধরার ফাঁদ ছাড়া কিছু নয়। নীলার ইচ্ছে করে বেনোয়াকে দেখিয়ে মোটা টাকার লাদেসিওঁর মেটাতে তার কার্তে ব্লু বের করতে। সে দেখুক, নীলা কোনও পথের ভিখিরি নয়, সে যা বলেছে, তাকে প্রচুর টাকা দিয়েছে তার মা, এ কথা মিথ্যে নয়।

বেনোয়া বুঝুক, নীলা মিথ্যে বলে না।

মুলা রুজ থেকে বেরিয়ে উৎফুল্ল বেনোয়া বলে, জানো, এত মেয়ে দেখেছি, তোমার মতো প্রাণবন্ত কাউকে দেখিনি। জীবন কী করে উপভোগ করতে হয়, তুমি জানো। তোমার মতো হৃদয়াবেগ আর কারও নেই। তোমার তুলনা তুমিই। ফরাসি মেয়েরা বিষম হিসেবি।

ফরাসি ছেলেরা নয়? নীলা জিজ্ঞেস করে।

বেনোয়া নীলার স্তুতিতে এতই বিভোর ছিল, শোনেনি নীলার প্রশ্ন।

সে রাতে বেনোয়া নীলার হোটেলঘরে রাত কাটায়। রাত কাটে ভালবেসে, আদরে আহ্লাদে, চুমুতে সঙ্গমে। সকালে বেনোয়া আপিস চলে গেলে, নীলা বেরোয়। বাড়ির দালালেরা যে ঝকঝকে দোকান পেতে বসে ব্যবসা করছে, ওসবে ঢুকে সে জিজ্ঞেস করে, বাড়ি পাওয়া যাবে কি না। বাড়ি পাওয়া যাবে, চাও তো এক্ষুনি নাও, তবে লোক কে আছে তোমার, যে জিম্মি হবে! প্লাসদিতালি আর রু দ্য ভুইয়ে-তে দুটো বাড়ি দেখে এসে সে হোটেলে শুয়ে থাকে অসহায়, বাড়ির দালালদের তার মোটা টাকার কাগজ দেখিয়ে কোনও লাভ হয়নি। যে বেনোয়া তার হৃদয় জুড়ে, সে নীলার অসহায়ত্ব দেখছে, কিন্তু সহায় হওয়ার কোনও আশা দিচ্ছে না। যে বেনোয়া তার সমস্ত জীবন জুড়ে, সে নীলার ধ্বসে পড়া জীবন দেখছে, কিন্তু ধ্বস থামাতে এতটুকু হাত বাড়াচ্ছে না।

যেহেতু দানিয়েল ব্যাঙ্কের চিঠি আসার খবর নীলাকে দিয়েছে, যেহেতু সে ইজেল আর ছবির মতো ডাস্টবিনে ফেলে দেয়নি চিঠি, রাগ তার পড়েছে, এই ভরসায় আর আশায় সে ফোন করে দানিয়েলকে।

দানিয়েল বলে, সে আগামী সপ্তাহে নিকল আর মিশেলের সঙ্গে সুইডেন যাচ্ছে, রিতার যাওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু ছবি তৈরির কাজে তাকে ইজরাইল যেতে হচ্ছে বলে সম্ভব হচ্ছে না। মারিয়া সুয়েনসন তাদের নেমন্তন্ন করেছে ইউসতেরো দ্বীপে ওর নতুন বাড়িতে। নিজের হাতে বাড়িটি বানিয়েছে মারিয়া। বাল্টিক সমুদ্রের ধারে লাল কাঠের বাড়ি।

নিজে বানিয়েছে?

হ্যাঁ নিজে। ওখানে লোকেরা নিজেই নিজের বাড়ি বানায়।

মারিয়া ওদের নিয়ে উত্তরে যাবে, ল্যাপ জাতি যেখানে বাস করে। ওখানে মধ্যরাতের সূর্য দেখবে ওরা।

দানিয়েল একবারও জিজ্ঞেস করে না, নীলা যেতে চায় কি না মধ্যরাতের সূর্য দেখতে। মারিয়া যে নীলাকে ছাড়া সে রাতের আর সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, সে বেশ স্পষ্ট।

নীলাকে অবশেষে সৌজন্য করেই সম্ভবত, জিজ্ঞেস করে কেমন চলছে তার জীবন।

হোটেলের জীবন তার, ভ্যান গগ না হয় সাড়ে তিন ফ্রাঁএ ঘর পেয়েছিলেন, একশো বছর পার হয়েছে মাঝখানে, দামও একশো গুণ বেড়েছে।

তোমার আর চিন্তা কী, টাকা তো আছেই! অত টাকা আমার জীবনে আমি কখনও উপার্জন করিনি। দেখিওনি।

নীলা বলে, কলকাতায় যা দেখেছ, তা আমার বাবার আর দাদার। মা কিছু টাকা দিয়েছেন, এই আমার সারাজীবনের সম্বল। টাকায় শুনেছি বাঘের দুধও কেনা যায়, কিন্তু এই প্যারিসে একটি বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় না।

নীলা এরপর কাতর মিনতি করে, ভাড়া নেওয়ার কোনও একটা ব্যবস্থা করে দিতে।

বাড়ি ভাড়া কত?

ধরো, হ হাজার।

তা হলে যে চার ছয়ে চব্বিশ হাজার ফ্রাঁ মাসে আয় করে, তার কাছে যাও। আমি অত টাকা আয় করি না। আমি কোনও কাজে লাগব না তোমার।

তোমার ওই বন্ধুরা, নিকল, রিতা, মিশেল? কেউ যদি দেয়।

আমার মনে হয় না কেউ দেবে। তুমি তোমার ওই বাঙালি বন্ধুকে বলছ না কেন! সে তো ভাল কামায় বলেছিলে।

সুনীলের সঙ্গে কথা বলার কোনও ইচ্ছে তার হয় না। নীলা শুয়ে থাকে। বেনোয়া আপিস শেষে চলে আসে হোটেলে রাত কাটাতে। বেনোয়ার স্পর্শ তার স্বপ্নকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে, একটি বাড়ির একটি সংসারের স্বপ্ন। বেনোয়া যত জ তেম বলে, তার তত ইচ্ছে জাগে পায়ের নীচে মাটি পেতে, দাঁড়াতে, যেন প্রতিটি দিন প্রতি নিশ্বাসে সে বেনোয়ার জ তেম এর ঘ্রাণ আরও গভীর করে নিতে পারে। মলিনার মতো ভালবাসাহীন বেঁচে থাকতে তার ভয় হয়।

বেনোয়া যখন শিশুর মতো নীলাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকে, নিদ্রাহীনতার কোলে শ্রান্ত মাথা রেখে নীলা তাকিয়ে থাকে অসহ্য সুন্দরের দিকে। মাঝে মধ্যে তার ইচ্ছে যে করেনি, বেনোয়াকে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে দিতে, ঘাড় ধরে ঘর থেকে বের করে দিতে, তা নয়। করে তার, কিন্তু তার পরের অন্ধকার জীবন সে দেখে চোখের সামনে, ভালবাসাহীন, আশাহীন, সুনীলের ভোগের শিকার হওয়া দিনের পর দিন, অসহায় অবলা মেয়েমানুষের মতো বাঁচা। বেনোয়া তাকে ভালবাসে ঠিকই, কিন্তু তাকে এখনও বিশ্বাস করে না। নিশ্চয়ই করে না। এক অবোধ অভিমান নীলাকে স্তব্ধ করে রাখে।

ইচ্ছের বাইরে সে নিজের মায়ের শ্রাদ্ধ করেনি, কিন্তু পরদিন সকালে সে সুনীলকে ফোন করে, কেবল তাই নয়, লা মারেতে সুনীলের ক্লিনিকে অব্দি যায় দেখা করতে।

ওভাবে চলে গেলে কেন? চৈতালিও বলছিল, এরকম না বলে যাওয়াটা ঠিক হয়নি। সুনীল, যেন অশোভন কোনও আচরণ সে নীলার সঙ্গে কোনওদিন করেনি, এমন ভালমানুষি সুরে জিজ্ঞেস করে।

চৈতালিকে বলেননি, আমার চলে যাওয়ার কারণ? নীলার তিক্ত বিরক্ত কণ্ঠ।

কী কারণ?

নীলা মুঠো শক্ত করে। লোকটির মুখ সে কোনওদিন দেখতে চায়নি, কণ্ঠ শুনতে চায়নি, দম টানা হাসির শব্দ সে পেতে চায়নি, কিন্তু আর কোনও উপায় নেই তার, নিজের একটি বাড়ি তার দরকার।

নিজের কণ্ঠস্বরে নীলা নিজেই চমকে ওঠে, যখন সে সুনীলকে অনুরোধ নয়, আদেশ করে জিম্মি হতে।

তুমি কি প্যারিসেই থাকবে ভাবছ? তবে আগে কাগজের ব্যবস্থা করো। কিষান ডিভোর্স দিলে কী করবে? অবশ্য তোমার তো আবার ফরাসি প্রেমিক আছে। তা বিয়ে টিয়ে করছ নাকি?

নীলা ধমকে থামায় সুনীলকে। আবারও সেই আদেশ কণ্ঠ।

শেষ অব্দি বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়। রু দ্য ভুইয়েতে বাহাত্তর বর্গমিটার, চারটে ঘর, ভাড়া সাত হাজার। দু মাসের অগ্রিম ভাড়া আর দালালকে সাত হাজার, মোট একুশ হাজার দিয়ে, সুনীলের কাগজপত্র আর মুচলেকা দেখিয়ে নীলা চাবি পায় দরজার। রু দ্য ভুইয়ের বাড়ির চারতলায় ঢুকে, বড় একটি শ্বাস নেয়, ফুসফুস ভরে স্বাধীনতার ঘ্রাণ নেয়। সুনীল বলেছিল, এত বড় বাড়ি দিয়ে একা মানুষ তুমি কী করবে। কোনও একটা স্টুডিয়ো ভাড়া নিলে পারতে। নীলা পারত অনেক কিছু, সরকারের অবাসযোগ্য ঘোষণা করে দেওয়া পোড়াবাড়িগুলোয় উদ্বাস্তুরা দখল করে যেমন বিনা ভাড়ায় দিব্যি বছরের পর বছর ধরে থেকে যাচ্ছে, গরমজল নেই, আলো নেই, তেমন থাকতে পারত সে। মোজাম্মেল যে এলাকায় থাকে, সেই বেলভিলে, সেই তাবৎ কালো বাদামি লোকদের এলাকায় সস্তায় কোনও ঘর ভাড়া নিতে পারত। নীলা হয়তো অনেক কিছু পারত, জিম্মির দরকার হয় না এমন কোথাও সে যেতে পারত, কোনও শহরতলির ভাঙাচোরা কোনও বাড়ি। নীলা করতে পারত অনেক কিছু করেনি। করেনি বলে তার কোনও অনুতাপ হয় না। সে ভাবতে থাকে চারটে ঘর সে কী করে সাজাবে, সাজানো বাড়িটিতে ঢুকে কেমন চমকাবে বেনোয়া, চমকে নীলাকে জড়িস রে কী করে চুমু খাবে আর বলবে তোমাকে যত দেখি তত মুগ্ধ হই। এত তুমি পারো কী করে!

ঘরগুলোর সব জানালা দরজা খুলে দিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে থাকে নীলা। হু হু করে হাওয়া ঢোকে ঘরে, বারান্দার রেলিঙে একটি একা পাখি এসে বসে, পাখিটি বিষ্ঠা ত্যাগ করে উড়ে যায়। সুনীলের পাওনা সে মিটিয়ে দিয়েছে, নীলার মনে হতে থাকে, সুনীলও সম্ভবত তার পাওনা মিটিয়েছে। সুনীলকে অমনই দেখিয়েছে, দেনাপাওনা শোধ হবার পর লোকের ঠোঁটের কোণে প্রশান্তি ঝিলিক দেয় যেমন।

নীলার বমি হয়ে যায় যা খেয়েছিল শে লুলুতে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress