Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ফরাসি প্রেমিক || Taslima Nasrin » Page 4

ফরাসি প্রেমিক || Taslima Nasrin

প্রত্যেকের জন্য কলকাতার রাস্তা, ফুটপাত, এঁদো গলি নিজের ঘরের মতো, যেখানে সে বসতে পারে, ঘুমোতে পারে, এমনকী পচা আবর্জনার স্তূপ থেকে নিজের খাবার তুলে খেতে পারে।
—ক্লদ লেভি স্ত্রস

কলকাতাকে যেমন রেখে গিয়েছিল নীলা, কলকাতা ঠিক তেমনি আছে। তবু তার মনে হয়, কলকাতা দেখতে মলিন হয়েছে আরও, ফুটপাতে নোংরা জমেছে আগের চেয়ে বেশি, ধুলো উড়ছে প্রচণ্ড, গাড়িঘোড়ার জটলা বেশি, আগেও ভেঁপু বাজত, এত তারস্বরে না, বাড়িঘরগুলো আগের চেয়ে রংওঠা, আস্তরখসা, দোকানপাটগুলো ছোট, ঘিঞ্জি, স্যাঁতসেঁতে, রাস্তাগুলো হঠাৎ সরু হয়ে গেছে, মানুষগুলো আরও কালো, মাঠে ঘাস আগের চেয়ে কম। ঘাসের রং গাছের পাতার রং আগের চেয়ে কালচে। নীলা দমদম থেকে গাড়ি করে বালিগঞ্জে আসতে আসতে নিখিলকে থেকে থেকে বলে, খুব বদলে গেছে কলকাতা।

নিখিল কলকাতার বদলে যাওয়া খোঁজে এদিক ওদিক। আর চালক রামকিরণ ময়লা রুমালে ঘাড়ের ঘাম মুছে বলে, দিদি, আপনি বদলেছেন, কলকাতা যেমন ছিল, তেমনই আছে।

বালিগঞ্জে বাড়িতে ঢুকে নীলার মনে হয়, বাড়িটিও অনেক ছোট হয়ে গেছে। নীলা বড় হয়ে তার ছোটবেলার বিশাল ইস্কুলবাড়িটি দেখতে গিয়েছিল একদিন, দেখে চিনতে পারেনি, ইস্কুলের যে বিশাল মাঠে নীলা দৌড়ে খেলত, সেই মাঠে দাঁড়িয়েই মাঠ খুঁজেছে, নদীর মতো বড় ইস্কুলের পুকুরটিকেও লেগেছিল ডোবা মতো।

মলিনার কী হয়েছে, কী অসুখ, নীলা কাউকে জিজ্ঞেস করেনি পথে, না নিখিলকে, না রামকিরণকে।

নীলাকে দেখে চিত্রা দৌড়ে খবর দিয়ে আসে মলিনাকে, দিদি এসেছে দিদি।

চিত্রার এমনই নিয়ম, নীলা দেরি করে বাড়ি ফিরলেই এমন খবর নিয়ে দৌড়োত। নীলার হঠাৎ মনে হয়, সে আজ দেরি করে বাড়ি ফিরেছে। পথে যানজট ছিল, তাই দেরি। নন্দনে অপর্ণার নতুন ছবি দেখতে গিয়েছিল, তাই দেরি।

নীলা যা করে ফিরে, মা মা বলে ডাকে।

মলিনাকে শোবার ঘরে না পেলে রান্নাঘরে ঢোকে, রান্নাঘরে না পেলে পুজোর ঘরে, পুজোর ঘরে না পেলে উঠোনের সবজিবাগানে, ওতেও না পেলে নীলা বেশ জানত, মলিনা এখন বাড়ির ছাদে, রোদে কাপড় শুকোতে দিচ্ছেন।

নীলা মা মা ডেকে আজও শোবার ঘরে ঢোকে। শোবার ঘরে মলিনা। বোঁ বোঁ শব্দে পাখা চলছে, পাখার তলে মলিনা ঘামছেন। মলিনা ঘুমোচ্ছেন।

মা ঘুমোচ্ছ এই অসময়ে? ওঠো। আমি এসেছি।

নীলা এসেছে। মলিনা ওঠো। নীলাকে খেতে দাও। নীলাকে ঠাণ্ডা জল দাও। নীলাকে পাশে বসিয়ে গল্প শোনো, অনেক গল্প জমেছে ওর। গল্প বলতে বলতে ওর যদি গলা বুজে আসে, কোলে ওর মাথাটা নিয়ে, গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ওকে বোলো, চোখের আড়ালে আর যাসনে মা। ঘুমপাড়ানি গান শোনাও নীলাকে, অনেকদিন পর তোমার পাশে তোমাকে জড়িয়ে ও ঘুমোবে, ওঠো।

নীলা শিয়রের কাছে বসে দেখছে মলিনার এক মাথা ঘন কালো চুল হাওয়ায় উড়ে গেছে, আর আস্ত একটি হাড়ের কঙ্কাল বোঁ বোঁ পাখার নীচে দুলছে। নীলা দোলে, নীলার ইফেল টাওয়ার দোলে।

চা দেব দিদি?

দিদি তার হ্যাঁ বলে না। না বলে না।

চিত্রা ডুকরে কেঁদে ওঠে। নীলা জানতে চায় না, চিত্রা কাঁদছে কেন।

উঠে যায়, উঠে দোতলায় নিজের ঘরে, নিজের বিছানায়। চিত্রা পেছন পেছন যায়, আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে, দিদি শুচ্ছেন যে, চান টান করুন, কিছু মুখে দিন।

চিত্রা তুই যা তো, আমাকে একটু একা থাকতে দে।

চিত্রা দাঁড়িয়েই থাকে দরজা ধরে। বলতে থাকে, মাসিমার এ যে হঠাৎ কী হল দিদি! এই চলছেন ফিরছেন, হঠাৎ বিছানা নিলেন। এখন তো উঠে দাঁড়াতে পারেন না আর। ঘুমের ওষুধ খেয়ে পড়ে পড়ে ঘুমোন। ঘুমোচ্ছেন বলে রক্ষে, না হলে ব্যথায় সে যে কী চিৎকার করেন। দেখলে আপনার সইবে না দিদি।

এত কথা বলছিস কেন? তোকে তো এত কথা জিজ্ঞেস করিনি। নীলা ধমকে ওঠে।

চিত্রা পা পা করে নীলার আরও কাছে সরে এল।

মাসিমা কেবলই আপনার কথা বলছেন দিদি। এই তো বলে বলে ঘুমোলেন আজ আমার নীলা আসবে রে, কইমাছ ভাজ, সর্ষেইলিশ কর, রুইমাছের ঝোল কর, সন্দেশ নিয়ে আয়।

তুই এ ঘর থেকে যা না, খানিকক্ষণের জন্য যা। নীলা বালিশে মুখ গোঁজে। চিত্রা যেন শব্দ নয়, এক একটি আগুনের পিণ্ড নীলার দিকে ছুড়ছে।

কত লোক আসে মাসিমাকে দেখতে, কেউ তো ভাল করতে পারে না। কতরকম ডাক্তারবাবু আসেন। কতরকম ওষুধ দিয়ে যান। কোনও ওষুধে তো মাসিমা ভাল হচ্ছেন না। দিন দিন বিছানার সঙ্গে মিশে যাচ্ছেন। দুদিন আগেও নরম করে দিলে দুটো ভাত খেতে পারতেন, এখন তো কিছুই মুখে ওঠে না। চিত্রা আবার ফুঁপিয়ে ওঠে।

চিত্রা একাই নীলাকে যন্ত্রণা দিচ্ছিল, এরপর যন্ত্রণা দিতে আসেন মঞ্জুষা, এতদিন পর এলি রে নীলা বলে হু হু করে কেঁদে উঠলেন।

বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদলেন আর বললেন, কেন আগে এলি না রে। তুই বিদেশে এটা খেতে পারছিস না, ওটা খেতে পারছিস না, বাড়ি ফিরে এলে তোর জন্য নিজে হাতে কত কিছু রাঁধবেন, বলেছিলেন। তোকে মুখে তুলে খাওয়াবেন। মায়ের হাতের রান্না খাওয়ার ভাগ্য তোর বুঝি আর হল না…

নীলা এবার বালিশে গোঁজা মুখ তুলে চেঁচায়, কী হয়েছে তোমাদের, ভেউ ভেউ করে সব এত কাঁদছ কেন। একটু দূরে সরো সবাই।

মঞ্জুষা বসেই থাকেন আর বলতে থাকেন, ডাক্তারবাবু আর ওষুধ দিচ্ছেন না, বলেছেন ওষুধ আর কাজ দেবে না। ব্যথার কটি ওষুধ কেবল চলছে। তাতে তো আজকাল ব্যথাও কমছেনা। ক্যান্সার নাকি নাড়ি থেকে থেকে লিভারে গেছে, কাল বলে গেলেন হাড়ে ঢুকেছে, আবার বললেন মাথাতেও। কাল সারারাত দিদি কাতরালেন ব্যথায়, বসে বসে তাই দেখতে হল।

নীলা এবার উঠে যায় বিছানা থেকে, দৌড়ে যায় স্নানঘরে।

বাইরে থেকে মঞ্জুষা বলেন চানটা করে খেতে আয় নীলা।

নীলা নীরবতা চাইছে। নীরবতা সম্ভবত বড় দুর্লভ জিনিস এ মুহূর্তে। সে চাইছে না কেউ কোনও নিখুঁত বর্ণনা দিক মলিনার শরীরের বা ইচ্ছের। মলিনার ইচ্ছের কথা নীলা সেই ছোটবেলা থেকেই জানে, মলিনার কোনও ইচ্ছে কখনও পূরণ হয়নি, তিনি চেয়েছিলেন অনির্বাণের সামান্য ভালবাসা পেতে, পাননি। অনির্বাণ মণ্ডল যে ভালবাসেন না কাউকে তা নয়, বাসেন, তবে মলিনাকে নয়, স্বাতী সেনকে। মলিনা একবার কাঞ্জিপুরম শাড়ি দেখে এসে বলেছিলেন, কী সুন্দর শাড়ি গো। একটা পরতে পারলে বেশ হত।

অনির্বাণ কাঞ্জিপুরম শাড়ি কিনে মলিনাকে দেননি, দিয়েছেন স্বাতীকে, স্বাতীকে সেই শাড়ি পরিয়ে সিমলায় নিয়ে গেছেন বেড়াতে। মলিনার সাধ ছিল কোনও একদিন দার্জিলিং যাবেন, অনির্বাণের কোনও দিনই সময় হয়নি মলিনাকে দার্জিলিং নেবার। স্বাতী দেখতে মলিনার চেয়ে ফর্সা ছিল, স্বাতীর ওই একটি গুণের কারণে অনির্বাণ স্বাতীর পিছু ছাড়েননি। বুদ্ধি হবার পর থেকে নীলা কখনও দেখেনি অনির্বাণ আর মলিনা এক ঘরে এক বিছানায় শুয়েছেন। মলিনা যত্ন করে স্বামীর বিছানা গুছিয়ে দিতেন, অনির্বাণ স্বাতীর সঙ্গে রাতের আমোদ আহ্লাদ সেরে বাড়ি ফিরে খেতে বসে কোন নিরামিষে নুন হয়নি, কোন মাংসে তেল বেশি পড়েছে, কোন ভাজা পুড়ে গেছে এসব নিয়ে চেঁচিয়ে গোছানো বিছানায় ঘুমোতেন নাক ডেকে। মলিনার জীবন ওরকমই ছিল। ইচ্ছের গায়ে শেকল পরিয়ে তিনি তাঁর জীবন কাটিয়েছেন এ সংসারে।

বিকেলে বাড়ি ভরে গেল মলিনাকে দেখতে আত্মীয়স্বজনে। বাড়ির মাঠ ভরে গেল ঝকঝকে গাড়িতে। মলিনার দিদি জামাইবাবু, তাদের ছেলে, ছেলের বউ, ছেলের বউয়ের দু বাচ্চা, মলিনার কাকিমা, দুই কাকাতো বোন কাকাতো বোনের ছেলে পল্টু, অনির্বাণের দাদা, দিদি, পিসতুতো দাদা, তার মেয়ে মিঠু, আর দুজন প্রতিবেশী গৃহবধু। চৌকাঠের জুতোর ঢিবিতে জুতো রেখে সব ঢুকে যাচ্ছে মলিনার ঘরে, হাতে কারও আপেল আঙুর কমলালেবু, কারও হাতে বেদানা, ডালিম, কেউ নিয়ে এসেছে হরলিকস, কেউ আবার বাটি ভরে শিংমাছের ঝোল এনেছে, কেউ এনেছে ঘরেপাতা খাঁটি দই, কারও হাতে ফুল। মলিনাকে দেখিয়ে দেখিয়ে জিনিসগুলো সামনে রাখছেন মঞ্জুষা। মঞ্জুষা জানেন যে ফুলের ঘ্রাণ মলিনার নাকে গন্ধিপোকার গন্ধ হয়ে ঢোকে, বেদানা বা কমলার রস মুখে ঢোকালে বমি হয়ে বেরিয়ে যায়। মলিনা শুকনো চোখে আত্মীয়দের খানিকক্ষণ দেখে আবার চোখ বোজেন। যেন সারাজীবন নিরন্তর পরিশ্রম করার পর এখন এত ক্লান্ত যে চোখ মেলার শক্তিও নেই। মলিনাকে দেখে কেউ আহা বলে, কেউ দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কেউ আঁচলে চোখ মোছে, হাতপাখায় কেউ বাতাস করে গায়ে, কেউ হাত বুলোতে থাকে মলিনার হাড়সার হাতে।

আর ভিড় থেকে ভেসে আসতে থাকে

এই কদিন আগেও তো হেঁটেছেন! কথা বলেছেন।

আহা শরীরের কী হাল হয়েছে?

পেটটা আজ বেশি ফোলা লাগছে।

চোখের হলুদটা আরও বেড়েছে।

নীলা ভিড় কেটে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। নীলার পেছন পেছন ভিড়ের মানুষগুলোও এক এক করে। মঞ্জুষা নীলাকে তাড়া দেন, শাঁখা সিঁদুর পরে আয় তো। এত লোক এসেছে, কী বলবে বল।

লোকেরা কি আমার শাঁখা সিঁদুর দেখতে এসেছে?

তা দেখতে আসেনি, কিন্তু চোখ তো বাড়িতে রেখে আসেনি কেউ। এ নিয়ে দেখিস, কথা হবে।

হোক।

নীলা শাঁখা সিঁদুর পরা অনেক আগেই ছেড়েছে, ও পরার কোনও ইচ্ছে তার নেই। জানালায় গিয়ে সে দাঁড়ায়, সেই জানালা, তাকালে প্রতিবেশীর বাড়ির পিঠ দেখা যায়, আর পিঠের তলে এক বোঝা আবর্জনা, আবর্জনা খুঁটে খাচ্ছে রাস্তার দুটো নেড়ি কুকুর। নীলার মগ্নতা ভাঙে মলিনার দাদার কণ্ঠস্বরে, হোয়াই ডিডন্ট হি কাম, নীলা?

কে?

কিষানলাল। আমি ভেবেছিলাম, হি হ্যাজ অলরেডি এরাইভড ইন ক্যালকাটা, আড্ডা ফাড্ডা দেব, হি ইজ রিয়েলি এ জেন্টেলম্যান।

তা বটে। কিন্তু সে আসেনি। নীলা একা এসেছে!

আমি প্যারিসে কখনও যাইনি। বাট আমি জানি, প্যারিস ইজ এ ওয়ান্ডারফুল সিটি, আই উড লাভ টু গো দেয়ার। কিষানলালের বাড়িতে থাকা যাবে তো! আই এম সিওর হি হ্যাজ এ বিউটিফুল বিগ হাউজ।

নীলা বলে, কথা বলতে গিয়ে এত ইংরেজি ব্যবহার করছেন কেন? বাঙালি মানুষ, বাংলায় কথা বলুন।

বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলা তাঁর চিরকালের স্বভাব। নীলা কখনও আপত্তি করেনি আগে, নিজেও সে মলিনার দাদার সঙ্গে বাংলা ইংরেজি মিলিয়েই কথা বলত।

হো হো শব্দে হেসে ওঠেন মলিনার দাদা, আত্মসম্মানে তাঁর আঘাত লাগেনি, বরং তাঁর সম্মান, নীলা অনুমান করে, তিনি ভাবছেন, যে বেড়েছে। তাঁর জিভে বাংলা শব্দ সহসা আসে না, এ নিয়ে কোনও লজ্জার বদলে গর্ব হচ্ছে তাঁর।

অনির্বাণের দিদি নীলাকে টেনে জানালা থেকে সরান। কী, এত চুপচাপ কেন নীলা! কথা বলো। কথা না বললে কষ্ট হয়ে বেশি। কী করবে বলো, আমাদের কারও কি হাত আছে মলিনাকে সারানোর… সব ভগবানের ইচ্ছে… মলিনার জামাইবাবু একটি সিগারেট ধরিয়ে সোফায় গা এলিয়ে বলেন, তা প্যারিসে জীবনযাপন কেমন চলছে। স্বামী ভাল কামায় তো? আই হার্ড দ্যাট হি আর্নস গুড মানি।

মলিনার কাকাতো বোন নীলার হাত দুটো তুলে ধরে, দেখো দিকিনি, কেমন খালি হাত, গয়নাগাটি খুলে রেখেছ কেন! শাঁখা সিঁদুরও পরোনি। কেমন বিধবার মতো দেখাচ্ছে।

আরেক কাকাতো বোন বলে, বাচ্চা কাচ্চা কবে হবে! যা নেবে, তাড়াতাড়ি নিয়ে নাও।

এবার মলিনার দিদির মেয়ে বলে, কোলের বাচ্চার মুখে দুধের বোতল ঢুকিয়ে দিয়ে দোলাতে দোলাতে, তোমার বাচ্চা তো জন্মেই ফরাসি নাগরিক হবে, তাই না!

মলিনার কাকিমা পল্টুকে ডেকে নীলার সামনে দাঁড় করায়। কী তোর দিদিকে নাকি প্যারিসের কথা জিজ্ঞেস করবি! করেছিস। পনেরো বছর বয়স পল্টুর, দিদিকে আর জিজ্ঞেস করা হয় না কিছু, দিদিমার পেছনে মুখ লুকোয় সে। এই পল্টুটাকে বিদেশে নেওয়া যায় কি না দেখো তো। ছেলেটা মোটে লেখাপড়া করতে চাইছে না দেশে।

অনির্বাণের পিসতুতো দাদা সাধন দাস নীলাকে আড়ালে ডেকে বড় শ্বাস ফেলে বলেন, মিঠুর জন্য কিছু কি করতে পারবে নীলা? একটা বিয়ে টিয়ের বন্দোবস্ত যদি করতে পারো…

নীলা অনুমান করে, আত্মীয়দের বিশ্বাস তার হাতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা এখন। কেউ জানে না যে সে নিজে সুনীলের কাছ থেকে বিমানভাড়ার টাকা ধার করে কলকাতা এসেছে। কেউ জানে না কারও কোনও সমস্যার সমাধান করা নীলার দ্বারা সম্ভব নয়। কেউ জানে না কার বিয়ে হচ্ছে না, কার লেখাপড়া হচ্ছে না এ দেশে, সে এসব জানতে চায় না। নীলা চায় বাড়ি থেকে অতিথিরা সব বিদেয় হোক, মলিনার পাশে বসার অবসর জুটুক তার, মলিনার বোজা চোখের দিকে তাকিয়ে থাকার যতক্ষণ না তিনি চোখ খোলেন, খুললে নীলা দেখাবে মার জন্য একজোড়া জুতো এনেছে সে প্যারিস থেকে, একটি ঘড়ি এনেছে হাতে পরার, আর একটি ক্রিম মুখে মাখার, বয়সের রেখা মুছে দেওয়ার ক্রিম।

চিত্রা আর মঞ্জুষা ব্যস্ত অতিথি আপ্যায়নে। চা বিস্কুট দেওয়া হচ্ছে ঘরে ঘরে।

নীলা দুর্লভ নীরবতা খোঁজে।

মিঠু একটি সাদা সুতি শাড়ি গায়ে, ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়েছিল, পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে নীলার দিকে, ইতিউতি তাকিয়ে গলা চেপে বলে, তোমার সঙ্গে একটু কথা বলব।

বলো।

এখানে না। চলো না তোমার ঘরে যাই।

নীলা দোতলায় নিজের ঘরে মিঠুকে নিয়ে ঢুকল। মিঠু ঘরের দরজা ভেজিয়ে বিছানায় বসল। বসে নীলার দুহাত চেপে ধরে বলল, আমার জন্য কিছু করো নীলা।

কী করব।

একটা ছেলে, যে কোনও একটা ছেলে খুঁজে দাও। তোমার চেয়ে চার বছরের বড় আমি জানো তো। বাবা কেরানি ছিলেন, সে ভাল চাকরিটা গেছে। এখন সে আপিসেই দারোয়ানের কাজ করেন। দাদা বেকার বসে আছে। বিয়ের জন্য যেই আসে, আমার রং তাদের পছন্দ হয় না। আমি কালো বলে, কেউ বিয়ে করতে চায় না আমাকে। বাবার এমন পয়সাও নেই যে ছেলে কিনতে পারে। বিয়ে না হওয়া এ সমাজে কী ভয়ংকর অপরাধ নীলা, তোমার বিয়ে হয়েছে, তুমি বুঝবে না। সেই কবে বি এ পাশ করে বসে আছি। বাপমায়ের সংসারে আমি একটা বোঝা ছাড়া কিছু নই। আমি অকল্যাণ। আমার ছায়া দেখাও পাপ। বিদেশের কোনও ছেলে, আমি ধর্ম টর্ম দেখব না, যে ধর্মেরই হোক, কানা হোক, খোঁড়া হোক, যদি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়…। এ দেশে তো আমাকে বিয়ে করার কেউ নেই, পণ দেবার ক্ষমতা আমার বাবার নেই। কী করে হবে বিয়ে, বলো!

মিঠুর ডাগর চোখে জল। মিঠুর দীঘল ঘন চুল পিঠে ছড়িয়ে আছে। মিঠুর পানপাতার মতো মুখে নীল আতঙ্ক। মিঠুর মেদহীন দীর্ঘ কালো শরীরের লাবণ্য নীলা দুচোখ ভরে দেখে।

দাদাকে বলি দাদা তুমি বিয়ে করছ না কেন? দাদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তোর বিয়ে না দিয়ে কী করে করি। দাদারও তো বয়স কম হল না। আমার বিয়ে হচ্ছে না বলে নিজে বিয়ে করতে পারছে না। আমার ভয় হয় নীলা। বিয়ে হয় না বলে সমাজে মুখ দেখানো যাচ্ছে না আর।

মিঠুর হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নীলা বলে, বি এ পাশ করেছ। কোথাও চাকরি বাকরি করো। বিয়ে না হলে কী হয়? মানুষ মরে যায়?

বিয়ে কি আমি আমার জন্য চাইছি নীলা! বাবা মার মুখের দিকে তাকাতে পারি না। অন্ধকার। আমার গায়ের রং দেখি সবার মুখে। এ যে কত বড় অপরাধ আমার, আমি কালো। দূর দূর করে আমাকে তাড়ায় সবাই। নীলা, যদি কেউ বিয়ে কোরে আমাকে দাসীবাঁদির মতো রাখে রাখুক, তবু বিয়েটা করুক। যদি পাও, বুড়ো হোক, পাগল হোক…

নীলা কোনও আশাও দেয় না মিঠুকে। মিঠু তার মুখের নীল আতঙ্ক মুখে নিয়ে ফিরে যায়।

অনির্বাণ সন্ধের পর বাড়ি ফিরে নীলাকে ডাকেন। যেমন ছিলেন তিনি, তেমনই আছেন। ঘরে ফিরে আগের মতো তিনি জামা জুতো খুলে, হাত মুখ ধুয়ে, পাজামা ফতুয়া পরে বসেন সোফায়। দিনের পত্রিকায় চোখ বুলোন। নীলা যখন সামনে মুখোমুখি বসল, অনির্বাণের চোখ দিনের পত্রিকায়।

কিষানের সঙ্গে হয়েছেটা কী তোর?

কিছু হয়নি তো।

অনির্বাণ চশমা খুলে ফতুয়ার কোনায় চশমার কাচ মুছে আবার পরে নিয়ে বলেন, জীবন যে খুব অল্পদিনের, দেখছ না? তোমার মার অবস্থা তো দেখছ! জীবনের মূল্য যদি না বোঝা, যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াও, ভবিষ্যতের বারোটা বাজিয়ে যদি বসে থাকো, হঠাৎ একদিন দেখবে জীবন ফুরিয়ে গেছে। কিছুর আর সময় নেই। পালটাবার বা নতুন করে গড়ার।

মানুষটি সারা জীবন ভবিষ্যতের কথাই বলেছেন নীলা আর নিখিলকে, ঠিক এভাবে। নীলা মনে করতে চেষ্টা করে, অনির্বাণকে কখনও সে কাঁদতে দেখেছে কি না।

অনির্বাণ মন্দ্রগম্ভীর স্বরে বলেন, কিষানের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে সেদিন। ও বলল, তুমি যদি ভদ্র হয়ে থাকো, আর দশটা মেয়ের মতো স্বামীর ঘর করতে চাও, স্বামীর কথা মতো চলতে চাও, তবে সে তোমাকে ক্ষমা করবে, ঘরে নেবে। না হলে কাগজে কলমে সম্পর্ক চুকিয়ে দিতে তার কোনও আপত্তি নেই। এই সোজাসাপটা ভালমানুষটাকে খেপিয়ে দিয়েছ নীলা। দুশ্চিন্তায় আমি ঘুমোতে পারি না।

নীলা অনির্বাণের ঠোঁটের দিকে উদাস তাকিয়ে ঠোঁটের নড়াচড়া দেখতে দেখতে বলে, বাবা, তুমি কখনও কেঁদেছ?

হঠাৎ কাঁদার কথা উঠছে কেন?

উঠছে কারণ আমি ওঠাচ্ছি। আমার খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে কখনও, তোমার জীবনে, তুমি কেঁদেছ কি না। মনে করে দেখো তো, কারও জন্য কেঁদেছ কি? কারও জন্য না হলেও নিজের জন্য কেঁদেছ কি না। চোখে কখনও হঠাৎ অনুভব করেছ যে জল? ওই চোখদুটো, চশমার আড়ালে, চশমা, মাত্র যার কাচ মুছে নিয়ে পরলে, সেই চশমার আড়ালে যে চোখ, সে চোখের কথা বলছি। ওই চোখদুটো থেকে এক ফোঁটা জল কখনও ঝরেছে? বুকের মধ্যে কষ্ট হচ্ছে কোনও, দেখলে তোমার গাল ভিজে গেছে কীসে যেন, চোখে হাত দিলে, দেখলে হাত ভিজে গেল, চোখ থেকে জল গড়ালে তো এমনই হয় তাই না? হাত ভিজে যায় মুছতে গেলে। এমন হয়েছে তোমার কখনও? অথবা বালিশ, শুয়ে কাঁদলে বালিশ ভিজে যায়। এরকম হয়েছে কখনও?

পাগল হয়ে গেছিস নাকি? অনির্বাণ ধমক লাগান।

নীলার অদ্ভুত শান্ত কণ্ঠ, হ্যাঁ হয়েছি।

অনির্বাণ আবার চশমা খুলে হাতে নেন। এবার আর চশমার কাচ মোছর জন্য নয়। নীলার দিকে তীক্ষ্ণতা ছুড়ে দিতে।

অনির্বাণের দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা পরোয়া না করে নীলা বলে অনুতাপ বলে একটি শব্দ আছে কখনও শুনেছ? কখনও অনুতাপ করেছ? কখনও করোনি। করার দরকার হয়নি। মাকে বিয়ে করেছিলে, তোমার টাকার দরকার ছিল বলে। মিটেছে। পণের টাকা নিয়ে নিজে ডাক্তারি পড়েছ, ডাক্তার হয়েছ, মিটেছে। মা এ সংসারে দাসীর মতো ছিল, ছিল না কি? ছিল। তাতে লোকে কেউ কিছু বলেনি, কারণ মেয়েরা স্বামীর সংসারে দাসীর মতোই থাকে। প্রভু হবার আনন্দও ভোগ করেছ। ওদিকে আবার স্বাতী সেনকে রেখেছ তোমাকে অন্য রকম আনন্দ দিতে। লোকে এতেও মন্দ কিছু বলেনি, কারণ পুরুষদের ওরকম দু একজন কিছু মেয়েমানুষ বাইরে থাকেই, থাকাটা তেমন খারাপ কিছু নয়। লোকে তোমাকে মন্দ বলেনি, বরং দেবতা ঠাউরেছে, কালো পেঁচি বউকে কখনও তাড়িয়ে দাওনি বলে। এদিকে নিষ্ফলা নপুংসক যে নও, তারও প্রমাণ রেখেছ, দুটো ছেলেমেয়ে হইয়ে। দুটো ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করে বড় ডিগ্রি নিয়েছে, এও সাতজনকে শোনানোর বিষয়, এতেও জিতেছ। এক কানাকড়ি মেয়ের বিয়েতে পণ লাগেনি, বেঁচেছ। লোকের কাছে আরও বলার সুযোগ হয়েছে মেয়ে তোমার বিদেশে থাকে। বিদেশে কেমন আছে কেমন থাকে তা তো আর লোকে জানতে চায় না, বিদেশে থাকা মানেই ভাল থাকা। মায়ের মতো মেয়েও যেন স্বামীর দাসী হয়ে জীবন পার করে, তা হলেই ষোলো কলা পূর্ণ হয়। তা না হলে মেয়ে আবার ডিভোর্সি হয়ে বাপের বাড়ি উঠলে তো ঝামেলার শেষ নেই। ছেলে এখন বড় চাকরি করে, রাজনীতিও করে, একদিন, কে জানে হয়তো মন্ত্রী ফন্ত্রীও হয়ে বসবে। বাহ! কানায় কানায় পূর্ণ জীবন, সার্থক জীবন। অনুতাপ আর যাকে করা মানায়, তোমাকে না। তাই না বাবা?

অনির্বাণকে আর কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নীলা চলে যায় অন্য ঘরে, মলিনার ঘরে। মলিনা চোখ বুজে আছেন, নীলা কাছে বসে মলিনার হাতটিতে আঙুল বুলোতে নিয়েছে যেই, সূর্যমুখীর কুঁড়ির ফুল হয়ে ফোটার মতো মলিনার বোজা চোখ খোলে।

মা কিছু বলবে?

তোমার বাবাকে কিছু বোলো না। বিপদে আপদে তোমার বাবাই তো ভরসা। মলিনার ক্লান্ত ভাঙা স্বর।

মা, তোমাকে আমি প্যারিস নিয়ে যাব। চিকিৎসা করাব। তুমি ভাল হয়ে উঠবে। তোমাকে বলেছি না প্যারিসে কত কী আছে দেখার। সব তোমাকে দেখাব, সব।

মলিনার চোখদুটো হঠাৎ উজ্জ্বল হয়, আমি ভাল হয়ে যাব?

নিশ্চয়ই তুমি ভাল হয়ে যাবে। ওখানে কত ভাল ভাল ডাক্তার। তারপর সমুদ্রের ধারে একটা চমৎকার বাড়ি বানাব। পাহাড়ও থাকবে পেছনে। তুমি তো সমুদ্র খুব ভালবাসো, তাই না?

মলিনা শিশুর মতো মাথা নাড়েন।

এ দেশেও কত কিছু দেখার আছে। আমি তোমাকে দার্জিলিং নিয়ে যাব, সিমলা নিয়ে যাব, কাশ্মীর নেব।

মলিনা বলেন, সেই ক্লান্ত অস্ফুট স্বর, না কাশ্মীর না।

ঠিক আছে কাশ্মীর না, কাশ্মীরে গণ্ডগোল। জয়পুর যাবে না মা? গোয়াতেও তো যাবে। গোয়ার সমুদ্রে সাঁতার কাটব আমরা…

মলিনার ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে যায়। চোখদুটো বোজেন, ধীরে, তারপর জোরে। এত জোরে যে নাক চোখ মুখ সব কুঁচকে দলামোচা করা কাগজের মতো দেখতে লাগে।

নীলা মলিনাকে জড়িয়ে রাখে।

হঠাৎ মঞ্জুষা বলে চিৎকার করেন মলিনা।

মঞ্জুষামাসি নেই মা। চলে গেছেন। বলো কী লাগবে।

চিত্রা দৌড়ে আসে চিৎকার শুনে।

দিদি, মাসিমাকে ওই লাল ওষুধটা খাইয়ে দিন। চিত্রা বলে।

ব্যথার ওষুধ। দুটোর জায়গায় তিনটে বড়ি জলে গুলে খাইয়ে দেয় নীলা।

ব্যথা কমার নাম গন্ধ নেই।

নীলা নিখিলকে ডেকে তোলে, দাদা বেশ তো ঘুমোচ্ছ। মা যে ব্যথায় চিৎকার করছেন। উঠে এসো। কোন ডাক্তার দেখছে মাকে, তাকে শিগরি ডাকো!

অনির্বাণ নাক ডেকে ঘুমোচ্ছিলেন, ডেকে তোলে তাঁকেও নীলা, ডাক্তার ডাকতে বলে। অনির্বাণ ধমকে ওঠেন, এত রাতে আবার কীসের ডাক্তার!

ঘুমন্ত বাড়ির ভেতর গোঙানোর শব্দ কেবল। মলিনা সারারাত গোঙান, চিৎকারের শক্তি চলে গেছে। নীলা অসহায় বসে থাকে পাশে। মনের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে মলিনার কষ্টগুলো নিজের শরীরে নিতে চায়, চায় মলিনার সব দুঃখগুলো আলতো করে তুলে নিয়ে নিজের হৃদয়ে ধারণ করতে।

হা ফামেলিয়া

সকালে বেরোবার আগে অনির্বাণ একবার উঁকি দেন মলিনার ঘরে। নিখিলও। প্রাতরাশ সেরে, উঁকিপর্ব সেরে ঝাড়া হাত পা, সারাদিনের জন্য হাওয়া হয়ে যেতে কারও কোনও অনুশোচনা হয় না।

নীলা পথ আগলে বলে, মার এমন অসুখ রেখে সকাল হতেই গটগট করে বেরিয়ে যাচ্ছ যে সব।

চাকরি আছে না!

চাকরি? সারাজীবন তো চাকরিই করবে। মোটা বেতনের চাকরি। ছুটি নাও।

কী করব ছুটি নিয়ে। মাকে কি সারাতে পারব?

সারাতে না পারলে। পাশে থাকো। তোমাকে দেখবেন মা।

দেখবেন কী, ঘুমিয়েই তো কাটাচ্ছেন।

সময় নষ্ট কোরো না। তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। অনির্বাণ নিখিলকে তাড়া দেন।

এই বাস্তবজ্ঞানবিবর্জিত মেয়ের কথায় কান দিয়ো না নিখিল, বেরোও। একজনের জীবন থেমে আছে বলে সংসারের বাকি মানুষদের জীবন থেমে থাকবে নাকি! ভারী গলায় বলেন অনির্বাণ।

যাও। যত পারো টাকা কামাই করো গিয়ে। তোমাদের সম্ভবত থাকারও দরকার নেই। কেবল ডাক্তার পাঠিয়ে দিয়ো। না পারো, ডাক্তারের নাম ঠিকানা দিয়ে যাও। আমিই আনার ব্যবস্থা করব। নীলা বলে, ক্লান্ত কণ্ঠ।

সকালে সূর্যমুখী ফোটে।

আজ বিকেলে গঙ্গার ধারে যাবে বেড়াতে?

মলিনার মুখে শিশুর হাসি। তিনি যাবেন। বহুকাল তাঁর বাড়ির বাইরে বেরোনো হয়নি। বাড়ির বাইরে কোথাও যে একটি জগৎ আছে, বহুকাল দেখা হয়নি তাঁর।

পই পই করে নীলা কী খাচ্ছে না খাচ্ছে সে খোঁজ নেন মলিনা। স্বর ফুটতে চায় না, তবু ফোটান, চোখ বুজে আসতে চায়, তবু তিনি খুলে রাখেন। মনের জোরে রাখেন। নীলা বলে সে খুব ভাল খাচ্ছে, চিত্রা রাঁধছে খুব ভাল, কইমাছ ভাজা, পুঁইশাক, চিতলমাছের ঝোল…

ঝোলে ধনেপাতা দিয়েছে তো!

দিয়েছে মা।

নিজে তিনি কিছুই খেতে পারেন না, সারাদিনে এক কাপ দুধ যদিও মুখে নেন, তাও বমি হয়ে যায়। নীলা মলিনাকে দেখে আর ভাবে, স্বামী সন্তানদের খাইয়ে নিজে এঁটোকাঁটা খেতেন, বাসি খাবার খেতেন। সংসারে মায়েরা যা করে, মলিনা তাই করেছেন। ওই করে অসুখ বেঁধেছে। নিজের দিকে কখনও তাকাননি, নিজের সামান্য সুস্থতার দিকে, সুখের দিকে। নীলাও কোনওদিন ফিরে দেখেনি মলিনা কী খাচ্ছেন না খাচ্ছেন, মলিনার অসুখ করছে কি না। বাড়ির আর সবাই যেমন দেখেনি। এখন নীলার চেতন ফিরেছে, এখন সে মরিয়া হয়ে মলিনাকে ভাল খাওয়াতে চাচ্ছে, নিজের হাতে মুখে তুলে। মলিনাকে সে সুস্থ করে তুলতে চাইছে। কিন্তু মলিনার পক্ষে কারও কোনও স্নেহ মমতা, কারও শ্রদ্ধা সেবা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। বড় দেরি হয়ে গেছে নীলার। নীলা প্রাণপণ চায় সময়কে পিছিয়ে দিতে, পারে না। প্রাণপণ চায় নিজের ভুলগুলি শুধরে নিতে, পারে না। সময়ের সময় নেই দাঁড়াবার, এ যখন যায়, যায়। মানুষের ভুলগুলি, অন্যায়গুলি সঙ্গে নিয়েই যায়।

ডাক্তার প্রশান্ত এলেন দুপুরের পর। অনেকদিনের চর্চায় হাত বাড়িয়ে দিল করমর্দন করতে, ডাক্তারের অপ্রস্তুত মুখ দেখে হাতের আঙুল গুটিয়ে নিয়ে, যেন হাতটি আসলে করমর্দনের জন্য সে বাড়ায়নি, কোন ঘরে যেতে হবে ডাক্তারকে তা দেখাতেই কেবল হাতটি প্রসারিত করা, এর বেশি কিছু নয়, নীলা হাঁপ ছাড়ে, ভাগ্য ভাল যে ডাক্তারের গালে চুমু খাবার জন্য সে ঠোঁট বাড়িয়ে দেয়নি। তাহলে শহরে নীলার নাম ছড়িয়ে যেতে মোটে দেরি হত না যে নীলা কেবল নষ্ট হয়ে যায়নি, তার মাথায় কোনও গোলমালও দেখা দিয়েছে।

ডাক্তার মলিনার রক্তচাপ মাপলেন, নাড়ি দেখলেন, বললেন যে ওষুধ তিনি লিখে দিয়েছেন, তাতেই চলবে।

তাই চলছে না ডাক্তারবাবু। কড়া ওষুধ দিন ব্যথার। মরফিন ইঞ্জেকশন দিন।

পাকাচুলো ডাক্তার, নাকের ওপর ঘোলা চশমাটি বছর তিরিশের পুরনো বলে নীলার মনে হয়, দুপাশে মাথা নেড়ে বলেন, মরফিন এখনই না। আরও পরে।

কত পরে?

কত পরে, তা ডাক্তার বলেন না। কেবল বলেন, পরে।

মরফিন পরে দেবার কারণটি শেষ অব্দি ডাক্তার ব্যাখ্যা করেন। তাঁর ধারণা, মরফিন জিনিসটি সুবিধের নয়, এটি নিলে নেশা হয়।

নীলার বিস্ময় চোখে ধরে না। গায়ে পায়ে নামে। লোমকূপে। সারা গা তার কাঁপে ক্রোধে। যে মানুষটি যে কোনও মুহূর্তে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবেন, তাঁর জন্য করা হচ্ছে মরফিনের নেশা হওয়ার আশঙ্কা!

নীলা বলে, হোক, মরফিনের নেশা হোক আমার মার। মার কখনও কোনও নেশা ছিল না। বাড়ির আর সবার নানা রকম নেশা আছে। আমি খুব করে চাইছি আমার মা যেন মরফিনের নেশা করেন। লিখে দিন মরফিন।

ডাক্তারিতে নীতি বলে আমাদের একটা ব্যাপার আছে তো। আমরা এর বাইরে যেতে পারি না। ডাক্তার তাঁর ঘোলা চশমাটি নাক থেকে চোখের দিকে ঠেলে বললেন।

রাখুন আপনার নীতি। মরফিন লিখে দিয়ে যান। আমি মাকে ইনজেকশন দেব। নীলা তার ত্রিগুণ বয়সী ডাক্তারকে ধমক দিয়েই বলে।

এরকম নিয়ম নয় নীলা জানে। গুরুজনদের সম্মান করার শিক্ষা জন্মের পর পরই সবাই পায় এ দেশে। নীলাও পেয়েছে, গুরুজন যাহা আদেশ করিবে, তাহাই পালন করিবে। গুরুজনের চোখের দিকে তাকাইয়া কথা বলিবে না। তাহাদের সঙ্গে নিচু কণ্ঠে কথা বলিবে, উচ্চকণ্ঠে না। গুরুজন মিথ্যা বলিলেও সে মিথ্যা মানিয়া লইবে। গুরুজন মন্দ কাজ করিলেও বলিবে, ইহা মন্দ নয়, ইহা ভাল। গুরুজন ভুল করিলে কখনও তাহা শুধরাইতে যাইও না, ভুলকেই ঠিক বলিয়া মানিয়ো। গুরু যদি গোরুর মতো ব্যবহার করে, তবে চক্ষু বন্ধ করিয়া রাখিয়ো। ইত্যাদি ইত্যাদি।

নীতির জলে ডুবে ডাক্তার খাবি খাচ্ছেন। মরফিনের পরামর্শ দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না।

পশ্চিমে যে ব্যাপারটি চলছে ইদানীং, ইউদেনেশিয়া, নীলার হঠাৎ মনে হয়, মন্দ নয়। আগে সে ইউদেনেশিয়াকে চরমতম নিষ্ঠুরতাই মনে করত। আজ, তার মনে হতে থাকে, বেঁচে থাকার অধিকার যেমন মানুষের আছে, মরে যাবার অধিকারও তার থাকা উচিত। এটিও মানবাধিকার। কী লাভ বেঁচে থেকে যখন যন্ত্রণা পোহানো ছাড়া সামনে আর কিছুই থাকে না।

যাবার সময় ডাক্তার বলে যান, এত উত্তেজিত হওয়ার কী আছে! অসুখ তো হঠাৎ করে হয়নি। দীর্ঘদিনের পোষা অসুখ। একটা ফুসকুড়ি মতো ছিল অন্ত্রে, ও থেকে রক্ত যাচ্ছিল, ওটি কেটে ফেলে দিলেই হত। না ফেলার কারণেই তো ক্যান্সারে দাঁড়িয়েছে। রোগীর পরিবার নিয়ে এই এক ঝামেলা পোহাতে হয় আমাদের। সময়মতো চিকিৎসা করাবে না, সময় চলে গেলে, মাথা গরম করবে।

বিকেলে নিখিল বাড়ি ফিরে গাড়ি পাঠিয়ে দেয় অনির্বাণকে হাসপাতাল থেকে তুলে আনতে। অনির্বাণ ফিরলে নীলা বলে, রামকিরণকে অপেক্ষা করতে বলো, আমি বেরোব।

কোথায় বেরোবে?

নীলা উত্তর দেয় না। নিখিলকে বলে মলিনাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে গাড়িতে তুলতে।

নিখিলকে ধমকে থামায় অনির্বাণ। ওরও মতো পাগল হয়েছিস তুই।

নিখিলও মত দেয়, এ পাগলের মতো কথাই বটে। যে মানুষ হাঁটতে পারে না, দাঁড়াতে পারে না, উঠে বসার শক্তি নেই যার, হাত পা প্রায় অবশ, সেই মানুষকে নিয়ে গঙ্গার ধারে যাওয়া।

মরার আগেই মেরে ফেলার ফন্দি এঁটেছে নাকি!

হতবাক দাঁড়িয়ে থাকা নীলাকে টেনে বারান্দায় নেয় নিখিল, বলে, তোর হয়েছে কী বল তো! এমন পাগলামো করছিস কেন! মার শরীর তো দেখছিস! এ সময় টানাটানির কোনও মানে হয় না!

নীলা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে।

কী যে হল মার হঠাৎ! নিখিল দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

দীর্ঘশ্বাসটি, নীলার বিশ্বাস, কৃত্রিম।

মলিনা ব্যথায় চিৎকার করছেন। বারান্দা থেকে সেই কাতর চিৎকারধ্বনি শুনছে সে। তার ইচ্ছে করে না সেই ভয়ংকর কষ্টের সামনে যেতে, দেখতে দুঃসহ যন্ত্রণায় কোঁকড়ানো মুখ। বারান্দার গ্রিল শক্ত মুঠোয় ধরে রাখে সে, কোথাও সে যাবে না, এখানে দাঁড়িয়েই সে জীবনের যত দুর্ভোগ দুর্যোগ দেখা থেকে নিজেকে রক্ষা করবে। কিন্তু যায়, পেছন ফিরে যখন দেখে টেলিভিশনে ধুন্দুমার নাচ হচ্ছে, আর সোফায় পাজামা আর ফতুয়া পরে অনির্বাণ বসে আছেন, হাতে দিনের পত্রিকা, চোখ বুক কাঁপানো কোমর দুলোনো তরুণীদের নাচে, সেদিকে।

টেলিভিশনটি বন্ধ করে, অনির্বাণের নাক বরাবর বসে বলে, কাল যে বলেছিলাম, অনুতাপের কথা। অনুতাপ হয় তোমার কোনও কারণে?

কী কারণে হবে? অনির্বাণ চশমা খোলেন। আবার সেই তীক্ষ্ণ চোখ।

হবে এই কারণে যে তুমি মার চিকিৎসা করোনি। দশ বছর ধরে মার রক্ত যাচ্ছিল, অর্শরোগের কারণে রক্ত যাচ্ছে বলেছ। বলোনি? এখন তো জানো, ওই রক্ত যাওয়া কোনও অর্শরোগের কারণে ছিল না। মার যে পেটে ব্যথা হত, বলোনি, ও কিছু না! মা খামোকা আহ্লাদ করছেন! ব্যথার কথা বলে মা নাকি আসলে শুয়ে আরাম করতে চান। বলোনি? বলেছ। মা তোমার মনোযোগ পেতে মিথ্যে বলছেন, বলোনি? বলেছ। এখন তো সব বুঝেছ। অনুতাপ হয় না? একবারও অনুতাপ করো না, যখন একা বসে থাকো, একবারও মনে হয় না যে এ রোগ হত না যদি তুমি মার চিকিৎসা করতে আগে থেকে। আগে যদি অবহেলা না করতে। তুমি তো গ্যাস্ট্রোএনটারোলজির প্রফেসর ছিলে, ছিলে কী এখনও আছো, অনুতাপ হয় না? অনুতাপ হয় না একবারও যে তুমি ডাক্তার বলে মা তোমার ওপর ভরসা করে ছিলেন, আর তুমি ফিরেও তাকাওনি, বিনা চিকিৎসায় মাকে মরতে হচ্ছে। হয় তো অনুতাপ, হয় না?

চিকিৎসা তো চলেছেই, এখনও চলছে। কেমোথেরাপি কি কম দেওয়া হল! অনির্বাণ গলা চড়ান।

বাজে কথা বোলো না। কেমোথেরাপি কোনও চিকিৎসা নয়। ক্যান্সার ঘটিয়েছ, আর এখন কেমোথরাপি দিয়ে লোক ভোলাচ্ছ যে চিকিৎসা করছ। চিকিৎসা যখন করার দরকার ছিল, তখন করোনি। এ তো তুমি ভাল জানো, জানো না? অনুতাপ হয় না? নীলার কণ্ঠে ক্রোধ, চোখে ঘৃণা।

আজও আমি অনকোলজিস্ট পাঠিয়েছি।

সে তো লোক দেখানো। লোককে দেখাচ্ছ যে বড় ডাক্তার এনেছ।

অনির্বাণ নিখিলের দিকে চেয়ে সমর্থন খোঁজেন, কী বলছে এই মেয়ে, শহরের সবচেয়ে নামকরা অনকোলজিস্ট…

ফাক ইয়োর অনকোলজিস্ট।

হোয়াট?

ফাক ইয়োরসেল্ফ।

এটুকুর পর নীলা কাঁদে। বাড়ি কাঁপিয়ে কাঁদে।

কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়ে নীলা, সোফায়। ঘুম ভাঙে মলিনার চিৎকারে আর অনির্বাণের নাক ডাকায়। বাড়ির একটি ঘরে অসহনীয় যন্ত্রণায় কাঁদছেন একজন, আর অন্য ঘরে সুখনিদ্রা যাচ্ছেন আরেকজন। দীর্ঘ চল্লিশ বছর তাঁরা এক ছাদের তলে বাস করেছেন। গুমোট, এত স্তব্ধতা চারদিকে। মলিনা যেমন শরীরের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, নীলা ওই স্তব্ধতার মধ্যে একা দাঁড়িয়ে থেকে মনের যন্ত্রণায় কাতরায়। নীলার ভয় হয়। মলিনাকে স্পর্শ করতে তার ভয় হয়। বোঁ বোঁ পাখার তলে মলিনার পা বরফঠাণ্ডা হচ্ছে আর মাথায় গ্রীষ্মের মধ্যাহ্ন। আহা মলিনার কেন বিদেশি কুকুর হয়ে জন্ম নেওয়া হল না।

সকালে সূর্যমুখী চোখ ফোটে।

চিত্রা নীলাকে চা করে দে রে!

চিত্রা শুয়ে ছিল ঘরের মেঝেয় কাঁথা বিছিয়ে। কাঁথা গুটিয়ে উঠে যায় চা করতে।

দরজাটা বন্ধ করে এস তো আমার কাছে। মলিনা বলেন।

নীলা দরজা বন্ধ করে।

বালিশের তল থেকে চাবি নিয়ে আমার আলমারিটা খোলো।

মলিনার কন্ঠ মনে হয় চাঁদের দেশ থেকে আসছে। এমন ক্ষীণ।

নীলা আলমারি খোলে।

ডান দিকের ড্রয়ারে দেখো কিছু কাগজ আছে।

নীলা কাগজ নিয়ে এল।

মলিনা বললেন এটা তোমার কাছে রাখো। এটা তোমার।

নীলা কাগজ খুলে দেখে তার নামে ভেতরে কুড়ি লক্ষ টাকার চেক।

সে চমকে ওঠে, এত টাকার চেক দেখে। এত টাকা তুমি আমাকে দিচ্ছ কেন মা? নীলা দেখে মলিনার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে বালিশে। জল মুছে দিয়ে ধরা গলায় বলে, এ টাকা দিয়ে তোমার চিকিৎসা করাব মা। তুমি ভাল হবে। আবার আগের মতো হাঁটবে, গান গাইবে। মনে আছে তুমি যে গাইতে আমি অকৃতি অধম বলেও তো কিছু কম করে মোরে দাওনি, যা দিয়েছ তারি অযোগ্য ভাবিয়া কেড়েও তো কিছু নাওনি…

বালিশে জল গড়াতে থাকে মলিনার।

দেখো মা আমি গাইছি গানটি…

নীলা গাইতে থাকে মেঝেয় বসে মলিনার মাথার পাশে মাথা রেখে, ভেজা বালিশে। বালিশ ভিজতে থাকে আরও, নীলার চোখের জলে মলিনার সিঁথিতে ঝাপসা হয়ে আসা সিঁদুরও মুছতে থাকে।

নীলার গলা বুজে আসে, গান শেষ হয় না।

চাঁদের দেশ থেকে আসা স্বর আবার, দেশে থেকো, বিদেশ যেয়ো না।

বাড়িতে হুলস্থুল শুরু হয়। নিখিল জানাল, দানিয়েল নামে একটি মেয়ে ফোন করেছিল প্যারিস থেকে। সে আজ রাতে এসে পৌঁছোচ্ছে কলকাতায়। অনির্বাণ বাজার করতে গেছে, বিদেশি অতিথির জন্য ভাল মাছ মাংস কিনতে। তাছাড়া অনির্বাণের দুজন বন্ধুও দুপুরে খাবে। রাতে খাবে কিছু আত্মীয়। এক চিত্রার ওপর চাপ বেশি পড়ে যায়। খবর পাঠিয়ে চিত্রার মা মাসিকে আনা হল। নীলা দূর থেকে বাড়ির ভোজউৎসব দেখে। নিখিলের ব্যস্ততা দেখে।

আচ্ছা তোর বিদেশি অতিথি কী পান করবে? ফরাসি ওয়াইন না হলে কি চলবে? ভারতীয় ওয়াইনের ব্যবস্থা করলে হবে তো!

নীলা কাঁপা কণ্ঠে বলে, দাদা, মার পাশে একটু বসো। একটু কথা বলো মার সঙ্গে। গায়ে একটু হাত বুলিয়ে দাও।

ডাক্তার বলেছে আরও দুমাস বাঁচবে মা। নিখিল বলে।

আমার ভয় লাগছে দাদা।

নিখিল বিমানবন্দর থেকে দানিয়েলকে নিয়ে বাড়ি এল সন্ধেবেলা। বাড়িতে আত্মীয়দের ভিড়ও বেড়েছে। সবাই দেখতে এসেছে মলিনাকে। রাতের ভোজ শেষ হলে অনির্বাণ মলিনার নাড়ি টিপে এসে মলিনার দাদা আর জামাইবাবুর সঙ্গে ফিসফিস করে শ্মশানঘাট, খাটিয়া, টাকা ইত্যাদি কথা বলেন।

নীলার কানে আগুনের শলার মতো ঢোকে প্রতিটি শব্দ। একা সে পুড়তে থাকে। নীলার পোড়া কাঁধে হাত রেখে, দানিয়েল ফিসফিস করে বলে, এত দূর থেকে তোমার কাছে এলাম, দেখে একটু খুশি হলে না মনে হচ্ছে।

ফিসফিসের কোনও উত্তর দেয় না সে।

নীলার বিছানাতেই দানিয়েলের ঘুমোনোর ব্যবস্থা হয়। নীলার বান্ধবী নীলার বিছানায় ঘুমোবে, এ নিতান্তই স্বাভাবিক, পশ্চিমে সূর্য ডোবার মতো, মলিনার কষ্ট পাওয়ার মতো। দুটো বেশি বালিশ পেতে বিছানা গুছিয়ে দিয়ে আসে চিত্রা। ঘুমোতে যাবার আগে অনেক রাত অব্দি বসার ঘরে বসে দানিয়েলের সঙ্গে ফরাসি বিপ্লব, ফরাসি সুগন্ধী নিয়ে কথা বলে নিখিল আর অনির্বাণ।

নীলা একা বসে ছিল মলিনার বিছানার পাশে, দেয়ালে হেলান দিয়ে। মধ্যরাত পার হলে দানিয়েল মলিনার ঘরে বেড়ালের মতো নিঃশব্দে ঢুকে, বলে, চলো ঘুমোতে যাবে।

তুমি ঘুমোও, আমি মার কাছে বসব।

তুমি খুব ক্লান্ত নীলা, তোমার ঘুম দরকার। এভাবে না ঘুমিয়ে শরীর খারাপ করলে তোমার মার কাছেই তোমার থাকা হবে না। তোমাকে নিয়েই বাড়ির লোকেরা ব্যস্ত হবে। তার চেয়ে রাতটা ঘুমিয়ে, সকালে এসে বোসো এখানে। দানিয়েল ফিসফিস করে বলে।

বাড়িটি, নীলা দেখে, ফিসফিসে ফিসফিসে ভরে উঠছে।

দানিয়েল নীলার ক্লান্ত শরীরকে টেনে নিয়ে যায় দোতলায়।

সারারাত নীলার নিস্তরঙ্গ শরীরে দানিয়েলের তৃষ্ণার্ত জিভ খেলা করে। নীলার মরাকাঠ শরীর হঠাৎ বানের জলে ভেসে যায়। দানিয়েল নিখুঁত শিল্পীর মতো নীলার শরীরে আঁকতে থাকে ওর স্বপ্নের ছবি।

নীলা শীৎকারে, শীর্ষসুখে যখন আকণ্ঠ ডুবে আছে, ভোরের আলো এসে চুমু খাচ্ছে তার এলো চুলে, তখনই চিত্রার চিৎকার তাকে পাথর করে দেয়।

দানিয়েল বেরিয়ে যায়, হিন্দুর সৎকারউৎসব ও দেখেনি কোনওদিন। দেখবে, এ এক নতুন অভিজ্ঞতা ওর জন্য।

নীলা বিছানা থেকে ওঠে না। নিখিল এসে ডেকে যায়। চিত্রা ডাকতে এসে বলে যায়, দিদি, মাসিমা অস্থির অস্থির করছিলেন, আর নীলা নীলা বলে ডাকছিলেন। ওই ডাকেই তো আমার ঘুম ভাঙে। তারপর মাসিমাকে কত ডাকি, মাসিমা আর কথা বলেন না। চোখ খোলেন না।

চিত্রা সরে গেলে নীলা উলঙ্গ শরীরে নেমে আসে বিছানা থেকে, ঘরের দরজায় খিল এঁটে দেয়। সারাদিন দরজায় শব্দ হয়, কেউ টোকা দেয়, কেউ ধাক্কা, কেউ ওপাশ থেকে শেষবার মায়ের মুখ দেখার অনুরোধ করে, কেউ আদেশ করে, মঞ্জুষা ভাঙা গলায় করেন, মলিনার দিদি দাদা ভারী গলায় করেন, অনির্বাণও কী কারণে নীলা জানে না, ডাকতে আসেন। কারও জন্য দরজা খোলে না সে।

সারাদিন জানালার হলুদ রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে থাকে নীলা, রাস্তার ফেরিঅলার ডাক, বাস ট্রাকের চিৎকার, সৎকারউৎসবের কোলাহল কিছুই তাকে স্পর্শ করে না।

রাতে অতল নিস্তব্ধতার বুক চিরে চিত্রার মিহি কান্নার শব্দ বাড়ির গুমোট বাতাসে ভাসতে থাকে।

নীলার বুক চিরে কোনও দীর্ঘশ্বাস বেরোয় না, চোখ জ্বালা করে এক ফোঁটা জল বেলোয়।

মলিনার দুঃখগুলোর ওপর গোলাপজল ছিটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল নীলার। যেন দুঃখগুলো সুগন্ধ পেতে পেতে ঘুমিয়ে পড়ে কোথাও, ময়দানের ঘাসে, বিড়লামন্দিরের সিঁড়িতে। সন্ধেবেলা আলতো করে তুলে বাড়ির ছাদে রেখে এলে দুঃখগুলো দুঃখ ভুলে চাঁদের সঙ্গে খেলত হয়তো বুড়িছোঁয়া খেলা। দুঃখরা মলিনাকে ছেড়ে কলতলা অব্দি যায়নি কোনওদিন। যেন এরা পরম আত্মীয়, খানিকটা আড়াল হলে বিষম একা পড়ে যাবেন মলিনা, কাদায় পিছলে পড়বেন, বাঘে ভালুকে খাবে।

মলিনাকে দুঃখের হাতে সঁপে বাড়ির মানুষগুলো অসম্ভব স্বস্তি পেত। দুঃখগুলোকে পিঁড়ি দিত বসতে, চা বিস্কুট দিত। নীলার ইচ্ছে ছিল বেড়াতে নিয়ে গিয়ে মলিনার দুঃখগুলো গঙ্গার জলে, কেউ জানবে না, ভাসিয়ে দেবে একদিন। কচুরিপানার মতো, খড়কুটোর মতো, মরা সাপের মতো ভাসতে ভাসতে দুঃখরা চলে যাবে দূরে… অনেক দূরে। নীলার কোনও ইচ্ছে পূরণ হয়নি, মলিনার দুঃখগুলো মলিনার সঙ্গে শ্মশান অব্দি গেছে।

আমরা এমনি ভেসে যাই

পুরো সপ্তাহ কলকাতার রাস্তায় ঘুরে ভিড়ভাট্টা ধুলোবালি যানজট ভেঁপুতে কাতর হয়ে, ফুটপাতের আলুকাবলি খেয়ে পেটের অসুখ বাঁধিয়ে, মনিক ক্লদ ম্যাথুর পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে দুদিন আড্ডা দিয়ে, চোখ বিস্ফারিত করে নিখিলের মাতৃদায় দেখে দানিয়েল প্যারিস ফিরে গেল। যাবার আগে নীলাকে সেধেছিল যেতে। নীলা যায়নি।

অনুতাপ? তুমি তো প্যারিস থেকে নাও আসতে পারতে। তোমাকে না দেখেই সম্ভবত মলিনার যেতে হত। নিজেকে দোষী ভাবছ তো! কক্ষনও নিজেকে কোনও কিছুর জন্য দোষী ভাবতে নেই নীলা, দোষী ভাবলে জীবন আর এগোয় না। স্থবির জলাশয় হতে চাও? তা হলে ভাবো।

এসব বলে পাথরে টোকা যতই দিতে চেয়েছে দানিয়েল, পাথরে শব্দ হয়নি। ঠেলেছে, পাথর নড়েনি।

দানিয়েলের শব্দবাক্য বাড়ির পেছনের আবর্জনায় ছুঁড়ে দিয়ে নীলা বলেছে, যথেষ্ট বিরক্ত করেছ আমাকে, আর কোরো না।

নীলার এ বাক্যই দানিয়েলের জন্য যথেষ্ট ছিল পেছনে আর ফিরে না তাকাবার। কিন্তু ও দরজার কাছ থেকে ফিরে মনিক ম্যাথুর ঠিকানা লেখা কাগজটি রেখে বলে যায়, নিকলের বন্ধু মনিক। চমৎকার মহিলা। যদি প্রয়োজন মনে করো কখনও, যেয়ো।

রাতগুলো আগের চেয়েও আরও বেশি স্তব্ধতার জলে ডুবে থাকে। কেউ আর এ বাড়িতে কাতরায় না। চিত্রাও আর কাঁদে না। মলিনার ঘর থেকে মলিনার বিছানা বালিশ সব ফেলে ঘর খালি করে ধুয়ে মুছে দিয়েছে চিত্রা। অনির্বাণ সে ঘরে টেবিল পাতবেন, রোগীর শোয়ার টেবিল, চেয়ার পাতবেন চারটে কি পাঁচটা, হাসপাতাল থেকে ফিরে রাতে রোগী দেখবেন সে ঘরে। হলুদ রোদ্দুর চলে গিয়ে অন্ধকার এসে বসে জানালায়, নীলা সেই অন্ধকারের দিকেই তাকিয়ে থাকে। ঘোর অমাবস্যার দিকে নীলার চোখ স্থির হয়ে থাকে।

অমনই এক রাতে, নিখিল এসে নীলার শিয়রের কাছে বসে, পিঠে হাত রেখে নীলার, বলে, কষ্ট তো তোর একার হচ্ছে না, কষ্ট আমাদের সবারই হচ্ছে। কিন্তু কী করা যাবে, মাকে কি ফিরিয়ে আনতে পারব! পারব না। জীবন তো আমাদের যাপন করতেই হবে। এটাই তো নিয়ম, বাস্তব খুব নির্মম হয়, কিন্তু মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।

অমাবস্যার ঘোরে নাকি জ্বরের, নীলা বলতে থাকে, আমাদের একটি মা ছিল, মা আমাদের খাওয়াত, শোয়াত, ঘুম পাড়াত। গায়ে কোনও ধুলো লাগতে দিত না, পিঁপড়ে উঠতে না, মনে কোনও আঁচড় পড়তে দিত না, মাথায় কোনও চোট পেতে না। মাকে লোকেরা কালো পেঁচি বলত, আমরাও। বোকা বুদ্ধু বলে গাল দিতাম মাকে। মা কষ্ট পেত, মা কষ্ট পেলে আমাদের কিছু যায় আসত না। আমাদের কিছুতে কিছু যায় আসত না, মা জ্বরে ভুগলেও না, মা জলে পড়লেও না। মাকে মা বলে মনে হত, মানুষ বলে না। মা মানে সংসারের ঘানি টানে যে, মা মানে সবচেয়ে ভাল রাঁধে যে, বাড়ে যে, কাপড় চোপড় ধুয়ে রাখে, গুছিয়ে রাখে যে, মা মানে হাড়মাংস কালি করে সকাল সন্ধে খাটে যে, যার খেতে নেই, শুতে নেই, ঘুমোতে নেই। যার হাসতে নেই, যাকে কেবল কাঁদলে মানায়, শোকের নদীতে যার নাক অব্দি ডুবে থাকা মানায়। মা মানে যার নিজের কোনও জীবন থাকে না। মাদের নিজের কোনও জীবন থাকতে নেই। মা ব্যথায় চেঁচাতে থাকলে বলি, ও কিছু না খামোকা আহ্লাদ। মরে গেলে মাকে দিব্যি পুড়িয়ে ফেলি। ভাবি যে বিষম এক কর্তব্য পালন হল। মা নেই, এতেও আমাদের কিছু যায় আসে না।

বাজে বকিস না তো, খাবি আয়। নিখিল নীলাকে টেনে, প্রায় কোলে তুলে নিয়ে গেল খাবার টেবিলে।

অনির্বাণ আর নিখিল দুজনই তিনদিনের ছুটি নিয়েছে। তিনদিন বাড়িতে কেবল ভাত আর নিরামিষ সেদ্ধ হবে। তিনদিন পর পুরুত ডেকে মায়ের শ্রাদ্ধ দিতে হবে নীলাকে। নিখিলের মাতৃদায় চলবে পুরো এক মাস। নিখিল সেলাই ছাড়া সাদা কাপড় এক টুকরো কোমরে পেঁচিয়েছে, আরেক টুকরো গলায়, হাতে কুশাসন। যেখানেই বসবে, কুশাসন পেতে। খাবার মধ্যে দুবেলা সেদ্ধ শাকান্ন আর চিড়া মুড়ি দই। এক মাস এই শোক চলবে নিখিলের। নীলার জন্য এক মাসের নয়, শোক তিনদিনের, বিয়ে হয়েছে তার, এক বংশ থেকে আরেক বংশে গেছে, সে এখন পর, মাতৃদায় তেমন নেই। অনির্বাণও আচার অনুষ্ঠান পালন করছেন যথারীতি। মাস গেলে মলিনার শ্রাদ্ধে কত লোক নেমন্তন্ন করবেন, তারই এখন থেকে হিসেব চলছে। শ্রাদ্ধ শেষ হলে অনির্বাণ আর নিখিল দুজনেরই ব্যস্ততা বাড়বে। মৃত্যুর স্মৃতিকে পেছনে ফেলে সামনে এগোবে। পেছনের কিছুর জন্য হাহাকার করে সময় নষ্ট করার যুক্তি না দেখেন অনির্বাণ, না দেখে নিখিল। একা নীলাই কেবল জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করেছে, কী অর্থ এই জীবনের।

মলিনার ঘরে হঠাৎ ঢুকে নীলা মা মা বলে ডাকে। ডেকে সে চমকে ওঠে, খালি ঘর, একটি টিমটিমে প্রদীপ জ্বলছে ঘরের মাঝখানে। মলিনার বুকে মাথা রেখে তার শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছিল, সুশান্ত চলে যাবার পর যেমন শুয়েছিল। টেলিভিশনের বিকট শব্দ আর নিখিলের হা হা হাসির যন্ত্রণায় নীলা কুঁকড়ে যেতে থাকে, চিত্রা এসে নীলাকে প্রদীপের সামনে থেকে তোলে।

চিত্রা, মা কী বলতে চেয়েছিলেন?

তা আমি কী করে বলব দিদি।

মুখে একটু জল চাইছিলেন? ওষুধ চাইছিলেন ব্যথা কমার?

তা কী করে বলব দিদি?

মা কি আমাকে জড়িয়ে ধরতে চাইছিলেন? ভয় পাচ্ছিলেন?

মৃত্যুর সময় কেমন লাগে, কী বলতে ইচ্ছে হয়, কী করতে, তা তো আমি জানি না দিদি! যাঁরা মরেছেন তাঁরা জানেন।

মলিনা নেই বলে কটি বিষাক্ত সাপ উঠে এসেছে উঠোনে, ফিরে যাচ্ছে না জলায় বা জংলায়। কাপড়ের ভাঁজে, টাকা পয়সার ড্রয়ারে, বালিশের নীচে, গেলাসে বাটিতে, ফুলদানিতে, চৌবাচ্চায়, জলকলের মুখে ইঁদুর আর তেলাপোকার বিশাল সংসার। মলিনা নেই বলে মাধবীলতাও আর ফুটছে না। দেয়াল ঘেঁষে যে রজনীগন্ধার গাছ ছিল, কামিনীর, মরে গেছে। গোলাপবাগানে গোলাপের বদলে শুধু কাঁটা আর পোকা খাওয়া পাতা। বুড়ো জাম গাছে বিচ্ছুদের বাসা, পেয়ারা গাছটি ঝড় নেই বাতাস নেই গুঁড়িসুদ্ধ উপড়ে পড়েছে। মিষ্টি আমের গাছে একটি আমও আর ধরে না, নারকেল গাছে না একখানা নারকেল। সুপুরি গাছেদের নাচের ইস্কুল এখন বন্ধ। মলিনা নেই বলে সবজির বাগান পঙ্গপাল এসে খেয়ে গেছে, সবুজ মাঠটি ভরে গেছে খড়ে, আগাছায়।

মলিনা নেই, মলিনার না থাকা জুড়ে দাপট এখন অদ্ভুত অসুস্থতার, নীলার শ্বাসরোধ করে আনে দুষিত বাতাস, মলিনার না থাকার দৈত্য ঝাঁপিয়ে পড়ছে ঘাড়ে, মলিনার না থাকার শকুন ছিঁড়ে খাচ্ছে নীলার সর্বাঙ্গ, মলিনার না থাকার উন্মত্ত আগুন পুড়িয়ে ছাই করছে, মলিনার না থাকার সর্বগ্রাসী জল নীলাকে ডুবিয়ে নিচ্ছে। নীলাও মলিনার মতো নেই হতে চায়।

নেই হওয়ার নানা পথ আছে, মনিক ম্যাথুর বাড়ি যাওয়া নয়। কিন্তু নীলা মনিকের বাড়ি যায়।

মনিক মলিনার বয়সি। অথচ কী দিব্যি বেঁচে আছেন। হাত পায়ের প্রতিটি নখ নিখুঁত করে রাঙানো, চোখের পাতায় গাঢ় নীল রং, পাপড়িগুলোয় রঙের প্রলেপে উজ্জ্বল, গালে রং, ঠোঁটে রং, বাদামি চুলকে রাঙিয়ে সোনালি করেছেন, স্তন ফুটে বেরোচ্ছে এমন পাতলা জামা পরেছেন। নীলা কোনওদিনই মলিনাকে মুখে কোনও রং লাগাতে দেখেনি। ভয় ছিল, কালোর ওপর রং পড়লে কী জানি আরও বিদঘুটে না দেখায়। মনিক ঝটপট চা বানিয়ে আনলেন, চা খেতে খেতে বললেন, জীবনের অর্থ কী জানো? ডগলাস আদামস বলেছিলেন জীবনের অর্থ বিয়াল্লিশ, আমার মনে হয় ভুল বলেছিলেন, জীবনের অর্থ আসলে সাতচল্লিশ।

মনিক স্তন দুলিয়ে হাসেন। নীলার হাসি পায় না।

মনিক উচ্ছল উজ্জ্বল প্রাণবান মানুষ। বয়সে ছোট এক বাঙালি ছেলেকে বিয়ে করেছিলেন, সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে দিল্লি চলে যাচ্ছেন এখন। আলিয়ঁজ ফ্রসেজে ফরাসি ভাষা শেখাতেন, ভাষা শেখানো ছেড়ে ফরাসি দূতাবাসে চাকরি জুটিয়ে নিয়েছেন, তাই কলকাতার পাট চুকোতে হবে তাঁর। কিন্তু কলকাতার এই বাড়িটি বিক্রি করবেন করবেন করেও মন তাঁর সায় দিচ্ছে না।

কলকাতার মতো, বুঝলে নীলা, শহর হয় না! যদি বাস করার জন্য কোনও শহর চাও, তো কলকাতা।

নীলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

তা তুমি কি ফিরে যাচ্ছ প্যারিসে? মনিক জিজ্ঞেস করেন।

নাহ।

দুটো জার্মান শেফার্ড ঘরে দাপট দেখিয়ে হাঁটে। লুলু আর ভুলু। বিদেশি কুকুরের বাংলা নাম!

মনিকের ওই প্রেমিক ছোকরাটি নাম রেখেছে। লুলুর গলায় ভুলুর পিঠে হাত বুলিয়ে মনিক ওদের খেলতে পাঠান বাগানে।

লুলু ভুলুকে নিয়েই আমার সংসার। অনেক পুরুষের সঙ্গে সংসার করে দেখেছি, কুকুরের সঙ্গে সংসার করায় আনন্দ বেশি। কারণ বিশ্বাস হল সবচেয়ে বড় ব্যাপার। মানুষ বিশ্বাস ভাঙে, কুকুর ভাঙে না। তুমি কুকুর পোষো?

নাহ।

নীলা তার মলিন মুখ আর উদাস দুচোখ নিয়ে বসে থাকে। সুতি একটি সাদা শাড়ি গায়ে, শাড়ির আঁচল গড়াচ্ছে মেঝেয়, উড়ো খুড়ো চুল, গালের ত্বক ফেটে চৌচির, নখে পুরনো রং আধখেচড়া হয়ে আছে।

মনিক অনেকক্ষণ তাকিয়ে নীলার দিকে, বলেন, তোমাকে দেখে একটা জিনিস আমার মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, তুমি অমর! কখনও মরবে না।

নীলা আগ্রহ দেখায় না মনিকের এই মন্তব্যের ব্যাখ্যা শুনতে, কিন্তু মনিক বলে যান, চোখের সামনে কেউ মরলে তুমি এত কষ্টে কাতর হও যে মনে করতে ভুলে যাও, মানুষ লক্ষ লক্ষ প্রজাতির ভিড়ে একটি প্রজাতি। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সহস্র কোটি গ্যালাক্সির ভেতর ছোট্ট একটি গ্যালাক্সিতে সহস্র কোটি সৌরজগতের ছোট্ট একটি সৌরজগতে ছোট্ট এক গ্রহে মানুষ নামক প্রাণী বাস করছি। তুমি একটি বিন্দুর মতো, আসলে একটি বিন্দুর মতোও না, তারও চেয়ে ক্ষুদ্র, ক ফুট লম্বা তুমি, আমার চেয়ে দু ইঞ্চি বেশি যদি হও, পাঁচ ফুট ছয়। আমার চেয়ে পাঁচ কিলো যদি কম হও, ষাট কিলো, এই বিশাল মহাজগতে কোথাও দেখতে পাও তোমার অস্তিত্ব? তোমার মায়ের? মানুষের চেয়ে ওই কাদাঘাঁটা কচ্ছপ বেশিদিন বাঁচে। প্রকৃতি এমনই। প্রকৃতিকে জয় করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা আসি, যাই। আমরা এমনি এসে ভেসে যাই। এক পলকে মানুষের আয়ু ফুরোয়। হিসেব করতে পারো বিলিয়ন বিলিয়ন বছর ধরে পৃথিবীর এই মাটিতে কত কিছুর জন্ম হচ্ছে, কত কিছু বিলীন হচ্ছে। ডায়নোসর এককালে দাপটের সঙ্গে বেঁচে ছিল, কোথায় এখন তারা, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। মানুষের অস্তিত্বও একসময় আর থাকবে না, মানুষের ইতিহাসই অতীতের গর্ভে গর্তে তলিয়ে যাবে। এই মহাজগতে আমরা কেউ না, কিচ্ছু না…

মনিকের সবুজ চোখদুটো উদাস।

উদাস চোখ নিমেষে চঞ্চল হয়। আচ্ছা তুমি কি পরজন্মে বিশ্বাস করো?

নীলা মাথা নাড়ে, সে বিশ্বাস করে না।

পরজন্মে বিশ্বাসীদের একটা সান্ত্বনা থাকে, এ জীবনে তো এ কাজটা করা হল না, পরের জন্মে না হয় করব। কিন্তু যদি বিশ্বাস করো জীবন একটিই, তবে অপেক্ষা কোরো না। যার যার জীবন তার তার। সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে যায়, যা পাবে, সব গ্রহণ করবে। স্বার্থপর হবে নীলা, এ ছাড়া গতি নেই। লুফে নাও, গোগ্রাসে নাও।

মনিকের মুখ তিজেভির মতো চলে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে মখমলের সোফায় পা তুলে বসে বাগানের মিঠে রোদ্দুরে বিশ্বাসী কুকুরের খেলা দেখতে দেখতে, নীলা জানে, চমৎকার চমৎকার সব কথা বলা যায়।

হঠাৎই প্রসঙ্গ ছাড়া প্রশ্ন করে বসে নীলা, তোমার মা আছেন মনিক?

আছেন। তুলুজের এক গ্রামে থাকেন। একানব্বই বছর বয়স।

বাড়িতে আর কে কে আছে?

মা একাই থাকেন।

একা?

হ্যাঁ একা।

তুমি গিয়ে থাকো না তোমার মার সঙ্গে?

আমার সময় কোথায়? আর মাও চান না ছেলেমেয়ে গিয়ে তাঁকে বিরক্ত করুক। যার জীবন তার নীলা।

স্বনির্ভরতার অহঙ্কার কে ছাড়তে চায়? বছরে একবার ক্রিসমাসের সময় মাকে দেখতে যাওয়া হয়। তাও সব বছর হয়ে ওঠে না।

তোমার মা একা পারেন রান্নাবান্না করতে? ঘর গোছাতে?

এখনও পারছেন। না পারলে বুড়োবুড়িদের সরকারি বাড়িতে চলে যাবেন, ওখানে দেখাশোনার লোক থাকবে।

অর্ধেক বেলা মনিকের বাড়িতে কাটিয়ে নীলা যখন বাড়ি এল, নিখিল জানাল, গলায় শাড়ি পেঁচিয়ে কড়িকাঠে ঝুলে গত রাতে আত্মহত্যা করেছে মিঠু।

অ রভোয়া

মিঠুকে শুইয়ে রাখা হয়েছে মেঝেয়। লাল একটি শাড়ি পরানো হয়েছে। গলায় ফুলের মালা, কপালে চন্দন। পায়ে আলতা। মিঠু বেঁচে থাকতে নিশ্চয়ই এত সাজেনি। মিঠুর জন্য সাজ সাজ রব পড়ে গেল। মিঠুকে সাজাও, খাটিয়া সাজাও।

লোক দেখতে এসে বলে যাচ্ছে, আহা কী নিখুঁত মুখ মেয়েটির। কী টিকোলো নাক! কী দীঘল কালো চুল। আহা চিবুকের তিলটি মেয়েকে আরও মায়াবী করেছিল। মেয়েটার স্বভাব চরিত্র, কী বলব, ফুলের মতো পবিত্র ছিল। মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটত, গুরুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে কোনওদিন কথা বলেনি, বেয়াদবি করেনি। লেখাপড়া জানা মেয়েরা আজকাল কি আর আদব কায়দা মানে! কিন্তু মিঠু মানত। মিঠু একা হাতে সংসারের সব কাজ করত, এত লক্ষ্মী ছিল!

নীলা দেখে মিঠুর মা বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছেন, কাঁদছেন কিন্তু সে কাঁদায় এক ধরনের তৃপ্তি আছে।

সাধনবাবু, মিঠুর বাবাও পাঞ্জাবির খুঁটে চোখের জল মোছেন, তাঁর কপালের দুশ্চিন্তার ভাঁজগুলো আগের মতো নেই। মিঠুকে নিয়ে এখন কারও আর দুশ্চিন্তার কিছু নেই। এখন কেবল কেওড়াতলা, নিমতলা, এখন মুখাগ্নি, এখন ছাই। মিঠু এ জগৎ থেকে জন্মের মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আগুনে পোড়া তার কালো শরীরের কালো ছাই নিয়ে সংসারে কেউ দুর্ভাবনার মধ্যে পড়বেনা। মিঠু আত্মহত্যা করে কালো হওয়ার অপমান থেকে যত না বাঁচল, ওর বাপ মাকে বাঁচাল আরও, ওর দাদাকেও বাঁচাল, ওর দাদা এখন দেখে শুনে ভাল পণ নিয়ে একটি মেয়ে বিয়ে করতে পারে।

মিঠুর এই মৃত্যু নীলাকে বাকরুদ্ধ করে আবার।

নীলাকে ঠেলে সজাগ করে অনির্বাণ জানতে চান কবে সে প্যারিস ফিরছে।

প্যারিস আর যাচ্ছি না। আমি এখানেই থাকব।

এখানে কোথায়?

এখানে এই কলকাতায়।

কলকাতায় কোথায়?

এই বাড়িতে।

বিয়ের পর স্বামীর বাড়িই তোর বাড়ি। স্বামীর বাড়িতেই তোর সব অধিকার। বাপের বাড়িতে মেয়েরা বেড়াতে আসে, থাকতে না। অনির্বাণ ভারী গলায় ভারী কানুন টানেন।

নীলা তার ঘরটিতে চোখ বুলোয়। তার বিছানা বালিশ, তার বইপত্র, শাড়ি কাপড়, পুরনো চিঠি, তার শখের তানপুরা, হারমোনিয়ম সব এ ঘরেই। প্যারিসের সুটকেসের জীবনের মতো জীবন নয়, অনেক প্রসারিত।

কী কারণে নীলাকে প্যারিস যেতে হবে? কারণ হল আত্মীয়রা এমনকী পড়শিরাও কানাঘুষা করছেন, নীলা বুঝি স্বামী ছেড়ে দিয়ে এসেছে।

হ্যাঁ এসেছি। তো ওদের হয়েছে কী?

অনির্বাণ গলা ফাটিয়ে বলেন, ওদের কিছু হয়নি। হয়েছে আমার। আমার আর এ সমাজে মুখ দেখানো যাবে না। বংশের মুখে চুনকালি দিতে চাস?

স্বামীর সঙ্গে যদি আমার না মেলে, তবে এ কি চুনকালি দেওয়া হল?

হল। অনির্বাণ জোর দেন এই হল-য়।

এই সমাজে থাকতে হলে, সমাজের আর দশটা লোক যেন ভাল বলে সেভাবে থাকতে হবে। প্যারিসে স্বামীর বাড়ি ফিরে যা, নয়তো মিঠুর মতো আত্মহত্যা করে আমাদের মুক্তি দে। এই আমার শেষ কথা।

অনির্বাণ তাঁর শেষ কথা বলে চলে যাওয়ার পর নীলা বাথটাবের ঠাণ্ডা জলে শুয়ে থাকে অনেকক্ষণ। না, চোখে এক ফোঁটা জল নেই নীলার।

গভীর রাতে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে, মলিনার খালি ঘরের খালি মেঝেয় শুয়ে একটি বাহু ছড়িয়ে দিয়ে সামনে, যেমন করে প্রায় রাতে এসে মলিনার গায়ের ওপর বাহু ছড়িয়ে, নীলা ঘুমোত, ফিসফিস করে বলে, মা তুমি নেই কেন? প্রদীপের আলোয় পিঠ করে শোয়া নীলার ছায়া বিশাল দৈত্য হয়ে তাকেই ছিঁড়ে খেতে আসে। নীলা সিদ্ধান্ত নেয় সে কলকাতা ছেড়ে যাবে।

মায়ের শ্রাদ্ধটা শেষ করেই যা। অনির্বাণ থেকে শুরু করে মলিনার কাছের দূরের সব আত্মীয় বলেন।

মলিনার শ্রাদ্ধে নীলার এতটুকু আগ্রহ নেই। লোক খাওয়ানো, পুরুত খাওয়ানো, এসবে সে কোনও যুক্তি দেখে না।

তোর মার আত্মা কষ্ট পাবে, এমন করিস নে।

নীলা হেসে বলে, মার কষ্ট সয়ে অভ্যেস ছিল, মার আত্মাও কষ্ট সইতে পারবে, এ কোনও ব্যাপারই না।

যাব বলে সুটকেস গোছানো হতে পারে, কিন্তু যাওয়া অত শিগরি হয় না। টিকিটের তারিখ ঠিক করো, ব্যাঙ্কের চেক ভাঙাও, টাকা তোলো, টাকা পাঠাও, নানান ঝামেলা।

পুরনো টিকিটে প্যারিস ফেরার যাত্রা বাতিল হয়ে গেছে, সুতরাং নতুন টিকিট করা চাই। শ্রাদ্ধ অব্দি যখন থাকতে চাইছে না, ঠিক আছে, অনির্বাণ নিখিলের হাতে টাকা দেন, সস্তায় কলকাতা প্যারিস টিকিট কিনতে।

নীলা পথ আটকায় নিখিলের। ও টাকা দিয়ে দাও, আমি কিনব টিকিট।

টিকিট কিনবে টাকা কোথায় পাবে?

এ কথা গোপন থাকে না, মলিনা তাঁর বাবার সম্পত্তি যা পেয়েছিলেন, বিক্রি করে ব্যাঙ্কে রেখেছিলেন, ব্যাঙ্কের সেই কাগজপত্র মলিনার ড্রয়ারে নেই, নীলার হাতে।

কত টাকা?

কুড়ি লক্ষ।

অনির্বাণ ধপাস করে বসে পড়েন। মাথায় হাত। এত টাকা কী করবি তুই? যা দরকার কিষানলাল দেবে। এ টাকা রেখে যা, সংসারের অনেক খরচা আছে। পুরনো বাড়ি, ভেঙে নতুন করে গড়তে হবে।

এ বাড়ি তো আমার নয়, আমি এ বাড়ির কেউ নই। এ তোমাদের বাড়ি, তোমরা করো যা করার। আমার টাকায় লোভ কোরো না।

তুই কি জানিস যে আইনত এই টাকা তিন ভাগে ভাগ হবে। এক ভাগ কেবল পাবি তুই। আর কোথায় কোনও মেয়েকে শুনেছিস টাকা নিতে? সব মেয়েরাই তো ভাইকে দিয়ে দেয় নিজের ভাগ।

ভাগাভাগি করতে চাইলে মা আমার নামে লিখে দিতেন না।

লিখে দিলেই হবে। উত্তরাধিকার বলে একটা ব্যাপার আছে না?

উত্তরাধিকার বলে যে একটি ব্যাপার আছে তা অনির্বাণ মলিনার আত্মীয়দের বাড়িতে ডেকে নীলাকে বোঝাতে অনুরোধ করেন। মলিনার দিদি, জামাইবাবু, দাদা, বউদি এমনকী মঞ্জুষাও এসে মাথা নেড়ে সায় দেন, যে উত্তরাধিকার বলে একটি ব্যাপার আছে। স্বামীর ঘরে যদিও জীবন পার করে, মেয়েরা কি বাপ ভাইকে ভুলে থাকে? থাকে না। পারলে জীবন দেয়। বাপ মায়ের সম্পত্তির কিছুর ওপর কোনও মেয়েরা লোভ করে না। লোভ করলে লোকে ভাল বলে না, মেয়েদের আর কিছু থাক, লোভ থাকা মানায় না। মেয়েরা হবে নির্লোভ, নিঃস্বার্থ নির্দোষ, নিষ্পাপ, নির্বিরোধ, নিবেদিত, নিখাদ, নিভৃত, নির্মল, নিরহঙ্কার, নির্ঝঞ্ঝাট…

মলিনারও কাণ্ড, মাথার ঠিক ছিল না, কী করতে কী করেছেন, এসব কি ধরতে আছে! না কি এ সই মলিনার নয়, হবে হয়তো, মলিনাকে ফুসলিয়ে বা নিজেই নকল সই দিয়ে কাজগুলো নীলা তলে তলে করেছে। আর যদি সই সত্যিকার সই-ই হয়, এত টাকা প্যারিস নিয়ে নষ্ট করার কোনও মানে হয় না। কিষানলাল তো আর এমন নয়, যে টাকা কম কামায়, দুটো রেস্তোরাঁর ব্যবসা, বহাল তবিয়তে আছে। আর যদি গোঁই ধরে, ঠিক আছে, টাকা কলকাতার ব্যাঙ্কে রেখে দিক, বিপদ আপদের কথা তো বলা যায় না, নয়তো এখানে একটা বাড়ি কিনে রাখুক, ভাড়ার টাকা নীলার ব্যাঙ্কে জমা থাকবে। লোকে বিদেশ গিয়ে টাকা রোজগার করে দেশে টাকা পাঠায়। কেউ দেশের টাকা বিদেশে খরচার জন্য নেয় না।

নীলা কি পাগল?

নীলা বলে, হ্যাঁ সে পাগল।

পাগলকে কে সামাল দেবে!

নীলার ধারণা, দেখতে খারাপ দেখায় বলে, অনির্বাণ নিখিলকে পরামর্শ দেননি নীলার বিরুদ্ধে মামলা করতে। মাঝে মাঝে সমাজের চোখের কারণে অনেক অন্যায়কেই থাবা গুটোতে হয়। এতে কপাল ভাল থাকলে বেঁচে যাওয়া যায়, নীলা যেমন বাঁচে। তবে ব্যাঙ্কগুলো নীলার জুতোর সুকতলি খসিয়ে ছাড়ে, মাড়োয়ারি ব্যাঙ্কারের মুখে প্রতিদিন খই ফোটে, এত টাকা দেশ থেকে চলে যাবে, এ কি মুখের কথা, কেন যাবে, কোথায় যাবে, কী কারণ, এত টাকা কোত্থেকে এল, করের কাগজ কোথায়, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমতি নিয়ে এসো, দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজানো হচ্ছে। ইত্যাদি ইত্যাদি।

জুতোর সুকতলি খসিয়ে অন্তত একটি ব্যাপার নীলা সম্ভব করতে পারে, হাজার পঞ্চাশেক টাকা সে তুলতে পারে, বাকিটা তার প্যারিসের ব্যাঙ্কে পাঠাতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও ঠিকঠিক জমা দিতে পারে, যদিও কবে টাকাটা প্যারিস পৌঁছবে, সে সম্পর্কে মাড়োয়ারি সঠিক কিছু বলতে পারেনি। অনিশ্চয়তার হাতে ভবিষ্যৎ ছেড়ে দিয়ে নীলা টিকিট কেনে।

প্রতিদিন বিমান যায় না কলকাতা থেকে প্যারিস, গেলে নীলা সেদিনই কে এল এম-এ চড়ে বসত। দিল্লি বোম্বেতে যে সুবিধে তা কলকাতায় নেই। দিন দিন পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে পড়ছে ভারতের আর সব রাজ্য থেকে। এখানকার বাঙালি বাবুরা বাণিজ্যে মন না দিয়ে লেখাপড়ায় মন দেন বেশি, রাজনীতিও ভিন্ন, সমাজতন্ত্রের জয়জয়কার, যে দলই কেন্দ্রে যায়, চুলের মুঠি ধরে সমাজতন্ত্রকে নামাতে চায় পশ্চিমবঙ্গের মঞ্চ থেকে, আর নামাতে গেলে রাস্তাঘাট থাকা চাই ভাঙা, কলকারখানা থাকা চাই অচল, বিমানবন্দরে চাই যত কম বিমান, অর্থনীতি ধসিয়ে সমাজতন্ত্র ভাঙার ঝনঝন শব্দ শুনতে কান পেতে আছে কেন্দ্রের বাবা।

দু সপ্তাহ অপেক্ষা করা ছাড়া নীলার গতি নেই। দু সপ্তাহ নীলার কাছে দু বছর মতো সময় মনে হয়। নীলা পালাতে চায় এই নোংরা সমাজ থেকে। কলকাতাকে তার আর আপন মনে হয় না, এ শহরে তার জন্ম, এ শহরে কেটেছে তার শৈশব কৈশোর, অথচ এ শহরকেই তার মনে হতে থাকে সবচেয়ে অচেনা, যেন এ শহরের সঙ্গে কোনওদিন তার কোনও ভাব ছিল না, এ শহরের ধুলোয় শরীর মেখে সে খেলেনি কোনওদিন, গঙ্গার হাওয়ার সঙ্গে মনে মনে তার কোনওদিন কোনও কথা হয়নি। কলকাতা এখন নীলার কাছে আস্ত একটি শ্মশান, যে শ্মশানে দাঁড়িয়ে প্রতিরাতে একটি কুকুর কাঁদে, আর কোণে নেশাগ্রস্ত পড়ে থাকে চিতা জ্বালানোর কজন লোক। কলকাতা ছিল মলিনার ধনেখালি শাড়ির আঁচল, যে আঁচলে ঘাম মুছে, চোখের জল মুছে দাঁড়িয়ে থাকতেন মলিনা, দরজায়। কলকাতা ছিল মলিনার গভীর কালো চোখ, যে চোখ ডানা মেলে উড়ে যেত, রোদ্দুরে, রাত্তিরে, যেখানেই নীলা ভাসে, ডোবে, পাড় পায়, খুঁজত নীলাকে। কলকাতা ছিল মলিনার এলো চুলের হাতখোঁপা, ভেঙে পড়ত, হেলে পড়ত, রাজ্যির শরম ঢাকত নীলার। কলকাতা ছিল মলিনার হাতে সর্ষের তেলে মাখা মুড়ি, মেঘলা দিনে ভাজা ইলিশ, ভুনি খিচুড়ি। কলকাতা ছিল মলিনার হাতের ছ জোড়া রঙিন চুড়ি। কলকাতা ছিল বাড়ির আঙিনায় মা মা বলে ডাকার আনন্দ। কনকনে শীতে মলিনার কাঁথার তলে গুটিসুটি শুয়ে পড়া, ভোরবেলা শিউলি ছাওয়া মাঠে বসে ঝাল পিঠে খাওয়া, অন্ধকারে মুড়ে, দূরে, নৈঃশব্দ্যের তলে মাটি খুঁড়ে কলকাতাকে পুরে, পালিয়েছে কারা যেন, কলকাতা বলে কেউ নেই এখন, কিছু নেই নীলার। খাঁ খাঁ একটি শ্মশান সামনে, একটি কুকুর, আর কজন নেশাগ্রস্ত লোক।

ফোঁসকা পড়া গরমে ঘেমে নেয়ে মনিকের ছায়ায় মায়ায় আশ্রয় নেয় নীলা।

কলকাতার নয়, ফরাসি দেশের গল্প বলো মনিক।

মনিক লাল অমৃতে ডুবে ফরাসি দেশের গল্প বলেন। অলস দুপুর জুড়ে লুলু ভুলু বারান্দায়, মনিকের গাড়ির চালক সুরঞ্জিত আগুনের হলকা থেকে গা বাঁচাতে গাছের ছায়ায়, রাঁধুনি বিন্দিয়া গুনগুনাচ্ছে, বিনুনি বাঁধছে, মালি হরিদাস লুলু ভুলুর পাশে গল্প বলা দাদার মতো শুয়ে আছে। আর ঠাণ্ডা ঘরে বসে মনিকের সবুজ চোখ ঝলমলিয়ে ওঠে গল্প বলতে বলতে। দক্ষিণ ফ্রান্সের শাতো মনতান-এ তার পূর্বপুরুষের বাস ছিল, এখনও সেই শাতোয় গিয়ে সেই হরিণ মাথার দিকে, সেই নিখুঁত তাপেসিরি পলকহীন চোখে দেখে। মনিকের প্রতি লোমকুপ থেকে ছিটকে বেরোতে থাকে আভিজাত্যের অহংকার। পরক্ষণেই, শাতো মনতান ভেঙে পড়ার নির্মম দৃশ্য কল্পনা করে তাঁর লোমকূপ বুজে যেতে থাকে, বাস্তিল ভাঙার দৃশ্য যেন তিনি নিজের চোখে দেখছেন, বিপ্লবের বিকট চিৎকার যেন নিজের কানে শুনছেন, কেঁপে ওঠে মনিকের স্তনজোড়া, ভয়ে।

তারপর তো ওই, ইগালিতে। ইগালিতে শব্দটি দুবার উচ্চারণ করেন তিনি।

আমি কাল দিল্লি যাচ্ছি তিনদিনের জন্য, কিন্তু বিষম দুশ্চিন্তায় পড়েছি। এই তিনদিন লুলু ভুলুকে খাওয়ানোর লোক পাচ্ছি না। মনিকের চোখে শ্যাওলা রঙের দুশ্চিন্তা।

তুমি এ কাজটা করবে নীলা? তোমাকে আমি চাবি দিয়ে যাচ্ছি। দেখিয়ে দিচ্ছি কোথায় খাবারগুলো রাখা, রেফ্রিজারেটরে কিছু, বাইরে কিছু, দু বোতল বিশুদ্ধ জল। তিনবার জল বদলাবে, আর খাবার দেবে দু বেলা।

নিশ্চয়ই করব। এ কোনও ব্যাপার হল! কিন্তু…

কিন্তু কী?

বিন্দিয়া, হরিদাস, আর ওই সুরঞ্জিত,ওরা থাকছে না?

তা থাকছে।

মনিক সিগারেট ধরান। ধোঁয়া ছুঁড়ে দিয়ে দেয়ালে টাঙানো সুনীল দাসের ঘোড়ায়, বলেন, থাকছে কিন্তু…

কিন্তু কী?

কিন্তু আমার লুলু ভুলু তো এখানকার কুকুরদের মতো আবর্জনা খায় না, ফেলে দেওয়া হাড় হাড্ডিও খায় না। ওদের জন্য প্যারিস থেকে প্যাকেটের খাবার আসে।

তো?

আমার সন্দেহ হয়, ওরা লুলু ভুলুকে খাওয়াবে না। মনিক গলা নিচু করে বলেন।

নীলা উৎসুক জানতে, খাওয়াবে না কেন?

কারণ ওরা নিজেরা ও খাবার খেয়ে ফেলবে।

নিজেরাই খেয়ে নেবে? বলো কী! কখনও খেয়েছে আগে?

খায়নি।

তবে?

খেতে পারে।

বিশ্বাস কী! খেতে পারে।

নীলা বিষম এক বিবমিষা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।

বাড়ির উঠোনে সেদ্ধ ভাত ছড়িয়ে নিখিল আকাশে তাকিয়ে কা কা কা কা করছে।

কা কা শব্দ শুনে কাক এসে ছড়ানো ভাত খাবে, তারপর নিখিল খাবে। মাতৃদায় সহজ জিনিস নয়, কাককে খাইয়ে তবে নিজে খেতে হয়।

নিখিলের পেছনে দাঁড়িয়ে নীলা বলে, আচ্ছা তুমি কি সত্যিই বিশ্বাস করো যে মা কাক হয়ে গেছেন?

পাগল নাকি তুই? নিয়ম, তাই করতে হয়। নিখিল আকাশ থেকে মুখ না ফিরিয়ে বলে।

নিজেকে কমুনিস্ট বলো, আবার তারাপীঠের মন্দিরে গিয়ে ফুল দাও, খাবার আগে কাক খাওয়াও! মেলে না কিছু। নীলা মরা সবজি বাগানে একটি পচা টমাটো পায়ে চটকে বলে।

শুনে নিখিল শুকনো ঠোঁটে হাসে। নীলা টেনে নিয়ে যায় নিখিলকে ঘরের ভেতর। গলার ধড়া খুলে নেয় এক টানে, ইস কী অবস্থা, এই পরেই স্নান করছ, গায়েই এই কাপড় শুকোচ্ছ! জামা পরো তো, খোলো এসব। এভাবে মায়ের ঋণ থেকে মুক্ত হওয়া যায় না। যত্তসব অদ্ভুত রীতি। যাও স্নান করে এসো, জামা জুতো পরে এসো, চলো কোনও ভাল রেস্তোরাঁয় গিয়ে খেয়ে আসি।

বাদ দে। আর কটা দিন মাত্র আছে। নিখিল ক্লান্ত গলায় বলে। সে যাবে না কোথাও, সেদ্ধ শাকান্নই খাবে।

তবে কাকের আগে নিজে খাও। নীলা নিখিলের মুখের ভেতর খাবার ঠেলে দেয়।

খেয়ে, ঘরের গুমোট গরম থেকে বেরিয়ে মাঠে ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে বসে নিখিল। চমৎকার হাওয়া দিচ্ছে।

নীলাও পাশে এসে বসে।

দাদা সত্যি করে বলো তো, তুমি কি এই ধর্ম কর্ম হিন্দু আচার এসব আসলেই বিশ্বাস করো?

এসব কি বিশ্বাসের জিনিস?

তা হলে করো কেন?

এক ধরনের মজা আছে এসবে।

মজা? আমি তো কোনও মজা দেখি না। যুক্তিহীন জিনিস সব। ফালতু আবেগ।

ধর, আজ যদি পুজো উঠে যায়, তোর কি ভাল লাগবে? খালি খালি লাগবে না? উৎসবের আনন্দ আর কোথায় পাবি।

তোমার মনে আছে দাদা, এই মাঠে আমরা যখন লুকোচুরি খেলতাম, তুমি ওই বেদিটার পেছনে বেশির ভাগ সময় লুকোতে! আর তোমাকে সবার আগে খুঁজে পেতাম আমি।

তোর লুকোনো ছিল অন্যরকম। আমগাছের মগডালে।

মনে আছে সেই প্রফুল্লদের বাড়ির পেয়ারাগাছের কথা? তুমি গিয়ে সব পাকা পেয়ারাগুলো চুরি করে আনলে..আর প্রফুল্ল বাবার কাছে বিচার নিয়ে এল।

নিখিল হা হা হাসে।

কেমন লেগেছিল বাবার পিটুনিগুলো? উফ।

আর রাতে, পূর্ণিমা রাতে, এত বাড়িঘর ওঠেনি তখন আশপাশে, মা মাঠে বসে রজনীকান্তের গান গাইতেন, সে কী চমৎকার গানের গলা ছিল মার…

অনেকক্ষণ দুজনের কেউ কোনও কথা বলে না।

সূর্যাস্তের আকাশের লালচে রঙের দিকে উদাস তাকিয়ে নীলা নীরবতা ভাঙে, জানো দাদা, মা একদিন ফিরে আসবেন। ফিরে কলতলায় পায়ের কাদা ধুতে ধুতে বলবেন, হঠাৎ দার্জিলিং গিয়েছিলাম, তোরা সব ভাল ছিলি তো! দার্জিলিঙের গল্প শোনাতে শোনাতে মা আমাদের খাওয়াবেন রাতে, নেপথলিনের গন্ধঅলা লাল পাড় শাড়ি পরে এই মাঠে বসে মা আমাদের আগের মতো গান শোনাবেন…

নীলা চকিতে উঠে দাঁড়ায়, বলে, আজ রাস্তায় দেখলাম, পঁচাশি বছরের এক বুড়ো হেঁটে যাচ্ছে। ওর কী দরকার ছিল বেঁচে থাকার। কাউকে বাঁচতে দেখলে অসম্ভব রাগ হয় আমার। পৃথিবীর সব গাছ যদি মরে কাঠ হয়ে যেত, পাহাড়গুলো ধসে যেত বাড়িঘরের ওপর, নদী সমুদ্র শুকিয়ে চর হয়ে যেত, সেই চরে পশুপাখি মানুষ এক বিষম অসুখে কাতারে কাতারে মরে যেত! আর এই কুৎসিত পৃথিবীটা যদি মহাকাশে ছিঁড়ে পড়ত হঠাৎ, সুর্যের দু হাত কাছে গিয়ে ঝলসে যেত, ছাই হয়ে যেত।

নীলা খেয়াল করে তার গা কাঁপছে। শিথিল হয়ে যাচ্ছে সমস্ত শরীর। নিখিলের পাশে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে সে, ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, জানো দাদা, আমার খুব একা লাগে। ভীষণ একা লাগে।

তুই কি সত্যি প্যারিস চলে যাচ্ছিস?

আমার কি না যেয়ে উপায় আছে, দাদা?

কবে ফিরবি?

কোথায়?

কোথায় আবার? কলকাতায়।

নীলা উত্তর দেয় না।

বাবার কথায় রাগ করেছিস তো! তুই চলে গেলে আবার ঠিক ঠিকই ভেবে মরবেন, কেমন আছিস ওখানে, সুখে আছিস তো!

সুখ! দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে আসে সুখ শব্দটি।

বাবা জানেন না কিষানলাল যে বিয়ে করেছিল আগে। আমি সেদিন মাত্র জানলাম, সুনীল বলল। কাউকে বলিনি।

বোলো না। কী দরকার। বাবা আবার চুনকালির ভয়ে অতিষ্ঠ হবেন।

তুই সে কারণেই কিষানকে ছেড়ে গিয়েছিলি, তাই বলল সুনীল। ও বিয়ে নাকি অনেকটা পাতানো বিয়ে ছিল, নাগরিকত্ব পাবার জন্য। ওটাকে ধরিস না।

ধরছি না।

এবার গিয়ে ভাল একটা শ্যানেল পাঠাস তো, আগে যেটা পাঠিয়েছিলি, নকল ছিল।

নকল কী করে বুঝলে?

মোটে গন্ধ নেই। কলকাতা থেকে যে শ্যানেল কিনি, ওতে কড়া গন্ধ থাকে।

আমি যেটা পাঠিয়েছিলাম, সেটাই আসল শ্যানেল।

ওটা কবেই ফেলে দিয়েছি।

আসল ফেলে নকলটা ব্যবহার করছ তো! আমার অতগুলো টাকা জলে ফেললে।

নীলার ভাল লাগছিল ওভাবে ঘাসে শুয়ে থাকতে। ফুরফুরে হাওয়ায় নীলার চুল উড়ছিল। পাখিরা ঝাঁক বেঁধে ঘরে ফিরছে। পাঁচিলের ওপর প্রতিবেশীর দুটো বেড়াল বসে ছিল, ওরাও লেজ গুটিয়ে ফিরে যাচ্ছে।

নিখিলও একসময় বলে, যাই ইন্টারনেটে চ্যাট করি গিয়ে।

নীলা শুয়ে থাকে ঘাসে। আকাশে একটি একটি তারা ফুটতে থাকে, আর নীলা একটি উজ্জ্বল তারা খোঁজে। নীলা যখন ঘোট, মলিনা একবার বলেছিলেন, মানুষ মরে গেলে আকাশে তারা হয়ে ফুটে থাকে।

নীলার যাবার দিন, মঞ্জুষা এসে নীলার সুটকেস গুছিয়ে দিতে দিতে বারবারই বলেন, মানিয়ে থাকিস কিষানলালের সঙ্গে। বিয়ে তো তোকে জোর করে কেউ দেয়নি, তোর নিজের ইচ্ছেতেই হয়েছে।

অনির্বাণ প্যারিসে ফোন করে কিষানলালকে জানিয়ে দেন নীলা কখন কটায় গিয়ে পৌঁছবে। পিতার কর্তব্য করেন তিনি।

বিমানবন্দরের ভেতরে ঢোকার আগে, নিখিল পকেট থেকে একটি কৌটো বের করে নীলার হাতে দেয়, এটা রাখ।

কী এটা?

মার ছাই।

মা আমার কাছে মা, ছাই নয়। নীলা ফিরিয়ে দেয় কৌটো।

বিমানে ঢুকে চেয়ারে হেলান দিয়ে কলকাতাকে অ রভোয়া বলে নীলা।

তারপর জিজ্ঞেস করে নিজেকে, নীলা তুমি জানো তুমি কোথায় যাচ্ছ? কার কাছে যাচ্ছ?

নিজেকেই উত্তর দেয় সে, না।

তুমি কি জানো তোমার এই জীবন নিয়ে কী করবে তুমি?

না।

বেনোয়া দুপঁ

দমদম থেকে শার্ল দ্য গোল।

মাঝখানে বেনোয়া দুপঁ ঘটে যায়।

নীলা বসেছিল জানালার ধারে, পাশের আসনে বেনোয়া। সোনালি চুলের বেনোয়া। নীল চোখের বেনোয়া। গোলাপি ঠোঁটের বেনোয়া। ফরাসি যুবক বেনোয়া। ছ ফুট তিন ইঞ্চি বেনোয়া। নীল জিনস বেনোয়া। সাদা টিশার্ট বেনোয়া। কালো বুটজুতো বেনোয়া। ম্যাক ল্যাপটপ বেনোয়া।

চোখে চঞ্চলতা বেনোয়ার, বারবার নীলায়, নীলার উদাস চোখে, এলো চুলে, গালের কালো তিলে, কপালের ছোট্ট কাটা দাগে। মাথার ওপরের ছোট আলো ল্যাপটপে আর বেনোয়ার চোখের আলো নীলায়, জানালায় মাথা রেখে বাইরের অদ্ভুত অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকা নীলায়। অন্ধকার সরিয়ে উজ্জ্বল একটি তারা খোঁজা নীলায়।

সাদা মেঘবালিকারা পাখির মতো উড়ে উড়ে যাচ্ছে কোথাও, বাড়ি ফিরছে! সবাই বাড়ি ফেরে, মেঘেরাও, কেবল নীলাই ফেরে না।

রাতের খাবার নিয়ে এলে, নীলা বলে দেয় সে খাবে না।

বেনোয়া শুরু করে এভাবে, অন্ধকারে কী দেখছেন এত?

আমাকে বলছেন?

হ্যাঁ আপনাকেই।

ম্লান হেসে বলে নীলা, অন্ধকারে অন্ধকার দেখছি।

অন্ধকারে কিছু কি দেখা যায়?

যায়, অন্ধকার দেখা যায়।

অদ্ভুত।

অন্ধকারেরও রূপ আছে। অন্যরকম।

বেনোয়া শ্যাম্পেন পান করে ধীরে। বলে, আমার দেখা হয়নি কোনওদিন।

শ্যাম্পেন শেষ করে খাবার খেতে খেতে বেনোয়া আবার বলে, এই বিমানে সম্ভবত আর কেউ নেই যে কিছু খাচ্ছে না, পান করছে না। কেবল অন্ধকার দেখছে।

নীলা ফেরে না।

প্যারিস যাচ্ছেন বেড়াতে?

নীলা ফেরে না।

দুঃখিত, আমি বোধহয় আপনাকে বিরক্ত করছি।

নীলা ফেরে, কিছু বলছেন আমাকে?

প্যারিস যাচ্ছেন বেড়াতে?

নাহ!

তবে?

থাকতে।

প্যারিসে কী করছেন, লেখাপড়া?

না।

চাকরি?

না।

বেনোয়ার চোখে নীল কৌতূহল, তার চোখের নীল মণির সঙ্গে গাঢ় নীল হয়ে সেঁটে থাকে।

ওখানে কি একা থাকেন? না কি সংসার আছে?

নীলা উত্তর দেয় না।

ওখানে আত্মীয় আছে?

নীলা মাথা নাড়ে। নেই।

তবে কে আছে?

কেউ নেই।

তাহলে বলুন একা থাকেন ওখানে।

খাওয়া শেষ হওয়ার পরও বেনোয়া লাল ওয়াইনের নতুন বোতল নেয়।

আমি বেনোয়া দুপঁ।

নীলা মাথা নাড়ে, শুনেছে সে যে সে বেনোয়া দুপঁ।

আপনি? আপনার নাম?

নীলা।

নীলা, দ্যা ভারতীয় সুন্দরী।

নীলা স্পষ্ট বুঝতে পারে, বেনোয়া দুপঁ তার সঙ্গে কথা বলতে চায় আরও। এরকম হয়, দীর্ঘ বিমানযাত্রায় একঠায় বসে থাকা ক্লান্তিকর বলে পাশের যাত্রীকে কোথায় যাওয়া হচ্ছে, কেন যাওয়া হচ্ছে, কী করা হয়, কোথায় থাকা হয়, বিয়ে হয়েছে কি না, বিয়ে হলে বাচ্চা কাচ্চা হয়েছে কি না, বাচ্চা কাচ্চা হলে বয়স কার কত, কী খেতে পছন্দ, কী গান পছন্দ, কোনও বিশেষ শখ আছে কি না, থাকলে কী, যদি কোনও বইয়ে চোখ বুলোতে থাকে পাশের জন, কী বই এটা, কার লেখা, এই লেখক আর কী বই লিখেছে, কোনটা তার পড়া হয়েছে, কোনটি হয়নি জিজ্ঞেস করে বারো ঘণ্টার যাত্রাকে কমিয়ে অন্তত দু ঘণ্টায় আনা যায়। বেনোয়া দুপঁ এই একঘেয়ে বসে থাকার চেয়ে পাশের রহস্যময়ীর রহস্য উদ্ধারে ব্যস্ত হতে চাইছে। গতবার প্যারিস যাওয়ার সময়, নীলার পাশের আসনে বসে থাকা ওলন্দাজ মেয়েকে নীলা এরকমই প্রশ্ন করেছিল, যত না একঘেয়েমি কাটাতে তার চেয়ে বেশি সাদা রঙের আকর্ষণে, সাদা রং কী করে, কী খায়। বয়স তেতাল্লিশ গাব্রিয়েলার, পাঁচ বছর ধরে ভারত থেকে কাপড় কিনে নিয়ে যায় নিজের দেশে বিক্রি করতে, কেবল কাপড় নয়, পাথরের মালা, দুল, আগরবাতি, শিবমূর্তি। কত টাকায় কেনে, কত লাভ হয়, কত টাকা বাড়িভাড়া দিতে হয় তার, কত টাকা খাওয়ার খরচা, কত যায় ভ্রমণে এসবের হিসেবও দিয়েছিল, আরও ব্যক্তিগততে গিয়ে বলেছিল, বিয়ে থা করেনি সে, একা থাকে, তবে একেবারে একাও নয়, মাঝে মাঝে প্রেম হয়, প্রেমিকের সঙ্গে দুবছর একবছর কাটানোও হয়, গাব্রিয়েলার শেষ প্রেমিক ছিল আবু নাসের, মিশরের ছেলে, মাস দুই পর নাসেরকে সে বলেছে ব্যস, যথেষ্ট হয়েছে, এবার বিদেয় হও, নাসের বিদেয় হওয়ার লোক ছিল না, শেষে পুলিশ ডেকে বিদেয় করতে হয়েছে। তারপর গভীর ব্যক্তিগততে গিয়ে বলেছিল, নাসের দুমিনিটে কাত। হা হা। কখনও গেছ আমস্টারডামে? না। কী আছে দেখার? পতিতা। পতিতা দেখার জিনিস? নিশ্চয়ই। রাস্তার কিনারে সারি সারি কাচের ঘরে পতিতারা উলঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকে, তাই দেখতে লক্ষ লোকের ভিড় হয় ও শহরে। নীলা ওয়াক করে। আর কী আছে দেখার? আর দেখার আছে স্বাধীনতা। কী রকম? উড়ে বেড়াবার। মারিহুয়ানার ধোঁয়া পিঠে দুটো পাখা বসিয়ে দেয়, তারপর শহর জুড়ে উড়ে বেড়াও, নেচে বেড়াও হা হা। বিমান থামলে সেই গাব্রিয়েলা বাই বলে নেমে গেল, পেছন ফেরেনি, নীলার ঠিকানাও নেয়নি, নিজেরটিও দেয়নি। প্যারিস থেকে কলকাতা যাবার পথেও প্রায় ওরকম হয়েছিল। নীলার পাশে এক শিখ যুবক তার জীবনের শুরু থেকে শেষ অব্দি নিজের জীবনের সব গল্প বলে নীলার গল্প শুনে গুরুনানকের জীবনের নানা দর্শন বর্ণনা করে কলকাতায় নেমে গেল। নীলা জানে ওই শিখের সঙ্গে নীলার আর কখনও দেখা হবে না, শিখের নামটিও নীলার জানা হয়নি। সে জানে নাগাড়ে বারো ঘণ্টা বসে থাকাকে কেবল বসে থাকা যেন না মনে হয় সে কারণে গল্প বলা এবং শোনা।

জানে বলে এ যাত্রায় নীলা কোনও আগ্রহ দেখায় না বেনোয়ার লাগামছাড়া উৎসাহের।

বেনোয়া এই প্রথম ভারতে এল, ভারতের দিল্লিতে নেমেছিল, আগ্রা ঘুরে চন্দননগর গেছে, চন্দননগর থেকে কলকাতা, ওখানে দুদিন কাটিয়ে ফিরে যাচ্ছে প্যারিসে। ভালয় ভালয় ফিরছে, অসুখ বিসুখ কিছু করেনি। অবশ্য প্যারিসের ডাক্তার তাকে ভারতে যাবার আগেই ম্যালেরিয়া থেকে শুরু করে যত রোগ শোক আছে পৃথিবীতে সব কিছুর প্রতিরোধক দিয়েছিল। আফ্রিকা যাবার বেলাতেও তাই হয়েছিল বেনোয়ার।

আমার তো কোথাও গেলে ওষুধ লাগে না। আপনার লাগে কেন?

আমাদের লাগে।

আপনাদের মানে?

ইয়োরোপিয়ানদের। সাদাদের।

ও।

আচ্ছা, ভারতীয় মেয়েরা এত সুন্দরী হয় কেন?

নীলা চমকায় প্রশ্ন শুনে। কিন্তু এটিই প্রশ্ন বেনোয়ার, ভারতীয় মেয়েরা কেন এত সুন্দরী!

কই আমি তো সুন্দরী নই!

বেনোয়া হাসে।

ভারতীয় মেয়েদের যে এত মিথ্যে বলার অভ্যেস আছে, তা অবশ্য আমার জানা ছিল না।

বেনোয়া তার ভারত সফরে কোথায় কত মেয়ে দেখেছে, এবং কোথায় কোন মেয়েকে দেখে মনে হয়েছে, ভগবান নিজের হাতে তৈরি করেছেন, এবং রাস্তায় ভিখিরি মেয়েদের থেকেও সে চোখ ফেরাতে পারেনি, এসব বলে বলে নীলাকে বাইরের অন্ধকার থেকে ফেরায় এবং শেষে একটি কথাই জোর দিয়ে বলে যে এ তার অনেক বড় সৌভাগ্য যে সে একজন ভারতীয় মেয়ের পাশে বসে আছে এবং কথা বলছে। কিন্তু সে একাই বকবক করছে, নীলা যদি কেবল হ্যাঁ না বা আচ্ছা ছাড়া আরও কিছু বলে, কিছু পূর্ণ বাক্য টাক্য, বেনোয়া দুপঁর জীবন সার্থক হবে।

আমি সুন্দরী হব কেন? আমি তো সাদা নই।

সাদা মেয়েরা বুঝি সুন্দরী? সাদা মেয়েরা ফ্যাকাশে। দেখেছেন কেমন কুৎসিত ভঙ্গিতে হাঁটে, ফ্যাসফ্যাস করে কথা বলে। বুক চিতিয়ে, ঘাড় উঁচিয়ে, দেখতে কেমন উটের মত লাগে। এদের সঙ্গে ঘুমোনো যায়, কিন্তু প্রেম করা যায় না। বেনোয়া ঝুঁকে বলে, নীলার দিকে।

তাহলে এ অব্দি কোনও সাদা মেয়ের প্রেমে পড়েননি?

প্রেমে পড়েছিলাম এক ইথিওপিয়ার মেয়ের। আগুনের মতো সুন্দরী। কিন্তু সে মেয়ে,… গন উইদ দ্য উইন্ড।

প্রেম করলে ভারতীয় মেয়ের সঙ্গে করব। এ আমার সিদ্ধান্ত। বেনোয়া চোখ টেপে।

ভারতীয় মেয়ে পাবেন কোথায়? ভারতে তো থাকেন না।

না থাকি। প্যারিসে কি ভারতীয় মেয়ের অভাব আছে?

যারা আছে সবাই বিবাহিত।

আপনিও কি বিবাহিত?

আমিও।

বেনোয়ার কপাল ভাঁজ পড়ে সাতটা।

তবে যে বললেন কেউ নেই আপনার?

আমি স্বামীর সঙ্গে থাকি না। তাকে আমার কেউ বলে মনে হয় না।

বেশ জটিল ব্যাপার।

বেনোয়া এরপর নিজের বিয়ের কথা বলে, নিজে সে বিয়ে করেছে এক সাদাকে। একটি মেয়ে আছে, জ্যাকলিন, তরতর করে বড় হয়ে যাচ্ছে।

আপনার বয়স কত নীলা? কুড়ি পার হয়নি নিশ্চয়ই।

সাতাশ।

সাতাশ? দেখে, উনিশ মতো লাগে।

আপনার কত?

পঁচিশ।

পঁচিশ? নীলা অবাক হয়।

কেন দেখে কি বেশি বয়স লাগে? কত ভেবেছিলেন?

নীলা ভেবেছিল বিয়াল্লিশের নীচে নয়। কিন্তু কমিয়ে বলে তিরিশ কি বত্রিশ।

শুনে হা হা হাসে বেনোয়া, রীতিমতো বুড়ো বানিয়ে ফেলেছিলেন।

কপালে সাতটা, চোখের কোণে চার দ্বিগুণে আট মোট পনেরোটা ভাঁজ, কী করে সে ভাববে বিয়াল্লিশ নয়।

বিমানের ভেতর আলো নিবে যায়, ব্যাস চেয়ার পেছনে হেলিয়ে ঘুমিয়ে যাও সব। ঘুম না এলে টেলিভিশনে বোবা ছবি দেখো, শব্দ শুনতে চাইলে চেয়ারের হাতলে লাগানো শব্দ যন্ত্র কানে লাগিয়ে শব্দ শোনো।

টেলিভিশনের শব্দ শুনতে না চাও, গান শোনো। বেনোয়া ছবিও দেখবে না, শব্দ যন্ত্রও কানে লাগাবে না, গান শুনবে না, ঘুমোবেও না। একটির পর একটি লাল ওয়াইনের বোতল শেষ করছে আর বলছে, পাসকালের সঙ্গে তার চার বছর আগে বিয়ে হয়েছে, প্রথম প্রথম বেশ উত্তেজনা ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে কেমন যেন একঘেয়ে লাগছে, ঠিক এরকম ধরাবাঁধা জীবন সে চায়নি, অন্য কিছু চেয়েছিল, অন্যরকম কিছু।

কী রকম?

ঠিক জানি না কী রকম। তবে অন্যরকম।

বিমানের কেউ কেউ হাতের কাছের আলো বইয়ে ফেলে পড়ছে, কেউ হাঁ হয়ে আছে টেলিভিশনের দিকে। কেউ চেয়ারে ঘুমোচ্ছ, কেউ আবার তিনটে চেয়ার দখল করে লম্বা হয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছ। বেনোয়া ফিসফিস করে, কারও যেন ঘুম না ভাঙে, আর ফিসফিসের কারণে তার নীলার দিকে সরে আসতে হয় অনেকটা। নীলারও সরতে হয় বেনোয়ার দিকে অনেকটা।

প্যারিসে কোথায় থাকেন?

ছিলাম গার দ্য নর্দের কাছে, এরপর পাঁচ এরনদিসময়, গার দ্য অস্তারলিজের কাছে, এক বান্ধবীর বাড়িতে।

এখন কি বান্ধবীর বাড়িতেই উঠবেন।

ঠিক জানি না।

আপনি কি সমকামী?

নীলা জানালায় তাকায়, অল্প অল্প আলো ফুটছে।

না কি উভকামী?

নীলা উন্মূল উদ্বাস্তুর মতো, বেনোয়াও তা টের পায়। নীলার কণ্ঠেও তা, অনিশ্চয়তা।

প্যারিসে কারও সঙ্গে প্রেম করেননি?

নীলা মাথা নাড়ে।

কোনও ফরাসি প্রেমিক?

না।

আপনি কি সবসময়ই কথা এত কম বলেন।

কম বলছি কোথায়!

আমি একটু বাচাল তা জানি। কিন্তু ভারতীয়রাও বাচাল শুনেছি। আপনাকে আমার ভারতীয়র চেয়ে ইয়োরোপিয়ান মনে হচ্ছে বেশি।

ইয়োরোপিয়ানরা কি কম কথা বলে?

মেপে কথা বলে। যার তার সঙ্গে বলে না। খামোখা বলে না।

আপনিও না?

মেপে হয়তো বলছি না, কিন্তু খামোখা বলছি না।

কী উদ্দেশ্য শুনি?

আপনি আমার কাছে এখনও রহস্য। উদ্দেশ্য রহস্যের গভীরে যাওয়া।

নীলা তাকায় বেনোয়ার নীল চোখে। স্বপ্নে যে সব সুদর্শনকে প্রেমিক হিসেবে ভেবেছে এতকাল, বেনোয়ার সঙ্গে তাদের কারও তুলনা হয় না। বেনোয়া নীলার যে কোনও স্বপ্নপুরুষের চেয়ে বেশি সুদর্শন। সোনালি কটা চুল বেনোয়ার কপালে পড়েছে এসে, ইচ্ছে করে চুলগুলো সরিয়ে দেয় সে। ইচ্ছে করে চুল সরিয়ে দিতে গিয়ে স্পর্শ করতে বেনোয়ার উজ্জ্বল ত্বক।

ইচ্ছেকে প্রশ্রয় না দিতে নীলা জানালায় ফেরায় চোখ। আকাশে অদ্ভুত এক আলো। এরকম আলো নীলা কখনও দেখেনি।

কী অপূর্ব! নীলা গলা চেপে চিৎকার করে ওঠে। এত সুন্দর কী করে হয় রং?

ইচ্ছে করে দিগন্তের ওই রংগুলোকে স্পর্শ করতে, মুঠো মুঠো তুলে আনতে ওই রং, গায়ে মাখতে।

বেনোয়াও ঝুঁকে থাকে, জানালায়, নীলায়।

নীলা টের পায় না বেনোয়া তার হাতটি নিয়েছে হাতে, সে হাতে আঙুল বুলোচ্ছে।

নীলার চোখের মুগ্ধতার দিকে অপলক তাকিয়ে বেনোয়া বলে অপূর্ব!

তাই না?

তাই।

এত চমৎকার আলো আমি আর আগে দেখিনি।

আমিও না। এত আলো কোথায় পেলেন আপনি, নীলা?

নীলা চমকে তাকায়। দেখে বেনোয়ার চোখ আকাশে নয়, তার চোখে।

আপনি আকাশের আলো দেখেননি?

দেখেছি, আমি আপনার চোখের আলো দেখেছি।

নীলা জানে, বেনোয়ার এই আবেগ আর কিছুক্ষণ পর নিবে যাবে। প্যারিস পৌঁছে বেনোয়া বাই বলে নেমে যাবে। স্বপ্নালু চোখদুটো নেমে যাবে। হাজার অচেনা মানুষের স্রোতে ভেসে যাবে। আর নীলা দাঁড়িয়ে থাকবে, না কুলে, না জলে।

কিন্তু নীলাকে অবাক করে প্যারিস পৌঁছে বেনোয়া বলে, খুব তাড়া নেই নিশ্চয়ই আপনার। গার দ্য অস্তারলিজের উলটোদিকে যাবেন তো। আমার বাড়িতে এক কাপ কফি খেয়ে গেলে নিশ্চয়ই আপনার বান্ধবী রাগ করবে না খুব।

ও জানেই না আমি এসেছি। নীলা হেসে বলে।

তা হলে আপনার জন্য কেউ অপেক্ষা করছে না প্যারিসে? আমার সৌভাগ্য, চলন চলুন।

বেনোয়া গাড়ি রেখে গিয়েছিল বিমানবন্দরের গাড়ি পার্কিংয়ে। লাল পুযো।

নীলাকে তুলে নিয়ে সোজা রু দ্য রেনের দিকে যায় সে। প্যারিসের স্নিগ্ধ সুন্দর সকাল দেখতে দেখতে যায় নীলা, ফুসফুস ভরে হাওয়া নেয়। বসন্ত নাকি গ্রীষ্ম এখন, নীলা হিসেব করে না, সে হাওয়ায় বসন্তের ঘ্রাণ পাচ্ছে। কলাপাতা রঙের সবুজে ছেয়ে আছে ঘাস, সবুজ পাতার পোশাকে সেজে আছে প্যারিস। গাছে ফুল, ঘাসে ফুল, বাড়ির জানালায় ফুল, ফুলেশ্বরী প্যারিসকে নতুন চোখে দেখে নীলা।

বেনোয়া বাড়ির সামনে গাড়ি রেখে নিজের সুটকেস নামিয়ে নেয়, নীলার দুটো থেকে যায় পুয়োর পেটে।

সুন্দর সাজানো গোছানো বাড়ি বেনোয়ার।

নীলা জিজ্ঞেস করে, আপনার বউ বাড়ি নেই?

বউ থাকে স্টারসবুর্গে। ওখানে মেয়রের অফিসে চাকরি করে, ছুটিছাটায় প্যারিসে আসে।

বেনোয়া নিস্পৃহ কণ্ঠে বউয়ের স্টারসবুর্গ থাকার খবরটি দেয়। নীলা সোফায় বসে ঘরটি দেখে, আবছা আলো ঘরটিতে, জানালার ভারী পর্দা ফুড়ে আসছে সকালের রোদ। সোফার পাশে একটি বিছানা, তার পাশে গানের যন্ত্র, গানের যন্ত্রের পাশে একটি তাকে কিছু বই, কিছু সিডি, কিছু ভিডিও। ঘরটির সামনে খোলা রান্নাঘর, কফি বানানোর মেশিনে জল ঢালতে ঢালতে বেনোয়া জিজ্ঞেস করে, কফিতে চিনি?

আমি কফি খাই না।

তবে কী খান?

চা।

চা তো নেই।

তবে যাই বলে নীলা উঠে দাঁড়াল। কফি খেতে ডেকেছে বেনোয়া তাকে, কফি যে সে খায় না, তা আগে সম্ভবত জানানো উচিত ছিল তার, যেহেতু সে জানায়নি, চায়ের সরঞ্জামাদি জোগাড় করা এখন সম্ভব নয়, যেহেতু সম্ভব নয়, এবং তার পক্ষে কফি পান করাও সম্ভব নয়, তবে, নীলা অনুমান করে, তার বিদায় নেওয়াই ভদ্র আচরণ। নীলার যাই শুনে বেনোয়া কফি রেখে সামনে এসে দাঁড়ায় নীলার। চোখে চেয়ে থাকে। নীলা চোখ নামিয়ে নেয়।

পান করার কিছু নেই বলে চলে যেতে হবে? বেনোয়া জিজ্ঞেস করে।

নীলা উত্তর দেয় না, নখের তলের ময়লা খোঁটে।

নীলার হাতদুটো ধরে বেনোয়া নীলার কাছে সরতে থাকে, সরতে সরতে ধুকপুক করা বুকের কাছে। নীলা ছিটকে সরে যায়, আর ছিটকে সরে যাওয়া দ্য ভারতীয় সুন্দরীকে টেনে এনে বুকে জড়িয়ে গভীর চুমু খায় বেনোয়া।

কী হচ্ছে কী! নীলা নিজেকে ছাড়িয়ে বলে।

আমাকে পান করো নীলা, আমাকে পান করো। বেনোয়া নিবিড় কণ্ঠে বলে।

নীলার মনে হয় না এ বাস্তবে ঘটছে। মনে হয় এখনও সে বিমানের ভেতর বসা, আর আকাশের অদ্ভুত আলোর দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছে।

এমন চুমু নীলাকে কেউ খায়নি কোনওদিন। নীলা জানে না চুমু এরকম গভীর হতে পারে। তার সমস্ত শরীর অবশ মতো হয়ে আসে, আর অবশ মতো শরীরটিকে তুলে তুলো-মেঘের মতো নরম বিছানায় শুইয়ে দিয়ে একটি একটি করে জামা খুলে ফেলে। কী সুন্দর তুমি, নীলা ও নীলা, ভগবান তোমাকে নিজের হাতে গড়েছেন বলে বলে নীলার সারা শরীরে চুমু খায় বেনোয়া। চুলে কপালে কানে চোখে নাকে ঠোঁটে জিভে গালে চিবুকে গলায় ঘাড়ে পিঠে বুকে বাহুতে হাতে আঙুলে স্তনে পেটে তলপেটে নিতম্বে উরুতে উরুসন্ধিতে হাঁটুতে পায়ে নখে পায়ের পাতায়।

নীলার সারা শরীর ভিজে ওঠে চুমুতে। চোখ বুজে থাকে সে।

এত সুখ সে তার সাতাশ বছরের জীবনে কখনও পায়নি।

এত আনন্দ তার জীবনে কখনও আসবে সে ভাবেনি। এই নির্মম নিষ্ঠুর কুৎসিত পৃথিবীতে ভালবাসা যে এত গভীর হতে পারে, সঙ্গম যে এত অসম্ভব সুন্দর হতে পারে, আগে সে কখনও অনুমানও করেনি।

নীলার জীবনে, নীলার অলক্ষেই ঘটে যায় বেনোয়া দুপঁ।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *