শেষ পর্যন্ত সন্ধি
মঘবা বলিলেন, কোদণ্ডদের ভাল রকম কাবু করিতে পারিলাম না। ক্ষেপিয়া গেলে ব্যাটারা ভীষণ লড়ে। যা হোক, শেষ পর্যন্ত সন্ধি করিয়াছে।
প্রদ্যুম্ন প্রশ্ন করিলেন, সন্ধির শর্ত কিরূপ?
মঘবা উচ্চৈঃস্বরে হাসিলেন, চমৎকার। অদ্ভুত জাত এই কোদণ্ড, আশ্চর্য তাহাদের রীতিনীতি। –জানিস, ওদের জাতে মেয়ে বাপের উত্তরাধিকারিণী হয়, ছেলে মামার সম্পত্তি পায়! শুনিয়াছিস কখনও?
মাথা নাড়িয়া প্রদ্যুম্ন বলিলেন, না। কিন্তু সন্ধির শর্ত কিরূপ?
শর্ত এই—কোদণ্ডের রাজকন্যা অপহরণ করাতে তাহাদের মর্যাদায় বড় আঘাত লাগিয়াছে; এই কলঙ্কমোচনের একমাত্র উপায় কন্যাকে বিবাহ করা। বিবাহ না করিলে তাহারা যুদ্ধ করিবে, কিছুতেই শুনিবে না। আর যদি বিবাহ করি, তবে উত্তরাধিকারসূত্রে কোদণ্ডদের রাজা হইব।
গুরুতর শর্ত নয়? বলিয়া মঘবা গলা ছাড়িয়া হাসিতে লাগিলেন।
প্রদ্যুম্ন কিয়ৎকাল হেঁটমুখে রহিলেন, তারপর ঈষৎ হাসিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, গুরুতর বটে।
মঘবা বলিলেন, সুতরাং আর বিলম্ব নয়, তাড়াতাড়ি কোদণ্ডকন্যাকে বিবাহ করিয়া ফেলা দরকার! মেয়েটা ঠিক আছে তো?
ঠিক আছে।
আর্যভাষা কেমন শিখিল?
বেশ।
তবে কালই বিবাহ করিব।
কিছু কাল নীরব থাকিয়া প্রদ্যুম্ন বলিলেন, কন্যার মতামত জানিবার প্রয়োজন নাই?
কিছুমাত্র না। এ রাজকীয় ব্যাপার, কথার নড়চড় চলিবে না। সন্ধির শর্ত পালন করিতেই হইবে।
সেই দিন গভীর রাত্রে প্রদ্যুম্ন চোরের মতো এলার মহলে প্রবেশ করিলেন। আকাশে প্রায় পূণাবয়ব চন্দ্র গবাক্ষপথে কিরণস্রোত ঢালিয়া দিতেছে; সেই জ্যোৎস্নার তলে মাটিতে পড়িয়া এলা ঘুমাইতেছে। ঘরে প্রদীপ নাই।
নিঃশব্দে প্রদ্যুম্ন তাহার কাছে গেলেন; হাঁটু গাড়িয়া তাহার পাশে বসিলেন; নিশ্বাস রোধ করিয়া তাহার মুখের কাছে মুখ লইয়া গেলেন।
এলা ঘুমাইতেছে, কিন্তু তাহার চক্ষের কোণ বাহিয়া বিন্দু বিন্দু অশ্রু ঝরিয়া পড়িতেছে। স্বপ্নে এলা গদগদ অবরুদ্ধ কণ্ঠে বলিতেছে—প্রদ্যুম্ন! প্রদ্যুম্ন! প্রদ্যুম্ন! আমি মরিতে চাহি না…তুমি কেমন মানুষ…কিছু বুঝিতে পার না?…বর্বর!..আমাকে উদ্ধার কর…প্রদ্যুম্ন! প্রদ্যুম্ন…
যে-কার্য করিতে আসিয়াছিলেন তাহা করা হইল না, বীজের মালা এলার কণ্ঠেই রহিল। প্রদ্যুম্ন চোরের মতো নিঃশব্দে ফিরিয়া গেলেন।
পরদিন সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে পূর্বাকাশে চন্দ্রোদয় হইল। মঘবা রাত্রির জন্যই প্রতীক্ষ্ণ। করিতেছিলেন, বলিলেন, প্রদ্যুম্ন, এবার বিবাহের আয়োজন কর।
রাজভবনের সম্মুখস্থ উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে ধুনির মতো অগ্নি জ্বলিয়া উঠিল; অগ্নি সাক্ষী করিয়া বিবাহ হইবে। হোমাগ্নির পুরোভাগে বরবধূর কাষ্ঠাসন-পীঠিকা সন্নিবেশিত হইল।
বিবাহের সংবাদ পূর্বাহেই প্রচারিত হইয়াছিল; উৎসুক জনমণ্ডলী প্রাঙ্গণে সমবেত হইতে লাগিল।
বক্ষ বাহুবদ্ধ করিয়া প্রদ্যুম্ন একদৃষ্টে অগ্নির পানে তাকাইয়া আছেন; একবার বক্ষপঞ্জর ভেদ করিয়া একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বাহির হইল।
মঘবা আসিয়া স্কন্ধে হাত রাখিতে তাহার চমক ভাঙ্গিল, অগ্নি হইতে চক্ষু তুলিয়া সম্মুখে চাহিলেন। সম্মুখেই চন্দ্র; বৃক্ষশাখার অন্তরাল ছাড়াইয়া এইমাত্র ঊর্ধ্বে উঠিয়াছে। প্রদ্যুম্ন সেই দিকে তাকাইয়া রহিলেন।
মঘবা বলিলেন, রাত্রি হইয়াছে, বিবাহের সময় উপস্থিত। তুই এবার গিয়া বধূকে লইয়া আয়।
প্রদ্যুম্ন ধীরে ধীরে মঘবার দিকে ফিরিলেন; গম্ভীর কণ্ঠে বলিলেন, সেনাপতি মঘবা!
মঘবা ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া গেলেন! রাজা হওয়ার অভ্যাস তাঁর প্রাণে এমনই বসিয়া গিয়াছিল যে প্রথমটা কিছু বুঝিতেই পারিলেন না। তারপর প্রদ্যুম্নের দৃষ্টি অনুসরণ করিতেই চাঁদের প্রতি চক্ষু পড়িল।
আকাশ নির্মেঘ কিন্তু চন্দ্রের শুভ্র মুখের উপর ধূম্রবর্ণ ছায়া পড়িয়াছে; করাল ছায়া ধীরে ধীরে চন্দ্রকে গ্রাস করিবার উপক্রম করিতেছে।
প্রদ্যুম্ন বলিলেন, সেনাপতি মঘবা, আমি বধূকে আনিতে যাইতেছি; সন্ধির শর্ত রক্ষার জন্য
আমিই তাহাকে বিবাহ করিব। ইতিমধ্যে তুমি প্রজামণ্ডলকে ব্যাপারটা বুঝাইয়া দাও।
মঘবা কিয়ৎকাল স্তম্ভের মতো নিশ্চল হইয়া রহিলেন। তারপর তাঁহার প্রচণ্ড অট্টহাস্যে আকাশ বিদীর্ণ হইয়া গেল।
সহসা হাস্য থামাইয়া মঘবা করজোড়ে বলিলেন, যে আজ্ঞা মহারাজ।
এলা বাতায়নের পাশে বসিয়া ছিল, প্রদ্যুম্ন প্রবেশ করিতেই উঠিয়া দাঁড়াইল।
আমাকে লইতে আসিয়াছ?
হাঁ রাজকুমারী। কোদণ্ডদের সহিত আমাদের সন্ধি হইয়াছে; তাহার শর্ত এই যে, আর্যরাজা কোদণ্ড-কন্যাকে বিবাহ করিবেন। আমরা ধৰ্মত এই শর্ত পালন করিতে বাধ্য।
আর কিছু বলিবার আছে?
সামান্য। ঘটনাক্রমে আমি এখন আর্যরাজা, মঘবা আমার সেনাপতি। সুতরাং বিবাহ করিতে হইলে আমাকেই বিবাহ করিতে হইবে।
এলা দীর্ঘকাল বিস্ফারিত নেত্রে চাহিয়া স্থির হইয়া রহিল; শেষে ক্ষীণকণ্ঠে উচ্চারণ করিল, কি বলিলে?
প্রদ্যুম্ন রাজকীয় গাম্ভীর্যের সহিত বলিলেন, আমাকে বিবাহ করিতে হইবে। এখন চট করিয়া স্থির করিয়া ফেল, বিবাহ করিবে, না বীজ ভক্ষণ করিবে।
স্বপ্নের অবরুদ্ধ আকুলতা এতক্ষণে বন্যার মতো নামিয়া আসিল, দলিতাঞ্জন চক্ষু দুইটি ছাপাইয়া ঝরিয়া পড়িতে লাগিল।
প্রদ্যুম্ন বাতায়নের উপর উঠিয়া বসিয়া বলিলেন, গ্রহণ ছাড়িতে এখনও বিলম্ব আছে। ততক্ষণ তোমাকে বিবেচনা করিবার সময় দিলাম।
বর্ষণের ভিতর দিয়া বিদ্যুৎ-চমকের মতো হাসি হাসিয়া এলা বলিল, বর্বর!
৯ আষাঢ় ১৩৪৬