গুরুতর সংবাদ আসিল
পরদিন প্রাতঃকালে কিন্তু গুরুতর সংবাদ আসিল। কোদণ্ডদেশ হইতে সদ্যপ্রত্যাগত নিরতিশয় নির্জীব একটি ভগ্নদূত জানাইল যে, রাজকন্যা-হরণের কথা জানিতে পারিয়া পলাতক কোদণ্ড জাতি আবার কাতারে কাতারে ফিরিয়া আসিয়াছে এবং একেবারে ক্ষেপিয়া গিয়াছে। মঘবা যে অল্পসংখ্যক আর্যটক থানা দিবার জন্য রাখিয়া আসিয়াছিলেন, শত্রুর অতর্কিত ক্ষিপ্ততায় তাহারা কচুকাটা হইয়াছে—কেবল ভগ্নদূত পদদ্বয়ের অসাধারণ ক্ষিপ্রতাবশত প্রাণ
বাঁচাইতে সমর্থ হইয়াছে। পরিস্থিতি অতিশয় ভয়াবহ।
শুনিয়া প্রদ্যুম্ন চঞ্চল হইয়া উঠিলেন, মহারাজ, অনুমতি দিন শ্যালকদের ঢিট করিয়া আসি।
মঘবা কিন্তু রাজী হইলেন না, বলিলেন, তাহা হয় না। ঢিট করিতে হয় আমি করিব।
সৈন্য সাজাইয়া আবার মঘবা বাহির হইলেন। কিছু দূর গিয়া ফিরিয়া আসিয়া প্রদ্যুম্নকে বলিলেন, ইতিমধ্যে মেয়েটাকে তুই আর্যভাষা শেখাস্।
মনের ক্ষুব্ধতা গোপন করিয়া প্রদ্যুন্ম বলিলেন, আচ্ছা।
দু-এক দিনের মধ্যেই প্রদ্যুম্ন বুঝিতে পারিলেন, অনার্য মেয়েটি অতিশয় মেধাবিনী। অষ্টাহমধ্যে সে ভাঙা ভাঙা কথা কহিতে আরম্ভ করিল। _ তাহার নাম এলা। অনার্য নাম বটে, কিন্তু শুনিতে ও বলিতে বড় মিষ্ট। প্রদ্যুম্ন কয়েক বার উচ্চারণ করিলেন, এলা! এলা! বাঃ! বেশ তো।
কথা কহিতে শিখিয়াই এলা প্রথম প্রশ্ন করিল, ও লোকটা কে? যে আমাকে ধরিয়া আনিয়াছে?
প্রদ্যুম্ন বলিলেন, আমার বন্ধু।
বন্ধু শব্দের ভাবার্থ বুঝিতে এলার কিছু বিলম্ব হইল। অবশেষে বুঝিতে পারিয়া সে নাক সিঁটকাইল; তীব্র অবজ্ঞার কণ্ঠে বলিল, তোমরা বর্বর।
প্রদ্যুম্ন অবাক হইয়া গেলেন; ভাবিলেন, কি আশ্চর্য! আমরা বর্বর!
ক্রমশ এলা আর্যভাষায় কথা কহিতে লাগিল—কোনও কথা বলিতে বা বুঝিতে তাহার বাধে না। একদিন জিজ্ঞাসা করিল, আমাকে এখানে ধরিয়া রাখিয়াছ কেন?
প্রদ্যুম্ন ঢোক গিলিয়া বলিলেন, আর্যভাষা শিখাইবার জন্য।
এলা বলিল ছাই ভাষা। ইহা শিখিয়া কি হইবে?
প্রদ্যুম্ন একটু রসিকতা করিয়া বলিলেন, প্রেমালাপ করিবার সুবিধা হইবে। মহারাজ মঘবা তোমাকে বিবাহ করিবেন স্থির করিয়াছেন।
এলা বসিয়া ছিল, ধীরে ধীরে উঠিয়া দাঁড়াইল, কিছুক্ষণ অপলক নেত্রে প্রদ্যুম্নের পানে চাহিয়া রহিল। তারপর আবার বসিয়া পড়িয়া নিশ্চিন্ত স্বরে বলিল, উহাকে আমি বিবাহ করিব না। বর্বর!
প্রদ্যুম্ন স্তোক দিবার জন্য বলিলেন, মঘবা দাড়ি রাখে বটে, কিন্তু তোক খারাপ নয়—
এলা শুধু বলিল, বর্বর!
এমনি ভাবে দিন কাটিতে লাগিল। কিন্তু মঘবার দেখা নাই—তিনি কোদণ্ডদের ঢিট করিলেন অথবা কোদণ্ডেরা তাঁহাকে ঢিট করিল, কোনও সংবাদ নাই! প্রদ্যুম্ন উতলা হইয়া উঠিলেন।
দেখিতে দেখিতে তিন মাস অতীত হইয়া গেল।
একদিন প্রাতঃকালে প্রদ্যুম্ন এলার কূটগৃহে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, এলা বাতায়ন-পার্শ্বে দাঁড়াইয়া বেণী উন্মোচন করিতেছে। প্রদ্যুম্নকে দেখিয়া সে একবার ঘাড় ফিরাইল, তারপর আবার বাহিরের দূর দৃশ্যের পানে তাকাইয়া বেণীর বিসর্পিল বয়ন মোচন করিতে লাগিল।
প্রদ্যুম্ন গলা ঝাড়া দিলেন, কিন্তু কোনও ফল হইল না। তখন তিনি বাতায়নসম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন; আকাশের দিকে তাকাইলেন, নিম্নে উঁকিঝুঁকি মারিলেন, তারপর পুনশ্চ গলাখাঁকারি দিয়া বলিলেন, শীত আর নাই; দিব্য গরম পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে।
এলা বলিল, হুঁ।
উৎসাহ পাইয়া প্রদ্যুম্ন বলিলেন, আজকাল দক্ষিণ হইতে যে হাওয়া বহিতেছে, তাহাকেই বুঝি তোমরা মলয় সমীরণ বলিয়া থাক? আর্যাবর্তে এ হাওয়া নাই।
এলা তাঁহার দিকে গম্ভীর চক্ষু তুলিয়া প্রশ্ন করিল, দু-দিন আসা হয় নাই কেন?
প্রদ্যুম্ন থতমত খাইয়া বলিলেন, ব্যস্ত ছিলাম,–একটু থামিয়া—তোমার তো আর আর্যভাষা শিখিবার প্রয়োজন নাই। যাহা শিখিয়াছ তাহাতেই আমাদের সকলের কান কাটিয়া লইতে পার।
কিছুক্ষণ কোনও কথা হইল না; এলা নতনেত্রে মুক্ত বেণী আবার বিনাইতে লাগিল। শেষে প্রদ্যুম্ন পূর্ব কথার জের টানিয়া বলিতে লাগিলেন, মঘবা আসিয়া পড়িলে বাঁচা যায়। অনেক দিন হইয়া গেল, এখনও তাহার কোন খবর নাই।—দুর্ভাবনা হইতেছে।
এলা তিলমাত্র সহানুভূতি না দেখাইয়া নির্দয়ভাবে হাসিল, বলিল, তোমার মঘবা আর ফিরিবে না, আমার স্বজাতিরা তাহাকে শেষ করিয়াছে।
ক্রুদ্ধ চক্ষে চাহিয়া প্রদ্যুম্ন বলিলেন, মঘবাকে শেষ করিতে পারে এমন মানুষ দাক্ষিণাত্যে নাই। সে মহাবীর!
তাচ্ছিল্যভরে এলা বলিল, বর্বর।
অধিকতর ক্রুদ্ধ হইয়া প্রদ্যুম্ন বলিলেন, ঐ বর্বরকেই তোমাকে বিবাহ করিতে হইবে।
ভঙ্গি করিয়া এলা বলিল, তাই নাকি! আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে?
তুমি তো বন্দিনী। তোমার আবার ইচ্ছা কি?
প্রত্যেকটি শব্দ কাটিয়া কাটিয়া এলা উত্তর দিল, ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে বিবাহ করিতে পারে এমন পুরুষ তোমাদের আর্যাবর্তে জন্মে নাই—এই বীজের মালা দেখিতেছ? এলা দুই আঙুলে নিজ কণ্ঠের বীজমালা তুলিয়া দেখাইল, একটি বীজ দাঁতে চিবাইতে যেটুকু দেরি—আর আমাকে পাইবে না।
প্রদ্যুম্ন সভয়ে বলিয়া উঠিলেন, কি সর্বনাশ—বিষ!–দাও, শীঘ্র মালা আমায় দাও।
এলা দূরে সরিয়া গিয়া বলিল, এত দিন তোমাদের বন্দিনী হইয়া আছি, ভাবিয়াছ আমি অসহায়া? তোমাদের খেলার পুতুল? তাহা নহে। যখন ইচ্ছা আমি মুক্তি লইতে পারি।
প্রদ্যুম্ন মূঢ়ের মতো তাকাইয়া থাকিয়া বলিলেন, তবে লও নাই কেন?
এলা ক্ষণেক চুপ করিয়া রহিল; তারপর গর্বিত স্বরে বলিল, সে আমার ইচ্ছা।
এই সময় বাতায়নের বাহিরে দূর উপত্যকায় শঙ্খের গভীর নির্ঘোষ হইল। চমকিয়া প্রদ্যুম্ন সেই দিকে দৃষ্টি প্রেরণ করিলেন। সীমান্তের বনানীর ভিতর হইতে ধ্বজকেতনধারী আর্যসেনা ফিরিয়া আসিতেছে। ললাটের উপর করতলের আচ্ছাদন দিয়া প্রদ্যুম্ন সেই দিকে চাহিয়া রহিলেন, তারপর গভীর নিশ্বাস মোচন করিয়া বলিলেন, যাক, বাঁচা গেল—মঘবা ফিরিয়াছে?
প্রদ্যুম্ন তাড়াতাড়ি চলিয়া যাইবার উপক্রম করিলেন। পিছন হইতে এলার শান্ত কণ্ঠস্বর আসিল, আমিও বাঁচিলাম, মুক্তির আর দেরি নাই।
প্রদ্যুম্ন চকিতে ফিরিয়া দাঁড়াইলেন, এলা তেমনি দাঁড়াইয়া বেণী বয়ন করিতেছে, তাহার মুখে সূচীবিদ্ধ মৃত প্রজাপতির মতো একটুখানি হাসি।
প্রদ্যুম্ন তাহার কাছে ফিরিয়া গিয়া অনুনয়ের কণ্ঠে বলিলেন, এলা, ছেলেমানুষি করিও না। মঘবাকে বুঝিতে সময় লাগে, বিবাহের পর বুঝিতে পারিবে তাহার মতো মানুষ হয় না—মিনতি করিতেছি, ঝোঁকের মাথায় হঠাৎ একটা কিছু করিয়া বসিও না।
এলা বলিল, হঠাৎ কোনও কাজ করা আমার অভ্যাস নয়; আমি কোদণ্ড-কন্যা, বর্বর নহি। যদি মঘবা বলপূর্বক আমাকে বিবাহ করিবার চেষ্টা করে, বিবাহের সভায় আমি মুক্তি লইব।