পৌষ সংক্রান্তির লোকাচার
” আউনি বাউনি চাউনি
তিনদিন তিনরাত কোথাও না যেও
ঘরে বসে পিঠে ভাত খেও।
মকর পরব এর আবহে সারা জঙ্গলমহলে উচ্চারিত হয় এই আন্তরিক লৌকিক মন্ত্র! অঞ্চল ভেদে মন্ত্রের চরণগুলো বদলে যায় ঠিকই কিন্তু কামনাটা একই থাকে। পৌষ মাসের শেষ দিনটি বাঙালির একান্ত প্রিয়। দেবী লক্ষ্মী কে তুষ্ট করে গৃহস্হ ঘরে তাঁর অচলা অবস্থানের আকাঙ্ক্ষায় এই লোকাচার। পৌষ সংক্রান্তির আগের দিনকে বলা হয় “বাউনি দিন”। এইদিন পুজো করে ধানের শীষ বা খড দিয়ে আম পাতা দিয়ে বিনুনী করে “বাউনি “তৈরি করা হয়। অনেকে মাটির সরার আস্কে পিঠে বানিয়ে সেটিকে বেড দিয়ে প্রথম “বাউনি” বানান। এই সরাকে বাড়ির সদর দরজাও অন্যান্য জায়গায় বেঁধে রাখা হয়। এই বাউনিবাঁধার সময় উচ্চারণ করা হয় ওই “আউনি বাউনি “ছড়া। এই ছড়ার অর্থ বড় মন ছোঁয়া। আউনির অর্থ দেবী লক্ষ্মীর আগমন বাউনির অর্থ মা লক্ষ্মীর বন্ধন বা স্থিতি ।আর চাউনি হল দেবীর কাছে প্রার্থনা। এই বাউনি দিনে চালের গুঁড়ো দিয়ে সেদ্ধ পিঠা আশকা পিঠে পাটি সাপটা সরুচাকলি ইত্যাদি বানাতে হয়। একে গুঁডিহাত বলে। এই ভাবেই শুরু হয় মকর সংক্রান্তির তিনদিনের উৎসবের। পূর্ণ হয় লোকাচার।
মকর সংক্রান্তির দিন ভোর বেলায় কোন নদী খাল বা প্রবাহমান জলধারা তে অবগাহন স্নান করা হয়। জলতল এর এক অঞ্জলি মাটি তুলে তাতে কুলপাতা গাঁদা ফুল ও কলা সহযোগে মা মকরবাহিনী গঙ্গাকে পুজো করে আবার তা জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। আনন্দের মকর স্নান এর পর নতুন কাপড় পরে নদীর ঘাটে পিঠেপুলির প্রসাদ গ্রহণ। স্নানের পর” মেডাঘরের আগুনে হাত-পা সেঁকে শীত তাড়ানো এক আনন্দ যাপন। সারা জঙ্গলমহলে ভেসে বেড়ায় মকর পরবে টুসু গানের সুর। নদীর ঘাটে ঘাটে টুসুর চৌদলের রামধনুর রং ঝলমল করতে থাকে।
গৃহস্থের খামার আলপনার অলঙ্করণে ঝলমল করে। পৌষ লক্ষ্মীর আরাধনার জন্য সারা খামার পিটুলির আলপনায় সেজে ওঠে। কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত সব চাষ যন্ত্রের আলপনা আঁকা হয় এখানে। আমন ধানের গোছা যা “ঠাকুর “নামে পরিচিত তা খামারে আলপনা আঁকা পিঁড়ির ওপর রাখা হয়। এই “ঠাকুর “ই পৌষ লক্ষীর রূপ। গাঁদা ফুলের সজ্জায় সজ্জিত মা লক্ষীকে” মকর ভোগে” আরাধনা করা হয়। মকর অর্থাৎ সব রকম ফল ভেজামুগ ডাল ভেজা ছোলা পাটালি একসাথে মিশ্রিত করা। একইভাবে এই মিশ্রণে আতপ চালের গুঁড়ো মিশিয়ে” চালের মকর “করা হয়। পৌষ লক্ষ্মীর পূজার আরেক বিশেষ রীতি হল “ডাক ধরা”!
সংক্রান্তির সাঁঝে শেয়াল, পেঁচা বা পাখির ডাক শুনে খামারের পৌষ লক্ষীকে জল ছড়া ও শঙ্খ ধ্বনি করে প্রদক্ষিণ করতে হয়!তিন বা পাঁচবার এই “ডাক” ধরতে হয়! এবার মা লক্ষ্মীর পুজো সম্পন্ন করে ব্রত কথাশুনতে হয়! অঞ্চল ভেদে পৌষ লক্ষ্মীর আরাধনার বিভিন্নতা দেখা যায়! যেমন বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া তে ধানের ওপর গজলক্ষী বা পৌষ লক্ষ্মী বা লক্ষ্মী সাজ( সুদর্শন গরুড মৎস্য পেঁচা) সাজিয়ে পুজো করা হয় পুজোর পর এই সাজ মাটির হাঁড়িতে ধানের মধ্যে চেলি জড়িয়ে রেখে দেওয়া হয়। পরের বছর আবার ধানও চেলি পরিবর্তন করা হয়।
এবার শুরু হয় পিঠে পায়েস ও মকর খাওয়ার ধুম। পৌষ সংক্রান্তি সন্ধ্যায় টুসু বিসর্জনের যে বিষাদ তা পৌষলক্ষ্মীর আবাহনে মিলিয়ে যায়। আসে আনন্দ মুখর পৌষ পাবনের লগ্ন। মা লক্ষ্মীর অচলা অবস্থানের কামনায় পৌষ বন্ধনের লোকাচারে মেতে ওঠে জঙ্গলমহল। পৌষ কে আবাহন করে বলে—–
এসো পৌষ বসো পৌষ খাও পিঠে পুলি
বউডি ঝিউড়ি পায় যেন সোনার শাঁখা রুলি।
মকর পরব শেষ হয় পয়লা মাঘ— এখান বা আই খ্যান দিনে। এইদিন “খামার বিশ্রাম”। আনন্দমুখর কৃষিজীবীরা উৎসবে মাতে এই সময়। জনজাতি দের শিকার উৎসব এই দিনে অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন লোক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মেলা খেলার আমোদে মেতে ওঠে জঙ্গলমহল। মাদল আডবাঁশি সারিন্দার মধুর তানে মুখরিত জঙ্গলমহল যাপন করে তাদের প্রাণের উৎসবের।