পোলিশ কবি চেসোয়াভ মিউশ, তাঁর কবিতা ও সাক্ষাৎকার -2
কিন্তু ১৯৬১ সালে, পঞ্চাশ বছর বয়সে, মিউশ আমেরিকায় পাড়ি জমান এবং বার্কলিস্থ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে স্লাভিক ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেখানে অত্যল্প একটি বিভাগের একজন শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও অচিরেই দস্তয়েভস্কি-বিষয়ক কোর্সগুলোর জন্য তাঁর প্রভূত নামধাম হয়ে যায় এবং সেখানে তিনি অনুবাদ, বিশেষত জবিগ্নিয়েভ হেরবের্টের কবিতার অনুবাদ করেন। আমেরিকায় আত্মজৈবনিক লেখা ন্যাটিভ রেল্ম : আ সার্চ ফর সেলফ ডেফিনেশন এবং ভিশনস ফ্রম সান ফ্রান্সিসকো বে প্রকাশিত হয়। এই বইগুলোতে মিউশ তাঁর দেশ পোল্যান্ডের সঙ্গে পশ্চিমকে তুলনা করে মতামত তুলে ধরেন। ১৯৭০ সালে তিনি আমেরিকান নাগরিকত্ব পান। ১৯৭৩ সালের আগ পর্যন্ত তাঁর নির্বাচিত কবিতার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়নি। ১৯৭৮ সালে তাঁর সংকলন বেলস ইন উইন্টার প্রকাশিত হয়, আর ১৯৮০ সালে তিনি পেয়ে যান সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। পোল সাহিত্যিকদের মধ্যে নোবেলপ্রাপ্তিতে তিনি হলেন পঞ্চম। ১৯৮১ সালে ত্রিশ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো তিনি পোল্যান্ড ভ্রমণ করেন আর ১৯৯২ সালে বায়ান্ন বছর পর তাঁর নিজ দেশ লিথুয়ানিয়ায় পুনরায় যান। বাহান্ন বছরের মধ্যে আবার লিথুয়ানিয়ায় যাওয়া সম্পর্কে তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানান, তা ছিল এক ভ্রাম্যমাণ অভিজ্ঞতা। সেখানে তাঁকে দেশের ছেলের মতোই বরণ করে নেওয়া হয়, সাম্মানিক ডিগ্রিও দেওয়া হয়। যেখানে তিনি জন্মগ্রহণ করেন, সেখানেও তিনি যান কিন্তু সেখানে তখন আর কোনো ঘরবাড়ি অবশিষ্ট ছিল না, ছিল না সেই মানুষগুলোও। ৫২ বছর পর লিথুয়ানিয়ায় গমন উপলক্ষে তিনি লেখেন – কবিতা
‘লিথুয়ানিয়া, বায়ান্ন বছর পর’; তিনি লেখেন :
‘আমরা ধন্যবাদ দিই নিজেদের আর পূর্বপুরুষদের নামগুলোকে
ওক আর তাদের এবড়োখেবড়ো বাকলগুলোর জন্য
পাইন, আর তাদের সূর্য-ঝলসিত গুঁড়িগুলোর জন্য
বসন্তকালের বার্চের কুঞ্জবনের পরিষ্কার সবুজ মেঘগুলোর জন্য
আর সেই পপলারের হেমন্তের খাঁ খাঁ প্রান্তরের পিলসুজের জন্য।’
লিথুয়ানিয়ায় তাঁর বেড়ে ওঠা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, তা ছিল এমন-একটা জায়গা যেখানে তখন ছিল না কোনো রেডিও, টেলিভিশন বা কোনো ছায়াছবি, এরকম একটা ইউরোপীয় প্রাদেশিক স্থানেই তাঁর শৈশবে বেড়ে-ওঠে। এত কিছুর ঘাটতির পরও তিনি বলেছেন, সেখানে ছিল বইয়ের প্রাচুর্য, বিশেষত তাঁর পিতামহের পাঠাগারটি তাঁকে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল, যেখানে ঠাসা ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর সব বিখ্যাত বই। পরে যখন তিনি ভিলনিয়াসে বাস করতে লাগলেন, তখন তিনি সিনেমা দেখা শুরু করেন। ভিলনিয়াস হলো এমন এক শহর যা বারেবারে প্রত্যর্পিত হয়েছে তাঁর লেখায়। তিনি বারবার এই শহরের কথা বলেছেন সাহিত্যে। মিউশ যখন পশ্চিমে তখনো তিনি পশ্চিমা পাঠকদের কাছে এ দুই শহরকে পরিচিত করিয়ে দিতে চাইতেন।
যদিও ১৯৬১ সাল থেকে তিনি আমেরিকায় বসবাস করেছেন তবু সেখানে তাঁর কবিতা কমই জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু পোল্যান্ডে তিনি ছিলেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যদিও কমিউনিস্ট শাসনের সময় একজন দেশত্যাগী হিসেবে তাঁর লেখা প্রচারিত হতো না রাষ্ট্রীয়ভাবে। এর কারণেই তিনি ভেতরে ভেতরে আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন – তাঁর বইয়ের অনেক গোপন বা আন্ডারগ্রাউন্ড সংস্করণ বের হতো, প্রচারিত হতো তা ততোধিক গোপনে। কিন্তু ১৯৮০ সালে নোবেল পাওয়ার পর কমিউনিস্ট সরকার অনেকটা বাধ্য হলো তাঁর বইয়ের প্রকাশনা করতে। তাঁর কবিতার এক সংকলন বের হলো, যা সরকারিভাবে বিক্রি হয়ে গেল দুই লাখ কপি। পোল্যান্ডে মিউশের জনপ্রিয়তার আরেক প্রমাণ হলো, কমিউনিস্ট পুলিশের গুলিতে নিহত কমরেডদের স্মরণে যখন পোলিশ শ্রমজীবীরা এক মনুমেন্টের উদ্বোধন করল, সেখানে উৎকীর্ণ করা হলো বাইবেল আর মিউশের এক কবিতা থেকে।
নোবেল পাওয়ার পর তাঁর অনেক কবিতা ও গদ্যের বই প্রকাশিত হয়। স্মর্তব্য যে, কয়েকজন বন্ধুবান্ধব বাদ দিলে তিনিই তাঁর কবিতার প্রধান ইংরেজি-অনুবাদক। তাঁর গদ্য বইয়ের মধ্যে আছে : ভিশন্স ফ্রম সান ফ্রান্সিসকো বে, বিগেনিং উইথ মাই স্ট্রিটস, দ্য ল্যান্ড অব উলরো আর তাঁর চার্লস এলিয়ট নর্টন ভাষণ দ্য উইটনেস অব পোয়েট্রি। ১৯৮৮ সালে মিউশের কবিতা সংগ্রহ প্রকাশিত হয়, যাতে তাঁর আনঅ্যাটেনেবল আর্থ কাব্যগ্রন্থটিও অন্তর্ভুক্ত হয়। পরবর্তীকালে প্রভিন্সেস কাব্যগ্রন্থটিও এতে স্থান পায়। ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয় বিগেনিং উইথ মাই স্ট্রিট্স : এসেইস অ্যান্ড রিকালেকশনস। ১৯৯৪ সালে বের হয় আ ইয়ার অব দ্য হান্টার আর কাব্যগ্রন্থ ফেসিং দ্য রিভার প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ সালে। ১৯৯৯ সালে ৮৮ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় কাব্য রোডসাইড ডগ যাতে তাঁর ধ্যান এবং অন্তর্বীক্ষণ স্পষ্টতই প্রতিফলিত। ২০০১ সালে প্রকাশ পায় তাঁর জীবনদৃষ্টি ও অভিজ্ঞতাঋদ্ধ গ্রন্থ মিউশেস আ বি সি। একই বছর আরো প্রকাশিত হয় তাঁর অনুবাদকর্ম আ ট্রিটিস অন পোয়েট্রি যা তাঁর নিজ ভাষায় প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৫৭ সালে। ২০০১ সালে আরো প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ সংকলন টু বিগেইন হোয়ার আই অ্যাম : নির্বাচিত প্রবন্ধ। বার্কলিতেই তিনি বেশিরভাগ সময় বসবাস করতেন, আর গ্রীষ্মাবকাশ কাটাতেন ক্রাকাওতে।
কবিতা সম্পর্কে তিনি তাঁর বিখ্যাত একটি কবিতায় বলেছেন : The purpose of poetry is to remind us/ how difficult it is to remain just one person,/ for our house is open, there are no keys in the doors,/ and invisible guests come in and out at wil (কবিতার উদ্দেশ্য আমাদের মনে করিয়ে দেওয়া শুধু একজন মানুষ থাকা কতটা কঠিন,
কারণ আমাদের ঘর খোলা, দরজায় কোন চাবি নেই,
এবং অদৃশ্য অতিথিরা ইচ্ছামত আসে এবং বাইরে আসে)
কীভাবে তাঁর ভেতর লেখার প্রেরণা বা উদ্ভিন্নতা জন্মলাভ করেছিল সে-সম্পর্কে তিনি বলেছেন, স্কুলে পড়ার সময়েই তিনি লেখালেখি শুরু করেন। কিন্তু তিনি এও বলেছেন, তা মোটেই ছিল না নিজেকে প্রকাশ করার নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস। বরং তিনি ষোড়শ শতকের ফরাসি প্লেইয়াদ গোষ্ঠী দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন তখন। তিনি বলেছেন, ‘এটা বলা মোটেই যথার্থ হবে না যে, আমি কবি হতে চেয়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম আমার চারপাশের সাথে দ্বন্দ্বে মেতে উঠতে, চেয়েছিলাম একধরনের ঋণাত্মক মনোভাব গড়ে তুলতে, ফ্লবের যাকে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে ঘৃণা হিসেবে উত্থাপন করেছিল। আমি চেয়েছিলাম এক ধরনের ভিন্ন স্টাইল রপ্ত করতে, জীবনের ভিন্নপথে চলতে।’ এ-কারণেই আমরা দেখি, তাঁর কবিতায় জীবন ও জগতের অন্বয়বদ্ধ সিমবিয়োসিস বা অন্যোন্যজীবিতা, যা ব্যাপক আয়তন এবং ভিন্নতর বাচন নিয়ে আবির্ভূত হয়। তাঁর কবিতাতে উপস্থিতি অনুপস্থিতির সঙ্গে অংশগ্রহণের কর্তৃত্ব করে, যা কবিতাকে খেয়ালের মতো শিথিল অথচ কূলপ্লাবী করে দেয়। বহুস্বরিক তাঁর কবিতা, বলার জন্য তা সবসময় উন্মুখ এবং তা বলেও যায় অবলীলাক্রমে। তাঁর কবিতা সম্পর্কে বলা হয় : তিনি পাঠককে এমন এক জায়গায় ঠেলে দেন যেখানে একজন, সময়সম্পর্কিত কবির নিজস্ব অন্বয়ের সূত্রে, দ্যাখে, সত্তার মাঝ দিয়ে উঠে আসা সত্তাকে। একটি কবিতায় তিনি বলেছেন এই বলার অভীপ্সা আর আকাঙ্ক্ষার কথা :
তুমি তো জানো কীভাবে আমি
শব্দ দিয়ে পৌঁছাতে চেষ্টা করি
কী যে অনিবার্য
আর কীভাবেই না আমি ব্যর্থ হই।
কবিতা লেখা এক অনিঃশেষ যাত্রা এবং প্রতিবারই কবি মনে করেন, নিজেকে তিনি নিঃশেষ করে দেবেন পরবর্তী লেখায়; কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত অনিঃশেষিতই থেকে যায়। একটি কবিতা, ‘স্পাইডারে’, তিনি রূপকের আবরণে এও বলেন যে, কবিতা হলো সময়ের সীমান্ত রেখার ওপারে পাড়ি দেওয়ার জন্য অতি ক্ষুদ্র এক নৌকা নির্মাণ করা। পেরোনো বা পাড়ি দেওয়া, এটা হলো সেই গুপ্ত ও সুপ্ত সন্ধান যা চলে নিরন্তর কবির ভেতরে। অর্থাৎ অধরা কবিতার প্রতি অন্ধভাবে ছুটে চলা। নিজেকে তিনি হারমেটিক কবি বলেছেন। তিনি মনে করতেন, তিনি লেখেন সেই আদর্শ ব্যক্তির জন্য যার আছে এক অপর সত্তা। নিজেকে তিনি অধিক প্রবেশযোগ্য মনে করতেন না। তাঁর মাপকাঠি ছিল, কবিতা ঠিক যথার্থ ও প্রয়োজনীয় হয় কি না। গন্ডগোল ও নঞর্থকতার বিরুদ্ধে বাস্তবতাকে তিনি কতটুকু আঙ্গিকায়িত করতে পারলেন, তা-ই ছিল তাঁর ভাবনার জায়গা। তিনি বলেছেন, তাঁর কবিতা সবসময়ই সুপরিসর ফর্মের জন্য এক অন্বেষণ। মিউশ মনে করতেন, বস্ত্তপৃথিবীকে ব্যবচ্ছেদ না করে বরং অনুভব বা ধ্যান করা উত্তম। বস্ত্তর প্রতি এই নিরাসক্ত অভিপ্রায় ওলন্দাজ স্টিল লাইফে পাওয়া যায় এবং শোফেনহাউয়ার একেই বিবেচনা করেছেন শিল্পের সর্বোচ্চ ফর্ম। মিউশও বলেছেন, শিল্পের ভালো একটি সংজ্ঞার্থ হলো এই নিরাসক্ত ধ্যান। দ্য উইটনেস অব পোয়েট্রিতে কবিতাকে তিনি বলেছেন, ‘বাস্তবের সংরাগিত পশ্চাদ্ধাবন’ যা শেষাবধি দূরাবগাহই থেকে যায়। এর সঙ্গে মিলে যায় ভার্জিনিয়া উল্ফের কথা, শিল্প হলো বুনোহাঁসের পশ্চাদ্ধাবন। পুঁজিবাদী পশ্চিম আর সাম্যবাদী পুবের কবিতার ভিন্নতা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, পশ্চিমের কবিতা বিবিক্ত, তা অন্তর্বীক্ষণের অন্তর্দাহে ঠাসা; অন্যদিকে পুবের কবিতা তা নয় মোটেই, কারণ কবিকে সেখানে সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হয়, তৃপ্ত করতে হয় একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতাধরকে। তিনি শিল্পের জন্য শিল্প – এই গোষ্ঠীর লেখকদের সমালোচনা করেছেন। তবে কবি হিসেবে তিনি শেষাবধি বোধহয় তৃপ্তই ছিলেন। ‘রিপোর্ট’ কবিতার প্রথমেই ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞচিত্তে তিনি জানান দেন, ‘হে মহান, তোমার ইচ্ছায় আমি কবি হয়ে জন্মেছি আর এখন আমার সময় রিপোর্ট দাখিল করার।’ দ্য হিস্টোরি অব পোলিশ লিটারেচারে তিনি বলেছেন, কবিতা লেখার কাজ হলো এক বিশ্বাসের কাজ। আমরা জানি তাঁর ক্যাথেলিক বাল্যকাল। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রাচ্য কি পাশ্চাত্য, সমসাময়িক সমাজের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো নৈতিক ভিত্তির অভাব। দ্য ল্যান্ড অব উলরোতে তিনি বলেছেন, আধুনিক মানুষের কেবল আছে মাথার ওপরে নক্ষত্রময় আকাশ আর ভেতরে নৈতিক আইনহীনতা। নিউইয়র্ক টাইমস বুক রিভিয়্যুর সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, তিনি সেই উত্তর খোঁজ করছেন, যা ধর্মীয় বিশ্বাসের অভ্যন্তরীণ ভাঙন থেকে উঠে আসে। সমালোচকেরাও বলেছেন, নৈতিকতায়, নান্দনিকতায়, মূল্যবোধে রোপিত সাহিত্যই তাঁর অন্বিষ্ট। এভাবেই নষ্ট পৃথিবীতে নষ্ট-হয়ে-যাওয়া আধ্যাত্মিকতাকে জাগাতে চাইলেন মিউশ। এর সঙ্গে সহজেই আমরা মিল খুঁজে পাই এলিয়টের। এলিয়টও রীতিমতো দীক্ষা নিয়েছিলেন ক্যাথেলিসিজমে, লিখেছিলেন দ্য আইডিয়া অব অ্যা ক্রিশ্চিয়ান সোসাইটির মতো বই। মানবতাবাদের পরিবর্তে তিনি ক্যাথেলিক ধর্মমতেই বিশ্বাস স্থাপন করে বসে থাকেন। প্রথম জীবনে ঈষৎ হেলে-থাকা নাস্তিক-মার্কসবাদী এবং শেষমেশ রোমান ক্যাথেলিকবাদে আত্মসমর্পণকারী ও আশ্রয়ী চেসোয়াভ মিউশ কি এই ‘বাস্তব’ বা ‘সত্য’ বলতে ঈশ্বরকেই বুঝিয়েছেন? প্রকৃতপক্ষে তা-ই : Religion used to be the opium of the people. To those suffering humiliation, pain, illness, and opium of the people is the belief in nothingness after death, the huge solace, the huge comfort of thinking that for our betrayals, our greed, our cowardice, our murders, we are not going to be judged serfdom, religion promised the reward of an afterlife. But now, we are witnessing a transformation, a true.
(ধর্ম ছিল মানুষের আফিম।যারা অপমান, যন্ত্রণা, অসুস্থতা এবং মানুষের আফিম ভোগ করছে তাদের কাছে মৃত্যুর পর শূন্যতায় বিশ্বাস, বিশাল সান্ত্বনা, আমাদের বিশ্বাসঘাতকতা, আমাদের লোভ, আমাদের কাপুরুষতা, আমাদের হত্যার জন্য আমরা যাচ্ছি না। দাসত্ব বিচার করা, ধর্ম একটি পুরস্কার প্রতিশ্রুতি পরকাল
শেষ জীবন
ভবিষ্যৎ জীবন
কিন্তু এখন, আমরা একটি রূপান্তর প্রত্যক্ষ করছি, একটি সত্য৷)
অনেকে তাঁকে একাধারে সংশয়বাদী আর সাধু বলে অভিহিত করেছেন। ২০০৪ সালের ১৪ আগস্ট, ৯৩ বছর বয়সে কাকাওতে তিনি মারা যান। হাজার হাজার মানুষ তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় শামিল হয়েছিল। পবিত্র ঘটনা হই-হুল্লোড়ে পরিণত হয়েছিল শেষাবধি। কয়েক দিন আগে, উগ্র-জাতীয়তাবাদী ক্যাথেলিকরা অনুষ্ঠানে বিক্ষোভ করে তাদের প্রতিবাদ জানাবে বলে ভয় দেখিয়েছিল। কারণ তাদের মতে, রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়ার জন্য এই নোবেল লরিয়েট না ছিলেন যথেষ্ট পোলিশ, না ছিলেন যথেষ্ট ক্যাথেলিক। শুনলে মিউশ নিঃসন্দেহে আনন্দ পেতেন কারণ একদা তিনিই বলেছিলেন যে, ‘একজন মানুষের অনিবার্য দ্বন্দ্বগুলোই তার শুদ্ধিস্থল।’ বলা সংগত যে, তাঁর মধ্যে এই দ্বৈততা ছিল প্রণিধানযোগ্য। তিনি ক্যাথেলিক, কমিউনিস্ট, নস্টিক, মানিকীয়পন্থী, সংশয়বাদী যিনি বলেছিলেন, ‘আমার সব বৌদ্ধিক তাড়নাই ধর্মীয়।’ সমালোচকেরা বলেছেন, মিউশ বাম বা ডান, কারো কাছেই বন্ধুত্বময় ছিলেন না। দ্য ক্যাপটিভ মাইন্ড লেখার পরও যুক্তরাষ্ট্র প্রাক্তন কমিউনিস্ট সংযুক্তির কারণে তাঁকে সন্দেহ করত। ইউরোপীয় বামপন্থীরা তাঁকে বিশ্বাসঘাতক ভাবত। পাবলো নেরুদা এক লেখায় ‘পালিয়ে যাওয়া মানুষ হিসেবে’ তাঁকে ভৎর্সনা করেছিলেন।
তবে যা-ই হোক, মিউশ বিংশ শতাব্দীর এক গুরুত্বপূর্ণ কবি, যেমনটা তাঁর সম্পর্কে বলেছেন আরেক দেশত্যাগী কবি জোসেফ ব্রদস্কি : ‘আমাদের সময়ের অন্যতম এক মহৎ কবি, সম্ভবত মহত্তম।’
‘আমি মনে করি না যে, নোবেল পুরস্কার আমাকে বা আমার কাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে’।
(#)
চেসোয়াভ মিউশ-এর সুদীর্ঘ কাব্য
“অর্ফিউস এবং ইউরিডাইস”
(অনুবাদ করেছেন – অংকুর সাহা।)
পাতালের প্রবেশপথের সামনে ফুটপাথে পাথরের ফলকের ওপর
ঝোড়ো হাওয়ায় অর্ফিউস কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে
বাতাস বিঁধছে তার পোশাকে, মিলিয়ে যাচ্ছে কুয়াশার তরঙ্গে,
উড়িয়ে দিচ্ছে গাছের পাতা। তার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির হেডলাইট
ঢেউ এর ওঠানামার মতন প্রখর ও মৃদু হতে থাকে।
তিনি থামলেন কাচের দরজার বাইরে, সন্দিহান
শেষ বিচারের মুখোমুখি হবার শক্তি অবশিষ্ট আছে কি না।
মনে পড়লো সেই নারীর কথা: “মানুষটা তুমি ভালো।”
কিন্তু বিশ্বাস হয় না। তিনি জানেন — গীতিকবিরা
সাধারণতঃ — কঠিন হৃদয়ের মানুষ।
অনেকটাই অসুখের মতন। শিল্পে নিখুঁত হবার প্রচেষ্টা
তার পরিবর্তে এরকম ব্যাধি হতেই পারে।
কেবল নারীর প্রেম তাঁকে করেছে উষ্ণ, মানবিক।
সেই নারীর সংস্পর্শে নিজেকে অন্যরকম ভাবতে পেরেছেন।
সে এখন মৃত, কিন্তু তাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভাঙতে পারেন না তিনি।
দরজা ঠেলে ঢুকলেন তিনি, ভেতরে গোলকধাঁধার মধ্যে হাঁটা
বারান্দা, এলিভেটর। জীবন্ত আলোক, কিন্তু আলো নয়
পৃথিবীর জড়ো করা অন্ধকার।
ইলেক্ট্রনিক গোয়েন্দা কুকুর নীরবে পার হল তাঁকে।
অনেক তলা নামলেন তিনি: একশো, তিনশো, আরও নীচে।
শীতবোধ হল তাঁর, বুঝলেন তিনি অস্তিত্বহীন।
হাজার হাজার বরফজমা শতাব্দীর আচ্ছাদনে,
বংশানুক্রমে মৃত মানুষজনের পড়া ছাই জমে জমে,
তৈরি হয়েছে এক রাজ্য — অতল ও অন্তহীন।
তাঁকে ঘিরে ধরে চলন্ত ছায়ার ভিড়।
তিনি চিনতে পারেন কয়েকটি মুখ।
রক্তে অনুভব করেন ছন্দ।
অপরাধবোধ সমেত হলেও নিজের জীবনে তাঁর গভীর বিশ্বাস
যাদের ক্ষতি করেছেন তাদের মুখোমুখি হবার ভয়।
কিন্তু মনে রাখার মতো কোনো ক্ষমতা নেই তাদের
কবিকে একঝলক দেখে, তারা আপনমনে চলে যায় নিরাসক্ত।
প্রতিরক্ষার জন্যে সঙ্গে আছে একটি নয়-তারের বীণা।
তিনি বয়ে এনেছেন তাতে পৃথিবীর সংগীত, যে অতল গহ্বরে
সব শব্দ লীন হয়ে যায় নীরবে, তার বিরুদ্ধে।
সংগীতের পায়ে নিজেকে সঁপে দেন তিনি, মিশে যান
গানের বাণীর ঝংকারে, উৎকর্ণ হয়ে শুনতে শুনতে,
নিজেই বীণার মতন তার যন্ত্র হয়ে দাঁড়ান।
শেষে তিনি পৌঁছে গেলেন সম্রাটের প্রাসাদে।
পার্সিফনি, তাঁর বাগানে শুকনো আপেল আর ন্যাসপাতি গাছের,
কালো হয়ে যাওয়া নগ্ন ডাল আর পচাগলা পল্লবের ফাঁকে,
শোকমিছিলের মতন বাদামিরঙা সিংহাসনে বসে কান পেতে শোনেন।
কবি গান গেয়ে যান উজ্জ্বল প্রত্যূষের আর সবুজ নদীর সংগীত,
গোলাপিরঙা ভোরে জল থেকে উঠে আসা ধূসর ধোঁয়ার গান
আরো অনেক গান; রঙের: গাঢ় লাল, গভীর লাল, পোড়া তামাটে, নীল,
পাহাড়ের পদতলে সুখনিবিড় সমুদ্রস্নানের,
নীচে বন্দরের জেলেডিঙির কোলাহল শুনতে শুনতে ছাদে ভুরিভোজের,
মদ, জলপাই তেল, বাদাম, সর্ষে, লবণ চেখে দেখার,
চড়াই আর বাজপাখির জীবন্ত উড়ন্ত ডানার,
উপসাগরীয় আকাশে উড্ডীন সম্মানিত পেলিক্যান ঝাঁকের,
বর্ষায় ভেজা মুঠো মুঠো লাইলাক সুগন্ধের,
সর্বদা মৃত্যুর প্রতিরোধে কথা সাজিয়ে লেখা তাঁর
অনস্তিত্বের প্রশংসায় তিনি ছন্দ মেলাবেন না কোনোদিন।
দেবী বললেন, জানি না, তুমি ভালোবেসেছ কিনা সেই নারীকে
কিন্তু তুমি এসেছ তার পিছু পিছু তাকে উদ্ধারের আশায়।
আমি তাকে ফিরিয়ে দেব তোমার হাতে। কিন্তু শর্ত থাকলো —
ফেরত যাত্রায় তার সঙ্গে কথা বলা নিষেধ, এমন কী
একবার ঈষৎ ঘাড় ঘুরিয়ে, সে পেছনে আছে কিনা, দেখাও নিষেধ।
হার্মিস সঙ্গে নিয়ে এলেন ইউরিডাইসকে
সে আর আগের মতো নেই, সব চুল শাদা,
তার চোখের পাতা নত, ছায়া ঘনায় অক্ষিপঙ্খে।
পুতুলের মতন পা ফেলে ফেলে সে এলো প্রভুর হাত ধরে
এবং তাঁর নির্দেশ অনুসরণ করে। অর্ফিউসের ইচ্ছে হল
তাঁর নাম ধরে ডাকেন, ভাঙান তাঁর শান্ত নিদ্রা।
কিন্তু কিছু করার নেই, শর্ত মানতেই হবে।
রওনা হলেন তাঁরা। প্রথমে কবি নিজে, আর তারপর, এবং ঠিক
তারপরও ওই, দেবতার চটির চটচট, তার পায়ের মৃদু মেয়েলি টুপটাপ
পরনের ঘিরে থাকা জোব্বার জন্যে অনিশ্চিত পদচারণা।
হঠাৎ চমকালো সামনের খাড়া চড়াই পথ
অন্ধকার গুহার দেওয়ালের মতন।
কবি থামলেন এবং কান খাড়া করলেন। তারাও থামলো
এবং থামলো তাদের পদশব্দের প্রতিধ্বনি।
আবার তিনি চলতে শুরু করলে, দ্বৈত পদশব্দও শুরু হল।
কখনো খুব কাছে, কখনো বেশ দূরে।
ফাটল ধরলো তার বিশ্বাসে, সন্দেহ জাগলো
এবং জড়ালো তাকে শীতল পুষ্পলতার মতন।
যে কোনো মরণশীল মানুষের মতন তাঁর অবস্থা এখন,
মৃতকে জাগিয়ে তোলার মানবিক আশা হারিয়ে তিনি অসহায়,
কান্না পায়, কিন্তু উপর নেই কাঁদার।
নীরব তাঁর বীণা, তবু তিনি স্বপ্ন দ্যাখেন, প্রতিরক্ষাহীন একা।
মনে বিশ্বাস রাখা প্রয়োজন, কিন্তু বিশ্বাস এখন অসম্ভব।
আরও অনেকটা পথ — সহ্য করো, ধৈর্য ধরো;
আধো নিদ্রায় পা গুনে গুনে হাঁটেন তিনি।
ভোর হয়ে আসে। চোখের সামনে জেগে ওঠে পাহাড়।
পাতাল থেকে উজ্জ্বল চোখে বেরিয়ে আসেন তিনি।
যা ভেবেছিলেন, তাই হল। পেছন ফিরে তাকালেন তিনি —
শূন্য পথ জনহীন, কেউ কোথাও নেই।
সূর্য এবং আকাশ। সাদা সাদা মেঘ আকাশে।
কেঁপে ওঠে চরাচর তাঁর শ্রবণে – ইউরিডাইস!
তোমার সঙ্গে ছাড়া, সান্ত্বনা ছাড়া কিভাবে বাঁচবো আমি!
চারিদিকে বুনো ওষধির সুরভিত সুগন্ধ, মৌমাছির মৃদু গুঞ্জন,
সূর্যালোকে উষ্ণ ধরায় কপোল ছুঁইয়ে নিদ্রা যান কবি।
টীকা : যেহেতু গ্রিক পুরাণের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ অনিয়মিত এবং সুদূর, কবিতাটির চরিত্রগুলির বিষয়ে অল্প কিছু কথা বলা বিধেয়।
পাতাল: গ্রিক পুরাণে এবং বাইবেলের নতুন সুসমাচার উল্লিখিত হেইডিজ; মৃত মানুষের বাসস্থান।
অর্ফিউস: গ্রিক পুরাণের কবি ও গায়ক। মৃতা স্ত্রী ইউরিডাইস এর আত্মাকে অনুসরণ করে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন পাতালে এবং সম্রাট প্লুটোকে খুশি করে অনুমতি পান স্ত্রীকে মর্ত্যে ফিরিয়ে আনার। শর্ত ছিল, ইউরিডাইস স্বামীর পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে মর্ত্যের দিকে যাবেন। কিন্তু পিছু ফিরে তাকানো চলবে না অর্ফিউসের। যাত্রাপথের প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে অর্ফিউস পেছন ফিরে তাকান এবং ইউরিডাইস হারিয়ে যান চিরকালের মতন। প্রসঙ্গত: উল্লেখযোগ্য যে কবির স্ত্রী ক্যারোলের মৃত্যু হয় ২০০৩ সালে এবং তার কয়েক মাস পরে কবিরও মৃত্যু।
পার্সিফনি: গ্রিক দেবতা জিউস এবং ডিমিটারের কন্যা। পাতালের সম্রাট প্লুটো তাঁকে হরণ করে আনেন এবং রানীর মর্যাদা দেন। স্ত্রীকে তিনি অনুমতিও দেন প্রতি বছর কয়েক মাস মর্ত্যে এসে থাকার। ঠিক সেই সময় নাকি বসন্ত আছে ধরায়।
হার্মিস: স্বর্গের ঘোষক এবং সংবাদবাহক দূত। অবসর সময়ে পথ, বাণিজ্য, আবিষ্কার, শঠতা এবং চৌর্যবৃত্তির দেবতা।
[কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করেছেন রবার্ট হাস এবং কবি নিজে। অনুবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল “দি নিউ ইয়র্কার” পত্রিকার মে ১৭, ২০০৪ সংখ্যায়।]