Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পিঞ্জরে বসিয়া শুক || Kamal Kumar Majumdar » Page 6

পিঞ্জরে বসিয়া শুক || Kamal Kumar Majumdar

যাহা এইরূপ–তিনি তাঁহার অফিস কামরা হইতে প্রায়শঃই লক্ষ্য করিতেন, কিণ্ডারগার্ডেনের শিশু যাহাদের তিনি দেশের ভবিষ্যৎ বলিয়া অভিহিত করিতেন, শিশু বলিয়া নহে। ইহাদের–পুরাতন মরিচা-ধরা টিনের নিকট পরিবৃত হওয়ত এক জটলা, টিফিন খাইতে থাকিয়া ইহাদের অদ্ভুত কথা কাটাকাটি চলিত!–প্রধান শিক্ষয়িত্রী রুটিন ও নানান খাতা হইতে যাহা প্রত্যক্ষ করেন, এমনও যে ক্লাস চলিবার কালে অনেক শিশুই বাহিরে আসিয়া সেই পথে গমনাগমনের সময় ঐখানে কিছু সেকেণ্ড নিশ্চল, শুধু মাথার ফিতা স্পন্দিত, কখনও স্কার্ট নড়ে, কিন্তু কোনদিনই, ব্যাপার যে কি তাহা জানিতে অবসর ঘটিয়া উঠে না।

অথচ বাল্যখিল্যরা মালীকে হটাইয়াছে, ইহা তাঁহার চোখে পড়ে, মালীকে তাহারা মারিবে ইহা শুনিলেন, হয়ত অনেক ছোট ছোট হাত উদ্যত তাহা কল্পনা করিলেন। ইহারা বৃষ্টি মানে না, উহাদের চোখ বড় হইয়াছে, কেহ মস্তকে হস্ত স্থাপন করিয়াছে, কেহ টিফিনের কিছু সেখানে দিয়াছে। এক দিবস, সেই দিন খালি রোদ, ঐ টিনের সন্নিকটে ভারী সোরগোল, তুমুল উদ্দীপনা, আমি আগে,…আমি দেখিয়াছি…না মনু ফাষ্ট তারপর আমি…!

তর্জ্জনী নির্দ্দেশ এক্ষেত্রে মারাত্মক, কেহ যদি ভুলক্রমে তর্জ্জনী দেখাইল, তৎক্ষণাৎ নির্দ্দেশকৰ্ত্তার তর্জ্জনী কেহ দংশন করিয়া দিয়াছে। একে অন্যরে মুষ্টিবদ্ধ করত ঐ টিনের দিকে দৰ্শাইয়াছে। আঃ স্বর তাহাদের অবাক মনোহর! তাহাদের হাঁ অনেকটা, ফোকলা যাহারা তাহাদের হাঁ তাৎপর্যপূর্ণ।

সেই দিবসই তিনি সেই আকৃষ্ট স্থানে যাহা নেহারিলেন, তাহাতে তিনি হাসিতে গিয়া কালো, যে এবং বজ্রাহত, একটি আবীজ আপনারে উন্মোষিত করিতে আছে–সূৰ্য্য ফাড়িয়া বর্ণসকল ফাড়িয়া কি এক দাম্ভিকতা। একি মাভৈঃ! কি এক মমত্ব!

উহার আঁশ সকল রোমশ, পসলা বারিপাত হেতু এক-আধ জলবসা নিটোল তাহাতে এ পর্যন্ত, কীদৃশী জঘন্য! কি লাম্পট্য! কোথাও কার এক গোপন রাত্র, শিকল-তোলার শব্দ যেখানে অহেতুক, প্রধান শিক্ষয়িত্ৰী যুগপৎ অসম্মানিত বিভীষিত হইলেন, বয়সী বালিকারা ইহা কি দেখিয়াছে? দেশের ভবিষ্যৎ অপ্রার্থিত কহিল, উহাতে বাঁশী হইবে!

ফোল্লা যে সে কহিল আমরা বাজাইব…আমি ফাষ্ট! ৩২২

অতীব বুদ্ধিমতী প্রধান শিক্ষয়িত্রী ঝটিতি চশমা খুলিলেন, বাস্তবতা ঝাঁপসা হইল। চোরা-অপম্মার তাহাতে উদঘাটিত হইল। মহা রোষে তিনি আজ্ঞা করিলেন,–যাও ক্লাসে।

তাহারা সকলে স্তম্ভিত, ধীরে পিছু হটে! কোন অবোধ কহিল,–টিফিন ত!

তিনি কর্কশ স্বরে কহিলেন,–গো! তাহারা পিছু খানিক হটিল যেন নাচে, হঠাৎ ঘুরিল, ছুটিল, তাহারা হাসিতে ছত্রাকার! ঘণ্টা বাজিল।

ইস অঙ্কুরিত ফাটা আবীজ কি অসভ্য!

আম্রবীজে তাঁহার প্রধান শিক্ষয়িত্রীর রন্ধন আউলাইল, উহা স্পর্শ করিবার কথায় তাঁহার জ্বর দেখা দেয়, তিনি বালি চাপা দিবেন? অবশেষে ঐ টিন সমেত উহা কোথাও, প্রাচীরের অন্যধারে, নিক্ষেপ করাই মনস্থ করিলেন। কয়েক দিবস পরে তিনি টর্চ হাতে, স্কুল যাইলেন। নিঃসঙ্গ স্কুল! দরওয়ান গেটে! মালীকে তিনি চিঠি ছাড়িতে পাঠাইলেন, হায়! তাঁহারে মিথ্যার শরণাপন্ন হইতে হইল। এখন টর্চের রশ্মিতে রামধনু বিচ্ছুরণে সেই বেলেল্লা, নোংরা, ব্যভিচার, শৃঙ্গার লালসা (!) উহাতে আবীজ যেন বেপথু!

প্রধান শিক্ষয়িত্রীর ভাব যেমন বা ঈর্ষান্বিত তাহা নিরীক্ষণে কিন্তু ইহা নহে।

ঐ আদিরসাত্মক বৈভব হইতে এক নিরীহ কমনীয় হরিৎ কাণ্ড উদ্ভূত যাহার শীর্ষ যুগ্ম পিঙ্গল-বেগুনী পত্ৰমণ্ডিত, ইহা কুলটার ভান এমত!

মৃদু শ্রাবণ বাতাসে দুলিতে আছে…মনুষ্য জাতি হিসাবে তিনি উহা অবলোকন করিলেন, মনুষ্য হিসাবে তাহার স্মৃতি নাই! তিনি ইংরাজি বলিতে বাঙলা, বাঙলা বলিতে হিন্দি, পুনৰ্ব্বার ইংরাজিতে আপনাকে, দাস আপনাকে, প্ররোচিত আপনাকে হুকুম করিলেন; কিন্তু টিন চাগাইয়া তুলা অসম্ভব হইল; যে তদনন্তর তদীয় মুখমণ্ডল অশ্বখুর দষ্ট হইল। তিনি ঝাঁপাইয়া পড়িলেন, এক পৈশাচিক ধ্বংসউন্মাদনায় তিনি কম্পিত, ঐ মৌনতাকে বিনষ্ট করিলেন। তাঁহার বিদ্যার ডিগ্রী অম্লান রহিল– তাঁহার সৌখীন এক লহমার অনুতাপ, স্বীকারোক্তির, নিমিত্ত এই নৃশংস দুষমনী সংঘটিত হইল!

ভারতের জাতীয় চরিত্রটি তাঁহার প্রধান শিক্ষয়িত্রীর কন্যাদ্বয়ের প্রতি চাহিয়াছে, ইহা তাঁহার নজরে এতক্ষণ পরে আসিল, সেই ব্যক্তি যে দাবার খুঁটির ন্যায় সকলের অজানিতে সান্নিধ্যে আসিবার কারণে বহু আসন বদলাইয়াছে, ইহা তিনি বুঝিলেন, বুঝিলেন কন্যাদ্বয় স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে না। তিনি উঠিয়া সেখানে যেখানে সুঘরাই তাহার খাঁচাটি কিছু তুলিয়া ধরিয়াছে! আর দাশ মহাশয় নৃত্য হইতে চোখ ফিরাইয়া উহাতে মনোনিবেশ করিলেন।

এবং মনিব মহাশয় উল্লাসে আপন সহধর্মিণীরে জ্ঞাত করিতেছিলেন,–তোমারে পূৰ্বেই। বলিয়াছি…দেখ…আমার কথা সত্য ত…বলি নাই হারামজাদা খাঁচা সাজাইতেছে?…দারুণ সাজাইয়াছে। যেন রেড ইণ্ডিয়ান হেড! পাখীটি কি গর্বিত দেখ…!

স্নেহশীলা মনিব পত্নী তদুত্তরে বলিলেন,-মরণ, ছোঁড়া তোকে কত বারই বারুণ না করেছি…রেতে গাছে হাতে দিতে নেই…তখন দেবতারা আসেন…সত্যিই ডেলিয়াগুলো আঃ ঐ সান ফ্লাওয়ারটা…মনে হচ্ছে এখানেই ফুটেছে…পাখীটা সাক্ষাৎ…সাক্ষাৎ…চমৎকার না!

দাশ মহাশয় এতক্ষণ নাচ উপভোগ করিতেছিলেন, ঘুঙুরের আওয়াজ–অবশ্য মাত্র পুরুষ নৰ্ত্তকদের পায়ে–গানের সঞ্চার এবং উল্লম্ফন ও দৈহিক দোলাতে তদীয় কাশির শব্দ অবধি বদলাইতে আছিল, যে তিনি তাহা সম্যক বুঝিতে পারিয়াছিলেন, এই দেহ স্থাপত্য-ধ্বনি সঞ্জাত, এখন কিন্তু আর সেই সত্যের রেশ নাই, এখন ইন্দ্রিয় সজাগ প্রায়!

একদা ছাতা বন্ধ করিতে চাহিলেন, যে তিনি নৃত্যর পশ্চাতে বৃক্ষসকল, ক্রমে দূরে রিখিয়ার নিগূঢ় আকাশ পর্য্যবেক্ষণ করিলেন! যেন সদ্য বিধবার ক্রন্দনধ্বনি শুনিলেন, (যেমন তদীয় স্ত্রীর অশৌচ বস্ত্র পরিহিত বালককে দর্শনে স্বস্তি হয়) তদনন্তর পুনৰ্ব্বার নর্তকীদের প্রতি একাগ্র কিন্তু ইউক্যালিপটসের পত্ৰমৰ্ম্মরে স্বামী-হারা বিলাপ নিশ্চিহ্ন হইল। তাঁহাকে অধৈৰ্য্য করিল–তিনি নাচ দেখিবেন! ভূমিতে পদাঘাতে উড়ন্ত ধূলায়, নৃত্যতে সাধারণ পদক্ষেপে হইতে, সকলকে উদ্বুদ্ধ করিতেছে। এমত কালে মনিব মহাশয়ের সংযম তাঁহারে আকৃষ্ট করিল, তিনি এক খাঁচা দেখিলেন।

অথচ ইতিমধ্যে সেই পুরুষবেশী বালিকাকে বেণী দুলাইয়া বলিতে শুনিলেন,–আমি যদি নিজেরে হত্যা করি মানে বিষ খাই তাহা হইলে জেল হইবে।

তদুত্তরে বালিকা কহিল,–কি করিয়া!

পুরুষবেশী বালিকা বলিল, তাই ত শুনিলাম…!

উত্তর হইল,–আমি যদি আমাকে মারি তাহাতে কাহার কি?

এই কলহ পার হইয়া দাশ মহাশয় খাঁচাটি বিশেষ তীক্ষ্ণ সূক্ষ্মতায় নিরীক্ষণ করিতেছিলেন, কেহ টর্চ ফেলিয়াছে, পাখীটি সুস্পষ্ট যাহাতে, এখানে ফুল ছিল, সুতরাং নির্মল আনন্দ প্রকাশের দিক ছিল। অতএব ছাতার কারণে আর তাঁহার খুঁং থাকে না, তিনি আনুনাসিক স্বরে স্বভাব-ভীত ভাবে প্রশংসা করিলেন,–সত্যই এবম্প্রকার দৃশ্য অমৃতবর্ষী…দেখুন কুসুম সকল, তখনই মনে হয় কোথাও এক স্বচ্ছতোয়া নদী আছে…কুসুমের বর্তমানতা…আঃ!

এমত সময় অহঙ্কার মদমত্ত সুঘরাই, যাহার মুখের নিকটে খাঁচা থাকার দরুণ, যে দেখিতে পাইল পক্ষী ঐ তুমুল আলোতে দুই একটি পোকা খাইতে চঞ্চু পৃথক করে, গোলাপী অভ্যন্তরে ক্ষণেক, খুট শব্দ হয়, গলদেশ উঠে-নামে, যে তন্নিবন্ধন বালক সুঘরাই যথার্থ অপদস্থ, কেন না পক্ষীর তাদৃশ তৎপরতায়ে তাহার কল্পনা ম্লান হইতেছে, সে আশা করে যে তাহার পক্ষী লক্ষ্মী হইয়া থাকিবে, ভদ্র থাকিবে; যে রুক্ষদৃষ্টিতে তাহাকে শাসন করে, তোমাকে এত খেলা শিখাইলাম, কসরৎ শিখাইলাম, কত কি শিখাইলাম, সবই পণ্ডশ্রম হইল, যে এবং তাহাতে, সুঘরাইতে, কোপনতা আসিতেছিল।

সে অস্ফুট স্বরে পক্ষীটিরে সাবধান করিয়াই জনসমাবেশের দিকে বড় করুণভাবে তাকাইল। তৎকালেই ঐ খাঁচাটি বিশেষ সশব্দে নড়িয়া উঠিয়াছে, যে যাহাতে সে দৃষ্টি ফিরাইতেই নিরীক্ষণ করিল, সান ফ্লাওয়ার খসিতেছে, ইহাতে সে ঝটিতি রুষ্ট এবং অন্য কাহারও বিবেচনার সময় না দিয়া খাঁচার উপর এক চাপড় মারিল, পক্ষী ত্রাহি স্বরে ডাকিল।

মনিব পত্নী তৎক্ষণাৎ বলিলেন,–এই তুই…কি করছিস…পাগল নাকি…!

মনিব মহাশয় বলিলেন,-হারামজাদা তাই বলিয়া অত জোরে চাপড় দিতে কখনও আছে…খাঁচা ভাঙ্গিয়া যাইত, পক্ষী ভয়ে পালাইত…আর বলিবেন না, সেদিন বৃথা আমার প্রায় একডজন গুলি নষ্ট হইল…ঠিক এইভাবে,…দেখ বেচারী এখনও ভয়ে অস্থির…আ হাহা, তিতি বল, বল,…নিগার কোথাকার!

দাশ মহাশয়ের কাশি স্বাভাবিক হইয়াছে এমত সংঘটনে, যাহাতে তিনি মনোজ্ঞ অনুনাসিক স্বরে, অর্গান বাদ্যযন্ত্রের কিয়ৎ রেশ আছে যাহাতে, বিস্তার ব্যাখ্যা করিলেন,–যথার্থ এতদ্দর্শনে বারম্বারই এই সত্য মনে আসে, পরম কল্যাণময় ঈশ্বর…যিনি সবার প্রভু,…মঙ্গলময় তিনি…চাহেন কেহ কাহারেও দুঃখ দিও না,.এখন এই পক্ষীর সূত্রে বলা যায়…ইহাদের আমি সৃষ্টি করিয়াছি, ইহারা আমার, ইহারাই প্রকৃতির প্রকৃতিই, আমি ইহারাই প্রকৃত!

এই পৰ্য্যন্ততে, যেন অতীব গূঢ় কিছু মীমাংসা ব্যক্ত করিতে, দাশ মহাশয় সমর্থ হইলেন; রহস্যসই করাই তাঁহাদের সাধনরীতি, যে এবং অধুনা তাঁহার গাম্ভীর্য অনুধাবনে ইহাই অনুমিত হইবে যে জীবন হইতে জীবনীর প্রতি তাঁহার শ্রদ্ধা আছে; কিন্তু তিনি নিজে যেমন জীবনীর চাপে কবে যেন মৃত…এখন কালো ছাতার পশ্চাদপট ক্রমে ইহাই বুঝায়–যেন কোন এক ছোট স্টেশনে তাঁহার লাশ পড়িয়া আছে।

এখন দাশ মহাশয় শুধু অনুনাসিক স্বর মাত্র। যে পার্শ্ববর্ত্তী নীরবতা, যাহা যেমন ধমক খাওয়া, যদিও সবাই তির্যক দৃষ্টিতে নাচ দেখে; ইহা তাঁহাকে অনুপ্রাণিত করিল, যে আবার সেই সঙ্গে তাৎপর্য্যপূর্ণ কাশির শব্দ ও অবিলম্বেই চোস্ত বাচনভঙ্গি শ্রুত হইল,–মঙ্গলময় সদাসর্বদা বলিতেছেন, নদী গিরিমালা লতাগুল্মবৃক্ষ কীটপতঙ্গের ভাষায়–তাহাদের সকলের ভাষায়…তোমরা আত্মসুখপরতন্ত্র ইহাদের খাঁচায় আবদ্ধ করিওনা…প্রকৃতিকে ফিরাইয়া দাও…ইহাদের সুখদুঃখ আমি জানি…তোমরা আত্মসুখে নিমজ্জিত…ইহাদের সুখদুঃখ বেদনা তোমরা কিছুই বুঝ না…ইহাদের পুষিও না…উহাতে পাপ হয়–!

সমবেত জনমণ্ডলী, নাচ দেখার ফাঁক মধ্যেই খুব একাগ্র, দাশ মহাশয়ের তত্ত্বাদেশ শুনিলেন, যারপরনাই পরিতুষ্ট হইলেন; সকলেই একবাক্যে এবং যে সাধুবাদ জ্ঞাপনকরত বলিলেন,-মহাশয় আপনি সঠিক চিন্তা করিয়াছেন। ইহার পর তাহারা সুঘরাই, যে অপ্রতিভ যে থতমত আছে, তাহারেই অবলোকনে ঈষৎ ভ্রূকুঞ্চিত করিলেন–সুঘরাইএর এতক্ষণ পরিবৃত উচ্চবর্ণের মধ্যেও এতটুকু আঁট বোধ হয় না, কিন্তু ইদানীং সকলের এহেন মনোভাব অনুভবে, সে খুব অস্বস্তিতে আপন প্রভুর প্রতি অসহায়ভাবে তাকাইয়াছিল।

মনিব মহাশয় যিনি এবম্ভূত দাশ মহাশয়ের বচন পরম্পরায় মৃদু হাসিতেছিলেন। তাঁহার কোন কথাই মানে লাগিবার নয়, কেন না দাশ মহাশয় শুধু বলিবার জন্যই বলিলেন, উনি কিছু আদিষ্ট পুরুষ নহেন; তাই তিনি শুধু নিবেদন করিলেন,–মহাশয় আপনি যা বলিলেন তাহা সত্য…তবে আমরা জড়…জড়বাদীর মানে…অবশ্য এক হয়, তিনি আছেন, তিনি যদি আসিয়া বলেন…তাহা হইলে অন্য কথা। আদতে ইনি, মনিব মহাশয় বলিতে চাহিয়াছিলেন, জড়বাদীর উপলব্ধ ভগবৎ প্রসঙ্গ বৃথা! কিন্তু আপনাকে, উচ্চবংশীয় সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ ইনি যেহেতু, সংযত রাখেন। এবং বরং আপন প্রিয় ভৃত্যরে। ধীরতার সহিত আজ্ঞা করিলেন,–আর পাপে প্রয়োজন নাই, ইনি যাহা কহিলেন তাহা অর্থপূর্ণ সত্যই, সুঘরাই তুই ঐ পক্ষীটিরে কল্যই জঙ্গলে ছাড়িয়া আসিবি…!

মমতাময়ী ধৰ্ম্মশীলা মনিব পত্নী তদুত্তরে স্বামীরে একান্তে লইয়া বাধা দিয়াছিলেন,–কি যে অলুক্ষুণে কথা বল…এই সন্ধ্যে মানে সবে সন্ধ্যে উতরোল, কেন মৎতে ও পাখী ছাড়বে ছি ছি…তুমি কি যে বল…মনে নাই ব্রজবাসী কি বলেছিল…পাখী পোষা কি যাতা…সে কথা তুমি ওনাকে বলছ না কেন?…অথচ মনে হল তুমি ওনাকে ঠাট্টা করলে যেন…!

মনিব মহাশয় বিনীত স্বরে প্রকাশিলেন,–তুমি বৃথাই আমারে দোষারোপ কর, আমি তামাসা করি নাই, যদি করিতাম উনিও তাহা বুঝিতেন, দেখ ভঁহার মুখমণ্ডল…আর জঙ্গলে ছাড়িবার কথা উহাতে সত্যই নাই…যাহারা ভগবানকে ঐরূপ জানে তাহাদের কোন কথা বলা নিরর্থক…!

মনিব পত্নীর আজও সেই ব্রজবাসীর (এই বৈষ্ণব যিনি বৃন্দাবনে থাকেন–ইহা নাম নহে) কথা মনে হয়, তাদৃশ সদানন্দময় মানুষ কমই চোখে পড়ে, ইনি মাঝে মাঝে কলিকাতায় তাহাদের বাড়ীতে আসিতেন, পূজার দালানে থামের নিম্নে বসিয়া যাঁহাকে তিলক সেবা করিতে তিনি দেখিয়াছেন, মুখে অহরহ কৃষ্ণ নাম; ইনি বলিয়াছিলেন,–ওহো তাহা নয়, খাঁচার পাখীতে মন আরোপ কর, মন আরোপের জন্যই পাখী পোষা–এই মরদেহ খাঁচা ঐ পাখী আত্মা…এ জানাই ঠিক জানা…! এই ভাব লও!

যে উপস্থিত হিরণার টিলায় প্রধান শিক্ষয়িত্রী সাঁওতাল নৃত্যের দিনকার তত্ত্বালোচনার উল্লেখে, মনিব মহাশয় শান্ত কণ্ঠে জানাইলেন,–দাশ মহাশয়ের কথায় তত্ত্বাভিজ্ঞতা আহে, উহা সূক্ষ্ম, সামান্য মানুষে উহা কেমনে ধারণা করিবে…সাধকরা উদ্দীপনার জন্য অনেক সময় পাখী পুষিয়া থাকেন…সে কথা ধরি না, তবে আপনি জানেন, বেদনা দুঃখ বুঝে না সাধারণে…মানুষের ক্ষমতা কতটুকু, সে ডাক্তারী করিতে পারে…কোন কিছুর বেদনা স্বয়ং অন্তর্যামী নারায়ণ বুঝিতে পারেন বা তাহার অবতার যেমন। ঠাকুর পারেন…মানুষ ছার!…তবে তিনি আমাদের ভালবাসা কথাটা জানাইয়াছেন…আমাকে একজনের। বা শতজনের মৃত্যু সংঘটনের ক্ষমতা যখন দিয়াছেন তখন নিশ্চয় তিনি ভালবাসার ঐশ্বৰ্যও দিয়াছেন। তবে নিশ্চয় তাঁহাকে জানাতেই সেই ভালবাসা আসে–তবু সুঘরাইকে যখন দেখি–উনি তিতি করিয়া ডাকিলে সাড়া দেয়, অবিকল তিতিরের মতোই আসে, তেমনই অদ্ভুত পদবিক্ষেপে ঘুরে…ইহা সেদিন আমার নজরে পড়িল, ভাবিয়াছিলাম যে উহা সাঁওতাল নাচ দর্শনে শিখিয়াছে, কেন না একই ভঙ্গিমা, একই ফের, অভিন্ন–কিন্তু উনি আমার সন্দেহ ঘুচাইলেন।

মনিব পত্নী সপক্ষে কহিলেন,–হ্যাঁ ছোঁড়া বরাবরই তিতিরের মত ভাবভঙ্গী করে, জানেন…আবার ছোঁড়া তিতিরটাকে নানা কিছু শেখায়, কত খেলা…ওগো সেইটে বল না, ও ছোঁড়া খাঁচার কাঠি ভগ্ন জায়গায় নিজের আঙুল বেঁধে জোড়া দিয়েছিল–আমি ত দেখে হেসে বাঁচি না…অন্য হাতে খাঁচাটা চাগিয়ে আমায় এনে দেখালে! আমার মনে হয় ও ছোঁড়া আজন্মে পাখীটার কেউ ছিল…আমি ভাবছি ওর মুরগী কাটা ছাড়িয়ে দেব…ওতেই মনে হয় বুঝলে…এখন আমার মনে হচ্ছে…তাছাড়া যখন পুষছে তখন ভাল নিশ্চয় বাসেই…।

মনিব মহাশয়, সুঘরাই আমার ধ্রুব বিশ্বাস উহারে খুব ভালবাসে, ভয়ঙ্কর ভালবাসে….. সুঘরাই ও তাহার খাঁচা এখন আবছায়ার কিছু, সুতরাং শুধুই ভালবাসা শব্দ আপনার বিশেষত্ব লইয়া প্রকট হওয়ত মায়া ধরিতেছিল। রিখিয়ার এই বিরাট চৌদিকের সর্বত্রে–প্রধান শিক্ষয়িত্রীর আর নেত্রপাত যযা ছিল না, ভালবাসা শব্দে তদীয় অধীনরাও নিজেও যেন কু কুঁ শব্দ করত ভীত! এই স্থল বুনো, লাট্টা খাম্বার শব্দ এতটুকু স্বাভাবিক করে না, কেহই সুতরাং নিজেকে জানে না। গা কেমন যেন ছম ছম করিতে আছিল। একমাত্র সুঘরাই ভাবিতে ছিল নূতন কোন অভিনব ধারায় খাঁচাটি সাজাইবে।

সুঘরাই অবসাদে নৈরাশ্যে যারপরনাই ক্লীব আছে, তাহার কান্দিবার মত আর ক্ষমতা ছিল না, ইহা যে শহরের অংশ তাহাও জ্ঞান ত নাই, এখন তাহার ভাবনাতে একমাত্র যে বাস্তবতা ছিল তাহা হয় ঘুম, নিজের ঘুমকে, যাহার চেহারা যেমন বা সে স্পষ্টই প্রত্যক্ষ করে, সে বড় ভয় পাইতেছিল, ইতিমধ্যে দুয়েকবার তন্দ্রাচ্ছন্ন হওয়াতে আতঙ্কিত বটে হইয়াছে।

পশ্চিমের আকাশ তাহাকে পীষিতেছিল, কেন না সন্ধ্যা সমাগত–নিজেকে এখন তাহার প্রহার করিতে ইচ্ছা করে, সে টলিতে টলিতে যেদিকে আরও কোলাহলপূর্ণ, যেদিকে সে ঘুম ভুলিতে পারে, সেই অভিমুখে শ্লথ পদক্ষেপে চলিতে আছিল। কুয়ায় হইতে জল তুলিবার শব্দে, কুয়া বাঁধান পাথর, যে স্থলে অপেক্ষাকৃত বেশী আরামদায়ক ঠাণ্ডা, সেখানেই সে থ, সে যেমন জাগিতেছে বলিয়া তাহার মনে হইল।

এবং যে দ্রুত কয়েক পদ অগ্রসরেই সুঘরাই এক কুয়ার সম্মুখে; যে লোকটি জল তুলে, সে জল দান করিতেছিল–কেহ জল পান করে, জলকণা সকল সুঘরাইএর দেহের এখানে সেখানে ছুটিয়া আসিতেই আপনা হইতেই তাহার চেতনা হইল, যে সে অনেকক্ষণ এখানে, ও ঝটিতি কি এক শব্দরোলে তাহার দেহ পূর্ণ হইল, যাহা সঠিক বুঝিতে না পারিলেও, যাহার উদ্দেশে ঐ ধ্বনি উঠে–সেই ছবি তাহাতে ক্রমে আবছায়া খেলিয়াছে। ক্রমে ভাস্বর হইল!

অলৌকিক বিবাহ-যাত্রা!

আশ্চৰ্য্য যে এহেন সঙ্কটেও সে ঐ শব্দ অনুকরণে–উহার যথার্থ স্বরূপ নির্ণয়ে উথলিতও হইয়াছে; এবং ইহাতে আপন কণ্ঠস্বরের পশ্চাতে মনিব মহাশয়কে সে অনুভব করিল। আশ্চৰ্য্য জল সম্বন্ধে সে যে তৃষ্ণার্ত, নিশ্চিত ক্ষুধার্ত, সে যে ঘুম ভয়ে ভীত তথা পরোক্ষভাবে সে যে হারাইয়াছে, তাহা ক্ষণেকের জন্য খেলিয়া উঠে নাই, জলধারায় শেষ সূৰ্যছটায় সেই মহিমা উদ্ভাসিত হইতে আছিল।

যে এখন যে ব্যক্তি জলপানরত সে ঈষৎ মুখ তুলিতেই সুঘরাই যেমন বা স্তম্ভিত, তথাপি কোনমতে সে ছায়া হইতে মানুষটিকে হদিশ করণে, কুঁড়িতে প্রয়াস পাইল; যখনই সেই ব্যক্তি আপন দেহ বাঁকাইয়া এক বিরাট ঢাক কাঁধে তুলিয়া অতীব স্নেহে এক গণ্ডুষ জল লইয়া ঢাকের ছাউনিতে ছিটাইল, যেমন উহা তাহারই ন্যায় তৃষ্ণার্ত! সন্নিহিত সুঘরাই এক চিরপরিচিত নাম ধরিয়া ডাকিবার অপ্রত্যাশিত স্বর আনিতে। মরিয়া হইল, অনতিকাল পরেই সে অদ্ভুতভাবে চীৎকার করি উঠিল, ইহাতে সেই ‘অহহা মহেশ্বরী! পদের রেশ থাকে!

অহো মহেশ্বরী।

শব্দের অক্ষহীন ধ্বনিতে, ঐ চীৎকারে তদীয় তিতিরের অবাধ উল্লাসে সবটুকুই পূর্ণ ছিল; সুঘরাই যেমন এতটুকু কাহিল না, ঘুম তাহার জলে ভিজিয়া গিয়াছে, যে এবং কয়েক মুহূর্ত পরেই সে নিখোঁচ গলায় ডাকিতে পারিল,–আ গে বিসরিয়ার বাপ!

এবম্বিধ ক্ষমতায় এতাবকার সমস্ত নিষ্ফলতার ক্ষোভ খেদ চমকপ্রদ কাহিনীতে সুবিন্যস্ত হইল। সুঘরাই যারপরনাই উচ্ছ্বসিত, যে সে পুলক ফেলিতে চাহিল না; বিসরিয়ার বাপের অনেক দিনকার

কামানো দাড়িতে চিড়ার কুচি, আর মুখময় জল, যে সে, বালক, তাহার স্বজাতিকে দেখিয়াছে, সে উহাকে ছুঁইতে চাহিল, আহা কতকাল যে সে মানুষ স্পর্শ করে নাই, নিশ্চয়ই বহুকাল, বহুকালই সে দল ছাড়া বিচ্ছিন্ন হওয়ত হারাইয়াছে।

সুঘরাইএর ডাকে বিসরিয়ার বাপের পদস্থিত ঘুঙুরের আওয়াজ হইল ঢাকেও মৃদু শব্দ ঘটিয়াছিল, যে এবং সে আড়নয়নে সুঘরাইকে লক্ষ্যের সঙ্গে শুধু মাত্র ‘আরে আরে’ জ্ঞাপনের পরই আর এক গণ্ডুষ জল গ্রহণ করিল, এবার মুখোনি তুলিয়াছে, নিবিষ্টচিত্তে সেই জল আপন বক্ষে বিশেষত সিঞ্চনে ক্রমে এখন লেপিতেছিল। এত নিকট হইতে সুঘরাই কখনও ইতিপূর্বে এই বৃদ্ধকে নিরীক্ষণ করে নাই!

বৃদ্ধ বিসরিয়ার বাপ কেমন যেমন অন্যমনস্ক আছে। ইহাতে সুঘরাই সত্যই আতান্তরে পড়িল, সে ত্বরিতে আশ-পাশ জলধারা সমস্ত কিছু দেখিল, সে কি সুঘরাই নয়! তৎক্ষণাৎ আপনার গেঞ্জী খুলিতে চাহিল, অধুনা জলে আর্দ্র বদনে করজোড়ে বৃদ্ধ বড় বিষাদে এই প্রার্থনা জানাইতেছিল,বাবা বৈদ্যনাথ তুমি দুঃখের দুঃখী, হয় কত দুঃখ আছে আমার, কবে ঘুম দিবে, আর কত দুঃখ আছে গো!

এই সরলতায় সুঘরাই নিশ্চিহ্ন মনে হইল, এখনও কি আমার হদিশ হয় নাই…মনিবরা? এখনও আমি কি হারাইয়া আছি…এই বিসরিয়ার বাপ কি সত্য!

ইদানীং তাহারা বিলাসীর টিলায়, বিসরিয়ার বাপ আর একবার মন্দিরের দিকে ফিরিয়া ভগবান বৈদ্যনাথকে নমস্কার করিল, এরূপ মনোহর উহার কৃতাঞ্জলি যেমন চৈত্রের শালবন প্রতিবিম্বিত হইতে পারে, অতএব মুহূর্তেই সুঘরাইএর আর উদ্বেগ নাই–এবং যেহেতু বিসরিয়ার বাপ এ সময়ে তাহার ঢাকে তিনবার কাঠি দেয়, এ কারণ যে ঢাকের আওয়াজ বড় সাহস!

উত্তর দিকে উৎরাই পথে অজস্র জোনাকি ভয়াল চক্ষুতে পরিণত হইবার নহে। এইবার তাহাদের রিখিয়া যাত্রা শুরু হইবে। বৈদ্যনাথের ধূলি মস্তকে লওয়া হইয়াছে।

বিসরিয়ার বাপ হাঁকিল,–হেরে মরোয়া রে!

মকরোয়া নামে ব্যক্তিটি নিশ্চয় কাছে কোথাও আছে!

সুঘরাইএর বিসরিয়া বাপের হাঁকে, চক্ষু তখন সজল হইল এবং সে এতক্ষণে ক্ষুধা অনুভব করিল, কুয়া হইতে এতটা পথ বৃদ্ধ অনবরত তাহার রোজগার গণনা করিয়াছে, এক এক হিসাব স্মরণে ঢাকে কাঠি দিয়াছে, খেয়াল রাখিতে, যথা ভোরের গাড়ী, মোটা চেহারার যাত্রীরা তাহাকে লয় নাই, কিন্তু বিধবা বুড়ী হ্যাঁ হ্যাঁ যে মন্দিরের দিকে…কাঁদিতেছিল, সে ঢোল বাজাইয়াছে, সেই বুড়ী দুপয়সা, হ্যাঁ। হ্যাঁ…তারপর এক পয়সা…তাহার পর এক পয়সা…এই ভাবে কতবার সে হিসাব ভুলিল, এইভাবে সে নিজেরে গালি পাড়িল, কিন্তু যে তদীয় পায়ের ঘুঙুর নিয়তই বাজিয়াছে, এক সময় আচমকা আপনার গালে বুকে চাপড় মারিয়া তারস্বরে দিক বিদীর্ণ করিল,হাহা আমি দেড় পয়সার চিড়া খাইতে গেলাম কেন…রাতে ভাত খাইব কেমনে…ও হো ও হো!…আমি শালা…!

তখন তাহারা বিলাসীর অভিমুখে, এখন শিবগঙ্গা প্রায় অতিক্রম করিবে, সারা পথ সুঘরাই বারম্বার পিছনে দৃষ্টিপাত করিয়াছে, যদি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়, উপস্থিত বিসরিয়ার বাপের খেদোক্তিতে মহা ভীরুভাবে কহিল,–বিসরিয়ার বাপ, তুমি যদি আমার মনিবদের একবার পাণ্ডাপাড়ায়…আমার মনিব তোমাকে নিশ্চয় টাকা…

বিসরিয়ার বাপ সবেগে উত্তর দিল,–তুমি কি পাগল, তাহাদের ঠিক সময় ক্ষুধা পায়…তাহারা বড়লোক।

ইহাতে সুঘরাই, যদিও ডোম তবু, মুখ ঘুরাইল, অনেক যুক্তির উল্লেখে ইচ্ছা থাকিলেও সে অবতারণা করিল না, এবং যে সে নিজেরেই অদ্যকার দুর্দৈবের জন্য দোষী করিয়াছিল। যে তখনই এবং এক মহিমান্বিত ধ্বনিতে সে চমকিত! কেননা এই পুণ্য নগরের বিবিধ সোরগোল, জয়ধ্বনি, ইদানীং এখানে এক বিচিত্র শব্দ রণনে রূপান্তরিত হইয়াছে। এবং যে আশ্চৰ্য্য যে বালকের মনপ্রাণ তাহা উচ্চারণে দেদীপ্যমান!

ইতিমধ্যে বৃদ্ধের ‘এ গে মকরোয়া’ ডাক ও মুহুর্মুহু ঢাকের শব্দে, এক পাল্টা সাড় আসিল, আর যে ক্রমে দেখা গেল এক বৃদ্ধ কেমন একভাবে পশ্চিমের আকাশে চোখ রাখিয়া আসিতে আছে, সে যেমন খাড়া পশ্চিমে যাইবে, তদীয় পদশব্দ কাঁকরে ঘর্ষণেতে, তাজ্জব, যে যখন ব্যক্তি বেশ কাছে তখন বিসরিয়ার বাপ জানাইল,–হেরে মকররায়া অদ্য এই বুতরু তোমার হাত ধরিবে…আমি সারা রাস্তা নিজেকে শালা মারিব…আমি অতটা চিড়া খাইলাম…আমি কি…! …এই সেই মকোরোয়া…শিব ইহারে রাতকানা করিয়াছে…শালা পাপী তুই ইহার হাত ধরিবি!

ডোমপুত্র সুঘরাই অবলোকন করে মকররায়া বিষাদের হাসিতে তদীয় হাত প্রলম্বিত করিল। আর সে, শান্ত নেত্রপাতে ঐ রাতকানা বেচারীকে পর্য্যবেক্ষণ করিল, এতাবৎ তাহার মনে এহেন সঙ্কল্প থাকে, যে সে বিসরিয়ার বাপের কাছ ঘেঁষিয়া থাকিবে, এই বৃদ্ধের সেই প্রথমকার মর্মান্তিক প্রার্থনা তাহাতে কোন এক দুর্লভ স্মৃতি দিয়াছিল, যে প্রার্থনার পরে, ঐ বৃদ্ধ শতচ্ছিন্ন বস্ত্রপ্রান্ত দ্বারা একাধারে জল মুছিয়া ক্লান্তি অপনোদন করিয়া তাহার দিকে সরলভাবে হাসিল, তাহাতে সুঘরাইকে এক ঘোর দিয়াছিল যে, যেমন যে এই দুঃখময় বার্ধক্যে হাসি থাকে কেন! এখন সুঘরাই ঐ প্রলম্বিত হাতখানিতে প্রলুব্ধ–যে এবং যেইমাত্র সে ঐ হস্ত ধরিতে স্পর্শ করে যুগপৎ মকরোয়া অন্যপক্ষে সুঘরাইএর হাত ধরিল, ইহাতে ক্ষণেকেই দিক সকল প্রকৃতিস্থ হইল, এই পৃথিবীতে কখনও ঝড় হয় নাই, কিন্তু তিলেকের মধ্যেই দীর্ঘশ্বাস অবশ্য সে, বালক ফেলিয়াছে!

হায় ডোমেদের দীর্ঘশ্বাস আছে!

কিন্তু দীর্ঘশ্বাসের কারণ জানিতে সে প্রস্তুত নহে! (বিস্ময়ের যে সে নিজেকে চালিত করে) তৎপরিবর্তে, সে বেদম উল্লাসে নাচিয়া উঠিল, অবাক দায়িত্ববোধে সে উষ্ণ, তদীয় গেঞ্জী যেমত শুভ্রতর হইল; লক্কড় ভূত প্রেতকে সে বিদ্রাবিত করিতে পারে–সে হুঙ্কার দিয়া নির্ভীকতায় সামনের পথ নজর করিয়াছিল।

অপার্থিব গর্বে তদীয় গ্রীবা উন্নত দৃঢ়, ইহা আপনা হইতেই ঘটিল, ক্কচিৎ এই ভঙ্গীতে ইহাতে বুঝায় যে তিতিরস্বভাব তাহাতে অনেকদূর প্রবেশ করিয়াছে, যে তাহাতে অধুনা এই অভিব্যক্তি সম্বন্ধে ধীরে বোধ আসিল এবং সে আপনকার গ্রীবায় মহা ভাবুকতায় হাত বুলাইয়াছে।

সেদিনও ঠিক আর এক যশোগরিমার আশায়ে এমনই ঘটে, স্নেহবৎসলা মনিব পত্নী যখন, কাগজের ফুল সকল নির্ম্মাণ করিয়া তাহাকে দিয়াছিলেন–সেই ফুলরাজি মনোলোভা, ইহাতে পোকা নাই, ইহা শুকাইবে না, বর্ণ নিষ্প্রভ হইবার নহে এবং উহাতে পক্ষীটি তাহার বিরাগভাজন হইবে না। সে আহ্লাদিত যে কাহারও খাঁচা–যাহা রিখিয়ার হাটে আনীত হয়, যাহা মোহনপুরে আসে–এমত ফুলে শোভা বর্ধন ঘটে নাই।

সুঘরাই সচকিত পদক্ষেপে চলিতে আছে, মকরোয়ার ধৃত হাতে বার্ধক্যের কম্পন; মধ্যে মধ্যে তাহাকে অন্যত্রে লইতেছিল–এতাদৃশই আরএক কম্পন! তাহা কিছু আজব প্রকারের উমের পিছন হইতে আগত শীতের কুয়ার জলে যে উম নাই! সুঘরাইএর কোমরের ঘুনসী ঢ্যাঁটার চাবিটির পাশেই যে বাঁধা রহিয়াছে, ফলে যাহা কখনই খোয়া যাইবার নহে, এবং যাহা মাঝে মাঝে মনে পড়ে। এ কম্পন অভিনব, প্রথম যখন বনে গিয়াছিল ইহা তখনকার।

সে সুঘরাই বনসম্পদের একটি হইয়াই ব্যাঙের ছাতি সংগ্রহে ঘুরিতেছিল, তাহার স্কন্ধ যখন বৃষের তুল্য, যখন সে ভয়ঙ্কর! তখন এই এহেন কম্পন স্পর্শ করে–সবে চোখ ফোঁটা এক পক্ষী শাবকেতে।

শুধু তখন হয়ত তাহার মনে হইল বহুদিন তিতিরের সেই কম্পন ছোঁয়া হয় নাই, কিম্বা মনে হইবার আগেই তাহার গাত্রে ঝুমুরের কয়েক মাত্রা দুলিয়া উঠিল–কেননা বিসরিয়ার বাপ ঢাকে কাঠি দিয়া তখন এক ঝুমুর গাহিতেছে।

মুখে হাসি, সব্বলাশী, বাঙালি কা বিটিয়া।
কলকতা তে বেচতরে তামাকুল টিকিয়া ॥

এই ঝুমুর আন্দোলনে সে অচিরাৎ শিশুহস্তী, কিন্তু তখনই সে আপন দায়িত্ব ভুলিতেই বেচারী মকরোয়া ত্রাসে মৃদু হাহা করিয়া উঠিয়া ব্যক্ত করিল কিছু।

কিন্তু পরক্ষণেই বিসরিয়ার বাপ পথিপার্শ্বস্থিত আধা ঘুমন্ত গ্রামবাসীদের সম্বোধন করিয়া বলিয়া উঠে,–শুন শুন আমার কপাড় হে, আমার এককুড়ি দুইটি ছেলে…অনেকেই মৃত, আমায় খাইতে দিবার ভয়ে অনেক শালারা মৃত, যাহারা আছে তাহারা আমায় ফেন পর্য্যন্ত দেয় না গো…।

আবার কয়েক পদ অগ্রসর হইয়া তেঁড়া দিয়া চীৎকার করিল, তোমরা শুন, ঘরে ফিরিবার আনন্দ আমার নাই, তোমরা শুন রেলের জনম আমার জনম এক (সময়)…আমার জনম বড় দুঃখের হে, দুঃখই আমার বয়স…শুন…। এবং ঢাকে কাঠি দিয়াছিল।

তাহার কথার উত্তরে পারিপার্শ্বিক নিথর নিঝুম হইতে উৎসারিত হয়, শালা তুমি মর, তুমি মর তুমি মর লক্‌কড়ে তোমারে খাক!

বিসরিয়ার বাপ ইহাতে গাহিয়া উঠিল–

পাগলা মনা পাগলা মনা।
পাগলা মনা রে।
আনন্দে হরি গুণ গাও!

সম্প্রতি সুঘরাইএর দেহে অনেক কথাই আঁচড়াইতেছে, সারাদিনের নানান ফেরে সে আর একে যেন পরিবর্তিত, অনুকম্পা, করুণা আদি বহুবিধ সত্ত্বগুণ তাহাতে আছে এখন, সে পারিপার্শ্বিক আঁধারে চোখ রাখিয়া উচ্চৈঃস্বরে স্বীয় মনোভাব জ্ঞাপন করিতে প্রস্তুত বিসরিয়ার বাপ ঢাক বাজাইয়া খানিক কাহিল যেহেতু, এই উদাত্ত স্বরে বলিতে পারার জন্য সে খুসী,–বিসরিয়ার বাপ তুমি খেদ কর কেন, তুমি ইচ্ছা করিলে একটা কাঁটাহার, (কাঁঠাল) একটা পাঁঠা, এক পালি চাল খাইতে পার, তোমার ত দুঃখের কথা নহে!

বিসরিয়ার বাপ এহেন প্রশংসায় উজ্জ্বল হইয়াছে, রাতকানা মকরোয়া বেশ বুঝা গেল ঈর্ষায় হাসিয়া কহিল, কে দিবে হে…?

যে সুঘরাই একশত বিচার করিয়া বলে নাই, অথবা কি যে সে ব্যক্ত করিতে মনস্থ করে তাহা তাহার খেয়াল নাই; সে অপ্রতিভ; সে ত্বরিত নিজেই সংযত হইল অথবা সমক্ষের কোন অন্ধকার দেখাতে আকৃষ্ট; আদতে ঐ বৃদ্ধের খেদ কমাইতে সে বলিয়াছিল। এবং আরও নিশ্চয় যেহেতু এই বিসরিয়ার বাপই যে তাহাকে কুয়াতলায় সবিস্ময়ে বলে,–হ্যাঁরে বুতরু তোমার তিতির কোথায়? তিতির বিনা তুমি! আশ্চর্য্য! তোমাকে আমি চিনিয়া লইতে পারি না,…আমি ভাবি একটা গেঞ্জীওয়ালা কেহ…। সেই কারণেও হইতে পারে!

যে এখন মকরোয়ার কম্পনেই ঐ বাক্য স্মরণেই উপস্থিত যে তাহা হদিশ পাইল–যে বৃদ্ধের কুয়াতলার ঐ কথারই জন্য সৌজন্য কৃতজ্ঞতা জানাইতে এযাবৎ সে যেন সুযোগ সন্ধান করিতেছিল, কিন্তু সে অযথা সূত্র ধরিয়াছে!

এমত সময় বিসরিয়ার বাপ যে গর্বে উত্থালিত আছে, বলিল,-হা রে মকরোয়া রাতকানা, যে বুতর তোমারে অদ্য পথ দেখাইয়া লইয়া যাইতেছে, সে খুব ভাগ্যবান…আরে বাবা!…বেজায় ধনী লোকের বাড়ী কাজ করে,…বেজায় ধনী হে…তাহারা ইহারে খুব যত্ন করে, রোজ এ পোয়া চালের ভাত দেয়, কি না বল?…

এই সুঘরাই খুব চতুর হে, এ ডালিম বেদনা দেখিয়াছে…যাহা গ্রামের আর কেহ দেখে নাই…আমি, আমার কথা ছাড়…সে ডালিম বেদানা খাইতে দেখিয়াছে, আসছে জন্মে…সে বড় ঘরে জন্মাইবে…হা রে দুঃখ!…হা হা এই বুতরুর চমৎকার এক তিতির আছে…আহা ঘরকে ফিরবার টান বটে…সুখ দুঃখের সাথী সেটা…।

সুঘরাই, তাহাকে একদিন লইয়া আসিও, দুটা ভাত দিব, ঝুমুর শুনাইব…’ত্রিকূট পৰ্ব্বতই চড়ি ডুমা ছাঁটে বাঁশরে কুরু বনে সুজনোয়া’…দারুণ তিতির, অনেক টাকায় বিকাইবে গো…বড় বড় ঘাটওয়াল জোড়া (কাপড়) দিবে হে, টাকাও দিবে…হা হা যখন তাহার (তিতিরের) বিয়ের ফুল ফুটিবে, তখন আমাকে বরাৎ দিও হে, হাটে হাটে ঢেঁড়া দিব…।

এবং তৎক্ষণাৎ বিসরিয়ার বাপ নৃত্যসহ ঢেঁড়া বাজানর ছন্দে, ঢাকে কাঠি দিল, সেই মত সে বাজাইতে থাকে তিতির বিষয়ক–একের পর অন্য পদবিন্যাসের বিরতিতে, যথা…চোখ উহার কাঁটি কাঁটি, রাগিয়া গেলে লাল, মেঘ ডাকিলে বেগুন বেগুন, আবার তারার মত বটে, নদীর মত হে, আকাশ বাতাসের ছায়া, তাঁহার মাথায় বাবুদের মতন টেরী কাটা, তাহার পাখার ঝাঁপটে পোকা পালায়, তাহার ডাক যেমন বা গাডের (রেল-গার্ডএর) হুইসিল,…রেল ছাড়ল হে…।

এবার তাহার ঘুঙুর বাজিল, পুনরায় ব্যাখ্যা করিল,…তাহার চাহনিতে মকরোয়ার রাত কানা ঘুচিবে, তাহার ডাকে মাদি তিতির পাছা তুলিয়া বসে,…সে বড় জোয়ান–গাছের পাতা তাহার সামনে উড়িলে সে রুখিয়া উঠে…জাত রাজ রাজপুত…বিড়াল হুলাড় ঐ তিতিরকে ডরায়, সুঘরাই তুমি যখন দেখিবে। পাখীটা ঘেঁড়া ন্যাকড়া, ঘেঁড়া দড়িকে ঠোঁট দিয়া কজা করিয়া চেঁকি করে,…তখনই আমায় খবর দিবে…তাহার বিয়ের ফুল ফুটিয়াছে বুঝিবে…যে জোড় খাইবে।…সে যখন লড়িবে শয়ে শয়ে পয়সা পড়িবে…কত লোক হারিয়া ধূলা চাপড়াইবে।

ইহাতে সুঘরাই আপন তিতিরের গুণকীর্ত্তনে নয়ছয় আছে, যে সে মকরোয়ার কম্পনে অত্যধিক প্ররোচিত, উদ্বুদ্ধ, যে সে ইতঃমধ্যে কখন যে মকরোয়ার হাত নিজে ধরিবার মনস্থ করে–ইহা তাহার অজ্ঞাতেই; এবং সে বুঝিল যে সে ঝটিতি আপন হস্ত মুক্ত করিয়া তখনই উহার হাত ধরিল।

মকরোয়ার হাত শিরাবহুল, ও অতীব রোমযুক্ত এবং যাহা অনুভবেই সুঘরাই চমকিত হইয়াছে, যে সে হোঁচট প্রায় খাইয়াছেকীদৃশী অলৌকিক ঘটনা উহা স্পর্শে, কি এক বিহান! সে ধানক্ষেত ঝরণায় স্রোতে পা ডুবাইবে, শব্দ হইবে–নিশ্চয় ও যে তখনই সে সঠিক আরবার মহেশ্বরী ধ্বনি শব্দত দিয়া উঠিল। ইহাতে সে বিস্ময়ে ছেলেমানুষ। অথচ সে নিজে তাহা বিশ্বাস করিতে পারিল না যে উহা তাহার কণ্ঠস্বর, উহা যেমত অন্য আর কেহ!

অন্যপক্ষে রাতকানা মকরোয়া, উঃ বলিয়া সবিনয়ে জানাইল,–হে বুতরু, আমি তোমার উপর নির্ভর করি…বেসামাল হইলে আমিও হইব…আমাকে বুঝিয়া চল…আমাকে বুঝিয়া চল হে…।

অবাক যে এহেন কাতরোক্তিতে সে বিচলিত নহে, যে সে তখন আপন কর্ণে সেই মহাধ্বনির অনুরণনই কেবল শুনিতেছিল, সেই ধ্বনিকে পূর্ণভাবে নিখুঁত শব্দে জানিবার কারণে সে কেমন যেমন নিষ্ঠুর, যে এবং ক্ষণিকেই বুদ্ধি করিল যে সে ভীত ভাণে পুনৰ্ব্বার সেই আস্বাদ লইবে! সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলিয়া আছে।

তাহারা সকলেই পথ চলিতেছিল। বালসরাইয়ের অন্যধারে চড়াইয়ের পূর্ব দিকে রাঙাপড়ির শালবন সেখান হইতে মাদলের আওয়াজ আসিতেছিল, ইতিমধ্যে আঁকাবাঁকা রাস্তার বালি সাদা দেখা যায়–সুঘরাইএর চোখ ছোট হইয়াছিল, আড়ষ্ট গলায় অনুরোধ করিল,–হে বিসরিয়ার বাপ একটু ঢাকে কাঠি দাও…কেন না লক্কড়টা যদি…এবং অথচ এখন ধীর পদক্ষেপে বাজনার অপেক্ষায় না থাকিয়া সে অগ্রসর হয়, এই উত্রাইএর কোথাও বিশেষত কালভার্টের কাছে সে নিশ্চয়ই আপন কম্পিত সুযোগ পাইবে, সুতরাং! ঐ কথা।

তথাপি সে অতীব শান্ত কণ্ঠে প্রকাশিল,দেখ হে মকরোয়া আমি ইচ্ছাসুখে তোমার হাত চাপি নাই, ইহা আমি জানি তুমি বৃদ্ধ, তুমি রাতকানা…আমার কথা তুমি জান না, আমি খাওয়া দেখিয়াছি কিন্তু খাই– নাই সারাদিন…আমি উপবাসী…তাহাতে আমার দুঃখ নাই…আমার মনিবদের হইতে আমি বিচ্ছিন্ন হই– আমি এখন যেহেতু ছেলেমানুষ, লক্কড় ভীতি…।

রাতকানা মকবোয়া এই সুদীর্ঘ আধ ভাঙ্গা বাক্যবিন্যাসে যেমন বা হৃদ্বয় কুঞ্চিত করিল, অন্তত সুঘরাই ইহা অনুমান করিয়াছিল, তন্নিবন্ধন সে যথার্থই সঙ্কুচিত, যে সে আপনার কথার আওয়াজে পীড়িত, সে আপনকার বাম হস্ত এই অন্ধকারে দেখিতে উৎসুক হইল।

ভাগ্যশ বিসরিয়ার বাপ এখন ঢাকে কাঠি দিয়া ত্রিভুবনকে জ্ঞাত করিল,হি সে শালা লক্কড় পেটে যে শালা বোবা, সেই শালার পেটে মদ ছিল, লক্কড় শালা মদের আস্বাদ পাইয়াছে…মাতাল ছাড়া আর কিছু সে খাইবে না…হাঃ আমি কি দুঃস্থ, বহুদিন আমি মদ খাই নাই…আমি তালের কেঁড়ে চুষি!–ইহার অন্তে সে গাহিয়া উঠিল…।

‘ফুলল গুলাব রে ভোমরা চুষাল…’।

যদিও এহেন স্থানে ঐ প্রকারের মস্করা বিসদৃশ, তথাপি সুঘরাই যেমত স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করিয়াছে এবং সে মকরোয়াকে বলিল,-তোমাকে আমার তিতির দেখাইব…তুমি দেখিলে তাহাতে তোমার শীত গ্রীষ্ম বোধ থাকিবে না…। কিন্তু ইহা জ্ঞাত করিতে সে যেমন তটস্থ হইতেছিল, কেন না সম্মুখে বাঁশঝোঁপ, ঝটিতি সে মকরোয়ার হাত সজোরে চাপ দিল, এখন নিশ্চয়ই কম্পন উপলব্ধির আশে নহে।

মকবোয়া ইহার নিমিত্ত প্রস্তুত ছিল, ফলে সে দাঁড়াইয়া পড়িল। অন্যপক্ষে সুঘরাই সভয়ে সেই বাঁশঝোঁপ অবলোকন করিতেছিল, সে শুনিয়াছে এই বাঁশঝাঁপ বড় দুষমন, ভূত আছে; যে ভূত দুইটি বাঁশ পাশাপাশি ভূমিতে আনত করাইয়া মানুষকে মারার কল পাতে, সুঘরাই এই সংস্কারে–অবশ্যই চোরা এই সত্য যে তাহার হাতে নোনা আছে–ত্বরিতে মোহিলি হইতে প্রাপ্ত এক অমোঘ মন্ত্র মনে মনে উচ্চারিয়া আপনারেই প্রদক্ষিণ করিয়াছিল।

তিতির পাখীটি তখন কয়েকদিনের বাচ্চা মাত্র, সুঘরাই আপনার হাতের উপরে বসাইয়া সেই পাখীটি লইয়া যায় মোহিলির কাছে, যে তখন কোদাল দিয়া জমি কোপাইতেছিল, সে তদ্দর্শনে তদীয় বক সমান লম্বা ঠ্যাং ভাঙ্গিয়া লাফাইয়া কহিল,–ছি ছি তোমার কোন কাণ্ডজ্ঞান নাই…তিতিরটি খড়ের উপর বা কোন কাটোরাতে (পাত্রে) আনিতে হয় জান না, তোমারে বলি নাই…সবে ইহার চোখ ফুটিয়াছে…খুব অন্যায় করিয়াছ!…জান না তোমার হাতে নোনা আছে…মানুষের নিজের হাত তাহার মনের কথা শুনে না–হাত ভারী খচ্চড়, কেরেট সাপ হইতেও পাজি…হাত সদ্যোজাত শিশুর দক্ষিণ প্রত্যঙ্গে যে ভূত পায় তাহা হইতেও নচ্ছার!

সুঘরাই ইহাতে মাটির দিকে চাহিয়াছিল, যে সে হয় পাঁশুটে, অথচ মোহিলির বাড়ী পর্যন্ত সারাটা পথ এই হাত দ্বারা এতক্ষণ এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতায় সে মথিত ছিল, ঐ ছোট শাবকের কম্পন তাহার হৃদপিণ্ডকে যেমন ছন্দিত করিতে আছিল এবং এক হাত হইতে অন্য হাতে শাবক রাখিয়া, শূন্য হাত গভীর কৌতূহলে আঘ্রাণ করিয়াছে…কম্পনের কি মধুর গন্ধ! কি মধুর!

সম্প্রতি মোহিলির ভর্ৎসনাতে সে বিচাল্যমান নির্জীব আছে।

মোহিলি কোদাল ফেলিয়া আসিয়া একটি স্থানে দাঁড়াইয়া মন্ত্র বিড় বিড় করিতে থাকিয়া বাম পদ দ্বারা যতদূর সম্ভব–উহা দূরে প্রসারিত করিয়া, ভূমিতে এক গণ্ডিচক্ৰ নির্ম্মাণ করিল, অদ্ভুতভাবে লাফ দিয়া গণ্ডির বাহিরে আসিল ও নানান ক্রিয়ার পর পক্ষীশাবককে গণ্ডির কেন্দ্রে বসাইয়া দিল। অতঃপর চারিভিতে অদ্ভুতভাবে হাঁক মোহিলি পাড়িল, এবার আকাশের দিকে তাকাইয়া স্বীয় বক্ষে চাপড় মারিয়া কি যেন গলাধঃকরণ করিতেই তন্মুহুর্তে মাটিতে সে নিজেই আছাড় খাইয়া পড়িয়া গোঙাইতে আছিল, এবং কাটা-ছাগলের ন্যায় সে কাঁপিতেছে; আশ্চর্য্য যে এবম্বিধ ঘটনায় পাখীটি স্থান ত্যাগ করে না; অন্যপক্ষে বালক থতমত হইয়া পলায়নে উদ্যত হইয়া তেমনই রহে, সে চিত্রার্পিত।

ক্রমে মোহিলির কর্ণদ্বয় নড়িল, এবং যে সে মাটিতে মুখ রাখিয়া অস্পষ্ট বিজড়িত কণ্ঠে কি যেন বলিতে আরম্ভিল,–এখন শোনা গেল, আমি সেই ভূত, আমি সর্বনাশ করিব, যে আমি…জল পান করি, ঐ বুতর কেন তিতিরকে শুধু হাতে বহন করিয়া আনিল, দুয়ার খুলিয়া দিল, পথ করিল; তুমি কেন দেখ নাই, এখন ফল ভোগ কর, তোমরা দুয়ার খুলিয়াছ, পথ করিয়াছ, সর্বনাশ করিব!

তদুত্তরে মোহিলি ঈষৎ তাহার নিজ স্বাভাবিক স্বরে, কি যেন কহিল, সম্ভব মার্জনা ভিক্ষায়। …আমি মরদ মিয়ার একটি ছাগল এখন বিনষ্ট করিয়াছি; আমি এখনই তোমার ও ডোমপুত্রের সৰ্ব্বনাশ করিব, ও তুমি লোহা ছুঁইলে বেশ…তোমরা রক্ষা পাইলে; কিন্তু তিতিরের রক্ত পান করিবই…কেন না যে রহস্য সূৰ্য্যকে ত্রিকূটের পশ্চাতে উঠায় আবার ডিগরিয়ার বামে এবং ডাইনে সরাইয়া ডুবায়, সেই রহস্য যেক্ষণে সবে পক্ষীতে গোড়া লাগে তাই পক্ষীশাবক কম্পিত, সেইতে বালকের হাত লাগিয়াছে যে সে চোর ছ্যাঁচড়া হইবে, উহার হাতে তাই নোনা, (নোনা মানুষের হাত, উহার হাতও নোনা) সেই নোনা লাগিয়াছে, আমি পক্ষীশাবকের রক্ত পান করিব।

মোহিলি স্বাভাবিক স্বরে মিনতি করিল।

…আচ্ছা! যেদিন পিঙ্গল বর্ণের কিদিম কাঠকোম (কাঁকড়াবিছা) খাইবে সেইদিন গোড়ালাগা উহাতে পুরা হইয়াছে জানিও…।

মোহিলি কোদাল পদদ্বারা ছুঁইল এবং অতঃপর উঠিয়া সুঘরাইকে পক্ষীশাবক সম্পর্কে অনেক নিয়ম-মানার উপদেশ দিল, আপাতত মৃৎপাত্রে ছোট কেঁড়েতে পাখীটিকে রাখার কথা কহিল, তিন হাট তিন দিন পর খাঁচা! কঞ্চি কাটার মন্ত্র তাহাকে বলিল। এবং ইহার পর তাজ্জব যে বালকের ভগনীপতি, পাখী যে অপছন্দ করিত, সেও কিছু বলে নাই!

সে, সুঘরাই, সারাদিন এক বিশ্রীদর্শন খাঁচা লইয়া ঘুরিত! আর সূর্যের দিকে সভয়ে চাহিত। কেন না সে এতাবৎ শুনিয়াছে যে সূৰ্য্য নিজে উঠে! নিজেই নিজের জমিদার! এখন জানিল অন্য কথা, যাহা কাহারও সহিত আলোচনা করাতে দিব্বি আছে। শুধু খাঁচার বাঁশ-চৌরস সময়ে নিজ গাত্রের কম্পনে ভীত হওয়ত মোহিলিকে বলিয়াছিল।

মোহিলি উত্তর দিল,–উহা হাওয়ার জন্য বা ঠাণ্ডায় ও কিছু নয়!

সুঘরাই যখন ঐ বাঁশঝোপে যে ইহা রাস্তার পাশে আছে, তির্যক নিরীক্ষণ করিতে থাকিয়া, অদ্ভুতভাবে মকরোয়ার হাত সন্ধান করিতে আছে, তৎকালেই মকরোয়া অনুচ্চ কণ্ঠে বলিল,–হে বিসরিয়ার বাপ, এই বুতরু খারাপ, খচ্চড়…আমার হাতে বড় জোর আবার চাপ দিয়াছে…আমি হোঁচট খাইতাম হে।

বিসরিয়ার বাপ ঐ বক্তব্যের প্রতিধ্বনিতে মন রাখিয়া উত্তর দিল,আহা সে বুরুমাত্র…এখন রাত্রকাল, তাই সে ভীত…নিশ্চয় স্বেচ্ছায় নহে, আরেঃ বাবা! মনিব কত ধনী, সে কিরূপে খচ্চড় হইবে।

রাতকানা মকরোয়া কোন যুক্তিতে কর্ণপাত না করত প্রকাশিল,হাঃ, শালা খচ্চড়!

যে সুঘরাই কায়িকভাবে যেমন এই ছোট তাহারার মধ্যে, তেমনই সে অন্তরেও নিমেষেই উহাদের সহিত এক; কটুক্তি এখনও বিশালতায় প্রতিধ্বনিত হইতেছে, কিন্তু যেহেতু, ক্রমে খচ্চ শব্দটিও বড় হইতে ছোট হওয়ত সৰ্বশেষে দক্ষিণের ক্ষেতের আল হইতে আসিল! তাই সে ক্ষণেক বিভেদে আছিল; এবং যে তাহাতে ইহা আভাসিত হয় যে যেন মকরোয়াতে কোন রহস্যেরই গোড়া লাগে নাই; কিন্তু তৎপ্রবর্ত্তীত অনুতাপ নহে, ছোট ছিছিও নহে, একটু অপ্রতিভ হইবার পূর্বেই পুনরপি, সেই মহাধ্বনি তুলিতে যেন মরীয়া হইল।

যে ধ্বনিতে এক অলৌকিক বিবাহ-যাত্রার ছবি!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress