Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পিঞ্জরে বসিয়া শুক || Kamal Kumar Majumdar » Page 5

পিঞ্জরে বসিয়া শুক || Kamal Kumar Majumdar

প্রধান শিক্ষয়িত্রীর কন্যা তেমনই শান্তকণ্ঠে তাহার মাতাকে অনুজ্ঞায় জানাইল, মা গো, এই সুন্দর স্থানে তুমি এনড্র মারভিলের সেই ‘অন এ ড্রপ অফ ডিউ’, আবৃত্তি কর না, কি মায়াময় স্থান ইহা হয়। যে–একবার বলিলেও মনে হইল সে যেমন বা এক বক্তব্য তিনবার বলিতেছে।

প্রধান শিক্ষয়িত্রী ঐ প্রশংসায়ে ছেলেমানুষ হইয়া থাকেন, সগর্বে ঝটিতি কহিলেন, তোমার আবৃত্তি আমি শুনিব–এবং তখন সুঘরাইকে নিকটে আসিতে দেখিয়া কিয়ৎ তাঁহার সারমর্ম নীতিসূত্র করার বৃত্তি হইতে, খানিক পূৰ্ব্ব-তর্কসূত্রে নিজের যুক্তি প্রতিষ্ঠাকল্পে, অবশ্য ইনি ঈষৎ খুসী ছিলেন যে, মনিব মহাশয় তর্ক নিয়ম অনুযায়ী করিতে পারেন নাই, মাত্র নিজের জাত্যাভিমান, যদি তাহা ব্যক্তিত্ব। হয়, তবে তাহাই ব্যবহার করিয়াছেন, আরও যে তিনি প্রমাণিতে চাহেন,–মনিব পত্নীর নাকছাবিতে হাত দেওয়াতে, ইহা সেকেলে যে তাঁহার নাকছাবি নলক দাগ নাই, আরও, আর যে তাদৃশী বিতর্ক তাহার ভাল লাগিতেছিল; তৎপ্রভাবিত সংজ্ঞাভূত করিলেন,–নিশ্চয় মানিবেন–কোন প্রাণী বিশেষত…এই সব জিনিষ পোষা ভাল নয়…সেদিন যেমন উনি স্বামী বলিতে ছিলেন…মনে পড়িবে।

সেই সাঁওতাল নাচের দিবস! আর প্রধান শিক্ষয়িত্রী যিনি বসন্তের হাওয়াকে নির্ঘন্ট্রচিত্তে শাসন করিতে পারেন বেশ তফাৎ আছিলেন।

এই বাড়ীর যেখানে কুঞ্জ গোছের, ছিটকান আলোয় দেখা যায় সাঁওতালরা পুরুষ-রমণী মিলিত সমাবেশ, চুটার ধোঁয়া উখিত, মহুয়া মদ তাহারা যেন চর্বণ করিয়া খাইতেছে! ঘুমন্ত মুরারীবাবু, ঐ শিশুকেন্দ্রিক গুলজার–যেখানে সেখানকার আধ-গ-আপ্লুত স্বর শুনিতে আছেন; কিন্তু উহা ছাপাইয়া–তাহাতে পরিতোষবাবু যিনি তাঁহার স্ত্রীর দক্ষতা বলিতে ক্রমশঃ এশা অর্থাৎ যে পুরুষ, রমণীর রহস্যময় বৈপরীত্যপরতন্ত্র বুঝিয়া মুগ্ধ বিহ্বল; ত্রাস-মিশ্র-শ্রদ্ধায় যে সদাসর্বদা আছে, সেই সেই ব্যক্তির গুমরান ধরনে, তিনি বিশদে বলিতেছিলেন, আমার স্ত্রী, নিজে ভুবনবাবুর মেজমেয়ে, যে ছেলে হওয়ার আগে খুব পাত খোলা চিবাইত, খুব চট সেলাই করিতে পারিত–তাঁহার পরম সুন্দর পুত্র। হইল, এই পুত্রের আঁতুড় দরজার পাশে আমার স্ত্রী নিজ হাতে চমৎকার দোয়াত কলম তালপত্র রাখেন–এই দোয়াত কলম তালপাতা আজও মদীয় গৃহে আছে…হ্যাঁ…রাত্র যখন নিশুতি…এক চমৎকার ফুলের গন্ধে তাঁহার তন্দ্রা কাটিয়া যায়, দেখিলেন এক তেজের মধ্যে বিধাতা পুরুষ! মদীয় স্ত্রী বুদ্ধিমতী, প্রণাম অন্তে জিজ্ঞাসা করিলেন,–প্রভু, মানুষে এত কষ্ট পাইয়া থাকে কেন! বিধাতা পুরুষ কহিলেন–যে সে জন্মায় এই কারণে।

আশ্চর্য্য যে পরিতোষবাবু কদাচ বলিলে বিশ্বাস করিবেন না বা পৃথিবীতে কত কি ঘটে আমরা কি জানি ইত্যাকার বচনে কৈফিয়ৎ কভু দেন না। মদ্যপ মনিব মহাশয় আপ্লুত স্বরের মধ্য হইতে বলিয়া উঠিলেন,–দেখ নৃত্যে জমি কি দারুণ চৌরস হইতেছে, এক অভিনব স্থাপত্যের গড়ন ও ভাঙ্গন পুনর্নির্মাণ হইবে…ডাগর নৃত্য হইবে! সুঘরাই তুমি খুবই ভুল করিয়াছ, যাও পক্ষী লইয়া আইস, সেই এ-ই জাঁকাল নৃত্য দেখিবে। ভয় পাইও না…কুকুর তোমার পক্ষীরে কিছু বলিবে না…।

সরসীবাবু যিনি মামলায়, প্রিভি কাউনসিলে তিনি বা তাঁহারা জিতিলেও, তিনি বা তদীয় পিতা সৰ্ব্বস্বান্ত হইয়াছেন, তাহাদের অট্টালিকার মৰ্ম্মর বিক্রীত হইয়া সুদূর সিংহলে গিয়াছে, বাড়ী ভাড়ার বিনামূল্যে রাবিশ দেওয়া হয় পড়িয়াছেন, এখন বাগান করেন, ইহার নিকট ছিলেন। পরিতোষবাবুই বা। কেহই এক্স-রূপে (X) পরিণত হয় না, সব সময় ইহার নাম উল্লেখ্য; ইনি সেই বিধাতা পুরুষের দুর্বল উত্তরে হাসিলেন, তখনই শিশুকেন্দ্রকে ভাঙ্গিয়া অনেক মহিলাকে দ্রুত পদে যাইতে প্রত্যক্ষ করিলেন। ইনি উদ্ভট অপ্রাকৃতিক, যে অথচ ইনি সুপুরুষ যে এবং একাহারী সংযমী! সকলকেই চিঠি লেখেন।

লোহার গেটের ছায়া গ্রাভেলে, অরকেরিয়ার গাছ হইতে মাগনোলিয়া-গ্র্যাণ্ডিফ্লোরাতে-আঃ মাগনোলিয়া কি অদ্ভুত কৌশলে তাহার পাপড়ী মেলিয়া থাকে–এ কারণ যে এই বাড়ীর গেট আগে-পাছে করিতেছিল! এ কারণ যে একটি সুকুমারমতি বালক, নবম বর্ষীয় যে মাত্র, গেটের পাল্লার সর্বনিম্ন বাতায় পা রাখিয়া, পায়ের দ্বারা ঠেলিয়া দুলিতে আছে, গেটে হাঁসকলের করুণ শব্দ উখিত হইতে থাকে, তৎসহ মাঝে মাঝে অন্য মৃদু সুখবর্ষী শব্দও আছে, যাহা একটি চাবির সংঘাত, যাহা বালকের গাত্রের দোছুটিতে (কাছা গলায়) লগ্ন আছে, যেহেতু কয়েক দিবস হয়, বালকের পিতৃবিয়োগ ঘটিয়াছে। এখন সে এখানে।

উৎসবের মধ্যে যাইতে তাহার বালকের মন সরে নাই, সকলে যখন সমীপে, যখন সকলে আপন আপন উচ্ছ্বাস-উদ্যমের নিমিত্ত সবিশেষ অপ্রতিভ, যখন সকলেই কথঞ্চিৎ বিমূঢ়, তখনও বালক পাল্লাতেই! গরাদের অন্যপার্শ্বে তদীয় দুঃখ-চাবকান মুখোনি বড় সুন্দর, বড় ক্লেশ অন্যদের দিতে ছিল; সকল সম অভিব্যক্তিতে উর্ধে তাকাইয়াছেন, ঐ ইউক্যালিপটসের চামর পাতার আরও ঊর্ধে, পুনরায় দৃষ্টি আনত ইহাদের, সমস্বরে বলিলেন, বেচারী, হায় ভগবান!

একান্তে প্রধান শিক্ষয়িত্রী আতঙ্কিত মনে তর্ক তুলিলেন,–ইহা খারাপ, এই হয় প্রকৃতই নিষ্ঠুর! ছোট ছেলে, দেখিলে প্রাণ ফাটিয়া যায়, এই নির্দোষ শিশুকে এহেন বস্ত্রে…উহাকে দোষী করা…এরূপ করার ঔচিত্য দেখি না…কবে আমাদের দেশ হইতে এই সকল যাইবে। আশ্চৰ্য কোনও ভদ্রলোক নামটা করিব না (মনিব মহাশয়) বলিয়াছেন, আমাকে ব্রাহ্মণ ভোজনে উহারা বলিতে চাহে, আমি নিশ্চয়ই যাইব…কি হৃদয়হীন!

কয়েকজনের, নারী ও পুরুষ সত্যই ঐ লৌকিকতা যে নির্দয়, এমত বুদ্ধি হয়, তাহারা সত্রাসে প্রধান শিক্ষয়িত্রীর প্রতি গভীরভাবে চোখ মেলিয়াছিলেন। তৎকালে গৃহকর্ত্রী যেখানে নাচের আয়োজন, আপনার ঘোর ছাড়িয়া, মধুর স্নেহযুক্ত কণ্ঠে জানিতে চাহিলেন, ও মা তুমি হঠাৎ।

হ্যাঁ আমাদের চাকরটি বোকা কিনা, তাই মা বলিলেন তুই উহার সহিত, ঐ জঙ্গলী ‘স্পিরিট’ কিছুতেই উচ্চারণ করিতে পারে নাই–এই বল ত স্পিরিট! (নিকটে চাকরটি ছিল) দেখুন কি মজা হয়…এই বল না…।

এই সরলতায় সকলেই অত্যধিক শোকে নিমজ্জিত, যে সকলের বক্ষঃদেশ আলোড়িত হইল, আঁখি নিষ্প্রভ ও যে সজল হইল, প্রধান শিক্ষয়িত্রী যিনি আপন উক্তি কারণে এতাবৎ কিন্তুতে, যে তাঁহার কথার সারবত্তা, বালকের চাপল্যে (!) অর্থ-সামঞ্জস্য লাভ করিল, ফলে কপালে বিকার নাই, অবশ্য তিনিও সন্তপ্ত হইলেও তাঁহার কণ্ঠে, ইহা হয় খারাপ, ইহা হয় অমানুষিকতা, আওয়াজে স্ফীত! অথচ ইহা অচিন্ত্যনীয় যে চোরা খুসী, যে ঈদৃশ এক বর্তমান এই শোকচিহ্ন এখানকার ফাজলামি হইতে রক্ষা করিবে, ইহাতে প্রশ্ন যে কঠিন কি তিনি, তাঁহার কন্যাদ্বয় ঈষৎ বিমূঢ় হইয়া তবুও ছিল।

বালকের এক হাত উত্তোলিত ছিল, উহা গরাদ ধরিয়াছিল, সে কহিল, নাচ হবে বুঝি…আমি নাচ বড় ভালবাসি, আমার বাবাও খুব নাচ ভালবাসিত, মাও ভালবাসে আমি ভালবাসি নাচ…নাচ…কতক্ষণ হইবে…রাত্র বারোটা অনেক রাত পর্যন্ত আমি জাগিয়া থাকিতে পারি…।

সকলেই নিম্নস্বরে, ‘বেচারী’ উচ্চারণ করিল।

আবার সকলেই ভারী পদক্ষেপে গেট হইতে ফিরিয়া আসিতেছে; যাহারা বিলিকে ঘিরিয়া তাহারা এহেন পদধ্বনিতে সচেতন, তাহারা ঘাড় বাঁকাইয়া পশ্চাতে নেত্রপাত করে! ইহাদের মধ্যেই জনৈক ভদ্রলোকের হাতের অন্যমনস্কতায় ছড়ির এলেবেলে আওয়াজ গ্রাভেলে সংঘাতে হইতেছে, যুগপৎ আরও অন্যান্য হস্তের ছড়ি লাঠির উৎসাহহীন শব্দ ঘটিল। সহচরীবৃন্দ এই সূত্রে অবলোক নিয়াছে যে নাচের জন্য মাঠ চৌরস করা চলিতেছে, এই ব্যক্তি কাজ করে কপাল হইতে ঘাম অপনয়ন করিল, উহার পশ্চাতে জলপানরত রমণী।

নাচ হইবে। মাদলের আওয়াজ আসিতেছে, মদ চলিতেছে! অভ্যাগতরা সকলেই এখন অনবরত একটি পদ মুখস্থ করিতেছিল, ‘পেট ত ভর’ল মহন ভরল না হে’–ইহা সাঁওতাল সর্দার মাঝি মহুয়া খাইতে খাইতে বলিয়াছে; চিড়া গুড় তাহারা পেট ভরিয়া খাইয়াছে, কিন্তু মদের অভাব! তাই মন ভরিয়া। উঠে নাই।

সাঁওতাল সর্দারের কথা, ঐ সংজ্ঞা ওষ্ঠ হইতে ওষ্ঠান্তরে! বাবুরা উহা প্রতিধ্বনিত করিলেন, বাতাস ভারী হইতেছিল, যে সাঁওতাল রমণী বক্ষবস্ত্র সামালিয়া বাঁকিয়া জল, স্বচ্ছ জল পান করিতেছিল সে। তিৰ্য্যকে চাহিল। সরসীবাবু সম্ভবত মনিব মহাশয়কে উপদেশ দিলেন,–আজ্ঞে এংগসট্রা বিটরস মিশাইয়া মহুয়া আপনি ট্রাই করিয়া দেখিতে পারেন…ভাবা যায় না! এই সেই সরসীবাবু, তখনি অতীব উদ্ভট।

আমার স্ত্রী, মহাশয় বলিয়াছি ত, একপ্রকার উন্মাদ, সেইবার শিমূলতলায় এক কাণ্ড ঘটে, আমাদের। বাড়ীর পাশেই নাম বলিব না এক সত্ৰাহ্মণবংশীয় ভদ্রলোক বাস করিয়াছিলেন, তাঁহার এক কন্যা মাত্র পঞ্চদশবর্ষীয়া, সে পরমাসুন্দরী রাজার ঘরে পড়িবার মতই, বিবাহের চার মাসের মধ্যে সে শাঁখা ভাঙে, এবং যে এই কন্যার দুঃখে দুঃখিত হইয়া তাহার মাতাও পান ও মৎস্য যাবতীয় বিলাসাদি ত্যাগ করেন। বেচারী সত্যই হতভাগিনী! পুত্রসম্ভবা ছিল। পুত্র জন্মিল, আশ্চৰ্য্য এগারো মাস সাত দিনের দিন, আমার তখনই বিশ্বাস ধ্রুব হইল, এ কোন মহাপুরুষ! আমার স্ত্রী খালাস করিবার পরে কাঁদিতে কাঁদিতে বাড়ী আসিলেন, তাঁহার মুখে, কি দেখিলাম কি দেখিলাম, শুধু এই কথা ছিল। তখন রাত্র অনেক, আমি কুয়ো হইতে জল তুলি, তিনি স্নান করেন, এই জল ধারার মধ্য হইতে জ্ঞাপন করিলেন–মহাপুরুষ! নবজাতক এক মহাপুরুষ আমি দেখিয়াছি কপালজোড়া হীরা জ্বলজ্বল করিতেছে, আহা আমি মধু দিয়াছিলাম, হায় তিনজন যমদূত আসিল, আমারে ধাক্কায় দূরে সরাইল! সময় পার-হওয়া (দশমাস দশ দিনের পর জন্ম) সন্তান যতই শ্রীমণ্ডিত হউক, ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক ঘরে রাখিতে ভরসা পান নাই। আমি, মহাশয় জানি, তিরিশ এগারং তিনশো তিরিশ প্লাস সাত, তিনশো সাঁইতিরিশ, এইবার আসুন তিন তিন সাত হইল, এইবার যোগ দিন। কত? তেরো! তেরো দারুণ শাস্ত্রসম্মত পয়া শুভ সংখ্যা! মহাপ্রভু নিজেই…আচ্ছা…আমার স্ত্রী ঐ যমদূতের পশ্চাতে ছুটিলেন, ঐ যমদূতরা বনেতে যখন হাঁড়ী রাখিল, যমদূতগুলি বিস্ময়াবিষ্ট হওয়ত দেখিল, হাঁড়ীর সরা আপনি খুলিয়া গেল, দেখিল যে; মণিময় এক শিশু উঠিয়া দাঁড়াইল; দেখিল যে, ঐ তাহাদের মানে যমদূতদের প্রতি মৃদু হাসিয়া অনেকানেক রকমের আলো বিকিরণ করত গভীর বনের মধ্যে।

সহচরীবৃন্দ তখন নৃত্য অঙ্গন প্রস্তুতি দেখিয়া পুনৰ্ব্বার বিলির দিকে; যে এবং শ্রদ্ধায় গম্ভীর হওয়ত এতাদৃশ অভিব্যক্তিতে একে অন্যে নয়ন মেলিয়াছে, যাহাতে বলিয়াছে, আমরা লাভ ম্যারেইজ শুনিয়াছি, আমরা বিলিকে শুনি নাই।

আঃ বিলি আশ্চর্য্য, বিলি আশ্চৰ্য্য, বিলি আশ্চর্য্য। উহার জন্য যে যে যুবক আত্মহত্যা করিয়াছে, আঃ বিলি! আত্মহত্যার খবরে বিলি হুঙ্কার দিয়াছে, প্রেমকাতর মাজ্জারের ন্যায় তাহাতে স্বরভেদ পরিলক্ষিত হইয়াছে, পুলিশ ইন্সপেক্টার বলিয়াছে, ডেপুটি কমিশনার এইচ. কিউ. তোমাকে দেখিতে চাহেন, তুমি নিদারুণ! ইংরাজ ডেপুটি কমিশনারের সিগারের ধোঁয়ায় বিলি অস্বস্তি বোধ করে নাই, কেননা সে হয় কালচারড তাহারে দেখিয়া ঐ ধোঁয়া নিপট হয়, তিনি বলিয়াছেন…পর পর আত্মহত্যা! বিলি তুমি ব্যবিলন…অন্তত অশোকের সময় ফিরিয়া যাও! এ শতাব্দীতে তুমি অত্যধিক, বিলি বিলি বিজ্ঞান আমাদের বিস্ময় অপহরণ করিয়াছে! জীবনধারায় এমন কোন কূট-আতঙ্কও নাই। আমরা গোবেচারা। তোমার মযাদা আমরা দিতে অপারগ!

আঃ লাভ ম্যারেজ আমরা শুনিয়াছি, আমরা কখনও বিলিকে শুনি নাই! একাবলী ছন্দে ঈদৃশী বাক্য বলিতে, সাবেক পরিবারের কুমারীগণ, তাহারা এক উপত্যকায় গিয়াছে এবং হর্ষ পুলকিত।

ওগো পুণ্য নগরী কলিকাতা। গঙ্গা বিধৌত শ্ৰীশ্ৰীকালীমাতা আশ্রিত, ভগবান রামকৃষ্ণ পদ-ছোঁওয়া তুমি, ধন্য নগরী কলিকাতা! উচ্চবর্ণের অভিজাতবর্গের কলিকাতা। বিলিকে দয়া করিও, আর যে প্রকৃতিরে অনুনয় করিও, সে যেন বিলির প্রতি দয়া রাখে।

এই সেই সরসীবাবু, যাঁহার মুখমণ্ডল ভাসা-ভাসা ভাগবৎ পাঠকারীকে বিদ্রাবিত করিবে, অবশ্য যদি নিম্ন স্থানাৎ আলো আসে। ইনি মুরারীবাবুকে দেখিলেন। তখন মুরারীবাবু তেমনভাবেই ঘুমাইতে আছেন, যদি ঘুম ইহা, যে, কোন মুহূর্তেই অথচ উঠিয়া ইনি হাসিয়া কহিবেন, আমি জাপানের সূৰ্য্যবংশীয় রাজপ্রাসাদ অন্তর্গত খিড়কির বাগানে জাফরান পদ্ম ফুটিতে দেখিয়াছি, আহা হরিদ্রা! তোমার মননে আমার চক্ষু জলভরা হউক। অয়ি আমার মহত্ত্ব। যে এবং আশপাশে দৃষ্টি সঞ্চারে ইহা তাহার অনুমান হইবে যে নাচ এখনও আরম্ভ হয় নাই।

আর যে পর্য্যবেক্ষণ করিবেন অলোেকা তেমনই ভাবে দণ্ডায়মানা। এবং যে অন্য ধারে, শালা রাজনৈতিক-কবন্ধ, শালা, যে ক্রমবর্ধমান জাতীয় চরিত্র, যে রুমাল বিন্যস্ত করিতেছিল, ইহারই এই ব্যক্তির কারণে, এই ছোট ধরিত্রীতে, অনেক রমণী অনাদৃতা হইয়াছেন! ইহার লালা-মিশ্রিত বলদ হাসি হাসি কীদৃশ নীচযান! সেই দুৰ্বত্তের শব্দাবলীতে কথাতে নারী, জাতি, শোষণ শব্দ আছে, সে ভাবে অভিজাতরাই গোঁড়া অপ্রাকৃতিক এবং সে নিজে ভূত বিশ্বাস করিলেও, ভগবান নাই, ইহা জানে!

এখনও নাচ আরম্ভ হয় নাই; রাজনৈতিক কবন্ধ ক্রমশঃ বিকলাঙ্গ হইতেছে! সাঁওতালগণের চিড়া খাওয়া দর্শনে তাহার জিহ্বায় জল আসিল, অথচ এই ব্যক্তি প্রতি প্লেট হইতে কিছু না কিছু খাইয়াছে, বলিয়াছে অপচয় অন্যায়। এবং আড়দৃষ্টিতে দেখিল, সে সাঁওতাল রমণীদের সান্নিধ্য চাহিতে ছিল।

ঐ সেই সরসীবাবু, যিনি স্যার পি’র বহু গল্প জানেন: দেওঘর স্টেশনে স্যর পি’র খাস বেয়ারা আবদুল হাতের ঘড়ি দেখিয়া কহিল, মেরী বাবা (অলোকা) টায়েম হইয়াছে, আমি কি হুজুরকে ঔষধ দিব। কেননা স্যর পি…স্নায়ু পীড়া-গ্রস্ত; ইনি বুনো ফুল ফুটুস গাছের সমীপে বহুসময় যাপন করেন, কেহ তাঁহাকে বলিয়াছে উহার গন্ধ স্নায়ুকে সমতা দেয়। যে ঐ দিবস দেওঘর স্টেশনের ফার্স্ট ক্লাশ বিশ্রামাগারটি আর এক রূপ ধারণ করিয়াছিল, খসখসের টাটু পর্যন্ত টানান হয়; এখন অসময়; রেলওয়ের কর্মচারীবৃন্দ হন্তদন্ত। ইতিমধ্যে মাস্টার মহাশয়, অপরাধী যেমন, আসিয়া কাহিল স্বরে জানাইলেন,–স্যর গাড়ী এখনও মধুপুরে পৌঁছায় নাই! বুঝিতে পারিতেছি না…এবং ইনি টেলিগ্রাম যন্ত্রের শব্দের জন্য এই স্থান হইতে উৎকর্ণ থাকেন। অলোকা তাহার পিকিংগীজ লইয়া না-জ্বালা টেবিল আলোর গোলাকার কাঁচে আপন প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করিতে আছে, এখন তাহার আতঙ্ক নাই, সর্পভীতি নাই, এখানেও তাহার আকৃতির কোন বিচ্যুতি নাই! ইহার দরুণ প্রতিচ্ছবি মজা-উদ্দীপক হইল না, সে মাস্টার মহাশয়ের কথা শুনিয়া তাঁহারই দিকে অসহায়ভাবে চাহিল, পিতামহকে দেখিতে তাহার জোর ছিল না, কেন না তিনি বেচারী যারপরনাই অধৈৰ্য্য; গোলাপের কলম তাঁহার বিদেশ হইতে আসিয়া কলিকাতা বন্দরে আসিয়াছে, কয়েক রাত্র তাঁহার ঘুম ছিল না; গোলাপের কলম হাওড়া ছাড়িয়াছে তাঁহার ঘুম হয় নাই; এখন এই স্টেশনে পৌঁছিবে, তিনি গোলাপের কলম লইতে আসিয়াছেন।

সরসীবাবু সেই অভিজাতকে অপেক্ষমাণ দেখিয়াছেন। ঐ স্যর পি…মহানুভব, ঐ স্যার পি…শান্ত। প্রকৃতির! ইহাও সরসীবাবু বলিতে পারেন।

একদা মনে পড়ে আমাদের লেখকের বাড়ীতে আমার বাবা, অনন্যোপায় বেড়া নিমিত্ত অনেক লেডি হ্যাঁমিলটন ও মার্শল নীলের কাটিং রোপণ করেন, কালে সেগুলি ঝামরাইয়া উঠে। সেবার রিখিয়ায় আসিয়া এই সংবাদে স্যর পি…ম্রিয়মাণ; তিনি বেড়ার অন্যধারে থাকিয়া জানাইলেন, ইহা অন্যায়।

আমার বাবা উত্তর করিলেন,–মহাশয়, মুঘোল বাগিচায় এরূপ ব্যবহার আছে!

তিনি সলজ্জভাবে বলিলেন, তাহারা যাযাবর জাতি ছিল, খুনী ছিল! আমার বাবা তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিলেন, শুনিলেন স্যর পি’র কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হইল, ইহার কাঁটা আছে ইহাই জানিয়াছেন, আমি ভাবি আপনি শুধু, হায়! জানিলেন গোলাপের কাঁটা আছে…ইহা লিখিত থাকিবে! স্যর পি…অতীব দীপ্তিশীল, আবার নিষ্প্রভ কেননা মানুষের দুঃখ হইতে দুঃখতর দুঃখ তাঁহাতে আছে!

এখন নাচ হইবে।

মনিব পত্নী উতলা হওয়ত স্বামীকে বলিলেন,-হতভাগা এখনও এল না (সুঘরাই) তুমি ত তাকে…তোমার মাথায় যে কি চাপে…পাখী আনতে বললে! এই অন্ধকার রাস্তা!

মনিব মহাশয় আপন পত্নীর বাক্যে কিছু আশ্চর্য্যে থাকিয়া কহিলেন, তোমার মনে পড়ে, আনা পাভলুভা কে…ওঃ তাহার প্রবেশ মনে পড়ে? সব থেকে আমাদের বিরক্ত করিতেছিল, সেই আলোর ছটা যাহা সারা প্রেক্ষাগৃহ পার হইয়া আসিতেছিল,…(ওল্ড) এম্পায়ার ত…প্রজেকশ্যন রুম হইতে আলো আসিতেছিল তাই। কিন্তু ষ্টারে ব্যবস্থা আর এক, কর্ণাৰ্জ্জুন নাটকেনরেশবাবুর হাতে, মানে শকুনির হাতে, সেই অব্যর্থ পাশায়…কাহার হাড় যেন। কি আলো! আজও মনে আছে। হ্যাঁ তুমি কি। পাগল হইলে; অন্ধকারেই উহারা ভাল দেখিতে পায়…সে কি চেঞ্জার! নিশ্চয় হারামজাদা খাঁচাটি। সাজাইতেছে…নাচ আরম্ভ হইবার আগেই সে আসিবে।…আমি আনা পাভলুভার নাচ কলিকাতাতে দেখি…সমস্ত প্রেক্ষাগৃহ ঐভাবে, সেই হাঁসের ন্যায়, মরিতে চাহে…।

সদ্যোজাত শিশু না কাঁদিলে সকলেরই, ধাত্রী হইতে গৃহস্থের মহা দুশ্চিন্তা উদ্বেগ হয় ত, সেবার আমার স্ত্রী নবজাতক কাঁদে না দেখিয়া, কান্দিল না দেখিয়া, সন্নিহিত ধাত্রীকে কহিলেন, এই জাতক না কাঁদিলে বাঁচিবে কেমনে; না কান্দিলে…রহ, আমি চপেটাঘাত করি। সে কান্দিল! সে বাঁচিবে।

শ্রোতারা সকলেই সেই প্রহেলিকাময়ী ধাত্রীবিদ্যা পারদর্শিনীকে, যিনি এই নৃত্যজমায়েতে তাঁহাকে, এখন অদূরে আছেন, দেখিল।

মনিব পত্নী মহা উৎসাহে প্রকাশ করিলেন, দেখ ঠিক এমনিতারা আমরা কলকাতায় এ্যাট হোম দেব (!) কি বল? এমনি চেয়ার তক্তাপোষ টুল ইজিচেয়ার মোড়া বেঞ্চ এই রকমই পাথর থেকে চায়না, কাঁসা, জার্মান সিলভার, রূপার ডিস, মাটিরও কিছু গেলাসও…এ্যাট হোম দেব.পেলমেল…কি বল? খুব মজা হবে না!

এবং পরক্ষণেই মনিব পত্নীই কহিলেন, উদয়শঙ্কর দারুণ না! নিরাশা নামে এক নাচ, মনে পড়ে, কি লিরিসিজম, সবসময়ে আমার মনে হইয়াছে মিউজিক হ্যাঁণ্ড একটু বেশী হইলে বড় ভাল হইত…!

মনিব মহাশয় তদুত্তরে বিস্ময় প্রকাশে সমর্থন করিলেন,–যথার্থ, সত্যিই উদয়শঙ্কর একটি আনন্দ, পারকাশ্যনকে লীলায়িত, মানে অন্য যন্ত্রে…নৃত্যের রেখা আর বাদ্যধ্বনি রেখা কোথাও এক মানে…আরে আসুন…অবশ্য আমি যদিও গৃহস্বামী নহি…।

মনিব মহাশয় যাঁহারে অভ্যর্থনা করিলেন তিনি দাশ মহাশয়, প্রধান শিক্ষয়িত্রীর স্বামী, ইহার হস্তে ছড়ি, মাথায় ছাতা, গলদেশে কম্পাটার, অথচ কেহ খুব কিছু মজা পায় নাই, এমনও যে অল্পবয়সীরাও নহে, যে মেয়েটি পুরুষের পোষাকে–তাহার বয়ঃক্রম দ্বাদশ হইবে, তাহার পায়ে ডারবি জুতা, তাহার পরনে ধুতি–ইহা মালকোঁচা দেওয়া, তাহার সিল্ক-টুইলের সার্টের উপর ওপব্রেষ্ট কোট, তাহার কানে মাকড়ী, তাহার নাসার পুটে পাতলা-রিঙ, যে এবং তাহার দুই দিকের বেণীশেষে চমৎকার গোলাপী ফিতা…! ইহার ভাই নাই তাই ঐ বেশ, এই প্রকার পুরুষবেশী কিশোরী শুধু অবাক হইয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া অতীব গ্রাম্য চাহনিতে দাশ মহাশয়রে নিরীক্ষণে ছিল। যে অথচ এই পুরুষবেশী কিশোরী নাক। কুঞ্চিত খ্যাঁদা করিয়া হাসিতে পারে, কপোলে টোলের উদ্ভব হয়; এক ঘটা! সে হাসে নাই, যে ইহাতে দাশ মহাশয়ের কোন হেলদোল আসে না, তিনি খোলা ছাতার কারণে অনুমতি লইলেন না, কেন না তাঁহার ইত্যাকার অভ্যাস সকলের চোখ-সওয়া!

মনিব মহাশয় পুনরায় খেই ধরিলেন,–আঃ নাচ কিভাবে যে মায়া করে!…ভাবিতে থাকিলে আমরা। বিন্দুবৎ…ষ্টেজ কি সৃষ্টি, ষ্টেজ কি দারুণ সৃষ্টি!…আপনি নাচ ভাল নিশ্চয়ই বাসেন…! ঐ যে উহারা…ঐ দল দারুণ নাচে…নানাবিধ পশুপক্ষীর ডাক শুধু সঙ্গে করিয়া আনে নাই…মানে পারে নাই, যাহা মাদল, তিন ফুটো বাঁশীর টান যোগাইয়া থাকে…তবে আনা পাভলুভা উদয়শঙ্কর ছাড়াই আমাদের ইহা ভাল লাগিবে।

দাশ মহাশয় অত্যধিক গাম্ভীৰ্য্য ধারণে সম্মতি জানাইয়া, এখন নৃত্যের জমি চৌরস দেখিলেন, কেহ জল ছিটাইতেছে, কেহ মাটি পেটাইতেছে দুরমুস দ্বারা, ছাদ-পেটাই দিয়া। আর যে ইহারই পশ্চাতে অনেক সাঁওতালী মেয়ে, তাহাদের হাস্যে যেমন বা আলো যেমন কম, আরও পশ্চাতে তখন হাড়িয়ার ভাত লাল গামছাতে ছাঁকিতেছে পুরুষেরা, মেঠো-ইন্দুর চকিতে চলিয়া যায়!

ইন্দুরগুলি উহাদের ডরায় না। এই অপ্রত্যাশিত সংস্থানের সহিত কখনও তাঁহার, দাশ মহাশয়ের পরিচয় নাই, বিদেশীর ন্যায় তিনি চাহিয়াছিলেন, একবার বিদ্যুতে খেলিয়া গেল, ইহারা নাচিবে! ততঃ দূরাগত শিয়ালের ডাক তিনি শুনিয়াছেন, এবং ছাতার নির্জনতায় তিনি স্বতন্ত্রই এযাবৎ; এখনও তাই; এইবার স্বেচ্ছায় আপনাকে মনেতে সঙ্কেত-আজ্ঞা দিলেন,নাচ হইবে! তন্মুহুর্তেই বোঙ্গা উপাসক (সাঁওতাল দেবতা) হইতে তাঁহার নিজের অদ্ভুত পার্থক্য যে তাহাই পরিষ্কার হইতেছিল।

পরক্ষণেই অল্প বাদেতেই দাশ মহাশয় সরসীবাবুকে আবিষ্কার করিয়াছিলেন। এই সেই সরসীবাবু, যে যিনি উদ্ভট, যে যিনি ত্ৰাসদায়ী। চেঞ্জারদের সহিত, স্বভাবতই আলাপ হঁহার হইয়া থাকে, আর যে যখন চেঞ্জাররা চলিয়া যায়, তাহাদের বিষয়ে তাঁহার দিব্য দর্শন সকল অন্যকে ইনি পোস্টকার্ডে জানাইয়া থাকেন; কোথাও লিখিয়াছেন, আপনাদের উনুনটি ভালভাবে ভাঙা উচিত ছিল, বলিয়াছিলাম বাড়ীটি। ভাল নয়, এই সেই দিন দেখিলাম আপনার স্ত্রী আঁচল কে যেন কাটিতেছে; কোথাও, হঠাৎ সন্ধ্যা স্পষ্ট দেখিলাম আপনি কাহাকে যেন দরজা খুলিয়া দিলেন, সেই লোকটির, আশ্চর্য্য দেখিতে সৰ্ব্বাঙ্গ ব্যাণ্ডেজ; কোথাও, অনুরূপ দর্শন ১৯২৮ হয়, আবার দেখিলাম, যে তুমি আমায় বলিলে, আমায় সি-অফ করিতে যাইবেন নিশ্চয়ই!

সুতরাং ঐ সরসীবাবুকে অবলোকনেই স্বতঃই ইহা তাঁহার মনে হয় যে, উহাকে কোন পর্যায়ে ফেলিবেন, এ কারণ যে তাঁহাদের জীবনধারা এক সূক্ষ্ম সমালোচনা হইতে উদ্ভূত, সমালোচনা তাঁহার অবলম্বন, যে কুসংস্কার তাঁহার নাই; সুতরাং পত্রের বিষয় তাঁহার আলোচ্য নহে, শুধু স্বল্পপরিচিতকে পত্র দেওয়া তাঁহাদের শিষ্টাচার বহির্ভূত; যে উহা সহবত-রহিত; আবার তৎক্ষণাৎ তিনি নিজেকে সংশোধন করিলেন, যে বিশেষ প্রয়োজন না হইলে উচিত নহে এমত পত্র দান করা। অথচ তিনি যে সরসীবাবুকে এই প্রথম দেখিতেছেন এমন নহে, যে তিনি তির্যক দৃষ্টিতে লক্ষ্য করিলেন সরসীবাবু অতীব স্বাচ্ছন্দ্যে এক প্রলম্বিত হাই তুলিলেন। এই স্মরণের পর যে এবং দাশ মহাশয় স্বগত বলিলেন,-উহারাই নাচিবে।

সদ্যপ্রসূত শিশু, ইহা বালক, কাঁদে নাই, অত্যাশ্চর্য্য হুঙ্কার দিয়াছিল সে ঘোর গোলাপী বর্ণ হইতে, পুরীতে, সমুদ্রে, প্রথম উদিত দিবাকরের প্রায় লাল হইল, সহসা লণ্ঠন নিৰ্বাপিত আপনি! শিশুর দেহ হইতে ধূম বাহির হইল, সে নীল হইল, সেই শিশু শুধুমাত্র একটি মাত্র চক্ষুতে রূপান্তরিত পরক্ষণেই এক ত্রিকোণ বস্তু! আবার সে একটি হাত, কখনও বা একটি পা মাত্র, কখনও এক কলম; ধাত্রী চীৎকার করিল,–আরও লণ্ঠন, কি বিভীষিকা দেখ, প্রসূতির স্তন কি বিরাট হইতেছে, কি বিকট হইতেছে দুগ্ধস্রোত বহিতেছে, শঙ্খ বাজাইতে নিষেধ কর। শিশু আপন বক্ষদেশ ফাড়িয়া দেখাইল, হৃদয় নাই; কহিল,–যাহা দেখিলে তাহা সত্য, মানুষ ইহাই, তাই আমি মাতৃগর্ভ হইতে তাকাই। গৃহস্থেরা আসিল,–দেখিল সেই রূপান্তরের পুনরাবৃত্তি ঘটিল, এবং কহিল,–ইহা সৰ্ব্বনাশা, দাও ইহারে, ইহারে আমরা মাটি চাপা দিব: সেই দিবস ঝাপান ছিল, মাঠে অনেক সন্ন্যাসী–ইহা কুড়মুনের কাছে এক মাঠে ঘটে, জিলা বর্ধমান…তাহারা অন্ধকারে মৃত শিশু খুঁজিতেছিল, ঐ শিশু দর্শনে নানাবিধ রব তাহারা করিয়া উঠে, শিশুটিরে ছিনাইয়া শূল শীর্ষে বিদ্ধ করিয়া নাচিল, প্রমত্ত হওয়ত নাচিল–যে তাহারা সিদ্ধ হইবে…মেমারী আগত পুত্রহীনা বেশ্যা সনাতনী ঐ শিশুটি চাহিয়াছিল, কারণ সে তাহার অভাব পূরণ করিবে। ইহাতে দুই দল হয়, তাহারা মারপিট করে–আর সকলে অন্যেরা নাচিতেছিল।

মনিব মহাশয় ধীর কণ্ঠে উত্তর দিয়াছিলেন,–এত উতলা হইবার কারণ নাই, সে হারামজাদা হয়ত পাখীটিরে সাজাইতেছে…বেচারী বড় দুঃখিত হইত…এই নৃত্য একমাত্র সে আর সেই পক্ষীরই দেখার উপযুক্ত, তাহাদের ভুল হইবে না–আমরা অনেক কিছু ভাবিব তবে দেখিব…এই নৃত্য যে কোনও ধ্বংসাবশেষকে দুর্লভতা দিবে…সে যদি একা দেখে বড় ক্লেশ পাইবে!…এ নাচ দারুণ, এ নৃত্য দারুণ হইবে।

মনিব পত্নী কহিলেন, মেরীকে তুমি ডেকো…কি যে এরা ছাই স্বাধীনতা স্বাধীনতা করে চেঁচায়, মরণ!

কাছেই একদল নানা বয়সী পুরুষ ঘোর তর্ক করিতেছিল, নিয়ত বাঙালী, বাঙলা দেশ, রিট্রেঞ্চমেন্ট, চরকা–একটা হোক্স, শব্দ উৎসারিত হইতেছিল যে সকলেই তর্ক জয় ইচ্ছুক, ইহাদের উৎসাহে জাতীয়তাবাদী দৈনিক পত্র-এর প্রচারসংখ্যা ক্রমবর্ধমান, যে ইহারা দেশ-প্রেমে ক্লান্ত হওয়ত এখন হাওয়া বদলাইতে আসিয়াছে। এই দেশাত্মবোধের মধ্যে রাজনৈতিক-কবন্ধ ছিল না! কেন না এনারকিষ্ট দীননাথ এখানে, সে বড় বালাই। এহেন ঘোরতর বাগযুদ্ধে মুরারীবাবু চোখ খুলেন নাই, তিনি স্বাধীনতায়, যে এবং তাঁহার হৃদ্বয় কুঞ্চিত নয়, নিশ্চয় বিরাট কোন সিদ্ধির জন্য আরও গভীরে তিনি আছেন। এক সময় তিনি ঘোষণা করিবেন, আমার আমিত্ব কি দুস্তর, কি বিচিত্র! আমি স্বাতি নক্ষত্রে যে জল তাহাতে গৌরবান্বিত হইলাম, তোমরা আমারে আরও খানিক মগ্ন থাকিতে দাও, আমি তোমাদিগকে অনেকবিধ আশ্চৰ্য কথা বলিব!

ডেপুটি কমিশনার এইচ. কিউ তাঁহার মোম চর্চ্চিত গোঁফ, তিনি দারুণ জবর পিগ ষ্টিকার একজন, তাহার নেত্র বীরতুল্য, তাঁহার বুটের আওয়াজ অধস্তনদের স্মরণে! তিনি সিগার-এর ধূম ত্যাগ করিতে, ধূমবৃত্ত উদ্ভূত হইল, কহিলেন, বিলি তুমি বিস্ময়কর, তোমার উচিত ছিল…কি ক্রেজি আমি…যেহেতু বালুকার বৈভব দিয়া তুমি নিৰ্ম্মিত, তোমাতে অন্ধকারের অ নাই। সূৰ্য্য উপাসনা হইতে পৌত্তলিকতা এবং বিমূর্ত মানসিকতার যখন সবেমাত্র সঞ্চার, বাস্তবতা যখন প্রহেলিকা, তাহার ইতঃমধ্যে লহমার কোনখানে ডাগর দাম্ভিকতায় তুমি খেলা করিতে পার!

হায় এ শতাব্দীতে মারাত্মক যুদ্ধ ঘটিয়াছে, এ শতাব্দীতে, বলিতে কি, রমণীর কোন প্রয়োজনই নাই! তুমি নিরর্থক, তোমার বাম বক্ষস্থিত কৃষ্ণপক্ষ রাত্রির, স্বেদবিন্দুতে অপুত্রকের পুত্র হয়, তোমার দক্ষিণেরটিতে শুক্লপক্ষীয় স্বেদবিন্দুকে, নদীসমূহে বন্যা দেখা দেয়, দেশান্তর হইতে আজব পক্ষীতে তোমার উন্মাদনা আছে, হায় আমাদের কাহারও নিকট সেই মুক্তামালা নাই যে তোমারে প্রীতিভক্তিতে প্রণামী দিব, যে এ পর্যন্ত যাহারা তোমার শুভ নামে আত্মহত্যা করিয়াছে, সেই তাহারাই তোমারে সৰ্ব্বদা অদৃশ্য থাকিয়া রক্ষা করিতেছে, তাহারা তোমার নামে আত্মত্যাগ করিতে, বহু তরুণকে প্ররোচিত করিতেছে–তাহাদের শেষ–পত্রসল তোমাকে, যদ্যপি আইনবিরুদ্ধ, আমি তবু দিব!…যে হয়ত উহা সকল তোমার উন্মাদনাকে খুসী করিবে…কি ক্রেজি আমি…বিলি তোমাকে আমরা দেখিলাম যে বিলি তুমি অপরিসীম টেররিফিক (বিলির উচ্চারণে) তুমি…তোমার কারণে পুলিশ রিপোর্ট বলে, তোমার কারণে ম্যাডাল্স স্কোয়ারে সেদিন সন্ধ্যায় রক্তাক্ত জঙ্গ হয়, তোমার জানলা হইতে তুমি দেখিয়াছ, দুইপক্ষ সকলে উদ্বুদ্ধ হইয়া খরতর লড়াই করে, কত হকিস্টিক ভাঙ্গিল, কত ইলেকট্রিক তারের চাবুক চালনার শব্দ সাঁইসাঁই হইল, পাঞ্চ ব্যবহৃতও হয়, কে একজন পার্কের ফরাশের (যে গ্যাস জ্বালে) মই লইয়া রণস্থলে আসিল!…ইহা কিছু নয়, একটি জাতিকে উচ্ছন্ন দিবার সম্ভাবনা তোমাতে…ইহা, এতাদৃশ বাক্যে খাঁটি ইংরাজ ডি. সি-র আধা নীল চক্ষুদ্বয় সুনীল হইল।

…দেখ দেখ ঐ সাঁওতাল কি পৰ্য্যন্ত আনন্দের! কি বাঘেরা!

শ্রোতৃবর্গের কণ্ঠ শুষ্ক হয়, তাহারা পুরাতন প্যাটার্নের অলঙ্কার, যথা, মটরমালা, মপচেন ইত্যাদির নিমিত্ত খানিক মৌন, তাহারাও সাঁওতাল দেখিল। এ সাঁওতালগণ বহু জনপদবধূর রাত্র আত্মসাতে কালো!

একটি শিশু কি অফুরন্ত তাহার চেহারা, যে কাজলকে, নিজ চক্ষুস্থিত, নৈনেত্তর করিয়াছে, তবু কি মধুর। শিশু হস্তীর প্রায় ছুটিয়া আসিয়া দাশ মহাশয়কে জানাইল,–মেতমতাই নমচ্‌কাল…মেতমতাই নমচ্‌কাল (নমস্কার)।

সহচরীবৃন্দ কহিল,–আমরা লাভ ম্যারেজ শুনিয়াছি কিন্তু বিলিকে কখনও শুনি নাই। অদ্য প্রাতে ভ্রমণরত বিলিকে আমরা দেখিয়াছি, তাহার পথের সম্মুখে কয়েক তরুণদের আগমন, বিলি শুধু মাত্র ফুৎকারে তাহাদের বিশৃঙ্খল করত কহিয়াছিল,যাও এক ফুৎকারে তোমাদের উড়াইয়া দিলাম। সত্যই তাহারা ছিন্নভিন্ন মেঘের ন্যায় হইল। যে এখন সহচরীদের বিস্ময়োক্তি ও ঐ যে শিশুকথিত পদবন্ধ অবাক মিশ্রিত–দুই পক্ষের এক এক শব্দ কখনও পাশাপাশি–সুতরাং এক অদ্ভুত ভাষার কথার সৃষ্টি হয়।

এক কাশি শব্দ শ্রুত হইল, আর আর প্রসব-বৃত্তান্ত সূচিত হইয়াছিল, আর স্বরে, পুনরায় ধ্বনিত হইল,–আমার স্ত্রী জন্ম সম্পর্ক নেশার দরুণ এক এক কুহক ঘটনা জানেন, আমি জানি, তিনি আমায় অনেক গুহ্যাতিগুহ্য অভিজ্ঞতা, তত্ত্ব, বলিয়াছেন, যে তাঁহার হস্ত নাড়ী কৰ্ত্তনের মুহূর্তে ঝনাৎ শব্দ করিয়া উঠে, তাঁহাতে দিব্য দৃষ্টি উপজাত হয়, যাহার বলে তিনি প্রত্যক্ষ করেন, ঝরণা, মৃত্তিকা, উদ্ভিদের ঈশ্বরী জাগ্রত, সৌরজগত বিচ্ছিন্ন হওয়ার অনৈসর্গিক শব্দ উহা–ঐ ঝনাৎ, তাহার শরীর এক অভূতপূর্ব দশা প্রাপ্ত হয়, মনে হয় তৎক্ষণাৎই তাহার বিবাহ ও স্বামী পরিচিত হইল, ধ্রুব যে তদীয় দেহে অন্য মনোরমত্ব উপচাইল!

তিনি বলেন,–কোন আসক্তি নাই আমাতে, পরে খেদ হয়, হায় মায়া! কোথায় আমি…(হঠাৎ গলা ফিরাইয়া) ভাল আছেন স্যার, এই এমনই গল্প হইতেছে…হঁহারা কত বড় ঘর! ভঁহাকে স্যার বলিলে আমি ছোট হই না, কোন অন্যায় হয় না…হ্যাঁ বলিতে ভুলিয়াছি, ঐ শালা…এমন চেঁচাইতেছে…দেশ যে উদ্ধার হইল…তাহাতে আর ভুলিব না!

হ্যাঁ একবার আমার বড় সাধ হয় যে আমিও ঐ রূপ মদীয় স্ত্রীর মতন অনুভব লাভ করি, তাহাকে আমার মনোবাসনা বলি, একদিন তিনি ছুটিয়া আসিলেন, তাঁহার কেশভার রুক্ষ অঞ্চল মৃত্তিকায়ে, বসনে রক্তচিহ্ন, হস্তদ্বয় আঠা আঠা, তিনি যেন সন্ন্যাসিনী, চক্ষুদ্বয় প্রজ্জ্বলিত দিব্য,…আমি ঘড়িতে দম দিতেছিলাম–তদ্দর্শনে ঘড়ি রাখিলাম, আঃ সেই হাত আমায় স্পর্শ করিল, সেই স্পর্শ ও গন্ধে এক মহাদুৰ্ব্বিপাক, এক দণ্ডকারণ্য, এক মানস-সরোবর, তাতাথৈ দিয়া উঠিল, এক হংস হত্যা হইল, এক হংস জীবিত হইল, আমি স্রোতাঘাতচকিত নুড়িবৎ, আমি পিপীলিকাবৎ, আমি মেঘবৎ, আমি ব্যাঘ্রবৎ, আমি বিদ্যুৎ, এই প্রথম আমি পুরুষ হইলাম! তাঁহার হস্তগন্ধে আমার চেনা-চেতন সমাসীন হওয়ত অট্টহাস্য করিল! বহির্জগৎ নিৰ্বাপিত হইল। ক্রমে শুনিলাম মদীয় স্ত্রী সন্ন্যাসিনীরূপে খেদোক্তি করিতেছেন, হায় আমি রমণী নই!

এই উক্তি ক্রমশ সকলের, যে যাহারা এখানে, যে যাহারা, ইতস্তত, সকলের অগোচরেই আপন আপন ত্বকে, অন্তরে, কন্দরে সর্বত্রেই অনুরণিত হইল, তৎপ্রভাবে, যুগপৎ সকলেই অনলাকার প্রতি, যে দিব্য প্রভাময়ী, যে অভিজাত, সৌন্দর্যে ময়ূর, যে বিশুদ্ধ, যাহাকে একমাত্র শিশু কিশোররা কামনা করিতে দ্বিধা করে না, শিশুরা আধোস্বরে বিবাহের ইচ্ছা প্রকাশে; আর যে কিশোরদের সেই কামনা ঈদৃশ, যেন ভাই হই! অলোকা আপনারে বিকিরণ করিতে আছে, তাহার অত্যুৎকৃষ্ট লিওঁ সিল্কের কৃষ্ণ আলডিহাইড সবুজের ঘোর পার্পল ফুলকারি গ্রীবাছাড়া খানিক আবক্ষ জুনিয়ার মিস ধরনের ফ্রকে উল্লেখিত আছে।

সেই অলোকা এক আশ্চর্য্য!

এখন সে আপনার কণ্ঠের মুক্তামালায় হাত দিল–তাহার বাহু কি অপরূপ ব্ৰণবিরহিত–টিকার দাগ নাই! সে স্থাপত্যকে অভিনব করিয়াছে! অলোকার অধরদ্বয় এমন, যেমত সে ইহা কহিতে আছে যে আঃ অবশ্যম্ভাবিতা, আমার তোমাতে মতি নাই, অপার করুণানিধি ভগবান আমায় যে ভীতি দিয়াছেন, আমি অলৌকিক সৌভাগ্যবতী, হে নির্ঘাত অবশ্যম্ভাবিতা, তোমাতে আমার লোলুপতা নাই, হে হাসনুহানা, তোমাতে অনবদ্যতা সুচির, তুমি কলমের আঁচড়ে প্রস্ফুটিত হইলেও আমি কণ্টকিত, হে কামিনী তোমাতে মোহিনী মায়া অমোঘ, যুবতীর কবরীতে থাকিলেও আমি ভীত! ভীতিতেই আমি বৈদিক!

এবং তদীয় এবম্ভূত খেদে সেই জন্মরহস্য আমার চক্ষুৰ্বয় সার্সিতে দেখিয়া আরক্তিম বুঝিলাম, কে যেমন আমার অভ্যন্তরে, আমার অভ্যন্তর গঙ্গাতীরে বসিয়া রামপ্রসাদ গাহিতেছে, আনন্দময়ী নিরানন্দ কর না, যে এবং গীত থামাইয়া ঐ গায়ক কহিলেন,–মন্ত্র লও মন্ত্র লও, তোমার স্ত্রী যখন এক রমণীগর্ভস্যুত মৃত সন্তানে চমৎকৃত হয়, ইহাতে যে, আশ্চর্য্য হয় যে, রমণীগর্ভে মৃত্যু প্রবেশ করে, রমণী কি বিস্ময়রহস্য অহহা সত্য! তৎপ্রভাবে যখন তোমার সহধর্মিণী ব্যামোহাবিষ্ট, তখন ইহা কহি। নাই; অহো সত্য! এখন সময় আগত, শীঘ্রই মন্ত্র লও, অতএব…আমরা গুরুর সন্ধান করিতেছি!

পুলিশ রিপোর্ট বলে যে, তুমি জানলায় থাকিয়া, তোমার অজস্র কেশরাশিতে তোমার চিরুণী যায় আসে–যেমন তুমি সেই গাড়ী দুইটির মারাত্মক দুর্ঘটনা দেখ, যে দুইটি তোমার জানলার তলা দিয়া প্রায় ৮০ হইতে ১০০ স্পিডে যাইত। যেমন মোটর বাইকের দুর্ঘটনাও দেখিয়াছ, তেমনি তুমি সেই সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম দেখিতেছিলে, অথচ তুমি ইতিহাস ভারাক্রান্ত কর নাই। বিলি তুমি সেখানে যাও যেখানে তোমার সম্মুখে পশ্চাতে অগণন খোঁজা, তাহারা কি অভাবনীয় গৰ্ব্বিত, কেন না তোমার দেহরক্ষী তাহারা!…এখন যে তরুণ সম্প্রতি তোমার কারণে আত্মহত্যা করিতে চেষ্টা করিয়াছে তাহাকে কি দেখিবে?

বিলি জানাইল,–আমি তণ্ডুবণে কহিলাম,-মন্দ কি! তরুণ আনীত হইল। যাহারে আমি কখনও, কোন বিবাহ বাড়ীতে, কোন জন্মতিথি, কোনও নিমন্ত্রণে কোনও একজিবিশানে (!) বায়োস্কোপে পথে ঘাটে বাসে ট্রামে কোথাও দেখি নাই–তবে পূৰ্ব্ব তরুণদ্বয় যাহারা আমার কারণে আত্মহত্যা করিতে চেষ্টা করিয়াছে অতএব, তাই সে পরিচিত–যেন আমি মৃদু হাসিলাম, সেই তরুণ কিছু পরিশ্রান্ত! সে আমার প্রতি গভীরভাবে নিষ্পলক দৃষ্টিতে চাহিয়াছিল, সে সন্ত্রাসে কম্পিত, আশ্চৰ্য্য সেই তরুণ আমাকে কখনও দেখে নাই! আমি কহিলাম,এখন সে যাইতে পারে।

ইহাতে সহচরীবৃন্দ সকলেই আপন আপন অলঙ্কার হইতে অতীব পুরাতন হইয়াছিল, কহিল, আমরা লাভ ম্যারেজ শুনিয়াছি–দৈব দুর্বিপাক শুনিয়াছি, কিন্তু বিলিকে শুনি নাই: যে আর ঐ সহচরীবৃন্দের মধ্যে যাহারা অম্লতা, ঋতুমতী, তাহারা ঐ বিলিকে সম্যক আঘ্রাণ করিল, যাহাতে অনুতাপ নাই, এই সেই রমণী যাহার অস্তিত্ব অনুষঙ্গ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় না। এই রমণী আমাদের আরাধ্যা! ভাগ্যশ আমরা রিখিয়ায় তাই এই রমণীরে সহজে বুঝিলাম!–ইহার পরক্ষণেই ইহারা সকলেই নৃত্যের জন্য উন্মুখ হইয়াছিল।

দেশের অবস্থা হইতে তার্কিকরা অনেক দূরে, কখনও আদিস আবাবা কখনও স্পেনে। বিগত মহাযুদ্ধ যাহারা দেখে নাই তাহারা অচিরেই লড়াই প্রার্থনা করিতেছিল, লড়াইতে আমাদের মুক্তি! এক স্বর শ্রুত হইল; এখন বলিতেছ বটে! আমি পড়িয়াছি, লড়াই সাংঘাতিক, ঘরবার দুই যায়, গীতাতেও আছে বর্ণসঙ্কর জন্মায়, বিশৃঙ্খলা!

অন্য কণ্ঠ,ঘরবার ত কিছুই নাই…যায় যাউক!

ভিন্ন কণ্ঠে,–পৃথিবী ত আপনার নয়…মানুষ কিভাবে ভুলিয়া যায় যে অন্যজনও মানুষ! সরসে আর একজন জানাইল–মহাশয় মানুষ নিজেরেই ভুলিয়া যায়। নিজেকে না মারিতে পারিলে অন্যরে মারা যায় না… এই বচসার অদূরে দেশবৎসল জাতীয় চরিত্র অন্যর প্লেটের দিকে নালমাখা চোখে চাহিয়াছিল এবং সে অনেকের প্লেট হইতে ভাগ পায়–সে পাঁঠার ন্যায় হাসে!

অন্যত্রে নৃত্য আরম্ভ হইয়াছে, এ নৃত্যে চড়াই উৎরাই, অসমতল-সমতল ভূমিতে চলনের ভঙ্গিমার বাস্তবতা আছে, ধিতাং ধিতাং নাদে মাদল বাজিতেছে, একজন নাসারন্ধ্র দিয়া যুগ্মবাঁশী মাঝে মাঝে বাজাইতেছে, যাহার আওয়াজ নাই বলিলেই হয়, সাঁওতাল, নৃত্যরত রমণীদের বাহুমূলের রেখা, পেলব থরথর স্তর সমন্বিত উন্নত বক্ষগত অংশ যাহা–পাঁজড়ায়ে সম্মোহ বিস্তার করিতেছে!

দাশ মহাশয় তেমনই ছাতা খোলা! প্রধান শিক্ষয়িত্রী ঐ নৃত্যের দুয়েক সঞ্চারী দর্শনে অস্বাচ্ছন্দ্য। অনুভব করিলেন, স্বামীর ঐ স্বাতন্ত্র অন্যের চোখে হাস্যকররূপে প্রতীয়মান হইল! তিনি কন্যাদের প্রতি তিৰ্য্যকে নেত্রপাত করিলেন, তিনি অলোকাকে নেহারিলেন, অলোকাতে জড়বাদী রমণীত্ব নাই!

যে নাসারন্ধ্র দ্বারা এবম্প্রকার প্রায় নিঃশব্দ প্রায় বংশী বাদনে প্রধান শিক্ষয়িত্রী অশেষ বিকারগ্রস্ত, যে তিনি নয়ছয়, যে তিনি কোণ-ঠেসা, যেমন যে লম্পট কিছুর সমীপে তিনি, যে এবং তিনি ধূপ ভালবাসেন, ধোপদুরস্ত বস্ত্র যে তাঁহার তৃপ্তি বর্ধন করে, এখন ঐ দৃশ্যে ইহা সকল সর্বৈব ভিত্তিহীন; অনন্তর তিনি নিজেকে ধিক্কার দিয়াছেন। যে, উক্ত কায়দায়ে ঐ বাঁশীগুলি বাজান হইয়া থাকে, এই জ্ঞান আগেভাগে থাকিলে, যে বংশীগুলিতে–খাসা নকাসীকৃত কাজ শ্রবণে তাহা দর্শন মানসে উদগ্রীব হইতেনই না, অবশ্য মূলত মনিব পত্নীর অসংযত মন্তব্য এড়াইতেই তদীয় শিল্প প্রবণতা ঘটিয়াছিল, অন্যথা বাঁশীর শিল্পকর্মের প্রতি তাঁহার আন্তরিক টান ছিল না, হায় কি বিড়ম্বনা!

ভাগ্যশ তিনি সাঁওতালটির হাত হইতে ঐ নিদর্শন লইয়া পর্য্যবেক্ষণ করেন নাই! যদি ঘটিত তাহা হইলে অনেক ইউক্যালিপটস ওয়েল, কারবলিক সাবানেও তিনি বহুদিন অশুচি রহিতেন! যে এখন নিকট হইতে তাহা দেখিয়াছেন স্মরণেই দেহমন কাহিল, কর্দমাক্ত; তিনি পান করিবার ছলে, জল চাহিয়াছিলেন, যে জল আনিল তাহার সাহায্যে হাতমুখ প্রক্ষালন খানিক আড়ালে যাইয়া করিলেন। এবং তিনি নির্মল এবং আরাম হইলেন, এঃ নাক দিয়া বাঁশী বাজান!

কিন্তু তিলেক পরেই পুনরপি বাঁশীর চেহারা, উহা বাদন কতটুকু বা তথাপি সৰ্ব্বদাই তাহার সমক্ষে, যে, এমনও যে উহাদের উৎকীর্ণ মৎস্যলতা কুসুম কেয়ারি অবধি, যাহাতে তিনি অত্রাহি, যাহাতে উৎখাত। সুস্বন লহরী, খোদাই বৃথা হইয়াছে। তৎপ্রভাবে এতেক বিপর্যস্ত বটে–যে সুললিত, রিখিয়ার হাওয়ার শব্দ সহিত অপসৃয়মাণ খৰ্ব্ব-প্রায় ক্ষুদ্র-তরঙ্গ ব্যঞ্জনা সমান ঐ নৃত্য, মাদল বাদকের চুলের ঝাঁপটা–যেহেতু সে নাচে, সমস্তই কদৰ্য্য এরূপ সংস্কার জন্মাইল। তিনি আরবার চশমা মুছিলেন।

পার্শ্ববর্তিনী যাহারা, যাহারা গ্র্যাণ্ড বলিতে ব্যস্ত, যাহারা নৰ্তকীদের গীতের অর্থ একে অন্যকে জ্ঞাত করিতেছে, যথা ‘শালফুল, আমার দেহতে পড়িতেছে আমার চালাতে পড়িতেছে, আমার ভাতে পড়িতেছে, আমি তাই গীত গাহিতে আছি।’ যে দর্শকরা গীতের অর্থ কি পর্য্যন্ত মধুর মধুর বলিতেছিল, তাহাদের সকলের দিকে, উপরন্তু কন্যাদ্বয়কে, নেত্রপাতে তিনি, প্রধান শিক্ষয়িত্রী স্বাভাবিক হইতে পারেন না, তিনি ক্রমান্বয় যেন পাপপঙ্কে যেন নরকে (!), এ নৃত্য সদ্য অঙ্কুরিত আবীজ নহে যে স্বহস্তে। উপড়াইয়া ফেলিয়া দিবেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress