লোকশ্রুত মহাপুরুষের অলৌকিক জেল্লা নেই
আমার সত্তায়, আমি আটপৌরে ছাপোষা মানুষ,
কোনোমতে সংসারের হাল ধরে, আছি দাঁতে দাঁতে
চেপে সামান্যের ভরসায়, কিছু আয় করে আর
কিছুবা দেনার টানে। সন্ধেবেলা গৃহিণী ভাজেন
রুটি, আমি, কাজ-থেকে-ফেরা, পুরনো জোব্বাটা রেখে
এক কোণে ক্লান্ত গা এলিয়ে খাটে আমার নিজস্ব
অতীতের অভ্যন্তরে আস্তেসুস্থে আঙুল চালাই,
যেমন ধার্মিক ধর্মপুস্তকের পাতা ক্রমাগত
উল্টে যান ভাবাবেশে নিরিবিলি। এইমতো কাটে
দিন কায়ক্লেশে, থাকি প্রাতঃস্মরণীয় মহাপ্রাণ
নূহের বাড়ির পাশে সন্তান-সন্ততিসহ আর
বৈয়মের তৈলসিক্ত জলপাইয়ের মতন আমি
শুষে নিই, যতদূর পারা যায়, উচ্ছল আরক
জীবনের; প্রায়শই বন্ধুর ডেরায় যাই, করি
গল্পগাছা, মাঝে-মধ্যে গুঞ্জরণময় বাজারের
আশপাশে শুনি সদ্যপ্রত্যাগত মাঝিমাল্লাদের
সরস কাহিনী কত। কখনও-কখনও মধ্যরাতে
অতীত সম্ভোগ করি গৃহিণীর সঙ্গে কিংবা ভাবি
যুগ্মতায় কীভাবে কতটা ব্যয়সঙ্কোচন করা
যায়, কেনা যায় কিছু শস্যদানা এবং একটি
পাহাড়ি দুধালো ছাগী। জালার শীতল পানি শেষ
হয়ে এলো কিনা, দেখি কখনও সখনও। এভাবেই
দিন যায়, দিন আসে জন্মমৃত্যুময় এই নাটে।
অকস্মাৎ পথে পথে মজলিসে হট্ররোলে শুনি
নূহের জাহাজ নাকি জোড়া জোড়া নানা পশুপাখি,
হরেকরকম শস্যবীজসমেত ভেসেছে আজ
ভয়ানক ফুঁসে-ওঠা সমুদ্রে। কেননা গর্জমান
মহাপ্লাবনের ক্রূর তাণ্ডব হয়েছে শুরু আর
চতুর্দিকে দিশাহারা বিপন্ন মানুষ অগ্নিদগ্ধ
মৌমাছির মতো পলায়নপর। কে এক পায়রা
চকিতে আসবে বলে নূহের ব্যাকুল দৃষ্টি গাঁথা
পানি-ধোয়া দিগন্তের দিকে। জনসাধারণ থেকে
বহুদূরে নিরাপদে এই অবস্থান, একি নয়
পলায়নীমনোবৃত্তি ধীমান নূহের? আমি এক
সাধারণ নগণ্য মানুষ, আছি অতি উপদ্রুত
মানুষেরই মাঝে; কাদামাখা হাতে সকলের
সাথে মিলে নিয়তির বিরুদ্ধে নিয়ত অনলস
লড়ে বাঁধ গড়ে মহাপ্লাবনের এ ব্যাপক রোষ
আকুল থামাতে চাই। যদি যাই ভেসে, তবু নেই
কোনো খেদ; পাড়াপড়শীকে, হাজার-হাজার আর্ত-
মানুষকে বিপর্যয়ে ফেলে আমি সুদূরে হইনি
পলাতক-এই গৌরবের কিরীট জ্বলবে হিংস্র
ঢেউয়ের চূড়ায় নৃত্যপর প্রদীপের মতো দ্রুত
মজ্জমান আমার মাথায় আর এই হস্তদ্বয়,
তরঙ্গে তরঙ্গে ক্ষুব্ধ হস্তদ্বয়, ক্রোশ ক্রোশব্যাপী
নারী পুরুষের আর্তনাদে, ভয়ংকর চোরাটানে
ব্যাকুল খুঁজবে শুধু বিপন্ন ডুবন্ত কোনো হাত।