নীললোহিতের চোখের সামনে
আমার মেজোকাকার ছেলের বিয়ে, নেমন্তন্নবাড়িতে সে কী কেলেঙ্কারি কাণ্ড!
মেজোকাকা টালিগঞ্জে নতুন বাড়ি তৈরি করেছেন এবং তাঁর বড় ছেলের বিয়ে, সুতরাং বেশ ধুমধামের ব্যাপার। দিল্লি আর পাটনা আর গৌহাটি থেকে পর্যন্ত আত্মীয়স্বজন এসেছেন, গমগম্ করছে সারা বাড়ি, আমি কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে অকারণে ব্যস্ত হয়ে খুব কাজ দেখাচ্ছি। গৌহাটির পিসেমশাই চা বাগানের ম্যানেজার—মানুষকে হুকুম করা তাঁর অভ্যাস—সুতরাং যখন-তখন ভরাট গলায় যাকে-তাকে হুকুম করে কর্তৃত্ব দেখাচ্ছেন, মেয়েরা শাড়ি-গয়নার আলোচনায় মুখের ফেনা তুলে ফেলেছে, মেজোকাকা মাংসওয়ালাকে খুব কচি নয় অথচ চর্বি থাকবেনা—এমন পাঁঠার কথা বোঝাচ্ছেন, কুটুমবাড়ির দেওয়া জিনিশপত্রের মাঝখানে মেজোকাকিমা নৈবেদ্যর ওপরে কিসমিসটির মতন বসে আছেন, এইসময় কাণ্ডটা ঘটল।
ছাদে দই-মিষ্টি তৈরি হচ্ছে-আমি তার তদারকি করছিলাম, বিকু এসে চুপি—চুপি আমাকে বলল, ‘নীলুদা, তুমি ছাড়া আর কেউ পারবেনা, তাই তোমাকেই বলতে এলাম, তুমি যদি একটু চেষ্টা করো, মানে ইয়ে…।’ আমি হাসতে-হাসতে বললাম—’লজ্জা কী বাবাজীবন, বলেই ফেলো! কিন্তু আজ তো দেখা হবেনা, আজ কালরাত্রি!’ বিকু বলল, ‘না না, তা নয়, ওর শরীরটা ভালো নেই— ‘
আমি সরলভাবে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওর মানে কার?’
বিকু বলল, ‘ঐ-যে তোমার ইয়ের, মানে শরীরটা ভালো নেই, তাই বলছিলাম কী, মেয়েরা যদি আচার-টাচার খানিকটা কমিয়ে একটু তাড়াতাড়ি শুইয়ে দেয় ওকে’
এরপর বিকুর সঙ্গে খানিকটা ঠাট্টা-ইয়ারকি করে আমি ওর অনুরোধ ঠেলতে না-পেরে নিচে নেমে এলাম, যদি হিংস্র কৌতূহলী মেয়েদের সরিয়ে নতুন বউয়ের একটু বিশ্রামের ব্যবস্থা করা যায়। ভাগ্যিস এসেছিলাম, তাই আমি সেই কাণ্ডটার সাক্ষী হতে পারলাম।
উৎসববাড়ি সরগরম করে রেখেছিল আর-একজন, বড়কাকার মেয়ে কাজলদির ছেলে রিন্টু। বয়েস মাত্র চার বছর, কিন্তু সে একাই একশোজনের সমান। ফুটফুটে ফর্সা রং, কোঁকড়া চুল, দেবশিশুর মতন কান্তি, কিন্তু আসলে একটি এক নম্বরের বিচ্ছু। কখনো সে ছাদে, কখনো সে একতলায়, কখনো রান্নাঘরে—সব জায়গায় রিন্টু, জরুরি সমস্ত কথাবার্তার মধ্যে রিন্টু এসে গণ্ডগোল উৎপাত শুরু করবে। সব উৎসববাড়িতেই বোধহয় ঐরকমের এক-একটি বিচ্ছু থাকে। কিন্তু রিন্টুকে বকুনি দেবার উপায় নেই—বড়কাকার সে আদরের নাতি-ওকে শুধু ধমকালেই কাজলদির মুখ ভার।
ছাদ থেকে নেমে এসে আমি নতুন বউ যে-ঘরে বসে আছে সেইদিকে যাচ্ছিলাম, রিন্টু আমার জামা টেনে ধরে জিজ্ঞেস করল, ‘নীলুমামা, ঐ-ঘরে ঐ—বস্তাটায় কী আছে?’ সারাদিন ধরে রিন্টুর মুখে ওটা কী, কেন, ওটা কোথায় —এতবার শুনতে হয় যে আর ধৈর্য থাকেনা—সুতরাং আমি উত্তর না-দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছিলাম, রিন্টু তবু আমার পিছন-পিছন আসতে-আসতে বলল, ‘বলো—না, ঐ-বস্তাটায় কী আছে, বলো-না!’ সিঁড়ির পাশে ভাঁড়ার ঘরে অনেককিছু কিনে রাখা হয়েছে—রিন্টু তারই একটা বস্তা দেখিয়ে বারবার বলছে, ‘বলো-না, ওটায় কী আছে! বলো-না!’ বাধ্য হয়েই সেই বস্তাটার দিকে এক পলক তাকিয়ে আমি রাগতভাবে উত্তর দিলাম, ‘ওটায় চিনি রাখা আছে। যাও, এবার খেলতে যাও!’ রিন্টু আমার জামা ছেড়ে দিল, তারপর বেশ অভিমানী সুরে বলল, ‘ওটার ওপরে হিসি করে দিয়েছি।’
—অ্যাঁ???
আমিও ঘুরে দাঁড়িয়েছি, মেজোকাকাও পাশ থেকে কথাটা শুনেছেন, দুজনে সমস্বরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘অ্যাঁ? কী বললি রিন্টু?’
রিন্টু বেশ সহজভাবেই, সবাইকে শুনিয়ে বলল, ‘আমি ঐ চিনির বস্তার ওপর হিসি করে দিয়েছি। মাকে ডাকলাম, মা যে আসছিলনা—’
যেন একটা বোমা পড়েছে, এক মুহূর্তের জন্য সব চুপ। নতুন বউয়ের গয়নার ডিজাইন লক্ষ করছিলেন কাজলদি, তিনি যেন ভূত দেখবার মতন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন রিন্টুর দিকে। সন্দেহ কী রিন্টুর জাঙ্গিয়া তখনও ভিজে, আমরা কয়েকজন ভাঁড়ার ঘরে ছুটে গেলাম, চিনির বস্তাটা ভিজে জবজব করছে—অনেকক্ষণ চেপে রেখেছিল তো রিন্টু, তাই বেশ অনেকখানি
ব্ল্যাকমার্কেট থেকে সাড়েচারটাকা দরে কেনা ৫০ কিলো চিনি। মেজোকাকার মুখখানা গুড়ের মতন চটচটে হয়ে এল, তিনি ধপ করে বসে পড়ে বললেন, ‘একী সব্বনেশে ব্যাপার, এখন পাওয়া যাবে কিনা আর, এতগুলো টাকা—ওফ!’ মেজোকাকিমাও ছুটে এসেছিলেন, তিনি বুদ্ধিমতী, তিনি তাড়াতাড়ি বললেন, ‘চেঁচিয়ে বাড়িশুদ্ধ লোককে শোনাচ্ছ কেন? চুপ্ করো-না, কী হয়েছে কী?’
পঞ্চাশ কিলো চিনির দাম দুশো পঁচিশ টাকা। সমস্যা, এক্ষুনি অতটা চিনি আবার জোগাড় করা যাবে কিনা। তাছাড়া অতগুলো টাকা বাজে খরচ। মেজোকাকা অসহায়ের মতন আমার হাত চেপে ধরে বললেন, ‘এখন কী করি বলো তো নীলু—ওফ্—’
মেজোকাকিমা বললেন, ‘চুপ করো, সারা বাড়ি চেঁচিয়ে শোনাচ্ছ কেন?’
আমি মেজোকাকিমার মনের ভাব বুঝতে পেরে বললাম, ‘হ্যাঁ মানে, ছোটছেলের ইয়ে তো খুব পাতলা হয় একটু বাদে উপে যাবে—কেউ টের পাবেনা।’
পিছন থেকে কে যেন বলল, ‘হ্যাঁ, রিন্টু বলছে বলেই তো আমরা জানতে পারলাম, যদি না-বলত, কেউ হয়তো টেরও পেতামনা।’
মেজোকাকা বলে উঠলেন, ‘না, না, না এখন লোকজন জানবেই—শেষে এত আয়োজনের পর ঐ সামান্য ব্যাপারের জন্য বদনাম হবে—’
দুম-দুম করে পা ফেলে কাজলদি ঘরে ঢুকে বললেন, ‘কোথায় গেল সে—হতভাগা ছেলে? আমি আগেই বলেছিলাম, ও-ছেলে নিয়ে আমি সন্ধেবেলা এসে শুধু নেমন্তন্ন খেয়ে গেলেই হত, তা না—’
মেজোকাকা বললেন, ‘না, না কাজল, তুই ওকে কিছু বলিসনা, ও অবোধ শিশু— ‘
কাজলদি বললেন, ‘শোনো কাকা, চিনির দামটা আমি দিয়ে দেব, তুমি আবার আনিয়ে নাও।’
–সে কী কথা, তুই দাম দিবি কী? ছিঃ! সামান্য টাকা—
—মোটেই সামান্য নয়। ঐ-টাকার জন্যে আমি কারুর কথা শুনতে পারবনা। আমার ছেলে পাজি,–আমার ছেলে খারাপ, আমি শিক্ষা দিতে জানিনা—
কাজলদি অবস্থাটা আরও ঘোরালো করে ফেললেন। হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন। তারপর রাগারাগি কান্নাকাটি আরও বাড়তে লাগল, আমি সেখান থেকে কেটে পড়লাম। ছাদে উঠে দেখি—ঠাকুররাও এ-খবর জেনে গেছে, তারা উনুনের সামনে বসে মুখ টিপে হাসাহাসি করছে। এত তাড়াতাড়ি কী করে খবর ছড়ায় কে জানে! আর ছাদের কোণে তিন-চারটে বাচ্চার সঙ্গে প্রবল বিক্রমে খেলায় মেতে আছে রিন্টু। তার কোন গ্লানি নেই। হঠাৎ আমার হাসি পেল।
জর্জ ওয়াশিংটনের গল্প শুনেছিলাম বাগানের ফুলগাছ কেটে ফেলে বাবার কাছে সেই কথা স্বীকার করেছিলেন, ছেলেবেলায় তার বাবা ফুলগাছের দুঃখ থেকেও ছেলের সাহস ও সত্যবাদিতায় বেশি খুশি হয়েছিলেন। আর সত্যবাদিতার জন্যই বোধহয় তিনি প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। দিব্যদৃষ্টিতে আমি রিন্টুকে দ্বিতীয় জর্জ ওয়াশিংটন হিশাবে দেখতে পেলাম। কী সরল মুখ করে রিন্টু তখন বলেছিল, আমি চিনির বস্তায় হিসি করেছি! আমাদের পরিবারের একজন পরে প্রেসিডেন্ট হবে এই সম্ভাবনার কথা জানতে পারায়—আজ রিন্টুকে নিয়ে আমাদের উৎসব করা উচিত। এর তুলনায় ৫০ কিলো চিনি কিংবা ২২৫টা টাকা তো কিছুইনা।
কিন্তু তার জের চলল অনেকক্ষণ। মেজোকাকা আবার টাকা খরচ করে চিনি কিনতে প্রস্তুত, বদনামের ভয়ে। কাজলদির গোঁ—তিনিই ঐ-টাকাটা দেবেন—নইলে শ্বশুরবাড়িতে তার নিন্দে হবে। এর সঙ্গে যোগ দিলেন ছোটমামা। ছোটমামার কেমিস্ট্রিতে বিলিতি ডিগ্রি আছে। তিনি দাবি তুললেন আবার চিনি কিছুতেই কেনা চলবেনা। ব্যবসায়ীরা গোরুর হাড় পর্যন্ত ভেজাল দিচ্ছে, আর এ তো সামান্য বাচ্চা ছেলের হিসি। চিনি জ্বাল দিয়ে রসগোল্লার রস হবে—অতক্ষণ আগুনের জ্বালের পর কোন দোষই থাকবেনা! এতখানি চিনি নষ্ট হবে? দেশের এইজন্যই উন্নতি হচ্ছেনা—যতসব কুসংস্কার! আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বাকি অনেকেরই দেখা গেল সাত পুরুষে কবে যেন কার ডায়াবিটিস ছিল—তারা তো মিষ্টি খাওয়াই ছেড়ে দিয়েছিল—সুতরাং এতে তাদের কিছু যায়-আসেনা! কাজলদির স্বামী একটু বাদে এসে সব শুনে প্রথমেই রিন্টুকে ডেকে ঠাস্ ঠাস্ করে দুটি চড় কষালেন, প্রেসিডেন্টের বাবা হবার সম্ভাবনা তিনি মনে স্থান দিলেননা।
অবস্থা যখন চরমে উঠল, তখন এলেন মেজোকাকিমার গুরুদেব। দেওঘর থেকে তিনি দয়া করে এসেছেন বিয়ে উপলক্ষে। ভুঁড়িওলা বিশাল চেহারা, দেখলে ভয়-ভক্তি হয়। ঐসব গুরুদেবদের উপকারিতা আমি সেদিন বুঝতে পারলাম। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করার বেশ দ্রুত উপস্থিত বুদ্ধি ওঁরা ব্যবহার করতে পারেন। তিনি প্রথমে সব ব্যাপারটা শুনলেন, এমনকী ছোটমামার তীব্র বক্তৃতা পর্যন্ত। তারপর স্মিতহাস্যে বললেন, ‘ঐ চিনি যদি আমি খাই, তাহলে তোরা খাবি তো? শিশু হচ্ছে নারায়ণ, শোন্ তাহলে একটা গপ্পো, বৃন্দাবনে একদিন শ্রীকৃষ্ণ…। গল্পটা মহাভারত কিংবা কোন পুরাণে যে নেই—সে-সম্পর্কে আমি নিঃসন্দেহ। গল্পের মূলকথা শ্রীকৃষ্ণও নাকি একদিন যশোদার ননীমাখনে হিসি করে দিয়েছিলেন, তাই দেখে সুদাম ঘেন্না প্রকাশ করায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন, এখন থেকে শিশুর ইয়েকে যদি কেউ ঘেন্না করে—তাহলে সে আমার দয়া পাবেনা। গুরুদেব ঐ চিনির বস্তায় গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ওঁ শুদ্ধি, ওঁ শুদ্ধি।
চমৎকারভাবে সব মিটে গেল। শুধু ছোটকাকা আমাকে এক পাশে ডেকে ফিসফিস করে বললেন, ‘তুই রান্নার ঠাকুরদের বলিস্ চিনি আবার নতুন করে কেনা হয়েছে। দরকার কী! যদি জিজ্ঞেস করে তাহলেই বলবি, না জিজ্ঞেস করলে কিছু দরকার নেই—’
সেবার আমাদের বাড়ির রান্নার মধ্যে রসগোল্লাই হয়েছিল সবচেয়ে ভালো। রসগোল্লার নতুন ধরনের স্বাদে প্রশংসা করে গেলেন নিমন্ত্রিতরা সবাই। আর আমি? অতক্ষণ পরিবেশন করে অন্য বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে ফস্টি করার পর -আমার আর খাবার সময় কোথায়? আমি দুটো রসগোল্লা রিন্টুর মুখে গুঁজে দিয়েছিলাম!