Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নীলমূর্তি রহস্য (১৯৯২) || Sunil Gangopadhyay » Page 18

নীলমূর্তি রহস্য (১৯৯২) || Sunil Gangopadhyay

পাহাড়ের গায়ে ছোট একটা জলাশয়, সেখানে পৌঁছে অংশুমান চৌধুরী বললেন, এবারে এখানে একটু বসা যাক। ভীম তোর ফ্লাস্কে আর চা আছে? খাবার টাবার কিছু আছে? খিদে পেয়ে গেছে।

ভীমু বলল, হ্যাঁ, আছে, স্যার। চা আছে, সন্দেশ আছে।

লর্ড বলল, এবারে আমাদের মুখখাশ খুলে ফেলতে পারি? মাথাটা ভীষণ ভারী ভারী লাগছে।

অংশুমান চৌধুরী বললেন, তোমাদের মুখোশ খুলে ফেলতে পারো। অনেকটা দূরে চলে এসেছি। তবে আমি খুলছি না। কতরকম পাখপাখালি, পোকামাকড় থাকতে পারে। ভীমু ভাল করে দেখে নে, এখানে খরগোশ-মরগোশ কিছু আছে কি না, তা হলে দূর করে দে।

মাধব রাও বললেন, এখানে থাকার দরকার কী? একেবারে পাহাড় থেকে নেমে গেলে হত না? আদিবাসীগুলো যদি জেগে উঠে হঠাৎ তাড়া করে আসে?

অংশুমান চৌধুরী হেসে বললেন, ওরা অন্তত পৌনে চার ঘন্টা ঘুমিয়ে থাকবেই, আমার ঠিক হিসেব আছে। তা ছাড়া, ওরা জেগে উঠলেই বা, আমি আবার ওদের ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারি না? আমি সঙ্গে থাকলে পৃথিবীতে কাউকে ভয় পাওয়ার দরকার নেই।

মাধব রাও বললেন, তবু যাই বলুন, আমার আর এই জায়গাটায় থাকতে ভাল লাগছে না। কাজ যখন হাসিল হয়েই গেছে, এত সহজে যে হবে তা আমি ভাবতেই পারিনি, সত্যি ধন্য আপনার ক্ষমতা মিস্টার চৌধুরী। এবারে এখান থেকে তাড়াতাড়ি সরে পড়া উচিত না।

অংশুমান চৌধুরী মুচকি হেসে বললেন, আপনার কাজ হাসিল হয়েছে বটে, কিন্তু আমার কিছুটা কাজ এখনও বাকি আছে।

ভীমু আর লর্ড ততক্ষণে মুখোশ খুলে ফেলেছে। লর্ড বলল, এক কাপ চা না খেয়ে আমি নড়ছি না।

মাধব রাও মুখোশ খুললেন, ভীমু চা ও সন্দেশ দিল সবাইকে।

আকাশে হঠাৎ কোথা থেকে যেন চলে এসেছে একদল মেঘ। রোদের তাপ অনেকটা কম। ফিনফিনে হাওয়া বইছে, বোধহয় একটু পরেই বৃষ্টি নামবে। সামনের জলাশয়টায় ফুটেছে কয়েকটা লাল রঙের শালুক। কয়েকটা ফড়িং উড়ছে সেখানে।

চা-টা খাওয়ার পর লর্ড আর মাধব রাও ঘাসের ওপর গা এলিয়ে দিল। মাথার ওপরে একটা বড় তেঁতুল গাছ। পাহাড়ি রাস্তায় একবার বিশ্রাম নিতে বসলেই আর উঠতে ইচ্ছে করে না।

অংশুমান চৌধুরী বললেন, ভীমু তুই একবার ফিরে যা গ্রামটায়। দেখে আয় রাজা রায়চৌধুরী এসে পৌঁছেছে কি না!

ভীমুর মুখখানা পাংশু হয়ে গেল, সে রাজা রায়চৌধুরীকে যতটুকু দেখেছে, তাতেই সে আর ওই লোকটার ধারেকাছে যেতে চায় না। সে ফাঁসফেসে গলায় বলল, আবার ওই গ্রামে ফিরে যেতে হবে স্যার?

অংশুমান চৌধুরী ধমক দিয়ে বললেন, তুই কি ভয় পাচ্ছিস নাকি? কিসের ভয়? আদিবাসীরা সবাই এখনও ঘুমোচ্ছ। ওই এরিয়ার মধ্যে ঢুকলে রাজা রায়চৌধুরীও জেগে থাকতে পারবে না। তুই দেখে আয়, ওরা এসেছে কি না। মন্দিরের ভেতরটা ঢুকে দেখবি।

ভীমু উঠে দাঁড়াতেই অংশুমান চৌধুরী আবার বললেন, মাস্কটা পরে যা! নইলে তুইও তো ঘুমিয়ে পড়বি?

ভীমু এক পা দুপা করে চলে গেল।

লর্ড বলল, আমার এখানেই ঘুম পেয়ে গেছে। এখানেও কি আপনার ওষুধের এফেক্ট আছে নাকি?

একটু-আধটু থাকতে পারে। ঘুম যদি পায়, মিনিট পনেরো ঘুমিয়ে নাও, জাগাবার ওষুধও আমার কাছে আছে।

আপনার কাছে সত্যি জাগাবার ওষুধও আছে?

হ্যাঁ। এমনকী পাগল করে দেওয়ার ওষুধও আছে।

অ্যাঁ? কী বললেন?

মাধব রাও কয়েকবার নাক ডেকেই হঠাৎ লাফিয়ে উঠে বললেন, আঁ, কিসের ওষুধ আছে আপনার কাছে? আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কেন? আমি যদি আর না জাগতাম? মিস্টার চৌধুরী, আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে চাই না। আমি এক্ষুনি চলে যেতে যাই! চলুন, চলুন, আর এখানে বসে থাকবেন না।

অংশুমান চৌধুরী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মাধব রাও-এর দিকে। তারপর আস্তে-আস্তে বললেন, বেশ তো, আপনি এখানে আর থাকতে চান না তো চলে যান! আপনাকে কি আমি জোর করে ধরে রেখেছি?

মাধব রাও বিস্ময়ে ভুরু তুলে বললেন, আমি চলে যাব…মানে, আমি একা চলে যাব?

একা না যেতে চান, লর্ডকে নিয়ে যান।

আপনি যাবেন না?

বললুম না, আমার কিছুটা কাজ এখনও বাকি আছে। আমার যেতে দেরি হবে। আপনার তাড়া আছে যখন, এগিয়ে পড়ন।

আমরা চলে যাব… আপনি থাকবেন…মানে…তা হলে মূর্তিটা কী হবে?

মূর্তিটা আপনি নিয়ে যান! মূর্তিটা আমার কাছে রেখে কী হবে?

আমি মূর্তিটা নিয়ে যাব?

মূর্তিটা পাওয়ার জন্যই তো এতদূর এসেছেন, তাই না? মূর্তিটা না নিয়ে চলে যাবেন কেন?

অংশুমান চৌধুরী একটা লম্বা ব্যাগ খুললেন, তার থেকে বার করলেন একটা নীল মূর্তি। সেই মূর্তির গাটা চকচক করছে।

দুহাতে মূর্তিটা উঁচু করে তুলে ধরে মুগ্ধভাবে সেটার দিকে তাকিয়ে থেকে অংশুমান চৌধুরী বললেন, দুর্দান্ত জিনিসটা! এর এত দাম কেন জানেন! এরকম নীল রঙের পাথর চট করে দেখা যায় না। এর আরও একটা বৈশিষ্ট্য আছে, মূর্তিটার পিঠে এই যে দুটো গোল গোল গর্ত আছে দেখুন। হাওয়া ঢুকলে এখানে কখনও কখনও বাঁশির মতন শব্দ বেরোয়। এলুউন সাহেবের বইতে সে কথা লেখা আছে। তবে, এমনি ফুঁ দিলে বাজে না, ঝড়ো হাওয়া উঠলে বেজে ওঠে, সেইজন্য এরা মনে করে, স্বর্গের দেবতা এই মূর্তির মধ্যে জাগ্রত হয়ে ওঠে।

মাধব রাও বললেন, মূর্তিটা দেখতেও খুব সুন্দর। কিন্তু এই মূর্তির পায়ে এরকম জুতো কেন, এখানকার আদিবাসীরা নিজেরাই জুতো পায় দেয় না, তারা এরকম একটা মূর্তি কী করে বানাল?

অংশুমান চৌধুরী বললেন, আমার ধারণা কোনও সাহেবকে দেখেই এখানকার কোনও শিল্পী এটা বানিয়েছিল এক সময়। তারপর আস্তে-আস্তে সেটা দেবতা হয়ে গেছে!

মূর্তিটা মাধব রাও-এর হাতে তুলে দিয়ে অংশুমান চৌধুরী তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, ব্যাপারটা কী চমৎকারভাবে মিটে গেল, বলুন তো? আপনার বন্ধু পট্টনায়ক সাহেব এই মূর্তিটা চেয়েছিলেন, তিনি সেটা পেয়ে গেলেন। আদিবাসীদের মন্দিরে আমি অবিকল এর নকল একটা মূর্তি বসিয়ে দিয়েছি, ওরা ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখবে, ওদের মন্দিরের মূর্তি ঠিকই আছে, ওদের গ্রাম থেকে কিছুই চুরি যায়নি। সবাই মিলে কেন যে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছিল, তাই ভেবে অবাক হবে শুধু। ওদের মূর্তিটা হয়তো আর বাঁশির মতন বাজবে না। কিন্তু সেটা ওরা ভাববে, দেবতারা দয়া করছে না!

মাধব রাও বললেন, সত্যি অদ্ভুত আপনার বুদ্ধি। আমরা রাজা রায়চৌধুরীর কাছে প্রথমে শুধু শুধু গিয়েছিলাম! ওঁকে দিয়ে এসব কিছুই হত না! এত টাকা-পয়সা খরচ করে রাজা রায়চৌধুরীকে এতদূর টেনে আনারও কোনও মানে হল না!

অংশুমান চৌধুরী বললেন, রাজা রায়চৌধুরীকে নিয়ে আসাটা আমার নিজস্ব ব্যাপার। যে টাকা-পয়সা আমি খরচ করেছি এবার সেটা উসুল করব। আপনারা এগিয়ে পড়ুন।

লর্ড জিজ্ঞেস করল, আমরা কি পাহাড় থেকে নেমে গিয়ে গাড়ির কাছে অপেক্ষা করব?

অংশুমান চৌধুরী: বললেন, হ্যাঁ, আমার ঘন্টা দুএক লাগবে। চিন্তার কোনও কারণ নেই।

লর্ড আর মাধব রাও এগিয়ে পড়বার পর অংশুমান চৌধুরী মনের আনন্দে গুনগুন করে একটা গান ধরলেন, তাঁর মুখে এখনও মুখোশ।

একটু বাদেই ভীমু ফিরে এল ছুটতে ছুটতে। সে-ও মহা আনন্দে চেঁচিয়ে বলল, স্যার, স্যার, কেল্লা ফতে! ওই রাজা নামে খোঁড়া বদমাইশটা অজ্ঞান হয়ে উলটে পড়ে আছে। আর ওর সঙ্গের বাচ্চা ছেলে দুটোও কাত! এবারে ওদের খতম করে দেব স্যার?

অংশুমান চৌধুরী বললেন, চোপ! তোকে বলছি না, খতম-টতমের কথা একেবারে উচ্চারণ করবি না! রাজা রায়চৌধুরী অজ্ঞান হয়ে গেছি, দেখলি?

হ্যাঁ, স্যার, নিজের চোখে দেখেছি! মন্দিরের সিঁড়িতে!

তাকে ধরে নিয়ে আসতে পারলি না?

আপনি তো ধরে আনতে বলেননি। শুধু দেখে আসতে বলেছেন।

মাথায় একটু বুদ্ধি খেলাতেও পারিস না? একটা লোক অজ্ঞান হয়ে আছে, তার পা দুটো ধরে টানতে টানতে নিয়ে এলেই তো ঝঞ্ঝাট চুকে যেত। চল, চল আমার সঙ্গে।

অংশুমান চৌধুরীর লম্বা চেহারা। তিনি হনহন করে এগিয়ে গেলেন। মন্দিরটা সেখান থেকে বেশি দূর নয়। আকাশে মেঘ কালো হয়ে এসেছে। বৃষ্টি নামতে আর দেরি নেই।

অংশুমান চৌধুরী কাকাবাবুর হাত দুখানা ধরে টেনে নিয়ে এলেন খানিকটা। তারপর কাকাবাবুর দুগালে দুই থাপ্পড় দিয়ে দেখলেন, কাকাবাবু সত্যি অজ্ঞান কি না। কাকাবাবুর চোখের একটা পলকও পড়ল না। তিনি হিঃ হিঃ হিঃ হিঃ করে হেসে বললেন, রাজা রায়চৌধুরী, এইবার? আমার সঙ্গে বুদ্ধির খেলা খেলতে এসেছিলে?

ভীমু বলল, স্যার, ওঁকে নিয়ে যাব আমি?

অংশুমান চৌধুরী বললেন, ওকে আমি একাই টেনে নিয়ে যেতে পারব। তুই এক কাজ কর, সেই ছেলেদুটো কোথায়? তাদের এখানে ফেলে রেখে যাওয়া ঠিক হবে না। তাদের তুই নিয়ে আয়!

দুজনকে এক সঙ্গে নিয়ে যাব স্যার? না, দুবারে এসে একজন একজন করে…

দুটো বাচ্চা ছেলেকে তুই নিয়ে যেতে পারবি না? তুই কী হয়েছিস? এরকম করলে তোর চাকরি ছাড়িয়ে দেব! কিংবা, কিংবা তোকে একেবারে অদৃশ্য করে দেব।

ঠিক আছে স্যার, যাচ্ছি স্যার, আপনি এগোন?

অংশুমান চৌধুরীর তুলনায় ভীমুর গায়ের জোর বেশ কম। অসুখে ভুগে ভুগে বেচারা রোগা হয়ে গেছে। সন্তু আর জোজোকে মন্দিরের সিঁড়ি থেকে খানিকটা সরিয়ে আনতেই সে হিমশিম খেয়ে গেল, ঘাম বেরিয়ে গেল কপালে।

একসঙ্গে দুজনকে টেনে নিয়ে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। তা হলে উপায়? না নিয়ে গেলে অংশুমান চৌধুরী রেগে গিয়ে যে কী করবেন তার ঠিক নেই। ওই যে বলে গেলেন অদৃশ্য করে দেওয়ার কথা। সেরকম কোনও ওষুধও ওঁর কাছে আছে কি না কে জানে!

এমন সময় মচ মচ্ মচ মচ্ শব্দ শুনতে পেল। ঠিক যেন জুতোর – আওয়াজ। ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠল ভীমু। তবে কি মন্দিরের জুতো পরা দেবতা…

তারপরেই একটা ফররর, ফররর শব্দে তার ভুল ভাঙল। জুতোর। আওয়াজ নয়, কোনও একটা প্রাণী ঘাস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। শব্দটা আসছে মন্দিরের পেছন থেকে।

ভীমু আস্তে-আস্তে সেদিকে গিয়ে দেখল, একটা ঘোড়া সেখানে একলা একলা ঘাস খেতে খুব ব্যস্ত। দেখে মনে হয়, বেশ শান্ত ঘোড়া। ভীমুর এক সময় ঘোড়ায় চড়ার শখ ছিল। আফগানিস্তানে অংশুমান চৌধুরীর সঙ্গে থাকার সময় সে নিয়মিত ঘোড়ায় চেপেছে। ঘোড়া দেখলেই তার চাপতে ইচ্ছা হয়।

কিন্তু এখন ঘোড়ায় চাপার সময় নয়। বরং তার মাথায় একটা বুদ্ধি এল, ওই অজ্ঞান ছেলে দুটোকে তো ঘোড়ার পিঠে শুইয়ে নেওয়া যায়! তা হলে আর বইতে হবে না!

সে আস্তে-আস্তে ঘোড়াটার পাশে গিয়ে তার গায়ে কয়েকটা চাপড় মারল। ঘোড়াটা পালাবার চেষ্টা করল না। তখন সে আরও কয়েকবার আদর করে তারপর লাগাম ধরে ঘোড়াটাকে টেনে আনল মন্দিরের সামনে। সন্তু আর জোজোকে টেনে তুলে ঝুলিয়ে দিল, ঘোড়ার পিঠে। এবার তার আর কোনও পরিশ্রম নেই। নিজের বুদ্ধিতেই নিজেরই কাঁধ চাপড়ে দিতে ইচ্ছে হল তার।

কয়েক পা এগিয়েই তার আবার একটা কথা মনে পড়ল। অংশুমান চৌধুরী কোনও জন্তু-জানোয়ার সহ্য করতে পারে না। ঘোড়াটাকে দেখলেই তো খেপে উঠবে!

কিন্তু সন্তু আর জোজোকে আবার ঘোড়ার পিঠ থেকে নামাতে তার ইচ্ছে করল না। ঘোড়াটাকে অন্তত কিছুটা দূর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যাক। আস্তে-আস্তে। তারপর যা হয় তা হবে!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *