নারীর সেকাল একাল
বাংলা ও বাঙালির নবজাগরণে যে মুষ্টিমেয় মানুষের নাম করা যায় তাঁদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অন্যতম। তাঁর হাত ধরেই সেই সময় নারী শিক্ষার এক প্রবল ঝড় বয়ে গিয়েছিলো। ১৮৫৭–৫৮ সাল এই এক বছরে তাঁর উদ্যোগে সমগ্র দক্ষিণ বঙ্গে প্রায় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিলো। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিধবা বিবাহ প্রথা আইনে স্বীকৃতি লাভ করে। বহু বিবাহ এবং বাল্য বিবাহের মত সামাজিক অভিশাপ দূরীকরণে তাঁকে অক্লান্ত পরিশ্রম চালাতে হয়ে ছিলো। তিনি বুঝেছিলেন স্ত্রী জাতিকে শিক্ষার আলোকে আলোকিত করতে না পারলে সমাজের অগ্রগতি হতে পারে না। তাই স্ত্রী শিক্ষার জন্য তার উদ্যোগে কলকাতায় “হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়” নামে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এই বিদ্যালয় বর্তমানে বেথুন স্কুল নামে পরিচিত। এটি ভারতের প্রথম মহিলা বিদ্যালয়। তৎকালীন ভারতবর্ষ তথা বাংলার নারী জাতি, দুঃখ দুর্দশা এবং কুসংস্কারে আবদ্ধ ছিলো। তাদের অন্তঃপুর বাসিনী করে রাখার প্রচেষ্টা পুরুষ জাতিকে স্বেচ্ছাচারী এবং দাম্ভিক করে তুলেছিলো।তারা মহিলাদের সম্মান করতে হয় তা জানত না। মহিলাদের সাথে দুর্ব্যবহার করাটাই রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। মহিলারাও নিজেদের এ ভাবেই মানিয়ে নিয়েছিলো।তাদের চোখের সামনে তাদের স্বামী বহু বিবাহ করতো তাদের কিছু বলার অধিকার ছিলোনা। বংশধর দিতে না পারার কারণ হিসেবেও মহিলাকেই দেখানো হতো। সেই মহিলার কপালে জুটতো লাঞ্ছনা আর অপমান। তাদের অশিক্ষার কারণে তারা এটা বুঝতেই পারতোনা বংশধর না দিতে পারার দোষ তার না। এবং এই লাঞ্ছনা অপমান মহিলাদের মুখ বুজে সহ্য করতে হতো। ১৯ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ঈশ্বরচন্দ্র বাংলার নারীদের কাছে ঈশ্বর রূপে প্রকাশ পেলেন।তাঁর বদান্যতায় নারী জাতি পেলো শিক্ষার আলো। এই সময় নারী শিক্ষার অন্যতম অগ্রণী ছিলেন কাদম্বিনী বসু।তিনি নারী হয়েও পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে শুরু করেছিলেন।যদিও তার এই চলার পথ খুব মসৃণ ছিলোনা । এই সব এগিয়ে আসা নারীদের বহু সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে।তবু নারী থেমে থাকেনি। সব সমালোচনা অত্যাচার সহ্য করেও মাথা উঁচু করে এগিয়ে গেছে। ১৮৮৩ সালে বেথুন কলেজ থেকে প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট হন কাদম্বিনী বসু, এবং উত্তর প্রদেশের বাঙালি মেয়ে চন্দ্রমুখী বসু। সেই সঙ্গেই শুরু হয় নারীদের জয় যাত্রা। কিন্তু আজ এই ২১শতকে দাঁড়িয়েও নারীকে আজও হতে হয় লাঞ্ছিতা, আজও শিক্ষার আলো থেকে বহু নারী পিছিয়ে আছে। তার কারণ স্বরূপ দারিদ্রতাকে অবশ্যই দায়ী করা যায়।বহু পিতা মাতা তাদের কন্যা সন্তান পেটের দায় বিক্রি করে দিচ্ছেন। আজও নাবালিকাকে বিদ্যালয়ে নয় বিবাহ বাসরে পাঠানো হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নারী সম্মান লুন্ঠিত করছে। যে শিক্ষক পথ প্রদর্শক হন, তিনি যদি হন ধর্ষক তাহলে সমাজ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে! (যদিও সব শিক্ষক এই শ্রেণিভুক্ত নয়।) বিদ্যাসাগর কি এই সমাজের জন্যই এতো সংগ্রাম করেছিলেন! দুশো বছর আগে জন্মানো মানুষটি সেই সময়কার কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের বিরুদ্ধে প্রায় একা লড়াই করেছিলেন;
তবে আজ কেন দুশো বছর পর সমাজ এগোনোর বদলে পিছিয়ে যাচ্ছে! নারীকে শিক্ষার আলোকে আলোকিত করার প্রচেষ্টায় তিনি এগিয়ে এসেছিলেন।আজ বহু নারী শিক্ষিত হয়েছে ঠিকই তবু অশিক্ষার অন্ধকার এখনো বহু নারীর জীবন তমসায় ঢেকে রেখেছে। আজ নারীকে নিজের রক্ষা নিজেকেই করতে হবে। অবলা নয় সবলা হয়ে, শিক্ষিত হয়ে। যদিও সরকার অনেক সচেষ্ট হয়েছে। নারী শিক্ষার অগ্রগতির জন্য অনেক ধরণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে নারীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টাই একমাত্র পারে নারীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।