নারী এবং নদীর পাড়ে বাড়ি – এক
অনেকটা পথ, রাস্তায় ঝড় বৃষ্টি এবং কিছুটা রাস্তা জল কাদা ভেঙে বারদীর স্টিমারঘাটে তাকে এনে তুলেছিলেন জগদীশ। পথশ্রম লাঘবের জন্য লোকনাথের আশ্রমেও কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছিলেন। বাল্যভোগের সময় তখনও পার হয়ে যায়নি। জগদীশকে দেখে সেবাইত কুলদাচরণ খুবই পুলকিত—আরে ভুঁইঞামশায়, এদিকে হঠাৎ। এটি কে?
জগদীশ এসব ক্ষেত্রে সে যে তার বড় পুত্র এমন পরিচয় কখনই দেন না। বাবার সঙ্গে গেলে এটা টের পেতে অসুবিধা হয়নি অরণির। আশ্রমেও আসন পেতে দিলে বাবা বলেছিলেন, ঠাকুরের কৃপা, বাল্যভোগ সেরে যাব ভেবেই আশ্রমে এসে উঠেছি। আপনার সব কুশল তো! যাচ্ছি কর্মস্থলে। সামান্য উঁজিয়ে স্টিমার ধরব বলে চলে এলাম। এবারে অরণি মাইনর পাশ করেছে। কাছাকাছি হাইস্কুল কোথায়! তাই নিয়ে যাচ্ছি।
কুলদাচরণ এবং তার লোকজন জগদীশকে খুবই খাতির করল, একটা লোক বালতি করে জল এনে দিয়েছিল, হাত মুখ ধুয়ে বাল্যভোগ সেরে আবার রওনা হওয়া। আশ্রম থেকে ঘাটের দূরত্ব সামান্য। স্টিমারের আওয়াজ আশ্রমে বসে শোনা যায় এমন সে শুনেছে।
বাবা লোকনাথের বাল্যভোগের স্বাদই আলাদা। গোবিন্দভোগ চালের ভাত, এক গণ্ডূষ ঘি এবং সঙ্গে আলু বেগুন কুমড়ো সেদ্ধ। এই দিয়ে সকালের জলযোগ। খুবই পরিতৃপ্ত তারা এবং দু ক্রোশ দুর্গম রাস্তার পথকষ্ট নিমেষে উবে গেলে সে তার বাবার সঙ্গে রওনা হবার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছিল।
জগদীশ বললেন, তা হলে এবার যাত্রা করা যাক। স্টিমারে ওঠার আগে বাবা লোকনাথের কৃপার বড় দরকার ছিল। তাই উজিয়ে চলে এলাম। স্টিমারে গেলে বেশি সময়ও লাগবে না।
চৌচালা ছোট্ট কুটিরে লোকনাথের অতিকায় ফটোটির সামনে তাঁর প্রণিপাত দেখে সেও লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছিল—দূর দেশে যাচ্ছে, মন তার ভালো ছিল না। সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাতের পর, অরণির মনে হয়েছিল, বাবা লোকনাথই তাকে রক্ষা করবেন।
কর্মস্থলে অবশ্য হেঁটেও যাওয়া যায়—দশক্রোশের মতো পথ। হেমন্তের শেষাশেষি সময়। মাঠ— ঘাট থেকে বর্ষায় জল নেমে গেছে ঠিক, তবে জায়গায় জায়গায় মাঠ ভাঙতে এত বেশি কাদা ভাঙতে হয় যে তাতে তার পক্ষে সুস্থ শরীরে পৌঁছানো সম্ভব কিনা এমন ভাবতেই পারেন জগদীশ। দু ক্রোশের মতো রাস্তা যে করে হোক পার হয়ে স্টিমারে ওঠার সময় সে বুঝেছিল, বাবার কর্মস্থলে পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে।
সারা রাস্তায় বাবা তাকে এত বেশি বুঝ প্রবোধ দিয়েছেন যে সে মাঝে মাঝে বিরক্ত না হয়ে পারেনি।
যেমন বাড়ি থেকে নেমে সে একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে ছিল।
বাবা বললেন, পেছনে তাকাতে নেই। হোঁচট খাবে।
তখন সে দেখেছিল পুকুরপাড়ে মা তোতন নীলু ফুলু ছোটকাকা সবাই দাঁড়িয়ে আছে। সে জানে যতক্ষণ দেখা যায় সবাই তাকে দেখবে। খেজুর গাছের নিচে তারা শুধু দাঁড়িয়ে নেই, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে যে কাঁদবে, কিংবা সবারই অশ্রুপাতের কথা ভেবে সে বিষণ্ণ হয়ে না যায় সেই ছিল আতঙ্ক। জল— কাদায় তাকে হেঁটে যেতে হবে। আর মাস দু এক আগে হলে সোজা নৌকায় সে তার বাবার কর্মস্থলে চলে যেতে পারত। কিন্তু মা মনস্থির করতে পারেননি। মামার বাড়ি রেখে পড়ানো যায় যদি—এবং বেশি দূরও না, ক্রোশ দুই রাস্তা পার হতে হয়। পুষ্পতারা হাইস্কুলে ভর্তি করে দেওয়ারও কথা হয়েছিল।
তবে বাবার মনঃপূত নয়। পুষ্পতারা স্কুলের রেজাল্ট মোটেই সুবিধের না। সেদিক থেকে ভবনাথ হাইস্কুলের বিশেষ সুনাম আছে। স্থানীয় জমিদারদের আনুকূল্যে স্কুলটি চলে। স্কুলে ফুটবল খেলার মাঠ পর্যন্ত আছে। এসব বিষয়ে বাবার পরামর্শ দেবার লোকের অভাব নাই। তিনি জমিদারদের এক শরিকের কাছারি বাড়িতে থাকেন। আদায়পত্র সব তারই জিম্মায়। বিশ্বস্ত খুব।
হাফপ্যান্ট হাফশার্ট গায় সে বারবার বাবার পেছনে পড়ে যাচ্ছিল। টিনের স্যুটকেসটি বাবার হাতে। ছোটকাকা সঙ্গে আসতে চেয়েছিলেন, বাবা রাজি হননি। কতটুকু রাস্তা, আমরা ঠিক চলে যাব। তোকে সঙ্গে আর যেতে হবে না।
আসলে বাবার বোধ হয় ধারণা, ছোটকাকা সঙ্গে থাকলে স্টিমারে ফের আর একটা সিন তৈরি হবে। ছোটকাকা ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকলে সে রেলিং থেকে কিছুতেই সরে যাবে না। তার ফের অশ্রুপাত শুরু হয়ে যেতে পারে। এমনিতেই বাবা খুবই দুশ্চিন্তায় ছিলেন, এতদূরে সে শেষ পর্যন্ত যেতে রাজি হবে কি না। এক গ্রীষ্মের বন্ধে কিংবা পূজার বন্ধে সে শুধু আসতে পারবে। এতদিন বাড়ি ছাড়া হয়ে থাকার কষ্ট ভুক্তভোগী মাত্রেই জানে।
কিছুটা হেঁটে এসেই সে দেখেছিল, সে আগে, বাবা তাকে এগিয়ে দিয়ে পেছনে তিনি আসছেন। সে আর পেছন ফিরে তাকাতেও সাহস পায়নি।
রাস্তা যে খুবই দুর্গম—সে বল্লভদির মাঠে নেমেই বুঝতে পেরেছিল। পায়ে তার রবারের জুতো। গাঁয়ের ভেতর দিয়ে কিছুটা হেঁটে একটা সাঁকোর সামনে দাঁড়ালেন বাবা। তার যে কী হয়েছে, কিছুতেই বাবার সঙ্গে হেঁটে পারছে না। কিছুটা গিয়েই তিনি তার জন্য অপেক্ষা করছেন। গাঁয়ের লোকজন বাবার যে খুবই পরিচিত তাও সে টের পেল। এত সকালে তাকে নিয়ে তিনি কোথায় যাচ্ছেন এমন কথাবার্তা শুনেও বাবার সেই এক কথা, অরুকে নিয়ে যাচ্ছি। আমার কাছে থাকবে। ওখানকার স্কুলে ভর্তি করে দেব।
সাঁকোর ঠিক নিচে এসে জগদীশ বলেছিলেন, জুতো খুলে নাও অরু। আমরা সোজা সাঁকো পার হয়ে যাচ্ছি না। আমরা যাব দক্ষিণে। সোজা গেলে দনদির বাজার পড়বে। আরও দূরে নদীর পাড়ে প্রভাকরদি। গঞ্জ মতো জায়গা। ওখানে মেলা পাটের আড়ত আছে। একটা বড় সাঁকো আছে। বড় হলে সবই জানতে পারবে। আমরা এবার মাঠে নেমে যাব। কিছুটা রাস্তা জলকাদা ভাঙতে হবে।
অরণি সাঁকোর উঁচু জায়গা থেকে খালের পাড়ে দৌড়ে নেমে গিয়েছিল। ঘাস পাতায় ঢাকা রাস্তা, তারপর আরও নিচে ধানখেতের লম্বা আল পড়েছে দেখতে পেল। এই আলের রাস্তায় নওঁগা পর্যন্ত হেঁটে না গেলে সড়কে ওঠা যাবে না। সকালের দিকে ঠান্ডার আমেজ থাকে। সূর্য উঠে গেছে। ঘাসে শিশির পড়ে আছে। ধানের জমিগুলো হলুদ রঙের—যতদূর চোখ যায় মনে হয়েছিল হেমন্তের মাঠ বড় নিরিবিলি।
অবশ্য আলের রাস্তায় বকের মতো পা ফেলে কিছুটা হেঁটে আসতেই দেখতে পেল— সামনের জমি সব উঁচু। রাস্তায় জলকাদাও নেই—দু—পাশের জমিতে কলাই সর্ষে বুনে দেওয়া হয়েছে। কীটপতঙ্গের আওয়াজও উঠছিল, দূরে একটি নদী আছে টের পেল—এবং এটা যে ছাগলবামনি নদী অরণি জানে। নদীর পাড় ধরে হেঁটে গেলে পায়ের কাদা ধুয়ে আবার জুতো পরে নেওয়া যেত, কিন্তু জগদীশ তাকে নিয়ে সেদিকে গেলেনই না। সোজা সামনে তিনি বেশ দ্রুত পায়েই হেঁটে যাচ্ছেন, এবং দম ফেলতে না ফেলতেই ফের সেই কাদাজল ভাঙা—ধানজমির মাঠ উঁচুনিচু হয়ে আছে—সামনের দিগন্ত প্রসারিত মাঠের শেষ দিকটায় বাবা আঙুল তুলে বললেন, আর ঘণ্টাখানেকের পথ, ওখানে আমাদের শেষ সাঁকোটি পার হতে হবে। নদীর জলে ইচ্ছে করলে পা ধুয়ে নিতে পারবে।
তারপর হাঁটতে হাঁটতেই বলেছিলেন, বারদীর আশ্রমে আমাদের একটু তাড়াতাড়ি উঠে যাওয়া দরকার। আশ্রমের বাল্যভোগ প্রসাদ পা চালিয়ে না হাঁটলে পাবে না। বাল্যভোগ তুমি খেয়েছ, তবে স্মৃতিতে সে অমৃতস্বাদের কথা মনে নাও থাকতে পারে। একবার তোমাদের সবাইকে নিয়ে জ্যৈষ্ঠমাসে বাবা লোকনাথের উৎসবে এসেছিলাম—তোমার কি মনে পড়ে।
অরণির কিছুই মনে নেই।
সে বলেছিল, কবে?
তখন তুমি খুবই ছোট। তোমার মা মানত করেছিল, আশ্রমে মিসরি বাতাসা ভোগ দেবে। তোমার ঠাকুমা তখন বেঁচে।
অরণি আর কোনও কথাই বলছিল না। কারণ ঠাকুমার কোনও স্মৃতি তার মনে নেই। আর সে ভেবে পাচ্ছিল না, বাবা তার সঙ্গে আজ এত কথা কেন বলছিলেন!
যেমন জমির কথা।
যেমন ঋতুর কথা।
যেমন এই মাঠ এবং গ্রামগুলো সম্পর্কে শোনা কথা।
জগদীশ বলেই চলেছেন, আশেপাশের গ্রামগুলোর নামে অদ্ভুত মিল আছে। যেমন ধরো আমরা বল্লভদি পার হয়ে এলাম—পূর্বে গেলে সুলতানসাদি, দক্ষিণে গেলে বাণেশ্বরদি, বারদি, হামচাদি, দামোদরদি। সব গ্রামের শেষে ‘দি’ শব্দটি আছে। আসলে ওটা ‘দি’ হবে না। ‘ডিহি’ হবে। জলা দেশ, আমাদের পূর্বপুরুষরা এই জলা দেশে মাটি ভরাট করে বাড়িঘর বানিয়েছিলেন। দেখবে সবার বাড়ির সামনেই একটা করে পুকুর আছে। মাটি তুলে নেওয়ার প্রয়োজনেই পুকুর কাটতে হয়েছে। মাটি তুলে ডিহি তৈরি করে বসতবাড়ি গড়া হয়েছে। যত উত্তরে যাবে সব ‘দি’। ব্রাহ্মণনদী, মনোহরদি, গোপালদি, নরসিংদি। তোমার পায়ে কি লাগল!
না বাবা!
বসে পড়লে কেন! অরণি দেখেছে বাবা তাকে গুরুত্বপূর্ণ কথায় কখনো সখনো তুমি বলে, আবার কখনো তুইতোকারিও করেন। আজ বাবা একটু বেশি মাত্রায় তুমি তুমি করছেন। অরণি পা থেকে জড়ানো কিছু যেন তুলে নিচ্ছে। বোধ হয় লতাপাতা কিছু জলকাদা ভাঙতে গিয়ে পায়ে জড়িয়ে গেছে।
জলা জায়গায় পোকামাকড়ের উপদ্রব এমনিতেই বেশি মাত্রায়। যদি জোঁকের উপদ্রবে পড়ে যায় অরু—জগদীশ নুয়ে দেখলেন, শ্যাওলা জাতীয় কিছু পায়ে আটকে গেছে। কাদা শুকিয়ে যাওয়ায় পায়ের গোড়ালিতে টান ধরে যেতে পারে। হাঁটতে অস্বস্তি হতে পারে। প্রায় হাঁটুর কাছেও কাদার দাগ। তিনি বললেন, আর বেশি দূর না। এবারে আমরা নওগাঁর সড়কে উঠে যাব। নওগাঁর শচীন ডাক্তারের কথা মনে আছে?
অরণি বলল, আছে। সোম শুক্র সাইকেলে আমাদের বাড়ি যেতেন।
তা হলে মনে করতে পারছ। দীর্ঘদিন কালাজ্বরে ভুগে ভুগে বড়ই রুগণ হয়ে পড়েছিলে। তোমার গায়ের রঙও পুড়ে গিয়েছিল—আমরা তো আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। ভাগ্যিস শচীন যুদ্ধফেরত সোজা দেশে চলে এসেছিল—তা না হলে কী যে হত! খবর পাঠাতেই সোজা এসে দেখে গেল তোমাকে। নওগাঁতেই তার বাড়ি।
আমার সবই মনে আছে বাবা। তিনি আমাকে ব্রহ্মচারী ইনজেকসান দিতেন। সপ্তাহে দু—বার।
ঠাকুরের কৃপায়, আর শচীন ডাক্তারের হাতযশে সেবারে তুমি আরোগ্য লাভ করলে। শচীন কিন্তু পাশ করা ডাক্তার না। আর পাশ করা ডাক্তার পাওয়াই যে কঠিন। দশ পনেরো ক্রোশের মধ্যে একজনও নেই। পাঁচদোনার মল্লিক বাড়ির ছেলে অমিয় শুনেছি কলকাতা থেকে এল এম এফ পাশ করে এসেছে। খুবই বড় ডাক্তার। তবে সে গাঁয়ে বসছে না। শহরেই ডিসপেনসারি খুলেছে। শচীনই আমাদের ব্রহ্মা বলো বিষ্ণু বলো, মহেশ্বরও বলতে পারো—একমাত্র পরিত্রাতা। তোমার এত বড় কঠিন অসুখ সেই নিরাময় করে তুলল। সামনে যে গাছপালা দেখা যাচ্ছে, সেখানেই শচীন থাকে। গ্রামটি খুবই বর্ধিষ্ণু। গাঁয়ে একটি পোস্টাফিসও আছে। তবে পাকা বাড়ি নেই। কষ্ট না করলে কেষ্ট পাওয়া যায় না। বারদী গাঁয়ে ঢুকলেই পাকা বাড়ি কেমন হয় বুঝতে পারবে। এই অঞ্চলে একমাত্র বারদী গ্রামেই চৈতন্য নাগের প্রাসাদতুল্য কোঠাবাড়ি আছে—স্টিমারঘাটে যাওয়ার রাস্তায় দেখতে পাবে। আর একটু কষ্ট করে পা চালিয়ে হাঁটো। সড়কে উঠে গেলে আর জলকাদা ভাঙতে হবে না।
অরু অবশ্য বলতে পারত তার মামাবাড়ির দেশে পাকাবাড়ি কেমন হয় সে দেখেছে। তবে সে কিছুই বলল না। দু ক্রোশ রাস্তায় এই সাঁকোটি পার হলেও সড়কে উঠে যাওয়া যাবে। জগদীশ হাতের পুঁটুলি এবং টিনের বাক্সটি নদীর পাড়ে রেখে ঘাটে নেমে গেলেন। অরু তার বাবার পিছু পিছু নামছে। কাঠের গুঁড়ি ফেলে অস্থায়ী ঘাট। গাঁয়ের মানুষজনের ভিড় আছে ঘাটে। জগদীশকে এলাকার লোক সবিশেষ চেনে। ব্রাহ্মণই শুধু নন, তিনি গোস্বামী বংশের সন্তান। তাঁর পিতাঠাকুরকে এলাকার লোক এক ডাকে চেনে। তাঁকে দেখে স্ত্রী—পুরুষ নির্বিশেষে ঘাট থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল।
জগদীশ সবার কুশল নিতে নিতে ঘাটে নেমে যাচ্ছিলেন। পুত্রেরও পরিচয় দিয়ে তারা যে স্টিমার ধরার জন্য রওনা হয়েছেন, রাস্তায় বাবা লোকনাথের আশ্রমে বাল্যভোগ গ্রহণের পর আবার রওনা হবেন, নদীর জলে নামার আগে সেই প্রসঙ্গেই নানা কথা বলছিলেন।
নদীর জল খুবই স্বচ্ছ। জলে স্রোত আছে। নিজে এক গণ্ডূষ জল খেলেন। কারণ রাস্তায় যত্রতত্র আহার এবং জলপান নিষিদ্ধ। তা—ছাড়া পুকুর কিংবা নদীর জলই তৃষ্ণা নিবারণের একমাত্র উপায়। যদিও জগদীশের পিতাঠাকুর তাঁর বাড়িতে একটি ইঁদারা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। যে দুটি গ্রামের উপর দিয়ে এলেন, সেখানে একটিমাত্র সরকারি টিউকল—ইউনিয়ন বোর্ড থেকে করা। তবে কলটির হাতল চুরি যাওয়ায় দীর্ঘকাল অব্যবহারে পড়ে থেকে থেকে বাকিটুকুও অদৃশ্য হবার অপেক্ষায় আছে।
জগদীশ পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন, রাস্তায় আহার এবং জলপানের সমস্যা আছে। পুঁটুলির মধ্যে একটি হলুদ রঙের তরমুজের সাইজ বাঙ্গি আছে। কৌটায় ঝোলা গুড়। স্টিমারে আহারের সুবন্দোবস্ত থাকলেও তাঁর এবং অরুর পক্ষে সেসব স্পর্শ করলে বিধর্মীর কাজ হবে। জাতপাতের বিচার জগদীশের মধ্যে একটু বেশি মাত্রাতেই আছে।
অরণি জগদীশের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার যথেষ্ট জল তেষ্টা, অথচ খাওয়া উচিত অনুচিত প্রশ্নে সে গণ্ডূষ করে জল খেতে পারছিল না।
জগদীশেরও জল তেষ্টা পেয়েছে। তিনি গণ্ডূষ করে জল খাবার আগে বলেছিলেন, নদীর জলে কোনও দোষ থাকে না। পতিত পাবনি গঙ্গারই শাখা—প্রশাখা সব। সবাই সাগরের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। তুমি নির্মল চিত্তে জল পান করতে পারো। নদীর জলে কোনও দোষ থাকে না।
অরু বাবা লোকনাথের আশ্রম থেকে নেমে বলল, চৈতন্যনাগের বাড়ি পার হয়ে গেলেই কি স্টিমারঘাট?
জগদীশ বললেন, না। চৈতন্যনাগ নদীর ধারেই বাড়ি করেছিলেন, কিন্তু কীর্তিনাশা নদীটি বর্ষায় কখন কোন পাড় ভেঙে ধেয়ে চলবে কেউ জানে না। নদীর পাড়ে বাড়ি করে চৈতন্যনাগ এই এক সমস্যায় ভুগছিলেন। বাবা লোকনাথই অভয় দিয়েছিলেন, আমি যদ্দিন আছি, তোর গৃহনাশের ভয় নেই। নদী যতই উত্তাল হোক, তোর বাড়ির দিকে এগিয়ে আসতে সাহস পাবে না।
অরু বাবা লোকনাথের অনেক অলৌকিক কাহিনী শুনেছে। কেমন আশ্চর্য মুগ্ধতা এই সব অলৌকিক বিস্তারের মধ্যে থেকে যায়। বাবা লোকনাথের ব্রহ্মবাক্যে অভিশপ্ত খ্যাপা নদীটি তার উত্তাল তরঙ্গমালা নিয়ে শেষ পর্যন্ত খাত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। নদীটি দেখার ইচ্ছা যেমন প্রবল হতে থাকে তেমনি যে প্রাসাদটি চার পুরুষ ধরে অক্ষত থেকে গেছে, সেটি দেখার বাসনাও তার কম নয়।
লোকনাথের আশ্রম থেকে নেমেই একটি বড় মাঠ পার হতে হয়। আজ হাটবার নয়। হাটবার মানুষের ভিড়ে হাঁটা যায় না। মাঠে গোরু মোষ চরে বেড়াচ্ছে। অঞ্চলে বারদীর হাট বিখ্যাত। নদীর পাড়ে হাটের দিন দু মাল্লা তিন মাল্লা নৌকার ভিড় হয়। যে দিনের যে সবজি, আনারসের নৌকা, তালের নৌকা, হাড়িপাতিলের নৌকা, করলা ঝিঙেও বাদ যায় না—নদীর পাড়ে অজস্র নৌকার ভিড়—দূরদেশ থেকে মানুষজন সওদা করতে আসে নৌকায়—বর্ষাকালে জায়গাটা একটা গঞ্জের মতো হয়ে যায়, পাটের নৌকাও নিয়ে আসে ব্যাপারীরা—তবে অরণি আশ্চর্য হল, লোকনাথের মন্দির সংলগ্ন যে নদীটি আছে, তার বিস্তার তো নেই—ই বরং কিছুটা যেন আবদ্ধ জলার মতো। কচুরিপানায় ঠাসা—হাঁটু জল ভেঙে এ—পাড় ও—পাড় করা যায়। এটা যে মূলনদী থেকে কোনও শাখা বের হয়ে বাবা লোকনাথের চরণ ছুঁয়ে চলে গেছে বুঝতে কষ্ট হয় না। এই জলাদেশটা এতসব নদীনালার ঘোরপ্যাঁচে পড়ে আছে সে তার বাবার কর্মস্থলে না গেলে যেন জানতে পারত না।
অরু এই প্রথম দূরদেশে যাচ্ছে। পাকাবাড়ি কিংবা প্রাসাদ দেখার অভিজ্ঞতা তার নেই বললেই চলে। তবে মামাবাড়ি গেলে চৌধুরীদের পাকাবাড়ি সে দেখেছে। সামনে দিঘি আছে একটা। দিঘির পাড়ে মন্দিরও আছে। মামাবাড়ির দেশটা এজন্য তার কাছে একটি বিশেষ রহস্যময় দেশ। সাদারঙের পাকাবাড়ি, ঘাট বাঁধানো দিঘি, সবুজ ঘাসের মাঠ বাড়ি—সংলগ্ন, সবই তার কাছে অসীম কৌতূহলের বিষয়। মামাবাড়িতে গেলে দিঘির ঘাটলায় বসে থাকলে কেমন সে অন্য গ্রহের মানুষ হয়ে যেত। কেউ এসে তার হাত ধরে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলে সে কেমন মুহ্যমান হয়ে যেত। ঘরের পর ঘর, ছাদে রঙিন কাচের ঝালর, এবং কিছু তৈলচিত্র, সুন্দর প্রতিমার মতো দেখতে মেয়েরা তাকে আদর করে অন্দরে নিয়ে গেলে সবাই হইচই বাধিয়ে দিত। ও মা দ্যাখো এসে কাকে নিয়ে এসেছি! বাসনাদির ছেলেটা না চুপচাপ আমাদের ঘাটলায় একা বসেছিল!
বাড়িটায় ঢুকলেই মনে হত চারপাশে যেন সাজানো গোছানো সবকিছু। শান বাঁধানো মেঝে চক চক করছে। খালি পায়ে হাঁটলে ঠান্ডায় পা কেমন শির শির করত। বারদী গ্রামটায় ঢুকে বুঝল, শুধু পর পর পাকাবাড়ি, তারপর দু—মাথা সমান উঁচু পাঁচিল কতদূর চলে গেছে! পাঁচিলের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্যাঁতলা ধরা দেয়াল, টিন—কাঠের বাড়িঘরও চোখে পড়ল। রাস্তাটা গ্রামের ভেতর দিয়ে গেছে বলে সে সবই দেখতে পাচ্ছে। তার বাবাকে এই এলাকার মানুষজনও যে চেনে, এতে তার কিছুটা অহঙ্কার হচ্ছিল। বাবার সঙ্গে এত লোকের পরিচয় আছে সে জানতই না। বাবাকে সে এমনিতেই সমীহ করে, বাবার সঙ্গে বের হয়ে দূরদেশে যাবার সময় মনে হল বাবা তার একজন মুসাফির। তিনি এই সব গ্রাম মাঠ ভ্রমণ শেষে নদীর শেষ প্রান্তে গিয়ে শেষে তাঁর কর্মস্থলে উঠেছেন।
জগদীশ বলল, শোনা যায় চৈতন্যনাগের পিতাঠাকুর বিখ্যাত ডাকাত সর্দার ছিলেন। মেঘনা নদীতে তার লোকজন, নৌবহর, ছিপনৌকা, সবই মজুত থাকত। পঞ্চাশটা বৈঠায় নৌকা নদীর উপরে উড়ে যেত। এখন আর সেই ছিপ নৌকাও নেই, ডাকাতিও কেউ করে না। চৈতন্যনাগের বংশধরদেরও পাত্তা নেই। তারা শহরে বাড়িঘর বানিয়ে থাকে। এমন অজ পাড়াগাঁতে কার পড়ে থাকতে ইচ্ছে হয় বল!
শহরে সব পাকাবাড়ি না বাবা?
সব কেন হবে। সব কি কখনও পাকাবাড়ি হয়? সবার হাতে এত পয়সা কোথায়। গরিব মানুষজনেরও তো অভাব নেই শহরে।
অরণি জানে বাবাকে বাবুদের মামলা মোকদ্দমার তদারকি করতে প্রায়ই শহরে যেতে হয়। বাবা শহরে রাত্রিবাসও করেন। সেই বাবার সঙ্গে সে হেঁটে যাচ্ছে। সোজা কথা!
শহরের পাকা রাস্তায় আপনি কখনও হেঁটে গেছেন।
হ্যাঁ গেছি, কেন?
আমি একবার আপনার সঙ্গে যাব।
যাবে। বড় হও।
আচ্ছা বাবা মদনগঞ্জে পাকা রাস্তা আছে?
আছে। হরিহরবাবুর প্রাসাদের সামনের কিছুটা রাস্তা পাকা। ঠিক পাকা বলা যায় না, আসলে নদী পাড় না ভাঙে, সেজন্য নদীর ধারের কিছুটা এলাকা বাঁধিয়ে দিয়েছেন বাবুরা। গেলে সবই দেখতে পাবে।
মদনগঞ্জে কি সব পাকাবাড়ি।
গেলেই দেখতে পাবে।
বাবুদের বাড়ির প্রাসাদে পরী ওড়ে নাকি?
জগদীশ হেসে ফেলেছিলেন।
ওড়ে। যে যেমন দেখে অরু।
তারপরই মোক্ষম কথাটা বলে ফেলল অরু।
আমি আবার কবে ফিরব? মাকে ছেড়ে থাকতে আমার খুব কষ্ট হয়।
জগদীশ বললেন, ঐ দেখ নদী। স্টিমারঘাটে লোকজন জড়ো হচ্ছে। মানুষতো এক জায়গায় থাকে না, তাকে স্থানান্তরে যেতেই হয়। তাড়াতাড়ি ভর্তি করে না দিতে পারলে একটা বছর নষ্ট হবে। মাসখানেক বাদেই এনুয়েল পরীক্ষা। ক্ষিতিমোহনবাবু তো বললেন, ভর্তি করে দিন ভুঁইঞামশায়। ছেলের একটা বছর নষ্ট করবেন কেন। পড়াশোনায় ভালো যখন ঠিক পাশ করে যাবে।
পরীক্ষা হয়ে গেলে আমি কিন্তু চলে আসব।
জগদীশ অগত্যা বললেন, ঠিক আছে পরীক্ষা দাও। কাউকে না হয় তোমার সঙ্গে পাঠাব। আমার তো সময় হবে না, দেখি কাকে পাঠাতে পারি।
অরু তখনই দেখতে পেল সেই নদী—মেঘনা। পারাপারহীন হয়ে আছে নদী—ও—পাড় দেখা যায় না। অনন্ত জলরাশি ছাড়া সামনে যেন কিছু নেই। এদিকটায় নদীর চড়া পড়ায় স্টিমারঘাট দূরে সরে গেছে। বাবা লোকনাথের অভ্রান্ত নির্দেশে নদী আর এদিকটায় এগোতে সাহস পায়নি। চড়ার জমিতে চাষ—আবাদও হচ্ছে।
তারা আল ধরে দ্রুত হাঁটছিল।
জমিতে লতার মতো গাছ বাড়ছে।
জগদীশ বললেন, এগুলো সব পটলের জমি। এগুলো সব পটলের লতা।
জগদীশ যেতে যেতে পুত্রকে রাস্তায় দু—পাশের মাঠঘাট চেনাচ্ছিলেন। কিছু যাযাবর পাখিও উড়ে এসেছে—চড়ার যেদিকটায় এখনও জোয়ারের সময় জলে ডুবে যায়, সেখানে চাষ—আবাদ নেই। কিন্তু হাজার হাজার পাখির ওড়াউড়ি আছে।
যাযাবর পাখিরা যে হিমালয় পার হয়ে উষ্ণতার জন্য এ—দেশে চলে আসে, এবং শীতের শেষে আবার সাইবেরিয়ায় উড়ে যায় যেতে যেতে জগদীশ পুত্রকে তাও জানালেন।
অরু তার গ্রাম মাঠ চেনে। তাদের গ্রামে কোনও পাকাবাড়ি নেই। তাদের গাঁয়ে কেন, কাছাকাছি কোনও গাঁয়েই পাকাবাড়ি নেই। সেতো ছোট কাকার সঙ্গে বাজার হাট করতে দু—এক ক্রোশ কখনও হেঁটে গেছে, বর্ষাকালে নৌকায় বাজার হাট করতে যাওয়ারও মজা কম না।
কিন্তু সে কোনও গাঁয়েই পাকাবাড়ি দেখেনি। কেবল দনদির বাজার পার হয়ে লাধুর চরের দিকে যাবার রাস্তায় একটি ছোট্ট মিনা করা শান বাঁধানো মসজিদ দেখেছে। কাচ হতে পারে, অথবা অন্য কিছুও হতে পারে। রোদ উঠলে মসজিদের মিনার এমন সোনালি রঙ ধরে যে তাজ্জব হয়ে যেতে হয়। গাঁয়ের সব বাড়িঘরই হয় টিন কাঠের, না হয় মুলিবাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি। মাটির ভিটে। গরিব মানুষেরা খড়ের ঘরে থাকে—ছোট ছোট কুটিরের মতো লাগে দেখতে।
এই গাছপালার মধ্যে, নদীনালার পাড়ে পাড়ে অবিশ্রান্ত এই নিবাস তৈরি করে বসবাসের মধ্যে মানুষের আশ্চর্য এক মোহ তৈরি হয়ে যায়। অরু হাঁটে।
যেদিকে চোখ যায়, এখন শুধু ধু ধু বালি রাশি। সে চড়া পার হয়ে যায় বাবার সঙ্গে। অদূরেই সেই বিশাল অশ্বত্থ গাছ, তার নিচে স্টিমারঘাটের স্টেশনবাবুর আটচালা বাড়ি। চা সিগারেট বিড়ির দোকান, একদিকে একটা কুঁড়েঘরে একজন সাধুবাবা ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছেন। স্টিমারযাত্রীদের ভিড়। সবই অতি দেহাতি মানুষ। মাথায় বোচকা। কাঁধে ঝোলানো কাস্তে এবং মাথলা। পরনে লুঙ্গি, ফতুয়া গায়। তারা উজানে ধান কাটতে বর্ষায় বের হয়ে গেছে, হেমন্তের শেষাশেষি দেশে ফিরছে। কিছু বাবুমতো মানুষ, তাদের পরিবার যাত্রীনিবাসের, বাঁশের মাচানে বসে আছে। কাঠের পাটাতনের উপর দিয়ে কিছুটা হেঁটে যেতে হবে। চিরপরিচিত পৃথিবী তার, এখানটায় এসে যেন একেবারেই হারিয়ে গেছে।
সে বারবারই মুখ তুলে বাবাকে দেখছে।
জগদীশ বললেন, নারাণগঞ্জ থেকে স্টিমারটা ছাড়ে। উদ্ধবগঞ্জ, বৈদ্যেরবাজার হয়ে বারদীর ঘাটে এসে ভিড়বে। বেলা দেখে সময়ের আন্দাজ করতে হয়। তবে জগদীশ জানে, দশটার মধ্যেই স্টিমার ঘাটে ভিড়বে।
এখানটায় নদী খুব চওড়া, এবং বাঁক আছে বলে, ঠিক বেলতলির মুখে না এলে স্টিমার দেখা যায় না। সবাই উদগ্রীব হয়ে আছে, ঐ বুঝি আসছে, ঐ বুঝি দেখা যায়। জগদীশ বুঝতে পারছেন না—ঠিক কতটা আর দেরি। তার পকেট ঘড়িটা সময় ঠিক দিচ্ছিল না, নারায়ণগঞ্জে সুধাকরের ঘড়ি মেরামতের দোকানে দিয়ে এসেছিল, ফেরত আনা হয়ে ওঠেনি। সেখানে যেতে হলেও যে স্টিমারে যেতে হয়—যেতে আসতে একটা দিন কাবার হয়ে যায়। মামলা মোকদ্দমা উপলক্ষেই যাওয়া এতদূর, তবে যে হেঁটে যাওয়া যায় না তাও নয়, শীত কিংবা গ্রীষ্মে হেঁটেই যেতে হয়। প্রায় পনেরো ক্রোশের মতো রাস্তা হেঁটে শুধু ঘড়ি মেরামতের খবর নেওয়াও কঠিন।
অগত্যা পাশের ভদ্রলোকটিকে বলতেই হল, বাবুমশায়, কটা বাজে?
লোকটি পকেট থেকে ঘড়ি বের না করেই বলল, দশটা বেজে গেছে। মনে হয় লেট আছে।
ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়তে পারে, চড়ায় আটকে যেতে পারে। কতরকমের দুর্দৈবই যে যাত্রাপথের অপেক্ষায় থাকে। জগদীশ অগত্যা অশ্বত্থ গাছের গুঁড়িতে বসে পড়লেন। পাশে অরু দাঁড়িয়ে আছে। সে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। হাওয়ায় নদীতে বড় বড় ঢেউ—পাখিরা উড়ছে, ফিঙে পাখির ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে নদীর উপর দিয়ে। কাক চিলও উড়ছে। ঢেউ—এর মাথায় ভেসে বেড়াচ্ছে বালিহাঁস—বাজপাখিরাও উড়ে উড়ে নদীর জলে শিকারের খোঁজে আছে। পাটাতনটা লম্বা হয়ে চলে গেছে বেশ দূরে—পাটাতনের নিচে বেদেদের নৌকাগুলি বাঁধা। ঢেউএ খুবই দুলছিল।
গাদাবোটও কম নেই। জেলে ডিঙ্গি সব মাছ নদীতে জাল ফেলে বসে আসে। অদূরে নদীর ঘাটে দুটো কেরায়া নৌকা লগি পুঁতে অপেক্ষা করছে। যাত্রী পেলেই বোধ হয় ঘাট থেকে নৌকা ছেড়ে দেবে। আর যতদূর চোখ যায় শুধু জল, আর কাশের জঙ্গল নদীর বুকে জেগে ওঠা চরগুলিতে। আশ্চর্য এক রূপকথার দেশে যেন অরু ঢুকে যাচ্ছে।
তখনই জগদীশ ডাকলেন, অরু আয়। স্টিমার আসছে।
অরু বেলতলির ঘাটের দিকে তাকাল—না কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সে শুনেছে, সাদারঙের স্টিমারটা অনেক দূর থেকেই দেখা যায়। কিন্তু চারপাশে তাকিয়ে স্টিমারের বিন্দুমাত্র চিহ্ন দেখতে পেল না।
সে বলল, কোথায়?
আসছে। চলো এগিয়ে থাকি।
এগিয়ে থাকি বলতে জগদীশ অরুকে কোথায় যেতে বলছেন বুঝতে পারল না।
সে দেখল বাবা তার আর কোনও কথা না বলে পাটাতনের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন।
সে এবার যেন কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলল, কোথায় স্টিমার?
বাবা বললেন, শব্দ শুনতে পাচ্ছ না। গুমগুম আওয়াজ। কান পাতলেই শোনা যায়। তোমার স্টিমার আসছে।