জয় বিষহরি মা
জয় বিষহরি মা গ পদ্মাবতী, জয়, তোমার জয়!
অরণ্যে, পৰ্বতে, দরিদ্রের ভাঙা ঘরে, রাত্রির অন্ধকারে তুমি গৃহস্থকে রক্ষা কর মা। বেদেকুলকে দাও পেটের অন্ন, পরনের কাপড়। সাঁতালীর বিষবেদেদের নাগিনী কন্যের ধর্মকে রক্ষা কর মা। বেদেকুলের ধর্মকে মাথায় করে রাখুক—বেদের মেয়ে অবিশ্বাসিনী, বেদের মেয়ে ছলনাময়ী, বেদের মেয়ে কালামুখী; তাদের অধৰ্ম, তাদের পাপ বেদেকুলকে স্পর্শ করে না ওই নাগিনী কন্যার মহিমায়, ওই কন্যার পুণ্যে।
কন্যার পুণ্য অনেক। মহিমা অনেক।
ভাদু শতমুখ হয়ে উঠেছে। কন্যের অঙ্গ ছুঁয়ে বলেছে—জনুনী, আমার চোখ খুলিছে। তুমার অঙ্গ ছুঁয়্যা–মা-বিষহরির নাম লিয়া বুলছি—আমরার চোখ খুলিছে। হাঁ, অনেক কাল পর এমন মহিমে দেখলম কন্যের। আমার চোখ খুলিছে।
ভাদু দশের মজলিক্ষে বর্ণনা করেছে সেই ঘটনার কথা।
বলেছে, সে স্বচক্ষে দেখেছে কন্যের মধ্যে নাগিনী রূপ। বলেছে—আবছা অন্ধকার ঘর, বাইরে কাতার বেঁধে লোক দাঁড়িয়ে দেখতে এসেছে—সাঁতালীর বিষবেদেরা নাগ-বন্দি করবে। ঘরের মধ্যে তিনজন বেদে আর দরজার মুখে সেই ঠাকুর, মাথায় রুখু কালো লম্বা চুল, মুখে গোঁফ দাড়ি, বড় বড় চোখে চিলের মত দৃষ্টি। সাক্ষাৎ চাঁদ সদাগরের বন্ধু ল্ফির গারুড়ী। রাঢ় দেশের নাগু ঠাকুর। নাগেশ্বর ঠাকুর। সাঁতালীর বেদের বিদ্যার পরখ করতে নিজের পরিচয় লুকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ঠাকুর। তার চোখ কি এড়ানো যায়? গঙ্গারামের কোমরে জড়ানো পদ্মনাগ, ঠিক ধরেছিল সে।
ভাদু বলে—মুই ছিলম বসে, খড়ি পেতে হাত চালায়ে দেখছিলাম। আমার কোমরেও। সাপ—তাও ঠাকুরের দিষ্টি এড়ায়ে যাবে কোথা? মারলে হক-সবুর। সে যেন গর্জে উঠল। অরুণ্যের বাঘ। মনে হল, আজ আর রক্ষা নাই। গেল, মান গেল, ইজ্জত গেল, দুশমনের মুখ। হাসল, কালি পড়ল সাঁতালীর বেদের কালোবরন মুখে, উপরে বুঝি কেঁদ্যা উঠল পিতিপুরুষেরা।
ভাদুর মনে পড়েছিল, সেই সর্বনাশা রাত্রির কথা। যে রাত্রে লোহার বাসরঘরে কালনাগিনী দংশন করেছিল লখিন্দরকে। সেদিন দেবছলনায় কালনাগিনী নিরাপদে বেদেদের ছলনা করে তাদের মাথায় চাপিয়ে দিয়েছিল অপবাদের বোঝা।
ভাদু বলেছে—ঠিক এই সময় বাঘের ডাকের উত্তরে যেন ফোঁস করে গর্জে উঠল। কালনাগিনী পিঙলা। সেদিন জাগরণের দিনে হিজল বিলে মা-বিষহরির ঘাটের উপরে যেমন দেখেছিল বাঘের সামনে উদ্যতফণা পদ্মনাগিনীকে যেমন শুনেছিল তাদের গর্জন ঠিক তেমনি। মনে হল। পরমুহূর্তে পিঙলা খুলে ফেলে দিলে তার কালো তনু অনাবৃত করে রক্তবস্ত্ৰখানা দাঁড়াল পলকহীন চোখে চেয়ে। উত্তেজনায় মৃদু মৃদু দুলছিল নাগিনী কন্যা-ভাদুর মনে হল সাঁতালীর বেদেকুলের কুলগৌরব বিপন্ন দেখে, কন্যা বসনের সঙ্গে নরদেহের খোলসটাও ফেলে দিয়ে স্বরূপে ফণা তুলে দাঁড়িয়েছে। ঠিক নাগলোকের নাগিনী। চোখে তার আগুন দেখেছে সে, নিশ্বাসে তার ঝড়ের শব্দ শুনেছে সে; তার অনাবৃত দেহে নারী রূপ সে দেখে নিদেখেছে নাগিনী রূপ।
জয় বিষহরি!
আগে বিষহরির জয়ধ্বনি দিলে তারপর কন্যার জয়ধ্বনিতে ভরিয়ে দিলে হিজলের কূল, সাঁতালীর আকাশ। কলিকালে দেবতার মাহাত্ম্য যখন ক্ষয় হয়ে আসছে, হিজলের ঘাসবনের আড়াল দিয়েও যখন কুটিল কলির প্রবেশপথ রোধ করা যাচ্ছে না, তখনই একদা এমনইভাবে কন্যার মাহাত্ম্য-মহিমা প্রকাশিত হওয়ার কাহিনী শুনে সাঁতালীর মানুষেরা আশ্বাসে উল্লাসে আশ্বস্ত ও উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল।
ভাদু শপথ করে বলে—সে প্রত্যক্ষ দেখেছে কন্যার নাগিনী রূপ।
পিঙলার নিজেরও মনে হয় তাই। সেই ক্ষণটির স্মৃতি তার অস্পষ্ট। অনেক ভেবে তার মনে পড়ে, চোখের দৃষ্টিতে আগুন ছুটেছিল, বুকের নিশ্বাসে বোধহয় বিষ ঝরেছিল, সে দুলেছিল নাগিনীর মতই; ইচ্ছে হয়েছিল ছোবল দেওয়ার মতই ঝাঁপিয়ে পড়ে আক্রমণ করে না। ঠাকুরকে। তাও সে করত, নাগু ঠাকুর যদি আর এক পা এগিয়ে আসত—তবে সে বিষকাটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত তার উপর। মা-বিষহরিকে স্মরণ করে যখন কাপড়খানা খুলে ফেলে দিয়েছিল, তখন এতগুলো পুরুষকে পুরুষ বলে মনে হয় নাই তার।
সত্যিই সেদিন নাগিনীর রূপ প্রকাশ পেয়েছিল তার মধ্যে। ভাদু ভুল দেখে নাই। ঠিক দেখেছে সে। ঠিক দেখেছে।
একদিন কালনাগিনী সাঁতালী পাহাড়ের বিষবৈদ্যদের মায়ায় আচ্ছন্ন করে বিষহরির মান রাখতে গিয়ে বৈদ্যদের অনিষ্ট করেছিল, তারা তাকে কন্যে বলে বুকে ধরেছিল, নাগিনী। বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, বৈদ্যদের জাতি কুল বাস সব গিয়েছিল। তারপর এতদিন যুগের পর যুগ গিয়েছে নাগিনী বেদেদের ঘরে কন্যে হয়ে জন্ম নিয়েছে, বিষহরির পূজা করেছে, নিজের বিষে নিজে জ্বলেছে; কিন্তু এমন করে ঋণ শোধের সুযোগ পায় নি। এবার পেয়েছে। তার জীবনটা ধন্য হয়ে গিয়েছে। জয় বিষহরি। কন্যের উপর তুমি দয়া কর।
হিজলের ঘাটে সকাল সন্ধ্যা পিঙলা হাত জোড় করে নতজানু হয়ে বসে মাকে প্রণাম করে। মধ্যে মধ্যে তার ভয় হয়। মা-বিষহরি তার মাথায় ভর করেন। চোখ রাঙা হয়ে ওঠে, চুল এলিয়ে পড়ে, ঘন ঘন মাথা নাড়ে সে। বিড়বিড় করে বকে।
ধূপধূনা নিয়ে ছুটে আসে সাঁতালীর বেদে-বেদেনীরা। হাত জোড় করে চিৎকার করে কি হল মা, আদেশ কর।
–আদেশ কর মা, আদেশ কর।
ভাদু মুখের সামনে বসে আদেশ শুনতে চেষ্টা করে।
গঙ্গারাম স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে বসে থাকে। চোখে তার প্রসন্ন বিমুগ্ধ দৃষ্টি। পিঙলার মহিমায়। জটিলচরিত্র গঙ্গারাম যেন বশীভূত হয়েছে। মধ্যে মধ্যে অচেতন হয়ে পড়ে পিঙলা। সেদিন বেদেকুলের শিরবেদে হিসাবে সে-ই তার শিথিল দেহ কোলে তুলে নিয়ে কন্যার ঘরে শুইয়ে দেয়। দেবতাশ্রিত অবস্থায় কন্যাকে স্পর্শ করার অধিকার সে ছাড়া আর কারও নাই। গঙ্গারামই সেবা করে, বেদেরা উদ্গ্রীব উৎকণ্ঠায় দরজায় বসে থাকে।
চেতনা ফিরলেই তারা জয়ধ্বনি দিয়ে ওঠে। গর্তে-খোঁচা-খাওয়া সাপের মতই পিঙলা তাড়াতাড়ি উঠে বসে; অঙ্গের কাপড় সস্তৃত করে নিয়ে তীব্র কণ্ঠে বলে—যা, যা তু বাহিরে যা। গঙ্গারামকে পিঙলা সহ্য করতে পারে না। গঙ্গারামের চোখের দৃষ্টিতে অতি তীক্ষ্ণ কিছু আছে যেন; সহ্য করতে পারে না পিঙলা।
এই সময়েই শিবরাম কবিরাজ দীর্ঘকাল পরে একদিন সাঁতালীতে গিয়েছিলেন। ওদিকে তখন আচার্য ধূর্জটি করিরাজ মহাপ্রয়াণ করেছেন, শিবরাম তখন রাঢ়ের এক বর্ধিষ্ণু গ্রামে আয়ুর্বেদ ভবন খুলে বসেছেন, সঙ্গে একটি টোলও আছে।
কাহিনী বলতে বলতে শিবরাম বলেন প্রারম্ভেই বলি নি, এক বর্ধিষ্ণু গ্রামের জমিদারবাড়িতে ডাকাতির কথা? সেই গ্রামে তখন চিকিৎসা করি। গুরুই আমাকে ওখানে পরিচিত করে দিয়েছিলেন। গুরু যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন সূচিকাভরণ গুরুর আয়ুর্বেদ ভবন থেকেই আনতাম। গুরু চলে গেলেন, আমি প্রথম সূচিকাভরণ প্রস্তুত করব সেবার। মুর্শিদাবাদ জেলা হলেও, রাঢ়ভূমি গঙ্গা খানিকটা দূর; এ অঞ্চলে বিষবেদেরা আসে না, আমার ঠিকানাও জানে না। মেটেল বেদের অঞ্চল এটা। মেটেল বেদেরা খাঁটি কালনাগিনী চেনে না। সৰ্পজাতির মধ্যে ওরা দুর্লভ। তাই নিজেই গেলাম সাঁতালী। স্বচক্ষে দেখলাম পিঙলাকে। দেখলাম সাঁতালীর অবস্থা।
পিঙলাকে দেখলাম শীর্ণ, চোখে তার অস্বাভাবিক দীপ্তি।
সেদিনও ছিল ওদের একটা উৎসব।
ধূপে ধূনায় বলিতে নৈবেদ্যে সমারোহ। বাজনা বাজছিল—বিষম-ঢাকি, তুমড়ী বাঁশি, চিমটে। মুহুর্মুহুঃ জয়ধ্বনি উঠেছিল। সমারোহের সবই যেন এবার বেশি বেশি। সাঁতালীর বেদেরা যেন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে। ভাদু প্রণাম করে বললে—কন্যে জাগিছেন বাবা, আমাদের ললাট বুঝি ইবারে ফিরল। মা-বিষহরি মূর্তি ধর্যা কন্যাকে দেখা দিবেন মোর মনে লিছে।
চুপি চুপি আবার বললে—এতদিন দেখা দিতেন গ। শুধু ওই পাপীটার লেগ্যা-ওই শিরবেদের পাপের তরে দেখা দিছেন নাই। দেখিছেন? দেখেন, হিজল বিল পানে তাকান।
—কি?
—দেখেন ইবারে পদ্মফুলের বহর। মা-পদ্মাবতীর ইশারা ইটা গ!
হিজলের বিল পদ্মলতায় সত্যসত্যই এবার ভরে উঠেছে। সচরাচর অমন পদ্মলতার প্রাচুর্য। দেখা যায় না। বৈশাখের মধ্যকাল, এরই মধ্যে দুটো-চারটে ফুল ফুটেছে, কুঁড়িও উঠেছে কয়েকটা।
—তা বাদে ইদিকে দেখেন। দেখেন ওই বাঘছালটা। পদ্মনাগিনী ইবারে বাঘ বধ করেছে জাগরণের দিনে।
শিবরাম বলেন—সাঁতালী গ্রামের নিস্তেজ অরণ্য-জীবন ওইটুকুকে আশ্রয় করে আবার সতেজ হয়ে উঠেছে। বিলের পদ্মফুলের প্রাচুর্যে, নাগদংশনে বাঘটার জীবনান্ত হওয়ায়, এমনকি হিজলের ঘাসবনের সবুজ রঙের গাঢ়তায়, তাদের অলৌকিকত্বে বিশ্বাসী আদিম আরণ্যক মন স্কৃতি পেয়েছে, সমস্ত কিছুর মধ্যে এক অসম্ভব সংঘটনের প্রকাশ দেখতে তারা উদ্গ্রীব হয়ে রয়েছে।
ভাদুই এখানকার এখন বড় সর্পবিদ্যাবিশারদ। তারই উৎসাহ সবচেয়ে বেশি। গভীর বিশ্বাসে, অসম্ভব প্রত্যাশায় লোকটার সত্যই পরিবর্তন হয়েছে। সে এখন অতি প্রাচীনকালের অতি সরল অতি ভয়ঙ্কর বর্বর সাঁতালীর বেদের জীবন ফিরে পেয়েছে।
নাকে নস্য দিয়ে শিবরাম বলেন-আচার্য ধূর্জটি কবিরাজ শুধু আয়ুর্বেদ শাস্ত্রেই পারঙ্গম ছিলেন না। সৃষ্টিতত্ত্ব, জীবন-রহস্য, সব ছিল তার নখদর্পণে। লোকে যে বলত-ধূর্জটি ধূর্জটি-সাক্ষাৎসে তারা শুধু শুধু বলত না। কষ্টিপাথর যাচাই না করে হরিদ্রাবর্ণের ধাতুমাত্রকেই স্বর্ণ বলে মানুষ কখনও গ্রহণ করে না। মানুষের মন বড় সন্ধিগ্ধ বাবা। তা ছাড়া, মানুষ হয়ে আর একজন মানুষকে দেবতাখ্যা দিয়ে তার পায়ে নতি জানাতে অন্তর তীর দগ্ধ হয়ে যায়। তিনি আমার আচার্যদের ধূর্জটি-সাক্ষাৎ ধূর্জটি কবিরাজ আমাকে বলেছিলেন–শিবরাম, বেদেদের সম্পর্কে তোমাদের সাবধান করি কেন জান? আর আমার মমতাই বা অত গাঢ় কেন জান? ওরা হল ভূতকালের মানুষ। পৃথিবীতে সৃষ্টিকাল থেকে কত মন্বন্তর হল, এক-একটা আপৎকাল এল, পৃথিবীতে ধর্ম বিপন্ন হল, মাৎস্যন্যায়ে ভরে গেল, আপদ্ধর্মে বিপ্লব হয়ে গেল, এক মনুর কাল গেল, নতুন মনু এলেন—নতুন বিধান নতুন ধর্মবর্তিকা হাতে নিয়ে। জ্ঞানে বিজ্ঞানে, আচারে-ব্যবহারে, রীতিতে-নীতিতে, পানে-ভোজনে, বাক্যে-ভঙ্গিতে, পরিচ্ছদে–প্রসাধনে কত পরিবর্তন হয়ে গেল। কিন্তু যারা নাকি আরণ্যক, তারা প্রতিবারই প্রতিটি বিপ্লবের সময়েই গভীরতর অরণ্যের মধ্যে গিয়ে তাদের আরণ্যক প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখলে। সেই কারণেই এরা সেই ভূতকালের মানুষই থেকে গিয়েছে। মনু বলেন, শাস্ত্ৰ পুরাণ বলে, এদের জন্মগত অর্থাৎ ধাতু এবং রক্তের প্রকৃতিই স্বতন্ত্র এবং সেইটেই এর কারণ। এই ধাতু এবং রক্তে গঠিত দেহের মধ্যে যে আত্মা বাস করেন, তিনি মানবাত্ম হলেও ওই পতিত দূষিত আবাসে বাস করার জন্যেই তিনিও পতিত এবং বিকৃত হয়ে এই ধর্মে আত্মপ্রকাশ করেন। এই বিকৃতিই ওদের স্বধর্ম। আবার এর মধ্যে পরমাশ্চর্য কি জান? শাস্ত্ৰে পুরাণে এই ধর্ম পালন করেই ওরা চরম মুক্তি লাভ করেছে, এর নজিরও আছে। মহাভারতে পাবে ধর্মব্যাধ নিজের আচরণবলে পরমতত্ত্বকে জ্ঞাত হয়েছিলেন। এক জিজ্ঞাসু ব্ৰাহ্মণকুমার তাঁর কাছে সেই তত্ত্ব জানতে গিয়ে তাকে দেখে বিস্মিত হয়েছিল। সেই আরণ্যক মানুষের বর্বর জীবন, অন্ধকার ঘর, চারিদিকে মৃত পশু, মাংস-মেদ-মজ্জার গন্ধ, শুষ্ক চর্মের আসন-শয্যা, কৃষ্ণবর্ণ রূঢ় মুখমণ্ডল, রক্তবর্ণ গোলাকৃতি চোখ, মুখে মদ্যগন্ধ দেখে তার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, এ কেমন করে চরম মুক্তি পেতে পারে? ব্যাধ বুঝেছিলেন ব্রাহ্মণকুমারের মনোভাব। তিনি তাকে সম্ভাষণ আবাহন করে বসিয়ে বলেছিলেন—এই আমার স্বধর্ম। এই স্বধর্ম পালনের মধ্যেই আমি সত্যকে মস্তকে ধারণ করে পরম তত্ত্ব অবগত হয়েছি। আমি যদি স্বধর্মকে পরিত্যাগ করতাম, তবে তোমাদের পরিচ্ছন্নতা সদাচরণ অনুকরণ করে তাকে আয়ত্ত করতে গিয়ে সদাচরণের পরিচ্ছন্নতার শান্তিতে সুখেই আমি তৃপ্ত হয়ে তত্ত্ব আয়ত্তের সাধনায় ক্ষান্ত হতাম। এই আচরণের মধ্যেই আমাদের জীবনের স্ফূর্তি। এর মধ্যেই আমাদের মুক্তি।
আচার্য চিন্তাকুল নেত্রে আকাশের দিকে চেয়ে থাকতেন কিছুক্ষণ। যেন ওই অনন্ত আকাশপটের নীলাভ অনুরঞ্জনের মধ্যে তাঁর চিন্তার অভিধান অদৃশ্য অক্ষরে লিখিত রয়েছে। তিনি তাই পাঠ করছেন। পাঠ করতে করতেই বলতেন—এদের মধ্যে ভাল মানুষ অনেক আছে, কিন্তু শূচিতা ওদের ধর্ম নয়। ওতে ওদের দেহ-আত্মা পীড়িত হয় না। আমাদের হয়। তাই সাবধান করি।
আবার কিছুক্ষণ চুপ করে ওই অভিধান পাঠ করে নিজের অস্পষ্ট চিন্তার অন্বয় করে অর্থ জ্ঞাত হয়ে বলতেন—তবে আমার উপলব্ধির কথা আমি বলি শোন। ধর্মব্যাধের কথা মিথ্যে নয়। এই বিশ্ব-রহস্যের মধ্যে ওই আচার-আচরণই বল আর আমাদের এই আচরণই বল—দুয়ের মধ্যে আসল জীবন-মূল্যের পার্থক্য সত্যই নাই। জীবনের পক্ষে আচার-আচরণের প্রাথমিক মূল্য আয়ু এবং স্বাস্থ্য এই দুয়ের পরিমাণ নির্ণয়ে। তার পরের মূল্য বুদ্ধি এবং জ্ঞান বিকাশের আনুকূল্যে। প্রথম মূল্য ওরা পর্যাপ্ত পরিমাণে পেয়েছে ওই ধর্মে। দ্বিতীয়টা পায় নি। কিন্তু শাস্ত্র যে বলে ওদের ওই পতিত এবং দূষিত ধাতু ও শোণিতে গঠিত দেহবাসী আত্মার পক্ষে এই আর্য-আচরণ অনধিগম্য, এটাতে ওদের অধিকারও নাই, এবং অনধিকার চর্চায় ওদের অনিষ্ট হবে, এইটি আমার জীবনবোধিতে আমি যতদূর বুঝেছি শিবরাম, তাতে এ ধারণা ভ্রান্ত, অসত্য। আমি আজীবন চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে আলোচনা করলাম, বহু আচারের বহু ধর্মের মানুষের চিকিৎসা করলাম, বহু পরীক্ষায় বহু বিচার করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, ধাতু বা শোণিত যদি রোগদূষিত না হয়, তবে এক জীবনধর্ম থেকে আর এক জীবনধর্মে আসতে কোনো বাধা বিশেষ নাই। যেটুকু বাধা, সে নগণ্য। অতি নগণ্য।
হেসে বলতেন—আমাদের বরং ওদের ধর্মে যেতে গেলে বাধা বেশি। খানিকটা মারাত্মকও বটে। ময়লা চীরখও কোমরে পরতে লজ্জার বাধা যদিবা জয় করা যায়, তবে চর্মরোগের আক্রমণ হবে অসহনীয়। তারপর খাদ্যের দিক; স্বাদের কথা বাদ দিয়ে উদরাময়ের ভয় আছে। সেটা অসহনীয় থেকেও গুরুতর মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। শীতাতপের প্রভাব আছে। সেও সহনীয় করে তোলা আমাদের পক্ষে সহজ নয়। কিন্তু ওরা জামাকাপড় পরে গ্রীষ্মকালে কথঞ্চিৎ কাতরতা করলেও শীতে বেশ আরামই অনুভব করবে। আসল কথা ওরা আমাদের জীবনে আসে নি, আসতে চায় নি—সে যে কারণেই হোক। হয়ত আমাদের জটিল জীবনাচরণের প্রতি ওদের ভীতি আছে–সংস্কারের ভীতি, জটিলতার ভীতি, আমরা যে আচরণ করি তার ভীতি। আমরা কেউ আহ্বান করি নি, আমরা দূরে থেকেছি, রেখেছি ঘৃণা করে। ওদের নাড়ি ওদের দেহলক্ষণ বিচার করে আমাদের সঙ্গে কোনো পার্থক্য তো পাই নি। ধাতু এবং শোণিত যদি বিশ্লেষণ করে পরীক্ষার উপায় জানতাম, তবে সঠিক তথ্যটা বুঝতে পারতাম।
বলে আবার চেয়ে থাকতেন আকাশের দিকে।
ভাদুকে দেখে গুরুর কথাই সেদিন মনে পড়েছিল।
ভূতকালের মানুষ, ভূতকালের মানসিক পরিবেশের পুনরুজ্জীবনে নতুন বল পেয়েছে, অভিনব স্কৃর্তি পেয়েছে কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি যেন অমাবস্যার নাগাল পেয়েছে। গোটা গ্রামখানির মানুষের জীবনে এ স্ফূৰ্তি এসেছে। বেশভূষায় আচারে-অনুষ্ঠানে তার পরিচয় সাঁতালীতে প্রবেশ করা মাত্রই শিবরামের চোখে পড়ল।
ভাদুর চকচকে কালো বিশাল দেহখানি ধূসর হয়ে উঠেছে। একালে ওরা তেল ব্যবহার করত, ভাদু তেলমাখা ছেড়েছে। রুক্ষ কালো কাঁকড়া চুলের জটা বেঁধেছে, তার উপর বেঁধেছে এক টুকরো ছেড়া গামছা। আগে নাকি এই গামছা বাধার প্রচলন ছিল। গলায় হাতে মালাতাবিজ-তাগার পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ করে তুলেছে। গায়ের গন্ধ উগ্রতর হয়ে উঠেছে। মদ্যপান বেড়েছে। গোটা সাঁতালীর বেদেরা গিরিমাটিতে কাপড় ছুপিয়ে গেরুয়া পরতে শুরু করেছে।
পিঙলা যেন তপঃশীর্ণা শর্বরী। শীর্ণ দেহ, এলায়িত কালো তৈলহীন বিশৃঙ্খল একরাশি চুল ফুলে ফেঁপে তার বিশীর্ণ মুখখানা ঘিরে ফেলেছে, চোখে অস্বাভাবিক দ্যুতি, সর্ব অবয়ব ঘিরে একটা যেন উদাসীনতা।
ভাদু তাকে দেখিয়ে বললে—দেখেন কেনে কন্যের রূপ! সেই পিঙলা কি হইছে দেখেন।
চুপিচুপি বললে।
শিবরাম স্থিরদৃষ্টিতে পিঙলার দিকে চেয়ে রইলেন। ধূর্জটি কবিরাজের শিষ্য তিনি, তার বুঝতে বিলম্ব হল না যে, পিঙলার এ লক্ষণগুলি কোনো দৈব প্রভাব বা দেবভাবের লক্ষণ নয়। এগুলি নিশ্চিতরূপে ব্যাধির লক্ষণ। মূৰ্ছারোগের লক্ষণ। ব্যাধি আক্রমণ করেছে মেয়েটিকে।
পিঙলা তাঁকে দেখে ঈষৎ প্রসন্ন হয়ে উঠল। সে যেন জীবন-চাঞ্চল্যে সচেতন হয়ে উঠল। হেসে বললে—আসেন গ ধন্বন্তরি ঠাকুর, বসেন। দে গ, বসতে দে।
একটা কাঠের চৌকি পেতে দিলে একজন বেদে। শিবরাম বসলেন।
পিঙলা বললে—শবলা দিদির কচি-ধন্বন্তরি তুমি-তুমি আমার ধন্বন্তরি ঠাকুর। কালনাগিনীর তরে আসছেন।
–হ্যাঁ। না এসে উপায় কি? গুরু দেহ রেখেছেন।–
–আঃ, হায় হায় হায়! আমাদের বাপের বাড়া ছিল গ! আঃ—আঃ–আঃ!
স্তব্ধ হয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করা যায় না এর উত্তরে। শিবরামের চোখে জল এল, মন উদাস হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর আত্মসংবরণ করে শিবরাম বললেন—এতদিন সূচিকাভরণ গুরুর কাছ থেকে নিয়ে যেতাম, এবার নিজেই তৈরি করব। সেইজন্য এসেছি। কালনাগিনীর খাঁটি জাত তোমরা, তোমরা ছাড়া কারুর কাছে পাব না বলেই আমি এসেছি।
পিঙলা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে—আর হয়ত পাবেই না ধন্বন্তরি ঠাকুর। আসল হয়ত আর মিলবেই না।
—মিলবে না? কেন? বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন শিবরাম।
–বিষহরির ইশারা এসেছে। আদেশ এখুনও আসে নাই, তবে আসবেক, দেরি নাই। তার কালনাগিনীকে নাগলোকে ফিরতে হবেক। বুঝিছ? তার অভিশাপের মোচন হবেক।
কথাটা ঠিক বুঝলেন না শিবরাম। মুখের দিকে চেয়ে রইলেন, সবিস্ময় সপ্রশ্ন দৃষ্টিতেই পিঙলার মুখের দিকে তাকালেন।
প্রশ্ন বুঝতে পারলে পিঙলা; তার প্রখরদৃষ্টি চোখ দুটি প্রখরতর হয়ে উঠল, যেন জ্বলন্ত অঙ্গারগর্ভ চুল্লিতে বাতাস লাগল; সে বললে তুমি শুন নাই? মুই ঋণ শোধ করেছি। ইবারে বিষহরির হুকুম আসিবে। বিষহরিমনে লাগিছে—বিধেতা-পুরুষের দরবারে হিসাব খতায়ে দেখিয়েছেন, তাঁকে বলিছেন—দেনা তো শোধ করিছে কন্যে, ইবারে মুই কন্যেরে ফিরা আসিতে হুকুম দিতে পারি কিনা কও? বিধেতার মত না নিয়া তো তিনি হুকুম দিবেন না।
শিবরাম বললেনদেখি, তোর হাতটা দেখি, দে।
–হাত? কি দেখিবে?
–আমি হাত দেখে গুনে বলতে পারি যে!
–পার? দেখ, তবে দেখ।
প্রসারিত করে ধরলে তার করতল। হাতের রেখা পরীক্ষা করে দেখবার ছল করে তিনি তার মণিবন্ধ নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে তার নাড়ি পরীক্ষা করতে শুরু করলেন। গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে তিনি স্পন্দনের গতি এবং প্রকৃতি নির্ণয় করতে চেষ্টা করলেন।
—কি দেখিছ গ ধন্বন্তরি ঠাকুর? ইবারে মুক্তি মিলিবে?
উত্তর দিলেন না। সে অবকাশই ছিল না তার। নাড়ির গতিপ্রকৃতি এবং অবস্থা বিচিত্র। উপবাসে দুর্বল, কিন্তু বায়ুর প্রকোপে চলছে যেন বলগাছেড়া উদ্দামগতি উদ্ভ্রান্ত ঘোড়ার মত, মধ্যে মধ্যে যেন টলছে। মুখের দিকে চাইলেন। চোখের প্রখর শুভ্রচ্ছদ আচ্ছন্ন করে অতি সূক্ষ্ম শিরাজালগুলি রক্তাভ হয়ে ফুটে উঠেছে। মূৰ্ছা রোগের অধিষ্ঠান তিনি অনুভব করতে পারলেন নাড়ির মধ্যে।
হতভাগিনী পিঙলা! একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন তিনি।
–ধন্বন্তরি! কি দেখিলে কও? ব্যর্থ হয়ে সে তাকিয়ে রইল শিবরামের মুখের দিকে।–এমন কর্যা তুমি নিশ্বাস ফেললা কেনে গ?
শিবরাম ভাবছিলেন-হতভাগিনী উন্মাদ পাগল হয়ে উঠবে একদিন, ওদিকে নতুন নাগিনী কন্যার আবির্ভাব হবে, দেবতা-অপবাদে স্বজন-পরিত্যক্ত উন্মাদিনীর দুর্দশার কি আর অন্ত থাকবে? অথচ সহজে তো মৃত্যু হবে না। এই তো ওর বয়স! কত হবে? বড় জোর পঁচিশ! জীবন যে অনেক দীর্ঘ। বিশেষত ওদের এই আরণ্যক মানুষের জীবন!
আবার পিঙলা প্রশ্ন করলে–মুক্তি হবে না? লিখনে নাই?
শিবরাম বললেন–দেরি আছে পিঙলা।
–দেরি আছে?
হ্যাঁ। একটু ভেবে নিয়ে বললেন মা তো তোকে নিয়ে যেতে চান, কিন্তু নিয়ে যাবেন কি করে? তোর দেহে যে বায়ুর প্রকোপ হয়েছে। দেবলোকে কি রোগ নিয়ে কেউ যেতে পারে?
স্থিরদৃষ্টিতে কবিরাজের মুখের দিকে সে চেয়ে বসে রইল। মনে মনে খতিয়ে দেখছে সে কথাগুলি। কয়েক মুহূর্ত পরে তার দুই চোখ বেয়ে নেমে এল অনর্গল অঞর ধারা। তারপর মা। বলে একটা করুণ ডাক ছেড়ে ঢলে পড়ে গেল মাটির উপর। একটা নিদারুণ যন্ত্রণায় সর্বাঙ্গে আক্ষেপ বয়ে যেতে লাগল। পৃথিবীর মাটি যেন তার হারিয়ে যাচ্ছে, দু হাতে খামচে মাটির বুক সে অ্যাঁকড়ে ধরতে চাইছে; মুখ ঘষছে নিদারুণ আতঙ্কে, যেন মাটির বুকে মা ধরিত্রীর বুকে মুখ লুকাতে চাইছে।
ওদিকে বেদেরা কোলাহল করে উঠল।
–ধূপ আন্ ধুনা আন, বিষম-ঢাকি বাজা।
শিবরাম বললেন—থাম্, তোরা থাম্। কন্যার রোগ হয়েছে।
মুহূর্তে ভাদু উগ্র হয়ে উঠল।—কি কইলা? যা জান না কবিরাজ, তা নিয়া কথা বলিয়ো না। খবরদার! মায়ের ভর হইছে। যাও তুমি যাও। কন্যেরে ছুঁয়ো না এখুন। যাও।
গঙ্গারাম নীরবে বসে সব দেখলে। কবিরাজর দৃষ্টির সঙ্গে তার দৃষ্টি মিলতেই সে একটু হাসলে। আশ্চর্য হয়ে গেলেন শিবরাম, গঙ্গারাম সমস্ত বেদেদের মধ্যে স্বতন্ত্র পৃথক হয়ে রয়েছে। এ সবের কোনো প্রভাব তাকে স্পর্শ করে নাই।
শিবরাম উঠে এলেন।
শিবরাম দাঁড়িয়ে ছিলেন হিজলবিলের ঘাটে।
ভাদু তাকে ভরসা দিয়েছে। বলেছে—কন্যে বলিছে বটে, কালনাগিনীরা চলি গেল নাগলোকে মায়ের ঘরে স্বস্থানে; সিটা বেশি বলিছে। আর দেনা শোধ হল—জনুনীর আদেশ আসিবে বলিছে আমরাও ধেয়াইছি কি , তবে আমাদের সেই জাত ফির্যা দাও, মান্যি ফির্যা দাও, সাঁতালী পাহাড়ের বাস ফির্যা দাও। বিধের হিসেব সূক্ষ্ম হিসেব কবিরাজ, বিঁধে কি করা বিষহরিকে বলিবে কি-হাঁ, ঋণটা শোধ-বোধ হইছে! তবে হ্যাঁ, বিষহরি দরবার জানাইছেন বিধেতার কাছে ইহা হতি পারে।
শিবরাম চুপ করে শোনেন, কি উত্তর দিবে এ সব কথার?
অরণ্যের মানুষ অরণ্যের ভাষা বুঝতে পারে, তাদের বিশ্বাস, তাদের সংস্কার সম্পর্কে ধূর্জটি কবিরাজের শিষ্যের অবিশ্বাস নাই। কিন্তু ভ্রম সংসারে আছে। পিঙলার অবস্থা সম্পর্কে ওদের যে ভ্রম হয়েছে এতে তার একবিন্দু সন্দেহ নাই। অরণ্যের মানুষ পত্রপল্লবের মর্মরধ্বনি শুনে, তাদের শিহরন দেখে মেঘ-ঝড়ের সম্ভাবনা বুঝতে পারে, আবার পত্রপল্লবের অন্তরাল। থেকে মানুষ কথা বললে দৈববাণী বলে ভ্রমও করে সহজেই।
অন্তরে অন্তরে বেদনা অনুভব করছেন শিবরাম। শবলার সঙ্গে অন্তরঙ্গতার সূত্রে তার পরবর্তিনী পিঙলাও তার স্নেহভাগিনী হয়ে উঠেছে। শবলার একটা কথা তার মনে অক্ষয় হয়ে আছে। তাঁর সঙ্গে ভাই-বোন সম্পর্ক পাবার সময় সে মনসার উপাখ্যানের বেনেবেটির কথা বলে বলেছিল—নরে নাগে বাস হয় না, নর নাগের বন্ধু নয়, নাগ নরের বন্ধু নয়। কিন্তু বেনেবেটি ভাই বলে ভালবেসেছিল দুটি নাগশিশুকে। তারাও তাকে দিদি বলে চিরদিন তার সকল সুখের সকল দুঃখের ভাগ নিয়েছিল। হেসে শবলা বলেছিল—একালে তুমি ভাই, মুই বহিন; তুমি কচিধন্বন্তরি, মুই বেদেকুলের সর্বনাশী নাগিনী কন্যে; কালনাগিনী কন্যের রূপ ধরে রইছি গ, লইলে দেখতে আমার ফণার দোলন, শুনতে আমার গর্জন!! বলে তার দিকে কটাক্ষ হেনে হেসেছিল। একটু হাসলেন শিবরাম। বিচিত্র জাত! অরণ্যের রীতি আর নগরের রীতি তো এক নয়!
ভাই-বোন, বাপ-বেটিযে-কোনো সম্পর্ক হোক, নর আর নারী সম্পর্কের সেই আদি ব্যাখ্যাটাই অসংকোচ প্রকাশে সহজ ছন্দে এখানে নিজেদের সমাজ-শৃঙ্খলাকে মেনেও আত্মপ্রকাশ করে। হাস্য-পরিহাসে সরস কৌতুকে পাতানো ভাইয়ের প্রতি কটাক্ষ হেনেছিল শবলা—তাতে আর আশ্চর্য কি?
শবলা মহাদেবকে হত্যা করে গঙ্গার জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে—সে আজ আট-দশ বছর হয়ে গেল। শবলার পর পিঙলা নাগিনী কন্যা হয়েছে। শবলা পিঙলাকে তার জীবনের সকল কথাই বলে গিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে তার ধন্বন্তরি ভাইয়ের কথাও বলে গিয়েছে। বলে গিয়েছে—আমার ভাই তো নয়, সে হইল নাগিনী কন্যের ভাই। তু তার চরণের ধুলা লিস, তারে ভাই বলিস।
পিঙলাও তাই বলে। শিবরামও তাকে স্নেহ করেন। ঠিক সেই কারণেই এই তেজস্বিনী আবেগময়ী মেয়েটিকে এমন বেদনাদায়ক পীড়ায় পীড়িত দেখে অন্তরে অন্তরে বিষণ্ণতা অনুভব না করে পারলেন না তিনি। ভাদু তাকে আশ্বাস দিয়েছে, আসল কৃষ্ণসপী ধরে দেবেই। অন্যথায় তিনি চলে যেতেন। হাঙরমুখীর খালে নৌকা বেঁধে তিনি ভাদুরই প্রতীক্ষা করে রয়েছেন।
জৈষ্ঠ্যের প্রথম। অপরাবেলা। হিজলবিলের কালো জল ধীরে ধীরে যেন একটা রহস্যে ঘনায়িত হয়ে উঠছে। কালো জল ক্রমশ ঘন কৃষ্ণ হয়ে আসছে। পশ্চিম দিগন্তে সূর্য একখানা কালো মেঘে ঢাকা পড়েছে। পশ্চিম দিক থেকে ছায়া ছুটে চলেছে পূর্ব দিকে হিজলবিল ঢেকে, ঘাসবনের কোমল সবুজে গাঢ়তা মাখিয়ে দিয়ে, গঙ্গার বালুচরের বালুরাশির জ্বালা জুড়িয়ে, গঙ্গার শান্ত জলধারায় অবগাহন করে, ওপারের শস্যক্ষেত্র এবং গ্রামবনশোভার মাথা পার হয়ে চলে। যাচ্ছে। শিবরামের কল্পনানেত্রের দৃষ্টিতে সে ছায়া বিস্তীৰ্ণ প্রসারিত হয়ে চলেছে—বহু দূর দূরান্তরে। দেশ থেকে দেশান্তরে।
ছায়া নেমেছে, কিন্তু শীতলতা আসে নাই এখনও রৌদ্রের জ্বালাটা মুছে গিয়েছে, কিন্তু উত্তাপ গাঢ় হয়ে উঠেছে। মাটির নিচে গরম এইবার অসহ্য হয়ে উঠবে। এইবার হিজলের সজল তটভূমি হয়ে উঠবে সৰ্পসঙ্কুল। সাপেরা বেরিয়ে পড়বে। দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন হিজলের জলজ পুষ্পশোভার দিকে। চারিপাশে সবুজের ঘের, মাঝখানে কালো জল, কলমি-সুষনেপানাড়ি-শালুক-পদ্মদামের সবুজ সমারোহ নবীনতার কোমল লাবণ্যে মরকতের মত। নয়নাভিরাম। তারই মাঝখানে হিজলের জল যেন সুমসৃণ চিকুণ একখানি নীলা। এই শোভাতেই তিনি তন্ময় হয়ে ছিলেন। হঠাৎ তিনি কীটদংশনে বিচলিত হয়ে দৃষ্টি ফেরালেন। দেখলেন, তাঁর পায়ের কাছেই লাল পিঁপড়ার সারি চলেছে, একটু দূরে একটা গর্ত থেকে তারা পিলপিল করে বেরিয়ে পড়ছে।
হেসে একটু সরে দাঁড়ালেন তিনি। এদেরও বিষ আছে। মানুষের বিষ বোধহয় দেহকোষ থেকে নির্বাসিত হয়ে মনকোষে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। সাপের চেয়েও মানুষ কুটিল।
–ধন্বন্তরি ভাই!
চমকে ফিরে তাকালেন শিবরাম। কাঁধে গামছা নিয়ে ঘাটের মাথায় এসে দাঁড়িয়েছে পিঙলা। একটি অতিক্রান্ত স্নিগ্ধ হাস্যরেখায় তার বিশীর্ণ মুখখানি ঈষৎ প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে। কোমল স্নিগ্ধকণ্ঠে সে বললে—জনুনীর দরবারের শোভা দেখিছ? এমনভাবে সে কথাগুলি বললে যে, শিবরাম যেন তার কোনো স্নেহাস্পদ বয়োকনিষ্ঠ; তিনি লুব্ধ হয়েছেন এই মনোহারী সজ্জায়; আর এই সমস্ত কিছুর সে অধিকারিণী; বয়োজ্যেষ্ঠা, তার মুগ্ধতা এবং লুব্ধতা দেখে প্রশ্ন করছে–দেখছ এই অপরূপ শোভা? ভাল লেগেছে তোমার? কি নেবে বল তো?
শিবরাম বললে–হ্যাঁ। এবার হিজল সেজেছে বড় ভাল। তুমি স্নান করবে?
–হ্যাঁ। স্নান করব। আপন বিষে মুই জ্বল্যা মলাম ধন্বন্তরি ভাই। অঙ্গে যত জ্বালা মাথায় মনে তত জ্বালা। জান, শবলা কইছিল–নাগিনী কন্যা মিছা কথা, কন্যে আবার নাগিনী হয়। কই, বোঝলম না তো কিছু! কিন্তুক–
একটু চুপ করে থেকে সে মৃদু ঘাড় নাড়লে। কিছু অস্বীকার করলে। অস্বীকার করলে শবলার কথা। মৃদুস্বরে বললে—মুই বোঝলম যে! পরানে-পরানে বোঝলম। চোখ মুদলি দেখি মুই, মোর আত্মারাম এই ফণা বিছায়ে দুলছে—দুলছে—দুলছে। সকলক করিছে জিভ, ধকধক করিছে চোখ দুটো, আর গর্জাইছে।
শিবরাম চিকিৎসকের গাম্ভীর্যে গম্ভীর হয়ে ধীরকণ্ঠে বললেন—তোমার অসুখ করেছে পিঙলা। তুমি নিজের দেহের একটু শুশ্ৰুষা কর। ওষুধ খাও। স্নান কর দু বেলা—ভালই কর, কিন্তু এমন রুখু স্নান না করে মাথায় একটু তেল দিয়ে। বললে না মাথায় জ্বালা, দেহে জ্বালা! তেল ব্যবহার করলে ওগুলো যাবে। তুমি সুস্থ হবে।
স্থিরদৃষ্টিতে পিঙলা শিবরামের মুখের দিকে চেয়ে রইল। প্রখর হয়ে উঠছে তার দৃষ্টি। একটু শঙ্কিত হলেন শিবরাম। এইবার উদ্মাদিনী হয়ত চিৎকার করে উঠবে। কিন্তু সে-সব কিছু করলে না পিঙলা, হঠাৎ আকাশের দিকে মুখ তুলে ঘন মেঘের দিকে চেয়ে রইল। কিছু যেন ভাবতে লাগল।
কালো মেঘ পুঞ্জিত হয়ে ফুলছে। তারই ছায়া পড়ল পিঙলার কালো মুখে। অতি মৃদু সঞ্চরণে বাতাস উঠছে। বিলের ধারের জলজ ঘাসবনের বাঁকা নমনীয় ডগাগুলি কাঁপছে; সাঁতালীর চরের একটু উঁচু কচি ঘাসবনে মৃদু সাড়া জেগেছে; ঝাউগাছের শাখায় কাণ্ডে গান জাগছে; হিজলের কালো জলে কম্পন ধরেছে; পিঙলার তৈলহীন রুক্ষ ফাঁপা চুল দুলছে–উড়ছে। পিঙলা একদৃষ্টে মেঘের দিকে চেয়ে ভাবছে, খতিয়ে দেখছে ধন্বন্তরিভাইয়ের কথা। অন্য কেউ এ কথা বললে সে অপমান বোধ করত, তীব্র প্রতিবাদ করে নাগিনীর মতই ফুঁসে উঠত। কিন্তু ধন্বন্তরি-ই তো সাধারণ মানুষ নয়, সে যে হাতের নাড়ি ধরে রোগের সন্ধান করতে পারে, দেহের মধ্যে কোথায় কোন্ রোগের নাম কি নাগিনী এসে বাসা বাঁধল, নাড়ি ধরে তিনি বেদেদের হাত চালিয়ে ঘরের সাপ-সন্ধানের মতই সন্ধান করতে পারেন। কিন্তু সে ঘাড় নাড়লে। তা তো নয়।
শিবরামের ইচ্ছা হল তিনি বলেন—তুই শেষ পর্যন্ত উন্মাদ পাগল হয়ে যাবি পিঙলা। ওরে, তার চেয়ে শোচনীয় পরিণাম মানুষের আর হয় না। তাদের বিশ্বাস মিথ্যে আমি বলছি নে। তবে দেবতাই হোক, আর যক্ষ-রক্ষ-নাগ-কিন্নরই হোক, মানুষ হয়ে জন্মালে মানুষ ছাড়া আর কিছু নয়। নাগিনী যদি হোস তুই তবুও তুই মানুষ। মানুষের দেহ তোর, তোর সঁতে বিষ নাই, থাকে তো বুকে আছে। ওসব তুই ভুলে যা। ওই ভাবনাতেই তুই পাগল হয়ে যাবি।
কিন্তু বলতে ভরসা পেলেন না।
পিঙলা তখনও ঘাড় নাড়ছিল; ঘাড় নেড়েই বললে—না ধন্বন্তরিভাই, তা নয়। তুমার ভুল হইছে গ। আমার ভিতরের নাগিনীটা জাগিছে। বিষ ঢালছে—আর সেই বিষ আবার গিলছে। তুমাকে তবে বলি শুন। ই কথা কারুকে বলি নাই। গুহ্য কথা। নারীমানুষের লাজের কথা। রাতে আমার ঘুম হয় না। বেদেপাড়ায় ঘুম নেমা আসে—আর আমার অঙ্গ থেক্যা চাপাফুলের বাস বাহির হয়। সি বাসে মুই নিজে পাগল হয়া যাই গ। মনে হয়, দরজা খুল্যা ছুট্যা বাহির হয়া যাই চরের ঘাসবনে, নয়ত ঝাঁপিয়ে পড়ি হিজলের জলে। আর পরান দিয়ে ডাকি কালো কানাইয়ে। কালো কানাই না আসে তো—আসুক আমার নাগ-নাগর—হেলে দুলে ফণা নাচায় আসুক।
কণ্ঠস্বর মৃদু হয়ে এল পিঙলার, চোখ দুটি নিম্পলক হয়ে উঠল, তাতে ফুটে উঠল শঙ্কাপূর্ণ স্বপ্ন দেখার আতঙ্কিত দৃষ্টি। বললে—আসে, সে আসে ধন্বন্তরিভাই। নাগ আসে। তুমার কাছে। আমার পরানের গোপন কথা কইতে যখন মুখ খুলেছি, তখুনি কিছু লুকাব না। বলি শুন।