খ্যাতনামা সত্যসন্ধানী
প্রিয়বরেষু, প্রথমেই বলে রাখি, আপনার মতো একজন খ্যাতনামা সত্যসন্ধানীকে এই চিঠি লেখার সময় আশ্বস্ত আছি এই ভেবে যে, চিঠির বিষয় আপনি গোপন রাখবেন। ডাক্তার এবং আপনাদের কাছে যেমন কোনও তথ্য গোপন করা উচিত নয়, তেমনই সাহায্যপ্রার্থীর বিষয় তৃতীয় ব্যক্তিকে না জানানোর শিষ্টাচার নিশ্চয়ই আপনার কাছে আশা করতে পারি।
আমার বয়স আগামী পয়লা কার্তিক একাত্তর পূর্ণ হবে। এখনও বার্ধক্যজনিত উপসর্গ আমাকে আক্রমণ করেনি। কিন্তু আমার স্ত্রী পঁয়ষট্টি বছর বয়সে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কিছুদিন আগে তার পেটে ক্যান্সার রোগ ধরা পড়েছে। মুম্বইয়ের এক নামী হাসপাতাল জানিয়ে দিয়েছে, ডাক্তারিশাস্ত্রে আর কিছু করণীয় নেই।
এই পৃথিবীতে বর্তমানে স্ত্রী ছাড়া আমার কেউ নেই। তাঁর মৃত্যুর পর আমার জীবিত থাকার কোনও কারণ দেখছি না। এই সময় একটি ইংরেজি সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিজ্ঞাপন আমার চোখে পড়ল। বিজ্ঞাপনটি যদি সত্যি হয়, তা হলে আমৃত্যু আমি আমার স্ত্রীকে সঙ্গিনী হিসেবে কাছে পাব। কথাবার্তা হবে না, চলাফেরাও নয়, নাই হোক, তাকে এখনকার চেহারায় ঠিকঠাক দেখলেও আমার প্রাণ শান্ত হবে।
এই চিঠির সঙ্গে বিজ্ঞাপনটির ফোটোকপি আপনাকে পাঠিয়ে দিলাম। সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকার একটা ব্যাঙ্ক ড্রাফট। আপনাকে অনুরোধ, এই বিজ্ঞাপনের সত্যাসত্য সন্ধান করে দ্রুত আমাকে জানান। এই বয়সে প্রতারিত হতে চাই না বলে আপনার শরণাপন্ন হলাম।
ইতি
শুভেচ্ছাসহ
কানাইলাল চৌধুরী
লাটাগুড়ি, জলপাইগুড়ি।
চিঠি পড়ে অবাক হল অর্জুন। চিঠির সঙ্গে তার নামে করা ব্যাঙ্ক ড্রাফটটাকে দেখল সে। তারপর ফোটোকপি করা বিজ্ঞাপনটি চোখের সামনে ধরল।
অভূতপূর্ব আবিষ্কার। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর গবেষণার পর মানুষের শরীর বিষয়ে নতুন আলোকপাত। বৈদিক ভেষজ প্রক্রিয়াকে আধুনিক ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করে সাফল্য পেয়েছেন আয়ুর্বেদাচার্য ডক্টর নীলমোহন বকসি।
আপনার প্রিয়জনের মৃত্যু হলে শাস্ত্রমতে দাহ অথবা সমাধি দিয়ে শরীর বিনষ্ট করাই স্বাভাবিক কাজ। মৃত মানুষটির শরীর তারপর শুধু স্মৃতি বা ছবিতে থাকে। কিন্তু ভেষজ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ডক্টর বকসি সেই মৃতদেহকে অবিকল একই চেহারায় রেখে দিতে পারেন চল্লিশ বছর পর্যন্ত। এজন্য সেই দেহটিকে কোনও জারক রসে ডুবিয়ে রাখতে হবে না। আপনার কাছে তিনি নির্বাক হয়েই থেকে যাবেন জীবিত চেহারায়। শুধু তার হৃৎস্পন্দন থাকবে না। বিশদ বিবরণের জন্যে যোগাযোগ করুন। বক্স নম্বর…।
বিজ্ঞাপনটি ইংরেজিতে লেখা। কাগজটি ছাপা হয় উত্তর ভারত থেকে। হেসে ফেলল অর্জুন। ডক্টর নীলমোহন বকসি যতই আয়ুর্বেদাচার্য হোন, তিনি যে একটি আস্ত উন্মাদ তাতে কোনও সন্দেহ নেই। একটি মানুষ মরে গেল, মরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর থেকে তার শরীরে পচনপ্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। বরফে চাপা দিয়ে সেটা দু-তিনদিন ঠেকিয়ে রাখা যায়। কিন্তু তিনি দিব্যি জামাকাপড় পরে একই চেহারায় ঘরে বসে থাকবেন চল্লিশ বছর পর্যন্ত? তা যদি সম্ভব হত, তা হলে বিজ্ঞানীদের মধ্যে সাড়া পড়ে যেত। নোবেল পেয়ে যেতেন ডক্টর বকসি।
স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে এটা একটা প্রতারক সংস্থা থেকে প্রচারিত বিজ্ঞাপন। মানুষের দুর্বলতাকে ওরা ব্যবহার করে টাকা রোজগার করতে চাইছে। অবিলম্বে পুলিশকে জানানো দরকার। এরকম বিজ্ঞাপন খবরের কাগজ কী করে ছাপল? অর্জুন ঠিক করল ব্যাঙ্ক ড্রাফট কানাইলাল চৌধুরীকে ফেরত দিয়ে দেবে।
কানাইলাল চৌধুরীর লেখা চিঠির একপাশে তার ফোন নম্বর রয়েছে। অর্জুন সেই নম্বরে ডায়াল করল। আজকাল এই উত্তরবঙ্গেও টেলিফোন ব্যবস্থা খুব উন্নত হয়েছে। লাইন পাওয়া গেল সহজেই। তারপর গলা শুনতে পেল, হ্যালো! কে বলছেন?
আমি শ্রীকানাইলাল চৌধুরী মশাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাই। বলছি। নমস্কার! আমি অর্জুন। আপনার চিঠি এইমাত্র পেলাম। নমস্কার! নমস্কার! আপনার স্ত্রী এখন কেমন আছেন?
আজ সকালে একটু ভাল। কিন্তু এখন তো লিকুইড ছাড়া ও খেতে পারছে না। কানাইলাল বললেন, অর্জুনবাবু, আমার ভয় হচ্ছে বেশি সময় হাতে নেই। আপনি যদি একটু তাড়াতাড়ি খোঁজখবর নেন। আমি জানি আপনারা যেসব বিষয় নিয়ে কাজ করেন, তার তুলনায় এটা অতি সাধারণ। কিন্তু বুঝতেই পারছেন, আমি কী রকম টেনশনে আছি। কানাইলাল চৌধুরী প্রায় এক নিশ্বাসে কথাগুলো বললেন।
অর্জুন চুপচাপ শুনছিল। একটু ভেবে সে জিজ্ঞেস করল, এরকম বিজ্ঞাপন বাস্তবে সম্ভব বলে আপনি কি বিশ্বাস করেন?।
আমি জানি না। এরকম হতে পারে কখনও শুনিনি। কিন্তু ছেলেবেলায় আমি ভাবতেই পারতাম না, চাঁদের বুকে কেউ হাঁটতে পারে। মহাকাশে ছ’মাস থাকা সম্ভব? এমনকী এই কিছুদিন আগেও ভাবতে পারিনি রাস্তায়, ট্রেনে, গাড়িতে বসে টেলিফোনে কথা বলতে পারব। সেলফোন শব্দটাও শুনিনি। ইন্টারনেট কী তাই জানতাম না। তাই এই ঘটনা সত্যি না মিথ্যে, তার প্রমাণ না-পাওয়া পর্যন্ত বলতে পারব না বিশ্বাস করি কি না! কানাইলাল বললেন, আপনার উপর ভরসা করে আছি ভাই। টাকার দরকার হলেই জানাবেন।
ফোন রেখে দিল অর্জুন। ভদ্রলোক যেসব যুক্তি দিলেন তা সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য। কিন্তু একটি মৃতদেহের হৃদযন্ত্র বন্ধ হওয়ার পর, রক্ত নিশ্চল হয়ে গেলে কিছুতেই শরীরকে আগের অবস্থায় রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু নিজস্ব ভাবনা যতই বাস্তব হোক, সরেজমিনে দেখে কানাইলাল চৌধুরীকে জানানো সঠিক হবে।
.
অর্জুনের লাল মোটরবাইক করলা নদীর পাশ দিয়ে কংক্রিটের ব্রিজ পেরিয়ে বাবুপাড়ায় যখন ঢুকল তখন সকাল দশটা। বাবুপাড়া এমনিতেই বেশ নির্জন। ছাড়া-ছাড়া বাড়ি। ডান দিকের রাস্তায় ঢুকে তিন নম্বর বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ল অর্জুন।
ভিতর থেকে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন ভেসে এল, পরিচয়?
আমি অর্জুন।
দরজা খুললেন যে বৃদ্ধ, তার বয়স আশি ছাড়িয়েছে। মাথায় শণের মতো চুল। খুব রোগা। গলাবন্ধ গেঞ্জি আর ধুতি পরা। ওঁকে দেখলেই অর্জুনের মনে পড়ে সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে দেখা অভিনেতা হারীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কথা। হাসলেন ভদ্রলোক, কী সংবাদ তৃতীয় পাণ্ডব? এসো, ভিতরে এসো।
এই বাড়ির সব ঘরে বই ঠাসা। অর্জুন চেয়ারে বসল বই সরিয়ে। সুধাময় সান্যাল বসলেন মাটিতে, সামনে জলচৌকি, তার উপর বই খোলা।
সুধাময় সান্যাল বললেন, তুমি তো এখন বেশ নামটাম করেছ। ভাল, তবু । বলব, অনুমানের ভিত্তিতে কোনও সিদ্ধান্ত নেবে না। বলো, কী ব্যাপার?
আচ্ছা, আপনি কি বিশ্বাস করেন কোনও মৃতদেহকে অবিকৃত অবস্থায় চল্লিশ বছর রাখা সম্ভব? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
ধুতির খুঁটে চশমার কাচ মুছতে মুছতে সুধাময় সান্যাল জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ?
হঠাৎ নয়, এটা দেখুন। বিজ্ঞাপনের কপি পকেট থেকে বের করে অর্জুন এগিয়ে ধরল সামনে। ওটা নিয়ে পড়লেন বৃদ্ধ। পড়ে হাসলেন, কী বলতে চাও?
এটা অসম্ভব। বুজরুকি। বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষের দুর্বলতাকে ভাঙিয়ে টাকা লুঠতে চাইছে। এখনই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। অর্জুন বেশ জোর দিয়ে কথাগুলো বলল।
সুধাময় সান্যাল মাথা নাড়লেন, প্রতারক হলে তাই তো করা উচিত। কিন্তু তুমি আমার কাছে এসেছ কেন? লোকটা প্রতারক কি না তা এখানে বসে আমার পক্ষে তো বলা সম্ভব নয়।
অর্জুন মাথা নাড়ল, আপনার অভিজ্ঞতায় এরকম ঘটনা আছে কি না। তাই জানতে এসেছি।
ও। কিন্তু তুমি তো ব্যাপারটা প্রতারণা ভেবেই রেখেছ। ওই কথাটা আবার আসছে কেন? যত অবিশ্বাস্যই হোক, যাচাই না করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা কখনওই উচিত নয়। সুধাময় সান্যাল উঠে দাঁড়ালেন। তারপর দেওয়ালের পাশে গিয়ে একটা আঁকশি দিয়ে একেবারে উপরের তাক থেকে একটা বই নামিয়ে নিয়ে পাতা ওলটাতে লাগলেন।
হ্যাঁ। এই যে! আবার জলচৌকির সামনে বসে বইটা তার উপর রেখে জোরে জোরে পড়তে লাগলেন। ইংরেজি লাইনগুলো পড়ার পর চোখ তুলে তাকালেন সুধাময় সান্যাল, বুঝতে পেরেছ নিশ্চয়ই!
অর্জুন মাথা নাড়ল। সুধাময় সান্যাল বললেন, মৃতদেহ অবিকৃত করে রাখার পদ্ধতি মিশরীয় চিকিৎসকরা আবিষ্কার করেছিলেন কয়েক হাজার বছর আগে। তখন ব্যাপারটা এত ব্যয়সাধ্য ছিল যে, বাদশা, মন্ত্রী বা ধনী ব্যক্তি ছাড়া আর কারও পক্ষে ওই পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া সম্ভব ছিল না। ধরে নিতে পারি, যদি সম্ভব হত তা হলেও বাদশা বা শাসনকর্তা সেটা পছন্দ করতেন না। একজন অখ্যাত মানুষকে মৃত্যুর পরও রেখে দেওয়ার অনুমতি তাঁরা দিতেই পারেন না। সেইসব মৃতদেহকে মমি করে রেখে দেওয়া হয়েছিল। সময় এবং ওষুধের গুণে সেই মৃতদেহগুলো পচেগলে না গিয়ে ফসিল হয়ে গিয়েছে। আজ ওই মমিদের নিয়ে গবেষণা করেও বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতে পারেননি ঠিক কী ওষুধ তখন ব্যবহার করা হয়েছিল। একটা কথা মনে রাখতে হবে, তখন চিকিৎসাপদ্ধতি ভেষজ-নির্ভর ছিল। অ্যালোপ্যাথি বা হোমিওপ্যাথির কথা মানুষ জানত না। ব্যাপারটা যে বুজরুকি নয়, তা মমির ছবি দেখলেই বুঝতে পারবে। তার মানে এও নয়, ডক্টর নীলমোহন বকসি ওই একই পদ্ধতিতে মৃতদেহ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে পেরেছেন। হয়তো তার পুরো দাবিই মিথ্যে। আবার সেটা মিথ্যে কিনা, তা যাচাই না করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। তবে এটুকু বলা যেতেই পারে, এই দাবি যদি সত্যি হয়, তা হলে গোটা পৃথিবী আলোড়িত হবে। চা খাবে?
মাথা নাড়ল অর্জুন, না।
বিজ্ঞাপনের এই ফোটোকপি তুমি কোথায় পেলে? যতটা জানি তাতে বলতে পারি আমাদের শহরে কেউ এই কাগজ রাখে না।
লাটাগুড়ি থেকে এক ভদ্রলোক পাঠিয়েছেন। তিনি কী করে পেলেন, তা বলেননি। তাঁর স্ত্রীর ক্যান্সার হয়েছে। ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিয়েছেন। তাই তিনি চান এই বিজ্ঞাপন যদি সঠিক হয়, তা হলে ডক্টর বকসির সাহায্য নেবেন। অর্জুন বলল।
তোমার উপর তিনি নির্ভর করছেন?
হ্যাঁ।
সুধাময় সান্যাল বললেন, তা হলে তোমার উচিত ডক্টর বকসির সঙ্গে দেখা করা।
তা হলে আমাকে লখনউ যেতে হবে, অর্জুন বলল।
বড় ভাল জায়গা। ঐতিহাসিক শহর। কত স্মৃতি, সৌজন্যবোধের শহর। যাওয়ার আগে লখনউ সম্পর্কে ভালকরে পড়ে নিয়ো। জেনে গেলে অনেক সুবিধে, সুধাময় সান্যাল উপদেশ দিলেন।
.
উত্তরবঙ্গ থেকে ভারতের অন্য প্রান্তে যেতে হলে আজকাল আর কলকাতায় আসার দরকার পড়ে না। গুয়াহাটি থেকে রাজধানী এক্সপ্রেস নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন হয়ে বিহার দিয়ে দিল্লি যায় দ্রুত গতিতে। কানাইলাল চৌধুরীকে টেলিফোনে জানিয়ে সেই ট্রেনে উঠে বসল অর্জুন নিউ জলপাইগুড়িতে গিয়ে। এসি থ্রি-টিয়ারের টিকিট কেটেছিল সে। বেশ আরামদায়ক ব্যবস্থা। কিন্তু অর্জুন লক্ষ করল, তার কামরার যাত্রীরা কী রকম গম্ভীর মুখ করে বসে আছেন। তার সামনে একজন গোঁফওয়ালা ভদ্রলোক, এই অল্প আলোয় রোদচশমা পরে বসে আছেন। লোকটাকে দেখলেই মনে হয় সব সময় মতলব ভাঁজছেন। তার পাশে সিল্কের পাঞ্জাবি পরা মারোয়াড়ি ভদ্রলোক, চোখ বন্ধ করে পানমশলা চিবিয়ে যাচ্ছেন। মারোয়াড়ি ভদ্রলোকের পাশে মোটাসোটা এক মহিলা, মাথার অনেকটাই ঘোমটার আড়ালে, হাতে বড় বড় বালা, চুড়ি। ঘোমটার আঁচলের ডগা হাতের মুঠো থেকে ছাড়ছেনই না।
অর্জুনের বাঁ দিকে বসে এক বাঙালি প্রৌঢ় খবরের কাগজ পড়ছিলেন। হঠাৎ মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন ধরুন, একটু পরে উগ্রপন্থীদের রেখে। দেওয়া বিস্ফোরকে ট্রেনটা উড়ে গেল। আপনি কী করবেন?
হকচকিয়ে গেল অর্জুন। তারপর হেসে ফেলল, নেমে যাব নীচে।
সঙ্গে সঙ্গে মারোয়াড়ি ভদ্রলোক হো হো করে হেসে উঁড়ি নাচিয়ে বলে উঠলেন, আরে মশাই! ট্রেন উড়ে গেলে আপনি থোড়াই বেঁচে থাকবেন। নামবেন কী করে?
অর্জুন হাসিমুখে মারোয়াড়ি ভদ্রলোককে বলল, আপনি যখন উত্তরটা জানেন, তখন এই ভদ্রলোকেরও তা জানা আছে। তা হলে প্রশ্নটা করলেন কেন?
সচ কথা। আপনি কেন প্রশ্ন করলেন? মারোয়াড়ি ভদ্রলোক প্রৌঢ়র দিকে তাকালেন। বেশ সিরিয়াস মুখ।
প্রৌঢ় সোজা হয়ে বসে বললেন, হঠাৎ মনে হল, এই চলন্ত ট্রেনে যদি বিস্ফোরণ হয়, তা হলে আমি কী করব? ভেবে না পেয়ে ফস করে জিজ্ঞেস করে ফেললাম। সত্যি তো, আমিও উড়ে যাব। হাত-পা-মাথা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। উঃ! কিন্তু এসব জেনেও আমরা ট্রেনে উঠছি। ঠিক যেভাবে লোকে ক্যান্সার হতে পারে জেনেও সিগারেট খায়।
অর্জুন বলল, ব্যাপার দুটো বোধ হয় এক নয়। তা ছাড়া আজকাল স্টেশনে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখা হয় কোনও রকম বিস্ফোরক রাখা আছে কিনা ট্রেনে।
দুর! এত বড় ট্রেন, কত কামরা। কোথায় কে কী লুকিয়ে রেখেছে, তা সব সময় টের পাওয়া যায়? আমি কীরকম নার্ভাস বোধ করছি।
ভদ্রলোক চোখ বন্ধ করলেন। অর্জুন খবরের কাগজটা টেনে নিল। অসমের ডিব্রুগঢ়ের কাছে উগ্রপন্থীরা ট্রেন উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। লাইনে পাতা বিস্ফোরক ট্রেন আসার আগেই ফেটে যাওয়ায় ড্রাইভার ট্রেন থামিয়ে দিতে পেরেছিলেন ঠিক সময়ে। নইলে কয়েকশো যাত্রী প্রাণ হারাতেন।
অর্জুন প্রৌঢ়ের দিকে তাকাল। এরকম খবর পড়লে ট্রেনে বসে একটু নার্ভাস হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। হঠাৎ তার মনে হল, এখন ভারতের বিভিন্ন জায়গায় উগ্রপন্থীরা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মানুষ মারছে। কিন্তু তাদের ক’জন ধরা পড়ছে? এটাও তো হত্যাকাণ্ড। কিন্তু খবরটা পুরনো হলেই সকলে ভুলে যাচ্ছে।
.
ট্রেন ছুটছিল। অর্জুন দেখল গোঁফওয়ালা, রঙিন চশমায় চোখটাকা লোকটি উঠে দাঁড়াল। তারপর করিডোর দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল। লোকটা চোখের আড়ালে যাওয়ামাত্র পাশের প্রৌঢ় ভদ্রলোক বললেন, লক্ষ করেছেন?
কী?
আড়াই ঘণ্টা হয়ে গেল, গুঁফো একটাও কথা বলেনি। চেহারায় কীরকম উগ্রপন্থী ছাপ রয়েছে। হয়তো বাথরুমে বিস্ফোরক রেখে সামনের স্টেশনে নেমে যাবে। ভুল বলছি?
আপ্তবাক্যটি মনে পড়ল অর্জুনের, কেউ সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। সে মাথা নাড়ল, হতে পারে আবার না-ও হতে পারে। চেহারা দেখলে সব সময় সত্যিটা বোঝা যায় না। এই যেমন আপনি। আচ্ছা, আপনি কি পেটের গোলমালে খুব ভোগেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
অ্যাকিউট কোষ্ঠকাঠিন্য! ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন।
তা সত্ত্বেও আপনি বোমা রেখে এই ট্রেন উড়িয়ে দিতে পারেন।
আমি? আ-আ-আমি? চোখ বড় হয়ে গেল ভদ্রলোকের।
কেন নয়! বলা হয়েছে যতক্ষণ না নির্দোষ প্রমাণিত হচ্ছে, ততক্ষণ কেউ সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। অর্জুন উঠে দাঁড়াল।
আমাকে কী দেখে নির্দোষ বলে মনে হচ্ছে না আপনার? মুখ শুকিয়ে গিয়েছে ভদ্রলোকের।
আমাকে কী মনে হচ্ছে আপনার? আগে কখনও দ্যাখেননি। অর্জুন হাসল।
তা ঠিক, তবু… এই ধরুন, এই ভদ্রলোক। আজ অবধি কোনও মারোয়াড়ি উগ্রপন্থীর কথা কাগজে পড়িনি। ভদ্রলোক উলটো দিকের লোকটিকে চোখের ইশারায় দেখালেন।
অর্জুন কাঁচের দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এল। হাত ধোওয়ার বেসিনের সামনে জায়গাটা ফাঁকা। দু পাশে বাথরুমে ঢোকার দরজা দুটোর একটা বন্ধ। ট্রেনের গতি কমে আসছে। অর্জুন দরজার সামনে গিয়ে ছিটকিনি তুলতে-না তুলতে প্ল্যাটফর্ম এসে গেল। ধীরে ধীরে ট্রেন দাঁড়িয়ে গেল। কয়েকজন যাত্রী উঠে পড়লেন ট্রেনে। টিটিই এসে গেলেন। যাত্রীরা ভিতরে ঢুকে যাওয়ার পর অর্জুন দেখল, বাথরুমের দরজা খুলে গোঁফওয়ালা লোকটি বেরিয়ে এসে সোজা প্ল্যাটফর্মে নেমে গেল। এবং তখনই ট্রেন ছেড়ে দিল। মুখ বাড়িয়ে অর্জুন দেখল, লোকটা হেঁটে চলেছে।
দরজা বন্ধ করে দিন। পাশে এসে দাঁড়ালেন টিটিই।
অর্জুন ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, একজন প্যাসেঞ্জার এইমাত্র নেমে গেলেন।
যেতেই পারেন।
ফিরে এসে বাঙালি প্রৌঢ়কে ব্যাপারটা বলতেই তিনি চেঁচামেচি শুরু করলেন। তার চিৎকারে ভিড় জমে গেল। রেলের ইউনিফর্ম পরা দুজন অফিসার ছুটে এলেন। সব শুনে একজন রেলরক্ষীকে নিয়ে ওঁরা ছুটে গেলেন বাথরুমের দিকে।
প্রৌঢ় ভদ্রলোক চেঁচাচ্ছিলেন, ট্রেন থামাতে হবে। চেন টানুন, চেন টানুন। উঃ! যে-কোনও মুহূর্তে বিস্ফোরণ হতে পারে। মা কালী, মা দুর্গা, মা সরস্বতী! আমি এখনই মারা যাব!
ভদ্রলোকের উন্মাদ-আচরণ সংক্রমিত হল। রেলের একজন অফিসার চেন টানতে বাধ্য হলেন। গাড়ি থামামাত্র সবাই হইহই করে নীচে নেমে মাঠে গিয়ে দাঁড়াল। এতক্ষণে প্রৌঢ় স্বস্তিতে ফিরলেন, যাক, বেঁচে গেলাম! ফাটুক এবার। আমাদের তো আর মারতে পারবে না।
.
প্রায় একঘণ্টা ধরে রেলের অফিসাররা তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছু পেলেন না। তবু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ওই কামরা খালি রেখে যাত্রীদের অন্য কামরায় পরবর্তী স্টেশন পর্যন্ত তুলে নেওয়া হল। বসার জায়গা পাওয়া । যায়নি। ছুটন্ত ট্রেনে অর্জুনের পাশে দাঁড়িয়ে প্রৌঢ় ভদ্রলোক মাঝে মাঝে চমকে উঠছিলেন অন্যরকম কোনও শব্দ কানে এলেই।
পরের স্টেশনে ট্রেন থামলে বম্ব স্কোয়াডের লোকজন এসে অনুসন্ধান করে জানিয়ে দিল কোনও বিস্ফোরক ট্রেনে নেই। আগের কামরায় ফিরে এল ওরা।
অর্জুন বলল, নার্ভাস হয়ে গিয়ে কী কাণ্ডই করলেন বলুন তো?
না না! সাবধানের মার নেই।
কিন্তু ট্রেন লেট হয়ে গিয়েছে। তার উপর হ্যারাসমেন্ট।
তা হোক। প্লেনে বিস্ফোরক আছে সন্দেহ করলে তাকে আবার ফিরিয়ে আনা হয় না? এখন কিছু নেই তাই একথা বলছেন, থাকলে কী হত ভেবে দেখুন! প্রৌঢ় ভদ্রলোকের কথা শেষ হতে না-হতে রেলের দু’জন অফিসার সামনে এসে দাঁড়ালেন। একজন জিজ্ঞেস করলেন, আপনার পুরো নামটা বলুন।
পিনাকেশ মিত্র।
ঠিকানা?
কাঁসিরাম মার্গ, লখনউ।
আপনি কী করেন?
স্কুলে পড়াই।
মিস্টার মিত্র, আপনিই প্রথম ট্রেনে বিস্ফোরক আছে সন্দেহ করে চিৎকার করেছিলেন। আপনার চিৎকারে অন্য যাত্রীরা ভীত হয়ে পড়েন। কী কারণে আপনার মনে ওই সন্দেহ এল?
আসবে না? বলেন কী! একটা গোঁফওয়ালা লোক চোখে কালো চশমা পরে ঠায় বসে থাকল সামনে, কারও সঙ্গে কোনও কথা বলল না। তারপর উঠে বাথরুমে ঢুকে গেল। আর ট্রেন থামতেই টুক করে কেটে পড়ল। সঙ্গে কোনও সুটকেস দূরের কথা, ব্যাগও ছিল না। এতে সন্দেহ হবে না?
ব্যাগ বা সুটকেস না থাকলে বিস্ফোরক রাখবে কোথায়?
অ্যাঁ! পকেটে রাখতে পারে না?
সচরাচর যে বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়, তা পকেটে নিয়ে বসে থাকা যায় । তা ছাড়া আপনি যার কথা বলছেন, তিনি রেলপুলিশের একজন বড়কা। ওঁর ওই স্টেশনেই থামার কথা ছিল। ভদ্রলোক কে, তা আপনি টিটিইকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন। তা না করে নিজের বিপদ ডেকে আনলেন।
বিপদ মানে?
আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ, বিনা কারণে যাত্রীদের ভয় পাইয়েছেন। তাদের একত্রিত করে রেলের অফিসারকে চেন টানতে বাধ্য করেছেন। অহেতুক ট্রেনটাকে দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে আপনার জন্য। টিকিট কেটেও দীর্ঘসময় এই কামরার যাত্রীরা অন্য কামরায় দাঁড়িয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে আপনার কৃতকর্মের জন্য। আপনাকে পরের স্টেশনে আমরা রেলপুলিশের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছি। আপনার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হবে। উঠুন।
সে কী! আমি, আমি তো ভালর জন্যই করেছিলাম…
আদালতে যা বলার বলবেন।
হঠাৎ প্রৌঢ় ভদ্রলোক কেঁদে ফেললেন, এর চেয়ে মরে যাওয়া ভাল ছিল। আমার শরীর ছিন্নভিন্ন হলে আমি তো দেখতে আসতাম না। অর্জুনের দিকে তাকালেন তিনি, লোকটার নেমে যাওয়ার খবর আপনি যদি আমাকে না দিতেন, তা হলে আমি রিঅ্যাক্ট করতাম না।
অফিসার বললেন, উনি আপনাকে অনেকবার বলেছেন শান্ত হতে।
অন্য যাত্রীরা উঠে এসে সব শুনলেন। তারা এবার অনুরোধ করলেন, মানুষটি সরল, শিক্ষক, এঁকে ছেড়ে দিন।
অফিসার জানালেন, আমাদের কিছু করার নেই। পুরো ঘটনাটা কর্তৃপক্ষ জেনে গিয়েছেন। বম্ব স্কোয়াডকে ডাকামাত্র তারা জানতে পেরেছেন। ঠিক আছে, আপনি এখানেই এখন বসে থাকুন। ট্রেন থামলে আমরা আসব।
অফিসাররা চলে যাওয়ার পর পিনাকেশ মিত্র দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলেন। অর্জুন বলল, শান্ত হন। একজন ভাল উকিলকে সব কথা খুলে বললে তিনি নিশ্চয়ই জামিনের ব্যবস্থা করে দেবেন।
আমি মুখ দেখাতে পারব না। আমার চাকরি চলে যাবে।
শেষপর্যন্ত ভদ্রলোক শান্ত হলেও গুম হয়ে বসে রইলেন। এই সময় মারোয়াড়ি ভদ্রলোক তাকে কাছে ডেকে ফিসফিস করে কিছু বলতেই তার চোখ চকচক করে উঠল। খানিকক্ষণ উসখুস করলেন। তারপর অর্জুনকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
লখনউ।
উঃ! ঈশ্বর আছেন। শুনুন। আমি ওঁদের ঠিকানাটা ভুল বলেছি। আমি থাকি লখনউ বেঙ্গলি ক্লাবের পাশে। পিনাকেশ নয়, পিনাকীরঞ্জন আসল নাম। ভয়ের চোটে যা মুখে এল, বলে ফেলেছিলাম।
ও।
আমার এই সুটকেসটা বাড়িতে পৌঁছে দেবেন?
বেশ, অর্জুন বলল।
এসব ঘটনার কথা একবারও বলবেন না প্লিজ।
তাই হবে।
ঘণ্টাদুয়েক টানা ছুটে ট্রেন গতি কমাতে আরম্ভ করতেই ভদ্রলোক বললেন, যাই, বাথরুম থেকে ঘুরে আসি।
ধীরে ধীরে চলে গেলেন ভদ্রলোক।
ট্রেন থামল। সঙ্গে সঙ্গে দু’জন রেলপুলিশ নিয়ে অফিসার চলে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, পিনাকেশবাবু কোথায়?
টয়লেটে গিয়েছেন।
ও।
কয়েক সেকেন্ড দাঁড়ালেন অফিসার। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কোন টয়লেটে গিয়েছেন উনি?
অর্জুন সঠিক দিকটা দেখিয়ে দিতে তারা চলে গেলেন সেখানে। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে যাচ্ছিল। একটি টয়লেট থেকে একজন মহিলা বেরোলেন। অন্যটি থেকে আর-একজন বৃদ্ধ। ট্রেন দুলে উঠতেই অফিসার চিৎকার করে উঠলেন, পালিয়েছে। লোকটা পালিয়েছে। প্ল্যাটফর্মে খুঁজুন।
সঙ্গে সঙ্গে প্রায় হুড়মুড়িয়ে নেমে গেলেন রেলপুলিশের কনস্টেবল এবং অফিসার।
ট্রেন গতি বাড়িয়েছে। নিজের জায়গায় ফিরে এসে অর্জুন দেখল, মারোয়াড়ি ভদ্রলোক চোখ বন্ধ করে পানমশলা চিবিয়ে চলেছেন।
অর্জুন বলল, একজন সরল মানুষকে আপনি এমন বুদ্ধি দিলেন যে, এখন উনি অপরাধী হয়ে গেলেন।
চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়লেন মারোয়াড়ি ভদ্রলোক, এ ছাড়া উনি বাঁচতে পারতেন না। পুলিশ ওঁকে জেলে দিত। সরকারের কাজে ব্যাঘাত তৈরি করার জন্য দু’-তিন বছর জেলে থাকলে চাকরিটাও চলে যেত। উনি যে ভয় পেয়ে বোকামি করেছেন, এটা বুঝতে পারলেও ছাড়ত না। কেন ছাড়ত না জানেন? ওরা পাবলিককে দেখাত যে, ওরা কত ভাল ডিউটি করছে। এখন যদি বুদ্ধি করে হাওয়া হয়ে যেতে পারেন, তা হলে এসব থেকে বেঁচে যাবেন উনি। তা ছাড়া আমি কে? তোক তো কত কিছু বলে, সব শুনতে হবে? উনি ভাল মনে করেছেন বলে শুনেছেন?
অর্জুন আর কথা বাড়াল ।
.
লখনউ স্টেশনে যখন ট্রেন পৌঁছোল, তখন সকাল সাতটা। অনেক চেষ্টা করেও ম্যানেজ করতে পারেননি ট্রেনচালক, ট্রেন এক ঘণ্টার উপর দেরি করে স্টেশনে ঢুকল। নিজের ব্যাগ নিয়ে অর্জুন নামতে যাচ্ছিল, মারোয়াড়ি ভদ্রলোক ইশারায় পিনাকেশবাবুর সুটকেস দেখিয়ে দিলেন।
একটু ইতস্তত করল অর্জুন। সে যদি পৌঁছে না দেয়, তা হলে এই সুটকেস দিল্লি চলে গিয়ে রেলের সম্পত্তি হয়ে যাবে। আপত্তি থাকলে তখনই পিনাকেশবাবুকে জানানো উচিত ছিল। সে সুটকেসটা তুলে নিল। ভাগ্যিস বেশি ভারী নয়!
জলপাইগুড়ির কদমতলার জগুদা কিছুদিন লখনউয়ে ছিলেন। রওনা হওয়ার আগে তাঁর সঙ্গে দেখা করে থাকার জায়গার খোঁজ নিয়েছিল অর্জন। জগুদা বলেছিলেন, বড় হোটেলগুলোতে বিস্তর টাকা লাগে। তুমি এক কাজ করো, মদনমোহন মালব্য রোডে চলে যাবে। ওখানে অল্প দামে কিছু ভাল গেস্ট হাউস আছে। তার একটায় উঠতে পারো। কোনও অসুবিধে হবে না।
স্টেশন থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে মদনমোহন মালব্য রোডে আসার সময় পুরনো দিনের বদলে আধুনিক শহর চোখে পড়ল। তবে লখনউ শহরের স্টেশনটা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। মুঘল আমলের আদলে স্টেশনবাড়িটি তৈরি করা হয়েছে। ট্যাক্সিওয়ালা হোটেলের নাম জানে, কিন্তু ওখানে কোনও গেস্ট হাউস আছে কিনা, তার খবর রাখে না।
মদনমোহন মালব্য রোডে ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে অর্জুন কয়েকজন পথচারীকে পরপর জিজ্ঞেস করে যখন হদিশ পেল না, তখন জগুদার উপর অতিরিক্ত আস্থা রাখার জন্য নিজের উপরও তার রাগ হচ্ছিল। আর-একটা ট্যাক্সি ডেকে অল্প দামি কোনও হোটেলে নিয়ে যেতে বলবে বলে ভাবতেই একটা গাড়ি তার সামনে এসে দাঁড়াল।
এনি প্রবলেম ভাই?
অর্জুন দেখল, যিনি গাড়ি চালাচ্ছেন, তিনিই প্রশ্নটা করলেন। মধ্যবয়সি মানুষটিকে তার অবাঙালি বলে মনে হল। আরে মানুষ কি এই শহরে গায়েপড়ে কথা বলে! সে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, এখানে কি কোনও গেস্ট হাউস আছে?
চোস্ত উর্দুতে ভদ্রলোক জবাব দিলেন, অবশ্যই আছে। পার্টিকুলার কোনও গেস্ট হাউসের ঠিকানা কি সঙ্গে আছে?
না।
দরজা খুলে দিলেন ভদ্রলোক। পিছনের এবং পাশের। উঠে পড়ুন, জিনিসগুলো পিছনের সিটে রেখে দিন।
পাশে বসামাত্র ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, কোথা থেকে আসছেন?
জলপাইগুড়ি।
যা ব্বাবা! আপনি বাঙালি? তা হলে ইংরেজিতে কথা বলছিলেন কেন? এবার হাসতে হাসতে বাংলায় বললেন ভদ্রলোক।
ওহো! আপনিও বাঙালি। কিন্তু দেখে তো মনে হয় না, অর্জুন হাসল।
কী করে হবে! আমি জন্মেছি ইলাহাবাদে, বড় হয়েছি কানপুরে, চাকরি করি এই লখনউয়ে। বিয়ে করেছি রাঁচির মহিলাকে। শরীরটায় তার ছাপ তো পড়বেই। কিন্তু মনে মনে আমি সেন্ট পার্সেন্ট বাঙালি। আমার নাম অমিতাভ। গাড়ি চালাতে চালাতে কথা বলে গেলেন অমিতাভ।
আমি অর্জুন।
কী উদ্দেশ্যে আসা হয়েছে, বেড়াতে?
না, একটা কাজ নিয়ে এসেছি।
ব্যাবসা না চাকরি?
কোনওটাই নয়। আমি মানুষের সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করি।
মাই গড! আপনাকে দেখে ভাই ধর্মগুরু বলে মনে হয় না। তারা ওসব করে থাকেন। এই যে, এখানে! ব্রেক চেপে গাড়ি দাঁড় করালেন অমিতাভ। আগে চলুন, দেখি ঘর পাওয়া যাচ্ছে কিনা! অমিতাভ দরজা খুললেন।
গেস্ট হাউসে জায়গা পাওয়া গেল। অমিতাভ নিজের পরিচয় দিলে ভাড়া অনেকটাই কমিয়ে দিলেন ম্যানেজার। মালপত্র নিয়ে ঘরে ঢোকার পর অমিতাভ বললেন, সকালে নিশ্চয়ই চা খাওয়া হয়নি। ফ্রেশ হয়ে নিন, আমি চা বলে দিয়ে যাচ্ছি।
আপনি কত দূরে থাকেন?
পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে এগিয়ে ধরলেন অমিতাভ, ঠিক পাঁচটা বাড়ি পর একটা হাউসিং কমপ্লেক্সে, গেটের দরোয়ানকে নাম বললেই দেখিয়ে দেবে। একটা ফোন করে চলে আসবেন। আচ্ছা, নো মোর আপনি। তুমি বয়সে অনেক ছোট, তুমি’ বললে নিশ্চয়ই আপত্তি করবে না।
অর্জুন হেসে ফেলল, বিন্দুমাত্র না। দু’কাপ চা বলুন। আপনার না হয় একটু দেরি হবে। প্রথম আলাপেই যখন তুমিতে নামলেন, তখন একসঙ্গে চা খেয়ে সেলিব্রেট করা যাক।
.
মিনিটদশেক পরে বাথরুম থেকে তরতাজা হয়ে বেরিয়ে এসে অর্জুন দেখল, অমিতাভ খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছেন। সামনের টেবিলে ট্রে-র উপর টি-পট টিকেজিতে ঢাকা রয়েছে। কাগজ সরিয়ে রেখে অমিতাভ বললেন, নিশ্চয়ই চিনি খাও।
হ্যাঁ।
চা তৈরি করে এগিয়ে দিলেন অমিতাভ।
চায়ে চুমুক দিয়ে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনাদের এখানে একটা বেঙ্গলি ক্লাব আছে, যার নাম আমি জলপাইগুড়িতে শুনেছি। নাটক প্রতিযোগিতা করে বিখ্যাত হয়েছে।
হ্যাঁ, ওই ক্লাব নিয়েই আমরা আছি।
ক্লাবটা এখান থেকে কত দূর?
আধঘণ্টার পথ। আজ সন্ধ্যায় যাবে নাকি?
যাওয়া যেতে পারে। এখানকার বাঙালিরা সকলে ক্লাবে যান?
না, না। ভাগাভাগি তো থাকবেই। পুজোও হয় অনেক।
আপনি সকলকে চেনেন?
অনেককেই চিনি, কিন্তু সকলকে চেনা অসম্ভব।
বেঙ্গলি ক্লাবের কাছাকাছি এক ভদ্রলোক থাকেন। স্কুলমাস্টার, নাম পিনাকীরঞ্জন মিত্র। প্রৌঢ় ভদ্রলোক। চিনতে পারছেন?
স্কুলে পড়ান? পিনাকীরঞ্জন মিত্র? নাঃ! মনে পড়ছে না তো।
যাচ্চলে! সমস্যায় পড়লাম।
কী ব্যাপার?
অর্জুন ট্রেনের ঘটনাটা খুলে বলল। পিনাকীরঞ্জনের সুটকেসটা দেখিয়ে বলল, ভদ্রলোকের বাড়ি খুঁজে বের করতে মনে হচ্ছে হিমসিম খেতে হবে।
কীরকম দেখতে বলো তো? চা শেষ করলেন অমিতাভ।
অর্জুন বর্ণনা দিয়ে বলল, মনে হয় পেটের অসুখে ভোগেন।
মাথা নাড়লেন অমিতাভ, পিনাকীরঞ্জন মিত্র? স্কুলমাস্টার? উঁহু!
অমিতাভ উঠে দাঁড়ালেন, এখনই খুঁজতে বেরিয়ো না। আমি একটু দেখি। আচ্ছা!
আর-একটা কথা। ডেলি নিউজ পত্রিকার অফিসে কীভাবে যাব?
এখান থেকে মাইলতিনেক দূরে। ট্যাক্সিওয়ালাকে বললেই হবে। অমিতাভ বেরিয়ে গেলেন।
সকালেই স্নান সেরে নিল অর্জুন। এটা গেস্ট হাউস বটে, কিন্তু হোটেলের ঘরের সঙ্গে তেমন কোনও পার্থক্য নেই। ম্যানেজার বলেছিলেন ব্রেকফাস্টের জন্য গেস্টদের কাছে কোনও বিল যায় না। তবে সেটা সাড়ে নটায় সেরে ফেলতে হবে।
একেবারে তৈরি হয়ে পকেটে টাকা রাখতেই দরজায় শব্দ হল। অর্জুন এগিয়ে গিয়ে সেটা খুলতেই দেখল, গাট্টাগোট্টা একটা লোক গেস্ট হাউসের ইউনিফর্ম পরে দরজায় দাঁড়িয়ে তাকে সেলাম করল, রুম পরিষ্কার করব স্যার? হিন্দিতে বলল।
আমি তো এইমাত্র ঘরে ঢুকলাম। রুম কি পরিষ্কার ছিল না? হিন্দিতেই জবাব দিল অর্জুন।
লোকটি হাসল, অনেকে কোনও জামা একবার পরেই কাচতে দেয়, আবার কেউ কেউ দু’দিন ধরে পরে। আপনি তো স্নান করেছেন, হয়তো বিছানায় শুয়েছেন। তাই মনে হল জিজ্ঞেস করি ঘর পরিষ্কার করতে হবে কিনা!
বাঃ! তুমি তো বেশ সুন্দর কথা বলো। অর্জুন টেবিলে রাখা একটা খাম পকেটে ভরে নিল।
স্যার, আমার কথা যদি আপনার শুনতে ভাল লাগে, তা হলে জানবেন এটা লখনউ শহরের দান। আপনি কি এর আগে এখানে এসেছেন? লোকটি দরজাতেই দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল।
না, এই প্রথমবার।
তা হলে আপনি নিশ্চয়ই লখনউ শহর ঘুরে দেখবেন। একা ঘুরলে আপনার কাছে অনেক কিছু অজানা থেকে যাবে। আমার এক ভাই ট্যাক্সি চালায়। আপনি চাইলে ও আপনাকে খুব যত্ন করে ঘোরাবে, লোকটি বলল।
কী নাম তোমার?
আবদুল। আমার ভাইয়ের নাম আফজল।
দরকার হলে বলব।
ডাইনিং টেবিলে বসে মনে মনে হাসছিল অর্জুন। আবদুল নিশ্চয়ই তাকে পকেটভরতি করে নিয়ে আসা একজন টুরিস্ট বলে ভেবেছে। কানাইলাল চৌধুরীর পাঠানো টাকার বেশ কিছুটা গিয়েছে ট্রেনের আসা-যাওয়ায় টিকিটে, বাকিটা তিনদিনেই শেষ হয়ে যাবে। অবশ্য কানাইলাল বলেছেন, টাকার দরকার হলে তাকে জানাতে। কিন্তু নিজের বেড়ানোর জন্য খরচ করার টাকা ওঁর কাছে চাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।
ডাইনিং রুমটি বেশ বড়। গোটাআটেক টেবিল মানে, এই গেস্ট হাউসে অন্তত আটটি ঘর রয়েছে। বাঁ দিকের দেওয়াল ঘেঁষে রাখা টেবিলে অন্তত পাঁচটি পদ। লুচি-তরকারির সঙ্গে স্যান্ডউইচ, পোচ, মিষ্টির সহাবস্থান। অর্জুন পাঁচটি পদই নিয়েছিল প্লেটে, যাতে বিকেলের আগে খাওয়ার দরকার না হয়। খেতে বসেছিল যখন, তখন ডাইনিং টেবিলে কেউ ছিল না। এখন একজন বৃদ্ধ এলেন। পাকা আমের মতো চেহারা, পরনে কমপ্লিট ধূসর রঙের সুট। বয়স আশির কাছাকাছি। বেশ গোলগাল চেহারা, উচ্চতা পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির মতো। ভদ্রলোকের ডান হাঁটুতে সমস্যা আছে। হাঁটার ভঙ্গি তো তাই বলছে।
টেবিল থেকে খাবার প্লেটে তুলে বৃদ্ধ চারপাশে তাকালেন। অর্জুনের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই তিনি হেসে বললেন, গুড মর্নিং!
গুড মর্নিং!
ক্যান আই জয়েন ইউ?
ওঃ। শিয়ের! অর্জুন সোজা হয়ে বসল।
ভদ্রলোক উলটো দিকের চেয়ারে বসলেন, যদি ভুল না করি, তা হলে মহাশয় একজন বঙ্গসন্তান, তাই কি?
অবশ্যই।
বাঃ! সকালটা বেশ ভাল কাটবে। আমার কয়েকটা দোষ আছে ভায়া, আমি একা একা খেতে পারি না। তেমন হলে টিভি চালিয়ে দিই। মানুষজন কথা বলেন, শুনতে শুনতে খাই। তখন মনে হয় না আমি একা। ওহো, আমি চন্দ্রশেখর গাঙ্গুলি। ইলাহাবাদের বাঙালি। ভদ্রলোক প্লেটের দিকে তাকালেন। সেখানে দুটি চিকেন স্যান্ডউইচ আর কাটাচামচ। ওঁর প্লেটের তুলনায় নিজের প্লেটটার উপর প্রায় পাহাড় রয়েছে বলে মনে হল অর্জুনের।
ভায়ার পরিচয়? স্যান্ডউইচের টুকরো মুখে তুললেন চন্দ্রশেখর গাঙ্গুলি।
আমি অর্জুন। পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি শহরে থাকি।
অর্জুন! গাঙ্গুলিমশাই মুখ তুলে কিছুক্ষণ দেখলেন, তারপর মাথা নাড়লেন, কবে আসা হল এই শহরে?
আজই।
আমি এসেছি গত সন্ধ্যায়। আমার মেয়ে-জামাই এখানেই থাকে। মেয়ে খুব অসুস্থ খবর পেয়ে এলাম। জামাই চেয়েছিল আমি ওর ওখানে উঠি। কিন্তু আমি গেলে সে বিব্রত হবেই। কাল রাতে মেয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। সে আমাকে বোঝে। গাঙ্গুলিমশাই মুখ তুললেন, কী নেবে? চা না কফি?
অর্জুন উঠে দাঁড়াল, আমি নিয়ে আসছি! কী আনব আপনার জন্য?
কফি। ব্ল্যাক এবং নো শুগার। গাঙ্গুলিমশাই বললেন।
.
কফি খেতে খেতে গাঙ্গুলিমশাই জিজ্ঞেস করলেন, কাজ নিয়ে না বেড়াতে আসা হয়েছে?
কাজ নিয়ে। আমাকে প্রথমে ডেলি নিউজ পত্রিকার অফিসে যেতে হবে।
ভায়া কি খবরের কাগজের সঙ্গে যুক্ত?।
না। ওই কাগজে বক্স নম্বর দিয়ে একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল। যে ভদ্রলোক বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, তার ঠিকানাটা দরকার।
মাথা নাড়লেন গাঙ্গুলিমশাই, পরিচিত কেউ আছেন ওখানে?
না।
তা হলে পাওয়াটা মুশকিল হয়ে যাবে। যিনি বক্স নম্বরের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার করবেন, তিনি নিজেকে গোপন রাখতে চাইবেন। খবরের কাগজ সেই গোপনীয়তা বজায় রাখে। গাঙ্গুলিমশাই বললেন, ঠিকানাটা কি খুব জরুরি?
হ্যাঁ। ওটা পেলে আমি যে জন্য লখনউ এসেছি, তা করা সম্ভব হবে।
দ্যাখো চেষ্টা করে, কফি শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন বৃদ্ধ, যদি ওরা ঠিকানা দিতে না চায়, তা হলে অক্ষয় গুপ্তার সঙ্গে দেখা করবে। তাকে আমার নাম বোলো। ও যদি বোঝে তোমার প্রয়োজন খুব গুরুত্বপূর্ণ তা হলে তোমাকে সাহায্য করতে পারে।
অর্জুন উঠে দাঁড়াল, অক্ষয় গুপ্তা কী পজিশনে আছেন?
অক্ষয় ডেলি নিউজের ম্যানেজিং ডিরেক্টর। ঠিক বারোটায় অফিসে পৌঁছোয়। চন্দ্রশেখর গাঙ্গুলি হাত নেড়ে বিদায় নিয়ে ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
ট্যাক্সিওয়ালা ডেলি নিউজ অফিসে পৌঁছে দিল অর্জুনকে। লোকটা যে তাকে বেশি পথ অনাবশ্যক ঘুরিয়ে বেশি ভাড়া নেয়নি, তা মিটার দেখে বুঝতে পারল অর্জুন। খবরের কাগজের অফিসের রিসেপশনে দাঁড়িয়ে অর্জুন বলল, বিজ্ঞাপন বিভাগের প্রধানের সঙ্গে কথা বলতে চাই। ক্লাসিফায়েড বিজ্ঞাপন।
ক্লাসিফায়েড বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য আপনি তিন নম্বর কাউন্টারে গেলেই জানতে পারবেন, রিসেপশনের মহিলা হাসিমুখে বললেন।
অগত্যা কাউন্টার খুঁজে তিন নম্বরের সামনে লাইনে দাঁড়াল অর্জুন। মিনিটপাঁচেকের মধ্যে কাউন্টারের ওপাশের ভদ্রলোক বললেন, বলুন, আপনার কী সেবা করতে পারি?
লখনউ শহর আর বিনয় বোধ হয় মিলেমিশে আছে। অর্জুন তার প্রয়োজনের কথা বলতেই ভদ্রলোক বললেন, আপনার আগে দু’জন একই উদ্দেশে এসেছিলেন। কিন্তু আমরা ক্লায়েন্টের স্বার্থ বজায় রাখতে চাই। বক্স নম্বরের বিজ্ঞাপনদাতার ঠিকানা জানানো অনৈতিক কাজ হবে। এর আগের দু’জনকে যা জানিয়েছি, আপনাকেও তাই বলছি।
ভদ্রলোকের বলার ভঙ্গি দেখে অর্জুন আর কথা বাড়াল না। সে ফিরে গিয়ে রিসেপশনিস্টকে বলল, আমি মিস্টার অক্ষয় গুপ্তার সঙ্গে দেখা করতে চাই। উনি কি অফিসে আছেন?
উনি মিটিং-এ আছেন, একটা স্লিপ এগিয়ে দিল মেয়েটি। সেটি ভরতি করে রেফারেন্স হিসেবে চন্দ্রশেখর গাঙ্গুলির নাম লিখল অর্জুন।
.
চল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করার পর এক ভদ্রলোক সামনে এসে দাঁড়ালেন। ভিজিটরদের চেয়ারে বসে ছিল অর্জুন। ভদ্রলোক বললেন, মিস্টার অর্জুন?
ইয়েস।
আমরা খুবই দুঃখিত আপনাকে এতক্ষণ অপেক্ষা করতে হল বলে। এম ডি খুব জরুরি মিটিং-এ ছিলেন। আসুন আমার সঙ্গে, উনি আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।
ভদ্রলোকের সঙ্গে লিফটে তিনতলায় উঠে এল অর্জুন। ছিমছাম অফিস। চারপাশে কাঁচের ঘর, মাঝখানে সুদৃশ্য কার্পেটমোড়া প্যাসেজ।
এম ডি লেখা ঘরের দরজায় আলতো শব্দ করে ভদ্রলোক ভিতরে ঢুকলেন, প্লিজ, কাম ইন।
ডিম্বাকৃতি একটা বিশাল টেবিলের একপ্রান্তে বসে ছিলেন যিনি, তার মাথায় একফোঁটা চুল নেই। বয়স হয়েছে, পরনে দামি সুট।
প্লিজ, বি সিটেড। হাত বাড়িয়ে চেয়ার দেখিয়ে দিলেন অক্ষয় গুপ্তা।
অর্জুন বসল।
ভদ্রলোক হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলেন, গাঙ্গুলিসাবকে আপনি চেনেন?
পরিচয় হয়েছে। উনিই বলেছেন রেফারেন্স হিসেবে আপনার নাম দিতে।
কিন্তু উনি তো এখন ইলাহাবাদে নেই!
উনি কাল সন্ধেবেলায় লখনউ এসেছেন।
আচ্ছা! বলুন, কী করতে পারি।
খাম থেকে বিজ্ঞাপনের ফোটোকপি বের করে সামনে রাখল অর্জুন, এই বিজ্ঞাপন আপনার কাগজের ক্লাসিফায়েড কলামে ছাপা হয়েছে, বক্স নম্বরে। আমি পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি শহর থেকে আসছি। যিনি বিজ্ঞাপন দিয়েছেন, তার সঙ্গে দেখা করতে চাইছি। আপনি যদি আমাকে সাহায্য করেন, অর্জুন বলল।
কাগজটার দিকে না তাকিয়ে অক্ষয় গুপ্তা বললেন, আপনি বক্স নম্বরে চিঠি লিখলে আমরা ভদ্রলোককে পাঠিয়ে দেব। তিনি প্রয়োজন মনে করলে দেখা করবেন।
এতে অনেকটা সময় চলে যাবে। আমার ক্লায়েন্ট মনে করছেন সেই সময় তার হাতে নেই। সেই জন্য আমাকে ছুটে আসতে হল।
আপনার ক্লায়েন্ট? আপনি কি ল-ইয়ার?
মাথা নাড়ল অর্জুন, না, আমি সত্যসন্ধানী।
বুঝলাম না?
কোনও সমস্যার পিছনে যে সত্যি ঘটনাটা চাপা থাকে, সেটা খুঁজে বের করাই আমার কাজ। অর্জুন গম্ভীর গলায় বলল।
তার মানে আপনি একজন গোয়েন্দা?
না, একজন গোয়েন্দা যা-যা করতে পারেন এবং করেন, তা আমি করি না। ক্লায়েন্ট দক্ষিণা দিলেই নীতিবিরুদ্ধ কোনও কাজ আমি করি না।
ভদ্রলোক এবার বিজ্ঞাপনের ফোটোকপি হাতে তুলে পড়লেন, ইন্টারেস্টিং! তারপর হাসলেন, আমার স্ত্রী বলেন যে, আমি বুড়ো হয়ে গিয়েছি। কথাটা মিথ্যে নয়। নইলে আমার কাগজে এই বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে অথচ, আমার নজর এড়িয়েছে, অক্ষয় ইন্টারকমের বোতাম টিপে জিজ্ঞেস করলেন, শর্মা, মানুষ মারা যাওয়ার পর তার শরীর টিকিয়ে রাখার ক্লেম করে এক ডক্টর বকসির বিজ্ঞাপন তুমি ছেপেছ?
ওপাশের বক্তব্য শুনে অক্ষয় গুপ্তা বললেন, নো। এটা ঠিক হয়নি। এই বিজ্ঞাপন অনেক পাঠককে উসকে দেবে। তুমি এটাকে জাস্ট এক ধরনের ফান বলে ছাপতে পারো না, ইন্টারকম বন্ধ করে অক্ষয় গুপ্তা বললেন, এই বিজ্ঞাপন দেখে আপনি সুদূর জলপাইগুড়ি থেকে ছুটে এসেছেন! ছি ছি! কিন্তু অর্জুন, আপনার ক্লায়েন্টের সমস্যাটা জানতে পারি?
ভদ্রলোককে পছন্দ হয়ে গেল অর্জুনের। সে কানাইলাল চৌধুরীর চিঠি এবং অনুরোধের বিষয়টা খুলে বলল। হতাশায় মাথা নাড়লেন অক্ষয় গুপ্তা, আপনার উচিত ছিল ওই ভদ্রলোককে এই বলে বোঝানো যে, মানুষের শরীর অবিকৃত অবস্থায় মৃত্যুর পর বেশিদিন রাখতে বিজ্ঞান এখনও সক্ষম হয়নি। উনি ওঁর স্ত্রীকে মৃত্যুর পরও চেয়ারে বসা অবস্থায় দেখলে খুশি হবেন হয়তো, কিন্তু…
উনি যুক্তি মানছেন না।
আর আপনি ওঁকে প্রশ্রয় দিতে লখনউ চলে এলেন?
না। আমি সত্যিটা জানতে চাই।
এটা যে বুজরুকি তা জানতে কি এত দূর আসতে হয়?
আপাতচোখে বুজরুকি মনে হচ্ছে। কিন্তু খোলাখুলি বিজ্ঞাপন দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে এর পিছনে অন্য কোনও সত্য লুকিয়ে থাকলেও থাকতে পারে। অর্জুন অক্ষয় গুপ্তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল।
ভদ্রলোক একটু ভাবলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, মিস্টার গাঙ্গুলি এখন কোথায়?
গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে আসার সময় ওঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল। বোধহয় মেয়েকে দেখতে গিয়েছেন, অর্জুন জানাল।
ওয়েল, মিস্টার গাঙ্গুলিকে আমি খুব রেসপেক্ট করি। উনি আপনাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন। ওঁর অনারে আপনাকে এই ডক্টর নীলমোহন বকসির ঠিকানা দেব। কিন্তু একটি শর্তে। আপনি যে সত্য আবিষ্কার করতে চাইছেন, তার বিশদ বর্ণনা আমার কাগজের জন্য লিখতে হবে। আপনাকে
আমি এই কাজের জন্য দায়িত্ব দিলে ঠিকানা দেওয়াটা আর অনৈতিক কাজ। হবে না, অক্ষয় গুপ্তা হাসলেন।
অর্জুন হেসে ফেলল, ধরুন, যা মনে হচ্ছে তার বাইরে কিছু পেলাম না। লোকটা স্রেফ ভণ্ড, তা হলে?
তা হলে তো আরও ভাল। আমার পাঠকদের সচেতন করা যাবে। এই বিজ্ঞাপন দেওয়ার অপরাধে পুলিশ লোকটাকে গ্রেপ্তার করতেই পারে।
বেশ। ঠিক আছে।
অক্ষয় গুপ্তা আবার বেল টিপলেন।