Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

গৌরী প্রণাম করিতে উদ্যত হইতেই শৈলজা দেবী পা দুইটি সরাইয়া লইয়া বলিলেন, থাক মা, অশৌচ হলে প্রণাম করতে নেই। আমি এমনই তোমাকে আশীর্বাদ করছি।

গৌরী সঙ্কুচিত হইয়া উদ্যত হস্ত সংবরণ করিয়া নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল। শৈলজা দেবী বধূর আপাদমস্তক একবার দেখিয়া লইয়া বলিলেন, কী অসুখ করেছিল তোমার, মাস্টার বলছিলেন?

গৌরী এ কথারও কোনো জবাব দিতে পারি না, বরং মাথাটি হেঁট করিয়া আরও যেন একটু সঙ্কুচিত হইয়া পড়িল। কমলেশ গৌরীর হইয়া কৈফিয়ত দিল, বলিল, কাশী থেকে কলকাতায় এসে একবার জ্বর হয়েছিল, তা ছাড়া হজমের গোলমাল, এতেই ওর শরীরটা অনেকটা খারাপ হয়ে গেছে।

শৈলজা দেবী বলিলেন, অ, আমি ভেবেছিলাম, বোধহয় শক্ত কিছু। যাকগে, এখন মুখে হাতে জল দাও মা। এই তোমার আপনার ঘর, তোমাকেই সব বুঝেসুঝে নিতে হবে। আমাকে এইবার খালাস দাও।

এ কথার জবাব কী-ই বা আছে, আর কেই বা দিবে! কমলেশ ও গৌরী উভয়েই নির্বাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। শৈলজা দেবীই আবার বলিলেন, তবে যখন আনতে পাঠানো হয়েছিল, তখনই আসাটা উচিত ছিল, তোমাদেরও পাঠানোই ছিল কর্তব্য কাজ। আমাকে নিয়ে যাই কর আর যাই বল, শাশুড়ির শেষ সময়টায় না আসা ভাল কাজ হয় নি।

কমলেশ ও গৌরীর এবার মুখ শুকাইয়া গেল, মানুষের অপরাধই অনুশোচনায় রূপান্তরিত হইয়া শাস্তি হইয়া দাঁড়ায়, তাহার উপর তাহা লইয়া অভিযোগ করিলে সে শাস্তি হইয়া ওঠে পর্বতের মত গুরুভার। শৈলজা দেবী গৌরীর মনের মধ্যে একটা আতঙ্কের মত হইয়া আছেন, আজ সেই মানুষ অভিযোগের সুযোগ পাইয়া দণ্ডদাতার মত সম্মুখে দাঁড়াইতেই ভয়ে তাহার সর্বশরীর যেন ঝিমঝিম করিয়া উঠিল। কিন্তু শৈলজা-ঠাকুরানী আর কোনো কঠোর কথা বলিলেন না; নিত্য-ঝিকে ডাকিয়া বলিলেন, নিত্য, শিবুর নতুন রঙ-করা ঘর বউমাকে খুলে দে; বউমার জিনিসপত্র সব ঘরের মধ্যে তুলে দে। শেষে বধূকে আবার বলিলেন, ঘরে চাবি দিয়ে রেখে বাছা, কাজকর্মের বাড়ি, সাবধান থাকা ভাল।

নিত্য সঙ্গে করিয়া লইয়া উপরের শিবনাথের জন্য শৈলজা দেবীর সাধ করিয়া সাজানো ঘরখানি খুলিয়া দিয়া বলিল, ঝটপাট দিয়ে পরিষ্কার করাই আছে বউদিদি। এই ছোট বেঞ্চিখানার ওপর বাক্সগুলো রেখে দিন। হাত-মুখ ধোবার জল বারান্দাতেই আছে। আর যদি কোনো দরকার পড়ে, ডাকবেন আমাকে।

গৌরী ও কমলেশ মুগ্ধ দৃষ্টিতে ঘরখানি দেখিতেছিল, ঘরের বিচিত্ৰতর শোভা, ইহা হইতেও মূল্যবান আসবাব ও গৃহসজ্জা কলিকাতার ধনীসমাজে তাহারা অনেক দেখিয়াছে, কিন্তু এ ঘরখানির বর্ণবিন্যাস হইতে পারিপাট্যের সূক্ষ্মতম ব্যবস্থাটির মধ্যেও একটি পরম যত্বের আভাস সুপরিস্ফুট। কমলেশ বলিল, বাঃ, শিবনাথের টেস্ট তো ভারি চমৎকার। সুন্দর সাজানো হয়েছে। ঘরখানি!

গৌরী এতক্ষণে প্রথম কথা বলিল, সে নিত্যকে প্রশ্ন করিল, নতুন সাজানো হয়েছে, না নিত্য?

হ্যাঁ বউদিদি, পিসিমা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে রঙ করিয়েছেন, মা সমস্ত বলে দিয়েছিলেন, পিসিমা মাকে দিয়ে ঘর সাজিয়েছিলেন।—বলিতে বলিতেই বোধকরি জ্যোতির্ময়ীকে তাহার মনে পড়িয়া গেল, একটা সুগভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সে বলিল, এমন শাশুড়ি নিয়ে আপনি ঘর করতে পেলেন না বউদিদি। আ! যদি দাদাবাবুর সঙ্গেও আসতেন, তাহলে দেখাটা হত।

গৌরীর মুখ মুহূর্তে গম্ভীর হইয়া উঠিল। অন্তরের মধ্যে ভয়ের অন্তরালে বিদ্রোহের ক্ষোভ এতক্ষণ গুমরিয়া মরিতেছিল, ব্যক্তিত্বের মধ্যে হীনতার সুযোগ পাইয়া সে বিদ্ৰোহ তাহার মাথা চাড়া দিয়া উঠিল; সে বলিল, সে দোষ-ঘাটের কৈফিয়ত কি তোমার কাছেও দিতে হবে নিত্য? যাও বাপু, তোমার কাজকর্ম থাকে তো করগে যাও। আমাকে একটু হাঁপ ছাড়তে দাও।

নিত্য বাড়ির পুরনো ঝি, বাড়ির পাঁচজনের একজনের অধিকার লইয়া সে কাজ করিয়া থাকে। নিত্য এ কথায় ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল এবং উত্তরও সে দিত, কিন্তু কমলেশের উপস্থিতির জন্য বাড়ির মর্যাদা রাখিয়া নীরবেই ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

কমলেশ যেন বিস্মিত হইয়া বলিল, ঝিটা তো ভারি অসভ্য!

গৌরীর চোখ ছলছল করিয়া উঠিল, সে বলিল, দেখ, তোমরাই দেখ। আমি এখানে থাকতে পারব না।

কমলেশ বলিল, শিবনাথকে আমি খোলাখুলি বলব নান্তি। শাশুড়িতে বউকে ধরে মারবার যুগ আর নেই, সে যুগে আর এ যুগে অনেক প্রভেদ।

সে আমি জানি কমলেশ।

কথার শব্দে গৌরী ও কমলেশ উভয়েই চমকিয়া উঠিয়া পিছন ফিরিয়া দেখিল, দরজার মুখেই দাঁড়াইয়া শিবনাথ। তৈলহীন রুক্ষ চুল, অঙ্গে অশৌচের বেশ, খালি পায়ে কখন সে উপরে আসিয়াছে কেহ জানিতে পারে নাই। শিবনাথ আবার বলিল, তোমার চেয়ে বরং বেশিই একটু জানি, সেটা হল ভবিষ্যতের কথা, বৃদ্ধবয়সে শ্বশুর-শাশুড়িদের পিঁজরেপোলের জানোয়ারের মত হাসপাতালে মরতে যাবার দিনও আগত প্ৰায়।

কমলেশের মুখ-চোখ লাল হইয়া উঠিল, অবগুণ্ঠনের মধ্যে গৌরীর মুখ বিবৰ্ণ পাংশু হইয়া গেল। আত্মসংবরণ করিয়া কমলেশ বলিল, অপরাধটা আমাদের গৌরীর অভিভাবকদের, গৌরীর নয়। এ কথাটা অতি সাধারণ লোকেও বুঝতে পারবে। তের-চোদ্দ বছরের মেয়ে নিজে থেকে শ্বশুরবাড়ি যাবার কথা কোনোমতেই প্রকাশ করে বলতে পারে না।

শিবনাথ তিক্ততার সহিত হাসিয়া বলিল, আরও কম বয়সের মেয়েতে কিন্তু জনরবের ওপর নির্ভর করে স্বামীর সঙ্গে সম্বন্ধ চুকিয়ে দেবার কথা লিখতে পারে, এইটে আরও আশ্চর্যের কথা।

রুদ্ধ ঘরে জানোয়ারকে পুরিয়া মারিলে সে যেমন মরিয়া হইয়া ক্ষিপ্ত হইয়া ওঠে, কমলেশের অবস্থা হইয়া উঠিতেছিল সেইরূপ, সে বলিয়া উঠিল, সে কথা সত্যি হলে সেই ব্যবস্থাই হত। অন্নবস্ত্রের কাঙাল হয়ে আমরা মেয়ের বিয়ে দিই নি। অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থা করে দেবার মত অবস্থা আমাদের আছে।

শিবনাথের মাথার মধ্যে দৰ্প করিয়া আগুন জ্বলিয়া উঠিল। কিন্তু ক্ৰোধ ভয় আনন্দ সুখ দুঃখ প্রভৃতি সকল কিছুর বিহ্বলতার উর্ধ্বে জাগ্ৰত থাকিবার মত শিক্ষার চেতনা তাহার আয়ত্ত হইয়া গিয়াছে, বিশেষ করিয়া এ কয় মাসের শিক্ষায় সাহচর্যে, কয়দিন আগে একটি মানুষের হাসিমুখে মৃত্যুবরণের প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্তে। সেই চেতনার নির্দেশে সে আপনাকে সংবরণ করিয়া সঙ্গে সঙ্গেই কোনো উত্তর দিয়া বসিল না, কমলেশের মুখ হইতে দৃষ্টি ফিরাইয়া লইবার জন্যই সে গৌরীর দিকে চাহিল, চোখের জলে তাহার ভয়বিবৰ্ণ মুখখানি ভাসিয়া গিয়াছে, এই বাদানুবাদের উগ্রতার মধ্যে তাহার মাথার অবগুণ্ঠন প্রায় খসিয়া পড়িয়াছে। শিবনাথের সংযমে আবদ্ধ বিক্ষুব্ধ মনের উপরের উত্তপ্ত বায়ুপ্রবাহ যেন গৌরীর অবর্ষণের ধারায় খানিকটা শীতল হইয়া শান্তও হইয়া গেল। সে অল্প একটু হাসিয়া বলিল, তোমরা ধনী, তোমরা হয়ত তা পার। কিন্তু গরিবের স্ত্রী তা পারে কি না, সেটা বরং তার কাছ থেকেই আমি শুনব। তুমি আমার কুটুম্ব, আমার বাড়ির ক্রিয়া-কর্ম উপলক্ষে এসেছ, কটু কথা বললেও সেটা আমার চুপ করে সহ্য করাই উচিত।

কমলেশ এ কথার কোনো উত্তর দিল না, অবরুদ্ধ ক্রোধে সে চুপ করিয়া নানা অদ্ভুত কল্পনা করিতে আরম্ভ করিল। শিবনাথকে তাহাদের ব্যবসায়ের মধ্যে একটা চাকরি দিয়া তাহার টেবিলের সম্মুখে দাড় করাইয়া কৈফিয়ত লইলে কেমন হয়? অথবা টাকা ধার দিয়া ঋণজালে আবদ্ধ করিয়া নির্মম আকর্ষণে টানিলে কেমন হয়?

শিবনাথ বলিল, আচ্ছা, তোমরা এখন বিশ্রাম কর। আমি বাইরে যাই, অনেক কাজ রয়েছে।—বলিয়া সে চলিয়া গেল।

কমলেশ বলিল, তুই স্পষ্ট বলবি নান্তি, এখানে তুই থাকতে পারবি না। শিবনাথ চলুক কলকাতায়, কয়লার ব্যবসায় এখন লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন ও ব্যবসা করুক, টাকা না থাকে। আমরা ধার দিচ্ছি। ব্যবসা না পারে, চাকরি করুক, তুইও সেখানে থাকবি। এ সামান্য জমিদারি, ফুঁ দিলে উড়ে যায়, এ নিয়ে পড়ে থাকলে কি হবে? পিসিমা এখানে থাকুন, খানদান, আর চোখ রাঙান ওই ঝি-চাকরদের ওপর।

গৌরী এতক্ষণে আপনাকে সামলাইয়া লইয়াছিল, অ্যাঁচলে চোখ মুছিয়া কী বলিতে গিয়া চুপ করিয়া গেল, শঙ্কিতভাবে মৃদুস্বরে বলিল, সিঁড়িতে পায়ের শব্দ উঠছে।

কমলেশ ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিয়া দেখিল, সিঁড়ির বাঁকের মুখে একটা মানুষের ছায়া সিঁড়ি হইতে দেওয়ালের গায়ে উঠিয়া আবার ওদিকে অদৃশ্য হইয়া গেল। কিছুক্ষণ পর রতন আসিয়া গৌরীকে ডাকিয়া বলিল, নেমে এস, ঘাটে যেতে হবে, শিবনাথের হবিষ্যিও তোমাকে চড়িয়ে দিতে হবে।

গৌরী শঙ্কিত অন্তরে নিচে নামিয়া গেল। শৈলজা-ঠাকুরানী অতি মিষ্টস্বরে বলিলেন, স্নান করে ফেল মা, স্নান করে হবিষ্যি চড়াতে হবে। এ ঘরদোর সবই তোমার, শিবুর মাতৃদায়, তোমার কি ওপরে বসে থাকলে চলে?

মিষ্ট কথায় আশ্বস্ত হয়ে গৌরী হৃষ্ট হইয়া উঠিল, সে আনুগত্য স্বীকার করিয়া বলিল, শ্রীপুকুরের ঘাটে নাইতে হবে তো পিসিমা।

হ্যাঁ, রতন যাচ্ছে তোমার সঙ্গে।

শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানটি বৃষোৎসর্গ হইলেও সাধারণ স্তরের ক্রিয়া হয় নাই। মানিকবাবু তাহার মাতৃশ্ৰাদ্ধের অনুরূপ ফর্দ করিয়াছিলেন—বোধকরি অতি কঠোর নিষ্ঠার সহিতই অনুরূপ ফর্দ করিয়াছিলেন। ব্যয় সমারোহে সমগ্র ক্রিয়াকাণ্ডটি আকারে বিপুলকায় হইয়া উঠিল। কিন্তু শৈলজা-ঠাকুরানী একাই যেন দশভুজা হইয়া উঠিলেন। তাঁহার ব্যক্তিত্বের আভিজাত্য কাহারও অজ্ঞাত নয়, বৈষয়িক কর্মে তাহার জন্মগত তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় সকলের সুবিদিত, কিন্তু এমন কঠোর পরিশ্রম-পারগতার পরিচয় সম্পূর্ণ অভিনব, সর্বোপরি ওই দৃপ্ত তেজস্বিনী মেয়েটির এমন নমনীয় শান্তস্নিগ্ধ ব্যবহার দেখিয়া সকলেই বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া গেল। শুধু তাই নয়, অকস্মাৎ তিনি যেন মমতায় পরম স্নেহময়ী হইয়া উঠিয়াছেন। সেদিন নিত্য-ঝি প্রকাণ্ড বড় গুড়ের জালা হইতে গামলায় গুড় বাহির করিতেছিল, একটা গামলা পরিপূর্ণ হইয়া গেলে সে আসিয়া পিসিমাকে বলিল, এক গামলা গুড় বের করেছি, আরও কি বের করব পিসিমা?

শৈলজা দেবী বলিলেন, না, আর এখন থাক।—বলিয়াই তিনি বলিলেন, এমন করেই কি বেহুশ হয়ে কাজ করে মা? মুখময় যে গুড় লেগেছে রে, মুছে ফেল।

নিত্য বা হাতের কজি ও কনুইয়ের মধ্যবর্তী অংশটা দিয়া মুখটা মুছিয়া লইল। পিসিমা বলিলেন, হল না রে। সরে আয় আমার কাছে, আয় না, তাতে কি দোষ আছে?—বলিয়া নিজেই একখানা গামছা দিয়া কন্যার মতই নিত্যর মুখখানা মুছাইয়া দিলেন।

রতন একান্তে নিত্যকে বলিল, ঠাকরুন আর বেশি দিন নয় নিত্য, এ যে অসম্ভব মতিগতি, সে মানুষই আর নয়। মামীমাই ননদের আশেপাশে ঘুরছে নিত্য, দেখিস তুই, ছ মাসের বেশি ঠাকরুন আর নয়।

নিত্য একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ও-কথা বোলো না রতনদি, সংসারটা তা হলে ভেসে যাবে।

শ্রাদ্ধের দিন খাওয়াদাওয়া যখন শেষ ইহল, রাত্রি তখন বারটা। শৈলজা দেবী তখনও পর্যন্ত অভুক্ত, সে সংবাদ জানিত শুধু নিত্য ও রতন। রতন ব্যস্ত হইয়া বলিল, মাসিমা, এবার আপনি কিছু মুখে দিন, এখনও পর্যন্ত তো কিছু খান নি।

শৈলজা বলিলেন, দে তো মা, এক গেলাস ঠাণ্ডা জল আমায় দে তো। ভেতরটা শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গিয়েছে।

রতন এক গ্লাস জল আনিয়া তাহার হাতে দিয়া বলিল, দুটা ভাতে-ভাত চড়িয়ে দিই মাসিমা, সমস্ত দিন কিছু খান নি।

আলগোছে গ্লাস তুলিয়া ঢকটক করিয়া জলটা নিঃশেষে পান করিয়া তিনি বলিলেন, না রতন, অনেক খেয়েছি মা, আর মুখে কিছু রুচবে না।

সবিস্ময়ে রতন বলিল, সে কী? কখন কী খেলেন আপনি?

শৈলজা বিচিত্ৰ হাসি হাসিয়া বলিলেন, স্বামী, পুত্ৰ, ভাই, ভাজ, অনেক খেলাম মা বসে বসে! আর ক্ষিদে থাকে, না থাকতে আছে? বউয়ের শ্রাদ্ধের অন্ন আমাকে খেতে হয় রতন? বলিয়া তিনি ধীরে ধীরে আপন শয়নকক্ষের অভিমুখে সিঁড়ি দিয়া অগ্রসর হইলেন।

এ কথার উত্তর রতন খুঁজিয়া পাইল না। নিত্য বলিল, আজ তো পায়ে তেল নেন নি, পায়ে তেল দিয়ে দিই।

শৈলজা দেবীর এ অভ্যাসটুকু চিরদিনের অভ্যাস। এটুকু না হইলে রাত্রে তাহার ঘুম পর্যন্ত হয় না। শৈলজা দেবী আজ বলিলেন, না থাক।

নিত্য ব্যস্ত হইয়া বলিল, না পিসিমা, রাত্রে আপনার ঘুম হবে না।

তিনি শান্তভাবে প্রতিবাদ করিয়া বলিলেন, না নিত্য, ভোগের মধ্যে থেকে থেকে ভগবানকে আমি দূর করে ফেলেছি মা, নিজে হয়ে উঠেছি দেবতা, ওসব আর নয়, সেবা আর আমি কারও নোব না। আপন শয়নঘরের দরজায় আসিয়া আবার তিনি ফিরিলেন, বারান্দার রেলিঙে ভর দিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, শিবনাথ শুয়েছে নিত্য? কোথায় শুয়েছে?

তিনি আর বউদির ভাই মায়ের ঘরে শুয়েছেন পিসিমা।

বউমার কাছে তুই শুবি তো?

হ্যাঁ।

কাল থেকে শিবুর বিছানা শিবুর ঘরে করে দিবি, বুঝলি?

নিত্য একটু ইতস্তত করিয়া বলিল, বউদিদি যে বলছিলেন, কলকাতায় যাবেন কাল পরশু।

হাসিয়া শৈলজা বলিলেন, যাব বললেই কি যাওয়া হয় বাছা? তার ঘরদোর কে নেবে, কে চালাবে?

তারপর আবার বলিলেন, কেষ্ট সিং আর বেহারী বাগদী বাড়িতে ওয়েছে তো? ওদের দরজা বন্ধ করে দিতে বল। একটু সজাগ হয়ে থাকতে বলে দে। রাজ্যের জিনিস বাইরে পড়ে আছে।

সকল কাজ সুশেষ করিয়া তিনি দরজা খুলিয়া শয়নকক্ষে প্রবেশ করিলেন।

পরদিন প্রাতঃকালে উঠিয়াই তিনি রাখাল সিংকে ডাকিয়া বলিলেন, শ্ৰাদ্ধ-শান্তি তো চুকে গেল সিংমশায়, এখন একটি জিনিস আমাকে বুঝিয়ে দিন দেখি, মোট কত টাকা খরচ হল? আমি একবার সিন্দুক খুলে মজুত টাকা আর খরচের হিসেবটা মিলিয়ে দেখি।

রাখাল সিং বলিলেন, তা কী করে হবে? এখনও যে অনেক খরচ বাকি রয়েছে, তা ছাড়া এতবড় হিসেব একদিনে কি খাড়া করা যায়?

সস্নেহে অনুরোধ করিয়া শৈলজা বলিলেন, যায় বৈকি সিংমশায়, ধর্মরাজের দরবারে এতবড় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের হিসেব-নিকেশ যখনই দেখবে, তখনই দেখবে কড়াক্রান্তিতে মিল। আপনারা কায়স্থেরা হলেন চিত্রগুপ্তের বংশধর, আপনারা মনে করতে না পারেন কী? আমার পাপপুণ্যের খতিয়ান করে আমাকে শুনিয়ে দুটি করে দিন আপনি।

রাখাল সিং বিষম সমস্যায় পড়িলেন, তীক্ষ্ণবুদ্ধি জমিদারের মেয়েটির বিষয়জ্ঞান টনটনে হইলেও হিসাব-নিকাশ যে কী বস্তু, কত জটিল, তাহা তো তিনি বুঝিবেন না! আর মুখের কথায়। সে কথা তাহাকে বুঝানোেৱ বা যায় কীরূপে! অবশেষে তিনি বলিলেন, আপনি বরং মাস্টারকে ডেকে জিজ্ঞাসা করুন, তাই কি হয়?

হাসিয়া শৈলজা বলিলেন, মাস্টারকে ডেকে আর কী করব? আমি বলছি কি, আমি বাড়ি থেকে দফায় দফায় যত টাকা দিয়েছি, সেগুলো তো গোলমেলে নয়, সেইগুলো যোগ দিয়ে। আমাকে বলে দিন আপনি নিজে হাতে কত টাকা খরচ করেছি। তার বেশি দায়িত্ব তো আমার নয়, সেই খরচে আর মজুতে মিলে গেলেই তো আমি খালাস। তারপর আপনারা আবার সে টাকা নিয়ে যে যেমন খরচ করেছেন, সে হিসেব আপনাদের আলাদা হবে।

শিবনাথ অভ্যাসমত প্রত্যুষে উঠিয়াই বাহিরে গিয়াছিল, সে ফিরিয়া বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিল। পিসিমা তাহাকে ডাকিয়া বলিলেন, শিবু, রাখাল সিংয়ের সঙ্গে বসে একবার হিসেব মিলিয়ে দেখতে হবে। কত টাকা আমি বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি, আর সিন্দুক খুলে দেখ, মজুতই বা কত আছে, তা হলেই মোটামুটি হিসেবটা ঠিক হবে। এই চাবিটা নে, সিন্দুকটা খুলেই আগে দে মজুত কত।

সিন্দুকের চাবিটা তিনি শিবুর হাতেই তুলিয়া দিলেন। তারপর টাকাকড়ি গুনিয়া দেখিয়া একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, একটা বোঝা নামল বাবা। এইবার বাসনপত্রগুলো। ওরে নিত্য, বউমাকে একবার ডাক তো।

গৌরী আসিয়া দাঁড়াইতেই পিসিমা বলিলেন, বাসনগুলো দেখে তুমি মিলিয়ে নাও দেখি। এই নাও, চাবি নাও, বাসনের ঘরের দরজা খোল। বলিয়া তাহার হাতে এক গোছা চাবি তুলিয়া দিলেন।

হিসাব-নিকাশ করিতে করিতে বারবার শিবনাথের ভুল হইতেছিল। এসব কিছুই তাহার ভাল লাগিতেছিল না। শ্রাদ্ধের কয়দিন কর্মব্যস্ত মুহুর্তগুলি ঝটিকার বেগে বহিয়া চলিয়া গিয়াছে, তাহার নিজের সকল শক্তিও এই কর্মসমারোহের মধ্যে পরিব্যাপ্ত ছিল; চিন্তার অবসর ছিল না, প্রবৃত্তি-অপ্রবৃত্তি সমস্ত যেন কোথায় আত্মগোপন করিয়া ছিল। আজ অবসর পাইয়া মন তাহার জাগিয়া উঠিয়াছে। মনে মনে সে একটা গভীর উদাসীনতা অনুভব করিল। কিছুই যেন তাহার ভাল লাগিতেছিল না।

রামরতনবাবু বলিলেন, এখন থাক্ শিবনাথ, শরীর মন দুই তোর দুর্বল হয়ে পড়েছে। ইউ রিকোয়্যার রেস্ট—অ্যাবসলিউট রেস্ট।

আপনার মুণ্ডিত মস্তকে হাত বুলাইয়া শিবনাথ বলিল, আসলে যেন কোনো কিছুতে প্রবৃত্তি হচ্ছে না মাস্টারমশায়, ভাল লাগছে না কিছু।

রাখাল সিং বলিলেন, থাক তা হলে এখন। আমি বরং যোগ দিয়ে ঠিক করে রাখি, আপনি এরপরে একবার চোখ বুলিয়ে নেবেন।

শিবনাথ উঠিয়া গিয়া একটা ডেক-চেয়ারের উপর আপনাকে এলাইয়া দিয়া বলিল, তাই হবে।

রামরতনবাবু মৃদুস্বরে বলিলেন, শিবু, একটা কথা তোকে না বলে আমি পারছি না। আমার মনে হচ্ছে, এজন্য আমিই হয়ত রেসপন্সিব্‌ল।

নিতান্ত অন্যমনস্কভাবে শিবু বলিল, বলুন।

আমার মনে হচ্ছে আমার শিক্ষার দোষেই জীবনে তুই এমন ডেঞ্জারাস পথ বেছে নিয়েছি। আমি বিশেষ কিছুই জানি না, তবু সেই মেয়েটির কাছে শুনে, সুশীলবাবুর বাড়ির আবহাওয়া দেখে আমি অনুমান করেছি। ইউ মাস্ট লিভ ইট, মাই বয়।

শিবনাথের চোখ মুহূর্তে প্রদীপ্ত স্থিরদৃষ্টিতে সম্মুখের আকাশের নীলিমায় নিবদ্ধ হইল, সে চোখের দৃষ্টি অতলস্পর্শী গভীর। তাহার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের স্পন্দনের অস্থিরতাটুকু পর্যন্ত গভীরতার গাম্ভীর্যে স্তব্ধ প্রশান্ত।

রামরতন ডাকিলেন, শিবু!

স্যার?

ইউ মাস্ট গিভ মি ইওর ওয়ার্ড অব অনার, আমায় কথা দে তুই।

পারি না স্যার। আজও ভেবে আমি ঠিক করতে পারি নি, তবে আমি পথ খুঁজছি।

আমার কথাতেও তুই নিবৃত্ত হতে পারিস না শিবু?

অতি ক্ষীণ হাস্যরেখা শিবুর অধরে ফুটিয়া উঠিল, সে বলিল, একজন মহামানব অতিমানব আমাকে বলেছেন, এ পথ ভ্রান্ত। কিন্তু অন্য পথের সন্ধান তিনি দিতে পারেন নি। আমি সেই পথ খুঁজছি।

রামতন একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া নীরব হইয়া গেলেন, তাঁহার অন্তরটা যেন অসহ দুঃখে ভরিয়া উঠিল। অতিমানব, মহামানব। কে সে? কেমন ব্যক্তি সে? বারবার সেই প্রশ্ন তাহার। অন্তরে ঘুরিয়া মরিতেছিল, কিন্তু তবু তিনি মুখ ফুটিয়া সে কথা জানিতে চাহিলেন না। তিনি বেশ জানেন, শিবু বলিবে না। পৃথিবীর কোনো শক্তি ওই ছেলেটির কাছে তাহা আদায় করিয়া লইতে। পারিবে না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই শিবনাথ সে প্রশান্ত গভীর চিন্তা হইতে জাগিয়া উঠিল। মনের মধ্যে সেই কিছু ভাল না লাগার অস্থিরতা। ডেক-চেয়ারটা ছাড়িয়া সে উঠিয়া পড়িল; দীর্ঘদিন পর আস্তাবলে আসিয়া ঘোড়াটার সম্মুখে দাঁড়াইল। গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ মসৃণ শরীরে সূর্যের আলো যেন ঠিকরাইয়া পড়িতেছে। দুরন্ত অস্থিরতায় চঞ্চল পায়ের খুরের আস্ফালনে আস্তাবলটা ধুলায় ভরিয়া উঠিয়াছে। এমন সুন্দর বাহনটিও তাহাকে আজ আকৰ্ষণ করিতে পারিল না। সে অন্যমনস্কভাবেই ঘুরিয়া ঘুরিয়া বাড়িটার সর্বস্থান যেন সন্ধান করিয়া ফিরিতে আরম্ভ করিল, কোথায় কোনখানে এ অস্থিরতার সান্ত্বনা লুকাইয়া আছে।

মালতীলতাটা সাদা ফুলে ভরিয়া উঠিয়াছে। খামার-বাড়িটা ঘাসে ঘাসে পুরু সবুজ গালিচার মত নরম। ঘাস মাড়াইয়া মাড়াইয়া সে শ্রীপুকুরের ঘাটে আসিয়া উঠিল। আশ্বিনের প্রারম্ভে পুকুর ভরা কালো জল টলমল করিতেছে।

সে আসিয়া বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিল। পিসিমা আহ্নিকে বসিয়াছেন। বাসনের ঘরের দরজায় গৌরী দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। সে উপরে উঠিয়া গেল। সাজানো ঘরখানার দরজাটা খোলা, ঘরের মধ্যে নিত্য-ঝি রাজ্যের বিছানা স্থূপীকৃত করিয়া ঝাড়া-মোছা করিতেছিল। শিবনাথ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। ঘরখানার চারদিক একবার দেখিয়া মেঝের উপর জড়ো করা বিছানাগুলির দিকে চাহিয়া সে বলিল, এগুলো নামালি কেন?

নিত্য পুলকিত হাসি হাসিয়া বলিল, নতুন করে বিছানা হবে, আপনি শোবেন এ ঘরে।

শিবনাথ তীক্ষ্ণ স্থিরদৃষ্টিতে নিত্যর দিকে চাহিয়া রহিল, নিত্যর হাসিতে কথায় একটা ইঙ্গিত রহিয়াছে। অকস্মাৎ এক মুহূর্তে তাহার মনের সকল অস্থিরতা দেহের প্রতি শোণিত-বিন্দুতে সঞ্চারিত হইয়া গেল, শোণিত কণিকাগুলি যেন উত্তাপে উত্তেজনায় কুঙ্কুমের মত ফাটিয়া পড়িতেছে।

নিত্য আবার হাসিয়া বলিল, আমার কিন্তু শয্যে-তুলুনি দিতে হবে দাদাবাবু।

শিবনাথ অস্থিরতর পদক্ষেপে দ্রুত ঘর হইতে বাহির হইয়া নামিয়া চলিয়া আসিল। কাছারিতে আসিয়া আবার সে ঘোড়াটার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। ঘোড়াটার কপালে মৃদু চাপড় মারিয়া তাহাকে আদর জানাইয়া বারান্দায় আসিয়া ডেক-চেয়ারটায় বসিল।

রাখাল সিং বলিলেন, আমার যোগ দেওয়া হয়ে গেল। মজুতে খরচে তহবিল ঠিক মিলই আছে। দেখুন একবার আপনি।

গভীর অনিচ্ছা জানাইয়া ঘাড় নাড়িয়া সে বলিল, না না, ও থাক। মিলে যখন গেছে তখন আর দেখব কী?

মাস্টার গম্ভীরভাবে পদচারণা করিতেছিলেন। শিবনাথ হিসাবের প্রসঙ্গ ত্যাগ করিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। কিছুক্ষণ পর অকস্মাৎ সে ডাকিল, নিতাই!

সহিস নিতাই আসিয়া দাঁড়াইতেই সে বলিল, ঘোড়ার সাজ পরিষ্কার করে রাখ। চারটের সময় ঘোড়ার পিঠে সাজ দিবি।

সতীশ আসিয়া বলিল, চান করুন, অনেক বেলা হয়েছে।

শিবনাথ বলিল, তেল গামছা নিয়ে আয়, আজ শ্রীপুকুরে নাইব, সাঁতার কাটব খানিকটা।

সাঁতার কাটিয়া একেবারে ক্লান্ত হইয়া তবে সে উঠিল, চোখে তখন যেন ঘুম ধরিয়া আসিয়াছে।

দুরন্ত গতিতে সে ঘোড়াটাকে ছাড়িয়াছিল; বলিষ্ঠ দৃঢ় দীর্ঘদেহ বাহনটির দুরন্ত গতিবেগের সঙ্গে সঙ্গে তাহার মন উচ্ছ্বসিত আনন্দে ভরিয়া উঠিতেছিল। দেহের পেশিগুলি সবল আন্দোলনের দোলায় দোলায় কঠিন পরিপুষ্টিতে জাগিয়া উঠিল। বাড়ি যখন ফিরিল, তখন তাহার সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজিয়া গিয়াছে। সহিসের হাতে ঘোড়াটাকে ছাড়িয়া দিয়া কাছারির বারান্দায় আসিয়া ডেক-চেয়ারটায় বসিয়া বলিল, ঘোড়াটার চালু হয়েছে চমৎকার!

রাখাল সিং চিন্তাকুল হইয়া বসিয়া ছিলেন, ওদিকে একখানা চেয়ারে মাস্টার বসিয়া ছিলেন, তাহার মুখেও অস্বাভাবিক গাম্ভীর্য। শিবনাথের কথায় কেহ কোনো উত্তর দিল না। শিবনাথ এদিক ওদিক চাহিয়া ডাকিল, সতীশ!

সতীশের এ সময়টি মৌতাতের সময়। সে একটি নির্জন আড়ালে বসিয়া গাঁজা টিপিতেছিল। শিবনাথের ডাক শুনিবামাত্র তাহার গঞ্জিকা-মৰ্দনচঞ্চল হাত দুইখানি স্তব্ধ হইয়া গেল। কিন্তু সে মুহূর্তের জন্য, মুহূর্ত পরেই আবার তাহার হাত চলিতে লাগিল, কোনো উত্তর সে দিল না।

শিবনাথ কোনো উত্তর না পাইয়া নিজেই উঠিল। রাখাল সিং বলিলেন, একবার বাড়ির দিকে যান আপনি। পিসিমা—

শিবনাথ তাঁহার কথার মধ্যপথেই বাধা দিয়া বলিল, বাড়িতেই যাচ্ছি আমি।

বাড়ির দরদালানে পিসিমা বসিয়া গৌরীকে কিছু বলিতেছিলেন, শিবনাথ বাড়িতে প্ৰবেশ। করিতেই তিনি বলিলেন, শিবু, তোর জন্যেই আমি পথ চেয়ে রয়েছি বাবা, তোর সঙ্গে আমার কথা আছে।

শিবনাথের মনের উত্তেজনা তখনও শান্ত হয় নাই, সে অল্প উচ্ছাসের সহিত বলিল, আসছি পিসিমা, কাপড়-জামাগুলো পালটে আসি, ঘামে একেবারে ভিজে গিয়েছে। আজ ঘোড়ায় চড়েছিলাম পিসিমা, ওঃ ঘোড়াটা যা চমৎকার হয়েছে!—বলিতে বলিতেই সে দ্রুতপদে উপরে উঠিয়া গেল। পা-হাত ধুইয়া সাবান দিয়া সে মুখ ধুইয়া ফেলিল, ঘর্মাক্ত কাপড়-জামা ছাড়িয়া পরিল জরিপাড় একখানি মিহি ধুতি ও একটি চুড়িদার পাঞ্জাবি। নিচে নামিয়া সে পিসিমার কোল। ঘেষিয়া ছোট ছেলের মতই বসিয়া পড়িল, বলিল, বল।

পিসিমা তাহাকে ভাল করিয়া দেখিয়া একটু হাসিলেন, সস্নেহে তাহার গায়ে হাত বুলাইয়া বলিলেন, তোর কাছে আমি একটি জিনিস চাইব শিবু। বল, দিবি।

শিবনাথ হাসিয়া ফেলিল। পিসিমার পাশেই বসিয়া গৌরী; মুহূর্তে শিবনাথ বুঝিয়া লইল, পিসিমা কী চাহেন,গৌরীর দোষের জন্য ক্ষমা। গৌরীর ঘোমটার ফাঁক দিয়া একটি পুলকিত চকিত কটাক্ষ হানিয়া সে বলিল, প্রতিজ্ঞা করতে হবে? বেশ, তাই করলাম, বল কী দিতে হবে?

নিত্য সহসা বলিয়া উঠিল, না দাদাবাবু।

শৈলজা ডাকিয়া বলিলেন, নিত্য!

নিত্য স্তব্ধ হইয়া গেল। শিবু একটু বিস্মিত হইল, সে ভাল করিয়া কিছু বুঝিবার পূর্বেই পিসিমা বলিলেন, আমায় ছুটি দে বাবা।

শিবনাথের মুখ বিবর্ণ হইয়া উঠিতেছিল, সে সবিস্ময়ে শুধু দুইটি অক্ষরে একটি প্রশ্ন করিল, ছুটি?

হ্যাঁ, ছুটি। আমার ডাক এসেছে বাবা, আমায় যেতে হবে; আমায় এইবার মুক্তি দাও। তোমরা।

এক ঝলক হিমতী বাতাস আসিয়া যেন শিবুকে মুহূর্তে অসাড় করিয়া দিল। পিসিমা বলিলেন, আমি কাশী যাব বাবা। আজ কদিন থেকেই আমার গুরু যেন স্বপ্নে আমাকে বলছেন, আর কতদিন আমায় ভুলে থাকবি? আয়, তুই কাশী আয়।

ধীরে ধীরে আত্মসংবরণ করিয়া আত্মস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিবর মনে সমস্ত দিনের উষ্ণ আবেগ বিদ্রোহের শিক্ষা ভুলিয়া জ্বলিয়া উঠিল। তাহার মনে হইল, গুরুর আহ্বান নয়, গৌরীর আগমনই তাঁহার এই বৈরাগ্যের হেতু। চোখ-মুখ তাহার রক্তোচ্ছাসে থমথমে হইয়া উঠিল। কিন্তু উত্তেজনার মুখে আত্মসমর্পণ করা তাহার স্বভাব নয়, সে কঠোর সহ্যমের সহিত আপনাকে শান্ত করিয়া স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। তারপর বলিল, আমাদের বন্ধন কি তোমাকে পীড়া দিচ্ছে। পিসিমা? না, ওপরের আকর্ষণে এ বন্ধন আর সত্যিই রাখা যায় না?

পিসিমা চমকিয়া উঠিলেন, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শিবুর মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, এতকাল পর আমার কথা তোর মিথ্যে বলে মনে হল শিবু? সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন।

শিবু ধীর স্বরেই বলিল, স্বপ্ন মনের বিকার পিসিমা, সত্যি হয় না কখনও, তাই বলছি।

মনের জটিল রহস্যময় গহনে যে কামনা গুরু-মূর্তিতে শৈলজা দেবীকে আহ্বান জানাইয়াছে, তাহাই তাহার মনকে করিয়া তুলিয়াছে শান্ত, দৃঢ়তায় অনমনীয় কঠিন, কোনোরূপেই তাহার পরিবর্তন সম্ভবপর নয়। তিনি অবিচলিত দৃঢ়তার সহিত বলিলেন, ও কথা বোলোনা বাবা শিবু। তুমি বিশ্বাস না কর, আমি বিশ্বাস করি। তাকে আমি প্রত্যক্ষ দেখেছি, তার আদেশ আমি অবহেলা করতে পারি না। আমি যাব, তুমি বাধা দিও না।

শিবু বহুক্ষণ নীরবে বসিয়া রহিল, মনের আকাশের কোন্ অদৃশ্য কোণে মেঘ জমিয়া আছে, সেখান হইতে বিদ্যুৎ-চমকের আভা মুহুর্মুহুঃ বিচ্ছুরিত হইতেছিল, শিক্ষা-দীক্ষা সমস্ত কিছুর চোখ যেন সে আভায় ধাধিয়া যাইতেছে। তবুও সে ধীরভাবে বিচার করিতে চেষ্টা করিল। সে যেন ভাল করিয়াই অনুভব করিল, গৌরী ও পিসিমার একত্রে বাস অসম্ভব। কেহ কাহাকেও সহ্য করিতে পারিবে না।

পিসিমা আবার বলিলেন, শিবু!

পিসিমা!

তুমি আমায় মুক্তি দিতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছ।

শিবুর অন্তর একটা প্রদীপ্ততর বিদ্যুৎ-চমকে ঝলসিয়া উঠিল, এবার সুদূরশ্ৰুত মেঘগর্জনের ধ্বনিও যেন শোনা গেল; গম্ভীর স্বরে শিবু বলিল, বেশ তাই হবে। যাবে তুমি।

গলাটা এবার পরিষ্কার করিয়া লইয়া শৈলজা বলিলেন, আজ ভোরেই আমি যাব বাবা। আমি মাস্টারকে বলে রেখেছি, সে-ই রেখে আসবে।

উত্তরে শিবু কেবল বলিল, আজই।

হ্যাঁ, আজই। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া শৈলজা দেবী আবার বলিলেন, ওপরের আকর্ষণ যদি না হয় শিবু, বিশ্বনাথ আমাকে স্থান দেবেন কেন। মরতেও আবার আমাকে ফিরে আসতে

হবে।

শিবু বলিল, বেশ, তাই হবে, আজই যাবে। সঙ্গে সঙ্গেই সে নিত্যকে ডাকিয়া বলিল, নিত্য, মাস্টারমশায়কে ডাক্ তো। রতনদি, তুমি একবার আলোটা ধর তো ভাই, আয়রন চেস্টটা খুলতে হবে।

টেবিলের উপর রেশমি নীলাভ শেড দেওয়া একটি টেবিলল্যাম্প জ্বলিতেছিল। শিবনাথ স্তব্ধ হইয়া বসিয়া পিসিমার কথাই ভাবিতেছিল। কিন্তু চিন্তার মধ্যে একটি ধারাবাহিকতা ছিল না। থাকিয়া থাকিয়া চঞ্চল হইয়া ব্যগ্ৰ চকিত দৃষ্টিতে সম্মুখের দুয়ারের দিকে চাহিয়া দেখিতেছিল–গৌরী আসিবে। কথাটা মনে করিবামাত্র দেহের শিরায় শিরায় এক শিহরন ছুটিয়া চলিতেছে।

ঝুনঝুন, খসখস—একটা শব্দ সিঁড়ির উপর বাজিয়া উঠিতেই অস্থির উত্তেজনায় শিবনাথ উঠিয়া দাঁড়াইল। সকল স্মৃতি যেন বিস্মৃতির অন্ধকারের মধ্যে বিলুপ্ত হইয়া যাইতেছে। সমস্ত দৃষ্টির মধ্যে গৌরী এবং সে ছাড়া আর কাহারও যেন অস্তিত্ব পর্যন্ত নাই। পায়ের তলায় ধরিত্রী যেন দুলিতেছে, গৌরী এবং তাহাকে দোলা দেবার জন্যই যেন দুলিতেছে। অস্ফুট কণ্ঠে সে আবৃত্তি করিল,-দে দোল-দোল, প্রিয়ারে আমার পেয়েছি আজিকে, ভরেছে কোল! দে দোল-দোল!

সেই মুহূর্তটিতেই শঙ্কিত সন্তর্পিত পদক্ষেপে গৌরী ঘরে প্রবেশ করিল; তাহার কাপড়ের মৃদু সেন্টের গন্ধে শিবনাথের বুক ভরিয়া গেল, চুড়ির মৃদু শব্দে তাহার মনে সুর জাগিয়া উঠিল। টেবিলল্যাম্পের শিখাটা আরও বাড়াইয়া দিয়া সে গৌরীর দিকে চাহিল। সেই নীলাভ আলো মুখে মাখিয়া কিশোরী গৌরী শিবনাথের সম্মুখে দাঁড়াইল। তাহার পরনে নীলাম্বরী শাড়ি, গৌরবর্ণ মসৃণ ললাটে একটি গাঢ় সবুজ মণিখণ্ডের মত কাচপোকার টিপ, চোখের কালো তারায় বিচিত্র দৃষ্টি। গৌরীর সর্ব-অবয়বের মধ্যে এইটুকু শিবুর চোখে পড়িল।

গৌরীর ক্ষুদ্র বৃহৎ ত্রুটিবিচ্যুতির গুরুতর অপরাধের কৈফিয়ত লইবার জন্য যে জাগ্রত কর্তব্যজ্ঞান কঠোর তপস্বীর মত বিনিদ্র তপস্যায় মগ্ন ছিল, তাহার ধ্যান ভাঙিয়া গেল, মোহগ্ৰস্তের মত আত্মহারা হইয়া ঢলিয়া পড়িল। শিবনাথ অভিযোগ করিল না, সম্ভাষণ করিল না, নীরবে উঠিয়া দাঁড়াইয়া গৌরীকে বুকের মধ্যে টানিয়া লইল।

কতক্ষণ কাটিয়া গেল। পরস্পরের বাহুপাশে আবদ্ধ হইয়াই দুই জনে সোফাটার উপর ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। এক সময় হাতে একটা যন্ত্ৰণা অনুভব করিয়া শিবনাথ জাগিয়া উঠিল, গৌরীর খোঁপার একটি কাটা তাহার হাতের উপর বিধিবার উপক্রম করিয়াছে। ধীরে ধীরে গৌরীর মাথাটি সরাইয়া দিয়া সে হাতটা টানিয়া লইয়া আপন মনেই মৃদু হাসিল। সহসা তাহার মনে হইল বারান্দায় কে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে!

আপন অভ্যাসমত জ কুঞ্চিত করিয়া সে প্রশ্ন করিল, কে?

বারান্দা হইতে শৈলজা-ঠাকুরানীর কণ্ঠস্বর শুনিয়া শিবু চমকিত হইয়া উঠিল; তিনি প্রশ্ন করিলেন, দেখ তো বাবা, কটা বাজল? রাত তিনটে কি বাজে নি এখনও?

শিবু ঘড়িতে দেখিল, সবে বারটা বাজিতেছে। সে বলিল, এই সবে বারটা, এখনও অনেক দেরি, শোও গিয়ে এখন।

শৈলজা দেবী গিয়া বিছানায় শুইলেন। কিন্তু আবার কী মনে করিয়া উঠিয়া বসিয়া জপ করিতে আরম্ভ করিলেন।

রাত্রি তিনটার গাড়িতে শৈলজা-ঠাকুরানী কাশী রওনা হইয়া গেলেন। শিবনাথ সঙ্গে সঙ্গে স্টেশন পর্যন্ত গিয়া তাহাকে ট্রেনে তুলিয়া দিল।

শেষরাত্রির অন্ধকারে কাহারও মুখ স্পষ্ট দেখা যাইতেছিল না, তবু প্রণাম করিয়াও শিবু নত মাথা তুলিল না, বলিল, পিসিমা!

পিসিমা তাহার চিবুক স্পৰ্শ করিয়া বলিলেন, অন্যায় অধর্মকে কখনও আশ্রয় কোরো না বাবা।

গাড়ির বাঁশি বাজিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress