Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

জ্যোতির্ময়ী যেন শিবনাথের প্রতীক্ষাতেই জীবনটুকু দেহের মধ্যে ধরিয়া রাখিয়াছিলেন। বিলিয়ারি কলিকের দারুণ যন্ত্রণা উপশমের জন্য মফিয়া ইন্‌জেকশন দেওয়া হইতেছিল। মরফিয়ার প্রভাবে আচ্ছন্নের মত তিনি পড়িয়া ছিলেন। মধ্যে মধ্যে শ্ৰান্ত চক্ষুপল্লব অতি কষ্টে ঈষৎ উন্মীলিত করিয়া চারিপাশ একবার দেখিয়া লইয়া বলিতেছিলেন, শিবু আসে নি?

তাহার শয্যাপার্শ্বে শৈলজা দেবী পাথরের মূর্তির মত বসিয়া ছিলেন। ভ্ৰাতৃজায়াকে যে তিনি এত ভালবাসিতেন, সে কথা তিনি এতদিনের মধ্যে আজ প্রথম উপলব্ধি করিলেন। তাহার মনে হইতেছিল, এই সংসারটিতে, শুধু এই সংসারটিতে কেন, সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে তাঁহার সকল দাবি-দাওয়ার মূল দলিলখানি যেন আজ নষ্ট হইতে বসিয়াছে। রোগে সেবা শুশ্রুষা তিনি কোনো কালেই করিতে পারেন না, তবে বিপদ-আপদের দুর্যোগের মধ্যেও দৃঢ় মুষ্টিতে সংসার-তরণীর হালখানি ধরিয়া অটুট ধৈর্যের সহিত বসিয়া থাকিতে তিনি পারেন; কিন্তু আজ যেন সে শক্তিও তাঁহার নিঃশেষে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। জ্যোতির্ময়ীর সেবা করিতেছিল পাচিকা রতন আর নিত্য-ঝি। ডাক্তার দেখানোর ত্রুটি হয় নাই, শৈলজা দেবী সেখানে এতটুকু খেদ রাখেন নাই। শহর হইতে সাহেব ডাক্তার আসিয়া বলিয়া গিয়াছেন, এত মফিয়া সহ্য করিবার মত শক্তি রোগিণীর নাই।

জ্যোতির্ময়ীর প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে শৈলজা দেবীর মন অসহনীয় উদ্বেগে পীড়িত হইয়া উঠিল। রামরতন আজ দুই দিন হইল শিবুকে আনিতে গিয়াছেন, তবু শিবু আজও আসিয়া পৌঁছিল না কেন? কোথায় এমন কোন জটিল জালের মধ্যে গিয়া জড়াইয়া পড়িল যে, মায়ের অসুখ শুনিয়াও সে আসিতে পারিল না? সঙ্গে সঙ্গে একটি লাবণ্যময়ী কিশোরীর মূর্তি মনের ছায়াপটে ভাসিয়া উঠিল; সে-ই যেন পথরোধ করিয়া শিবুর বক্ষোলীনা হইবার ভঙ্গিতে দাঁড়াইয়া আছে। এতক্ষণে নিস্পন্দ অসাড় মূর্তিতে স্পন্দন জাগিল, শ্বাসরোধী স্বপ্নের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণায় বহু কষ্টে যেমন মানুষ জাগিয়া ওঠে, তেমনভাবেই শৈলজা দেবী এতক্ষণে একটা দীৰ্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া উঠিয়া পাঁড়াইলেন। আবার টেলিগ্রাম করিতে হইবে, অন্তত রামরতন ফিরিয়া আসুক। সুকঠিন প্রয়াসে ধৈর্য ও সংযম বজায় রাখিয়া তিনি স্বাভাবিক পদক্ষেপে নিচে নামিয়া আসিয়া ডাকিলেন, সতীশ!

নিচের তলাটা জনশূন্য, কেহ কোথাও নাই। এমনকি ২১৯ নম্বর তৌজির লন্দী বেহারী বাগদী, যাহাকে অহরহ এ দুঃসময়ে ঘর-দুয়ার আগলাইবার ভার দেওয়া হইয়াছে, সে লোকটা পর্যন্ত নাই। তাহার ইচ্ছা হইল চিৎকার করিয়া বাড়িখানার ইটকাঠের নিরেট দেওয়ালগুলা পর্যন্ত চৌচির করিয়া ফাটাইয়া দেন। কিন্তু কিছু করিবার পূর্বেই সদর-দরজার রাস্তা-ঘরে একেবারে কয়েক জোড়া জুতার শব্দ বাজিয়া উঠিল। বিভিন্ন মানুষের পদশব্দের বিভিন্নতার মধ্যেও তাঁহার অন্তরের শব্দানুভূতি একাগ্র উন্মুখ হইয়া উঠিল। কে? কে? এ কাহার পদশব্দ? পরক্ষণেই তাহাব সকল সন্দেহের নিরসন করিয়া অন্দরের উঠানে সর্বাগ্রে প্রবেশ করিল শিবু, তাহার পশ্চাতে রামরতনবাবু, সর্বশেষে রাখাল সিং।

দৈহিক কৃশতাহেতু শিবুকে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ বলিয়া মনে হইতেছিল, তৈলহীন রুক্ষ দীর্ঘ চুল, শুভ্র দীপ্ত চোখে ধারালো দৃষ্টি, সে যেন ভবিতব্যতার সকল কঠোরতার সম্মুখীন হইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া আসিয়াছে। বিচিত্র মানুষের প্রকৃতি, শৈলজা দেবীর মুহূৰ্তপূর্বে বজ্রগর্ভ অন্তর পরমুহূর্তে বর্ষণোণুখ হইয়া উঠিল। তাহার ঠোঁট দুইটি কাঁপিয়া উঠিল, তিনি বহুকষ্টে আত্মসংবরণ করিয়া বলিলেন, আসতে পারলি বাবা?

শিবু স্থিরদৃষ্টিতে পিসিমার দিকে চাহিয়া শান্ত অথচ সকরুণ কণ্ঠে প্ৰশ্ন করিল, পিসিমা, আমার মা?

ফোঁটা কয়েক অবাধ্য অশ্রু পিসিমার চোখ হইতে টপটপ করিয়া ঝরিয়া পড়িল, দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সিক্ত চক্ষু মুছিয়া শৈলজা দেবী বলিলেন, আয়, ওপরে আছে তোর মা।

লক্ষ্মী বেহারী সেই মুহূর্তেই রঙিন শাড়ির ঘেরাটোপ-ঢাকা শিবনাথের বাক্সটা মাথায় করিয়া বাড়িতে আসিয়া প্রবেশ করিল। রামরতন বলিলেন, শিবু আজ দুদিন কিছু খায় নি, ওকে একটু শরবত খাওয়ান আগে।

পিসিমা সে কথার উত্তর দিলেন না, বাক্সটার উপরে রঙিন কাপড়ের ঘেরাটোপটার দিকে। চাহিয়া তিনি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মাস্টারকে বলিলেন, বউমা কই মাস্টার?

রামরতন বলিলেন, বউমার শরীর নাকি খুব খারাপ, তাই তিনি আসতে পারলেন না।

শিবু বলিল, ও-কথাটা তাদের অজুহাত পিসিমা; আসলে তারা তাকে পাঠালেন না।

পাঠালেন না?

না।

দুর্জয় ক্রোধে শৈলজা দেবীর মুখখানি ভীষণ হইয়া উঠিল, কিন্তু সে ক্রোধ প্রকাশের অবকাশ তাহার হইল না; উপরের বারান্দা হইতে ঝুঁকিয়া নিত্য-ঝি বলিল, দাদাবাবুকে মা ডাকছেন। পিসিমা।

শিবু আর অপেক্ষা করিল না, সে দ্রুতপদে উপরে উঠিয়া গেল। শৈলজা দেবীও শিবুর অনুসরণ করিয়া উপরে আসিয়া ভ্ৰাতৃজায়ার শিয়রে বসিয়া বলিলেন, তোমার শিবু এসেছে ভাই বউ।

জ্যোতির্ময়ী অর্ধ-নিমীলিত চোখে অলস আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে শিবুর মুখের দিকে চাহিয়া ছিলেন, শিবু মায়ের কপালে অতি মৃদু স্পর্শে হাত বুলাইতেছিল। জ্যোতির্ময়ী শৈলজা দেবীর কথার কোনো উত্তর দিলেন না, ক্ষীণ ক্লান্ত স্বরে তিনি শিবুকে বলিলেন, কোনো অন্যায় করিস নি তো শিবু?

শিবনাথ অবিচলিত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে চাহিয়া বলিল, না মা।

জ্যোতির্ময়ী অতি কষ্টে হাতখানি ছেলের কোলের উপর রাখিয়া প্রশান্ত মুখে চোখ বুজিলেন।

শৈলজা দেবী ডকিলেন, বউ!

জ্যোতির্ময়ী চোখ না খুলিয়া জ্বর ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন, উঁ?

শৈলজা বলিলেন, বল, তোমার কী কষ্ট হচ্ছে শিবুকে বল।

ধীরে ধীরে মাথাটি নাড়িয়া জ্যোতির্ময়ী জানাইলেন, না।

শিবনাথ এবার বলিল, কী হচ্ছে তোমার, বল মা?

একটা ম্লান হাসি জ্যোতির্ময়ীর অধরে ফুটিয়া উঠিল, তিনি ক্ষীণ কণ্ঠে ধীরে ধীরে বলিলেন, চলে যাচ্ছি, মনে হচ্ছে, অনেক দূরে আমি চলে যাচ্ছি। তোরা যেন কতদূর থেকে কথা বলছি, সব যেন ঝাপসা হয়ে আসছে।

এই কথা কয়টি বলিতেই তাহার ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটিয়া উঠিল। শিবু সযত্নে তাহা মুছাইয়া দিয়া বাতাস করিতে আরম্ভ করিল।

অপরাহ্রের দিকে নিঃশেষিত তৈল প্রদীপের মতই ধীরে ধীরে নিঃশেষে ক্ষয়িত হইয়া জ্যোতির্ময়ী মৃত্যুর মধ্যে যেন বিলীন হইয়া গেলেন।

মায়ের পারলৌকিক ক্রিয়া শেষ করিয়া শিবু এক অদ্ভুত মন লইয়া ফিরি। চোখের সম্মুখে উপর্যুপরি দুই-দুইটি মানুষের আকস্মিক মৃত্যু দেখিয়া তাহার মন সমগ্র সৃষ্টির নশ্বরতার কথাই গভীরভাবে উপলব্ধি করিবার চেষ্টা করিতেছিল; কিন্তু সে উপলব্ধির মধ্যে এক বিন্দু খেদ ছিল না, আক্ষেপজনিত বৈরাগ্য ছিল না, মৃত্যুর প্রতি ভয় ছিল না। যে মানুষ দুইটিকে মৃত্যু আক্রমণ করিল, সে মানুষ দুইটি সহাস্যে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করিয়া মৃত্যুর আক্রমণের তীব্রতাকে হতমান করিয়া দিয়াছে। বারান্দায় কম্বল বিছাইয়া তাহারই উপর বসিয়া সে এই কথাটাই ভাবিতেছিল। তখন প্রায় শেষ রাত্রি, শরতের অমলধবল জ্যোৎস্নার মধ্যে মানুষের রাজ্য সুষুপ্ত, কিন্তু মৃত্তিকার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অসংখ্য কোটি কীটপতঙ্গের বিচিত্র সম্মিলিত স্বরধ্বনি ধরণীর মর্মর-সঙ্গীতের মত অবিরাম ধ্বনিত হইতেছে। ইহারই মধ্যে শিবনাথ যেন সমগ্র সৃষ্টির জীবনস্পন্দন অনুভব করিল, তাহার চোখের সম্মুখের জ্যোত্সালোক-প্রতিফলিত অচঞ্চল খওপ্রকৃতি অসীমবিস্তার হইয়া ধরা দিল, ইহারই মধ্যে সমগ্র ধরিত্রীকে সে যেন দেখিতে পাইল। জন্ম-মৃত্যুর সমুদ্রমন্থনে উঠিয়া রহস্যময়ী ধরিত্রী এমনই মনোরমা মূর্তিতে যুগ-যুগান্তর ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। কী অপূর্ব আজিকার ধরিত্রীর রূপ! তাহার মা ছিলেন এই জ্যোৎস্নাবৰ্ণময়ী নিশীথের মত প্রশান্ত স্থৈৰ্যময়ী , দিবসের কলরবের উন্মত্ততা তাঁহার জীবনে ছিল না, তিনি ছিলেন এমনই নৈশপ্রকৃতির মত অশ্রান্ত মর্মসঙ্গীতময়ী। তাহার মনে পড়িয়া গেল—শুভ্ৰ জ্যোস্না-পুলকিত-যামিনীম্, ফুল্লকুসুমিত-দ্ৰুমদলশোভিনীম্, সুহাসিনীং সুমধুরভাষিণীম্, সুখদাং বরদাং মাতরম্বন্দে মাতরম্।

মনে মনে কয়টি লাইন আবৃত্তি করিতে করিতে সহসা তাহার মনে হইল, তাহার ওই মায়ের জীবনধারার মধ্যে শারদাকাশের ছায়াপথের মত একটি সাধনার স্রোতের আভাস যেন সে অনুভব। করিতেছে। তাহার সেই কয়েক ঘণ্টার পরিচিত মানুষটিকে মনে পড়িয়া গেল, হাসিমুখে যিনি ভুলের মাসুল কড়ায়গায় শোধ করিয়া দিলেন।

শিবু!—শৈলজা-ঠাকুরানী শ্মশান-বন্ধুদের বিদায় করিয়া এতক্ষণে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

শিবনাথ এতক্ষণে একটি গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মুখ তুলিয়া বলিল, পিসিমা?

হ্যাঁ। শুয়ে পড় বাবা। রাত্রি যে শেষ হয়ে এল!

এই শুই।—বলিয়া সে কম্বলের উপর ক্লান্ত দেহ প্রসারিত করিয়া দিয়া কহিল, এরকম রাত্রি কিন্তু বড় দীর্ঘই হয়ে থাকে পিসিমা।

স্নেহভরে শিবনাথের মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে দিতে শৈলজা-ঠাকুরানী বলিলেন, দুঃখের রাত্রি শেষ হতে চায় না বাবা, ক্ষণকে মনে হয় যেন একটা যুগ। কিন্তু ধৈর্য যে ধরতেই হবে বাবা। বিপদের পরও যে মানুষের কর্তব্য ফুরোয় না–কর্তব্য না করলে যে উপায় নেই।

শিবনাথ আবার একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া চোখ বুজিল। শৈলজা-ঠাকুরানী বসিয়া নিস্তব্ধ। নৈশপ্রকৃতির দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে অবিরল ধারায় নীরবে কাঁদিয়া আকুল হইয়া উঠিলেন। বউ—তাহার সকল সুখদুঃখের অংশভাগিনী, সহোদরার মত মমতাময়ী, সখীর মত প্রিয়ভাষিণী—জ্যোতির্ময়ী নাই, কোথায় কোন্ অজানার মধ্যে হারাইয়া গেল!

পরদিন প্রভাতে কিন্তু সদ্যবিয়োগদুঃখে কাতর অবসন্ন শিথিলগতি এই সংসারটির মধ্যে শক্তি সঞ্চয় করিয়া স্বাভাবিক রূপ লইয়া সর্বাগ্রে জাগিয়া উঠিলেন শৈলজা-ঠাকুরানীই। ঘরের দুয়ারে দুয়ারে জল দিয়া তিনি নিত্য ও মানদা ঝি এবং রতন পাচিকাকে ডাকিয়া তুলিলেন, নিত্য, রতন, মানদা ওঠ মা, আর শুয়ে থেকো না। রাজ্যের কাজ পড়ে রয়েছে, ওঠ সব।

রতন একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, উঠব বৈকি মাসিমা। খেতেও হবে, মাখতে হবে, পরতেও হবে, করতে হবে যে সবই।

শৈলজা দেবী বলিলেন, মা, পৃথিবীর পানে চেয়ে দেখ, ওঁর তো শোক দুঃখ কিছু মানলে চলে না, ভূমিকম্পই হোক আর ঝড়-বৃষ্টিতে বুক ভেঙে ভেসেই যাক, দিনরাত্রি সেই সমানে হবে, আর সৃষ্টিকেও সেই বুকে করেই ধরে রাখতে হবে। নিত্য, মুখে হাতে জল দে মা। আমার সঙ্গে কাছারি-বাড়ি যেতে হবে।

গোটা কাছারি-বাড়িটাও মুহ্যমানের মত অবসন্ন স্তব্ধ। বারান্দার তক্তপোশটার উপর রাখাল সিং গালে হাত দিয়া উদাস দৃষ্টিতে চাহিয়া বসিয়া ছিলেন, নিচে দেওয়ালে ঠেস দিয়া বসিয়া কেষ্ট সিং আকাশের দিকে চাহিয়া ছিল, সতীশ চাকর উবু হইয়া দুই হাতে মাথা ধরিয়া বসিয়া আছে, মাস্টার রামরতনবাবু শুধু বারান্দায় পায়চারি করিতে করিতে মোহমুগর আওড়াইতেছেন, শৈলজা-ঠাকুরানী আসিয়া দাঁড়াইলেন, কিন্তু তবুও আজ কাহারও মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা গেল না।

শৈলজা দেবী বলিলেন, সিংমশায়, এমন করে বসে থাকলে তো চলবে না। যা হবার সে তো হয়েই গেল, এখন ক্রিয়াকর্মের ব্যবস্থা করতে হবে যে। দশটা দিন সময়, তার মধ্যে একটা। দিন তো চলে গেল।

রাখাল সিং যেন একটু লজ্জিত হইয়া পড়িলেন। সত্য কথা, এ কর্তব্যকর্মে সজাগ হইয়া উঠা উচিত ছিল তাঁহারই সর্বাগ্রে। তিনি কেষ্ট সিংকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, কাঠটা কাটিয়ে ফেলতে হবে সকলের আগে। তেঁতুল কিংবা কয়েতবেলের গাছ দুটো কাটিয়ে ফেল, বুঝলে হে?

কেষ্ট সিং একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া নড়িয়াচড়িয়া বসিয়া বলিল, কোথাকার গাছ কাটব বলুন? কাছে-পিঠেই কাটতে হবে, নইলে এই জল-কাদার দিনে গাছ নিয়ে আসাই হবে মুশকিল।

রামরতনবাবু পদচারণায় ক্ষান্ত দিয়া তক্তপোশটায় আসিয়া বসিলেন। সম্মুখের এই আসন্ন কর্তব্যকর্মটির দায়িত্বের অংশ যেন তিনি স্বেচ্ছায় গ্রহণ করিয়া বলিলেন, গাছ কোথায় কাটাতে হবে, মাছ কোথায় ধরাতে হবে, ওই আপনার চাল তৈরি করতে কোথায় দিতে হবে, এ ভারগুলো হল কে সিংয়ের। ওগুলো ওকেই ছেড়ে দিন। মহলের গোমস্তাদের আনিয়ে তাদের সব কাজ ভাগ করে দিন। ইংরেজিতে একে বলে—ডিভিশন অব লেবার; বড় কাজ করতে হলেই ও না হলে হবে না। আপনি বরং সর্বাগ্রে একটা ফর্দ করে ফেলুন দি ফার্স্ট অ্যান্ড দি মোস্ট ইম্পৰ্ট্যান্ট থিং।

রাখাল সিং বহুদৰ্শী ব্যক্তি, তিনি বলিলেন, তা হলে গ্রামের মুরব্বিদের একবার আহ্বান করে তাদের পরামর্শমত ফর্দ করাই উচিত। অবশ্য তারাও সব আপনা হতেই আসবেন।

রামরতনবাবু বলিলেন, ইয়েস। এটা তাদেরও একটা সামাজিক কর্তব্য।

রাখাল সিং মাথা চুলকাইয়া বলিলেন, বাবুর মামাশ্বশুরকেও একটা খবর দিতে হয়, তাদেরও একটা মতামত না কী বলেন মাস্টারমশায়?

শৈলজা-ঠাকুরানী বলিলেন, হ্যাঁ, খবর দিতে হবে বৈকি। আর পরামর্শ চাইতেও হবে। কিন্তু সকলের আগে একখানা টেলিগ্রাম করতে হবে বউমাকে পাঠিয়ে দেবার জন্যে, মাস্টার একখানা টেলিগ্রাম লেখ তো বাবা।

রাখাল সিং বলিলেন, এঁদের ম্যানেজারকে ডেকে তাকে দিয়েও একখানা পত্র বরং–

শৈলজা দেবী বলিলেন, এতটা নামতে পারব না সিংমশাই; আমার বউ আনতে বউয়ের মামার কর্মচারীকে সুপারিশ করবার জন্যে ধরতে পারব না।

এই সময়েই কাছারি-বাড়ির ফটকে কয়েকজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি প্রবেশ করিলেন; সামাজিক প্রথা অনুযায়ী তাঁহারা তত্ত্বতল্লাশ করিতে আসিয়াছেন। শৈলজা দেবী মাথায় স্বল্প একটু অবগুণ্ঠন টানিয়া দিয়া বলিলেন, ভদ্রলোকেরা আসছেন, আমি তা হলে বাড়ির মধ্যে যাই, শিবুকে পাঠিয়ে দিই। মাস্টার, তুমি বাবা টেলিগ্রামখানা লিখে এখুনি পাঠিয়ে দাও।

তিনি একটু দ্রুত পদক্ষেপেই কাছারি-বাড়ি হইতে বাহির হইয়া গেলেন। রাখাল সিং সতীশকে বলিলেন, গড়গড়ায় জল ফিরিয়ে দে সতীশ, কাছারি-ঘরখানাও খুলে দে।

সতীশ কাছারি-ঘর খুলিয়া সমস্ত জানালা-দরজাগুলি খুলিতে আরম্ভ করিল; রাখাল সিং জোড়হাতে কাছারির দাওয়া হইতে নামিয়া বাগানের পথের উপর দাঁড়াইয়া আগন্তুকগণকে অভ্যর্থনা করিলেন।

শৈলজা-ঠাকুরানী বাড়ির মধ্যে আসিয়া দেখিলেন, শিবুর কাছে বসিয়া আছেন এ সংসারের সেই সন্ন্যাসী বন্ধুটি_শিবুর গোঁসাই-বাবা স্থানীয় দেবস্থানের গদিয়ান রামজী সাধু। স্ন্যাসীকে দেখিয়া একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া শৈলজা বলিলেন, আসুন দাদা, থাকল না, ধরে রাখতে পারলাম না।

সন্ন্যাসী নিমেষহীন স্থিরদৃষ্টিতে সম্মুখের দিকে চাহিয়া নীরবে বসিয়া রহিলেন। এ সংসারটির সহিত তাহার পরিচয় মৌখিক নয়, গভীর এবং আন্তরিক; আন্তরিকতার মধ্য দিয়া জীবনের সকল মমতা তিনি এইখানে উজাড় করিয়া ঢালিয়া দিয়াছিলেন। চোখ ফাটিয়া জল বাহিরে আসিতে চাহিতেছিল, তাই তিনি নির্নিমেষ দৃষ্টিতে কঠোরতার উত্তাপে সে জল শুষ্ক করিয়া দিবার প্রয়াস করিলেন।

শিবনাথ সন্ন্যাসীর মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, মৃত্যু কী, বলতে পার গোঁসাই-বাবা?

সন্ন্যাসী ম্লান হাসি হাসিয়া অপকপটে আপনার অজ্ঞতা অস্বীকার করিলেন, হামি জানে না বাবা; উ যদি হামি জানবে বাবা, তবে সন্সার ছোড়কে ফিন কেনো মায়াজালমে গিরবো হামি?

শৈলজা দেবী শিবুর এই তীক্ষ্ণ অনুভূতিপ্রবণতা দেখিয়া কাল হইতেই শঙ্কিত হইয়া উঠিয়াছিলেন; শিবুর মনকে যেন তিনি স্পৰ্শ করিতে পারিতেছেন না; তিনি প্রসঙ্গটা বন্ধ করিবার জন্যই তাড়াতাড়ি বলিলেন, ওসব উদ্ভট ভাবনা ভেবো না বাবা। জন্ম মৃত্যু হল বিধাতার কীর্তি, চিরকাল আছে, ওতেই সংসার চলছে। ওর কি আর জবাব আছে?

বিস্ময়বিমুগ্ধতার একটি মৃদু হাস্যরেখা শিবনাথের মুখে ফুটিয়া উঠিল, সে বলিল, বুদ্ধদেব বলে গেছেন, নির্বাণ; বিজ্ঞান বলে, দেহের যন্ত্রণাসমূহের ধ্বংসেই সব শেষ; সাধারণে বলে, জন্মান্তর।

সন্ন্যাসীও এবার যেন হাঁপাইয়া উঠিলেন, তিনি তাহাকে বাধা দিয়া বলিলেন, ছোড় দে বেটা; কর আপনা কাম ভাই, ভজ ভগবান, মরণকে কেয়া ডর, তুমহারা মতি মান।

শৈলজা দেবী বলিলেন, ওসব কথা এখন থাক্ দাদা; আপনি বরং শিবুকে নিয়ে একবার বৈঠকখানায় যান। গ্রামের ভদ্রলোকজন সকলে আসছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে, তাঁদের পাঁচজনের পরামর্শ নিতে হবে, নিয়ে কাজ করতে হবে। কথায় বলে, মাতৃপিতৃদায়।

সন্ন্যাসী বলিলেন, আসিয়েছেন সব? তবে চল্ বেটা শিবু, বাহারমে চল্ বাবা হামার। উনিলোগ কী মনমে লিবেন?

শিবু উঠিল, আর বিলম্ব করিল না। উঠিতে উঠিতে তাহার মনে হইল, সমাজে বাস করার এ মাসুল; না দিয়া উপায় নাই, দিতেই হইবে।

কাছারিতে তখন আরও কয়েকজন ভদ্রলোক আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন, গড়গড়ায় তামাক দেওয়া হইয়াছে, ঠুকাতেও তামাক চলিতেছে। রাখাল সিং সসম্ভ্ৰমে দাঁড়াইয়া আছেন, মাস্টার এক পাশে বসিয়া কথাবার্তা শুনিতেছেন।

কথা হইতেছিল নাবালক শিবনাথের অভিভাবকত্ব লইয়া। কৃষ্ণদাসবাবুর মৃত্যুর পর নাবালক শিবনাথের স্বাভাবিক অভিভাবক ছিলেন তাহার মা; এখনও শিবুর সাবালকত্ব অর্জন করিতে প্রায় তিন বৎসর বিলম্ব আছে।

শিবনাথের পিতৃবন্ধু মানিকবাবু এ গ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তি, তিনিও জমিদার, তিনি বলিতেছিলেন, অবশ্য শিবনাথের পিসিমাই এখন সত্যকার অভিভাবক। কিন্তু আমার বিবেচনায় আইনে আদালতে দরখাস্ত করে তাঁর অভিভাবক না হওয়াই ভাল।

একজন বলিলেন, কেন, হলেই বা ক্ষতি কী? আমার বিবেচনায় তাঁরই তো হওয়া উচিত।

মানিকবাবু বলিলেন, অর্থ অনর্থম্ ভাবয় নিত্যম-বুঝলে, বিষয় হল বিষ, অমৃতকেও সে নষ্ট করে। ধর, ভবিষ্যৎ বনিবনাও আছে, যদিই কোনো কারণে তার সঙ্গে বনিবনাও না হয়, তখন এই দায়িত্ব নিয়েই তার নানা ফ্যাসাদ হতে পারে।

রামরতনবাবু বারবার এ কথাটা অস্বীকার করিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, না না না, শিবনাথের এমন মতিগতি কখনও হতে পারে না। শিবনাথ কখনও তার কাজে না করতে পারে না।

মানিকবাবু হাসিয়া বলিলেন, আপনি মাস্টার, শিক্ষক মানুষ, সাংসারিক জ্ঞান আপনাদের কিছু কম। অবশ্য অনেক শিক্ষক তেজারতি-মহাজনি করেন, মামলা-মকদ্দমাতেও ওস্তাদ শিক্ষকের নাম শুনতে পাই, কিন্তু আপনি তো সে দলের নন। তাই কথাটা ভেঙে বলতে হচ্ছে। ভাল কথা, শিবনাথ তাঁকে খুবই ভক্তি করে, মান্য করে, মেনে নিলাম। কিন্তু শিবনাথের স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর যদি না বনে? তখন শিবনাথ কাকে ফেলবে? পিসিমাকে, না স্ত্রীকে?

কথাটা শুনিয়া সকলেই নিস্তব্ধ হইয়া গেল। এমন করিয়া অন্তর্ভেদী দৃষ্টি হানিয়া কেহ। অবস্থাটা দেখিয়া ভবিষ্যতের কথা ভাবে নাই। তাহা ছাড়াও, প্রকাশ্যভাবে কথাটার বহিরাবরণ এমন করিয়া উন্মুক্ত করিয়া দেওয়ার ফলে সকলেই অল্প লজ্জিত না হইয়া পারিল না। সত্য হইলেও কথাটার সহিত লজ্জার যেন একটু সংস্রব আছে, অন্তত পল্লীর প্রাচীন সমাজে আছে। শিবনাথ ঠিক এই নির্বাক অবসরটিতেই আসিয়া কাছারি-ঘরে প্রবেশ করিল।

মানিকবাবু সস্নেহে তাহাকে সম্ভাষণ করিয়া বলিলেন, এস বাবা, এস। তোমার অপেক্ষাতেই রয়েছি আমরা।

শিবনাথ অল্প ইতস্তত করিয়া বলিল, প্রণাম তো করতে পাব না আমি এখন?

না। অশৌচকালে প্রণাম নিষেধ। বোসো, তুমি বোসো, এইখানেই কম্বলটা বিছিয়ে বোসো।

ওদিক হইতে একজন প্রসঙ্গটা পুনরুত্থাপিত করিয়া বলিলেন, তা হলে শিবনাথের শ্বশুরদের হাতে ভার দিতে হয়। গ্রামের শ্রেষ্ঠ লোক ওঁরা, বিষয়ও প্রকাণ্ড, তারই সঙ্গে এ এস্টেটও বেশ চলে যাবে।

মানিকবাবু বলিলেন, তা অবশ্য বলতে পারেন, চলেও অবশ্য যাবে, জাহাজের পেছনের জেলে-বোটের মত। কিন্তু কৃষ্ণদাসদাদার ছেলে ঘরজামাই না হয়েও শ্বশুরের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে, এটা আমার কোনোমতেই ভাল লাগছে না।

শিবনাথ কথাটা বুঝিতে পারি না, কিন্তু মানিকবাবুর কথার বঙ্কিম তীক্ষা তাহাকে বিদ্ধ করিল, সে পূর্ণ দৃষ্টিতে মানিকবাবুর মুখের দিকে চাহিয়া বলি , কথাটা আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না কাকা।

মানিকবাবু বলিলেন, তোমারই অভিভাবকত্বের কথা হচ্ছে বাবা। তোমার মা মারা গেলেন, এখন আদালতগ্রাহ্য অভিভাবক হবে কে? সেই নিয়ে কথা হচ্ছে। আমার মতে তোমার পিসিমার হওয়া উচিত নয়; এরা তোমার শ্বশুরদের কথা বলছেন, সেও আমি বেশ পছন্দ করতে পারছি না।

শিবনাথ বলিল, পরে সেটা ভেবে দেখলেই হবে কাকা, এখন আমার মায়ের কাজকর্ম কী করে সুশৃঙ্খলে হয়, সেই ব্যবস্থা করে দিন আপনারা।

একটা অপ্রিয় অবাঞ্ছনীয় আলোচনার জটিল জাল হইতে মুক্তি পাইয়া সকলে যেন হপ ছাড়িয়া বচিল। একসঙ্গে কয়েকজনই শিবনাথের কথাতেই সায় দিয়া বলিয়া উঠিল, ঠিক কথা, ও তো হল পরের কথা; এখন মাথার ওপরে যে দায় চেপেছে, তারই ব্যবস্থা করা হোক।

মানিকবাবু গম্ভীরভাবে বলিলেন, বেশ তো, খরচপত্র কী রকম করা হবে, কৃতীর সামর্থ্য কতখানি, সে কথা আমাদের জানালেই আমরা সেই মত ব্যবস্থা করে দেব। কী রাখাল সিং, খরচপত্র কী রকম করা যেতে পারে, এস্টেটের সামর্থ্য কতখানি, সে কথা তুমিই বলতে পারবে ভাল, বল তুমি সে কথা।

কথাটার উত্তর দেওয়া সহজ নয়, উত্তর দিতে হইলে এস্টেটের গোপন কথাটি প্রকাশ করিতে হয়, রাখাল সিং বিব্রত হইয়া পড়িলেন। সতীশ চাকর সেই মুহুর্তে সসম্ভ্ৰমে ঘরে প্রবেশ করিয়া রাখাল সিংকে বলিল, পিসিমা আপনাকে একবার ডাকছেন, এই পাশের ঘরেই আছেন। রাখাল সিং দ্রুতপদেই ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন।

সতীশ গড়গড়ার কঙ্কে পাল্টাইয়া নূতন কল্কে বসাইয়া দিল, ওপাশ হইতে কা হাতে করিয়া এক ব্যক্তি বলিলেন, এটাও পালটে দাও হে, শুধু গড়গড়ার মাথাতেই নজর রেখো না, বুঝলে?

সতীশ তাড়াতাড়ি বলিল, আজ্ঞে না, কোর কল্কেও সেজে এনেছি, এই যে।

বক্তা বলিলেন, কন্ধে তো দু রকম, তামাক দু রকম নয় তো?—বলিয়া আপন রসিকতায় তিনি হা-হা করিয়া হাসিয়া আকুল হইয়া উঠিলেন।

সহসা শিবনাথ বলিল, আচ্ছা কাকা, কোনো উকিলকে গাৰ্জেন নিযুক্ত করে আমি নিজে তো সম্পত্তি দেখতে পারি?

মানিকবাবু তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ছেলেটির মুখের দিকে চাহিয়া কয়েক মুহুর্ত নীরব হইয়া রহিলেন, এরূপ একটি সমস্যার এমন তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্মত সমাধান শিবনাথের মুখে তিনি শুনিবার প্রত্যাশা করেন নাই। তাহার পরই তিনি অল্প একটু হাসিয়া বলিলেন, হ্যাঁ, সে অবশ্য খুবই ভাল যুক্তি; কিন্তু ব্যয়সাপেক্ষ, মানে–উকিল একটা ফি নেবেন।

শিবনাথ বলিল তা হলে তাই হবে। এই যুক্তিই আমি স্থির করলাম। এখন আপনারা এই শ্ৰাদ্ধের একটা ফর্দ করে দিন।

রাখাল সিং শিবনাথের কথার মধ্যস্থলেই আসিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। মানিকবাবু বলিলেন, খরচ কী পরিমাণ করা হবে, সেই কথাই তো জিজ্ঞাসা করলাম তোমার নায়েবকে বাবা। সেইটে জানালেই আমরা ব্যবস্থা করে দেব।

রাখাল সিং এবার জবাব দিলেন, পিসিমাই নিবেদন করিলেন কথাটা। তিনি বলিলেন, মাতৃদায় পিতৃদায়, যেমন করেই হোক সমাধা করতে হবে। তাতে তো মজুত দেখতে গেলে চলবে না। টাকার সংস্থান একরকম করে হয়ে যাবে, আপনি আপনার মাতৃশ্ৰাদ্ধের ফর্দ অনুযায়ী ফর্দ করে দিন দয়া করে।

মানিকবাবু অত্যন্ত গম্ভীরভাবে বলিলেন, তা হলে কাগজ-কলম নিয়ে এস।

শৈলজা-ঠাকুরানী এইবার পাশের ঘর হইতে বাহির হইয়া অন্দরে চলিয়া গেলেন। তাহার মুখ বেদনায় যেন বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে। নিত্য তাহার মুখের দিকে চাহিয়া প্রশ্ন করিল, পিসিমা, শরীরটা কি খারাপ মনে হচ্ছে?

পিসিমা সংক্ষেপে উত্তর দিলেন, না।

দারুণ দুঃখের উপর তিনি মর্মান্তিক আঘাত পাইয়াছিলেন। অভিভাবকত্ব ও বিষয় পরিচালনার ব্যবস্থা লইয়া শিবনাথের প্রস্তাবটি তিনি কাছারি-ঘরের পাশের ঘরে থাকিয়া স্বকর্ণেই শুনিয়াছিলেন। আশ্চর্য মানুষের মন! কয়েক মাস পূর্বে তিনিই শিবনাথকে কাছারি-ঘরে বসাইয়া সম্পত্তি পরিচালনার সমগ্র ভার তাহার হাতে তুলিয়া দিতে চাহিয়াছিলেন, অথচ আজ শিবনাথের মুখেই সেই সংকল্পের কথা শুনিয়া মর্মান্তিক আঘাত অনুভব করিলেন। তাঁহার বারবার মনে হইল, তাঁহার জীবনের সকল প্রয়োজন ফুরাইয়া গিয়াছে। তিনি বাড়িতে আসিয়া অবসনের মত মেঝের উপর শুইয়া পড়িলেন, ভ্ৰাতৃজায়ার অভাব এই মুহূর্তে যেন সহস্ৰগুণে অধিক হইয়া উঠিল। বহুক্ষণ কাঁদিয়া তিনি উঠিয়া বসিলেন, বারবার আপন ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করিয়া আপনার মনকে লক্ষ সান্ত্বনা দিয়া দৃঢ় করিয়া তুলিলেন। রতন ও নিত্য-ঝি দুয়ারের পাশে দাঁড়াইয়া নীরবে অবিসর্জন করিতেছিল, তাহারা ভাবিয়াছিল, শৈলজা দেবী এইবার অবসর পাইয়া জ্যোতির্ময়ীর জন্য কাঁদিতে বসিয়াছেন। মনকে বাঁধিয়া চোখ মুছিয়া শৈলজা দেবী বলিলেন, রান্নাবান্না চড়াও মা রতন। নিত্য, চাকর-বাকরদের জলখাবার বের করে দাও। আমি দেখি, ঠাকুরদের পুজো-ভোগের ব্যবস্থা করে দিই।

ভাষায় সুরে এ যেন সে শৈলজা-ঠাকুরানী নন।

দুই দিনেই শ্ৰাদ্ধকার্যের বন্দোবস্তের মধ্যে একটি শৃঙ্খলা আসিয়া গেল। হলের গোমস্তারা সকলে আসিয়া গিয়াছে, তাদের সঙ্গে পাইক লক্ষ্মীও আসিয়া কাজে লাগিয়াছে। সমগ্র কাজটি কয়েক ভাগে ভাগ করিয়া এক-একজনকে ভার দেওয়া হইয়াছে, সকল বন্দোবস্তের কর্তৃত্বভার লইয়াছেন মানিকবাবু, রাখাল সিং ও রামরতন হইয়াছেন তাহার সহকারী।

কলিকাতার বাজারের ফর্দ তৈয়ারি হইতেছিল। রামরতন যাইবেন কলিকাতায় বাজার করিতে। শিবনাথ নীরবে কম্বলের উপর বসিয়া ছিল। সহসা সে রামরতনকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, একটা কথা আপনাকে বলে দিই মাস্টারমশায়।

কী, বল?

একবার আপনি সুশীলদার ওখানে যাবেন। তাকে আমার এই বিপর্যয়ের কথাটা জানিয়ে আসবেন। তিনি মাকে বড় ভক্তি করতেন।—বলিতে বলিতেই তাহার ঠোঁট দুইটি কাঁপিয়া উঠিল। আশ্চর্যের কথা, সদ্য মাতৃবিয়োগে সে কাঁদে নাই, সেদিন যেন বুকে সে অসীম ধৈর্য অনুভব করিয়াছিল। কিন্তু যত দিন যাইতেছে, সে যেন ততই দুর্বল হইয়া পড়িতেছে। এ সময়ে পূর্ণ তাহার পাশে থাকিলে বড় ভাল হইত। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সে আবার বলিল, পূর্ণ কেমন আছে, এইটে জিজ্ঞেস করতে যেন ভুলবেন না।

রাখাল সিং ফর্দ করিতে করিতেও বোধহয় কথাটা শুনিয়াছিলেন, তাহার আর একটা কথা মনে পড়িয়া গেল। তিনি একটু ইতস্তত করিয়া বলিলেন, আর একবার মানে, বউমা তো আজও এলেন না, কোনো খবরও পাওয়া গেল না—এঁদের ওখানে একবার গেলে হত না?

শিবনাথ ঘাড় নাড়িয়া অস্বীকার করিয়া বলিল, না।

রামরতন সহসা প্রশ্ন করিলেন, কদিন থেকেই তোকে কথাটা জিজ্ঞেস করব ভাবছিলাম শিবু, তুই কি আর পড়বি না?

কলেজের পড়া আর পড়ব না।

তাই তো রে! একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া রামরতন বলিলেন, ক্ষুদ্ৰ এই বিষয়টুকুর গণ্ডির মধ্যেই বন্ধ করে রাখবি নিজেকে?

শিবনাথ চুপ করিয়া সম্মুখের পানে চিন্তাকুল দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল। কয়টা কুলি প্রচুর মোটঘাট লইয়া কাছারিতে প্রবেশ করিয়া বলিল, আজ্ঞেন, কোথা রাখব জিনিসগুলি?

কার জিনিস? কে এল রে বাপু?—রাখাল সিং সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিলেন।

শিবুও সবিস্ময়ে মাথার মোটগুলির দিকে চাহিয়া দেখিয়া চমকিয়া উঠিল, এ বাক্সটা—

কুলিরা উত্তর দিল, আজ্ঞেন এ বাড়ির বউঠাকরুন এলেন, উ বাড়ির দাদাবাবু এলেন।

শিবনাথ, রাখাল সিং সকলেই দেখিল, অন্দরের দরজায় কমলেশের পিছনে পিছনে। অবগুণ্ঠনাবৃতা কিশোরী গৌরী বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিতেছে।

শিবনাথ একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া চোখ বুজিল, আবার তাহার চোখে জল আসিতেছিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress