Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

পরদিন বেলা আটটা তখনও বাজে নাই। শিবনাথদের কাছারিবাড়ির দক্ষিণ-দুয়ারী প্রকাণ্ড খড়ের বাংলোটার বারান্দায় তক্তপোশের উপর নায়েব সিংহ মহাশয় সেরেস্তা বিছাইয়া বসিয়া ছিলেন। চাকর সতীশ ঢেরা ঘুরাইয়া শণের দড়ি পাকাইতেছিল। চাপরাসী কেষ্ট সিং ঘরের মধ্যে মাথায় পাগড়িটা ঠিক করিয়া লইতেছিল।

বাংলোটার সহিত সমকোণ করিয়া পূর্ব দিকে আর একখানা ছোট খড়ো বাংলো। ওই ঘরগুলিতে চাকর-চাপরাসী থাকে। এই ঘরটার বারান্দার চালে কাঠামোয়-বাধা দুইখানা পালকি ঝুলিতেছে। পালকি দুইখানার নাম আছে—একখানা কর্তা-সওয়ারী একখানা গিনিসওয়ারী, অর্থাৎ একখানা বাড়ির কর্তার জন্য, অপরখানি বাড়ির গিন্নির জন্য নির্দিষ্ট। গিনিসওয়ারীটার সাজসজ্জা জঁাকজমক বেশি, ভিতরটা লাল সালু দিয়া মোড়া, ছাদের চাঁদোয়ার পাশে পাশে ঝুটা-মতির ঝালর। কাছারিবাড়ির সম্মুখেই কাঠা কয়েক জায়গা ঘেরিয়া ফুলের বাগান। একদিকে একসারি নারিকেল গাছ, মধ্যে বেল, উঁহুঁ, করবী, জবা, কামিনী, স্থলপদ্ম প্রভৃতি গাছের কেয়ারি। ঠিক মধ্যস্থলে একটি পাকা বেদি। বাগানের পরই বিঘা দেড়েক স্থান। প্রাচীরবেষ্টনীর মধ্যে তকতক করিতেছে। এইটি খামার-বাড়ি। একদিকে একসারিতে গোটাতিনেক ধানের খামার। বাগানের পাশেই খামার-বাড়ি যেখানে আরম্ভ হইয়াছে, সেইখানেই একটি ফটক। ফটকের দুই পাশের থামের গায়ে দুইটি লতা, একটি মালতী ও অপরটি মধুমালতী, উপরে উঠিয়া তাহারা জড়াইয়া একাকার হইয়া গিয়াছে। বাড়ির পূর্ব গায়েই বাঁড়ুজ্জে-বাবুদের শখের পুকুর শ্রীপুকুরের দক্ষিণ পাড়ে আর একটা বাড়ি,বাবুদের গোশালা, চাষ-বাড়ি ও শূন্য একটি আস্তাবল।

পিসিমা আসিয়া সঁড়াইলেন। পিছনে নিত্য ঝি। নায়েব সসম্ভ্ৰমে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। চারিদিকে একবার সূক্ষ্ম দৃষ্টি বুলাইয়া লইয়া পিসিমা প্রশ্ন করিলেন, কেষ্ট সিং কোথা গেল?

পাগড়িটা জড়াইতে জড়াইতে কেষ্ট সিং তাড়াতাড়ি বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আজ্ঞে।

পিসিমা প্রশ্ন করিলেন, শম্ভু কোথায়? গরুবাছুরকে সব খেতে দেওয়া হয়েছে?

পুরু চশমাটা নাকের ডগায় টানিয়া দিয়া ঐ ও চশমার ফাঁক দিয়া এদিক-ওদিক দেখিয়া সিংহ মহাশয় হকিলেন, শম্ভু! শম্ভু!

কেষ্ট সিং ততক্ষণে দ্রুতপদে শঙ্কুর খোঁজে চলিয়া গিয়াছে।

পিসিমা বলিলেন, এ খোঁজটা সকালেই নিতে হয় সিং মশায়, গো-সেবায় অপরাধ হলে হিন্দুর সংসারে অভিসম্পাত হয়।

নায়েব মাথা চুলকাইয়া কী বলিতে গেলেন, কিন্তু তাহার পূর্বেই পিসিমা বলিলেন, সতীশ, কাছারি ঘরটা খোল্ তো।

কয়েক বৎসর পূর্বে কৃষ্ণদাসবাবুর মৃত্যু হইয়াছে। তাহার পর হইতে কাছারি কক্ষখানি বন্ধই আছে। নাবালক ছেলে সাবালক হইলে এ ঘর আবার নিয়মিত খোলা হইবে, ব্যবহৃত হইবে। সতীশ তাড়াতাড়ি চাবি খুলিয়া দিল। পিসিমা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া নিস্তব্ধভাবে দাঁড়াইয়া রহিলেন। ঘরখানি পূর্বের মতই সাজানো রহিয়াছে। প্রকাণ্ড লম্বা ঘরখানার ঠিক মধ্যস্থলে একখানা আবলুসকাঠের টেবিল, তাহার পিছনে একখানা ভারী কাঠের সেকালের চেয়ার, টেবিলের দুই পাশে দুইখানা প্রকাণ্ড তক্তপোশ ঘরের দুই প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। তক্তপোশের উপর ফরাস বিছানোই আছে, ফরাসের উপর সারি সারি তাকিয়া, ঘরের দেওয়ালে বড় বড় দেবদেবীর ছবি, ঠিক দুয়ারের মাথায় সে-আমলের মন্দিরের আকারের একটা ব্লক টকটক করিয়া চলিতেছিল। রুপার আলবোলাটি পর্যন্ত একটা পোয়ার উপর পূর্বের মতই রক্ষিত, নলটি টেবিলের উপর পড়িয়া আছে, যেন মালিক কোথায় কার্যান্তরে উঠিয়া গিয়াছেন।

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া পিসিমা বলিলেন, জানালাগুলো খুলে দে, ঘরে রোদ আসুক।

সে ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিয়া নায়েবকে বলিলেন, বগতোড়ের মহেন্দ্ৰ গণকের কাছে একটা লোক পাঠাতে হবে। খোকার কুষ্টি দেখে একটা শান্তি, আর–

এক মুহূৰ্ত নীরব থাকিয়া পিসিমা বলিলেন, তাকে আপনি আসতে লিখে দিন।

তারপর আবার বলিলেন, মহালে মহালে লোক পাঠানো হয়েছে?

নায়েব বলিলেন, আজ্ঞে হ্যাঁ, পরশু লোক চলে গিয়েছে সব।

পিসিমা আর দাঁড়াইলেন না, কাছারিবাড়ির সংলগ্ন শ্রীপুকুরে বাধা ঘাটে আসিয়া দাঁড়াইলেন। মাঝারি আকারের সমচতুষ্কোণ পুকুরটির চারিপাশে তালতশ্রেণী সীমানা নির্দেশ করিয়া প্রাচীরের মত দাঁড়াইয়া আছে। পিসিমা দেখিলেন, ঠিক বিপরীত দিকে এক দল ভদ্রলোক কী যেন করিতেছে। তাহাদের সঙ্গে একটা শিকলের মত কি একটা টানিতে টানিতে লইয়া চলিয়াছে, হাঁ, শিকলই তো।

পিসিমা বেশ উচ্চকণ্ঠেই প্ৰশ্ন করিলেন, কারা ওখানে?

কেহ উত্তর দিল না। পিসিমা কাছারির দিকে মুখ ফিরাইয়া ডাকিলেন, সিং মশায়!

নায়েব সিংহ মহাশয় তাড়াতাড়ি আসিয়া সঁড়াইলেন। পিসিমা পদশব্দে তাহার আগমন অনুমান করিয়া বলিলেন, দেখে আসুন তো, কী হচ্ছে ওখানে আমার সীমানার মধ্যে।

কথাটা তিনি তার স্বাভাবিক উচ্চকণ্ঠে বলিলেন। এবার ওদিক হইতে উত্তর আসিল, সাহা-পুকুরের সীমানা জরিপ হচ্ছে।

শ্রীপুকুরের ওপাশেই সাহা-পুকুর, পুকুরের শরিকদের মধ্যে পাড় বাটোয়ারা লইয়া একটা মামলা চলিতেছিল। কথাটা সকলেই জানি।

পিসিমা বলিলেন, তা আমার সীমানার মধ্যে শেকল পড়ল কেন? শেকল তুলে নাও ওখান থেকে।

ওপাড়ার বৃদ্ধ শশী রায় বলিলেন, আমরা তো তোমাদের সীমানা খেয়ে ফেলি নি, তুলেও নিয়ে যাই নি–

বাধা দিয়া পিসিমা বলিলেন, তুলে নিন শেকল আমার সীমানা থেকে।

তাঁহার কণ্ঠস্বরে ও আদেশের ভঙ্গিমায় সকলেই একটু চকিত হইয়া উঠিল। বৃদ্ধ শশী রায় গাঁজাখোর, তিনি ক্ষিপ্তের মত বলিয়া উঠিলেন, আচ্ছা হারামজাদা মেয়ে যা হোক!

কঠিন কণ্ঠে সঙ্গে সঙ্গে এদিক হইতে উচ্চারিত হইল, কেষ্ট সিং ওই জানোয়ারটাকে ঘাড় ধরে আমার সীমানা থেকে বের করে দিয়ে এস।

পিসিমার উচ্চ কঠিন কণ্ঠস্বর শুনিয়া কেষ্ট সিং প্রায় নায়েবের সঙ্গেই আসিয়া লাঠি হাতে দাঁড়াইয়া ছিল। বিনা বাক্যব্যয়ে সে ওপাড়ের দিকে চলিয়া গেল। পিসিমা বলিলেন নায়েবকে, আপনি যান, সরকারি লোক যিনি জরিপ করতে এসেছেন, তাঁকে বলুন, আমি তার সঙ্গে দেখা করতে চাই।—বলিয়াই তিনি কাছারি-বাড়িতে ঢুকিয়া সতীশকে বলিলেন, সতীশ, কাছারি-ঘর খুলে দে, আর পাশের খোকার পড়ার ঘরের মধ্যের দরজা খুলে দিয়ে পরদাটা ফেলে দে। খোকা কোথায়? ডেকে দে।

আস্তাবলটার আড়ালে গা-ঢাকা দিয়া শিবনাথ শম্ভুর সহিত ফিসফিস করিয়া পরামর্শ করিতেছিল—সেই নেকড়ের বাচ্চা ধরিবার পরামর্শ। তাহার মনের মধ্যে বাঘ পুষিবার শখ নেশার মত প্রবল হইয়া উঠিয়াছে। রাত্রে স্বপ্নে পর্যন্ত ওই শাবকগুলি মন-গহনে খেলা করিয়াছে।

শম্ভুর উৎসাহ প্রবল, সে বলিল, উ ঠিক হবে আজ্ঞে। এই ঠিক ঝিকিমিকি বেলাতে ওদের মা-বাবাতে বেরিয়ে যাবে। আমরা অমুনি গত্ত থেকে বার করে নিয়ে আসব।

শিবনাথ একটু চিন্তা করিয়া প্রশ্ন করিল, আর বেশি থাকে না তো? পরক্ষণেই মনে পড়িল, সে পড়িয়াছে, মাংসাশী হিংস্ৰ জন্তুরা কখনও দশজনে মিলিয়া ঘর বাঁধিয়া থাকে না। তাহার মায়ের কথাটাও মনে পড়িল, মানুষ ও জানোয়ারের তফাতের কথা। কিন্তু ইউরোপে নেকড়েরা দল বাঁধিয়া শিকার করে। সে আবার চিন্তিত হইয়া প্রশ্ন করিল, আচ্ছা ওরা দল বেঁধে থাকে না?

না। একসঙ্গে দুটোর বেশি থাকে না। আমাদের মাঝিকে জিজ্ঞেস করুন কেনে।

মাঝি, অর্থাৎ শিবনাথদের সাঁওতাল কৃষাণ।

শম্ভু আবার বলিল, একটো বগিদা নিয়ে যাব, থাকেই যদি, এক কোপে বলিদান দিয়ে দোব আজ্ঞে।

শিবনাথও চট করিয়া একটা অস্ত্রের সন্ধান করিয়া ফেলিল, ক্রিকেটের উইকেট বল্লমের কাজ করিবে। মনে তাহার উত্তেজনা জাগিয়া উঠিল, থাকেই যদি, যুদ্ধ করিবে। ঠিক সেই সময়েই পিসিমার কণ্ঠস্বর তাহার কানে আসিয়া পৌঁছিল, খোকা কোথায়? ডেকে দে।

সরকারি কানুনগো আসিয়া কাছারি-ঘরে বসিলেন। শিবনাথ উভয় ঘরের মধ্যে পরদাটা ধরিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। ভিতরের ঘর হইতে আদেশ হইল, নমস্কার কর শিবনাথ।

তাঁহার কথা শেষ হইবার পূর্বেই শিবনাথ নমস্কার করিয়াছিল, সে বলিল, করেছি পিসিমা।

কানুনগোবাবু বলিলেন, আমাকে কিছু বলবেন?

পিসিমা ভিতর হইতে বলিলেন, হ্যাঁ। আমার সীমানার মধ্যে শেকল আনবার পূর্বে আমাকে কি জানাবারও দরকার নেই? আমি স্ত্রীলোক, আইনের কথা ভাল জানি না, আইন কি আপনাদের তাই?

কানুনগো একটু ইতস্তত করিয়া বলিলেন, হ্যাঁ, ম্যাপ অনুযায়ী জরিপ করলে জানাবার ঠিক দরকার হয় না।

প্রশ্ন হইল, ম্যাপ অনুসারেই কি জরিপ করেছেন?

কানুনগো জবাব দিলেন, না, ওঁদের কহত-মতই আমি জরিপ ২১ছিলাম। আর ওঁরা ঠিক আপনার সীমানা জরিপ করাচ্ছিলেন না, তালগাছের বেড়ার জন্য ওপাশে যেতে অসুবিধে হচ্ছিল, তাইতে আপনার সীমানার

এবার পিসিমা বাধা দিয়া বলিলেন, সীমানা আমার নয়, নাবালকের; এই ছেলেটির অভিভাবক সরকার-তরফ থেকে জজসাহেব, আমি তারই প্রতিনিধি।

কানুনগো ভদ্রলোক অভিভূত হইয়া পড়িতেছিলেন, স্ত্রীলোকের নিকট তিনি এমন প্রশ্নোত্তর প্রত্যাশা করেন নাই। তিনি বলিলেন, আমারই দোষ, অপনাদের অনুমতি নেওয়া সত্যিই আমার উচিত ছিল, তার জন্যে

আবার বাধা দিয়া পিসিমা বলিলেন, আপনি সরকারের কর্মচারী, আমাদের মান্যের ব্যক্তি। আপনাকে জবাবদিহি করতে আমি ডাকি নি; আমি শুধু ওইটুকু জানতে চেয়েছিলাম।

কানুনগো বলিলেন, না না, ওই বুড়ো ভদ্রলোকটির কথায় আমার লজ্জার সীমা নেই, আপনি যদি এর প্রতিকার চান—

তাঁহার কথায় বাধা দিয়া উত্তর আসিল, উনি গাঁজাখোর, তা ছাড়া ওপরদিকে থুতু ছুঁড়ে লাভ তো হয় না, সে নিজের গায়েই এসে পড়ে। আর আমার বাপ কী ছিলেন, সে তো এ চাকলার লোকের অজানা নয়। মামলা করে টাকার ডিক্রি নেওয়া চলে, সম্মানের ডিক্রি নিতে যাওয়া ভুল।

কানুনগো চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া বলিলেন, তা হলে আমি উঠি?

এবার শিবনাথ একটু অগ্রসর হইয়া আসিয়া বলিল, একটু চা খেয়ে যান।

কানুনগো হাসিয়া বলিলেন, না না খোকা, সে দরকার হবে না।

ভিতর হইতে অনুরোধ হইল, আমাদের হিন্দুর ঘর, তার ওপর আমরা জমিদার, আপনি অতিথি, সরকারি কর্মচারী, আপনি না খেলে বুঝব, আপনি অসন্তুষ্ট হয়েছেন আমাদের ওপরে।

কানুনগো এ কথার জবাব দিতে পারিলেন না।

শিবনাথ বলিল, চা দেওয়া হয়েছে আপনার।

কানুনগো মুখ ফিরাইয়া দেখিলেন, ছোট একটি টেবিলের ওপর রুপার রেকাবিতে মিষ্টান্ন এবং ধূমায়িত চায়ের কাপ শোভা পাইতেছে। দুয়ারের পাশে, হাতে গাড়ু, কাঁধে গামছা লইয়া চাকর দাঁড়াইয়া আছে।

কানুনগো চলিয়া গেলে পিসিমা বাহির হইয়া আসিলেন। বারান্দায় একজন দীর্ঘাকৃতি ভদ্রলোক দাঁড়াইয়া ছিলেন, তিনি শৈলজা-ঠাকুরানীকে প্রণাম করিয়া বলিলেন, ভাল আছেন?

সুযোগ পাইয়া শিবনাথ আবার শঙ্কুর সন্ধানে খামার-বাড়ির দিকে চলিয়া গেল।

পিসিমা ভদ্রলোকটিকে বলিলেন, এস আই এস, কি ভাগ্যি আমার, লক্ষ্মীর বরপুত্রের পায়ের ধুলো আজ সকালেই আমার ঘরে! তবে এলে তুমি, ভাল ছিলে?

ভদ্রলোকটি এই পাড়ারই, রামকিঙ্করবাবু, লক্ষপতি ব্যবসায়ী, কলকাতায় থাকেন।

রামকিঙ্করবাবু বলিলেন, পরশু এসেছি। আজ সকালেই বৈঠকখানার দোরে দাঁড়িয়ে এই হাঙ্গামাটা শুনলাম, শুনে তাড়াতাড়ি এলাম, যদি কোনো দরকারে লাগতে পারি।

পিসিমা স্মিতমুখে আশীৰ্বাদ করিয়া বলিলেন, বেঁচে থাক ভাই, ধনেপুত্রে বাড়বাড়ন্ত হোক তোমার। তোমাদের পাঁচজনেরই তো ভরসা করি।

রামকিঙ্কর হাসিয়া বলিলেন, ভরসা আপনাকে কারও করতে হবে না ঠাকরুনদিদি। লোকে আপনাকে ঠাট্টা করে বলে, ফৌজদারির উকিল। তা দেখলাম, উকিলের চেয়েও বড় আপনি, আপনি ব্যারিস্টার।

পিসিমা হাসিলেন, বলিলেন, আমায় তা হলে এবার কলকাতা থেকে গাউন আর টুপি এনে দিও, আর মামলা থাকলে খবর দিও।

রামকিঙ্করবাবু বলিলেন, মামলা একটা নিয়েই এসেছি ঠাকরুনদিদি। তবে এ মামলায় আপনি জজসাহেব, একেবারে হাইকোর্ট, এর আর আপিল নেই।

পিসিমা বলিলেন, তাই তো বলি, ব্যবসাদার কি বিনা গরজে কোথাও পা বাড়ায়! বেনেী বুদ্ধি পেটে পেটে হয় তাদের। কি, বল শুনি!

রামকিঙ্করবাবু বলিলেন, আমার মা-মরা ভাগ্নীটিকে আপনাকে নিতে হবে। শিবনাথের আপনি বিয়ে দিচ্ছেন শুনলাম।

পিসিমা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, তারপর ধীরে ধীরে বলিলেন, এখন এ কথার জবাব দিতে পারলাম না ভাই, কাল জবাব দোব।

রামকিঙ্করবাবু এ উত্তর প্রত্যাশা করেন নাই, তিনি ঈষৎ উষ্ণভাবে বলিলেন, কেন, আপনাদের জমিদারের ঘরের উপযুক্ত হবে না আমার ভাগ্নী?

পিসিমার মুখচোখ রাঙা হইয়া উঠিল, কিন্তু আত্মসংবরণ করিয়া তিনি বলিলেন, ঠিক উলটো ভাবছি ভাই,ভাবছি হাতির খোরাক যোগাতে কি আমার শিবনাথ পারবে? লক্ষপতির ঘরের মেয়ে। আমাদের মত ছোট জমিদারের ঘরে খাপ খাবে? তা ছাড়া তার মা আছে, তারও একটা মত চাই।

রামকিঙ্করবাবু একটু অপ্রতিভ হইয়া গিয়াছিলেন, তিনি বলিলেন, না, না, আপনার দাদার, আমাদের ঠাকুরদার প্রতাপে বাঘে-বলদে একঘাটে জল খেয়েছে; তার ছেলে শিবনাথ, সে বাঘিনী হলেও বশ মানাবে। ওই দেখুন না_সম্মুখেই প্রশস্ত অঙ্গনের মধ্যে তখন শিবনাথ একটা ঘোড়াকে শাসন করিতেছিল। কাহার একটা ছোট ঘোড়া, কিন্তু দুরন্তপনায় সে খাটো নয়, ক্ৰমাগত পিছনের পা দুইটি ঘুড়িয়া সওয়ার শিবনাথকে ফেলিয়া দিবার চেষ্টা করিতেছিল।

শিবনাথ হুকুম করিতেছিল শঙ্কুকে, দে তো রে একটা খেজুরের ডাল ভেঙে কাঁটাসুদ্ধ।

রামকিঙ্করবাবু হা-হা করিয়া হাসিয়া উঠিলেন, বলিলেন, শুনছেন?

পিসিমার মুখও আনন্দোজ্জ্বল হইয়া উঠিল, তিনি ডাকিলেন, শিবু, অ শিবু, নেমে আয়।

শিবু বলিল, দাঁড়াও না, বেটার পা ছোঁড়াটা একবার বের করে দিই।

পিসিমা বলিলেন, কার ঘোড়ায় চেপেছিস, মা শুনলে রাগ করবে!

সম্মুখেই এক প্রৌঢ় আধা-ভদ্র মুসলমান দাঁড়াইয়া ছিল, সে সসম্ভ্ৰমে অভিবাদন করিয়া বলিল, আমারই ঘোড়া মা, আমি আপনাদের প্রজা মা। আপনার মহল দোগাছির মোড়ল আমি।

পিসিমার মুখ গম্ভীর হইয়া উঠিল, তিনি বলিলেন, তুমিই সবজান শেখ।

প্রৌঢ় বলিল, আপনাদের গোলাম তাবেদার আমি মা।

পিসিমা রামবাবুকে বলিলেন, তুমি কাল সকালে একবার এস ভাই রাম, নান্তির কুষ্টিটাও নিয়ে এসো। আজ দেরি হয়ে গেল, কাল সকালে জলখাবারের নেমন্তন্ন রইল।

রামকিঙ্কর হাসিয়া বলিলেন, তাই আসব। কিন্তু সে মিষ্টি তো আমার ঘটকালির পাওনা। আজকের–

পিসিমা হাসিয়া বলিলেন, বেশ তো, দু থালা খাবে।

রামকিঙ্কর হাসিতে হাসিতে চলিয়া গেলেন। পিসিমার মুখে হাসি মিলাইয়া গেল, মুখখানা কঠোর হইয়া উঠিল; তিনি ডাকিলেন, শিবনাথ, নেমে এস!

শিবু শিবনাথ সম্বোধন এবং সম্পূর্ণ ভাষায় আদেশ শুনিয়া বুঝিয়াছিল, এ আদেশ অলঙ্নীয়। সে ঘোড়া হইতে নামিয়া কাছারির বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইল।

সবজান আসিয়া বলিল, প্রথমেই হুজুরের সঙ্গে দেখা, হুজুরকে সেলাম করতেই হুজুর বললেন, ওই পিসিমা রয়েছেন, হোথা যাও, আমি তোমার ঘোড়াটা দেখি।—বলিয়া সে এইবার শিবনাথের সম্মুখে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া দুই হাতে প্রসারিত একখানি লাল রেশমি রুমালের উপর পাঁচটি টাকা নজর হাজির করিল।

শিবনাথ চাহিয়া ছিল পিসিমার মুখের দিকে, সেখানে কখন কি ইঙ্গিত সে পাইল সে-ই জানে, সে টাকা পাঁচটি স্পর্শ করিয়া বলিল, নায়েববাবুর সেরেস্তায় দাও।

সবজান করজোড়ে বলিল, আমাকে রক্ষা করতে হবে হুজুর। আমাদের খাজনা নিতে হুকুম দিতে হবে।

শিবনাথ পিসিমার মুখের দিকে চাহিয়া ছিল। পিসিমার মুখ গভীর গাম্ভীর্যে থমথম করিতেছিল।

সবজান বলিল, হুজুর।

শিবনাথ একবার সবজানের দিকে চাহিয়া দেখিল, তাহার চোখের কোণে কোণে অশ্রু জমা হইয়া উঠিতেছে। সে বলিয়া উঠিল, বেশ তো, খাজনা দাও না তুমি।—বলিয়াই সে বলিল, পিসিমা!

পিসিমার অনুমতি প্রার্থনায় সবজানও একান্ত অনুনয়পূর্ণ কণ্ঠে বলিল, মা!

পিসিমা হাসিয়া বলিলেন, মালিকের হুকুম হয়ে গিয়েছে সবজান, সে তো আর না হয় না।

সবজান বার বার সেলাম করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। পিসিমা বলিলেন, দু ফোঁটা চোখের জলে তুমি আমার কাছে রেহাই পেতে না সবজান। আরও একটু শিক্ষা তোমায় আমি দিতাম। যাক, কিন্তু স্বীকার করে যাও, জমিদারের লোককে বিনা কারণে অপমান আর কখনও–

সবজান বলিয়া উঠিল, আমরাও তো আপনার ছেলে মা।

পিসিমার ভ্রূ কুঞ্চিত হইয়া উঠিয়াছিল। তিনি বলিলেন, কথার ওপর কথা বলতে নেই সবজান। ছেলে তোমরা নিশ্চয়ই, কিন্তু অবাধ্যতার জন্যে তোমাদের ওই মালিক শিবনাথের পিঠেও মারের দাগ দেখতে পাবে। এস শিবনাথ।

শিবনাথের হাত ধরিয়া পিসিমা চলিয়া গেলেন। কিছুক্ষণ পর সতীশ চাকর মাটির বাসনে করিয়া জলখাবার আনিয়া বলিল, শেখজী, আপনার জলখাবার।

নায়েবের সম্মুখে ছোট একটা কাগজের টিপ ফেলিয়া দিয়া সতীশ নায়েবকে বলিল, শেখজীর বিদেয়।

নায়েব পড়িল, চিরকুটে লেখা রহিয়াছে দোগাছির মণ্ডল সবজান শেখের বিদায়ের জন্য একজোড়া কাপড় ও চাদর আনিয়া দিতে হইবে। সহি করিয়াছেন শিবনাথের মাতা, আর এক পাশে একটা ঢেরা-সহি, এইটুকু পিসিমার হুকুম; পিসিমা অল্প পড়িতে জানেন, কিন্তু লিখিতে জানেন না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress