Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ধরণীর দয়া-রাজ ও হিংসুটে বোনেরা || Sankar Brahma

ধরণীর দয়া-রাজ ও হিংসুটে বোনেরা || Sankar Brahma

ধরণীর দয়া-রাজ ও হিংসুটে বোনেরা

প্রায় দু’শো বছর আগের কথা, এক ধনী বণিক বাস করতেন কলকাতায়। নাম তার ছিল গোপাল শেঠ। তিনি মধ্য-প্রাচ্যে মাল রপ্তানি করতেন জাহাজে করে – পাকা-চামড়া, দামী সিল্ক ও মসলিন, সুগন্ধী আতর, রেশম শিল্প সামগ্রী প্রভৃতি। তখন ইংরেজ আমল। ইংরেজদের সঙ্গে তার বনিবনা ছিল।
পত্নী ছিল না তার। ছিল সুন্দরী তিন কন্যা। পত্নী গত হয়েছেন প্রায় ষোল বছর আগে, তার ছোট মেয়ে ধরণী জন্মাবার সময়।
তিনি মেয়েদের সর্বদা দামী পোশাক, গহনা এবং তাদের প্রয়োজনীয় সব কিছু কিনে দিতেন। তাদের কোন অভাব রাখতেন না।
ছোট মেয়েটির নাম ছিল – ধরণী।
সে এত দয়ালু ছিল, তার ব্যবহার এত মিষ্টি ছিল,
যে সকলেই তাকে ভালবাসত। এমন কী বণিকেরও সে খুব প্রিয় ছিল।
বাকী দুই মেয়ের নাম ছিল – তরণী ও স্মরণী।
একদিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর বণিক তিন মেয়ের সঙ্গে বসে খোস-গল্প করছিলেন। এমন সময় খবর এলো সমুদ্র ঝড়ে তার পণ্য বোঝাই জাহাজ দুটি হারিয়ে গেছে। তিনি মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। মেয়েরা তা দেখে বলল, কি হয়েছে বাবা?
তিনি তাদের সব খুলে বললেন। শেষে বললেন,
এবার আমাদের কোন গ্রামে গিয়ে গরীবের মতো বাস করতে হবে। আর বাঁচার জন্য হয়তো চাষের কাজ করতে হবে আমাদের।
এরপর তিনি তার সব সম্পতি বিক্রি করে, যাদের থেকে দেনায় সব মালপত্র নিয়েছিলেন,
সেই সব দেনা শোধ করে দিয়ে, সোনারপুরের এক গ্রামে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করলেন।

ধরণী তা হাসি মুখে মেনে নিলেও তরণী আর স্মরণী তা মেনে নিতে পারল না।
এতদিন তারা দামী পোষাক পরে , ভাল খাবার খেয়ে অভ্যস্ত ছিল। আর আজ মোটা চালের ভাত খেয়ে, সুতির শাড়ি পরে ধরণী আগের মতো হাসিখুশি থাকলেও, বাকী দুই বোন তরণী আর স্মরণী সব সময়, খিচ খিচ করত। এটা নেই, সেটা নেই। এটা-সেটা কিভাবে জোগাড় হবে সেটা নিয়ে তারা ভাবত না।
বাবা গোপালবাবু ওই দুই মেয়েকে কোন কাজ করতে বললে, তারা বলত, আমাদের হাত এত নরম আর সাদা পরিস্কার তা দিয়ে আমরা কি করে এসব কাজ করব?
ধরণী কোন আপত্তি করত না। সে যতটা পারত তার সামর্থ অনুযায়ী খুশি মনে তার বাবাকে সাহায্য করত । আর তার দুই দিদিকে বলত, আমরা নিশ্চয়ই রান্নার কাজ, সেলাইয়ের কাজ, মাঠের কাজ শিখে নেব একদিন অন্য সবার মতো, চিন্তা করিস না।
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে, ঝাঁটা হাতে নিয়ে, সারা উঠোনটাকে ঝেড়ে পরিস্কার করে তুলতে ঘেমে নেয়ে গেছে ধরণী। তারপর তাদের বাসী জামা-কাপড় সব পুকুরে নিয়ে গিয়ে কেঁচে নিয়ে, স্নান সেরে বাড়ি ফিরেছে। দেখে দিদিরা তখনও সব শুয়ে ঘুমোচ্ছে। কোন দায়িত্ব নেই। বাবা সেই কোন ভোরে উঠে মাঠের কাজে গেছে।
সে কিছু কাঠ-কুঠো জোগাড় করে, আগুন জ্বেলে
মোটা চাল চড়িয়ে দিল হাড়িতে। বাবা ফিরে এসে যদি দুটো ভাত না পায়, তাহলে কেমন দেখায়? সে ভাবনা ধরণীর থাকলেও , তার দিদিদের নেই। থাকলে কি আর এতক্ষণ নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারত?
এমন সময় জটা-জুট ধারী এক সন্ন্যাসী এসে বলল, মা কিছু খেতে দিবি?
ধরণী তাকে একটি আসন পেতে দিয়ে বলল, আপনি বসুন, এই তো গরম গরম ভাত নামলেই আপনাকে খেতে দিয়ে দেব।
ঘরে একটু ঘি ছিল, তা দিয়ে আর লবন, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে তাকে গরম গরম ফুটানো ভাত দু’হাতা হাড়ি থেকে তুলে তার পাতে দিয়ে ধরণী বলল, নিন খান এবার। সন্ন্যাসী তা খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে, তার স্বরূপ প্রকাশ করে বললেন, আমি তোর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছি মা। আমি হলাম মহাদেব আমার কাছে তুই একটা বর চেয়ে নে।
অলি বলল, আপনি যদি সত্যিই বর দিতে চান, তবে এমন বর দিন, যাতে আমার বাবার হারানো জাহাজ দুটি ফেরৎ পাওয়া যায়।
– তথাস্তু বলে দেবাদিদেব অদৃশ্য হলেন। এরপরই মাঠ থেকে ফিরে এলেন তার বাবা।
মেয়ে ধরণীকে বললেন, জানিস মা, আমাদের জাহাজদু’টি খুঁজে পাওয়া গেছে, ঘোড়ায় চড়ে এক সাহেব এসে আমাকে খবর দিয়ে গেল মাঠে।
আমার কিছু খেতে দে। আমি খেয়ে বন্দরে গিয়ে
পাকা-খবর নিয়ে আসি। ততক্ষণে তরণী আর স্মরণী ঘুম থেকে উঠে পড়েছে।
তরণী শুনে বলল, বাবা তুমি যখন বন্দরে যাচ্ছা তখন আমার জন্য এক-ছড়া মুক্ত-মালা হার এনো।
স্মরণী বলল, আমার জন্য এনো একজোড়া হীরে বসানো বালা।
ধরণী কিছু বলছে না দেখে গোপালবাবু বললেন, তোর কি চাই মা, বল না?
– আমার কিছু চাই না বাবা। তুমি ভালোয় ভালোয় কাজ সেরে ফিরে এসো, সেটাই শুধু চাই আমি।
– সে তো আসবই। তবুও বল একটা কিছু
– আমার জন্য তবে একটা গোলাপ এনো, ধরণী বলল।
– শুধু একটা গোলাপ?
– হ্যাঁ বাবা আর কিছু চাই না আমার।

গোপাল বাবু ভাত খেয়েই রওনা দিলেন, বন্দরের উদ্দেশ্যে। বন্দরে এসে শুনলেন, গভীর সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া দু’টি জাহাজ পাওয়া গেছে। সে দু’টি জাহাজ যে তার, সেটা প্রমাণ-পত্র দেখিয়ে তবে ছাড়াতে হবে। প্রমাণ-পত্র তো সোনার পুরের বাড়িতে আছে। সেখান থেকে আনতে হবে তবে।
বাড়ি ফেরার সময় প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টি শুরু হল। সব গাড়ি-ঘোড়া বন্ধ হয়ে গেল। হেঁটে ফেরা ছাড়া আর কোন উপায় রইল না। অগত্যা সে হাঁটা শুরু করল। কম পথ? পথ যেন আর শেষই হতে চায় না। আবার ঝড়-বৃষ্টি শুরু হল। এখন একটা আশ্রয় দরকার । বেহাল রাস্তার পাশেই গভীর বন। বনের ভিতর যেন কোথায় বাতি জ্বলছে, তার রশ্মি দেখা যাচ্ছে। তিনি সে দিকে হাঁটা শুরু করলেন।
সেখানে পৌঁছে দেখলেন, একটা সুন্দর অট্টালিকা। ডেকে সাড়া পেলেন না কারও । সব শুনশান।
কেউ কোথাও নেই। তিনি বাড়ির ভিতর ঢুকে দেখলেন। রান্না ঘরে সু-স্বাদু খাবার সাজানো, তাঁর ঘ্রাণে জিবে জল এসে গেল তার। শোবার ঘরে পরিপাটি করে বিছানা সাজানো।
আর কী চাই? যখন বাইরে প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তখন এরচেয়ে ভাল আর কিছু আর প্রত্যাশা করা যায় না।
তিনি তৃপ্তি সহকারে খাবার খেয়ে,পরিপাটি বিছানায় শুয়ে, এক ঘুমে ভোর করে দিলেন।
ভোরে উঠে জানলা দিয়ে দেখলেন, বাইরের বাগানে কী সুন্দর গোলাপ ফুল ফুটে আছে। ধরণীর কথা মনে পড়ে গেল তার। সে একটা গোলাপ ফুল নিয়ে যেতে বলছিল। তিনি বিছানা ছেড়ে উঠে, হাত মুখ ধুয়ে বাগানে গেলেন।
একটি ফুল ছিঁড়তে যাবেন এমন সময় কেউ বজ্র-কঠিন স্বরে বলে কেউ উঠল –
– একদম হাত দেবেন না
গোপাল বাবু তাকিয়ে দেখলেন, বিশ্রী কদাকার এক দানব।
– আপনি কে?
– বাঃ রে ! আমি কে? আমারই খাবার খেলে,
আমার বিছানায় শুলে, আবার আমার বাগানেরই ফুল ছিঁড়তে যাচ্ছ? কেন?
– আমার ছোট মেয়ে ধরণীর জন্য, সে একটা গোলাপ নিয়ে যেতে বলেছিল, তাই –
– কয়টি মেয়ে আপনার?
– তিন মেয়ে
– বাকী দু’জন কিছু নিয়ে যেতে বলেনি?
– হ্যাঁ বলেছে, তরণী নিয়ে যেতে বলেছে, এক-ছড়া মুক্ত মালার হার,আর স্মরণী নিয়ে যেতে বলেছে, হীরে বসানো একজোড়া বালা।
– আমি দয়াসুর। এখানকার মালিক। আসলে আমি ছিলাম একসময় এখানকার রাজা, এক বদরাগী, কুপিত-দর্পধারী দুষ্ট সন্ন্যাসীর অভিশাপে আমি দানবে পরিণত হয়েছি। এই নির্জন বনে একা পড়ে আছি। প্রজারা সব আমায় ছেড়ে ভয়ে পালিয়ে গেছে।
– এর থেকে আপনার মুক্তির কি কোন উপায় নেই।
– হ্যাঁ আছে।
– কোন কুমারী মেয়ে যদি সত্যিকারের আমায় ভালবাসে তবে, আমার এই শাপ কেটে যাবে আমার। আমি মুক্তি পাব।
– আচ্ছা আমি খুঁজে দেখব। তেমন কেন মেয়ে পাওয়া যায় কীনা, আমি আপনার কথা মনে রাখব।
দয়া-দানব তার আলমারি খুলে, তরণীর জন্য এক-ছড়া মুক্ত-মালার হার, স্মরণীর জন্য হীরে বসানো এক-জোড়া সোনার বালা, আর ধরণীর জন্য বাগানের সেরা গোলাপটি নিজের হাতে তুলে তিনি গোপালবাবুকে দিলেন।
গোপালবাবু তাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে, তাই নিয়ে সেখান থেকে সেইদিন নিজের বাড়ি ফিরে এলেন।
মেয়েরা তো খুব খুশি, তাদের পছন্দ মতো জিনিষ পেয়ে।
ধরণী গোলাপটি নিয়ে একটি কাচের জারে জল ভর্তি করে , সেটায় রেখে দিল। সারা ঘর গোলাপ গন্ধে ভরে গেল। সে বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে বলল, আ হ হ্।
সেদিনই ঘুমের ভিতর সে স্বপ্ন দেখল, গোলাপটা থেকে ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়ে এলো এক রাজকুমার।
তাকে বলল, তোমায় আমি বিয়ে করে নিয়ে যেতে এসেছি । ধরণী আড় চোখে রাজকুমারের মুখটা দেখার চেষ্টা করেন। রাজ মুকুটে অনেকটা ঢাকা পড়ে গেছে তার মুখটা। মুখের খানিকটা অংশ দেখা যাচ্ছে।
পরদিন ঘুম থেকে উঠে মনে তার সেই স্বপ্নের রেশ লেগে রইল।
গোপালবাবু বেরোবার সময়, ধরণী বলল,বাবা আমি তোমার সঙ্গে যাব।
– না মা, সে অনেক দূরের পথ। তুই পারবি না, তোর কষ্ট হবে খুব।
– না বাবা আমি পারব। দেখো তুমি –
গোপালবাবু আর কিছু না বলে, তাকে সঙ্গে নিয়ে নিলেন। ভাবলেন ধরণী তো কখনও কিছু বায়না করে না। তবে আজ যখন যাওয়ার জন্য আবদার করছে, তখন চলুক না হয় সঙ্গে।
সোনানপুর থেকে ট্রেনে করে তাদের কলকাতা পৌঁছেতে বেশী বেগ পেতে হল না। খিদিরপুর বন্দরে যেতে অনেকটা পথ এখনও হাঁটতে হবে।ঘোড়ার গড়িতে অনেক ভাড়া। তাছাড়া জায়গাটাও তেমন ভাল না। নানা-রকম আজে-বাজে লোকের আনাগোনা সেখানে। তাই গোপালবাবুর ধরণীকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। তিনি ভাবলেন এখন এক কাজ করলে হয়। দয়া-দানবের কাছে ধরণীকে রেখে গেলে কেমন হয়? তার মনে দয়া মায়া আছে। সে ধরণীর কোন ক্ষতি করবে না নিশ্চিৎভাবেই।
সে কথা ভেবে, গোপালবাবু ধরণীকে বললেন, গোলাপটা তোকে সেদিন যে বাগান থেকে এনে দিয়েছি , সেই বাগানটা এ পথেই পড়বে। দেখবি নাকি একবার?
ধরণী শুনে খুব খুশি হয়ে, আনন্দে লাফিয়ে উঠল। বলল, হ্যাঁ বাবা চল। দেখে আসি।
গোপালবাবু এসে দয়া-দানবকে ডাক দিতেই,
সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে গোপালবাবুকে দেখে খুব খুশি হলেন। তার সঙ্গে ধরণীকে দেখে বললেন, এ কে?
– আমার মেয়ে ধরণী। যার জন্য সেদিন গোলাপটা নিয়ে গেছিলাম।
দয়া-দানবের ভয়াল চেহারা দেখে ধরণীর মনে কোন আতঙ্ক বা ঘৃণা সৃষ্টি হল না। বরং তার জন্য করুণা ও মায়া হল একরাশ।
দয়া-দানব তাকে বাগানটা ঘুরে দেখালেন।
বাগান দেখে তো একেবারে মুগ্ধ ধরণী। একরাশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে ফেলল দয়া-দানবের সামনেই।
তারপর দয়া-দানব তাদের ঘরে এনে খাবার টেবিলে বসতে বললেন। নিজের হাতে তাদের সমস্ত রকম সুখাদ্য পরিবেশন করলেন। ওরাও খুব তৃপ্তি সহকারে সব কিছু চেটে পুটে খেল।
তারপর এখানেই ধরণীকে থাকতে বলে, তিনি একা রওনা হলেন বন্দরের অফিসের উদ্দেশ্যে। তারপর কাগজ-পত্র সব দেখিয়ে তার জাহাজ ছাড়িয়ে নিয়ে, বন্দরের হেফাজতে রেখে ফিরে এলেন দয়া-দানবের সুদৃশ্য অট্টালিকায়। সেখান থেকে ধরণীকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলেন নিজের গ্রামের বাড়িতে। তাদের ফেরার সময় দয়া-দানব বাগান থেকে ধরণীর জন্য একটা সতেজ-টাটকা গোলাপ ফুল তুলে তাকে উপহার দিলেন। ধরণী গোলাপ ফুলটি পেয়ে খুব খুশি হল,এবং তাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে, বাবার সঙ্গে নিজেদের বাড়ি ফিরে এলো।

গোপালবাবুর জাহাজ আবার মাল-পত্র বোঝাই করে নিয়ে, মধ্য প্রাচ্যে পাড়ি দিল। সব সামগ্রী বিক্রি করে জাহাজ এবার ফিরে এলেই, তারা পুনরায় কলকাতায় গিয়ে বসবাস করবেন ঠিক হল।
মাস তিনেক পর গোপালবাবু খবর পেলেন, দয়া-দানব খুব অসুস্থ। তার প্রাণ নিয়ে টানাটানি শুরু করেছে যম। কথাটা ধরণীর কানে যেতেই সে খুব অস্থির হয়ে উঠল। যে তাকে ভালবেসে ফুল উপহার দিয়েছে, তাকে একবার মৃত্যু শয্যায় দেখতে যাবে না? তা কি হয় ! না গেলে অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায়। তা কিছুতেই ধরণী সইতে পারবে না। তাই বাবাকে বলল, আজই চল বাবা আমরা একবার দেখে আসি তাকে। গোপাল বাবু রাজী হলেন। এবং ধরণীকে নিয়ে দয়া-দানবের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।
সেখানে পৌঁছে দেখলেন, এত শরীর খারাপ যে দয়া-দানব একেবারে বিছানার সঙ্গে মিশে গেছেন। গলার স্বর ম্রিয়মান।
ধরণী সেখানে পৌঁচ্ছেই নাওয়া-খাওযা ভুলে, দিন-রাত্তির তার সেবা যত্ন শুরু করল। ওষুধ পথ্য সময় মতো তার মুখে তুলে দিল। এভাবে তিন রাত্রি পার হল। পরদিন সকাল থেকেই দয়া-দানবের শ্বাসটান শুরু হল। যখন তার প্রাণটা বেরিয়ে যাবে, যম তা নিয়ে যাবার জন্য তার মাথার কাছে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । ঠিক সেইসময় ধরণী চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে উঠল, এভাবে আপনি এই ধরণীকে ছেড়ে চলে যেতে পারেন না। এই ক’দিনেই আমি আপনাকে ভালবেসে ফেলেছি। খুব ভালবাসি আপনাকে।
তার পরমুহূর্তেই আশ্চর্য ঘটনাটি ঘটল। দয়া-দানবের আশ্চর্য রূপন্তর ঘটল। তার ভয়াল চেহারাটা ক্রমে বদলে গিয়ে, আশ্চর্য সুন্দর সবল সুপুরুষের চেহারায় প্রকাশ পেল। ধরণী তা দেখে আশ্চর্য অবাক হয়ে গেল।
মুখটা ঠিক যেন তার স্বপ্নে দেখা রাজকুমারের মুখের মতো মনে হল।
গোপালবাবু তখন ধরণীকে দয়া-দানবকে দেওয়া, ক্রুদ্ধ সন্ন্যাসীর অভিশাপের কথা বললেন।
এরপর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠে, দয়া-রাজ ধরণীকে তার মহিষী করার প্রস্তাব দিলেন গোপাল বাবুর কাছে।
গোপাল বাবু শুনে বললেন, আচ্ছ,আমি ধরণীর সাথে কথা বলে, একটু ভেবে আপনাকে কিছুদিনের মধ্যেই জানাব।
গোপাপবাবু মেয়েকে নিয়ে ফিরে এলেন
সোনারপুরের নিজের বাড়িতে। তারপর বাড়ি এসে ভাবলেন, আগে বড় মেয়ে দু’টির বিয়ে দিতে হবে। তা না হলে তো ছোট মেয়ের বিয়ে দেওয়া আমাদের সমাজে শোভনীয় হবে না। তরণী ও স্মরণীর জন্য ছেলে দেখা শুরু করলেন তিনি। কিছুদিনের মধ্যে বন্দরের মাছের আরতদারের বড় ছেলের সঙ্গে তরণীর বিয়ে ঠিক হল। ছেলেটি দেখতে রূপবান, গুণবান কিনা তা গোপালবাবু জানেন না। ছেলের ছবি দেখে বড় মেয়ে তরুণীর পছন্দ হয়ে গেল। এরপর স্মরণীর জন্য মেয়ে খোঁজার পালা শুরু হল। গ্রামেরই এক সম্পন্ন চাষীর ছোট ছেলের সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা চলার পর তা পাকা হল , স্মরণীর পছন্দ হল তাকে। ছেলেটি কলেজে পড়ে, ফাইন্যাল ইয়ার। ছেলেটি সঙ্গে স্মরণীর বিয়ে দিয়ে দেবেন ঠিক করলেন। ছেলেটি দেখতে বেশ স্মার্ট । কথাবার্তায়ও ভদ্র।

একদিন নিজের কাজের প্রয়োজনে বন্দরে যাবার পথে দয়া-দানবের বাড়িতে গিয়ে তাকে
সব কথা জানালেন। আরও জানালেন, ওদের বিয়েটা হয়ে গেলেই তিনি ছোট মেয়ে ধরণীর বিয়ে দেবেন। সব শুনে দয়া-দানব খুব খুশি হলেন। প্রয়েজনে তিনি তাকে সব রকম সাহায্য করবেন এই কথা গোপালবাবুকে জানালেন।
এবার ধরণীর মনের কথাটা জানতে হবে।
তার কোন আপত্তি আছে কিনা দয়া-রাজকে বিয়ে করতে। এইসব ভেবে, বন্দরের কাজ সেরে তিনি গ্রামের বাড়িতে ফিরে এলেন।
দিদিদের বিয়ের আয়োজন হচ্ছে দেখে, ধরণীর মন খুশিতে ভরে আছে। কত মজা হবে
দিদিদের বিয়েতে তার। সেকথা মনে হতেই আর একটা দৃশ্য তার চোখে ভেসে উঠল। দয়া-রাজ ঘোড়ায় চড়ে এসে তাকে ডেকে বললেন, ও মেয়ে
তোমায় আমি বিয়ে করতে চাই। তুমি কি রাজী?
বাবার ডাকে তার স্বপ্ন-ঘোর কাটল। বাবা ডেকে বলল, তোকে একটা কথা বলতে চাই। কী ভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না।
– কি কথা? তুমি বলো না বাবা।
– দয়ারাজকে তোর কেমন লাগে?
– ভালই তো
– ওকে তোর পছন্দ হয়?
– কেন বাবা?
– ও তোকে বিয়ে করতে চায়। তোর কোন আপত্তি নেই তো?
– সে তুমি যা ভাল বুঝবে, তাই করবে
– তবুও তোর একটা মত
– আমি কি কখনও বাবা, তোমার অমতে গেছি?
– আমাকে বাঁচালি মা।
তোর দিদিদের বিয়ে হয়ে গেলেই। তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করব আমি। তা শুনে ধরণী লাজুক ভঙ্গীতে মাথা নামিয়ে নিল নীচের দিকে।

সমস্ত পণ্য বিক্রি করে জাহাজদু’টি তারও কয়েকদিন পর বন্দরে ফরে এলো। এবার প্রচুর লাভ হয়েছে।
কিছুদিনের মধ্যেই ধুম-ধাম করে দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। দয়া-রাজ সেই বিয়েতে না আসতে পারলেও প্রচুর উপঢৌকন পাঠিয়েছেন তাদের জন্য। ধরণী খুব আনন্দ করল,দিদিদের বিয়েতে। মনে মনে ভাবল এবার তার পালা।
গোপাল বাবুর জাহাজদুটি আবার পণ্য বোঝাই করে মধ্য-প্রাচ্যের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিল।
এরমধ্যে গোপালবাবু দয়ারাজের সঙ্গে কথা বলে বিয়ের দিন পাকা করে ফেলল।
ইতিমধ্যে দয়ারাজের অনেক প্রজাই দয়া-রাজের পরিবর্তন দেখে দেশে ফিরে এসেছে। তাদের মধ্যে সাজ-সাজ রব পড়ে গেল। সেজে উঠল সার রাজ্য। সেজে উঠল দয়ারাজের দরবার। বিয়ের দিন যত এগিয়ে আসতে লাগল, ধরণীর মন তত চঞ্চল হয়ে উঠতে লাগল। মনের ভিতরটা কেমন অস্থির হয়ে উঠল, নানা কথা ভেবে। বাবাকে একা ফেলে রেখে সে চলে যাবে দয়ারাজের কাছে। বাবা বড় একা হয়ে যাবেন। কী করে কাটবে তার। এইসব নানা দুশ্চিন্তায় তার মাথার ভিতরটা তালগোল পাকিয়ে গিয়ে,ভীষণ অস্থির লাগছে তার।
সময় বসে থাকে না। নদীর মতো সামনের দিকে প্রবাহিত হয়। দেখতে দেখতে ছ’মাস কেটে গেল। জাহাজদুটি আবার বন্দরে ফিরে এলো পণ্য বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা লাভ করে। তার কয়েকদিন পরেই দয়ারাজের সঙ্গে বিয়ের দিন পাকা করা হলো। দয়ারাজের রাজ্যে সাজো সাজো রব পড়ে গেছে এরই মধ্যে। জরুরী ভিত্তিতে নগর সেজে উঠল। প্রজাদের মনে আর আনন্দ ধরে না। এতদিন পরে রাজ্যে কোন বড় উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। রাজ্যের সকলে নিমন্ত্রিত এই বিয়ের অনুষ্ঠানে, তা ঢেরা পিটিয়ে দু’দিন আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে সকলকে।

মহাসমারোহে পয়লা ফাল্গুনের দিন বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হল। সারা মাস ধরে চলল উৎসব। দয়ারাজ ধরণীকে তার মহিষী রূপে পেয়ে খুব খুশি হল মনে মনে। ধরণীও খুব খুশি। তবু তার মনটা বাবার জন্য কেমন করতে লাগল।
তা দয়ারাজের নজর এড়ালো না। কয়েক দিন পর সে ধরণীকে জিজ্ঞাসা করল, তোমাকে এমন বিষন্ন দেখাচ্ছে কেন? তুমি কি আমাকে বিয়ে করে খুশি হওনি?
ধরণী বলল, না না, তা নয়। বাবার জন্য মনটা কেমন করছে।
দয়ারাজ বলল, ঠিক আছে তোমার বাবাকে না হয় এখানে আনিয়ে রাখছি।
ধরণী শুনে বলল, তাহলে তো খুবই ভাল হয়।

এর কিছুদিন পর খবর আসে, গোপাল শেঠের মাঝরাতে হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল, প্রতিবেশীরা তাকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেলে, সেখানে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। শুনে ধরণী আলু-থালু হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। দযারাজ পুত্রতুল্য হয়ে তার শ্রদ্ধাদির সমস্ত আনুষ্ঠানিক ক্রিয়া কর্ম সম্পন্ন করেন।
কিছুদিন পর জাহাজ দু’টি দুই মেয়ের নামে রেজিষ্ট্রি করে লিখে দেন। এবং দয়ারাজ ধরণীকে নিয়ে গয়ায় গিয়ে গোপাল বাবুর পিন্ড-দানের আনুষ্ঠানিক ক্রিয়া কর্ম সম্পন্ন করে ফিরে আসেন।

দু’বছর পর দয়ারাজের এক পুত্র সন্তান হয়।
শিশুর মুখটি একেবারে গোপাল শেঠের মতো।
দয়ারাজ ধরণীকে বলে, দেখ, তোমার বাবা আবার তোমার কাছে ফিরে এসেছেন নতুন কর জন্ম নিয়ে। এ কথা শুনে ধরণীও মনে মনে খুব খুশি হয়। সন্তান জন্মাবার পর তাদের সংসারে যেন খুশি আর আনন্দের জোয়ার বইতে থাকে।
কিন্তু তরণী ও স্মরণী দুই বোন ধরণীর সংসারে সুখের আতিশয্য দেখে হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরতে থাকে , মনে মনে। তাদের কারও তা সহ্য হয় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress