দুর্গেশনন্দিনী – ২য় খণ্ড – ০১-০৫
প্রথম পরিচ্ছেদ : আয়েষা
আয়েষা, জগৎসিংহ যখন চক্ষুরুন্মীলন করিলেন, তখন দেখিলেন যে, তিনি সুরম্য হর্ম্যমধ্যে পর্যঙ্কে শয়ন করিয়া আছেন। যে ঘরে তিনি শয়ন করিয়া আছেন, তথায় যে আর কখন আসিয়াছিলেন, এমত বোধ হইল না; কক্ষটি অতি প্রশস্ত, অতি সুশোভিত; প্রস্তরনির্মিত হর্ম্যতল, পাদস্পর্শসুখজনক গালিচার আবৃত; তদুপরি গোলাবপাশ প্রভৃতি স্বর্ণ রৌপ্য গজদন্তাদি নানা মহার্ঘবস্তু-নির্মিত সামগ্রী রহিয়াছে; কক্ষদ্বারে বা গবাক্ষে নীল পর্দা আছে; এজন্য দিবসের আলোক অতি স্নিগ্ধ হইয়া কক্ষে প্রবেশ করিতেছে; কক্ষ নানাবিধ স্নিগ্ধ সৌগন্ধে আমোদিত হইয়াছে।
কক্ষমধ্যে নীরব, যেন কেহই নাই। একজন কিঙ্করী সুবাসিত বারিসিক্ত ব্যজনহস্তে রাজপুত্রকে নি:শব্দে বাতাস দিতেছে, অপরা একজন কিঙ্করী কিছু দূরে বাক্শহক্তিবিহীনা চিত্র-পুত্তলিকার ন্যায় দণ্ডায়মানা আছে। যে দ্বিরদ-দন্ত-খচিত পালঙ্কে রাজপুত্র শয়ন করিয়া আছেন, তাহার উপরে রাজপুত্রের পার্শ্বে বসিয়া একটি স্ত্রীলোক; তাঁহার অঙ্গের ক্ষতসকলে সাবধানহস্তে কি ঔষধ লেপন করিতেছে। হর্ম্যতলে গালিচার উপরে উত্তম পরিচ্ছদবিশিষ্ট একজন পাঠান বসিয়া তাম্বূল চর্বণ করিতেছে ও একখানি পারসী পুস্তক দৃষ্টি করিতেছে। কেহই কোন কথা কহিতেছে না বা শব্দ করিতেছে না।
রাজপুত্র চক্ষুরুন্মীলন করিয়া কক্ষের চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন। পাশ ফিরিতে চেষ্টা করিলেন; কিন্তু তিলার্ধ সরিতে পারিলেন না; সর্বাঙ্গে দারুণ বেদনা।
পর্যঙ্কে যে স্ত্রীলোক বসিয়াছিল, সে রাজপুত্রের উদ্যম দেখিয়া অতি মৃদু বীণাবৎ মধুর স্বরে কহিল, “স্থির থাকুন, চঞ্চল হইবেন না।”
রাজপুত্র ক্ষীণস্বরে কহিলেন, “আমি কোথায়?”
সেই মধুর স্বরে উত্তর হইল, “কথা কহিবেন না, আপনি উত্তম স্থানে আছেন। চিন্তা করিবেন না, কথা কহিবেন না।”
রাজপুত্র পুনশ্চ অতি ক্ষীণস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বেলা কত?”
মধুরভাষিণী পুনরপি অস্ফুট বচনে কহিল, “অপরাহ্ন। আপনি স্থির হউন, কথা কহিলে আরোগ্য পাইতে পারিবেন না। আপনি চুপ করিলে আমরা উঠিয়া যাইব।”
রাজপুত্র কষ্টে কহিলেন, “আর একটি কথা; তুমি কে?”
রমণী কহিল, “আয়েষা।”
রাজপুত্র নিস্তব্ধ হইয়া আয়েষার মুখ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। আর কোথাও কি ইঁহাকে দেখিয়াছেন? না; আর কখন দেখেন নাই; সে বিষয় নিশ্চিত প্রতীতি হইল।
আয়েষার বয়:ক্রম দ্বাবিংশতি বৎসর হইবেক। আয়েষা দেখিতে পরমা সুন্দরী, কিন্তু সে রীতির সৌন্দর্য দুই চারি শব্দে সেরূপ প্রকটিত করা দু:সাধ্য। তিলোত্তমাও পরম রূপবতী, কিন্তু আয়েষার সৌন্দর্য সে রীতির নহে; স্থিরযৌবনা বিমলারও এ কাল পর্যন্ত রূপের ছটা লোক-মনোমোহিনী ছিল; আয়েষার রূপরাশি তদনুরূপও নহে। কোন কোন তরুণীর সৌন্দর্য বাসন্তী মল্লিকার ন্যায়; নবস্ফুট, ব্রীড়াসঙ্কুচিত, কোমল, নির্মল, পরিমলময়। তিলোত্তমার সৌন্দর্য সেইরূপ। কোন রমণীর রূপ অপরাহ্নের স্থলপদ্মের ন্যায়; নির্বাস, মুদিতোন্মুখ, শুষ্কপল্লব, অথচ সুশোভিত, অধিক বিকসিত, অধিক প্রভাবিশিষ্ট, মধুপরিপূর্ণ। বিমলা সেইরূপ সুন্দরী। আয়েষার সৌন্দর্য নব-রবিকর-ফুল্ল জলনলিনীর ন্যায়; সুবিকাশিত, সুবাসিত, রসপরিপূর্ণ, রৌদ্রপ্রদীপ্ত; না সঙ্কুচিত, না বিশুষ্ক; কোমল, অথচ প্রোজ্জ্বল; পূর্ণ দলরাজি হইতে রৌদ্র প্রতিফলিত হইতেছে, অথচ মুখে হাসি ধরে না। পাঠক মহাশয়, “রূপের আলো” কখন দেখিয়াছেন? না দেখিয়া থাকিবেন, শুনিয়া থাকিবেন। অনেক সুন্দরী রূপে “দশ দিক আলো” করে। শুনা যায়, অনেকের পুত্রবধূ “ঘর আলো” করিয়া থাকেন। ব্রজধামে আর নিশুম্ভের যুদ্ধে কালো রূপেও আলো হইয়াছিল। বস্তুত: পাঠক মহাশয় বুঝিয়াছেন, “রূপের আলো” কাহাকে বলে? বিমলা রূপে আলো করিতেন, কিন্তু সে প্রদীপের আলোর মত; একটু মিট্মিটে, তেল চাই, নহিলে জ্বলে না; গৃহকার্যে চলে; নিয়ে ঘর কর, ভাত রান্ধ, বিছানা পাড়, সব চলিবে; কিন্তু স্পর্শ করিলে পুড়িয়া মরিতে হয়। তিলোত্তমাও রূপে আলো করিতেন – সে বালেন্দু-জ্যোতির ন্যায়; সুবিমল, সুমধুর, সুশীতল; কিন্তু তাহাতে গৃহকার্য হয় না; তত প্রখর নয়, এবং দূরনি:সৃত। আয়েষাও রূপে আলো করিতেন, কিন্তু সে পূর্বাহ্নিক সূর্যরশ্মির ন্যায়; প্রদীপ্ত, প্রভাময়, অথচ যাহাতে পড়ে, তাহাই হাসিতে থাকে।
যেমন উদ্যানমধ্যে পদ্মফুল, এ আখ্যায়িকা মধ্যে তেমনই আয়েষা; এজন্য তাঁহার অবয়ব পাঠক মহাশয়ের ধ্যান-প্রাপ্য করিতে চাহি। যদি চিত্রকর হইতাম, যদি এইখানে তুলি ধরিতে পারিতাম, যদি সে বর্ণ ফলাইতে পারিতাম; যদি সে কপাল তেমনই নিটোল করিয়া আঁকিতে পারিতাম, নিটোল অথচ বিস্তীর্ণ, মন্মথের রঙ্গভূমি-স্বরূপ করিয়া লিখিতে পারিতাম, তাহার উপরে তেমনই সুবঙ্কিম কেশের সীমা-রেখা দিতে পারিতাম; সে রেখা তেমনই পরিষ্কার, তেমনই কপালের গোলাকৃতির অনুগামিনী করিয়া আকর্ণ টানিতে পারিতাম; কর্ণের উপরে সে রেখা তেমনই করিয়া ঘুরাইয়া দিতে পারিতাম; যদি তেমনই কালো রেশমের মত কেশগুলি লিখিতে পারিতাম, কেশমধ্যে তেমনই করিয়া কপাল হইতে সিঁথি কাটিয়া দিতে পারিতাম–তেমনই পরিষ্কার, তেমনই সূক্ষ্ম; যদি তেমনই করিয়া কেশ রঞ্জিত করিয়া দিতে পারিতাম; যদি তেমনই করিয়া লোল কবরী বাঁধিয়া দিতে পারিতাম; যদি সে অতি নিবিড় ভ্রূযুগ আঁকিয়া দেখাইতে পারিতাম; প্রথমে যথায় দুটি ভ্রূ পরস্পর সংযোগাশয়ী হইয়াও মিলিত হয় নাই, তথা হইতে যেখানে যেমন বর্ধিতায়তন হইয়া মধ্যস্থলে না আসিতে আসিতেই যেরূপ স্থূলরেখ হইয়াছিল, পরে আবার যেমন ক্রমে ক্রমে সূক্ষ্মাকারে কেশবিন্যাসরেখার নিকটে গিয়া সূচ্যগ্রবৎ সমাপ্ত হইয়াছিল, তাহা যদি দেখাইতে পারিতাম; যদি সেই বিদ্যুদগ্নিপূর্ণ মেঘবৎ চঞ্চল, কোমল, চক্ষু:পল্লব লিখিতে পারিতাম; যদি সে নয়নযুগলের বিস্তৃত আয়তন লিখিতে পারিতাম; তাহার উপরিপল্লব ও অধ:পল্লবের সুন্দর বঙ্ক ভঙ্গী, সে চক্ষুর নীলালক্তকপ্রভা, তাহার ভ্রমরকৃষ্ণ স্থূল তারা লিখিতে পারিতাম; যদি সে গর্ববিস্ফারিত রন্ধ্রসমেত সুনাসা, সে রসময় ওষ্ঠাধর, সে কবরীস্পৃষ্ট প্রস্তরশ্বেত গ্রীবা, সে কর্ণাভরণস্পর্শপ্রার্থী পীবরাংশ, সে স্থূল কোমল রত্নালঙ্কারখচিত বাহু, যে অঙ্গুলিতে রত্নাঙ্গুরীয় হীনভাস হইয়াছে, সে অঙ্গুলি, সে পদ্মারক্ত, কোমল করপল্লব, সে মুক্তাহার-প্রভানিন্দী পীবরোন্নত বক্ষ, সে ঈষদ্দীর্ঘ বপুর মনোমোহন ভঙ্গী, যদি সকলই লিখিতে পারিতাম, তথাপি তুলি স্পর্শ করিতাম না। আয়েষার সৌন্দর্যসার, সে সমুদ্রের কৌস্তুভরত্ন, তাহার ধীর কটাক্ষ! সন্ধ্যাসমীরণকম্পিত নীলোৎপলতুল্য ধীর মধুর কটাক্ষ! কি প্রকারে লিখিব?
রাজপুত্র আয়েষার প্রতি অনেকক্ষণ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। তাঁহার তিলোত্তমাকে মনে পড়িল। স্মৃতিমাত্র হৃদয় যেন বিদীর্ণ হইয়া গেল, শিরাসমূহমধ্যে রক্তস্রোত প্রবল বেগে প্রধাবিত হইল, গভীর ক্ষত হইতে পুনর্বার রক্ত-প্রবাহ ছুটিল; রাজপুত্র পুনর্বার বিচেতন হইয়া চক্ষু মুদ্রিত করিলেন।
খট্টারূঢ়া সুন্দরী তৎক্ষণাৎ ত্রস্তে গাত্রোত্থান করিলেন। যে ব্যক্তি গালিচায় বসিয়া পুস্তক পাঠ করিতেছিল, সে মধ্যে মধ্যে পুস্তক হইতে চক্ষু তুলিয়া সপ্রেম দৃষ্টিতে আয়েষাকে নিরীক্ষণ করিতেছিল; এমন কি, যুবতী পালঙ্ক হইতে উঠিলে তাহার যে কর্ণাভরণ দুলিতে লাগিল, পাঠান তাহাই অনেকক্ষণ অপরিতৃপ্তলোচনে দেখিতে লাগিল। আয়েষা গাত্রোত্থান করিয়া ধীরে ধীরে পাঠানের নিকট গমনপূর্বক তাহার কাণে কাণে কহিলেন, “ওসমান, শীঘ্র হকিমের নিকট লোক পাঠাও।”
দুর্গজেতা ওসমান খাঁ-ই গালিচায় বসিয়াছিলেন। আয়েষার কথা শুনিয়া তিনি উঠিয়া গেলেন।
আয়েষা, একটা রূপার সেপায়ার উপরে যে পাত্র ছিল, তাহা হইতে একটু জলবৎ দ্রব্য লইয়া পুনর্মূছাগত রাজপুত্রের কপালে মুখে সিঞ্চন করিতে লাগিলেন।
ওসমান খাঁ অচিরাৎ হকিম লইয়া প্রত্যাগমন করিলেন। হকিম অনেক যত্নে রক্তস্রাব নিবারণ করিলেন, এবং নানাবিধ ঔষধ আয়েষার নিকট দিয়া মৃদু মৃদু স্বরে সেবনের ব্যবস্থা উপদেশ করিলেন।
আয়েষা কাণে কাণে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন অবস্থা দেখিতেছেন?”
হকিম কহিলেন, “জ্বর অতি ভয়ঙ্কর।”
হকিম বিদায় লইয়া প্রতিগমন করেন, তখন ওসমান তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গিয়া দ্বারদেশে তাঁহাকে মৃদুস্বরে কহিলেন, “রক্ষা পাইবে?”
হকিম কহিলেন, “আকার নহে; পুনর্বার যাতনা হইলে আমাকে ডাকিবেন।”
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : কুসুমের মধ্যে পাষাণ
কুসুমের মধ্যে পাষাণসেই দিবস অনেক রাত্রি পর্যন্ত আয়েষা ও ওসমান জগৎসিংহের নিকট বসিয়া রহিলেন। জগৎসিংহের কখন চেতনা হইতেছে, কখন মূর্ছা হইতেছে; হকিম অনেকবার আসিয়া দেখিয়া গেলেন। আয়েষা অবিশ্রান্তা হইয়া কুমারের শুশ্রূষা করিতে লাগিলেন। যখন দ্বিতীয় প্রহর, তখন একজন পরিচারিকা আসিয়া আয়েষাকে কহিল যে, বেগম তাঁহাকে স্মরণ করিয়াছেন।
“যাইতেছি” বলিয়া আয়েষা গাত্রোত্থান করিলেন। ওসমানও গাত্রোত্থান করিলেন। আয়েষা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমিও উঠিলে?”
ওসমান কহিলেন, “রাত্রি হইয়াছে, চল তোমাকে রাখিয়া আসি।”
আয়েষা দাসদাসীদিগকে সতর্ক থাকিতে আদেশ করিয়া মাতৃগৃহ অভিমুখে চলিলেন। পথে ওসমান জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কি আজ বেগমের নিকটে থাকিবে?”
আয়েষা কহিলেন, “না, আমি আবার রাজপুত্রের নিকট প্রত্যাগমন করিব।”
ওসমান কহিলেন, “আয়েষা! তোমার গুণের সীমা দিতে পারি না; তুমি এই পরম শত্রুকে যে যত্ন করিয়া শুশ্রূষা করিতেছ, ভগিনী ভ্রাতার জন্য এমন করে না। তুমি উহার প্রাণদান করিতেছ।”
আয়েষা ভুবনমোহন মুখে একটু হাসি হাসিয়া কহিলেন, “ওসমান! আমি ত স্বভাবত: রমণী; পীড়িতের সেবা আমার পরম ধর্ম; না করিলে দোষ, করিলে প্রশংসা নাই; কিন্তু তোমার কি? যে তোমার পরম বৈরী, রণক্ষেত্র তোমার দর্পহারী প্রতিযোগী, স্বহস্তে যাহার এ দশা ঘটাইয়াছ, তুমি যে অনুদিন নিজে ব্যস্ত থাকিয়া তাহার সেবা করাইতেছ, তাহার আরোগ্যসাধন করাইতেছ, ইহাতে তুমিই যথার্থ প্রশংসাভাজন।”
ওসমান কিঞ্চিৎ অপ্রতিভের ন্যায় হইয়া কহিলেন, “তুমি, আয়েষা, আপনার সুন্দর স্বভাবের মত সকলকে দেখ। আমার অভিপ্রায় তত ভাল নহে। তুমি দেখতেছ না, জগৎসিংহ প্রাণ পাইলে আমাদিগের কত লাভ? রাজপুত্রের এক্ষণে মৃত্যু হইলে আমাদিগের কি হইবে? রণক্ষেত্রে মানসিংহ জগৎসিংহের ন্যূন নহে, একজন যোদ্ধার পরিবর্তে আর একজন যোদ্ধা আসিবে। কিন্তু যদি জগৎসিংহ জীবিত থাকিয়া আমাদিগের হস্তে কারারুদ্ধ থাকে, তবে মানসিংহকে হাতে পাইলাম; সে প্রিয় পুত্রের মুক্তির জন্য অবশ্য আমাদিগকে মঙ্গলজনক সন্ধি করিবে; আকবরও এতাদৃশ দক্ষ সেনাপতিকে পুন:প্রাপ্ত হইবার জন্য অবশ্য সন্ধির পক্ষে মনোযোগী হইতে পারিবে; আর যদি জগৎসিংহকে আমাদিগের সদ্ব্যবহার দ্বারা বাধ্য করিতে পারি, তবে সেও আমাদিগের মনোমত সন্ধিবন্ধন পক্ষে অনুরোধ কি যত্ন করিতে পারে; তাহার যত্ন নিতান্ত নিষ্ফল হইবে না। নিতান্ত কিছু ফল না দর্শে, তবে জগৎসিংহের স্বাধীনতার মূল্যস্বরূপ মানসিংহের নিকট বিস্তর ধনও পাইতে পারিব। সম্মুখ সংগ্রামে একদিন জয়ী হওয়ার অপেক্ষাও জগৎসিংহের জীবনে আমাদিগের উপকার।”
ওসমান এই সকল আলোচনা করিয়া রাজপুত্রের পুনর্জীবনে যত্নবান হইয়াছিলেন সন্দেহ নাই; কিন্তু আর কিছুও ছিল। কাহারও কাহারও অভ্যাস আছে যে, পাছে লোকে দয়ালু-চিত্ত বলে, এই লজ্জার আশঙ্কায় কাঠিন্য প্রকাশ করেন; এবং দয়াশীলতা নারী-স্বভাব-সিদ্ধ বলিয়া উপহাস করিতে করিতে পরোপকার করেন। লোকে জিজ্ঞাসিলে বলেন, ইহাতে আমার বড় প্রয়োজন আছে। আয়েষা বিলক্ষণ জানিতেন, ওসমান তাহারই একজন। হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “ওসমান! সকলেই যেন তোমার মত স্বার্থপরতায় দূরদর্শী হয়। তাহা হইলে আর ধর্মে কাজ নাই|”
ওসমান কিঞ্চিৎকাল ইতস্তত: করিয়া মৃদুস্বরে কহিলেন, “আমি যে পরম স্বার্থপর, তাহার আর এক প্রমাণ দিতেছি।”
আয়েষা নিজ সবিদ্যুৎ মেঘতুল্য চক্ষু ওসমানের বদনের প্রতি স্থির করিলেন।
ওসমান কহিলেন, “আমি আশা-লতা ধরিয়া আছি, আর কত কাল তাহার তলে জলসিঞ্চন করিব?”
আয়েষার মুখশ্রী গম্ভীর হইল। ওসমান এ ভাবান্তরেও নূতন সৌন্দর্য দেখিতে লাগিলেন। আয়েষা কহিলেন, “ওসমান! ভাই বহিন বলিয়া তোমার সঙ্গে বসি দাঁড়াই। বাড়াবাড়ি করিলে, তোমার সাক্ষাতে বাহির হইব না।”
ওসমানের হর্ষোৎফুল্ল মুখ মলিন হইয়া গেল। কহিলেন, “ঐ কথা চিরকাল! সৃষ্টিকর্তা! এ কুসুমের দেহমধ্যে তুমি কি পাষাণের হৃদয় গড়িয়া রাখিয়াছ?”
ওসমান আয়েষাকে মাতৃগৃহ পর্যন্ত রাখিয়া আসিয়া বিষণ্ণ মনে নিজ আবাসমন্দির মধ্যে প্রত্যাগমন করিলেন।
আর জগৎসিংহ?
বিষম জ্বর-বিকারে অচেতন শয্যাশায়ী হইয়া রহিলেন।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ : তুমি না তিলোত্তমা
পরদিন প্রদোষকালে জগৎসিংহের অবস্থান-কক্ষে আয়েষা, ওসমান আর চিকিৎসক পূর্ববৎ নি:শব্দে বসিয়া আছেন; আয়েষা পালঙ্কে বসিয়া স্বহস্তে ব্যজনাদি করিতেছেন; চিকিৎসক ঘন ঘন জগৎসিংহের নাড়ী দেখিতেছেন; জগৎসিংহ অচেতন; চিকিৎসক কহিয়াছেন, সেই রাত্রে জ্বরত্যাগের সময়ে জগৎসিংহের লয় হইবার সম্ভাবনা, যদি সে সময় শুধরাইয়া যান, তবে আর চিন্তা থাকিবে না, নিশ্চিত রক্ষা পাইবেন। জ্বর-বিশ্রামের সময় আগত, এই জন্য সকলেই বিশেষ ব্যগ্র; চিকিৎসক মুহুর্মুহু: নাড়ী দেখিতেছেন, “নাড়ী ক্ষীণ,” “আরও ক্ষীণ”, – “কিঞ্চিৎ সবল”, ইত্যাদি মুহুর্মুহু: অস্ফুটশব্দে বলিতেছেন। সহসা চিকিৎসকের মুখ কালিমাপ্রাপ্ত হইল। বলিলেন, “সময় আগত।”
আয়েষা ও ওসমান নিস্পন্দ হইয়া শুনিতে লাগিলেন। হকিম নাড়ী ধরিয়া রহিলেন।
কিয়ৎক্ষণ পরে চিকিৎসক কহিলেন, “গতিক মন্দ।” আয়েষার মুখ আরও ম্লান হইল। হঠাৎ জগৎসিংহের মুখে বিকট ভঙ্গী উপস্থিত হইল; মুখ শ্বেতবর্ণ হইয়া আসিল; হস্তে দৃঢ়মুষ্টি বাঁধিল; চক্ষে অলৌকিক স্পন্দন হইতে লাগিল; আয়েষা বুঝিলেন, কৃতান্তের গ্রাস পূর্ণ হইতে আর বিলম্ব নাই। চিকিৎসক হস্তস্থিত পাত্রে ঔষধ লইয়া বসিয়াছিলেন; এরূপ লক্ষণ দেখিবামাত্রই অঙ্গুলি দ্বারা রোগীর মুখব্যাদান করাইয়া ঐ ঔষধ পান করাইলেন। ঔষধ ওষ্ঠোপ্রান্ত হইতে নির্গত হইয়া পড়িল; কিঞ্চিৎ উদরে গেল। উদরে প্রবেশমাত্রেই রোগীর দেহের অবস্থা পরিবর্তিত হইতে লাগিল; ক্রমে মুখের বিকট ভঙ্গী দূরে গিয়া কান্তি স্থির হইল, বর্ণের অস্বাভাবিক শ্বেতভাব বিনষ্ট হইয়া ক্রমে রক্তসঞ্চার হইতে লাগিল; হস্তের মুষ্টি শিথিল হইল; চক্ষু স্থির হইয়া পুনর্বার মুদ্রিত হইল। হকিম অত্যন্ত মনোভিনিবেশপূর্বক নাড়ী দেখিতে লাগিলেন। অনেকক্ষণ দেখিয়া সহর্ষে কহিলেন, “আর চিন্তা নাই; রক্ষা পাইয়াছেন।”
ওসমান জিজ্ঞাসা করিলেন, “জ্বরত্যাগ হইয়াছে?”
ভিষক কহিলেন, “হইয়াছে।”
আয়েষা ও ওসমান উভয়েরই মুখ প্রফুল্ল হইল। ভিষক কহিলেন, “এখন আর কোন চিন্তা নাই, আমার বসিয়া থাকার প্রয়োজন করে না; এই ঔষধ দুই প্রহর রাত্রি পর্যন্ত ঘড়ী ঘড়ী খাওয়াইবেন।” এই বলিয়া ভিষক প্রস্থান করিলেন। ওসমান আর দুই চারি দণ্ড বসিয়া নিজ আবাসগৃহে গেলেন। আয়েষা পূর্ববৎ পালঙ্কে বসিয়া ঔষধাদি সেবন করাইতে লাগিলেন।
রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরের কিঞ্চিৎ পূর্বে রাজকুমার নয়ন উন্মীলন করিলেন। প্রথমেই আয়েষার সুখপ্রফুল্ল মুখ দেখিতে পাইলেন। চক্ষুর কটাক্ষভাব দেখিয়া আয়েষার বোধ হইল, যেন তাঁহার বুদ্ধির ভ্রম জন্মিতেছে, যেন তিনি কিছু স্মরণ করিতে চেষ্টা করিতেছেন, কিন্তু যত্ন বিফল হইতেছে। অনেকক্ষণ পরে আয়েষার প্রতি চাহিয়া কহিলেন, “আমি কোথায়?” দুই দিবসের পর রাজপুত্র এই প্রথম কথা কহিলেন।
আয়েষা কহিলেন, “কতলু খাঁর দুর্গে।”
রাজপুত্র আবার পূর্ববৎ স্মরণ করিতে লাগিলেন, অনেকক্ষণ পরে কহিলেন, “আমি কেন এখানে?”
আয়েষা প্রথমে নিরুত্তর হইয়া রহিলেন; পরে কহিলেন, “আপনি পীড়িত।”
রাজপুত্র ভাবিতে ভাবিতে মস্তক আন্দোলন করিয়া কহিলেন, “না না, আমি বন্দী হইয়াছি।”
এই কথা বলিতে রাজপুত্রের মুখের ভাবান্তর হইল।
আয়েষা উত্তর করিলেন না; দেখিলেন, রাজপুত্রের স্মৃতিক্ষমতা পুনরুদ্দীপ্ত হইতেছে।
ক্ষণপরে রাজপুত্র পুনর্বার জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে?”
“আমি আয়েষা।”
“আয়েষা কে?”
“কতলু খাঁর কন্যা।”
রাজপুত্র আবার ক্ষণকাল নিস্তব্ধ রহিলেন; এককালে অধিকক্ষণ কথা কহিতে শক্তি নাই। কিয়ৎক্ষণ নীরবে বিশ্রাম লাভ করিয়া কহিলেন, “আমি কয়দিন এখানে আছি?”
“চারি দিন।”
“গড় মান্দারণ অদ্যাপি তোমাদিগের অধিকারে আছে?”
“আছে।”
জগৎসিংহ আবার কিয়ৎক্ষণ বিশ্রাম করিয়া কহিলেন, “বীরেন্দ্রসিংহের কি হইয়াছে?”
“বীরেন্দ্রসিংহ কারাগারে আবদ্ধ আছেন, অদ্য তাঁহার বিচার হইবে।”
জগৎসিংহের মলিন মুখ আরও মলিন হইল। জিজ্ঞাসা করিলেন, “আর আর পৌরবর্গ কি অবস্থায় আছে?”
আয়েষা উদ্বিগ্না হইলেন। কহিলেন, “সকল কথা আমি অবগত নহি।”
রাজপুত্র আপনা আপনি কি বলিলেন। একটি নাম তাঁহার কণ্ঠনির্গত হইল, আয়েষা তাহা শুনিতে পাইলেন, “তিলোত্তমা।”
আয়েষা ধীরে ধীরে উঠিয়া পাত্র হইতে ভিষক্দণত্ত সুস্বাদু ঔষধ আনিতে গেলেন; রাজপুত্র তাঁহার দোদুল্যমান কর্ণাভরণসংযুক্ত অলৌকিক দেহমহিমা নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। আয়েষা ঔষধ আনিলেন; রাজপুত্র তাহা পান করিয়া কহিলেন, “আমি পীড়ার মোহে স্বপ্ন দেখিতাম, স্বর্গীয় দেবকন্যা আমার শিয়রে বসিয়া শুশ্রূষা করিতেছেন, সে তুমি, না তিলোত্তমা?”
আয়েষা কহিলেন, “আপনি তিলোত্তমাকে স্বপ্ন দেখিয়া থাকিবেন।”
চতুর্থ পরিচ্ছেদ : অবগুণ্ঠনবতী
দুর্গজয়ের দুই দিবস পরে, বেলা প্রহরেকের সময়ে কতলু খাঁ নিজ দুর্গমধ্যে দরবারে বসিয়াছেন। দুই দিকে শ্রেণীবদ্ধ হইয়া পারিষদগ্ণ দণ্ডায়মান আছে। সম্মুখস্থ ভূমিখণ্ডে বহু সহস্র লোক নি:শব্দে রহিয়াছে। অদ্য বীরেন্দ্রসিংহের দণ্ড হইবে।
কয়েকজন শস্ত্রপাণি প্রহরী বীরেন্দ্রসিংহকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া দরবারে আনীত করিল। বীরেন্দ্রসিংহের মূর্তি রক্তবর্ণ, কিন্তু তাহাতে ভীতিচিহ্ন কিছুমাত্র নাই। প্রদীপ্ত চক্ষু হইতে অগ্নিকণা বিস্ফুরিত হইতেছিল; নাসিকারন্ধ্র বর্ধিতায়তন হইয়া কম্পিত হইতেছিল। দন্তে অধর দংশন করিতেছিলেন। কতলু খাঁর সম্মুখে আনীত হইলে, কতলু খাঁ বীরেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বীরেন্দ্রসিংহ! তোমার অপরাধের দণ্ড করিব। তুমি কি জন্য আমার বিরুদ্ধাচারী হইয়াছিলে?”
বীরেন্দ্রসিংহ নিজ লোহিত-মূর্তি-প্রকটিত ক্রোধ সংবরণ করিয়া কহিলেন, “তোমার বিরুদ্ধে কোন্ কর্ম করিয়াছি, তাহা অগ্রে আমাকে বল।”
একজন পারিষদ কহিল, “বিনীতভাবে কথা কহ।”
কতলু খাঁ বলিলেন, “কি জন্য আমার আদেশমত, আমাকে অর্থ আর সেনা পাঠাইতে অসম্মত হইয়াছিলে?”
বীরেন্দ্রসিংহ অকুতোভয়ে কহিলেন, “তুমি রাজবিদ্রোহী দস্যু; তোমাকে কেন অর্থ দিব? তোমায় কি জন্য সেনা দিব?”
দ্রষ্টৃবর্গ দেখিলেন, বীরেন্দ্র আপন মুণ্ড আপনি ছেদনে উদ্যত হইয়াছেন।
কতলু খাঁর ক্রোধে কলেবর কম্পিত হইয়া উঠিল। তিনি সহসা ক্রোধ সংবরণ করিবার ক্ষমতা অভ্যাসসিদ্ধ করিয়াছিলেন; এজন্য কতক স্থিরভাবে কহিলেন, “তুমি আমার অধিকারে বসতি করিয়া, কেন মোগলের সহিত মিলন করিয়াছিলে?”
বীরেন্দ্র কহিলেন, “তোমার অধিকার কোথা?”
কতলু খাঁ আরও কুপিত হইয়া কহিলেন, “শোন্ দুরাত্মা! নিজ কর্মোচিত ফল পাইবি। এখনও তোর জীবনের আশা ছিল, কিন্তু তুই নির্বোধ, নিজ দর্পে আপন বধের উদ্যোগ করিতেছিস।”
বীরেন্দ্রসিংহ সগর্বে হাস্য করিলেন; কহিলেন, “কতলু খাঁ – আমি তোমার কাছে যখন শৃঙ্খলাবদ্ধ হইয়া আসিয়াছি, তখন দয়ার প্রত্যাশা করিয়া আসি নাই। তোমার তুল্য শত্রুর দয়ায় আর জীবন রক্ষা, – তাহার জীবনে প্রয়োজন? তোমাকে আশীর্বাদ করিয়া প্রাণত্যাগ করিতাম; কিন্তু আমার পবিত্র কুলে কালি দিয়াছ; তুমি আমার প্রাণের অধিক ধনকে__”
বীরেন্দ্রসিংহ আর বলিতে পারিলেন না; স্বর বদ্ধ হইয়া গেল, চক্ষু বাষ্পাকুল হইল; নির্ভীক গর্বিত বীরেন্দ্রসিংহ অধোবদন হইয়া রোদন করিতে লাগিলেন।
কতলু খাঁ স্বভাবত: নিষ্ঠুর; এতদূর নিষ্ঠুর যে, পরপীড়ায় তাঁহার উল্লাস জন্মিত। দাম্ভিক বৈরীর ঈদৃশ অবস্থা দেখিয়া মুখ হর্ষোৎফুল্ল হইল। কহিলেন, “বীরেন্দ্রসিংহ! তুমি কি আমার নিকট কিছু যাচ্ঞা করিবে না? বিবেচনা করিয়া দেখ, তোমার সময় নিকট।”
যে দু:সহ সন্তাপাগ্নিতে বীরেন্দ্রের হৃদয় দগ্ধ হইতেছিল, রোদন করিয়া তাহার কিঞ্চিৎ সমতা হইল। পূর্বাপেক্ষা স্থিরভাবে উত্তর করিলেন, “আর কিছুই চাহি না, কেবল এই ভিক্ষা যে, আমার বধ-কার্য শীঘ্র সমাপ্ত কর।”
ক। তাহাই হইবে, আর কিছু?
উত্তর। এ জন্মে আর কিছু না।
ক। মৃত্যুকালে তোমার কন্যার সহিত সাক্ষাৎ করিবে না?
এই প্রশ্ন শুনিয়া দ্রষ্টৃবর্গ পরিতাপে নি:শব্দ হইল, বীরেন্দ্রের চক্ষে আবার উজ্জ্বলাগ্নি জ্বলিতে লাগিল।
“যদি আমার কন্যা তোমার গৃহে জীবিতা থাকে, তবে সাক্ষাৎ করিব না। যদি মরিয়া থাকে, লইয়া আইস, কোলে করিয়া মরিব।”
দ্রষ্টৃবর্গ একেবারে নীরব, অগণিত লোক এতাদৃশ গভীর নিস্তব্ধ যে, সূচীপাত হইলে শব্দ শুনা যাইত। নবাবের ঈঙ্গিত পাইয়া, রক্ষিবর্গ বীরেন্দ্রসিংহকে বধ্যভূমিতে লইয়া চলিল। তথায় উপনীত হইবার কিছু পূর্বে একজন মুসলমান বীরেন্দ্রের কাণে কাণে কি কহিল; বীরেন্দ্র তাহা কিছু বুঝিতে পারিলেন না। মুসলমান তাঁহার হস্তে একখানি পত্র দিল। বীরেন্দ্র ভাবিতে ভাবিতে অন্যমনে ঐ পত্র খুলিয়া দেখিলেন, বিমলার হস্তের লেখা। বীরেন্দ্র ঘোর বিরক্তির সহিত লিপি মর্দিত করিয়া দূরে নিক্ষেপ করিলেন। লিপি-বাহক লিপি তুলিয়া লইয়া গেল। নিকটস্থ কোন দর্শক বীরেন্দ্রের এই কর্ম দেখিয়া অপরকে অনুচ্চৈ:স্বরে কহিল, “বুঝি কন্যার পত্র?”
কথা বীরেন্দ্রের কাণে গেল। সেই দিকে ফিরিয়া কহিলেন, “কে বলে আমার কন্যা? আমার কন্যা নাই।”
পত্রবাহক পত্র লইয়া গেল। রক্ষিবর্গকে কহিয়া গেল, “আমি যতক্ষণ প্রত্যাগমন না করি, ততক্ষণ বিলম্ব করিও।”
রক্ষিগণ কহিল, “যে আজ্ঞা প্রভো!”
স্বয়ং ওসমান পত্রবাহক; এই জন্য রক্ষিবর্গ প্রভু সম্বোধন করিল।
ওসমান লিপিহস্তে অন্ত:পুর-প্রাচীর মধ্যে গেলেন; তথায় এক বকুল-বৃক্ষের অন্তরালে এক অবগুণ্ঠনবতী স্ত্রীলোক দণ্ডায়মানা আছে। ওসমান তাহার সন্নিধানে গিয়া চতুর্দিক নিরীক্ষণ করিয়া যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা বিবৃত করিলেন। অবগুণ্ঠবতী কহিলেন, “আপনাকে বহু ক্লেশ দিতেছি, কিন্তু আপনা হইতেই আমাদের এ দশা ঘটিয়াছে। আপনাকে আমার এ কার্য সাধন করিতে হইবে।”
ওসমান নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন।
অবগুণ্ঠনবতী মন:পীড়া-বিকম্পিত স্বরে কহিতে লাগিলেন, “না করেন – না করুন, আমরা এক্ষণে অনাথা; কিন্তু জগদীশ্বর আছেন!”
ওসমান কহিলেন, “মা! তুমি জান না যে, কি কঠিন কর্মে আমায় নিযুক্ত করিতেছ। কতলু খাঁ জানিতে পারিলে আমার প্রাণান্ত করিবে।”
স্ত্রী কহিলেন, “কতলু খাঁ? আমাকে কেন প্রবঞ্চনা কর? কতলু খাঁর সাধ্য নাই যে, তোমার কেশ স্পর্শ করে|”
ও। কতলু খাঁকে চেন না । – কিন্তু চল, আমি তোমাকে বধ্যভূমিতে লইয়া যাইব।
ওসমানের পশ্চাৎ পশ্চাৎ অবগুণ্ঠনবতী বধ্যভূমিতে গিয়া নিস্তব্ধে দণ্ডায়মানা হইলেন। বীরেন্দ্রসিংহ তাঁহাকে না দেখিয়া একজন ভিখারীর বেশধারী ব্রাহ্মণের সহিত কথা কহিতেছিলেন। অবগুণ্ঠনবতী অবগুণ্ঠনমধ্য হইতে দেখিলেন, ভিখারী অভিরাম স্বামী।
বীরেন্দ্র অভিরাম স্বামীকে কহিলেন, “গুরুদেব! তবে বিদায় হইলাম। আমি আর আপনাকে কি বলিয়া যাইব? ইহলোকে আমার কিছু প্রার্থনীয় নাই; কাহার জন্য প্রার্থনা করিব?”
অভিরাম স্বামী অঙ্গুলি নির্দেশ দ্বারা পশ্চাদ্বর্তিনী অবগুণ্ঠনবতীকে দেখাইলেন। বীরেন্দ্রসিংহ সেই দিকে মুখ ফিরাইলেন; অমনি রমণী অবগুণ্ঠন দূরে নিক্ষেপ করিয়া বীরেন্দ্রের শৃঙ্খলাবদ্ধ পদতলে অবলুণ্ঠন করিতে লাগিলেন। বীরেন্দ্র গদগদ স্বরে ডাকিলেন, “বিমলা!”
“স্বামী! প্রভু! প্রাণেশ্বর!” বলিতে বলিতে উন্মাদিনীর ন্যায় অধিকতর উচ্চৈ:স্বরে বিমলা কহিতে লাগিলেন, “আজ আমি জগৎসমীপে বলিব, কে নিবারণ করিবে? স্বামী! কণ্ঠরত্ন! কোথা যাও! আমাদের কথা রাখিয়া যাও!”
বীরেন্দ্রসিংহের চক্ষে দরদর অশ্রুধারা পতিত হইতে লাগিল। হস্ত ধরিয়া বিমলাকে বলিলেন, “বিমলা! প্রিয়তমে! এ সময় কেন আমায় রোদন করাও! শত্রুরা দেখিলে আমায় মরণে ভীত মনে করিবে।”
বিমলা নিস্তব্ধ হইলেন। বীরেন্দ্র পুনর্বার কহিলেন, “বিমলে! আমি যাই, তোমরা আমার পশ্চাৎ আইস।”
বিমলা কহিলেন, “যাইব।”
আর কেহ না শুনিতে পায় এমত স্বরে কহিতে লাগিলেন, “যাইব, কিন্তু আগে এ যন্ত্রণার প্রতিশোধ করিব।”
নির্বাণোন্মুখ প্রদীপবৎ বীরেন্দ্রের মুখ হর্ষোৎফুল্ল হইল – কহিলেন, “পারিবে?”
বিমলা দক্ষিণ হস্তে অঙ্গুলি দিয়া কহিলেন, “এই হস্তে! এই হস্তের স্বর্ণ ত্যাগ করিলাম; আর কাজ কি!” বলিয়া কঙ্কণাদি খুলিয়া দূরে নিক্ষেপ করিতে করিতে বলিতে লাগিলেন, “শাণিত লৌহ ভিন্ন এ হস্তে অলঙ্কার আর ধরিব না।”
বীরেন্দ্র হৃষ্টচিত্তে কহিলেন, “তুমি পারিবে, জগদীশ্বর তোমার মনস্কামনা সফল করুন।”
জল্লাদ ডাকিয়া কহিল, “আর বিলম্ব করিতে পারি না।”
বীরেন্দ্র বিমলাকে কহিলেন, “আর কি? তুমি এখন যাও।”
বিমলা কহিলেন, “না, আমার সম্মুখেই আমার বৈধব্য ঘটুক। তোমার রুধিরে মনের সঙ্কোচ বিসর্জন করিব।” বিমলার স্বর ভয়ঙ্কর হইল।
“তাহাই হউক, বলিয়া বীরেন্দ্রসিংহ জল্লাদকে ইঙ্গিত করিলেন। বিমলা দেখিতে পাইলেন, ঊর্ধ্বোত্থিত কুঠার সূর্যতেজে প্রদীপ্ত হইল; তাঁহার নয়নপল্লব মুহূর্ত জন্য আপনি মুদ্রিত হইল; পুনরুন্মীলন করিয়া দেখেন, বীরেন্দ্রসিংহের ছিন্ন শির রুধির-সিক্ত ধূলিতে অবলুণ্ঠন করিতেছে।
বিমলা প্রস্তর-মূর্তিবৎ দণ্ডায়মানা রহিলেন, মস্তকের একটি কেশ বাতাসে দুলিতেছে না। এক বিন্দু অশ্রু পড়িতেছে না। চক্ষুর পলক নাই, একদৃষ্টে ছিন্ন শির প্রতি চাহিয়া আছেন।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ : বিধবা
তিলোত্তমা কোথায়? পিতৃহীনা, অনাথিনী বালিকা কোথায়? বিমলাই বা কোথায়? কোথা হইতে বিমলা স্বামীর বধ্যভূমিতে আসিয়া দর্শন দিয়াছিলেন? তাহার পরই আবার কোথায় গেলেন?
কেন বীরেন্দ্রসিংহ মৃত্যুকালে প্রিয়তমা কন্যার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন না? কেনই বা নামমাত্রে হুতাশনবৎ প্রদীপ্ত হইয়াছিলেন? কেন বলিয়াছেন, “আমার কন্যা নাই?”
কেন বিমলার পত্র বিনা পাঠে দূরে নিক্ষেপ করিয়াছিলেন?
কেন? কতলু খাঁর প্রতি বীরেন্দ্রের তিরস্কার স্মরণ করিয়া দেখ, কি ভয়ানক ব্যাপার ঘটিয়াছে।
“পবিত্র কুলে কালি পড়িয়াছে” এই কথা বলিয়া শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যাঘ্র গর্জন করিয়াছিল।
তিলোত্তমা আর বিমলা কোথায়, জিজ্ঞাসা কর? কতলু খাঁর উপপত্নীদিগের আবাসগৃহে সন্ধান কর, দেখা পাইবে।
সংসারের এই গতি! অদৃষ্টচক্রের এমনি নিদারুণ আবর্তন! রূপ, যৌবন, সরলতা, অমলতা, সকলই নেমির পেষণে দলিত হইয়া যায়!
কতলু খাঁর এই নিয়ম ছিল যে, কোন দুর্গ বা গ্রাম জয় হইলে, তন্মধ্যে কোন উৎকৃষ্ট সুন্দরী যদি বন্দী হইত, তবে সে তাঁহার আত্মসেবার জন্য প্রেরিত হইত। গড় মান্দারণ জয়ের পরদিবস, কতলু খাঁ তথায় উপনীত হইয়া বন্দীদিগের প্রতি যথা-বিহিত বিধান ও ভবিষ্যতে দুর্গের রক্ষণাবেক্ষণ পক্ষে সৈন্য নিয়োজন ইত্যাদি বিষয়ে নিযুক্ত হইলেন। বন্দীদিগের মধ্যে বিমলা ও তিলোত্তমাকে দেখিবামাত্র নিজ বিলাসগৃহ সাজাইবার জন্য তাহাদিগকে পাঠাইলেন। তৎপরে অন্যান্য কার্যে বিশেষ ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। এমন শ্রুত ছিলেন যে রাজপুত সেনা জগৎসিংহের বন্ধন শুনিয়া নিকটে কোথাও আক্রমণের উদ্যোগে আছে; অতএব তাহাদিগকে পরাঙ্মুখ করিবার জন্য উচিত ব্যবস্থা বিধানাদিতে ব্যাপৃত ছিলেন, এজন্য এ পর্যন্ত কতলু খাঁ নূতন দাসীদিগের সঙ্গসুখলাভ করিতে অবকাশ পান নাই।
বিমলা ও তিলোত্তমা পৃথক পৃথক কক্ষে রক্ষিত হইয়াছিলেন। তথায় পিতৃহীনা নবীনার ধূলি-ধূসরা দেহলতা ধরাতলে পড়িয়া আছে, পাঠক! তথায় নেত্রপাত করিয়া কাজ নাই। কাজ কি? তিলোত্তমা প্রতি কে আর এখন নেত্রপাত করিতেছে? মধূদয়ে নববল্লরী যখন মন্দ-বায়ু-হিল্লোলে বিধূত হইতে থাকে, কে না তখন সুবাসাশয়ে সাদরে তাহার কাছে দণ্ডায়মান হয়? আর যখন নৈদাঘ ঝটিকাতে অবলম্বিত বৃক্ষ সহিত সে ভূতলশায়িনী হয়, তখন উন্মূলিত পদার্থরাশি মধ্যে বৃক্ষ ছাড়িয়া কে লতা দৃষ্টি করে? কাঠুরিয়ারা কাঠ কাটিয়া লইয়া যায়, লতাকে পদতলে দলিত করে মাত্র।
চল, তিলোত্তমাকে রাখিয়া অন্যত্র যাই। যথায় চঞ্চলা, চতুরা, রসপ্রিয়া, রসিকা বিমলার পরিবর্তে গম্ভীরা, অনুতাপিতা, মলিনা বিধবা চক্ষে অঞ্চল দিয়া বসিয়া আছে, তথায় যাই।
এই কি বিমলা? তাহার সে কেশবিন্যাস নাই। মাথায় ধূলিরাশি; সে কারুকার্য-খচিত ওড়না নাই; সে রত্ন-খচিত কাঁচলি নাই; বসন বড় মলিন। পরিধানে জীর্ণ, ক্ষুদ্র বসন। সে অলঙ্কার-ভার কোথায়? সে অংসসংসস্পর্শলোভী কর্ণাভরণ কোথায়? চক্ষু ফুলিয়াছে কেন? সে কটাক্ষ কই? কপালে ক্ষত কেন? রুধির যে বাহিত হইতেছে!
বিমলা ওসমানের প্রতীক্ষা করিতেছিলেন।
ওসমান পাঠানকুলতিলক। যুদ্ধ তাঁহার স্বার্থসাধন ও নিজ ব্যবসায় এবং ধর্ম; সুতরাং যুদ্ধজয়ার্থ ওসমান কোন কার্যেই সঙ্কোচ করিতেন না। কিন্তু যুদ্ধ প্রয়োজন সিদ্ধ হইলে পরাজিত পক্ষের প্রতি কদাচিৎ নিষ্প্রয়োজনে তিলার্ধ অত্যাচার করিতে দিতেন না। যদি কতলু খাঁ স্বয়ং বিমলা, তিলোত্তমার অদৃষ্টে এ দারুণ বিধান না করিতেন, তবে ওসমানের কৃপায় তাঁহারা কদাচ বন্দী থাকিতেন না। তাঁহারই অনুকম্পায় স্বামীর মৃত্যুকালে বিমলা তৎসাক্ষাৎ লাভ করিয়াছিলেন। পরে যখন ওসমান জানিতে পারিলেন যে, বিমলা বীরেন্দ্রসিংহের স্ত্রী, তখন তাহার দয়ার্দ্র চিত্ত আরও আর্দ্রীভূত হইল। ওসমান কতলু খাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র, এজন্য অন্ত:পুরেও কোথাও তাঁহার গমনে বারণ ছিল না, ইহা পূর্বেই দৃষ্ট হইয়াছে। যে বিহারগৃহে কতলু খাঁর উপপত্নীসমূহ থাকিত, সে স্থলে কতলু খাঁর পুত্রেরাও যাইতে পারিতেন না, ওসমানও নহে। কিন্তু ওসমান কতলু খাঁর দক্ষিণ হস্ত, ওসমানের বাহুবলেই তিনি আমোদর তীর পর্যন্ত উৎকল অধিকার করিয়াছিলেন। সুতরাং পৌরজন প্রায় কতলু খাঁর যাদৃশ, ওসমানের তাদৃশ বাধ্য ছিল। এজন্যই অদ্য প্রাতে বিমলার প্রার্থনানুসারে, চরমকালে তাঁহার স্বামিসন্দর্শন ঘটিয়াছিল।
বৈধব্য-ঘটনার দুই দিবস পরে বিমলার যে কিছু অলঙ্কারাদি অবশিষ্ট ছিল, তৎসমুদায় লইয়া তিনি কতলু খাঁর নিয়োজিত দাসীকে দিলেন। দাসী কহিল, “আমায় কি আজ্ঞা করিতেছেন?”
বিমলা কহিলেন, “তুমি যেরূপ কাল ওসমানের নিকট গিয়াছিলেন, সেইরূপ আর একবার যাও; কহিও যে, আমি তাঁহার নিকট আর একবার সাক্ষাতের প্রার্থিতা; বলিও এই শেষ, আর তৃতীয়বার ভিক্ষা করিব না।”
দাসী সেইরূপ করিল। ওসমান বলিয়া পাঠাইলেন, “সে মহাল মধ্যে যাতায়াতে উভয়েরই সঙ্কট; তাঁহাকে আমার আবাসমন্দিরে আসিতে কহিও।”
বিমলা জিজ্ঞেস করিলেন, “আমি যাই কি প্রকারে?” দাসী কহিল, “তিনি কহিয়াছেন যে, তিনি তাহার উপায় করিয়া দিবেন।”
সন্ধ্যার পর আয়েষার একজন দাসী আসিয়া অন্ত:পুররক্ষী খোজাদিগের সহিত কি কথাবার্তা কহিয়া বিমলাকে সমভিব্যাহারে করিয়া ওসমানের নিকট লইয়া গেল।
ওসমান কহিলেন, “আর তোমার কোন অংশে উপকার করিতে পারি?” বিমলা কহিলেন, “অতি সামান্য কথামাত্র; রাজপুতকুমার জগৎসিংহ কি জীবিত আছেন?”
ও। জীবিত আছেন।
বি। স্বাধীন আছেন কি বন্দী আছেন?
ও। বন্দী বটে, কিন্তু আপাতত: কারাগারে নহে। তাঁহার অঙ্গের অস্ত্রক্ষতের হেতু পীড়িত হইয়া শয্যাগত আছেন। কতলু খাঁর অজ্ঞাতসারে তাঁহাকে অন্ত:পুরেই রাখিয়াছি। সেখানে বিশেষ যত্ন হইবে বলিয়া রাখিয়াছি।
বিমলা শুনিয়া বলিলেন, “এ অভাগিনীদের সম্পর্কমাত্রেই অমঙ্গল ঘটিয়াছে। সে সকল দেবতাকৃত। এক্ষণে যদি রাজপুত্র পুনর্জীবিত হয়েন, তবে তাঁহার আরোগ্যপ্রাপ্তির পর, এই পত্রখানি তাঁহাকে দিবেন; আপাতত: আপনার নিকট রাখিবেন। এইমাত্র আমার ভিক্ষা।”
ওসমান লিপি প্রত্যর্পণ করিয়া কহিলেন, “ইহা আমার অনুচিত কার্য; রাজপুত্র যে অবস্থাতেই থাকুন, তিনি বন্দী বলিয়া গণ্য। বন্দীদিগের নিকট কোন লিপি আমরা নিজে পাঠ না করিয়া যাইতে দেওয়া অবৈধ, এবং আমার প্রভুর আদেশবিরুদ্ধ।”
বিমলা কহিলেন, “এ লিপির মধ্যে আপনাদিগের অনিষ্টকারক কোন কথাই নাই, সুতরাং অবৈধ কার্য হইবে না। আর প্রভুর আদেশ? আপনি আপন প্রভু।”
ওসমান কহিলেন, “অন্যান্য বিষয়ে আমি পিতৃব্যের আদেশবিরুদ্ধ আচরণ কখন করিতে পারি; কিন্তু এ সকল বিষয়ে নহে। আপনি যখন কহিতেছেন যে, এই লিপিমধ্যে বিরুদ্ধ কথা নাই, তখন সেইরূপই আমার প্রতীত হইতেছে, কিন্তু এ বিষয়ে নিয়ম ভঙ্গ করিতে পারি না। আমা হইতে এ কার্য হইবে না।”
বিমলা ক্ষুণ্ণ হইয়া কহিলেন, “তবে আপনি পাঠ করিয়াই দিবেন।”
ওসমান লিপি গ্রহণ করিয়া পাঠ করিতে আরম্ভ করিলেন।