দুই বাড়ি (Dui Bari) : 03
বিকালে সুনীলবাবুর বাসায় নিধু গিয়া দেখিল সাধন ভটচাজ পূর্ব হইতেই সেখানে বসিয়া আছেন৷ সুনীলবাবু তখনো কাজ শেষ করিয়া বাসায় ফেরেন নাই৷ চাকরে তাহাকে অভ্যর্থনা করাই বসাইল৷
সাধন বলিলেন—এস. ডি. ও. নেই কিনা—সুনীলবাবু ট্রেজারীর কাজ শেষ করে আসবেন বোধ হয়৷
আরও ঘণ্টাখানেক বসিবার পরে সুনীলবাবুকে ব্যস্তসমস্তভাবে আসিতে দেখা গেল৷
উহাদের বাহিরের ঘরে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া বলিলেন—বড্ড দেরি হয়ে গেল—সো সরি! আজ আবার বড় কর্তা নেই—টুরে বেরিয়েছেন মফঃস্বলে—ট্রেজারির কাজ দেখে আসতে হল কিনা৷ বসুন—আসচি—
বাহিরের ঘরটিতে দুখানা বেতের কৌচ, দুখানা টেবিল, খান-চার-পাঁচ চেয়ার পাতা৷ একটা ছোট আলমারিতে অনেকগুলি বাংলা ও ইংরাজী বই—দেওয়ালে কয়েকখানি ফটো, কয়েকখানি ছবি৷ তাহার মধ্যে একখানি ছবি নিধুর বেশ ভালো লাগিল৷ একটা গাছের তলায় দুটি হরিণ ক্রীড়ারত—দূরে কোনো স্রোতস্বিনী, অপরপারে কাননভূমি, আকাশে মেঘের ফাঁকে চাঁদ উঁকি মারিতেছে৷
সে সাধন ভটচাজকে ছবিখানা আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল—দেখুন, কি চমৎকার না?
সাধন ভটচাজ মোক্তারী করিয়া ও মক্কেল শিখাইয়া বহুকাল অতিবাহিত করিয়াছেন, কিন্তু কোন জিনিস দেখিতে ভালো, কোনটা মন্দ, ইহা লইয়া কখনো মাথা ঘামান নাই৷ সুতরাং তিনি অনাসক্ত ও উদাসীন দৃষ্টিতে দেওয়ালের দিকে চোখ তুলিয়া চাহিয়া বলিলেন—কোনটা? ও-খানা? হ্যাঁ, তা বেশ৷
এমন সময় সুনীলবাবু একটা সিগারেটের টিন লইয়া ঘরে ঢুকিয়া নিধুর সামনের টেবিলে টিনটি রাখিয়া বলিলেন—খান—
নিধু তো এমনি কখনো ধূমপান করে না, সাধন ভটচাজ করেন বটে কিন্তু হাকিমের সামনে কি করিয়া সিগারেট টানিবেন? সে ভরসা তাঁহার হয় না৷ সুতরাং যেখানকার সিগারেটের টিন সেখানেই পড়িয়া রহিল৷ সাধন ভটচাজ কৃত্রিম খুশির ভাব মুখে আনিয়া বলিলেন—চমৎকার ছবিগুলো আপনার ঘরে—
সুনীলবাবু বলিলেন—এখানে ভালো ছবি কিছু আনিনি৷ হয়েচে কি, ভালো ছবি কিনবার রেওয়াজ আমাদের বাঙালীর মধ্যে নেই বললেই হয়৷ আমরা ছবির ভালোমন্দ প্রায়ই বুঝিনে৷ অনেক সময় নিকৃষ্ট বিলিতি ওলিওগ্রাফ কিনে এনে বৈঠকখানায় জাঁক করে বাঁধিয়ে রাখি—সাধনবাবু যেখানা দেখালেন, ওখানা সত্যিই ভালো ছবি৷ নন্দলাল বসুর আঁকা একখানা ছবির প্রিণ্ট৷ নন্দলাল বসুর নাম নিশ্চয়ই—
কে নন্দলাল বসু, সাধন ভটচাজ জীবনে কখনো শোনেন নাই, হাকিমকে খুশি করিবার জন্য সজোরে ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন—হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব—খুব—আমাদের বাড়ীর মা-বাবা সবাই নন্দলাল বসুর ছবির ভক্ত—
—আজ্ঞে তা হবেই তো৷ কত বড় শিক্ষিত বংশ আপনাদের—
নিধু আলমারির বই দেখিতেছে দেখিয়া সুনীলবাবু বলিলেন—বই প্রায় সব এখানে পাবেন, আজকাল যা-যা বেরুচ্চে—বই পড়তে ভালোবাসেন দেখচি আপনি—
নিধু বলিল—বই ভালোবাসি, কিন্তু এসব জায়গায় ভালো বই মেলেই না৷
—কেন আপনার বার-লাইব্রেরীতে?
—মোক্তার-বারে দু’দশখানা বাঁধানো ল’রিপোর্ট আর উইকলি নোটস ছাড়া আর তো বই দেখিনে৷
—আপনি আমার কাছ থেকে বই নিয়ে যাবেন, আবার পড়া হলে ফেরত দিয়ে নতুন বই নিয়ে যাবেন৷
—তাহলে তো বেঁচে যাই—
—আচ্ছা, কুড়ুলগাছি এখান থেকে ক-মাইল হবে বললেন?
—ছ-ক্রোশ রাস্তা হবে—
—যাবার কি উপায় আছে?
—গরুর গাড়ী করে যাওয়া যায়—নয় তো হেঁটে—
—সাইকেলে যাওয়া যায় তো? আমাকে নিয়ে যাবেন?
—সে তো আমাদের ভাগ্য, কবে যাবেন বলুন?
—লালবিহারীবাবুদের সঙ্গে আমাদের ফ্যামিলির খুব জানাশুনো—আমি এখানে নতুন এসেচি, উনি জানেন না, জানলে এতদিন ডেকে নিয়ে যেতেন৷
—বেশ, বেশ৷ আমি গিয়ে বলব এ শনিবারেই৷
এই সময় ভৃত্য চা ও খাবার আনিয়া সামনের টেবিলে রাখিয়া দিল৷
সুনীলবাবু বলিলেন—আসুন, চা খেয়ে নিন—চাকরে-বাকরে যা করে, তেমন কিছু ভালো হয় নি৷ বাসায় আমি একা, মেয়েমানুষ কেউ নেই তো৷ সাধন ভটচাজ সম্ভ্রমের সুরে জিজ্ঞাসা করিলেন—হুজুর কি আপাতত এখানে একা আছেন?
—একাই থাকি বই কি!
—কেন, আপনার স্ত্রীকে বুঝি নিয়ে আসেন নি?
সুনীলবাবু হাসিয়া বলিলেন—মাথা নেই তার মাথাব্যথা! স্ত্রী কোথায়? এখনো বিয়ে করিনি—
সাধন ভটচাজ অপ্রতিভের সুরে বলিলেন—ও, তা তো বুঝতে পারিনি৷ তা হুজুরের আর বয়েস কি? আপনি তো ছেলেমানুষ—করে ফেলুন এইবারে বিয়ে৷ এই আমাদের এখানে থাকতে-থাকতেই—
—ভালোই তো৷ দিন না একটা যোগাড় করে—
সাধন ভটচাজ ব্যস্ত হইয়া বলিলেন—যোগাড় করার ভাবনা? হুজুরের মুখ থেকে কথা বেরুলে একটা ছেড়ে দশটা পাত্রী কালই যোগাড় করে দেব৷
—নিধিরামবাবু আপনি বিবাহিত?
নিধু সলজ্জভাবে বলিল—আজ্ঞে না, এখনো করি নি—
—আপনি তো আমার চেয়েও বয়সে ছোট—আপনার যথেষ্ট সময় আছে এখনো৷
সাধন ভটচাজ ব্যগ্রভাবে নিধুর মুখের কথা কাড়িয়া লইয়া বলিলেন—আর হুজুরেরই কি সময় গিয়েচে নাকি! বলুন তো দেখি চেষ্টা কাল থেকেই—
সুনীলবাবু হাসিয়া বলিলেন—হবে, হবে, ঠিক সময়ে বলব বই কি৷
লঘু হাস্য-পরিহাসের মধ্য দিয়া চা-মজলিস শেষ হইলে উভয়ে সুনীলবাবুর বাসা হইতে বিদায় লইয়া চলিয়া আসিলেন৷ পথে সাধন ভটচাজকে একটু অন্যমনস্ক মনে হইল৷ নিধুর কথার উপরে সাধন দু-একটা অসংলগ্ন উত্তর দিলেন৷ নিধুর বাসার কাছে আসিয়া সাধন একবার মাত্র বলিলেন—তাহলে নিধু তুমি এ শনিবার বাড়ি যাচ্ছ নাকি?
নিধু বলিল—আজ্ঞে হ্যাঁ—যাব বই কি—
—আচ্ছা তা হলে সোমবার দেখা হবে৷ আসি আজ—
নিধু মনে মনে হাসিল৷ সাধন-মোক্তারকে সে ইতিমধ্যে বেশ চিনিয়া ফেলিয়াছে৷ স্বার্থ ছাড়া তিনি এক পাও চলেন না৷ আশ্চর্য! ওই মেয়েকে সাবডেপুটি সুনীলবাবুর হাতে গছাইবার দুরাশা সাধনের মনে স্থান পাইল কি করিয়া? যাক, পরের কথায় থাকিবার তাহার দরকার নাই৷ সে নিজে আপাতত সাধন-মোক্তারের তাগিদের দায় হইতে রেহাই পাইয়াছে ইহাই যথেষ্ট৷
ভাদ্রমাসের দিন ছোট হইয়া আসিতেছে ক্রমশ—নিধুর সকল ব্যস্ততাকে ব্যর্থ করিয়া দিয়া কামারগাছি দীঘির পাড়ে আসিতেই সন্ধ্যা হইয়া গেল৷ বাড়ী পৌঁছিল সে সন্ধ্যার প্রায় আধঘণ্টা পরে৷ আজ মঞ্জুর সঙ্গে দেখা হওয়ার আর কোনো উপায় নাই৷ এত রাত্রে সে কোন ছুতায় মঞ্জুদের বাড়ী যাইবে?
বাড়ীতে সে পা দিতেই তাহার মা বলিলেন—তুই এলি? জজবাবুর ছেলে তোকে বিকেল থেকে তিনবার খোঁজ করে গিয়েচে৷ এই তো খানিক আগেও এসেছিল—বলে গিয়েচে এলেই পাঠিয়ে দিতে—মঞ্জু কি দরকারে তোর খোঁজ করেচে—
নিধু উদাসীনভাবে বলিল—ও! আচ্ছা দেখি—আবার রাত হয়ে গেল এদিকে—
—রাত তাই কি! মঞ্জুর ভাই বলে গেল, যত রাত হয় জ্যাঠাইমা, নিধুদা এলে পাঠিয়ে দেবেনই—
—বেশ যাব এখন৷ হাত-মুখ ধুই—
ঘরে ছোট্ট একখানা আরশি ছিল৷ নিজের মুখ তাহাতে দেখিয়া নিধু বিশেষ খুশি হইল না৷ পথশ্রমে ও ধূলায় মুখের চেহারা—নাঃ, হোপলেস! ভদ্রমহিলাদের সামনে এ চেহারা লইয়া দাঁড়ানো অসম্ভব৷
কিছুক্ষণ পরে নিধুর মা ছেলেকে গামছা কাঁধে ভিজা কাপড়ে পুকুরের ঘাট হইতে আসিতে দেখিয়া বিস্ময়ের সুরে বলিলেন—হ্যাঁরে ওকি, তুই নেয়ে এলি নাকি এই সন্দেবেলা?
—হ্যাঁ মা, বড্ড ধুলো আর গরম—তাই নেয়ে সাবান দিয়ে ঠাণ্ডা হয়ে এলাম—
—অসুখ-বিসুখ না করলে বাঁচি এখন৷ কক্ষনো তো সন্দেবেলা নাইতে দেখিনে তোকে—কাপড় ছেড়ে এসে জল খেয়ে নে৷ চা খাবি?
নিধু জানে মা চা করিতে জানে না৷ তাছাড়া ভালো চা বাড়ীতে নাইও, কারণ তাহাদের বাড়ীতে কখনো কালে-ভদ্রে কেহ শখ করিয়া হয়তো চা খায়—তাহাও ঔষধ হিসাবে; সর্দি-টর্দি লাগিলে তবে৷
সে বলিল—না মা, চা থাক—তুমি খাবার দাও বরং—
নিধুর মা ছেলেকে রেকাবিতে করিয়া তালের ফুলুরি ও গুড় আনিয়া দিলেন৷ নিধু খাইতে ভালোবাসে বলিয়া দ্বিপ্রহরে রন্ধন সারিয়া এগুলি নিজহস্তে করিয়া রাখিয়াছেন৷ বলিলেন—খা তুই—আর লাগে আরও দেব, আছে৷
এমন এক সময় আসে জীবনে, আসল মাতৃস্নেহও মনকে তৃপ্তি দিতে পারে না, বরং উত্যক্ত করিয়া তোলে৷ নিধুর জীবনে সেই সময় সমাগত৷ সে এতগুলি তেলেভাজা তালের বড়া এখন বসিয়া বসিয়া খাইতে রাজী নয়৷ তাহাতে প্রথমত তো সময় যাইবে, তারপর যদি মঞ্জুরা জলখাবার খাইবার জন্য বলে—কিছুই খাওয়া যাইবে না৷
গোগ্রাসে কতক বড়া খাইয়া কতক বা ফেলিয়া নিধু তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িয়া মুখ ধুইয়া বাহিরে যাইতে উদ্যত হইল৷
নিধুর মা ডাকিয়া বলিলেন—হ্যাঁরে, ওমা এ কি করে খেলি তুই? সবই যে ফেলে গেলি? ভালোবাসিস বলে বসে বসে করলাম—তা পান খাবি নে?
উত্তরে দরজার বাহির হইতে নিধু কি যে বলিল—ভালো বোঝা গেল না৷
মঞ্জুদের বাড়ীর দরজাতে পা দিতেই নৃপেনের সঙ্গে দেখা৷
—ও দিদি, নিধুদা এসেচে—এই যে—ওমা—বলিতে বলিতে সে তাহার হাত ধরিয়া টানিতে-টানিতে বাড়ীর মধ্যে লইয়া গেল৷
মঞ্জু হাসিমুখে ঘর হইতে রোয়াকে আসিয়া বলিল—এই যে আসুন নিধুদা, আমি আজ তিনবার নৃপেনকে পাঠিয়েচি আপনার খোঁজে৷ এই মাত্তর বলছিলাম ওকে আর একবার গিয়ে দেখে আসতে—এলেন কিনা৷ কতক্ষণ এসেচেন?
—এই ঘণ্টাখানেক৷ সন্দের পর এসেচি—এসে নেয়ে এলাম পুকুরে—
—আসুন বসুন৷ কিছু মুখে দিন—
—সব সেরে এসেচি বাড়ী থেকে—
—এটাও তো বাড়ী নিধুদা৷ সেরে এসেচেন বলে কি রেহাই পাবেন? বসুন—
মঞ্জুকে নিধুর আজ বড় ভালো লাগিল৷ সে একখানা ফিকে ধূসর রঙের জরির কাজ করা ঢাকাই শাড়ী ও ঘন-বেগুনি রঙের সাটিনের ব্লাউজ পরিয়াছে, পিঠে লম্বা চুলের বিনুনির অগ্রভাগে বড় বড় টাসেল দোলানো, খালি পায়ে আলতা, সুন্দর ফরসা মুখে ঈষৎ পাউডারের আমেজ—বড় বড় চোখে প্রসন্ন বন্ধুত্বের হাসি৷
নৃপেন বলিল—কাল আপনি আছেন তো? আমাদের আবৃত্তি প্রতিযোগিতা জানেন না?
নিধু বিস্ময়ের সুরে বলিল—কোথায়, কে করবে—
—বাবা এখানকার পাঠশালার ছেলেদের আর মেয়েদের মেডেল দিচ্চেন৷ অবিশ্যি যে ফার্স্ট হবে তাকে দেবেন৷ বাবা সভাপতি, স্কুল সাব-ইন্সপেক্টার বিচার করবেন৷ বাবা মেডেল দেবেন, বাবা তো বিচার করতে পারেন না?
—কাল কখন হবে?
—এই বেলা দুটো থেকে আরম্ভ হবে, আমাদের বাড়ীর বৈঠকখানাতেই হবে৷ বেশি তো ছেলে নয়, ত্রিশ না বত্রিশটি ছেলেতে মেয়েতে—
এই সময় মঞ্জু খাবারের প্লেট হাতে ঘরে ঢুকিতে ঢুকিতে বলিল—অমনি সব ফাঁস করে দেওয়া হচ্চে! কোথায় আমি ভাবচি খাবার খাইয়ে সুস্থ করে নিধুদাকে সব বলব—না উনি অমনি—
নৃপেন অভিমানের সুরে বলিল—বাঃ, তুমি কি আমায় বারণ করে দিয়েছিলে? তাছাড়া আসল কথাটা তো এখনো বলি নি, সেটা তুমিই বল৷
নিধু মঞ্জুর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাহিল৷
মঞ্জু হাসিয়া বলিল—অন্য কিছু নয়, আপনাকেও একজন জজ হতে হবে, বাবাকে আমি বলেচি বিশেষ করে৷ আপনাকে নিতেই হবে৷ কেমন রাজী?
নিধু বিস্ময়ের সুরে বলিল—তুমি কি যে বল মঞ্জু! আমি ভালো আবৃত্তি করেচি কোনো কালে যে জজ হতে যাব? সব বাজে৷
—ওসব বললে আমি শুনচিনে—হতেই হবে আপনাকে৷
—কি রকম কি করতে হবে তাই জানিনে৷
—সব বলে দেব, তা হলেই হল তো?
মঞ্জুদের বাড়ী আসিলেই তাহার ভালো লাগে৷ সপ্তাহের সমস্ত পরিশ্রম, যদু-মোক্তারের পেছনে পেছনে জামিননামার উমেদারী করা, মক্কেলদের মিথ্যা কথা শেখানো—সব শ্রমের সার্থকতা হয় এখানে৷ সারা সপ্তাহের দুঃখ, একঘেয়েমি কাটিয়া যায় যেন৷ ইহাদের বাড়ীতে সবসময় যেন একটা আনন্দের স্রোত বহিতেছে—যে আনন্দের স্বাদ সে সারাজীবনে কোনোদিন পায় নাই—এখানে আসিয়াই তাহার প্রথম সন্ধান পাইল৷ কিন্তু মঞ্জু আছে বলিয়াই এই বাড়ীটি সজীব হইয়া আছে, মঞ্জু যেন ইহার অধিষ্ঠাত্রী৷
নিধু বলিল—কি কবিতা আবৃত্তি হবে শুনি!
—রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’ আর মাইকেল মধুসূদনের ‘রসাল ও স্বর্ণলতিকা’—
—আমি নিজে কখনোই ও দুটো ভালো করে আবৃত্তি করতে পারিনি—
—তাহলেই তো আপনি সব চেয়ে ভালো জজ হতে পারবেন—
—আমি কেন তবে? আমাদের গাঁয়ের হরি কলুকে জজ কর না কেন তবে?
মঞ্জু হি-হি করিয়া হাসিয়া উঠিল৷ নিধুর মনে হয়, এমন বীণার ঝঙ্কারের মতো সুমিষ্ট হাসি সে কখনো শোনে নাই৷
নৃপেন বলিল—নিধুদা, দিদিকে একবার বলুন না, ও দুটো আবৃত্তি করতে?
নিধু বলিল—কর না মঞ্জু, কখনো শুনিনি তোমার মুখে—
মঞ্জুর একটা গুণ, বেশিক্ষণ ধরিয়া তাহাকে কোনো বিষয়ের জন্যই সাধিতে হয় না—যদি তাহার অভ্যাস থাকে, সেটা সে তখনি করে৷ মঞ্জুর চরিত্রের এ দিকটা নিধুর সব চেয়ে ভালো লাগে—এমন সপ্রতিভ মেয়ে সে কখনো দেখে নাই৷
মঞ্জু দুটি কবিতাই আবৃত্তি করিল৷ নিধু মুগ্ধ হইয়া শুনিল—এমন গলার সুর, এমন হাত নাড়িবার সুকুমার ভঙ্গি এসব পল্লী অঞ্চলে মেয়েদের মধ্যে কল্পনা করাও কঠিন৷
মঞ্জু বলিল—নিধুদা, আমরা একটা অভিনয় করব সেদিন বলেছিলুম—থাকবেন আপনি?
—নিশ্চয়ই থাকব—
—কি বই প্লে করা যায় বলুন না?
—আমি কি বইয়ের কথা বলব বল! আমি কখনো কিছু দেখিনি—
নিধুর এই সরলতা মঞ্জুর বড় ভালো লাগে৷ চাল-দেওয়া-ছোকরা সে তাহার মামার বাড়ীর আশে-পাশে অনেক দেখিল, কিন্তু নিধুদার মধ্যে বাজে চাল এতটুকু নাই, মঞ্জু ভাবে৷
নৃপেন বলিল—রবীন্দ্রনাথের একটা বই করা যাক—ধর ‘মুক্তধারা’—
মঞ্জু বলিল—বড় শক্ত হবে—সে আমাদের স্কুলের মেয়েরা করেছিল সেবার, অনেক লোক দরকার—বড্ড শক্ত! নিধুদা একটা লিখুন—
নিধু এ ধরনের কথায় বড় লজ্জা পায়৷ তাহাকে ইহারা ভাবিয়াছে কি? কোন কালে সে বাংলা লিখিল?
সে সঙ্কোচের সহিত বলিল—আমাকে কেন মিথ্যে বলা! আমি লিখতে জানি?
মঞ্জু বলিল—আপনার কবিতা তো দেখেচি—দেখি নি?
—সে ঝোঁকের মাথায় লেখা বাজে কবিতা—তাকে লেখা বলে না!
—তাই আমাদের লিখে দিন, সেই বাজে বই-ই আমরা প্লে করব৷
—তার চেয়ে তুমি কেন লেখ না মঞ্জু ?
—আমি! তাহলেই হয়েচে! আমি এইবার কলম ধরে অনুরূপা দেবী হব আর কি!
—ভালো কথা মঞ্জু, আমি বই পড়তে পাই নে—আমায় খান-দুই বই দিয়ো—এবার যাবার সময় নিয়ে যাব৷
—এতদিন বলেননি কেন? বই অনেক আছে, দিয়ে দিতাম৷ যখন যা দরকার হবে নিয়ে যাবেন৷
—কি কি বই আছে?
—অনেক, অনেক—কত নাম করব? রবীন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থ বারো ভল্যুম আছে—মাইকেল আছে—
—কবিতা নয় উপন্যাস আছে?
—তাও আছে৷ মা’র কাছ থেকে চাবি আনব? দেখবেন?
—না এখন থাক, রাত হয়ে গিয়েচে৷ কাল সকালে আসব—
—আচ্ছা নিধুদা, আপনি কেন ছুটি নিন না দিন কতক!
নিধু বিস্ময়ের সুরে বলিল—কেন বল তো?
—আপনি থাকলে বেশ লাগে৷ এই অজ পাড়াগাঁয়ে মিশবার লোক নেই আর কেউ৷ আপনি আসেন তবু দুদিন বেশ আনন্দে কাটে৷
—আমার আবার ছুটি কি? আমি তো কারো চাকরি করি না?
—তবে ভালোই তো৷ এ হপ্তায় আর যাবেন না—কেমন?
—না গেলে পসার নষ্ট হয়ে যাবে যে৷ নতুন প্র্যাকটিসে বসে কামাই করা চলে না৷
সেদিন রাত্রে বাড়ী আসিয়া নিধুর আর ঘুমই হয় না৷
মঞ্জু তাহাকে থাকিবার জন্য অনুরোধ করিয়াছে৷ সে থাকিলে নাকি মঞ্জুর ভালো লাগে—মঞ্জুর মুখে এ কথা সে কোনোদিন শুনিবে, ইহা বহুদূর নীল সমুদ্রের পারে স্বপ্নদ্বীপের মতো অবিশ্বাস্য ও অবাস্তব! তবু সে নিজের কানে শুনিয়াছে, মঞ্জুই একথা বলিয়াছে!
ভোরে উঠিয়া সে বাড়ীতে থাকিতে পারিল না৷ গ্রামের পথে পথে কিছুক্ষণ ঘুরিয়া বেড়াইল৷ তাহার পর বাড়ী ফিরিয়া পুকুরে স্নান করিয়া আসিল৷
নিধুর মা বলিলেন—না খেয়ে বেরিও না যেন—
—মা, ধোপার-বাড়ী থেকে কাপড় এসেচে?
—কই না বাবা, বিষ্টির জন্যে ধোপা তো আসেনি এ ক’দিন!
—আমার ফরসা কাপড় তোমার বাক্সে আছে?
ছেলের আমার সব বিদঘুটে! কাপড় সব নিয়ে গেলি রামনগরের বাসায়৷ আমার বাক্সে তোর কাপড় থাকবে কোথা থেকে? তোর কিছু খেয়াল যদি থাকে! নিজের কাপড় চোপড়ের পর্যন্ত খেয়াল নেই৷ একটি বৌমা বাড়ীতে না আনলে—
নিধু ঘরের মধ্যে পালাইবার উপক্রম করিতে মা বলিলেন—দাঁড়া, যাসনে কোথাও যেন৷ একটু মিছরি ভিজিয়ে রেখেচি, আর শশা কেটে—
ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া নিধু দেখিল তাহার ফরসা কাপড় নিজের কাছেও কিছু নাই৷ আজ সভায় মোক্তারগিরি করিবে কি করিয়া তবে? মাকে সেকথা জানাইল৷ নিধুর মা বলিলেন—তা আমি এখন কি করি বাপু! এ যে অন্যায় কথা হ’ল! কর্তার একটা সেকেলে পাঞ্জাবি আছে—সেটা তোর গায়ে হয়?
—তা বোধ হয় হ’তে পারে৷ বাবা তো মোটামানুষ নন, আমারই মতো—দেখি কেমন?
কিন্তু শেষে দেখা গেল সে পাঞ্জাবির গলার কাছে পোকায় কাটিয়া ফেলিয়াছে অনেকখানি৷ তাহা পরিয়া কোথাও যাওয়া চলে না৷
নিধুর মা স্মৃতিবিহ্বল দৃষ্টিতে পাঞ্জাবিটার দিকে চাহিয়া বলিলেন—উনি তৈরি করিয়েছিলেন, তখন এই তিন-চার মাস আমাদের বিয়ে হয়েচে! তখন কি চেহারা ছিল কর্তার! চুয়োডাঙায় জমিদারী সেরেস্তায় চাকরি করতেন৷ তোর মতো শনিবার-শনিবার বাড়ী আসতেন—
মায়ের চোখে এমন অতীতের স্বপ্নভরা দৃষ্টি নিধু আরও দু-একবার দেখিয়াছে৷ তখন সে নিজে চুপ করিয়া থাকে, কোনো কথা বলে না৷ তাহার মন কেমন করে মায়ের জন্য৷ বড় ভালোমানুষ৷ সৎমা বলিয়া নিধু বাল্যকাল হইতেই কখনো ভাবে নাই—তিনিও সৎছেলে বলিয়া দেখেন নাই৷ নিজের মায়ের কথা নিধুর মনেই হয় না৷ মা বলিতে সে ইঁহাকেই বোঝে৷
—চারুর জামা তোর গায়ে হয় না? দেখি গিয়ে না হয় চারুর মা’র কাছে চেয়ে?
—থাক মা, তোমার এখানে-ওখানে বেড়াতে হবে না জামার জন্যে৷ আমি যা আছে তাই গায়ে দিয়ে যাব এখন৷ কি খেতে দেবে দাও—
হঠাৎ মা ও ছেলে যেন কি দেখিয়া যুগপৎ আড়ষ্ট হইয়া গেল৷ ভূত নয় অবিশ্যি—সকালবেলা, মঞ্জু সদর দরজা পার হইয়া উঠানে পা দিয়াছে—সঙ্গে কেহ নাই৷ সদ্য স্নান করিয়া ভিজে চুল পিঠে এলাইয়া দিয়াছে, চওড়া জরিপাড় ফিকে নীল রঙের শাড়ী পরনে, তার সঙ্গে ঘোর বেগুনি রঙের ব্লাউজ, খালি পা, হাতে খানকতক বই, মুখে হাসি৷
—এস মা-মণি এস, এস—
—কই, সকালে এলুম জ্যাঠাইমা, খাবার কই! খিদে পেয়েছে—নিধুদা কোথায়?
—এই তো এখানে—বোধ হয় ঘরের মধ্যে—বস মা বস৷
—নিধুদা কাল বই পড়তে চেয়েছিলেন তাই নিয়ে এলাম৷
—তুমি আমাদের লক্ষ্মী মা-টি৷ বস আমি আসচি—
ইতিমধ্যে নিধু চুল আঁচড়াইয়া ফিটফাট হইয়া ঘর হইতে বাহির হইল৷
তাহার পালানোর কারণ তাহার অসংস্কৃত কেশ৷ বলিল—এই যে মঞ্জু! কখন এলে? ওগুলো কি?
—এগুলো আপনার জন্যে এনেছি—বই—
—দেখি কি কি বই—
—এখন থাক৷ আপনি জজ হবেন আবৃত্তি কমপিটিশনে, তা গাঁ-সুদ্ধ সবাই জেনে গিয়েচে, জানেন?
—কি রকম?
—বাবার কাছে সব এসে জিগগেস করছিল যে আজ সকালে!
নিধুর মা এই সময় এক বাটি মুড়ি মাখিয়া আনিয়া মঞ্জুর হাতে দিয়া বলিলেন—খেতে চাইলে, কিন্তু তোমার গরীব জ্যাঠাইমার আর কিছু দেওয়ার—
মঞ্জু কথা শেষ করিতে না দিয়াই প্রতিবাদের সুরে বলিল—অমন যদি বলবেন জ্যাঠাইমা, তাহলে আপনাদের বাড়ী কক্ষনো আসব না—তাহলে ভাবব পর ভাবেন তাই ভদ্রতা করচেন৷ বাড়ীর মেয়ের সঙ্গে আবার ভদ্রতা কেন? সে যা জুটবে তাই খাবে—কি বলেন নিধুদা? কই নিধুদার কই?
—এই যে ওকেও দিই—মিছরীর জলটা আগে—
—খেয়ে নিধুদা চলুন আমাদের বাড়ী—আবৃত্তির কবিতাগুলো একবার পড়ে নেবেন তো?
—হ্যাঁ, ভালোই তো, চল৷
নিধুর মা বলিলেন—যাবে এখন মা, এখানে একটু বস৷ ও পুঁটি, মঞ্জুকে জল দিয়ে যা মা৷ পান খাবে?
—না জ্যাঠাইমা—পান খেলেও আমি সকালবেলা খাইনে৷ একটা পান খাই দুপুরে খাওয়ার পর, আর বিকেলে একটা৷ রাত্রে খাইনে—আমার বড় মামীমার দাঁত খারাপ হয়ে গিয়েচে অতিরিক্ত পান-দোক্তা খাওয়ার দরুন৷ আমি দেখে-শুনে ভয়ে ছেড়ে দিয়েচি৷
মঞ্জু আরও আধঘণ্টা বসিয়া নিধুর মা ও বাড়ীর ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে গল্পগুজব করিল৷ সে যে নিধুকে দুপুরে নিমন্ত্রণ করিতে আসিয়াছে, সে কথা প্রকাশ করিল উঠিবার কিছু পূর্বে৷
মঞ্জু চলিয়া গেলে নিধুর মা বলিলেন—সামনের রবিবারে ওদের দুই ভাই-বোনকে খাওয়াতে হবে নেমন্তন্ন করে৷ রোজ রোজ ওদের বাড়ী খাওয়া হচ্চে—মান থাকে না নইলে—
—বেশ তো মা, তাই কোরো৷ আমি আসবার সময় রামনগর থেকে কিছু ভালো সন্দেশ আর রসগোল্লা নিয়ে আসব—কি বল?
—তাই আনিস বাবা৷ যা ভালো বুঝিস৷
সারাদিন হৈ-হৈ করিয়া, কোথা দিয়া কাটিয়া গেল৷ নিমন্ত্রণ খাওয়া, মঞ্জুর হাসি, আলাপ, আবৃত্তি-প্রতিযোগিতায় সমগ্র গ্রামবাসীর ঈর্ষা-প্রশংসা মিশ্রিত দৃষ্টির সম্মুখে মঞ্জুর বাবার ও স্কুল ইনস্পেক্টরের পাশে চেয়ারে বসিয়া আবৃত্তির ভালোমন্দ বিচার করা, আবার সন্ধ্যায় মঞ্জুদের বাড়ী জলখাবার খাওয়া, আবার আড্ডা, গল্প, মঞ্জুর গান, মঞ্জুর হাসি, মঞ্জুর স্নেহবর্ষী-দৃষ্টির প্রসন্ন আলো—
নিধুর মা রাত্রে বলিলেন—হ্যাঁরে, তুই নাকি জজবাবুর পাশে বসে কি করেছিলি স্কুলে?
—কে বললে?
—পালিতদের বাড়ী শুনে এলাম৷ তোর বড্ড সুখ্যাতি করছিল সেখানে সবাই৷ বললে—হীরের টুকরো ছেলে হয়েচে নিধু, অত বড় বড় লোকের পাশে বসে ঐটুকু ছেলে—
—তা তোমার ছেলে কম কেন হবে বল না?
—আমার বুকখানা শুনে বাবা দশ হাত হ’ল৷
নিধুর বাবা বাড়ীতে থাকিয়াও বড় কাহারো একটা খোঁজখবর রাখেন না৷ তিনি পর্যন্ত ডাকিয়া নিধুকে জিজ্ঞাসাবাদ করিলেন সভা সম্বন্ধে৷
তিনি লোকের মুখে শুনিয়াছেন৷ সভায় যান নাই—কোথাও বড় যান না৷
সোমবার সকাল৷ সপ্তাহে এমন দিন কেন আসে?
অত ভোরে মঞ্জুর সঙ্গে দেখা হওয়ার কোনোই সম্ভাবনা ছিল না৷ নিধুর মা রাত্রি থাকিতে উঠিয়া ভাত চড়াইয়াছিলেন৷ স্নান করিয়া দুটি ভাত মুখে দিয়া নিধু পথে বাহির হইল৷
কি আশ্চর্য! চোখকে বিশ্বাস করা শক্ত! অত সকালে গ্রামের বাহিরের পাকা রাস্তা দিয়া নৃপেন, বীরেন ও মঞ্জু বেড়াইয়া ফিরিতেছে৷
নিধু বলিল—বীরেন যে! কখন এলে?
—কাল অনেক রাত্রে৷ রাত দশটার ট্রেনে স্টেশনে নেমে বাড়ী পৌঁছতে একটা হয়ে গেল৷
—তারপর মঞ্জু যে বড় বেড়াতে বেরিয়েচে? কখনো তো—
—বেড়াতে বেরুই নি৷ মেজদা কাল রাত্রে পথে ফাউণ্টেন পেন হারিয়ে এসেচে—তাই ভোরে কেউ উঠবার আগে আমরা তিনজনে খুঁজতে বেরিয়েছিলাম৷ পাওয়া গেল না৷
—স্টেশন পর্যন্ত সারা পথ না খুঁজলে—
বীরেন বলিল—তা নয়, পূব-পাড়ার শাম বাগদীর বাড়ী পর্যন্ত ফাউণ্টেন পেন পকেটে ছিল৷ শাম বাগদী রামনগরের হাটে গিয়েছিল, তার গাড়ী ফিরছিল—সেই গাড়ীতে এলাম৷ তাকে পয়সা দিতে গিয়ে দেখেচি পেনটা তখনও পকেটে আছে৷ বাড়ী এসে আর দেখলাম না৷
মঞ্জু বলিল—চলো মেজদা, নিধুদাকে একটু এগিয়ে দিই৷
নিধু সকৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে মঞ্জুর দিকে চাহিল৷ মঞ্জু বলিল—খেয়ে যাবেন না নিধুদা?
—মা কি না খাইয়ে ছেড়েছেন? সেটি হবার যো নেই তাঁর কাছে৷ সেই কোন ভোরে উঠে—
—চমৎকার মানুষ বটে জ্যাঠাইমা৷ সামনের শনিবারে আসা চাই নিধুদা৷
—আসব বই কি—
—পুজো তো এসে গেল, পুজোর সময় আমরা সবাই মিলে একটা ছোটখাটো প্লে করব—আপনি আসুন, সামনের রবিবারে তার পরামর্শ করা যাবে৷ মেজদা এসেচে, বড়দাও সামনের হপ্তায় আসবে৷ বেশ মজা হবে৷
—কে, অরুণবাবু? তাঁকে কখনো দেখিনি৷
—দেখবেন এখন সামনের রবিবারে৷
তোমরা যাও মঞ্জু, আর আসতে হবে না৷
—আর একটু যাই—ওই সাঁকোটা পর্যন্ত—ভারি ভালো লাগে শরতের সকালে বেড়াতে৷ কি সবুজ গাছপালা! চোখ জুড়িয়ে যায়৷ আমার কাছে এসব নতুন৷
—তুমি এর আগে পাড়াগাঁ দেখ নি বুঝি মঞ্জু?
মধুপুর দেখেচি দুমকা দেখেচি৷ বাঙলাদেশের পাড়াগাঁয়ে এই প্রথম—
সাঁকোর কাছে গিয়া সকলে সাঁকোর উপর কিছুক্ষণ বসিল৷ বীরেন বলিল—মঞ্জু একটা গান কর তো? বেশ লাগছে সকালটা৷ নিধুও সে অনুরোধে যোগ দিল৷ মঞ্জু দু-তিনটি গান গাহিল৷ ক্রমে বেলা উঠিয়া গেল৷ দুধারের গাছপালার মাথায় শরতের রৌদ্র ঝলমল করিতে লাগিল৷ নিধু উহাদের কাছে বিদায় লইয়া জোর-পায়ে পথ হাঁটিতে লাগিল৷
সেদিন এজলাসে ঢুকিতেই সাবডেপুটি সুনীলবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন—কি নিধিরামবাবু, লালবিহারীবাবুকে আমার খবরটা দিয়েছিলেন তো?
সর্বনাশ! নিধু তাহা একেবারে ভুলিয়া গিয়াছে৷ সেকথা একেবারেই তাহার মনে ছিল না৷ মঞ্জুর সঙ্গে দেখা হইলে তাহার কোনো কথাই ছাই মনে থাকে না!
সে আমতা আমতা করিয়া বলিল—হুজুর—খবরটা দেওয়া হয় নি৷ আমার বাড়ীতে অসুখবিসুখ—উনিও স্কুলে কি সব কাজে বড় ব্যস্ত—বড়ই দুঃখিত—
—না, না, সেজন্যে কি! সেজন্য কিছু মনে করবেন না৷ দেখি যদি সুবিধে পাই—সামনের রবিবারে আমি নিজেই সাইকেল করে যাব৷ সামনের শনিবারে আপনি শুধু জানিয়ে দেবেন দয়া করে যে আমি রবিবারে যেতেও পারি, তাহলেই হল৷
সাধন-মোক্তার ফৌজদারী কোর্টের বটতলা হইতে নিধুকে দেখিতে পাইয়া তাহার দিকে আসিতেছিলেন, সাবডেপুটির এজলাসের বাহির হইবার সঙ্গে সঙ্গে নিধু একেবারে সাধনের সামনে গিয়া পড়িল৷
—আরে এই যে নিধিরাম, আজ এলে সকালে? বেশ, বেশ৷ চল একটা জামিননামা আছে, যদুদা তোমায় খুঁজছিলেন যে, দেখা হয়েচে?
—আজ্ঞে না—এই তো আমি পা দিয়েছি কোর্টে৷ কারো সঙ্গে এখনো—
—সুনীলের এজলাসে কি কেস ছিল?
সাধন-মোক্তার প্রবীণ লোক—সাবডেপুটির সামনাসামনি যদিও কখনো ‘হুজুর’ ছাড়া সম্বোধন করেন না, কিন্তু সেই সাবডেপুটি বা অন্য জুনিয়ার হাকিমদের প্রথম পুরুষে উল্লেখ করিবার সময় তাহাদের নামের শেষে ‘বাবু’ পর্যন্ত যোগ করেন না—ইহাতে সাধন ভাবেন তাঁহার চরিত্রের নির্ভীকতা প্রকাশ পায়৷
নিধু তাঁহার প্রশ্নের জবাব দিয়া যদু-মোক্তারের খোঁজে গেল৷ বার লাইব্রেরীতে যদু বাঁড়ুয্যে, ধরণী পাল ও হরিবাবু বসিয়া কি লইয়া তর্কবিতর্ক করিতেছেন—এমন সময় নিধুকে ঢুকিতে দেখিয়া যদু বলিলেন—আরে নিধিরাম যে, এস! সেদিনের রূপনারাণপুরের মারামারির কেসের রায় আজ বেরুবে—আসামী দুজন এখনো এসে পৌঁছল না৷ ওদের টাকা আগে হাত করতে হবে—নয়তো কিছু দেবে না—তুমি এখানে বসে থাক৷ তুমিও তো কেসে ছিলে, তোমারও পাওনা আছে৷ ওরা এলে কোর্ট-মুখো যেন না হয়৷
—কেন?
—আসামী সব বেকসুর খালাস হয়েচে রায়ে৷ আমি খবর নিয়েচি৷
—এ তো ভালো কথা৷ তবে তারা এলে—যা টাকা বাকি আছে—
ধরণী ও হরি-মোক্তার নিধুর কথা শুনিয়া হাসিলেন৷ যদু বাঁড়ুয্যে মুখে হতাশার ভাব আনিয়া বলিলেন—জুনিয়ার মোক্তার কিনা, এখনো গায়ে ইস্কুল-কলেজের বেঞ্চির গন্ধ! বুঝতে তোমার এখনো অনেক দেরি, বাবা!
নিধু জিনিসটা এখনো ভালো করিয়া বুঝিতে পারে নাই দেখিয়া প্রবীণ হরি-মোক্তার বলিলেন—নিধিরামবাবু, বুঝলেন না? আসামী যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে সে খালাস পাবে, তবে সে আপনাকে বা যদুদাকে আর সিকি পয়সাও ঠ্যাকাবে না৷ কোর্টের ওদিকে গেলে ওই পেস্কার-টেস্কার পয়সা আদায় করার জন্যে খবরটা শুনিয়ে দেবে—কারণ সবাই তো ওৎ পেতে আছে পরের ঘাড় ভাঙবার—
—আজ্ঞে বুঝেচি হরিদা—এই যে এরা এসেচে, রূপনারাণপুরের সেই মক্কেল দুজন—
যদুবাবু অমনি তাহাদের উপর যেন ছোঁ মারিয়া পড়িয়া বলিলেন—এই যে, এলে? এস বস বাবা৷ খবর তো বড় খারাপ!
আগন্তুক মক্কেল দুটি পল্লীগ্রামের লোক, পরনে হাঁটু পর্যন্ত তোলা ময়লা কাপড়, পায়ে কাদা, গায়ে ময়লা আকার-প্রকার-হীন পিরাণ বা ফতুয়ার উপর গামছা ফেলা—বগলে ছোট পুঁটুলি৷ ইহাদের মধ্যে একজনের চেহারা খুব লম্বা-চওড়া, একমুখ দাড়ি, গোল-গোল ভাঁটার মতো চোখ—দেখিলে মনে হয় বেশ বলবান, তবে নিরীহ ও নির্বোধ ধরনের৷
দুজনেই উৎসুক ভাবে বলিল—কি খবর বাবু?
—খবর খারাপ৷ হাকিম খুব চটেচেন—
—কার ওপর চটলেন বাবু?
—তোমাদের দুজনের ওপর৷ জেলে যেতে হবে৷ রায়ের গতিক ভালো নয়৷ আজ একবার হদ্দমুদ্দ শেষ চেষ্টা করে দেখি যদি খালাস করতে পারি—কিন্তু—
এই সময় যদু বাঁড়ুয্যে নিধুর হাতে একটা স্লিপে কি লিখিয়া দিলেন৷
নিধু স্লিপটা পড়িয়া বলিল—বাবু আজ বিশেষ চেষ্টা করবেন তোমাদের জন্যে, তিন টাকা তেরো আনা ন’ পাই প্রত্যেকের খরচ চাই—
—বাবু, ট্যাকা তো অত মোরা আনি নি৷ মোরা জানি রায় বেরুবে—
যদু বাঁড়ুয্যে মুখ খিঁচাইয়া বলিলেন—রায় বেরুবে! রায়ে তোমাকে একেবারে বেকসুর খালাস দিয়ে দেবে যে! যাও গিয়ে এখন দুটি বচ্ছর ধরে ঘানি টানো গে জেলে—তবে তোমাদের চৈতন্য হবে৷ সেদিন কি বলে দিয়েছিলাম?
—তা বাবু, বলে তো দেলেন—কিন্তু ইদিকি যে মোদের দিন চলে না এমনডা হয়েচে৷ এই মোকদ্দমায় এপর্যন্ত বাইশ-তেইশ টাকা উকীল-মোক্তারের দেনা, আর পুলিস—
—ওসব প্যানপ্যানানি রাখগে যা তুলে৷ টাকা না আনিস, এক পা নড়ব না এখান থেকে—দেখি কি হয়—ক-বছর ঘানি টানতে হয় দেখি একবার—
—না বাবু, আপনি একবার চেষ্টা করে দেখুন—আমি ট্যাকার সন্ধান করে আসচি—বাজারের দিকি যাই—আমাদের গাঁয়ের দুটো লোক এসেচে—তাদের কাছে—
—তা যা শিগগির যা—আর শোন, একটা কথা—কাছে আয়—
তাহারা কাছে সরিয়া আসিলে যদু-মোক্তার গলার সুর নিচু করিয়া বলিলেন—খবরদার যেন কোর্টের দিকে যাবিনে—তোদের দেখলে হাকিমের রাগ হবে—শেষকালে বাঁচাতে পারব না তোদের—টাকা এনে আমার হাতে দিয়ে চুপটি করে এই বার লাইব্রেরীতে বারান্দায় বসে থাকবি, বুঝলি?
—বেশ বাবু, যা বলবেন৷
লোক দুটি চলিয়া গেলে হরি ও ধরণী-মোক্তার হো হো করিয়া হাসিয়া ঘর ফাটাইবার উপক্রম করিলেন৷ হরি-মোক্তার বলিলেন—বাবা, পাকা লোক যদু-দা! ওঁর কাছে মক্কেলের চালাকি? না কোর্টের আমলাদের চালাকি?
যদু সগর্বে বলিলেন—আরে ভায়া, টাকা রয়েচে ওদের কাছে৷ দেবে না—দিতে চায় না৷ এই কাজ করচি এই রামনগরের কোর্টে আজ চল্লিশ বছর প্রায়, দেখে-দেখে ঘুণ হয়ে গেলাম৷ এখুনি দেখ এসে টাকা দিয়ে যাবে৷ বাইরে দুজনে পরামর্শ করতে গেল, আর কাছা থেকে টাকা খুলতে গেল৷ আমি জ্ঞান হয়ে অবধি এই দেখে আসচি—কত হাকিম এল, কত হাকিম গেল! রমেশ দত্তকে এই কোর্টে দেখেচি—তখন তিনি জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট—সিভিলিয়ান রমেশ দত্ত—আমি আজকের লোক নই!
নিধুকে ডাকিয়া যদু বাঁড়ুয্যে বলিলেন—তুমি বস এখানে৷ আমি এজলাসে যাব একবার৷ কোথাও যেও না টাকা আদায় না করে৷
আজ বারো মাসের মোক্তারী জীবনে নিধু এরকম অনেক দেখিল৷ এক-একবার তাহার মনে হয় এর চেয়ে স্কুল-মাস্টারি করা অনেক ভালো ছিল৷ এ দুঃখের কথা—পলে-পলে মনুষ্যত্বের এই মরণ—কাহার কাছে এসব কথা ব্যক্ত করিবে সে!
একজন মাত্র মানুষ আছে, সে মঞ্জু৷ মঞ্জুর কাছে সামনের শনিবারে সব সে খুলিয়া বলিবে৷ এ জীবন আর ভালো লাগে না৷
কোর্টের কাজ সারিয়া বাহির হইতে প্রায় পাঁচটা বাজিল৷ সাধন-মোক্তার তাহাকে বাসায় যাইবার পথে ধরিয়া বসিলেন—ওহে নিধিরাম, শোনো শোনো৷ আমার সে ব্যাপারটা—
—আজ্ঞে, বুঝেচি৷ সে এখন হবে না৷
—কেন বল তো? জিগগেস করেছিলে বাড়ীতে?
—বাড়ীতে আর জিগগেস করব! এখন নিজেরই মন নেই, এই তো রোজগারের দশা—দেখচেন তো সব!
—ওসব কথা কাজের নয় হে৷ তুমি ছেলেমানুষ, এখুনি কি রোজগার করতে চাও? দিন যাক, সিনিয়র মোক্তারগুলো আগে পটল তুলুক—
—ততদিনে আমাকেও পটল তুলতে হবে দাদা!
—তুমি ভুল করচো ভায়া৷ ভেবে দেখ আগে, তোমাকে এ কাজ করতেই হবে—বাড়ীতে এরা তোমাকে পছন্দ—
নিধু বাসায় আসিয়া দোর খুলিল৷ এখানে নিজেরই রাঁধিতে হয়, একটা ছোকরা চাকর কাজকর্ম করে৷ ঘর-দোর বড় অপরিষ্কার দেখিয়া সে চাকরটিকে ডাকিয়া ধমক দিল৷ বলিল—উনুনে আঁচ দে, রান্না চড়িয়ে দেব৷ ভালো বিপদে ফেলিয়াছে সাধন-মোক্তার৷ বাড়ীতে পছন্দ করিয়াছে তো তাহার কি? কাল সকালে স্পষ্ট জবাব দিয়া দিবে৷
হাত-মুখ ধুইয়া রান্না চাপাইবার উদ্যোগ করিতেছে, এমন সময় সাবডেপুটির আরদালি আসিয়া একখানা পত্র তার হাতে দিল৷
সুনীলবাবু তাহাকে একবার এখনি দেখা করিতে লিখিয়াছেন৷ সেখানেই সে চা খাইবে৷
সন্ধ্যা তখনো হয় নাই৷ সুনীলবাবু বৈঠকখানায় বসিয়া মুন্সেফবাবুর সঙ্গে গল্প করিতেছেন৷
—আসুন নিধিরামবাবু, বসুন৷ আপনার জন্য আমরা অপেক্ষা করচি, কেউ চা খাই নি—
—আজ্ঞে আমি তো চা খাইনে—আপনারা খান৷ নমস্কার মুন্সেফবাবু, বেশ ভালো আছেন?
মুন্সেফবাবুটি নবাগত৷ সুনীলবাবু নিধুর পরিচয় করাইয়া দিয়া বলিলেন—এঁর কথাই বলছিলাম৷ বেশ প্রমিসিং মুকটিয়ার, যদিও এই সবে—
মুন্সেফবাবু বলিলেন—আপনার নাম শুনেচি এঁর মুখে নিধিরামবাবু৷ আপনার বাড়ী বুঝি লালবিহারীবাবুর স্বগ্রামে?
—আজ্ঞে৷ আপনি তাঁকে চেনেন?
—হ্যাঁ৷ আলাপ নেই—তবে একই সার্ভিসের লোক, যদিও তিনি আমাদের চেয়ে সিনিয়র৷ নাম খুব জানি৷ আচ্ছা আপনাকে একটা কথা জিগগেস করব—
—আজ্ঞে বলুন—
—লালবিহারীবাবুর বড় ছেলে অরুণকে আপনি জানেন?
—দেখি নি তবে নাম শুনেচি—তিনি এখানে আসেন নি—তবে শুনচি সামনের রবিবার নাকি আসবেন৷
সুনীলবাবু বলিলেন—তবে তো ভালো হল অমরবাবু, চলুন আপনিও সামনের রবিবারে ওঁদের ওখানে৷ অরুণবাবুকে দেখে আসবেন—কি বলেন নিধিরামবাবু?
—আজ্ঞে এ তো খুব ভালো কথা৷
মুন্সেফবাবু বলিলেন—আপনাকে বলি, আমার একটি ভাগ্নীর সঙ্গে অরুণবাবুর বিবাহের প্রস্তাব হয়েচে—মানে এখনও ফরম্যালি কথা হয়নি ওঁর সঙ্গে—আমরা দেখে এসে—
—আজ্ঞে খুব ভালো কথা৷
সুনীলবাবু বলিলেন—আমরা রবিবারে যাব দুজনে৷ আপনি দয়া করে শুধু লালবিহারীবাবুকে যদি জানিয়ে রাখেন—
—এ আর বেশি কথা কি বলুন—আমি নিশ্চয়ই বলব এখন৷ আজ্ঞে না, আমি তো চা খাইনে—এ কাপ নিয়ে যাও—
—আচ্ছা বাড়তি কাপ আমাদের এখানে দিয়ে যা, চা ফেলা যাবে না আমাদের কাছে—কি বলেন অমরবাবু—আপনাকে কি ওভালটিন দেবে?
—আজ্ঞে না, আমি শুধু এই খাবার—একগ্লাস জল দিলেই—
—ওরে বাবুকে একগ্লাস জল—আর পান নিয়ে আয় তিন খিলি—
আরও আধঘণ্টা কথাবার্তার পরে নিধিরাম বিদায় লইয়া বাসায় আসিল৷ তাহার মনটা বেশ প্রফুল্ল৷ এত বড় বড় অফিসারের সঙ্গে বসিয়া চা খাইয়া আড্ডা দিবে—সে কখনো ভাবিয়াছিল? গ্রামে তাহারা অত্যন্ত গরীব—তাহার বাবা তো কোথাও সুখ পান না গরীব বলিয়া৷ কাছারীর নায়েব দুবেলা ডাকিয়া শাসন করে৷ আর আজ সে কিনা মহকুমার দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের সঙ্গে সমানে সমানে বসিয়া জলখাবার খাইল, গল্পগুজব করিল! গ্রামে গিয়া একটা গল্প করিবার জিনিস হইয়াছে বটে! কিন্তু তাহার চেয়েও—এ সবের চেয়েও গর্বের বিষয় তাহার জীবনে—মঞ্জুর সঙ্গে আলাপ, মঞ্জুর মতো শিক্ষিতা, সুন্দরী, বড়দরের গভর্ণমেন্ট অফিসারের মেয়ের সঙ্গে তাহার আলাপ, তাহার বন্ধুত্ব!
তাহার এ সৌভাগ্যের তুলনা হয়? কজনের ভাগ্যে এমন ঘটে?
কিন্তু মুশকিল ঘটিয়া গেল৷ সামনের রবিবারে যদি ইঁহারা গিয়া উপস্থিত হন, তবে গোলমালে এমন সকলে ব্যস্ত হইয়া উঠিবে যে মঞ্জুর সহিত দেখাশোনা হয়তো ঘটিয়াই উঠিবে না৷ তাহাদের গ্রামে যখন ইঁহারা যাইতেছেন—তখন তাহাকে ইঁহাদের লইয়াই ব্যস্ত থাকিতে হইবে—মঞ্জুর সহিত সে দেখা করিবে কখন? মঞ্জু যে বলিয়াছিল আগামী রবিবারে অভিনয়ের সম্বন্ধে পরামর্শ করিবে—সে-সব গেল উল্টাইয়া৷ তাহার সময় কই? সামনের রবিবার একেবারে মাটি৷
পরদিন যদু বাঁড়ুয্যে কতকটা অবিশ্বাস, কতকটা আগ্রহের সুরে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন—হ্যাঁ হে নিধু, সুনীলবাবু আর মুন্সেফবাবু নাকি সামনের হপ্তায় তোমাদের গাঁয়ে তোমাদের বাড়ী যাচ্চেন?
নিধু হাসিয়া বলিল—কে বললে?
—সব শুনতে পাই হে, সব কানে আসে৷ পেশকারবাবুর মুখে শুনলাম৷ সুনীলবাবুর চাপরাশি বলেচে৷
—আজ্ঞে হ্যাঁ কাকা, তবে আমাদের বাড়ী তো নয়—আমাদের প্রতিবেশী লালবিহারীবাবু মুন্সেফ—তাঁদেরই বাড়ী৷
—সে যাই হোক, তুমিও একটু তোমার বাড়ীতে নিয়ে যেও, খাতির-যত্ন কোরো হে৷ হাকিমদের বাড়ী যাতায়াত করলে বা হাকিম বাড়ীতে যাতায়াত করলে মক্কেলের চোখে উকীল-মোক্তারের কদর বেড়ে যায়—ও একটা মস্ত খাতির হে৷
যদু-মোক্তার যেন একটু ক্ষুণ্ণ হইয়াছেন মনে হইল৷
তিনি এতকাল রামনগরে মোক্তারি করিতেছেন—তাঁহার এখানে শহরের বাসায় নিমন্ত্রণ উপলক্ষে অনেকবার হাকিমদের পদধূলি যে না পড়িয়াছে তাহা নয়—কিন্তু কই, কোনো হাকিম তো তাঁহার পৈতৃক গ্রামের বাঁশবনের অন্ধকারে কখনো যান নাই! এ মান অনেক বড়, এর মূল্য অনেক বেশি৷ এই অর্বাচীন জুনিয়ার মোক্তারটার অদৃষ্টে কিনা শেষে এই সম্মান জুটিল!
শনিবার সুনীলবাবু নিধুকে এজলাসে বলিলেন—লালবিহারীবাবুর নামে চিঠি আর দিলাম না, বুঝলেন? যদি না যাওয়া হয়? আপনি মুখেই বলবেন—
বাড়ী যাইবার পথে নিধু কতবার ভাবিল—তাই যেন হয় হে ভগবান! ওদের যাওয়া যেন না ঘটে!
যদু মোক্তারের বর্ণিত মানখাতির বা মক্কেলের চোখে মূল্যবৃদ্ধি সে চায় না বর্তমানে—শনি-রবিবারগুলি যেন এভাবে নষ্ট না হয়—ভগবানের কাছে এই তাহার প্রার্থনা৷ মক্কেলের মানখাতিরে কি হইবে?
বাড়ী পৌঁছিয়া বিপদের উপর বিপদ—তাহার এক বৃদ্ধ মেসোমশায় আসিয়াছেন, তাঁহার বকুনিরও বিরাম নাই, তামাক খাওয়ারও বিরাম নাই৷ নিধুকে দেখিয়া তিনি যেন তাহাকে আঁকড়াইয়া ধরিলেন, বাজে বকুনিতে নিধুর কান ঝালাপালা হইয়া উঠিল৷ নিধুর মাকে দেখাইয়া বলিলেন—চিনু তো কালকের মেয়ে! আমি যখন ওর জ্যাঠতুতো দিদিকে বিয়ে করি, তখন চিনুর বয়স কত—এতটুকু মেয়ে! রাঙা ছোট্ট শাড়ী পরে গুটগুট করে হাঁটত৷ বস হে নিধুবাবু, তোমরা হলে আমার নাতির বয়সী৷
সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া প্রায় ঘণ্টাখানেক কাটিল৷ মেসোমশায় তাহাকে আর ছাড়েন না৷ তিনি কোন কালে চা-বাগানে কাজ করিতেন সেই আমলের সব গল্প৷ নিধুর মা তাঁহার পিতার বয়সী ভগ্নীপতির ঘন ঘন তদারক করিতেছেন—বাড়ীসুদ্ধ সরগরম৷ আজ কি মঞ্জুও একবার খোঁজ লইল না?
নিধুর মন রীতিমতো দমিয়া গেল৷
সন্ধ্যার প্রায় ঘণ্টা দুই পরে নিধু একবার বাড়ীর বাহির হইল৷ লালবিহারীবাবুর বাড়ীতে যাইবার খুব ভালো অজুহাত তাহার রহিয়াছে৷ হাকিমবাবুদের আসিবার সংবাদটা দেওয়া৷ সে চাহিয়া দেখিল উঁহাদের বৈঠকখানায় তাহার বাবা বসিয়া আছেন—পাড়ার আরও দু-একটি বৃদ্ধ সেখানে উপস্থিত৷ দাবা খেলা চলিতেছে৷
নিধু ঘরে ঢুকিতেই লালবিহারীবাবু বলিলেন—আরে নিধু যে! এখন এলে? এস এস—
—আজ্ঞে কাকাবাবু, একটা কথা বলতে এলাম৷ আমাদের সাবডেপুটি সুনীলবাবু আর মুন্সেফ অমরবাবু কাল আপনার বাড়ী বেড়াতে আসবেন বলে দিয়েচেন—
—ও, সুনীল! সিমলে তাঁতিপাড়ার সুনীল—বুঝেচি! জগৎতারণের ছেলে সুনীল!—তবে অমরবাবুকে তো আমি ঠিক চিনি নে৷ নাম শুনেচি বটে৷ ছোকরা মতো—না? হ্যাঁ, তাই হবে—আমাদের সার্ভিসের সিনিয়ার লোকদের অনেককেই জানি কিনা৷ অমরবাবু ছোকরাই হবে—
—আজ্ঞে হ্যাঁ, বয়েস বেশি নয়—নতুনও খুব নয়, পাঁচ ছ-বছরের সার্ভিস৷
—ওই হল—আমাদের সার্ভিসে ওসব জুনিয়ারের দল৷ তা তুমি একবার বাড়ীর মধ্যে গিয়ে তোমার কাকীমাকে কথাটা বোলো হে—
নিধু দুরু-দুরু বক্ষে বাড়ীর মধ্যে ঢুকিল৷ রান্নাঘরের দাওয়ায় ঝি বসিয়া কি করিতেছে, দু-একটা চাকর ঘুরিতেছে—আর কেহ নাই৷ নিধু ঝিকে বলিল—কাকীমা কোথায়?
—এই তো এখানে ছিলেন—দেখুন বোধ হয় ঘরের মধ্যে, কি দোতলায়—
—ও কাকীমা—
দোতলার জানালায় মুখ বাড়াইয়া মঞ্জুই জিজ্ঞাসা করিল—কে?
নিধুর বুকে কিসের ঢেউ হঠাৎ যেন উদ্বেল হইয়া উঠিল—বুক হইতে গলা পর্যন্ত যেন অবশ হইয়া গেল৷ সে দিশাহারা ভাবে উত্তর দিতে গেল—এই যে আমি—আমি নিধু৷
—নিধুদা? বেশ, বেশ লোক যা হোক—দাঁড়ান যাচ্ছি—
মঞ্জু জানালা হইতে মুখ সরাইয়া লইল৷ চক্ষের পলকে সে একেবারে নিচের বারান্দার দোরের কাছে আসিয়া হাসিমুখে বলিল—বা রে, আপনি কেমন লোক বলুন তো নিধুদা? কখন এলেন বাড়ী?
—সন্দের আগে এসেচি তো—
—এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? আমি আপনার জন্যে কতক্ষণ বসে৷ নিজে চপ করলাম বাবা খেতে চেয়েছিলেন বলে—আপনার জন্যে রেখে বসে বসে—এই আসেন, এই আসেন—ওমা, একেবারে রাত নটার সময় এলেন!
নিধু অভিমানের সুরে বলিল—তা তুমিও তো খোঁজ কর নি মঞ্জু?
—আমি দুবার নৃপেনকে পাঠিয়েচি যে—কেন জ্যাঠাইমা বলেন নি?
—কৈ, না তো৷
—বাঃ, সন্দের আগে বিকেলের দিকে দুবার নৃপেন গিয়েছে—আপনাদের বাড়ী কে এক ভদ্রলোক এসেচেন, তিনি ওকে ডেকে গল্প করলেন—কাছে বসালেন—ও বলছিল আমায়—তাহলে জ্যাঠাইমা বলতে ভুলে গিয়েচেন৷ ব্যস্ত আছেন কিনা অতিথি নিয়ে৷ আসুন বসুন—দালানের মধ্যে বসবেন, না রোয়াকে? আজ বড্ড গরম—ভাদ্রমাসের গুমট—
—রোয়াকেই বসি, বেশ হাওয়া আছে—
মঞ্জু যেন খানিকটা আপন মনেই বলিল—দেখুন তো, চপগুলো সব জুড়িয়ে জল হয়ে গেল—এখন কি খেতে ভালো লাগে৷ বিকেলে বেশ গরম ছিল—খেয়ে কিন্তু নিন্দে করতে পারবেন না৷
নিধু হাসিয়া বলিল—কেন, নিন্দেই তো করব, খারাপ হলেও ভালো বলতে হবে?
—খারাপ কক্ষনো হয় নি৷ রান্নায় আমি স্কুলে সার্টিফিকেট পেয়েছি—জানেন তা? তবে জুড়িয়ে গেল—আপনি বসুন, আমি ওগুলো গরম করে নিয়ে আসি—
আধঘণ্টা পরে মঞ্জু, নৃপেন, বীরেন ও নিধু বসিয়া গল্প করিতেছিল৷ হঠাৎ মঞ্জু বলিল—চলুন ছাদে যাই নিধুদা, বড় গরম এখানে—চল মেজদা—
সবাই মিলিয়া খোলা ছাদে শতরঞ্জি পাতিয়া আসর জমাইল৷ নানা ভূতের গল্প, শহরের গল্প, বীরেনের মুখে উৎসাহের সহিত বর্ণিত গত সপ্তাহে কলিকাতায় ফুটবল খেলার গল্প ইত্যাদিতে আড্ডা মুখর হইয়া উঠিল৷ ছাদের উপরে নুইয়া পড়া বাঁশঝাড়ে রাতচরা কোনো পাখির ডানা-ঝটাপটি৷ পরিষ্কার শরতের আকাশে সুস্পষ্ট জ্বলজ্বলে নক্ষত্ররাজি ও ট্যারচা ছায়াপথ৷
নিধু যেন নূতন মানুষ হইয়া গিয়াছে৷ জীবনে যেন সে এই প্রথম আনন্দ কাহাকে বলে জানিয়াছে৷ এরা কত ভালো ভালো জায়গার গল্প বলিতেছে, কখনো নিধু সে-সব দেশে যায়ও নাই—কলিকাতায় গেলেও সেখানকার শিক্ষিত বড়লোকদের সঙ্গে এদের মতো মেশেও নাই—জজ-মুন্সেফের বাড়ীতে শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের সঙ্গে এত রাত্রি পর্যন্ত বসিয়া গল্পগুজব করিবে—আর বছর এমন সময় সে-ই কি সেকথা ভাবিতে পারিত?
হঠাৎ তাহার মনে পড়িল—যেজন্য সে বাড়ীর ভিতর আসিয়াছিল—সুনীলবাবু ও মুন্সেফ বাবুর আসার কথা বলিতে—সেকথা এখনো বলা হয় নাই৷ মঞ্জুকে দেখিয়া সে সব ভুলিয়া গিয়াছে৷ কথাটা সে এ আসরেই বলিল৷ বীরেন বলিল—ও, সুনীলবাবু! এখানে এসেচেন নাকি সাবডেপুটি হয়ে? তা তো জানিনে!
—তাঁর সঙ্গে আলাপ আছে বুঝি?
—খুব৷ সিমলেতে আমাদের মামার বাড়ীর পাশের বাড়ীতেই—
মঞ্জু বলিল—ওঁর বোন ভানু আমার সঙ্গে এক ক্লাসে পড়ত—গত বছর বিয়ে হয়ে গেল৷ খুব জাঁকের বিয়ে৷ সুনীলবাবুর বাবা বেশ বড়লোক—তিনিও রিটায়ার্ড সাবজজ—
—কাল এলে কখন আসবেন?
—বোধহয় সকালের দিকেই—কাকীমাকে বোলো বীরেন৷ আমি বলতে ভুলেই গিয়েচি—
রাত্রে নিধুর মা জিজ্ঞাসা করিলেন—হ্যাঁরে, কাল বলব নাকি খেতে মঞ্জুদের? বীরেনও যে এসেচে—তাকেও বলতে হয়৷
—কিন্তু মা, কাল একটু গোলমাল আছে৷ সাবডেপুটি আর মুন্সেফবাবু আসবেন বেড়াতে ওদের বাড়ী৷ কাল দরকার নেই—সেই সব নিয়ে ওরা কাল ব্যস্ত থাকবে৷
সকালে উঠিয়া নিধু রামনগরের পাকা রাস্তার উপর পায়চারি করিল বেলা আটটা পর্যন্ত৷ তখনো পর্যন্ত কাহাকেও আসিতে দেখা গেল না৷ না আসিলেই ভালো৷ দিনটা একেবারে মাটি হইয়া যাইবে উহারা আসিলে৷ এত বেলা যখন হইয়া গেল—হয়তো আর আসিবে না৷ সাড়ে-আটটা পর্যন্ত রাস্তার উপর অপেক্ষা করিয়া নিধু বাড়ী ফিরিতেছে, পথে নৃপেনের সঙ্গে দেখা৷ সে বলিল—বা রে, কোথায় গিয়েছিলেন বেড়াতে? আপনার বাড়ী বসে বসে—
—কেন?
—দিদি সেই সাড়ে-সাতটার সময় আপনাকে ডাকতে পাঠিয়েচে—জলখাবার খাবেন বলে খাবার সাজিয়ে বসে আছে—
—আচ্ছা, তুমি যাও নৃপেন৷ আমি নেয়ে নিই পুকুরে—তারপর যাচ্ছি—
স্নান সারিয়া ফিটফাট হইয়া মঞ্জুদের বাড়ী যাইতে ন’টা বাজিয়া গেল৷
বাড়ীর ভিতর পা না দিতেই মঞ্জু রান্নাঘরের দাওয়া হইতে বলিল—আজকাল আপনার হয়েচে কি! লুচি জুড়িয়ে জল হয়ে গেল৷ কখন ডাকতে পাঠিয়েচি নৃপেনকে—বেশ লোক যা হোক!
মঞ্জুর মা বসিয়া নিজের হাতেই ওল কুটিতেছেন, তিনিও বলিলেন—এস বাবা৷ মঞ্জু এখনো খায় নি, বলে—অতিথিকে না খাইয়ে আগে খেতে নেই৷ আমি বললাম, ও তো ঘরের ছেলে, ও আবার অতিথি কোথায় মা, তুই খেয়ে নে৷ মেয়ের সবই বাড়াবাড়ি৷
নিধু অপ্রতিভ হইল৷ সঙ্গে সঙ্গে এক অপূর্ব উত্তেজনা ও আনন্দে তাহার সারা শরীর যেন ঝিমঝিম করিয়া উঠিল৷ মঞ্জু না খাইয়া আছে সে খায় নাই বলিয়া—কেন? কই, কোনো মেয়ে তো এ পর্যন্ত তাহার না খাওয়ার জন্য নিজেকে অভুক্ত রাখে নাই! অন্তত কোনো শিক্ষিতা তরুণী বড়লোকের মেয়ে তো নয়ই৷ নিজের সৌভাগ্যকে সে যেন বিশ্বাস করিতে পারে না৷
মঞ্জু তাহাকে ভিতরের ঘরের বারান্দায় খাইতে দিয়া কাছে দাঁড়াইয়া রহিল৷ বলিল—আজ যে সেই প্লে সিলেক্ট করার দিন—তাও আপনি ভুলে বসে আছেন নিধুদা?
—কেন ভুলব? তবে আজ অরুণবাবুর আসার কথা ছিল না!
—বড়দা বেলা বারোটার কম কি পৌঁছবেন এখানে? যদি আসেন তো ওবেলা সবাই মিলে বসে—
—আচ্ছা মঞ্জু, একটা কথা বলব?
—কি?
—তুমি না খেয়ে রইলে কেন এত বেলা পর্যন্ত? অন্যায় নয় তোমার? কাকীমা কি ভাবলেন?
—মা আবার কি ভাববেন—বা রে!
নিধুর একটু দুষ্টুমি বুদ্ধি আসিয়া জুটিল—কেউ কোনো দিকে নাই দেখিয়া সে সুর নামাইয়া বলিল—ভাবচেন কি শুনবে? ভাবচেন মঞ্জুর সঙ্গে নিধুর খুব ভাবসাব হয়েচে কিনা, তাই ও না খেলে মেয়েও খায় না—
মঞ্জু চোখ পাকাইয়া বলিল—ভদ্রলোকের বাড়ীতে বসে ভদ্রলোকের মেয়েদের সম্বন্ধে এ সব কি কথাবার্তা হচ্চে?
নিধু হাসিমুখে বলিল—বেশ করচি যাও৷ কাকীমা ভাবতে পারেন কিনা বল?
—পাড়াগাঁয়ের ভূত কি আর সাধে বলে?
—আর তোমার পৈতৃক ভিটেও তো এই পাড়াগাঁয়েই—বিলেত থেকে তো আস নি?
—না এসেচি তো না এসেচি—যান—কি হবে তার!
—পাড়াগাঁয়ের ভূত বলে তাহলে আমায় গালাগাল দেওয়াটা কি ভালো তবে?
এমন সময় হঠাৎ বীরেন ও নৃপেন একসঙ্গে ব্যস্তসমস্ত ভাবে ঘরে ঢুকিয়া বলিল—ও নিধুদা, ও দিদি—ওঁরা সব এসেচেন—মুন্সেফ অমরবাবু আর সাবডেপুটি—বাইরের ঘরে বাবার সঙ্গে—আসুন শিগগির—
—আমার কথা ওঁরা জিগগেস করলেন নাকি?
—না, তা কিছু বলেন নি, তবে বলছিলেন আপনাকে দিয়ে খবর দেওয়া ছিল—
মঞ্জু বলিল—অত তাড়াতাড়ি গোগ্রাসে গিলতে হবে না৷ এমন তো লাটসাহেব কেউ আসে নি—ও লুচি দুখানা খেয়ে নিয়েই—একটু পরেই না হয়—আপনাকে তো তাঁরা ডেকে পাঠান নি—
কিন্তু নিধুর পক্ষে ধীরেসুস্থে বসিয়া বসিয়া লুচি খাওয়া আর সম্ভব নয়৷ যাঁহারা আসিয়াছেন—তাঁহারা তাহার পক্ষে লাটসাহেবই বটে৷ এ অবস্থায় আর থাকা চলে না৷
নিধু একপ্রকার ছুটিতে ছুটিতে বাহিরে আসিল৷
বৈঠকখানায় অনেক লোক৷ লালবিহারীবাবু, নিধুর বাবা, সাবডেপুটি ও মুন্সেফবাবু, উপেন হালদার ও স্থানীয় স্কুলের পণ্ডিত উমাপদ ভট্টাচার্য সকলে মিলিয়া বসিয়া পল্লীগ্রামের বর্তমান দুর্দশার কথা আলোচনা করিতেছেন৷
সুনীলবাবু নিধুকে দেখিয়া বলিয়া উঠিলেন—আরে এই যে নিধিরামবাবু! মশাই, রাস্তা বড় ভয়ানক, জায়গায়-জায়গায় এমন কাদা যে সাইকেল চলে না—কাঁধে তুলে আনতে হয়েচে—বসুন৷
মুন্সেফবাবু বলিলেন—আপনাদের বাড়ীটা কোন দিকে? আমরা সেখানেও যাব—
নিধুর বাবা রামতারণ বিনয়ে ভাঙিয়া পড়িয়া বলিলেন—যাবেন বই কি? গরীবের কুঁড়েতে আপনাদের মতো মহৎ লোকের পায়ের ধুলো পড়বে এ আমরা আশা করতে পারিনে—লালবিহারী ভায়া আমাদের গ্রামের চুড়ো—উনি আজ এসেচেন বলেই আপনাদের মতো লোকের—
সকলে মিলিয়া গ্রাম দেখিতে বাহির হইলেন৷ গ্রামে দ্রষ্টব্য স্থানের মধ্যে একটা ভাঙা শিবমন্দির ছাড়া অন্য কিছুই নাই৷ উমাপদ পণ্ডিত সেটির মধ্যে নিজে ঢুকিয়া সকলকে ভিতরে আসিতে বলিলেন৷ সাপের ভয়ে কেহই ভিতরে গেলেন না—কবাটহীন দরজার কাছে দাঁড়াইয়া উঁকি মারিয়া দেখিলেন৷
নিধুর বাড়ীর বাহিরের ঘরেও সকলে একবার আসিয়া বসিলেন৷ নিধু চা ও খাবারের ব্যবস্থা পূর্ব হইতেই করিয়া রাখিয়াছিল—সকলকে রেকাবি করিয়া খাবার দেওয়া হইল—সুনীলবাবু ও মুন্সেফবাবু ছাড়া আর কেহ খাইতে চাহিলেন না৷ কারণ বাকি সকলে বৃদ্ধ—উঁহারা সন্ধ্যাহ্নিক না করিয়া খাইবেন না৷ সকলে মিলিয়া আবার মঞ্জুদের বাড়ী ফিরিলেন৷ সুনীলবাবুকে মঞ্জুর মা বাড়ীর ভিতরে ডাকিয়া পাঠাইলেন৷ বীরেন তাঁহাকে লইয়া গেল৷ নিধু সঙ্গেই দাঁড়াইয়া ছিল—কিন্তু তাহাকে বীরেন যেন দেখিতেই পাইল না আজ৷
নিধু বাড়ী ফিরিয়া আসিতেই তাহার মা বলিলেন—হ্যাঁরে, মোহনভোগ খারাপ হয় নি তো?
—কেন খারাপ হবে! বেশ হয়েছিল—
—ওঁরা খেয়েছিলেন তো? হাকিমবাবুরা?
—সবটা খেয়েছিল৷ ভালো হলে খাবে না কেন?
—হ্যাঁ রে তুই এখানে খাবি, না জজবাবুদের বাড়ী খেতে বলেচে?
এ ধরনের সোজা প্রশ্নের উত্তরে নিধু প্রথমটা কি বলিবে ঠিক করিতে পারিল না৷ পরে বলিল—না—বাড়ীতেই খাব৷ ওরা খেতে বলেছিল, কিন্তু আমার লজ্জা করে মা রোজ-রোজ ওদের বাড়ী—
নিধুর মা ক্ষুণ্ণস্বরে বলিলেন—তা আজকের দিনটা কেন খেলি নে—ভালোটা-মন্দটা হত—বড় বড় বাবুরা এসেছে বাড়ীতে—
—তা হোক মা—ফি রবিবারেই তো ওখানে খাচ্চি৷ তোমার হাতের রান্না খাওয়া বরং হয়েই ওঠে না আজকাল৷
নিধুর মা মনে মনে খুশি হইলেন৷ ছেলের মতো ছেলে নিধু৷ এখন বাঁচিয়া থাকিলে হয়৷ আজ তাহার দৌলতেই তো তাঁহাদের খড়ের ঘরে হাকিম-হুকুমের পায়ের ধূলা পড়িল! বংশের মুখ উজ্জ্বল করা ছেলে বটে৷
দুপুরের পরেই তিনি পুকুরের ঘাটে বাসন মাজিতে গিয়া বুঝিলেন কথাটা সারা গ্রামে রাষ্ট্র হইয়াছে৷
তিনুর মা বুড়ো রায়গিন্নি বলিলেন—হ্যাঁরে ও নতুন বৌ, তোদের বাড়ী নাকি রামনগর থেকে ডিপটিবাবু আর মনসববাবু এসেছিল?
—হ্যাঁ দিদি—কার মুখে শুনলে?
—ওমা এই দক্ষ পিসি বললে—জগোঠাকরুণ তাকে বলেছে৷ সকলেই তো বলচে৷ তা বেশ, ভালো ভালো৷
—জজবাবুদের বাড়ী এসেছিলেন৷ তা নিধুকে খুব ভালোবাসেন কিনা, তাই এখানেও এলেন৷ বড় ভালো লোক—
ইতিমধ্যে আরও দু-তিনটি পাড়ার ঝি-বৌ পুকুরের ঘাটে বাসন হাতে আসিলেন৷ সকলের মুখেই ওই এক প্রশ্ন৷ হাকিমদের বয়স কত? নিধুর মা কি খাইতে দিল তাহাদের?
বুড়ো রায়গিন্নি বলিলেন—তা বেঁচে থাক নিধু৷ ওকে সবাই ভালোবাসে—অমন ছেলে গাঁয়ে নেই—
—তাই এখন বল দিদি—তোমাদের আশীর্বাদে, তোমাদের মা-বাপের আশীর্বাদে নিধু এখন—
নিধুকে কিন্তু সারাদিনের মধ্যে ও-বাড়ী হইতে কেহই ডাকিতে আসিল না৷ বৈকালের দিকে সে নিজেই একবার মঞ্জুদের বৈঠকখানায় গিয়া খোঁজ লইয়া জানিল সুনীলবাবু ও মুন্সেফবাবু বাড়ীর মধ্যে জলযোগ করিতেছেন—এখনি রামনগরে ফিরিবেন৷ লালবিহারীবাবুকে বাহিরে দেখা গেল না—সম্ভবত অন্তঃপুরে অতিথিদের আদর-আপ্যায়নে নিযুক্ত আছেন৷
কিছু ভালো লাগিল না৷ পৃথিবীটা হঠাৎ যেন ফাঁকা হইয়া গিয়াছে৷
রামনগরের পাকা রাস্তার উপরে খানিকটা উদভ্রান্ত ভাবে পায়চারি করিতে করিতে সে একটা সাঁকোর উপরে আসিয়া বসিল৷ হঠাৎ সে দেখিল, দূরে দুখানা সাইকেলে সুনীলবাবু ও মুন্সেফবাবু আসিতেছেন৷
তাঁহারাও তাহাকে দেখিয়াছেন মনে করিয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইল—নতুবা হয়তো গাছের আড়ালে লুকাইয়া পড়িত৷
সুনীলবাবু কাছে আসিয়া বলিলেন—নিধিরামবাবু বেড়াতে বেরিয়েছেন বুঝি? খুঁজলাম আপনাকে আসবার সময়, পেলাম না৷ আপনি কাল সকালে যাবেন?
দুজনেই সাইকেল হইতে নামিয়াছিলেন৷ নিধু কিছুদূর পর্যন্ত তাঁহাদের সঙ্গে হাঁটিয়া আগাইয়া দিয়া আসিল৷
সন্ধ্যার পরে সে বাড়ী ফিরিল৷ নিধুর মা বলিলেন—বিকেলবেলা কিছু খেলিনে—জজবাবুর বাড়ী খাবার খেয়েছিস বুঝি?
—হ্যাঁ৷
—সে আমি তখনই বুঝেচি—তোকে না খাইয়ে কি ওরা ছাড়ে কখনো? হাকিমবাবুরা চলে গেল বুঝি?
—গেল৷
এমন সময় একটা লণ্ঠনের আলো তাহাদের উঠানে পড়িল—এবং আলোর পিছনে লণ্ঠন ধরিয়া যে দুজন মেটে পাঁচিলের ছোট্ট দরজা দিয়া বাড়ীর ভিতরে ঢুকিল—তাহাদের দেখিয়া নিধু বিস্ময়ে আড়ষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল৷ মঞ্জু আগাইয়া আসিয়া বলিল—ও জ্যাঠাইমা, কি করচেন? নিধুদা কোথায়? ওমা এই যে নিধুদা!
হতভম্ব নিধু কিছু জবাব দিবার পূর্বেই মঞ্জু বলিল—বড়দা এসেছেন, আপনাকে খুঁজচেন কখন থেকে৷ জ্যাঠাইমা, নিধুদা আজ রাত্রে ওখানে খাবে কিন্তু—চলুন নিধুদা—আসুন—বলিয়া নিধুকে বিশেষ কিছু বলিবার সুযোগ না দিয়াই মঞ্জু ও নৃপেন তাহাকে লইয়া বাড়ীর বাহির হইয়া গেল৷ নৃপেন আগে, মঞ্জু ও নিধু পিছনে৷ পথে মঞ্জু বলিল—কি হয়েচে আপনার? সারাদিন দেখি নি কেন? ছিলেন কোথায়?
—বাড়ীতেই ছিলাম—যাব আবার কোথায়!
—আমাদের ওখানে যাননি যে বড়?
—সব সময়ই যে যেতে হবে তার মানে কি?
মঞ্জু নিধুর উত্তর শুনিয়া অবাক হইয়া তাহার দিকে অল্পক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া বলিল—কি হয়েচে আপনার?
—কিছুই না৷ আমরা গরীব মানুষ, আমাদের আবার হবে কি?
—কেন, রাগ হল কেন হঠাৎ শুনি? কি হয়েচে?
—কিছুই না, কি আবার হবে?
—রাগ হয়েচে তা বুঝতে আমার বাকি নেই৷ কিন্তু আমি কি করব নিধুদা, বাড়ীতে আজ সবাই ওদের নিয়ে ব্যস্ত৷ আমি ওদের সামনে কবার বেরিয়েচি? ডাকবার সুবিধে থাকলে ডাকতাম৷
নিধুর রাগ নিবিয়া জল হইয়া গেল৷ বেচারী মঞ্জু! সে কি করিবে?
বাড়ী ঢুকিয়া মঞ্জু মাকে ডাকিয়া বলিল—নিধুদা রাত্রে আমাদের এখানে খাবে বলে এনেছি মা—আজ সারাদিন আমাদের বাড়ীতে আসে নি মা—এখন গিয়ে ধরে আনলাম—আসুন বড়দার সঙ্গে দেখা করিয়ে দিই—
পাশের ঘরে মঞ্জুর বড়দা অরুণের সঙ্গে আলাপ হইল৷ অরুণকে নিধুর তেমন ভালো লাগিল না৷ কথার মধ্যে বেশির ভাগ বাঁকা সুরে ইংরাজি বলে, ঘন ঘন সিগারেট খায়—একটু নাক-সিঁটকানো গর্বের ভাব কথাবার্তার মধ্যে৷ অরুণের প্রতি কথায় পাড়াগাঁয়ের সব কিছুর উপর একটা ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের ভাব বেশ সুস্পষ্ট৷
—উঃ, কাল কি সোজা কষ্ট গিয়েচে এখানে পৌঁছুতে! বাবারও যেমন কাণ্ড৷ বলেছিলুম দেশে পূজো করে কি হবে! ছুটি নিয়ে এই অজ পাড়াগাঁয়ে বসে আছেন—তারপর যখন ম্যালেরিয়াতে ধরবে তখন বুঝবেন৷ বাববাঃ—এই জঙ্গলে মানুষ থাকে?
—তা বটে৷ আমরা উপায় নেই বলে পড়ে আছি—
—আপনি বুঝি রামনগরে প্র্যাকটিস করেন? ফিল্ড কি রকম?
—আগে ভালোই ছিল৷ এখন দেশে নেই পয়সা—আপনিও তো ল’ পড়চেন শুনলাম—
—আমি যদি বসি, আলিপুরে বেরুব৷ এসব জায়গায় লাইফটা নষ্ট করে কোনো লাভ নেই৷ পয়সা পেলেও না—
—না, আপনাদের মতো লোক কেন এখানে থাকতে যাবেন?
আর আধঘণ্টা পরে মঞ্জুকে সে কিছুক্ষণের জন্য একা পাইল৷
মঞ্জু বলিল—বড়দার সঙ্গে আলাপ হল? বেশ লোক বড়দা৷ কাল সকালে যাবেন নাকি আপনি?
—যাব না তো কি! এখানে থাকলে তো চলবে না—
—এখনো আপনার রাগ যায় নি নিধুদা—
—আমরা গরীব মানুষ, আমাদের আবার রাগ—
—ও রকম বলবেন না নিধুদা—আমার মনে কষ্ট হয় না ওতে?
—হলে কি সারাদিন না ডেকে থাকতে পারতে?
—কিছু লাভ ছিল না ডেকে৷ সামনে বেরুতে পারতাম না তো!
—কেন?
—ওঁরা সব সময় ঘরের মধ্যে৷ অমরবাবুর সামনে আমি বেরুই নি—ওঁর সঙ্গে আলাপ নেই আমার৷
—আমি ভাবলুম আমাকে ওদের সামনে কি করে বার করবে ভেবে আর ডাকলে না—
—দুষ্টুবুদ্ধি আপনার হাড়ে-হাড়ে৷ কুটিল মন কিনা৷
—সে তো জানোই—পাড়াগাঁয়ের মানুষের মন কখনো সরল হয়?
—হয়ই না তো৷ সেটা মিথ্যে কথা নাকি!
—তার প্রমাণ পেয়েই গেলে৷ হাতে-হাতেই পেলে—
—এমন আড়ি দেব আপনার সঙ্গে যে আর কখনো কথা বলব না—
—না তা করো না লক্ষ্মীটি—তাহলে থাকতে পারব না—
—তবে! তবে ওরকম করেন কেন? এখন বলুন, আর ওসব কথা বলবেন না?
—কক্ষনো না৷
—পুজোর সময় প্লে করার কি হবে?
—ঠিক করে ফেল—অরুণবাবু তো আছেন—
—বড়দা বলছিলেন রবি ঠাকুরের ‘ফাল্গুনী’ প্লে করতে—কলকাতায় সম্প্রতি হয়েছে—উনি দেখে এসেচেন—
—উনি যা বলেন৷ বইখানা আনতে বোলো—
—আপনি কি বলেন?
—আমি ওসবের কি জানি? আমরা জানি যাত্রার প্লে—রামনগরের উকীল-মোক্তারদের একটা থিয়েটার আছে—তারা পুজোর সময় গিরিশ ঘোষের ‘জনা’ করবে৷ আমাকে পার্ট নিতে বলেচে—
—কি পাট নেবেন?
—তা এখনো ঠিক হয়নি—
—ভালো পার্ট করতে পারেন?
—কখনো করি নি, কি করে বলি? তবে চেষ্টা করলে মন্দ হবে না—
—আমার মনে হয় খুব ভালোই হবে৷
—তুমি পার্ট করবে তো?
—আমি তো স্কুলে পার্ট করে এসেছি ফি বছর৷ আমার অভ্যেস আছে৷ গান যাতে আছে এমন পার্ট আমায় দিত৷
—এখানেও তাই নিতে হবে তোমায়, গান তুমি ছাড়া কে গাইবে?
—আচ্ছা একটা কথা, পাড়াগাঁয়ে কেউ কিছু বলবে না তো?
—তোমরা করলে কেউ বলবে না৷ কাকাবাবুর নামে সবাই তটস্থ, অন্য কেউ হলে রক্ষে রাখত না—
—সে আমি জানি৷ আচ্ছা, গাঁয়ের আর কোনো মেয়ে পার্ট নিতে পারে?
—আমার তো মনে হয় না—তবে ভুবন গাঙ্গুলির এক মেয়ে এসেচে বাপের বাড়ী৷ বিয়ে হয়েচে, জামাই রেলের অফিসে ভালো চাকরি করে—তুমি ডাকিয়ে জিগগেস কোরো—ও বিয়ের আগে গোয়াড়ী গার্লস স্কুলে পড়ত মামার বাড়ী থেকে—সেখানে পার্ট করত—
—কি নাম? আমি তো জানিনে—কালই আলাপ করব—
—নাম হৈমবতী৷ এখন শুনচি নাম হয়েচে হেমপ্রভা—ও চিরকাল মামার বাড়ীতে মানুষ, এখানে বড় একটা আসত না৷ তা ছাড়া ওর বাবাও নাকি এখানে থাকত না৷ যাক—সে কথা বাদ দাও মঞ্জু৷ ডেকে নিয়ে আসতে পার তো এস—
—তারপর সেই কাগজ বার করার কথা মনে আছে তো?
—সে তো পুজোর পর!
—না, পুজোর সময় প্রথম সংখ্যা বার করব৷
—যা তোমার ইচ্ছে৷ তুমি যা বলবে আমি তাই করব৷
—মনের কথা বলচেন নিধুদা?
—মনের কথা নিশ্চয়ই৷ বিশ্বাস কর মঞ্জু৷
রাত্রে আহারাদির পরে নিধু চলিয়া আসিল৷
আসিবার সময় মঞ্জু দরজায় দাঁড়াইয়া বলিল—সামনের শনিবারে আসবেন তো?
—কেন আসব না?
—না এলে আপনার সঙ্গে আড়ি দেব—
—দেখ আসি কিনা৷