০১. দিনের কবিতা
প্রথম ভাগ : দিনের কবিতা
প্রাতে বন্ধু এসেছে পথিক,
পিঙ্গল সাহারা হতে করিয়া চয়ন
শুষ্ক জীর্ণ তৃণ একগাছি।
ক্ষতবুক তৃষার প্রতীক
রাতের কাজল—লোভী কাতর নয়ন,
ওষ্ঠপুটে মৃত মৌমাছি।
স্নিগ্ধ ছায়া ফেলে সে দাঁড়ায়
আমারে পোড়ায় তবু উত্তপ্ত নিশ্বাস
গৃহাঙ্গনে মরীচিকা আনে।
বক্ষ রিক্ত তার মমতায়
এ জীবনে জীবনের এল না আভাস
বিবর্ণ বিশীর্ণ মরুতৃণে।
সকাল সাতটার সময় রূপাইকুড়ার থানার সামনে হেরম্বের গাড়ি দাঁড়াল।
বিস্না পর্যন্ত মোটরে আসতে তার বিশেষ কষ্ট হয় নি। কিন্তু রাত বারটা থেকে এখন পর্যন্ত গরুর গাড়ির ঝাঁকানিতে সর্বাঙ্গ ব্যথা ধরে গেছে। গাড়ি থেকে নেমে শরীরটাকে টান করে দাঁড়িয়ে হেরম্ব আরাম বোধ করল। এক টিপ নস্য নিয়ে সে চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল।
পুব আর পশ্চিমে কেবল প্রান্তর আর দিগন্ত। মাঝে মাঝে দু-একটি গ্রামের সবুজ চাপড়া বসানো আছে, বৈচিত্ৰ্য শুধু এই! উত্তরে কেবল পাহাড়। একটি-দুটি নয়, ধোয়ার নৈবেদ্যের মতো অজস্র পাহাড় গায়ে গায়ে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে–অতিক্রম করে যাওয়ার সাধ্য চোখের নেই, আকাশের সঙ্গে এমনি নিবিড় মিতালি। দক্ষিণে প্রায় আধমাইল তফাতে একটি গ্রামের ঘনসন্নিবিষ্ট গাছপালা ও কতকগুলি মাটির ঘর চোখে পড়ে। অনুমান হয় যে, ওটিই রূপাইকুড়া গ্রাম। গ্রামটির ঠিক উপরে আকাশে এখন রূপার ছড়াছড়ি। তবে সেগুলি আসল রূপা নয়, মেঘ।
গাড়ি দাঁড়াতে দেখে থানার জমাদার মতিলাল বেরিয়ে এসেছিল। হেরম্বকে সে-ই সসম্মানে অভ্যর্থনা করল।
একটু অর্থহীন নিরীহ হাসি হেসে বলল, ‘আজ্ঞে না, বাবু নেই। বরকাঁপাশীতে কাল একটা খুন হয়েছে, ভোর ভোর ঘোড়ায় চেপে বাবু তার তদারকে গেছেন। ওবেলা ফিরবেন—ঘরে গিয়ে আপনি বসুন, আমি জিনিসপত্র নামিয়ে নিচ্ছি। এ কিষণ! কিষণ! ইধর আও তো।
আপিস ও সিপাহীদের ছোট ব্যারাকটির মধ্যে গভীর লালিত্যহীন থানার বাগান। বাগানের শেষপ্রান্তে দারগাবাবুর কোয়ার্টার। চুনকাম-করা কাঁচা ইটের দেয়াল, তলার দিকটা মেঝে থেকে তিন হাত উঁচু পর্যন্ত আলকাতরা মাখানো। চাল শণের। এ বছর বর্ষা নামার আগেই চালের শণ সমস্ত বদলে ফেলায় সকালবেলার আলোতে বাড়িটিকে ঝকঝকে দেখাচ্ছে! বাড়ির সামনে চওড়া বারান্দা।
ভিতরে যাবার দরজার পর্দা ফাঁক করে একটি সুন্দর মুখ উঁকি দিচ্ছিল। হেরম্ব বারান্দার সামনে এগিয়ে আসতে খসে-পড়া ঘোমটাটি মাথায় তুলে দেবার প্রয়োজনে মুখখানা এক মুহূর্তের জন্য আড়ালে চলে গেল।
তারপর পর্দা সরিয়ে আস্ত মানুষটাই বেরিয়ে এল বারান্দায়।
আগ্রহ ও উত্তেজনা সংযত রেখে সহজভাবেই বলল, ‘আসুন। রাস্তায় কষ্ট হয় নি?’
‘হয়েছিল। এই মুহূর্তে সব ভুলে গেলাম সুপ্রিয়া।’
‘আমায় দেখেই?’ কোমল হাসিতে সুপ্রিয়ার মুখ ভরে গেল, ‘বিশ্বাস করা একটু শক্ত ঠেকছে। যে রাস্তা আর যে গাড়ি, আসবার সময় আমি শুধু কাঁদতে বাকি রেখেছিলাম। পাঁচ বছর যার খোঁজখবর নেওয়াও দরকার মনে করেন নি, তাকে দেখে অত কষ্ট কেউ ভুলতে পারে?’
‘আমি পারি। কষ্ট হলে যদি সহজে অবহেলাই করতে না পারব, পাঁচ বছর তবে তার খোঁজখবর নিলাম না কেন?’
‘কত সংক্ষেপে কত বড় কৈফিয়ত! মেনে নিলাম ভাববেন না। কিন্তু! আপনার সঙ্গে আমার ঢের ঝগড়া আছে। বাইরে দাঁড়িয়ে আর কথা নয়। ভেতরে চলুন। জামা খুলে গা উদলা করে দিন, পাখা নেড়ে আমি একটু হাত ব্যথা করি। স্নান করবেন তো? আপনার জন্যে এক টবী জল তুলে রেখেছি। ইদারা থেকে তোলা কিনা, বেশ ঠাণ্ডা জল। স্নান করে আরাম পাবেন!’
সুপ্রিয়ার কথা বলার ভঙ্গিটি মনোরম। সকালবেলাই এখন এক শ চার ডিগ্রি গরমে মানুষ সন্তপ্ত হয়ে আছে। কিন্তু সুপ্রিয়ার যেন একটি দাৰ্জিলিঙের আবহাওয়ার আবেষ্টনী আছে। এত গরমেও তার কথার মাধুর্যের এককণা বাষ্প হয়ে উড়ে যায় নি, তার কণ্ঠে শ্ৰান্তির আভাস দেখা দেয় নি। তার ইদারার জলের মতোই সেও যেন জুড়িয়ে আছে।
বাইরের ঘরের ভিতর দিয়ে অন্দরের বারান্দা হয়ে হেরম্বকে সে একেবারে তার শোবার ঘরে নিয়ে গেল। যেতে যেতে হেরম্ব লক্ষ করে দেখল, চারিদিকে একটা অতিরিক্ত ঘষামাজ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ভাব। ঘর ও রোয়াকে ধোয়া মেঝে সবে শুকিয়ে উঠেছে, সাদাকালো দেয়ালে কোথাও একটু দাগ পর্যন্ত নেই। জলের বালতি, ঘটি-বাটি, বসবার আসন প্রভৃতি টুকিটাকি জিনিসগুলি পর্যন্ত কঠোর নিষ্ঠার সঙ্গে স্বস্থানে অবস্থান করছে। স্থানভ্রষ্ট একটি চামচও বোধহয় এ বাড়ির কোথাও আবিষ্কার করা যাবে না।
ঘরে ঢুকে সুপ্রিয়া বলল, ‘ওই ইজিচেয়ারটাতে বসে সবচেয়ে আরাম হয়। জামা খুলে কাত হয়ে এলিয়ে পড়ুন। ছারপোকা নেই, কামড়াবে না।’
হেরম্ব জামা খুলে ইজিচেয়ারটাতে বসল। এলিয়ে পড়ার দরকার বোধ করল না।
‘আমার আরামের আর কি ব্যবস্থা রেখেছিস বল তো?’
সুপ্রিয়া সত্য সত্যই পাখা নিয়ে তাকে বাতাস করা শুরু করে বলল, ‘আরামের ব্যবস্থার কথা। আর বলবেন না, হেরম্ববাবু। বিশ মাইলের মধ্যে চ’টি পর্যন্ত কিনতে পাওয়া যায় না, এমন বুনো দেশ। যে ক’দিন থাকবেন আপনাকে কষ্ট করেই থাকতে হবে।‘–সে একটু হাসল—’তবে কষ্ট আপনি সহজেই অবহেলা করতে পারেন, এই যা ভরসার কথা। নইলে মুশকিলে পড়তাম।’
সুপ্রিয়ার এ ঘর সাজানো, ছবির মতো সাজানো। বিছানার ধবধবে চাদরে কোথাও একটি কুঞ্চন নেই, বালিশগুলি নিটোল। দেয়ালের গায়ে পেরেকের শেষ গর্তটি চুনের তলে অদৃশ্য হয়েছে। এদিকে টেবিলে সুপ্রিয়া ও তার স্বামীর প্রসাধন সামগ্ৰীগুলির একটি কোনোদিনই হয়তো আর একটির গায়ে ঠেকে যাবে না, সেলাইয়ের কলের ঢাকনিটি চিরদিন এমনি ধূলিহীন হয়েই থাকবে। প্রতিদিন সুপ্রিয়া কতক্ষণ ঘর সাফ করে আর গোছায় হেরম্ব কল্পনা করে উঠতে পারছিল না।
সুপ্রিয়ার পাখার বাতাসে স্নিগ্ধ হতে হতেও সে একটু অস্বস্তি বোধ করছিল।
এক সময় একটু আচমকাই সে জিজ্ঞাসা করে বসল, ‘দোকানের মতো ঘর সাজিয়েছিস কেন?’
‘দোকানের মতো!’
‘দোকানের মতো না হোক, বাড়াবাড়ি আছে একটু। তোর ভালো লাগে?’
‘কি জানি! ভালো লাগে। কিনা জানিস নে কি রকম?’
‘অত বুঝি নে। মুদ্রাদোষের মতো হয়ে গেছে। না করেই-বা কি করি বলুন। সারাদিন একটা কিছু নিয়ে থাকতে হবে তো মানুষের? একটা ছেলে দিয়ে ভগবান আবার কেড়ে নিলেন। বই-টই পড়তে আমার ভালো লাগে না। এই সবই করি। কিন্তু–সুপ্রিয়ার কথা বলার মধুর ভঙ্গি ফিরে এল, ‘আমার কথা কেন? আগে বলুন আপনার মা কেমন আছেন?’
‘মা আশ্বিন মাসে স্বর্গে গেছেন।’
সুপ্রিয়া চমকে বলল, ‘কি সর্বনাশ!’ তার দুচোখ সজল হয়ে উঠল।
হেরম্ব বলল, ‘মরবার আগে মা তোর কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন।’
সুপ্রিয়ার পাখা থেমে গিয়েছিল। আবার সেটা নাড়তে আরম্ভ করে বলল, ‘আমাকে বড়। ভালবাসতেন। আপনাকে হেরম্ববাবু বলার জন্য সকলের কাছে গাল খেয়েছি, তিনিই শুধু হেসে বলতেন, পাগলী মেয়ে।’
হেরম্ব বলল, ‘তখন তুই পাগলীই ছিল সুপ্রিয়া।’
সুপ্রিয়া চিন্তামগ্ন হয়ে পড়েছিল, জবাব দিল না।
সুপ্রিয়া ভারি গৃহস্থ মেয়ে।
গোয়ালা আজ কি কারণে এত বেলাতেও আসে নি। সুপ্রিয়া নিজেই দুরন্ত গরুর বাঁট টেনে হেরম্ব্বের চায়ের দুধ বার করল। উঠানের একপাশে দরমার বেড়ায় ঘেরা স্নানের জায়গা। হেরম্ব সেখানে স্নান করছিল। এই সময় বাইরে এসে তার দুধ দোয়া দেখে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
সুপ্রিয় বলল, ‘বলক তোলা টাটকা দুধ খাবেন একটু? ভারি উপকারী। উনি রোজ খান। দুইব বেশি করে?’
হেরম্ব বলল, ‘বালক তোলা দুধ শিশুতে খায়। অশোক বাড়ি ফিরলে তাকে খাওয়াস। এ কাজটা শিখলি কবে?’
‘এ আবার শিখতে হয় নাএমবি
‘হয়। কারণ, শিখি নি বলে আমি পারব নাম।’
সুপ্রিয়া হেসে বলল, ‘পারবেন। দুধ দেবার জন্যে ভোর থেকে গরু আমার হামলাচ্ছে, বাটে হাত দিলে দুধ ঝরবে। তবে আপনাকে কাছেই ঘেঁষতে দেবে কিনা সন্দেহ–গুঁতোবে হয়তো।’
‘কাছে গেলে তো! চাউনি দেখে ভালো বোধ হচ্ছে না।’
‘বড় দুরন্ত। দুবেলা দড়ি ছিঁড়বে, ধরতে গেলে শিং নেড়ে তেড়ে আসবে। কত মোটা শেকল দিয়ে বাঁধতে হয়েছে দেখছেন না? আমি খেতে দিই বলে আমায় কিছু বলে না।’
সুপ্রিয়া সস্নেহে তার গরুর গলা চুলকে দিল। বলল, ‘ঘরেই আয়না চিরুনি আছে।’
গরুর সামনে কয়েক আঁটি খড় ফেলে দিয়ে সে রান্নাঘরে গেল। কাল রাত্রে ছানা কেটেছিল, তাই দিয়ে তৈরি করুল সন্দেশ, সন্দেশ ভালো হল না বলে তার যে কি দুঃখ।
হেরম্বকে খেতে দিয়ে বলল, ‘আপনি খাবেন কিনা, তাই আজ শক্রিতা করেছে।’
হেরম্ব সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘আহা হোক না, খাব বৈ তো নয়।’
‘খাবার জন্যই তো খাবার, কিন্তু তাই বলে যা তা দেওয়া যায়? মিহি না হলে সে আবার সন্দেশা! কাল রাত্রে, পড়লাম ফিট হয়ে, নইলে রাত্রেই করে রাখতাম। সারা রাত ফেলে রেখে সে ছানায় কি সন্দেশ হয়?’
হেরম্ব খাওয়া বন্ধ করে বলল, ‘তোর না ফিট সেরে গিয়েছিল?’
‘গিয়ে তো ছিল, এ বছর আবার হচ্ছে। কাল নিয়ে দুবার হল। রান্নাঘরে ছানা ডলছি, হঠা মাথার মধ্যে এমনি ঝিমঝিম করে উঠল! তার পর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান হতে দেখি পাড়ে আর দাই গায়ে বালতি বালতি জল ঢালছে, রান্নাঘর ভেসে একেবারে পুকুর!’
‘চা আনি।’ হেরম্বকে কথা বলার অবকাশ না দিয়ে সুপ্রিয়া রান্নাঘরে চলে গেল।
চা এনে সে অন্য কথা পাড়ল।
‘রাঁচিতে ক’দিন ছিলেন?’
‘চারদিন।’
‘এখানে কতদিন থাকবেন?’
‘একদিন।‘
সুপ্রিয়া ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘রক্ষে পেলেম। গেলেই বাঁচি।’
চায়ে চুমুক দিয়ে বাঁ হাতের তালুতে চিবুক ঘষে হেরম্ব বলল, ‘আমাকে তুই কদিন রাখতে চাস?’
‘দিন? বছর বলুন!’
এ কথা হেসে উড়িয়ে দেবার উপায় নেই। সুপ্রিয়া আকস্মিকতা পছন্দ করে না। ওর হিসাবে দিন নেই, মাস নেই, বছর দিয়ে ও জীবনকে ভাগ করেছে। ওর প্রকৃতির কল্পনাতীত সহিষ্ণুতা হেরম্বের অজানা নয়।
তবু তাকে বলতে হল, ‘বছর নয়, মাস নয়, সপ্তাহও নয়। একদিন। শুধু আজ।’
সুপ্রিয়া কথাটা বিশ্বাস করতে পারল না।
‘ওবেলাই চলে যাবেন?’
‘না, কাল সকালে।’
অনেকক্ষণ নীরব থেকে সুপ্রিয়া বলল, ‘একদিন থাকবার জন্য এমন করে আপনার আসার দরকার কি ছিল? পাঁচ বছর খোঁজ নেন নি, আরো পাঁচ বছর নয় না নিতেন।‘
চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে কাপড়ে মুখ মুছে হেরম্ব বলল, ‘তাতে লাভ কি হত রে?’
সুপ্রিয়া পলকহীন চোখে চেয়ে থেকে বলল, ‘আপনি বাড়িতে এলে বাইরের ঘরে বসিয়ে এক কাপ চা আর একটু সুজি পাঠিয়ে দিতাম। মনে মনে বলতাম, আপদ বিদেয় হলেই বাঁচি।’
হেরম্ব একটু হেসে বলল, ‘আচ্ছা, এবার দশ বছর পরে আসব। মনে তোর ক্ষোভ রাখব না, সুপ্রিয়া।’
সুপ্রিয়া আস্তে আস্তে বলল, ‘আপনি তা পারেন। ছেলেমানুষ পেয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে আমায় যখন বিয়ে দিয়েছিলেন, তখনি জেনেছিলাম। আপনার অসাধ্য কর্ম নেই।’
হেরম্ব প্রতিবাদ করে বলল, ‘আমি তোর বিয়ে দিই নি সুপ্রিয়া, তোর বাবা দিয়েছিলেন। হ্যাঁ রে, বিয়ের সময় তোকে একটা উপহারও বোধহয় আমি দিইনি দিয়েছিলাম?’
সুপ্রিয়া শেষ কথাটা কানে তুলল না। বলল, ‘বাবা বিয়ে দিয়েছিলেন বৈকি। আমাকে ভজিয়ে ভজিয়ে রাজি করিয়েছিল কে? কার মুখের বড় বড় ভবিষ্যদ্বাণী শুনে আমি ভেসে গিয়েছিলাম। কি সব প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড কথা! কত কথার মানে বুঝি নি। তবু শুনে গা শিউরে উঠেছিল! আচ্ছা, সে সব কথা অভিধানে আছে?’
জবাব দিতে হেরম্বকে একটু ভাবতে হল। সুপ্রিয়ার ঝগড়া করার ইচ্ছা নেই এটা সে টের পেয়েছিল। কিন্তু তার অনেক, দিনের জমানো নালিশ, কলহ না করলেও নালিশগুলি ও জানিয়ে রাখবে। না জানিয়ে ওর উপায় নেই। মনের নেপথ্যে এত অভিযোগ পুষে রাখলে মানসিক সুস্থতা কারো বজায় থাকে না। এখনকার মতো কথাগুলি স্থগিত রাখলেও সুপ্রিয়ার চলবে না। সে কাল চলে যাবে, দু-চার বছরের মধ্যে তার সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনায় সুপ্রিয়া বিশ্বাস করে না। যা বলার আছে এখুনি সব বলে দিয়ে বাকি দিনটুকু নিশ্চিন্ত মনে অতিথির পরিচর্যা করবার সুযোগটাও সে বুঝি সৃষ্টি করে নিতে চায়। তার সংক্ষিপ্ত উপস্থিতির সময়টুকুর মধ্যে অন্যমনস্ক হয়ে পড়বার কারণটা সে গোড়াতেই বিনষ্ট করে দিতে চায়।
চোখের জলের মধ্যে সুপ্রিয়ার বক্তব্য শেষ হবে কিনা ভেবে হেরম্ব মনে মনে একটু ভীত হয়ে পড়েছিল।
‘তোর ভালোর জন্য যতটুকু বলার দরকার তার বেশি আমি কিছুই বলি নি, সুপ্রিয়া।’
‘না বললে আমার মন্দ কি হত? স্কুলে পড়ছিলাম, লেখাপড়া শিখে চাকরি করে স্বাধীনভাবে জীবন কাটোতাম। আপনি আমাকে তা করতে দেন নি কেন?’
হেরম্ব মাথা নেড়ে বলল, ‘তোর সহ্য হত না, সুপ্রিয়া।’
সুপ্রিয়া তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন হত না? পাঁচ বছর এই বুনো দেশে পড়ে থাকা সহ্য হচ্ছে, পেট ভরাবার জন্য পরের দাসীবৃত্তি করছি, গরু-বাছুরের সেবা করে আর ঘর গুছিয়ে জীবন কাটাচ্ছি। —ঝিমিয়ে পড়েছি। একেবারে। নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালে আমার সহ্য হত না কেন?’
হেরম্ব বলল, ‘দাসীবৃত্তি করছিস নাকি?’
সুপ্রিয়া তার সহিষ্ণুতা অক্ষুন্ন রেখে বলল, ‘ধরতে গেলে, কথাটা তাই দাঁড়ায় বৈকি!’
হেরম্ব আবার মাথা নেড়ে বলল, ‘না, তা দাঁড়ায় না। দাঁড়ালেও পৃথিবীসুদ্ধ সব মেয়ে হাসিমুখে যে কাজ করছে, তার বিরুদ্ধে তোর নালিশ সাজে না। চাকরি করে স্বাধীনভাবে জীবন কাটানো তুই হয়তো খুব মজার ব্যাপার মনে করিস। আসলে কিন্তু তা নয়। আর্থিক পরাধীনতা স্বীকার করবার সাহস যে মেয়ের নেই তাকে কেউ ভালবাসে না। তাছাড়া-’ এইখানে ইজিচেয়ারের দুইদিকের পাটাতনে কনুইয়ের ভর রেখে হেরম্ব সামনের দিকে একটু ঝুঁকে পড়ল, ‘তাছাড়া, স্বাধীনতা তোর সইত না। কতকগুলি বিশ্ৰী কেলেঙ্কারি করে জীবনটা তুই মাটি করে ফেলতিস।‘
সুপ্রিয়া সংক্ষেপে শুধু বলল, ‘ইস্!’
‘ইস্ নয়। ওই তোর প্রকৃতি। পনের বছর বয়সেই তুই একটু পেকে গিয়েছিলি, সুপ্রিয়া। বাইশ-তেইশ বছর বয়সে মেয়েরা সারা জীবনের একনিষ্ঠতা অর্জন করে, তোর মধ্যে সেটা পনের বছর বয়সে এসেছিল। তখনই তোর জীবনের দুটো পথ তুই একেবারে স্থির করে ফেলেছিলি! তার একটা হল লেখাপড়া শিখে স্বাধীন হয়ে থাকা, আর একটা–হেরম্বকে একটু থামতে হল, ‘—অন্যটা এক অসম্ভব কল্পনা।’
সুপ্রিয়া আবার পলকহীন চোখে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করল, ‘অসম্ভব কেন?’
হেরম্ব চেয়ারে কত হয়ে এলিয়ে পড়ল।
‘যা তুই, রান্নাঘর থেকে একবার ঘুরে আয়গে। ভাগ।’
হেরম্বের আদেশে নয়, আতিথ্যের প্রয়োজনেই সুপ্রিয়াকে একসময়ে রান্নাঘরে যেতে হল। মনে তার কঠিন আঘাত লেগেছে। সংসারে থাকতে হলে সংসারের কতকগুলি নিয়ম মেনে চলতে হয়, এটা সুপ্রিয়া জানে এবং মানে। বিয়েই যখন তার করতে হল। তখন মোটা মাইনের হাকিম অথবা অধ্যাপক অথবা পয়সাওয়ালা ডাক্তারের বদলে একজন ছোট দারগার সঙ্গে তাকে গেঁথে দেওয়া হল। কেন ভেবে তার কখনো আফসোস হয় নি। বিয়ের ব্যাপারে বাধ্য হয়ে মানুষকে যে সব হিসাব ধরতে হয় সেদিক থেকে ধরলে কোনো ছেলেমেয়েই সংসারে ঠিকে না। এক বড় দারগা যাচাই করতে এসে তাকে পছন্দ করে নি। তার নাকটা যে বেচা সে অপরাধও সেই বড় দারগার নয়। একটি চোখা নাকের জন্য কষ্ট করে বড় দারগা হয়ে তাকে বাতিল করে দেওয়াটা সুপ্রিয়া তার অন্যায় মনে করে না। তবু তার কিশোর বয়সের কল্পনাটি অসম্ভব কেন, সুপ্রিয়া তার কোনো সঙ্গত কারণ আবিষ্কার করতে পারে নি।
তার হতাশ বেদনা আজো তাই ফেনিল হয়ে আছে। চেনা মানুষ, জানা মানুষ, একান্ত আপনার মানুষ। যে নিয়মে অচেনা অজানা ছোট দারগা তার স্বামী হল, ওই মানুষটির বেলা সে নিয়ম খাটবে কেন? ও খাটতে দেবে কেন? একি বিস্ময়কর অকারণ অন্যায় মানুষের! কেন, ভালবাসা বলে সংসারে কিছু নেই নাকি? সংসারের নিয়মে এর হিসাবটা গুঁজবার ফাঁক নেই নাকি?
সুপ্রিয় ভাবে। এত ভাবে যে বছরে তার দু-তিনবার ফিট হয়।
সুপ্রিয়াকে ডালভাত রাঁধতে হয় না, একজন পাড়ে সিপাহী বেগার দেয়। সুপ্রিয়া রাধে মাছ তরিতরকারি, রাধে ছানার ডালনা। গৃহকর্মকে সে সত্য সত্যই এত ভালবেসেছে যে, মাছের ঝোলের আলু কুটতে বসেই তার মনের আঘাত মিলিয়ে আসে। ওবেলা গা থেকে দুটো মুরগি আনবার মতলবীটাও এ সময় সে মনে মনে স্থির করে ফেলে।
রান্নার ফাঁকে একসময় হেরম্বকে শুনিয়ে আসে, ‘আর কেউ হলে রান্নাঘরে গিয়ে আমার সঙ্গে গল্প করত।–ওমা, ঘুমে যে চোখ ঢুলছে!’
‘ভারি ঘুম পাচ্ছে সুপ্রিয়া। সারারাত ঘুমোইনি।’
সুপ্রিয়া বলে, ‘তাই বলে, এখন এই সকালবেলা ঘুমোতে পাবেন না। সারাদিন শরীর বিশ্ৰী হয়ে থাকবে। আরেক কাপ চা পাঠাচ্ছি, খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নিন, তারপর দুপুরবেলাটা পড়ে পড়ে যত ইচ্ছে ঘুমোবেন!’
দুপুরবেলা হেরম্বের সঙ্গে গল্প করবে, না কয়েকটা বিশেষ বিশেষ খাবার তৈরি করতে বসবে এতক্ষণ সুপ্রিয়া তা ঠিক করে উঠতে পারে নি। দুপুরে হেরম্বের ঘুমের প্রয়োজনে এ সমস্যার মীমাংসা হয়ে যাওয়ায় সে নিশ্চিত হয়।
ভাবে, একা ফেলে রেখে কি আর খাবার করা যেত? পেটুক তো সহজ নয়? এ বেশ হল। ঘুমোবার সময়ের মধ্যেই হাত চালিয়ে সব করে ফেলব। তারপর গা ধুয়ে এসে আর কাজ নয়। শুধু গল্প।
গম্ভীর হেরম্বের সঙ্গে সে কি গল্প করবে সে-ই জানে।
হেরাম্বের জন্য আবার চা করতে গিয়ে সে ফিরে আসে।
‘একটু ব্র্যান্ডি খাবেন? শরীরের জড়তা কেটে যাবে।’
সে তামাশা করছে ভেবে হেরম্ব একটু অসন্তুষ্ট হয়ে বলে, ‘ব্র্যান্ডি! ব্র্যান্ডি তুই পাবি কোথায়?’
‘আছে। উনি খান যে!’
হেরম্ব অবাক হয়ে বলে, ‘অশোক মদ খায়?’
সুপ্রিয়া হাসে।
‘নেশা করবার জন্যে কি আর খায়? শরীর ভালো নয় বলে ওষুধের মতো খায়। আমিও ক’দিন খেয়েছি। খেলে এমন চিনচনে লাগে শরীর যে মনে হয় ওজন অর্ধেক হালকা হয়ে গেছে। একদিন–রাগ করবেন না তো?–একদিন অনেকটা খেয়ে ফেলেছিলাম। নেশায় শেষে অন্ধকার দেখতে লাগলাম!’
‘তোর সব বিষয়েই বাড়াবাড়ি সুপ্রিয়া। নেশায় কেউ অন্ধকার দ্যাখে?’
‘দ্যাখে না? আমার যে-রকম ভয় হয়েছিল, আপনার হলে বুঝতেন।’ চাবির গোছা হাতে নিয়ে সুপ্রিয়া একটা চাবি বেছে ঠিক করে, ‘বলুন, চা খাবেন, না ব্র্যান্ডি খাবেন। আলমারিতে দু। বোতল আছে। কী রঙ! দেখলে লোভ হয়।’
মাতাল হবার জন্য স্বামী মদ খায় না বলে এটা সুপ্রিয়ার কাছে এখনো হাসির ব্যাপার। কিন্তু হেরম্বের মুখের দিকে চেয়ে হঠাৎ তার হাসি ড়ুবে যায়।
সে ভয়ে ভয়ে বলে, ‘রাগ করলেন?’ হেরম্বের রাত জাগা লাল চোখ এ প্রশ্নে তার দিকে ফিরে আসে না, স্কুলের ছেলের সামনে কড়া মাস্টারের মতো তার গাম্ভীর্য কোথাও একটু টোল খায় না। রূঢ়, নীরস কণ্ঠে সে সংক্ষেপে বলে, ‘না।’
সুপ্রিয়ার কানে কথাটা ধমকের মতো শোনায়। নিজেকে হঠাৎ অসহায়, বিপন্ন মনে হয়।
‘কি হল, বলুন। আপনাকে বলতে হবে। আমি ব্র্যান্ডি খেয়েছি বলে? সত্যি বলছি, একদিন শুধু শখ করে একটুখানি–’
হেরম্ব বলে, ‘ছেলেমানুষের মতো কথা বলিস নে, সুপ্রিয়া। তোর অনেক বয়স হয়েছে।’ সুপ্রিয়া দু’পা সামনে এগিয়ে যায়। হেরম্বের একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলে, ‘ছেলেমানুষের মতো কথা আমি বলি নি। আপনিই আমায় ছেলেমানুষ করে রাখছেন।–এসব চলবে না, তাকান, তাকান, তাকান আমার দিকে। আমার ছ’বছর বিয়ে হয়েছে, আমি কচি খুঁকি নই যে, হঠাৎ কেন এত রেগে গেলেন শুনতে পাব না।’
হেরম্ব তার চোখের দিকে তাকাল না। তেমনিভাবে বসে তেমনি কড়া সুরে বলে, ‘শুনে কি হবে? তুই কি বুঝবি? তোর মাথাটা একেবারেই খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু তুই এমন আস্তে আস্তে নিজের সর্বনাশের ব্যবস্থা করছিস কেন? আমি তোকে ভালো উপায় বলে দিচ্ছি। রাত্রে একদিন অশোককে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘরের চালে আগুন লাগিয়ে দিস।’
অনেকক্ষণ স্তব্ধ বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কথা বলার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে সুপ্রিয়া কেঁদে ফেলে। রান্নাঘরে চলে গেল। তার মনে হতে লাগল, বিশেষভাবে তাকে আঘাত করবার জন্যই হেরম্ব এতকাল পরে তার বাড়িতে অতিথি হয়েছে। দুদিনের নোটিশ দিয়ে ওর আকস্মিক আবির্ভাবটা গভীর ষড়যন্ত্রের ব্যাপার। পঁাচ বছরে তার মনের অবস্থা কিরকম দাঁড়িয়েছে, আগে তার একটা ধারণা করে নিয়ে তাকে আঘাত দিয়ে অপমান করে তার কল্পনা ও স্বপ্নের অবশিষ্টটুকু মুছে নেবার উদ্দেশ্যেই হেরম্ব তার বাড়িতে পদার্পণ করেছে। তাকে ও শাসন করবে, সংকীর্ণ ও সংক্ষিপ্ত একটি বাগানে তার মূল বিস্তার করা দরকার বলে তার সব বাহুল্য ডালপালা ছেটে ফেলবে, এমন একটি শাখা রেখে যাবে না, যেখানে সে দুটি অনাবশ্যক ফুল ফোঁটাতে পারে।
ছোট দারগার সঙ্গে হেরম্ব তার বিয়ে দিয়েছিল। আজ একদিনে সে তাকে ছোট দারগারই বৌ তৈরি করে দিয়ে চলে যাবে।
এবার আর কাজে সুপ্রিয়া মন বসাতে পারে না, মাছের ঝোলে আলুর দিমের গোটা গোটা আলু ছেড়ে খুন্তি দিয়ে তরকারির মতো ঘুটে দেয়। নুন দেওয়া হয়েছে কিনা মনে করতে না পেরে খুন্তিটা উঁচু করে ঠাণ্ডা হবার সময় না দিয়েই একফোঁটা তপ্ত ঝোল জিভে ফেলে দেয়। গরমের জুলাটাই সে টের পায়, নুনের স্বাদ পায় না।
ডেকে বলে, ‘ও পাঁড়ে, দ্যাখ তো নিমক দিয়া কি নেই?’ এবং মাছের ঝোল মুখে করা দূরে থাক পাড়ে তার ছোঁয়া পর্যন্ত খায় না। স্মরণ করে তার রাগ হয়।
‘যাও, তুম্ বাহার চলা যাও।’
ভাবে, ‘হয়েছে। আজ আর আমি রোধে খাইয়েছি!’
তার মনের মধ্যে হেরম্বের কথাটা পাক খেয়ে বেড়ায়। শরীর খারাপ বলে অশোক ওষুধের মতো মদ খেলে তার অপরাধটা কোনখানে হয়। সে ভেবে পায় না। আজকের ওষুধ কাল অশোকের নেশীয় দাঁড়িয়ে গেলেও সে ঠেকাবে কি করে? বারণ সে করতে পারে। একবার কেন দশবার বারণ করতে পারে। দরকার হলে পায়ে ধরে কাঁদাকাটা করতেও তার আপত্তি নেই। কিন্তু চাকরির জোরে বিয়ে-করা বৌয়ের কথা শুনছে। কে? সংসারে সকলে যদি তার কথামতোই চলত। তবে আর ভাবনা ছিল কিসের মদে আসক্তি জন্মে যাবার আশঙ্কা অশোক হেসেই উড়িয়ে দেবে। বলবে, ‘ক্ষেপেছ?’ আমার ওটুকু মনের জোর নেই? এ বোতল দুটো শেষ হলে হয়তো আর কিনবার দরকার হবে না।’ বলবে, ‘কতগুলো টাকা! থাকলে পোষ্টাপিসে জমত। সাধ করে কেউ আত দামি পদাৰ্থ কেনে!’
সে জবাব দেবে কি? স্বামীর মনের জোরে সন্দেহ প্ৰকাশ করবে? তার স্বাস্থ্য ভালো করার দরকার নেই বলে আব্দার ধরবে? অশোক ধমকে উঠলে তার মুখখানা হেরম্ব যেন তখন দেখে যায়।
গরমে, আগুনের তাতে, সুপ্রিয়া এতক্ষণে ঘোমে উঠেছে। উঠানে চনাচনে রোদ। একটু বাতাস গায়ে লাগাবার জন্য দরজার কাছে গিয়ে সুপ্রিয়া দেহকতে পেল, হেরম্ব শোবার ঘরের বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। দুজনের মাঝে উঠানের ব্যবধান ভরে ঝাজাল কড়া রোদটা সুপ্রিয়ার কাছে রূপকের মতো ঠেকাল।
বারান্দা থেকেই হেরম্ব বলল, ‘এত গরমে তোর না। রাধলেও চলবে, সুপ্রিয়া। পাড়েকে ছেড়ে দিয়ে চলে আয়, যা পারে ওই করবে।‘
সুপ্রিয়া কথা বলল না। আঁচলে মুখ মুছে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল।
হেরম্ব বলল, ‘আমাকে চা দিলি না যে?
‘এত গরমে এক শ বার চা খেতে হবে না।’
‘এক গেলাস জল দে। তবে।‘
হেরম্বকে তৃষ্ণার্তা জেনে সুপ্রিয়ার সেবাবৃত্তি জাগ্রত হয়ে উঠল।
‘শরবত করে দেব? লেবুর শরবত?’
হেরম্ব আগ্রহ জানিয়ে বলল, ‘দে, তাই দে।’
আহত, উত্তপ্ত ও ঘর্মাক্ত সুপ্রিয়ার হাত থেকে শরবতের গ্লাস নেবার সময় এক মুহূর্তের জন্য হেরম্বের মনে হয় হয়তো সত্য সত্যই মেয়েদের মঙ্গলের ব্যবস্থা করতে গিয়ে পুরুষেরা গোড়াতেই কোথাও একটা গলদ বাধিয়ে বসে আছে, যে জন্য ওদের মনের শৈশব কোনোদিনই ঘুচিতে চায় না। ঘুণ যদি ধরে তো একেবারে কাঁচা মনেই ধরে, নইলে ওরা আজন্ম শিশু। জীবন-সাগরের তীরে বালি খুঁড়ে পুকুর তৈরি করে ওরা খুশি থাকবে, সমুদ্রের সঙ্গে তাদের সে কীর্তির তুলনা কখনো করে না। ডাবের জলে ডাবের শীসে জগতের ক্ষুধা-তৃষ্ণ দূর হয় চিরদিন এই থাকত ওদের ধারণা, জগতের ক্ষুধাও ওরা বুঝবে না, তৃষ্ণর প্রকৃতিও জানবে না।
শরবত পান করে হেরম্ব বলল, ‘কাল ফিট হয়েছিল, আজ আবার রাধতে গেলি কেন?’
‘বাড়িতে অতিথি, রাধব না? অতিথি খাবে কি?’
‘অতিথি দাইচিড়ে দিয়ে ফলার করবে।’
‘অতিথির অন্ত দরদ দেখিয়ে কাজ নেই।’
সুপ্রিয়ার মুখের মেঘ আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছিল। সে ভাবতে আরম্ভ করেছিল যে, হেরম্ব খেয়ালি মানুষ, মনের খেয়ালে ও যদি একটা অদ্ভুত কিছু করতে চায়, রাগ করে আর লাভ কি হবে? যে উদ্দেশ্যে যে মনোভাব নিয়েই ও এসে থাক, সে বিনা প্রতিবাদে। ওকে গ্ৰহণ করবে। নিজের সুখ-দুঃখ মান-অভিমানের কথাটা একেবারেই ভাববে না। বড় ভাইয়ের মতো ও যদি তাকেশাসন করে, ছোট বোনের মতো সে নীরবে শাসিত হবে। ভ্ৰান্ত কল্যাণকামীর মতো ও যদি তার মনে ব্যথা দেয়, মুখ বুজে। সে ব্যথিত হবে। ও যদি তার চোখের জল দেখতে চায়, দুচোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল ঢেলে ওকে সে চোখের জল দেখাবে। স্বপ্নহীন মাধুৰ্যহীন রূঢ় বাস্তবতার মধ্যে তাকে যদি আকণ্ঠ নিমজ্জিত দেখতে চায়, পাকা গিনির মতো ব্যবহার করে ওকে সে তাক লাগিয়ে দেবে।
হেরম্বের নিদ্রালস প্রভাতটি অতঃপর, সুপ্রিয়ার এই গোপন প্রতিজ্ঞার ফলাফলে ক্ষুব্ধ ও ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। সহসা সুপ্রিয়া যেন তার কাছে একটা দুৰ্বোধ্য রহস্যের আবরণ নিয়েছে বিদায়কামী কচের কাছে দেবযানীর অভিশাপের মতো সুপ্রিয়ার আকস্মিক ও অভিনব সহজ হাসিখুশির ভাবটা হেরম্বের কাছে দুর্বলের বিশ্ৰী প্রতিশোধ নেওয়ার মতো ঠেকতে লাগল। মনে হল, ইদারার জলের মতো ঠাণ্ডা মেয়েটা হঠাৎ বরফ হয়ে গেছে। স্নিগ্ধতা দেখালে আরো জমাট বাঁধছে, রূঢ়তার উত্তাপে বিনা বাক্যব্যয়ে গলতে আরম্ভ করে দিচ্ছে। কিন্তু গ্ৰহণ করছে না কিছুই।
সুপ্রিয়ার রান্না শেষ হতে বারটা বাজল। ফিট হতে শুরু হওয়ার পর থেকে তার চোখের কোলে নিষ্প্রভ কাজলের মতো একটা কালিমার ছাপা পড়েছিল। এই আবেষ্টনীর মধ্যে চোখ দুটি আজকাল আরো বেশি উজ্জ্বল দেখায়। এখন, এই গরমে এতক্ষণ কাঠের উনানে রান্না করার ফলে তার সমস্ত মুখ মলিন নিরুজ্জ্বল হয়ে গেছে। হেরম্ব আর একবার স্নান করবে। কিনা জিজ্ঞাসা করতে এলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে হেরম্ব ব্যথিত হল। একধার থেকে কেবল রান্না করে যাওয়ার পাগলামি মেয়েদের কেন আসে হেরম্বের তা অজানা নয়! আরো অনেককেই সে এ নেশায় মেতে থাকতে দেখেছে। সুপ্রিয়ার মতো তাদেরও এমনি রান্নার ঝোঁক চাপে, রেঁধে রেঁধে আধমরা হয়ে তারা খুশি হয়।
অথচ তাদের সঙ্গে, যারা ভাববার উপর্যুক্ত মন থেকে বঞ্চিত, সুপ্রিয়ার একটা অতিবড় মৌলিক পার্থক্য আছে। ওর এত রান্না করাকে হেরম্ব কোনোমতেই সমর্থন করতে পারল না।
বারান্দায় দাঁড়ালে বাড়ির প্রাচীর ডিঙিয়ে বহুদূর অবধি প্রান্তর চোখে পড়ে। মাঠ থেকে এখন আগুনের হালকা উঠছে। খানিক তাকিয়ে থাকলে চোখে ধাঁধা লেগে যায়।
হেরম্ব বলল, ‘বার বার স্নান করিয়ে আমাকে ঠাণ্ডা করতে চাস, তুই যে গরমে গলে গেলি নিজে?’
সুপ্রিয়া এখনো হাসল, ‘গলে গেলাম? ননীর পুতুল নাকি?’
হেরম্ব গম্ভীর হয়ে বলল, ‘হাসিস নে। তুই কি বলবি জানি, তবু তোকে বলে রাখি, শরীর ভালো রাখার চেয়ে বড় কাজ মানুষের নেই। শরীর ভালো না থাকলে মানুষ ভাবুক হয়, দুঃখ বেদনা কল্পনা করে, ভাবে জীবনটা শুধু ফাঁকি। বদহজম আর ভালবাসার লক্ষণগুলি যে একরকম তা বোধহয় তুই জানিস নে? —’
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সুপ্রিয়া আনমনে হেরম্বের মুখে স্বাস্থ্যতত্ত্ব সম্পৰ্কীয় উপদেশ শুনল। কিন্তু তার একটি কথাতেও সায় দিল না।
সূর্যাস্ত পর্যন্ত ঘুমিয়ে উঠে হেরম্ব দেখল। আয়নার সামনে সুপ্রিয়া চুলবাধা শেষ করে এনেছে। সে টের পেল, সুপ্রিয়ার একটি আশা সে পূর্ণ করেছে। প্রসাধন শেষ হবার আগে ঘুম ভেঙে সে তাকে দেখবে সুপ্রিয়ার এই কামনা হেরম্বকে রীতিমতো বিস্মিত করে দিল।
‘চুলের জট ছাড়াতে কান্না আসছিল, হেরম্ববাবু। কপাল ভালো, তাই একটু আগে আপনার ঘুম ভাঙে নি। তখন আমার মুখ দেখলে আর এক মিনিট এ বাড়িতে থাকতে রাজি হতেন না।’
দুহাতের তালু একত্র করে মাথার পিছনে রেখে হেরম্ব বলল, ‘ডেকে তোলা উচিত ছিল। চুলের জট ছাড়াবার সময় তোদের মুখভঙ্গি দেখতে আমার বড় ভালো লাগে, সুপ্রিয়া!’
‘সৃষ্টিছাড়া ভালো লাগা নিয়েই তো করবার আপনার।’
সুপ্রিয়া তাড়াতাড়ি খোঁপা বেঁধে ফেলল। আয়নায় একবার পরীক্ষকের দৃষ্টিতে নিজের মুখখানা দেখে নিয়ে প্রসাধনে যবনিকাপাত করল।
বলল, ‘আর ঘরে কেন? বাইরে বসে চা খাবেন চলুন। এর মধ্যে চারিদিক জুড়িয়ে গিয়ে ঝিরঝির বাতাস বইছে।‘
‘রাত্রে এখানে ঠাণ্ডা পড়ে, না?’
সুপ্রিয়া হেসে মাথা নেড়ে বলল, ‘গরম কমে, ঠাণ্ডা পড়ে না। তবে খুব বাতাস বয়–ওই যে ঝাউগাছগুলি দেখছেন? সমস্ত রাত শী শী করে ডাকবে, শুনতে পাবেন।’
হেরম্ব ক্ষণিকের জন্য মুগ্ধ হয়ে গেল।
‘ঝাউগাছের কাছ থেকে বেড়িয়ে আসি চল, সুপ্রিয়া।’
‘যাবেন?’ সুপ্রিয়া এক মুহূর্তে উত্তেজিত হয়ে উঠল—’তবে উঠুন, উঠে শিগগির তৈরি হয়ে নিন। আমি চাটু করে চা করে ফেলছি। উঠুন না।’
হেরম্ব প্রশান্তভাবে শুয়ে রইল। উঠবার তার কোনো তাড়াই আর দেখা গেল না। আলস্যের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে স্তিমিত চোখে তাকিয়ে সে বলল, ‘আলসেমি লাগছে সুপ্রিয়া।’
সুপ্রিয়া ক্ষুন্ন হয়ে বলল, ‘যাবেন বললেন যে?’
‘যাব বললাম বটে কিন্তু তারপর ভেবে দেখলাম, ঝাউগাছ দূর থেকেই ভালো দেখায়।’
‘অন্যদিকে চলুন। তবে? চলুন দুজনে মাঠে খানিকটা হেঁটে আসি। যাবেন বলেছেন যখন, আপনাকে যেতে হবেই হেরম্ববাবু। উঠুন। দশ গোনার মধ্যে না উঠলে হাত ধরে টেনে তুলে দেবী।‘
হাত ধরে টেনে তোলার ইচ্ছাটা সুপ্রিয়ার আকস্মিক নয়, হাত ধরে টেনে তোেলবার সুযোগটা হেরম্ব তাকে দেবে এ আশাও সুপ্রিয়া করছিল। রহস্যের ছলে এ তো তুচ্ছ, সামান্য দান। কিন্তু এটুকু বুঝবার মতো নিবিড় মনোযোগ সুপ্রিয়ার প্রতি হেরম্ব বজায় রাখতে পারে নি। সুপ্রিয়ার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই সে বিছানায় উঠে বসল।
সুপ্রিয়াকে চেষ্টা করে চোখের জল নিবারণ করতে হল। তার যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে পদে পদে ব্যথা না পেয়ে তার উপায় ছিল না। গোধূলিলগ্নে নির্জন তরঙ্গায়িত প্রান্তরে তার সঙ্গে পাশাপাশি বেড়াতে যাওয়া হেরন্থের কাম্য নয় সন্দেহ করে, কাম্য হলেও একটা তুচ্ছ খেয়ালের বশে বেড়াতে যাওয়ার উৎসাহ সে সত্য সত্যই দমন করে ফেলেছে নিশ্চিত জেনে, সুপ্রিয়া কম আহত হয় নি। তবু হৃদয়কে হেরম্ব জোর করে নিয়ন্ত্রিত করছে এই ধারণা সুপ্রিয়াকে সন্তুনা দিচ্ছিল। কিন্তু সে যে ছুতো করে হেরম্বের হাত ধরে টেনে তুলতে চায় এটা হেরম্ব খেয়াল পর্যন্ত করতে পারল না দেখে নিজেকে তার অপমানিত ও অবহেলিত মনে হতে লাগল। সে যেন বুঝতে পারুল, হেরাম্বের মন থেকে সে মিলিয়ে গেছে। একটা কর্তব্য-বুদ্ধির, একটা মোটা সাংসারিক প্রতিকারস্পৃহার আশ্রয় ছাড়া হেরম্বের কোনো মনোবৃত্তিই আর তাকে নিয়ে ব্যাপৃত হয়ে নেই।
শেষ পর্যন্ত মাঠে হেরম্ব তাকে বেড়াতে নিয়ে গেল, কিন্তু বেড়ানো উপভোগ করার ক্ষমতা সুপ্রিয়ার আর ছিল না। সমস্ত দুপুরাটা প্রকৃতির গ্ৰীষ্ম আর উনানের ধীেয়া সহ্য করে সে কল্পনার জাল বুনেছে। ভেবেছে, পথের গ্লানি কেটে গেলে বিকালে শত অনিচ্ছাতেও নিজেকে ও প্রকাশ না করে পারবে না। নিজের অজ্ঞাতেই ও কত কথা বলবে, কত ভুল করবে, কত সময় অন্যমনে আমার দিকে চাইবে। ও টেরও পাবে না। ওর কোন কথাটি কুড়িয়ে, কোন ভুলটি ধরে, কোন চাউনির মানে বুঝে ওকে আমি চিনে ফেলেছি। সুপ্রিয়া আরো ভেবেছে, আমি এখন বড় হয়েছি। পাঁচ বছর ধরে ভেবে ভেবে আমি বুঝতে পেরেছি। পৃথিবীতে একটা ব্যাপার হয় না। বেশ মোটা করে ভালবাসা বুঝিয়ে না দিলে–
সারা দুপুর সুপ্রিয়া এই কথা ভেবেছে। ভেবেছে আমার এই শরীরটা এত সুন্দর নয় যে, শুধু চোখে দেখার সান্নিধ্যে কেউ খুশি হয়। ওর মনের বাজে খেয়ালটা নষ্ট করে দিতে হলে আমাকে লজ্জা একটু কমাতে হবে। ওর কি, কাল চলে গেলে মস্ত একটা ত্যাগ করার গৌরব নিয়েই বাকি জীবনটা দিব্যি কাটিয়ে দেবে। সর্বনাশ! আমার। কাব্য নিয়ে থাকলে আমার চলবে কেন? আমি যে একটি দিনের জন্য সুখ পেলাম না, সারাদিন আমার যে কিছু ভালো লাগে না, কিছুই ভালো লাগে না–
কাল ও জন্মের মতো চলে গেলে বেঁচে থেকে আমি কি করব? এতদিন আশায় আশায় কাটিয়েও যে কষ্টটা আমি পেয়েছি, ও তার কিছু বুঝবে! ছাই সংসার, ছাই ভালোমন্দা ছাই আমার মঙ্গল-অমঙ্গল! একজনের অদর্শন সইতে না পেরে আমার যদি শুধু অসহ্য যন্ত্রণাই হতে থাকে, জগতে কিসে তবে আমার মঙ্গল হওয়া সম্ভব শুনি? পাঁচ বছর পরীক্ষা করেই তো বোঝা গেল এসব আমার পোষাবে না। কলের মতো হাত-পা নেড়েছি, শুয়েছি, বসেছি, হেসেছি। পর্যন্ত; কিন্তু আমি তো জানি কি করে এতকাল আমার কেটেছে, দিনের মধ্যে কতবার আমার মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে সাধ গিয়েছে।
না বাপু, এমন করে একটা দিনও আমি থাকতে পারব না।
কড়াইয়ের ফেনার তলে অদৃশ্যপ্রায় রসগোল্লাগুলির দিকে তাকিয়ে ভেবেছে আমি ওর সঙ্গে চলে যাব। কিছুতেই আমাকে ফেলে রেখে যেতে দেব না। বলব আপনার জন্য না হোক, আমার জন্যই আমাকে নিয়ে চলুন। না নিয়ে গেলে আমি যে জীবনে প্রথমবার ওর অবাধ্য হয়ে বিষ খেয়ে মরে যাব এ কথাটাও ওকে আমি জানিয়ে দেব।
সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে হেরম্বের সঙ্গে শুকনো ঘাসে ঢাকা মাঠে হাঁটতে হাঁটতে সুপ্রিয়া তার এই প্রতিজ্ঞ স্মরণ করে মূক হয়ে গিয়েছিল। এই নিস্তেজ আত্মবিস্মৃত মানুষটার সঙ্গে গিয়ে তার লাভ কি হবে? ও তো ভুলে গিয়েছে। ও আর না চায় সুপ্রিয়ার দেহ, না চায় তার মন। সংসারের টানে সুপ্রিয়া ওর কাছ থেকে ভেসে গিয়েছে। ওর আর ইচ্ছা নয় সাঁতরে সে ফিরে আসে।
হে ভগবান! জগতে এমন ব্যাপার ঘটে কি করে!
মাটির স্থির তরঙ্গের মতো একটা উঁচু জায়গায় পৌঁছে সুপ্রিয়া অস্ফুট স্বরে বলল, ‘একটু বসি।‘
থানার মিটমিটে আলোটির দিকে মুখ করে তারা বসল।
সুপ্রিয়া হঠাৎ বলল, ‘বৌয়ের কথা বলতে আপনার কি কষ্ট হয়?’
হেরম্ব পাশবিক নিষ্ঠুরতার সঙ্গে জবাব দিল, ‘না।’
‘বৌ গলায় দড়ি দিয়েছিল। কেন?’
‘জানি না।’
চারিদিকে অন্ধকার দ্রুত গাঢ় হয়ে আসছিল। রূপাইকুড়া গ্রামে দু-একটি আলোকবিন্দু সঞ্চরণ করছে। বছরে দুবার আকাশে তারা-খসার মরসুম আসে, এখন আর শীতকালে। আকাশে অর্ধেক তারা উঠবার আগেই থানার পিছনে একটা তারা খসে পড়ল।
হেরম্বের সংক্ষিপ্ত জবাবটি মনে মনে খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করে সুপ্রিয়া বলল, ‘দাদার চিঠিতে যখন জানলাম বৌ ওরকমভাবে মরেছে, প্রথমটা বিশ্বাস করতে পারি নি। জগতে এত লোক থাকতে আপনার বৌ গলায় দড়ি দেবে এ যেন ভাবাও যায় না।’
‘আমার মতো লোকের বৌয়েরাই গলায় দড়ি দেয় সুপ্রিয়া। আমি হলাম জগতের সেরা পাষণ্ড। তুই ছেলেমানুষ —’
‘আবার ও কথা!’
হেরম্ব এবার একটু শব্দ করেই হাসল।
‘ছেলেমানুষ বললে তোরা রাগ করিস, এদিকে বয়স কমাবার চেষ্টার কামাই নেই। তোরা-’
‘এসব বিশ্ৰী পচা ঠাট্টা শুনতে ভালো লাগছে না, হেরম্ববাবু।’
‘সেটা আশ্চৰ্য নয় সুপ্রিয়া।’ হেরম্ব একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল।
খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে সুপ্রিয়া বলল, ‘তারপর বলুন।’
হেরম্ব বলল, ‘আমি জগতের সেরা পাষণ্ড, একথা স্বীকার করার পর আর কি বলার থাকে মানুষের? গলায় দড়ি না দিলে উমা ক্ষেপে যেত। প্রকৃতপক্ষে, একটু ক্ষেপে গিয়েই সে গলায় দড়ি দিয়েছিল।‘
সুপ্রিয়া রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার কথা শুনে?’
‘তোর কথা আমি ওকে কিছুই বলি নি।’
‘তবে? কি জন্যে। তবে ও অমন কাজ করল! আমি ওর সম্বন্ধে খোঁজ নিয়েছি, হেরম্ববাবু। দাদা লিখেছেন, অমন শান্ত ভালো মেয়ে আর হয় না। শুধু শুধু সে অমন কাজ করতে যাবে কেন?’
‘তোর দাদা জগতের সব খবর রাখে।‘
‘আশ্চর্য মানুষ আপনি!’ সুপ্রিয়া আর কথা খুঁজে পেল না। হেরম্বের কাছে কথার অভাব তার চিরন্তন। হেরম্বের কাছে এলে মনের কথা ভাষায় প্রকাশ করার প্রয়োজন তার শেষ হয়ে যায়। হেরম্ব। যেন তার ভাবনা শুনতে পাবে। কাছে বসে ভেবে গেলেই হল। প্রথম প্ৰেমে-পড়া মেয়েদের এই ভ্রান্ত অবস্থাটি সুপ্রিয়া এখনো একেবারে কাটিয়ে উঠতে পারে নি। হাজার প্রশ্নে মন ভারি করে সে তাই নীরবে বসে রইল।
উমা তারই জন্য আত্মহত্যা করেছে এই ছিল এতকাল তার ধারণা। স্বামী মনপ্রাণ দিয়ে আর একজনকে ভালবাসে–তাকে ভালবাসে না, এটা বেচারির সহ্য হয় নি। আরেকজনের তরে, প্রেমে তলিয়ে যাওয়া স্বামীকে ছেড়ে সে তাই মৃত্যুর অন্ধকারে তলিয়ে গিয়েছে। এই ধারণা হেরম্বের কথায় ভেঙে যেতে সুপ্রিয়া বিহ্বল হয়ে গেল। হেরম্ব যে তাকে ভালবাসে উমার আত্মহত্যা ছিল তার প্রমাণ। মৃত্যুর মতো অখণ্ড অপরিবর্তনীয় নিঃসংশয় প্রমাণ। এই প্রমাণের বাঁধ অপসারিত হয়ে যেতে যে সন্দেহ ও আত্মগ্লানির বন্যা এল, সুপ্রিয়া তাতে আর থাই পেল না। তার মনে হল, সারাদিনের ব্যর্থ চেষ্টার পর এতক্ষণে হেরম্ব তাকে আশ্ৰয়াচুত করে দুঃখ হতাশার স্রোতে ভাসিয়ে দিতে পেরেছে। জীবনে আর তার কিছুই রইল না। একদিনের ভুল আর বাকি দিনগুলির জন্যে সেই ভুলের উপলব্ধি—এই দুটি পরিচ্ছেদই তার জীবনী। যে জীবনকে সে মহাকাব্য বলে জেনে রেখেছিল। সে একটা সাধারণ কবিতাও নয়।
থানায় পৌঁছে তারা দেখল, অশোক ফিরে এসে স্নান সমাপ্ত করে বিশ্রাম করছে।
হেরম্ব জিজ্ঞাসা করল, ‘কতক্ষণ ফিরেছ, অশোক?’
‘আপনারা বেরিয়ে যাবার একটু পরেই।’
সুপ্রিয়া অনুযোগ দিয়ে বলল, ‘আমায় ডেকে পাঠালে না কেন? আমরা ওই সামনের মাঠে ছিলাম। এখান থেকে দেখা যায়।’
অশোক হেসে বলল, ‘কি বলে ডেকে পাঠােতাম? আমি বাড়ি এসেছি, তুমি চাটু করে বাড়ি চলে। এস? তার চেয়ে দিব্যি স্নানটান করে বিশ্রাম করছিলাম। গা হাত, জান গো, ব্যথা হয়ে গেছে।’
‘আহা, তা হবে না? সারাটা দিন যে ঘোড়ার পিঠে কাটল। খাও নি কিছু? জানি খাও নি, আমি এসে না দিলে খাবে–’
অশোক অপরাধীর মতো বলল, ‘খেয়েছি, সুপ্রিয়া। এমন খিদে পেয়েছিল।–’
হেরম্ব লক্ষ করল, সুপ্রিয়ার মুখ প্রথমে একটু কালো হয়ে শেষে লালিমায় পরিবর্তিত হয়ে গেল। চাকরি ছাড়া স্বামীকে আর সব বিষয়েই সে যে তার মুখাপেক্ষী করে রেখেছে, হেরন্ধের কাছে তা প্রকাশ হয়ে গেল। একদিন ক্ষুধার সময় তার অপেক্ষায় বসে না থেকে পেট ভরালে অশোকের যদি অপরাধ হয়, স্ত্রীর কাছে সে অনেকটা শিশুত্বই অর্জন করেছে বলতে হবে। আগাগোড়া স্ত্রীর মুন যোগানোর এই আদর্শ বজায় রেখে অশোক দিন কাটায় কি করে ভেবে হেরে অবাক হয়ে রইল।
সুপ্রিয়া বলল, ‘কি খেলে?’
‘তুমি যা যা করেছ। খুঁজে-পেতে সব একটা করে খেয়েছি।’
‘তবে তো খুব খেয়েছ!’-বলে সুপ্রিয়া জেরা আরম্ভ করল, ‘সন্দেশ খেয়েছ? না খেলেই ভালো হত, সন্দেশে তোমার অম্বল হয়। রসগোল্লা খেয়েছ? একটা খেলে কেন মোটো? আর দুটো খেলেই হত। আজ ঠিক স্পঞ্জ হয় নি? মালপো খেয়েছ? কেন খেলে? যা সয় না তা খাবার দরকার কি ছিল! এই জন্যেই তো তোমাকে আমি নিজের হাতে খেতে দিই। লোভে পড়ে যা-তা খাবে, শেষে বলবে সোডা দাও।…সরভাজা খাও নি?’
হেরম্ব অশোককে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার নাকি স্বাস্থ্য খুব খারাপ হয়ে পড়েছে, অশোক? শরীর ভালো করার জন্য ব্র্যান্ডি খাও।’
অশোক চমকে বলল, ‘আমি? কই না, খাই না তো। কে বললে খাই?’
হেরম্ব বলল, ‘কেউ না, এমনি কথাটা জিজ্ঞাসা করলাম।’
সুপ্রিয়া বলল, ‘নাই-বা করতেন। কথাটা জিজ্ঞাসা?’
কিন্তু এ প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য তার সফল হল না। অনায়াসে প্রসঙ্গান্তর এনে হেরম্ব তার কথাটা চাপা দিয়ে দিল। অশোককে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘খুনী ধরতে গিয়েছিলে শুনলাম? কোথায় খুন হল?’
‘বরকাপাশীতে।’ অশোক সংক্ষেপে জবাব দিল।
‘ধরলে?’
‘ধরেছি। বড় ভুগিয়েছে ব্যাটা। এ গাঁ থেকে সে গাঁ —হয়রান করে মেরেছে! শেষে একটা ঝোঁপের মধ্যে কোণঠাসা করে ধরতে ধরা দিলে।’ অশোক একটু উৎসাহিত হয়ে উঠল। নিজের ব্যবসার কথা বলতে পেলে সকলেই খুশি হয়।’দা নিয়ে খুন করতে উঠেছিল। জমাদার জাপটে না ধরলে আজ একেবারে রক্তারক্তি কাণ্ড হয়ে যেত। ব্যাটা কি জোয়ান।’
সুপ্রিয়ার চোখের দিকে একবার স্পষ্টভাবে তাকিয়ে হেরম্ব বলল, ‘কাকে খুন করেছে?’
‘বৌকে। চিরকাল যা হয়ে থাকে–অসময়ে স্বামী বাড়ি ফিরল, লাভার গেল পালিয়ে, বৌ হল খুন। গলাটা একেবারে দুফাক করেও ব্যাটার তৃপ্তি হয় নি। সমস্ত শরীর দা দিয়ে কুপিয়েছে!’
সুপ্রিয়া শিউরে উঠে বলল, ‘মাগো!’
খুনীটা তার স্বামীকে দা নিয়ে কাটতে উঠেছিল শুনে সুপ্রিয়া শব্দ করে নি। স্মরণ করে হেরম্ব একটু ক্ষুব্ধ হল!
‘ফাঁসি হবে?’
অশোক বলল, ‘না! যথেষ্ট প্রোভোকশন ছিল।’
সুপ্রিয়া অস্থির হয়ে বলল, ‘কি আলোচনা আরম্ভ করলো? ওসব কথা থাক বাপু, ভালো লাগে না। খুন, জখম, ফাসি–বলার কি আর কথা নেই?’
হেরম্ব হেসে বলল, ‘তুই দারগার বৌ, খুন জখম ভালো না লাগলে তোর চলবে কেন প্রিয়া?’
‘দারগার বৌ হয়ে কি অপরাধ করেছি? আমি তো দারগা নাই।’
‘কি জানি কি অপরাধ করেছিস। আমি বলতে পারব না। অশোককে জিজ্ঞাসা কর। খুন জখম ভালো না লাগলে পাছে অশোককেও তোর ভালো না লাগে এই ভেবে বলছিলাম সংসারের রাহাজানির ব্যাপারগুলোকে ভালবাসতে শেখ। তুই দাঁড়িয়ে রইলি কেন বল তো, সুপ্রিয়া? অশোকের সামনে তুই দাঁড়িয়ে থাকিস নাকি? এ তো ভালো কথা নয়। হেঁটে এসে তোর নিশ্চয় পা ব্যথা করছে। দাও। হে অশোক, ওকে বসবার অনুমতি দাও। ভালো করে বসে একটা গল্প শোন, সুপ্রিয়া।’
‘শুনব না গল্প।‘
‘আহা শোন না। অশোক ওকে শুনতে বল তো।’
‘শুনব না, শুনব না, শুনব না। হল? গল্প শুনবে–আমি কচি খুঁকি নই।’
হেরম্ব একটা চুরুট বার করে বলল, ‘তবে দেশলাই দে। চুরুট খাই।’
অশোক অভিভূত হয়ে গিয়েছিল। সে যেন ঘুম ভেঙে উঠে বলল, ‘একি কাণ্ড! আপনারা যে রীতিমতো ঝগড়া করছেন!’
হেরম্ব হেসে বলল, ‘না। সুপ্রিয়াকে একটু রাগাচ্ছিলাম। ছেলেবেলায় গল্প বলুন, গল্প বলুন বলে এত বিরক্ত করত——কোথায় যাচ্ছিস সুপ্রিয়া?’
‘রান্নার ব্যবস্থা একটু দেখি?’–বলে সুপ্রিয়া চলে গেল।
হেরম্ব বলল, ‘চটেছে।’
অশোক বলল, ‘ঠাট্টা তামাশা একেবারে সইতে পারে না।’ একটু ইতস্তত করে যোগ দিল, ‘সেন্স অফ হিউমার বড় কম।’
হেরম্ব বলল, ‘তাই নাকি!’
‘ওকে আমি এত ভয় করি শুনলে আপনি হাসবেন।’
‘ওকে কে ভয় করে না, অশোক? এমন একগুঁয়ে জেদী মেয়ে সংসারে নেই। একবার যা ধরবে শেষ না দেখে ছাড়বে না। ওকে বোধহয় মেরে ফেলা যায়। কিন্তু জেদ ছাড়ানো যায় না।’
‘ঠিক। অবিকল মিলে যাচ্ছে।’
হেরম্ব শঙ্কিত হয়ে বলল, ‘মিলে যাচ্ছে কি রকম?’
‘আপনি জানেন না? বিয়ের পর এক বছর ধরে চেষ্টা করেও ওকে কিছুতে এখানে আনতে পারি নি। শেষবার আনতে গেলে ওর কাকা বুঝি বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, না যাস্ তো আমার বাড়িতে থাকতে পাবি নে। আমারও একটু অন্যায় হয়েছিল। —রাগারগি আরম্ভ করে দিয়েছিলাম। যাই হোক, আমার সঙ্গে সেই যে এল তারপর পাঁচ বছরের মধ্যে একদিনও ওর কোকা ওকে নিয়ে যেতে পারে নি। বলে, যাব না বলে এসেছি, যাব কেন?’
‘প্রথমে এখানে আসতে চায় নি জানতাম। আমিও অনেক বুঝিয়েছি। কিন্তু আসবার সময় ফিরে যাবে না বলে এসেছিল এ খবর তো পাইনি।’
‘ছেলেমানুষ রাগের মাথায় কি বলেছে না বলেছে কে খেয়াল করে রেখেছিল। ও যে ফিরে যাবে না প্রতিজ্ঞা করে এসেছিল, ও ছাড়া আর কারুর হয়তো সেকথা এখন মনেও নেই। ওর কাকা এখনো দুঃখ করে আমাকে চিঠি লেখেন। চিঠি পড়ে। কাঁদে, কিন্তু একদিনের জন্য যেতে রাজি হয় না।‘
হেরম্ব একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘আমার ধারণা ছিল, তুমিই ওকে পাঠাও না।’
অশোক, বিমৰ্ষভাবে হাসল। বলল, ‘ককার চিঠির যে সব জবাব আমাকে দিয়ে লিখিয়েছে, তাতে আপনি কেন, সকলেরই ওরকম ধারণা হবে। কথাটা প্ৰকাশ করবেন না, দাদা। ওদিকে কাকা মনে ব্যথা পাবেন, এদিকে আপনাকে বলার জন্য আমাকে টিকতে দেবে না। রাগের মাথায় মত বদলে কাকার কাছে চললাম, তোমার কাছে আর আসব না বলে বিদায় নিলে তো বিপদেই পড়ে যাব।’
অশোকের কাছে লুকিয়ে হেরম্ব গভীরভাবে চিন্তা করছিল। চারিদিক বিবেচনা করে ক্রমে ক্রমে তার ধারণা হচ্ছে, এতদিন পরে সুপ্রিয়ার সংস্পর্শে না এলেই সে ভালো করত।
সুপ্রিয়ার কোন শিক্ষাটা বাকি আছে যে ওকে আজ নতুন কিছু শেখানো সম্ভব? জীবনের স্তরে স্তরে সুপ্রিয়া নিজেকে সঞ্চয় করেছে, কারো অনুমতির অপেক্ষা রাখে নি, কারো পরামর্শ নেয় নি। ওর সঙ্গে আজ পেরে উঠবে কে?
খানিক পরে সুপ্রিয়া ফিরে এল। তার এক হাতে ব্র্যান্ডির বোতল অন্য হাতে কাচের গ্লাস!
‘তোমার ওষুধ খাবার সময় হয়েছে। সকালে খাও নি, বড় ডোজ দি, কেমন?’
অশোক কথা বলতে পারে না। একবার মদের বোতলটার দিকে, একবার হেরম্বের মুখের দিকে তাকায়। ভাবে কি সব কাণ্ড সুপ্রিয়ার।
হেরম্ব একটু হাসে। তার একেবারেই বিস্ময় নেই। সুপ্রিয়া যে নারী তাঁর এই প্রমাণটা সে না। দিলেই আশ্চর্য হত। এটুকু বিদ্রোহ না করলে ও তো মরে গেছে!
‘আমায় একটু দিস তো সুপ্রিয়া।’
‘আপনি খাবেন? মদ কিন্তু, খেলে নেশা হয়। মদে শেষে আপনার আসক্তি জন্মে যাবে না তো?’
হেরম্ব তবু হাসে।
‘আসক্তি জন্মলে কি হবে? আমার জন্য মদ যোগাড় করে রাখবে কে সুপ্রিয়া? আমার তো বৌ নেই।‘
এক মিনিটের জন্য হেরম্বকে সুপ্রিয়া ঘৃণা করল বৈকি? রাগে তার মুখ লাল হয়ে গেছে।
‘না, আপনার বৌ নেই। আপনার বৌ গলায় দড়ি দিয়েছে।‘
‘একথা হেরম্বর জানা ছিল যে, এরকম অসংযম সুপ্রিয়ার জীবনে আরো একবার যদি এসে থাকে। তবে এই নিয়ে দুবার হল। এই সংখ্যাটি সুপ্রিয়ার বাকি জীবনে কখনো দুই থেকে তিনে সুরলি সে বিষয়ে বার্তা রাখতে হয়ে রাজি হবে না। শুধু সুধিয়াকে মারতে পারলে হেরম্ব খুশি হত।
অশোক স্তম্ভিত হয়ে বলল, ‘এসব তুমি কি বলছ?’
কিন্তু সুপ্রিয়ার মুখে আর কথা নেই! কাচের গ্লাসে অশোককে নীরবে খানিকটা মদ ঢেলে দিয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
রাতে তারা যখন খেতে বসেছে, খুনীকে সঙ্গে করে সিপাহীরা ফিরে এল। হেরম্ব বহুক্ষণ আত্মসংবরণ করেছে। সুপ্রিয়ার মুখ ম্লান। আকাশ ঢেকে মেঘ করে এসেছে। পৃথিবী বায়ুখীন। হেরম্ব বলল, ‘খুনীটার সঙ্গে একটু আলাপ করতে পারি না, অশোক? কৌতূহল হচ্ছে।’
অশোক বলল, ‘বেশ তো।’
সুপ্রিয়া চেষ্টা করে বলল, ‘খুনীর সঙ্গে আলাপ করতে চান করবেন, সেজন্য তাড়াতাড়ি করবার দরকার কি! খুনী পালাবে না।’
হেরম্ব হেসে বলল, ‘না, খুনী পালাবে না। কোমরে দড়ি বাধা হয়েছে, না অশোক?’
‘নিশ্চয়।‘
সুপ্রিয়া অবাক হয়। হেরম্বের কথার মানে বুঝতে চেষ্টা করে হঠাৎ তার মনে হয়, হেরম্ব নার্ভাস হয়ে পড়েছে, চাল দিচ্ছে, ওর কথার কোনো মানে নেই।
খেয়ে উঠে তারা বাইরের বারান্দায় গেল। একটা কালিপড়া লণ্ঠন জ্বলছে। থামে ঠেস দিয়ে ধূলিধূসরিত দেহে খুনী বসে আছে। যুদ্ধ না করে সে যে পুলিশের কাছে হার মানে নি। সর্বাঙ্গে তার অনেকগুলি চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। কোমরে বাঁধা দড়িটা ধরে একজন কনষ্টেবল উবু হয়ে বসে ছিল, হেরম্ব ও অশোকের আবির্ভাবে ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল।
হেরম্ব জিজ্ঞাসা করল, ‘তোর নাম কিরে?’
‘বিরসা।’ দুদিন বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছে বুনো জন্তুর মতো; কিন্তু বুনো জন্তু সে নয়, মানুষ। প্রশ্নের জবাব দিয়ে বিরসা আবার ঝিমিয়ে পড়ল।
কনষ্টেবল বলল, ‘আস্নান করনে মাংতা, হুজুর।’
অশোক বলল, ‘এক বালতি পানি, ব্যস!’
হেরাম্বের চিন্তার ধারা অন্যরকম।
‘এমন কাজ করলি কেন বিরসা? বৌকে তাড়িয়ে দিলেই পারতিস।’
বিরসা কিছুই বলল না। বৌয়ের নামোল্লেখে লাল টকটকে চোখ মেলে হেরম্বের দিকে একবার তাকিয়ে আবার ঝিমোতে শুরু করল। অশোক শান্তভাবে বলল, ‘ওকে ওসব বলে লাভ কি হেরম্ববাবু?’
‘লাভ? লাভ কিছু নেই।’ হেরম্ব একটু ভীরু হাসি হাসল, ‘আমি শুধু জানতে চাইছিলাম ফেথলেস ওয়াইফকে খুন করে মানুষের অনুতাপ হয় কিনা।’
অশোক আরো শান্তভাবে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি জানলেন?’
‘জানলাম? অনেক কিছু জানলাম, অশোক। আমার বরাবর সন্দেহ ছিল যে ঈর্ষার বশে যদি কোনো স্বামী স্ত্রীকে খুন করে ফেলতে পারে, তাতে আর যাই হোক, স্বামীটির চরম ভালবাসার প্রমাণ পাওয়া যায়, এই থিয়োরি হয়তো সত্য নয়। আজ বুঝলাম আমার সন্দেহ সত্যি! ওর তাকাবার রকম দেখলে, অশোকঃ স্ত্রীকে খুন করে তার দাম দেবার ভয়ে ও একেবারে মরে গেছে! এটা ভালবাসার লক্ষণ নয়। ও শুধু খুনী, স্রেফ খুনী; প্রেমিক আমি ওকে বলব না! না, স্ত্রীকে ও ভালবাসত না। স্ত্রী আর একজনকে ভালবাসে বলে যে তাকে খুন করে অথবা কষ্ট দেয়, অবহেলা করে, স্ত্রীকে সে ভালবাসে না। তুমি বুঝতে পার না। অশোক, ভালবাসার বাড়া-কমা নেই? ভালবাসা ধৈৰ্য আর তিতিক্ষা? একটা একটানা উগ্র অনুভূতি হল ভালবাসা, তুমি তাকে বাড়াতে পার না কমাতে পার না? স্ত্রীকে খুন করে ফেলতে চাও কর, কিন্তু তারপর একদিনের জন্য যদি তোমার ভালবাসায় ভঁটা পড়ে, মনে হয় খুন না করলেই হত ভালো, সেইদিন জানবে, ভালবেসে স্ত্রীকে তুমি খুন কর নি, করেছিলে অন্য কারণে। স্ত্রীকে যে ভালবাসে সে অপেক্ষা করে। ভাবে, এখন ও ছেলেমানুষ, আর একজনের স্বপ্ন দেখছে। দেখুক, যৌবনে ওর প্রেম পাব। ভাবে, যৌবন ওকে অন্ধ করে রেখেছে, ও তাই অতীতের অন্ধকারটাই দেখছে। দেখুক, যৌবন চলে গেলে আমি ওকে ভালবাসব। আচ্ছা অশোক, তোমার কি কখনো মনে হয় না যে সুপ্রিয়া আর একজনকে ভালবাসছে এই অবস্থাটাকে মৃত্যু দিয়ে অপরিবর্তনীয় করে দেওয়া বোকামি? কষ্ট দিয়ে আর একজনের প্রতি এই ভালবাসাকে, এই মোহকে প্রবল আর স্থায়ী করে দেওয়া মূর্খামিঃ একি স্ত্রীকে ভালো না বাসার প্রমাণ নয়? এর চেয়ে স্ত্রীকে বাঁচিয়ে রেখে, তাকে সুখী করে–’
সুপ্রিয়া দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শুনছিল। হেরম্বের বক্তৃতার ঠিক এইখানে তার ফিট হল। গোলমাল শুনে দুজনে গিয়ে দেখে, সুপ্রিয়া বুকের নিচে দুটি হাত জড়ো করে উপুড় হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে।
অশোক চেঁচিয়ে বলল, ‘ওকে শুনিয়ে এসব কথা কি আমায় না বললেই হত না? রাস্কেল!’
রাতদুপুরে সুপ্রিয়া হেরম্বের ঘরে এল।
‘জেগে আছেন?’
‘জেগেই আছি সুপ্রিয়া।’
‘বিছানায় উঠব না! শরীরটা এত দুর্বল লাগছে, দাঁড়াতেও কষ্ট হচ্ছে।’
‘শুয়ে থাকলি না কেন, সুপ্রিয়া? কেন উঠে এলি?’
‘সকালে চলে যাবেন, কয়েকটা কথা আপনাকে বলতে চাই। দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে, হেরম্ববাবু।’ হেরম্ব চুপ করে থাকে।
‘মাথা ঘুরে হয়তো আবার আমি ফিট হয়ে পড়ে যাব। সবাই উঠে আসবে। বলুন কিছু, বলুন যাহোক কিছু।’
‘তুই তো চিরদিন লক্ষ্মী মেয়ে ছিলি সুপ্রিয়া। এত অবাধ্য, এত দুরন্ত কবে থেকে হলি?’
সুপ্রিয়াকে অন্ধকারেও দেখা যায়। কারণ, অন্ধকারে সে গাঢ়তর অন্ধকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
‘আমার সত্যি দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে।’
হেরম্ব এবারো চুপ করে থাকে।
‘আপনি আমাকে ডাকলেই পারেন। আপনি বললেই বিছানায় উঠে বসতে পারি।’
হেরম্ব তবু চুপ করে থাকে। কথা বলবার আগে সুপ্রিয়া এবার অপেক্ষা করে অনেকক্ষণ।
‘আজ টের পেলাম, বৌ কেন গলায় দড়ি দিয়েছিল। আপনি মেয়ে মানুষের সর্বনাশ করেন। কিন্তু তাদের ভার ঘাড়ে নেবার সময় হলেই যান এড়িয়ে। কাল আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে বলে বিছানায় উঠে বসতে দিচ্ছেন না। আমি দাঁড়াতে পারছি না, তবু!’
হেরম্ব বলে, ‘শোন সুপ্রিয়া। আজ তোর শরীর ভালো নেই, তাছাড়া নানা কারণে উত্তেজিত হয়ে আছিস। ধরতে গেলে আজ তুই রোগী, অসুস্থ মানুষ। আজ তুই যা চাইবি তাই কি তোকে দেওয়া যায়? তবে আর জুরের সময় রোগীকে কুপথ্য দিলে দোষ কি ছিল? বেশি ঝাল হয়েছিল বলে অশোককে তুই আজ মাছের ঝোল খেতে দিস নি মনে আছে? তুই আজ ঘুমিয়ে থাকবি যা সুপ্রিয়া। ছ’মাসের মধ্যে তোর সঙ্গে আমার দেখা হবে। তখন দু’জনে মিলে পরামর্শ করে যা হয় করব।’
‘আরো ছ’মাস!’
‘ছি’ মাস দেখতে দেখতে কেটে যাবে।‘
‘যদি দেখা না হয়? আমি যদি মরে যাই?’
জীবনের দিগন্তে তাকে অস্তমিত রেখে সুপ্রিয়া মরতেও রাজি নয়? হেরম্বের দ্বিধা হয়, সংশয় হয়। জীবনকে কোনোমতেই পরিপূর্ণ করবার উপায় নেই। তবু সুপ্রিয়াকে জীবনের সঙ্গে গেঁথে ফেললে হয়তো চিরদিনের জন্য জীবন এত বেশি অপূর্ণ থাকবে যে, একদিন আফসোস করতে হবে হেরম্বের এই আশঙ্কা কমে আসে। তার মনে হয়, আজ একদিনে সুপ্রিয়া ক্ষণে ক্ষণে নিজের যে নব নব পরিচয় দিয়েছে হয়তো তা বহু সংযম, সাবধানতা ও কার্পণ্যের বাধা ঠেলেই বাইরে এসেছে। হয়তো পাঁচবছর ধরে সুপ্রিয়া যে ঐশ্বৰ্য সংগ্রহ করেছে তা অতুলনীয়, কল্পনাতীত। কিন্তু তবু হেরম্ব সাহস পায় নি। নিজেকে দান করবার চেয়ে কঠিন কাজ জগতে কি আছে? অত বড় দাতা হবার সাহস হেরম্ব সহসা সংগ্রহ করে উঠতে পারে না।
বলে, ‘মরবি কেন, সুপ্রিয়া? লক্ষ্মী মেয়ের মতো তুই বেঁচে থাকবি।’
সুপ্রিয়া চলে গেলে হেরম্ব শয্যা ত্যাগ করে। দরজা খুলে বাইরে যায়। থানার পাহারাদার বলে—’কিধার জাতা বাবু?’
‘ঘুমানে জাতা। নিদ হোতা নেহি।’
আকাশ মেঘে ঢাকা। ওদিকে বিদ্যুৎ চমকায়। শুকনো ঘাসে ঢাকা মাঠে হেরম্ব আস্তে আস্তে পায়চারি করে। আজ রাত্রে যদি বৃষ্টি হয় কাল হয়তো মাঠের বিবৰ্ণ বিশীর্ণ তৃণ প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে।