দাবার চাল
অবশেষে মাস ছয়েক ধরে দেখাশোনা, কথাবার্তা চলার পর মৌ আর রোহিতের মধ্যে বিয়ের পাকা কথাটা হয়েই গেলো দুই পরিবারের সামঞ্জস্যপূর্ণ আলোচনায় । বুকে পেশ মেকার বসানো বাবা দৌড় ঝাঁপের ধকল বেশি নিতে পারেন না ।বাড়িতে বলতে মা, বাবা, মৌ আর দীর্ঘদিনের দেখভাল করা বৃদ্ধ রামু কাকা ।
হাতে গোনা আর কুড়িটা দিন, ক্যালেন্ডার টা দেখে আর বসে থাকতে পারলেন না প্রবীর বাবু ।কার্ড গুলো হাতে নিয়ে ঠিকানা লেখার কাজ টা সারতে লাগলেন আর পাশে সহধর্মিণী অনুপমা দেবী কার্ডে হলুদ ছাপ দেবার কাজ টা বেশ আহ্লাদেই করে চলেছেন একমনে। মনের মধ্যে ফুটে উঠছে মৌ এর হামাগুড়ি, হাঁটি হাঁটি, আরো কত্ত কি ছবির ভিড় । পরদিন সকালে পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠ রায় বাবুর বাড়িতে প্রথম নিমন্ত্রণ কার্ড দিয়ে ফেরার পথে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের বাড়ি কি এখনই ঢুকবো এই ভাবতে ভাবতে গ্রিল ঠেলে ভেতরে এগিয়ে গেলেন প্রবীরবাবু। “আরে কাকাবাবু যে আসুন আসুন” বলে কাউন্সিলর রথী দেব সামনের চেয়ারটা এগিয়ে দিলেন ।হাতে বিয়ের কার্ড টা বার করে নিজের মেয়ের বিয়ের প্রসঙ্গ তুলতেই এক অদ্ভুত যেন নীরবতা!”কাকাবাবু, সব কিছু এতো জলদি সেরে ফেললেন যে, এতো তাড়াহুড়োতে কাজ টা কি ভালো হলো !” এমন কথা শুনে প্রবীর বাবু অবাক হতেই এক সাকরেদ দাদার ঘাড়, পিঠ টিপতে টিপতে যেই বলেছে “আসলে মেশোমশাই, আপনার মেয়েকে তো আমরা ইয়ে, মানে বৌদি বলেই সম্মান দিতাম “, অমনি রথী দা এক অশ্লীল ভাষায় তাকে থামিয়ে , “কাকাবাবু একটু ভেতরে আসুন, গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে “বলে ডেকে নিয়ে গেলেন অন্দর মহলে ।
বাড়িতে ঢুকতেই শুনতে পেলো, মৌ কাকে যেনো বিয়ে বাড়ির প্রস্তুতির আদ্য প্রান্ত, মেনু, ক্যাটারিং, বরযাত্রী সব কিছু বলেই চলছে । অনুপমা ইশারা করে জানিয়ে গেলেন, রিন্টুর ফোন, মৌ এর মামার ছেলে দিল্লি থেকে ফোনে সব জানছে ।এক সপ্তাহ আগেই সে নাকি এসে বিয়েবাড়িতে দায়িত্ব সামলাতে হাজির হবে ।কোনো কথা না বলে, এক ধীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রবীর বাবু স্নানে ঢুকলেন, বুকে যেনো কেউ একটা ভারী পাথর বসিয়ে দিয়েছে । “আরে আর যে মোটে চৌদ্দ টা দিন গো, তুমি কিনা ঠান্ডা সকালে এভাবে ঘামছো, শরীর ঠিক আছে তো “এই বলে হন্তদন্ত হয়ে রান্না ঘর থেকে এসে হাঁক ছাড়লেন সহধর্মিণী । একটু সম্বিত ফিরলেও আবার চিন্তার ডুব সাঁতারে চলে গেলেন কত্তা, “আহারে রাস্তা ঘাটে কত্ত মন্তব্যই, কত্ত বেলেল্লাপনাই না সহ্য করতে হয়েছে মেয়েটাকে, বাবার চিন্তা, অসুস্থতা পাছে আরো বেড়ে যায়, কোনোদিন প্রকাশও করেনি ! “
একদিন বিকালে মৌ বেরিয়েছে ওর ব্ন্ধু পলির সাথে কসমেটিকস এর কিছু জিনিস কিনতে। বাড়িতে তখন ওনারা দুজন আর অনুপমার পিসতুতো ভাই রঞ্জন ।বরযাত্রী দের আপ্যায়ন বিষয়ে আলোচনার বিষয়ে তিনজনের মগ্নতার মাঝেই জোরালো গোটা কতক বাইকের তীব্র আলো বারান্দার সামনে ।”ও কাকাবাবু দরজা টা একটু খুলুন তো, “, এই ডাকে প্রবীর বাবুর অন্তর আশঙ্কায় দুলে উঠলো ।ততক্ষণে সকল কে অবাক করে, জনা চারেক হৃষ্ট পুষ্ট ছেলে ধুপ ধাপ করে প্রণাম সেরে ফেলে বেশ কিছু বড়ো প্যাকেটে টেবিল ভরিয়ে ফেলেছে ।”এসব কি ব্যপার জামাইবাবু “, রঞ্জনের অবাক প্রশ্নে হটাত সশরীরে পাড়ার দাদা, রথী দেব হাতজোড় করে সবিনয়ে সামনে এসে জানালেন “সামনের শুভ দিনে আমি এই বাড়ির জামাই হতে চলেছি, তারই কিছু জামা কাপড়, বাজার হাট দিয়ে গেলাম আজ “। অনুপমা ততক্ষণে রুদ্র মূর্তি তে বলে চলেছেন “মানে, এটা মগের মুলুক নাকি, যখন যা চাইবেন, দেশে আইন কানুন বলে কিছু নেই !” এরপরই রীতিমতো থ্রেট দিয়ে চাপা আওয়াজে ওরা বলে বেরিয়ে গেলো , “দেখুন কাকিমা, থুড়ি মামনি, বেশি ঘাঁটাবেন না, তাহলে কিন্তু ফল মোটেই ভালো হবে না ” চলে যেতেই ওরা এক গোপন বোঝাপড়া সেরে ফেললেন, যা মৌও জানবে না ।প্রবীর বাবুরা ঠিক করলেন ফোনে নয়, একবার ওদের সাথে যদি দেখা করা যেতো, কিন্তু বাড়িতে আনার সাহস পেলেন না ।কদিন ধরেই যেনো বাড়ির ওপর কিছু অনভিপ্রেত চোরা দৃষ্টি বেড়েই চলেছে !
সেদিনই মৌ রাতে জানালো, জামাই রোহিত পরশু দিল্লি থেকে ফিরছে বাড়ি, এখানে মেদিনীপুরে নিজে এসে শেরওয়ানি, পাঞ্জাবি প্রভৃতি মৌ এর সাথেই দুজনেই বাজার করবে । পরদিন প্রবীর বাবু ব্যাংকে যাবার পথে বুথ থেকে রোহিত এর বাবাকে ফোনে, একটু গুরুত্বপূর্ণ অলোচনার জন্য দেখা হওয়া খুব দরকার, এটা বলতে গিয়ে যা শুনলেন, একদম চমকে ওঠার মতো ।গতকাল ট্রেন এ ফেরার পথে পূর্বা এক্সপ্রেসে রোহিত কে মাদক মেশানো চা খাইয়ে সর্বস্ব লুঠ করে আসানসোল স্টেশনে অচৈতন্য অবস্থায় পুলিশ উদ্ধার করে বাড়ি পাঠায় । প্রবীর বাবুর আর বুঝতে বাকি রইলো না, হয়তো হতেই পারে, রথী দেবের স্নেহ ধন্য দল বলই এর পেছনে ।তবুও একটুও ভেঙ্গে না পরে বেয়াই মশাই কে এক ভিন্ন স্থানে দেখা করার অনুরোধ জানিয়ে দিন নির্ধারন করলেন ।
আর মাত্র সাতটা দিন মাঝে ।ক্যাটারারের মঙ্গল দা ফোন করে জানিয়ে গেলেন, “কাকু, চারশো টা খাবার প্লেট বেড়ে বারোশো’টা করেছেন রথী দা, আর উনি এসব নিয়ে চিন্তা করতে বারণ করেছেন ।
দু বছর আগে পৌর ভোটের আগে এক অন্য পার্টি কর্মী অনিল কে সরাসরি গুলি করে হত্যার রায় অঘোষিত হলেও কারুরই জানতে বাকি নেই “রথী দেব এর গুণের কথা “।অনিল দার সুন্দরী বিবাহিত বৌ এর প্রতি কু নজর থাকায় রথী দার আচরণে প্রতিবাদ করাতেই অনিল কে চিরতরে সরিয়ে ফেলা হয় ।এরপর থেকে রথী দেবের আনাগোনা, পেশীশক্তি আরো বেড়েছে কাউন্সিলর হবার পর ।এই সব ভাবতে ভাবতে মৌ এর কপালে যে কি আছে, কি হবে সেই ভাবনায় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ডুব দিলেন অনুপমা ।
চুপ চাপ একদিন সন্ধায় খোঁজ খবর নিয়ে অনিলদার, বছর বত্রিশের বিধবা স্ত্রী করবীর বাড়িতে হাজির হলেন ।পরিচয়, মেয়েলি কথার মাঝে রথী দেবের প্রতি করবীর প্রতিশোধ নেবার আগুনে ঝাঁজ, টের পেলেন অনুপমা ।রথী দেব নাকি করবী কে দিনের পর দিন যৌন শোষণ করে গেছেন পেশী শক্তির ভয় দেখিয়ে আর বিয়ে করার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ! করবী এখন লোক লজ্জায়, ঘৃণায় সকল আত্মীয় স্বজন থেকে দূরে সরে কোনরকমে এই একচিলতে ঘরে একাকী বাস করে ।
দিন যতো এগিয়ে আসছে, মা-বাবাকে একটু যেনো চুপ চাপ দেখছে মৌ।সে না হয় চলেই যাবে তাবলেএতো জলদি মনখারাপ করে পরিবেশ গুমোট করার কি কোনো আদৌ মানে আছে মায়েদের ! হেসে পরিবেশ শুধরানোর চেষ্টা করে সে । কোনোকিছুই মেয়েকে জানান নি তারা, তবুও আদরের মেয়ের কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হলো কিছুটা । অনুপমা, প্রবীর দুজনই ভাবছে নিজেদের মতো করে আপন পরিকল্পনায় ।কেউ কাউকেই পরস্পরের ভাবনা প্রকাশ না করে আগামী পয়লা ডিসেম্বর যেনো মীরাক্কেল কিছু ঘটার দিন গুনতে থাকে ।
দুই বেয়াই এর গোপন কথা অনুযায়ী মেদিনীপুর শহর থেকে প্রায় পঁচিশ কিমি দূরে ছিন্নমস্তা কালীমন্দিরের পুরোহিতের সাথে আলচনায় বিয়ের যাবতীয় আয়োজন সারা ।এখনও পর্যন্ত ঠিক আছে দু-পাঁচ জন নিকট আত্মীয়দের সামনে ওই একই লগ্নে মৌ আর রোহিতের বিয়ে দিয়ে, রাতেই কলকাতাতে পৌঁছনোর ব্যবস্থা ও লজে বাকি আয়োজন রাখা ।
ইতিমধ্যে এই বাড়ির যাবতীয় দামী মূল্যবান জিনিস, গয়নাগাটি আস্তে আস্তে করে রন্টির হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে মৌ এর মামার বাড়ীতে।আর সর্বক্ষণের রামু কাকা কেও কিছুদিন ছুটিতে দেশ পাঠানো হয়ে গেছে ।মৌ এর পড়াশোনার জন্যই এই শহরে অবসরের পরেও, দত্ত পরিবারকে থেকে যেতে হয় ।আসবাব, খাটবিছানা, বইপত্র যাবতীয় গুছিয়ে বিয়ের আগের দিন রাতে মৌ কে সব বিস্তারিত জানালেন প্রবীরবাবু । ঘুণাক্ষরে না জানতে পারা মৌ এর তো তখন ভ্যাবাচাকা খাওযার অবস্থা ! ব্যাগ থেকে একটা কালো বোরখা বার করে কি যেনো বোঝালেন মেয়েকে । মেয়েকে, মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বস্ত করে আবেগ ভরা, ছল ছল চোখে বললেন, “মা রে, লক্ষী মা আমার, রোহিতের সাথে তোর বিয়ে দেবার জন্য জীবনের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত আমরা লড়াই করে যাবো দেখেনিস । তোকে যা বলবো, মন দিয়ে মেনে চলার চেষ্টা করিস একটু । অনুপমা এতক্ষণ চুপ থেকে সব কিছু যেনো মনে মনে রিহার্সাল করে নিচ্ছিলেন ।শান্ত অথচ সাহসী গলায় বললেন, কাল সন্ধায় যখনআমার মেয়ে, পার্লার যাবে সাজতে, সেখান থেকে বোরখা পরে ঠিক করে রাখা গাড়ি, সোজা নিয়ে যাবে হাইরোড ধরে গন্তব্যের ঠাকুর থানে ।একই সময়ে করবী, টোটো ধরে পার্লার গিয়ে রথী দেবের পছন্দ কড়া উজ্জ্বল বেনারসীতে, হুবহু একই রকম সেজে ফিরবে বিয়ের মণ্ডপে, মেয়ের সাজতে যাওয়া রথী দেবের নির্ধারিত গাড়িতেই । কথা গুলো এক নাগাড়ে বলে এই নভেম্বরের শেষ দিনের ঠান্ডাতেও অনুপমাকে কপালের ঘাম মুছতে হলো । এতদিন নীরবে কাজ করে যাওয়া শান্ত মাকে যেনো কিছু একটা ভর করেছে আজ, কি অফুরন্ত মনের জোর বেড়ে গেছে মায়ের, নিজের মনেই কথা গুলো বলে ফেলল মৌ ।
আজ দুমাস হয়ে গেলো, মৌ আর রহিতের বিয়ে হয়ে গেছে । জামাই বিয়ের পরপরই ট্রান্সফার হয়ে গেছে পুনেতে, ওখানেই থাকে ওরা স্বামী, স্ত্রী ।প্রবীর আর অনুপমা কলকাতার এক ভাড়া ফ্লাটে বসে আয়েশ করে চা খাচ্ছিলেন । হটাত্ ক্যুরিযার কোম্পানির ফোন এলো, “কাকাবাবু আপনার কথামতো আপনাদের মেদিনীপুর শহর থেকে যাবতীয় জিনিসপত্র আমাদের অফিসে হাজির হয়ে গেছে । সেইসঙ্গে বাড়িওয়ালার বকেয়া ভাড়াও আপনি যেমন বলেছিলেন, মিটিয়ে দিয়ে এসেছি, সময় করে মালপত্তর গুলো নিয়ে যাবেন ।।