Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দাড়িবাবাদের কবলে || Syed Mustafa Siraj

দাড়িবাবাদের কবলে || Syed Mustafa Siraj

দাড়িবাবাদের কবলে

তাঁকে বড়রা বলতেন তোতামিয়াঁ। আমরা ছোটরা বলতুম তোতামামা। কেউ-কেউ তাকে বলতেন, জাহাজি তোতা। কারণ তোতামামা ছিলেন জাহাজের নাবিক।

আমাদের ছোট্ট শহরে হিন্দু ও মুসলিমরা মিলেমিশে বাস করতেন। তোতামামার বাড়ি ছিল আমাদের বাড়ির পাশেই। তাঁর ভাই ছিলেন দর্জি। তার ডাকনাম ছিল আমিয়া। দুজনেরই আসল নাম আমার জানা ছিল না। কিন্তু তোতা-আতা দুইভাই ছিলেন একেবারে বিপরীত। যেমন মেজাজে, তেমনি চেহারায়।

তোতামামা ছিলেন লম্বা-চওড়া প্রকাণ্ড মানুষ। তেমনি প্রকাণ্ড ভূঁড়ি। মাথার চুল কাঁচাপাকা। সামনের দিকে অল্প চুল। কিন্তু পেছনে একেবারে খুঁটিয়ে ছাঁটা। তবে দেখবার মতো জিনিস ছিল তার গোঁফ। সূচলো বাঁকা গোঁফের ডগা। কিন্তু বিশাল সেই গোঁফ। রোজ দাড়ি কামাতেন। তাই বাবা ঠাট্টা করে বলতেন, কী হে তোতামিয়া! রোজ দাড়ি কামাও কি গোঁফকে দেখনসই করার জন্য?

তোমামা ভুঁড়ি কাঁপিয়ে হেসে বলতেন, তুমি ঠিকই ধরেছ। তবে কী জানো? আমার জাহাজের ক্যাপ্টেন হুবার্ট সায়েব ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রাখেন। তাই কোনও নাবিকের দাড়ি রাখা পছন্দ করেন না। দাড়ি রাখবেন শুধু তিনি। ক্যাপ্টেন বলে কথা।

তোতামামা সারা বছর সমুদ্রে পৃথিবীর এক বন্দর থেকে অন্য বন্দরে জাহাজে কাটিয়ে বাড়ি ফিরতেন মাত্র একবার। কিছুদিন ছুটি কাটিয়ে আবার কলকাতা ফিরে যেতেন। তারপর আবার জাহাজে পাড়ি দিতেন এক দেশ থেকে অন্য দেশে। যখন বাড়ি ফিরতেন, তখন পাড়ার ছোট-বড় সবার জন্য কত জিনিস নিয়ে আসতেন এবং উপহার দিতেন। আমার জন্য আনতেন রংবেরঙের ছবির বই, কালার পেনসিল, লজেন্স। আমাদের বাড়ির ভেতরে বারান্দায় বসে চা খেতে-খেতে তার সমুদ্রযাত্রার অদ্ভুত-অদ্ভুত গল্প শোনাতেন। তাই তোতামামা এলেই আমি আহ্লাদে আটখানা হয়ে যেতুম। বাবা ও মা-ও খুশি হয়ে গল্প শুনতেন।

সেবার পুজোর আগে সন্ধ্যাবেলায় পড়তে বসেছি, এমনসময় বাইরে তোতামামার চেনা সেই ভরাট গলার ডাক শোনা গেল,–পুঁটু। ও পুঁটু!

অমনি দৌড়ে ছোট্ট উঠোন পেরিয়ে সদর দরজা খুলে দিলাম। তারপরই ভীষণ ভড়কে গেলুম। এ আবার কে? সেই দশাসই চেহারা, পরনে প্যান্ট-শার্ট, কাঁধে ব্যাগ অথচ মুখে গোফ নেই এবং মাথায় চুল নেই। পুরো মাথা জুড়ে চকচকে টাক!

আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি দেখে তোমামা বললেন, কী রে পুঁটু? চিনতে পারছিসনে? আমি তোর সেই তোতামামা?

অবাক হয়ে বললুম,–আপনার গোঁফ নেই কেন? মাথায় চুল নেই কেন তোতামামা?

ভেতরে চল। সব বলব। –বলে তোতামামা বাড়ি ঢুকলেন।

বাবা ইতিমধ্যে উঠোনে নেমে এসেছেন। তিনিও খুব অবাক হয়ে বললেন,–কী অদ্ভুত ব্যাপার! ওহে তোতামিয়া! তোমার গোঁফ কোথায় গেল? মাথাজুড়ে টাক পড়ল কেন? তোমার গালই বা অমন চকচক করছে কেন?

তোমামা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিষণ্ণ মুখে বললেন,–আর বোলো না হে! প্রাণে বেঁচে ফিরতে পেরেছি এই যথেষ্ট। বলে তিনি হাঁক দিলেন, কই গো বোনটি? শিগগির চা দাও। তোমার হাতের চা না খেলে চাঙ্গা হব না। ট্রেন থেকে নেমেই প্রথমে এ বাড়ি ঢুকেছি।

মা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মা-ও ভীষণ অবাক। বললেন,–এ কী দাদা! তোমার এমন চেহারা হল কেন?

তোতামিয়াঁ বারান্দায় উঠে একটা চেয়ারে বসে বললেন, আগে চা। তারপর কথা হবে। হ্যাঁ–পুঁটুর কোন ক্লাস হল এবার?

বললুম, ক্লাস সিক্স।

বাহ! এই নে। তোর জন্য কত ইংরেজি গল্পের বই এনেছি দ্যাখ! –তোতামামা কয়েকটা রংচঙে লম্বা-চওড়া বই বের করে আমার হাতে গুঁজে দিলেন। তারপর বাবাকে বললেন, তোমার জন্য এই সেফটি রেজার, ব্লেড আর দাড়ি কামানোর লোশন এনেছি। আর আমার বোনটির জন্য এনেছি পাপুয়া দ্বীপের আদিবাসীদের তৈরি কতরকমের গয়না। হা–একসেট সাবানও এনেছি।

মা তখনই চা করতে গেলেন। বাবা পাশে একটা চেয়ার টেনে বসলেন। আমি থামে হেলান দিয়ে তোতামামার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলুম। ইনি কি সত্যি সেই তোতামামা, নাকি অন্য কেউ? কিছু বলা যায় না। আমাদের পাড়ার শেষে একটা কবরখানা আছে। কেন যেন গা ছমছম করতে লাগল।

বাবা বললেন,–দেখো ভাই তোতা! তোমার সেফটি রেজার, ব্লেড, আর এই লোশন দিয়ে দাড়ি কামিয়ে আমার অবস্থা তোমার মতো হবে না তো?

তোতামামা একটু হেসে বললেন, আরে নানা! ওগুলো খাঁটি অস্ট্রেলিয়ায় তৈরি। ও সবের সঙ্গে আমার গোঁফ হারানো বা মাথাজুড়ে টাক গজানোর কোনও সম্পর্ক নেই।

মা শিগগির চা এনে দিয়ে মোড়ায় বসে উপহারগুলো দেখতে থাকলেন। আমি বললুম,–এবার বলুন না তোতামামা, আপনার গোঁফের কী হল? মাথায় অমন টাক পড়ল কেন?

তোতামামা আস্তেসুস্থে চা খাওয়ার পর বললেন,–সে এক সাংঘাতিক ঘটনা। বললে তোমরা বিশ্বাস করবে না। কিন্তু যা বলছি, তা কত সত্যি আমি জানি। আমার অবস্থা এমন কেন হল এবার শোনো।

তোমামা বলতে শুরু করলেন তার গোঁফ হারানো আর টাক গজানোর রোমাঞ্চকর কাহিনি।…

–আমাদের জাহাজটা যাত্রিবাহী নয়, মালবাহী ছোট জাহাজ। পৃথিবীর এক বন্দর থেকে অন্য বন্দরে নানা কোম্পানির নানারকম জিনিস পৌঁছে দেয়। জাহাজটার মালিক এক ব্রিটিশ কোম্পানি। জাহাজের নাম ভিট্রি।

গত বছর নভেম্বরে কলকাতা থেকে হংকংয়ে মাল পোঁছে দিয়ে আবার সেখান থেকে মাল বোঝাই করে জাপানের হোক্কাইদো দ্বীপের কাহিরা বন্দরে পৌঁছেছিলুম। কাহিরা থেকে ডিসেম্বরের শেষাশেষি আমাদের জাহাজ রওনা হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন বন্দরের দিকে।

প্রশান্ত মহাসাগরের যে অঞ্চল দিয়ে আমরা ভেসে যাচ্ছিলুম, তাকে পলিনেশিয়া বলা হয়। জাহাজের গতি দক্ষিণে। বাঁ-দিকে পাপুয়া এবং নিউজিল্যান্ড, ডানদিকে অস্ট্রেলিয়া। ওখানে প্রশান্ত মহাসাগর আর তত চওড়া নয়। জানুয়ারি মাস। কিন্তু দক্ষিণ গোলার্ধে তখন গ্রীষ্মকাল শুরু হয়েছে। উত্তর গোলার্ধে যখন শীত, দক্ষিণ গোলার্ধে তখন গ্রীষ্ম!

বেশ যাচ্ছিলুম। হঠাৎ এক রাত্রে শুরু হয়ে গেল তুমুল ঝড়বৃষ্টি। ঝড়ের গতিও দক্ষিণে। কিন্তু সেই ঝড় এমন সাংঘাতিক যে, আমাদের ছোট জাহাজটার অবস্থা হল শোচনীয়। গতি নিয়ন্ত্রণ করে যে যন্ত্রটা, তার নাম রেডার। আমরা নাবিকরা বলি র‍্যাডার। পাপুয়ার পাশ ঘেঁষে যাওয়া বিপজ্জনক। কারণ সমুদ্রের তলায় ওখানে আছে কয়েকটা ডুবোপাহাড়। কিন্তু ঝড়ের দাপটে র‍্যাডার অকেজো হয়ে গিয়েছিল। ডুবোপাহাড়ের কিনারায় ধাক্কা লেগেই এই দুরবস্থা।

তারপর আর জাহাজের গতি সামাল দেওয়া গেল না। র‍্যাডার নৌকোর হালের কাজ করে। হাল ভাঙলে নৌকোর কী অবস্থা হয় ভাববা! ক্যাপ্টেন হুবার্ট বেতারে এস. ও. এস. অর্থাৎ বিপদসংকেত পাঠাতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, কোনও বন্দর থেকে সাড়া পাচ্ছিলেন না।

অবশেষে ঝড় যখন থামল, তখন বিপদের ওপর বিপদ, অগভীর সমুদ্রের তলায় জাহাজ গেল আটকে। ইঞ্জিনও গেল বিগড়ে। কারণ জাহাজের প্রপেলার সমুদ্রতলে চড়ার ধাক্কায় বেঁকেচুরে গিয়েছিল। জলের গভীরতা মেপে আমরা প্রমাদ গুনলুম। মাত্র বিশ ফুট গভীরতা সেখানে! ছোট জাহাজ হলেও দুশো টন মাল তো ভর্তি।

ক্যাপ্টেন হুবার্ট অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ হিসেব করছিলেন কম্পাসযন্ত্রে। তাঁর কেবিন থেকে বেরিয়ে জাহাজের মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, অফিসার আর নাবিকদের ডেকে তিনি বললেন, আমরা বিপন্ন। কারণ আমরা এসে পড়েছি সলোমন দ্বীপপুঞ্জের কাছে। অক্ষাংশ ১০ ডিগ্রি এবং দ্রাঘিমাংশ ১৬০ ডিগ্রি থেকে সামান্য দূরে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই অগভীর সমুদ্রের পূর্বে এবং খুব কাছাকাছি যে দ্বীপটা আছে, তার নাম ডেভিলস আইল্যান্ড।

অর্থাৎ কিনা শয়তানের দ্বীপ! আমরা চমকে উঠেছিলুম। কারণ নাবিকজীবনে ওই জনহীন দ্বীপ সম্পর্কে অনেক ভুতুড়ে গল্প শুনেছি। ততক্ষণে ভোর হয়ে গেছে। ক্যাপ্টেন হুবার্ট দূরবিনে দেখে নিয়ে আবার বললেন,-া। আমাদের বাঁ-দিকে একমাইল দূরে একটা ছোট্ট দ্বীপ দেখতে পাচ্ছি। ওটাই যে শয়তানের দ্বীপ তাতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

কিছুক্ষণ পরে দিনের আলো ফুটে উঠল। খালিচোখেই দ্বীপটা দেখতে পেলুম। নাবিকদের মধ্যে বব নামে এক মার্কিন যুবক আর পরেশ রায় নামে একজন বাঙালি যুবক ছিল আমার খুব ঘনিষ্ঠ। পুটুর মতোই, কেন জানি না, পরেশ আমাকে বলত তোমামা। আর বব বলত আঙ্কল টোটা। তো ববের কাছে ছিল বাইনোকুলার। সে বাইনোকুলারে দ্বীপটা দেখতে-দেখতে বলল,–শুধু জঙ্গল দেখতে পাচ্ছি আঙ্কল টোটা! গাছগুলোর চেহারা ভারি অদ্ভুত। তলায় ফার্নের ঝোঁপ আছে অবশ্য। আর একটা পাহাড়ও দেখতে পাচ্ছি। পাহাড় থেকে জলপ্রপাত নেমে গেছে মনে হচ্ছে। কিন্তু সত্যি কোনও জনমানব দূরের কথা, কোনও প্রাণী–এমনকী পাখি পর্যন্ত নেই। আশ্চর্য তো!

ববের কাছ থেকে বাইনোকুলার নিয়ে আমিও খুঁটিয়ে দেখে বললুম, বব ঠিকই বলেছে। দ্বীপের গাছগুলোর মতো ওই রকম আজব গাছ কখনও দেখিনি। গাছগুলো যেন জ্যান্ত হয়ে কটমট করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। পরেশও আমার কাছে থেকে বাইনোকুলার নিয়ে দ্বীপটা দেখতে থাকল!

তোতামামা শ্বাস ছেড়ে চুপ করলেন। বাবা বললেন,–তারপর কী হল বলো!

তোতামামা একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, শেষে বেতারযন্ত্রটাও গেল বিগড়ে। এখন আমাদের একমাত্র ভরসা, যদি দূরে কোথাও কোনও জাহাজ বা মাছধরা ট্রলারের দেখা পাওয়া যায়। মাছধরা ট্রলার এই অগভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে আসে শুনেছিলুম।…

কিন্তু কোথায় কী? সাতদিন সাতরাত্রি কেটে গেল। খাদ্যের ভাণ্ডার ফুরিয়ে আসছিল। রেশন করে একটুকরো পাউরুটি আর একটুখানি জল খেয়ে কাটাচ্ছিলুম। অবশ্য নাবিকদের অনেকের কাছে মাছধরা ছিপ ছিল। সমুদ্রের মাছ কোনটা খাওয়া যায়, কোনটা বিষাক্ত বা অখাদ্য আমরা জানি। সেই মাছ পুড়িয়ে খেয়ে পেট ভরাচ্ছিলুম বটে, কিন্তু পানীয় জল? শেষে এমন অবস্থা হল, জলের অভাবে আমরা কাতর হয়ে পড়লুম।

তখন আমিই মরিয়া হয়ে ক্যাপ্টেনসায়েবকে বললুম, স্যার! শয়তানের দ্বীপে একটা পাহাড়ে জলপ্রপাত বা ঝরনা, যা-ই হোক, আমরা দেখতে পেয়েছি। আপনি যদি অনুমতি দেন, তা হলে আমি শয়তানের তোয়াক্কা না করে ওই দ্বীপ থেকে পানীয় জল আনতে পারি।

ক্যাপ্টেন বললেন, তোমার মাথাখারাপ হয়েছে টোটা? ওই দ্বীপে যারা যায়, শুনেছি তারা আর জ্যান্ত ফিরে আসে না।

তাই শুনে বব বলল, আঙ্কল টোটার সঙ্গে আমিও যেতে রাজি।

পরেশও বলল, আমিও যাব। রবারের ভেলায় প্লাস্টিকের পাত্রে প্রচুর জল ভরে আনব।

দুই ভাগ্নের সাহসে আরও সাহসী হয়ে বললুম, ক্যাপ্টেনসায়েব! আমাদের যেতে অনুমতি দিন। আমাদের চাই শুধু তিনটে আগ্নেয়াস্ত্র!

ক্যাপ্টেন একটু চিন্তাভাবনা করে বললেন,–এই অগভীর সমুদ্রে বহু দ্বীপ থেকে আদিবাসীরা মাছ ধরতে এসে আমাদের জাহাজ দেখতে পাবে। তখন তারা আমাদের আক্রমণ করতে পারে। তাই আমি তোমাদের রাইফেল বা রিভলভার দিতে পারব না। বড়জোর দুটো শটগান আর দুটো করে চারটে কার্তুজ দিতে পারি। ক্যাপ্টেনের কথায় যুক্তি ছিল।

তো বব আর আমি শটগান দুটো নিলুম। পরেশ নিল ঝোঁপজঙ্গল কাটা একটা ভোঙ্গালি জাতীয় ছোট্ট ধারালো দা। আমরা তিনজনে রবারের ভেলায় চেপে শয়তানের দ্বীপের বালিভরা বিচে পোঁছলুম। তারপর জল ভরার তিনটে পাত্র নিয়ে রবারের ভেলাটা টানতে-টানতে ফার্নের জঙ্গলে লুকিয়ে রাখলুম।

আগেই বলেছি, দ্বীপের গাছপালার চেহারা কেমন যেন জ্যান্ত। এসব গাছ আমি জীবনে দেখিনি। কাছাকাছি গিয়ে মনে হচ্ছিল ফিসফিস শব্দে গাছগুলো যেন আমাদের বিরুদ্ধে কী চক্রান্ত করছে। ফার্নের ঝোঁপ কেটে যত এগোচ্ছি পাহাড়টার দিকে, তত চমকে উঠে পিছনে তাকাচ্ছি। কেউ বা কারা যেন গোপনে বা অদৃশ্য থেকে আমাদের পিছনে হেঁটে আসছে। বব তো একবার চমকে উঠে শটগান তাক করে গুলি ছুঁড়তে যাচ্ছিল। ওকে আটকে না দিলে সত্যি গুলি ছুড়ত।

মিনিট কুড়ি হাঁটার পর দেখলুম, ওটা পাহাড়ি ঝরনাই বটে। প্রায় পঞ্চাশ ফুট উঁচু থেকে জলের ধারা নিচে আছড়ে পড়ে ছোট্ট একটা জলাশয় সৃষ্টি করেছে। বহু দ্বীপে এ ধরনের প্রস্রবণ আছে, সুপেয় জলের। ছোট্ট জলাশয়টা অন্তত বিশ ফুট নিচে একটা সংকীর্ণ উপত্যকায় অবস্থিত। তারপর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে। ঝোঁপ কেটে আমরা নামতে যাচ্ছি, হঠাৎ এক অদ্ভুত-বেজায় উদ্ভুট্টে দৃশ্য দেখতে পেয়ে তিনজনই গুঁড়ি মেরে বসে পড়লুম।

ঝরনা যেখানে আছড়ে পড়ছে, তার পাশে একটা চওড়া কালো সমতল পাথর। সেই পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে চারটে প্রাণী। কীরকম প্রাণী বলি।

ফুট চারেক উঁচু। তাদের সাদা গোঁফ-দাড়ি বুক ঢেকে পায়ের তলায় পৌঁছেছে। তাদের মাথার সাদা চুলও পিঠ ঢেকে পায়ের পেছনে মাটি ছুঁয়েছে। শুধু মুখের ওপরটা আর দুটো লিকলিকে হাত দেখা যাচ্ছে কঁধ থেকে। বেজায় কালো রং। চোখগুলো যেন জ্বলছে।

ওরা কতকটা মানুষের মতো। অথচ মানুষ নয়। আমরা হতভম্ব হয়ে বসে আছি। কী করা উচিত ভেবে পাচ্ছি না। একটু পরে চারটে প্রাণীই ঝুপঝুপ করে জলাশয়ে ঝাঁপ দিল। সাঁতার কাটল কিছুক্ষণ। তারপর পাথরটাতে উঠে শরীর নাড়া দিয়ে জল ঝেড়ে ফেলে রোদে বসল। মনে হল, ওরা দাড়ি আর চুল শুকিয়ে নিচ্ছে।

পরেশ ফিসফিস করে বলল, তোতামামা! মনে হচ্ছে এরাই সেই বালখিল্য মুনি। মহাভারতে এদের কথা পড়েছি। ব্রহ্মার পুত্র ছিলেন ক্রতু। তুর পুত্র ছিলেন বালখিল্য মুনিরা। শুধু একটা কথা মিলছে না। বালখিল্য মুনিদের সাইজ ছিল এক আঙুল লম্বা। পরেশ আমাকে বাংলায় কথাগুলো বলছিল। তাই বব চটে গিয়ে জানতে চাইল কী বলছে পরেশ? তখন পরেশ তাকে কথাগুলো যথাসাধ্য ইংরেজিতে বুঝিয়ে দিল।

বব গম্ভীর হয়ে বলল,–তোমাদের ওই বই যারা লিখেছিল, তারা নিশ্চয় দৈত্যের মতো প্রকাণ্ড ছিল। তাদের আঙুল কি তোমার মতো ছিল? পরেশ সায় দিল তার কথায়।

আধঘণ্টা কেটে গেল। কিন্তু বালখিল্যরা নড়ল না। তখন অধৈর্য হয়ে খাপ্পা বব আমি বাধা দেওয়ার আগেই শূন্যে ফায়ার করে দিল। নিচের উপত্যকায় প্রচণ্ড শব্দ হল। অমনি সেই দাড়িবাবারা, পরে ঠাট্টা করে আমি তাদের দাড়িবাবা নাম দিয়েছিলুম–তারা চমকে গিয়ে আমাদের দিকে তাকাল। তারপর কিচিরমিচির করে কী বলতে থাক। ববকে আটকাতে পারলুম না। সে আবার শূন্যে ফায়ার করামাত্র দাড়িবাবা বা বালখিল্যরা পাহাড়ের গায়ে ঝোঁপজঙ্গলের ভেতর চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

বব, তার পিছনে পরেশ, তার পিছনে আমি তিনটে জলের পাত্র নিয়ে দ্রুত নেমে গেলুম। সেই পাথরটা থেকে ঝরনার জল ভরতে শুরু করল বব আর পরেশ। আমি শটগান হাতে পাহারায় রইলুম।

হঠাৎ আমার মাথায় গো চাপল। দুর্মতি আর কাকে বলে?

তোমামা আবার জোরে শ্বাস ছেড়ে চুপ করলেন। বললুম,–তোমামা! তারপর কী হল?

তোতামামা তাঁর মাথার চকচকে চামড়ায় হাত বুলিয়ে নিয়ে আবার তাঁর কাহিনি শুরু করলেন।

–হঠাৎ আমার মাথায় গো চাপল। শটগানের গুলির শব্দে যারা ভয় পায়, তারা নিশ্চয় ভিতু। আমার হাতে শটগান আছে। দুটো কার্তুজ আছে। ধারালো দা আছে। তাছাড়া নাবিকজীবনে কত ভয়াবহ অবস্থায় পড়েছি। তা থেকে গায়ের জোর আর বুদ্ধির জোরে উদ্ধার পেয়েছি। এই চার ফুট দাড়ি-চুলওয়ালা দুপেয়ে প্রাণীগুলোকে ভয় পাওয়ার মানে হয় না। ওদের অন্তত একটাকে ধরে জাহাজে নিয়ে যেতে পারলে হইচই পড়ে যাবে।

আমি বব আর পরেশকে কিছু না বলেই খাড়াই বেয়ে সাবধানে উঠতে শুরু করলুম। ওরা আমাকে ডাকাডাকি করছিল। সাড়া দিলুম না। পাহাড়ের চূড়ার কাছাকাছি গিয়ে দেখি জঙ্গলের ভিতরে সরু একটা পথ। ওই পথেই বিদঘুঁটে প্রাণীগুলো তাহলে এসেছিল। কয়েক পা এগিয়ে গেছি, আচমকা দুধারের গাছ থেকে ঝুপঝুপ করে সেই দাড়িবাবারা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তখন বুঝলুম, ওদের গায়ে কী সাংঘাতিক শক্তি! একজন আমার শটগান কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল। বাকি তিনজন আমার পিঠে বসে ফরফর করে আমার জামা ছিঁড়ে ফেলে দাড়ি ঘষতে থাকল। ওহ! সে কী সুড়সুড়ি! হাসব কী, চ্যাঁচিতে শুরু করলুম। তখন একজন হাত বাড়িয়ে আমার গোঁফসুদ্ধ মুখ চেপে ধরল। গোঁ-গোঁ করতে থাকলুম।

তারপর কী হয়েছিল মনে নেই। নিশ্চয় আতঙ্কে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলুম। কতক্ষণ পরে দেখি, বব আর পরেশ আমার মুখে জলের ঝাঁপটা দিচ্ছে। জ্ঞান ফিরতেই বললুম, ওরা কোথায়?

বব বলল,–তা জানি না। আমরা তোমাকে খুঁজতে এসে দেখি, এখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছো তুমি। তোমার জামা ছিঁড়ে ফাই। পরেশ বলল, তোমার শটগান কী হল তোতামামা?

অতিকষ্টে বললুম,–ওই জঙ্গলে ওরা ছুঁড়ে ফেলেছে। পরেশ জঙ্গলে খুঁজে শটগানটা কুড়িয়ে আনল। তারপর ওদের সাহায্যে অতিকষ্টে নিচে নেমে এলুম। জলের পাত্র তিনটে ঠিকই ছিল। পরেশ আর বব তিনটে পাত্র ধরাধরি করে নিয়ে চলল। আমি খাপ্পা হয়ে শটগানটা থেকে পাহাড়ের চূড়ার দিকে একটা গুলি ছুড়লুম।

কিন্তু তখনও জানতুম না এরপর কী ঘটবে।

ভেলায় চেপে জাহাজে ফিরে গেলুম। জাহাজসুদ্ধ লোক ভিড় করে দাড়িবাবা বা বালখিল্যদের গল্প শুনল। কিন্তু তারা বিশ্বাস করল না। শুধু ক্যাপ্টেন হুবার্ট বললেন,–ওটার নাম ডেভিলস আইল্যান্ড কেন তা এবার জানা গেল। বব, পরেশ আর টোটা যাদের দেখেছে, তারা সেই শয়তান। যাই হোক, টোটাকে শয়তানরা ছুঁয়েছিল। টোটাকে একটা আলাদা কেবিনে রাখতে হবে। ওর গায়ে শয়তানের ভাইরাস লেগেছে। সাবধান! কথাগুলো শুনে আমি একটু ভড়কে গেলুম। তবে পুরো একটা কেবিনে একা থাকার সুযোগ পেয়ে একটু খুশিও হয়েছিলুম।

সেদিনই বিকেলে পাপুয়া দ্বীপের একটা মাছধরা ট্রলার মাছ ধরতে এসেছিল ওই অঞ্চলে। নাবিকদের পতাকা নাড়ানো দেখে তারা আমাদের জাহাজের পাশে এসেছিল। তারপর ক্যাপ্টেনের মুখে সব কথা শুনে একজন ইঞ্জিনিয়ার এবং একজন অফিসারকে ট্রলারে চাপিয়ে নিয়ে গেল।

মাঝরাতে একটা ছোট জাহাজ এসে প্রায় একমাইল উত্তরে নোঙর করেছিল। সেখান থেকে রবারের ভেলায় পালাক্রমে আমাদের জাহাজের লোকজনকে নিয়ে গেল। বাকি রইলেন শুধু ক্যাপ্টেন হুবার্ট আর আমি। ক্যাপ্টেন বললেন, আমাদের জাহাজের সব মাল খালাস করে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্রিসবেন থেকে একটা মালবাহী জাহাজ আসছে। সেটা না আসা পর্যন্ত আমাকে থাকতে হবে। আর টোটা! তোমাকে শয়তানগুলো ছুঁয়েছে। তোমাকে কারও সংস্পর্শে যেতে দেওয়া হবে না। সেই জাহাজে তুমি আমার সঙ্গে যাবে। কথা শুনে খুব মনমরা হয়ে গেলুম।

যাই হোক। কেবিনে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম শেষ রাত্রে! হঠাৎ ঘুম ভাঙার পর চমকে উঠলুম। এ কী! আমার পা পর্যন্ত জঙ্গলের মতো দাড়ি গজিয়েছে কেন? লাফিয়ে উঠে বসলুম। সেই রকম লম্বা চুল আমার মাথা থেকে পায়ের পেছন দিকে লুটিয়ে পড়ল। সর্বনাশ! আমিও যে দাড়িবাবা হয় গেছি! চিৎকার করে ডাকলুম, ক্যাপ্টেন সায়েব! ক্যাপ্টেনসায়েব! ক্যাপ্টেন হুবার্ট এসেই আমাকে দেখে রিভলভার বের করেছিলেন। বললুম,–আমি আপনার সেই নাবিক টোটা স্যার! দয়া করে গুলি করে আমাকে মেরে ফেলবেন না। ক্যাপ্টেন তখন দড়াম করে কেবিনের দরজা এঁটে বাইরে থেকে বললেন,–তালা আটকে দিচ্ছি! টোটা! তুমি টু শব্দটি করবে না। করলেই গুলি করে মেরে ফেলব। আর শোনো! তোমাকে দেখলে ব্রিসবেনে হইচই শুরু হয়ে যাবে। তাই গোপনে তোমাকে আমার চেনা এক জীববিজ্ঞানী এবং ডাক্তারের ল্যাবে নিয়ে যাব। সাবধান! টু শব্দ নয়।

–কথা না বাড়িয়ে এবার সংক্ষেপে বলি। বোনটি! তার আগে আর এক কাপ চা চাই।

মা চা করে আনতে কিচেনে চলে গেলেন। দেখলুম, বাবা মিটিমিটি হাসছেন। তোতামামা বললেন,-বলেছিলুম বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আমার মাথা, নাকের নিচেটা আর গালের অবস্থা দেখো…

চা খেয়ে তোতামিয়া তার কাহিনি শুরু করলেন।

ব্রিসবেনে জীববিজ্ঞানী এবং ডাক্তার রবার্ট স্টিলারের ল্যাবে প্রায় একমাস ধরে গোপনে আমার চিকিৎসা চলেছিল। ডাঃ স্টিলার বলেছিলেন, সলোমন আইল্যান্ড এলাকায় অনেক অদ্ভুত প্রাণী এখনও থাকতে পারে। তাদের গায়ের লোেম থেকে এরকম অদ্ভুত সংক্রামক ব্যাধি হওয়া খুবই সম্ভব। যাই হোক, আমি যে লোশন তৈরি করেছি, তার ফল পাওয়া গেছে। তবে এই নাবিকবেচারার দুর্ভাগ্য, আর ওর চুল গজাবে না। গোঁফ-দাড়ি গজাবে না। এর শরীরে আর লোম পর্যন্ত গজাবে না। কিন্তু সাবধান নাবিক! তোমাকে এখনও তিনমাস আমার লোশন মেখে স্নান করতে হবে প্রতিদিন। এর মধ্যে একদিন লোশন না মাখলে কী ঘটবে তা বলতে পারছি না। কথা শুনে কোনও প্রশ্ন করতে পারিনি। ডাঃ স্টিলার ক্যাপ্টেন হুবার্টের মতোই রগচটা মানুষ।

বলে তোতামামা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বাবা তার উপহার দেওয়া লোশন দেখিয়ে বললেন, ওহে তোতামিয়া! এই লোশন তোমার সেই লোশন নয় তো?

অমনি তোতামিয়া আগের সময়ের মতো কুঁড়ি কাঁপয়ে হেসে বললেন, না, না! আমার লোশন কবে ফুরিয়ে গেছে। ওটার গায়ে কী লেখা আছে দেখো! শেভিং লোশন।

বললুম,–আচ্ছা তোতামামা! আপনি সেই ডাক্তারকে কেন বলেননি, অন্তত গোঁফ গজানোর কোনও লোশন দিন! তোতামামা! আপনার গোঁফ না থাকলে আপনাকে যে কেউ চিনতে পারবে না।

তোতামামা বললেন,–চেপে যা পুঁটু! এ শহরে কেউ যেন টের না পায় আমার গোঁফ নেই। তাহলে কেউ আমাকে গ্রাহ্য করবে না। জানিস? আমি ছোটভাইয়ের বাড়ি ঢুকিনি। চুপিচুপি সন্ধ্যাবেলা শুধু তোদের বাড়ি এসেছি। এখনই চুপিচুপি কেটে পড়ব। কলকাতা চলে যাব।

বাবা বললেন, তা কেন? তুমি নকল গোঁফ পরে মাথায় পরচুলো চাপিয়ে নেবে।

তোতামামা হাসলেন। –তা মন্দ বলেনি। কলকাতা গিয়ে চিৎপুর থেকে যাত্রা-থিয়েটারের দোকানে গোঁফ-পরচুলো কিনে বরং ফিরে আসব। ইশ! এই সামান্য বুদ্ধিটা মাথায় কেন যে আসেনি! আসলে পুটুকে বইগুলো দেওয়ার জন্য আমার তর সইছিল না। হা–আসলে সেই দাড়িবাবারা! শয়তানগুলো আমার বুদ্ধিসুদ্ধি শেষ করে দিয়েছে।

বলে তোতামিয়া ব্যাগ থেকে টুপি বের করে মাথায় চাপিয়ে তক্ষুনি বেরিয়ে গেলেন।…..

একটু পরিশিষ্ট আছে। তোমামা সত্যি নকল গোঁফ আর পরচুলো পরে ফিরে এসেছিলেন। আমি, বাবা, মা–কেউই রটিয়ে দিইনি ব্যাপারটা। বরং খুশিই হয়েছিলুম। সেই পেস্লায় গোঁফ ছাড়া কি তোমামা আর তোতামামা থাকেন? সুকুমার রায়ের পদ্যে পড়েছিলুম না? গোঁফের আমি গোঁফের তুমি, গোঁফ দিয়ে যায় চেনা!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress