পর্ব – ১০
কন্ট্রোল রুম-এর এসি এতটাই জোরালো যে, জিশানের শীত করতে লাগল।
ঘরে পাঁচজন সিকিওরিটি অফিসার বিভিন্ন স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে একমনে কাজ করছিল। ওদের পরনে গাঢ় নীল ইউনিফর্ম—তার কোনও-কোনও জায়গায় সাদা বিডের লাইনিং।
এ ছাড়া আরও একজন অফিসার ঘরের ডানদিকের এককোণে একটা অল-গ্লাস কিউবিকলে বসে ছিল। তার সামনের টেবিলে একটা আর্ক কম্পিউটার স্ক্রিন। লম্বা, ধনুকের মতো বাঁকানো তার এল. সি. ডি. পরদা।
জিশানরা ঘরে ঢুকতেই কিউবিকলের অফিসার চোখ তুলে তাকাল। এবং পরমুহূর্তেই চটপট আঙুল চালিয়ে কম্পিউটারের কিবোর্ডের কয়েকটা বোতাম টিপে দিল। তারপর একগাল হেসে উঠে দাঁড়াল।
কিউবিকলের বাইরে বেরিয়ে এল অফিসার।
মাথায় কাঁচাপাকা চুল। তামাটে মুখে হাসির ভাঁজ। লম্বা-চওড়া চেহারা। দেখে সিকিওরিটি অফিসার বলে সমীহ হয়।
ভদ্রলোকের কোমরে কালো রঙের পার্টিকল গান। এই বন্দুকের সুইচ টিপলেই হাই-এনার্জি পার্টিকল স্ট্রিম বেরিয়ে আসে। শত্রুকে অকেজো করে দেয়। পিস ফোর্সের উঁচু স্তরের অফিসাররা এই বন্দুক ব্যবহার করে।
‘হাই, জিশান।’ বলে জিশানের দিকে হাতে বাড়াল অফিসার : ‘উইশ য়ু লাক ইন কিল গেম।’
হ্যান্ডশেক করে জিশান বলল, ‘থ্যাংকস।’
এবার পান্ডা আর মূর্তির দিকে তাকিয়ে অফিসার বলল, ‘তোমরা এ-ঘরে ঢোকামাত্রই এই গেস্টহাউস বিল্ডিং-এর চারটে অডিয়ো-ভিশুয়াল সারভেইল্যান্স জোন আমি ডি-অ্যাক্টিভেট করে দিয়েছি। ফলে এখানে জিশানকে কেউ ওয়াচ করতে পারবে না। তা ছাড়া সিকিওরিটি সেন্ট্রালের তিনটে অফিসে আমার কোর লিডারদের সঙ্গে কথা বলা আছে। ওরা তো এককথায় রাজি…।’
পান্ডা জিশানের দিকে তাকিয়ে চোখ নাচাল। ছোট্ট করে বলল, ‘জিশান ম্যাজিক।’
জিশান ঠোঁটে হাসল।
এরপর জিশানকে ‘তৈরি’ করার পালা।
পান্ডা আর মূর্তি জিশানকে খোলসা করে কিছু বলেনি। কিন্তু ওকে পাশের একটা ছোট ঘরে নিয়ে গিয়ে ওরা যা শুরু করল সেটা থিয়েটারের গ্রিনরুমকেও হার মানায়। অফিসারটির তত্বাবধানে আনমোল নামে একজন সিকিওরিটি গার্ড জিশানের ভোল পালটানোর কাজে হাত দিল।
পান্ডা আর মূর্তি নিজেদের মধ্যে গল্প করছিল। আর পান্ডা মাঝে-মাঝেই শ্রীধর পাট্টার মুণ্ডপাত করে উত্তেজিত সব মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছিল।
প্রথমে জিশানকে বলা হল, জামাকাপড় ছেড়ে সিকিওরিটি গার্ডের ইউনিফর্ম পরে নিতে।
অফিসার পান্ডাকে লক্ষ করে বলল, ‘জানো, এই স্পেয়ার ইউনিফর্মটা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে স্টোর থেকে ম্যানেজ করতে হয়েছে। প্রত্যেকটা ইউনিফর্মে ম্যাগনেটিক সেন্সর লাগানো আছে। আমি রূপমকে বলেছিলাম। ও স্টোরের সারভেইল্যান্স চিফ। ও হেলপ না করলে হত না।’
জিশান ইউনিফর্মটা পরতে-পরতে অচেনা রূপমকে ধন্যবাদ দিল। ওর মনে হল, এই অন্যরকম প্রতিবাদী মানুষগুলো জিশানকে সাহায্য করেই সিন্ডিকেটের অবিচারের বিরুদ্ধে ওদের প্রতিবাদ জানাচ্ছে। জিশান কিল গেমে কোয়ালিফাই করে গার্ডদের সহানুভূতি জিতে নিয়েছে। ফাঁসির আসামির শেষ ইচ্ছে পূরণের মতোই ওরা জিশানের ‘শেষ’ ইচ্ছেগুলো পূরণ করে চলেছে।
গার্ডের সাহায্যে কয়েকমিনিটের মধ্যেই জিশানের পোশাক বদল শেষ হল। অফিসার ওকে শকার, স্মার্ট কার্ড সব দিল। হেসে বলল, ‘ওই আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াও। নিজেকে একবার দেখে নাও—।’
একটা মেটাল ক্যাবিনেটের খোলা পাল্লার ভেতরদিকে একটা ঝকঝকে আয়না লাগানো ছিল। জিশান আয়নাটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
কী আশ্চর্য! একটা কালো ইউনিফর্ম জিশানকে কী সাংঘাতিক পালটে দিয়েছে। এখন ও বলতে গেলে নিউ সিটির নিরাপত্তার যান্ত্রিক ব্যবস্থার একটা অংশ হয়ে গেছে।
গার্ড জিশানের কাছে এসে দাঁড়াল। ওর হাতে ছাই রঙের একটা মেকাপ বক্স। বলল, ‘এবার একটু হালকা মেকাপ…ব্যস…।’
পান্ডা হেসে বলল, ‘আনমোল একসময় যাত্রাদলের মেকাপম্যান ছিল। তারপর পেটের দায়ে এই বেশি মাইনের হতচ্ছাড়া চাকরিতে এসেছে। ওর মেকাপ কমপ্লিট হওয়ার পর তোমার ওয়াইফই তোমাকে আর চিনতে পারবে না—শ্রীধরের বাচ্চা তো কোন ছাড়!’
আনমোলের দিকে তাকাল জিশান। বয়েস তিরিশ ছুঁয়েছে কি না সন্দেহ। ফরসা মুখে ব্রণের দাগ। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। মুখ থেকে পেপারমিন্টের গন্ধ বেরোচ্ছে। চোখ ছোট-ছোট, তবে নজর তীক্ষ্ণ।
দক্ষ হাতে জিশানের মুখে কাজ শুরু করল আনমোল।
ঘরের দেওয়াল-ঘড়ির হিসেবে সময় লাগল উনিশ মিনিটের কয়েকসেকেন্ড বেশি। কিন্তু ওই অল্প সময়েই আনমোল জিশানকে পালটে দিল।
পান্ডা আর মূর্তি ওদের ‘নাইট সাফারি’-র প্ল্যান নিয়ে অফিসারের সঙ্গে আলোচনা করছিল। অফিসার বলল, ‘বেশি রিসক নেওয়ার দরকার নেই। শুধু সেফ জায়গাগুলোই জিশানকে ঘুরিয়ে দেখাও। নানান জোনের গার্ডদের সঙ্গে ওকে মিশিয়ে দেবে। তা হলেই ওকে আর কেউ নজর করতে পারবে না। নইলে…বুঝতেই তো পারছ…যদি আমাদের মার্শাল কোনওরকমে ব্যাপারটা টের পায় তা হলে আমরা কেউই আর বাদ যাব না। একজন ধরা পড়লেই ও টরচার করে তার পেটের সব কথা বের করে নেবে। একটা লোককে কী করে না মেরেও মেরে ফেলা যায় সেটা শ্রীধর পাট্টা ভালো করেই জানে। সুতরাং, কেয়ারফুল…।’
অফিসারের সঙ্গে কথা শেষ করে পান্ডা আর মূর্তি জিশানকে নিয়ে সিকিওরিটি কন্ট্রোল রুম থেকে বেরিয়ে এল। করিডর ধরে হাঁটতে শুরু করল।
চকচকে বাদামি গ্রানাইট পাথর বসানো মেঝেতে আয়নার মতো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছিল। জিশানের দুপাশে পান্ডা আর মূর্তি। প্যারেডের মতো সমান তালে পা মিলিয়ে ব্যস্তভাবে হেঁটে চলেছে। দেখে মনে হবে, ওরা কোনও মিশনে চলেছে। কন্ট্রোল রুমের অফিসার পান্ডা আর মূর্তিকে ঠিক এইভাবে হেঁটে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। জিশানের নিরাপত্তার জন্য এটা ওদের একরকম ছদ্মবেশ।
করিডরের দৈর্ঘ্য শেষ হতেই কয়েকধাপ সিঁড়ি। তারপর স্মার্ট ডোর। নির্দিষ্ট স্লটে নিজের স্মার্ট কার্ড সোয়াইপ করল মূর্তি। দরজা খুলে গেল। সামনেই খোলা চত্বর। চত্বরের বাইরে একফালি মিহি ঘাসজমির পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা কিউ-মোবাইল। তার গায়ে সিন্ডিকেটের লোগো আঁকা।
জিশান চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল।
জায়গাটা একদম ফাঁকা এবং অন্ধকার। পান্ডা চাপা গলায় বলল যে, এটা গেস্টহাউসের পিছনদিক। এদিকটায় শুধু গার্ডরাই চলাফেরা করে। ওদের ব্যবহারের জন্য যেসব কিউ-মোবাইল গেস্টহাউসে আসা-যাওয়া করে সেগুলো এখানেই পার্ক করা হয়। এখানে এসে গাড়িগুলো থামে, গার্ডরা ওঠা-নামা করে।
জিশানদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কিউ-মোবাইলটার কাছ থেকে প্রায় পঞ্চাশ মিটার দূরে আরও ছ’টা কিউ-মোবাইল পার্ক করা রয়েছে। পার্কিং জোনে লাল আলো জ্বলছে। বুঝিয়ে দিচ্ছে এটা ‘রেড অ্যালার্ট’ জোন।
দূরে চারজন গার্ডকে দেখতে পেল জিশান। ওদের দিকে ইশারা করে পান্ডা হাত নাড়ল। ওরাও হাত নেড়ে জবাব দিল।
গাড়িটার কাছাকাছি গিয়ে পান্ডা পকেট থেকে একটা রিমোট বের করে বোতাম টিপল।
কিউ-মোবাইলের চারটে দরজা ডানার মতো খুলে গেল। জিশান দেখল, গাড়িতে কেউ নেই। তা হলে গাড়িটা চালাবে কে?
চোখে এই প্রশ্ন নিয়ে পান্ডার দিকে তাকাল জিশান।
পান্ডা হাসল। বলল, ‘আমি চালাব। কোনও ভয় নেই। আমার এই গাড়ি ড্রাইভিং-এর লাইসেন্স আছে। অনেক গার্ডকেই কিউ-মোবাইল ড্রাইভিং-এর ট্রেনিং দেওয়া হয়। কেউ সে-ট্রেনিং নেয়, কেউ নেয় না।’
পান্ডা পাইলটের সিটে বসে পড়ল। ওর বাঁ-পাশে জিশান। আর তার পর মূর্তি। শকারগুলো খুলে ওরা গাড়ির পিছনের সিটে রেখে দিল।
রিমোট টিপতেই গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
পান্ডা গাড়ি স্টার্ট দিল। সঙ্গে-সঙ্গে অটোমেটিক এসি চালু হয়ে গেল।
দক্ষ হাতে গাড়িটাকে চওড়া রাস্তায় নিয়ে এল পান্ডা। তারপর মসৃণ পথ ধরে নি:শব্দে গাড়ি ছোটাল।
একটু পরে পান্ডা আপনমনে বলতে লাগল, ‘জানো ভাই, জিশান, ছোটবেলা থেকেই আমার গাড়ি চালানোর খুব শখ। আমার বাপের গাড়ি রং করার দোকান ছিল। তো ওইসব পুডিং ঘষা রং চটা গাড়ি—লুকিয়ে ওগুলোর চাবি নিয়ে চালাতাম। টের পেলেই বাপ খ্যাঁচখ্যাঁচ করত। বলত, খদ্দেরদের গাড়ি। আমি পাত্তা দিতাম না। গাড়ি আমাকে টানত।’
মূর্তি বলল, ‘শুরুর দিকে ও সিন্ডিকেটের গাড়ি চালাত। একটা অ্যাক্সিডেন্ট করার পর থেকে সিকিওরিটি গার্ড হয়েছে।’
‘যাকগে, ওসব বাদ দাও—’ জিশানকে কনুইয়ের খোঁচা দিল পান্ডা : ‘নিউ সিটির কী-কী দেখবে বলো…।’
জিশান পান্ডার দিকে তাকাল। অন্ধকারে আবছা পান্ডার মুখ। তার ওপরে রাস্তার মেটাল ল্যাম্প থেকে ছিটকে আসা আলোর হাইলাইট।
কী বলবে জিশান? বাড়ির ঠিকানা, আর বাবার চোখের জল—নিউ সিটির এটুকুই তো মনে আছে!
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ও বলল, ‘এন—টুয়েলভ কমা থার্টি সিক্স। এই ঠিকানায় আমি থাকতাম। আজ থেকে প্রায় দেড়যুগ আগে।’
‘তাই?’ অবাক চোখে জিশানের দিকে তাকাল মূর্তি। পান্ডাও।
নিউ সিটিকে অনেকগুলো ছোট-ছোট জোনে ভাগ করা আছে। জোনগুলোর নাম এ, বি, সি, ডি ইত্যাদি। এইরকম প্রতিটি জোনের এক-একটি অঞ্চলের নির্দিষ্ট স্থানাঙ্ক বা কো-অর্ডিনেট আছে। সেই সংখ্যা দিয়েই কোনও জোনের একটি বিশেষ এলাকা চিহ্নিত করা হয়। জিশানের শুধু এটুকুই মনে আছে : এন—টুয়েলভ কমা থার্টি সিক্স।
জিশান সংক্ষেপে ওর ছোটবেলার কথা বলতে লাগল।
গেম পার্টিসিপ্যান্টস ক্যাম্পাস পেরিয়ে কিউ-মোবাইল অনেকক্ষণ আগেই বড় রাস্তায় এসে পড়েছিল। রাস্তার দু-ধারের আলোয় ছবির মতো পথটা দেখতে পাচ্ছিল জিশান। কালচে রুপোলি রং। ধাতুর পাতের মতো চকচকে। তারই ওপরে ছোট-ছোট বুটি। ঠিক যেন ব্যাঙের চামড়া। গাড়ির চাকা এই রাস্তায় সহজে পিছলে যাবে না। বাড়তি ঘর্ষণ গুণাঙ্ক সেই নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবে।
রাস্তায় বড়-বড় ইলেকট্রনিক বিলবোর্ড চোখে পড়ছিল। সেগুলোর বেশিরভাগই প্রসাধন আর নেশার হরেকরকম উপকরণের বিজ্ঞাপন। জিশান অবাক হয়ে দেখছিল, বিজ্ঞাপনের চলমান ছবিগুলো ঠিক যেন আসলের মতো—ত্রিমাত্রিক।
মূর্তিকে সে-কথা জিগ্যেস করতেই ও বলল, ‘এখানে নিয়মিত ফরেন টেকনোলজি কেনা হয়। কথায়-কথায় সবাই জাপান আর আমেরিকা দেখায়। ওই বিজ্ঞাপনের ছবিগুলো সব হলোগ্রাম ইমেজ…তাই ওরকম আসলের মতো দেখাচ্ছে।’
একটু পরেই রঙিন হলোগ্রাম ইমেজ দেখে-দেখে জিশানের চোখ সয়ে গেল।
কিন্তু শুধু বিলবোর্ড নয়, নানান অফিস বিল্ডিং-এর চেহারা আর আলোকসজ্জা দেখেও তাক লেগে যায়। মনে হয় যেন শহরটা সৌন্দর্যে স্বর্গের খুব কাছাকাছি। যদিও স্বর্গের সৌন্দর্য কেমন জিশান জানে না।
ওল্ড সিটির কথা মনে পড়ে গেল জিশানের। কষ্ট হল। মনে হল, একটা লেসার বিলবোর্ডের খরচ দিয়ে ওর শহরের দশটা গরিব পরিবারের একমাস খাওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এরকম একটা সুন্দর বিল্ডিং-এর বদলে ওল্ড সিটিতে অনায়াসে গড়ে তোলা যায় দুটো ভদ্রস্থ হাসপাতাল, কিংবা হাফডজন স্কুল।
কিউ-মোবাইল ছুটছিল। আর জিশান মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এতটাই আকর্ষণীয় হতে পারে! আধুনিক এই প্রযুক্তির পাশাপাশি কী সাংঘাতিক ওইসব আদিম হিংস্র খেলা! বাইরের এই রঙিন সুন্দরের আড়ালে কী অদ্ভুতভাবেই না ঘাপটি মেরে বসে আছে ভয়ংকর কুৎসিত!
জিশানের বমি পেয়ে গেল। আচমকা ‘ওয়াক’ তুলল দুবার।
মূর্তি জিগ্যেস করল, ‘কী হল?’
জিশান মুখে হাত চাপা দিয়ে কাশল, বলল, ‘কিছু না।’
পান্ডা ওর দিকে একবার তাকাল শুধু—কিছু বলল না।
দশ কি পনেরো সেকেন্ডের মধ্যে পান্ডা গাড়িটাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে এল যাকে স্বপ্নের জগৎ ছাড়া আর কিছু বলে ভাবা যায় না। একটা বিশাল এলাকা জুড়ে নানান উচ্চতার বিমূর্ত ছাঁদের বাড়ি। তার সর্বত্র উৎসবের আলোকমালা। হাজার রঙের লেসার-ছবি বাড়িগুলোর গায়ে অদ্ভুত ছন্দে চলে-ফিরে বেড়াচ্ছে।
পান্ডা পার্কিংজোনে গাড়িটা পার্ক করতে-করতে বলল, ‘এই কমপ্লেক্সটার নাম ”ই-ল্যান্ড”—এনটারটেইনমেন্ট ল্যান্ড। ফূর্তি-জোনও বলতে পারো। চার কিলোমিটার বাই চার কিলোমিটার এলাকা। টুয়েন্টি ফোর সেভেন খোলা…।’
রিমোট দিয়ে গাড়ির দরজা খুলল পান্ডা। নামতে-নামতে মূর্তিকে বলল, ‘এই, শকারগুলো নিয়ে নে। কোমরে ঝোলাতে হবে।’
জিশান আর মূর্তি অন্য দরজা দিয়ে নামল। পিছনের সিট থেকে শকারগুলো তুলে নিল মূর্তি। জিশানকে একটা দিল, আর বাকি দুটো হাতে করে পান্ডার কাছে গেল।
পান্ডা কিউ-মোবাইলের দরজা বন্ধ করল। তারপর রিমোটের অন্য একটা বোতাম টিপে গাড়িটা ‘ফার্মলক’ করে দিল।
জিশান অবাক হয়ে সুবিশাল ইলেকট্রনিক হাঙ্গামার দিকে তাকিয়ে ছিল। যেদিকে দু-চোখ যায় সেদিকেই এনটারটেইনমেন্ট। নন-স্টপ বিনোদন।
চঞ্চল আলোর রঙিন আভা জিশান, পান্ডা আর মূর্তির মুখে খেলা করছিল।
ওরা তিনজনে এগোল ‘ই-ল্যান্ড’-এর দিকে। দেখে মনে হচ্ছিল, পিস ফোর্সের তিনজন গার্ড ব্যস্তভাবে ডিউটিতে চলেছে।
স্বপ্নের জগতে ঢুকে পড়ল জিশান। ওর মনে হল, ও অলৌকিক কোনও শহরে এসে পড়েছে। যেখানে অটোমেশান, ইলেকট্রনিক্স আর অপটিকস তাদের ‘ছলাকলা’র মরণপণ প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
পান্ডা আর মূর্তির সঙ্গে হাঁটছিল জিশান। সব জায়গায় স্মার্ট কার্ড সোয়াইপ করার ব্যাপারটা ওরা দুজন সামলাচ্ছিল। আর জিশান ওপরদিকে তাকিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে আশ্চর্য জগতের অভিঘাতটা শুষে নেওয়ার চেষ্টা করছিল।
পান্ডা ওকে বলছিল, ‘…এখানে দোকানপাট আছে, ব্যাঙ্ক আছে, ক্লাব আছে, গেমস পারলার আছে, নকল সমুদ্র আছে, সি-বিচ আছে…কী নেই!’
কথা বলতে-বলতে একটা মল-বিল্ডিং-এর গ্রাউন্ড ফ্লোরে ঢুকে পড়ল ওরা।
চারিদিকে শুধু কাচ আর কাচ, আলো আর আলো। আলো যেমন নানান রঙের, কাচের দেওয়ালগুলোও তাই। এ ছাড়া রয়েছে স্বচ্ছ ফাইবারের সিঁড়ি আর মেঝে। সিঁড়ি চলছে, কোথাও-কোথাও মেঝেও।
তাজ্জব জিশানকে নিয়ে এদিক-সেদিক ঘুরিয়ে দেখাতে লাগল পান্ডা আর মূর্তি। তারপর একটা গেমস পারলারের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। পারলারের কাচের দেওয়ালের দিকে আঙুল দেখিয়ে মূর্তি বলল ‘ওই দ্যাখো—।’
জিশান তাকাল। এবং নিজেকে দেখতে পেল।
কাচের দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে, পারলারের ভেতরে জায়ান্ট টিভি চলছে এবং সেখানে জিশানকে দেখা যাচ্ছে।
পান্ডা জিশানের হাত ধরে টানল। ওরা তিনজন পারলারে ঢুকে পড়ল।
জিশান অবাক হয়ে দেখল, টিভিতে কিলগেমের প্রাোমো চলছে। তাতে জিশানের নানারকম ক্লিপিংস দেখানো হচ্ছে। জিশান ঘরে পায়চারি করছে, খেলার মাঠে বল খেলছে, অ্যানালগ জিমে ব্যায়াম করছে, কানে হেডফোন লাগিয়ে শুটিং প্র্যাকটিস করছে, কমব্যাট পার্কে কোমোডো ড্রাগনের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে, টিভি ক্যামেরাম্যানকে দু-হাতে মাথার ওপরে তুলে নিয়েছে, স্নেক লেকে প্রাণপণে দৌড়চ্ছে, জাব্বার সঙ্গে মরিয়া লড়াই চালাচ্ছে…।
এবং তারপর কিল গেমের বিজ্ঞাপন। খুব শিগগিরই কিল গেমের দিনক্ষণ জানানো হবে। সেই খেলার সিধা প্রসারণের সময় যাঁরা বিজ্ঞাপন দিতে চান তাঁরা অন-লাইনে বুকিং করুন। তারপরই পরদায় ফুটে উঠছে কয়েকটি ওয়েবসাইট আর সাইবার লিংকের অ্যাড্রেস।
পারলারে ভিড় ছিল। নানান বিচিত্র গেম খেলায় ব্যস্ত নানাবয়েসি ছেলে-মেয়ে। তা ছাড়া আরও অনেকে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছিল। জিশান লক্ষ করল, ওকে নিয়ে কিল গেমের প্রাোমো চলছে দেখে টিভির সামনে ভিড় বাড়ছিল। এবং টিভিতে ওর মুখ দেখানোমাত্রই হইচইয়ের জোয়ার উঠছিল।
আশপাশের মানুষজনের কথা শুনতে পাচ্ছিল জিশান।
কেউ ওর বডির প্রশংসা করছিল। কেউ বলছিল, ‘লোকটাকে কী হ্যান্ডসাম দেখতে!’ কেউ বলছিল, জাব্বার মতো একজোড়া পালোয়ানের সঙ্গে ও অনায়াসে মহড়া নিতে পারে। আবার আর-একজনের মন্তব্য : ‘আমার মনে হচ্ছে ছেলেটা কিল গেমে জিতে যাবে…।’
পান্ডা জিশানকে খোঁচা দিল। জিশান ওর দিকে ফিরে তাকাতেই পান্ডা চোখ ঠারল। যার অর্থ হল : ‘দেখছ, সবাই তোমার কথা বলছে!’
যতক্ষণ কিল গেমের প্রাোমো চলল ততক্ষণ টিভির সামনে ভিড় লেগে রইল। দর্শকদের উচ্ছ্বাস জিশানকে অবাক করে দিল। গার্ডরা ওকে যে পছন্দ করে তার পিছনে হয়তো শ্রীধর পাট্টাকে অপছন্দের কারণ রয়েছে। কিন্তু পারলারে বিনোদনের সন্ধানে আসা জনগণ? ওরা কি চাইছে জিশানের ভালো হোক, জিশান জিতুক? নাকি আসলে চাইছে কিল গেম জমে উঠুক?
পান্ডা আর মূর্তির হাত ধরে টান মারল জিশান। তারপর ওরা তিনজনে গেমস পারলার থেকে বেরিয়ে এল।
মূর্তি বলল, ‘জিশান, তোমাকে নিয়ে লোক কিন্তু হেভি এক্সাইটেড। তোমার বিজ্ঞাপনগুলোও পাবলিককে হেভি টানছে…।’
‘বিজ্ঞাপন? তার মানে?’ জিশান অবাক হয়ে মূর্তিকে দেখল।
তখন পান্ডা বলল, ‘প্রায় একমাস ধরে সিন্ডিকেট এই কাজটা শুরু করেছে। তোমার ডিফারেন্ট টাইপের ক্লিপিংস দেখিয়ে তার ফাঁকে-ফাঁকে নানান প্রাোডাক্টের অ্যাড চলছে। এরপর…কিল গেমের আগে…তোমাকে নিয়ে ক’দিন শুটিং চলবে। নতুন-নতুন জিনিসের বিজ্ঞাপন। গেঞ্জি-জাঙ্গিয়া থেকে শুরু করে প্রাোটিন ফুড আর ক্রাঞ্চি মিল পর্যন্ত…।’
জিশান চুপ করে রইল। একটা ক্লাবের পাশ দিয়ে ওরা হেঁটে যাচ্ছিল। তার কাচের দেওয়ালে রঙিন এল. সি. ডি. ডিসপ্লে-তে ইংরেজিতে লেখা ‘ফানডম’। তার নীচে লেখা : ‘ডু নট এন্টার ইফ য়ু আর অ্যাবাভ সিক্সটিন।’
জিশান সেদিকে তাকিয়ে আছে দেখে পান্ডা হেসে বলল, ‘ ”ই-ল্যান্ড”-এ যে ক’টা ক্লাব আছে তার একটার নামও নাইট ক্লাব নয়। কেন জানো?’
জিশান পান্ডার দিকে তাকিয়ে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল। জানে না।
পান্ডা আর মূর্তি এ-ওর গায়ে চাপড় মারল, হাসাহাসি করল। তারপর মূর্তি বলল, ‘ক্লাবগুলো দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে বলে এগুলোর নাম নাইট ক্লাব নয়।’
‘তা ছাড়া নানান ক্লাবের নানারকম বয়েসের লিমিট আছে।’ পান্ডা বলল। আঙুল তুলে ‘ফানডম’-এর নীচের লেখাটা দেখাল: ‘ওই যে…ওইরকম।’
এরপর ”ই-ল্যান্ড”-এর আরও অনেকগুলো বিল্ডিং ঘুরে দেখল ওরা। ট্রান্সপারেন্ট ফাইবারের এসক্যালেটরে চড়ে বহুবার ওপর-নীচ করল। হরেকরকম বিনোদনের পসরা দেখে জিশানের চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছিল। বেশ কয়েকটা দোকানে জায়ান্ট স্ক্রিন টিভিতে নিজেকে দেখতে পেল জিশান। ওকে নিয়ে তৈরি দু-তিনটে বিজ্ঞাপনও দেখল।
আশ্চর্য! এই বিজ্ঞাপনের ব্যাপারটা ও কিছুই জানে না!
পান্ডা আপনমনে বলল, ‘তোমাকে সিন্ডিকেট প্রাইজ মানি দিচ্ছে ঠিকই—কিন্তু সেই টাকা কড়ায়-গন্ডায় উশুল করে নিচ্ছে। তোমাকে নিয়ে ওরা মিডিয়া হাইপ তৈরি করছে। কিল গেমের ব্যাপক পাবলিসিটি করছে—যাতে প্রচুর অ্যাড পাওয়া যায়।’
জিশান চুপ করে রইল। সিন্ডিকেটের অঙ্কটা মনে-মনে বোঝার চেষ্টা করল। বিজ্ঞাপনের শুটিং করতে হবে ওকে! ওকে পাবলিসিটি দিয়ে জনপ্রিয় করে তুলে তারপর ফায়দা তোলার পালা। আর সবশেষে রয়েছে পাঁঠাবলির লাইভ টেলিকাস্ট।
‘ই-ল্যান্ড’ থেকে বেরিয়ে ওরা কিউ-মোবাইলে উঠে আবার রওনা দিল। নানান রাস্তা ঘুরে জিশানের ছোটবেলার বাড়ির কাছে পৌঁছে গেল।
জায়গাটা দেখে জিশানের বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। পুরোনো কিছুই আর নেই। নতুন-নতুন সব বাড়ি-ঘর তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।
‘এইখানে একটা দোতলা বাড়ি ছিল। সেই বাড়িতে আমি থাকতাম।’ পান্ডার দিকে তাকিয়ে বলল জিশান। মনে-মনে ও ছোটবেলায় ফিরে যাচ্ছিল। ওদের বাড়িটা ঠিক কোন জায়গায় ছিল সেটা আঁচ করার চেষ্টা করছিল।
রোজ ঘুম থেকে উঠে যে-বারান্দাটায় গিয়ে ও দাঁড়াত সেটা কোনদিকে ছিল যেন? সূর্যটা কোনদিক থেকে ওঠে? কোনটা পুবদিক?
আকাশের দিকে তাকাল জিশান। একটুকরো চাঁদ, তারা, আর অন্ধকার। পুবদিক কোনদিকটা হতে পারে সেটা আন্দাজ করে ‘বারান্দা’টা আবার খুঁজল। পেল না।
সবকিছু কেমন গুলিয়ে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল জিশান। শুধু বিড়বিড় করে বারবার বলতে লাগল, ‘এইখানে আমাদের বাড়ি ছিল। এইখানে…আমাদের… বাড়ি…ছিল…।’
বাবার ডাক শুনতে পেল জিশান। বাবা ওকে ডাকছে : ‘জিশু! জিশু—!’
জিশান চোখ মুছল। চোয়াল শক্ত করল। পুরোনো মুছে গিয়ে ভালোই হয়েছে। মনে-মনে ভাবল জিশান। পুরোনো সবকিছু থাকলে স্মৃতি ওর চোখের জলে আরও ঢেউ তুলত। ‘পুরোনো’কে ঝাপসা করে দেওয়ার জন্য ‘নতুন’কে ধন্যবাদ জানাল। মনটা আরও শক্ত করতে চাইল।
শহরের আরও অনেক জায়গা ঘুরিয়ে দেখানোর পর কিউ-মোবাইল জিপিসি-র পথ ধরল। এই কয়েকঘণ্টার শহর ভ্রমণে জিশান নিজের অনেক ছবি দেখেছে। বেশ কয়েকটা বিলবোর্ডেও জিশান পালচৌধুরী হাজির। চারিদিকে ওর এত ছবি!
‘ছবি’ হয়ে যাওয়ার আগে এখানে বোধহয় এরকমটাই হয়।
•
গেস্টহাউসে নিজের রুমে ফিরে আসার পর জিশানের খুব ক্লান্ত লাগছিল—তবে চোখে ঘুম আসছিল না। অন্ধকার ঘরে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে ছিল। চোখের নজর ঘরের সিলিং-এর দিকে। সেদিকে তাকিয়ে এক অন্ধকার সিনেমার পরদায় ও যেন নিজের জীবনের ছায়াছবি দেখছিল।
গত কয়েকটা মাসে কত ঘটনাই না ঘটে গেছে ওর জীবনে! ওর ওল্ড সিটির বস্তিবাড়িতে শ্রীধর পাট্টা হাজির হওয়ার পর থেকেই শান্ত সুন্দর জীবনটা কেমন বদলে গেল। ওর ওল্ড সিটির হতমান অবস্থার মধ্যে কোনও সৌন্দর্য ছিল না ঠিকই, কিন্তু ওর জীবনের ভেতরে সৌন্দর্য ছিল।
আর এখানে! নিউ সিটির অঙ্গসজ্জায় সৌন্দর্যই প্রথম এবং শেষ কথা। কিন্তু তার গভীরতা শরীরের ত্বক পর্যন্তই। তারপর…ত্বকের গভীরতার পর থেকেই শুরু হয়ে গেছে কুৎসিতের জয়জয়কার। তাই কিল গেমে ‘মৃত্যুপথযাত্রী’ জিশানকে নিয়েও ওরা নির্লজ্জ ব্যাবসা শুরু করে দিয়েছে।
কেন জানি না, জিশান মনে-মনে ভীষণ ভেঙে পড়ছিল। আর কতদিন…আর কতদিন ও কুৎসিতের সঙ্গে এরকম মরিয়া লড়াই চালিয়ে যেতে পারবে?
কিল গেম পর্যন্ত সুপারগেমস কর্পোরেশন জিশানকে নিয়ে চূড়ান্ত ব্যাবসা করবে। তারপর…কিল গেম শেষ হলে…অথবা, জিশান শেষ হলে…ওরা নতুন আর-একজন ‘সুপারহিরো’র সন্ধানে নেমে পড়বে।
কিন্তু ওই তিনটে খুনির সঙ্গে ‘ক্যাট অ্যান্ড মাউস’ গেমে জিশান যদি জিতে যায়!
তা হলে জিশান হয়ে যাবে ‘মেগা সুপারহিরো’। ওকে নিয়ে সিন্ডিকেট আরও কিছুদিন রমরমা ব্যাবসা চালাবে। প্রাইজমানি ছাড়াও ওকে নিউ সিটির একটা ফ্ল্যাট গিফট করবে। আরও সব নানান কোম্পানি ওকে হরেকরকম উপঢৌকন দেবে। তার মধ্যে গাড়ি তো আছেই! তা ছাড়াও থাকবে আধুনিক জীবনযাত্রার নানান সরঞ্জাম।
তখন মিনি আর শানুকে নিয়ে জিশান ওল্ড সিটি ছেড়ে চলে আসতে পারবে। চিরকালের জন্য। দু:খের জগৎ থেকে ওরা তিনজন চলে আসবে সুখের জগতে।
কিন্তু ওল্ড সিটির বাকি মানুষজন? ওরা কি ছন্নছাড়া জীবন আর অভাবের জাঁতাকলে পিষে মরবে?
যতই চিন্তা করছিল ততই জিশানের পাগল-পাগল লাগছিল। ও বিছানায় ছটফট করতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর ও বিছানায় উঠে বসল। বল রিমোটের বোতাম টিপে ঘরের আলো জ্বেলে দিল। তারপর দেওয়ালের প্লেট টিভিটার দিকে তাকাল।
জিপিসি-র এই গেস্টহাউসে আসার পর জিশান প্রথম দু-এক সপ্তাহ নানান চ্যানেলের প্রাোগ্রাম দেখেছিল। তারপর থেকে ও গেমস-এর চ্যানেল আর চালায় না। ওইসব চ্যানেল দেখলে ওর মনের ওপর চাপ পড়ে। তাই ও নিয়ম করে দু-চারটে নিউজ চ্যানেল ছাড়া অন্য কোনও চ্যানেল আর দ্যাখে না। আর বেশিরভাগ সময় টিভিটাকে অন-লাইন ইনটারঅ্যাকটিভ মোডে রাখে, যাতে সিন্ডিকেট বা সুপারগেমস কর্পোরেশনের সঙ্গে ওর যোগাযোগ থাকে। এ ছাড়া টিভিটাতে একটা অদ্ভুত ব্যবস্থা আছে—সিন্ডিকেট যখন ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায় তখন যদি টিভিটা অফ থাকে তা হলে সেটা নিজে থেকেই অন হয়ে যায় এবং ইনটারঅ্যাকটিভ চ্যানেল চালু হয়ে যায়।
আর টিভি যদি চালু থাকে এবং তাতে অন্য চ্যানেল চলতে থাকে, তা হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চ্যানেল সোয়াপ হয়ে গিয়ে ইনটারঅ্যাকটিভ চ্যানেল পরদায় চলে আসে।
টিভির দিকে তাকিয়ে জিশান ওর আজকের নাইট সাফারির কথা ভাবছিল। ভাবছিল, ওকে নিয়ে বিজ্ঞাপনদাতাদের মাতামাতির কথা।
রিমোটের বোতাম টিপে টিভি অন করে দিল জিশান। চ্যানেল সার্ফ করে একটা গেমের চ্যানেলে গিয়ে থামল। লাইভ টেলিকাস্ট নয়—সেখানে তখন একটা ‘হাংরি ডলফিন’ গেমের ভিডিয়ো রেকর্ডিং দেখাচ্ছে। সমুদ্রের জলে ডলফিনের সঙ্গে মিশে আছে ডলফিনের ‘ছদ্মবেশ’ নেওয়া হিংস্র হাঙর। তাদের মধ্যে সাঁতারে বেড়াচ্ছে প্রতিযোগী।
হঠাৎই শুরু হল কর্মাশিয়াল ব্রেক। আর সেই ব্রেকের সময়ে টিভির পরদায় দেখা দিল জিশান। ওকে নিয়ে বিজ্ঞাপন শুরু হল।
অ্যানালগ জিমে জিশান ব্যায়াম করছে। বাটারফ্লাই ক্রাঞ্চ! রুমে এসি থাকা সত্বেও ওর ত্বকের ওপরে ঘামের চকচকে স্তর। হঠাৎ সেই ছবি সরে গিয়ে একটা ভাইটালাইজিং পাউডারের কনটেইনারের ছবি। পাশে একজন স্লিম সুন্দরী তরুণী। মিষ্টি গলায় পাউডারের নানান গুণপনার কথা বলছে। পাউডারের কৌটোটাকে উষ্ণ আদরের ভঙ্গিতে বুকে জড়িয়ে ধরেছে। আদুরে ঢঙে হাস্কি ভয়েসে বলছে, ‘তুমি আমার। আমার তুমি।’ তারপরই জিশানের হাসিমুখ। আবার জিশানের ব্যায়াম। আবার পাউডারের কৌটো।
বিজ্ঞাপনটা শেষ হওয়ার পর জিশান ভাবতে বসল। টিভিতে তখন অন্য বিজ্ঞাপন শুরু হয়ে গেলেও সেদিকে ওর মন ছিল না।
এই বিজ্ঞাপনের ব্যাপারটা জিশান জানতেও পারেনি। জিশানকে জানানোর দরকারও মনে করেনি কেউ। ওর ব্যায়ামের ছবির ক্লিপিং-এর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে ওই ভাইটালাইজিং পাউডারের ছবি, মেয়েটির ছবি। তারপর এডিটিং-এর কারসাজিতে ছবিগুলো বিনুনির মতো জুড়িয়ে দিয়েছে। তারই মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে জিশানের হাসিমুখ। কোনওসময় ও হয়তো মনোহর বা খোকনের সঙ্গে হাসি-মশকরা করছিল, তখন লুকোনো টেলিক্যামেরায় তুলে নিয়েছে ওর হাসিমুখের ছবি।
জিশানের খুব রাগ হল। কিন্তু পরমুহূর্তেই ও বুঝল, এ রাগের কোনও মানে নেই। ওর ফোঁসফোঁসানিই সার—ওর কামড়ে কোনও বিষ নেই।
হতাশা আর ক্ষোভে ওর চোখ জ্বালা করতে লাগল।
বিছানার মাথার দিকে তাকাল জিশান। বালিশের পাশেই পড়ে আছে এম. ভি. পি.—মাইক্রোভিডিয়োফোন।
মিনিকে ভীষণ ফোন করতে ইচ্ছে করল।
দেওয়াল-ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত দেড়টা।
মিনি নিশ্চয়ই এখন ঘুমিয়ে আছে। আর মা-কে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে ছোট্ট শানু। তা ছাড়া এই মাঝরাতে মিনির এম. ভি. পি. নিশ্চয়ই সুইচ অফ করা আছে।
এতসব ভাবনার পরেও জিশান শরীরটা ঝুঁকিয়ে হাত বাড়িয়ে এম. ভি. পি.-টা মুঠো করে ধরল। সঙ্গে-সঙ্গে ওর মনে হল, মিনি এসে গেছে হাতের মুঠোয়।
সোজা হয়ে বসল। এম. ভি. পি.-টা মুখের সামনে তুলে ধরল। তারপর বোতাম টিপল।
আজকের রাতটার মধ্যে বোধহয় ম্যাজিক আছে। কারণ, ফোনের বাজনা তৃতীয়বার শেষ হওয়ার আগেই মিনি ফোন ধরল।
ছোট্ট এল.সি.ডি. পরদায় ওকে দেখতে পেল জিশান।
ঘরের অন্ধকারে ভাসছে মিনির সদ্য-ঘুম-ভাঙা মুখ। ফোনের আলোর আভায় ওর মুখটা অলৌকিক দেখাচ্ছে।
‘মিনি—।’
‘জিশান! কী হয়েছে? এত রাতে!’ ঘুম জড়ানো গলায় মিনি বলল। ওর কথায় আশঙ্কা উঁকি মারছে।
‘না, কিছু হয়নি।’
‘না—বলো। তুমি লুকোচ্ছ। প্লিজ বলো—!’
‘না, মিনি—কিচ্ছু না। বিশ্বাস করো।’ একটু চুপ করে থেকে আবার বলল, ‘আসলে তোমাকে ভীষণ ফোন করতে ইচ্ছে করল। দেখতে ইচ্ছে করল। আমি…শুধু-শুধু তোমার ঘুম ভাঙালাম…।’
‘তাতে কী আছে! তোমার ফোন আসতে পারে ভেবে আমি রোজ ফোনটা অন করে বালিশের পাশে রেখে শুই।’
‘আমার এখানে আর ভাল্লাগছে না।’ বাচ্চা ছেলের বায়নার ঢঙে বলল,’আমার কিছু ভাল্লাগছে না।’
‘ভালো লাগবে কেমন করে! নিউ সিটি মোটেই ভালো লাগার জায়গা নয়…সবাই জানে…।’
জিশান আর মিনি কথা বলতে লাগল। ওদের কথা আর ফুরোতে চায় না। কিন্তু বরাদ্দ দশমিনিট ধীরে-ধীরে ফুরিয়ে আসছিল।
জিশান বেশ বুঝতে পারছিল, ওরা দুজনেই কিল গেমের কথা এড়িয়ে যাচ্ছে। যেন ব্যাপারটাকে অস্বীকার করলেই ওটা উধাও হয়ে যাবে।
সময় ফুরিয়ে আসছিল বলে জিশান মিনিকে ওর নাইট সাফারির কথা বলল। বলল পান্ডা আর মূর্তির সাহায্যের কথা। আনমোলের কথা। সিকিওরিটি কন্ট্রোল রুমের অফিসারের কথা।
পান্ডা আর মূর্তির কথা মিনি জিশানের কাছে আগেই শুনেছিল। এখন জানতে পারল, আরও অনেক সিকিওরিটি গার্ড জিশানের ভালো চাইছে। চাইছে জিশান জিতুক।
জিশান এবার বিজ্ঞাপনের কথা বলল। বলল, কীভাবে সিন্ডিকেট ওকে বিপণনের কাজে লাগাচ্ছে।
‘…আমার হাত-পা বাঁধা। কিছু করতে পারছি না। মিনি, আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে…।’ জিশান কেঁদে ফেলল।
‘হ্যাঁ—জানি, তোমার ভীষণ খারাপ লাগছে। কিন্তু উপায় কী! তোমাকে সহ্য করতেই হবে। প্লিজ, কেঁদো না…।’
জিশান চোখের জল মুছে বলল, ‘এরপর হয়তো ওরা ক্লিপিংস ইউজ না করে আমাকে দিয়ে অ্যাডের শুটিং করাবে। একটা বলির পাঁঠাকে নিয়ে আর কত হেনস্থা করবে ওরা! ওই শয়তানটা…ওই হারামজাদা শ্রীধর পাট্টা…ওকে খতম করতে পারলে…।’
‘শোনো, জিশান!’ ওকে বাধা দিয়ে বলল মিনি, ‘এইসব হেনস্থার জবাব তোমাকে দিতে হবে কিল গেমে।’
‘কিল গেমে!’ হঠাৎ করে কিল গেমের প্রসঙ্গ সরাসরি উঠে আসায় জিশান অবাক হল। মিনির ছবির দিকে তাকাল।
‘হ্যাঁ। কিল গেমের দিন ঠিক হলে ওই গেম সিটিতেই তোমাকে জবাব দিতে হবে। ওই চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে—।’
চোয়াল শক্ত করল জিশান : ‘হ্যাঁ, তুমি ঠিক বলেছ।’ মাথা নাড়ল : ‘ওই চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই জবাব দিতে হবে।’ একটু থেমে আবার বলল, ‘চব্বিশ ঘণ্টা নয়—তেইশ ঘণ্টা ষাট মিনিটের মধ্যে—।’
‘হ্যাঁ। তুমি…।’
দশ মিনিট ফুরিয়ে গেল। এম.ভি.পি.-র পরদায় মিনির ছবি দপ করে নিভে গেল।
জিশান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ও যেন এতক্ষণ স্বর্গে ছিল—এই মুহূর্তে নরকের অন্ধকূপে খসে পড়ল।
এম.ভি.পি.-টা সুইচ অফ করে বালিশের কাছে ছুড়ে দিল। বল রিমোটের বোতাম টিপে প্লেট টিভি অফ করল। তারপর ঘরের আলোটাও নিভিয়ে দিল।
অন্ধকারে ডুবে গেল ঘর।
জীবন্ত প্রেতের মতো মাথা ঝুঁকিয়ে বসে রইল জিশান। হতাশার স্রোত ওকে আলোয়ানের মতো জড়িয়ে নিচ্ছিল। এবং অন্ধকারে চুপচাপ বসে ও প্রাণপণে তার সঙ্গে লড়াই চালাচ্ছিল।
এভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে কে জানে! হঠাৎই টিভির ইনটারঅ্যাকটিভ চ্যানেল দপ করে চালু হয়ে গেল।
আলোর ঝলকানিতে চমকে উঠল জিশান। তাকাল টিভির দিকে।
একজন সুন্দরী মিষ্টি গলায় ওর নাম ধরে ডাকল : ‘জিশান! জিশান!’
মেয়েটি বোধহয় ভেবেছে জিশান ঘুমিয়ে আছে।
আরও দু-একবার ডাকার পর জিশান বিছানা ছেড়ে উঠল। টিভির কাছে গিয়ে বলল, ‘বলো। জেগে আছি।’
হাসল মেয়ে : ‘সরি, জিশান। ডিসটার্ব করছি। তোমাকে আমাদের পিস ফোর্সের মাননীয় মার্শাল ডেকে পাঠিয়েছেন। তুমি রেডি হয়ে নাও। পিস ফোর্সের গার্ডরা ঠিক সাত মিনিট পর তোমাকে নিতে আসবে। থ্যাংক য়ু।’
ইনটারঅ্যাকটিভ চ্যানেল অফ হয়ে গেল। মেয়ে মিলিয়ে গেল।
রিমোটের বোতাম টিপে আলো জ্বালল জিশান। ওয়ার্ডরোবের কাছে গিয়ে পাল্লা খুলল। একটা ছাই রঙা কর্ডের প্যান্ট আর নীল রঙের পোলো নেক টি-শার্ট পরে নিল।
শ্রীধর পাট্টা ওকে ডেকে পাঠিয়েছেন!
কিন্তু কেন?
সাত মিনিট শেষ হতে না হতেই দরজায় কলিংবেল। গার্ডরা এসে গেছে।
দরজা খুলল জিশান। পিস ফোর্সের তিনজন গার্ড। অভিব্যক্তিহীন মুখ। কোমরে শকার—সুইচ অন করা।
না, গার্ডদের একটা মুখও ওর চেনা নয়।
‘চলো—মাননীয় মার্শাল…।’ ওদের একজন বলতে শুরু করেছিল।
‘জানি।’ লোকটাকে থামিয়ে দিয়ে জিশান বলল। এবং ওদের সঙ্গে রওনা হল।
করিডর ধরে যেতে-যেতে জিশান ওদের কাছে বারবার জানতে চাইল, শ্রীধর পাট্টা ওকে কেন ডেকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু ওরা কোনও জবাব দিল না।
আরও অনেকবার জিশান একই কথা জিগ্যেস করল। কিন্তু তা সত্বেও কোনও জবাব নেই।
এলিভেটরে করে নামার সময় জিশান ওদের অনুনয় করে বলল, ‘প্লিজ, ভাই! যদি জানা থাকে আমাকে বলো। প্লিজ!’
গার্ডরা নিজেদের মধ্যে একবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারপর বরফ গলল। ওদের একজন জিগ্যেস করল, ‘তুমি আজ রাতে গেস্টহাউস ছেড়ে বেরিয়েছিলে?’
জিশান কোনও উত্তর দিতে পারল না। হতবাক হয়ে গার্ডের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
আর-একজন গার্ড বলল, ‘তুমি জিপিসি-র ক্যাম্পাস ছেড়ে বেরিয়েছিলে। মনে হয়, শ্রীধর পাট্টা সেটা জানতে পেরেছেন…।’
জিশানের বুকের ভেতর দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নামতে শুরু করল। আবার তা হলে ‘রোলারবল’?
কিন্তু শ্রীধর জানতে পারলেন কেমন করে!