পুজোর পর অফিস খুলেছে
পুজোর পর অফিস খুলেছে। দশ-বারোদিন কুঁড়েমি করার পর কাজে আর মন বসে না, সকালে উঠে জোর করে অফিসের জন্য তৈরি হতে হয়। এতদিনেও বেশ পোক্ত চাকরিজীবী হতে পারলাম না। আমার বিশ্বাস মানুষের জীবনটা প্রধানত অবকাশ-যাপনের জন্যই, তবে অবসর সময়ে একটা চাকরি করলে ক্ষতি নেই। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীর দাবী এত বেশি যে, চাকরিই প্রধান হয়ে উঠেছে, অবকাশটা গৌণ। অথচ মানবসভ্যতার শ্রেষ্ঠ অবদান যা—যেমন সাহিত্য, শিল্প, ভাস্কর্য—সবই তো অবকাশের ফসল। একমাত্র বানে পেটেন্ট অফিসে কাজ করতে করতে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের আবিষ্কার ছাড়া চাকরি করে কে কবে অমর হয়েছে?
ছুটির পর বাড়ি ফিরে চা খেতে খেতে এইসব উচ্চমার্গের চিন্তা করছিলাম। ক্রমে যখন ধারণা হয়ে এসেছে যে, চাকরি না করলে আমিও জগতে অমর কীর্তি রেখে যেতে পারতাম, (ক্লাস সেভেনে যখন পড়ি, আমার লেখা কবিতা পড়ে থার্ড পণ্ডিত মশাই যে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন সেটা তো আর মিথ্যে নয়! কেউ কেউ যে রবি ঠাকুরের কবিতার সঙ্গে মিল দেখতে পেয়েছিল, সেটা কেবল নিন্দুকগুলা খাইতে পায়না বলিয়াই–) সেই সময়ে বাইরে থেকে কিশোরীর হাক শোনা গেল। বেরিয়ে বললাম—ব্যাপার কি?
-এই যে, ফিরেছ দেখছি। আজ আর তাসের আড্ডায় যেতে ইচ্ছে করছে না। চল, তারানাথকে বিজয়ার প্রণাম করে আসি
শার্টটা গায়ে চাপিয়ে কিশোরীর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। তারানাথ রাবড়ি খেতে ভালবাসে, কিন্তু সম্প্রতি তার যা আর্থিক অবস্থা তাতে রাবড়ি খাওয়া চলে না। কিশোরী আর আমি পকেট হাতড়ে যা বের করলাম, তা দিয়ে তালতলার চেনা হিন্দুস্থানীর দোকান থেকে সেরখানেক রাবড়ি কিনে নেওয়া গেল।
আমাদের দেখে তারানাথের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল—বৌ আর ছেলেপিলেরা। ছাড়া এই তোমরাই যা বিজয়া করতে এলে এবার! এত যে জানাশোনা লোক ছিল, তারা গেল কোথায় বল দেখি?
রাবড়ি পেয়ে তারানাথ খুব খুশি, ওঃ এ তো প্রায় সেরখানেক হবেই। অনেকদিন পর পেট ভরে রাবড়ি খাব। বোসো তোমরা, চা বলে আসি-–
চা এল, সঙ্গে নারকেল নাড়ু আর বাড়িতে ভাজা কুচো নিমকি খাওয়ার পর কিশোরীর পকেট থেকে অবশ্যম্ভাবী পাসিং শো-এর প্যাকেটটি বেরুল। সিগারেট ধরিয়ে তারানাথ চোখ; বুজে মৌজ করে টান দিচ্ছে, কিশোরী বলল—আজ বছরকার দিনটা, একটা গল্প না শুনেই ফিরে যাব?
তারানাথ চোখ মেলে হেসে বলল—তোমরা দুটিতে যখন এসোছ, গল্প না শুনে ফিরবে না জানি। কি রকম গল্প চাই?
—আজ আমাদের কোনো বায়না নেই। আপনি যা বলবেন—
কিছুক্ষণ তারানাথ চুপ। বোধহয় মনে মনে গল্পটাকে গুছিয়ে নেবার কাজ চলছে। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে অ্যাশট্রে হিসেবে ব্যবহৃত একটা নারকেলের মালায় গুজে তারানাথ বলতে শুরু করল—বীরভূমের একটা রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বসে আছি। লুপ লাইনের অখ্যাত, গেয়ো স্টেশন। সাহেবগঞ্জ লোকাল ধরে হাওড়া আসব, তা সে ট্রেন শুনলাম দেড়ঘণ্টা লেট। কোথাও একটা খাবারের দোকানও নেই যে এককাপ চা খাব। একটা বিড়ি ধরিয়ে পায়চারী করছি, দেখি প্ল্যাটফর্মের একেবারে শেষ প্রান্তে একটা ইটের পাজার ওপর একজন বিশাল চেহারার লোক চুপ করে বসে আছে। পোশাক খুবই সাধারণ, খাটো ধুতির ওপর একটা ফতুয়া গোছের জামা, পায়ে বহু পুরনো একজোড়া চটি। মাথায় অযত্নলালিত বাকড়া চুল। কিন্তু লোকটার ঋজু বসবার ভঙ্গিতে আর চোখের দৃষ্টিতে এক আশ্চর্য ব্যক্তিত্বের ছাপ রয়েছে, বার বার তাকিয়ে দেখতে হয়।
আমাকে অনেকক্ষণ একা কাটাতে হবে, কাজেই আলাপ জমাবার উদ্দেশ্যে ইটের পাজার একপাশে বসে পড়ে জিজ্ঞাসা করলাম—সাহেবগঞ্জ লোকাল ধরবেন বুঝি?
আমার দিকে না তাকিয়েই লোকটা বলল—হ্যাঁ।
—সে ট্রেন তো শুনলাম দেড়ঘণ্টা দেরিতে আসছে।
—হ্যাঁ।
দু-বার এরকম একাক্ষরী উত্তর দেবার পর লোকটি এবার আমার দিকে তাকাল। বেশ বুদ্ধিদীপ্ত চোখে আমার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল-গুরুর দর্শনলাভ ঘটেছে?
হেসে বললাম—কি করে বুঝলেন?
লোকটিও সামান্য হেসে বলল—হাত গুনতে হয় না, তোমার গেরুয়া আর রুদ্রাক্ষের মালা দেখেই বলা যায় তুমি কোন পথের পথিক।
—আর গুরুর ব্যাপারটা?
—গুরুর কৃপা না পেলে চোখে জ্যোতি ফোটে না। তোমার চোখে সেই জ্যোতি রয়েছে। তুমি বলছি বলে রাগ করছ না তো? তুমি আমার চেয়ে অনেক ছোট–
সবিনয়ে বললাম—না না, আমাকে তুমি’-ই বলবেন।
—আমার বয়েস কত মনে হয়?
ভাল করে তাকিয়ে দেখে বললাম—বছর পঞ্চাশেক হবে, না কি?
–-আমার এই বাহাত্তর চলছে, সামনের চৈত্রে তিয়াত্তর হবে।
অবাক হয়ে বললাম—বলেন কি। যাঃ, তা কি করে হতে পারে? আপনার তো একটা চুলও পাকেনি দেখছি—
–পাকবেও না। যেদিন যাবার হবে এইভাবেই চলে যাব।
আমি উঠে তার পায়ের ধুলো নিয়ে বললাম—আপনি নিশ্চয় সিদ্ধপুরুষ, অনেক ভাগ্যে আপনার দেখা পেলাম। আমাকে আশীর্বাদ করুন।
লোকটি সজ্জন, আমি পায়ে হাত দিতে সঙ্কুচিত হয়ে বললেন—আরে আরে! পায়ে হাত দিচ্ছ কেন? আমি সিদ্ধপুরুষটুরুষ কিছু নইরে ভাই, নিয়মিত প্রাণায়াম করি— তাতেই শরীরটা তৈরি হয়ে গিয়েছে আর কি। জরার আক্রমণ কিছুদিন ঠেকিয়ে রাখতে পারব।
ইটের পাঁজার ওপর লোকটির পাশে জমিয়ে বসলাম। একটু একটু করে আলাপও হয়ে গেল। তার নাম বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য, লোকে বিশুঠাকুর বলে ডাকে এককালে মুর্শিদাবাদের কোন গ্রামে বাড়ি ছিল, এখন কিছু নেই। এইরকম ঘুরে ঘুরে বেড়ান, কোথাও কোনো বটতলায় বা মন্দিরে আশ্রয় নেন। সাধুসন্তের প্রতি গ্রামের মানুষের আকর্ষণ চিরকালের—তারা দেখতে এসে কলা মুলো যা দেয় তাতেই একটা পেট চলে যায়।
জিজ্ঞাসা করলাম—এখন যাচ্ছেন কোথায়?
উনি একটু চুপ করে থেকে বললেন—বেশিদূর নয়, এই কয়েকটা ইস্টিশন পরেই আমার এক গুরুভাইয়ের বাড়ি। একসঙ্গে দীক্ষা নিয়ে দুজনে কিছুদিন সাধনা করেছিলাম। পরে সে অবশ্য বিয়েথাওয়া করে সংসারী হয়—ধানের ব্যবসা করে কিছু টাকাও করেছিল, সেটাই তার কাল হল শেষ অবধি–
নড়ে বসে বললাম—কি রকম?
বিশুঠাকুর বললেন—আমার সেই বন্ধু, রামরাম ঘোষাল, দিন দশবারো আগে খুন হয়েছে।
—সেকি খুন! কেন?
–রামরামের কিছু টাকাপয়সা হয়েছিল এ খবর অনেকেই জানত। নিজের বসতবাড়ি থেকে একটু দূরে বাঁশঝাড়ের পেছনে রামরাম একখানা ঘর তুলেছিল, সেখানে রাত্তিরে গিয়ে সাধনভজন করবার চেষ্টা করত। গৃহী হয়েও এ অভ্যেসটা ছাড়তে পারেনি। এই ঘরেরই মাটির মেঝেতে টাকা পুঁতে রেখেছিল রামরাম। তাকে মেরে মাটি খুঁড়ে সবকিছু নিয়ে চলে গিয়েছে।
—কে করল এ কাজ?
বিশুঠাকুর বললেন—জানি না। তবে যে করেছে তাকে শাস্তি পেতেই হবে। যে কাঠায় মাপ, সে কাঠায় শোধ, বুঝলে?
ঠাকুরের গলার স্বরে একটু অবাক হলাম। এ শুধু প্রিয় বন্ধুর অক্ষম হাহাকার নয়, এ কথার পেছনে দৃঢ় প্রত্যয় লুকিয়ে রয়েছে। কিন্তু অজ্ঞাত হত্যাকারীর বিরুদ্ধে বিশুঠাকুর কিইবা করতে পারেন তা বুঝলাম না।
-তুমি কোথায় চলেছ? হেসে বললাম—কোথাও না। মানে, কোনো ঠিক নেই। আর কি। বাড়িতে ভাল লাগে না, তাই ঘুরে ঘুরে বেড়াই, আর সাধুসন্নাসীর দেখা পেলে তাদের সঙ্গলাভের চেষ্টা করি। এই যেমন এখন ইচ্ছে করছে আপনার সঙ্গে থাকি—
বিশুঠাকুর এই প্রথম হাসলেন, বললেন—আমার সঙ্গে থাকতে চাও? বেশ, চল— আমার কোনো আপত্তি নেই। খাওয়াদাওয়া কিন্তু আমার যা জুটবে তোমারও তাই, আবার নাও জুটতে পারে, চলবে তো?
—আমার অভ্যেস আছে।
আমার সংক্ষিপ্ত উত্তরে বিশুঠাকুর একবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তারপর বললেন—চল তাহলে। অখ্যাততর একটি স্টেশনে নেমে মাইলছয়েক হেঁটে ঘোর সন্ধেবেলা রামরাম ঘোষালের গ্রামে পৌঁছনো গেল। বিশুঠাকুর আগে দু-একবার এ গ্রামে এসেছেন। তিনি হনহন করে হেঁটে গ্রামের একেবারে শেষপ্রান্তে একটা বড় আটচালা বাড়ির সামনে দাঁড়ালেন। মাঝখানে উঠোন ঘিরে গায়ে গায়ে লাগা অনেকগুলো ঘর, উঠোনে তুলসীমঞ্চ। ঘরে ঘরে আলো জ্বালার উদ্যোগ চলছে, কয়েকটি শিশুর কলরব শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সবমিলিয়ে বাড়ির পরিবেশে একটা শোকের বিষণ্ণতা পরিব্যপ্ত হয়ে আছে। বিশুঠাকুর আমার হাত ধরে উঠোনে এসে দাঁড়ালেন।
গৃহস্বামী এগিয়ে এসে অতিথিকে আপ্যায়ন না করলে অতিথির পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকাটা বড় অস্বস্তিকর হয়ে পড়ে। এ বাড়ির কর্তা এখন কে জানি না, কাজেই আমরা চুপ করে দাঁড়িয়েই রইলাম।
মিনিটদশেক পরে উঠোনের ওধারের একটা ঘর থেকে প্রদীপহাতে এক বিষণ্ণমূর্তি মহিলা বেরিয়ে তুলসীতলায় আসতে গিয়ে আমাদের দেখে থমকে দাঁড়িয়ে বললেনকে? কে ওখানে?
বিশুঠাকুর দু-পা এগিয়ে গিয়ে বললেন—বৌমা, আমি বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য। চিনতে পারছ? রামরাম থাকতে আমি এসেছি কয়েকবার
মহিলাটি একমুহূর্ত নীরব থাকবার পর চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। তার কান্নার শব্দে চারদিকের ঘর থেকে এতক্ষণে অনেকে বেরিয়ে এল। বেশ কিছুক্ষণ একটা মিশ্র কোলাহল চলবার পর আমরা দাওয়ায় বসবার আসন পেলাম।
একঘণ্টা পর।
বিশুঠাকুর এসেছেন শুনে গ্রামের অনেকে জড়ো হয়েছে রামরাম ঘোষালের বাড়ি। তালপাতার চাটাইতে বিশুঠাকুর বেশ ঋজু হয়ে বসে আছেন। রামরামের ছোটভাই শিবরাম চোখে জল নিয়ে হাতজোড় করে ধরা গলায় বলছে—ঠাকুরমশাই, কে একাজ করেছে জানি না কিন্তু যেই করুক, সে ভুল করেছে। দাদা আমার শিবতুল্য মানুষ ছিলেন, ব্যবসা করতেন বটে, কিন্তু টাকাকড়ির ওপর কোন লোভ ছিল না। কত লোকের পাওনা ছেড়ে দিয়েছেন, কত লোকের কন্যাদায় উদ্ধার করেছেন। এ অঞ্চলের সবাই জানত বিপদে পড়ে রামঠাকুরের কাছে গেলে খালিহাতে ফিরতে হবে না। এত পয়সা উপার্জন করতেন, কিন্তু নিজে পরতেন একটা খাটো ধুতি, সারাদিনের শেষে খেতেন একমুঠো আতপচাল সেদ্ধ। আমার বিশ্বাস, হত্যাকারী চাইলে দাদা টাকাপয়সা সবই বের করে দিতেন, খুন করবার দরকার হত না। সবই ভাগ্য—
বিশুঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন পুলিশ কি বলছে? শিবরাম উত্তর দেবার আগেই ভিড়ের মধ্য থেকে একজন কে বলে উঠল—পুলিশ বরাবর যা বলে। খুনের পরদিন সকালে খবর দেওয়া হয়েছে, পুলিশ এসেছে বিকেলে। কি ঝামেলা ভাবুন তো! আবার দারোগ বলে দিয়েছিল—পুলিশ পৌঁছনোর আগে যেন মৃতদেহ সৎকার না করা হয়। সেই দেহ নিয়ে পরদিন রাত বারোটা অবধি সবাই বসে। এদিকে পুলিশের কি হম্বিতম্বি—গ্রামসুদ্ধ লোককে ফাঁসি দেয় আর কি! তারপর পুলিশও চলে গেল, সবকিছু মিটে গেল। খুনি আর ধরা পড়েছে।
বিশুঠাকুর বিষণ্ণতা মাখানো গলায় বললেন—ঠিকই। পুলিশের অপদার্থতা আর কারও জানতে বাকি নেই, খুনীকে তারা ধরতে পারবে বলে আমারও বিশ্বাস হয় না। আহা, রামরাম এমন বেঘোরে মারা যাবে স্বপ্নেও ভাবিনি। নাং, এ খুনের কিনারা কিছু হবে না—
আমি একটু অবাক হয়ে বিশুঠাকুরের মুখের দিকে তাকালাম। এই আজই কয়েকঘণ্টা আগে না—ব্যাপার কি? কিন্তু বিশুঠাকুর সত্যিই যেন কেমন হতাশ আর হালছাড়া ভঙ্গিতে বসে রয়েছেন, মুখে শোকের ছায়া। আসলে বন্ধুর মৃত্যুতে বুড়োমানুষ হয়ত রেগে গিয়ে ওসব কথা তখন বলেছিলেন, সত্যিই তো—কি করে আর এখন ধরা যাবে হত্যাকারীকে?
একজন দীর্ঘদেহ শ্যামবর্ণ লোক ভিড়ের থেকে একটু আলাদা হয়ে দাওয়ার একপ্রান্তে বসে সবার কথা শুনছিল। গ্রাম্য মানুষদের থেকে তার ব্যক্তিত্বকে কিছুটা আলাদা করে বোঝা যায়। অন্য সবাই বেশির ভাগই খালিগায়ে এসেছে, কেবল এ লোকটির গায়ে হাফহাতা নীল শার্ট। এসব শহুরে ধাঁচ লোকটা পেল কোথায় তা ভাবছি, এমন সময় লোকটা বলে উঠল-খুনের কিনারা হবে না বলছেন? ভাবলেও খারাপ লাগে, রামজ্যাঠার মত লোক—খুনীর শাস্তি না হলে তার আত্মা শাস্তি পাবে না। কিছুই কি করার নেই?
সে কথার উত্তর না দিয়ে বিশুঠাকুর লোকটির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন—তুমি কে?
লোকটি যেন একটু থতমত খেয়ে বলল—আজ্ঞে, আমি হরিপদ।
–রামরামের ভাইপো?
—আজ্ঞে না, ওঁকে ছোটবেলা থেকেই জ্যাঠামশাই বলে ডাকি। উনি আমার বাবার বন্ধু ছিলেন।
—গতবার এসে তো তোমাকে দেখেছি বলে মনে হয় না—
হরিপদ বলল—ঠিকই। আমি মাঝে প্রায় পনেরো বছর গ্রামে ছিলাম না। বাইরে চাকরি . করতাম, সম্প্রতি ফিরে গ্রামে বসেছি।
—চাকরি ছাড়লে কেন?
বিশুকুরের জেরায় লোকটি স্পষ্টত বেশ অস্বস্তি বোধ করছে। সে বলল শরীরটা ভাল যাচ্ছে না, চাকরির ধকল পোষাল না। শরীর একটু ভাল বোধ করলে হয়ত আবার চলে যাব–
বিশুঠাকুর তাকে আর কোন প্রশ্ন করলেন না। উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে একটু মাতব্বরমত শ্রীদাম ঘোষ বলল—ঠাকুর যখন এসেছেন, এদের বাড়িতে একটু স্বস্ত্যয়ন করে দিয়ে যান। অপঘাতটা হল তো—বাড়ি ঠাণ্ডা হবে’খন।
সে হবে। কর্তব্য করব বলেই তো এসেছি—
আবার ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। ভারি অদ্ভুত মানুষ তো! সেই দৃঢ় প্রত্যয়ের সুর ফিরে এসেছে গলায়। কর্তব্য! কি কর্তব্যের কথা উনি বলছেন?
কিন্তু আমাকে বেশি ভাবতে না দিয়ে বিশুঠাকুর হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে বললেন—চল দেখি তোমরা, রামরামের সেই চালাঘর কোনদিকে? একটু দেখে আসি জায়গাটা–
গ্রামে যেমন হয়, পুরো ভিড়টা আমাদের সঙ্গে চলল। বাড়ির পেছনের ঘন বনজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটা ছোট্ট সুড়িপথ চলে গিয়েছে। সেটা ধরে বেশ কিছুটা যাওয়ার পর মৃত বলরাম ঘোষালের সাধনপীঠে এসে উপস্থিত হলাম। সামান্য খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে মজবুত চালাঘর তোলা হয়েছে, মাটির সিড়ি বেয়ে উঠে প্রথমে সরু দাওয়া, তারপর ঘর। দরজা খোলা হা হা করছে। এখানে কয়েকদিন আগেও একজন রীতিমত জীবন্ত মানুষ বসে ঈশ্বরের আরাধনা করত-এখনও তার রক্তের দাগ মাটির মেঝেতে লেগে রয়েছে। এসব ভাবতে গিয়ে মনটা উদাস হয়ে গেল। হাসিমুখে যে লোকটা দুপুরে ভাত খেয়েছে, ভোরে সূর্যপ্রণাম করেছে, ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছে—সে জানত না পরের দিন সকালে এই পৃথিবীটা তার কাছে অনেক দূরের হয়ে যাবে। এইটুকু তো মানুষের জীবন, নিতান্ত অনিশ্চিত—এরই মধ্যে কত ঈর্ষা ও বিদ্বেষ, পার্থিব ভোগ্যবস্তু অধিকার করে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা! কি সার্থকতা এর?
বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য আর আমি দাওয়া পেরিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকলাম। শ্রীদামের হাতে লণ্ঠন ছিল, সেও আমাদের সঙ্গে ঢুকল ঘরে—তার পেছনে শিবরাম। বাকিরা ভিড় করে দাঁড়াল দরজার কাছে। গ্রামে এমনিতে জীবন নিস্তরঙ্গ—কাজেই সামান্য কিছু ঘটলেও খবর রটে বিদ্যুতের গতিতে। ঘোষালবাড়িতে দু-জন সাধু এসেছে—এ বার্তা রটে যেতেই অর্ধেক গ্রাম রামরামের চালাঘরের সামনে এসে জমল।
ঘরের এককোণে কাঠের ছোট জলচৌকির ওপর লাল বনাত দিয়ে ঢাকা ঠাকুরের আসন। সেখানে সিঁদুর মাখানো একটি পাথরের কালী মূর্তি রয়েছে। দেয়ালে দশমহাবিদ্যার ছাপা ছবি বাঁধানো, বাজারে যেমন কিনতে পাওয়া যায়। এছাড়া সমস্ত ঘরে আর কিছুই নেই, আসবাবপত্রও না।
ঘরের মেঝেতে এখানে-সেখানে মাটি খুঁড়ে ডাই করা রয়েছে। হত্যাকারী বেশ মাথাঠাণ্ডা লোক বলতে হবে। একজনকে খুন করে তার মৃতদেহের পাশে বসে মাটি খুঁড়ে লুকোনো টাকা বের করতে হলে স্নায়ুর ওপর রীতিমত কর্তৃত্ব থাকা প্রয়োজন। একবারে যে খুঁজে পায়নি তা বোঝাই যাচ্ছে, কারণ মেঝের বিভিন্ন অংশ খোড়া হয়েছে। ঠাকুরের আসনের সামনে মাটির মেঝেতে কালো ছোপ লেগে, রক্ত শুকিয়ে কালো দেখাচ্ছে। অর্থাৎ গভীর রাত্তিরে রামরাম ঘোষাল যখন দরজার দিকে পেছন ফিরে সাধনায় রত ছিলেন, তখন আততায়ী পেছন থেকে তাকে আঘাত করে।
মাটিতে লেগে থাকা রক্তের দাগের দিকে তাকিয়ে বিশুঠাকুরের চোখ জলে ভরে এল। ধরা গলায় তিনি বললেন-রামরাম, তুই আমাদের চেয়ে অনেক বড় ছিলি। আমি তো সংসার ছেড়ে বিবাগী হয়ে বেড়াই। আর তুই গৃহী হয়েও সাধনা ছাড়িস নি— অনেক মহৎ ছিলি তুই
তারপর কেমন একটা দৃষ্টিতে ঘরের অন্ধকার একটা কোণের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন—আমি এসে গিয়েছি। কাজ সেরে ফিরব। তুই ভাবিস না—
এমন দৃঢ়তার সঙ্গে বিশুঠাকুর কথাগুলো বললেন যেন ঘরের ওই শূন্য অন্ধকার কোণে তিনি এক অশরীর উপস্থিতিকে প্রত্যক্ষ করছেন। আমার সমস্ত শরীরে কাটা দিল। শ্রীদাম আর শিবরামও দেখি কেমনভাবে তার দিকে তাকাচ্ছে, পাগল ভাবছে কিনা কে জানে।
বিশুঠাকুর বললেন—চল তারানাথ, বাইরে যাই।
ঘর থেকে বেরিয়ে আমরা দাওয়ায় বসলাম। গ্রামবাসীরা চারদিকে ঘিরে রইল। আমি শ্রীদামকে বললাম—ঘোষালমশায়ের সাহস ছিল বলতে হবে। এমন নির্জন জায়গায়, জঙ্গলের মধ্যে রাত্তিরে একা থাকতেন। সাধারণ লোক হলে পারত না।
—আজ্ঞে হ্যাঁ। তবে সাধক মানুষ তো, কিছুকে পরোয়া করতেন না।
শিবরাম বলল—দাদার সঙ্গে কেতু থাকত, দাদার আদরের কুকুর। কিন্তু দাদার মৃত্যুর পর থেকে তাকেও কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কোথায় যে গেল কুকুরটা।
হঠাৎ দেখলাম বিশুঠাকুর ঋজু হয়ে বসেছেন, চোখে বুদ্ধি মেশানো খরদৃষ্টি। বললেন—কেতু কি দেশি কুকুর?
–আজ্ঞে। বিলিতি কুকুর আর এই গ্রামে আমরা কোথা থেকে পাচ্ছি বলুন? তবে দেশি কুকুর বলে তাকে কেউ অবহেলা করতে সাহস পেত না। এই বিশাল চেহারা কেতুর, সিংহের মত থাবা। ভারী গলায় তার গর্জন শুনলে অচেনা লোকের নাড়ী ছেড়ে যেত। বাড়ির কাছে কারো আসার উপায় ছিল না—বাঘের মত কুকুর ঠাকুরমশাই! দাদার পেছন পেছন ঘুরত সারাদিন, দাদা রাত্তিরে এইখানে এলে কেতুর দরজার কাছে চুপটি করে বসে থাকত।
—ই। তাকে আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না বলছ?
-না ঠাকুরমশাই। দাদা মারা যেতে কোথাও চলে গিয়েছে হয়ত। জন্তুজানোয়াররা সব বুঝতে পারে।
বিশুঠাকুর যেন বিষয়টা ঝেড়ে ফেলার মত করে শিবরামকে বললেন—তা হবে হয়ত। যাক গে সে কথা, আমরা কিন্তু আজ রাত্তিরটা এখানেই থাকব, বুঝলে?
শিবরাম অবাক হয়ে বলল—এখানে কি করে থাকবেন? পাড়া থেকে এতটা দূরে, বনের মধ্যে
—আমাদের কোন অসুবিধে হবে না। শুধু কিছুটা দুধ দিয়ে যেয়ো, আর একবোঝা শুকনো কাঠ, ধুনি জ্বালাব।
শিবরাম বলল—আমি গিয়েই কাঠ আর দুধ পাঠিয়ে দিচ্ছি। যদি বলেন চাল-ডাল আর নতুন হাড়িও দিচ্ছি, বরং দুটো ভাত ফুটিয়ে নিয়ে–
বিশুঠাকুর দৃঢ়গলায় বললেন—প্রয়োজন হবে না। আমি রাত্তিরে দুধ ছাড়া কিছু খাই না।
–ঠিক আছে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তবে ঠাকুরমশাই আজ আমার বাড়িতে থাকলেই ভাল করতেন—
–আমার এরকম বাইরে থেকেই অভ্যেস, কারো বাড়িতে থাকলে ঘুমোতে পারব। তাছাড়া ভয় কি? এখান থেকে চেঁচিয়ে ডাকলে তো তুমি শুনতে পাবে, তাই না?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
—তবে ঠিক আছে। কাল আমরা চলে যাব, একটা রাত এখানেই কেটে যাবে। যার সঙ্গে এত বন্ধুত্ব—যাকে দিয়ে সম্পর্ক—সেই যখন রইল না—
তারপর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বিশুঠাকুর বললেন—নাঃ, আর মায়া বাড়াব না—
ঠাকুরের গলাটা যেন বড়ই অভিনয়-অভিনয় ঠেকল। এত দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাহুতাশ করবার লোক ইনি নন। কি ব্যাপার বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলাম।
বিশুঠাকুর আবার বললেন—সত্যি, মানুষের কি কপাল! টাকা পয়সা তো মেঝে খুঁড়ে নিয়ে গেলই, গ্রামের কালীমন্দিরটাও আর হল না—
ভিড়ের মধ্যে সামান্য গুঞ্জন চলছিল, হঠাৎ তা থেমে গেল। সবাই নতুন কথা শুনে বিশুঠাকুরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
শ্রীদাম ঘোষ বলল—আজ্ঞে, এ কালীমন্দিরের কথাটা কি বললেন, ঠিক বুঝলাম না তো?
—কেন তোমরা জান না? রামরাম ঠিক করেছিল গ্রামে বিরাট কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করবে। স্বপ্নে আদেশ পেয়েছিল দেবীর কাছ থেকে। এজন্য কিছু সোনা কিনে জমিয়ে রেখেছিল বেচারা। সে-সবও হত্যাকারী নিয়ে গেল!
শিবরাম অবাক হয়ে বলল—দাদা সোনা কিনে জমিয়ে রেখেছিল। বলেন কি ঠাকুরমশাই? কই, আমরা তো কিছু জানতাম না
—জানবে কি করে? গোপনে করছিল কাজটা। মন্দির প্রতিষ্ঠা হলে দেখতেই পেতে। গতবার যখন আসি, আমাকে একমুঠো পাকা সোনার গিনি দেখিয়ে ছিল। এ ক’বছরে না জানি আরও কত গিনি জমেছিল। সবই পরের ভোগে চলে গেল। মন্দিরটা হলে তোমাদেরই থাকত। মেঝে খোঁড়ার কথা শুনেই বুঝেছি হত্যাকারী আর কিছু রেখে যায়নি—
ভিড়টা আস্তে আস্তে পাতলা হয়ে এল। এত বড় খবরটা বাড়ি গিয়ে সবাইকে জানাতে হবে তো!
শিবরামও শেষপর্যন্ত আমাদের প্রণাম করে উঠে পড়ল।-লণ্ঠনটা রইল। ঠাকুরমশাই, তেল ভরা আছে।
হঠাৎ পেছন থেকে বিশুঠাকুর তাকে ডাকলেন—শিবরাম, শোনো।
—আজ্ঞে?
—দুধটা তুমি নিজে দিয়ে যেয়ো, কারো হাত দিয়ে পাঠিয়ো না—আর—
শিবরাম বিনীত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
–রামরামের কুকুর কেতুর গায়ের রঙ কি ছিল বলতে পার? লাল?
একটু বিস্মিত হয়ে শিবরাম বলল—আজ্ঞে না, কালো, মিশমিশে কালো। কেন। বলুন তো?
—নাঃ, এমনি মনে হল তাই জিজ্ঞাসা করলাম। আচ্ছা, তুমি যাও এখন!
শিবরাম চলে যেতেই চারদিকে নৈশ স্তব্ধতা যেন প্রকট হয়ে উঠল। বিবি ডাকছে জঙ্গলে, বাশবনে অদ্ভুত শব্দ করে বাঁশ দুলছে। মাথার ওপরে কেবল একটুখানি খোলা আকাশ দেখা যায়। অজস্র নক্ষত্র ফুটেছে কালো রাত্রির পটে। আবহাওয়া বেশ সুন্দর, তেমনি গরমও নেই, আবার ঠাণ্ডাও নয়।
বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্যের গলা শুনতে পেলাম রাত্রির নির্জনতার মধ্যে বেজে উঠেছে, আস্তে আস্তে স্পষ্ট উচ্চারণে বলছেন—অহনাহনি ভূতানি গচ্ছত্তিহ যমালয়ম, শেষাঃ স্থাবরমিচ্ছত্তি কিমাশ্চর্যমতঃপরম!
বললাম—মহাভারত?
–হ্যাঁ। বকরূপী ধর্মের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের সংলাপ। প্রত্যেক দিনই পৃথিবীতে শতশত মানুষ মরছে, কেউ পার্থিব সম্পদ বেঁচেকা বেঁধে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারছে না। তবু যারা বেঁচে আছে তারা ভাবছে তারা বুঝি চিরকালই বেঁচে থাকবে।
—কিন্তু সবাই এই সার কথা বুঝে সন্ন্যাসী হয়ে গেলে জগৎসংসার কি করে চলবে ঠাকুরমশাই?
—সবাই সন্ন্যাসী হবে কেন? গৃহী কি সৎ হতে পারে না? অনাসক্ত হতে পারে? কিসের সম্পত্তি আর ঐশ্বর্য আর ক্ষমতা নিয়ে অহঙ্কার? জান তো, মা কুরু ধনজনযৌবনগর্বং, নিমেষে। হরতি কালং সর্বং? যদি সম্পদ সংগ্রহ করতে হয়, তাহলে অপরের জন্য করো—মহাকাল সব এক নিমেষে হরণ করতে পারে।
বললাম—যেমন ঘোষালমশাই গ্রামের লোকদের ভাল হবে বলে মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য সোনা জমিয়েছিলেন?
বিশুঠাকুর একমুহূর্ত আমার দিকে রহস্যময় চোখে তাকিয়ে রইলেন, তার ঠোটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির রেখা। তারপর চোখ সরিয়ে নিয়ে হালকা গলায় বললেন-রামরাম কোনোদিনই মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য দেবীর আদেশ পায়নি, তার কোন সোনাও জমানো ছিল না।
বিস্মিত হয়ে বললাম—তার মানে? আপনি যে সবাইকে বললেন নিজের চোখে একমুঠো গিনি দেখে গিয়েছেন–
মিথ্যে কথা বলেছি।
—সে কি! কেন?
—যে সোনা আমার কল্পনায় ছাড়া কোথাও ছিল না, কাজেই হত্যাকারী নিশ্চয় তা পায়নি। যা নেই তা আর পাবে কি করে? কিন্তু আমার এই কথাটা এখুনি গ্রামের মধ্যে প্রচার হয়ে যাবে।
হত্যাকারীও গ্রামের লোক, রামরামের পরিচিত লোক—নইলে প্রথমত সে রামরামের লুকোনো টাকার কথা জানতে পারত না, দ্বিতীয়ত তাকে দেখেই খুনের রাত্রে কুকুরটা চেচাত এবং আক্রমণ করত। সম্ভবত একটু আগে এখানে যে ভিড় জমেছিল, তার মধ্যে সে দাঁড়িয়েছিল। এখন এই সোনার কথা শুনে সে মনে করবে এটা এখনও এ ঘরের মেঝেতেই কোথাও মাটির তলায় পোতা রয়েছে। সোনার লোভ বড় লোভ। আমার বিশ্বাস, এ ভুল শুধরে নিতে সে আবার এখানে আসবে।
শুনে বিশেষ ভরসা হল না। বাঁশবনের ধারে এই চালাঘরে আমরা দুটি প্রাণী। রাত্তিরে যদি রামরামের হত্যাকারী আবার আসে তাহলে আমি অন্তত খুব আনন্দ পাব না।
বললাম—কবে আসবে?
বিশুঠাকুর হেসে বললেন—ভয় নেই, আজ আসবে না। সে বোকা নয়, সে জানে তার হাতে অঢেল সময় রয়েছে। আমরা কাল চলে গেলে সে যে কোনোদিন এসে ধীরেসুস্থে কাজ শেষ করে যাবার কথা ভাববে। একজন অসতর্ক মানুষকে খুন করা সোজা, কিন্তু ধুনী জ্বালিয়ে জেগে, থাকা দু-জন মানুষকে আক্রমণ করা সহজ নয়— আর খামোকা করবেই বা কেন, যখন পরে নিরুপদ্রবে কাজটা সারা যেতে পারে?
একটু ভেবে বললাম—কিন্তু আমরা তো কাল চলে যাচ্ছি, তাহলে এ ফাদ পেতে লাভ কি? খুনি এলেই বা তাকে ধরবে কে? আর ধরলেই বা কি প্রমাণ হবে? রাত্তিরে এই চালাঘরের কাছে ঘুরঘুর করছিল, কাজেই সে রামরাম ঘোষালকে মেরেছে—এমন যুক্তি কি আদালত শুনবে?
বিশুঠাকুর যথার্থ বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন—আদালত? এর মধ্যে আদালত আসছে কোথা থেকে?
—তাহলে?
—পরে বলব। তুমি তো আমার সঙ্গে আছ, দেখতে পাবে।
চুপ করে বসে আছি, সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। বিশুঠাকুর আপনমনে গুনগুন করে একটা শ্যামাসঙ্গীত গাইছেন।
শিবরাম দুধ নিয়ে এল।
-ভয় করছে না তো ঠাকুরমশাই?
—নাঃ। মায়ের নামগান করছি। ভয় কি?
–দরকার হলে চেঁচিয়ে ডাকবেন কিন্তু, কেমন?
—নিশ্চয়। তুমি চিন্তা কোরো না।
শিবরাম চলে গেলে ঠাকুরমশাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-শিবরামকে নিজে এসে দুধ দিয়ে যেতে বলেছিলাম কেন জানো?
—কেন?
—আমরা আসায় এ গ্রামের একজন নিশ্চয় স্বস্তি বোধ করছে না। সে কে, তা তো আমরা জানি না। তাই সাবধানে থাকাই ভাল। সামনে আক্রমণ না করলেও খাবারে বিষ মিশিয়ে দিতে বাধা কোথায়? দুধটা শিবরামের নিজের গরুর, নিশ্চিন্তে খেতে পারো–
-–খাব?
–খাও। শিবরাম তার দাদাকে খুন করেনি।
—কি করে বুঝলেন?
—আমি বুঝতে পারি।
নিজের পোটলা থেকে একটা পেতলের ঘটি বের করে তাতে অর্ধেক দুধ ঢেলে নিয়ে মাটির ভাঁড়টা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন–ধরো।
ঘটিতে একটা চুমুক দিয়ে বিশুঠাকুর বললেন—যে অন্যায় করে, মনে তার সবসময়ই ভয় থাকে—এই বুঝি ধরা পড়লাম! সবার দিকেই সে সন্দেহের চোখে তাকায়। তাই এই সাবধানতাটুকু নিতে হল। শুধু দুধ খেতে কষ্ট হচ্ছে, না?
লজ্জা পেয়ে বললাম—না না—
—আমারই ভুল। তুমি ছোকরা লোক, তোমার খিদে পেতেই পারে। কি খেতে ভালবাস তুমি?
হেসে বললাম—আমার এখন কিছু না হলেও চলবে। তবে একটু আগে মনে পড়ছিল ছোটবেলায় গ্রামের বিরিঞ্চি ময়রার দোকানের মাখা সন্দেশের কথা। মা দুধ আর মাখা সন্দেশ খেতে দিতেন মাঝেমাঝে, কোথায় গেল সে ছোটবেলা?
-মাখা সন্দেশ? মানে কাচাগোল্লা? ভাল মজা তো, আজই বিকেলে তোমার সঙ্গে দেখা হবার একটু আগে খানিকটা মাখা সন্দেশ কিনেছিলাম রাত্তিরে আর কিছু না জুটলে খাব বলে। আর তুমিও কিনা পৃথিবীতে এত জিনিস থাকতে মাখা সন্দেশ খেতে চাইলে। দাঁড়াও—
বিশুঠাকুর পোটলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা শালপাতার ঠোঙা বের করে আমার হাতে দিলেন।
ঠোঙার ভেতরে অনেকখানি কাচাগোল্লা।
ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে বললাম—এটা আপনি বিকেলে কিনেছেন? আমার সঙ্গে দেখা হবার আগে?
-হ্যাঁ। কেন?
—এ সন্দেশ তো এখনো গরম রয়েছে।
একটু থতমত খেয়ে বিশুঠাকুর বললেন—বোঁচকার ভেতর ছিল তো, তাই গরম রয়ে গিয়েছে আর কি আপত্তি করে বললাম—তাই কখনও হতে পারে?
–হতে পারে নিশ্চয়, নইলে, হল কি করে? নাও, আর কথা না বাড়িয়ে খেয়ে ফেল দেখি। তারপর তুমি ঘুমোও, আমি জেগে থাকব।
শুয়ে শুয়ে অনেক রাত্তির অবধি দেখলাম বাঁশবনের মাথা দুলছে তারাভরা আকাশের পটভূমিকায়। ঘুম আসার আগে একবার জিজ্ঞাসা করলাম—আচ্ছা, কেতুর কি হল বলুন দেখি?
গম্ভীর গলায় বিশুঠাকুর উত্তর দিলেন—কেতুকে হত্যাকারী মেরে ফেলেছে, সম্ভবত বিষ মেশানো খাবার দিয়ে। চেনা লোক বলে কেতু চেঁচামেচি করেনি, হাত থেকে খাবারও নিয়েছে।
কিন্তু রামরামকে আঘাত করতে দেখলেই সে, আক্রমণ করত। কাজেই তাকে আগে সরানো একান্ত দরকার ছিল।
—দেহটা কোথায় গেল তাহলে?
-খুব সম্ভব শেয়ালে নিয়ে গিয়েছে। এসব অঞ্চলে সাবধানে দরজা দিয়ে না শুলে অনেকসময় ছোট শিশুকেও বিছানা থেকে শিয়ালে টেনে নিয়ে যায়। আবার শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি, ঘুম আসে না। হঠাৎ আর একটা প্রশ্ন মাথায় আসতে জিজ্ঞাসা করলাম—আচ্ছা, আপনি কেতুর গায়ের রঙের কথা জিজ্ঞাসা করলেন কেন? এটা আমি কিন্তু বুঝতে পারিনি–
চটে গিয়ে বিশুঠাকুর বললেন—বেশ করেছি জিজ্ঞেস করেছি, কেবল প্রশ্ন করে। ঘুমেও না কেন বাপু-কোন ব্যাপারটাই বা এ অবধি বুঝতে পেরেছ?
ঠাকুরকে আর না ঘটিয়ে বিনাবাক্যব্যয়ে পাশ ফিরে শুয়ে অচিরাৎ ঘুমিয়ে পড়লাম। সারারাত স্বপ্ন দেখলাম কেতু ল্যাজ নাড়তে নাড়তে বিশুঠাকুরের হাত থেকে মাখা সন্দেশ খাচ্ছে।
পরের দিন সকালে আমরা শিবরামের কাছে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। সে আমাদের কয়েকটা দিন তার বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণের জন্য বিস্তর অনুরোধ করেছিল, কিন্তু বিশুঠাকুর রাজি হলেন না। তার নাকি কি কাজে আজই সিউড়ি রওনা হতে হবে, থাকার কোন উপায়ই নেই। পরে বরঞ্চ কখনও—ইত্যাদি।
শিবরাম, শ্রীদাম ঘোষ ইত্যাদি অনেকেই গ্রামের সীমানা পর্যন্ত আমাদের এগিয়ে দিয়ে গেল।
স্টেশনের কাছে একটা নির্জন জায়গায় এসে বিশুঠাকুর দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—তারানাথ, এখন আমি যা বলছি খুব মনোযোগ দিয়ে শোন। আমরা সিউড়ি যাচ্ছি না, আমরা আজ এখানেই থাকব—আজকের দিনটা। তারপর রাত্তিরে আবার গ্রামে ফিরে যাব।
অবাক হয়ে বললাম—তার মানে?
—মানে এই, আমরা চলে গিয়েছি মনে করে রামরামের খুনী আজ রাত্তিরেই আমাদের পেতে আসা ফাদে পা দেবে। অত সোনা মাটির তলায় পড়ে আছে জেনে সে শান্তিতে ঘুমোতে পারবে না। মানুষের চরিত্র যতদূর বুঝেছি তাতে আমার দৃঢ়বিশ্বাস আর দেরি না করে আজ রাতেই সে আসবে। তাকে ধরতে গেলে ওই চালাঘরের পাশে জঙ্গলে আমাদের লুকিয়ে বসে থাকতে হবে।
–কিন্তু এ কাজ কি আমাদের দুজনের দ্বারা সম্ভব? খুনীর হাতে তো অস্ত্রও থাকতে পারে। তাছাড়া আগে যা বলেছিলাম, কাউকে ধরলেও সেই যে খুন করেছে তা প্রমাণ করা যাবে না। ধরবার সময় দু-একজন সাক্ষীও থাকা ভাল—
—সব ব্যবস্থা হয়েছে। আমরা রওনা হবার আগে বাড়ির মেয়েরা প্রণাম করতে চায়। বলে শিবরাম আমাকে অন্দরমহলে নিয়ে গেল না? তখনই শিবরামকে আমি সমস্ত কথা খুলে বলেছি। শিবরাম, তার দুই জোয়ান ছেলে আর বাড়ির কয়েকজন কৃষাণ আজ রাত্তিরে না ঘুমিয়ে তৈরি হয়ে বসে থাকবে। আমাদের ডাক শুনলেই তারা দৌড়ে চালাঘরে এসে হাজির হবে। আপাতত দিনের বেলাটা আমরা ইস্টিশনে কোথাও ঘাপটি মেরে কাটিয়ে দিই এস–
এ রকম একটা খুনোখুনির ব্যাপারে আমার জড়িয়ে পড়তে ইচ্ছে করছিল না, আবার ঘটনার শেষটা দেখার জন্য নিদারুণ কৌতূহলও ছিল। ফলে থেকেই গেলাম। ভাল সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম, কারণ এর ফলে জীবনের এক অন্যতম আশ্চর্য অভিজ্ঞতা আমার লাভ হয়েছিল।
প্ল্যাটফর্মের শেষপ্রান্তে কয়েকবস্তা পাটের পেছনে বসে আমাদের দিনটা কেটে গেল। সন্ধ্যা নামতে বিশুঠাকুর উঠে গিয়ে স্টেশনের বাইরের মুদিখানা থেকে কিছু চিড়ে আর গুড় কিনে এনে আমাকে দিলেন।—নাও, তোমার আর রামরামের বাড়ি হয়ে যাবার কোন দরকার নেই, গ্রামের লোকে দেখে ফেলবে। একেবারে সোজা ওই চালাঘরের পুবদিকে আশশেওড়ার ঝোপের পেছনে বসে থেকো। ভয় নেই, আমি সময়মত পৌঁছে যাব—
—সে কি! আপনি আমার সঙ্গে যাবেন না?
—না। দু-জনে একসঙ্গে গেলেই লোকের নজরে পড়বার সম্ভবনা। তুমিও সোজাপথে গ্রামে ঢুকো না, গ্রাম ছাড়িয়ে চলে গিয়ে পেছনের আমবাগান দিয়ে চালাঘরের কাছে চলে যেয়ো।
তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন-আরে! তুমি ভয় পাচ্ছ নাকি? শোন, বিশ্বেশ্বর ভঞ্চায যাকে বলেছে ভয় নেই, তার সত্যিই কোন ভয় নেই। যাও—
লোকটার যাদুকরী ব্যক্তিত্ব আছে। আমি একলা যেতে রাজি হয়ে গেলাম।
অন্ধকারে অচেনা পথে ছমাইল হাঁটতে সময় লাগে। রামরাম ঘোষালের চালাঘরের পুবদিকে আশশেওড়ার ঘন ঝোপের পেছনে যখন গুছিয়ে বসলাম তখন বেশ রাত হয়েছে, অন্তত পল্লীগ্রামে একেই রাত বলে। দূরে কোথাও সংকীর্তন হচ্ছিল, ক্রমে তাও বন্ধ হয়ে গেল। বাঁশঝাড়ে মাটির ওপর পড়ে থাকা শুকনো বাঁশপাতার ওপর দিয়ে মাঝে মাঝে খসখস করে কী যেন যাতায়াত করছে—তাছাড়া আর কোথাও কোন শব্দ নেই। চুপ করে বসে আছি।
কিন্তু কিচ্ছ না করেই বা কতক্ষণ বসে থাকা যায়? রাত কত হল কে জানে? বিশুঠাকুরই বা আসছেন না কেন? আমাকে এরকম বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে তার কি এত দেরি করা উচিত হচ্ছে? মশাও কামড়াচ্ছে বেশ। কিন্তু পাছে শব্দ হয় সেই ভয়ে চাপড় দিয়ে মশা মারতে পারছি। না, হাত নেড়ে নেড়ে তাড়াচ্ছি। নিজের ওপর বেশ রাগও হচ্ছে। জীবনে অনেক কিছু করেছি বটে, কিন্তু কখনও একজন অচেনা হত্যাকারীকে ধরব বলে রাত্তিরবেলা সাপখোপের ভয় উপেক্ষা করে মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে ঝোপের আড়ালে বসে থাকিনি।
এভাবে বহুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর আমার সত্যিই খুব ভয় করতে লাগল। ব্যাপার কি? স্টেশন থেকে ছ-মাইল পথ হেঁটে আসতে যতক্ষণই লাগুক, তাতে এত দেরি হতে পারে না। বিশুঠাকুরের কি হল? আমার কাছে কড়ি না থাকলেও আন্দাজ করতে পারছি রাত অনেক হয়েছে। একা এইভাবে বসে থাকা বিপজ্জনকও বটে। উঠে শিবরামের বাড়ির দিকে চলে যাব কি? কিন্তু ধরা যাক আমিও উঠলাম, আর ওদিক থেকে রামরাম ঘোষালের হত্যাকারী এসে হাজির হল—সেটাই বা কি এমন সুখকর ব্যাপার হবে? তার চেয়ে বরং চুপ করে এভাবে বসে থাকাই ভাল। যদি বিশুঠাকুর না আসেন, অথচ রামরামের হত্যাকারী এসে উপস্থিত হয়, তাহলে সে সমস্তটা ঘরের মেঝে থেকে উঠোন অবধি খুঁড়ে ফেললেও আমি চেচাব না।
তখনও জানি না আমার জীবনের এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতার মুহূর্ত কত কাছে এসে গিয়েছে।
নাকের ফুটোয় একটা মশা ঢুকে পড়ায় হাঁচি এসেছিল, প্রাণপণে হাত মুঠো করে, চোয়াল শক্ত করে সজোরে হেঁচে ফেলবার ইচ্ছে দমন করবার চেষ্টা করছি—এমন সময় আমি যেখানে বসে আছি তার উলটো দিক দিয়ে, অর্থাৎ বাঁশবাগানের পাশের জঙ্গল ঠেলে সন্তপণে কার আসবার আওয়াজ পেলাম।
হাঁচি আপনিই বন্ধ হয়ে গেল।
বিশুঠাকুর এলেন কি?
কিন্তু তিনি এলে আমি যে পথে এসেছি সেই পথে মাঠের মধ্যে দিয়ে ঘুরে আসবেন, নয়তো শিবরামের বাড়ির থেকে সুড়িপথটা ধরে আসবেন-কিন্তু ও রাস্তায় নয়। ওটা তো গ্রামের ভেতর থেকে আসবার রাস্তা।
রামরাম ঘোষালের চালাঘরটা অন্ধকারের স্তুপের মত দাঁড়িয়ে রয়েছে। জঙ্গল ভেদ করে তার পাশে ফুটে উঠল একটা ছায়ামূর্তি, বেশ লম্বামত, হাতে সম্ভবত একখানা শাবল। লোকটা সন্দিগ্ধভাবে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। আমি যেভাবে যেখানে বসে আছি, তাতে আমাকে দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু প্রচণ্ড ঝুঁকির কাজে প্রবৃত্ত হলে মানুষের স্নায়ু একধরনের বিশেষ সংবেদনশীলতা লাভ করে। তাই দিয়ে লোকটা হয়ত অনুভব করেছে আজ রাতে এ জায়গা তার পক্ষে নিরাপদ নয়।
ততক্ষণে আমি লোকটাকে চিনে ফেলেছি।
হরিপদ!
কি নৃশংসতা মানুষ টাকার লোভে করতে পারে! বাবার বন্ধুকে হত্যা করতে তার হাত কাপেনি, আবার আজ এসেছে সোনার লোভে।
হরিপদর মনোবল বোধহয় ভেঙে পড়ল। ইতস্তত করে সে ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ করছে। আমার চুপ করে দেখে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। এমন সময় আমার বাঁদিকে খুব কাছে ঝোপের মধ্যে একটা আওয়াজ শুনে চমকে তাকিয়ে অবাক। হয়ে গেলাম, বুকের মধ্যে বিস্ময়ে আর আতঙ্কে ঢেউ খেলে উঠল।
কখন যেন আমার ঠিক গা ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়েছে একটা বাঘের মত মিশমিশে কালো কুকুর। তার প্রগাঢ় নিঃশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। একদৃষ্টে সে ঝোপের ফাক দিয়ে হরিপদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
হরিপদও বোধহয় কিছু শুনতে পেয়েছিল। সে ফিরে দাঁড়িয়েছে, তার সমস্ত শরীর শক্ত, শাবলটা শক্ত করে ধরে আছে।
একটা গম্ভীর গর্জন করে কুকুরটা লাফিয়ে গিয়ে হরিপদর সামনে খোলা উঠোনে পড়ল। একবার সেদিকে তাকিয়েই মহাতঙ্কে তীব্র আর্তনাদ করে উঠল হরিপদ। আমি এমন রক্তজমানো ভয়ের আর্তনাদ আর কখনো শুনিনি। সঙ্গে সঙ্গে হরিপদ হাতের শাবলটা সজোরে ছুড়ে দিল কুকুরটার দিকে। ভারী লোহার শাবল ডানপায়ের থাবায় এসে লাগতেই কুকুরটা আর একবার তীব্র গর্জন করে হরিপদর ওপর লাফিয়ে পড়ল।
সুড়িপথের দিকে কাদের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, বেশ অনেক মানুষের কণ্ঠ। এতক্ষণে কি এলেন বিশুঠাকুর?
আমি ততক্ষণে উত্তেজনায় আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি, কেন যেন বুঝতে পেরে গিয়েছি হরিপদকে আর ভয় করবার কোন কারণ নেই।
শিবরামের গলা শোনা যাচ্ছে—ভয় নেই ঠাকুরমশাই, এই যে আমরা সবাই এসে পড়েছি!
এদিকে উঠোনে মাটিতে পড়ে দুহাত দিয়ে আত্মরক্ষার ব্যর্থ চেষ্টা করছে হরিপদ, কি এক অপার্থিব আতঙ্ক দেখে যেন তার নিজের পেশীর ওপর সব কর্তৃত্ব চলে গিয়েছে। তার বুকের ওপর শরীরের উর্ধ্বাংশ চাপিয়ে দিয়ে গলায় দাঁত বসাবার সুযোগ খুঁজছে কুকুরটা, ডানথাবা দিয়ে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে, সেদিকে তার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই।
আমার পাশে লোকজন নিয়ে পৌঁছে গিয়েছে শিবরাম, গ্রামের আরও লোকজন। ছুটে আসছে, তাদেরও গলার শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
কুকুরটার দিকে একবার তাকিয়েই শিবরাম চিৎকার করে উঠল—কেতু। তুই কোথা থেকে এলি?
কেতু তখন হরিপদর টুটি কামড়ে ধরেছে, হরিপদর দু-হাত অবশ হয়ে এলিয়ে পড়েছে দুদিকে। কেবল পা-দুটো পর্যায়ক্রমে মৃত্যুবিক্ষেপে সামনে পেছনে নড়ে অদৃশ্য কি একটা বস্তু যেন ঠেলে দেবার চেষ্টা করছে।
শ্রীদাম ঘোষ সহ গ্রামের আরও অনেকে এসে পড়ে বিস্তারিত চোখে উঠোনের ভয়াবহ দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে আছে।
শিবরাম বলল—কিন্তু লোকটা কে? হরিপদ না? বললাম—হ্যাঁ।
এতক্ষণে সম্বিত ফিরে পেয়ে শিবরামের কৃষাণের লাঠি উচিয়ে তাড়া করে গেল। কেতু সরে গিয়ে মুখ তুলে তাকাল একবার। তার কষ বেয়ে গড়াচ্ছে তাজা রক্ত।
তারপরই একলাফে কেতু পাশের ঝোপে পড়ে মিলিয়ে গেল। শোনা গৈল শুকনো বাঁশপাতার ওপর তার পায়ের শব্দ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে।
কৃষাণেরা যখন ধরাধরি করে হরিপদর দেহ রামরাম ঘোষালের চালাঘরের দাওয়ায় এনে রাখল, তখন সে দেহে আর প্রাণ নেই।
শিবরাম বলল—শেষে হরিপদ এই কাজ করল। দাদা ওকে নিজের ছেলের মতন ভালবাসতেন।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম—ঠাকুরমশাই কোথায়?
—তিনি তো আপনার সঙ্গে ছিলেন, আপনার সঙ্গেই থাকবার কথা। আপনি জানেন না?
বিশুঠাকুর আর এলেনই না। পরের দিন সকালে আমিও স্টেশনের দিকে বেরিয়ে পড়লাম! আর থেকে কি হবে? পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে—এবার তাদের কাজ তারা করবে। কোন মামলাও বোধহয় হবে না এ নিয়ে। অন্তত ত্রিশজন গ্রামবাসী ঘটনাটা নিজের চোখে দেখেছে— পাগলা কুকুরের আক্রমণে জনৈক গ্রামবাসীর করুণ মৃত্যু। মামলা আর কি হবে?
কিন্তু কেতু এল কোথা থেকে?
উত্তরটা পেলাম বিশুঠাকুরের সঙ্গে দেখা হবার পর। তিনি পরম প্রশান্তমুখে প্ল্যাটফর্মের চায়ের দোকানে বসে গরম চা খাচ্ছিলেন—আমাকে দেখে বললেন—এই যে তারানাথ এসো। চা খাবে? আমার আর কালকে যাওয়া হল না, বুঝলে? তুমি চলে যাবার পর—বললে বিশ্বাস করবে না—ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। একঘুমে একদম রাত কাবার। জেগে দেখি ভোর হয়ে এসেছে। ভাবলাম আর এতটা পথ হেঁটে কি হবে? তুমি নিশ্চয় এসে পড়বে সকালে। তা কি হল বল রাত্তিরে? খামোকা জাগতে হোল তো?
নিতান্ত গা জ্বালা করা সত্ত্বেও সমস্ত ঘটনাটা তাকে বললাম। তাঁর বিশেষ কোনো ভাবপরিবর্তন হল বলে মনে হল না। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে পেয়ালা নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন—যাঃ! শেষ অবধি হরিপদর এই কাজ! ব্যাটা একেবারে নরাধম, ঠিক। শাস্তি হয়েছে।
—আপনি বলেছিলেন কেতু মারা গেছে।
-ভুল বলেছিলাম। বেঁচে আছে তো দেখাই যাচ্ছে। যাক গে, ট্রেনের প্রথম ঘণ্টা পড়ছে—টিকিট কাটো গে যাও।
একটু চুপ করে থেকে বললাম—আমি আপনার সঙ্গে আর যাব না—
—কোথায় যাবে তবে?
—কোলকাতার দিকে যাব। কাজ আছে।
বিশুঠাকুর হেসে বললেন—বেশ, তাই যেয়ো। আমাকে ট্রেনে তুলে দাও অন্তত। তোমার গাড়ির তো দেরি আছে।
গাড়িতে তুলতে গিয়ে খেয়াল করলাম বিশুঠাকুর খোড়াচ্ছেন, ডানপায়ের পাতায় ন্যাকড়ার পট্টি বাধা।
আমার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে এল, বললাম—একি! আপনার পায়ে কি হয়েছে? কাল বিকেলেও তো দেখিনি
বিশুঠাকুর বললেন—ও কিছু নয়, প্ল্যাটফর্মের বেড়া পার হতে গিয়ে কাটা-তারে লেগে কেটে গিয়েছে।
আমি একদৃষ্টে বিশুঠাকুরের ডানপায়ের পট্টির দিকে তাকিয়ে আছি। হরিপদর সেই আর্তনাদ, শাবল ছুড়ে মারা—কেতুর ডানপায়ে রক্তের ধারা। তবে কি–
ট্রেন ছেড়ে দিল। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বিশুঠাকুর হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। সেই শেষ, আর কখনও তাকে দেখিনি।