তারানাথের সেদিন কোন কাজ ছিল না
তারানাথের সেদিন কোন কাজ ছিল না। সন্ধ্যের দিকে এমনিতেই তার বৈঠকখানা ফাকা থাকে, আজ যেন বড় ফাকা। তারানাথ বসে একা হুকো খাচ্ছে। আমাদের দেখে খুশী হয়ে বলে উঠল—আরে এস এস, তোমাদের কথাই ভাবছিলাম।
কিশোরী বলল—হঠাৎ আমাদের কথা ভাবছিলেন যে বড়?
—হঠাৎ নয়। আজ সারাদিন কোন কাজ নেই, বুঝলে? অন্য অন্য দিনে কোষ্ঠী করাতে না হোক, অন্তত হাত দেখাতে দু’চারজন এসেই যায়। দিনের খরচাটা যা হোক করে—বুঝলে না? আজ একটা পয়সা আমদানী নেই। হাত-পা কোলে করে বসে থেকে বিরক্তি ধরে যাচ্ছিল। তোমরা আসায় বাঁচলুম।
বললাম—কিন্তু আমরা তো খদের নই।
তারানাথ বলল—না-ই বা হলে। পয়সা না পাই, আড্ডা দিয়ে তো বাঁচব। তোমাদের তো বলেইছি, পয়সা কম উপার্জন করিনি জীবনে। বৈষয়িক লোক হলে অনেক জমিয়ে ফেলতে পারতাম। পয়সার মায়া নেই আমার। দিন চলে গেলেই খুশি। যাবার সময় কটা পয়সা গাটে বেঁধে নিয়ে যেতে পারব মনে কর?
চারি পেয়ালায় চা নিয়ে এল। তারানাথ পাকা মজলিশী লোক। চা খেতে খেতে সে গল্প জমিয়ে তুলল। কিছুক্ষণ নানা বিষয়ে কথা হবার পর কিশোরী বলল—ভালো কথা, আজকের কাগজ দেখেছেন? তরুবালা হত্যাকাণ্ডের মীমাংসা হয়ে গিয়েছে। প্রত্যক্ষদশীর বিবরণ অনুযায়ী ফাঁসির হুকুমও হয়ে গিয়েছে দেখলাম।
খবরটা দেখেছি বটে। কিছুদিন আগে কোলকাতার এক কুখ্যাত পাড়ায় তরুবালা নামে একটি পতিতা মেয়ে খুন হয়। খুনী কোন সূত্র রেখে যায়নি। তাই নিয়ে ক’দিন কাগজে খুব হৈ চৈ চলেছিল। আজ কাগজে বেরিয়েছে খুনী ধরা পড়ার খবর! অপর একটি পতিতা মেয়ে বাথরুমে লুকিয়ে থেকে সমস্ত খুনের দৃশ্যটা দেখেছিল। এতদিন প্রাণের ভয়ে কিছু বলেনি। কিন্তু পুলিশী জেরার চাপে আর বিবেকের তাড়নায় সে শেষপর্যন্ত সব স্বীকার করেছে। বস্তুত তার বিবৃতিকে নির্ভর করেই অপরাধীর শাস্তি হয়ে গেল।
আমি বললাম—সত্যি, মেয়েটার দোষ নেই। প্রাণের ভয় সবারই আছে। তাছাড়া চোখের ওপর একটা খুন দেখলে মনের অবস্থা কেমন হয় কে জানে। একজন মানুষকে পাঁচহাতের মধ্যে মেরে ফেলা হচ্ছে—উঃ! ভাবা যায় না।
কিশরী বলল–সত্যি বলেস, খুনের প্রত্যক্ষদর্শীর মনের অবস্থা কি হয় ভারি জানতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কে বলতে পারবে?
তারানাথ বলল—আমি পারি। আমি আর কিশোরী তারানাথের কথায় অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। বলে কি তারানাথ? ঠাট্টা করছে নাকি? কিন্তু সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে ঠাট্টা করবার লোক তো তারানাথ নয়। তাহলে?
কিশোরী আমার চেয়ে আগে সমস্ত পরিস্থিতিকে সামলে নিতে পারে। সে জিজ্ঞাসা করল কি করে বলবেন?
তারানাথ গম্ভীর গলায় বলল—কারণ আমি চোখের সামনে একটা খুন হতে দেখেছি।
তারানাথের কাছে অনেক অদ্ভুত গল্প শুনেছি, কিন্তু এ ব্যাপারে একেবারেই অপ্রত্যাশিত। এবার কিশোরীও কোনো কথা বলল না। তারানাথ আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল—খুন হয়েছিল বটে, কিন্তু সে খুনের জন্য কারো ফাসি হয়নি। আমি ছাড়া আরো কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিল। কেস আদালতে ওঠে, কিন্তু পরে যে খুন করেছিল, সে ছাড়া পেয়ে যায়। শুনবে গল্পটা? তাহলে বলি।
শোনবার জন্য আমাদের অনুরোধ করার সামান্যই প্রয়োজন ছিল। তারানাথ এক কলকে তামাক সেজে বলতে শুরু করল।
বছর দশেক আগের কথা। তখন আমার কাছে অমরনাথ ভট্টাচার্য বলে এক ভদ্রলোক প্রায়ই আসতেন। ব্যক্তিগত একটা বিপর্যয়ে পড়ে আমার কাছে হাত দেখাতে এসেছিলেন। আমার কথামতো রত্ন ধারণ করে সে বিপদ কেটে যায়। তারপর থেকে কৃতজ্ঞতাবশতই হোক আর আমাকে ভাল লেগে যাওয়ার জন্যই হোক, সপ্তাহে অন্তত তিনদিন উনি আড্ডা দিতে আসতেন। অতি অমায়িক মানুষ। আড্ডাবাজ এবং ভালো গল্প বলিয়েও বটে। আমাদের আলাপ খুব জমে উঠেছিল।
একদিন অমরবাবু সন্ধ্যের দিকে এসে হাজির হলেন। দেখলাম উনি কিছু অন্যমনস্ক, কোনো চিন্তায় মগ্ন থাকলে যেমন হয়। চা খাচ্ছেন, হ্যা-হু করে আমার কথার উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু আড্ডা যেন ঠিক জমছে না।
একসময় বলে ফেললাম—আপনার কি হয়েছে বলুন তো? কিছু ভাবছেন?
অমর ভট্টাচার্য একমুহূর্ত কি ভাবলেন, তারপর বললেন—ভেবেছিলাম বলব না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বললে আপনাকেই বলা উচিত। অন্যে হেসে উড়িয়ে দেবে কিন্তু আপনি হয়তো বুঝতে পারবেন।
বললাম—খুলে বলুন।
–আমার এক বাল্যবন্ধু আছেন। তার নাম বিজয় চাটুজ্জে। অনেকদিন বিয়ে হয়েছে বটে, কিন্তু একটি বই সস্তান হয়নি। মেয়ে সন্তান—নাম সুবালা। এখন তার বয়েস তেরো। মেয়েটি দেখতে খুব সুন্দরী। পড়াশুনাতেও ভালো। বিজয় প্রাচীনপন্থী গোড়া লোক নয়। মেয়েকে সে লেখাপড়া শিখিয়ে উপযুক্ত করে বিয়ে দিতে চায়। সবই তো ভাল চলছিল, কিন্তু হঠাৎ এক বিপদ উপস্থিত হয়েছে।
–কি হয়েছে?
—সুবালা আজকাল কেমন কেমন সব কথাবার্তা বলতে শুরু করেছে। যার কোনো মানে হয় না এমন সব অসংলগ্ন কথা। বিজয় খুব ভয় পেয়ে গিয়েছে, সে সন্দেহ করছে সুবালার বোধহয় মস্তিষ্কবিকৃতির লক্ষণ দেখা দিয়েছে।
—কি ধরনের অসংলগ্ন কথা? অশ্লীল কিছু?
—আদৌ না। সবার সঙ্গে বসে আলাপ করতে করতে থেমে গিয়ে কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। তারপর একটা ঘুম ঘুম ভাবের মধ্যে নানা অদ্ভুত কথা বলছে।
—সে কথাগুলো কি?
অমর ভট্টাচার্য বললেন—সে ঠিক বলে বোঝানো যাবে না। আপনি চলুন না একবার। আপনি তো নানা রকম বিষয় জানেন। হয়তো আপনাকে দিয়ে বিজয়ের একটা উপকার হয়ে যাবে। সুবালাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার আগে আপনি একবার চলুন।
বললাম—বিজয়বাবু কোথায় থাকেন?
–এই কাছেই, অবিনাশ দত্ত লেনে। কাল যাবেন?
আমার কৌতুহল জেগে উঠেছিল, বললাম—বেশ তো, বলে রাখবেন আপনার বন্ধুকে। কাল সন্ধ্যার দিকে যাওয়া যাবে এখন।
-–ঠিক আছে আমি এসে আপনাকে নিয়ে যাব। তৈরি থাকবেন।
পরের দিন গেলাম বিজয় চাটুজ্যের বাড়ি। সাধারণ মধ্যবিত্ত গৃহস্থ, তবে সচ্ছল অবস্থা। ভদ্রলোক বেশ সুপুরুষ। চল্লিশ পেরিয়েও চুলে পাক ধরেনি বা কপালে একটি রেখাও পড়েনি। আমাকে আপ্যায়ন করে বসিয়ে বললেন—বড় বিপদে পড়েছি ঠাকুরমশায়। আমার এই একটি মাত্র সন্তান। ওর যদি কিছু হয় তাহলে আমাদের আর কোনো সাত্বনা থাকবে না। শুনেছেন তো সব অমরের কাছে?
বললাম—মেয়েটিকে একবার ডাকুন না, দেখি।
বিজয়বাবু নিজে গিয়ে হাত ধরে সুবালাকে নিয়ে এলেন। অমর ভট্টাচার্জ ঠিকই বলেছিলেন। মেয়েটি অপরূপ সুন্দরী। বাড়ন্ত গড়নের জন্য সত্যিকার বয়সের চেয়ে অনেক বড় দেখায়। সুবালা ঘরে ঢুকতেই আমি চমকে সোজা হয়ে বসলাম। মেয়েটি সাধারণ মেয়ে নয়। আমাদের তন্ত্রশাস্ত্রে কিছু কিছু অতিলৌকিক দেহলক্ষণের বর্ণনা আছে। সুবালার শরীরে সেগুলি বর্তমান।
আমার চমকে ওঠা বিজয়বাবু লক্ষ্য করেছিলেন, কিন্তু মেয়ের সামনে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না। আমি আদর করে কাছে বসিয়ে সুবালার সঙ্গে কথা বলতে লাগলাম। বেশ স্বাভাবিক মেয়ে, কোন দিক দিয়ে কোন ব্যতিক্রম নেই। কিছু পরে বিজয়বাবুকে বললাম—যান, ওকে ভিতরে দিয়ে আসুন।
বিজয় চাটুজ্জে বললেন, যাও তো মা, ভিতরে গিয়ে মাকে বলো খাবার পাঠাতে।
সুবালা চলে যেতে আমিই প্রথমে বললাম–ভয় নেই বিজয়বাবু, আপনার মেয়ের কোন অসুখ করেনি। এটা পাগলামির পূর্বাভাস নয়।
—তবে?
—আপনার মেয়ের শরীরে কয়েকটা দিব্যলক্ষণ রয়েছে। কি লক্ষণ তা আমি বলব না। অন্যের চেয়ে আপনার মেয়ে কিছু আলাদা হবেই। এ আপনি রোধ করতে পারবেন না।
বিজয়বাবু অপ্রসন্নমুখে চুপ করে রইলেন। বুঝলাম আমার ব্যাখ্যা তার ঠিক মনঃপূত হয়নি। তা আর আমি কি করতে পারি? মেয়ের তো কোন অসুখ নেই বা অপদেবতা ভর করেনি যে আমি মাদুলি দিয়ে কি যজ্ঞ করে সারাবার চেষ্টা করব।
এমন সময় ভেতরবাড়িতে একটা হৈচৈ-এর শব্দ শোনা গেল। কয়েকজন মহিলার সম্মিলিত কণ্ঠস্বর। বিজয়বাবু তাড়াতাড়ি করে উঠতে উঠতে বললেন—ওই সুবালা বোধহয় আবার অমন করছে। আসুন ঠাকুরমশায় আমার সঙ্গে, দেখে যান।
সামান্য ইতস্তত করে তার পেছন পেছন বাড়ির ভেতর ঢুকলাম। লম্বা বারান্দা পেরিয়ে একটা ঘরের সামনে দাঁড়া লেন বিজয়বাবু। সে ঘর থেকেই গোলমাল ভেসে আসছে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ভেতরে উকি দিলাম।
দেয়ালে হেলান দিয়ে মাটিতে বসে আছে সুবালা। চোখ দুটো অর্ধেক বোজা। সেই অবস্থাতেই বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। আমাকে দেখে ঘরের মহিলারা ঘোমটা টেনে দিলেন।
বিজয়বাবুকে বললাম—ওঁদের একটু সরে দাঁড়াতে বলুন তো। আমি একবার আপনার মেয়ের কাছে যাব।
বিজয়বাবুকে কিছু বলতে হল না। আমার কথা শুনে মেয়েরা নিজে থেকেই ঘরের এক কোণে সরে গেলেন। আমি গিয়ে হাঁটু গেড়ে সুবালার পাশে বসে ডাকলাম— সুবালা! শুনতে পেল কিনা বোঝা গেল না, অন্তত বাহিরে তার কোনো প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেল না। মনে মনে ইষ্ট স্মরণ করে সুবালার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতেই তার কথা বন্ধ হয়ে গেল। যেন সে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ছে। জানো তো, মধুসুন্দরী দেবী আমাকে ওই ধরনের কয়েকটি ক্ষমতা দান করেছিলেন। সুবালাও শান্ত হয়ে এল, গভীর নিঃশ্বাস পড়তে লাগল।
আমি মৃদুস্বরে বললাম—বলো মা, কি বলছিলে বলো।
সুবালা টেনে টেনে বলল—খোকা পড়ে যাচ্ছে যে! আমিও পড়ে যাচ্ছি। পেছন থেকে ঠেলে দিল—আমার কোলে খোকা—
বললাম—খোকা কে?
—আমার খোকা।
—তোমার ছেলে?
উত্তর নেই।
—মাথায় কি কষ্ট। উঃ, পাথর এসে লাগল মাথায়।
—কে ধাক্কা দিল তোমাকে?
আর উত্তর নেই। এবারে সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটি।
বিজয়বাবুকে বললাম—ওকে বিছানায় শুইয়ে দিন। ঘুমিয়ে পড়েছে। আর আপনি আমার সঙ্গে আসুন, কথা আছে।
বাইরের ঘরে এসে বললাম কিছু বুঝতে পারলেন? না, মানে—ঠিক—
—আপনার মেয়ে জাতিস্মর।
—জাতিস্মর!
—হ্যাঁ, সুবালা সম্ভবত আগের জন্মের কথা মনে করতে পারে। যেসব কথাকে। আপনারা অসংলগ্ন বলে মনে করছেন, তা আসলে ওর আগের জন্মে ঘটে যাওয়া ঘটনা। এই কারণেই ওর শরীরে নানা দিব্যলক্ষণ রয়েছে। জাতিস্মর হওয়া আত্মার খুব উঁচু অবস্থার পরিচয়।
বিজয়বাবু বললেন—তাহলে এখন আমাদের কি করা কর্তব্য?
—কিছুই নয়। এ ভাব আপনিই কেটে যাবে। আমি আরও একটি জাতিস্মর মেয়েকে দেখেছিলাম, বয়েস বাড়তে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে জন্মান্তরের স্মৃতি কমে আসতে থাকে। সুবালার কতদিন এরকম হয়েছে?
বিজয়বাবু একটু ভেবে বললেন—তা প্রায় বছরখানেক হবে।
-তাহলে তো অনেক বেশি বয়েসে শুরু হয়েছে বলতে হবে। জন্মান্তরের স্মৃতি সাধারণত পাঁচ-ছয় বছর বয়েসে জেগে উঠে এই বয়েসে মিলিয়ে আসতে থাকে। যাক, কিছু না করে শুধু দেখে যান। সুবালা আপনিই সেরে যাবে।
সেদিন ফিরে চলে এলাম। তারপর বছর কয়েক ধরে মাঝে মাঝে বিজয় চাটুজ্জের বাড়ি গিয়েছি, কখনো বা উনি আর অমরনাথ আমার কাছে এসে সুবালার খবর দিয়েছেন। মোটের ওপর বলতে গেলে—দু’বছরে আমরা সুবালার গত জন্মে কি ঘটেছিল সে সম্বন্ধে একটা ধারণা করতে পারলাম। বিভিন্ন সময়ে আচ্ছন্ন অবস্থায় সুবালা যা বলেছিল তার ওপরে নির্ভর করেই আমরা কিছু জোড়াতালি দিয়ে সমস্ত ব্যাপারটা আন্দাজ করেছিলাম। কিন্তু আমাদের আন্দাজ যদি সত্য হয়ে থাকে—হয়ে থাকে কেন, নিশ্চয়ই সত্য—কারণ পরে যা ঘটেছিল তাতে আর কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়—তাহলে সে বড় মর্মম্ভদ ঘটনা।
কিশোরী বলল—আপনারা কি আন্দাজ করেছিলেন?
তারানাথ বলল—সুবালা ওই ঘোরলাগা অবস্থায় প্রায়ই বলত সে তার ছেলেকে নিয়ে যেন কোনো উঁচু জায়গা থেকে পড়ে যাচ্ছে! মাথায় আঘাত পাওয়ার কথা বলত। একদিন ও টান করে চুল বেঁধে এসেছে, দেখলাম বাঁদিকের কপালে একটা লম্বা দাগ, পুরনো ক্ষত শুকিয়ে এলেও যেমন দাগ শুকিয়ে যায়—তেমনি। বিজয়বাবুকে বলতে তিনি বললেন ওটা সুবালার জন্মদাগ।
বললাম—খেয়াল করেছেন কি, সুবালা আচ্ছন্ন অবস্থায় মাথার যেখানে আঘাত লাগার কথা বলে, এই দাগটাও ঠিক সেখানেই।
বিজয়বাবু বললেন—তাও কি হয়? গতজন্মের আঘাতের দাগ এজন্মে ফুটে ওঠে?
বললাম—জানি না। তবে পৃথিবীতে অনেক কিছুই যে সম্ভব সে তো দেখতেই পাচ্ছেন। যাক্, দু’বছরে যা জানতে পেরেছিলাম তা খুব স্পষ্ট না হলেও মোটামুটি এই—সুবালা গতজন্মে একটি শিশুসন্তান নিয়ে বিধবা হয়। পরে কে বা কারা কোনো উঁচু স্থান থেকে সম্ভবত কোনো টিলার ওপর থেকে সন্তানসহ সুবালাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে হত্যা করে। কিন্তু কেন হত্যা করে, এবং হত্যাকারীর নাম কি—এসব খবর আমরা কিছুতেই জানতে পারিনি। এখানে এসেই সুবালার কথা আটকে যেত! মনের ওপর চাপ পড়লে ক্ষতি হতে পারে ভেবে আমিও জোর করিনি কখনো।
এখানে একটা কথা বলে রাখি। এই ঘটনায় আমি বুঝতে পেরেছিলাম মাতৃস্নেহ কি জিনিস। সস্তানের প্রতি মায়ের টান বিশ্বের একটা বড় শক্তি। সুবালা মাত্র তেরো বছরের কিশোরী— এজন্যে এখনো সে মা হয়নি কিন্তু আধো-অজ্ঞান অবস্থায় যখন সে বলত—খোকা পড়ে যাচ্ছে! খোকাকে বাঁচাও—তখন তার মুখে যে ব্যাকুলতা ফুটে উঠত, তা মাতৃহৃদয়ের গভীর অভিব্যক্তি ছাড়া হয় না। গতজন্মের হারানো ছেলের প্রতি এই আর্তি একটু কমে এল। এইভাবে আরো বছর দুই কেটে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে সুবালা অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এল! এখন তার বয়েস হল সতেরো। একদিন বিকেলে অমরবাবু এসে বললেন—একটা ভালো খবর আছে। বেশ বড় রকমের ভোজ আসন্ন।
বললাম—কি ব্যাপার? গৃহিণী পুত্রমুখ দর্শন করবেন নাকি?
-দূর। আপনার যেমন সব কথা! এই বয়েসে—যাকগে। কথা হচ্ছে এই আমাদের বিজয় চাটুজ্জের মেয়ের বিয়ে বোধ হয় লাগল।
-কার, সুবালার?
হ্যাঁ। আগামী পরশু পাত্রের বাবা দেখতে আসছেন জব্বলপুর থেকে। প্রবাসী বাঙালী। পাত্রও সেখানেই ব্যবসা করে। বিরাট অবস্থা। মেয়ে সুন্দরী শুনে দেখতে আসছে। নইলে বিজয়ের যা আর্থিক সঙ্গতি, এরকম ঘরে তারা ছেলের বিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতো না। আপনিও আসুন না ওদিন। বিজয় আমাকে বলেছিল আপনাকে নিয়ে যেতে। একটা শুভদিন—আপনার মত সদব্রাহ্মণ উপস্থিত থাকলে সুবালার মঙ্গল হবে।
মেয়ে দেখার দিন বিজয় চাটুজ্জের বাড়ি গেলাম অমরের সঙ্গে। এসব সামাজিক উৎসব আমার ভালোই লাগে। তারপর মেয়ে দেখানোর ব্যাপার, ভালো খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে নিশ্চয়ই। আমি ভোজন রসিক চিরদিনই। ধুতি-চাদর চাপিয়ে বিকেলে গিয়ে হাজির হলাম।
তখনও ছেলের বাবা এসে পৌছান নি। বিজয়বাবু আমাদের আদর করে নিয়ে বৈঠকখানায় বসালেন। তামাক এল, চা-খাবার এল। বিজয়বাবু একবার সুবালাকে ডেকে এনে প্রণাম করিয়ে নিয়ে গেলেন। সুবালা মাথায় হঠাৎ যেন অনেকখানি লম্বা হয়ে গিয়েছে। চোখ-মুখ যেন তুলি দিয়ে আঁকা। সত্যি সুন্দরী বটে। মাথায় হাত দিয়ে প্রাণভরে আশীর্বাদ করলাম—সুখী হও মা।
জীবনে এমন ব্যর্থ আশীর্বাদ আর করিনি।
বিজয় চাটুজ্জে বললেন—ঠাকুরমশায় কিন্তু আজ রাত্তিরে এখানেই খেয়ে যাবেন। মাংস চলে তো?
খুব চলে। আমি ঘন্টানাড়া পুরুত বামুন নই।
সবারই মন বেশ ভাল। বিজয়বাবুর মনের আনন্দ কিছুটা বাইরে বেরিয়ে আসছে। কেনই বা হবে না? বড়লোকের ঘরে মেয়ে বিয়ে দিতে চলেছেন। বিয়ে প্রায় ঠিকই বলতে গেলে। পাত্রের কে এক আত্মীয় মেয়ে দেখে গিয়ে ওখানে দারুণ প্রশংসা করেছেন। আজ বাবা দেখে গেলেই পাকাপাকি হয়ে যায়।
সন্ধ্যে ঠিক সাতটায় দরজার কড়া নড়ে উঠল। বিজয় ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে গিয়ে একটু পরেই এক দোহারা চেহারার সুপুরুষ প্রৌঢ় ভদ্রলোককে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আলাপ করিয়ে দিয়ে বিজয়বাবু বললেন—ইনি হচ্ছেন সনাতন মুখোপাধ্যায়, পাত্রের বাবা। আমরা নমস্কার করলাম। সনাতনবাবু আমাকে প্রণাম করার ধার দিয়েও গেলেন না। অর্থ থাকলেও অনেক ধনী ব্যক্তির ব্যবহারে একটা নম্রতা থাকে। ইনি সে দলের নন। বেশ জবরদস্ত লোক। আমাদের নমস্কারের উত্তরে একটা দায়সারা প্রতিনমস্কার করেই তাড়া দিয়ে বললেন—চাটুজ্জেমশাই মেয়েকে আনুন। আমার হাতে বেশি সময় নেই। এখুনি আবার উঠতে হবে। কোলকাতায় এসেছিলাম ব্যবসার একটা জরুরি কাজে। ভাবলাম এলাম যখন একবার দেখেই যাই। নইলে এমনিতে তো আর বড় একটা আসা হয়ে ওঠে না।
এমন দু’চারটি কথায় ভদ্রলোক বেশ স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিলেন তার আর বিজয়বাবুর মধ্যে অবস্থার বিস্তর প্রভেদ। বুঝিয়ে দিলেন যে তিনি নেহাত ব্যবসার কাজে আসতে হয়েছিল বলেই দয়া করে মেয়ে দেখে যাচ্ছেন। বুঝলাম বিয়ে হয়ত হবে, কিন্তু কুটুম্বের দিক দিয়ে বিজয়বাবুর বিশেষ সুখ হবে না। কিন্তু কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার অত সম্মানজ্ঞান থাকলে চলে না। বিজয়বাবু তাড়াতাড়ি করে ভেতরে গেলেন মেয়েকে আনবার কথা বলতে। আমরা মুখ নিচু করে নীরবে বসে রইলাম। এক একজন লোক আছে, যাদের সামনে কিছুতেই আড্ডা জমানো যায় না। সনাতন মুখোপাধ্যায় সেইরকম লোক। একটু বাদেই ভেতর থেকে খাবার এল। মেয়েদের নিজের হাতে তৈরি খাবার। সনাতনবাবু সে-সব স্পর্শও করলেন না। কেবল চা খেলেন এককাপ। আর অনর্গল মেয়ে দেখানোর জন্য তাড়া দিতে লাগলেন। বিজয়বাবু মুক্তকচ্ছ হয়ে বারবার সে তাড়া বাড়ির ভেতরে পৌঁছে দিয়ে আসতে লাগলেন। বস্তুত এমন অভব্য মানুষ খুব কমই দেখেছি।
এইবার ঘটল আসল ঘটনা, যে কাহিনী বলবার জন্য বসেছি।
একটু বাদেই যে একটা বিরাট কিছু ঘটতে চলেছে তা আমরা ঘূণাক্ষরেও জানতে পারিনি। বেশ সুন্দর পরিবেশ। একটি বিয়ের প্রাককথন হবে, কিছু বাদে একটি ভোজের আভাসও রয়েছে। কে জানত কি ভয়াবহ ব্যাপার ঘটতে চলেছে আর কয়েক মিনিটের মধ্যে।
ভেতরবাড়ির দিকে চুড়ির শব্দ হতে বিজয়বাবু উঠে গিয়ে সুবালাকে হাত ধরে ঘরের ভেতরে নিয়ে এলেন। আমি বেশ ভাল করে তখন তার মুখ দেখেছিলাম। হলপ করে বলতে পারি, সে মুখে তখন কোনো অস্বাভাবিকতা বা পাগলামির চিহ্নমাত্র ছিল না। আমি সুবালাকে বসতে জায়গা করে দেব বলে উঠে সরে যাচ্ছি, অমরনাথও সরে বসবার উদ্যোগ করেছে, হঠাৎ কেমন একটা অদ্ভুত আওয়াজে মুখ তুলে তাকিয়েই পাথর হয়ে গেলাম।
সুবালার চোখ বিস্ফারিত, জিঘাংসু উন্মাদের মত সে তাকিয়ে কাছে সনাতন মুখুজ্জের দিকে। সনাতনবাবুও বিস্মিত হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। সুবালার সমস্ত শরীরের পেশী শক্ত হয়ে গিয়েছে। চোখ তীব্র ক্রোধে জ্বলে উঠেছে, ঠোটের ভঙ্গি ক্ষিপ্ত।
বিজয়বাবু ভয় পেয়ে কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন। তার মনের অবস্থা সহজেই অনুমান করা যায়। অনেক দিন মেয়ে এমন করেনি। একেবারে সেরে গিয়েছে, এই ভরসায় তার বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। আজ এত বছর পরে আবার সুবালার এমন। হবে কে জানত! তিনি বোধহয় কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই ঘরের মধ্যে সুবালার তীব্র আক্রোশপূর্ণ গলা ছড়িয়ে পড়ল—ওই! ওই লোকটাই আমার খোকাকে মেরে ফেলেছে, আমাকে মেরে ফেলেছে।
বলে কি সুবালা! বিয়ে তো আর হচ্ছেই না, কিন্তু এতে ব্যাপার অন্যদিকে অনেকদূর গড়িয়ে যেতে পারে। বিজয়বাবু ধমক দিয়ে বললেন—আঃ, কি বলছিস্ চুপ কর।
কাকে কি বলা! সুবালা কালনাগিনীর মত ফুলছে। বলছে—টাকার জন্য খুন। করেছিলি, না? দাদাকে মেরে শান্তি হয়নি। সম্পত্তি পাবার জন্য আমাকে আর খোকাকে পাহাড় থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলি। বেশ! কিন্তু এবার তোকে কে বাঁচাবে?
সনাতনবাবুর মুখ সাদা হয়ে গিয়েছে। অবাস্তব, অসম্ভব বিভীষিকা দেখলে মানুষের মুখ যেমন হয়। তিনি অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন—বৌদি।
সেই মুহূর্তেই সুবালা টলতে টলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বিজয়বাবু স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, অমর ভায বারবার বলছেন—চলে যান, সনাতনবাবু, আপনি এক্ষুনি এখান থেকে চলে যান। আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে সনাতনবাবুর সামনে গিয়ে বললাম—বৌদি কে?
সনাতনবাবু ঠকঠক করে কাপছেন। বললেন—অ্যাঁ?
আমি আবার বললাম—বৌদি বলে কাকে ডাকলেন? কাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলেন পাহাড় থেকে?
সনাতনবাবু আর কোনোদিন কোন কথা বলার সুযোগ পাননি। আমার পেছন থেকে হঠাৎ বিজয়বাবু ‘ধর ধর করে চিৎকার করে উঠলেন। আমি চমকে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি সুবালা একটা বিরাট বঁটি নিয়ে ঘরে ঢুকছে। তার কাপড় প্রায় খুলে গিয়েছে, চোখে খুনীর দৃষ্টি। আরো পেছনে দৌড়ে আসছেন মহিলারা। ব্যাপারটা চোখের নিমেষে ঘটে গেল। অমরবাবু খাট থেকে নেমে, বা আমি আর বিজয়বাবু এগিয়ে গিয়ে বাধা দেবার আগেই সুবালা ঝড়ের বেগে দৌড়ে এসে সনাতন মুখুজ্জের গলায় বঁটিটা বসিয়ে দিল। বিকৃত একটা শব্দ করে সনাতনবাবু পড়ে গেলেন। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল। সুবালা পড়ে গেল অজ্ঞান হয়ে।
মিনিট দশেক পরে মোড়ের ডাক্তারখানা থেকে যখন ডাক্তার নিয়ে ফিরে এলাম, তখন আর সনাতনবাবুর দেহে প্রাণ নেই। ঘণ্টা দুই পরে সুবালার জ্ঞান ফিরেছিল। কিন্তু এতসব ঘটনা তার কিছুই মনে নেই। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।
সনাতনবাবুর ছেলে কেস চেপে দেবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পুলিশ ছাড়েনি। পুলিশ সুবালার বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনে। কিন্তু জজ বুদ্ধিমান। এ খুনের কোনো মোটিভ নেই, তাছাড়া আসামীপক্ষ থেকে বলা হয়েছিল মেয়ে পাগল। আমার আর অমর ভচ্চাযের সাক্ষ্যেও কাজ হয়েছিল। সুবালা খালাস পেয়ে যায়।
গতজন্মে টাকার লোভে বিধবা সুবালা আর তার সন্তানকে হত্যা করেছিল সনাতন! সেই সম্পত্তি পেয়েই জব্বলপুরে ব্যবসা ফেঁদেছিল সে। এদিকে সুবালা কোলকাতায় বিজয় চাটুজ্জের মেয়ে হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। ভগবানের মার বড় সাংঘাতিক মার। কোথা থেকে সনাতন মুখুজ্জেকে এসে শাস্তি নিয়ে যেতে হল। নিজের জন্য অতটা নয়—কিন্তু তার সন্তানের মৃত্যুর কথা ভুলতে পারেনি সুবালা। সনাতনকে দেখামাত্র দপ করে জ্বলে উঠেছিল জন্মান্তরের স্মৃতি।
তারানাথ থামল। অন্যদিন গল্পের শেষে কিশোরী যা হোক একটা টিপ্পনী কাটে। আজ সেও চুপ করে বসে রইল। বাইরে ল্যাম্পপোস্টে আলো জ্বলে উঠেছে। ঘরের মধ্যে কেমন একটা বিষণ্ণতা। তারানাথও আর কোন কথা বলছে না।
শেষে আমিই স্তব্ধতা ভেঙে বললাম—আজ যাই। আর একদিন আসব।