Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তনু অতনু সংবাদ || Samaresh Majumdar

তনু অতনু সংবাদ || Samaresh Majumdar

ডুডুয়া একটি নদীর নাম

প্রথম প্রকাশ, অগ্রহায়ণ ১৪১২
TANU ATANU SAMBAD Bye Samaresh Majumder A Bengali novel published by Mitra & Ghosh Publishers Pvt. Ltd.

শ্ৰীযুক্তা অর্চনা রায়কে
সশ্রদ্ধায়
সমরেশ

ডুডুয়া একটি নদীর নাম। পাহাড়ি ঝরনাগুলো মিলে মিশে সমতলে পৌঁছে নদীর চেহারা নেয়, এ নদীও নিয়েছিল। নিয়ে মাইল তিরিশেক গিয়ে সব জল ঢেলেছে জলঢাকার পেটে। অতএব নদীর দৈর্ঘ্য বেশি নয়। তবে এর জল শীত গ্রীষ্মে কমে গেলেও একেবারে শুকোয় না। তখন বেশ শান্ত বালিকার মতো তিরতিরিয়ে বয়ে যায়। ওইটুকু যাওয়ার পথে তাকে একবারই মাথার ওপর। সেতুকে মেনে নিতে হয়েছে। কারণ ন্যাশনাল হাইওয়ে ওখান দিয়ে চলে গেছে আসামে। নদীর নাম বহুকাল আগে কেউ দিয়েছিল ডুডুয়া। তাই ন্যাশনাল হাইওয়ের পাশে বছর আশি আগে যে জনপদ গড়ে উঠেছিল তার নামকরণ হয়েছিল নদীর নামে, ডুডুয়া।

জনপদ, তবে সেখানকার মানুষের সংখ্যা মেরে কেটে হাজার তিনেক। একটা পোস্ট-অফিস, ব্লক অফিস, কয়েকটা মুদির দোকান, একটা প্রাইমারি স্কুল ছাড়া কয়েক বছর হল সরকারি চিকিৎসালয় তৈরি হয়েছে এখানে। একটা ভাটিখানাও গজিয়ে উঠেছে গ্রামের শেষপ্রান্তে জঙ্গলের গায়ে।

জঙ্গল কেটে বসতি। আর কে না জানে এসব সম্ভব হয়েছে একটা লোকের জন্যে। সতীশ রায়। কিন্তু ওর কথা বলতে গেলেই লোকে বলে ডুডুয়ার সতীশ রায়। এই জায়গার নাম, নদীর নাম আর মানুষটির নাম একসঙ্গে জুড়ে গেছে। ডুডুয়ার একমাত্র কাঠচেরাই-এর কারখানার মালিক সতীশ রায়ের বয়স এখন বাহান্ন। বছর পনেরো আগে ম্যালেরিয়ায় ভুগে ওঁর স্ত্রী মারা যান। তাকে জলপাইগুড়ির হাসপাতালে ভর্তি করিয়েও বাঁচাতে পারেননি তিনি। ডাক্তাররা বলেছিল, বড্ড দেরি করে নিয়ে এসেছেন। ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হয়ে গেছে। একমাত্র ছেলে সত্য তখন সাত বছরের। স্ত্রীর চলে যাওয়ার আঘাত সতীশ রায় মুখ বুজে সহ্য করেছিলেন শুধু ছেলের দিকে তাকিয়ে। আত্মীয়স্বজন, স্তাবকেরা বলেছিল আবার বিয়ে করতে। অন্তত ছেলেকে মানুষ করার জন্যে আর একজন মহিলার প্রয়োজন। কানে তোলেননি সতীশ রায়। বাড়ির পুরোনো কাজের মহিলা মতির মাকে ডেকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন সত্যর দেখাশোনা করার। কিন্তু স্ত্রীর মৃত্যুর আড়াই বছরের মধ্যে অনেক লেখালেখি, তদ্বির করে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র খুলিয়ে ছিলেন ডুডুয়াতে। যাতে ম্যালেরিয়া হলেই ঠিকঠাক ওষুধ এলাকার মানুষ পায় সেই চেষ্টা করেছেন। নদীতে মশা জন্মায় খুব কম। মশার ডিম তো মাছেরাই খেয়ে ফেলে। সতীশ রায়ের উদ্যোগে ডুডুয়া গ্রামের কোথাও কোন ভাঙা পাত্রে, গর্তে জল জমে যাতে মশা ডিম না পাড়তে পারে তার ব্যবস্থা হয়েছে।

এই ডুডুয়া গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ কৃষিজীবী। হাইওয়ের এপাশে গ্রাম, ওপাশে চাষের জমি। আর কিছু মানুষ কাঠের কারখানায় কাজ করে। এছাড়া পোস্ট অফিস, স্বাস্থ্যকেন্দ্র অথবা দোকানগুলোর কর্মচারীরা আছে। কিন্তু সবাই জানে, বিপদে আপদে মাথার ওপর সতীশ রায় আছেন। ডুডুয়ার সতীশ রায়কে চেনে না এমন লোক জেলার এই তল্লাটে নেই।

স্ত্রীর চলে যাওয়ার পর একটি অভ্যেসে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন সতীশ রায়। সন্ধের মুখে তার দুই স্তাবক চলে আসেন। সতীশেরই সমান বয়সি। একজন গোরক্ষনাথ, অন্যজন নাগেশ্বর। দুজনেই খুব শীর্ণ চেহারার, বেঁটে। কিন্তু দুজনের মুখের হাসি কখনই বন্ধ হয় না। এরা নিঃশব্দে হাসতে জানেন।

গোধূলির একটু পরেই ওরা চলে এল। গোরক্ষনাথ আকাশের দিকে মুখ তুলে বলল, আমি বলছি, আজ বৃষ্টি হবে না। কাল পূর্ণিমা বলে কথা।

নাগেশ্বর মাথা নাড়ল, ঠিক হল না। কথাটা হবে, পূর্ণিমার আগের দিন বৃষ্টি হয় না। চক্ষুলজ্জা বলে তো একটা কথা আছে।

নদীর গায়ে বাগান। বাগানের শেষে বাড়ি। সতীশ রায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাগানে এসে দাঁড়ালেন। পরনে পাঞ্জাবি আর পাজামা। হাতে বার্মা চুরুট। দুই স্তাবকের দিকে তাকিয়ে ভু কোঁচকালেন, নাগেশ্বর, আজ দুপুরে কিছু খাওনি?

হাত কচলাল নাগেশ্বর, একেই বলে দিব্যদৃষ্টি। দেখলে গোরক্ষনাথ, ঠিক ধরে ফেলেছেন। ঈশ্বরের আশীর্বাদ না থাকলে এরকম হয় না।

গোরক্ষনাথ বলল, আজ ওর স্ত্রীর মঙ্গলচণ্ডীর উপোস।

তাই বলো। তাই তোমাকে রোগা দেখাচ্ছে। সতীশ রায় বললেন, তা আজ কোথায় আসন পাতবে?

গোরক্ষনাথ বলল, বলছিলাম কী, আজ বৃষ্টি হবে না। ভালো বাতাসও বইছে। নদীর ধারে টেবিল চেয়ার পেতে বসলে কেমন হয়।

একটু বাদেই চাঁদ উঠবে। আপনি তো জ্যোৎস্না খুব পছন্দ করেন। নাগেশ্বর সবিনয়ে মনে করিয়ে দিল।

করতাম। পনেরো বছর আগে। যাকগে। সতীশ রায় গলা তুলে ডাকলেন, হরিপদ, হরিপদ!

সঙ্গে সঙ্গে একজন প্রৌঢ় কাজের লোক সামনে এসে দাঁড়াল।

সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন, খোকা কোথায়?

তার ঘরে। হরিপদ জবাব দিল।

কী করছে এখন?

আজ্ঞে, লেখালেখি করছে।

লেখালেখি? কী লেখে?

তা জানি না। লেখে আর কাটে। নিজের মনেই থাকে।

হুঁ। মতির মাকে বলল কী লেখে তা জিজ্ঞাসা করতে। আর হ্যাঁ, নদীর ধারে টেবিল আর চারটে চেয়ার লাগাও। জলদি। সতীশ রায় এগিয়ে গিয়ে ডুডুয়ার পাড়ে দাঁড়ালেন। মনে হল, ওখানে বসলে জল, আকাশ এবং জলে আকাশ সবই দেখা যাবে।

গোরক্ষনাথ বলল, আজ একটা চেয়ার বেশি বললেন?

ভয় নেই। তাতে তোমাদের ভাগ কম হবে না। বলতে বলতে জলে। মাছের ঘাই-এর শব্দ শুনতে পেলেন সতীশ রায়। তার মুখে হাসি ফুটল। বললেন, দ্যাখো, কাজ হয়েছে। বলেছিলাম বছরে ছয়মাস কেউ নদীতে ছিপ বা জাল ফেলবে না। লোকে কথা শুনেছে বলেই মাছগুলো গায়ে গতরে বেড়েছে।

নাগেশ্বর বলল, কার ঘাড়ে কটা মাথা যে আপনার কথা শুনবে না।

হরিপদ টেবিল চেয়ার এনে সাজিয়ে দিল। দুটো বোতল এল। একটা দামি হুইস্কি অন্যটা অতি সাধারণ। সতীশ রায়ের জন্যে কাজুবাদাম আর ওদের জন্যে চিনে বাদাম! সতীশ রায়ের জন্যে ফোঁটানো জল আর বরফ, অন্যদের জন্যে কুয়োর জল। সতীশ রায় বসলেন সেই চেয়ারে যেখানে বসলে চাঁদের মুখ দেখতে পাবেন। অন্য দু-জন তার উলটো দিকে। হরিপদ পরিবেশন করে চলে গেল।

চীয়ার্স। সতীশ রায় গ্লাসে ঠোঁট রাখলেন।

চীয়ার্স, চীয়ার্স। দু-জন বলতেই জলে ভালো শব্দ হল। প্রথম ঢোঁক গিলে সতীশ রায় বললেন, কাতলা। দেড় কেজি ওজন। পেটে ডিম নেই।

গোরক্ষনাথ বলল, তার মানে পেট পাতলা হয়নি। আহা।

সতীশ রায় বললেন, আমার এই ডুডুয়ায় কত রকমের মাছ আছে জানো? আমি তো আট রকমের খোঁজ পেয়েছি। রুই, কাতলা, পারশে, ট্যাংরা, খলসে, পুঁটি, বান, শোল।

নাগেশ্বর মাথা নাড়ল, আর একটা মাছ নদীতে এলে ষোলকলা পূর্ণ হত।

গোরক্ষনাথ মুখ তুলল, ভেটকি?

দূর! নাগেশ্বর সতীশ রায়ের দিকে তাকাল, ইলিশ ডুডুয়ায় পেলে কী ভালো হত।

গোরক্ষনাথ হাসল। তার টাক মাথার চামড়ায় ঢেউ খেলে গেল। শুনলেন বড়বাবু? ডুডুয়াতে ইলিশ এলে ছিপে ধরবেন নাগেশ্বর। আরে ইলিশ হল সমুদ্রের মাছ। এ কথা তো বাচ্চারাও জানে। নদীতে পাওয়া যাবে কী করে?

খুব রেগে গেল নাগেশ্বর, নাঃ! সঙ্গ ত্যাগ না করলে চরিত্র নিম্নমুখী হয়। বড়বাবু স্নেহ করেন বলে না এসে পারি না। আচ্ছা, গঙ্গা, পদ্ম, রূপনারায়ণ এরা কী নদী নয়? এদের জলে কি ইলিশ পাওয়া যায় না?

সতীশ রায়ের মজা লাগছিল। বললেন, ঠিক কথা। তবে ওসব নদীতে ইলিশ ঢুকে পড়ে সমুদ্র থেকে ডিম পাড়তে। তখনই ধরা পড়ে।

সেকথাই তো বলছি। গঙ্গায় যেমন ঢোকে ডুডুয়াতেও যদি ঢুকত?

গোরক্ষনাথ বলল, ঢুকবে কী করে? ডুডুয়া গিয়ে মিশেছে জলঢাকায়। জলঢাকা পড়েছে তোৰ্যায়, তোৰ্ষা ব্ৰহ্মপুত্রে, ব্ৰহ্মপুত্ৰ সমুদ্রে। ব্রহ্মপুত্রে ইলিশ ঢোকে।

সেকথাই তো বলছি। ইলিশগুলো তো নদী বেয়ে বেয়ে এখানে চলে আসতে পারত। কি বড়বাবু, পারত না? নাগেশ্বর তাকাল।

সতীশ রায় মুখ তুললেন, সঙ্গে সঙ্গে দূরের গাছগাছালির ওপর প্রায়-গোল একটা আলোর বল লাফিয়ে উঠে বসল। মুগ্ধ হয়ে গেলেন তিনি। এখনই চরাচর জ্যোৎস্নায় ছেয়ে যাবে। চাঁদের শরীরের কলঙ্ক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তিনি বললেন, মন ভালো হয়ে গেল। তিনি গ্লাসে বড় চুমুক দিলেন।

আজ্ঞে, ইলিশের কথা উঠলে আমারও মন ভালো হয়ে যায়।

তাহলে তুমি পেছনে তাকিয়ো না।

পেছনে? কী আছে পেছনে? নাগেশ্বর তাকাতে গিয়েও তাকাল না।

চাঁদ উঠেছে। বিশাল চাঁদ। আহা, চক্ষু সার্থক হল।

এই কথা! চাঁদের মুখে সূর্যের আলো পড়েছে বলেই চাঁদ সুন্দর। আবার সেই চাঁদের আলো আপনার মুখে পড়ায় আমি ধন্য হয়ে গিয়েছি।

কেন? সতীশ রায় চোখ ছোট করলেন।

আপনাকে এখন পরমসুন্দর দেখাচ্ছে।

সতীশ রায় কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু হরিপদকে আসতে দেখে থমকে গেলেন। হরিপদ কাছে এসে নিচু গলায় বলল, তরুণ সংঘের ছেলেরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। কাল আসতে বলব?

গোরক্ষনাথ বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ তাই বলো। এখন বড়বাবুকে বিরক্ত কেন করবে?

সতীশ রায় উঠে দাঁড়ালেন, আমি যাচ্ছি।

বাগানের ভেতর দিয়ে জ্যোৎস্নায় হাঁটতে অসুবিধে হল না। গেটের ওপাশে ছেলেগুলো দাঁড়িয়ে। কুড়ি থেকে পঁচিশের মধ্যে বয়স। তরুণ সংঘ নাম দিয়ে ক্লাব করেছে। আশেপাশের গঞ্জে ফুটবল খেলে বেড়ায়। সতীশ রায় প্রেসিডেন্ট। প্রতিবছর বল কিনে দিতে হয়, খেলতে যাওয়ার সময় গাড়ি ভাড়াও তাঁকেই জোগাতে হয়। ছেলেগুলো বেকার। চাযের সময় বাপ কাকাকে সাহায্য করতে মাঠে যায় বটে, বাকি সময়টা নিষ্কর্মা হয়ে থাকে।

হ্যাঁ। বলল, কী ব্যাপার? সতীশ রায় গেটের সামনে চলে এলেন।

পরশু খেলা আছে। বানারহাটের সঙ্গে। যেতে হবে। একজন বলল।

নিশ্চয়ই যাবো। কিন্তু তোমাদের সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। সতীশ রায় বললেন।

ওরা নিজেদের দিকে তাকাল। একজন বলল, কেউ কি কোনও অন্যায় করেছে।

না না, এক কাজ করো। আমি কাল সকাল সাড়ে নটায় বেরুব। তোমরা ঠিক নটায় এখানে চলে আসবে। তোমাদের ক্যাপ্টেন কে?

এক এক ম্যাচে এক একজন হয়।

হুঁ, কিন্তু কাল আসার আগে একজনকে নেতা ঠিক করে আসবে। যাও।

ওরা চলে গেলে ফিরে এসে তিনি দেখলেন দু-জনেই গ্লাস ভরে নিয়েছে। তাকে বলতে হল না, ওরাই তার গ্লাস ভরে দিতেই পাশের নদীর জলে আবার ঘাই মারল মাছ।

খেলতে যাবে বুঝি? নাগেশ্বর জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ, তবে কাল ওদের আসতে বলেছি অন্য কারণে। এই ছেলেগুলোকে একটা রোজগারের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে চাই। সতীশ রায় বললেন।

কী রকম?

ডুডুয়ায় এখন প্রচুর মাছ। আওয়াজ তো শুনছ। তরুণ সংঘের ছেলেরা ছয় মাস ধরে এই মাছ ধরবে। ধরে হাটে গিয়ে মাছওয়ালাদের কাছে বিক্রি করবে। খরচ বাদ দিয়ে যা লাভ হবে তা নিজেরা সমান ভাগ করে নেবে। যে ছয়মাস মাছ ধরা হবে না সেই ছয়মাস ওরাই নদী পাহারা দেবে। কী? আইডিয়াটা কেমন লাগছে? সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন।

অপূর্ব। চমৎকার। অবস্থা ফিরে যাবে ওদের। গোরক্ষনাথ বলল।

একটা কথা। শুধু ছেলে কেন, মেয়েদেরও যদি জুড়ে দিতেন। নাগেশ্বর বলতে বলতে আড়চোখে গোরক্ষনাথকে দেখল।

গোরক্ষনাথ ফিক ফিক করে হাসি শুরু করেছে।

নাগেশ্বর হজম করল। গোরক্ষর মেয়ে নেই। সংসারে আইবুড়ো মেয়ে বসে থাকলে যে জ্বালা বাবার মনে ধরে তা ও কী করে বুঝবে।

মাস্টারনি থেকে মেছো, ভাবাটাই অন্যায়। গোরক্ষ বলল।

কার কথা বলছ? সতীশ রায় তাকালেন।

আজ্ঞে নাগেশ্বরের মেয়ে। আপনি বলে দেওয়ায় সে পাঠশালার মাস্টারের কাছে পড়ানো শিখেছে। মাস্টারের চাকরি তো এই চৈত্রেই শেষ হবে। তারপর পাঠশালার যে কী হাল হবে! গোরক্ষ হতাশ।

কেন? আমার মেয়ে কি খারাপ পড়াচ্ছে? মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করেছি। তিনি তো একটাও কুকথা বললেন না। তবে পোস্ট-অফিসের অবস্থা খুব খারাপ। কথা ঘোরাল নাগেশ্বর।

কেন? দ্বিতীয় গ্লাস শেষ করলেন সতীশ রায়। এটাই তাঁর কোটা। কালেভদ্রে তৃতীয় গ্লাস চলতে পারে, রোজ কখনই নয়। মদ আর মস্তিষ্ক কখনই বন্ধু হতে পারে না। যতক্ষণ মদকে মস্তিষ্ক দাবিয়ে রাখতে পারে ততক্ষণ পান করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

পোস্টমাস্টার ফ্যামিলি নিয়ে কলকাতায় গিয়েছে। ব্যাস, কর্মচারীদের পোয়াবারো। ঠিক সময়ে পোস্ট-অফিস খুলল না, খুললেও ডিউটিতে থাকছে না। নাগেশ্বর জানাল।

এই সময় হরিপদ কাছে এসে দাঁড়াল, এক ভদ্রলোক দেখা করতে চান।

কে? সতীশ রায় সোজা হয়ে বসলেন।

বললেন উনি ঘটকমশাই। হরিপদ বলল।

নাগেশ্বর হাসল, তুমি এই খবর দিতে এলে হরিপদ! বড়বাবুর যদি ইচ্ছে থাকত তাহলে কয়েক বছর আগেই বিয়ে করতে পারত। কাটিয়ে দাও।

আঃ! বড্ড বেশি কথা বলো তুমি! ধমকালেন সতীশ রায়। তারপর মাথা নাড়লেন, নিয়ে এসো এখানে।

হরিপদ চলে গেল।

গোরক্ষ বলল, কথাই আছে, যে বেশি বকে সে বাজে কথা বলে।

হরিপদ যাকে নিয়ে এল তার বয়স ষাট পেরিয়েছে। পরনে ধুতি আর বাবু শার্ট। কাঁধে কাপড়ের ঝোলা। সামনে এসে দুহাত কপালে ঠেকিয়ে ঝুঁকে নমস্কার জানিয়ে টেবিলের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন। এ হে হে, বড় অসময়ে এসে পড়লাম।

সতীশ রায় বললেন, বসো।

বসব? আপনাদের এখন সেবার সময়।

শোনো ঘটকবাবু, ন্যাকামি আমি সহ্য করতে পারি না।

চেয়ার টেনে দ্রুত বসে পড়লেন ঘটকবাবু। বসে তাকালেন দুজনের দিকে।

গোরক্ষ বলল, আমি গোরক্ষ, ইনি নাগেশ্বর। বড়বাবুর স্নেহধন্য।

আমার দুই সাপ। তবে বিষ নেই। তেঁড়া বা হেলে বলতে পারো। সতীশ রায় হাসলেন, তা, এখন কটা বাজে?

আজ্ঞে সাতটা। নাগেশ্বর বলল।

তোমার শেষ বাস কখন?

এখান দিয়ে সাড়ে সাতটায় যায়। ঘটকবাবু বললেন।

তাহলে একদম সময় নেই। এক গ্লাস চলবে?

না না। শরীর নাড়ালেন ঘটকবাবু, সন্ধান পেয়েছি বড়বাবু।

বাঃ! গুড। বাড়ি কোথায়?

আলিপুরদুয়ারের কাছে।

বয়স?

আজ্ঞে বলছে কুড়ি। দু-বছর জল মেশালে বাইশ ধরতে পারেন।

চলবে। বৃত্তান্ত বলল।

পরমাসুন্দরী, যেমন নাক, তেমন চোখ, তেমন গড়ন, গায়ের রঙ ওই জ্যোৎস্নার চেয়েও সুন্দর। মানে যাকে বলে–।

আঃ! অন্য গুণ বলো!

হ্যাঁ। গৃহকর্মনিপুণা, রন্ধনে দ্রৌপদী, সূচিশিল্পে দক্ষ, মৃদুভাষিণী, এরকম পাত্রী ভুভারতে পাওয়া যাবে না।

তুমি ওঠো! সতীশ রায় গম্ভীর গলায় বললেন।

অ্যাঁ? চমকে উঠলেন ঘটকবাবু।

তোমাকে সেদিন বলেছিলাম আমার প্রতিমার দরকার নেই।

তাহলে?

কান খুলে শোনো, আমার ছেলে সত্যচরণের জন্যে আমি একটি সুশ্রী পাত্রী চাই, যার দিকে তাকালে মন বিরূপ হবে না। ডানাকাটা সুন্দরীর কোনও দরকার নেই। কিন্তু আমার একটাই শর্ত আছে। মাথা নাড়লেন সতীশ রায়।

আদেশ করুন। ঝোলা থেকে খাতা বের করলেন ঘটকমশাই।

সেই মেয়ের স্বভাবে একটু নষ্টামির ঝোঁক থাকতে হবে।

সেকি! আঁতকে উঠলেন ঘটকমশাই।

আর দেরি করলে বাস পাবে না।

কিন্তু, কোনও বাপ বলবে যে তার মেয়ের স্বভাবে নষ্টামি আছে? ঘটকমশাই খাতা ব্যাগে ঢোকালেন।

ওঃ! আমি নষ্টামি বলিনি। বলেছি নষ্টামির ঝোঁক। বোঝনি?

না।

বাতাস জোরে বইলে কী বলি আমরা?

আজ্ঞে ঝড়।

যদি খুব ধীরে বয়?

মধুর হাওয়া।

ঠিক তাই।

কিন্তু বড়বাবু, কোনও বাপ স্বীকার করবে না।

বাপ না করুক মা করবে। সতীশ রায় বললেন।

মা না করুক প্রতিবেশিরা করবে। নাগেশ্বর বলল।

উঠে দাঁড়ালেন ঘটকমশাই। তাঁর মুখ চুপসে গিয়েছে।

আচ্ছা, চলি।

ঘটকমশাই চলে গেলে গোরক্ষ বলল, আহা, বেচারির মুখ দেখে মনে হল পাঁচ কেজি মাছ বঁড়শি থেকে ছিটকে গেল।

নাগেশ্বরের গলা জড়িয়ে এল, বড়বাবু।

সতীশ রায় উঠে দাঁড়ালেন, আমার খাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে।

একটা কথা! নাগেশ্বর উঠে দাঁড়াতে পা টলল।

চটপট বলল। মাতালদের অসহ্য লাগে আমার।

খোকার জন্য ওরকম পাত্রী চাইছেন কেন? নাগেশ্বর জিজ্ঞাসা করল।

সতীশ রায় একটা আঙুল তুললেন, এভাবে সোজা করে আঙুল বোতলে ঢোকালে ঘি উঠবে? তার জন্যে আঙুলটা একটু বাঁকাতে হয়। বাড়ির দিকে চলে গেলেন সতীশ রায়।

হরিপদ প্রায় লাফিয়ে এল সামনে, বাড়ি যান।

এখনও গ্লাসে রয়েছে যে–। গোরক্ষ বলল।

গ্লাসের তরল পদার্থ ঘাসের ওপর ফেলে দিয়ে হরিপদ বলল, আর নেই, বাবুকে খেতে দিতে হবে, দেরি করিয়ে দেবেন না।

জ্যোৎস্নায় গোরক্ষ আর নাগেশ্বর বাড়ির দিকে পা বাড়াল হাত ধরাধরি করে।

ভোর ভোর সময়টায় ঘুম ভেঙে যায় ডুডুয়ার সতীশ রায়ের। মুখ ধুয়ে তিনি চলে আসেন বাগানের এপাশে, ডুডুয়া নদীর ধারে। বড়সড় নদী নয়, তবু এই কালো ছায়ামাখা নদীর দিকে তাকালে মন ভরে যায়। সতীশ রায়ের পিতৃদেবের ইচ্ছেয় জায়গার নাম ডুডুয়া হয়েছে বলে কথিত আছে। তখনও এখানে ধানের চাষ হত, এপাশে ছিল জঙ্গল। ধূপগুড়ির উপকণ্ঠে বাড়ি ছিল তাদের। যাতায়াতে অসুবিধে হত, জায়গাতেও কুলাচ্ছিল না, তাই বন কেটে জমির গায়ে বাড়ি তৈরি করা হয়েছিল। লোকে বলে তাঁদের পরিবারের জন্যেই এখানকার সবাই ভাল আছে। বাবার কাছে শুনেছেন সতীশ রায়, পাকিস্তান হওয়ার পর পূর্ববঙ্গ থেকে চলে আসা উদ্বাস্তুদের বেশ বড় দুটো দল এখানেও আশ্রয় নিয়েছে। তখন নিজেদের সংখ্যা কম হওয়ায় তারা সাগ্রহে ওদের সাহায্য করেছেন। বেশির ভাগই জলপাইগুড়ি কুচবিহার সীমান্তের ওপারের মানুষ। ভাষা, সংস্কৃতিতে কোনও পার্থক্য না থাকায় মিশে যেতে অসুবিধে হয়নি। এখন আর ডুডুয়াতে খালি জমি নেই। যা আছে তা সরকারি খাস জমি অথবা বনবিভাগের সম্পত্তি। ভালই হয়েছে তাতে, জনসংখ্যা আর না বাড়াই ভালো।

একটা ছিপ নৌকো দেখতে পেলেন সতীশ রায়। চিৎকার করলেন, কে যায়?

আঙে আমি তারিণী। লগি নৌকোয় তুলে হাতজোড় করল লোকটা।

ও। তা এই সাতসকালে চললে কোথায়? মাছ ধরতে নাকি?

ছি ছি ছি। আপনি নিষেধ করেছেন, অমান্য করতে পারি?

তোমার ছেলে তরুণ সংঘে খেলে, তাই তো?

আর বলবেন না। এক পয়সা রোজগার নেই, শুধু খেলা আর খেলা। বড়বাবু ওর একটা ব্যবস্থা করে দিন না। তারিণী কাতর গলায় বলল।

হবে, শিগগির হবে। তা তুমি নদীতে কী করছ?

মেয়ের বাড়ি যাচ্ছি। নাতির শরীর খারাপ খবর এসেছে।

মেয়ের বাড়ি কোথায়?

জোড়াপানিতে, বাসে গেলে দুবার পালটাতে হয়, পয়সাও লাগে। নদী বেয়ে গেলে এক ঘণ্টায় পৌঁছে যাব মাগনায়। নদীর পাশেই বাড়ি।

বাঃ! বেশ ভালো। যাও।

তারিণীর ছিপ নৌকো অদৃশ্য হওয়ামাত্র একটা কাতলা মাছ লাফিয়ে জলের ওপর উঠেই নেমে গেল। এক লহমায় তার চকচকে শরীর দেখতে পেয়ে খুব খুশি হলেন সতীশ রায়। বেশ ভালো স্বাস্থ্য মাছটার।

তখনই তার মাথায় বুদ্ধিটা এল। এই যে ছেলেগুলো খেলা-পাগল, খেলেই চলেছে কিন্তু কী করে ভালো খেলতে হয় তা শেখানোর কোনও লোক নেই। নিজেরাই যা পারছে খেলছে। শহর থেকে কোচ আনলে কী রকম খরচ পড়ে? জলপাইগুড়ির টাউন ক্লাবের অবনীদার সঙ্গে তাঁর এককালে পরিচয় ছিল। ওঁকে জিজ্ঞাসা করলে কেমন হয়? আজ শহরে যেতে হবে ডিসি অফিসে। তখন যদি সময় পান তাহলে অবনীদার সঙ্গে দেখা করবেন।

সকাল নটায় ভাত খেয়ে নিলেন সতীশ রায়। খাওয়া শেষ হতে মতির মাকে ডেকে পাঠালেন। বৃদ্ধা এসে দরজার পাশে দাঁড়াল মাথায় ঘোমটা দিয়ে। চেয়ারে বসে পান চিবোচ্ছিলেন সতীশ রায়। জিজ্ঞাসা করলেন, এখন এই বাড়িতে কে রাঁধছে মতির মা?

আজ্ঞে আমি।

লোক দ্যাখো। ভালো রান্না জানা এমন কাউকে আনন। যত বয়স হচ্ছে। তোমার হাতের রান্না তত খারাপ হচ্ছে। রান্নায় যে ঝাল দিতে হয় তাও ভুলে গেছ।

খোকা ঝাল একদম খেতে পারে না। কষ্ট হয়। মতির মা বলল।

মাথা নাড়লেন সতীশ রায়। তারপর বললেন, তোমার ওই খোকার রান্না তুমি বেঁধে, আমার জন্যে ভালো রাঁধুনি খুঁজে আনো। কথাটা বলেই খেয়াল হল, তাঁর, সত্যকে এখানে আসতে বলে।

মতির মা যেন আঁতকে উঠল, ওকে বকবেন না বড়বাবু।

বকব? আমি তাকে বকবো বলে কেন মনে হল! যত্ত সব! যাও, পাঠিয়ে দাও।

মতির মা চলে গেল। সিগারেট শেষ করলেন তিনি। সারাদিনে এক প্যাকেট সিগারেট, সন্ধের পর একটা দামি চুরুট। ডাক্তাররা বলে নেশাটা খারাপ, কিন্তু কিছু করার নেই। সত্যর মা বলত, তুমি সিগারেট খেলে গন্ধটা বেশ লাগে, কিন্তু চুরুটের গন্ধ সহ্য করতে পারি না। তখন সন্ধের পরে মদ্যপান করতেন না, তাই চুরুট খাওয়া বন্ধ রেখেছিলেন। হঠাৎ দরজার দিকে তাকাতেই দেখলেন, সত্যচরণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

তুমি ওখানে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? জিজ্ঞাসা করলেন সতীশ রায়।

আপনি ডেকেছেন! মাথা নিচু করে জবাব দিল সত্যচরণ।

তাতে সাড়া দিয়ে তুমি এঘরে এসেছ সেটা জানান দেবে তো!

সত্যচরণ কথা বলল না। মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকল।

কি করছিলে?

পড়ছিলাম।

কী বই?

শরৎচন্দ্রের পশ্লীসমাজ।

পাও কোথায়?

হরিপদদা এনে দেয় লাইব্রেরি থেকে।

শোনো, অনেক হয়েছে। কাল থেকে তুমি আমার সঙ্গে বেরুবে। অনেক বয়স হয়েছে। ঘরে বসে বই পড়ে সময় নষ্ট করা চলবে না। আমার ব্যবসাগুলো কীভাবে চলছে শিখে নাও। কানে ঢুকল? ছেলের দিকে তাকালেন সতীশ রায়।

কাল থেকে যেতে বলবেন না। মুখ তুলল না সত্যচরণ।

কেন? কী রাজকাজ আছে তোমার?

এই মাসটায় আমি খুব কষ্টে থাকি।

কষ্টে থাকো? কেন?

এই মাসেই মা স্বর্গে গিয়েছিল।

থমকে গেলেন সতীশ রায়। হ্যাঁ, কথাটা ঠিক। তবে পনেরো বছর বাদে ওটা মনে রাখার বিষয় নয়। এমন মাতৃভক্ত ছেলে যে অনেক বছর পরেও মায়ের মৃত্যুমাসে কষ্টে থাকে! ভাবা যায়?

হুম, ঠিকু আছে। মনে রেখো আমার সঙ্গে ছলচাতুরি করে তুমি পার পাবে না। ও হ্যাঁ, শুনলাম ঘরে বসে তুমি নাকি কিছু লেখো আর কাটো। কী ব্যাপার?

চুপ করে থাকল সত্যচরণ।

দ্যাখো, তোমার কোনও বন্ধু নেই, কোথাও গল্প করতে যাও না। তরুণ সংঘের ছেলেরা খেলাধুলা করে, তাদের সঙ্গেও তোমার সম্পর্ক নেই, একদম ঘরকুনো হয়ে থাকলে চলবে? যাও।

বলমাত্র সত্যচরণ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কিন্তু হরিপদ এল, ক্লাবের ছেলেরা এসেছে দেখা করতে। বলল, আপনি আসতে বলেছেন।

হুঁ, শোনো হরিপদ। সত্য কী লেখে আর কাটে তা আমি দেখতে চাই।

আমাকে মতির মা খোকার ঘরে ঢুকতে দেয় না।

তাহলে তাকেই বলে একটা পাতা জোগাড় করে আনতে।

বলবো, এই একটু আগে খোকা একটা পাতা ছিঁড়ে পাকিয়ে মেঝেয় ফেলে দিতেই মতির মা সেটা যত্ন করে কুড়িয়ে নিয়েছে।

বাঃ, ওই পাতাটা মতির মায়ের কাছ থেকে নিয়ে এসো। আমার হুকুম।

বাইরে বেরিয়ে এলেন সতীশ রায়।

ছেলেগুলো দাঁড়িয়ে আছে বাগানে। একটু অস্বস্তিতে। এদের মধ্যে তারিণীর ছেলে শেনটা? বুঝতে পারলেন না। জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের দলে কজন আছে?

কুড়ি-জন।

কিন্তু এখানে তো বারোজনকে দেখতে পাচ্ছি।

বাকি আটজন বয়সে ছোট। মোল সতেরো। তাই নিয়ে আসিনি।

যে ছেলেটি কথা বলছিল তার দিকে তাকালেন। ওর নাম মঙ্গল। ব্যাক। খেলে। ভালোই খেলে।

তমাদের জন্যে একটা পরিকল্পনা করেছি। তোমরা সবাই জানো গত ছয়মাস ধরে চূড়ুয়া নদীর এই এলাকায় মাছ ধরা বন্ধ আছে। আগামী ছয়মাস মাছ ধরা যাবে এবং সেটা ধরবে তোমরা ঘোষণার ভঙ্গিতে বললেন সতীশ রায়।

গুঞ্জন উঠল।

সতীশ রায় বললেন, তার আগে তোমাদের একটা কো-অপারেটিভ তৈরি করতে হবে। এই বারোজন হবে সেই কো-অপারেটিভের মেম্বার। আমি গতরাতে বলে দিয়েছিলাম আজ এখানে আসার আগে একজনকে নেতা নির্বাচন করে আসবে। কাকে নির্বাচন করেছ?

মঙ্গলকে। সবাই কথা বলল, একসঙ্গে।

বেশ। মঙ্গল হবে কো-অপারেটিভের সেক্রেটারি। এই কো-অপারেটিভ ছাড়া আর কেউ ডুডুয়াতে মাছ ধরতে পারবে না। মাছ ধরতে যা যা লাগে সেসব খরচ আমার। এখান থেকে তিরিশ মাইলের মধ্যে সপ্তাহে চারটে হাটি হয়। প্রতি ভোরে মাছ ধরবে, সকাল নটা পর্যন্ত। তারপর সেই মাছ হাটে নিয়ে গিয়ে মাছওয়াদের কাছে বিক্রি করে দেবে। খরচ বাদ দিয়ে যা লাভ থাকবে তার অর্ধেক ব্যাঙ্কে রাখবে কো-অপারেটিভের অ্যাকাউন্টে। বাকিটা বারোজন সমান ভাগ করে নেবে। এই ছয়মাসে যা রোজগার করবে তাতে তোমাদের পরিবারের বারোমাসের খরচ মেটাতে পারবে। ব্যাঙ্কে যা জমবে তার বারোভাগের একভাগ প্রত্যেকে আপদে বিপদে খরচ করতে পারবে। ধীরে ধীরে বুঝিয়ে বললেন সতীশ রায়।

ছেলেগুলোর মুখ চকচক করল। একজন বলল, কিন্তু আমরা কী দিয়ে মাছ ধরব? ছিপ দিয়ে?

ছিপ দিয়ে তিনচার ঘণ্টায় কটা মাছ ধরতে পারবে? জাল ফেলতে হবে। এটা শিখে নাও অন্য জায়গার জেলেদের কাছে। শিখতে চাইলে সব কিছু শেখা যায়। কো-অপারেটিভের নাম হবে ডুডুয়া ইয়ং মেন ফিশারিস। সতীশ রায় বললেন, আমি আজ শহরে যাচিছ। কত তাড়াতাড়ি কো-অপারেটিভ, তৈরি করা যায় খবরাখবর নেব। তোমরা ময়নাগুড়িতে গিয়ে দাশরখি উকিলের সঙ্গে দেখা করে আমার কথা বলবে। তিনি কাগজপত্র তৈরি করে দেবেন।

মঙ্গল বলল, রোজ কত মাছ ধরব?

রোজ নয়, সপ্তাহে চারদিন। চারদিনের ভোর থেকে চার ঘণ্টায় যা ওঠে। তার বেশি নয়। আর হ্যাঁ। এখন মাছ বেশ বড় হয়ে গেছে। তোমাদের লক্ষ রাখতে হবে যেন চুরি করে কেউ মাছ না ধরে।

তাহলে কি তরুণ সংঘ উঠে যাবে? একজন জিজ্ঞাসা করল।

মুর্খের মতো কথা বলছ! ছয়মাস সপ্তাহে চারদিনের অর্ধেক বেলা। তারপর কী করবে? তরুশ সংঘ থাকবে। ভালোভাবে থাকবে। আর বাকি ছয়মাস তো তোমরা একদম বেকার। তখন তো আরও সময় পাবে। এ ব্যাপারেও আমি ভেবেছি। তোমরা এখন ফুটবল খেলো নিজেদের মতো করে। কিন্তু ভালো খেলতে হলে একজন কোচ দরকার। এই কোচ তোমাদের ঠিকঠাক খেলা শেখাবেন।

সতীশ রায়ের কথায় হাসি ফুটল প্রত্যেকটা মুখে। সতীশ রায় লক্ষ করলেন মাছ ধরার প্রস্তাবেও এই হাসি ওদের মুখে দেখা যায়নি।

পকেট থেকে আড়াইশো টাকা বের করে মঙ্গলের হাতে দিলেন তিনি, বানারহাটে খেলতে যাচ্ছ, জিতে ফিরতে হবে।

আমরা চেষ্টা করব। মঙ্গল বলল।

ওরা ফিরে যেতে যেতে দাঁড়াল। নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করল নিচু গলায়। তারপর মঙ্গল ফিরে এল, কাকা, সত্যদাকে আমাদের মধ্যে পাওয়া যাবে না।

কী ব্যাপারে?

ওই কো-অপারেটিভ।

তার সঙ্গে তোমাদের কথা হয়?

না।

তাকে দেখতে পাও?

না।

কো-অপারেটিভের প্রত্যেক সদস্যকে কাজ করতে হবে। অকাজের লোককে রেখে লাভ কী! তোমরা পরে এসে ওকে জিজ্ঞাসা কোরো সে কাজ করতে ইচ্ছুক কিনা।

ছেলেরা চলে গেল।

দেরি হয়ে গিয়েছে বেশ। সতীশ রায় ঘরে এসে তৈরি হলেন। এই সময় মতির মা দরজায় এল, বাবু।

বলো।

খোকাবাবু তো নিজের মনে লেখে, ওকে কিছু বলবেন না।

কী লেখে?

একটা দলা পাকানো কাগজ এগিয়ে দিল মতির মা।

সেটা নিয়ে খুললেন সতীশ রায়। টান টান করে দেখলেন তিনটে লাইন লেখা হয়েছে। লেখার পর লাইন। তিনটে কেটে দিয়েছে সত্য। প্রথম লাইন, এখানকার সব পাখি বোবা হয়ে গেছে। লাইনটা দুবার কেটে দ্বিতীয় লাইন লিখেছে, এখানে পাখিরা আর কথা বলে না। এটাও দুবার কেটেছে ছোকরা। তৃতীয় লাইন, পাখিরা এখন মূক, পাখি নেই বলে। এটা একবার কাটা।

চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল সতীশ রায়ের। কবিতা লিখছে নাকি ছোকরা? কী সর্বনাশ! দিনরাত ঘরে বসে কবিতা লিখছে আর কাটছে? মেজাজ টঙে উঠল তাঁর। ইচ্ছে হল ওর ঘরে গিয়ে কবিতার ভূত ভাগাতে। মতির মা তার মুখ দেখে বলে উঠল, বড়বাবু!

আঃ। যাও দূর হও এখান থেকে। চিৎকার করতেই মতির মা অদৃশ্য হল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালেন সতীশ রায়। খুব দেরি হয়ে যাওয়ার আগে একটা বিহিত করা দরকার।

গাড়িটা অ্যাম্বাসাডার। পা ছড়িয়ে বসতে বেশ আরাম লাগে। দুপাশে বাড়িঘর, মুদির দোকান,একটা পুকুর পেরিয়ে পাঠশালার সামনে গাড়ি দাঁড় করাতে বললেন ড্রাইভারকে। পাঠশালার দুটো ঘর। বাইরের সাইনবোর্ডে লেখা, পাঠশালা। ভেতর থেকে পড়ুয়াদের গলা ভেসে আসছে।

গাড়ির শব্দ শুনে দ্রুত বেরিয়ে এলেন মাস্টার মশাই নিতাই দাস। হাতজোড় করে বললেন, আপনি এখানে কেন কষ্ট করে এলেন। আমায় ডেকে–।

কথা শেষ করতে দিলেন না সতীশ রায়, পাঠশালা কেমন চলছে?

ভালো। এবছর যারা ক্লাস ওয়ানে ভর্তির পরীক্ষা দিয়েছিল সবাই পাশ করেছে।

বাঃ। মাথা নাড়লেন সতীশ রায়। কোন অসুবিধে?

বড়বাবু, অসুবিধে তো থাকবেই। কিন্তু তার সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়।

হুম। আপনার চাকরি আর কতদিন?

হয়ে এল। ষাট বছরের পর তো আর চাকরি থাকে না।

তখন কী করবেন?

আমি জানি না। ভাবলেই চোখে সরষে ফুল দেখি, তাই ভাবি না।

আপনার জায়গায় কে পড়াবে?

পাঠশালা কমিটি ঠিক করবেন।

কেউ কি এখন সাহায্য করছে আপনাকে?

সাহায্য? ঠিক সাহায্য নয়। নাগেশ্বরবাবুর মেয়ে পার্বতী রোজ আসে। কী করে পড়াতে হয় তাই শেখাচ্ছি তাকে।

একটু ডাকুন তো ওকে।

নিতাই মাস্টার দরজার কাছে গিয়ে ডাকতেই পার্বতী বেরিয়ে এল। বাপের উচ্চতা পেয়েছে মেয়ে। পাঁচ ফুট। কিন্তু প্রস্থে প্রায় এক দরজার সমান। এইটুকু হেঁটে আসতেই সময় লাগল, জ্যেঠু!

কেমন পড়াচ্ছ?

আমার ভাল্লাগে না।

তাহলে আসছ কেন?

বাবা রাগ করে। বলে নিজের পায়ে দাঁড়া। পার্বতী বলল, এই সকাল দশটা থেকে তিনটে পর্যন্ত নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোমরে ব্যথা হয়ে গেছে জ্যেই।

ভেতরে যাও।

পার্বতী চলে গেলে সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন, ওখানে বসার ব্যবস্থা নেই? চেয়ার টেয়ার।

না। শিশুরা সতরঞ্চির ওপর বসে পড়ে। আমরাও মাটিতে আসন পেতে বসে পড়াই। এতে দূরত্ব কমে যায়।

তাহলে পার্বতী বসে পড়ায় না কেন?

আজ্ঞে, ওর যা শরীর পা মুড়ে বসতে পারে না। প্রথমদিন চেষ্টা করে। বসেছিল কিন্তু দুটো পা এত অবশ হয়ে গিয়েছিল যে অনেক কষ্টে ওকে ভোলা হয়েছিল। নিতাই মাস্টার বললেন।

অনেক চেষ্টায় হাসি সামলালেন সতীশ রায়। তারপর বললেন, একটা অ্যাপ্লিকেশন দিন। কমিটি যাতে আপনার চাকরি আরও কয়েক বছর বাড়িয়ে দেয় তার চেষ্টা করব। সতীশ রায় গাড়িতে উঠলেন।

একটু এগিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন নিতাই মাস্টার। তার চোখ উপচে জল বেরিয়ে আসছে। সহানুভূতির কথা শুনলে আজকাল শরীরটা আর বশে থাকে না।

গাড়ি চলছিল নির্জন পথ দিয়ে। হঠাৎ সাইকেলটা চোখে পড়ল। লোকটা সাইকেল রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে মাথার ওপর হাত নিয়ে যেতেই ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললেন সতীশ রায়। একেবারে লোকটার মুখোমুখি গাড়ির জানলাটা নিয়ে এল ড্রাইভার।

নমস্কার বড়বাবু। লোকটির নাম হরেকৃষ্ণ।

নমস্কার। তাহলে সাইকেল পেয়ে গেছেন? জিজ্ঞাসা করলেন সতীশ রায়।

হ্যাঁ। হাসি ফুটল হরেকৃষ্ণের মুখে, পেয়ে গেছি। আর ভয় নেই।

ঠিক বললেন না। ভয় আছে।

হ্যাঁ। যদি শুনি কোনও বেকার লোক অথবা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেকে চোলাই বিক্রি করছেন তাহলে আপনার ভাটিখানা ভেঙে দেওয়া হবে।

ছি ছি ছি! অমন কাজ করব কেন?

না করলেই মঙ্গল। পাবলিক কাজটা করলে পুলিশ আসবে না আপনাকে সাহায্য করতে তা যতই লাইসেন্স পান। মনে রাখবেন কথাটা।

নিশ্চয়ই মনে রাখব। কিন্তু বড়বাবু, একটা কথা–কে বেকার কে বেকার নয়, কার আঠারো হয়েছে কার সতেরো তা বুঝব কী করে?

প্রথম কাউকে চাকরি দিন যে সবাইকে চেনে। চলো।

ড্রাইভার ইঞ্জিন চালু করল। মদ্যপান তিনি নিজেও করেন। কিন্তু কখনই শোভনসীমার বাইরে যান না। তাছাড়া নিজের বাড়ির বাইরে গিয়ে কখনই পান করেননি তিনি। ভাটিখানা যখন চালু করল হরেকৃষ্ণ তখন অনেকেই তার কাছে আপত্তি জানিয়েছিল। যদিও ভাটিখানাটা বসতির বাইরে, জঙ্গলের কোল ঘেঁষে কিন্তু অভাবী মানুষগুলো সেখানে ছুটে যাবেই। যারা যাবে তারা চোলাই খেয়ে নিজেকে সামলাতে পারবে না। তার প্রতিক্রিয়া ডুডুয়ার সংসারগুলোতে পড়বেই। এদিকে নিজে যতই বিলিতি দামি জিনিস খান, সেটা তো মদই, অন্যকে নিষেধ করেন কী করে? তাহলে পান করা ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু গোরক্ষ তাকে যুক্তি দিল, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের অধিকার আছে নিজের পছন্দমতো পানীয় খাওয়ার। সেটা খেয়ে সে যদি অন্যের অপকার না করে তাহলে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়।

হরেকৃষ্ণর বাড়ি মেখলিগঞ্জে। বাইরের লোক। তবু তাকে ডেকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন সতীশ রায়। তখনও সে হাতে লাইসেন্স পায়নি। এদিকের গ্রামগুলোতে বাড়িতেই তৈরি চোলাই প্রকাশ্যে বিক্রি হয়। হরেকৃষ্ণ কাগজপত্র দেখিয়েছিল। সে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছে।

এই একটা বিষফোঁড়া। কিন্তু মেনে না নিয়ে কী করবেন।

পোস্ট-অফিসের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চিৎকার শুনতে পেয়ে গাড়ি থামাতে বললেন। গোরক্ষ আর নাগেশ্বর ছুটতে ছুটতে আসছে। কাছে এসে নাগেশ্বর হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, টাইট করে দিয়েছি।

কী টাইট করলে? সতীশ রায় অবাক।

পোস্ট-অফিসের দুই কর্মচারীকে। আপনার নাম বলতেই একেবারে কেঁচো। এখন থেকে ঠিক সময়ে পোস্ট-অফিস খুলবে, বন্ধ করবে। খুলে চরতে বেরুবে না। তবে একটু সুখের কথা, পোস্টমাস্টারও আগামী পরশু ফিরে আসছে। নাগেশ্বর যেন বিশ্বজয় করে এসেছে এমন হাসি হাসল।

সতীশ রায় বুঝলেন। এদের ধরে আনতে বললে বেঁবে আনে। পোস্ট অফিসের কর্মচারীদের ওপর নিশ্চয়ই রোলার চালিয়ে এসেছে।

ঠিক আছে। চলি।

আজ্ঞে বড়বাবু, কোথায়, মানে, কোন্ দিকে যাচ্ছেন? গোরক্ষ জিজ্ঞাসা করল।

সদরে।

উঃ কতকাল সদরে যাইনি। নাগেশ্বর বলল।

কোর্টের চত্বরে ভাতের হোটেলে পাবদার ঝাল যা করে না। গোরক্ষ মাথা নাড়ল।

দ্যাখো, আমি কাজে যাচ্ছি। তোমরা গিয়ে কী করবে?

কিছু না। চুপচাপ গাড়িতে বসে থাকব। দিনের বেলায় তো আপনার সঙ্গ পাই না! কথায় বলে সাধুসঙ্গে স্বর্গবাস। বলেই দূরে দাঁড়ানো এক কিশোরকে ডেকে নাগেশ্বর বলল, আই রতন, আমাদের দুজনের বাড়িতে গিয়ে খবর দিবি, আমরা বড়বাবুর সঙ্গে সদরে যাচ্ছি।

ছেলেটি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলতেই ওরা দরজা খুলে ড্রাইভারের পাশে উঠে। বসল। ড্রাইভার বিরক্ত হয়ে বলল, সরে বসুন।

সরেই তো আছি বাবা। বেশি সরলে তো বাইরে বেড়িয়ে যাব। বেশ নরম গলায় বলল গোরক্ষ।

এই দুজন দিব্যি আছে। জমিতে দুটো চাষ লোক দিয়ে করায়। তাতেই সম্বৎসরের খাওয়া পরা চলে যায়। এতেই যথেষ্ট। তবে দু-জনের দুই ছেলে কুচবিহারের বাসে কন্ডাক্টরি করে। কাঁচা পয়সা, কিছু পাঠায় তাদের বাড়িতে।

গাড়ি চলছিল ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে। শুনশান রাস্তা। দুপাশে চাষের মাঠ। সতীশ রায় ভেবে নিলেন। প্রথমে ডিসি অফিসে যেতে হবে। সেখান থেকে কোঅপারেটিভ অফিসে। তারপর অবনীদার খোঁজ নিতে হবে।

ধূপগুড়ি পেরিয়ে গেল। সতীশ রায় দেখলেন মানিকজোড় চুপচাপ ঢুলছে। জলঢাকা নদী আসতেই ওরা সোজা হল। নাগেশ্বর ঝুঁকে নদী দেখল, দ্যাখ মাছ। ধরছে। কী মাছ?

পুঁটি? গোরক্ষ জবাব দিল গম্ভীর মুখে।

কী করে বোঝা গেল?

গিয়ে দেখলেই হয়।

এদের কখনই মিল হয় না অথচ দুজন দুজনাকে ছেড়ে চলবে না। সতীশ রায় হাসলেন। নাগেশ্বর বলল, বাবা, কষা মাংস।

গোরক্ষ বলল, উঁহু। মাটন তরকা, জবাব নেই।

নাগেশর পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখল সতীশ রায় চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। নিঃশব্দে হাত ঘুরিয়ে সে গোরক্ষকে জানিয়ে দিল, কোনও লাভ হবে না। গোরক্ষ বলল, তবে স্ট্যান্ডার্ড খুব পড়ে গেছে। আগের মতো নেই।

ডিসি অফিসের কাজ শেষ করতে দুটো বেজে গেল। গাড়ির কাছে এসে সতীশ রায় দেখলেন মানিকজোড় ধারে কাছে নেই। ড্রাইভার বলল, ওঁরা। কোর্টের দিকে গেছেন।

এখনও এই এলাকাকে লোকে কোর্ট বলে কারণ বহু বছর এখানেই সদরের আদালতগুলো ছিল। এখন আদালত চলে গিয়েছে নবাববাড়িতে কিন্তু নামটা জড়িয়ে আছে এলাকার সঙ্গে।

গাড়ি নিয়ে কোর্টের চত্বরে ঢুকতেই ওদের দেখতে পেলেন তিনি। একটা গাছের তলায় বেঞ্চিতে বসে আছে বিমর্ষ মুখে। গাড়ি দেখে চলে এল কাছে, হয়ে গেছে?

হ্যাঁ। তোমরা পাবদার ঝাল খেয়েছ?

নাঃ। খদ্দের হয় না বলে দোকান উঠে গেছে।

তাহলে গাড়িতে উঠে বসো।

সেখান থেকে কো-অপারেটিভের অফিসে। গাড়ি থেকে নামার সময় সতীশ রায় বললেন, গোরক্ষ, তুমি আমার সঙ্গে এসো।

আমি? নাগেশ্বর তাকাল।

তুমি গাড়িতেই অপেক্ষা করো।

অফিসে ঢোকার আগে সতীশ রায় বললেন, এখানে কখনও আসিনি। এরা আমাকে চেনে না। তুমি একটু পরিচয়টা দিয়ো।

অবশ্যই।

অফিসে ঢুকে একজন করণিককে সতীশ রায় বললেন, বড়সাহেব আছেন?

কেন? কী দরকার। আমাকে বলুন। লোকটি সোজা হয়ে বসল।

গোরক্ষ বলল, আপনাকে আমি বলতে পারি, কিন্তু উনি পারেন না।

কেন? উনি কে?

ডুডুয়া বলে একটা জায়গার নাম শুনেছেন?

ডুডুয়া? হ্যাঁ।

সেই জায়গাটা ওঁর কথায় চলে। আপনার কথায় কতজন চলে?

লোকটা সতীশ রায়ের দিকে তাকাল। সতীশ রায় নির্বিকার।

দাঁড়ান; দেখছি।

দু মিনিটের মধ্যে লোকটা ফিরে এল, আসুন।

পরদা ঠেলে ভেতরে ঢুকল লোকটা, পেছনে ওঁরা।

টেকো মাথার অফিসার বললেন, ডুডুয়ার কি যেন বলছিলে–।

আমার নাম সতীশ রায়। লোকে বলে ডুডুয়ার সতীশ রায়।

অ। বলুন, বসুন।

আমার ওখানে তরুণ সংঘ নামে একটা ফুটবল ক্লাব আছে। তার ছেলেরা একটা কো-অপারেটিভ খুলতে চায়। আমার উকিলবাবু যা যা করার সব করবেন। কিন্তু আমি এসেছি উদ্বোধনের দিন আপনি বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত যেন থাকেন সেই অনুরোধ নিয়ে। সতীশ রায় বেশ বিনয়ের সঙ্গে বললেন, বলে বসলেন।

কবে উদ্বোধন? ক্যালেন্ডার দেখলেন ভদ্রলোক।

যেদিন আপনি কাগজপত্র দেবেন।

অ্যাঁ। অ্যাপ্লাই করেছেন?

না। কালই করব।

আপনি অ্যাপ্লাই করেই উদ্বোধনের কথা ভাবছেন?

নাহলে তো আপনার তারিখ পাওয়া যাবে না।

কী মুশকিল। অ্যাপ্লাই করলেই যে অনুমতি পেয়ে যাবেন তা কী করে ভাবছেন? আর এর জন্যে সময় লাগে! খিঁচিয়ে উঠলেন অফিসার।

আগে থেকে উদ্বোধনের দিন ঠিক করে নিলে সুবিধে এই যে কোন তারিখের মধ্যে অনুমতি দিতে হবে সেটা আপনার জানা থাকবে। তা ধরুন, সামনের মাসের পনেরো তারিখ। ডি.এম. সাহেব ওই দিনটাই ঠিক করেছেন।

ডি.এম.?

উনিই তোত প্রধান অতিথি হয়ে যাবেন। সত্যি বলতে কি ওঁর সাজেসশনেই। আমরা আপনাকে বিশেষ অতিথি হিসেবে স্বাগত জানাতে এসেছি।

ডি.এম, আমার কথা বলেছেন? সোজা হয়ে বসলেন অফিসার, তাহলে, ঠিক আছে, পনেরো তারিখ রবিবার। আপনারা বারো তারিখ অনুমতি পেয়ে যাবেন। কালই সব কাগজপত্র পাঠিয়ে দিন। আমার হাতে দিয়ে যেতে বলবেন।

অফিসার একটা কাগজে লিখলেন, ডুডুয়ার সতীশ রায়।

আপনি মাছ খান?

হে হে হে। বাঙালির তো ওটাই প্রিয় খাবার।

ডুডুয়া নদীতে দেড়কেজি রুই ঘাই মারছে। ডি.এম. সাহেব দুটো নেবেন। আপনি কটা? সতীশ রায় উঠে দাঁড়ালেন।

একটা। দুজন তো লোক, ডি.এম. দুটো নিলে একটার বেশি নেওয়া ভালো দেখায় না। বুঝলেন না। অফিসার ভালোমানুষের মতো মুখ করে বললেন।

গাড়িতে বসে সতীশ রায় বুঝলেন নাগেশ্বর নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কাল তোমার স্ত্রীর মঙ্গলচণ্ডীর উপোস ছিল। আজ কী?

আজ? তিনরকমের তরকারি আর হাঁসের ডিমের ঝোল গলা অবধি খেয়ে এখন নাক ডাকছেন। নাগেশ্বর করুণ গলায় বলল।

আহা! একথা আগে বলবে তো! আমি ভাবলাম আজও তার উপোস।

হুঁঃ। নাকে শব্দ করল নাগেশ্বর।

আজ তোমার মেয়েকে অনেককাল বাদে দেখলাম। সতীশ রায় বললেন, একটু ব্যায়াম করা দরকার ওর।

ব্যায়াম? কোনও লাভ হবে না বড়বাবু। হাতির পেট থেকে যে বের হয় তাকে হাজার ব্যায়াম করিয়ে কেউ হরিণ করতে পারবে না, হাতিই হবে।

গোরক্ষ চুপচাপ শুনছিল, এবার জোরে শ্বাস ফেলল।

তোমার কি হল?

তার উপোস করার অভ্যেস নেই। ভালোই খান। সব হাড়ে ঢুকে যায়। সরু সরু হাড়। জোরে বাতাস বইলে ঘরের বাইরে বের হন না।

সেকি? কেন?

পড়ে যাবেন। ছেলের আবদার ছিল, মা তুমি সালোয়ার কামিজ পরো। শহরে বুড়িরাও পড়ছে। আমি এনে দেব। শুনে আমি বললাম, বাবা, তুমি তো চলে যাবে আর আমি সারাক্ষণ দেখব একটা হ্যাঁঙারে ওই সালোয়ার কামিজ ঝুলছে। সেটা কি ভালো লাগবে। গোরক্ষ বলল।

– অবনীদাকে বাড়িতেই পাওয়া গেল। খবরের কাগজ পড়ছেন। দেখামাত্র বললেন, আরে সতীশবাবু যে! ডুড়ুয়া ছেড়ে আমার এখানে?

সতীশ রায় বললেন, কেমন আছেন দাদা?

ষাট কমপ্লিট করলাম তবে এখনও টাউন ক্লাব মাঠটা চারবার দৌড়াই। যেদিন পারব না সেদিন মারা যাব। অবনীদা হাসলেন।

একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি। সতীশ রায় বললেন।

আপনার মতো লোক আমাকে অনুরোধ করছেন, কী ব্যাপার?

ডুডুয়াতে তরুণ সংঘ নামে একটা ক্লাব করেছে ছেলেরা। ফুটবল খেলে। বানারহাট বীরপাড়াতে গিয়ে ম্যাচ খেলে। কখনও হারে কখনও জেতে। কিন্তু শেখাবার কেউ নেই। নিজেরাই যা পারে তাই খেলে। আমার ইচ্ছে আপনি যদি ওদের একটু খেলাটা শেখান। সতীশ রায় বললেন।

ওদের বয়স কত?

আঠারো থেকে চব্বিশ।

কোনও লাভ নেই। দড়কচা মেরে গেছে। এখন শেখালে কোনও লাভ হবে না। আমি যা বলব তা ওরা করতে পারবে না। শেখার বয়স আট থেকে চোদ্দ। দেখুন যে অক্ষর চেনে না সে বুড়ো বয়সে অক্ষর চিনতে পারে কিন্তু চিনে লেখক হতে পারে না। অবনীদা বললেন।

কয়েক সেকেন্ড ভাবলেন সতীশ রায়, বেশ। ওই বয়সের ছেলেরাও আছে। আপনি তাদের শেখান।

কিন্তু এখান থেকে বোজ ডুডুয়াতে যাব কী করে?

শুক্রবার যাবেন। শনি রবি থেকে সোমবার ফিরে আসবেন। অথবা। সপ্তাহে চারদিন। ওখান থেকে একটা বাস সাড়ে সাতটায় আসে।

কথা দিচ্ছি না। একবার ওদের দেখি–।

আর একটা অনুরোধ। যাতায়াতের ভাড়া বাদ দিয়ে আপনার সম্মান দক্ষিণা কত দিতে হবে?

হো হো করে হাসলেন অবনীদা। তারপর বললেন, গত পঁচিশ বছর ধরে শহরে কোচিং করছি। কত ছেলে আমার কাছে খেলা শিখে কলকাতার ফার্স্ট ডিভিসনে ফুটবল খেলছে। দুজন তো ইন্ডিয়া টিমে খেলে এসেছে। কেউ আমাকে একটা টাকা দিয়েছে না আমি কারও কাছে চাইতে পেরেছি। হ্যাঁ, আমার খেলা দেখে রায়মশাই চাকরি দিয়েছিলেন। তাতেই খুশি আমি। যাব, যাব। এই ধরুন সামনের শনিবারে। বেলা দুটোয় পৌঁছাবো।

না অবনীদা! পারিশ্রমিক না নিলে আপনাকে দরকার নেই।

অবনীদা সতীশ রায়ের দিকে তাকালেন, আমাকে পেশাদার কোচ হতে বলছেন? তাহলে অন্য লোকের কাছে যান।

নমস্কার জানিয়ে বেরিয়ে এলেন সতীশ রায়। একটা মানুষ এখান থেকে অতদূরে যাবে, খাটবে কিন্তু পয়সা নেবে না, এটা ঠিক কথা নয়। যতই ফুটবল পাগল মানুষ হন, পেশাদার না হলে দায়িত্ব বাড়ে না। তাছাড়া ওঁকে টাকা দিলে তাদের মনে হবে না কারও দয়ার ওপর আছেন।

গাড়িতে উঠে কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইলেন সতীশ রায়। ড্রাইভারের পাশে বসে মানিকজোড় ঢুলছে। তিস্তা ব্রিজ পেরিয়ে গাড়ি ময়নাগুড়ি বাইপাসের কাছে আসাতে ড্রাইভারকে থামতে বললেন তিনি।

গাড়ি থামতেই ঘুম ভাঙল ওদের। সতীশ রায় বললেন, এবার নামো। তুমি কষা মাংস রুটি কিংবা ভাত আর তুমি মাটন তরকা রুটি খেয়ে এসো। ওই যে তোমাদের ধাবা।

লোক দুটো নিঃশব্দে নেমে এগিয়ে গেল ধাবার দিকে। ড্রাইভারের হাতে টাকা দিয়ে সতীশ বললেন, তুমি কিছু খেয়ে নাও। আর ওঁদের খাবারের দাম মিটিয়ে দিয়ে। চোখ বন্ধ করলেন তিনি।

ডুডুয়া সতীশ রায়ের কাঠের কল কিছুদিন আগে পর্যন্ত প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই আওয়াজ করত। ইলেকট্রিক সার আগে জেনারেটার মেশিন চলত। তখন নিলামে গাছ কাটার অধিকার পেয়ে কাঠের ব্যবসায়ীরা ট্রাকে চাপিয়ে বড় বড় গাছ এনে ফেলতেন সমিলের সামনে। যে যেমন চায় তেমন সাইজের তক্তা। বানিয়ে দেওয়া হত গাছ কেটে। অনেকে আবার সেইসব গাছ সরাসরি বিক্রি করে দিতেন সতীশ রায়ের কাছে। সেগুলো সতীশ রায়ের কাছ থেকে তক্তা। হিসেবে কিনে নিয়ে যেত কন্ট্রাক্টররা।

কয়েক বছর হল সরকার জঙ্গলে কাঠ কাটার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। যে গাছগুলো নষ্ট হয়ে গেছে বা ঝড়ে পড়ে গেছে অথবা সরকারি প্রয়োজনে যে গাছ কাটা দরকার সেগুলোকে নিলামে তোলা হয়। ফলে অনেক কাঠের ব্যবসায়ী হাত গুটিয়ে বসে আছেন। সতীশ রায়ের কাঠের কলে আট দশ ঘণ্টার বেশি শব্দ হয় না। তবে প্রায়ই প্রস্তাব আসে, বেআইনি ভাবে কাটা গাছকে তত্তায় রূপান্তরিত করে দিতে। তার জন্য দ্বিগুণ টাকা দিতেও তারা রাজি। কিন্তু সতীশ রায় রাজি নন। তার কড়া নির্দেশ আছে কর্মচারীদের কাছে, সরকারি কাগজ ছাড়া কেউ যেন ওই ধরনের গাছের গুঁড়ি কারখানাতে না ঢোকাতে পারে। আর এই কথাটা জেলার কর্তারা জানেন। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট বা পুলিশ মাঝে মাঝে অন্য কারখানাগুলোতে হানা দিলেও সতীশ রায়ের এখানে আসেন না।

আজ সকাল থেকেই কারখানার ম্যানেজারের সঙ্গে হিসেব নিয়ে বসেছিলেন সতীশ রায়। সারা মাসের আয়-ব্যয়ের অঙ্ক কষে সতীশ রায় ম্যানেজারের দিকে তাকালেন। লোকটি সৎ। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে কাজ করছেন।

সতীশ রায় বললেন, গতমাসে যা রোজগার করেছেন তাতে আপনাদের মাইনে, ইলেকট্রিকের বিল মিটিয়েই শেষ হয়ে যাচ্ছে। কী করা যায়?

ম্যানেজার বললেন, গত চারমাসে একই অবস্থা গিয়েছে। আরও মাস দুয়েক দেখে কারখানা বন্ধ করে দিন।

কারখানা বন্ধ করলে বারোটা লোক যাবে কোথায়? খাবে কী?

কিন্তু বড়বাবু, সরকার যদি পলিসি না বদলায় তাহলে ঘর থেকে টাকা বের করে কারখানা চালাতে হবে। সেটা অন্যায়। ম্যানেজার বললেন।

আপনি তো অদ্ভুত লোক। নিজের সর্বাশি নিজেই চাইছেন?

কেউ কি তা চায় বড়বাবু! কিন্তু আমি তো আশার আলো দেখতে পাচ্ছি, না। সরকার যদি জঙ্গলে কাঠ কাটতে না দেয় তাহলে কাঠ চেরাই-এর কলগুলো বাঁচবে কী করে? ম্যানেজার বিমর্ষমুখে বললেন।

আচ্ছা, আরও কয়েকমাস দেখুন। সামনের মাস থেকে সত্য এসে বসবে

এখানে। কাজ না থাকলে এখানেই তার সুবিধে, কবিতা লিখতে পারবে। উঠে দাঁড়ালেন সতীশ রায়।

ম্যানেজার বললেন, ঠিক বুঝলাম না।

আমারও একই অবস্থা। সতীশ রায় ঘড়ি দেখলেন। বেলা হয়েছে।

ম্যানেজারবাবু একটু ইতস্তত করে বললেন, বড়বাবু, একটা কথা বলব?

সতীশ রায় তাকালেন।

শুনতে পাচ্ছি কিছু খাস জমি সরকার বিক্রি করবেন।

আমিও শুনেছি। ওগুলো উঁচু নিচু জমি। জল দাঁড়ায় না। চাষ হবে না। বিক্রি করতে চাইলে খদ্দের পাবে কোথায়?

আপনি যদি কিনে নেন?

তার চেয়ে পকেটের টাকা ডুডুয়ায় ফেলে দিতে বলুন। কম পরিশ্রম।

আমার কথা একটু শুনুন। যদি তিন চার একর জমি পাওয়া যায় তাহলে একটা চাষ হতে পারে। আমরা ওখানে চা-গাছ লাগাতে পারি।

হাঁ হয়ে গেলেন সতীশ রায়, চা গাছ?

হ্যাঁ বড়বাবু। এদিকের চা বাগানগুলোতে লেবার ট্রাবল লেগেই আছে। তার ওপরে ঠিকঠাক যত্ন না নেওয়ায় চায়ের পাতার মানও কমে গেছে। আমরা যদি যত্ন করে চা গাছ তৈরি করি তাহলে দেখতে হবে না। ম্যানেজার বলল।

গাছ লাগালেন, পাতাও হল। তা সেগুলো থেকে চা তৈরি করতে কত টাকার কারখানা বানাতে হয় তা জানেন? সতীশ রায় এবার বিরক্ত হলেন।

আমরা কারখানা করব কেন? যাদের কারখানা আছে তারা আমাদের কাছ থেকে পাতা কিনবে। ম্যানেজার বোঝাল।

কেন কিনবে? তাদের নিজেদের বাগানেই তো পাতা হচ্ছে।

যে পাতা হয় তাতে তো সারাবছর মেশিন চলে না। কয়েকশ লোকের মাইনে, সার, অন্য সব খরচ মিটিয়ে পাতার যা দাম পড়ে তার চেয়ে সস্তায় যদি .. আমাদের কাছ থেকে পায় তাহলে নেবে না কেন? মানেজার উৎসাহের সঙ্গে বললেন।

একটু ভাবলেন সতীশ রায়। তারপর বললেন, দেখি, ভেবে দেখি। চা-গাছ তো একদিনে বড় হয় না। তিনবছরে কত ইনভেস্টমেন্ট সেটাই আগে হিসেব করে দেখতে হবে। তাছাড়া এ ব্যাপারে সরকারের অনুমতি নেওয়া দরকার কিনা তাও জানতে হবে। দেখি।

কিন্তু বাড়ির পথে আসার সময় সতীশ রায়ের মনে হল এই ম্যানেজার লোকটা কাঠচেরাই করে শেষ হয়ে যায়নি। এই যে খাস জমিতে চা-বাগান তৈরি করার কথা ভাবা, এর মধ্যেও একটা স্বপ্ন দেখার চেষ্টা আছে। যারা স্বপ্ন দেখতে চায় তারা সহজে মরে না। তার সত্যচরণ কবিতা লেখে, কবিরা কি স্বপ্ন দ্যাখে না?

আজ দুপুরের খাওয়া বেশ জমিয়ে খেলেন সতীশ রায়। প্রতিটি রামাই সুস্বাদু। খেয়েদেয়ে ঘরে এসে পান আর সিগারেট নিয়ে ডাকলেন, মতির মা। কেউ ওকে ডেকে দাও। সেদিন একটু কড়া গলায় ধমক দিয়েছিলেন, দেওয়ায় কাজ হয়েছে।

মতির মা এসে দাঁড়াল দরজায়, ঘোমটা মাথায়।

হঠাৎ তোমার রান্নার হাত খুলে গেল কী করে? এ বাড়িতে তো অনেক বছর আছ এরকম রান্না কখনওরাঁধেনি। সতীশ রায় বললেন, ভালো, বেশ ভালো।

আমি তো রাঁধিনি। মতির মা নিচু গলায় বলল।

ও। কে বেঁধেছে?

আপনি বলেছিলেন রান্নার জন্যে কাউকে আনতে–?

হ্যাঁ, এ কে?

গুরুচরণ হালদারের মেয়ে। বিয়ে হয়েছিল। এখন বিধবা হয়ে বাপের বাড়িতে ফিরে এসেছে। বাপের অবস্থা খারাপ।

কে গুরুচরণ হালদার মনে করতে পারলেন না সতীশ রায়। জিজ্ঞাসা করলেন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, তো?

ওকে ডাকব? ·

ডাকো।

সিগারেট খাচ্ছিলেন তিনি। এসময় তার চোখ স্ত্রীর ছবির দিকে যাবেই। আজও গেল। মৃত মানুষের ছবির চোখ কি মাঝে মাঝে বদলে যায়? চোখ সরাতেই শুনতে পেলেন, ডেকেছেন?

মুখ ঘুরিয়ে মেয়েটিকে দেখালেন। বছর তিরিশের, বেশ লম্বা চেহারা।

তুমি রান্না করেছ?

হ্যাঁ। খারাপ হয়নি তো?

না। কি নাম?

এলোকেশী।

তোমাদের কোন্ বাড়ি?

ব্লক অফিসের কোয়ার্টার। বাবা দুবছর হল বদলি হয়ে এসেছেন।

তাই বলো। পুরোনো লোক হলে চিনতে পারতাম। তা তুমি এ বাড়িতে এসে রান্না করছ, তোমার বাবা আপত্তি করেননি?

না। বিধবা মেয়ে বাচ্চা সমেত অভাবের সংসারে এলে কোন বাবাই খুশি হয় না। এতে স্বস্তি পেয়েছে। বলেছে, কোনও কাজই ছোট না।

কথাটা ঠিক। মাইনে ঠিক হয়েছে?

কার সঙ্গে কথা বলে ঠিক হবে?

কেন? মতির মা কিছু বলেনি?

বলতে এসেছিল। আমি শুনিনি।

কেন?

মাইনে ঠিক করবে মালিক। ও কি আমার মালিক?

থতমত খেয়ে গেলেন সতীশ রায়। তার মুখের ওপর এরকম কথা আজ পর্যন্ত কোন কর্মচারী বলেনি। অবশ্য এই মেয়েটিকে ওই অর্থে কর্মচারী বলা যায় না।

সতীশ রায় বললেন, তুমি কত টাকা চাও?

আমি কিছু চাই না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে একটা কাজের মধ্যে আছি তাতেই আমার শান্তি। আপনার বিবেচনায় যা হয় দেবেন।

এসো।

যাচ্ছি। একটা কথা বলব?

সতীশ রায় তাকালেন।

খোকা নাকি ঝাল খেতে ভালবাসে না। কিন্তু আমার রান্না চেটেপুটে খেয়েছে। সেই থেকে মতির মায়ের মুখ গোমড়া হয়ে আছে। আমি কি খোকার জন্যে রাঁধব না?

মতির মা যা বলে তাই করবে।

আপনি মাংস খান না শুনলাম।

হ্যাঁ।

আমি একদিন রাঁধি, একটু চেখে দেখুন।

হেসে ফেললেন সতীশ রায়, দেখা যাবে।

যাকগে। এখানে এসে শুনেছিলাম আপনি নাকি ভীষণ রাগী। কেউ মুখ তুলে আপনার সঙ্গে কথা বলে না। ভুলটা ভাঙল। এলোকেশী চলে গেল।

কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন সতীশ রায়। এ মেয়ে কথা বলে না খই ফোঁটায়। বিধবা, এক বাচ্চার মা বলে মনেই হয় না। নাঃ। একে আর বাড়তে দেওয়া ঠিক হবে না। মাইনে যখন নেবে তখন কর্মচারীর মতো ওকে থাকতে হবে এই বাড়িতে।

Pages: 1 2 3 4 5 6
Pages ( 1 of 6 ): 1 23 ... 6পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress