Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তটিনী ও আকাতরু || Buddhadeb Guha » Page 4

তটিনী ও আকাতরু || Buddhadeb Guha

সারারাত-ই প্রায় জেগে কাটল তটিনী। এমন সুন্দর স্বপ্নের পরিবেশে, এর আগে কোনো রাত কাটায়নি ও। মিষ্টি মিষ্টি ঠাণ্ডা। এক চাঁদরের মতন। ছমছমে জ্যোৎস্নার রাত। চওড়া নদীর সাদা বুকে জ্যোৎস্না পড়ে নদীটাই আকাশ বা আকাশটাই নদী তা যেন, বোঝা যাচ্ছিল না। জয়ন্তী বন-বাংলোর উলটোদিকে, নদীর ওপারের পাহাড়ের মাথাতে আগুনের মালাটা মাঝরাতে নিভে এসেছিল। তটিনীর-ই মতো মালা পরাবার কোনো মনের মানুষ জোটেনি হয়তো সেই পাহাড়ের। চাঁদনি রাতে পাহাড়টাকে আরও রহস্যময় দেখাচ্ছিল। যা-কিছুই, যে জনই একা, তাই ‘রহস্যময়’। তা নারীই হোক কী পাহাড়, কী পুরুষ। তারা দুঃখীও। সেই দুঃখের স্বরূপ শুধু তারাই জানে।যেকোনো অবিবাহিত পুরুষ অথবা নারীকে ভালো করে লক্ষ করলেই এইকথার সত্যতা বোঝা যায়। লক্ষ্য পাহাড় অথবা নদীকেও করা যায় কিন্তু প্রশ্ন করা যায় শুধুমাত্র মানুষকেই। নিজেদের দুঃখের কথা মানুষ যেমন, প্রকাশ করতে পারে, অন্য প্রাণীরা অথবা নদী বা পাহাড় তা পারে না। সারারাত কত কী পাখি ও প্রাণী ডাকল চারধারের বন থেকে, নদীর বুক থেকে, পাহাড় থেকে। কোনটা যে, কার ডাক তা তটিনী জানে না। আকাতরু তার পাশে থাকলে বলতে পারত। তার পাশে, শুধু তার মনকে ভালোবেসে আজ অবধি একজনও থাকেনি। কী জীবনে, কী খাটে। পুরুষগুলো বড়োবোকা। মেয়েদের শরীরে এসেই তাদের সব চাওয়া থেমে যায়। শরীরের কবরেই মন লীন হয়। ‘ভালোবাসা কাকে যে, বলে তা খুব কম পুরুষ-ই জানে। পুরুষেরা অধিকাংশই ওই চানু রায় বা মৃদুলদের-ই মতন পরম মূর্খ। তাই নিজেদের বুদ্ধিমান ভাবে। পুরুষমাত্রই ওভারকনফিডেন্ট নিজেদের সম্বন্ধে। বিধাতা প্রত্যেক নারীকে তারা অন্যরকম বলেই তাদের এক সহজাত বুদ্ধি দিয়েছে তাদের বর্ম হিসেবে। সে বর্ম সাদা চোখে দেখা যায় না।

জয়ন্তী নদীর চওড়া বুক ধরে, ঠিক আড়াআড়ি নয়, কোনাকুনি চলেছে ওদের জিপ। সাদা শুকনো পাথরময় নদীরেখা ধরে উথাল-পাতাল হতে হতে চলেছে ওরা। তবে বালি উড়ছে না। রাতের শিশিরে এখনও বালিতে আদ্রতা আছে।

একজোড়া পাখি বাংলোর হাতার মধ্যে অথবা হাতার সীমানার বাইরে, জয়ন্তী নদীর ধারের একটি গাছে শেষরাত থেকে মহা শশারগোল তুলেছিল। ভোরে উঠে বাইরে এসে, আকাতরুর সঙ্গে দেখা হতেই জিজ্ঞেস করেছিল তটিনী সেই গাছ ও পাখিদের দেখিয়ে। আকাতরু বলেছিল, পাখিগুলোরনাম র‍্যাকেট ট্রেইলড ড্রঙ্গো। ফিঙে একধরনের। তবে মহা মারকুট্টে নাকি। ওদের ভয় পায় ওদের চেয়ে আয়তনে বড়ো অনেক পাখিই। যেখানেই থাকুক ওরা এমনি করেই সকলের ঘুম ভাঙায়। ভোরের ময়ূর-মুরগি জাগারও অনেক আগে ওরা জাগে। আর গাছেদের নাম, ডিকরাসি’।

এবারে জয়ন্তী নদী ছেড়ে ওপাড়ে উঠল জিপ। সকালে জয়ন্তী বনবাংলোয় চৌকিদার অজয় ছেত্রী জবরদস্ত নাস্তা করিয়ে দিয়েছিল। জয়ন্তী গ্রামে রসগোল্লাটা নাকি গৃহশিল্প। দুধ প্রচুর এবং সস্তা বলে এখানের বাড়ি বাড়ি রসগোল্লা বানিয়ে রাজাভাতখাওয়া এবং আলিপুরদুয়ারে চালান দিয়ে দু-পয়সা রোজগার করে নেয় স্থানীয় মানুষেরা।

অবনী বলছিল ওদের।

নদীটা পেরোবার পথেই একটি দো-তলা কাঠের বাড়ি বাঁ-পাশে। ওটি একটি লাইমস্টোন কোয়ারির বাড়ি। বন্যা দয়া করে গ্রাস করতে করতেও করেনি। ছেড়ে গেছে।

তটিনী বলল, এসব অঞ্চলে অনেক খনিজ জিনিস পাওয়া যায়, না? মানে ধাতু?

যায়-ই তো। পাহাড়ের গায়ে গায়ে যে, সাদা সাদা দাগ দেখছেন, চাঁদনি রাতে যেসব জায়গাকে মনে হয় বরফাবৃত, সেইসব জায়গাতে হয় ধস নেমেছিল, কখনো, নয় খোঁড়াখুঁড়ি করে নানা ধাতব আকর বের করা হয়েছিল একসময়।

কী কী ধাতব আকর পাওয়া যায় এখানে?

তবু।

অনেক কিছু।

ডলোমাইট, লাইমস্টোন, ক্যালসেরাস টুফা, কপার ওর, কয়লা, আয়রন ওর, ক্লে ইত্যাদি। এইসব ধাতব আকরের জন্যেই তো পুরো বক্সা বনাঞ্চল-ই বিপদগ্রস্ত। পাহাড়ে পাহাড়ে খোঁড়াখুঁড়ি চললে, ট্রাকের পর ট্রাক চললে, বনের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবে না। একোলজিকাল ব্যালান্স নষ্ট হয়ে যাবে তো।

তাই?

তাই তো।

বাবাঃ! আপনি কত জানেন।

তটিনী বলল।

অবনী লজ্জিত হয়ে বলল, আমি তো এই অঞ্চলেই জীবন কাটালাম। এসব জানি একটু আধটু তবে গাছ, পাখি, ফুলের কথা আকা জানে আমার চেয়ে অনেক বেশি। এসব আমরা জানলে কী হবে? আমরা কি আপনার মতন অভিনয় জানি না, গান গাইতে জানি?

অভিনয় আর আমি কতটুকু জানি?

তা ঠিক।

অবনী বলল।

তারপর বলল, অভিনয়ে মৃদুলবাবু আপনাকে অনেক গোল দিয়ে দেবেন।

আকা বলল, সক্কালবেলা! তুই আর অন্য কোনো মানুষের নাম পাইলি না? ওই লোকটার নামও উচ্চারণ করিস যদি আর একবার।

সত্যি তো। কিন্তু মানুষটা গেল কোথায়?

তটিনী বলল।

যেখানেই যাক। থাকা-খাওয়ার অসুবিধে হবে না চানু রায়ের হেপাজতে যখন আছে। চানু। রায় মানুষটা যেমন খারাপ, আবার ভালোও।

তুই অরে ভালো কইতাছিস?

আকা ধমকে বলল।

ভালোই তো। যে-খারাপ মানুষকে খারাপ বলে চেনা যায়, যে, নিজেও স্বীকার করে যে, সে খারাপ তাকে নিয়ে ভয় নেই। কিন্তু মৃদুলবাবুদের মতন আঁতেল যাঁরা, যাঁদের আমরা দূরদর্শনে দেখি প্রায়-ই, দেখি খবরের কাগজের পাতায়, ধুমসো চেহারা আর থুম্বো মুখের, যাঁরা মদ খেয়ে আর দলবাজি করে বঙ্গভূমের তাবৎ সংস্কৃতির সাহিত্যিক সাংগীতিক পরিবেশের স্বনিয়োজিত রক্ষক, তাঁদের নিয়েই বিপদ। এই জানোয়ারগুলোর মাত্র দুটো পা থাকাতেই এরা এ-জন্মে বেঁচে গেল।

কদ্দিন বাঁইচা থাকব। আমি হালারে হালুয়া বানাইয়া ছাড়ম। আর্ট-কেলচার করণ চিরজীবনের মতো বন্ধ কইর‍্যা দিমু।

আঃ। ছাড়-না।

অবনী বলল।

তারপর বলল, তোর এই এক দোষ আকা। তোর হাতে কি এই পৃথিবীর ভার দিয়েছেন ভগবান? তুই কি ডন কিয়টে? যে পৃথিবীর, যে-প্রান্তে যা অন্যায় হচ্ছে, তার-ই প্রতিবিধান করার দায় নিয়ে এখানে এসেছিস। শান্ত হ। তোর নিজের জীবনের শান্তি বাহ্যিক কারণে নষ্ট করে লাভ কী?

সেই ত হইল গিয়া কথা। পরের অশান্তি যে, একদিন নিজের হইয়া উঠব এ-কথা বোঝে কোন ব্যাটায়। আমাগো স্বভাবও হইল গিয়া ওইরকম। নিজের পায়ে জুতার চাপ না পড়ন পর্যন্ত আমাগো হুশ-ই আসে না। ইটাই ট্রাজেডি।

আবারও নদী!

স্বগতোক্তি করল তটিনী।

তটিনী আজ সকালে একটা ছাইরঙা তাঁতের শাড়ি পরেছে। কালোরঙা ব্লাউজ। চোখে কাজল দিয়েছে গাঢ় করে। কালো টিপ পরেছে কপালে। সাদারঙা ঝুঠো মুক্তোর মালা আর বালা পরেছে গলাতে আর ডান হাতে। শ্যাম্পু করেছে না, শিকাকাই বুঝতে পারছে না আকাতরু কিন্তু সদ্যস্নাতা তটিনীকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে যাওয়া জিপের মধ্যে, খুব-ই কাছ থেকে দেখতে পেয়ে খুশিতে সে, মরে যাচ্ছে। কী গন্ধ মেখেছে তটিনী কে জানে? বিলিতি সেন্ট-টেন্ট-এর নাম তো ও জানে না। জানতে চায়ও না। তটিনীর কোনো পারফুমের দরকার-ই নেই। তার গায়ের নিজস্ব গন্ধটা যদি একবার পেতে পারত আকাতরু তবে তাতেই ভালো লাগাতে অজ্ঞান হয়ে যেত। তটিনীর মতন মেয়েরা যে। কেন নিজের গায়ের গন্ধে আকাতরুর মতন হতভাগ্য পুরুষদের পেতে দেয় না। তটিনী যেন, কোনো ফুল! কাছে থাকাতেই আমোদিত হচ্ছে আকা।

আবারও বলল তটিনী, আবারও নদী!

অবনী বলল। হুঁ।

কী যেন, ভাবছিল সে।

তারপর বলল, একটা নয়। তিন তিনটে নদী পেরিয়ে যেতে হয়, জয়ন্তী থেকে ভুটানঘাটে যেতে হলে। জয়ন্তী, ফাসখাওয়া আর চুনিয়া ঝোড়া। এখন সহজে যেসব নদীর বুকের উপর দিয়ে জিপ পেরিয়ে যাচ্ছে বর্ষাতে সেইসব নদীর চেহারা যদি, দেখতে পারতেন তাহলে বুঝতেন এরা কীরকম।

কীরকম মানে?

মানে, প্রলয়ংকরী। মানে, আপনার যেমন রূপ এই সকালে। কত পুরুষ-ই যে ঐরাবতের মতন ভেসে যাবে না জেনেই।

শব্দ না করে মুখ টিপে হাসল তটিনী একটু।

প্রশংসাতে খুশি ভগবানও হন। আর তটিনী তো কোন ছার।

বেশ ভালো লাগছিল ওর। বহুবছর এমন ভালো লাগেনি। পুরুষের মুগ্ধ-দৃষ্টিতে ভালো লাগে সব মেয়েরই। কিন্তু সেই মুগ্ধতা একধরনের বন্যতা আকাতরুর মতন বন্য কোনো পুরুষের জংলি চোখের দিকে চেয়ে।

একটি গান শোনান-না।

অবনী বলল।

পাগল! এই লাফানো-ঝাঁপানো জিপে বসে! সে তো পপ মিউজিক হয়ে যাবে। গান থাক। তার চেয়ে আপনি বলুন তো কী কী নদী আছে আপনাদের এই বক্সা অঞ্চলে।

নদীর অভাব কী? কত্ত নদী।

স্বগতোক্তি করল, ভেতরে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টায় ব্যাপৃত আকাতরু। ও ভাবছিল, ও যদি অবনীর মতন কলকাত্তাইয়া ভাষাতে কথা বলতে পারত। তবে ও, তটিনীকে সব-ই বলত। পশ্চিমবঙ্গবাসী সংস্কৃতিসম্পন্ন তটিনী আকাতরুর ভাষার ধাক্কাতে যেন চমকে চমকে ওঠে। কিন্তু আকাতরুর পুববাংলার ভাষাতে যা-প্রাণ, যা-দম, যা ফুর্তি তা কী চিবিয়ে চিবিয়ে বলা পশ্চিমবঙ্গীয় ভাষাতে আছে!

অবনী বলল, পানা, ডিমা, বালা, ফাসখাওয়া, রায়ডাক আর সংকোশ।

আর একটু ডিটেইলস-এ বলুন, ওইসব নদীদের সম্বন্ধে কি আর কিছুই বলার নেই?

আছে বই কী। বলছি। একটু পরে কিন্তু আমরা একটা চা-বাগানের মধ্যে দিয়ে যাব। তার নাম ‘তুরতুরি’।

তুরতুরি? বাঃ কী সুন্দর নাম!

হ্যাঁ। এই বক্সা অঞ্চলে তুরতুরি ছাড়াও আরও অনেক চা-বাগান আছে। যেমন রায়ডাক, ঢালাঝোড়া, কোহিনুর, নিউল্যাণ্ডস, সংকোশ, কুমারগ্রাম, রায়মাটাঙ্গ, চিঙ্কুলা, গাঙ্গুটিয়া, মাজেরভাবরি, আচাপাড়া।

আকাতরু বলল, ভাটপাড়া, চুয়াপাড়া, রাধারানি, ডিমা, কানখাওয়ায় দোষ করল কী? আর…

আর থাম এবারে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-না? ‘ভালো, বেশি হয়ে গেলে আর ভালো থাকে না। কম বলেই তা ভালো। চা-এর সেলসম্যান আমি থোরিই। ওইতেই হবে।

তা-যা কইছস।

কলকাতার তটিনী হাসি হাসি মুখে আলিপুরদুয়ারের এই দু-জন মানুষের সঙ্গ খুব-ই উপভোগ করছিল। এই সারল্য, কলকাতার কোনো মানুষের-ই মধ্যে পাওয়ার নয়। কলকাতাতে সারল্য’র মতন পাপ আর দু-টি নেই। অপরাধও নয়। বক্র আর কুটিলদের শহর ওই কলকাতা।

এবারে নদীর কথা বলুন।

তটিনী বলল।

তারপর ভাবল,কী চমৎকার কাটছে আজকের সকালটা। আকাশে মেঘ করে এসেছে। বোধ হয় বৃষ্টি হবে। উদলা আকাশের নীচে বসন্তে বাদলা বাতাস বইছে। “আজ সকালবেলার বাদল আঁধারে/আজ বনের বীণায় কী সুর বাঁধা রে।”

বনে না এলে, প্রকৃতির মধ্যে একাত্ম না হতে পারলে, রবীন্দ্রনাথের গানকে বোধ হয় হৃদয়ংগম করা যায় না। বাণীর মানেই না বোঝা গেলে গান যে, গান হয়ে ওঠে না। কলকাতার লাল রায়, নীল সেন, বাসন্তী রায়, বেগুনি দাশগুপ্ত, সর্বজ্ঞ গুহঠাকুরতাদের মতন ঝাঁক ঝাঁক রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীদের এইকথাটা যদি বোঝানো যেত।

অবনী সিগারেটটা হাত বাড়িয়ে পথে ফেলে বলল, পানা’ নদীর জন্ম ভুটানে। এই পানা নদী বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পর পশ্চিমের সীমানা নির্ধারণ করে বয়ে গেছে। ‘ডিমা’র উৎসও ভুটান পাহাড়েই। ভুটান পাহাড় থেকে নেমে এসে পানা আলাইকরি নদীর সঙ্গে মিশেছে। তারপর বয়ে গেছে আলিপুরদুয়ারের মধ্যে দিয়ে। আর ডিমা নদীর সঙ্গে গাঙ্গুটিয়া এবং রায়মাটা নদী এসে মেশার পর এই একত্রিত তিন নদীর নাম হয়েছে কালজানি।

আর বলার কথা কইলি না?

আকাতরু বলল, ইন্টারাপ্ট করে।

বলছি তো। তুই-ই বলনা তাহলে। আমি বললে কথার মধ্যে এতকথা বললে বলতে পারব না।

হ। হ। আমি আর কথা কম না। তুই-ই ক। তটিনী দেবী কি আর কখনো আইবেন এই আমাগো ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরে? তাই ভালো কইর‍্যা সব বুঝাইয়া দে উনারে।

বক্সা পাহাড় থেকে নেমে এসেছে বালা নদী। থেলচাঙ্গ আর কালকূট নদী এসে মিশেছে বালাতে। বালা গিয়েও পড়েছে সেই কালজানি নদীতেই।

তাই?

হ্যাঁ।

আর যে জয়ন্তী পেরিয়ে এলেন, তা বেরিয়েছে ভুটানের সীমান্তের জয়ন্তী পাহাড় থেকে। ফাসখাওয়া আর হাতিপোতা ফরেস্ট ব্লক-এর সীমানা চিহ্নিত করে বয়ে গেছে জয়ন্তী।

আর ফাসখাওয়া?

অন্য নদীগুলোর কথা এখন থাক। একটু জল খাই। বলেই প্লাস্টিকের পার্লপেট-এর জলের বোতল খুলে, ড্রাইভারকে বলল, একটু থামো তো ভাই। জল খেয়েনি।

অবনীর জল খাওয়া হলে তটিনী বলল, আপনি এতসব জানলেন কী করে?

অবনী হাসল, আমার বড়দা ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টেই কাজ করতেন। বাবার মৃত্যুর পরে এই দাদাই আমাদের মানুষ করেন। সেই সময়ে এই সমস্ত অঞ্চলে আমার থাকবার সুযোগ হয়েছিল।

তাই বলুন। আচ্ছা, আমরা যে, ভুটানঘাট বাংলোতে থাকব, সেখান থেকে ভুটান কত দূর?

কাছেই। তাই তো নাম ভুটানঘাট। বাংলোর সামনে দিয়ে বয়ে গেছে রায়ডাক নদী। আশ্চর্য সুন্দর তার রূপ। এক একরকম রূপ, এক এক ঋতুতে। এই রায়ডাক নদীও এসেছে ভুটান থেকে। পিপিং-এ নিয়ে যাব আপনাকে। ভুটানের সেই পিপিং-এ পৌঁছে ওয়াঞ্চ নদী সমতলে পড়েছে। ভারতে। পড়েই চওড়া হয়ে গেছে। পিপিং অবধি পর্বতের পর পর্বতের মধ্যের গিরিখাত দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এসেছে ওয়াঞ্চ। ভুটানঘাট-এর সামনে দিয়ে বয়ে গিয়ে নর্থ রায়ডাক, সেন্ট্রাল রায়ডাক, মারাকাটা এবং নারাখালি ফরেস্ট ব্লক-এর মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে রায়ডাক নদী। এই নদীর বিশেষত্ব হচ্ছে যে, সমতলে এসে সে, গতএক-শো বছরে বহুবার গতিপথ বদলেছে। একঘেয়েমি বোধ হয় রায়ডাক-এর একেবারেই পছন্দ নয়। আমাদের কার-ই বা ইচ্ছে করে একই পথ বেয়ে আজীবন চলতে। কিন্তু নদী তো নদীই। আমরা নদী হলে আমরাও আমাদের গতিপথ বার বার বদলে ফেলে নিজেদের নবীকৃত করতাম। উনিশ-শশা পাঁচ, উনিশ-শশা তিরিশ, উনিশ-শো তেত্রিশ, উনিশ-শো পঞ্চাশ এবং সবশেষ উনিশ-শো আটষট্টিতে গতিপথ বদলেছে রায়ডাক। এই গতি পরিবর্তনের পাগলামির খেসারত দিতে হয়েছে মারাত্মকারে বনকে। সেন্ট্রাল রায়ডার আর মারাকাটা ব্লক একেবারে তছনছ হয়ে গেছিল। আটষট্টির পরে রায়ডাক-এর পুরোনো খাত-এর ওপরে একটা সসেজ’ বোল্ডার-বাঁধ বেঁধে দেওয়া হয়। তারপর থেকে বর্ষাতে সেন্ট্রাল রায়ডাক আর মারাকাটার তেমন ক্ষতি হয়নি।

এমন সময় আকাতরু হঠাৎ বলে উঠল, থামা ত, তর নদীর ইতিহাস।

বলেই বলল, তটিনীকে উদ্দেশ্য করে, অ্যাই দ্যাখেন, আমরা এহনে চূর্ণঝোড়াও পার হইয়া আইলাম। ফাসখাওয়া ত আগেই পারাইছি। তা বোঝবেন ক্যামনে? রিভার রিসার্চ ইনস্টিটুটের অফিসারের মতন যা বকবকান বকবকাইতাছে পোলায় তার আর কী কমু! তুরতুরি বাগানে ঢুকুম আমরা একটু পর-ই। তারপর ময়নাবাড়ি বিটে পৌঁছামু। মাইমেনসিঙ্গা সুভাষবাবু আছেন বিট অফিসার। শুঁটকি মাছ খাইবেন নাকি ম্যাডাম?

শুঁটকি মাছ?

চোখ কপালে তুলে বলল তটিনী।

তারপর বলল, আপনি শুঁটকি মাছ খান? ইস। আপনি বাঙাল যে, তা জানতাম, এমন পচা বাঙাল তা তো জানতাম না।

হঃ।

অপমানটাকে ঝেড়ে ফেলে আকাতরু বলল। শুঁটকি মাছের ট্যাক্ট যে, একবার পাইছে, স্যা মানুষের অবস্থা মাংসর সোয়াদ পাওনের পর মানুষখেকো বাঘের মতন হইয়া যায় আর কী। বোঝলেন কি না!

তারপর বলল, জলে না নাইম্যাই সাঁতার শেখন কি যায়? আপনেই কয়েন।

আকাতরুর উদ্ভট উপমাতে হাসি পেল তটিনীর। সাধে কী আর বাঙালদের ‘বাঙাল’ বলে পশ্চিমবঙ্গের পুরোনো বাসিন্দারা! ঠিক-ই বলে।

ও হেসে বলল, আমার সাঁতার শিখে কাজ নেই। ভুটানঘাট আর কতদূর?

এই ত তুরতুরি বাগানের এলাকা প্রায় পেরিয়ে এলাম। বাঁ-দিকে সামনে একটু দাঁড়াতে হবে। সুভাষদার সঙ্গে দেখা করে যেতে হবে।

অবনী বলল। একটু পরেই গাড়িটা দাঁড়াল বাঁ-দিকে।

বিট অফিস এটা।

অবনী বলল।

সেটা কী আবার?

ফরেস্ট-এর নানা ভাগ থাকে। তেমন থাকে আমলাদেরও। এক একটি ফরেস্ট ডিভিশন-এর বড়োসাহেব হচ্ছেন ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার। মানে ডি.এফ.ও.। তাঁর নীচে থাকেন কয়েকজন রেঞ্জার। এক একটি রেঞ্জ-এর ভারপ্রাপ্ত অফিসার। এক একটা রেঞ্জ আবার কয়েকটি বিট-এ ভাগ করা থাকে। প্রত্যেকটি বিট-এর জন্যে থাকেন, এক একজন বিট অফিসার। এক একজন বিট অফিসারের নীচে থাকেন, কয়েকজন ফরেস্ট গার্ড। এবারে বুঝলেন।

হ্যাঁ। তাহলে এ.ডি.এফ.ও-টা কী জিনিস?

এ.ডি.এফ.ও. দুরকম হয়। অ্যাসিস্যান্ট ডি.এফ.ও. বা সিনিয়র রেঞ্জার। আর অ্যাডিশনাল ডি.এফ.ও। আজকাল সারাদেশেই সরকারি চাকুরেদের মধ্যে গাজোয়ারি ওপরে ওঠার এক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কী কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে, কী রাজ্য সরকারের। ওপরওয়ালার খেতাবটি ব্যবহার করার বড়োই লোভ দেখা যায়। যেমন ওপরওয়ালাদের দেখা যায়, গাড়িতে লাল বাতি জ্বালিয়ে পদমর্যাদা বেড়েছে এমন ভাবা। এদিকে তাঁদের মধ্যে অনেকেই জানেন না যে, সাধারণ মানুষের মনোভাব বিচার করলে তাঁদের গাড়ির মাথাতে লাল বাতি না জ্বালতে দিয়ে তাঁদের প্রত্যেকের পেছনে একটা করে লাল বাতি জ্বেলে দেওয়া উচিত। তাই অ্যাডিশনাল ডি.এফ.ও-দের ভুলক্রমে এ.ডি.এফ.ও. বললেই তাঁরা হামলে পড়ে কল্যাণবাবুর মতন বলেন “অ্যাডিশনাল বলুন, অ্যাডিশনাল।”

একজন পান-খাওয়া রোগা-সোগা ভদ্রলোক বিট অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন।

অবনী বলল, সুভাষদা, এই যে, তটিনী দেবী। আলিপুরদুয়ারে এসেছিলেন যাত্রার জন্যে।

আসেন আসেন। নামেন একটু। পায়ের ধুলা দিয়ে ধন্য করেন আমাগো চা খাইয়া যান এককাপ।

মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট হল সকালের জলখাবার খেয়ে বেরিয়েছি। আজ থাক মানে, এখন থাক। ফেরার পথে হবেখন।

তটিনী বলল, বিনয়ের সঙ্গে।

অবনী ও আকাতরু গাড়ি থেকে নামল। অবনী বলল, পাঁচ মিনিট একটু সুভাষদার সঙ্গে দেখা সেরে আসছি ম্যাডাম।

ঠিক আছে।

তটিনী বলল।

তটিনীর মন বলল, ওঁরা নিশ্চয়ই চানু রায় আর মৃদুলবাবু সম্বন্ধে কথা বলতে গেলেন। গত রাতের ঘটনাটার কথা মনে হতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল তটিনীর। মৃদুলকে ও পছন্দ কোনোদিনও করেনি। কিন্তু অপছন্দ করা আর ঘৃণা করার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান আছে। কলকাতার পরিবেশ যেমন প্রতিদিন দূষিত থেকে দূষিততর হয়ে যাচ্ছে, দূষিত হচ্ছে। প্রতিবেশও। এইসব মানুষদের সঙ্গেই দিন কাটাতে হয়। ভাবলেই বুকের মধ্যে একটা কষ্ট অনুভব করে। পুরুষগুলো কি সবাই এমন বজ্জাত? কে জানে! তা নয় বোধ হয়। আকাতরুরাও তো আছে। মেয়েদের মধ্যেও বজ্জাত কম নেই। সে নিজেও তো বজ্জাত-ই। তাকে ভালো কে বলবে?

গাড়ির পেছনের সিটে বসে সামনে তাকাল। কাঁচা, কোরা রঙের ধূলিধূসরিত পথটি সোজা চলে গেছে গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে। বাগানের প্রান্ত এলাকা। বাগানের মধ্যে যে, বড়ো বড়ো গাছগুলোলাগানো হয়, কী নাম কে জানে! আকাতরু জানবে। সেই গাছগুলো ছাড়া অন্য গাছ নেই। বাঁ-দিকে গভীর জঙ্গল দেখা যাচ্ছে।

ওপরে চেয়ে দেখল, চমৎকার নীল আকাশ। ঝকমক করছে রোদ। রোদের কুচি উড়ছে যেন, হাওয়ার সঙ্গে। বিট অফিসে যাওয়ার পথের বাঁ-দিকে পথপাশে একটা ছোট্টডোবা মতন। তার কিনারে কলমিশাক ফুটেছে। অজস্র। চার-পাঁচটি পাতিহাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে ‘প্যাঁ এক প্যাঁ-এ-ক’ শব্দ করে। সামনের মাটির বাড়ির দাওয়াতে একটা তিন-চার বছরের ছেলে, যার নিম্নাঙ্গ নগ্ন কিন্তু ঊর্ধ্বাঙ্গে একটি নীলরঙা বুকছেঁড়া হাফ-শার্ট, কোঁচড়ে মুড়ি রেখে নিবিষ্টমনে একটি একটি করে মুড়ি তুলে, তা সে গুনে গুনে খাচ্ছে। কোথাও কোনো তাড়াহুড়ো নেই। অবকাশ-ই অবকাশ। দু-টি ছাগল নিয়ে এক বুড়ি হেঁটে চলেছে পথ বেয়ে। কে জানে, কোথায় চলেছে। আজ বোধ হয় হাট আছে, এই ময়নাবাড়িতে। দু-একজনকে ধামাতে করে আনাজপাতি নিয়ে যেতেও দেখল। কারোরই কোনো তাড়া নেই। না হাঁসেদের, না ছেলেটির, না বুড়ির, না অন্য কারোর। ভারি ভালো লাগছিল তটিনীর। ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল ওর। পুকুরপাড়ে মধুচুষি ফুলের ঝোঁপের মধ্যে বসে থাকত ছোট্টমেয়ে তটিনী এমন-ই নিস্তব্ধ দুপুরে। ফড়িং উড়ত। মরা নদীর সোঁতার পাশের সজনে গাছের ডালে নীলকণ্ঠ পাখি উড়ে এসে বসত। হরেকৃষ্ণ দলুই-এর বাড়ি থেকে তার নব্বই বছরের বুড়ি মা বাতের ব্যথায় কঁকিয়ে কাঁদত। নিস্তব্ধ ঘুঘুডাকা দুপুরে চিলের কান্নার সঙ্গে সেই কান্না মিশে যেত। তটিনীর সমস্ত ছেলেবেলাটা ফ্রেমে-বাঁধানো কোনো ছবির-ই মতন তার মনের চোখে একঝলক ভেসে উঠেই মিলিয়ে গেল। খুব-ই গরিব ছিল ওরা। কিন্তু আজকে কলকাতার ফ্ল্যাট, মারুতি গাড়ি, চাকর-ঝি, ফ্রিজ, ভিসিআর, টিভি, বেডরুমে এয়ার কণ্ডিশনার, বসবার ঘরে সোফাসেট, কার্পেট এসব কোনো কিছুর মূল্যেই ছেলেবেলার সেই, আশ্চর্য দিনগুলিকে কেনা যাবে না। যা গেছে, তা গেছে চিরদিনের-ই মতন।

অবনীবাবুরা ফিরে এল। ড্রাইভারও। বোধ হয় সিগারেট খাচ্ছিল গাড়ির পেছনে গিয়ে। সুভাষবাবু গাড়ি অবধি এসে বিদায় জানালেন। দু-টি গন্ধরাজ লেবু দিলেন তটিনীর হাতে। বললেন, আমার বাগানের। ওখানে লেবু পাওয়া যায় না। তাই দিলাম। ভুটানঘাট বাংলোর চৌকিদার মানবাহাদুর খুব ভালো মসুর ডাল রাঁধে। মসুর ডালের সঙ্গে খাইবেন ভাত দিয়া।

তটিনী মুখে ধন্যবাদ না দিয়ে, হাসল একটু। ধন্যবাদ বা “থ্যাঙ্ক ইউ” সব জায়গাতে বলা যায় না। বলা উচিতও নয়। গাছ থেকে ছিঁড়ে আনা পাতাসুদ্ধ দু-টি গন্ধরাজ লেবুও যে, এক মস্ত উপহার হতে পারে এ-কথা কলকাতাতে বসে ভাবা পর্যন্ত যায় না।

গাড়ি ছেড়ে দিল। একটু এগিয়ে গিয়েই গাড়িটা বাঁ-দিকে মোড় নিল। পথে একটি চেকনাকা ছিল বনবিভাগের। সেটি পেরিয়ে, নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল গাড়ি।

হাতি। হাতি। ওই যে।

বলে, চেঁচিয়ে উঠল তটিনী।

আকাতরু হাসল। বলল, না।

হাতি-না?

হাতি হইব না ক্যান? হাতি নিশ্চয়ই!

তবে?

হাতি দেখে উত্তেজিত গলাতে বলল তটিনী, ছোট্টমেয়ের মতো।

হাতি নিশ্চয়ই। কিন্তু জংলা হাতি না।

তবে? জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, আর জংলা হাতি নয় কেমন?

আপনেও ত জঙ্গলেই আইছেন। তাই বইল্যা আপনেও কি ‘জংগলি’? কী যে কন?

অবনী আকার কথাতে হেসে ফেলল।

আকা আবার বলল, ওই হাতিটা মাইয়া হাতি।

মানে? হস্তিনী?

হ! হেইটার নাম হইল গিয়া প্রমীলা।

তাই?

হ! ফরেস্ট ডিপার্টের হাতি। অনেকদিন আগে চান করণের সময়ে পায়ের ছিকলখান খুইল্যা দিছিল ওর মাহুতে। জঙ্গলের মধ্যের ঝোড়াতে চান করতাছিল প্রমীলা। হেই সময়েই সে, পেরথমবার জঙ্গলে পলাইয়া যায়।

তার এক প্রেমিক আছে।

অবনী বলল।

তারপর বলল, এক-ই প্রেমিক। প্রকান্ড দাঁতাল। অল্প কদিন আগেই একবার রাতের বেলা পালিয়ে গেছিল। বার বার পালায় জঙ্গলে কিন্তু প্রেমিক বদলায় না। খুব ভালোবাসা দু জনের।

তটিনী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তাই?

হ। হাতিটা সুভাষদার-ই সম্পত্তি কইতে পারেন। ময়নাবাড়ির বিটের এই সম্পত্তি।

কী করেন সুভাষবাবু হাতি দিয়ে?

তটিনী বলল।

কী করেন না তাই কন?

আকাতরু বলল।

ডুয়ার্স আর আসামের জঙ্গলে হাতি, উড়িষ্যার জঙ্গলে মোয, উত্তরপ্রদেশের ড্রাই ইলাকায় উট কত কাজেই যে, লাগে তা কহনের নয়।

তাই?

বলল তটিনী।

.

০৮.

মসুর ডাল, কাঁচালঙ্কা, কালোজিরে ফোড়ন দিয়ে রাঁধা, কড়কড়ে করে আলু ভাজা, আঁচড়ের তরকারি, খুব বড়ো বড়ো পিস করে কাটা তেলঅলা পাকা রুইয়ের ঝোল, ভেটকি মাছের কাঁটা চচ্চড়ি দিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে ঘুম লাগিয়েছিল তটিনী। এতঘুম যে, কোথায় কী করে জমে ছিল তা তটিনী ভেবেই পাচ্ছে না। শরীর এবং মনও যেন, ছেড়ে দিয়েছে একেবারে। এলিয়ে দিয়েছে। আনওয়াইজিং প্রসেস’ শুরু হয়েছিল রাজাভাতখাওয়াতেই। তা গতিজাড্য পেয়েছিল জয়ন্তীতে এসে। আর ভুটানঘাটে এসে সেই চড়াই যেন, শেষ হল আপাতত।

ভারি সুন্দর বাংলোটি ভুটানঘাটের। কাঠের দোতলা বাংলো। চওড়া বারান্দা ও বসবার ঘর আছে দো-তলাতে। একতলাতেও বারান্দা আছে। বাংলোর কিছুটা দুর দিয়েই ওপারের ভুটানের উত্তুঙ্গ পাহাড়শ্রেণির পা ছুঁয়ে আর গভীর বনরাজির মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে রায়ডাক নদী। ঝরঝর শব্দ করে। কাছেই বোধ হয় জলের মধ্যে একাধিক প্রপাত আছে। একই ডেসিবেল-এ জোরে জল পড়ার শব্দ। হয়েই যাচ্ছে অবিরাম। শব্দটি হয়তো এক-ই থাকবে কিন্তু রাতের বেলা যখন বন-বাংলো সংলগ্ন পরিবেশ অনেক বেশি শান্ত হবে, বনবাণীও নিথর হবে তখন এই শব্দকেই নিশ্চয়ই আরও অনেক জোর বলে মনে হবে।

নদীতে যাওয়ার পথ করা আছে একটা। নদীর কাছেই পাম্প-হাউস। আর আছে একটি বানানো “নুনী”। SALT LICKI রাজাভাতখাওয়া-জয়ন্তী রোডের ওপরের টাওয়ারের কাছে যেমন আছে, সাংহাই রোডের মোড়ে, এখানেও বস্তা বস্তা নুন ফেলে রেখেছেন বনবিভাগ বাংলোর কাছেই। সেখানে ভরদুপুরেও চিতল হরিণেরা নুন চাটতে এসেছে। গম্ভীর হরজাই জঙ্গলের মধ্যে সেই নুনী। রায়ডাক নদী, নদীর ওপাড়ের ভুটানের আকাশছোঁয়া পাহাড় এবং তারও উপরে নির্মেঘ কলুষহীন সুনীল আকাশ মিলেমিশে মনে হচ্ছে একটি ফ্রেমে-বাঁধানো ছবি।

আকাতরু আর অবনীবাবু বলেছিলেন, বিকেলে নদীতে বেড়াতে নিয়ে যাবেন বাংলোর সামনের পথ দিয়ে হাঁটিয়ে। তারপর নদীর বিস্তীর্ণ বালি আর নুড়িময় বুক ধরে হেঁটে ফিরে আসবে বাংলোতে।

ঘুম থেকে উঠে ও দো-তলার বাংলোতে বারান্দার ডানকোণে চেয়ার পেতে নদীর দিকে চেয়ে বসেছিল। ওরা দু-জনে নীচের ঘরে উঠেছেন একইসঙ্গে। ওঁরাও বারান্দাতে বসে কথা বলছিলেন। মনে হচ্ছিল যেন, ওর পাশে বসেই কথা বলছেন ওঁরা। এমন নিস্তব্ধ পুরো অঞ্চল। বাংলোর পেছন দিকে বাবুর্চিখানা। কে যেন, বালতি নামাল সিমেন্ট-বাঁধানো চবুতরাতে। তাতেই কত শব্দ হল। তবে হাওয়া আছে জোর। নদীর উপর দিয়ে বয়ে আসছে সে-হাওয়া। বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া। এখন-ই শীত শীত করছে। রাতে কম্বল গায়ে দিয়ে শুতে হবে সব দরজা-জানলা বন্ধ করে।

কথা আছে বিকেল চারটেতে চা নিয়ে আসবে চৌকিদার মানবাহাদুরের হেল্পার। তারপর ওরা হেঁটে বেরোবে যাতে, দিনের আলো থাকতে থাকতে বাংলোতে ফিরে আসতে পারে। এইসব অঞ্চলেরজঙ্গল এমন-ই নিচ্ছিদ্র যে, ভেতরে চোখ যায় না। দু-পাশ থেকে জঙ্গল ঝুঁকে পড়েছে পথের ওপরে। ভয় করে দেখে। তা ছাড়া এইসব জঙ্গলে বাঘ তো আছেই, কিন্তু বাঘের থেকে যত না ভয় তার চেয়ে অনেক-ই বেশি ভয় সাপের এবং হাতির।

নীচ থেকে অবনীবাবু বললেন, লুঙ্গি-টুঙ্গি ছেড়ে তৈরি হয়ে নে আকা। সাড়ে তিনটে বেজে গেছে। চারটেতে চা খেয়ে না বেরোলে আলো থাকতে থাকতে ফিরে আসা যাবে না।

হ।

আকা বলল।

তারপর বলল, আমার কিছুই ভালো লাগতাছে না রে অবু।

বুঝেছি।

কী বুঝছস? আমি এহনে কী করুম তাই ক!

মরেছিস তুই। আমি কিছুই করতে বলি না।

তার মানে কী? তুই আমার বন্ধু কি বন্ধু না?

বন্ধু বলেই তো বলছি। সারাটা জীবন তুই উলটোপালটা কাজ করে এলি। কলেজপাড়ার নমিতা তোকে এত ভালোবাসে। পালটি ঘর। কত গুণের মেয়ে। এত করে বললাম তোকে। মাসিমারও ভীষণ-ই পছন্দ অথচ তোর…

হঃ। কার সঙ্গে কার তুলনা!

তটিনীকে নিয়ে তুই কী করতে চাস?

সকলেই যা করে। বাড়ির বউ। তুই নলিনীকে নিয়ে যা করছস। সকলেই যা করে।

তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

তটিনী কত ঘাটের জল খাওয়া মেয়ে, সে-সম্বন্ধে তোর কোনো ধারণা আছে?

আস্তে কথা ক। শুইন্যা ফ্যালাইলে বেচারি মনে দুঃখ পাইবনে।

দুঃখ পাওয়ার তো কিছু নেই। তটিনী কি নিজে জানে না এ-কথা? তা ছাড়া আমি তো তাকে শোনাবার বা আঘাত দেওয়ার জন্য এ-কথা বলছি না। বলছি, তোর-ই ভালোর জন্যে। ওর ঘর তো দো-তলার বাঁ-দিকে। এই দিকের কথা শুনতে পাবে না। তা ছাড়া সে তো এখনও ঘুমোচ্ছে। মানবাহাদুরকে বলা আছে, চারটের সময়ে চা নিয়ে গিয়ে দরজাতে ধাক্কা দেবে।

তবু। তুই আস্তে আস্তে কথা ক।

অবনী আকাতরুর কথার কোনো উত্তর দিল না।

আকা বলল, কথা কইস না ক্যান?

কোনো কথা নেই আমার। তোর মাথাটা গেছে।

হয়তো। অবশ্য আমি কী আর বুঝি না যে, আমার কুনোই যুগ্যতা নাই তারে পাওনের। আমার ভালোবাসাই হইব আমার সব যুগ্যতা। আমি বাকিজীবন তার চাকর হইয়া থাকুম।

তোকে সে চাকর রাখলে তো? যাদের সকাল বিকেল চাকর পালটানো অভ্যেস তাদের তোর মতো গোঁয়ার-গোবিন্দ বাঙাল চাকরের প্রয়োজন নেই। তাদের প্রয়োজন টাকার। তোর ভালোবাসাতে তাদের কোনো প্রয়োজন নেই। বারো বছর বয়স থেকে তারা ভালোবাসা টেনে-ছিড়ে ভালোবাসার ওপরে বিরক্ত হয়ে গেছে। পুরুষের ভালোবাসা আর মুসলমানের মুরগিপোষা যে, এক-ই গোত্রীয় তা তারা ভালো করেই জানে। ভালোবাসার কথা বললে, তারা হাসবে।

হাসব? কইস কী রে? এমন বুকা মাইয়াও আছে নাকি এই পৃথিবীতে যে, ভালোবাসা বুঝে না। বিশেষ কইর‍্যা যে, কুখনো পেরকৃত ভালোবাসা কারে কয় তাই জানে নাই।

অবনী হেসে উঠল আকাতরুর কথাতে।

হাসলি ক্যান? ইডিয়ট?

হাসলাম এইজন্যে যে, তোর পেরকৃত ভালোবাসা তটিনীর চোখে বিকৃত ভালোবাসা বলে ঠেকবে। ও যাত্রার নায়িকা। তুই ওর সঙ্গে যাত্রার ডায়ালগ দিয়ে পারবি? তুই একটা ছাগল।

মুখ সামলাইয়া কথা কইস য্যান।

হলে কী করবি? তোর মাথা ফাটাইয়া দিমু।

হ্যাঁ। জানিস তো ওই গুণ্ডাগিরি। তুই একটা ঘটোৎকচ। তোর মতন একটা গ্রস, দুর্গন্ধ বাঙালকে কলকাতার তটিনীর ভালো লাগবে কেন, তার একটা কারণ আমাকে দেখাতে পারিস? জাস্ট একটা?

ক্যান পারুম না। আমার মতন শুদ্ধ ভালোবাসা অরে অর জীবনে আর কেউই বাসে নাই যে, এইটাই হইল গিয়া যথেষ্ট কারণ। ও মাইয়ার মগজ বইল্যা কিছু যদি থাইক্যা থাকে ত সে নিশ্চয়ই বুঝবো আনে। সে তোর মতন ছাগল নাকি?

অবনী বলল, ঘটোৎকচ!

তারপর-ই বলল, তোর যা ইচ্ছে হয় তাই কর। তোর এলেম থাকে তুই ভালোবাস, তুই তার সঙ্গে শুয়ে পড়, বিয়ে কর, যা খুশি তাই কর। কিন্তু সব-ই করতে হবে নিজের এলেমে। আমার বিন্দুমাত্র সাহায্য তুমি পাবে না তা বলে দিলাম। জিইয়ে রাখা কইমাছের মতন নমিতাকে আমি আর মাসিমা জিইয়ে রেখেছি তোর জন্যে। তুই জানিস কত ভালো সম্বন্ধ এসেছিল মেয়েটার, আমরা সেসব সাবোটাজ করেছি দিনের পর দিন। তুই হলি গিয়ে ধাঙ্গড় বস্তির শুয়োর। ময়লা খাওয়াই তোর অদৃষ্ট। ফলমূল তোর ভোগে লাগবে কেন?

আকাতরু কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। তারপর বলল, ঠিক আছে। আজ চা খাওনের পর তর আর যাইতে হইব না। আমি একাই তটিনীরে লইয়া যামু নদীতে।

মাথা খারাপ। তোর এখন যা-অবস্থা। তোর সঙ্গে একা তটিনীকে ছেড়ে দেওয়ার মতন দায়িত্বজ্ঞানহীন আমি নই। আমার নিজের দায়িত্বে তাকে এই জঙ্গলে এনেছিলাম। তাও মৃদুলবাবু সঙ্গে থাকলে আমার দায়িত্ব অনেক কম থাকত। কাল রাতে উনি চলে যাওয়াতে আমার দায়িত্ব বেড়ে গেছে অনেক। অমন কাঁচাকাজ আমার দ্বারা হবে না। তুই যদি স্বাভবিক থাকতিস তাহলেও অন্যকথা ছিল। তুই তো এখন খ্যাপা কুকুর। কামড়াবি না, আঁচড়াবি ওকে একা পেলে তা ঈশ্বর-ই জানেন!

আকাতরু আহত হয়ে চুপ করে গেল।

একটু পরে বলল, অরে পিপিং-এ লইয়া যাবি না?

যাব। কাল সকালে।

হুঁ।

পিপিং-এ গিয়ে কীই বা দেখবে।

ক্যান? ওয়াঙ্গু নদী কেমন কইর‍্যা ভুটানের দুই পাহাড়ের চিপা থিক্যা বারাইয়া হঠাৎ ছড়াইয়া গেছে সমতলে তা কী দেখার নয় নাকি? তর চক্ষু কখনো আছিল যে, তুই দেখতে পাইবি। হঃ।

তাও শীতকালে হলে হত। ভুটান থেকে কমলালেবু এসে পিপিং-এর হাটে কমলালেবুর পাহাড় জমত তখন। এই ন্যাড়া পিপিং দেখে কী হবে?

স্যা তর বোঝনের কাম নাই। যার চক্ষু আছে স্যা ন্যাড়া মাথাতেও চুল দেইখ্যা লয়। অ্যারে কয় ইমাজিনেশান। বুঝলি কিনা মাস্টর। ইমাজিনেশান! তুই ইসবের কী বোঝস?

.

০৯.

চা খাওয়ার পর ওরা তিনজনে বেরিয়ে পড়ল।

গাড়ি নেবেন না?

তটিনী বলল।

নিতে পারেন। ড্রাইভার তো বসেই আছে। কিন্তু হেঁটে গেলে পথটাকে অনেক ভালো করে দেখতে পেতেন। তা ছাড়া, আকার মতন গাইড তো আর রোজ রোজ পাবেন না। সে তো এখানে প্রতিটি গাছ, ফুল, লতা, পাতা সব-ই চেনে। চিনতে চিনতে পথ চলতে পারবেন।

হাতি বা বাঘ যদি বেরিয়ে পড়ে।

বাঘ বেরোবে না। এখানের বাঘেরা সব অসূর্যম্পশ্যা। যদিও নাম ‘টাইগার প্রোজেক্ট”, কেউই এ-অঞ্চলে বাঘ দেখতে পান না। বাঘেরা শহুরে কবি-সাহিত্যিক-গায়ক-বাদকদের মতন ‘এগবিশিনাষ্টি প্রাণী নয়। অন্তর্মুখীনতা’ শব্দটার মানে যে কী, তা বাঘদের দেখে শিখতে হয়। “আমাকে দ্যাখো”, আমাকে দ্যাখো” –এই সস্তা স্লোগান নেই তাদের। তবে বাঘ যে আছে, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। আর হাতি যদি বেরোয় তবেও ভয়ের কিছু নেই। আমার বন্ধু আকাতরু নিজেই সাক্ষাৎ গণপতি। চেহারা দেখে কি আপনার ওকে হাতি নয় বলে মনে হয়। হাতি বটে, তবে মাকনা। দাঁত নেই।

তারপর একটু চুপ করে থেকে অবনী বলল, আকাতরুর নিজের ধড়ে প্রাণ থাকতে আপনার বিন্দুমাত্র ক্ষতি কোনো মানুষ কী জানোয়ার-ই করতে যে, পারবে না, তা কি গতরাতে বোঝেননি?

তটিনী আকার দিকে মুখ তুলে হাসল একফালি। অমন সুন্দর বৈশাখী বিকেলে অমন ফুল ফলন্ত বনে, অমন সুন্দর অথচ বিবাগি নদীতটে, অমন মৌনী, আকাশচুম্বী পাহাড়শ্রেণির পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না তটিনীর। ও ভাবছিল, মানুষ বড়োবেশি কথা বলে।

অবনীর মন বলল, গেল। গেল। ছেলেটার সর্বনাশের যা-বাকি ছিল, তা সম্পূর্ণ হল। এমন মার সে, সইবে কী করে যখন, অভিজ্ঞ অবনীর বুকের মধ্যেটাও তটিনীর মরা আলোর মতো সুন্দর, আশ্চর্য সেই হাসির ছোঁয়া লেগে ‘ধড়াস ধড়াস’ করতে লেগেছে?

সকালে পরা শাড়ি-জামা ছেড়ে একটি চাঁপারঙা সিল্কের শাড়ি পরেছে তটিনী। লাল ব্লাউজ।

কে দেখবে, কে জানে!

মেয়েরা বোধ হয় কারোকে দেখাবার জন্যে সাজগোেজ যতটা করে, তার চেয়ে বেশি করে, নিজেদের মধ্যে নিজেকে স্বীকৃত করার যে-জন্মগত তাগিদ আছে, সেই তাগিদেই। নইলে এই পান্ডববর্জিত জায়গাতে, ঘন ঘন পোশাক বদলাবার কী আছে? অবনী তার আকাতরু তো মানুষের মধ্যেই গণ্য নয়।

হাতে পরেছে প্লাস্টিকের লালরঙা চুড়ি অনেকগুলো করে। দু-হাতেই। লাল প্লাস্টিকের দুল। কাজলও পরেছে। ওই চোখে কাজল লাগালে যে, দু-চোখের কণীনিকার পটভূমিতে চোখ দু টির মণিতে, আঁখিপল্লবে, উড়ে যাওয়া কালো পাখির ডানার মতন ভুরুতে অতলান্ত হয়ে ওঠে। সে-কথা কি তটিনী নিজে জানে? হয়তো জানে। জানে বলেই হয়তো ইচ্ছে করে বধ্যভূমিতে আকর্ষণ করে বোকা পুরুষদের।

এটা কী বাঁশ?

তটিনী বলল, আঙুল তুলে দেখিয়ে।

বলল, এর আগে কোথাওই দেখিনি তো!

“আগে কখনোও দেখেননি এমন জিনিস এই “পুরোনো” পৃথিবীর আনাচে কানাচে পাবেন। মৃদুলবাবুর মতন যাঁরা বলেন যে, এই পৃথিবীটা বড়োই পুরোনো হয়ে গেছে তাঁরা বোধ হয়, কখনোই দু-চোখ মেলে, এই সুন্দর পৃথিবীর দিকে একবারও তাকাননি!

ওই বাঁশের নাম ‘মাকলা বাঁশ’।

আকা বলল।

বাঁশ অনেকরকম হয় বুঝি?

হয় না ত কী?

তটিনীর আকার কথা শুনে মজা লাগল খুব। সবসময়েই যে, ধমকে ধমকে কথা বলে। যেন, কোনো অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে অনুক্ষণ লড়াই করছে সে।

আর কী কী বাঁশ হয় এইসব অঞ্চলে?

মাকলা ছাড়াও হয় দাওয়া বাঁশ, লাঠি বাঁশ, তামা অথবা ছোঁয়া বাঁশ।

লাঠি বাঁশ দিয়ে কি লাঠি হয়?

হয় তো।

বাঃ। আমাকে জোগাড় করে দেবেন তো একটা। বেশি মোটাও নয়, বেশি সরুও নয়।

কাকে মারবেন লাঠি দিয়ে?

অবনী হেসে বলল।

কত লোক আছে মারার। চোর-ছ্যাঁচোড়ের তো অভাব নেই। তা ছাড়া মাঝে মাঝে নিজেকে মারার কথাও মনে হয়। নিজের মধ্যেও তো খারাপত্ব কম নেই!

বাঃ! সুন্দর বলেছেন।

অবনী বলল।

তারপর বলল, আপনি এমন কথা বলেন তটিনী দেবী যে, মনে হয় সবসময়েই যাত্রার ডায়ালগ বলছেন। তবে এ-ডায়ালগ কোনো গ্রাম্যযাত্রা নয়, যেন, ভীষণ সফিস্টিকেটেড কোনো অডিয়েন্সের জন্যে বিশেষভাবে পরিকল্পিত কোনো সফিস্টিকেটেড যাত্রা।

হঠাৎ আকা বলল আঙুল তুলে, ওই দ্যাখেন। লজ্জাবতী লতা।

কই? কই?

ওই যে। চান। আগে দ্যাখেন নাই কুখনো?

নাঃ।

ওইগুলির ইংরেজি নাম হইল গিয়া ‘মিমোসা পুডিকা’।

বাবাঃ আপনার কি ‘বটানি’ ছিল নাকি? কলেজে?

আকা উত্তর দিল না।

একটু চুপ করে থেকে বলল, আমি ল্যাখ্যাপড়া তেমন শিখি নাই। মাঝে মাঝে মনে হয়, না শিখ্যা দুষ করি নাই কুনো। শিখলে হয়তো মৃদুলবাবু হইয়া যাইতাম।

তটিনী চুপ করে থাকল।

অবনী বলল, থাক, ওই অপ্রিয় প্রসঙ্গ থাক।

মানুষটা কোথায় চলে গেল বলুন তো? ওই চানুবাবুরা তাকে মেরেটরে ফেলবে না তো? হয়তো শুকনো নদীর বেড-এ কোথাও ডেডবডি ফেলে রাখল।

তারপর-ই বলল, আচ্ছ, বৈশাখের একেবারে গোড়াতেই এখানের সব নদীর এমন শুকনো অবস্থা কেন? অন্য সব জায়গাতে তো বৈশাখের শেষে অথবা জ্যৈষ্ঠ মাসেই নদী শুকোয় দেখেছি।

তারপরে একটু থেমে বলল, অবশ্য আমি আর কত জায়গাতেই বা গেছি?

অবনী বলল, ঠিক-ই বলেছেন। কিন্তু এসব তো ভাববার অঞ্চল।

‘ভাববার’ মানে?

এইসব অঞ্চলের এই বিশেষত্ব। হিমালয়ের পাদদেশে দুরকমের জঙ্গল দেখা যায়। ভাববার আর তেরাই। ভাববার জঙ্গলের বিশেষত্ব হচ্ছে, এই অঞ্চলের নদীগুলো পাহাড় থেকে সমতলে নেমে কিছুদূর যাওয়ার পর-ই ডুবসাঁতার দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।

আকা বলল মানে, অন্তঃসলিলা হইয়া যায় আর কী!

অবনী বলল, সেই কারণেই এখানকার সব গাছগাছালির শিকড় মাটির নীচে অনেকদূর অবধি নেমে যায় জলের সন্ধানে। এই শিকড়গুলোর নাম ‘ট্যাপ রুটস’।

নদীগুলো কি আর মাথা তোলে না?

তোলে বই কী। বেশ কিছুদূর ডুবসাঁতারে গিয়ে মাথা তোলে। এই কারণেই ভাববার অঞ্চলে নানা গাছগাছালি দেখা যায়, যা, অন্যান্য অঞ্চলে দেখা যায় না।

একবার সুন্দরবনে গেছিলাম। সেখানে দেখেছিলাম, গাছেদের শিকড়গুলো সব দাঁত বের করে থাকে ভাটার সময়ে।

তাই তো। সেই শিকড়ের নাম এরিয়্যাল রুটস। তারা দিনের মধ্যে দু-বার মাথা উঁচিয়ে বারো ঘণ্টা না থাকতে পারলে তো পচেই যেত।

অবনী বলল।

সত্যি! প্রকৃতির মধ্যে কত যে, রহস্য। আমার জঙ্গলে আসতে ভারি ভালো লাগে। ভালো লাগে বলেই তো আলিপুরদুয়ারে যাত্রা শেষ হতেই আপনাদের জ্বালিয়ে দিয়ে এখানে এলাম।

আকাতরু বলল, আমরা দাহ্য পদার্থ না। আমরা নিজেরা যদি নিজেদের ইচ্ছাতে না জ্বলি তবে অন্যর সাধ্য কী আমাগো জ্বালায়? কী বল অবনী?

ঠিক।

অবনী বলল।

ওরা পাটকিলেরঙা ধুলোর পথ বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে নদীর কাছে পৌঁছে গেল। বাঁ-দিকে পথ চলে গেছে পিপিং-এ।

নদী এখানে অনেকটাই চওড়া। পথের দিকে বিস্তীর্ণ চর। তার ওপরে নুড়ি বিছানো। পথের ধুলোতে ট্রাকের চাকার দাগ দেখল। তটিনী বলল, বাঃ কী সুন্দর! কিন্তু ট্রাক এখানে কী করতে আসে?

কী করতে আর? নুড়ি-পাথর বয়ে নিয়ে যায়।

ইস। নদীর বুক যে, ফাঁকা হয়ে যাবে।

তটিনী চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বলল।

নদীর বুক নারীর বুক নয়। অত সহজে তা ‘শূন্য’ হয় না। যা হারায় নদী, তা পরের বছর-ই পুরিয়ে নেয়। রবীন্দ্রনাথের সেই গানটার মতন।

কী গান?

তটিনী শুধোল।

“আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনি লীলা তব
ফুরায়ে দিয়ে আবার ভরেছ জীবন নব নব।”

অবনী বলল।

বাঃ।

তটিনী স্বগতোক্তি করল।

এমন সময়ে হঠাৎ কী মনে পড়াতে অবনী বলল, আমার একবার বাংলোতে ফিরে যেতে হবে।

ক্যান?

আকাতরু শুধোল।

রাতে কী রান্না হবে তাই বলে আসতে ভুলে গেছি মানবাহাদুরকে। তা ছাড়া আগামীকাল একটা পাঁঠা কিনতে বলেছিলাম। সেজন্যে আজ-ই টাকা দিয়ে কারোকে পাঠাতে হবে ময়নাগুড়িতে সুভাষদার কাছে। রেঞ্জার সাহেবের জিপ আসবে কী যেন কাজে একটু পরেই। ড্রাইভারের হাতে টাকাটা পাঠাতে হবে। নইলে সকালে পাঁঠা কিনে তা কেটেকুটে ভুটানঘাটে পাঠাতে পারবেন না সুভাষদা। সাইকেল নিয়ে লোক আসবে ময়নাগুড়ি থেকে রোদ চড়া হওয়ার আগে আগে।

কাল সকালে পাঠাবার বন্দোবস্ত করলে হত-না? আমাদের ড্রাইভারও তো পৌঁছে দিয়ে আসতে পারে।

তটিনী বলল।

তা হবে না। আমরা কাল চা খেয়েই চলে যাব পিপিং।

পিপিং শুদামুদা যাইয়া কী অইব? এখন তো কমলার সময় নয়। কমলার সময়ে পিপিং-এ যখন কমলার পাহাড় লাগে তখন যাইলেই না মজা!

আকাতরু বলল।

সবসময়ই মজা। ওয়াক্কু নদী হ্যাঁঙ্গিং ব্রিজ-এর নীচ দিয়ে বয়ে এসে যখন, সমতলে ছড়িয়ে গেল তখনকার দৃশ্যই আলাদা।

ঋষিকেশ-এর গঙ্গার মতন?

হ্যাঁ। প্রায় সেরকম-ই।

বলেই বলল, না। আর সময় নষ্ট করলে অন্ধকার হয়ে যাবে। অন্ধকারে এই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাওয়া সেফ হবে না। সঙ্গে টর্চ পর্যন্ত নেই একটা। কিন্তু তোরাই বা ফিরবি কী করে? তোদের সঙ্গেও তো টর্চ নেই।

আমরা নদীর বুকে বুকে ফিরব ত, জলের উপর আলো থাকে অনেকক্ষণ। তর যদি যাইতেই হয় ত আর দেরি কইর‍্যা কাম নাই। চইল্যাই যা তুই।

হ্যাঁ। তাই যাই।

অবনী বলল।

তারপর বলল, আপনাদের জন্যে চায়ের জল বসিয়ে, পেঁয়াজি বেসনে ডুবিয়ে রাখতে বলব, যাতে গিয়ে পৌঁছেলেই গরম গরম পেঁয়াজির সঙ্গে চা খেতে পারেন। আমি চলি। তোরা সাবধানে আসিস আকা এই সময় নদীতে সব জানোয়ার জল খেতে যাবে। নজর রেখে চলিস। বাংলোর কাছে অনেকখানি জায়গাতে পৌঁছোতে পৌঁছোতে তো সন্ধে হয়ে যাবে। নাঃ। আমরা বড্ড দেরি করে বেরোলাম বাংলো থেকে। কী করবি? আমার সঙ্গেই ফিরে যাবি?

আকাতরুর মুখটি যেন, শুকিয়ে গেল।

তটিনী বলল, এমন এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হতে চাই না আমি। ভুটান পাহাড়ের পায়ের কাছ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর পাশে পাশে এই আশ্চর্য সুন্দর নুড়িময় নদীরেখা ধরে হেঁটে যাওয়ার সুযোগ কী জীবনে আর আসবে? আপনি যান অবনীবাবু। এমন জায়গাতে এসে, এমন অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হতে চাই না আমি।

বেশ। তবে আমি যাই।

বলে, অবনী বড়ো বড়ো পা ফেলে যে-পথে এসেছিল, সেই পথেই ফিরে গেল।

অবনী ঘন বনের মধ্যের পথের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যেতেই আকা বলল, আসেন। আমরা আউগ্যাইয়া যাই।

চলুন।

তটিনী বলল, স্বপ্নাদিষ্টর মতন।

পায়ে পায়ে ওরা দু-জনে বালি পেরিয়ে নদীর নুড়িময় বুকে এসে দাঁড়াল। রায়ডাক নদীটা একটু এগিয়েই সুন্দর একটা বাঁক নিয়ে মিলিয়ে গেছে বনের মধ্যে। পিপিং-এর দিকে গেছে নদী। ওরা আরও কিছুটা গিয়ে জলের পাশে দাঁড়াল। তারপর-ই সেই সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে গিয়ে বোবা হয়ে গেল তটিনী। ঠিক এইরকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সামনে, এর আগে কখনোই দাঁড়ায়নি সে।

বেলা পড়ে এসেছে। হালকা কমলারঙা আলোয় হাসছে যেন, সাদা নুড়িময় তটভূমি, দ্রুতবেগে ধাবমানা নদী, পেছনের গভীর জঙ্গলাবৃত উঁচু পাহাড়শ্রেণি, ভুটান হিমালয়ের। আর ওদের পেছনেও গভীর জঙ্গল, হরজাই গাছের। গভীর বললেও সব বলা হয় না। বলতে হয় নিচ্ছিদ্র। কোথাও কোনো শব্দ নেই, শুধু জলের শব্দ আর জলের উপরে হাওয়ার শব্দ ছাড়া। পিপিং-এর দিক থেকে হাওয়াতে সাদা সাদা কী যেন, উড়ে আসছে আলতো হয়ে। তারপর নদীর জলে এসে পড়ছে। তারপর নদী তাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দ্রুতবেগে। নদীতে, ভাঁটিতে দু-তিনটি ছোট্টপ্রপাত এই এক কোমর বা এক মানুষ মতন হবে। তাতেই প্রচন্ড শব্দ উঠছে। কাছে গেলে, ভালো করে দেখা যাবে। শব্দও নিশ্চয়ই আরও অনেক জোর হবে।

মন্ত্রমুগ্ধের মতন দাঁড়িয়ে রইল তটিনী সেই ভুটান-কন্যা ত্রস্ত তটিনীর দিকে চেয়ে। তার নিজের শরীরে মনেও এমন আগলখোলা বিবসনা হয়ে দৌড়ে যাওয়ার এক তাগিদ অনুভব করল যেন ও। তার পাশেই দাঁড়িয়ে শালপ্রাংশু এক আদিম পুরুষ। ভান-ভন্ডামিহীন, তথাকথিত শিক্ষাহীন, খাঁটি, ভন্ডামিহীন একজন মানুষ। “আদম”-এর মতন আদিম। সেই মানুষটা তাকে ভালোবাসে। খুব-ই ভালোবাসে। জানে তটিনী। তার আদম-এর পাশে দাঁড়িয়ে তারও “ইভ’ হয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল। আদম আর ইভ-এর মতন নগ্ন হয়ে, এই সমুখের বয়ে যাওয়া নৃত্যরতা আদিম তটিনীর মতন বিরাট এবং পাহাড়ের মতন সকল, মহিরুহর মতন নীরব আকাতরুকে সমর্পণ করে দেয় নিজেকে। সে নিজে প্রকৃতি বলেই, পুরুষের মধ্যে, যথার্থ পুরুষের মধ্যে লীন হয়ে যেতে, এই পরম লগ্নে, এই গোধূলি লগনে ভারি ইচ্ছে করল ওর।

শব্দটি বোধ হয় ‘ইচ্ছে’ নয়। তার চেয়েও তীব্রতর, তীব্রতম কিছু। একেই কি কাম বলে? কে জানে! ঋতুমতী হওয়ার পর থেকে পুরুষের কাম-এর শিকার হয়েছে ও, ঠিকই কিন্তু নিজের ভেতরের কাম-এর উপস্থিতি সম্বন্ধে সম্পূর্ণই অনবহিত ছিল এতগুলো বছর। অন্য দশজন মেয়ের মতন সেও শালীন, সভ্য এবং চাপা ছিল তার শরীরী অভিব্যক্তিতে। তার ভেতরে এই অনুভূতিও যে, এমন তীব্রভাবে উপস্থিত ছিল, তা এই মূহূর্তের আগে ও জানেনি।

আকাতরু কোনো আদিম আদিবাসী শিমুলের মতন তার পাশে দাঁড়িয়েছিল। না, বহমান রায়ডাকের দিকে চেয়ে নয়। বহমান ভুটান-দুহিতার দিকে চেয়ে নয়, অনড় দাঁড়িয়ে থাকা, কনে-দেখা আলোর মধ্যে চাঁপারঙা শাড়ি আর লালরঙা ব্লাউজ-পরা তটিনীর দিকে, সেই আশ্চর্য অবিশ্বাস্য সুন্দর পটভূমিতে। কম-কথা-বলা আকাতরু যেন, না বলে বলছিল, চলেন। জামাকাপড় সব খুইল্যা ফ্যালাইয়া আমরা দুজনে এই নদীতে চান করি। এখানে আমাগো দ্যাখনের কেউই নাই। আকাশ আর বাতাস আর পাহাড় আর জঙ্গল আর নদী ছাড়া আমাদের দেখার মতন কোনো নোংরা চোখ-ই নাই। আইস্যেন! আইস্যেন!’

তটিনীও চুপ করেই ছিল। যেমন আকাতরুও। কিন্তু মুখে চুপ করে থাকলে কী হয়? প্রত্যেক মানুষ-ই সারাজীবনে মুখ দিয়ে আর ক-টি কথা বলে? যত কথা, তার অধিকাংশই তো বলে চোখ দিয়ে নয়তো মনে মনে। এই সরল সত্যটি বোঝেন কজনে?

অনেকক্ষণ পরে তটিনী বলল, এগুলো কী?

কোন গুলান?

ওই যে, উড়ে আসছে হাওয়ায় ভেসে, সাদা প্রজাপতির মতন? জলে গিয়ে পড়ে ভেসে যাচ্ছে। ওগুলো কি প্রজাপতি?

না। তবে ওইরকম-ই। ওগুলান শিমুল তুলা। বীজ ফাইট্যা বাহির হইয়াই হাওয়ায় ভাইস্যা আসতেছে।

বাঃ।

বলে উঠল তটিনী।

শিমুল তুলোর লেপ তোশক বালিশ সে, ব্যবহার করেছে কিন্তু কখনো বীজ-ফাটা তুলো দেখেনি। কী সুন্দর! ওর ইচ্ছে করল ও, নিজের ভেতরের বীজ থেকে ফুটে, ফেটে বেরিয়ে এমন হাওয়াতে ভেসে ভেসে কোনো দ্রুতধাবমনা নদীতে আছড়ে পড়ে ভেসে যায়, নদী যেদিকে নিয়ে যায় সেই দিকে।

ইচ্ছে করল। ইচ্ছেই। জীবনে কত কীই তো ইচ্ছে করল এ-পর্যন্ত কিন্তু ক-টি ইচ্ছেই বা পূরিত হল? হবে? পরক্ষণেই ভাবল, ওর একার-ই এমন দুঃখ নয়, হয়তো সব মানুষের-ই এমন মনে হয়। এক মানুষের বুকের কষ্ট অন্য মানুষে বোঝে কই? ক-জন বোঝে?

আকাতরুর চোখের দিকে তাকিয়ে তটিনী বুঝতে পারল, ওর বুকের মধ্যে কী হচ্ছে এখন, কী বলতে চাইছে ও, তটিনীকে। কিন্তু ও তো কথার কারিগর নয়। কথা দিয়ে যে, চতুরেরা কথার মালা গাঁথে, আকাতরু তো সেই মৃদুলদের মতন কথাসার মানুষ নয়। সে যে, খাঁটি। সে যে, সরল। তার দুঃখের কথা সে, নিজমুখে প্রকাশ করতে পারবে না কোনোদিনই। কিন্তু তটিনী বুঝেছে তার কথা।

কিন্তু বুঝলে কী হবে? যা কিছুই জীবনে চাওয়া যায় তাই কী পাওয়া যায়? যা চাওয়া যায় তার কতটুকু পাওয়া যায়? ওরা গুহাবাসী মানুষ হলে, ভাল্লুক-ভাল্লুকী হলে আকাতরু যা চায়, তা দিয়ে এই পাহাড়ের-ই কোনো গুহাতে বা প্রস্তরাশ্রয়ে আদিম অনাবৃত মানুষের মতন বাকিজীবন কাটিয়ে দিতে পারত। কিন্তু অনাবৃত মানুষ তার শরীরকে পরতে পরতে অন্তর্বাস এ আর নানা পোশাকে আবৃত করার সঙ্গে সঙ্গে তার আগলমুক্ত মনকেও যে, আগল-তোলা ঘরে ঢুকিয়েছে। তার শরীরের পোশাকের ভারের চেয়ে তার মনের ভূষণের ভার কিছু কম নয়। আধুনিক মানুষ বা মানুষী যেমন, এই উন্মুক্ত জায়গাতে সহজে তার শরীরকে অনাবৃত করতে পারে না, তেমন-ই পারে না তার মনকে নিরাবরণ করতে কোথাওই। সভ্যতা, এই লক্ষ লক্ষ বছরের অভ্যেস তাকে শরীরে মনে বড়োই ভারী করে তুলেছে, যাত্রাদলের নায়ক নায়িকাদের মতন অনেক রাংতা আর জরি আর গর্জন তেল-এর ভারে সে, ন্যুজ হয়ে গেছে শরীরে মনে। আলোয় ফেরা, সারল্যে ফেরা তার পক্ষে ভারী কঠিন। আকাকে তার এইজন্যে এভালো লেগেছে। সে, এই আধুনিক মানসিকতার মানুষদের থেকে এখনও বহুদূরে আছে। আকাশ, মাটি, নদী, পাহাড়ের খুব-ই কাছাকাছি। যত কাছাকাছি বহুশত মাইল পেছনে হেঁটেও তটিনী পৌঁছোতে পারবে না।

আকাতরু হঠাৎ তটিনীর স্বপ্নভঙ্গ করে তার নিথর ভাবনার জাল ছিঁড়ে দিয়ে বলল, চলেন। আউগ্যাই গিয়া। অন্ধকার হইলে ত অনেক-ই বিপদ।

তটিনী অস্ফুটে বলল, হুঁ।

মনে মনে বলল, এখন-ই বা বিপদ কম কী? মানুষের নিজের কাছ থেকে যত বিপদ, তত বিপদ কোনোদিনও অন্যের কাছ থেকে আশঙ্কার ছিল না।

এটা কী?

একটু এগিয়েই তটিনী বলল, বালির দিকে তাকিয়ে। আকাতরু ঝুঁকে পড়ে দেখল এক সেকেণ্ড। তারপর বলল, চলেন। ইটা কিছু না। বাঘ জল খাইয়া ফিইর‍্যা গেছে জঙ্গলে।

বাঘ! তবু কিছু না?

অবাক হল তটিনী।

বলল, কতক্ষণ আগে গেছে?

দু-তিন দিন আগের দাগ। ছাঁচ ভাইঙ্গা গেছে গিয়া।

বাঘ না বাঘিনি?

দাঁড়ান এক সেকেণ্ড।

তারপর ভালো করে দেখে বলল, বাঘিনি। আমাগো পেছনের জঙ্গল থিক্যাই আইছিল আবার সিখানেই ফিরত গ্যাছে গিয়া। সামনের পাহাড়টা যেমন, খাড়া উঠছে, কোনো জানোয়ার তেমন বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া খামোকা উটায় উঠব নামব বইল্যা, মনে হয় না।

আলো ক্রমশই কমে আসছে এবং খুব-ই তাড়াতাড়ি। এমন সময়ে ওদের বাঁ-পাশ থেকে, পাহাড়ের গা থেকে হাতির বৃংহণ ভেসে এল। চমকে উঠল ভয়ে, তটিনী।

আকাতরু বলল, ও কিছু না। জলে নামব ওরা।

একজোড়া মস্ত বড়ো সাদা-কালো হাঁস উড়ে আসছিল সামনে থেকে। পিপিং-এর দিকে উড়ে যাচ্ছে ওরা।

এতবড়ো আর এত সুন্দর কী হাঁস ওগুলো। তটিনী শুধোল, চোখ দিয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত সোনালি বিধুর আলোতে ওদের মসৃণ ছন্দবদ্ধ ডানার কাঁপন দেখা যায়, ততক্ষণ তা দেখে।

এগুলান সাধারণ হাঁস না, যে। এগুলান হইল গিয়া ভারি দুইপ্রাপ্য হাঁস। উড-ডাক। এই হাঁস রাতের বেলা ত বটেই, দিনের বেলাতেও ইচ্ছা হইলে গাছে চইড়া বইস্যা থাকে। সচরাচর জলের পাখি জঙ্গলের মধ্যেই গাছে বসে না, এক পানকৌড়ি-মানকৌড়ি ছাড়া। তাও সিসব পাখিও জলের আনাচ-কানাচেই থাকে। আপনার ভাগ্য ভালো যে, উড-ডাক-এর দর্শন পাইলেন।

পাখিরা অদৃশ্য হলে, ওরা আবার পা বাড়াল। আর ক-পা গিয়েই আবার বালির দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল তটিনী।

বলল, এটা কীসের পায়ের ছাপ?

কোনটা? অ। ইটা? ইটা চিতাবাঘের। ওই জল খাইতে আইছিল। ওঃ। এ-ব্যাটা মিনিট পনেরো আগেই ফিরছে জল খাইয়া। দ্যাখছেন না, বালি এখনও ভিজা।

বলেই, আকাতরু নদীর বুকে হাঁটু গেড়ে বসে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখল দাগটাকে, বোঝার জন্যে যে, কতখানি আগে গেছে সে-চিতাবাঘ। এবারে ওরা সেই প্রপাত দুটোর কাছে চলে এসেছে। এত যে, আওয়াজ তা দূর থেকে বোঝা যাচ্ছিল না। হাওয়াটাও যেন, সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে আরও জোর হয়েছে। অন্ধকারো হয়ে আসছে দ্রুত। ভুটানঘাটের বাংলো তো এখনও অনেক দূরে। এই নদীর প্রপাতের পাশে দাঁড়িয়ে তড়িতাহত হওয়ার-ই মতন প্রকৃতিহত হয়ে গেল তটিনী। এত মুগ্ধ সে, কোনো কিছু দেখেই এর আগে হয়নি আর ওর জীবনে।

আকাতরু ওর চার হাত দুরে দাঁড়িয়ে ওকে কী যেন বলল। বারে বারে বলল। প্রপাতের আওয়াজ আর হাওয়ার বেগ উড়িয়ে নিল সেইকথাকে। শুনতে পেল না তটিনী।

আকাতরু আবারও বলল, এবার দৃশ্যত গলা তুলে। কিন্তু দৃশ্যতই। কানে তার কথা সেবারেও শোনা গেল না।

তটিনীর মনে হল, আকাতরুর কথাগুলোও বীজ-ফাটা শিমুল তুলোর-ই মতন উড়ে গিয়ে নদীতে পড়ে ভেসে গেল। আর তাদের ফেরানো যাবে না।

তটিনী পা দু-টি শক্ত করে নুড়ি আর বালির মধ্যে পুঁতে দিয়ে গলা তুলে চেঁচিয়ে বলল, যা। বলার তা কাছে এসে বলুন।

হাওয়া ওর চুলগুলো ওর বুকের আঁচল, ওর শাড়ির পায়ের দিকে উথাল-পাতাল করছিল। ওর বুকের মধ্যেও প্রপাত ঝরছিল।

তটিনী বলল, কাছে আসুন। কাছে এসো। আরও কাছে। আমার আকাতরু, প্রাচীন, আদিম, অকৃত্রিম আকাতরু। তুমি কী চাও তা আমি জানি। বারে বারে চেয়ে নিজেকে ছোটো করার দরকার নেই। তুমি আমাকে চিরদিনের করে পাবে না। পাওয়া সম্ভব নয় বলে। এই নির্জনতা, এই সৌন্দর্য যে, আমার জন্যে নয়। চড়া মেক-আপ নিয়ে অনেক হাজার ওয়াটের আলো মুখে নিয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাজার পুরুষের মনোরঞ্জন-ই যে, আমার জীবন। সেই উচ্চরবের তীব্র আলোর জীবন যে, আমার ধমনিতে মিশে গেছে আকা। সেই জীবনে তুমি সম্পূর্ণই বেমানান হবে। এই ‘উড-ডাক’ হাঁসেদেরই মতন। বন্যেরা বনেই সুন্দর। তোমাকে যা দিতে পারব না, তা চেয়ে নিজেকে ছোটো কোরো না। যা দিতে পারি, তা দিতে কার্পণ্য করব না। নাও নাও, তুমি আমাকে নাও। এই নদীচরে এই নির্জনে, ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে। তোমরা পুরুষেরা, যা মেয়েদের সবচেয়ে দামি বলে মনে করো তাই তোমাকে দেব আজ। তোমরা সকলেই এ-বাবদে সমান। কী মৃদুলবাবু, কী চানু রায় আর কী তুমি। আমাদের কাছে কীসের ‘দাম’ সবচেয়ে বেশি, তা তোমরা কেউই বুঝলে না কোনোদিনও। বুঝবেও না।

তারপর মনে মনে বলল, হয়তো বোঝে, বুঝবে কেউ কেউ। বুঝবে কেউ। সে, যতদিন না আসে আমাকে অপেক্ষা করতেই হবে, তার জন্যে আকাতরু। যা পেলে তুমি খুশি হও, তাই নাও। এই বালিশয্যায়, আকাশের তারাদের দিকে চেয়ে, নদীর গান শুনতে শুনতে তুমি আমাকে নিঃশেষে পাও যে, নিঃশেষ”-এ তোমাদের বিশ্বাস। সেই মিথ্যে বিশ্বাসের কথা মনে করে, আমি বড়ো বড়ো নিশ্বাস নেব। নাও আকা, তুমি নাও, আমাকে চেটেপুটে খাও। এই একটি সন্ধের জন্যে, একটিবারের জন্যে আমি তোমার। কিন্তু এরপর অন্য দশ জন মানুষের-ই মতন একবার বিস্কুট খেতে দিয়ে লোভী করে তোলা নেড়িকুত্তার মতন আমার পেছনে পেছনে ঘুরো না। তুমি অন্যরকম হোয়ো আকাতরু। তুমি তুমিই। তুমি আকাতরু। মহিরুহ। তুমি ঝোঁপঝাড়, বিচুটি হোয়ো না।

আমাদের মতো লজ্জাবতীরা চিরদিন-ই আকাতরুদের দিকেই চেয়ে থেকে জীবন কাটিয়েছে। তাদের জীবনে পাক আর নাই পাক।

এসো, আকাতরু, এসো। আমাকে গ্রহণ করো। এই নদীতীরে, আমার এই অপবিত্র শরীরকে তুমি মন্দিরের মতো পবিত্র করে দাও। দাও, দাও তোমার অকলুষ পরশে।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress